বসন্ত
দোলযাত্রা’র পুণ্য প্রভাত। সক্কাল সক্কাল দাঁতটাত মেজে, অতি সুপ্রসন্ন মেজাজে বাহুবলী স্টাইলে আরাম করে সোফায় বসে প্রাতরাশের অপেক্ষা করছি, এমন সময় মনে হলো আইলা, আজ হোলি না?
ভাবতেই নোলাটা কেমন স্যাক স্যাক করে উঠলো বুঝলেন? হায়, আজও কী দরিদ্র কায়স্থসন্তানের কপালে সেই রুটি আর ঢেঁড়সসেদ্ধ? আজও কি ঈশ্বর আমার প্রতি সদয় হবেন না? আজও কি গরীবের পেট মুক্তন্ট্রে বলে উঠবে না, ”হামে চাহিয়ে আজাদি, ঢেঁড়সসেদ্ধসে আজাদি…?” দেশ জাতি সমাজ সবই কি আজ অত্যাচারী শাসকের কবলে? হায় বন্ধু, মানবতা আজ কোথায়? কোথায় সেই বসন্তের বজ্রনির্ঘোষসম ”অচ্ছে দিন?” নিপীড়িত শোষিত নিষ্পেষিত অত্যাচারিত ভুখা পেট কি আজকে বিপ্লবের ধ্বজা তুলে ধরে গেয়ে উঠবে না, টু আর্মস সিত্রোঁয়ে..
এইসব ভেবেটেবে মনটা ভারী নরম হয়ে এসেছে, আরেকটু পর কেঁদে ফেলবো ফেলবো অবস্থা, এমন সময় মনে হলো একবার চান্স নিয়ে দেখি নাকি? বলা যায় না, ঈশ্বরবাবু যদি আজ তেনার বার্থডে উপলক্ষ্যে ইস্পেসাল কিছু অ্যারেঞ্জ করে রাখেন? মানে বেড়ালের ভাগ্যে কশ্চিৎ কদাচিৎ এমন সৌভাগ্যের উদয় হয় বটে। তবে আমি এমনিতে ঘরপোড়া গরু কি না, তাই এ ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হওয়ার জন্য রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে একটা রাজসিক হাঁক পাড়লাম, ‘কই হে, আমার ব্রেকফাস্ট কই? দেখো, লুচিগুলো যেন ফুলকো ফুলকো হয়, আর আলুরদমটা মাখোমাখো। আশা করি জানো যে আমাদের বাড়িতে গাওয়া ঘি ছাড়া লুচি ভাজা হয় না। মোহনভোগটা একবাটিই দিও। আর হ্যাঁ, নলেনগুড়ের ”আবার খাবো” টা ভুলো না যেন।’
বলেই চট করে চোখটা বন্ধ করে ফেললুম।
ছোটবেলা থেকেই আমার এই এক স্বভাব। বিপদ আসন্ন দেখলেই চোখটা বুজে ফেলি। মানে যা হয় হোক, আমাকে তোর আর দেখতে হচ্ছে না!
কিন্তু আমাকে চমকে দিয়ে ঈশ্বর বললেন ‘ওহে খোকা, আজ হাম তোমার উপর সুপ্রসন্ন হ্যায়। কেয়া মাংতা হ্যায় চট করে বলে ফেল দিকিনি। আজ আমার আবার একটু তাড়া আছে।’
দৈববাণীর মতই রান্নাঘর থেকে সুমধুর কণ্ঠ ভেসে এলো, ‘শুধু গাওয়া ঘিয়ে ভাজা লুচি খাবে গো? তার সঙ্গে একটু কমলালেবুর পায়েস আর রাবড়ি দিই? নাকি লুচির বদলে ঘিয়ে ভাজা পরোটাই করে দেবো? আর কালকে ওপরের মাসিমা বর্ধমানের সীতাভোগ দিয়ে গেছেন, খাবে নাকি?’
আমি তো মাইরি, ভালো বাংলায় যাকে বলে, টোটাল স্তম্ভিত ! নিজের গায়ে জোরসে চিমটি কেটে নিজেই লাফিয়ে উঠলাম। এ কি সত্য? নাকি স্বপ্ন?
জিভের জলটা সুরুৎ করে টেনে নিয়ে বললাম, ‘ইয়ে, আর দুপুরে কী হয়েছে আজ?’
রান্নাঘর থেকে সুরলহরী ভেসে এলো, ‘দুপুরে? মাখো মাখো ছানার ডালনা দিয়ে রাধাবল্লভী, তারপর দেরাদুন রাইসের সঙ্গে তেলতেলে গোটা কপি দিচ্ছি। চিতল মাছের পেটি আছে বেশ তেলঝাল দিয়ে। ও হো, তেলকইয়ের কথাটা বোধহয় বলিনি, না? তা সেই তেলকইয়ের পর কষা কষা মাটন রোগনজোশ আর আউধের পোলাও , শেষপাতে মোল্লারচকের লালদই, সূর্য মোদকের জলভরা তালশাঁস আর নলেন গুড়ের আইসক্রিম। আর হ্যাঁ, এর সঙ্গে জয়নগরের মোয়াও রাখবো কি?’
বলা বাহুল্য, এরপর কেঁদে না ফেললে কান্নাকাটি ব্যাপারটা থাকার কোনও মানেই হয় না। ফোঁপাতে ফোঁপাতে ধরা গলায় বললাম, ‘আর রাতে?’
‘রাতে তো মোর্গমসল্লম আর আরসালানের স্পেশাল বিরিয়ানির অর্ডার দিয়েছি। তারপর ফিরনি। আর শেষে রসমাধুরী, মালাই চমচম আর নাহুমের প্লাম কেক। এতে তোমার হয়ে যাবে না সোনা?’
চশমা খুলে হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোখের জলটা মুছে নিলাম। আহা, আজ আকাশটা কী সুন্দর, বাতাসে কী সুমধুর ইয়ে, মধুবাতা ঋতায়তে, মধুঃক্ষরন্তি সিন্ধবাঃ..
‘আর শোনো না, অলিপাব থেকে তোমার প্রিয় ওই চিকেন আ লা কিয়েভ না কি একটা আছে না? ভাজা চিকেনের মধ্যে মাখনের পুর দিয়ে? ওইটা অর্ডার করলে বাড়িতে দিয়ে যাবে না গো?’
এবার ফেঁৎ ফেঁৎ করে নাকটা ঝেড়ে ফেলতে গিয়েই কেমন একটা কুটিল সন্দেহ হতে লাগলো, বুঝলেন। একই দিনে এত ভাগ্যোদয়, মানে এ যে সৌভাগ্যের ষাঁড়াষাঁড়ি বান ডেকেছে রে ভাই! বলি কপালটা একটু রয়েসয়ে খুললে হতো না? এই রেটে খুললে তো শেষমেষ কপাল হাতে নিয়ে ঘুরতে হবে দেখছি। সেটাই কি খুব ভালো দেখাবে, অ্যাঁ?
সন্তর্পণে প্রশ্ন ভাসিয়ে দিলাম, ‘হ্যাঁ গো, ইয়ার্কি করছো না তো?’
ওধার একটা ছোট সাইজের পরমাণু বোমা উড়ে এসে কানের কাছে ফেটে পড়লো, ‘ইয়ার্কিটা কে শুরু করেছে শুনি? যার কোলেস্টেরল দুশো আশি, ট্রাইগ্লিসারাইড চারশোর ওপর, ব্লাড প্রেশার একশো পঞ্চাশ বাই একশোয় চড়ে বসে আছে সে কোন আক্কেলে লুচির কথা বলে শুনি? আর মিষ্টি? তোমার লজ্জা করে না মিষ্টির কথা বলতে? ডাক্তার পইপই করে বলে দিয়েছে তোমার মিষ্টি খাওয়া বারণ, তা সত্ত্বেও কোন আক্কেলে তুমি কাল পাড়ার মোড়ে দাঁড়িয়ে নিতাই সুইটস থেকে দুটো সন্দেশ খেলে?’
ব্যাঘ্রগর্জনে চিঁ চিঁ করে বল্লুম, ‘কই, খাই নি তো।’
‘খাও নি? বটে? ফের মিথ্যে কথা? হ্যাংলা বাঙাল কোথাকার। আমার ন” কাকু নিজের চোখে দেখেছে তোমাকে সন্দেশ খেতে। বলো তুমি খাওনি?’
সোফার কোণে সেঁধিয়ে গেলুম একেবারে। এবার থেকে দেখছি ন” কাকু, সেজো পিসে, সিধু জ্যাঠা এইসব দেখেশুনে…
ঠকাস করে একটা প্লেট উড়ে এসে পড়লো সামনে, কড়া করে সেঁকা দুটো পাঁউরুটি, সঙ্গে দুকুচি শশা আর গাজর!
‘সেদিন যে ব্লাড টেস্ট করালে, তার রিপোর্টটা আনা হবে কবে শুনি?’
আমি উদাসমুখে পাঁউরুটি চিবোতে চিবোতে আকাশের কাক গুণতে থাকি।
‘কথা কানে যাচ্ছে না?’
‘ইয়ে, আজকে ওদের আপিস বন্ধ, হোলিতে ওদের ছুটি থাকে কি না।’
‘ফের বাজে কথা?’ চোখ পাকিয়ে বললেন তিনি, ‘ওরাই ফোন করে বলেছিলো না হোলির দিন রিপোর্ট নিয়ে আসতে?’
‘অ্যাঁ? ইয়ে, আজ কার্তিকী অমাবস্যা না অলাবু ত্রয়োদশী, কি একটা আছে না? আজ পাঁজিপুঁথি মতে ব্লাড টেস্টের রিপোর্ট আনা নিষিদ্ধ যে?’
‘দেখো, একদম কথা ঘোরাবে না। যাও গিয়ে রিপোর্ট নিয়ে এসো। আর শোনো, এই হলো বাজারের ফর্দ। দু কিলো আলু, এককিলো পেঁয়াজ, পাঁচশো শশা…’ এই বলে একটা লম্বা ফর্দ আমাকে ধরিয়ে দেন তিনি। শেষে বলেন, ‘আর হ্যাঁ, নিতাই সুইটস থেকে আড়াইশো পনীর আনবে। আর যদি শুনেছি চুরি করে মিষ্টি খেয়েছো..।’
হাঁ হাঁ করে উঠতেই হয়, ‘আহা চুরি করে খাবো কেন? ছিঃ, আমাকে তুমি এই ভাবলে? জানো আমি কোন বাড়ির ছেলে? আমি চুরি করে মিষ্টি খাবো? কভি নেহি, আমি পয়সা দিয়েই মিষ্টি খাবো। ভদ্রলোকের এক কথা।’
‘না আ আ’ ঘরের মধ্যে বজ্রপাতের কড়ক্কড় শব্দ, ‘তুমি মিষ্টি খাবে না। বুঝেছো?’
বুঝতেই হয়। বোঝা ছাড়া এই অসার জীবনে আর কীই বা বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি বলুন তো?
তা টুকটুক করে বাজারপত্তর সেরে নিতাই সুইটসে গিয়ে দাঁড়াতে হলো। শোকেস জুড়ে থরেথরে মিষ্টির ভাঁড়ার। আমাকে দেখে তাদের সে কি হাঁকাহাঁকি, ‘আমি নলেন গুড়ের কালাকাঁদ বলছি স্যার, একটু দেখবেন,’ ‘ওহে খুড়ো, বলি কাল ছিলে কই? এই সবে ভিয়েন থেকে এয়েচি। এট্টুসখানি হবে নাকি?’, ‘আরে দাদা যে, হেঁ হেঁ হেঁ, খবরটবর সব ভালো? তা আজ দেখছি আমার এই শ্রীঅঙ্গে এরা আবার একপরত আমসত্ত্ব দিয়েছে। চেখে দেখবেন নাকি একবার?’ রসকদমগুলো তো কেঁদেই ফেললো, ‘কী অপরাধ করেছি কত্তা, যে আপনার শ্রীপাকস্থলীতে ঠাঁই দেওয়া থেকে আমাদের এভাবে বঞ্চিত করছেন?’ ওদিকে সরভাজার প্লেট থেকে যেটা ভেসে এলো সেটাকে আপনারা খোশবাই বলে ভুল করতে পারেন, আমার তো স্পষ্ট মনে হলো বিরহী যক্ষের দীর্ঘশ্বাস!
তবে শাস্ত্রে বলেছে পিঠে খেলে কোনওমতেই পেটে সয় না। ফলে শকুন্তলাত্যাগে উদ্যত নিঠুর নিদয় দুষ্মন্তের মতো গম্ভীর গলায় দোকানীকে বললুম, ”আড়াইশো পনীর দে খোকা।”
বলে খোকার দিকে তাকিয়ে আমি থ!
খোকা দেখি আকাশের দিকে, থুড়ি রাস্তার মোড়ের দিকে আড়নয়নে তাকাচ্ছে আর মোবাইলে কী যেন খুটুর খুটুর করছে। এই যে জলজ্যান্ত একশো কিলো ওজনেরর একটি গন্ধমাদন পর্বত তেনার সামনে দাঁড়িয়ে, ”ওহে খোকা পনিরং দেহি মে” করে চিল্লে যাচ্ছে তার প্রতি কোনও ইয়েই নেই?
ব্যাপার কি? একে আমি নয় নয় করে নয় বচ্ছর ধরে চিনি। অতীব ভদ্রসভ্য ছেলে। আমার সঙ্গে একবার স্কচ নিয়ে মনোজ্ঞ আলোচনার পর গভীর শ্রদ্ধাবনত চিত্তে একটি অসামান্য উক্তি করেছিল, ‘দাদার বডিতে এডুকেশন আছে।’ সেই থেকে ছোঁড়াকে আমি বিশেষ স্নেহই করি। সে আজ আমার দিকে এমন লোষ্ট্রবৎ অবজ্ঞানিক্ষেপ করে কেন?
তার ওপর চোখফোখ দেখে বুঝলুম, হুঁ, কেস প্রায় স্যুটকেস! অমন ফ্যালফ্যালে চোখ সচরাচর মুক্তপুরুষটুরুষদের হয়। এ ছোকরার তো সেদিকে মতি আছে বলে খবর পাইনি! তবে?
বেশীক্ষণ অবশ্য এর উত্তর পেতে অপেক্ষা করতে হলো না। ছোকরার আকুলনয়ান অনুসরণ করে ঘাড় ঘোরাতেই দেখি স্টেট ব্যাঙ্কের মোড় থেকে খর্বনাসা, পীতাঙ্গী এবং সামান্য পৃথুলা এক সুন্দরীশ্রেষ্ঠা এদিকেই গজেন্দ্রাণীগমনে হেঁটে আসছেন। তাঁকে দেখে আমি একবার খোকার দিকে আড়নয়নে চেয়ে নিলাম। তার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে যেন স্বয়ং দেবী লক্ষ্মী তার দিকে দিব্যভঙ্গিমায় হেঁটে আসছেন, এক হাতে বরমাল্য, অন্য হাতে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ক্যাশবাক্সের চাবি!
ধীরে, অতি ধীরে সে মদালসনেত্রা বিপণিসমীপে উপস্থিত হলেন। তারপর এক দিলতোড় কটাক্ষবাণ হেনে জিজ্ঞেস করলেন, ”আপ ক্যায়সে হ্যাঁয় বাবলুজী?”
এতদিন পরে বঁধুয়া এলে, দেখা না হইতো পরাণ গেলে! ধীরেধীরে বাবলুকুমারেরর সর্বাঙ্গে স্বেদ কম্প আদি পূর্বরাগের সমস্ত লক্ষ্মণ ফুটে উঠতে লাগলো। চোখে সেই ভুবনমোহন হাসি, যে হাসি একদা উত্তমকুমার হাসতেন বলে অরণ্যের প্রাচীন প্রবাদ। বিগলিত করুণা, জাহ্নবী যমুনা ভঙ্গীতে শ্রীবাবলু তাঁর স্বরে পোয়াটাক মধু এবং কয়েক পেগ ভালোবাসা মিশিয়ে বললেন, ‘ম্যায় অ্যাকদম ঠিক হ্যাঁয় সঙ্গীতাজী, আপনি ক্যামন হ্যায়?’
সেই সুলোচনা, সুকেশী, পক্ববিম্বাধরোষ্ঠী মহিলাটি মাধুরীসমহিল্লোলে বডি কাঁপিয়ে বলে উঠলেন, ‘আপ তো খবর হি নেহি লেতে হোঁ। আব পুছনে সে কেয়া ফায়দা? ম্যায় আপসে বাত নেহি করতি, যাও।’
‘হেঁ হেঁ হেঁ, ক্যায়সে খবর নিই? আপনে তো পিছলি বার আপকা নাম্বার নেহি দিয়া। ইনবক্সে কত বাত করেগা?’
‘চল, ঝুটা কহিঁকা।’
বুকটা কেমন হু হু করে উঠলো, জানেন? আহা রে, তোর সঙ্গে দেখা হইতো যদি সখী, লত্তুন যৈবনেরই কালে… তাহলে কি আর গাজরসেদ্ধ দিয়ে ব্রেকফাস্ট সারতে হতো এখন?
আমার সে চিন্তার মাঝেই সেই বরবর্ণিনী বলে উঠলেন, ‘ইয়ে কেয়া আপকা দুকান হ্যাঁয়?’
দুকান এঁটো করা হাসি উড়ে এলো, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, একদম আপনা দুকান হ্যায়।’
‘মতলব আপ হালওয়াই হো? হি হি হি…’
সেই ইয়র্কারের সামনে আমাদের বাবলুকুমার পুরো এলবিডাব্লুকুমার হওয়ার মতো মুখ করে বসে রইলেন। ব্যাকগ্রাউন্ডে করুণ সুরে সানাই বাজতে লাগলো, ”কানু কহে রাই , কহিতে ডরাই, ধবলী চরাই মুই..”
ভদ্রমহিলার বোধহয় সে ভ্যাবলাকান্তকে দেখে কিঞ্চিৎ করুণা হলো, দয়ার্দচিত্তে তিনি বললেন ”ধান্দা করনা আচ্ছা হ্যায়। আপ বেঙ্গলি লোগ তো সির্ফ নোওকরি করতে হো।”
আমি গম্ভীরমুখে এই সাম্প্রদায়িক কুমন্তব্যের বিরুদ্ধে একখানা আড়াই পাতা ডায়লগ নামাতে যাবো, এমন সময় শ্রীবাবলু তেড়েফুঁড়ে উঠলেন, ‘মোট্টে না। এই তো হাম ক্যামন বিজনেস কর রাহা হ্যায়। ইধর আপনা মিঠাই খুব ফেমাস হ্যায়। স্বাদুষ্ট ওউর তন্দুরুস্ত।’
স্বাদুষ্ট বলে কোনও শব্দ হয় কি না, এ নিয়ে একটা কুটিল সন্দেহ মনের মধ্যে পাকিয়ে উঠতে থাকে। আর মিঠাই তন্দুরুস্ত কী করে হয় সেটাও বুঝে উঠতে পারি না।
এদিকে শ্রীমতী তখন হেসে কুল পাচ্ছেন না। উচ্ছ্বল ঝর্ণার মতো সে হাসি কালিন্দীর ফুটপাথে লুটিয়ে পড়লো। ‘তন্দুরুস্ত তো হ্যাঁয়, লেকিন মিঠাই নেহি, হলওয়াই।’
বাবলুকুমারকে দেখে মনে হলো জীবনে এই প্রথম নিজের বরতনুটি নিয়ে সামান্য লজ্জিত হলেন। ব্রীড়ানত মুখে বললেন, ‘ম্যায় মোটা নেহি হুঁ, সামান্য হেলদি হুঁ, এই যা।’
দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। আজি হতে শতবর্ষ আগে এরকমই এক শনিবারের বারবেলায়, নন্দন চত্ত্বরে ঝোপের আড়ালে বসে, এমনই এক সামান্য স্থূলাঙ্গী মহিলাকে নেহাত আদর করেই ‘মুটকি সোনু’ বলে ডাকার পর ঝাড়া আধঘন্টা ধরে অনেক নতুন নতুন জন্তু জানোয়ারের নাম জানতে পেরেছিলাম। তার সঙ্গে আরও দুটো নতুন ইংরেজি শব্দ শিখেছিলাম, বডি শেমিং আর মিসোজিনি!
‘আপ জিম উম মে জয়েন কিঁউ নেই করতে?’ মহিলাটি এবার শোকেসের ওপর আরও ঘন হয়ে আসেন, ‘লেকটাউনমে মেরে চাচা কা বেটা এক নয়া জিম খোলা হ্যাঁয়। একদম টপ টু বটম আপটুডেট, চকাচ্চক। বোলো তো বাত করওয়া দেতা হুঁ। ডিসকাউন্ট ভি দিলা দুঙ্গি।’
স্তম্ভিত হয়ে মহিলার দিকে চোখ গোলগোল করে তাকিয়ে রইলুম, কী ডেঞ্জারাস জিনিস রে ভাই! ডেট করতে এসে ভাইয়াকে কাস্টমার ভেট দেওয়ার ফিকির করছে?
তবে আমার আশ্চর্য হওয়ার আরও বাকি ছিলো। মহিলা আরও বলতে লাগলেন, ‘লেকিন সির্ফ জিম করনে সে নেহি হোগা। আপকো ডায়েটিং ওগ্যারাহ ভি করনা পড়েগা। অয়েলি ফুড ইনটেক ইজ দ্য মেইন রিজন ফর অবেসিটি।’
এইবার আর চুপ থাকা গেলো না, গলা খাঁকড়ে বলতে বাধ্য হলুম, ‘কথাটা কিন্তু উনি খারাপ বলেননি বাবলু, স্পেশ্যালি ওই ওবেসিটির ব্যাপারটা। কথাটা উনি যখন ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই বলছেন তখন এ বিষয়ে….’
বলেই থমকে যাই। মানে থমকাতে বাধ্য হই বললেই চলে!
বাপ রে! সে কী অগ্নিবর্ষী দৃষ্টি, সে কী ভয়াল কুটিল চাউনি! মনে হচ্ছে আমাকে জ্যান্ত রোস্ট করা হবে নাকি কুচিয়ে ভর্তা করা হবে সে নিয়েই ভদ্রমহিলা সামান্য দ্বিধায় রয়েছেন। নইলে নরকের যে আঁচে আমার ইন্তেকাম হওয়া উচিত, সেখান থেকে একটা জ্বলন্ত নুড়ো এনে এক্ষুনি আমার মুখে গুঁজে দিলে ব্যাপারটা বেশ খোলতাই হতো বলে ওঁর ধারণা। একটু আগেই যাকে হেলেন অফ ট্রয় মনে হচ্ছিলো, এখন তাকে গডেস অফ ভয় বলেই বেশী ঠাহর হতে থাকে।
এতক্ষণে বাবলুকুমারের টনক নড়ে। দু’মিনিটে ফটাফট দেড়শো গ্রাম পনীর ওজন করে, আমার হাতে প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে, পেমেন্ট নিয়ে চাপা, খুনী স্বরে দুটি মাত্র শব্দ উচ্চারণ করে, ‘দাদা, ফুটুন।’
আমিও ফুল হয়ে ফুটে যাই। এপ্রিল ফুল হয়ে, এই ঘোর বসন্তেই। প্রেম যে এত হিংস্র আর অসহিষ্ণুহতে পারে তা এদের না দেখলে জানতেই পারতুম না! হায়, এ মৃত্যুউপত্যকা আমার দেশ না…
এই ভাবতে ভাবতে কাউন্টার ছেড়ে চলে আসছি, এমন সময় সেই বাবলুকুমারীর শেষের কথা গুলো শুনে পা’দুটো ভারখয়ানস্কের তুষারাবৃত উপত্যকার বুকে নাছোড় আইস অ্যাক্সের মতই আটকে গেলো।
স্বকর্ণে শুনলাম সেই মোহিনী আমাদের নধরকান্তি নদের নিমাইকে স্বাস্থ্যসম্বন্ধিত সৎপরামর্শ দিচ্ছেন, ‘ব্রেকফাস্টমে ইয়ে সব পুরি সবজি, মিঠাই ওগ্যারাহ খানা বন্ধ করনা পড়েগা বাবলুজী। মতলব আগর আপ ইয়ে রিলেশন কে বারে মে সিরিয়াস হ্যায় তো।’
কোন সে দিগন্তের ওপার থেকে আমাদের ভোলাভালা ছেলেটার বিস্মৃতপ্রায় আবছা স্বর ভেসে এলো, ‘হাঁ হাঁ সঙ্গীতাজী। বোলিয়ে না, কেয়া কেয়া করনা পঢ়েগা। আপকো তো মালুম হ্যায়..’
‘মর্ণিং মে সির্ফ টু স্লাইস ব্রেড, উইদাউট বাটার। উসকে সাথ থোড়াসা কিউকাম্বার অ্যান্ড ক্যারট মিক্স…’
কেউ নিজের পায়ে কুড়ুল মারে, কেউ নিজের পা”টা কুড়ুলের ওপর মারে। ফলাফল একই।
আড়াইশো পনীর আর গাদাগুচ্ছের স্বাস্থ্যসম্মত সবজি সমেত বাড়ি ফিরতে ফিরতে শুনি বাড়ির সামনে কোন বেরসিক হতভাগা মাইকে রোবিন্দসংগীত চালিয়েছে, ‘আহা আজি এ বসন্তে, এত ফুল ফুটে, এত বাঁশি বাজে..এত পাখি গায়…’
বসন্ত, মাই ফুট!