বসুরাজ ও গিরিকা
শক্রোৎসব সমাপনের পর মৃগয়াভিলাষে কাননে প্রবেশ করলেন চেদিপতি বসুরাজ।
সুরপতি ইন্দ্রের অনুগ্রহে সমৃদ্ধিসমাকুল চেদিরাজ্যের প্রভুত্ব লাভ করেছেন বসুরাজ। তাঁর কণ্ঠে সুরপতির সৌহার্দ্যের উপহার অম্লানপঙ্কজকুসুমের বৈজয়ন্তী মাল্য শোভা পায়। ইন্দ্রেরই প্রদত্ত স্ফটিকনির্মিত বিমানরথে আব্দঢ় বসুরাজ গগন অঙ্গনে বিগ্রহবান দেবতার মতো সঞ্চরণ করেন। সুরপতি ইন্দ্র প্রদান করেছেন শিষ্টপ্রতিপালনী বেণু-যষ্টি। এই বেণু-যষ্টির মর্যাদা রক্ষা করতে কোন ভুল করেন না বসুরাজ। বিপন্ন ও প্রপন্নের রক্ষার জন্য সর্বদা ব্যাকুল হয়ে থাকে চেদিপতি বসুরাজের বিপুলবলে স্পর্ধিত দুই বাহু।
কুটজ সৌগন্ধে অভিভূত কাননবায় তখন সদ্যোজাগ্রত বিহগের কাকলীতে শিহরিত হয়ে নবারুণপ্রভার বন্দনায় চঞ্চল হয়ে উঠেছে। কিঞ্জল্করাগে রঞ্জিত হয়েছে বনসরসীর নীর। জেগেছে গন্ধাকৃষ্ট মধুব্রত, পরিপতিত পরাগে পাটলীকৃত হয়েছে বনভূভাগ। বসুরাজ মুগ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন, এবং তাঁর দুই চক্ষু যেন শিশিরস্নাত এই পুষ্পলতা ও বনস্পতির অন্তরচরী মাধুরীর অভিষেক লাভের জন্য উৎসুক হয়ে ওঠে।
আলোকে আপ্লুত হয়ে উঠেছে পূর্ব গগনের ললাট। সূক্ষ্ম অংশুক নীশারের মত ধীরে ধীরে অপসৃত হয় খিন্ন কুহেলিকা। আর, বিগলিতদুকূলা কামিনীর মত শরীরশোভা প্রকট করে ফুটে ওঠে কূলমালিনী এক তটিনীর রূপ। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে যায় বসুরাজের, ঐ তটিনীরই নিকটে এক শৈলকুন্দরের অন্ধকারময় নিভৃত হতে হঠাৎ উত্থিত এক আর্তনাদ শুনে একদিন চঞ্চল হয়ে উঠেছিল তাঁর করধৃত এই শিষ্টপ্রতিপালনী বেণু-যষ্টি।
শুক্তিমতী নামে এক পরিণতযৌবনা কুমারী স্নানাভিলাষে ঐ তটিনীর নিকটে এসে দাঁড়িয়েছিল আর কোলাহল নামে এক লালসামূঢ় কামান্ধ শক্তিমতীর সকল অনুনয় ও প্রতিবাদ রূঢ় আক্রমণে স্তব্ধ করে দিয়ে সেই কুমারীতনুর যৌবন ক্ষুধার্ত শ্বাপদের মত উপভোগ করেছিল।
কিন্তু কর্তব্য পালন করেছিলেন তরুণ চেদিপতি বসুরাজ। সেই বিপন্নাকে রক্ষা করেছিলেন এবং তাঁর বিপুল বলকুশল এই বাহুর একটি আঘাতে সেই অত্যাচারীর প্রাণ চিরকালের মত স্তব্ধ করে দিয়েছিলেন। ধর্ষকের উন্মাদ আগ্রহের গ্রাস হতে যে নারীকে সেদিন মুক্ত করতে পেরেছিলেন বসুরাজ, সেই নারী প্রণতশিরে তাঁরই চরণ স্পর্শ করে তাঁকেই পিতৃসম্বোধনে সম্মানিত করেছিল। তারপর একে একে কত শত কুহু রাকা ও সিনীবালী রজনী এই তটিনীরই সিকতায় শিশিরস্নেহভার সঁপে দিয়ে ফুরিয়ে গিয়েছে! একে একে বিগত হয়েছে অষ্টাদশ বৎসর। কোথায় গেল সেই নারী? সেই শক্তিমতী?
মনে পড়ে বসুরাজের, সেদিন কি-যেন বলতে গিয়েও বলতে পারেনি শুক্তিমতী। ক্রূর কিরাতের কার্মুকে আহত মৃগবধূর মত ধূলিলুণ্ঠিত দেহ নিয়ে, বসুরাজের চরণ স্পর্শ করে, আর ভয়বিহ্বল ও করুণ দুই চক্ষুর দৃষ্টি প্রসারিত করে তাকিয়েছিল শুক্তিমতী। বসুরাজ বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করেছিলেন—আর ভয় কেন নারী? চেয়ে দেখ, তোমার কুমারী-জীবনের শুচিতার ঘাতক ঐ কামান্ধ আমার এই ভীমবাহু-প্রহরণের একটি আঘাতে নিষ্প্রাণ রুধিরাক্ত শ্বাপদের মত ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে পড়ে আছে।
হ্যাঁ, সেদিন সেই ধর্ষকের দেহ ঐ শৈলকন্দরের নিকটে নিষ্প্রাণ রুধিরাক্ত শ্বাপদের দেহের মত পড়েছিল। শুক্তিমতী নামে এক বনবাসিনী কুমারী নারীর যৌবনলুণ্ঠক কোলাহল নামে সেই দস্যুর শোণিতপ্রবাহে সিক্ত হয়ে গিয়েছিল শৈলকরের কঠিন শিলাতল। তবুও বলাৎকারমত্ত মূঢ়ের সেই নিষ্প্রাণ দেহপিণ্ডের দিকে তাকিয়ে যেন নিশ্চিন্ত হতে পারেনি শুক্তিমতী। অশ্রুবাষ্পে আচ্ছন্ন চক্ষু নিয়ে তরুণ বসুরাজের দিকে তাকিয়ে আবেদন করেছিল—পিতা!
বসুরাজ—তুমি তো এখন মুক্ত, তবুও তুমি শান্ত ও নির্ভয় হতে পারছ না কেন নারী?
শুক্তিমতী বলে—অত্যাচারীর হিংস্র ভুজ-ভুজঙ্গমের বন্ধন হতে আপনি আমাকে মুক্ত করেছেন পিতা, কিন্তু মনে হয় তার লালসার বিষ আমার এই কুমারীদেহকে মুক্তি দেবে না।
চমকে ওঠেন বসুরাজ—এ কথার অর্থ?
শুক্তিমতী—ভয় হয় পিতা, অনুভব করছি পিতা, আমার এই দেহের শোণিতে যেন এক প্রাণের বীজ সন্তরণ করছে।
বিমর্ষ ও বিষণ্ণ বসুরাজ বলেন—বুঝেছি, এবং আমার ভয় হয় নারী, তোমার এই ভয় বোধহয় মিথ্যা ভয় নয়।
ক্রন্দন করে শুক্তিমতী—তবে বলুন নৃপতি বসুরাজ, ধর্ষকের লালসা যে প্রাণের অঙ্কুর আমার যৌবনোর্বর শোণিতে নিক্ষেপ করেছে, সেই প্রাণ এই বনকুসুমের পরাগের মত কলুষহীন শুচিরুচির ও সুন্দর।
উত্তর দেন না বসুরাজ।
শুক্তিমতী বলে বলুন প্রজাপালক বসুরাজ। আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে, আমার অন্তরাত্মাকে যন্ত্রণাক্ত করে আমার জীবনকে অপমানিত করে, হত্যার উৎসবের মত এক প্রমত্ততার আঘাতে আমার দেহের সকল স্নায়ু তন্তু ও নিঃশ্বাস পীড়িত করে, প্রণয়হীন আনন্দহীন ও আর্তনাদপীড়িত কতগুলি মুহূর্তের অভিশাপলীলার পরিণাম হয়ে যে প্রাণ আমার দেহে সঞ্চারিত হয়েছে, সেই প্রাণ আপনার বিচারে কোন অপরাধী প্রাণ নয়।
উত্তর দেন না বসুরাজ।
শুক্তিমতী বলে—আপনি প্রতিশ্রুতি দান করুন বসুরাজ, আমার এই প্রণয়হীন ও আনন্দহীন অবমাননাময় কয়েকটি দিবসের আর্তনাদজাত সন্তান আপনার রাজ্যের সকল প্রণয়জাত সন্তানের মত মানবোচিত সম্মান লাভ করবে।
ভ্রূ কুঞ্চিত করে বিস্মিতভাবে শুধু শুক্তিমতীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন বসুরাজ।
শুক্তিমতী বলে—আমাকে প্রতিশ্রুতি দান করুন শিষ্টপ্রতিপালক বসুরাজ, তাহলেই আপনাকে আমার পরিত্রাতা পিতা বলে আমি বিশ্বাস করতে ও শ্রদ্ধা করতে পারব।
বসুরাজ বলেন—প্রতিশ্রুতি দিতে পারি না।
শুক্তিমতী—কেন পারেন না?
বসুরাজ—তোমার সন্তান এক অত্যদ্ভুত জন্ম-পরিচয় নিয়ে ভূমিষ্ঠ হবে। ধর্ষকের লালসার সৃষ্টি তোমার সেই সন্তান পৃথিবীর একটি প্রাণিরূপে গণ্য হবে, এই মাত্র, এর অধিক কোন মর্যাদা তার হতে পারে না।
শিউরে ওঠে শুক্তিমতী—কেন?
বসুরাজ কঠোরভাবে বলেন—শ্বাপদের সৃষ্টি শ্বাপদই হয়ে থাকে।
ধর্ষক কোলাহলের নিষ্প্রাণ দেহপিণ্ডের দিকে অঙ্গুলি-সঙ্কেত করে শুক্তিমতী বলে—কিন্তু মানুষের প্রণয়জাত সন্তানও তো শ্বাপদ হয়ে উঠতে পারে।
বাধা দিয়ে কঠোরস্বরে বলেন বসুরাজ—কুতর্ক করো না নারী।
শুক্তিমতী—ঐ শ্বাপদপ্রায় লালসান্ধ কোলাহল আপনারই রাজ্যের এক মানবদম্পতির প্রণয়জাত সন্তান। এক নারী ও এক পুরুষের দেহ-মনের মিলন ও আনন্দেরই সৃষ্টি ঐ কোলাহল।
বিব্রতভাবে বসুরাজ বলেন—বিচিত্র তোমার মন! সন্দেহ হয় আমার, তোমার যে আর্তনাদ শুনে বিচলিত হয়েছিলাম, সে আর্তনাদ নিতান্তই কপট এক দুঃখের প্রতিধ্বনি।
শুক্তিমতী করুণস্বরে বলে—এমন ভয়ানক সন্দেহ করবেন না, বসুরাজ।
বসুরাজ—তবে কেন তুমি তোমার সেই দুঃসহ অপমানের সৃষ্টিকে পালন করবার জন্য এবং তার ভবিষ্যৎ চিন্তা করে এত আকুল হয়ে উঠেছ দস্যুস্পর্শদূষিতা কুমারী?
আরও আকুল হয়ে কেঁদে ওঠে শুক্তিমতী—সত্যই বুঝতে পারি না পিতা, এ আমার কোন্ মনোবিকার? অত্যাচারী কোলাহলের সেই লালসাক্ষুব্ধ মুখাবয়ব কল্পনা করতেও ঘৃণা বোধ করি, কিন্তু আমার শোণিতে সঞ্চারিত একটি প্রাণকে কিছুতেই যে ঘৃণা করতে পারছি না।
বসুরাজ—কিন্তু আমি যে তোমার শোণিতে সম্ভাবিত অদ্ভুত আবিলতার অঙ্কুর ঐ প্রাণকে কল্পনা করতেও ঘৃণা বোধ করি।
শুক্তিমতী বলে—আপনার এই ভয় ও ঘৃণার হেতু বুঝতে পারছি না বসুরাজ। আপনার এই রাজ্যে কি কোন কুমারীর গূঢ়োৎপন্ন সন্তান নেই?
বসুরাজ—আছে।
শুক্তিমতী—আপনার রাজ্যে কি কোন প্রোষিতভর্তৃকা নারীর ক্রোড়ে সন্তান নেই?
বসুরাজ—আছে।
শুক্তিমতী—আপনার রাজ্যে কি কোন প্রোষিতভর্তৃকা নারীর ক্রোড়ে সন্তান আবির্ভূত হয়নি?
বসুরাজ—হয়েছে।
শুক্তিমতী—আপনার রাজ্যে কি কোন কৌলটেয় নেই?
বসুরাজ—আছে।
শুক্তিমতী—আপনার রাজ্যে কি কোন বিবাহিতা নারী পরপুরুষাসঙ্গে প্রজায়িনী হয়ে ক্ষেত্রজ সন্তান ক্রোড়ে ধারণ করেনি?
বসুরাজ—করেছে।
শুক্তিমতী—অদ্ভুত বিধি আর অবিধির বশীভূত এই সব মিলনের সন্তান যারা তাদের কি আপনি আপনারই প্রজা বলে মনে করেন না?
বসুরাজ—করি।
শুক্তিমতী—আপনার ধারণায় এরা সকলেই মানুষ নিশ্চয়?
বসুরাজ—নিশ্চয়।
শুক্তিমতী—এদের মনুষ্যত্ব কি আপনার কাছে সম্মাননীয় নয়?
বসুরাজ—অবশ্যই সম্মাননীয়।
শুক্তিমতী—তবে আমার সন্তান কেন শিষ্টপ্রতিপালক চেদিপতি বসুরাজের বিচারে ঘৃণ্য বলে বিবেচিত হবে?
বসুরাজ—তুমি ভুল বুঝেছ নারী। আমার রাজ্যের প্রত্যেক গূঢ়োৎপন্ন ও কৌলটেয় হলো এক মানব ও এক মানবীর স্মরবেশপ্রগল্ভ মিলনের আনন্দের ও আগ্রহের সৃষ্টি, আর্তনাদের সৃষ্টি নয়। কল্পনা করতেও আতঙ্ক হয়, কি ভয়ংকর কর্কশ সংস্কার নিয়ে জন্মগ্রহণ করবে তোমার সন্তান! অনুমান করতেও ঘৃণা হয়, কি ভয়ংকর অপচিত্ততা নিয়ে ভূমিষ্ঠ হবে তোমার সন্তান। ধারণা করলে শিহর দিয়ে কণ্টকিত হয়ে ওঠে সকল চিন্তা, কে জানে কোন বীভৎসতা নিয়ে আত্মপ্রকাশ করবে তোমার সন্তানের অবয়ব! তোমার সন্তান কখনও সমাজের মানুষ হতে পারবে না, সে হবে এই বনেরই এক প্রাণী। আমি মনে করি, বলাৎকৃতা নারীর দেহজাত সন্তানই হলো এই সংসারের অন্ত্যজাধম।
শুক্তিমতী বিস্মিত হয়ে বলে—এই কি শিষ্টপ্রতিপালকের ন্যায়বিধি?
বসুরাজ—হ্যাঁ।
শুক্তিমতী—নিতান্তই অন্যায়বিধি, বসুরাজ। আপনি বলাৎকৃতা নারীর মাতৃত্বকে শাস্তি দান করছেন।
বসুরাজ—আমি বিস্মিত হচ্ছি, এক নারী তার ধর্মাপহাৱক দস্যুর হঠলালসার সৃষ্টিকে ঘৃণা করতে পারছে না কেন? কিসের এই মোহ?
শুক্তিমতী—আমার শোণিতের স্নেহের উত্তাপে দশ মাস দশ দিন লালিত হবে যে প্রাণ, তাকে আমি কেমন করে ঘৃণা করব বসুরাজ?
বসুরাজ—অপজাত এক প্রাণকে, তোমার যৌবনের সকল শুচিতার হন্তা এক দস্যুর মত্ততার সৃষ্টিকে যদি তুমি ঘৃণা করতে না পার, তবে সে অপরাধ তোমার। ঘৃণাকে ঘৃণা করতে যদি না পার, তবে সেই ভুলের শাস্তি তুমিই জীবনে সহ্য করবে। আমি অপ্রজা পালন করি না, নারী।
শুক্তিমতী বলে—আর একটি কথা শুধু বলবার ছিল, কিন্তু বলতে পারলাম না, বসুরাজ।
কুটজগন্ধে অভিভূত বনবায়ুর স্পর্শে সেদিনের মত আজও বসুরাজের চিন্তা শিহরিত হয়। কোথায় গেল সেই নারী, শুক্তিমতী নামে সেই কুমারী? কল্পনা করেন বসুরাজ এবং সঙ্গে সঙ্গে একটা বিষণ্ণতার ছায়াও যেন তাঁর দুই চক্ষুর দৃষ্টিতে সঞ্চারিত হয়। বোধ হয় এই তটিনীসলিলে সেদিন দেহ বিসর্জিত করে সকল শাস্তি সন্তাপ ও মোহের অবসান করে দিয়েছে সেই নারী। ভালই হয়েছে, ধর্ষকের লালসাজাত সন্তানের মাতা হবার দুর্ভাগ্য সেই অদ্ভুত নারীকে সহ্য করতে হয়নি। কি আশ্চর্য, কি অদ্ভুত ছিল সেই নারীর মন! বসুরাজের প্রহরণাঘাতে নিহত এক ধর্ষকের রক্তাক্ত দেহপিণ্ডের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠেছিল নারীর যে চক্ষু, সেই চক্ষুই আবার ধর্ষকেরই ঔরসের পরিণাম চিন্তা করে সজল হয়ে উঠেছিল। একে একে বিগত হয়েছে অষ্টাদশ বৎসর, ঐ শৈলকন্দরের এক নিভৃত হতে উত্থিত নারীকণ্ঠের সেই আর্তনাদ কোন স্মৃতিচিহ্ন না রেখে কালস্রোতে লুপ্ত হয়ে গিয়েছে চিরকালের মত।
কাননভূমির অভ্যন্তরে আবার হৃষ্টচিত্তে পরিভ্রমণ করতে থাকেন বসুরাজ। শান্ত বনবীথিকার ধূলিকে ছায়ায় আকীর্ণ করে দাঁড়িয়ে আছে অনেক শ্যাম অনোকহ। কিন্তু ধীরে ধীরে উত্তপ্ত হয়ে উঠতে থাকে সূর্যকরনিকর। তৃষ্ণার্তি অনুভব করেন বসুরাজ। এগিয়ে এসে প্রচ্ছায়শান্ত তরুতলে দাঁড়িয়ে শ্রমক্লম অপনোদন করেন। তারপরেই শুনতে পান, যেন নিকটেই কোথাও তৃপ্ত সারসের কলরব ধ্বনিত হয়ে চলেছে। শুনতে পান বসুরাজ, জলোৎপলের সৌরভে অভিভূত রোলম্ব নিকুরম্বের গুঞ্জন। আরও কিছুদূর অগ্রসর হয়ে দেখতে পান বসুরাজ, মিথ্যা নয় তাঁর অনুমান। অজস্র বিকচ তামরসের শোভা বক্ষে ধারণ করে রয়েছে স্নিগ্ধসলিলা এক সরসী। জলপানে তৃষ্ণার্তি দূর করেন বসুরাজ।
কিন্তু সেই মুহূর্তে বিপুল তৃষ্ণায় বিচলিত হয়ে উঠল বসুরাজের দুই চক্ষু।
সরসীতটের এক নিভৃতে স্ফুটকুসুমে আচ্ছন্ন এক প্রিয়ক তরুর ছায়ায় নবীন শাদ্বলের উপর কাঞ্চনলতিকার মত শয়ান এক নারীর অলসলুলিত দেহ, নিবিড় নিদ্রায় অভিভূত। মনে হয়, ঐ নারীর হাস্যজ্যোতির্লিপ্ত অধরে ইন্দুকর কন্দল ঘুমিয়ে আছে। মনে হয়, ঊর্ধ্বাকাশের মেঘ নবীন শাদ্বলের হরিৎ বক্ষ চুম্বনের জন্য এই নারীর চিকুরের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে। নীবিচ্যুত হয়ে রুক্ষ বল্কল যেন সেই রূপাভিরামা রমণীর নাভিকুহরিণী আর ত্রিবলিরেখার দিকে তৃষ্ণাভিমানিত নয়নে তাকিয়ে আছে। বিস্মিত হন বসুরাজ, যেন রূপময় নিখিল নিসর্গের সকল মৃদুল স্পন্দন, সকল সুচারু গঠন, সকল মঞ্জুল শোভা, আর সকল মদিরকোমল বিহ্বলতা দিয়ে রচিত হয়েছে এই বরযৌবনা নারীর তনু। মনে হয়, এই তো কবি-কল্পনার সেই নারী, যার মুখমদস্পর্শে প্রস্ফুটিত হয় বকুলকোরক, যার আলিঙ্গনে জাগ্রত হয় কুরুবক কুট্মল, যার চরণধ্বনিতে মঞ্জরিত হয় রক্তাশোক আর কটাক্ষে পুষ্পিত হয় তিলক।
যেন বসুরাজের সেই চঞ্চল নিঃশ্বাসের আঘাতে নারীর নিদ্রা ভেঙে যায়। স্বপ্নোত্থিতার মত হঠাৎ উন্মীলিত দুই চক্ষুর বিস্ময় নিয়ে বসুরাজের দিকে তাকায়, আর বিপুললজ্জাবিকম্পিত হস্তে ব্যস্তভাবে বল্কল ও উৎপলমেখলা আকর্ষণ করে বরাঙ্গের বিকচ শোভা আবৃত করে নারী।
বিস্মিত বসুরাজ প্রশ্ন করেন—কে তুমি ভদ্রে?
দরদলিত উৎপলকলিকার মত ঈষৎ হাস্যে অধর স্ফুরিত করে উত্তর দান করে তরুণী—আমার পরিচয় আমি জানি না। আপনি কে?
বসুরাজ—আমি চেদিপতি বসুরাজ।
নারীর ভ্রূরেখা বিস্ময়ে শিহরিত হয়। —আপনি এই রাজ্যের অধীশ্বর, সুরপতি ইন্দ্রের অনুগৃহীত শিষ্টপ্রতিপালক বসুরাজ?
বসুরাজ—হ্যাঁ। কিন্তু তুমি কে?
নারী—আমি এক বনেচর প্রাণী মাত্র।
ব্যথিত হন বসুরাজ।—লোকললামা নারী, কি হেতু নিজেকে এই মিথ্যা রূঢ়ভাষণে নিন্দিত করছ তুমি?
নারী—সত্যই আমার পরিচয় জানি না।
বসুরাজ—আমি অনুমান করতে পারি।
নারী—তবে অনুমান করুন।
বসুরাজ—তুমি কোন দেবতনয়া। নইলে দেবরাজ ইন্দ্রের প্রদত্ত এই বৈজয়ন্তী মাল্যের অম্লানপঙ্কজকুসুমের চেয়েও ফুল্ল ও সুন্দর ঐ মুখরুচি কি কোন মর্ত্যনারীর হতে পারে? কখনই না।
নারী বলে—না বসুরাজ। বড়ই ভুল অনুমান করেছেন।
বসুরাজ—তোমার কি কোন নাম নেই?
নারী—আছে, আপনার এই কাননভূমির সকল প্রাণী লতা ও পুষ্পের যখন নাম আছে, তখন আমারও একটি নাম আছে।
বসুরাজ—কি নাম?
নারী—গিরিকা।
বসুরাজ বুঝেছি গিরিকা, তুমি এই কাননেরই উপান্তবাসী কোন ঋষির তনয়া।
গিরিকা বলে—কী দেখে বুঝলেন?
বসুরাজ—তোমার এই স্নিগ্ধহাস্য বদনমাধুরী আর শান্ত সম্ভাষণ তোমারই পরিচয় প্রকট করে দিয়েছে। ঋষি পিতার আশ্রমচ্ছায়ে লালিত পুষ্পলতার মত তোমার তনুসুষমা আমাকে মুগ্ধ করেছে, গিরিকা।
গিরিকা—ভুল বুঝেছেন, আমার কোন পিতা নেই।
চমকে ওঠেন বসুরাজ—পিতা নেই? তোমার পিতৃপরিচয় জান না?
গিরিকা—না।
কিছুক্ষণ চিন্তান্বিতের মত দাঁড়িয়ে থাকেন বসুরাজ তারপরেই স্মিতহাস্যে ও পুলকিত স্বরে বলেন—বুঝেছি গিরিকা, তুমি এক অপ্সরার সন্তান।
গিরিকা—এমন ধারণা কেন করছেন?
বসুরাজ—হ্যাঁ, তোমার ঐ বিহ্বল দুটি অক্ষিতারকার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পেরেছি তোমার জন্মপরিচয়। তুমি এক অপ্সরার প্রণয়জাত সন্তান। তোমার নয়নে সেই প্রণয়ের উদ্ভাস, তোমার ওষ্ঠমুদ্রায় সেই মিলনবিহ্বল আনন্দের স্মৃতি সুন্দর রেখায় জন্মলাভ করেছে।
গিরিকা—না বসুরাজ, আমি অপ্সরার তনয়া নই।
বিব্রতভাবে তাকিয়ে থাকেন বসুরাজ—তবে কে তুমি?
গিরিকা—অনুমান করুন বসুরাজ।
বসুরাজ—তুমি কি কোন নির্বাসিতা রাজতনয়া?
গিরিকা হেসে ওঠে—না।
বসুরাজ—তবে তুমি কি কোন কুমারী নারীর গোপন প্রণয়ের সৃষ্টি?
গিরিকা—না।
বসুরাজ বিষণ্ণভাবে বলেন—মনে হয়, তুমি এক পরানুরাগিণী জনপদবধূর সন্তান, লোকাপবাদের ভয়ে তোমার সদ্যোভূমিষ্ঠ শিশুদেহকে এই বনভূমির তরুচ্ছায়াতলে বিসর্জন দিয়ে চলে গিয়েছিল সেই নিষ্ঠুরা।
গিরিকা—না।।
বসুরাজ—আর অনুমান করবার শক্তি নেই আমার। তুমিই বল তোমার জন্মপরিচয়।
গিরিকা—কিন্তু আমার জন্মপরিচয় জেনে আপনার কি লাভ হবে বসুরাজ?
বসুরাজ—কোন লাভ নেই, কৌতূহল মাত্র।
গিরিকা—কৌতূহল কেন?
বসুরাজ—আমি এই রাজ্যের অধীশ্বর, আমার রাজ্যের বনময় প্রদেশে কে তুমি সকল বনশোভা আরও দীপ্ত ও সুন্দর করে দিয়ে এই তরুচ্ছায়াতলে দাঁড়িয়ে আছ, সেকথা জানবার ও শুনবার অধিকার আমার আছে। আমারও কর্তব্য আছে, তাই এই কৌতূহল।
গিরিকা—আপনি কি আমার কোন উপকার করতে চান?
গিরিকার নিকটে এগিয়ে এসে ব্যাকুল বিহ্বল ও মুগ্ধ দুই চক্ষুর দৃষ্টি তুলে স্তবসঙ্গীতের মত সাকাঙ্ক্ষ স্বরে বলতে থাকেন বসুরাজ—আমার নিজেরই জীবনের উপকার করতে চাই, গিরিকা। যে-ই হও তুমি, তুমি চেদিপতি বসুরাজের আকাঙ্ক্ষিতা। তুমি আমার স্পৃহনীয়া বরণীয়া ও স্তবনীয়া। আমি তোমার ঐ ওষ্ঠপুটের সঞ্চিত মকরন্দের পিপাসী। তুমিই আমার জীবনের তৃষ্ণার্তি দূর করতে পার গিরিকা। ধন্য হবে আমার জীবন, যদি তোমার ঐ চিকুরতিমিরের ছায়া এইক্ষণে আমার এই বক্ষে লুটিয়ে পড়ে। তুমি বসুরাজের জীবনসঙ্গিনী হও, গিরিকা।
হঠাৎ বাষ্পার্দ্র হয়ে ওঠে গিরিকার দুই চক্ষু। কম্পিতকণ্ঠে বলে—কিন্তু…।
বসুরাজ—মিথ্যা দ্বিধা কেন, গিরিকা?
গিরিকা—মিথ্যা নয়, বসুরাজ।
বসুরাজ বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করেন—আমার জীবনসঙ্গিনী হতে তোমার মনে কি কোন আপত্তি আছে?
গিরিকা—আপনি বলুন বসুরাজ, এই পরিচয়হীনা নারী সংসারের কোন মানুষের প্রেমিকা হতে পারবে কি? আপনার কি সন্দেহ হয় না বসুরাজ, গিরিকার এই পুষ্পস্রগাসক্ত বক্ষের অভ্যন্তরে কোন প্রেমহীন হৃৎপিণ্ড লুকিয়ে থাকতে পারে? আপনার কি ভুলেও এই ভয় হয় না বসুরাজ, গিরিকা নামে এই বনচারিণী নারীর দেহশোণিতে ভয়ংকর এক বিষাক্ত সংস্কার লুকিয়ে থাকতে পারে?
হঠাৎ চঞ্চল হয়ে ওঠে বসুরাজের বক্ষের নিঃশ্বাস। অপলক নেত্রে গিরিকার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। যেন অষ্টাদশ বৎসর পূর্বের এক ঘটনার স্মৃতি বসুরাজের কল্পনায় হঠাৎ আর্তনাদ করে উঠেছে। চিৎকারধ্বনির মত বিচলিত স্বরে জিজ্ঞাসা করেন বসুরাজ।—তোমার জন্মপরিচয় বল অপরিচিতা। বল, কে তোমার মাতা?
গিরিকা—আমার মাতা শুক্তিমতী।
দুই চক্ষু মুদ্রিত করে আর স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন বসুরাজ। গিরিকার একটি কথার আঘাতে বসুরাজের সকল জিজ্ঞাসা হঠাৎ অন্ধ হয়ে গিয়েছে। শিষ্টপ্রতিপালক বসুরাজের হাতের বেণু-যষ্টি থর থর করে কেঁপে ওঠে। যেন এক বিদ্রূপের অট্টহাস্যে চুর্ণ হয়ে যাচ্ছে বসুরাজের কঠোর ন্যায়বিধির প্রাচীর, তারই শব্দ শুনছেন বসুরাজ। যেন অষ্টাদশ বৎসর পূর্বের এক প্রভাতের ক্রন্দনরতা এক নারীর অশ্রুসমাচ্ছন্ন চক্ষুর আবেদন এতদিন পরে বসুরাজের সম্মুখে এসে প্রশ্ন করছে—এইবার বল শিষ্টপ্রতিপালক বসুরাজ, সেই প্রাণ কি সত্যই অন্ত্যজাধম প্রাণ?
বসুরাজের ভাবনাভিভূত ও ব্যথিত দুই চক্ষু হতে ছিন্ন মনিসরের মত অশ্রুর ধারা ভূতলে লুটিয়ে পড়ে।
কিন্তু দেখতে পেয়ে চমকে ওঠে গিরিকা; আর বিচলিতভাবে সেই অশ্রুমুক্তা ধারণ করবার জন্য হস্ত প্রসারিত করে বসুরাজের কাছে এসে দাঁড়ায়। ব্যথিত স্বরে বলে— এ কি?
সিক্ত ও মুদ্রিত চক্ষুর পক্ষ্ম বিকশিত করে গিরিকার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন বসুরাজ। পর মুহূর্তে কাঞ্চনলতার মত ললিততনু গিরিকাকে দুই বাহুর আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে বক্ষোলগ্ন করেন, যেন তাঁর মিথ্যা ন্যায়বিধির অন্ধকার চুর্ণ করে দিয়ে অদ্ভুত সত্যের সুস্বপ্ন শরীরিণী হয়ে তাঁর কাছে এতদিনে দেখা দিয়েছে।
গিরিকা বলে—ভুল করবেন না, বসুরাজ। আমি যে এক নিগৃহীতার নিরানন্দ জীবনের আর্তনাদ হতে উদ্ভূতা, আপনার ন্যায়বিধির ঘৃণিতা ও নিন্দিতা।
বসুরাজ—তুমি সকলশমলা, সুনির্মলা। তুমি অনবরীণা, অনবগীতা।
গিরিকা—আমি এই জগতের দুর্ঘটনা; আমি বিনা অভিলাষের সৃষ্টি। আপনি আমার জন্মপরিচয় জানেন বসুরাজ।
গিরিকার প্রতিবাদ চকিত চুম্বনের আঘাতে স্তব্ধ করে দিয়ে বসুরাজ বলেন—তুমি জান না, তোমার মাতা শুক্তিমতীও জানে না তোমার জন্মপরিচয়। আমিও জানতাম না গিরিকা, কিন্তু আমি আজ জেনেছি।
বুঝতে না পেরে প্রশ্নাকুল নয়নে প্রণয়বিবশ বসুরাজের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে গিরিকা।
বসুরাজ বলেন—এই নিখিলের সকল প্রাণের পিতা যিনি, তাঁরই অভিলাষের সৃষ্টি তুমি।