বসন্ত রজনী – ৫

পাঁচ 

বাইরের পরিধি ক্রমেই আমার ছোট হয়ে আসছে। মধ্যে মধ্যে বন্ধুবান্ধবের বাড়ী যাওয়ার যে অভ্যাস ছিল সে তো ছেড়েই দিয়েছি, ক্লাবে যাওয়াও আজকাল বড় একটা ঘটে ওঠে না। কাছারী থেকে সোজা বাড়ী ফিরি। সন্ধ্যাবেলায় একটু রেডিও, একটু গ্রামোফোন মাঝে মাঝে টুলু গান গেয়ে শোনায়, তারপরে লুডো খেলা। রাত্রি বারোটা একটা পর্যন্ত এই চলে। এ ছাড়া থিয়েটার আছে, বায়োস্কোপ আছে, তারপর শীতের রাত্রে সার্কাস আছে, কার্নিভ্যাল আছে। সময় কাটাবার জিনিসের অভাব নেই। কেবল সাহিত্য চর্চাটা কমে গেছে। সাহিত্যের প্রসঙ্গ উঠলেই টুলু হাই তোলে। 

জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি সাহিত্য ছেড়ে দিলে না কি? 

টুলু হেসে বললে, হ্যাঁ। 

—এ বিরাগের কারণ? 

আলস্য ভেঙে টুলু বললে, কি হবে কতকগুলো মিথ্যে কথা পড়ে আর মিথ্যে কথা লিখে? 

বললাম, মিথ্যে কি রকম? 

বললে, মিথ্যে না তো কি? তাহলে শুনুন আমি একবার একটা গল্প লিখেছিলাম। একটি মেয়ের দুঃখের কথা। 

ম্লান হেসে বললে, সেই গল্পই হল কাল। যাকগে। লিখলাম একটি মেয়ের গল্প। গল্প পড়ে লোকে কেঁদে আর বাঁচে না। আমারও ধারণা হয়েছিল গল্পটি সত্যি হয়েছে। তখন তো জানতাম না সত্যিকার দুঃখের রূপ কি! এখন বুঝছি ওর চেয়ে মিথ্যে গল্প আর হতে পারে না। 

বললাম, পৃথিবীতে যা কিছু ঘটে তাইতো একমাত্র সত্যি নয়। গল্পের সত্যের রূপ আলাদা। 

বললে, সে আমি জানি। কিন্তু দুঃখের নাম করে দুঃখের বিলাস, ও নিয়ে গল্প আর লিখব না। দুঃখের সত্যিকার রুক্ষ কর্কশ রূপের সঙ্গে আজ পরিচয় ঘটেছে। আজ বুঝেছি দুঃখ কি ভয়ঙ্কর! তাই মিথ্যে লিখতেও মন সরে না, পড়তেও মন সরে না। মৃণালবাবু, মানুষের দুঃখ নিয়ে পরিহাস করা পাপ। 

আমি অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, তোমাকে একটা কথা আমি বলিনি টুলু। সুকোমলকে আমি একখানা চিঠি লিখেছিলাম। 

উৎসুক দৃষ্টিতে টুলু আমার দিকে চাইল। 

বললাম, সে চিঠির কোনো জবাব পাইনি এতদিন। কাল এসেছে। 

টুলু নিরুত্তর রইল। 

আমি বলতে লাগলাম, এতদিন ছিল না এখানে। বাইরে কোথায় বেড়াতে গিয়েছিল, সম্প্রতি ফিরেছে! লিখেছে তার শরীর সুস্থ নেই। কি না কি কঠিন অসুখ হয়েছিল।

ওর মুখ ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছিল। ঠোটে ঠোট চেপে স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে রইল। 

—লিখেছে, শরীর সুস্থ হলে একদিন আসবে। ইতিমধ্যে আমি যেন একবার যাই। অনেক কথা লিখেছে। আনব চিঠিখানা? 

টুলু ঘাড় নেড়ে জানালে, দরকার নেই। 

বললাম, তোমার কথাও লিখেছে। মনে হল সুরটা ভালোই। 

টুলু কঠিন কণ্ঠে বললে, বাধিত হলাম। 

ওর মনের ভাব বোঝার উপায় নেই। ভেবেছিলাম, মুখে কিছু না বললেও এই একটি সংবাদের জন্যে সে মনে মনে মরে যাচ্ছে। ওর নিস্পৃহ ভাব এবং কঠিন কথা শুনে মনে হল ব্যাপারটা অত সহজ হয়তো হবে না। আশঙ্কা হল ভেতরে টুলু যথেষ্ট উত্তপ্ত হয়ে আছে। নোয়াতে দেরী হবে। তবু এছাড়া আমার উপায় নেই। ধীরে ধীরে আমার মনে পাপ উঠছে জমে। টুলু কথা বলে বেশী, হাসে বেশী, আমার কাছে কাছে ঘোরে বেশী। ওর তরঙ্গিত হাসি, চটুল কথা, সুমধুর কলহ ক্রমেই যেন আমাকে পাকে পাকে বাঁধছে। নিজেকে বারে বারে সতর্ক করি। কিন্তু সতর্কতা মিথ্যা। একই বাড়ীতে টুলুকে এড়িয়ে চলা শুধু কঠিন নয়, অসম্ভব। আমার পথে ও এসে পড়বেই। বয়স ওর হয়েছে, ছোট তো আর নয়! ও কি জানে না, পুরুষের মধ্যে আগুন জ্বালাতে এক মিনিটের বেশী লাগে না? জানে। তবু ত আসবেই। নানা ছলে, নানা ছুতোয় আসবে। আমাকে একটি মুহূর্ত নিষ্কৃতি দেবে না। আমাকে নইলে একটি মুহূর্ত ওর চলবে না। 

সেই তো বিপদ। সেই ভয়ে সমস্ত সঙ্কোচ কাটিয়ে সুকোমলকে লিখি চিঠি। ভেবেছিলাম, সুকোমলকে যদি কিছু নরম করতে পারি,—সেও তো স্বামী, ভালোবেসেছিল,—যদি কোনোদিন নিজের ভুল বুঝতে পেরে টুলুকে গ্রহণ করে, আমি যাব বেঁচে। দুঃখ আমার যত বড়ই হোক, তবু যাব বেঁচে। আপনাকে দিন রাত্রি চোখে চোখে রাখার হাত থেকে পাব রেহাই। কিন্তু এখন দেখছি সমস্যা শুধু সুকোমলকেই নিয়ে নয়। টুলু তো আর রাধার মতো মাটির ঢেলা নয়। তার মন আছে, বুদ্ধি আছে, অহঙ্কার আছে। আপন আত্মাকে সে সম্মান করে। সে সম্মান সহজে ঘুচবে এমন তো মনে হয় না। তাকে আমি চিনেছি। 

আমি আবদারের সুরে বললাম, একটা অনুরোধ করব টুলু?

টুলু হেসে বললে, নিশ্চয়ই। 

—আজকে সন্ধ্যায় চল না দু’জনে যাই। লিখেছে অসুখ… যাবে? 

টুলুর মুখ দেখতে দেখতে কঠিন হয়ে উঠল। শান্ত অথচ দৃঢ়কণ্ঠে বললে, না।

বললাম, কী ক্ষতি। 

টুলু অকস্মাৎ বারুদের মতো জ্বলে উঠল। বললে, অনেক ক্ষতি। আপনারা বুঝবেন না। সে চোখ আপনাদের নেই। মৃণালবাবু, আপনারা আমাদের কী ভাবেন?আমরা কি কুকুর?-তাড়িয়ে দিলেই ছুটে পালাব, আর আঙুল নেড়ে ডাকলেই ছুটে এসে পায়ের কাছে ল্যাজ নাড়ব? আমাদের কি আত্মা নেই? মন নেই? প্রাণ নেই? মর্যাদা বলে কিছুই নেই? কী আপনাদের ধারণা? 

বললাম, স্বামী-স্ত্রীতে ঝগড়া কি হয় না টুলু? সকালে হয়, সন্ধ্যা বেলায় মিটে যায়।

বললে, সে আমি জানি। কিন্তু এ তা নয়। এ আমার সমস্ত সত্তাকে নিয়ে কথা। যিনি আমাকে অকারণে সন্দেহ করেছেন, আমার মর্যাদার কথা একবারও ভাবেন নি, তাঁকে কোনোদিন ক্ষমা করতে পারব না। কোনদিন না। আপনি বললেও না। 

টুলু গট গট্ করে উঠে চলে গেল। 

তখনি আবার ফিরে এসে বললে, আপনি সেখানে যান না যান আমার কিছু এসে যায় না। কিন্তু একটা কথা। সেখানে দয়া করে আমার প্রসঙ্গ তুলবেন না। আমার কাছেও তাঁর প্রসঙ্গ না তুললে সুখী হব। 

টুলু আর দাঁড়াল না। ওর এমন ক্রোধ আমি কখনও দেখিনি। স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। মনে হল কথাটা ঠিক বলা হয়নি। কোথায় কি যেন ভুল করেছি। বোধ হয় আমার আরও অপেক্ষা করা উচিত ছিল। কিন্তু মনের অবস্থা আরও সহজ হলেই কি ও বুঝবে? তেমন মেয়েই নয়। কে জানে হয়তো বাইরে যাই দেখাক আমার এখানে কিছুতে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছে না। ভিতরে অবিশ্রান্ত সংগ্রাম চলেছে! স্বামীর লাঞ্ছনা প্রতিমুহূর্তে ওকে বিধছে! ভুলতে পারছে না। 

স্থির করেছিলাম সন্ধ্যার সময় সুকোমলের সঙ্গে দেখা করতে যাব। তার চিঠি পাওয়ার পরে সঙ্কোচ আমার কেটে গিয়েছে। বুঝেছি আমার প্রতি সে বিরূপ হয়নি। বিশ্বাসও হারায়নি। তার কাছে আমার লজ্জা করার কোনো কারণ নেই। 

সুকোমল অসুস্থ। তার অসুস্থতা কোথায় বুঝি। কেন যে সে নানা স্থানে ঘুরে বেড়ায় তারও কারণ অনুমান করা শক্ত নয়। সন্দেহের জ্বালা তাকে ছুটিয়ে বেড়াচ্ছে। কোথাও স্থির হয়ে বসতে দিচ্ছে না। মন তার জর্জরিত। এতদিনে বোধ করি অবসাদ এসেছে। আর সে পারছে না। যে-টুলুকে সে এক মুহূর্তের জন্যে চোখের আড়াল করতে পারত না, তাকে ছেড়ে বাঁচা তার পক্ষে অসম্ভব। সে আর পারছে না। আমাকে সে চায়। হয়তো আমার মুখ থেকে একবার শুনতে চায়, টুলু অবিশ্বাসিনী নয়। শুধু মুখের কথা। তারপর, মনের সন্দেহ মন থেকে মুছে যাক আর না যাক, যা হবার হোক, টুলুকে সে গ্রহণ করবে। এমন করে বেঁচে থাকতে আর সে পারছে না। 

এ আমার অনুমান। কিন্তু সুকোমলকে যে জানে, যে জানে টুলুকে সে কত ভালোবাসে, সে এ ছাড়া আর কিছু অনুমান করবে না। করতে পারে না। মনে হয়, এখন একবার তার কাছে যাওয়ার অপেক্ষা। বাকী আপনি ঠিক হয়ে যাবে। 

কিন্তু টুলুর কথা শুনে সে ইচ্ছা আর রইল না। বুঝলাম, মানুষ ইচ্ছা করে তার চলার সুগম পথ কণ্টকিত করবেই। 

কাছারী থেকে ফিরে চুপি চুপি নীচের ঘরেই বসে রইলাম, অন্ধকারে। আলোটা জ্বালাতে ইচ্ছা হল না। আমি যে কি করব ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। নানা ভাবের সমাবেশে মনে কি রকম অস্বস্তি অনুভব করছিলাম। অন্ধকারেই বসে রইলাম। 

কতক্ষণ এমন ভাবে বসে ছিলাম জানি না। বোধ হয় অনেকক্ষণ হবে। হঠাৎ এক সময় আলো জ্বলে উঠল। 

টুলু। 

বললে, অন্ধকারে বসে যে!

বললাম, তাই তো দেখছি! 

হেসে উঠল, তাই তো দেখছেন? আরেকটু আগে দেখলে হত! কতক্ষণ এসেছেন?

–কি জানি! 

টুলু আবার হেসে উঠল। বলল, তাও জানেন না? হাতে ঘড়িটা আছে তো? না তাও নেই? 

আমি জবাব দিলাম না। টুলু আমার টেবিলটা গোছাতে লাগল। হঠাৎ শুষ্কমুখে জিগ্যেস করলে, আপনার অসুখ করেনি তো? অমন চুপ করে আছেন কেন? 

আমার উত্তরের প্রতীক্ষা না করেই সে তার ফুলের মতো নরম হাত দিয়ে আমার ললাটের উত্তাপ পরীক্ষা করলে। 

আশ্বস্ত ভাবে বললে, না, জ্বর হয়নি। তবে অমন করে আছেন কেন? আমার সঙ্গে কথা কইবেন না? রাগ করেছেন? 

আমি একটু ফাঁকা হাসি হাসলাম। 

টুলু বললে, রাগলেন তো বয়ে গেল। জল খাবার খাবেন তো? না, তাও জানেন না? 

টুলু আমাকে নির্জনে নিশ্চিন্তে বসে একটু ভাবতেও দেবে না। উঠতেই হল। বললাম, শুধু এক বাটি চা দাও। 

—শুধু চা? কেন, জল খাবার কি দোষ করলে? 

বললাম, ক্ষিধে নেই। 

—ক্ষিধে নেই? খেয়ে এসেছেন? খেলেন কেন? আপনার জন্যে খাবার তৈরী হয় জানেন না? এ খাবার খাবে কে? আমাদের পেটে কি রাক্ষস ঢুকেছে? সে হবে না! রাধা! 

রাধা এল। 

টুলু বললে, মৃণালবাবু এসেছেন এক ঘণ্টা, দু’ঘণ্টা, কি কত ঘণ্টা হল তাও জানেন না। অন্ধকারে বসে ছিলেন। বলছেন ক্ষিধে নেই। শুধু এক বাটি চা খাবেন। 

রাধা বললে, শুধু চা মানুষে আবার খায় না কি? 

রাধা বেরিয়ে গেল। এবং আমি হাত-মুখ ধুয়ে পোশাক ছেড়ে আসতে না আসতে রাধা এক থালা খাবার এনে হাজির করলে। 

টুলু হেসে বললে, এবার তো আর না বলবার উপায় রইল না? খাবার আমার তৈরী নয়, রাধার তৈরী। এনেছেও সে নিজে! আমি ছুঁই নি পর্যন্ত। দেখুন না টেবিল থেকে সরে দাঁড়িয়ে আছি 

রাধা আর দাঁড়াল না। ওর নিজের প্রসঙ্গ উঠলেই ও ভয়ানক লজ্জা পায়। লজ্জা পেলে আর দাঁড়াবে না। জুৎসই কথা ও বলতে পারে না। 

টুলু অনেকক্ষণ পরে বললে, আমি যে দু’বেলা খাচ্ছি তাতে আপনার কষ্ট হচ্ছে?

অবাক হয়ে বললাম, তার মানে? 

বললে, তার মানে তো সোজা। জানতে চাচ্ছি আমাকে তাড়াবার জন্যে অত ব্যস্ত হয়েছেন কেন? 

—ব্যস্ত হয়েছি কে বললে? 

—আমিই বলছি। বলুন না, কথাটা সত্যি কি মিথ্যে? 

তখনইতখনই উত্তর দিতে পারলাম না। গভীর মনোযোগের সঙ্গে চা খেতে লাগলাম। তারপরে বললাম, কথাটা সত্যি। 

ক্ষুণ্ণভাবে টুলু বললে, আমি বড্ড বেশী ভার হয়েছি? 

—ভারের জন্যে নয়। 

—তবে? 

নিঃশেষিত পেয়ালা সরিয়ে রেখে বললাম, সত্যি কথা শুনতে চাও? 

টুলু ঘাড় নেড়ে জানালে, তাই চায়। 

বললাম, তাহলে শোন, ভারের জন্যে নয়, ভয়ের জন্যে। আমার মনে ভয় ঢুকেছে।

আমার স্থিরদৃষ্টির সামনে টুলু চোখ নামালে। অস্ফুটস্বরে বললে, ভয় আবার কিসের? 

—কিসের ভয়? তোমার ভয়। তোমার সম্বন্ধে আমার মনে দুর্বলতা এসেছে। নিজেকে আর বিশ্বাস নেই। 

কেন? 

নিম্নকণ্ঠে টুলু বললে, বিশ্বাস না থাকে ভয়ে ভয়েই থাকবেন। আমাকে তাড়াবেন 

বললাম, তাড়াব না! শুধু আমার পথ থেকে তোমায় সরাতে চাই।

—দাঁড়ান! 

বলে টুলু বাইরে উঁকি দিয়ে কি দেখে এল। ফিরে এসে একেবারে আমার সোফার পাশে এসে দাঁড়াল। উত্তেজিত নিম্ন কণ্ঠে বললে, পুরুষ মানুষের এত ভয়ই বা কিসের? বলুন না কি চান? 

ওর চোখ জ্বল জ্বল করে জ্বলছিল। গলার স্বর কাঁপছিল। 

বললে, আপনি আমাকে আশ্রয় দিয়েছেন! সবাই অনায়াসে যখন আমায় অসম্মানের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে তখন আপনি আমাকে সম্মানের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছেন। আপনি কি কারও চেয়ে পর? 

ওর হল কি? মনের জ্বালায় ও কি পাগল হয়ে গেল নাকি? অকস্মাৎ ওর শরীর থর থর করে কাঁপতে লাগল। ধপ্ করে আমার সোফায় বসে পড়ে চীৎকার করে উঠল, আমার শরীর এমন করছে কেন? আমাকে ধর না। 

সঙ্গে সঙ্গে ওর অচৈতন্য দেহ আমার কোলের মধ্যে লুটিয়ে পড়ল। 

চীৎকার শুনে রাধা এল ছুটে। বললে, কি হয়েছে? ভয়ে রাধার মুখ শুকিয়ে গেছে।

বললাম, বোধ হয় ফিট হয়েছে। শীগগির এক গ্লাস জল আন তো! 

রাধা জল আনতে ছুটল। আমার কোলের মধ্যে ওর তখন খিঁচুনি আরম্ভ হয়েছে। কোথা থেকে ওর দেহে এত শক্তি এসেছে যে, একা আমার পক্ষে সামলান দায়। আমাকে উলটে উলটে ফেলে দেয়। আধ ঘণ্টার উপর এমনি ধস্তাধস্তির পর যেন একটু স্থির হল। কিন্তু তখনও জ্ঞান ফিরে আসে নি। এমন সময় বাইরে যেন পরিচিত কন্ঠের ডাক শুনলাম। 

সাড়া দিলাম, কে? 

—আমি সুকোমল। 

সুকোমল নিজেই এসে পড়েছে। বললাম, এস। 

রাধা সরে গেল। সুকোমল আস্তে আস্তে ঘরে ঢুকেই আমার কোলে টুলুকে তদবস্থায় দেখে অবাক হয়ে গেল! বললে, কি ব্যাপার? 

ধস্তাধস্তিতে টুলুর গায়ের কাপড় অসংবৃত। মাথার চুল এলিয়ে লুটিয়ে পড়েছে আমার পায়ের তলায়, ওর গায়ের কাপড় ঠিক করে দিয়ে বললাম, 

ফিট হয়েছে। সুকোমল একদৃষ্টে ওর বিবর্ণ ক্লিষ্ট মুখের দিকে চাইতে চাইতে অন্যমনস্কভাবে বললে, আগে তো ছিল না! 

বললাম, আগে ছিল না। আমিও আর দেখি নি। বোধ হয় এই প্রথম।

সুকোমল কি যেন ভাবছিল। অন্যমনস্কভাবে শুধু বললে, হুঁ। 

খানিক পরে আবার বললে, এই প্রথম? তুমি বলছ এই—এই প্রথম? না?

–বোধ হয়। 

 সুকোমলের মুখ দিয়ে আবার বের হল, হুঁ।

আরও অনেকক্ষণ কাটল। মিনিট পনেরো। টুলুর হাতের মুঠো ধীরে ধীরে খুলে গেল।

সুকোমল ফিস ফিস করে বললে, বোধ হয় জ্ঞান হচ্ছে এবার। 

ডাকলাম, টুলু! 

টুলু কথা বললে না, শুধু মাথা নেড়ে সাড়া দিলে! ধীরে ধীরে চোখ মেললে। তারপর সর্বাঙ্গ ভালো করে ঢেকে বসল। তখনও ওর অবসাদ কাটেনি। 

আমি উঠে গিয়ে সামনের চেয়ারে বসলাম। বললাম, এখনও উঠো না টুলু। শুয়ে থাক আর একটু। 

টুলু হাতের ইঙ্গিতে জানালে, বেশ আছি। 

এতক্ষণে ওর দৃষ্টি পড়ল সুকোমলের ওপর। বোধ হয় তখনও ঘোর কাটে নি। বোধ হয় চিনতে দেরী হচ্ছিল। এই দু’তিন বছরের মধ্যেই তার মাথায় টাক পড়েছে। স্বল্পাবশিষ্ট চুলগুলি রুখু! অনেকদিন তেল পড়েনি হয়তো। গাল ভেঙে যাওয়ায় মুখখানি লম্বা দেখাচ্ছে। চিনতে দেরী হচ্ছিল। ঘোরও বোধ হয় কাটেনি। যেই চিনল, অমনি গম্ভীরভাবে উঠে টলতে টলতে বাইরে বেরিয়ে গেল। 

আমিও দেখলাম। সুকোমলও দেখলে। কিন্তু কেউ একটা কথাও বলতে পারলাম না। সুকোমলের দিকে চেয়ে দেখি, সে গভীর মনোযোগের সঙ্গে মেঝের দিকে চেয়ে আছে। আর থেকে থেকে আপন মনেই মাথা নাড়ছে। 

সুকোমলকে জিজ্ঞাসা করলাম, কতদূর বেড়াতে গিয়েছিলে? 

অন্যমনস্কভাবে সুকোমল উত্তর দিলে, অনেক দূর। কাশ্মীরটাশ্মীর। 

জিজ্ঞাসা করলাম, কাশ্মীর জায়গাটা ভালোই! কি বল? কথায় বলে, ভূ-স্বর্গ।

বললে, হুঁ। 

—ছুটি নিয়েছিলে বুঝি? 

—হুঁ। 

—একাই গিয়েছিলে? 

—একাই। 

—কিন্তু শরীর তো বিশেষ … 

—না। শরীর কই আর সারল! 

সাধারণ কুশল প্রশ্ন শেষ হল। আর কি জিজ্ঞাসা করা যায়? বললাম, কোনো একটা ভালো ওষুধ নিয়মিত ব্যবহার কর। 

সুকোমল উত্তর দিলে না, শুধু বাহিরের দিকে চেয়ে ম্লানভাবে একটু হাসলে।

গ্লানিকর নিস্তব্ধতার মধ্যে দু’জনে নিঃশব্দে বসে রইলাম অনেকক্ষণ। হঠাৎ দেওয়ালের ঘড়িতে ঢং ঢং করে ন’টা বাজল। সে শব্দে সুকোমলের সংবিৎ ফিরে এল। একটু ইতস্তত করে বললে, তোমার সঙ্গে কিছু কথা ছিল মৃণাল। 

আমার বুকের ভিতরটা ঢিপ্ টিপ্ করে উঠল। ও কি টুলুকে নিয়ে যেতে এসেছে? উৎসুক দৃষ্টিতে ওর দিকে চাইলাম। 

অনেকক্ষণ ভেবে সুকোমল বললে, আমার বড় কষ্ট মৃণাল। 

ওর চোখ ছলছল করে উঠল। আমি নিঃশব্দে বসে রইলাম।

বললে, আমার মনে শাস্তি নেই। 

মনে হল, ঘরে আলো ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে আসছে। হাওয়াও ভারী হয়ে উঠেছে। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। সুকোমল আর কিছু বললে না। চুপ করে কি যেন ভাবতে লাগল। 

তারপর বললে, আমার উপর তোমার ঘৃণার শেষ নাই। কিন্তু যদি জানতে কি আমার দুঃখ তাহলে করুণা করতে। 

তাড়াতাড়ি বললাম, না, না, ঘৃণার কথা নয় সুকোমল। তুমি কিন্তু মস্ত বড় ভুল করেছ। 

—সে জানি। জানি ভুল করেছি। মস্ত বড় ভুল। তুমি কি মনে কর, তোমরা টুলুকে চেন আর আমি চিনি না? চিনি। বুঝি ওর ভালোবাসায় কোথাও ফাঁকি নেই। তবু সন্দেহ করি। একবার আমার জন্যে ও জীবন দিতে বসেছিল। সেও চোখে দেখা। কিন্তু রোজ রোজ এত চিঠি ও কোথায় লেখে? একলা বেড়াতে যায় কেন? মেয়েমানুষের একলা বেড়াতে যাওয়া কি কথা? 

ক্রোধে ও উত্তেজনায় সুকোমলের চোখ দপ দপ করে জ্বলে উঠল। ওর ক্রমাগত দম ফুরিয়ে আসছিল। দম নেবার জন্যে থামলে। ওর শীর্ণ বক্ষ হাপরের মতো ফুলে ফুলে উঠছিল। 

বললাম, নিষেধ করনি কেন? 

—করিনি! একশো বার করেছিলাম। শোনে নি। 

একটু থেমে বললে, স্পষ্ট করে নিষেধ অবশ্য করি নি। কিন্তু আকারে-ইঙ্গিতে হাবে- ভাবে বলতে বাকী কিছুই রাখি নি। কিন্তু ও কিছুতে বুঝতে চাইলে না। অদৃষ্টে দুঃখ আছে কি না! 

সুকোমল আবার চুপ করলে। 

তারপর বলতে লাগল, এ ছ’বছর কি করেছি আর কি করি নি? বিকারের রোগীর মতো ছুটে ছুটে বেড়িয়েছি। ছোট বড় কোনো দেবতা বাকী রাখি নি। সবারই দোরে মাথা কুটেছি, আর বলেছি, শান্তি দাও, শান্তি দাও। দেবতা আমার, শান্তি দাও। তবু শান্তি পাই নি, জানো? 

সুকোমল হতাশভাবে মাথা নেড়ে বললে, পৃথিবীতে সব পাওয়া যায়, কেবল শান্তি পাওয়া যায় না। 

ও আবার আপনমনে কি যেন ভাবতে বসল। হঠাৎ একসময় মাথা তুলে বললে, আচ্ছা, তোমার কি মনে হয়? টুলু সত্যিই ভালো? 

এতক্ষণ পরে এই কথা? সুকোমলের কি মাথার দোষ ঘটেছে? বিরক্তভাবে বললাম, এর উত্তর আমার কাছ থেকে শুনে কি হবে বল? আমার কথা তো বিশ্বাস করবে না! 

সুকোমল সাগ্রহে বললে, করব বিশ্বাস। তুমি বল। আমার কি দরকার জানো? সবাই মিলে এখন আমার কাছে কেবল বলুক, টুলু ভালো, টুলু খুব ভালো। শুনতে শুনতে আমার হয় তো বিশ্বাস ফিরে আসবে। 

সুকোমল আমাকে অবাক করেছে। বাধ্য হয়ে মুখ ফুটে বলতে হল, টুলু ভালো, টুলু সত্যিই খুব ভালো। 

সুকোমল যেন আমার মুখের এই একটি কথার অপেক্ষায় ছিল। লাফিয়ে উঠে বললে, আমার নিজেরও তাই ধারণা। আমি টুলুর সঙ্গে একবার দেখা করব মৃণাল। তুমি খবর দাও। 

আমি খবর দিতে উপরে গেলাম! দেখি ঘরের বাইরে দরজার গোড়ায় টুলু সর্বাঙ্গ ঢেকে জড়সড় হয়ে বসে আছে! 

বললাম, বাইরে বসে কেন টুলু? ঠাণ্ডা কত। ঘরে গিয়ে একটু শুলেই তো পারতে! 

টুলুর সাড়া না পেয়ে ভয় হল। জোর করে ডাকলাম, টুলু!

ও ফ্যাল ফ্যাল করে আমার দিকে চাইলে। 

—বলছিলাম, ঘরে গিয়ে শুলে না কেন? বাইরে বড় ঠাণ্ডা।

বললে, বেশ আছি। 

ব’লে যেমন মুখ ঢেকে বসেছিল, আবার তেমনি বসল। আমিও ধীরে ধীরে ওর সুমুখে মেঝের ওপর বসলাম। কিন্তু সে বোধ হয় টুলু লক্ষ্যও করল না। 

স্নিগ্ধকণ্ঠে ডাকলাম, টুলু। 

ও মুখ না তুলেই বললে, বলুন। 

—সুকোমল বলছিল… 

—সে যায়নি এখনও?—টুলু চীৎকার করে উঠল। 

শান্তভাবে বললাম, তোমার সঙ্গে দেখা না করে যায় কি করে? তাকে কি আনব এখানে? 

কিন্তু টুলু শান্ত হল না। বললে, কখনো না। আমার সময় হবে না। তাকে বলে দিন আমি দেখা করব না। 

ধীরে ধীরে বললাম, সে কি হয়? 

টুলু অধীর কণ্ঠে বললে, আপনাকে যা বললাম তাই গিয়ে বলুন না। যান। 

ওর ভাবগতিক দেখে আমি ভয় পেলাম। আর বাক্যব্যয় না করে নীচে ফিরে এলাম। দেখি সুকোমল গালে হাত দিয়ে গভীর চিন্তায় নিমগ্ন। আমি কি করব ভেবে না পেয়ে নীরবে দাঁড়িয়ে রইলাম! 

অনেকক্ষণ পরে সুকোমল মুখ তুলে বললে, তুমি তাজমহল দেখেছ মৃণাল?

তাজমহল! সুকোমল টুলুর কথা ভুলেই গেছে বোধ হয়!–বললাম, না!

সুকোমল গম্ভীরভাবে বললে, দেখে এস। একটা দেখবার মতো জিনিস। আচ্ছা, উঠি আজকে। 

 বললাম, টুলু তো ঘুমিয়ে পড়েছে। 

সুকোমল নিস্পৃহভাবে বললে, থাক, থাক। তাকে আর এখন বিরক্ত করতে হবে না।

সুকোমলকে বাইরের দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এলাম। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *