বসু-বাড়ি – ২৫

২৫

১৯৩৭-৩৮ সালে গান্ধীজি ও জওহরলাল তো কলকাতায় আমাদের বাড়িতে থাকতেন। তা ছাড়া সেই সময় দেশের অন্যান্য বড় বড় নেতাদেরও বেশ কাছ থেকে দেখা যেত। এ-সুযোগ কে ছাড়তে চায়। ১৯৩৭-এর কলকাতায় নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির সভায় একটা প্রধান আকর্ষণ ছিল মঞ্চে একসাথে জওহরলাল ও সুভাষচন্দ্রের উপস্থিতি। অটোগ্রাফ সংগ্রহের জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে যেত। জওহরলাল ও রাঙাকাকাবাবুকে ঠিক সময়ে ধরতে পারলে অটোগ্রাফ পেতে বিশেষ অসুবিধা হত না। 

গান্ধীজির বেলায় কিন্তু নিয়ম ছিল একেবারে অন্যরকম। পাঁচটা টাকা অটোগ্রাফের খাতার ভিতরে গুঁজে দিয়ে তবেই জমা দিতে হত, রোজই অটোগ্রাফের বইয়ের স্তূপ ঘরের এককোনায় দেখা যেত। এই ভাবে গান্ধীজি হরিজন ফাণ্ডের জন্য টাকা তুলতেন। দৰ্শন করতে এসে অনেক মহিলাও গয়না খুলে গান্ধীজির হাতে সমর্পণ করে যেতেন। কোনো কোনো অটোগ্রাফপ্রার্থী আবদার করতেন যে, ইংরেজি অক্ষরে গান্ধীজির সই চাই। এ-সব ক্ষেত্রে বিশেষ আরজির প্রয়োজন হত। মনে আছে, একদিন বিশেষ কোনো অটোগ্রাফপ্রার্থীর হয়ে সাহস করে ওঁর কাছে গিয়ে বললাম যে, তিনি যেন দয়া করে দেবনাগরীতে না লিখে ইংরেজিতে সই করে দেন। নাকের ডগায় চশমার উপর দিয়ে কিছুক্ষণ আমার দিকে চেয়ে রইলেন গান্ধীজি, তারপর মুচকি হেসে বললেন যে, সেবারকার মতো তিনি ইংরেজিতে সই করে দিচ্ছেন, কিন্তু ‘ইফ এনিবডি এল্স এগেন আসক্স্ ফর অ্যান অটোগ্রাফ ইন ইংলিশ, প্লীজ টেল হিম্ দ্যাট দি চার্জ ইজ টেন রুপিজ, অ্যাণ্ড নট ফাইভ।’ 

লক্ষ করার বিষয় যে, দেশের কাজে দেশবাসীর কাছে কোনো দাবি রাখতে মহাত্মা গান্ধীর দ্বিধা ছিল না। পরে যেমন আজাদ হিন্দ আন্দোলনের সময় রাঙাকাকাবাবু পূর্ব-এশিয়ার ভারতীয়দের কাছে দেশের মুক্তির জন্য সর্বস্ব দাবি করেছিলেন—সব ত্যাগ করে ফকির হতে বলেছিলেন। 

আগেই তো বলেছি, যতই গান্ধীজিকে কাছ থেকে দেখতে লাগলাম, ওঁর অসাধারণত্ব ততই প্রকট হতে লাগল। কেবল অসাধারণত্ব নয়, অভিনবত্বও বটে। ব্যক্তিগত বা জাতীয় জীবনে তিনি কোনো কিছুই পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করে গ্রহণ করতে রাজি ছিলেন না। চিকিৎসার ব্যাপারে তিনি সোজাসুজি ডাক্তার বিধান রায় বা নতুনকাকাবাবু ডাক্তার সুনীল বসুকে বলে দিতেন যে, পাশ্চাত্ত্যের চিকিৎসা-পদ্ধতি তাঁর কাছে গ্রাহ্য নয়। বেশি রসুন খাওয়া নিয়ে আপত্তি করলে জবাব দিতেন যে, তিনি পরীক্ষা করে দেখেছেন সেটা তাঁর পক্ষে ভাল, তাঁর ব্লাড প্রেশার ঠিক রাখে। গঙ্গার ঘাট থেকে মাটি আনিয়ে কাপড়ের মধ্যে পুরু করে প্রলেপ তৈরি করে কপালে ও পেটের উপর রেখে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুয়ে থাকতেন। বড় বড় ডাক্তারেরা হাঁ করে দেখতেন। অন্যদিকে আবার কয়েকটি ব্যাপারে তিনি বৈজ্ঞানিক রীতিনীতিও মেনে চলতেন। যেমন, তাঁর জন্য আনা শাকসব্জি জীবাণুমুক্ত করার জন্য পোটাশিয়াম পারমাঙ্গানেট মেশানো জলে ভিজিয়ে রাখা হত। শরীর ভাল রাখার জন্য তিনি একটি বিখ্যাত জার্মান কোম্পানির গ্লুকোজ খেতেন। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে তিনি খুবই কড়াকড়ি করতেন। বাবা গান্ধীজির জন্য রাতারাতি তাঁর ঘরের পাশের বাথরুমে বিশেষ কয়েকটি ব্যবস্থা করিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু বাথরুম পরিষ্কার রাখার ভার গান্ধীজি কাউকে ছাড়বেন না। গৃহস্বামী যতই বিব্রত হোন না কেন, নিজের বাথরুম গান্ধীজি নিজের হাতে পরিষ্কার করবেনই। 

গান্ধীজির খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থাদি করতেন আমার মা ও বোন গীতা। যোগাড় দিতেন আমাদের মাসতুতো দাদা রবীন্দ্রকুমার ঘোষ, যাঁকে সকলেই ‘ডাঁটিদা’ বলে জানত। ডাঁটিদা গান্ধীজির জন্য কলকাতার বাজার তোলপাড় করে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট যা আছে এনে হাজির করতেন। এ-ব্যাপারে কেউ কোনো সমালোচনা করলে ডাঁটিদা বড়ই দুঃখ পেতেন। জানতে পারলে গান্ধীজি কিন্তু ডাঁটিদার পক্ষে এগিয়ে আসতেন। বলতেন, “রবিবাবু আমার জন্য বাজারের সেরা জিনিস আনেন।” তাঁর সম্বন্ধে যে-কেউ কিছু ভাল বললেই ডাঁটিদা একেবারে অভিভূত হয়ে পড়তেন, চোখে জল এসে পড়ত। এই সূত্রে ডাঁটিদা সম্বন্ধে আরও কিছু বলি। এমন প্রাণখোলা পরোপকারী মানুষ সচরাচর দেখা যায় না। বিশেষ করে গান্ধীজি আমাদের বাড়িতে আসার সময় থেকে বাবা মা ও আমাদের সঙ্গে তাঁর বিশেষ প্রীতির সম্পর্ক গড়ে ওঠে, মাত্র কয়েক বছর আগে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত সেটা বজায় ছিল। মনে হত যেন কেবল অন্যের কাজ হাসিমুখে করবার জন্যই বিধাতাপুরুষ ডাঁটিদাকে এ-জগতে পাঠিয়েছিলেন। সেই থেকে সুদিনে ও দুর্দিনে উডবার্ন পার্কের বাড়িতে তিনি প্রায় রোজই আসতেন; যেমন সব রকম কাজের ভার নিজে থেকেই নিতেন, তেমনি জমিয়ে আড্ডাও দিতেন। বাবা তাঁকে ডাকতেন ‘ডাঁটি-মহারাজ’ বলে, বাবার প্রতি আনুগত্যে তাঁর কোনোদিন হেরফের হয়নি। যুদ্ধের সময় যখন আমি সুদূর পাঞ্জাবে বন্দী, তখন মার কাছে লুকিয়ে একটি চিঠি পাঠাবার সময় আমি ডাঁটিদার ঠিকানা ব্যবহার করার কথা ভেবেছিলাম। নেতাজী রিসার্চ ব্যুরোর কাজে তিনি শেষদিন পর্যন্ত তাঁর অকুণ্ঠ ও সহৃদয় সাহায্য দিয়ে গেছেন। 

কলকাতায় গান্ধীজির অন্যান্য কাজের মধ্যে একটা বিশেষ কাজ ছিল। বাংলার রাজবন্দীদের নিয়ে ব্রিটিশ সরকার বড়ই বেগ দিত। কংগ্রেসের সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক সমঝোতা হলে তারা অহিংস সত্যাগ্রহী বন্দীদের মুক্তি দিলেও বাংলার বিপ্লবী রাজবন্দীদের সহজে ছাড়তে চাইত না। এ-বিষয়ে রাঙাকাকাবাবুর মনোভাব ছিল খুব কঠিন ও পরিষ্কার। তাঁর মত ছিল যে, যখনই যুদ্ধবিরতি হবে, সব রাজবন্দীকে মুক্তি দিতে হবে, হিংসা-অহিংসার অজুহাত দিয়ে এই নীতির ব্যতিক্রম করা চলবে না। ব্রিটিশ সরকারের উপর এই ব্যাপারে চাপ সৃষ্টি করার জন্য তিনি গান্ধীজির সহযোগিতা চান। গান্ধীজি কলকাতায় এসে একদিকে ইংরেজ গভর্নরের সঙ্গে কথা বলছিলেন, অন্যদিকে জেলে গিয়ে আমাদের বিপ্লবী বন্দীদের সঙ্গে দেখা করছিলেন। গান্ধীজির ও বাবা-রাঙাকাকাবাবুর এ-ব্যাপারে কাজের ধারাটা ঠিক একরকম না হলেও, উদ্দেশ্য ছিল এক। শেষ পর্যন্ত সমস্যার একটা সুরাহা হয়, বেশির ভাগ বন্দী মুক্তি পান, এবং তাঁরা কংগ্রেসে সামিল হয়ে জাতীয় আন্দোলনে আত্মনিয়োগ করেন। 

.

১ নং উডবার্ন পার্কে আমাদের বাড়িতে দুই মহামানবের মিলন হয়েছিল দু’বার। গান্ধীজি ও রবীন্দ্রনাথ। একবার আমি তো সাক্ষীই ছিলাম, অন্যবার একটা বিপদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ গান্ধীজিকে দেখতে ছুটে এসেছিলেন। একদিন সন্ধ্যার দিকে হঠাৎ খবর এল, রবীন্দ্রনাথ আমাদের বাড়িতে গান্ধীজির সঙ্গে দেখা করতে আসছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পড়লেন। রবীন্দ্রনাথ উপরে উঠতে পারবেন না। গান্ধীজি তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলেন। একতলায় যে-ঘরটা পণ্ডিতজির ঘর বলে চিহ্নিত ছিল, সেই ঘরে দুজনের দেখা হল। যাবার সময় হলে গান্ধীজি নিজের হাতে করে রবীন্দ্রনাথের চটিজোড়া এগিয়ে দিলেন। রবীন্দ্রনাথ চলে যাবার কয়েক মিনিটের মধ্যেই হন্তদন্ত হয়ে ক্যামেরা-ট্যামেরা নিয়ে সাংবাদিকরা এসে পড়লেন, কিন্তু একটু দেরি হয়ে গেল। 

অন্যবার যখন রবীন্দ্রনাথ আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন, তখন গান্ধীজি খুবই অসুস্থ, রক্তের চাপ অসম্ভব রকম বেড়ে গিয়েছিল। সারা বাড়ি থমথম করছে। বাবা, রাঙাকাকাবাবু, জওহরলাল চিন্তায় আকুল। ডাক্তার রায় ও নতুনকাকাবাবু অস্থির হয়ে যা করতে পারেন করছেন। গান্ধীজি তখন দোতালায় বাবার ঘরে রয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ গান্ধীজিকে দেখতে আসতে চাইলেন। এবার তাঁকে চেয়ারে করে উপরে তুলতে হল। চেয়ার বহন করলেন সুভাষচন্দ্র বসু, জওহরলাল নেহরু, শরৎচন্দ্র বসু ও মহাদেব দেশাই। 

২৬

১৯৩৭-এর মাঝামাঝি থেকেই কানাঘুষো শোনা যাচ্ছিল যে, রাঙাকাকাবাবু সম্ভবত ১৯৩৮-এ কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হবেন। অক্টোবরে জওহরলালের সভাপতিত্বে অল্ ইণ্ডিয়া কংগ্রেস কমিটির অধিবেশনের পর এবং গান্ধীজি কলকাতায় ঘুরে যাবার পর গুজবটা জোরদার হল। রাঙাকাকাবাবু সেই সময় ইউরোপে ও দেশের কোনো কোনো বন্ধুর ব্যক্তিগত চিঠিপত্রে এই মর্মে আভাস দিচ্ছিলেন। সেকালে কংগ্রেসের সভাপতির পদের গুরুত্ব আজকালকার ছেলেমেয়েদের পক্ষে অনুমান করা শক্ত। কংগ্রেসের সভাপতিকে তখন ‘রাষ্ট্রপতি’ বলা হত। স্বাধীনতাকামী কোটি-কোটি ভারতবাসীর কাছে তিনিই হতেন আমাদের জাতীয়তার প্রতিভূ ও আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। ভারতের বাইরেও ভারতপ্রেমী বিদেশী বন্ধুদের কাছে এর গুরুত্ব কম ছিল না। পুরনো চিঠিপত্র দেখছি, রাঙাকাকাবাবু কংগ্রেসের প্রধান হবার সম্ভাবনায় তাঁরা খুবই আনন্দিত হচ্ছেন। এটা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ যে, এই সম্ভাবনার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৩৭ সালের শেষে রাঙাকাকাবাবু অল্প সময়ের জন্য হলেও ইউরোপ সফরে যান। 

ঐ ইউরোপ ভ্রমণ মাত্র কয়েক সপ্তাহের জন্য হলেও নানা দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। প্রথমত, রাঙাকাকাবাবু নিজের চোখে ইউরোপের রাজনীতির চেহারাটা একবার দেখে নিলেন। দ্বিতীয়ত, ইউরোপে ও পরে ইংল্যাণ্ডে বেশ কিছু রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে তাঁর আলাপ-আলোচনা হয়। তৃতীয়ত, ১৯৩৭ সালের মাঝামাঝি থেকেই তিনি আত্মজীবনী লেখার পরিকল্পনা করছিলেন। ইংল্যাণ্ডের এক নামকরা প্রকাশন-সংস্থার সঙ্গে ব‍ই প্রকাশ করার চুক্তির মূল কপি আমাদের কাছে রয়েছে। তাতে দেখছি, প্রকাশক আত্মজীবনীর সম্পূর্ণ পাণ্ডুলিপি ১৯৩৭-এর নভেম্বরের মধ্যে চাইছেন। নানা কাজের মধ্যে যে রাঙাকাকাবাবু চুক্তি অনুযায়ী লেখা শেষ করতে পারেননি তা তো বোঝাই যাচ্ছে। 

.

ঝড়ের মতো যাঁদের জীবনের গতি, লেখালেখির কাজ ভাল করে করতে হলে দেখছি হয় তাঁদের জেলে যেতে হয়, নয়তো নির্বাসনে। ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৬ পর্যন্ত যদি রাঙাকাকাবাবু ইউরোপে নির্বাসনে না থাকতেন, তাহলে ‘দি ইণ্ডিয়ান স্ট্রাগল’ লেখা হত কিনা সন্দেহ। কী হুড়োহুড়ির মধ্যে তিনি লেখার কাজ করতেন, তার দুটো বড় দৃষ্টান্ত দিতে পারি। হরিপুরা কংগ্রেসের সভাপতির ভাষণ রাঙাকাকাবাবু দুদিনের মধ্যে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত একটানা লিখেছিলেন। দৃশ্যটি মনে আছে। তিনি এলগিন রোডের বাড়িতে তাঁর ঘরে বসে পাতার পর পাতা লিখে চলেছেন। দু-এক পাতা লেখা হলেই একজন দৌড়ে সেটা উডবার্ন পার্কের বাড়িতে পৌঁছে দিচ্ছে। উডবার্ন পার্কে টাইপ করা হচ্ছে, টাইপ করা হলে বাবার সেক্রেটারি নীরদ চৌধুরী মহাশয় সেটা মিলিয়ে দেখে দিচ্ছেন। তারপর আর-একজন দৌড়ে সেটা প্রেসে পৌঁছে দিচ্ছে। হরিপুরার পথে রওনা হবার ঘণ্টাখানেক আগে পর্যন্ত রাঙাকাকাবাবু তাঁর ভাষণ লিখছিলেন। নিজে ফিরে একবার পড়বার বা শোধরাবার কোনো সময় তিনি পাননি। তাঁর সঙ্গে ভাষণের ছাপা কপি দেওয়া সম্ভব হয়নি। সারা রাত এবং পরের দিন পুরোদমে প্রেসের কাজ চালিয়ে, বই বাঁধিয়ে পরের দিন রাতের ট্রেনে পাঠানো হয়। আজাদ হিন্দ সরকারের ঐতিহাসিক ঘোষণাপত্রটিও রাঙাকাকাবাবু সিঙ্গাপুরে একটা পুরো রাত জেগে লিখেছিলেন। ২১শে অক্টোবর সরকার ঘোষণা হবে, কিন্তু ১৯শে পর্যন্ত ঘোষণাপত্রটি লেখা হয়নি। ১৯শে রাত বারোটায় শুরু করে ২০শে ভোর ছটা পর্যন্ত কালো কফিতে চুমুক দিতে-দিতে একটানা লিখে গেলেন। দু-একখানা পাতা লেখা হচ্ছে, আর আবিদ হাসান বা এন. জি. স্বামী পাশের ঘরে এস্. এ. আয়ারের হাতে পৌঁছে দিচ্ছেন। আয়ার টাইপ করে চলেছেন। টাইপ করা হবার পর বিন্দু-বিসর্গও বদলাতে হয়নি। যেমন আমরা দেখেছিলাম হরিপুরা ভাষণের বেলায়। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে দুটি অতি মূল্যবান ও স্মরণীয় দলিল এই ভাবে ঝড়ের বেগে লেখা হয়েছিল। 

আত্মজীবনী তো একরাতে লেখা যায় না। ১৯৩৭-এর ডিসেম্বরের ইউরোপ যাত্রায় তিনি প্রথমেই গেলেন অস্ট্রিয়ায় তাঁর প্রিয় স্বাস্থ্যনিবাস বাদগাস্টাইনে। সেখানে শ্রীমতী এমিলিয়ের সাহায্যে দিন দশেক ইংরাজিতে আত্মজীবনীর দশটি পরিচ্ছেদ লিখলেন। জন্ম থেকে আই. সি. এস. থেকে পদত্যাগ পর্যন্ত তিনটি খাতায় লেখা হল। এখানে উল্লেখ করতে পারি যে, রাঙাকাকাবাবুর গুরুত্বপূর্ণ অনেক চিঠি বা প্রবন্ধ পেনসিলে লেখা, এটিও তাই। সেজন্য সংরক্ষণের কাজে নেতাজী রিসার্চ ব্যুরোতে আমাদের বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। 

আত্মজীবনীতে রাঙাকাকাবাবু বসুবাড়ির সাতাশ পুরুষ পর্যন্ত পারিবারিক ইতিহাস সংক্ষেপে বর্ণনা করেছেন। এর আগে আমরা আমাদের পূর্বপুরুষ ও তাঁদের জীবন ও কার্যাবলী সম্বন্ধে বিশেষ ঔৎসুক্য প্রকাশ করিনি। জানতামও খুব কম। আমাদের গোষ্ঠীর বা পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন দশরথ বসু। তাঁর চার পুরুষ পরে মুক্তি বসু কলকাতার চোদ্দ মাইল দক্ষিণে মাহীনগর গ্রামে গিয়ে বসবাস আরম্ভ করেন। সেই থেকে আমরা মাহীনগরের বসু-পরিবার বলে খ্যাত। দশরথের এগারো পুরুষ পর থেকে বসু-পরিবার জনজীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। মহীপতি বসু সেই সময় বাংলার অর্থ ও যুদ্ধমন্ত্রী নিযুক্ত হন। মহীপতির নাতি গোপীনাথ আরও এগিয়ে যান এবং তৎকালীন বাংলার অধিপতি সুলতান হুসেন শাহের অর্থমন্ত্রী ও নৌ-সেনাপতি নিযুক্ত হন। সুলতান তাঁকে ‘পুরন্দর খাঁ উপাধি দেন এবং মাহীনগরের কাছেই পুরন্দরপুর বলে যে একটা গ্রাম আছে সেটা তাঁরই জায়গির। পুরন্দরের বাগানই এখন হয়েছে মালঞ্চ গ্রাম। এই মালঞ্চে দাদাভাইয়ের বেশ একটা প্রকাণ্ড বাগান ছিল। পুজোর সময় ছেলেবেলায় আমরা যখন দল বেঁধে দেশে যেতাম, সেই সময় রাঙাকাকাবাবুকে এই বাগানের পুকুরে সাঁতার কাটতে দেখেছি। 

দুশো বছর আগে মাহীনগরের কাছ দিয়েই হুগলী নদী বইত। কিন্তু নদীর গতি ধীরে-ধীরে সরে যাওয়ায় মাহীনগর ও আশপাশের গ্রামগুলিতে মহামারী দেখা দেয় এবং গ্রামবাসীরা এদিক-ওদিক ছড়িয়ে পড়েন। রসুবাড়ির একটি শাখা পুরন্দরের বংশধরেরা কাছেই কোদালিয়া গ্রামে বসবাস শুরু করেন। আমরা কোদালিয়াকেই আমাদের গ্রাম বলে জেনে এসেছি। গ্রামের নামের বেশ একটা ইতিহাস আছে। পুরন্দর বা গোপীনাথ বসু প্রগতিবাদী ছিলেন। জাত, কুল ইত্যাদি সম্বন্ধে সামাজিক নিয়ম ও বিধিগুলি পরিবর্তন করার জন্য তিনি এক বিরাট সম্মেলন ডেকেছিলেন, যাতে নাকি এক লক্ষেরও বেশি লোক যোগ দিয়েছিলেন। ঐ বিরাট সমাবেশে জল সরবরাহের জন্য অনেক লোক লাগিয়ে তিনি লম্বা একটা পুকুর বা খাল কাটিয়েছিলেন। কাজের পর মজুরেরা তাদের কোদালগুলি যেখানে জড় করে রাখতেন, সেখানেই কোদালিয়া গ্রামটি গড়ে ওঠে। 

যাই হোক, রাঙাকাকাবাবু তাঁর আত্মজীবনী সম্পূর্ণ করবার সময় পেলেন না, এবং লণ্ডন থেকে বই প্রকাশের পরিকল্পনা ভেস্তে গেল। ১৯৩৮-এর জানুয়ারি প্রথমে তিনি লণ্ডনে পৌঁছলেন। সেখানেই খবর পেলেন যে, তিনি কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। লণ্ডনে দেশী বিদেশী বহু লোকের সঙ্গে তাঁর আলাপ-আলোচনা হয়। বেশ কয়েকটি সভায় তিনি বক্তৃতা করেন। একটি সভায় বন্ধুভাবাপন্ন ব্রিটিশ লেবার পার্টির নেতৃস্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তিও উপস্থিত ছিলেন। রাঙাকাকাবাবু তাঁদের স্পষ্ট করে বলে দিয়েছিলেন যে, আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রামে ইংল্যাণ্ডের কোনো রাজনৈতিক দলের কোনো সাহায্য তিনি প্রত্যাশা করেন না, লড়াই করেই আমরা আমাদের স্বাধীনতা অর্জন করব। সেই সময় কোনো কূটনৈতিক আলোচনার জন্য আয়াল্যাণ্ডের নেতা ডি· ভ্যালেরা লণ্ডনে ছিলেন, তাঁর সঙ্গেও রাঙাকাকাবাবুর দেখা হয়। ফেরার পথে ইটালির রাষ্ট্রনায়ক মুসোলিনির সঙ্গেও তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছিল। 

ইউরোপ রওনা হবার সময় বসু-বাড়ির একটা বিরাট দল দমদম বিমান ঘাঁটিতে তাঁকে বিদায় জানাতে গিয়েছিল। মাসখানেক পরে কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হয়ে তিনি যেদিন ফিরলেন, সেদিন দমদমে খুব ভিড়। তাঁকে দেখে মনে হল, অল্পদিনের ঐ ইউরোপ সফরে তাঁর স্বাস্থ্যের বেশ উন্নতি হয়েছে—সবল, সুঠাম দেহ, গায়ের রঙ যেন ফেটে পড়ছে। 

২২

বাড়ির কেউ বিশেষ কোনো সম্মান বা জীবনে বড় রকমের প্রতিষ্ঠা লাভ করলে পরিবারে, বন্ধুবান্ধব ও সহকর্মীদের মধ্যে নানা রকম প্রতিক্রিয়া হয়। প্রতিক্রিয়াগুলি যদি আমি বিশ্লেষণ করে দেখি তাহলে ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতির মানুষের মনের ও চরিত্রের একটা ছবি বেশ ফুটে ওঠে। বসুবাড়িও ব্যতিক্রম ছিল না। 

বলাই বাহুল্য, রাঙাকাকাবাবু কংগ্রেসের সভাপতি হওয়ার ফলে সামগ্রিকভাবে বসুবাড়ির ছোটবড় সকলেরই মর্যাদা বেড়ে গেল এবং সকলেই বেশ গৌরব বোধ করলেন। তবে আমার মনে হয় রাঙাকাকাবাবু ‘রাষ্ট্রপতি’ হবার আগে পর্যন্ত বসুবাড়ির মধ্যমণি ছিলেন না। অনেকেই তাঁকে দূর থেকে দেখতেন বা দূরত্ব রেখে চলতেন, এমনও কেউ কেউ ছিলেন যাঁরা ফিরেও তাকাতেন না। এখন থেকে কিন্তু রাঙাকাকাবাবুকে ঘিরেই বসুবাড়ি চলতে লাগল। সবাই তাঁকে ঘিরে দাঁড়ালেন। মাজননীর ইচ্ছায় তিনি অনেকদিন পরে এলগিন রোডের সাবেক বাড়িতে বসবাস আরম্ভ করলেন। দাদাভাইয়ের শোবার ঘরটি তাঁর জন্য বরাদ্দ হল। বাড়ির অনেক ব্যবস্থা পালটাতে হল। কারণ সভাপতির তো একটা ভাল অফিস চাই। তাছাড়া রোজ় কত লোক তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসবে, বসবার জায়গা চাই। বাড়ির পেছনের দিকের একটা বড় ঘর খাওয়াদাওয়ার জন্য ব্যবহার করা হত, সেটা আসবাবপত্র গুছিয়ে রাঙাকাকাবাবুর অফিস হল। আজও নেতাজী ভবনে ঘরটি একইভাবে সাজানো আছে। অতিথিদের বসবার জন্য নীচের তলায় একটা ও উপর তলায় একটা ঘর রাখা হল। 

অনেকদিন বাংলা থেকে কেউ কংগ্রেসের সভাপতি হননি। সেই ১৯২২ সালে গয়া কংগ্রেসের সভাপতি হয়েছিলেন দেশবন্ধু দাশ। পরে আইন অমান্য আন্দোলনের সময় কলকাতার এপ্ল্যানেডে বেআইনি কংগ্রেসের একটি বিশেষ ও ক্ষণস্থায়ী অধিবেশনের সভানেত্রীত্ব করেছিলেন যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তের স্ত্রী নেলী সেনগুপ্তা। এতদিন পরে রাঙাকাকাবাবুর এই পদ লাভ করার একটা বিশেষ ও সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য ছিল। এ কথাটা আজ বাংলা দেশে অনেকেই ভুলে গেছেন। প্রথমতঃ, বাংলার জনমানসে সেদিন একটা নতুন আশার সঞ্চার হয়েছিল। দ্বিতীয়ত, বাংলার রাজনীতিতে তখন একটা ছন্নছাড়া ভাব এসেছিল, সেটা কেটে গেল। তৃতীয়ত, বাংলার বিপ্লববাদী রাজনৈতিক কর্মীরা রাঙাকাকাবাবুর মাধ্যমে সর্বভারতীয় রাজনীতিতে খানিকটা প্রতিনিধিত্ব পেলেন। চতুর্থত, ব্যাপারটা ছিল মহাত্মা গান্ধী ও রাঙাকাকাবাবু দুজনের দিক থেকেই একটা ঐতিহাসিক এক্সপেরিমেন্ট। স্বাধীনতা-সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়ে জাতীয় সংগ্রামের দুটি স্রোত যুক্ত করে অগ্রসর হবার চেষ্টা দুদিক থেকেই। করা হয়েছিল। আমি অবশ্য কট্টর ও গোঁড়া সুভাষবিরোধীদের কথা বাদ দিচ্ছি। ১৯৩৮ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত গান্ধী-সুভাষ সম্পর্কের ইতিহাস ও দেশের রাজনীতিতে তার প্রতিক্রিয়া, আমাদের পক্ষে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। কেবল অতীতকে বোঝবার জন্যই আমি একথা বলছি না। আজকের রাজনীতি মূলত সেই সময়কার ঘটনাবলীরই পরিণাম। ঐক্যবদ্ধ ও প্রগতিশীল ভারতবর্ষ গড়ে তুলতে হলে গান্ধীজির গণজাগরণ ও লোকশক্তির পথ এবং সুভাষচন্দ্রের বৈপ্লবিক সংগ্রামী ও বৈজ্ঞানিক মতাদর্শের একটা সমন্বয় ঘটানো যায় না? এ প্রশ্নের উত্তর আজকের যুবসমাজ দিতে পারে। 

একটা অপ্রিয় কথা না বলে পারছি না, যদিও ব্যাপারটা গুটিকতক ব্যক্তির ক্ষেত্রেই খাটে। রাঙাকাকাবাবুর সমসাময়িক কোনো কোনো রাজনীতিবিদ ও বন্ধু তিনি কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ায় বেশ ঈর্ষান্বিত হয়েছিলেন। ব্যক্তিগত ও জনজীবনে মানুষের চরিত্রের এই দুর্বলতা প্রায়ই দেখা দেয়। যাঁরা বড় তাঁরা উদার হয়ে এসব উপেক্ষা করেন। মাজননী, বাবা, মা ও বাড়ির অন্য অনেকে দল বেঁধে রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে হরিপুরায় গিয়েছিলেন। রাঙাকাকাবাবুর খুব ইচ্ছা ছিল যে বাসন্তী দেবীও তাঁর সঙ্গে হরিপুরায় যান। এ বিষয়ে তিনি ঠাকুমাকে একটি মর্মস্পর্শী চিঠি লেখেন, কিন্তু ঠাকুমার যাওয়া হয়ে ওঠেনি। কংগ্রেস খুব জমকালো হয়েছিল। একান্নটি বলদ দিয়ে টানা এক্কাগাড়ি ধরনের একটা সাজানো রথে/ বসিয়ে সভাপতিকে বিরাট শোভাযাত্রা করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। দৃশ্যটি ফিল্মে ধরা আছে এবং আমরা মাঝে মাঝে দেখি। সভাপতির অভিভাষণ রাঙাকাকাবাবু খানিকটা হিন্দিতে পড়েছিলেন। যাঁরা শুনেছিলেন তাঁরা বলেন যে তখনও তিনি ঠেকে ঠেকে হিন্দি বলতেন। অবশ্য আগে থেকেই তিনি হিন্দি শিখতে আরম্ভ করেছিলেন। শেখবার জন্য একজন শিক্ষকও রেখেছিলেন,। অমায়িক, স্বল্পভাষী ঐ পণ্ডিতজি যে কেবল বাড়িতে এসে রাঙাকাকাবাবুকে হিন্দি অভ্যাস করাতেন তাই নয়। রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে তিনি সফরেও যেতেন, যাতে ক্রমাগতই হিন্দি শিক্ষা চলতে পারে। কয়েক মাসের মধ্যেই রাঙাকাকাবাবু হিন্দিভাষা বেশ রপ্ত করে ফেললেন। ক্রমে ক্রমে কথাবার্তায় ও বক্তৃতায় তিনি উর্দু কথা মেশাতে আরম্ভ করলেন। শুনেছি, অন্য কেউ সভায় হিন্দুস্তানি বা উর্দুতে বক্তৃতা করলে রাঙাকাকাবাবু খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতেন এবং নতুন কয়েকটি কথা মনে মনে তুলে নিতেন। পরের সভায় তিনি নিজেই সেই কথাগুলি ব্যবহার করতেন। 

রাঙাকাকাবাবুর হরিপুরা ভাষণ স্কুলকলেজের ছেলেমেয়েদের মনোযোগ দিয়ে পড়া উচিত। ঐ ভাষণে তিনি ইতিহাসের পটভূমিতে ভারতের মুক্তি সংগ্রামের প্রকৃতি, গতি ও লক্ষ্যের একটা পরিষ্কার ছবি তুলে ধরেছিলেন। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি বিজ্ঞানভিত্তিক ও বাস্তবধর্মী। রাজনীতি অর্থনীতি সমাজনীতি সম্বন্ধে কোনো গোঁড়ামি—যা আজ আমরা এত দেখতে পাই—তাঁর মধ্যে ছিল না। দৃষ্টান্তস্বরূপ আমাদের জাতীয় ভাষা সম্বন্ধে তাঁর মতামত বিচার করে দেখলে হয়। তিনি বলেছিলেন যে, হিন্দুস্তানি—হিন্দি ও উর্দুর একটা সহজ সংমিশ্রণ—আমাদের জাতীয় ভাষা হিসাবে গ্রহণ করা উচিত। আরও বলেছিলেন যে, জাতীয় সংহতি ও যোগাযোগের সুবিধার জন্য রোমান বা ল্যাটিন লিপি আমাদের গ্রহণ করা উচিত। 

বসুবাড়ির যাঁরা রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে হরিপুরায় গিয়েছিলেন তাঁরা বেশ আদরযত্ন পেয়েছিলেন। গুজরাটের জীবনযাত্রার ধরন তো অন্য রকম, বিশেষ করে খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে। তা সত্ত্বেও দেশের যেখানেই যাই না কেন, বুঝতে পারি কেমন একটা মূলগত ঐক্যের বাঁধনে আমরা ভারতবাসীরা একসূত্রে বাঁধা। আর-একটা বড় কথা হল, গান্ধীজির ইচ্ছায় ও নির্দেশে বার্ষিক অধিবেশনগুলি গ্রামে করার নীতি কংগ্রেস সবেমাত্র গ্রহণ করেছে। যেটা কদিন আগেও একটা ছোট্ট গ্রাম ছিল, সেখানে অত বড় সম্মেলনের ও জনসমাবেশের জন্য সবরকম ব্যবস্থা দেখে আমাদের বাড়ির সকলেই খুব আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলেন। 

শুনেছি, হরিপুরায় রাষ্ট্রপতির মা, আমাদের মাজননীর বিনয় ও স্বভাবিকতা সকলকে মুগ্ধ করেছিল। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়টা তো ছিল ত্যাগ ও সেবার যুগ। নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে দম্ভের অভিব্যক্তি ছিল কম। 

হরিপুরা কংগ্রেসের পর রাঙাকাকাবাবু মাজননী ও বাড়ির অন্যান্য কয়েকজনকে নিয়ে বোম্বাই যান। সেই সূত্রে বোম্বাইয়ে এক গুজরাটি দম্পতি নাথালাল পারিখ ও তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে বসুবাড়ির বেশ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তাঁদের বাড়িতেই রাঙাকাকাবাবু অতিথি ছিলেন। পরেও যতবার বোম্বাই গিয়েছেন তাঁদের বাড়িতেই থেকেছেন। ইউরোপে থাকতেই নাথালালের সঙ্গে রাঙাকাকাবাবুর আলাপ-পরিচয় হয়েছিল। ১৯৩৮ থেকে সম্পর্কটা ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। 

১৯৩৮ সালের শেষের দিকে কংগ্রেস সভাপতি হিসাবে রাঙাকাকাবাবু একটা বিরাট কাজের সূচনা করেছিলেন—স্বাধীনতা অর্জনের পর দেশ পুনর্গঠনের পরিকল্পনার জন্য ন্যাশনাল প্ল্যানিং কমিটি গঠন। সেই সূত্রে বিশিষ্ট বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহাকে বেশ কয়েকবার এলগিন রোডের বাড়িতে এসে রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে আলোচনা করতে দেখেছি। 

২৮

আমার মনে হয় অনেক অসুবিধার মধ্যে রাঙাকাকাবাবুকে কংগ্রেস সভাপতির কাজ চালাতে হয়েছিল। কংগ্রেসের সদর অফিস ছিল এলাহাবাদে। সভাপতির কাজের যা চাপ সেটা সামলাতে তাঁর জন্য কলকাতায় অন্তত দুজন দক্ষ সেক্রেটারির প্রয়োজন ছিল। তিনি অবশ্য মোটামুটি একটা ব্যবস্থা করে নিয়েছিলেন, কিন্তু সেটা ছিল নেহাতই চলনসই, উপযুক্ত বা পর্যাপ্ত নয়। অতিরিক্ত ব্যস্ততার মধ্যে তাঁর চিঠিপত্র, অফিসের কাগজপত্র ইত্যাদি খুবই এলোমেলো হয়ে যেত। ফলে পরে সবকিছু একত্র ও সুসংবদ্ধ করে দেশবাসীর জন্য বাঁচিয়ে রাখতে নেতাজী রিসার্চ ব্যুরোকে খুবই বেগ পেতে হয়েছে। 

রাঙাকাকাবাবুর অত্যধিক খাটুনির আরও একটা দিক ছিল। ১৯২১ সালে জনজীবনে প্রবেশ করার সময় থেকে রাজনীতির বাইরেও তিনি কলকাতা ও বাঙলার নানা ধরনের জনহিতকর প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নিজেকে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে রেখেছিলেন। তা সে সমাজসেবী প্রতিষ্ঠান, ছাত্র ও যুবকদের নানা সংগঠন, 

ও যুবকদের নানা সংগঠন, বিদ্যায়তন, লাইব্রেরি, ব্যায়ামাগার—যাই হোক না কেন। তাছাড়া কলকাতা করপোরেশন তো ছিলই, যেটা একাধারে রাজনীতি ও খানিকটা সমাজ সংগঠনের এলাকা ছিল। 

রাঙাকাকাবাবু যে-কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেই যুক্ত হতেন, তার কাজকর্মের খুঁটিনাটি নিয়ে মাথা ঘামাতেন, কেবল উপদেশ, পরামর্শ ও বক্তৃতার মধ্যে তাঁর কাজ সীমাবদ্ধ থাকত না। আমি নিজে তখনও ভেবেছি, কংগ্রেসের সভাপতি হবার পর তিনি স্থানীয় ও প্রাদেশিক নানা কাজ ও সমস্যা থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিচ্ছেন না কেন। যেমন কংগ্রেসের সভাপতি হবার পরও তিনি করপোরেশনের অলডারম্যান হয়েছিলেন। প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির দৈনন্দিন কাজেও তাঁকে বেশ সময় দিতে হত। কত লোকের সঙ্গে যে রোজ দেখা করতেন বলবার নয়। অনেকের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট হত মোটরগাড়িতে। এমন কী, হয়তো বাইরে সফরে বেরোচ্ছেন, বাড়ি থেকে হাওড়া স্টেশন পর্যন্ত কারুর সঙ্গে জরুরি কথা বলবেন। অথবা কাউকে হয়তো বললেন বর্ধমান কি আসানসোল পর্যন্ত চলুন, ট্রেনে কথা হবে। 

এমন লোকের ড্রাইভারও জবরদস্ত হওয়া দরকার। ১৯৩৭ সালে কার্শিয়ঙ-এ আমাদের সঙ্গে থাকার সময় এক বিলেত-ফেরত নেপালি ড্রাইভারকে পছন্দ করে রাঙাকাকাবাবু কলকাতায় নিয়ে আসেন। ‘বাহাদুর’ ড্রাইভার DKW নামে এক মজবুত জার্মান গাড়িতে রাঙাকাকাবাবুকে নিয়ে ঘুরত। প্রায়ই তো শেষ মুহূর্তে ট্রেন ধরতে হত, বাহাদুর রাঙাকাকাবাবুকে নিয়ে দশবারো মিনিটে এলগিন রোড থেকে হাওড়া স্টেশন পৌঁছে দিয়ে রেকর্ড করত। কতবার যে পুলিসের হাত অমান্য করেছে তার ঠিক নেই। ঝড়ের বেগে গিয়েও যে ঠিক সময়ে পৌঁছতেন তা নয়। অনেক সময় মেল ট্রেনও কয়েক মিনিট দেরিতে ছাড়ত—রাষ্ট্রপতি না-আসা পর্যন্ত গার্ড হুইস্‌ল দিতেন না। 

রাঙাকাকাবাবু তো ক্রমাগতই বড়-বড় জনসভায় বক্তৃতা করতেন। মধ্য-কলকাতার শ্রদ্ধানন্দ পার্কেই সভা হত বেশি। মেডিকেল কলেজ থেকে জায়গাটা তো কাছেই— ১৯৩৮ থেকে ১৯৪০ পর্যন্ত রাঙাকাকাবাবুর অনেক বক্তৃতা সেখানে শুনেছি। আমি কিন্তু রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে সভায় যেতাম না, জনসাধারণের সঙ্গে মিশে গিয়ে মাঠে বসে বক্তৃতা শুনতাম। রাঙাকাকাবাবু প্রায় প্রত্যেক মীটিঙেই দেরি করে আসতেন। আমি হিসেব করে দেখেছিলাম, মোটামুটিভাবে আড়াই ঘণ্টা দেরি নিয়মেই দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। লোকেরা কিন্তু স্থির ও শান্ত হয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করত এবং তাঁর লম্বা-লম্বা বক্তৃতা শেষ না-হওয়া পর্যন্ত কেউ নড়ত না। 

বক্তৃতার ধরনটা রাঙাকাকাবাবু একেবারেই বদলে ফেলেছিলেন। শুদ্ধ বাংলায় দার্শনিকের মতো বক্তৃতা তিনি জনসভায় আর করতেন না—সহজ ও সোজাসুজি কথাবার্তার ঢঙে বলতেন। মাঝে-মাঝে রসিকতার সুরে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ প্রশ্ন তুলে সকলকে চমকে দিতেন। যেমন, একদিন জিজ্ঞাসা করে বসলেন, “যদি ইংরেজরা এই যুদ্ধে হেরে যায়, আপনারা কি দুঃখিত হবেন?” কোনো জবাব নেই, সব চুপ। তখন বললেন, “ও, ভয় করছে বুঝি! আমি আপনাদের হয়ে বলে দিচ্ছি, আমরা মোটেই দুঃখিত হব না।” আর একবার প্রশ্ন করলেন, “এই যে জার্মানরা লণ্ডনের উপর জিনিসপত্র ফেলছে, তাতে আপনাদের কি কষ্ট হচ্ছে?” আবার সব চুপ। নিজেই জবাব দিলেন, বললেন, “আপনাদের মনের কথা আমিই বলে দিচ্ছি, এতে আমাদের কোনো কষ্ট নেই।” তিনি জবাবগুলি বলে দেবার পর তুমুল হাততালি পড়ত। আর একটা কথা তিনি প্রায় প্রতি সভায় বক্তৃতার শেষে জিজ্ঞাসা করতেন—স্বাধীনতার শেষ সংগ্রামের জন্য সকলে প্রস্তুত আছেন কিনা। সকলেই একবাক্যে হাত তুলে সম্মতি জানাতেন। 

দেশত্যাগ করার আগে যে তিন বছর রাঙাকাকাবাবু এলগিন রোডের বাড়িতে ছিলেন, সেই সময়কার কথা বলতে গিয়ে একজনকার সম্বন্ধে না লিখলেই নয়। আমার খুড়তুতো বোন ইলার কথা। সেই সময় যে স্নেহ, আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে ইলা রাঙাকাকাবাবুর দেখাশুনো সেবা করেছিলেন, তার তুলনা পাওয়া শক্ত। দৈনন্দিন জীবনযাত্রায়, অসুখে-বিসুখে এবং অনেক ছোটবড় কাজে রাঙাকাকাবাবু অনেকটা ইলার উপর নির্ভর করতেন। মহানিষ্ক্রমণের সময় ইলার ভূমিকা সম্বন্ধে পরে বলব। তবে রাঙাকাকাবাবুর কথা বলতে গেলেই আমার এই কোমলহৃদয় প্রিয় বোনটির কথা মনে পড়ে যায়। অবশ্য বাড়ির সব ছেলেমেয়েরাই যার যেমন সাধ্য রাঙাকাকাবাবুর কাজ করতে কখনও পেছপা হত না। ১৯৩৮-এ এলগিন রোডের বাড়িতেই কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির মিটিং হল। বাড়ির সকলেই কাজে লেগে গেল। 

ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে ১৯৩৮-৩৯-এ আমাদের দেশের দুই মনীষীর সঙ্গে রাঙাকাকাবাবুর সম্পর্কের ক্ষেত্রে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার ঘটেছিল। একজন হলেন রবীন্দ্রনাথ, আর অন্যজন হলেন গান্ধীজি। রবীন্দ্রনাথ নিজেই পরে বলেছেন যে, অনেকদিন পর্যন্ত রাঙাকাকাবাবুর নেতৃত্ব সম্বন্ধে তাঁর মনে কিছু দ্বিধা ছিল। পুরনো চিঠিপত্র পড়ে মনে হয় রাঙাকাকাবাবুরও রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে কিছু অভিমান ছিল। কিন্তু ১৯৩৮-এ রবীন্দ্রনাথের সব দ্বিধা কেটে গিয়েছে এবং তিনি রাঙাকাকাবাবুকে দেশনেতার সর্বোচ্চ আসনে আহবান করলেন। শুধু তাই নয়, আগামী কালের মুক্তিসংগ্রামের অধিনায়ককে তিনি সুভাষচন্দ্রের মধ্যেই দেখতে পেলেন। 

১৯৩৮-এর শেষের দিকে যখন রাঙাকাকাবাবু দ্বিতীয়বার কংগ্রেসের সভাপতি পদের জন্য প্রার্থী হবেন বলে ঠিক করলেন, তখন রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধীজির প্রতিক্রিয়া একরকম তো হলই না, পরস্পরবিরোধী হল বলা যায়। রবীন্দ্রনাথ রাজনীতির ডামাডোলে নিজেকে বড়-একটা জড়াতেন না। কিন্তু এক্ষেত্রে, দেশের বৃহত্তর স্বার্থে, তিনি তাঁর মতামত গান্ধীজিকে জানিয়েছিলেন। তাঁর মতে, আমাদের মঙ্গলের জন্য দেশের দুই আধুনিক-মতাবলম্বী নেতা জওহরলাল ও সুভাষচন্দ্রকে নেতৃত্বের আসনে প্রতিষ্ঠিত করা উচিত। 

জওহরলালকে ইতিমধ্যেই সুভাষচন্দ্র ন্যাশনাল প্ল্যানিং কমিটির চেয়ারম্যান করেছেন, সুতরাং রবীন্দ্রনাথ বললেন, সুভাষচন্দ্রকেই কংগ্রেসের সভাপতির পদে রাখা উচিত। গান্ধীজি কিন্তু একমত হলেন না। এক বছর আগেই গান্ধীজি রাঙাকাকাবাবুকে সাদরে সভাপতির পদে আহ্বান করেছিলেন। কেন গান্ধীজি নিজের মত ও পথ একেবারে পালটে ফেললেন এটা ঐতিহাসিকদের কাছে একটা গবেষণার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটা বোঝাপড়ার জন্য জওহরলাল কিছু চেষ্টা করলেন, কিন্তু কোনো ফল হল না। বোধ হয়, সেই সময় গান্ধীজির উপর উগ্র ও কট্টর গান্ধীবাদীদের প্রভাব ছিল সবচেয়ে বেশি। এদিকে রাঙাকাকাবাবুর স্থির বিশ্বাস হল যে ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদীদের সঙ্গে একটা আপসের চেষ্টা ব্যর্থ করতে তাঁর উচিত সভাপতির পদের জন্য লড়া। ফলে কংগ্রেসের মধ্যে একটা তীব্র লড়াই অনিবার্য হয়ে উঠল। 

২৯

১৯৩৯-এর জানুয়ারির শেষে ত্রিপুরী কংগ্রেসের সভাপতি-নির্বাচন হল। এ-ধরনের নির্বাচন কংগ্রেসের ইতিহাসে আর হয়নি। সেই সময় আমাদের বড় দাদার বিয়ে লাগল। বাড়ির বড় ছেলের বিয়ে, সেজন্য কলকাতায় আত্মীয়স্বজনদের বেশ একটা বড় জমায়েত হল। যেদিন কংগ্রেস-সভাপতি নির্বাচনে সারা দেশে ভোট নেওয়া হচ্ছে সেই দিনই বিকালে বাবা উডবার্ন পার্কের সাউথ ক্লাবের মাঠে বিয়ের চা-পার্টি দিচ্ছেন। রাঙাকাকাবাবু ও আছেন। একে-একে বিভিন্ন প্রদেশ থেকে ফলাফল জানা যাচ্ছে হয় টেলিগ্রাম বা প্রেস মারফত—দৌড়ে এসে কেউ-না-কেউ খবরটা দিয়ে যাচ্ছেন। সে কী উত্তেজনা। প্ৰথমটা প্রতিযোগিতা খুবই তীব্র মনে হচ্ছিল, ভোট প্রায় সমান-সমান চলছিল। 

রাঙাকাকাবাবু চা খাচ্ছেন আর শান্তভাবে হিসেব করে দেখছেন, ভোটের ধারা সম্বন্ধে মাঝে-মাঝে নিজের মন্তব্য করছেন। ক্রমে এটা বোঝা গেল যে, রাঙাকাকাবাবুর দিকের পাল্লাটাই ভারী। চা-পার্টি শেষ হবার পর রাঙাকাকাবাবু এলগিন রোডের বাড়িতে তাঁর অফিসঘরে গিয়ে বসলেন। বাড়ির ছোটবড় সকলেই আমরা তাঁকে ঘিরে রইলাম। শেষের ফলাফলগুলো তখন আসছে। রাঙাকাকাবাবু ক্রমাগতই টেলিফোনে কথা বলছেন। এই সূত্রে একটা কথা আমার মনে গেঁথে আছে। প্রত্যেক বারই বলছেন “আমরা জিতছি” বা “আমরা জিতব”, একবারও ভুলে বলছেন না যে “আমি জিতছি”। এই সামান্য কথার মধ্যে দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছেন যে ব্যাপারটা ব্যক্তিগত নয়, সকলে মিলে একটা আদর্শের জন্য লড়াই। 

আর-একটা কথাও মনে আছে। রাঙাকাকাবাবুর নির্বাচনের জয়ের খবরে বাড়ির ও বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে কেউ-কেউ প্রাদেশিকতা ও বিচ্ছিন্নতাবাদের সুরে কথা বলতে আরম্ভ করেছিলেন। যেন এটা ছিল সর্বভারতীয় শক্তির বিরুদ্ধে বাংলার একটা সাফল্য বা কৃতিত্ব। রাঙাকাকাবাবু কিন্তু এই ধরনের কথাবার্তা ও ধারণা সঙ্গে-সঙ্গেই সম্পূর্ণভাবে অগ্রাহ্য করেছিলেন। তাছাড়া গান্ধীজির একটা খুবই দুঃখজনক মন্তব্যের পরেও তিনি তাঁর মানসিক স্থৈর্য হারাননি। নির্বাচনের ফল ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে কোনো হীন আপসের বিরুদ্ধে রায় বলে মেনে নিয়ে তিনি আবার কংগ্রেসের মধ্যে একতা ফিরিয়ে আনবার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন। 

সপ্তাহ-দুই পরে রাঙাকাকাবাবু ওয়াধায় গান্ধীজির সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। কলকাতা ফেরবার পথে ট্রেনেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। মনে হয়, অসুখের গুরুত্বটা তিনি নিজেও ঠিক বুঝতে পারেননি। কলকাতায় ফিরে তিনি স্বাভাবিক কাজকর্ম করার চেষ্টা করলেন। দু-একদিন পরেই সফরে বের হবার কথা। ভাবলেন প্রোগ্রাম ঠিকই চলবে। কিন্তু একেবারেই শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন। সব কাজকর্ম বন্ধ হল, সফর বাতিল হল। নতুনকাকাবাবু ডাঃ সুনীল বসুকে রাঙাকাকাবাবুর স্বাস্থ্য নিয়ে এত উদ্বিগ্ন হতে কখনও দেখিনি। ডাঃ নীলরতন সরকার, ডাঃ মণি দে-র মতো বড়-বড় ডাক্তার প্রায়ই যাওয়া-আসা করতে লাগলেন। বাঙাকাকাবাবু গোঁ ধরে বসলেন, যাই হোক না কেন, মার্চ মাসের প্রথমে ত্রিপুরী কংগ্রেসে তাঁকে যেতেই হবে। ডাক্তাররা বললেন, তিনি যদি ডাক্তারদের সব নির্দেশ না মেনে চলেন তাহলে ত্রিপুরী কংগ্রেসে যাওয়ার আশাও তাঁকে ত্যাগ করতে হবে। এদিকে আবার ফেব্রুয়ারি মাসের তৃতীয় সপ্তাহে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির মীটিং ওয়ার্ধায় বসবার কথা। ওয়ার্কিং কমিটির মীটিং-এ যাবার তো প্রশ্নই ওঠে না। রাঙাকাকাবাবু কমিটির মীটিং পেছিয়ে দেবার প্রস্তাব করলেন। উত্তরে কমিটির প্রায় সব সদস্যই পদত্যাগ করে বসলেন। চারদিক থেকে নানা রকম বিপদ যেন রাঙাকাকাবাবুকে চেপে ধরল। তাঁর অসুখ নিয়ে কেবল ডাক্তাররাই নয়, বাড়ির সকলেই খুবই শঙ্কিত হয়ে ছিলেন। বিছানায় শুয়ে শুয়ে তাঁকে আবার বেশ একটা বড় রকমের রাজনৈতিক লড়াইও লড়তে হচ্ছিল। রাঙাকাকাবাবু নিজেই পরে লিখেছিলেন যে, জীবনে তিনি অনেক ভুগেছেন কিন্তু ত্রিপুরী কংগ্রেসের সময় এক মাস তিনি যে শারীরিক ও মানসিক কষ্ট পেয়েছিলেন, সেরকম কষ্ট জীবনে পাননি। রোগ নির্ণয় করতে ডাক্তারদের অসুবিধা হচ্ছিল, কারণ উপসর্গগুলি ছিল অদ্ভুত ধরনের। জ্বর আসে যায় কিন্তু কিছুতেই ছাড়ে না। রাঙাকাকাবাবুর কাছে শুনেছি, দুই ফুসফুসেই নাকি এক মারাত্মক রকমের নিউমোনিয়া হয়েছিল এবং রাঙাকাকাবাবু সেযাত্রায় রক্ষা পাবেন কিনা সেবিষয়ে ডাক্তারদের বেশ সন্দেহ ছিল। 

যাই হোক, রাঙাকাকাবাবু ত্রিপুরী যাবেনই। নতুনকাকাবাবু দুজন সহকারী ডাক্তার নিয়ে সঙ্গে যাবেন, বাড়ির আরও অনেকে সঙ্গে থাকবেন। আমি ত্রিপুরী যাইনি, সেখানকার সব ঘটনার কথা বাবা মা ও অন্যান্যদের কাছে পরে শুনেছিলাম। বাড়ি থেকে হাওড়া স্টেশন পর্যন্ত তো অ্যাম্বুলেন্সে করে তাঁকে দিয়ে যাওয়া হল। রাঙাকাকাবাবু যখন ত্রিপুরীর সভাপতির ক্যাম্পে পৌঁছলেন তখন তাঁর জ্বর ১০৩ ডিগ্রি। কংগ্রেস ক্যাম্পের ডাক্তাররা তাঁর অবস্থা দেখে খুবই উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন। শুনেছি তাঁরা নাকি বলেছিলেন, তাঁকে জব্বলপুরের ভাল হাসপাতালে রাখা হোক, ক্যাম্পে রাখাটা নিরাপদ নয়। রোগী নিজে কিন্তু ঐ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। 

অনেক জ্বর নিয়েও রাঙাকাকাবাবু অ্যাম্বুলেন্সে চেপে মণ্ডপে গিয়ে বিষয়-নির্বাচনী সভায় সভাপতিত্ব করেন। ফলে তাঁর অবস্থার আরও অবনতি হয়। কংগ্রেসের পূর্ণ অধিবেশনে তাঁকে যেতে দেওয়া হয়নি। বাবা তাঁর অভিভাষণ পড়েছিলেন। শুনেছি ক্যাম্পে শুয়ে-শুয়ে তিনি মাইক্রোফোনে বাবার গলা শোনার অপেক্ষায় থাকতেন। মাঝে-মাঝে বলে উঠতেন, ঐ শোনো, মেজদা বলছেন। 

ত্রিপুরী কংগ্রেসের এমন একটি প্রস্তাব পাস হল যাতে করে সভাপতির হাত-পা বেঁধে দেওয়া হয় বলা যেতে পারে। যাঁদের রাঙাকাকাবাবু তাঁর সমর্থক বলে মনে করেছিলেন তাঁদের মধ্যে অনেকেই অন্য দিকে চলে যান কিংবা কোনো অজুহাত দেখিয়ে দু’ নৌকোয় পা রেখে নিজেদের বাঁচাবার চেষ্টা করেন। তাছাড়া ত্রিপুরীতে উপরতলার রাজনৈতিক মহলের ক্ষুদ্রতা রাঙাকাকাবাবুকে বিশেষ পীড়া দিয়েছিল। তিনি পরে লেখেন, এতই বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন যে সবকিছু ছেড়ে হিমালয়ের কোলে আশ্রয় নেবার ইচ্ছা তাঁর আবার জেগেছিল। কিন্তু ঐ সাময়িক দুর্বলতা তিনি কাটিয়ে উঠেছিলেন। ভারতের সব প্রান্তের অগণিত লোকের ভালবাসা ও সমর্থনের যথেষ্ট পরিচয় তিনি নানা ভাবে পেয়েছিলেন। ফলে তাঁর মনের বল আবার ফিরে এসেছিল। ত্রিপুরী যে আসল ভারতবর্ষের প্রতিভূ নয় তা তিনি বুঝেছিলেন এবং আবার দেশের ও দশের সেবায় আত্মনিয়োগ করবার সঙ্কল্প গ্রহণ করেছিলেন। 

ডাক্তারদের ও বাড়ির সকলের মত হল যে, ত্রিপুরীর পর রাঙাকাকাবাবুকে কলকাতায় না এনে অন্তত কিছু দিন অন্য কোনো অপেক্ষাকৃত জনবিরল ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশে রাখা উচিত। কলকাতার পথে ধানবাদে তাঁকে নামিয়ে নেওয়া হল এবং আমাদের ন’কাকাবাবু সুধীরচন্দ্রের জামাডোবার বাংলোতে তোলা হল। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *