বসবার ঘর – রমাপদ চৌধুরী
কোথায় যেন গিয়েছিল হিমু, হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে এল। রেখাকে দেখেই দম নেবার চেষ্টা করে হাসতে হাসতে বললে, ছোট বৌদি, কেলেঙ্কারিয়াস ব্যাপার।
—কী হল আবার? রেখার মুখে তখনও আতঙ্ক ছিল না বরং কৌতুকের ছিটে লেগে ছিল হাসিতে। হিমু কিছু একটা করে এসেছে হয়তো! দু’টাকার নোটটা কোথায় যে পড়ে গেল, কিংবা ভাঙানি পয়সা ফেরত নিতে ভুলে গেছি।
উঁহু, হিমু তখনও হাঁপাচ্ছে। কোনও রকমে বললে, অবনীবাবুকে দেখলাম। বাস থেকে নামলেন, সঙ্গে বোধহয় অবনীবাবুর বউ। বলে আমার দিকে তাকাল হিমু, আমি রেখার মুখের দিকে।
রেখার চোখ বললে, বোঝো এবার। তারপরই ব্যাপারটার গুরুত্ব বুঝে ওর মুখ ফ্যাকাশে হল, চোখ গোল গোল। রীতিমত আতঙ্ক সে-চোখে।
হিমু তখনও হাসছে। —দেখেই, বাস থেকে নামলেন আর আমি ছুটতে ছুটতে —এই দ্যাখো স্যান্ডেল ছিঁড়ে গেছে।
রেখা চট করে একবার ঝুল-বারান্দা থেকে উঁকি দিয়ে দেখে এল অবনীবাবুরা এসে পড়লেন কি না। আমার তখন এত আক্ষেপ হচ্ছে, কী যে করব ভেবে পাচ্ছি না। সেদিন অবনীবাবুদের পাড়া দিয়ে যেতে যেতে কী যে খেয়াল হলো, কেন যে ঢুঁ মারলাম ওঁর বাড়িতে!
অবনীবাবুর স্ত্রী খুব মিশুকে লোক, আলাপ হতেই বললেন, স্ত্রীকে নিয়ে আসবেন একদিন।
আমি দিব্যি ঘাড় নেড়ে সায় দিয়ে ভাবলাম রেহাই পাওয়া গেল। কিন্তু অবনীবাবু। বলে বসলেন, আহা, প্রথমে একবার তুমি গিয়ে না বলে এলে তিনি আসবেন কেন!
সে-কথাটা রেখাকে আর বলিনি, ভেবেছিলাম অবনীবাবুরা সত্যিই কি আর আসবেন। তা ছাড়া শুনলে রেখাও তো চটে যেত। —এলে কোথায় বসতে দেবে শুনি? অবনীবাবু একা হলেও কথা ছিল, মেয়েদের তো জানো না, সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তাদের দেখা চাই।
এখন আর সে-সব কথা বলার সময়ই নেই তার। রাস্তার মোড়ে লাল আলোটা হলুদ থেকে সবুজ হয়ে গেলেই যেন তাড়াহুড়ো পড়ে যায়, সমস্ত বাড়িটার এখন তেমনি অবস্থা। পলকের মধ্যে খবরটা মেজবউদির কাছে, কুমকুমের কাছে, ছোড়দির কাছে পৌঁছে দিয়ে এসে ও তখন আলমারির সামনে চাবির গোছা নিয়ে দাঁড়িয়েছে।
আলমারি খুলে সবে মণিপুরী বেডকভারটা বের করেছে, মেজবউদি এসে বললে, ছোট, ধোয়ানো চাদর আছে আর?
একটা সাদা চাদর বের করে দিলে রেখা, আর মেজবউদি সেটা হাতে নিয়ে কুমকুমকে ডাকতেই সে সুরুত করে বেরিয়ে গেল। বলতে বলতে গেল, ইস্, আমাকে বুঝি শাড়িটা বদলাতে হবে না!
রেখা ততক্ষণে বিছানার ওপর বেডকভারটা বিছিয়ে ফেলেছে, আলনার কাপড়গুলো দ্রুত হাতে গুছিয়ে রাখছে।
এমন প্রায়ই হয়। কেউ এসে পড়লে বা এসে পড়েছে শুনেই দুদ্দাড় ছোটাছুটি শুরু হয়ে যায়। দু’চার মিনিটে এলোমেলো নোংরা ঘর ক’খানা যতখানি সাজিয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা যায়।
—কাজের সময় কেন যে আসে। কাজের ফাঁকেই বিড়বিড় করল রেখা।
কেউ এলেই আজকাল চটে যায়। অথচ আগে প্রায়ই বলত, কী বাড়ি বাবা তোমাদের, কেউ বেড়াতেও আসে না!
অলক, আমার ইস্কুলের বন্ধু, এক সঙ্গে পড়তাম। হঠাৎ একদিন পনেরো বছর পর বাসে দেখা হয়ে গেল। চিনতে পেরে চলন্ত বাসেই জড়িয়ে ধরল, চল, তোকে আমার বাড়ি আজ যেতেই হবে।
আমি যত বলি, হবে হবে, আর একদিন গেলেই হবে, তবু শোনে কি। শেষে ঠিকানা লিখে নিল, বললে, না এলে দেখিস, বউকে নিয়ে একদিন গিয়ে হাজির হব।
রেখাকে এসে বললাম, জানো, আজ এক ইস্কুলের বন্ধু, অলক…
রেখা সব শুনে বললে, না গিয়ে ভালই করেছ, গেলেই তো আসার কথা বলতে হত…
—কিন্তু ও যে বলেছে, না গেলে নিজেই এসে হাজির হবে বউকে নিয়ে। আমি হাসতে হাসতে বললাম বটে, কিন্তু ভয় আমারও। ও তো জানে আমি চাকরি করছি ভাল, উন্নতি হয়েছে, এসে ঘরখানা যদি দেখে…
—সত্যি, বসবার ঘর একখানা না হলে কিন্তু চলে না। রেখা মাঝে মাঝে বলে। কিন্তু উপায় কী!
এত ইচ্ছে হয়, এই একঘেয়েমি ছেড়ে মাঝেসাজে এর ওর বাড়ি বেড়াতে যাই। ইচ্ছে হয় তারা মাঝে মাঝে বেড়াতে আসুক, দু’দণ্ড বসে গল্প করি, কিন্তু—না, আমাদের কোনও বসবার ঘর নেই। নেই বলেই দিনে দিনে মানুষগুলোকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছি, দূরে সরে আসছি নিজেরা, একা হয়ে যাচ্ছি।
ছি, ছি, মালপত্রে ঠাসা এই নোংরা ঘরে কাউকে এনে বসানো যায়? এই খাট- আলমারির বন্ধ-হওয়া অন্ধকূপে?
ওঃ, সেদিন কী ভয় পেয়েছিলাম! আলনা গুছিয়ে, বিছানার চাদর বদলে, রেখা-কুমকুম ওরা শাড়ি পালটে মেঝেতে তাড়াতাড়ি ঝাঁটা বুলিয়ে অপেক্ষা করে রইল। কিন্তু অবনীবাবুরা এলেন না। হিমুর কাণ্ড, কাকে দেখতে কাকে দেখেছে। কিংবা অবনীবাবুই হয়তো অন্য কারও বাড়ি গেছেন, বাস থেকে নামতে দেখে ও ভেবেছে এদিকেই আসছেন।
সেদিন খুব হাসাহাসি হয়েছিল হিমুকে নিয়ে। তখন অস্বস্তি কেটে গেছে, অবনীবাবু আসতে পারেন এমন ভয়ও নেই, তাই প্রাণ খুলে হাসতে পেরেছিলাম হিমুকে ঠাট্টা করে।
কুমকুম তবু ঠোঁট ঝুলিয়ে বলেছিল, আমাদের বাড়িটা কী রে ছোটদা, একটা ড্রয়িং রুমও নেই।
বাইরের লোক এলে তাকে বসতে দেবার জন্যে এক টুকরো বারান্দা থাকলেও কথা ছিল। তা-ও নেই। না, আমাদের কোনও বসবার জায়গাই নেই।
কিন্তু মেজদা বড় মেজাজি রসিক মানুষ। কুমকুমের অভিযোগ শুনে খেঁকানি দিয়ে উঠলেন। —কী নেই? তারপর কুমকুমের আদুরে-আদুরে গলাটা নকল করে ভেংচি কাটলেন, ড্রয়িং রুম? টুল-রুম নেই তার ড্রয়িং রুম।
—টুল-রুম কী মেজদা? কুমকুম বুঝতে না পেরে জিগ্যেস করলে।
—টুল-রুম বুঝলি না? বসবার জন্যে দু’একটা টুল রাখার মতো ঘর। মেজদা নিজের রসিকতায় নিজেই হাসতে লাগলেন।
আট বছরের টুটু মিশনারি ইস্কুলে পড়ে, ও মাস্টারি করতে ছাড়ল না। ঠাণ্ডা গম্ভীর গলায় বললে, ড্রয়িং রুম না রে দিদি, আজকাল সিটিং রুম বলে।
—তুই থাম তো। কুমকুমের ভুল ইংরেজি উচ্চারণ ধরে ও কথায় কথায়, তাই ধমক দিয়ে থামিয়ে দিল কুমকুম।
এদিকে মেজবউদি কোন ফাঁকে এসে ঢুকেছেন কেউ লক্ষ করেনি। বললেন, তোমার আবার ড্রয়িং রুমের দরকার পড়ল কেন শুনি? পাত্রপক্ষ যখন মেয়ে দেখতে আসবে, তখন এই ঘরে বসতে দিলেই হবে, তোমার অত দুশ্চিন্তা বইতে হবে না।
কুমকুম নাক উঁচু করল। —বয়ে গেছে গান্ধীর মতো গালে হাত দিয়ে বসতে। আমি বিয়েই করব না।
মেজদা-টার পড়াশুনো বেশি এগোয়নি, বিয়াল্লিশে বন্দে মাতরম্ করে জেলে গিয়েছিল, এখন ছোট্ট একটা চিনেমাটির কারখানা চালায়। মেজদা হেসে বললে, গান্ধীর সে ছবি তোরা দেখেছিস? তোরা তো ভাবিস গান্ধী বলে কেউ ছিল না।
আমি বললাম, পাগল হয়েছে মেজদা, সে-ছবি কোথায় দেখবে? ও নির্ঘাত কোনও বইয়ে…
কুমকুম কিন্তু আবার ড্রয়িং রুমেই ফিরে গেল। —তোমরা বুঝবে না। নাকের ডগা থেকে চিবুক অবধি এমন একটা ঘেন্না ঝরিয়ে দিল কুমকুম যে আমরা হেসে ফেললাম। ও আরো চটে গেল, চোখ কান্না-কান্না। —জানো, কলেজের সবাই আমাকে আনসোশ্যাল বলে। কারও বাড়ি যাই না, কাউকে আসতে বলি না। শুধু সুধা আর নন্দিতা, ওরা তো ছোট থেকে দেখছে।
মেজবউদি বুঝতে পারেননি, পান চিবোতে চিবোতে বললেন, গেলেই পারো তাদের বাড়ি, কার শাসনই বা তুমি মানো।
কুমকুম হাসল। —বসবে কোথায় তারা, এলে? এই ঘরে কাউকে আনা যায়?
টুটু ভারিক্কি চালে বলে উঠলো, ঠিক বলেছিস দিদি। স্কুলের বাস থেকে একদিন উমাশঙ্কর প্যাটেল, নামতে চাইল। আমার এত লজ্জা করছিল—
রাগে আমার কান ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল। ছেলেটার পাকামি দেখলে, ওর এই আট বছরে আটচল্লিশের ভান দেখলে অ্যাংলো ইণ্ডিয়ান ইস্কুলগুলোর ওপর রাগে আমার সারা শরীর জ্বলে যায়। ওঃ কী লাটসাহেব রে, বসার ঘর নেই বলে ওঁর লজ্জা। ড্রয়িং রুম-ওলা বাড়ি ভাড়া নিলে যে তোকে কর্পোরেশন ইস্কুলে পড়তে হবে তা জানিস? একটা ধমক দিতে যাচ্ছিলাম তাই।
কুমকুম তার আগেই হেসে উঠেছে। —আমি বাবা কারও জন্মদিনে যাই না সে জন্যে।
বাড়িটার দিকে তাকালে আমার নিজেরও গা রি-রি করে, কুমকুমকে দোষ দেব কি! ঘর তো নয়, এক একখানা গোডাউন। কাঠের বেঞ্চির ওপর সারি সারি তোরঙ, একটার ওপর একটা, ওপাশে লেপ তোষক স্তূপীকৃত করা আছে, খাট-আলমারি, খাটের নীচে থেকে বিয়ের সময় পাওয়া গামলা কলসি হাঁড়ি ইত্যাদি উঁকি দিচ্ছে, ওপাশে আলনা— যেটুকু দেয়াল দেখা যাবার কথা, তাও সতেরোটা ক্যালেণ্ডারে চালচিত্তির হয়ে আছে।
যাচ্ছেতাই, যাচ্ছেতাই।
বাবা অবশ্য এখন রিটায়ার করেছেন, কিন্তু সেই অসুখের সময় বাবার আপিসের হালদার সাহেব দেখা করতে এলেন, বাবা তো ‘এখানেই নিয়ে আয়’ বলে খালাস। আমার যে কী অস্বস্তি হচ্ছিল! মা আবার শাড়ির পাড় জুড়ে জুড়ে ট্রাঙ্কের ঢাকা বানিয়েছে। এত সেকেলে লাগে।
এমন একটা আতঙ্ক নিয়ে বাস করা যায়!
ভেবেছিলাম, অলক হয়তো ভুলে গেছে, আর আসবে না। অবনীবাবু মুখে যাই বলুন, সত্যি কি কেউ যেচে নিজে নিজে আসতে পারে!
কিন্তু সেদিন অলক হঠাৎ আপিসে এসে হাজির।
হেসে বললে, কী রে গেলি না তো? আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, আপিসের খবর পেলি কোত্থেকে?
—বাঃ, সেদিন তো বললি, টেলিফোন ডিরেক্টরি দেখে…
তারপর একটু থেমে বললে, বউয়ের কাছে প্রেস্টিজ আর রইল না, এত গল্প করেছি এতদিন, তারপর সেদিন বললাম, দেখা হয়েছে, আসবে বলেছে…
বললাম, সময় পাই না, যাব যাব।
—আর গিয়েছিস! উমা প্রত্যেক রবিবার বলে, কই গো তোমার সেই বন্ধু তো এল না। অলকের মুখ দেখে মনে হল ও ভেবেছে আমি ওকে ভুলে গেছি, কিংবা ওকে তাচ্ছিল্য করছি।
আমি চা আনিয়ে হাসতে হাসতে বললাম, ঠিক আছে, এই সপ্তাহে যাব।
মনে মনে প্রতিজ্ঞাও করে ফেললাম। অলক, অলকই তো, সেই ছোটবেলায় কত বন্ধু ছিল! একটা দিন দেখা না হলে মন খারাপ হত, রাত্রে ঘুম হত না, যার যত সমস্যা একজন আর একজনকে না বলে শান্তি ছিল না। আর সেই প্রেমপত্র লেখা?
মনে পড়তেই হেসে ফেললাম। —স্বর্ণর খবর কী রে?
অলক লজ্জা পেল। বললে, কী জানি, ওর তো সেই আসানসোলে বিয়ে হয়েছিল, তারপর…
ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি তখন দু’জনে, স্বর্ণর সঙ্গে ভালবাসাবাসি হয়েছিল অলকের। কিন্তু বেচারা বাংলায় ভীষণ কাঁচা ছিল, আর কী বিশ্রী হাতের লেখা। ফলে অলকের নাম দিয়ে আমাকেই প্রেমপত্র লিখতে হত। কত শলাপরামর্শ করে সুন্দর সুন্দর চিঠি লিখে দিতাম, আর উত্তর পেলেই এসে হাজির হত অলক। আমি বলতাম, স্বর্ণ দেখিস শেষে আমারই প্রেমে পড়ে যাবে, যদি জানে আমার লেখা…। কখনও ভয় দেখাতাম, স্বর্ণকে একটু চুমু খেতে দিবি বল, তা নইলে যাও বাবা নিজে লিখবে যাও। ওর তখন হাতের লেখা বদলানোর উপায় নেই, অথচ আমার কথা শুনে ওর খুব খারাপ লাগত যেন আমি সত্যি সত্যি চুমু খেতে চাইছি। তখন তো জানতাম না, যাকে ভালবাসা যায়, মানুষ তাকে ভিতরে ভিতরে শ্রদ্ধাও করে।
সে-সব কথা মনে পড়তেই বললাম, তোর বউকে কিন্তু সব বলে দেব।
অলক হা হা করে হেসে উঠলা।—আরে আমিই তো সব বলেছি, তুই চিঠি লিখে দিতিস তাও। তাই তো বলে, তোকে একদিন…
আমি কথা দিলাম। অলক বিশ্বাস করে চলে গেল।
কিন্তু আমার ভীষণ খারাপ লাগল। রেখাও সব শুনে সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল। —যেতে হয় তুমি একা যাও আর ভালমানুষ সেজে তাদের আসতে বোলো না যেন।
আচ্ছা, কারও বাড়ি গিয়ে তাকে আসতে না বললে চলে!
আর ইচ্ছেও তো হয়। এত যে একা একা লাগে, সন্ধ্যের পর কোথায় যাব খুঁজে পাই না, ছুটির দিনগুলো এত বিস্বাদ হয়ে ওঠে, কোথাও গিয়ে গল্পগুজব করে মশগুল হয়ে যেতে সাধ হয়… নাঃ, শুধু একটা বসবার ঘরের অভাবে ক্রমশ যেন নিজেদের গুটিয়ে ফেলছি; সকলকে দূরে সরিয়ে দিয়ে খোলসের মধ্যে ঢুকে পড়তে চাইছি।
মনেপ্রাণে যেটা ইচ্ছে হয় সেটাই একটা আতঙ্ক।
মনে হয় যাদের বেশ একটা সুন্দর সাজানো গোছানো বসবার ঘর আছে তাদের মত সুখী আর কেউ নেই।
অনেক আগে বিজ্ঞাপন দেখে ট্যুইশনির জন্যে দরখাস্ত করেছিলাম পরাশর রোডের সেই বাড়িটা যেন চোখে লেগে আছে। জানালায় কী সুন্দর পর্দা, দেওয়ালে হালকা সবুজ রং, আর বসবার ঘরখানা। থালার মতো বড় একটা ঘষা কাচের শেড, আলোটা ঠিক সাদা মেঘ-ঢাকা জ্যোৎস্নার মতো। মেঝেতে কী নরম কার্পেট, জুতো পরে ঢুকব, না খুলে রেখে, ভেবে পাইনি। আর শোফা সেট! কী নরম গদি, কী চমৎকার ফিকে রঙের ঢাকনি।
বহুদিন অবধি অমন একটা ড্রয়িং রুম আমার স্বপ্ন ছিল। ভাবতাম মাইনেটা যদি বাড়ে, নতুন বাড়ি ভাড়া নিয়ে একখানা বসবার ঘর সাজাব মনের মতো করে। তখন আর বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন কাউকে ভয় পাব না।
ভয় পাব না বললেই তো ভয় দূরে সরে থাকবে না।
রবিবার বিকেলে ঘুম থেকে উঠে সবে চায়ের কাপে চুমুক দিয়েছি, ইস্ চায়ের কাপটাও কী বাজে, দোকানের শো-কেসে সেদিন কী সুন্দর সুন্দর ডিজাইন দেখলাম, —কুমকুম এসে বললে, ছোটদা, কে এসেছে তোমার কাছে, সঙ্গে মেয়েছেলে…
চা-টা নিমেষে আরও বিস্বাদ লাগলো। কে এল? অবনীবাবু? অলক? রেখাদের সম্পর্কের কেউ?
তাড়াতাড়ি না গিয়েও উপায় নেই, নিশ্চয়ই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। টুটু-হিমু পড়তে বসেছে, মাস্টার এসেছে তাদের, সেখানেও যে বসতে বলব, তার উপায় নেই। রেখাই বা গেল কোথায়?
গিয়ে দেখি অলক। —সঙ্গে বউ!
অলক বললে, বলেছিলাম না, না গেলে নিজেই আসব। বলে হাসল ও। পরিচয় করাল, এই উমা।
বাঃ, বেশ ছিপছিপে চেহারা, মিষ্টি মিষ্টি মুখ, রঙটা একটু চাপা, চাপা বলেই ভাল লাগছে।
উমা হাসি হাসি মুখে বললে, পর্বত যখন মহম্মদের কাছে যাবে না…
ভিতরে ভিতরে তখন অস্বস্তি বোধ করছি, আমার হাসিটাও কেমন নকল নকল ঠেকল নিজের কাছেই। মন খুলে কথা বলতেও পারছি না। কিন্তু এভাবে আর দাঁড় করিয়ে রাখা যায় না। বললাম, চলুন। চল্ ভিতরে চল্।
ঘরের ভিতরে নিয়ে এসে ভাঙা চেয়ারটা টেনে দিলাম অলককে, উমা খাটের পাশে বসল।
রেখা এল, কুমকুম এল।
অলক দেখে বললে, কুমকুম? এত বড় হয়ে গেছে? বাগেরহাটে থাকতে মনে আছে? ওকে রথ দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলাম কোলে করে?
কুমকুম হাসল। বোকার মতো। ও তো চিনতে পারছে না। আর আমি ভাবলাম, বাগেরহাটের সেই বাড়ি, সেই বাগান— অলক আর উমা এই ঘরখানা দেখে কী ভাবছে কে জানে।
অস্বস্তি কিংবা ঘরদোরের লজ্জায় রেখাও ওদের সঙ্গে ভাল করে আলাপ করতে পারল না।
বাবাকে প্রণাম করে, মেজদার সঙ্গে, মেজবউদির সঙ্গে গল্প করে অলক চলে গেল। বারবার বলে গেল, যাস কিন্তু একদিন!
ওরা চলে যাওয়ার পর কী স্বস্তি। হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। ওরা কী ভাবল কী জানি। এক সময় তাই অনুশোচনায় মুষড়ে পড়লাম। এসেই যখন পড়ল, তখন এত সঙ্কোচের কী ছিল, মন খুলে গল্প করে আবার তো ছোটবেলার সেই জীবনে কিছুক্ষণের জন্যে ফিরে যেতে পারতাম। তা নয়, শুধু ‘হুঁ’ আর ‘না’। রেখাও তো দু’চারটে কথা বলতে পারত। অলক এত অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিল আমার এত আপন, অথচ মনে হল যেন সিঙাড়া আর চা খেতে এসেছিল।
নিজের ওপর রাগ হল, রেখার ওপর, সমস্ত বাড়িটার ওপর। এক এক সময় রাগে সব তছনছ করে দিত ইচ্ছে করে, ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করে, কিংবা মেজদা, মেজবউদি, হিমু, কুমকুম সকলকে ছেড়ে একটা ছোট্ট সুন্দর স্বার্থপরতার ফ্ল্যাটে পালাতে ইচ্ছে করে। তখন আর এত অস্বস্তি থাকবে না, সঙ্কোচের খাঁচার মধ্যে লুকিয়ে থাকতে ইচ্ছে হবে না।
—কী ভাবল বলো তো আমাদের, রেখাকে বললাম।
রেখা মুখ কাচুমাচু করে বললে, সেবার ছোট জামাইবাবু এসেছিল, ফিরে গিয়ে বলেছে আমরা নাকি কথা বলি না, মিশতে জানি না…
আমি হাসলাম।—কেন তা তো জানে না।
রেখা হঠাৎ হেসে উঠল, বললে, যা হবার তা তো হয়েই গেছে, চলো একদিন অলকদের বাড়ি যাই।
সত্যি তো, এখন তো আর ভয় নেই। গেলেই হয়। বরং অলক খুশি হবে, উমা খুশি হবে, আমাদের সম্পর্কে ভুল ধারণা হবে না।
ঠিকানা খুঁজে খুঁজে একদিন গিয়ে হাজির হলাম রেখাকে সঙ্গে নিয়ে।
গলিটায় ট্যাক্সি ঢুকতে চাইল না, তাই ভাড়া মিটিয়ে বাড়ির নম্বর দেখে দেখে হাঁটছি, একটি বাচ্চা মেয়ে জিগ্যেস করল, কাদের বাড়ি খুঁজছেন?
অলকের নাম বলতেই বললে, উমাদিদের বাড়ি? ওই তো। দরজায় কড়া নাড়ুন।
ও মা, এই বাড়ি। মান্ধাতা আমলের জীর্ণ বাড়ি, দেয়ালে গঙ্গাজলের ট্যাঙ্ক থেকে জল গড়িয়ে গড়িয়ে শ্যাওলা ধরেছে। গলিটায় কেমন একটা ভ্যাপসা দুর্গন্ধ।
কড়া নাড়তেই কে এসে দরজা খুলে দিল। কে আবার? অলক। তারপর আমাদের দেখে অলকের সমস্ত মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। —চিৎকার করে ডাকল, উমা, এই উমা, আরে দেখবে এসো কারা এসেছে। কী ভাগ্য রে, তোরা সত্যি সত্যি… আসুন বউদি, আসুন।
উমাও ছুটে এল। এক গাছ ফুলের মতো মুখ নিয়ে। আনন্দে বিস্ময়ে রেখার আর আমার দুখানা হাত ধরে ফেললো দু’হাতে। —আসুন আসুন! এই মন্টু, মন্টু, তোর সেই নতুন কাকিমা এসেছে রে… মন্টু তো এসে ঢিপ করে প্রণাম করল আমাদের।
উঁচু নিচু ভিজে ইঁটের উঠোন ডিঙিয়ে একবারে শোবার ঘরে নিয়ে গেল উমা। কিংবা ওই একটাই ঘর হয়তো। একটা তক্তপোশ, কম দামি একটা রেডিয়ো, কেরোসিন কাঠের একটা খাবারের আলমারি, দেয়ালের পেরেকে একটা তালপাতার পাখা। অলক ভাঁজ খুলে ক্যানভাসের চেয়ারটা পেতে দিল, নিজে একটা মোড়া টেনে নিল। আর উমা রেখার হাত ধরে হাসতে হাসতে তক্তপোশের ধারে বসাল।
তারপর বললে, এক মিনিট ভাই, চায়ের জলটা বসিয়ে আসি।
আমি বললাম, আহা, এত তাড়া কীসের?
—আপনাদের নামে আমারও এক কাপ হয়ে যাবে যে, স্বার্থ আছে বইকী। বলেই চলে গেল উমা।
দু’মিনিট পরেই ফিরে এসে বসল রেখার পাশে। বললে, ওরা এত বন্ধু, আমরাও দু’জনে খুব বন্ধু হয়ে যাব, কী মশাই, রাজি তো? বলে রেখার হাতে হাত রাখল।
একটু পরেই রেখাকে বললে, চলো ভাই। তুমি বললাম বলে রাগ করলে না তো?
রেখাকে দেখে মনে হল ও অনেকদিন পরে যেন হাসতে শিখেছে। খুশি-খুশি।
উমা আমাকে বললে, গল্প করুন। বলেই রেখাকে বললে, চলো চলো আমরা দু’জনে মিলে চা-টা করে নিই।
বাঃ রে, উমা নয়, রেখা এসে চা দিয়ে গেল। আমার ভীষণ ভাল লাগল। খুব আপন আপন। যেন নিজেরই বাড়ি।
একটু পরেই উমা চিৎকার করল।
—ও স্যার, আপনারা এখানে আসুন না; একসঙ্গে গল্প করি।
অলক হেসে বললে, চল, তোকে ডাকছে।
রান্নাঘরের সামনে এসে দাঁড়াতেই দুটো পিঁড়ি এগিয়ে দিল উমা। —বসুন এখানে। একা একা দু’জনে স্বর্ণলতার গল্প করবেন, ওসব হবে না।
—স্বর্ণলতা কে? রেখা চোখ কপালে তুলল।
—ও মা জানো না। বলে রসিয়ে রসিয়ে আমার প্রেমপত্র লিখে দেওয়ার গল্পও বলল উমা, বলতে বলতে হেসে গড়িয়ে পড়ল।
আমি ততক্ষণে লক্ষ করেছি, আটা মেখে লুচি ভাজার ব্যবস্থা করছে উমা, আর রেখা লুচি বেলে দিচ্ছে।
হঠাৎ তাই বলে বসল, কী মশাই, বউকে খাটিয়ে নিচ্ছি বলে চটে যাচ্ছেন না তো!
আমরা সবাই হেসে উঠলাম। লুচি ভাজতে ভাজতে উমা হঠাৎ সহাস্য বলে উঠল, সত্যি বলুন তো, স্বর্ণলতা খুব সুন্দর ছিল? আমার চেয়ে?
ছেলেবেলার গল্পের মধ্যে ডুবে গিয়ে কীভাবে যে সময় কেটে গেল টেরই পাইনি। উমা প্রথমে আব্দার ধরেছিল রাত্রেও খেয়ে যেতে হবে। আর একদিন এসে খেয়ে যাব কথা দিলাম। যখন বিদায় নিলাম, বাস স্টপ অবধি ওরা দু’জনেই এল।
বাস ছেড়ে দেওয়ার পরও ফিরে দেখলাম ওরা তখনও আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। রেখা ওর হাতে বাঁধা ছোট্ট ঘড়িটা দেখে বললে, পৌঁছতে পৌঁছতে রাত দশটা বেজে যাবে।
বললাম হুঁ।
তারপর স্বগতোক্তির মতো যেন নিজেই বললাম, খুব মিশুকে কিন্তু ওরা, কেমন আপন-আপন। রেখা কী ভাবছিল।
—ওদেরও কিন্তু… কী বলতে গিয়ে চুপ করে গেল রেখা। শুধু বললে, হ্যাঁ, খুব মিশুকে।
০৮.১০.১৯৬৭
প্রথম প্রকাশ ১৯৬৭ ’র শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকায়
লেখক পরিচিতি
রমাপদ চৌধুরী: ২৮ ডিসেম্বর ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে খড়গপুরে জন্ম। পঁচিশ বছর বয়স থেকে শারদীয়া আনন্দবাজার ও দেশ পত্রিকার নিয়মিত লেখক। ১৯৬৩-তে আনন্দ পুরস্কার। ১৯৭১-এ ‘এখনই’ উপন্যাসের জন্য রবীন্দ্র পুরস্কার। ১৯৮৩-তে অকাদেমি পুরস্কার ও জগত্তারিণী সুবর্ণপদক। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাম্মানিক ডি লিট।