বসুন্ধরা

বসুন্ধরা

আমার বাড়িটা বিশাল। তাই সময়ও ধরে অনেক। যেন কাটতেই চায় না। বছর তিনেক হল স্বামী গত হয়েছে, আমি এখন একা। তবে ‘একা’ বলা বোধহয় ঠিক হল না, বিলের মা আমার দেখাশোনা করে। রাতে থাকে। দিনের বেলা কাজের ফাঁকে সামলিয়ে আসে নিজের সংসার। বাজার কলোনিতে ওর বাড়ি। এই ছুটিটা ওর কাজের শর্তে নেই। আমার ছেলেমেয়েরা জানলে রাগারাগি করবে খুব। জানাই না। বউটার সম্বল বলতে ওই অভাবের সংসারটুকু। সেখানকার আশা, আশঙ্কা আঁকড়ে বিলের মা বাঁচে। ওটাই ওর জীবন-স্পন্দন। দিনের বেশিটা সময় আমি বসে থাকি হুইলচেয়ারে, ঝুলবারান্দায়। রাস্তার লোক চলাচল দেখি। পাড়ার পরিচিত জনের সঙ্গে হাসি দিয়ে কুশল বিনিময় করি। তাদের চোখে একটা অবধারিত জিজ্ঞাসাও দেখতে পাই। রাস্তা থেকে ঝুলবারান্দার দূরত্ব অনেকটাই, মাঝে আমার বাগান। গলা তুলতে হবে বলে কথাটা তাদের মনেই রয়ে যায়। প্রশ্নটা হচ্ছে, মাসিমা (অথবা দিদি), আপনি একা কেন এখানে থাকেন? অসুস্থ শরীর। ছেলেমেয়েরা যখন এত প্রতিষ্ঠিত, থাকতেই পারেন তাদের কাছে গিয়ে।

যে প্রশ্ন দৃষ্টিতেই আবদ্ধ, দায় থাকে না উত্তর দেওয়ার। ফলে বেঁচে যাই। রাস্তা যখন হয়ে পড়ে জনশূন্য, চেয়ে থাকি বাগানটার দিকে। পরিচর্যার বাগান। মালি আসে দু’বার। ফলফুল হয়। পাখি প্রজাপতি ঘোরে। তবু বাগানটার আগের সেই উজ্জ্বলতা আর নেই। কদিন আগের ঘূর্ণিঝড়ে আরও যেন কাহিল হয়ে পড়েছে। ঝড়ের তাণ্ডব মারাত্মক কিছু ছিল না। পুরো সময়টা জানালার পাশেই বসেছিলাম। এর চেয়েও ভয়ানক ঝড়বৃষ্টি দেখার অভিজ্ঞতা আমার আছে। ডুবে গিয়েছিলাম সেইসব স্মৃতিতে। বিলের মা দুপুরে বাড়ি গিয়েছিল, ঝড় চলে যাওয়ার পরও ফেরার নাম নেই। ভাবছি, কী হল? ফোন এল রাত দশটা নাগাদ। কারও মোবাইল সেট থেকে করেছে বিলের মা। ব্যস্ত গলায় বলল, মা,ঝড়ের চোটে বাড়ির টিনের চালা উড়ে গেছে। ঘরের জিনিসপত্তর ওলটপালট। রান্নাবান্না কিছু করতে পারছি না। গোটা কলোনির একই অবস্থা। বড় বড় গাছ পড়ে বাড়ি ভেঙে গেছে অনেকের। আজ আর যেতে পারছি না। কষ্ট করে ফ্রিজের খাবার দিয়ে রাতটা চালিয়ে নিয়ো। কাল সকালেই যাচ্ছি।

ভেবেছিলাম, বাড়িয়ে বলছে। এই সুযোগে একটা ছুটি করে নিল। তা নিক। স্বামী, বাচ্চার সঙ্গে একটা রাত কাটাতে পারবে। আমার রাতের খাবারের তেমন ঝামেলা নেই। খই, দুধ, একটু মিষ্টি হলেই চলে যায়। দুধটা ঠান্ডা খেতে হবে। হুইলচেয়ারে বসে রান্নার কাজ করা যায় না।

টিভি অন করতেই বিলের মায়ের খবরের সত্যতা প্রমাণিত হল। সুন্দরবন অঞ্চল ভেসে গেছে। কলকাতাও বিধ্বস্ত। প্রাচীন সব গাছ শিকড় উপড়ে পড়ে আছে রাস্তায়। আমার যেমন বহু ঘূর্ণিঝড়ের স্মৃতি আছে, ওদের ছিল প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। ঝড়ের দাপট তেমন না থাকলেও, কেন ওভাবে ধরাশায়ী হল ওরা? মাটির সঙ্গে শিকড়ের টান কখন যেন আলগা হয়ে গেছে, টের পায়নি। গাছগুলোর পরিণতি দেখে, কেমন একটা ভয় ঘিরে ধরল আমায়। আমি তো এখন একটা গাছেরই মতো। হুইলচেয়ারে শুধু দোতালাটা ঘুরতে পারি। আমারও কি আলগা হয়ে গেছে শিকড়, জীবনের কোন জিনিসটা আঁকড়ে বেঁচে আছি? স্বামী নেই, ছেলেমেয়েরা প্রবাসে, নাতিনাতনির গলা শুনতে পাই ফোনের মাধ্যমে। দৃষ্টি দিয়েও ছুঁতে পারি না ওদের বেদনা, আনন্দ, উচ্ছ্বাস। শিকড় আমারও উদাসীন হয়ে গেছে। মন নাড়া দেওয়া সামান্য কোনও ঘটনাই হয়তো আমাকে উপড়ে ফেলবে।

এই বাড়িটা কৰ্তা কিনেছিলেন শখ করে। চাকরি সূত্রে থাকতেন ভারতের প্রধান প্রধান শহরে। কোথাও পাঁচ বছর, কোথাও সাত, সঙ্গে আমিও থাকতাম। ছেলেমেয়ের স্কুলকলেজ বারেবারে পালটে যেত। সিমেন্ট-পিচ বাঁধানো শহরে হামেশাই হাঁপিয়ে উঠতেন কর্তা। তখনই মনের গভীরে থাকা একটা বাগানওলা বাড়ির আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আসতেন সামনে। কল্পনায় প্ল্যান তৈরি করতেন বাড়ির। বলতেন, একটা ঝুলবারান্দা থাকবে, কোমর সমান নকশা করা রেলিং, ছাদে যাওয়ার লোহার ঘোরানো সিঁড়ি, খড়খড়ি দেওয়া জানালা, এরকম আরও কত কী! পরিকল্পনার মধ্যে ঢুকে থাকত বিষ্ণুপুরের পৈতৃক বাড়ির কিছুটা, পুরুলিয়ার মামার বাড়ির আদলও থাকত। আরামবাগের এক জমিদার বাড়ির কিছু ডিজাইন যোগ হয়েছিল। গ্রাম মফস্সলের ওই পরিবেশেই বড় হয়েছিলেন তিনি। আমি ছিলাম পুরোপুরি কলকাতার মেয়ে। বিয়ের আগে অবধি কেটেছে ভবানীপুরে। কর্তা যখন বাড়ির প্ল্যান আমায় বলতেন, উৎসাহ ভরে ইন্ধন জোগাতাম। জানতাম, বাড়ির ভিত আসলে শূন্যে গাঁথা হচ্ছে। আমাকে একেবারে বোকা বানিয়ে চাকরির শেষ চার বছরের মাথায় কর্তা এখানকার জমিটা কিনলেন। তখন আমরা জামসেদপুরে। ছেলে দু’জন চাকরিতে ঢুকে গেছে, মেয়ে কলেজে ফাইনাল ইয়ার। কলকাতা থেকে একঘণ্টা দূরত্বে এই মফস্সল। আমাদের জমিটা রেল স্টেশনের পশ্চিম পাড়ে, অঞ্চলটায় তখনও লেগে ছিল গ্রামের জলছাপ। প্লট দেখাতে নিয়ে এসে কর্তা বলেছিলেন, বাসস্থান বলতে এরকম জায়গাকেই বোঝায়। আশপাশের গাছপালা দেখো, খাল, বিল, পুকুরের জলছোঁয়া বাতাস পেয়ে কেমন সজীব, সতেজ হয়েছে। এর প্রভাবে তোমার মন হবে নির্ভার, শুদ্ধ।

বছর ঘুরতে না ঘুরতেই কর্তার কল্পনার বাড়ি বাস্তব রূপ নিল। আমি মেয়েকে নিয়ে চলে এলাম এখানে। রিটায়ারমেন্টের পরও কোম্পানি ছাড়ল না কর্তাকে। এক্সটেনশন পেয়ে আরও দু’বছর কাটাতে হল বড় বড় শহরে। মৃত্যুর আগের দু’বছর কাটিয়েছিলেন তাঁর এই শখের বাগানবাড়িতে। ততদিনে এলাকা থেকে গ্রাম গ্রাম ভাবটা উধাও হতে শুরু করেছে। এখন তো পুকুর, দিঘি, ডোবা সমস্তটাই বুজিয়ে ফেলে পরের পর বাড়ি, বেশ কিছু ফ্ল্যাটবাড়িও উঠে গেছে। দূর দিয়ে খালটা বয়ে গেলেও স্বাস্থ্য খুবই শীর্ণ। হয়তো আমার বাগানের জৌলুষ কমার এটাই প্রধান কারণ।

একসময় ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা লুকিয়ে ফলফুল পাড়তে আসত বাগানে, আড়াল থেকে তাদের মিষ্টি দুষ্টুমি দেখতাম। এখন আর কেউ আসে না। সময় নেই তাদের। আমি ছোট্টগুলোকে কল্পনায় নিয়ে আসি। বলি, কী রে এত দেরি করলি কেন তোরা? ফলফুল তো সব মাটিতে পড়ে থেকে শুকিয়ে গেল। আমি চলতে পারলে ঠিক তুলে নিয়ে আসতাম।

আর্থারাইটিস পঙ্গু করেছে আমায়। বড় ছেলে থাকে আমেরিকার সিয়াটেলে, মেজ ছেলে মুম্বই, মেয়ের বিয়ে হয়েছে বেঙ্গালুরুতে। চাকরিও করে। তিনজনেই আমাকে বলে চলেছে তাদের কাছে গিয়ে থাকতে। ওরা ফোন করা মানে একটা পয়েন্ট মাস্ট। জানতে চায়, কী আছে ওই বাড়িতে?

সত্যিই তো, কীসের টানে পড়ে আছি? স্বামীও বেশিদিন এখানে থাকেননি যে বলব, বাঁচছি তাঁর স্মৃতির ভিতর। জুতসই কোনও উত্তর নেই আমার কাছে। ‘থাকতে ভাল লাগে’ বললে, অভিমান করবে। বলবে, আমাদের সঙ্গে থাকতে তোমার খারাপ লাগবে? নাতিনাতনিকে পাবে কাছে…

দায়সারা উত্তর দিয়ে ঠেকিয়ে রেখেছি ছেলেমেয়েকে। আমি তো নিজেই জানি না, কেন একলা আগলে থাকব বাড়িঘর? আমাদের পাড়াটাও আগের মতো আর সুন্দর নেই। রাস্তার ওপারে সামন্তদের একতলা বাড়ির পিছনেই উঠেছে ছ’তলা ফ্ল্যাটবাড়ি। দৃষ্টিপথ হয়েছে সংক্ষিপ্ত, আকাশে পাক খাওয়া চিলের পুরো বৃত্তটা দেখতে পাই না। অস্তরাগ ছোঁয়া মেঘগুলো এখন অনেকটাই থাকে চোখের আড়ালে। ফ্ল্যাটবাড়ির দেয়াল ডিঙিয়ে যখন উঠে আসে চাঁদ, বড় মূহ্যমান দেখায়।

তবে ফ্ল্যাটবাড়ি হওয়ার একটা ভাল দিকও আছে। নতুন মানুষ এসেছে কত! তাদের ধরনধারণ এক এক রকম। পাড়ায় যেহেতু নতুন, একটু সিঁটিয়ে থাকে। চেহারায় প্রতিভাত হয় ছেড়ে আসা বসতের বিষাদ। এদের মধ্যে এক ইয়ং দম্পতিকে আমার খুব পছন্দ হয়। বর-বউ দু’জনেই চাকরি করে। অফিস বেরোনোর সময় একটা অদ্ভুত কাণ্ড করে এরা। যার মানে আজ অবধি খুঁজে পাইনি। বর বেরোনোর ঠিক দু’মিনিট পর বউ বেরোয়। আমার বাড়ির গা দিয়ে যে রাস্তাটা গেছে স্টেশনের দিকে, সেটা ধরে এগিয়ে যায়। যতদূর দেখা যায় দেখেছি, নির্দিষ্ট একটা তফাত রয়েই যায় দু’জনের মাঝে। সন্ধেবেলা কিন্তু এরা বাড়ি ফেরে একসঙ্গে, হাসি গল্প করতে করতে। আমি ভাবি, ছেলেটার অফিস কি দু’মিনিট বেশি কড়া?

মেয়েটির একটা লক্ষ করার মতো অভ্যাস আছে, ফ্ল্যাটবাড়ির গেট থেকে বেরিয়ে একটু এগোলে মিউনিসিপ্যালিটির চাতালে বাঁধানো টাইমকল। মাত্র দু’ফুট উঁচু। সময় ধরে জল আসে, জল যায়। পাড়ার লোকেরা ব্যবহার করে। কল বন্ধ করার কথা কারও খেয়াল থাকে না। মেয়েটি কিন্তু অফিসের জন্য বেরিয়ে প্রথমে ওই কাজটি করে। সেই সময় ওর গার্ডার বাঁধা চুল পিঠ থেকে লাফিয়ে পড়ে সামনে। ব্যাগ কাঁধ থেকে নেমে কনুইয়ের ভাঁজে ঝোলে। সব সামলে নিচু হয়ে কলের প্যাঁচ বন্ধ করে সে। যেন জল সিঞ্চন করল এলাকার অবশিষ্ট গাছপালায়। যার কিছুটা আমার শিকড়েও এসে পড়ে। ছুটির দিন অথবা মেয়েটি যেদিন অফিস যায় না, জল পড়েই যায় কল থেকে। আমার আড়ষ্ট পা দুটোর গভীরে চনমন

করে ওঠে অজ্ঞাত কোনও স্নায়ু। যা স্মৃতির মতোই নিরুপায়। মেয়েটি ফের অফিস না বেরোনো অবধি আমার স্বস্তি নেই।

দিন পাঁচেক হয়ে গেল মেয়েটি বেরোচ্ছে না। ছেলেটি রোজকার মতো কাজে যাচ্ছে। রোজই আমি এই সময়টা মেয়েটার জন্য উন্মুখ হয়ে বসে থাকি। কল থেকে জল পড়ে যায় অবিরাম।

মেয়েটির অফিস না যাওয়ার ন্যায্য কারণ আছে। এখন সে পূর্ণগর্ভা। চোখের সামনে পেট বাড়তে দেখলাম তার। অফিস যাওয়ার পথে বরের সঙ্গে নির্দিষ্ট দূরত্বটা বজায় রাখতে পারছে না। পিছিয়ে পড়ছে ক্রমশ। কল বন্ধ করা কিন্তু ছাড়েনি। শেষ যেদিন দেখলাম, এতদূর থেকেও মনে হল মুখটা বুঝি লাল। তারপর থেকে ভাবছি, গলা তুলে মেয়েটাকে কল বন্ধ করতে বারণ করব। সে সুযোগ আর হয়নি। ক’মাস চলছে, কে জানে! অফিস না গিয়ে এবার হয়তো নার্সিংহোমে যাবে।

ছেলেটা বেরিয়ে এল। অভ্যেস মতো মৌরিটৌরি কিছু চিবোচ্ছে। হেঁটে আসছে নিত্যদিনের ছন্দে। হাতে সেই একই কালো ব্যাগ। ছেলেটার সঙ্গে আলাপ হয়নি। আগ বাড়িয়ে ওর বউয়ের খবর নিতে পারছি না। ছেলেটা চলে যাওয়ার পর গত ক’দিনের মতো কলের জলের দিকে তাকিয়ে বসে আছি। এমন সময় ওমা, একী, মেয়েটা বেরিয়ে এল যে। পরনে অফিসের সাজ। পেটটা আরও ভারী হয়েছে।… উত্তেজনায় পিঠ সোজা করে বসি। আজও কি কলটা বন্ধ করবে?

হ্যাঁ, মনে হচ্ছে তাই। মেয়েটা কলের সামনে দাঁড়িয়েছে। নিচু হয়ে কলটা বন্ধ করতে গিয়ে থেমে গেল। পারছে না। আবার চেষ্টা করছে। আমি চেঁচিয়ে বারণ করতে যাব, দেখি, মেয়েটা পেট থেকে সন্তানকে মাটিতে নামিয়ে কল বন্ধ করল। ফের বাচ্চাটাকে তুলে ঢুকিয়ে নিল পেটে।

ভিতর ঘরে ফোন বাজছে। চেয়ারের চাকা ঠেলে যেতে ইচ্ছে করছে না। নিশ্চয়ই ছেলেমেয়ে কারও। একটু ক্লান্ত পদক্ষেপে হলেও, মেয়েটি নির্বিকারভাবে চলেছে অফিসে। কপালের ঘামে হেসে উঠেছে আজ সকালের রোদ। মনে মনে বলে উঠি, সাবধানে যেয়ো মা, দুগ্গা, দুগ্গা… আমার সঙ্গে সঙ্গে আরও কারা যেন বলে উঠল একই কথা। কারা? পরখ করতে এবার উচ্চারণ করে মঙ্গল কামনা করি। আবারও কোরাস। এবার চিনতে পারি ওদের কণ্ঠস্বর। এরা হচ্ছে আমাদের এলাকার সেইসব লুপ্ত পুকুর, বিল, ডোবা।

তথ্যকেন্দ্র শারদ সাহিত্য ২০০৯

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *