৬০
লাহোর ফোর্টে প্রথম মাস-দেড়েক যে আমার কী করে কাটল, এখনও আমি ভেবে পাই না। রাত্রের ঘুম বারে বারে ভেঙে যায়। প্রথমত চোখের উপর জোরালো আলো, তারপর মাঝে-মাঝেই প্রহরীর ‘হল্ট’ চিৎকার। তার উপর আছে শীত। ঘুমের মধ্যে ক্রমাগতই আমার স্কুলজীবনের স্বপ্ন দেখি। দক্ষিণ কলকাতার সাউথ সুবারবান স্কুলে আমার ছেড়ে আসা দিনগুলির খুঁটিনাটি নিয়ে স্বপ্ন। কেন ঐ ধরনের স্বপ্ন দেখতাম মনস্তত্ত্ববিদরাই বলতে পারবেন। ভোর হলে আশেপাশে লোকজনের আনাগোনার আভাস পাই, কিন্তু বিশেষ কারুকে দেখতে পাই না। কিছুক্ষণ পরে চা আর রুটি দিয়ে যায়। তখন মনে হয়, দিনটা বুঝি শুরু হল।
যতই শীত বাড়তে থাকে চায়ের জন্য আমার উৎকণ্ঠাও তত বাড়তে থাকে। চা খাবার জন্য ততটা নয়, যতটা আমার ভাঙা পিতলের গেলাসটিতে চা ঢেলে হাত গরম করার জন্য। তার পরেই ঐ ছোট সেলের মধ্যে পায়চারি শুরু। দেওয়ালের ওপাশ থেকে মিলিটারি ব্যাণ্ডের ড্রামারদের প্র্যাকটিসের আওয়াজ কানে আসে, সেটা মন্দ লাগে না। গরাদের ফাঁক দিয়ে আকাশে ছোটছোট হলুদ রঙের এরোপ্লেনের ক্রীড়া-কৌশল দেখতে পাই। পরে শুনেছিলাম সেগুলি নাকি চীনা এরোপ্লেন, আমাদের দেশে শিক্ষানবিসি করতে এসেছিল। দুপুরটা কাটতেই চায় না, মনে মনে গান গাই। ওরই মাঝে মাঝে দূর থেকে অথবা মনে হয় মাটির নীচের সেল থেকে অত্যাচারিত বন্দীদের আর্তনাদ শুনতে পেয়েছিলাম। একদিন যেন শুনলাম, ‘মরে গেলাম, মরে গেলাম’। শুনে মনে হল, আমাদেরই দলেরই হয়তো বা কেউ। শীতকাল, সন্ধ্যা শীঘ্রই নামত। বিকাল থেকে সারা সন্ধ্যাটা আমি আকাশের দিকে চেয়ে থাকতাম। সূর্যাস্তের আগে ও পরে মেঘের রঙের যে কী বিচিত্র পরিবর্তন হয়, এর আগে আমি কখনও দেখিনি। সন্ধ্যা হলেই আবার সেই বিচিত্র অনুভতি। চারিদিকে যেন অন্ধকারের সমুদ্র, আমি রয়েছি একটি আলোকিত ছোট্ট নৌকায়।
মাসখানেক বাদে হঠাৎ একদিন আবার রভিসাহেবের আবির্ভাব হল। এবার আর তিনি ভান করলেন না যে, আমার সম্বন্ধে কিছুই জানেন না। বলে ফেললেন : তোমার বাবা তো দক্ষিণ ভারতে বন্দী। তুমি পাঞ্জাবে। তোমার মা বাড়িতে অসুস্থ। তোমরা তো বেশ বিপদেই পড়েছ!
তার পর থেকে সুযোগ পেলেই তাঁরা মা’র অসুস্থতার কথা আমাকে শোনাতেন, কিন্তু চিঠিপত্রের কথা জিজ্ঞাসা করলে বলতেন, কিছু আসেনি। এবার এসে রজভিসাহেব যেন একটু অভিমানের সুরেই বললেন, আচ্ছা তোমাকে তো আমরা বেশ কষ্টের মধ্যেই রেখেছি, তুমি কমপ্লেন করো না কেন? তুমি তো অদ্ভুত লোক। সকলেই তো কমপ্লেন করে, ঝগড়া-ঝাটি বাধিয়ে দেয়। বুঝলাম, বন্দীর মন শান্ত ও স্থির থাকাটা ওদের পক্ষে সুবিধার নয়। শারীরিক ও মানসিক ভারসাম্য আমরা হারিয়ে ফেলি, ওরা তাই চায়। তারপর পুলিশসাহেব বললেন, এইভাবে থাকাটাও তো বিপজ্জনক, তোমার কাকার তো বর্মার জেলে যক্ষ্মা হয়ে গিয়েছিল। সেই যে যক্ষ্মার কথা বলে গেল তারপর অনেকদিন পর্যন্ত নিজেই নিজের বুক ঠুকে-ঠুকে দেখতাম আওয়াজের কোনো তারতম্য হচ্ছে কি না।
নানারকম চরিত্রের লোক ক্রমে ক্রমে লাহোর ফোর্টে দেখলাম। রজভিসাহেবই হলেন কর্তাব্যক্তি, অতি বুদ্ধিমান এবং বড় সাহেবদের খুব বিশ্বাসভাজন। শুনেছিলাম, রাঙাকাকাবাবুর অন্তর্ধানের কোনো হদিস করতে না পারায় বাংলাদেশের গোয়েন্দা দফতরের উপর দিল্লির বড়কর্তারা খুব প্রসন্ন ছিলেন না, বিশ্বাস রাখতেও পারছিলেন না। যুদ্ধের সময় পাঞ্জাবের গোয়েন্দা দফতরই ইংরাজ সরকারের সুনজরে পড়ে যায় এবং তাদের উপরই দিল্লি অনেকটা নির্ভর করত। রজভিসাহেবের বাবাও ইংরেজদের অতি বিশ্বাসভাজন অফিসার ছিলেন। একদিন জিজ্ঞাসাবাদের সময় রজভি বড়াই করে আমাকে বলেছিলেন, মনে রেখো, ছেলেবেলা থেকেই আমার লাহোর ফোর্টে আনাগোনা, আমি অ আ ক খ শিখেছি ভারতের শ্রেষ্ঠ বিপ্লবীদের কাছ থেকে। এখানেই ভগৎ সিং, রাজগুরু শুকদেব এবং আরও কত বিপ্লবীকে আনা হয়েছিল। এখানে জনাকয়েকের ফাঁসিও হয়েছে।
কথাবার্তার মধ্যে একদিন রজভিসাহেব বলে ফেললেন, তুমি সুড়ঙ্গ খুঁড়তে আরম্ভ করছ না কেন, এই এত গজ যেতে পারলেই দেওয়ালের ওপারে পৌঁছে যাবে। তবে বলে রাখি, প্রহরীদের হুকুম দেওয়া আছে, কোনো বন্দী পালাবার চেষ্টা করছে দেখলেই গুলি করবে।
রজভির পাশে পাশে ঘোরাঘুরি করতেন দু’জন, একজন মিরজাসাহেব অন্যজন সর্দার দশোয়ন্ত সিং। মিরজাসাহেব আমিরি চালে ঘোরাফেরা করতেন, তবে বিশেষ কাজের ছিলেন বলে মনে হত না। আর সর্দারজি তো আমাকে লাহোর স্টেশনে আনতে গিয়েছিলেন। তিনি দেখাতে চাইতেন যে, তিনি অনেক কিছু বোঝেন। তিনি আমাকে বলতেন, দ্যাখো, তুমি আমাদের কায়দা করবার চেষ্টা করছ, আসল খবর চেপে যাচ্ছ, আমরা কি বুঝি না নাকি? খানসাহেব বলে একটি লোক ছিল, একেবারে পাষণ্ড, বন্দীদের উপর শারীরিক অত্যাচার করাই ছিল তার কাজ, তাতেই যেন তার খুব আনন্দ।
পেটরোগা বলে আমার সুনাম তো ছিলই, শেষপর্যন্ত অসুখেই পড়লাম। এরা সেলের মধ্যে ডাক্তার নিয়ে এল। আমাকে পরীক্ষা করে ডাক্তার ওষুধও পাঠিয়ে দিলেন। ওষুধের শিশির ওপর দেখি অন্য নাম লেখা—’সনসার মন্দ’। আমি তো দেখে রেখে দিলাম। ভাবলাম জঞ্জালগুলি না খেয়ে বরং উপোসে থাকি, ভাল হয়ে যাব। একটি ভালমানুষ ওয়ার্ডার, যে ওষুধটা এনে দিয়েছিল, পরের দিন যখন খবর নিতে এল আমি ব্যাপারটা বললাম। সে বলল, ভুল কিছু হয়নি, এখানে আপনার নামই ‘সসার চন্দ্’। আসল নামটা এখানকার খাতায় লেখা হয় না। দু’দিন পরে রাতের অন্ধকারে সে আবার আমাকে দেখতে এল। চাপা গলায় বলল, “ইওর অনার, হাউ আর ইউ?” আমি তো অবাক। বললাম, আমাকে ‘ইওর অনার’ বলছ যে? সে সরলভাবে গলা আরও নামিয়ে উত্তর দিল, আপনারাই তো অনারেবল লোক, দেশের জন্য এত কষ্ট করছেন, আর আমরা তো কেবল পেটের জন্য যা বলছে তাই করছি।
আর একটি মজার চরিত্রের কথা মনে আছে। সে নাকি লাহোর ফোর্টের কেটারিংয়ের তদারকি করত, নাম ফকরুদ্দিন। একদিন হঠাৎ এসে বলল: খাবার বড়ই খারাপ হচ্ছিল শুনে খবর নিতে এলাম, এখন ঠিক আছে তো? আমি হেসে বললাম: তোমাদের কোনটা ঠিক কোনটা বেঠিক বুঝি না। তারপর সে দার্শনিকের মতো বলল: আমিও তো বুঝি না যৌবনের শ্রেষ্ঠ দিনগুলি তোমরা এইভাবে জেলখানায় হেলায় কাটিয়ে দিচ্ছ কেন! জীবনে তাহলে আর কী রইল।
ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ শুরু হয়েছে। একদিন দেখি ফোর্টের কর্মচারীরা সকাল থেকেই খুব ব্যস্তসমস্ত হয়ে ঘোরাঘুরি করছে। যেন কিছু একটা ঘটবে। বিকালের দিকে আমার সেলের দরজা খোলা হল, খানসাহেব বিশাল একটা হাতকড়া নিয়ে ঢুকল। মজবুত করে হাতকড়া লাগিয়ে আমাকে ফোর্টের উপরের দিকে নিয়ে গেল। দালান পেরিয়ে একটা ঘরের সামনে প্রথমে দাঁড় করাল। দরজাটা খুলতেই দেখলাম রজভিসাহেব আমাকে অভ্যর্থনার জন্য দাঁড়িয়ে আছেন। হাতকড়াটার চেনটা রজভিসাহেব নিলেন এবং ভিতরে নিয়ে গেলেন। ভিতরে দেখলাম দুজন ইংরেজ ভদ্রলোক টেবিলের দুপাশে বসে আছেন, একজন আমার মুখোমুখি, অন্যজন আমার বাঁ পাশে। আমার জন্য একটা চেয়ার ছিল। হাতকড়ার চেনটা শক্ত করে ধরে রজভি আমার পেছনেই দাঁড়িয়ে রইলেন। পরে রাজভি আমাকে বলেছিলেন, ওরকম করা ছাড়া তাঁর উপায় ছিল না, কারণ, অতীতে কোনো কোনো বন্দী ইংরেজ অফিসারদের হঠাৎ আক্রমণ করে বসেছেন।
আমার সঙ্গে কথা বললেন যিনি আমার মুখোমুখি বসে ছিলেন। অন্যজন সর্বক্ষণ কেবল আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। প্রথম প্রশ্ন হল, তুমিই তো শিশির বসু, না? বললাম, শিশিরকুমার বসু। জবাব, ঐ হল, একই কথা। আচ্ছা, তোমার কাকা দেশ ছেড়ে যাবার আগে তোমার সঙ্গে তাঁর সম্পর্কটা বেশ নিকট ছিল, নয় কি? আমি বললাম, আমাদের দেশে, একান্নবর্তী ভারতীয় পরিবারে, কাকা-ভাইপোর সম্পর্কটা নিকটই হয়ে থাকে। তারপর প্রশ্ন হল, আচ্ছা, তুমি জাপানিদের সাহায্য করছ না কেন, বলো তো? বললাম, আমি জীবনে সম্ভবত কোনো জাপানিকে চোখেও দেখিনি, সাহায্য করার প্রশ্ন ওঠে না।
আবার প্রশ্ন হল, তোমার কাকা জাপানিদের সাহায্য করছেন বলেই কি তুমিও তাই করছ? আমি বললাম, আমার কাকা জাপানিদের সাহায্য করছেন মনে করার কোনো কারণ নেই, আমি যতদূর জানি তিনি দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছেন। তখন তিনি বললেন, “টেক মাই ওয়ার্ড ফর ইট্,হি ইজ এ গ্রেট হেল্পার অব দি জ্যাপানিস।” ভবী ভোলবার নয়। কেবল জাপানি আর জাপানি। আবার জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি চাও যে জাপানিরা যুদ্ধে জিতে যাক, আমরা জানি, এদেশের অনেকেই তাই চায়। আমি বললাম, জাপানিদের কী হয় বা না হয়, তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। আমরা চাই আমাদের দেশ স্বাধীন হোক। তারপর সাহেব বললেন, তুমি তো মহা বিপদ নিজের উপর টেনে এনেছ। তোমার বাবা তো জেলে। তোমার এক দাদা তো বিলেতে রয়েছেন, তিনিও কি দেশে ফিরে এসে জাপানিদের সাহায্যে লেগে যাবেন? আমি বললাম, সে-রকম মনে করার কোনো কারণ নেই। তবে আমার সম্বন্ধে তোমাদের কোথাও একটা ভুল হয়ে গেছে। গলা চড়িয়ে সাহেব বললেন, দ্যাখো, ভারত সরকার ভুল করে কারুকে লাহোর ফোর্টে আনে না। তোমার সামনে ভীষণ বিপদ। মনে রেখো, এখন যুদ্ধ চলছে, শত্রুকে সাহায্য করার দণ্ড চরম।
পরে জেনেছিলাম, সাহেবটি ছিলেন ভারত সরকারের অ্যাডিশনাল হোম সেক্রেটারি রিচার্ড টটেনহ্যাম স্বয়ং।
খানসাহেব আমাকে আবার ধরেবেঁধে আমার সেলে পৌঁছে দিয়ে গেল। সেই দিনই সন্ধ্যায় আবার আমাকে সেই ঘরে নিয়ে গেল। রভিসাহেব তখন টেবিলের মাথায় বসে। রিচার্ড টটেনহ্যামের সই-করা চার্জশিটের দুটি কপি তিনি আমার হাতে দিলেন। মূলটা সই করিয়ে ফেরত নিয়ে, কপিটা আমাকে দিলেন। বললেন, এর উত্তরে আমার কিছু বলার থাকলে আমাকে কাগজ-কলম দেওয়া হবে।
সেই রাতে বজ্রবিদ্যুৎসহ খুব বৃষ্টি হল। আমার সেলের ছাদের নানা দিক দিয়ে জল পড়তে লাগল। সকালে কনকনে হাত-পা জমানো শীত।
৬১
চার্জশিটের জবাব যে দিতে হবে সে বিষয়ে আমার মনে কোনো দ্বিধা ছিল না। তবে অভিযোগগুলি খুঁটিয়ে পড়ে দুটি কথায় আমার খুবই উদ্বেগ হল। কথা দুটি হল ‘অ্যাণ্ড আদার্স’। আমি বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স দলের যোগসাজশে সুভাষচন্দ্র বসু ও জাপানিদের সাহায্য করেছি এটা না হয় বোঝা গেল, কিন্তু ‘অ্যাণ্ড আদার্স’ কথা দুটি থাকায় আমার সন্দেহ হল যে, খুব সম্ভব রাঙাকাকাবাবুর পাঠানো লোকগুলির সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ ও কাজকর্মের কথা ব্রিটিশ গোয়েন্দারা অন্তত খানিকটা জেনে ফেলেছে। আমার মনে হল যদি তাদেরও কাউকে সরকার ধরে ফেলে থাকে, তাহলে আমাদের সকলকে একসঙ্গে গোপনে বিচার করে সাজা দেবার নিশ্চয়ই চেষ্টা করবে।
এদিকে বাড়ি থেকে নানাভাবে আমার খবর নেবার চেষ্টা হচ্ছিল। নৃপেন্দ্রচন্দ্র মিত্র মহাশয় ও আমাদের মামাবাবু —অজিতকুমার দে ভারত সরকারের ভূতপূর্ব আইনমন্ত্রী স্যার নৃপেন্দ্রনাথ সরকারকে ধরলেন তিনি যেন ভাইসরয় লর্ড ওয়েভেলকে আমার কেসটা দেখতে বলেন। লর্ড ওয়েভেল সরকারসাহেবকে লিখলেন যে, তিনি সাধারণত এই সব ব্যাপারে হোম ডিপার্টমেন্টের কাজে হস্তক্ষেপ করেন না, কিন্তু সরকারসাহেবের কথা রাখবার জন্য তিনি তা করবেন। দিনকতক পরে বড়লাট সরকারসাহেবকে জানালেন যে, তিনি আমার ফাইলটা দেখেছেন কিন্তু আমার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলি এতই গুরুতর যে, তাঁর কিছু করবার নেই। সেই সময়কার কেন্দ্রীয় আইনসভার এক সদস্যার মাধ্যমেও আমার সম্বন্ধে খবর নেওয়ার চেষ্টা করা হয়। তিনি খবর দেন সরকার আমাকে এক ষড়যন্ত্রের মামলায় ফাঁসাবার চেষ্টা চালাচ্ছে।
যাই হোক, আমি চার্জশিটের জবাব দেব বলায় ফোর্টের কর্তৃপক্ষ দোয়াত-কলম ও তিন-চার পৃষ্ঠা কাগজ দিয়ে গেল। চার্জশিটের উপরই খসড়া আরম্ভ করলাম। কী লিখি? চার্জশিট খণ্ডন করে বাবার দুটি ঐতিহাসিক ও বিখ্যাত চিঠি—একটি তিরিশ দশকের ও অন্যটি চল্লিশ দশকের—আমার ভাল করে পড়া ছিল। বুঝতেই পারছি যে, ওরা যা বলছে তা মোটামুটি সত্যি, যদিও আমাদের উদ্দেশ্য খুবই মহৎ এবং জাপানিদের সঙ্গে যোগাযোগ নেহাতই আনুষঙ্গিক। আত্মপক্ষ সমর্থনে বলিষ্ঠ মনোভাব দেখানো ও নিজেদের আদর্শ ও মতবাদকে জোরের সঙ্গে পেশ করা আমি বাবার লেখা থেকে শিখেছিলাম। যতটা পারলাম নানারকম যুক্তি-তর্কের অবতারণা করে সরকারের অভিযোগের অসারতা প্রমাণ করবার চেষ্টা করলাম। আমি লিখেছিলাম, জীবনে একটিও জাপানির সঙ্গে আমার পরিচয় হয়নি, বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স বলে যে একটি দল আছে তাই আমার জানা নেই ইত্যাদি। আমি বলেছিলাম, তথ্যপ্রমাণ থাকলে সরকার তো অনায়াসে বিচার করে আমাকে সাজা দিতে পারেন, বিনা বিচারে আটক রাখার যুক্তি কী?
ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহের এক সন্ধ্যায় আমাকে হাতকড়া লাগিয়ে রজভিসাহেবের ঘরে নিয়ে গেল। রজভিসাহেব বললেন, আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। আরও বললেন, যদিও দেখে তাঁর মনে হয় যে, ‘ইউ আর এ পারসন হু শুড বি ট্রিটেড উইথ রেসপেক্ট’, কিন্তু লাহোর ফোর্টের ইনটেরোগেশন মোটেই সুখকর নয় এবং তার থেকে নিস্তার নেই। কথায় কথায় বলে বসলেন যে, তাঁদের কাছে আমি খুবই পরিচিত লোক—সেই এক রাত্রে তাঁকে নিয়ে গাড়ি চালিয়ে অদৃশ্য হওয়া থেকে আরম্ভ করে মাস-দুয়েক আগে রাস্তায় গ্রেপ্তার হওয়া পর্যন্ত আমার জীবনের প্রতিটি ঘটনা সম্বন্ধে তাঁরা নানা সূত্র থেকে খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে খবর সংগ্রহ করেছেন।
হাতকড়া লাগিয়ে চেয়ারে বসিয়ে দিনের পর দিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্রশ্ন আর প্রশ্ন। যেন আমার জীবনী লিখছে। আমি মোটামুটিভাবে নিজের দিকটা মনে মনে গুছিয়ে নিয়েছিলাম। কয়েক সপ্তাহ ধরে যা চলল সেটাকে আমি বলতে পারি ‘ব্যাটল অব উইট্স’। ওরা আমাকে কেবলই ফাঁদে ফেলতে চায় আর আমি চেষ্টা করি জাল কেটে বেরিয়ে আসতে। কৌশল ও স্নায়ুর লড়াইয়ে আমি কয়েকটা উপায় ঠিক করে নিয়েছিলাম। প্রথমত, গুরুতর কার্যকলাপের কথা উঠলে অপেক্ষাকৃত কম গুরুতর কাজকর্মকে বড় করে দেখানো। দ্বিতীয়ত, ওরা অন্যদের আমার কাজকর্মের সঙ্গে জড়াবার চেষ্টা করলে নিজে সব কিছুর দায়িত্ব নেওয়া। তৃতীয়ত, লোকের নাম, তারিখ ভুলে যাওয়ার ভান করা ইত্যাদি। রভিসাহেব তো একদিন আমাকে আমার সব জ্যাঠাইমা কাকিমাদের নাম বলতে বললেন। আমি না পারায়, বাহাদুরি দেখাবার জন্য নিজেই গড়গড় করে নামগুলি বলে গেলেন। নানারকম কথা বলে গোয়েন্দারা ক্রমাগতই বোঝাবার চেষ্টা করে যে, তারা সবকিছুই জেনে ফেলেছে, যদিও আসলে কিন্তু তা নাও হতে পারে। একদিন পুলিশসাহেব আমাদের উডবার্ন পার্কের বাড়ি কী ভাবে তৈরি এবং বাড়ির কোথায় কী আছে বলে গেলেন।
আমি মেডিকেল কলেজের ছাত্র ইউনিয়নে আমার ভূমিকা এবং ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে আমার ভূমিকা খুব ফলাও করে বলেছিলাম যাতে গোপন কাজকর্মের কথা যতটা সম্ভব চাপা পড়ে যায়। নাম ভুলে যাওয়া বা ভুল বলা নিয়ে মাঝে-মাঝে বেশ মজা হত। আমি শান্ত ও গম্ভীরভাবে একটা ভুল নাম বললাম। কিন্তু বুঝতে পারলাম রজভিসাহেবের হয় বিশ্বাস হচ্ছে না বা গুলিয়ে যাচ্ছে। বি.ভি.-র শান্তিময় গাঙ্গুলি সম্বন্ধে একদিন বললেন, “শান্তি গাঙ্গুলির কার্যকলাপ সম্বন্ধে তুমি কী জানো বলো তো?” আমি বললাম, “শান্তি গাঙ্গুলি? মহিলাটি কে?” তাচ্ছিল্যের সুরে রজভি বলে উঠলেন, “দুত্তোরি, তুমি তো কিছুই জানো না দেখছি!” আমি প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলাম যাতে আমার নানারকম গোপন কার্যকলাপের আওতা থেকে বাবা-মাকে বাইরে রাখা যায়। আমার বিশ্বাস, আমি ওদের এ-ব্যাপারে বিচার-বিবেচনায় গোলমাল করে দিতে পেরেছিলাম। রাঙাকাকাবাবুর সব কাজকর্মে আমি গভীরভাবে উৎসাহী একথা আমি খোলাখুলিভাবেই বলেছিলাম।
সুধীর বকসী মহাশয়কে লাহোর ফোর্টে এনেছে আমি অনুমান করেছিলাম। দলের অন্য কার-কার এই দুর্ভাগ্য হয়েছিল, তখন জানতে পারিনি। পরে জেনেছিলাম। আমি যখন সেখানে ছিলাম, জয়প্রকাশ নারায়ণও লাহোর ফোর্টে বন্দী ছিলেন। অত্যাচারের ফলে একদিন কোনো এক বন্দীর মৃত্যু হল—এরকম আভাসও আমি পেয়েছিলাম।
প্রথম দিকে আমার নানারকম আশঙ্কা হলেও, জিজ্ঞাসাবাদের শেষের দিকে ওদের কথাবার্তা থেকে আমার ধারণা হল যে, পূর্ব-এশিয়া থেকে আগত আমাদের বন্ধুদের ওরা ধরতে পারেনি। সুতরাং আমাদের বিরুদ্ধে গোপন ষড়যন্ত্রের একটা কেস খাড়া করা সরকারের পক্ষে খুবই শক্ত। অন্যদিকে বুঝলাম যে, ১৯৪১ সালে রাঙাকাকাবাবুর অন্তর্ধানে আমার ভূমিকার ভিত্তিতে কোনো কেস খাড়া করাব কোনো ইচ্ছা তাদের নেই। আরও বুঝলাম, যে সূত্র তাদের কাছে ব্যাপারটা ফাঁস করে দিয়েছে, রাজনৈতিক কারণে তাদের পর্দার আড়ালে রাখাই তাদের পক্ষে যুক্তিযুক্ত। তাহলেই রাঙাকাকাবাবুর বিরুদ্ধে ইংরেজ সরকার ও দেশের বিশেষ যে রাজনৈতিক গোষ্ঠীর যে গোপন আঁতাত হয়েছে, সেটা ধরা পড়বে না, ভবিষ্যতেও চালু থাকবে।
ইনটেরোগেশনটা খুব লম্বা হওয়াতে একদিক দিয়ে আমি কিছু লাভ উঠিয়েছিলাম। জিজ্ঞাসাবাদ করতে করতে এমন হয় যে, পুলিশ অফিসার বন্দীর ব্যক্তিত্বের দ্বারা খানিকটা প্রভাবিত হয়ে পড়ে, এবং অসতর্ক হয়ে মাঝে মাঝে এটা-ওটা বলে ফেলে। এইভাবে আমি রাঙাকাকাবাবুর আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও রাজনৈতিক সহকর্মীদের মধ্যে কারও-কারও সম্বন্ধে কিছু কিছু অপ্রিয় খবরাখবর আদায় করতে পেরেছিলাম এবং বুঝেছিলাম যে, অনেকের সম্বন্ধে রাঙাকাকাবাবুর সন্দেহ অমূলক ছিল না।
অতিরিক্ত ঠাণ্ডার মধ্যে চলছিল আমার ইনটেরোগেশন। কিন্তু আমার তো গরম: জামাকাপড় বলতে কিছু নেই। ঠাণ্ডায় পায়ের গাঁটে-গাঁটে রক্ত জমে গেল। চলাফেরা করতে ব্যথা লাগছিল। একদিন একটা ঘরে নিয়ে গেল যেখানে বেশ গনগন করে আগুন জ্বলছে। খাবার সময় হলে রজভিসাহেব আমার থালিটা আনিয়ে বললেন, “আজ তোমার খাবারটা গরম করে দিই।” যেন দয়াপরবশ হয়েই খানিকটা আগুনের উপরে রেখে গরম করে দিলেন। কিন্তু আমি খেতে পারলাম না, দু’মাস বরফের মতো ঠাণ্ডা খাবার খেয়ে অন্যরকম অভ্যাস হয়ে গেছে। দেখে পুলিশসাহেব বলে উঠলেন, দেখ, মানুষের কী না হয়! ঐ ঠাণ্ডার মধ্যে একটা জিনিসই একটু যেন গরমের আঁচ এনে দিত—আমার ক্রমবর্ধমান দাড়ি। প্রায়ই কলসির জলে মুখের ছায়া দেখে দাড়ির বিস্তার আন্দাজ করতাম। আমাকে আগেই ওরা জানিয়ে দিয়েছিল যে, লাহোর ফোর্টে তারা বন্দীদের দাড়ি কামাতে দেয় না যাতে আমরা আত্মহত্যার সুযোগ না নিই।
ইনটেরোগেশনের শেষের দিকে রজভিসাহেবকে একদিন বলে ফেললাম, “তোমরা তো আমার কেরিয়ারটাই নষ্ট করে দিলে।” উত্তরে তিনি বললেন, “না, লাহোর ফোর্টে কেরিয়ার শেষ হয় না, শুরু হয়।” নাটকীয় সুরে আরও বললেন, “আমি এই ফোর্টে জীবন শুরু করেছিলাম, এইখানেই শেষ করব। তোমার এখানে শুরু—ইউ উইল বি এ বিগ্ ম্যান সাম ডে, আই স্টার্টেড হিয়ার অ্যাণ্ড উইল এণ্ড হিয়ার।”
শেষ পর্যন্ত আমাকে একদিন জানানো হল যে, আমাকে ফোর্ট থেকে বদলি করা হবে। বাড়ি থেকে পাঠানো আমার জিনিসপত্র ভর্তি একটা ট্রাঙ্ক এতদিন তাদের কাছেই ছিল। সেটা থেকে বের করে আমাকে কিছু কাপড়-চাপড় দেওয়া হল। গরম কোটটা পরতে গিয়ে দেখি ভিতরে লাইনিং সব কাটা। যদি লাইনিংয়ের ভিতরে কাগজপত্র লুকানো থাকে!
বিদায় দেবার আগে, নাজির আহমদ রজভি খানিকটা দুঃখ প্রকাশ করে বললেন, “যা ঘটল, তার জন্য কিছু মনে কোরো না, আমরা বর্তমানে পরস্পর-বিরোধী পক্ষের লোক, উপায় ছিল না। তবে আমরা যে সরকার যখন ক্ষমতায় থাকে তারই হুকুম তামিল করি। তবে ন্যাশনাল গভর্নমেন্ট তো একদিন হবেই, তখন যদি তোমাদের কোনো কাজে লাগতে পারি তো বোলো।”
রাঙাকাকাবাবু সম্বন্ধে তিনি বলেছিলেন, তাঁর সামনে তো খুবই বিপদ। রাশিয়ানরা তো তাঁকে গ্রহণ করবে না। তিনি যাবেন কোথায়? গ্রেট থিংস অফ্ বার্ন দেমসেলভ্স আপ্ ইন দেয়ার ওন ফায়ার!
১৯৪৪-এর ফেব্রুয়ারির এক সকালে হাতকড়া লাগিয়ে কড়া পাহারায় ওরা আমাকে আরও পশ্চিমমুখো এক ট্রেনে তুলল।
৬২
লাহোর ফোর্ট থেকে আমাকে কোথায় বদলি করছে আমাকে ওরা বলেনি। সকালে রওনা হয়ে সন্ধ্যার মুখে ট্রেন পৌঁছল লায়ালপুরে। লায়ালপুর ছিল পাঞ্জাবের মুলতান ডিভিশনের একটি সুন্দর পরিচ্ছন্ন যাকে বলে প্ল্যাণ্ড শহর। তবে মুলতান এলাকায় গ্রীষ্মে অসহ্য গরম হয়। ভাবলাম লাহোরে তো বেশ ঠাণ্ডা দাবাই দিয়েছে, এবারে বোধহয় খানিকটা গরম দাবাই দেবে। আর একবার টাঙ্গায় চাপিয়ে আমাকে স্টেশন থেকে লায়ালপুর ডিস্ট্রিক্ট জেলের সামনে নামাল। নিয়মমতো জেলের বড় দরজার ছোট অংশটি খোলা হল। সুপারিনটেনডেন্টসাহেব যেন আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তাঁর ঘরে হাজির হবার পরে তিনি গম্ভীর গলায় বললেন, হাতকড়াটা খুলে দিতে পারো। মনে হল, ভদ্রলোকটি নিজেকে যেন বেশ কেউকেটা ভাবেন। জানলাম তাঁর নাম সৈয়দ আমির শাহ। তিনি আশা প্রকাশ করলেন, আমরা যেন মিলেমিশে সুখে ঘর করি। জেলরসাহেবকে ডেকে আমাকে আমার নির্দিষ্ট ওয়ার্ডে নিয়ে যেতে বললেন। খুব লম্বা, ধবধবে ফর্সা, বিরাট পাগড়ি মাথায় এক ভদ্রলোক আমাকে নিয়ে, জেলের ভিতরে এগিয়ে চললেন। রাস্তায় সারিবদ্ধ কয়েদিরা জেলারসাহেবকে সেলাম ঠুকতে লাগল। দেখলাম কয়েদিরা তাদের সন্ধ্যার আহারের আশায় দাঁড়িয়ে আছে। বড় বড় তন্দুরে তৈরি বিরাটকায় রুটি তাদের মধ্যে বিতরণ করা হচ্ছে।
জেলটি কিন্তু ইঁট, সিমেন্ট দিয়ে পাকা গাঁথুনির নয়। কেবল মাঝের টাওয়ারটি পাকা। বাকি সবই কাঁচা মাটি জমিয়ে তৈরি। দেওয়ালগুলি অবশ্য যে-কোনো জেলের মতোই সোজা ও উঁচু। আমাকে যে ওয়ার্ডে নিয়ে গেল তার এলাকাটা বেশ বড়ই। তারই মাঝ-বরাবর পাশাপাশি চারটি সেল। সবগুলিই খালি। একটি অমায়িক বৃদ্ধ পাহারাওয়ালা ছিল। চারটির মধ্যে একটি সেল জেলারসাহেব আমার জন্য বরাদ্দ করে গেলেন।
লায়ালপুর জেলে সেই সময় বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক বন্দী ছিলেন। শুনলাম আমার আগমন-বার্তায় তাঁদের মধ্যে খুব উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে। এমনিতেই বাঙালী বন্দীদের বহুদিন ধরে পাঞ্জাবের জেলমহলে বেশ নাম-ডাক। তার উপর আবার বসুবাড়ির একজন।
একটু পরেই অন্য ওয়ার্ড থেকে আমার জন্য চা ও খাবার এসে পৌঁছল। সেদিনের জন্য তো আমার ইয়ার্ডে কোনো ব্যবস্থা নেই, বলা হল পরের দিন থেকে আমাকে একটি লোক দেওয়া হবে, রেঁধেবেড়ে নেওয়ায় সাহায্য করবে।
সন্ধ্যা বাড়তেই আমাকে সেলে ঢুকতে বলে তালা দিয়ে দিল। খবর পেয়ে অন্য রাজনৈতিক বন্দীরা খুব শোরগোল তুললেন। দাবি তুললেন যে, অন্য রাজবন্দীদের লক্-আপ করা হয় না,আমাকেও করা চলবে না। কিন্তু পরে জেল কর্তৃপক্ষ তাঁদের জানিয়ে দিলেন যে, এই বন্দীটি সম্বন্ধে বিশেষ কয়েকটি নির্দেশ আছে, একে একেবারে আলাদা রাখতে হবে, নিয়মমাফিক লক্-আপ করতে হবে, কাগজ-কলম দেওয়া চলবে না, ইত্যাদি। আমাকে যে ইয়ার্ডে বন্দী করা হল সেটিতে সাম্প্রতিক কালেও কনডেমড প্রিজনার্সদের বা ফাঁসির কয়েদিদের রাখা হত। এটা নিয়েও অন্য রাজবন্দীরা আপত্তি তুললেন।
সেলটি ছিল ছোট, একটা চারপাই প্রায় সবটাই জুড়ে ছিল। জানালা নেই, আলো-বাতাস কম। রাত্রের জন্য একটি টিমটিমে কেরোসিনের লণ্ঠন। যাই হোক, আমার মনে হল লাহোর ফোর্টের সেই ভয়ঙ্কর পরিবেশ থেকে হয়তো বা রেহাই পেলাম।
ফেব্রুয়ারি মাস, বেশ কনকনে ঠাণ্ডা। তবে জামাকাপড় তো পেয়ে গেছি, ভারী গরম জামা চাপিয়ে যতটা সম্ভব ঘোরাঘুরি করতে লাগলাম। দেখলাম, মা ইউরোপে ব্যবহার করা রাঙাকাকাবাবুর গরম ড্রেসিং গাউনটি আমার কাপড়-চোপড়ের সঙ্গে পাঠিয়েছেন। পরে বেশ ভাল লাগল।
সকাল হতেই এক ওয়ার্ডার বছর আঠারো-কুড়ির একটি কয়েদিকে আমার সামনে হাজির করল। নাম ইব্রাহিম। সে আমার ইয়ার্ডে থাকবে, রান্নাবান্না ও অন্যান্য কাজে সাহায্য করবে। ভাবলাম, যাক, কথা বলার অন্তত একটা লোক হল। তাছাড়া রান্নাবান্না তো আমি জীবনে করিনি, ভাবলাম সেদিক দিয়েও একটা ব্যবস্থা হল।
ইব্রাহিম ছেলেটি অতি সরল ও অতি ভদ্র। কিন্তু কথা বলব কী, সে হিন্দি-টিন্দি বলে না, বলে কেবল গ্রাম্য পাঞ্জাবি ভাষা। যাই হোক, জিজ্ঞাসা করলাম, রান্নাবান্না কী করবে বলো। সে আমাকে বুঝিয়ে দিল, সে জীবনে কোনোদিন রান্না করেনি। করবেই বা কেন, বাড়িতে মা, বৌ নেই নাকি। সে অবশ্য মদ তৈরি করতে জানে, বেআইনি ভাবে মদ চোলাই করবার অপরাধেই তো সে জেলে এসেছে।
আমি নিজেকে বোঝালাম, কেমিস্ট্রি তো আমার কিছু জানা আছে। তারই জোরে আমি ইব্রাহিমকে নির্দেশ দিতে পারব। ভাত রাঁধতে কতটা জল দিতে হবে আলু-বাঁধাকপির চচ্চড়িতে কী কী মশলা ব্যবহার করা সঙ্গত। কোন্টা পরে বা কোন্টা আগে দিতে হবে ইত্যাদি নানা সমস্যা নিয়ে ইব্রাহিম ও আমি ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।
লাহোর ফোর্টে আমার বন্দীজীবনের শেষের দিকে ছাপানো রুলটানা ফর্মে আমাকে কয়েকখানা চিঠি লিখতে দিয়েছিল। আমাকে বলেও দিয়েছিল যে, বাংলায় লিখলে চিঠি পৌঁছতে অনেক দেরি হবার সম্ভাবনা। এখানেও সেই ব্যবস্থা বহাল রইল। একজন ওয়ার্ডার ফর্ম, কালি ও কলম নিয়ে আসবে। আমি যতক্ষণ লিখব আমাকে পাহারা দেবে। লেখা হয়ে গেলে সবকিছু গুটিয়ে নিয়ে চলে যাবে। আমাকে কিছু বই ও খবরের কাগজ দেওয়া হবে, অবশ্য যেগুলি উপরওয়ালা মঞ্জুর করবেন। জেলের একটা লাইব্রেরি ছিল, নিজের বই না পাওয়া পর্যন্ত সেখান থেকে দু-চারখানা ইংরেজি সাহিত্যের বই জেল কর্তৃপক্ষ আমাকে দিতে রাজি হলেন। মনে আছে, চার্লস ডিকেন্সের পিক-উইক পেপার্স জেলে বসে পড়তে বেশ ভালই লেগেছিল।
লাহোর ফোর্টে থাকাকালীন আমি গল্পের রিপ ভ্যান উইনক্ল্ হয়ে গিয়েছিলাম। দেশ-বিদেশের খবরাখবর তো কিছুই জানতে পারতাম না। মাঝে মাঝে ওরা কেবল বর্মা ইংরেজ ফৌজের অগ্রগতির কথা আমাকে শোনাত। যেমন একদিন বলল, কাল তো আমরা আকিয়াব দখল করেছি। পরে একদিন বলল, তোমাদের অবস্থা খারাপ, আমাদের ফৌজ ইরাবতীর তীরে পৌঁছে গেছে—ইত্যাদি। মনে আছে জানুয়ারি মাসের শেষে একদিন আমি রজুভি-সাহেবকে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফল জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি খুব খানিকটা হেসে বললেন, আরে, তুমি কোথায় আছ, ব্যাপারটা তো মাস-দুয়েক আগেই হয়ে গেছে। যাই হোক, লায়ালপুরে আসার পরে আমি দেশের ও যুদ্ধের খবর সংগ্রহ করার জন্য নানাভাবে চেষ্টা করতে লাগলাম। কলকাতার দুটি খবরের কাগজ—আনন্দবাজার ও হিন্দুস্থান স্ট্যাণ্ডার্ড চাইলাম,কিন্তু কর্তৃপক্ষ সেটা নামঞ্জুর করলেন। প্রথমে স্টেটস্ম্যান পত্রিকা আমাকে দেওয়া হল। পরে লাহোরের ‘ট্রিবিউন’ পত্রিকা মঞ্জুর হল। বইয়ের জন্য বাড়িতে লিখলাম—কিছু ডাক্তারি বই, কিছু বিজ্ঞান, সাহিত্য ও ইতিহাসের বই। তবে বাড়ি থেকে পাঠানো বইপত্র আমার হাতে পৌঁছতে অনেক সময় লাগত, আবার অনেক কিছুই আটকে দেওয়া হত।
এক রাজবন্দীর অন্য এক রাজবন্দীকে চিঠি লেখবার অনুমতি ছিল না। সেজন্য বাড়িতে লেখা আমার চিঠি কপি করে বাবাকে পাঠানো হত। বাবা সেগুলি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তেন। আমার সাধারণ কথার মধ্যেও নানারকম অর্থ খুঁজে পেতেন, যেগুলি অন্য কারও মনেও ধরত না।
ইব্রাহিমের সঙ্গে আমার দিনগুলি কোনোরকমে কেটে যেত লাগল। প্রতিদিন সকালে সুপারিনটেনডেন্ট আমির শাহ প্রায় রাজকীয় কায়দায় ছাতি মাথায় দিয়ে মিছিল করে রাউণ্ডে আসতেন। আমি বেশি কথা বলতাম না। কুশল-বিনিময় ও আকাশ-বাতাস নিয়ে দু’চারটি কথা বলে সেরে দিতাম। হঠাৎ একদিন কিছু চেয়ে বসলাম। শুনেছিলাম জেলে একজন মাস্টার আছেন, তিনি কয়েদিদের নিরক্ষরতা দূর করার চেষ্টা করেন। আমি সকালে কিছুক্ষণের জন্য মাষ্টারকে চাইলাম উর্দু শেখার জন্য। আমির শাহ রাজি হয়ে গেলেন। ‘আলিফ’ ‘বে’ ‘পে’ থেকে আরম্ভ করে ক্রমশ আমি উর্দুতে ছোটদের জন্য লেখা গল্পের বই পর্যন্ত পৌঁছে গেলাম। সন্ধ্যার অন্ধকারে একদিন আমার সেলের সামনে পায়চারি করছি। হঠাৎ কানে এল, জেলের টাওয়ার থেকে প্রচার করা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের একটি পূজার গান। জীবনে কোনোদিন বাংলা গান, রবীন্দ্রনাথের গান এত ভাল লাগেনি, প্রাণ যেন জুড়িয়ে গেল:
আমি জ্বালব না মোর বাতায়নে প্রদীপ আনি,
আমি শুনব বসে আঁধার-ভরা গভীর বাণী!!
আমার এ দেহ মন মিলায়ে যাক নিশীথ রাতে,
আমার লুকিয়ে ফোটা এই হৃদয়ের পুষ্পপাতে,
থাক-না ঢাকা মোর বেদনার গন্ধখানি।
পরে খোঁজ নিয়ে জানলাম কখনও কখনও লক্ষ্ণৌ রেডিও স্টেশন থেকে গানের প্রোগ্রাম রিলে করে শোনানো হয়—তার মধ্যে কখনও-কখনও বাংলা গানও থাকে।
৬৩
১৯৪৫-এর প্রথম মাস-চারেক ছিল ইউরোপের যুদ্ধের শেষ পর্যায়। পশ্চিম থেকে আমেরিকান, ফরাসি ও ইংরেজদের যুক্ত আক্রমণ আর অন্য দিক থেকে সোভিয়েট রাশিয়ার অভিযান জার্মানিকে পর্যুদস্ত করে ফেলেছিল। দুই পক্ষের খবর না পেলেও বুঝতেই পারছিলাম যে, হিটলার যতই আস্ফালন করুন না কেন, জার্মানির চূড়ান্ত পরাজয় অনিবার্য। লাহোরের ‘ট্রিবিউন’ পত্রিকা আমাকে মাঝে-মাঝে পড়তে দেওয়া হত। খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে পড়তাম। দেশ-বিদেশের যতটা খবর পাওয়া যায়। তখন কিন্তু আমার মনে হয়েছিল যে, জার্মানির হারের পরেও জাপানকে কাবু করতে ইংরেজ ও আমেরিকানদের অনেক সময় লাগবে। সেজন্য আরও বেশ কিছুদিন যে জেলে থাকতে হবে সেটা ধরেই নিয়েছিলাম।
ইব্রাহিমকে নিয়ে কোনোরকমে দিনগুলি কেটে যাচ্ছিল। ক্রমে ক্রমে ইব্রাহিম ও অন্য কয়েদি বা ওয়ার্ডারদের কথাবার্তা বুঝতে শুরু করলাম। ভাঙা-ভাঙা পাঞ্জাবিও বলতে আরম্ভ করলাম। পাঞ্জাবের গ্রামাঞ্চলের ও জনজীবনের অনেক খবর আমার গোচরে এল। পাঞ্জাবের জেলে আসার আগেই তো বাংলার ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখে এসেছি। পাঞ্জাবের গ্রামাঞ্চলের জীবনযাত্রার কথা শুনে মনে হল এদের অবস্থা তো বেশ সচ্ছল, একই দেশে একই রাজত্বে এমন হয় কী করে!
সাধারণ কয়েদিদের সম্বন্ধে আমার ধারণা একেবারে বদলে গেল। বর্মার জেলে থাকতে রাঙাকাকাবাবু এদের কাছ থেকে দেখে, তাদের মানসিকতা বিচার করে, তাদের বাড়ি-ঘর আত্মীয়-স্বজন সম্বন্ধে খবরাখবর নিয়ে,জেলের নিয়মকানুনের সংস্কার ও অভিযুক্ত কয়েদিদের প্রতি আমাদের আচরণবিধি ইত্যাদি সম্বন্ধে অনেক কিছু লিখেছিলেন। নিজের জেলের অভিজ্ঞতা থেকে এখন আমি রাঙাকাকাবাবুর মতামতের যৌক্তিকতা উপলব্ধি করতে পারলাম। আমি একলা থাকি, যে সব কয়েদি কোনো কাজ নিয়ে আমার ইয়ার্ডে আসে তাদের সকলেরই চেষ্টা কী উপায়ে অমাকে প্রফুল্ল রাখা যায়। একটি বৃদ্ধ কয়েদির ওপর আমার ইয়ার্ড পরিষ্কার রাখার ভার ছিল। সে কাজ সেরে যাবার আগে গান গেয়ে ও নেচে আমাকে এনটারটেন করে যেত। পাঞ্জাবিরা মুখে মুখে কবিতা বা ‘শ্যার’ তৈরি করতে খুব পটু। প্রায়ই আমার কয়েদি বন্ধুরা কোনো অজুহাতে আমার ইয়ার্ডে ঢুকে পড়ে ‘শ্যার’ শুনিয়ে যেত। ক্রমে-ক্রমে এদের সম্বন্ধে ভীতি বা সন্দেহ একেবারেই কেটে গেল। বুঝতে শিখলাম এদের মধ্যে বেশির ভাগই সহজ-সরল মানুষ, বিশেষ কোনো অবস্থায় পড়ে বা সাময়িক ঝোঁকের মাথায় কোনো অপরাধ করে ফেলেছে এবং শাস্তি ভোগ করছে।
বাড়ি থেকে পাঠানো কিছু-কিছু বই কর্তারা পাশ করে দিচ্ছিলেন। কিছু ডাক্তারি বই, কিছু ইংরেজি ও বাংলা সাহিত্যের বই। তিরিশের জব্বলপুর জেলে বাবার ব্যবহার-করা একটি গীতা আমার কাছে পৌঁছে গেল। দেখলাম, বইটির বিভিন্ন পাতায় পেনসিলে রাঙাকাকাবাবুর হাতে লেখা কিছু কথাবার্তা রয়েছে। ভাবলাম, রাঙাকাকাবাবু সম্ভবত বাবার কাছে বইটির মাধ্যমে কিছু খবর পাঠিয়েছিলেন। গোয়েন্দারা নজর করেনি। নানা ধরনের ও বিষয়ের বই নাড়াচাড়া করবার সুযোগ পেলেও আমি ভাবলাম ডাক্তারি পড়াটা তো শিকেয় তুলে রাখতে হবে। যদি বছর কয়েক বন্দী থাকতে হয় তাহলে ডাক্তার হবার বাসনা ত্যাগ করাই ভাল। বাড়িতে লিখলাম কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে খবর নিতে আমাকে প্রাইভেট ছাত্র হিসাবে বি. এ. পড়ার অনুমতি দেবে কিনা। অনেক রাজ-বন্দী তো জেলে থাকতেই বি. এ. এম. এ. পাশ করেছেন। আমার এই প্রস্তাব বাড়িতে কারও পছন্দ হল না। তাঁরা হয়তো ভাবলেন আমি অধৈর্য হয়ে ডাক্তারি পড়া ছেড়ে দিতে চাইছি।
আমি এমনিতেই শীতকাতুরে। কলকাতার শীতেই মোটা সোয়েটার, গরম মোজা ও গেঞ্জি, স্নানের গরম জল ইত্যাদি না হলে অস্থির হয়ে যাই। লাহোর, ফোর্টের ঠাণ্ডা দাবাইয়ের পর অভ্যাসটা যেন বদলে গেল। লায়ালপুরে প্রথম দু’মাস খুবই ঠাণ্ডা ছিল। তারই মধ্যে ইব্রাহিমের শখ হল খোলা আকাশের নীচে কনকনে ঠাণ্ডা জলে আমাকে স্নান করাবে। প্রাণ যায় আর কি! কিন্তু দেখলাম যা কি না কিছুদিন আগে পর্যন্ত একেবারেই অসম্ভব বলে মনে হত, তা বেশ সম্ভব। হাড়-কাঁপানো ঠাণ্ডার মধ্যে খোলা বাতাসের মধ্যে ঠাণ্ডা জলে স্নান নিয়মিত চলতে লাগল। নিউমোনিয়া তো হলই না, বরং স্বাস্থ্যের যেন কিছু উন্নতিই হল।
অনির্দিষ্ট কালের জন্য ‘সলিটারি কনফাইনমেন্ট’ বা একেবারে একলা বন্দী করে রাখা জেলখানার সাধারণ নিয়মেও গ্রাহ্য নয়। জেলের শৃঙ্খলা ভাঙার অপরাধে কোনো বন্দীকে সপ্তাহ-দুয়েক একলা রেখে দেওয়া যায় বলে আমরা জানতাম। ইংরেজ সরকার রাজনৈতিক বন্দীদের নিয়ে অনেক বেআইনি কাজ করতেন। তার মধ্যে মাসের পর মাস ‘সলিটারি কনফাইনমেন্টে’ রাখাটা ছিল একটা ঘোরতর অন্যায় ব্যবস্থা। তখন আমাদের হয়ে দেশে বা বিদেশে বলবার তো কেউ ছিল না। তা হলেও বিদেশী সরকার যতটা সম্ভব এই ধরনের অন্যায় কাজকর্ম চেপে রাখবার চেষ্টা করত। আমাদের বাড়ি থেকে এই ব্যাপারে একটু নাড়াচাড়া হওয়াতে ভারত সরকার বোধহয় একটু সতর্ক হয়ে গেলেন। তবে আমাদের মতো বিপজ্জনক বন্দীদের জন্য সঙ্গী যোগাড় করতে সরকারকে অনেক চিন্তাভাবনা করতে হত। অনেক গড়িমসির পরে বাবার জেলের সঙ্গী হিসাবে তারা লালা শঙ্করলালকে পাঠিয়েছিল। লালা শঙ্করলাল তার আগে বসুবাড়ির আর দুই ছেলে দ্বিজেন ও অরবিন্দের সঙ্গে পাঞ্জাবের ক্যাম্পবেলপুর জেলে ছিলেন। আমার বেলায় নয় মাসের উপর একলা থাকার পরে সরকার একটা ব্যবস্থা নিলেন।
মাস-তিনেক ‘কনডেন্ল্ড প্রিজনার্স’ ইয়ার্ডে থাকার পরে আমাকে অন্য একটি এলাকায় বদলি করা হল। ইয়ার্ডটি অপেক্ষাকৃত ছোট এবং ফাঁসির আসামীদের ওয়ার্ড ও ফাঁসির মঞ্চের ঠিক পাশেই। ফাঁসির মঞ্চের ওপরের ভাগটি এখান থেকে বেশ ভালভাবেই দেখা যেত। নতুন জায়গায় এসে একটা সুবিধা হল যে, অন্য রাজনৈতিক বন্দীদের আমি খানিকটা কাছাকাছি এলাম। লুকিয়েচুরিয়ে মাঝে-মাঝে অন্য দু-একজন রাজবন্দীর সঙ্গে দু-একটা কথা বলাও যেত। এঁদের মধ্যে দুজন কংগ্রেস সোস্যালিস্ট পার্টির তারাচাঁদ গুপ্ত ও পণ্ডিত বাৎস্যায়ন আমাকে নানাভাবে সাহায্য করবার চেষ্টা করতেন, লুকিয়ে বই ও কাগজপত্র পাঠাতেন। এক প্রবীণ বিপ্লবী বন্দী বাবা গুরুদিৎ সিং সেই সময় ঐ জেলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করছিলেন। জেল কর্তৃপক্ষ তাঁকে রোজ একবার করে হেঁটে জেল প্রদক্ষিণ করতে দিত। সেই সময় ঐ সৌম্যকান্তি পাঞ্জাবি-বিপ্লবী আমার ওয়ার্ডের সামনে এসে আমার সঙ্গে দু-একটা কথা বিনিময় করেছিলেন।
হঠাৎ একদিন সকালে এক সুদর্শন বাঙালী ভদ্রলোককে জেলারসাহেব আমার বাসস্থানে পৌঁছে দিয়ে গেলেন। বললেন, ইনি আমার সঙ্গে থাকবেন। সত্যরঞ্জন বক্সী মহাশয়ের বাড়িতে সুধীরবাবুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে ১৯৪৪ সালের প্রথমের দিকে এক সন্ধ্যায় আমি এঁকে দেখেছিলাম। মনে হল তিনিও যেন সেই বছর-খানেক আগে এক ঝলক দেখা হবার কথা মনে রেখেছেন। বুঝলাম অনেক মাছই এক জালে ধরা পড়েছে। ভদ্রলোকের নাম অরুণচন্দ্র সেন, স্কটিশ চার্চ কলেজের অধ্যাপক। পাঞ্জাবেরই ঝাং বলে একটি জায়গায় কয়েক মাস তাঁকে বন্দী করে রাখার পরে আমার কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। ভদ্রলোকের বয়স হয়েছে, মাথার চুল প্রায় সবই পাকা, জেলে থাকতে বেশ কষ্ট পেয়েছেন বলে মন হল। যাই হোক, দিন-কয়েকের মধ্যেই আমার সঙ্গে খুব হৃদ্যতা হয়ে গেল তাঁর, এবং দিনের পর দিন তিনি তার জীবনের অনেক ঘটনা আমাকে অকপটে বলে যেতে লাগলেন।
লায়ালপুরে তখন বেশ গরম পড়ে গিয়েছে—১১৮ ডিগ্রি তাপমাত্রা নেহাতই স্বাভাবিক ব্যাপার। রাত্রে সেলের ভেতর শোয়া যায় না। আমাদের বাইরে শোবার অনুমতি দেওয়া হল। মাঝে-মাঝে আঁধি আসে—মানে ধুলোর ঝড়। প্রথমে মনে হয় যে, ধুলোর একটা বিরাট পাহাড় ধীরে-ধীরে এগিয়ে আসছে, তারপর ধুলোর মধ্যে যেন সব কিছুই ডুবে যায়। আমরা সব কিছু গুটিয়ে নিয়ে দৌড়ে সেলের ভেতর আশ্রয় নিই। অরুণবাবুর খুবই কষ্ট হত বুঝতে পারতাম, কিন্তু উপায় কী?
প্রবীণ অধ্যাপকটি প্রথমে ছিলেন ঘোর কমিউনিস্ট। কোনো কমিউনিস্ট নেতার সঙ্গেই একবার রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে এলগিন রোডের বাড়িতে দেখা করতে আসেন। প্রথম কথাবার্তায় এতই আকৃষ্ট হন যে, রাঙাকাকাবাবুর কাছে বারবার আসতে লাগলেন। কিছুদিন যোগাযোগ ও আলাপ-আলোচনার পরে তিনি রাঙাকাকাবাবুর একনিষ্ঠ ভক্ত এবং ঘোর কমিউনিস্ট-বিরোধী হয়ে পড়েন। তিনি প্রায়ই আমাকে বলতেন, একদিকে এক পুরুষসিংহ ও মহাবিদ্রোহী, অন্যদিকে নেহাতই অকিঞ্চিৎকর একদল মানুষ, রাঙাকাকাবাবুর সংস্পর্শে এসে তাঁর চোখ পুরোপুরি খুলে গেছে। আমার সব চালচলন এবং দৈনিক রুটিন তিনি খুব মন দিয় লক্ষ করতেন। ঐ গরমের মধ্যেও রোজ স্নান করা তিনি অপছন্দ করতেন, বলতেন তাঁর বাবা স্বনামধন্য স্বর্গীয় দীনেশচন্দ্র সেন তাঁকে শিখিয়ে গেছেন, মানুষের শরীর রজ্জুর ন্যায়, জলে ভেজালে দুর্বল হয়। আমি যখন গীতা পড়তাম বা উর্দু শিখতাম তিনি খুশি হতেন। অন্য রাজবন্দীরা আমাকে স্টালিনের লেখা রাশিয়ান কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাস পাঠিয়েছিলেন। আমি যখন সেটা পড়তাম তখন তিনি মুখ ভার করে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকতেন। বলতেন, কমিউনিস্ট সাহিত্য পড়াটাও পাপ। কারণ, তাঁর মতে, আমাদের জাতীয় আন্দোলনের ও জাতীয় জীবনের এত ক্ষতি আর কোনো মতবাদ করেনি।
তাঁর জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা থেকে অরুণবাবু আমাকে অনেক কিছু বলেছিলেন। অনেক মূল্যবান পরামর্শও দিয়েছিলেন। পরবর্তী জীবনে যাতে আমি হঠাৎ অথবা যথেষ্ট প্রস্তুতির আগে রাজনীতিতে জড়িয়ে না পড়ি, সে-বিষয়ে আমাকে প্রায়ই সাবধান করে দিতেন। বয়সের তফাত থাকলেও জেলের ভেতরে আমাদের মধ্যে এক গভীর স্নেহের বন্ধন গড়ে উঠেছিল। অন্য দিকে আবার পাঞ্জাবের এক নিভৃত গ্রামের এক সরল যুবক ইব্রাহিমের আমার প্রতি কী মমতা! আমার সঙ্গে মাস-চারেক থাকার পরে তার জেলের মেয়াদ পূর্ণ হল এবং ছুটির আদেশ এল। বিদায়ের সময় তার সে কী কান্না!
ফাঁসির মঞ্চের পাশেই থাকার ফলে অন্তত আংশিকভাবে তিনটি ফাঁসি আমি দেখেছি। ফাঁসির দিন ঠিক হলেই আমরা জানতে পারতাম। ফাঁসির আগের দিন শেষ দেখার জন্য আসামীর আত্মীয়-স্বজন আসত। খবর পেতাম যে, আসামীরা সেই সময় স্থির ও অবিচলিত থাকত। ফাঁসির পরে দেহ নেবার সময় জেলগেটের সামনে যে জমায়েত হত, তখনই কেবল খানিকটা শোরগোল শোনা যেত।
দেওয়ালের ওপর থেকে কখনও-কখনও ফাঁসির আসামীরা আমাদের কাছ থেকে সিগারেটের টুকরো চাইত। আমি সিগারেট ধরিয়ে দু-একটা টান দিয়ে দেওয়াল টপকে ফেলে দিতাম। ঐ সামান্য কাজটির জন্য তারা অন্য বন্দীদের মাধ্যমে আমাদের কৃতজ্ঞতা জানাত। এর আগে আমার ধারণাই ছিল না খুনি আসামীরা কী সাহসের সঙ্গে ফাঁসির মঞ্চে ওঠে! ফাঁসির সময় আমি যতটা সম্ভব উঁচু জায়গায় উঠে ব্যাপারটা দেখবার চেষ্টা করতাম। প্রথমে একটা আওয়াজ, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জোর গলায় ‘ইয়া আল্লাহ’ বলে চিৎকার, শেষে ফাঁসির দড়িটার কাঁপুনি দেখতে পেতাম। পরেই কিছুক্ষণের জন্য নিস্তব্ধতা।
ফাঁসির পরে সুপারিনটেনডেন্টসাহেব, সিভিল সার্জেনকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের একবার দেখে যেতেন। তাঁদের মুখে বিশেষ কোনো অভিব্যক্তি দেখতে পেতাম না। ভাবতাম এই যে আমরা প্রাণের বদলে প্রাণ নিচ্ছি, এই অধিকার আমরা কোথা থেকে পেলাম।
৬৪
১৯৪৫-এর মার্চ থেকে আগস্ট। জেলে বসে বসে খবরের কাগজ পড়ে বুঝতেই পারছিলাম, বর্মায় প্রথমে চিনদউইন ও পরে ইরাবতী নদীর তীর বরাবর প্রচণ্ড লড়াই চলছে। ব্রিটিশ ফৌজ আমেরিকানদের সাহায্যে এগিয়ে চলেছে ও জাপানিরা হটে যাচ্ছে। তখন অবশ্য জানতে পারিনি যে, আজাদ হিন্দ ফৌজ বীর বিক্রমে ঐ লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করেছে, হাজার-হাজার আজাদি সৈনিক প্রাণ দিয়েছে। হাজার-হাজার যুদ্ধবন্দীও হয়েছে। দেশের খবরের কাগজে রাঙাকাকাবাবু বা আজাদ হিন্দ ফৌজের নামগন্ধও থাকত না। ইংরেজ সরকার খুব সাফল্যের সঙ্গে ভারতের জনগণের কাছ থেকে এত বড় একটা মুক্তি অভিযানের খবর লুকিয়ে রাখতে পেরেছিলেন।
হঠাৎ একদিন পত্রিকায় রাঙাকাকাবাবুর একটি অর্ডার অব দি ডে-র একটা অংশ রয়টার সংবাদ সংস্থার সৌজন্যে ছাপা হল। উদ্দেশ্য অবশ্যই ছিল লোককে বোঝানো যে, সুভাষচন্দ্র বসু হার স্বীকার করে নিয়েছেন। রাঙাকাকাবাবুর কথাগুলি ছিল—
Comrades: At this critical hour, I have only one word of command to give you, and that is, that if you have to go down temporarily, then go down fighting with the National Tricolour held aloft; go down as heroes go down upholding the highest code of honour and discipline…
আসলে কিন্তু কথাগুলির মানে ছিল অন্য। আর একটি খবর আমাদের মধ্যে বেশ সাড়া জাগিয়েছিল। পণ্ডিত জওহরলাল জেল থেকে মুক্তি পাবার পর বললেন যে, তিনি খবর পেয়েছেন পূর্ব-এশিয়ার ভারতীয়রা সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বে একটি ফৌজ গঠন করেছিলেন, ফৌজটি জাপানিদের পাশাপাশি লড়েছিল। তাঁদের মধ্যে অনেকেই ইংরেজদের হাতে বন্দী হয়েছেন! জওহরলাল বললেন যে, ঐ সব যুদ্ধবন্দীদের উপর খারাপ ব্যবহার করা চলবে না।
১৯৪৫-এর জুলাই-আগস্ট মাস আমরা খুবই চিন্তার মধ্যে কাটিয়েছিলাম। রাঙাকাকাবাবু শেষ পর্যন্ত কী করবেন, আজাদ হিন্দ ফৌজ কী করবে, আমাদের ভবিষ্যৎই বা কী হবে—এই সব প্রশ্ন নিয়ে অরুণবাবু ও আমি ক্রমাগতই আলোচনা করতাম। প্রচণ্ড বিপর্যয়ের মধ্যেও রাঙাকাকাবাবু যে ঠিক একটা রাস্তা বের করবেন, এ-বিষয়ে কিন্তু আমাদের কোনো সন্দেহ ছিল না।
তারপর হঠাৎ একদিন নাগাসাকি ও হিরোসিমার উপর অ্যাটম বোমা ফেলার খবর এল। মানবজাতির ইতিহাসে এত বড় নিষ্ঠুর ও ধ্বংসের খেলা যে আর হয়নি—সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ রইল না। দিন-কতকের মধ্যেই এল জাপানের আত্মসমর্পণের খবর। এর আগেই রাশিয়া জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল।
জাপানের আত্মসমর্পণের দিন সূর্যাস্তের সময় দেখলাম, প্রবীণ বন্দী বাবা গুরুদিৎ সিং আমাদের ইয়ার্ডের গেটের ওপারে দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে দেখে বললেন, ভাবছি সুভাষ এখন কী করবে। তার পক্ষে তো এক চরম সংকটের দিন এসে পড়েছে।
.
শুক্রবার ২৪ আগস্ট দুপুরে আমি স্নান করে এসে শুনলাম যে, সুপারিনটেনডেন্ট সাহেব খবরের কাগজ হাতে করে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। আমাকে না পেয়ে ফিরে গেছেন, কিছুক্ষণ পরে আবার আসবেন বলে গেছেন। অরুণবাবু আমার দিকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন, কিছু বললেন না। একটু পরেই বড়সাহেব আবার হাজির হলেন। বললেন, সকালের কাগজে একটা খবর পড়ে কাগজটা তোমাকে আর পাঠাইনি। ভাবলাম নিজেই তোমার কাছে আসব ও আমার কর্তব্য করব। আই অ্যাম রিয়ালি ভেরি ভেরি সরি, তোমার কাকার সম্বন্ধে খুব খারাপ খবর আছে, এই দেখ কী লিখেছে। এই চরম দুঃখের দিনে আমরা সকলে তোমাকে সমবেদনা জানাচ্ছি।
.
ছবিসুদ্ধ খবর—ফরমোসোয় সুভাষচন্দ্র বসু এক বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন।
কিছুক্ষণের জন্য যেন সব কিছু থেমে গেল। ট্রিবিউন পত্রিকাটি হাতে নিয়ে নিজের সেলের ভিতরে গিয়ে বসলাম। অরুণ সেন মহাশয় একটু পরে এসে আমার মুখোমুখি বসলেন। মিনিট-কয়েক কোনো কথাবার্তা নেই। কেবল পরস্পরের দিকে চেয়ে থাকা। অরুণবাবু আমার দিকে কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে থাকার পরে বলে উঠলেন, বাট দিস ইজ নট ট্রু। চমকে উঠলাম। তাই তো, এটা তো সত্যি নাও হতে পারে!
সপ্তাহের শেষ, চিঠির কোটা ফুরিয়ে গেছে। বাড়িতে লিখবই বা কী! সোমবার মাকে চিঠি লিখলাম।
এর পরেও মাস-খানেক জেলে ছিলাম। গুজব চলছিল যে, এবার আমাদের বোধহয় ছেড়ে দেবে। কিন্তু একদিন আমাদের সহবন্দী তারাচাঁদ গুপ্ত চুপি-চুপি আমাকে বললেন, তোমার কেসটা কিন্তু ভাল নয়, বোধহয় ছাড়বে না। তোমার সম্বন্ধে বাংলার গোয়েন্দা দফতরের একটা রিপোর্ট লাহোর ফোর্টে না গিয়ে ভুল করে এই জেলের অফিসে চলে এসেছিল। সেটা আমি দেখেছি। তাতে তোমাকে বিপজ্জনক লোক বলা হয়েছে, এবং অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য বন্দী করে রাখার সুপারিশ করা হয়েছে।
রাঙাকাকাবাবুর মৃত্যুর খবরটা সত্যি বা সত্যি নয়—এই নিয়ে আমরা দু’জনে ক্রমাগতই নানারকম জল্পনা-কল্পনা করতে লাগলাম। আমার কিন্তু কেবলই বাবার কথা মনে হত। শুনেছি, পুত্রশোকের চেয়ে মর্মান্তিক আর কিছু নেই। বাবার কাছে এটা তো পুত্রশোকের চেয়েও বড় আঘাত। রাঙাকাকাবাবু ছিলেন তাঁর চোখের মণি। তিনি বুক ফুলিয়ে বলতেন, লিখেও গেছেন, যে ছোট্ট ‘কুকা’কে তিনি ছেলেবেলায় কোলে করে নিয়ে বেড়িয়েছেন, সে তাঁর সব আশা, সব স্বপ্ন পূর্ণ করল। হয়ে উঠল এক মহান কর্মযোগী। ভাবলাম, সুদূর দক্ষিণ ভারতের বন্দিশালায় বাবা আজ কত নিঃসঙ্গ। অনেক পরে তাঁর ডায়েরির পাতা ওলটাতে-ওলটাতে ১৯৪৫ সালের ২৫ আগস্ট তারিখের লেখায় তাঁর গভীর মর্মবেদনার কথা খুঁজে পেয়েছিলাম। তিনি লিখছেন, মঙ্গলময়ী মা রুদ্রাণীর রূপ নিলেন কেন? এত বড় এত নিষ্ঠুর আঘাত কেন তিনি হানলেন! আমাদের আরও কত দিতে হবে, আরও কত বলিদানের প্রয়োজন হবে দেশমাতৃকার শৃঙ্খল মোচনের জন্য? মা ভগবতীর ইচ্ছা মা-ই জানেন! আরও লিখেছেন, কদিন আগেই তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন সুভাষ তাঁর বন্দিশালার বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে এবং আকৃতিতে তাঁকে বিরাট দেখাচ্ছে। বাবা তাঁর মুখ দেখবার জন্য লাফিয়ে উঠলেন, কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে সে কোথায় মিলিয়ে গেল!
১৯৪৫-এর ১৩ সেপ্টেম্বর ভারত সরকারের পক্ষ থেকে এই মর্মে এক বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা হল :
With the effective surrender of the Japanese in Singapore, it has become unnecessary to keep any longer in custody a number of persons, including Mr. Sarat Chandra Bose and certain members of his family, who had been detained by order of the Central Government to prevent them from acting in a manner prejudicial to the defence of British India and the efficient prosecution of the war.
এবার যে মুক্তি পাব ধরেই নিলাম। কিন্তু আমার মুক্তির আদেশটা লায়ালপুরে পৌঁছতে দু’দিন দেরি হল। শেষ পর্যন্ত অরুণবাবু ও আমাকে একসঙ্গেই ছেড়ে দেওয়ার আদেশ এল। জীবনে এক অধ্যায় শেষ হল।