বস্তাবন্দি দুই কন্যে

বস্তাবন্দি দুই কন্যে

ঝুপ করে কী যেন একটা ফেলেই চলে গেল!

২০১২—এর ২৫ জানুয়ারি। তখন বেলা আড়াইটে হবে। ঢাকুরিয়া ব্রিজের নীচে স্টেশন রোডের মোড়ের কাছে একটা হলুদ ট্যাক্সি এসে দাঁড়াল। এই সময়ে বড় একটা ভিড় থাকে না জায়গাটায়। দু—একটা দোকান খোলা রয়েছে বটে কিছুটা দূরে। তবে সেই দোকানিরাও রোজকার মতো দুপুরের খাওয়াদাওয়া সেরে একটু ঝিমিয়ে নিচ্ছেন। পুরসভার জঞ্জাল সংগ্রহের গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে সামনে। ভ্যাট থেকে আবর্জনা সাফাইয়ে ব্যস্ত কয়েকজন। হঠাৎ দু’টো লোক নেমে এল ট্যাক্সি থেকে। প্রথমে এ দিক—ও দিক একটু দেখে নিল। না, কেউ তাদের খেয়াল করছে না। সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত। দু’জনে ট্যাক্সির পিছনের ডালা খুলে একটা বস্তা বের করে ফেলে দিল রাস্তার ধারের ভ্যাটে। তারপর একজন ঢাকুরিয়া স্টেশন রোড় ধরে হেঁটে চলে গেল। অন্য জন ট্যাক্সি চালিয়ে গেল গড়িয়াহাট রোড (সাউথ) ধরে ঢাকুরিয়া মোড়ের দিকে।

 ভ্যাটে এত বড় বস্তায় কী? লাভের আশায় কাগজকুড়ানিদের দু’—একজন দৌড়ে গেল বস্তাটার কাছে। হতেই তো পারে, বাতিল মালের মধ্যে থেকে দামি কিছু পাওয়া গেল। কয়েকজন মিলে ঘিরে ধরে সেটাকে। ওদের মধ্যে মাঝবয়সি একজন এক টানে খুলে ফেলল বস্তায় বাঁধা দড়িটা। মুখটা খুলতেই আঁতকে উঠে কয়েক পা পিছিয়ে গেল সবাই। ভিতর থেকে যেটা বেরিয়ে এল সেটা একটা কিশোরীর দেহ। হ্যাঁ, কিশোরীই বলা চলে। বয়স বড়জোর চোদ্দ পনেরোর মধ্যে। পরনে সালোয়ার কামিজ। মাথার চুল ঘাড় পর্যন্ত ছাঁটা। হাত পা ওড়না দিয়ে পিছমোড়া করে বাঁধা। দুর্গন্ধে টেকা দায়। যে ক’জন মিলে বস্তাটা খুলেছিল, একরাশ আতঙ্কে যেন ছিটকে গেল কিছুটা দূরে। ঢাকুরিয়া মোড়ের কাছে ডিউটি করছিলেন কলকাতা ট্রাফিক পুলিশের সার্জেন্ট। প্রায় হাঁফাতে হাঁফাতে তাঁর কাছে দৌড়ে গেল একজন, স্যর, স্যর। একটা লাশ। ওই ওখানে।

চমকে উঠলেন সার্জেন্ট, ‘লাশ মানে? কোথায়?’

লেক থানা থেকে জায়গাটা ঢিল ছোঁড়া দূরত্বেই বলা চলে। কাছাকাছি কেন্দ্রের এক মন্ত্রীর বাড়িও রয়েছে। নিরাপত্তা যেখানে নিচ্ছিদ্র থাকার কথা, সেখানেই কি না একেবারে পুলিশের নাকের ডগায় এভাবে খুনিরা একটা মেয়ের লাশ ফেলে চলে গেল! তাও ভরদুপুরে! টিভি, কাগজে খবরটা চাউর হতে দেরি হল না। লেক থানার ওসি কল করলেন লালবাজারে হোমিসাইড বিভাগের বড় কর্তাকে, ‘স্যর। একজন অল্পবয়সী মেয়ের ডেডবডি পাওয়া গিয়েছে। লোকাল লোকজন বলছে, কিছুক্ষণ আগেই নাকি একটা ট্যাক্সি থেকে ফেলে দিয়েছে কেউ।…হ্যাঁ, স্যর, মার্ডার। কোনও সন্দেহ নেই। লালবাজার থেকে ছুটল হোমিসাইড বিভাগের অফিসারদের গাড়ি। সঙ্গে পুলিশ কুকুরও।

লেক থানার অফিসার—ইন—চার্জ আর হোমিসাইড বিভাগের ওসি আশপাশটা খুঁটিয়ে দেখছিলেন। মেপে নিচ্ছিলেন, সম্ভাব্য কোন রাস্তা দিয়ে এসে থাকতে পারে ট্যাক্সিটা, যেতে পারে কোথায়। কারও চোখে পড়ার সম্ভাবনা আছে কি ট্যাক্সিটাকে, যে অন্তত গাড়ির নম্বরটা দেখে মনে রাখতে পারবে! মনে রাখার কথা হয়তো নয়। সারাদিনে কতই তো ট্যাক্সি যায় ওই রাস্তা দিয়ে। ক’টার নম্বর কে মনে রাখে! অকুস্থল থেকে যতটুকু যা তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করে ছবি তুলে রাখলেন গোয়েন্দারা। কাগজকুড়ানিদের বেশিরভাগই ভয়ে সরে পড়েছিল। পুলিশ এসে পুরো দেহটা বের করল বস্তা থেকে।

—স্যর, শুধু ডেডবডি নয়। বস্তাটা কীভাবে প্যাক করা হয়েছে দেখুন।

—কেন, কী হয়েছে?

—ডেডবডির সঙ্গে নানারকম মাপের জামাকাপড়, ছোট বালিশ, এমনকি একটা বাচ্চাদের স্কুলের ফ্রকও রয়েছে।

উদ্ধার করা স্কুলের পোশাক
উদ্ধার করা স্কুলের পোশাক

—ভেরি ইন্টারেস্টিং। হতে পারে যাতে বস্তার ফাঁক দিয়ে দেহটা কোনওভাবে বোঝা না যায়, সেজন্য এগুলো দিয়ে প্যাক করা হয়েছে। অথবা আমাদের মিসগাইড করতে।

—কিন্তু যে খুন করেছিল, সে কি এগুলো অন্য কোনও জায়গা থেকে নিয়ে এসেছিল? নাকি, যেখানে খুন করা হয়েছে মেয়েটিকে, সেখানেই ছিল এই স্কুলের ফ্রক, জামাকাপড়ের টুকরো.…

—সবকিছু আলাদা আলাদা করে কালেক্ট করো। বস্তার মুখটা যে দড়ি দিয়ে বাঁধা হয়েছে, সেটাও। কোনও কিছুই বাদ দিয়ো না।

প্রাথমিক কাজগুলো শেষ করে মৃতদেহ পাঠানো হল এসএসকেএম হাসপাতালে। দুঁদে গোয়েন্দাদের চোখ বলে দিচ্ছিল, কিশোরী খুন হয়েছে অন্তত ৪৮ ঘণ্টা আগে। তাই দেহে পচন ধরে গিয়েছে ভালোরকমই। শরীরে বাহ্যিক আঘাতের চিহ্ন তেমন কিছু নেই, অন্তত খালি চোখে ধরা পড়ার মতো নয়। কিন্তু কীভাবে খুন? তার আগে কোনও শারীরিক নির্যাতন হয়েছিল কি? মানে সেক্সয়্যাল অ্যাসল্ট অ্যান্ড মার্ডার? খুনের কিনারা করতে এ সবই জানাটা জরুরি। তার জন্য দরকার ময়না তদন্তের রিপোর্টটা পাওয়া। আর সবার আগে বের করতে হবে যে কিশোরীটি খুন হয়েছে, তার পরিচয়। লালবাজারে ফিরে গোয়েন্দা প্রধানকে পুরোটা ‘ব্রিফ করলেন হোমিসাইড বিভাগের ওসি।

২০১৩—এর ৯ ফেব্রুয়ারি। বিকেল অতিক্রান্ত।

মুম্বই পুলিশ ক্রাইম ব্রাঞ্চের ইন্টারোগেশন রুম। একটানা জেরায় ধুকছেন বছর তিরিশের যুবক। জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়েছে দুপুর থেকেই, চলছে বিরামহীন। শুরুর কয়েক ঘণ্টায় পুলিশের সব প্রশ্নেরই একই জবাব দিচ্ছিলেন যুবকটি, ‘স্যর, মুঝে কুছ ভি মালুম নহি। ম্যায় ভি তো উসে ঢুন রহা হু। আপ য়কিন কিজিয়ে। প্লিজ…।’

উল্টো দিকের অফিসারটি কখনও মারাঠি, কখনও হিন্দিতে যা বলছিলেন, তার সারমর্ম কিছুটা এরকম, “আরে তুই কিছুই জানিস না দেখছি। তোর বৌ, দু’টো বাচ্চা মেয়ে কোথায় গেল কিছুই জানিস না? আশপাশের লোকজন তো বলছে সাত—আট মাস ধরে ওদের কোনও পাত্তা নেই। কোথায় রেখে এসেছিস? যেটা জানিস ভালোয় ভালোয় বলে ফেল। তা না—হলে তোরই সমস্যা বাড়বে।’

বেশ কিছুক্ষণ এভাবে যুঝে যাওয়ার পর যুবকটি বললেন, ‘স্যর। বচ্চে লোগ তো কলকাত্তা মে হ্যায়। আপ য়কিন কিজিয়ে।’

—কলকাতা? কলকাতার কোথায়? উত্তর দিতে গিয়ে আবার হোঁচট খান যুবকটি।

—থোড়া পানি মিলেগা স্যর?

—পানি জরুর মিলেগা। পহলে বাতা বিবি—বচ্চে হ্যায় কঁহা? নহি তো আউর ভি তরিকে হ্যায় হমারে পাশ সচ উগলওয়ানে কে লিয়ে।

দাবার বোর্ডে যেমন ক্রমাগত বোড়ে—মন্ত্রী—গজের আড়াল থেকে বের করে কোনঠাসা করা হয় প্রতিপক্ষের রাজাকে, অনেকটা সেভাবেই প্রশ্ন আর পাল্টা প্রশ্নের জালে যুবকটিকে ঘিরছিলেন মুম্বই পুলিশের অফিসাররা। একটা সময় যুবকটির মজবুত ডিফেন্স ভাঙতে সক্ষম হলেন তাঁরা। ইন্টারোগেশন রুম থেকে বেরিয়ে এসে নিজের মনেই বিড়বিড় করেন তদন্তকারী অফিসারটি, ‘বৌ—দু’টো বাচ্চা সবাই….। ভাবা যাচ্ছে না। এক্ষুনি জানাতে হবে সবটা উপরমহলে।’

‘ঢাকুরিয়া ব্রিজের নীচে কিশোরীর বস্তাবন্দি লাশ, প্রজাতন্ত্র দিবসের সকালে প্রায় সবক’টি খবরের কাগজেই গুরুত্ব দিয়ে বেরিয়েছে খবরটা। সকালে রেড রোডে প্রজাতন্ত্র দিবসের প্যারেডে ডিউটি ছিল সিনিয়র অফিসারদের সবারই। এমনিতে সরকারি ক্যালেন্ডারে ছুটির দিন। তবে পুলিশের আর ছুটি কোথায়? তার উপর এরকম একটা কেস! বিকেলে লালবাজারে হোমিসাইড বিভাগের অফিসারদের ডেকে নিলেন গোয়েন্দা প্রধান। জানতে চাইলেন। কেসের অগ্রগতি।

—এখনও বাচ্চা মেয়েটার কোনও পরিচয় জানা গেল না? মিসিং পারসনস স্কোয়াডের সঙ্গে কথা বলেছ? কোনও থানায় এই রকম কোনও মেয়ে মিসিং হয়েছে বলে ডায়েরি হয়নি?

—না, স্যর। আশপাশের সব থানাতেই ছবি পাঠিয়ে দিয়েছি। কোনও জায়গা থেকেই পজিটিভ রিপ্লাই আসেনি এখনও।

পোস্ট মর্টেম রিপোর্টে কি বলছে?

—প্রাইমারিলি পাওয়া গিয়েছে, খাবার বা কোল্ডড্রিঙ্কসের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ জাতীয় কিছু খাওয়ানো হয়েছিল। তারপর ম্যানুয়াল স্ট্র্যাঙ্গুলেশন। ডেডবডি রিকভারির ৪৮ ঘণ্টা আগে খুনটা হয়েছে।

—খুনের আগে কোনও সেক্সয়্যাল অ্যাসল্ট…

—না, স্যর। সেজুয়্যাল অ্যাসল্ট হয়নি।

—বস্তাটা বা ওই স্কুল ইউনিফর্ম থেকে কিছু জানা গেল? কোন স্কুলের ইউনিফর্ম ওটা? সেখান থেকে কোনও ক্লু বেরতেও পারে। খোঁজ নাও। আর কোনও আপডেট এলেই জানিও।

একটা কিশোরীকে কেউ খুন করল। দিনদুপুরে থানার কাছেই খুনি ডেডবডি ভ্যাটে ফেলে দিয়ে গেল। এখনও তার দেহ শনাক্ত করতে এল না কেউ। তাহলে কি অন্য কোনও জেলা বা রাজ্য থেকে অপহরণ করে নিয়ে খুন করা হল মেয়েটিকে? সেজন্যই কি কলকাতা বা তার সংলগ্ন এলাকায় কেউ শনাক্ত করতে পারছে না মেয়েটিকে? আশপাশের প্রত্যক্ষদর্শী, দোকানদার— সবার সঙ্গেই কথা বলছিল পুলিশ। তবে উল্লেখযোগ্য কোনও ক্লু আসছিল তদন্তকারীদের হাতে। আজকের কলকাতা শহরের মতো সাত—আট বছর আগে এত সিসিটিভি ক্যামেরা ছিল না প্রতি কোণে। ফলে যে বা যারা ট্যাক্সি থেকে নেমে বস্তা ফেলে গেল, তাদের চিহ্নিত করার মতো গুরুত্বপূর্ণ সূত্র কিছুতেই আসছিল না হাতে।

হোমিসাইড বিভাগের গোয়েন্দারা যখন রীতিমতো অন্ধকারে হাতড়াচ্ছেন তখন একটা খবর এল। সেটা এল রেলপুলিশের কাছ থেকে। যে দিন ঢাকুরিয়া ব্রিজের নীচে পাওয়া যায় এই কিশোরীর দেহ, ঠিক তার আগেরদিনের ঘটনা। পার্ক সার্কাস স্টেশন থেকে উদ্ধার হয়েছিল আরও এক বালিকার বস্তাবন্দি দেহ। বয়স বছর ৮—৯ এর আশপাশে। বস্তার ভিতর একইরকম জামাকাপড়, ওড়না, স্কুল ইউনিফর্ম। তাকেও খুন করা হয়েছে। সম্ভবত একইরকমভাবে, শ্বাসরোধ করে। সেই বস্তা, জামাকাপড় সবকিছুই রয়েছে রেলপুলিশের জিম্মায়। একজন অফিসারকে ডেকে নির্দেশ দিলেন হোমিসাইড বিভাগের ওসি, ‘এখনই ওই কেসের ইনভেস্টিগেটিং অফিসারের সঙ্গে কথা বলো। হতে পারে দু’টো কেস ইন্টার কানেক্টেড।’

বস্তা, তার ভিতরের জামাকাপড়, মৃতদেহের ছবি—সবই খুঁটিয়ে দেখলেন তদন্তকারীরা। দুটো ঘটনার মধ্যে অনেক মিল। একইরকমভাবে ভরা হয়েছে দেহ। মৃত দু’জনেই নাবালিকা। ভিতরে প্যাক করা ছিল প্রায় একই ধরনের জামাকাপড় আর স্কুল ইউনিফর্ম। দুটো বস্তার গায়েই লেখা ‘ইউপিএস’। সম্ভবত একই জায়গা থেকে আনা হয়েছে বস্তা দুটো।

টুকরো টুকরো এসব তথ্যপ্রমাণ থেকে সম্ভাব্য আততায়ীর একটা ছবি মনে মনে আঁকার চেষ্টা করছিলেন তদন্তকারী অফিসাররা। হতে পারে, দু’টো ঘটনাতেই খুনি সম্ভবত একই ব্যক্তি বা দল। পার্ক সাকাস স্টেশনের বালিকা আর ঢাকুরিয়া ব্রিজের কিশোরীর মধ্যে নিশ্চিত কোনও সম্পর্ক আছে। আততায়ী কি তাদের পূর্ব পরিচিত? একগুচ্ছ সম্ভাবনার পাশাপাশি ঘুরপাক খেতে থাকে আশঙ্কার মেঘও, খুনি আরও কোনও জায়গায় এভাবে বস্তায় পুরে লাশ ফেলে যায়নি তো? বহু বছর আগে স্টোনম্যানের আতঙ্কে ঘুম ছুটে গিয়েছিল রাতের কলকাতার।

দু’জন নাবালিকাকে যে খুন করেছে, সে স্টোনম্যানের মতো সিরিয়াল কিলার নয় তো? যে রাতের অন্ধকারে অল্পবয়সি মেয়েদের খুন করে মৃতদেহ বস্তায় ভরে ফেলে যাচ্ছে রাজপথে? নাকি এটা কোনও বিকৃতমনস্কের কারবার ? নগরপালের নির্দেশে শহরের সবক’টি থানাকে সতর্ক করা হল। বার্তা পৌঁছাল কলকাতা লাগোয়া থানাগুলোতেও।

যে কোনও খুনের ঘটনাতেই তদন্তকারী অফিসারকে খুঁজতে হয় মোটিভ— কেন খুন করা হল। ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা, মার্ডার ফর গেইন, নাকি অন্য কিছু। কিন্তু নিহতের পরিচয় জানা না গেলে সেটাই বা কীভাবে সম্ভব? বস্তা, স্কুল ইউনিফর্ম হাতে থাকা সবক’টা সূত্র নিয়ে এগোতে গিয়েও একটা জায়গাতেই আটকে যাচ্ছিল পুলিশ। দু’টো নাবালিকা খুন হল। একই কায়দায় খুন। কিন্তু তাদের বাবা—মা—আত্মীয় কেউ কোনও নিখোঁজ ডায়েরি পর্যন্ত করল না? অনেক দিন তো হল, কেন তাদের খোঁজ করতে এল না কেউ? আর যেখানে মৃতকে শনাক্ত করা যাচ্ছে না, সেখানে খুনের তদন্ত চালিয়ে যাওয়াটা যে কতটা কঠিন, গোয়েন্দা পুলিশের দুঁদে অফিসাররা তা হাড়ে হাড়ে জানেন। তদন্ত কতদূর এগোল, রোজ গোয়েন্দা প্রধানের কাছ থেকে আপডেট নিচ্ছিলেন নগরপাল। টিভির পর্দা বা খবরের কাগজের পাতায় দুই নাবালিকার মৃত্যু রহস্য ক’দিন বাদে চাপা পড়ে গেল। পুলিশের হাতেও তো কেসের অভাব নেই। তবু নতুন—পুরোনো মামলার ফাইলের ভিড়ে জোড়া খুনের রহস্য নিয়ে তদন্তকারী অফিসারের মাথা থেকে খচখচানিটা যাচ্ছিল না কিছুতেই। হোমিসাইড বিভাগের বড় কর্তাকে গিয়ে বললেন তদন্তকারী অফিসারটি, ‘স্যর, যারা সে দিন বস্তাটা ফেলে গিয়েছিল, তাদের স্কেচ করানো যায় না? তাতে যদি কিছুটা সুবিধা হয়। সায় মেলে সঙ্গে সঙ্গেই। ভ্যাটের কয়েকজন কাগজকুড়ানি দেখেছিল ট্যাক্সি থেকে দু’জনকে নামতে। তাদের বর্ণনা শুনে চেহারা এঁকে ফেললেন পুলিশের শিল্পী।

একজনের পরনে লাল—সাদা ডােরাকাটা জামা। মুখটা একটু লম্বাটে। এই লোকটাই ট্যাক্সি থেকে নেমে হেঁটে চলে গিয়েছিল। অন্য লোকটার পরনে ট্যাক্সিচালকের পোশাক। বস্তাটা ঢাকুরিয়া ব্রিজের নীচে ফেলার পর সে ট্যাক্সি চালিয়ে বেরিয়ে যায়। সব থানায় দ্রুত পৌঁছে গেল সম্ভাব্য সন্দেহভাজনের ছবি। কিন্তু ফল হল না। দুই নাবালিকার ছবি দিয়ে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপনও দিল পুলিশ, যদি ছবি দেখে কেউ যোগাযোগ করে। অন্তত দু’জনের পরিচয় জানা যায়। মাস গেল, বছরও ঘুরতে যায়। পরিচয় জানা গেল না কারও, না খুনির, না দুই নাবালিকার।

২০১৩, ৯ ফেব্রুয়ারি। রাত ৮টা।

লালবাজারের গোয়েন্দা প্রধানের টেবিলে রাখা টেলিফোনটা ঝনঝনিয়ে উঠল। উল্টোদিকে গোয়েন্দা প্রধানের পিএ অফিস থেকে চেনা কণ্ঠ ভেসে আসে, ‘স্যর, মুম্বই পুলিশের ক্রাইম ব্রাঞ্চ থেকে কল আছে।’ হ্যাঁ, লাইনটা দাও,’ বলেন গোয়েন্দা প্রধান।

—স্যর, ম্যায় মুম্বই পুলিশ সে ইন্সপেক্টর..…

—হ্যাঁ, বলুন কী ব্যাপার।

—স্যর, আপনাদের ওখানে কি দুটো বাচ্চা মেয়ের কোনও কেস পেন্ডিং আছে? একটু বলতে পারেন?

—হ্যাঁ, হ্যাঁ আছে। কেন বলুন তো?

—আমাদের এখানে একটা ছেলেকে তুলে এনেছি, অন্য একটা কেসে। ও বলছে, ওই বাচ্চা দুটো নাকি..…

ফোন রেখেই হোমিসাইডের ওসিকে ডেকে নেন গোয়েন্দা প্রধান, ‘শোনো, কাল আরলি মর্নিং তোমার দু’জন অফিসারকে নিয়ে মুম্বই চলে যাও। ওখানকার ক্রাইম ব্রাঞ্চ থেকে ফোন করেছিল একটু আগেই। মনে হচ্ছে, ডাবল মার্ডারের কোনও পজিটিভ লিঙ্ক আছে। আর কিপ মি আপডেটেড।’

দু’জন নাবালিকার মৃত্যু তদন্তের ফাইল যখন তথ্যসূত্রের অভাবে বন্ধ হওয়ার মুখে, ঠিক তখনই মুম্বই পুলিশের কাছ থেকে আসা ফোনটা হোমিসাইড বিভাগের অফিসারদের আবার অ্যাড্রিনালিন জোগাল। মুস্তাক শেখ নামে বছর তিরিশের এক যুবককে মুম্বই পুলিশের ক্রাইম ব্রাঞ্চ ডিটেইন করেছে। তার বৌ—দুই মেয়ে নাকি অনেকদিন ধরে মিসিং। পরদিন সকালেই কলকাতা থেকে হোমিসাইড বিভাগের একটা টিম উড়ে গেল মুম্বই।

কে এই মুস্তাক? খুনের সঙ্গে কী তার সম্পর্ক?

মুম্বই ও কলকাতা পুলিশের জেরায় যা জানাল মুস্তাক, তাতে দুঁদে গোয়েন্দাদেরও মাথার চুল খাড়া হয়ে যাওয়ার জোগাড়। মুম্বইয়ে একটা চামড়ার মানিব্যাগ তৈরির কারখানায় কাজ করত মুস্তাক। সেখানে থাকতে থাকতেই তার সম্পর্ক গড়ে ওঠে নাফিসা খাতুন নামে এক মহিলার সঙ্গে। মুম্বইয়ের ধারাভিতে ছোট একটা ঘর ছিল নাফিসার। বিবাহ বিচ্ছিন্না। সঙ্গে দু’টো ফুটফুটে মেয়ে। চোদ্দ আর ন’বছর বয়স দু’জনের। ঘনিষ্ঠতা থেকে প্রেম মুস্তাক—নাফিসার। ধারাভির ঘরে নিয়মিত যাতায়াত করতে শুরু করে তাঁর থেকে বছর দশেকের ছোট মুস্তাক। সেখান থেকে নতুন জীবন গড়ার স্বপ্ন। মুস্তাক তাঁকে বলে, বিয়ে করে নাফিসার দুই মেয়েকে নিয়ে একসঙ্গে থাকবে তারা। সেজন্য কিছু টাকা দরকার। টাকা আসবে কোথা থেকে? তাই নাফিসাকে বলে মুস্তাক, আমরা তো এখানে আর থাকব না। উত্তরপ্রদেশে আমার বাড়ি আছে। সেখানেই নিয়ে যাব তোমাদের। তখন এই ঘরটা রেখে কী করবে? বরং ধারাভির ঘরটা বিক্রি করে দিয়ে যে টাকা আসবে, সেটা আমাদের নতুন সংসার পাততে কাজে লাগবে। গ্রামে তো আমার জমি—বাড়ি আছেই। কাজও জুটিয়ে নেব একটা।’

নাফিসা তখন দুই মেয়েকে নিয়ে নতুন করে সংসার গড়ার স্বপ্নে বিভোর। তাঁকে বুঝিয়েসুজিয়ে ধারাভির ছোট্ট ঘরটা ন’লাখ টাকায় বিক্রি করায় মুস্তাক। তারপর নাফিসা আর তাঁর দুই মেয়েকে নিয়ে চলে আসে কলকাতায়। একটা ছোট ঘর ভাড়া নেয় তপসিয়ায়। শহরের এই চত্বরটায় আগেও আনাগোনা ছিল মুস্তাকের। আমাদের তোমার বাড়িতে কবে নিয়ে যাবে, মাঝেমধ্যেই জানতে চাইতেন নাফিসা। মুস্তাক বোঝায়, ‘আর ক’দিন এখানে থাকো। আমি খুব শিগগিরই তোমাদের উত্তরপ্রদেশে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাব।’

সেই দিনও চলে আসে। ঠিক হয়, মুস্তাক প্রথমে নাফিসাকে নিয়ে যাবে তার গ্রামের বাড়িতে। পরে দুই মেয়েকে। যেমন ভাবা, তেমন কাজ। বড় মেয়ের হাতে হাজার দেড়েক টাকা দিয়ে মুস্তাক বলে, নাফিসাকে নিয়ে যাচ্ছে গ্রামের বাড়ি। ফিরে এসে তাদেরও নিয়ে যাবে। হাওড়া স্টেশন থেকে দু’জন ট্রেনে উঠে পড়ে। উত্তরপ্রদেশের ফতেপুরের কাছে লালোনি নামে একটা জায়গায় নামে তারা। স্টেশন থেকে কাছেই নাকি মুস্তাকের বাড়ি। হেঁটে যাওয়া যায়। বাইরে বেরিয়ে নির্জন জায়গা দেখে মাঝরাস্তাতে মুস্তাক খুন করে নাফিসাকে। রাস্তার ধারে ক্ষেতে ফেলে দেয় দেহ। তারপর উঠে পড়ে ফিরতি ট্রেনে। গন্তব্য ফের কলকাতা। এ বার টার্গেট দুই মেয়ে। কলকাতায় ফিরে এসে দুই মেয়েকে মুস্তাক বলে, ‘মা ঠিকমতো পৌঁছে গিয়েছে বাড়ি। কাল তোদের নিয়ে যাব। আজ খাওয়াদাওয়া করে শুয়ে পড়। কাল অনেক দৌড়াদৌড়ি আছে তো। সেটাই যে তাদের জীবনের শেষ রাত, বোঝেনি দুই বোন। দু’জনকে খাবার আর কোল্ডড্রিঙ্কস কিনে দেয় মুস্তাক। সেই কোল্ডড্রিঙ্কসে মেশানো হয় ঘুমের ওষুধ। দুই বোন খাওয়াদাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই অচৈতন্য হয়ে পড়ে। দু’জনের হাত—পা বেঁধে মুখে বালিশ চাপা দিয়ে শ্বাসরোধ করে মৃত্যু নিশ্চিত করে মুস্তাক। হাত—পা খানিক ছটফট করে ওঠে দু’জনের। তারপর সব শেষ। মুস্তাক ঘরেই ফেলে রাখে দু’জনের দেহ। লাশ দুটো বাইরে ফেলতে আগেই নিয়ে এসেছিল দুটো বস্তা। ঘরের মধ্যে যা জামাকাপড় ছিল সব দিয়ে প্যাক করে দেহ দু’টি তাতে ভরে ফেলে মুস্তাক। একটা ট্যাক্সিওয়ালাকে কিছু টাকা দিয়ে ভাড়া করে। তাকে বলে, দু’টো বস্তা ভ্যাটে ফেলতে হবে। তারপর সুযোগ বুঝে দুই বোনের দেহ ফেলে দেওয়া হয় পার্ক সাকাস স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের পাশে আর ঢাকুরিয়া ব্রিজের নীচে। কাজ হাসিল করে আবার মুম্বইয়ে ফিরে যায় মুস্তাক। তার পুরোনো ঠেকে। ভেবেছিল, নাফিসার রেখে যাওয়া টাকায় তার দিব্যি চলে যাবে। আর এত বড় মুম্বই শহরে তার খোঁজ কে পাবে?

পুলিশের আঁকানো অভিযুক্তদের স্কেচ
পুলিশের আঁকানো অভিযুক্তদের স্কেচ

তবে মুম্বইয়ে গুঞ্জন শুরু হল ক’দিন পরেই। কলকাতা যাওয়ার সময় নাফিসা আর দুই মেয়েকে নিয়ে গিয়েছিল মুস্তাক। সে ফিরলেও বাকিরা কোথায়? প্রথমে নাফিসার আত্মীয়স্বজন ও পড়শিদেরও উত্তরপ্রদেশে গ্রামের বাড়ির গল্প শোনায় সে। কিন্তু মুম্বইয়ে নাফিসার পরিজনদের কেমন একটা সন্দেহ হয়। এতদিন ধরে কোথায় মা আর দুই মেয়ে? এক মাস, দু’মাস, ছ’মাস যায়। মুস্তাকের কথায় ক্রমশ সন্দেহ বাড়তে থাকে নাফিসার পরিবারের, খবর পায় পুলিশ। শাক দিয়ে ক’দিন আর মাছ ঢাকা যায়?

মুম্বইয়ে মুস্তাকের বিরুদ্ধে আলাদা মামলা রুজু হয়েছিল নাফিসাকে অপহরণের অভিযোগে। আর এ শহরের দুই প্রান্তে দুই নাবালিকাকে খুনের মামলায় পুলিশ আলাদা চার্জশিট জমা দেয়। সাক্ষ্যপ্রমাণ সংহত করা হয়েছিল নিবিড় যত্নে, যাতে তদন্তে কোনও ফাঁক না—থাকে। খুঁজে বের করা হল সেই ট্যাক্সিচালককে, যে ট্যাক্সিতে চেপে ঢাকুরিয়া ব্রিজে বস্তা ফেলে আসতে গিয়েছিল মুস্তাক। তপসিয়ার ভাড়া ঘর থেকেও মেলে বেশকিছু তথ্যপ্রমাণ। তদন্তের সূত্র অধরা থাকলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পোড়খাওয়া পুলিশ অফিসারকে গ্রাস করে অনিবার্য হতাশা। কলকাতা শহরের দু’প্রান্তে পর পর দু’দিন বস্তাবন্দি দুই নাবালিকার দেহ উদ্ধারের তদন্তের ক্ষেত্রেও তেমনটাই হচ্ছিল। কিন্তু বাধার পাহাড় সত্ত্বেও চেষ্টা চালিয়ে গেলে একদিন ভাগ্যদেবী মুখ তুলে তাকান নিশ্চিতই। কৃপাদৃষ্টি দেন আচম্বিতে, ঘটে যায় অভাবিত সমাপতন। যেমনটা হয়েছে এই ডাবল, থুড়ি ট্রিপল মার্ডার মিস্ট্রিতেও।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *