দুই
জীবনের পথে চলেছিলাম হাল্কা পায়ে। হঠাৎ এ কী বাধা! আকস্মিক এবং অপ্রত্যাশিত!
অজয়ের শেষকৃত্য সেরে যখন ফিরে এলাম তখন রাত হয়েছে, কিন্তু বেশী নয়। বোধ হয় ন’টা কি দশটা। সমস্ত বাড়ীটা যেন অন্ধকারে মুহ্যমান হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাতে আর জীবনের চিহ্ন পর্যন্ত ছিল না। শ্মশান-বন্ধুরা যখন দ্বারপ্রান্তে এসে “হরিবোল” দিলে, বাড়ীখানা যেন শিউরে উঠল! কয়েক সেকেন্ড পরে একটি ঘরে আলো জ্বলে উঠল। সিঁড়িতে কার যেন অতি সন্তর্পণে নামার শব্দ পাওয়া গেল তারপরে নীচে একটি আলো জ্বলল এবং সঙ্গে সঙ্গে সদর দরজা খুলে গেল।
রাধা নতনেত্রে একপাশে দাঁড়িয়ে। স্বল্প অবগুণ্ঠনের ফাঁকে সুন্দর মুখখানিতে একটি বিষণ্ণ ম্লানিমা। রাধা নীরবে আমায় টুলুর ঘরে নিয়ে গেল। আলো জ্বেলে অত্যন্ত সন্তর্পণে একটি চেয়ার এগিয়ে দিয়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল।
চারিদিকে একটা ভয়ঙ্কর নিস্তব্ধতা। মৃত্যুর মতো শীতল, কঠিন এবং ভয়ঙ্কর। টুলু তার খাটের উপর উপুড় হয়ে শুয়ে চুপে চুপে কাঁদছে। অবরুদ্ধ কান্নায় ওর শরীর ফুলে ফুলে দুলে দুলে উঠছিল। মনে হচ্ছিল, এখুনি বুঝি ভেঙে পড়বে। কিন্তু আমার মুখে বাক্য যেন বন্ধ হয়ে গেছে। এই ভয়ঙ্কর নিস্তব্ধতায় কথা বলাই যেন অসভ্যতা। আর কী কথাই বা বলব? কথা বলার আছে কী! বিশেষ টুলুকে। বেচারী সমস্ত অবলম্বন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এইখানে একটা মাথা গোঁজার আশ্রয় পেয়েছিল। শুধু আশ্রয় নয়, পেয়েছিল সহোদরেরও অধিক স্নেহ, মেয়েমানুষের চরমতম দুঃখের দিনে যা সে আর কোথাও পায়নি।
কথাটা আমি কোনো দিনই বিশ্বাস করতে পারিনি, আজও পারি না! বিশ্বাস করার মতো কথাও নয়। ওদের দু’জনকে আমি ভালো জানি। বিনাদোষে সুকোমল যে টুলুকে ত্যাগ করতে পারে একথা স্বপ্নেও ভাবা যায় না। পক্ষান্তরে টুলু যে এমন কোনো অপরাধ করতে পারে তাও অবিশ্বাস্য।
সেদিনের কথা আজও মনে পড়ে। এদিকে সেতুবন্ধ রামেশ্বর ওদিকে কাশ্মীর ঘুরে ফিরতি মুখে এলাহাবাদে নামলাম দাদার ওখানে। সেখান থেকে আবার যখন গাড়ীতে চাপলাম তখন অনেকগুলো বোঝা জমে উঠল। সেগুলো বর্ধমানে নেমে বৌদির কাছে পৌঁছে দিয়ে যেতে হবে। ঠিক শহরে নয়, গ্রামে। সেই গ্রামেই টুলুর বাপের বাড়ী। সেইখানে প্রথম কথাটা শুনলাম।
বৌদি বললেন, এক বছর হল টুলু বাপের বাড়ী এসেছে, এর মধ্যে সুকোমল একটি দিনও তার সঙ্গে দেখা করতে আসেনি।
কৌতুক করে বললাম, এক বছরের মধ্যে দাদাও তো একটি দিন আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসেননি। তা থেকে কি প্রমাণ হয় যে…
বৌদি হেসে বললেন, আহা! তোমার দাদা যে এলাহাবাদে থাকেন, বছরে একবারের বেশী আসার উপায় নেই। সুকোমলবাবুর তো তা নয়। এখান থেকে কলকাতা তো মোটে চার ঘণ্টার পথ।
বৌদির কথা উড়িয়ে দিয়ে বললাম, তা অমন হয়। কাজের ভিড়ে আসতে পারেনি বোধ হয়।
বৌদি বাধা দিয়ে বললেন, তা যেন মানলাম। কিন্তু কাজের ভিড়ে কি একখানা চিঠি লেখারও সময় পান না?
তাও বটে! কিন্তু সুকোমল…
টুলুর জন্য যথেষ্ট উদ্বিগ্ন হলাম। উদ্বেগের আরও কারণ ছিল। অজয় আমার নিতান্ত অন্তরঙ্গ বন্ধু এবং আত্মীয়। টুলু আমাদের বাড়ীর মেয়ের মতো। এই শিক্ষিতা তীক্ষ্ণবুদ্ধি মেয়েটি বরাবরই আমার বিশেষ স্নেহের পাত্রী। তার বিবাহের ঘটকও আমি। সুকোমল আমার কলেজের সহপাঠী এবং বিশেষ বন্ধু। অত্যন্ত শান্ত, মার্জিতরুচি এবং চরিত্রবান আমি তাকে ভালো করে জানতাম বলেই টুলুকে নিঃসংশয়ে তার হাতে সমর্পণ করেছিলাম। টুলুর সম্পর্কে সেজন্যে আমার একটা দায়িত্ব আছে।
বৌদি বললেন, প্রথমটা আমরাও কেউ সন্দেহ করিনি। তারপরে একমাস গেল, দু’মাস গেল, ছ’মাস গেল। না এল একখানা চিঠি, না এলেন তিনি নিজে। টুলু দিন দিন শুকিয়ে যায়। বাইরে বেরোয় না। তখনই ব্যাপারটা কানাকানি হল।
বৌদির কথা মনোযোগের সঙ্গে শুনলাম। টুলুর শুকনো মুখখানি স্পষ্ট চোখের উপর ভেসে উঠল। বহুদিন তাকে দেখিনি। এতদিনে আরও অনেক বড় হয়েছে নিশ্চয়। সেদিনের চপল মেয়ের সুন্দর স্নিগ্ধ মুখখানি এখন হয়তো মধুর গাম্ভীর্যে সুন্দরতর, স্নিগ্ধতর হয়েছে। মেঘে ঢাকা চাঁদের মতো সেই মুখে আজ বিষণ্নতার ছায়া পড়েছে। হয়তো আরো রুগণ হয়েছে, চোখ ঢুকেছে কোটরে, দেহ আধখানা হয়ে গেছে। তা আর না হয়? স্বামীর ভালোবাসা হারালে মেয়েদের আর থাকে কি? বিশেষ এতবড় অপবাদে
সেই কথাটাই বৌদিকে আর একবার জিগ্যেস করলাম। কিন্তু তিনি সে সম্বন্ধে নিশ্চয় করে কিছুই জানেন না। শুধু শোনা কথার উপর নির্ভর করে মেয়েমানুষের এতবড় কলঙ্ক সম্বন্ধে কোনো কথাই তিনি বলতে চাইলেন না।
বললাম, কিন্তু আমি তো সুকোমলকে জানি। তার মন মেয়েমানুষের মনের মতো নরম! আমি তো জানি টুলু তার কাছে কতখানি। মিথ্যে নয়, সত্যি সন্দেহের বশেও টুলুকে ত্যাগ করা তার পক্ষে আত্মহত্যার চেয়েও কঠিন।
বৌদি দুষ্টুমি করে বললেন, পুরুষ মানুষ বাড়াবাড়ি যতখানি করে, ততখানি ভালবাসে না। ভালোবাসা তাদের একটা নেশা। তাতে তারা মাতাল হয়। ভালোবাসা তাদের কাছে নিঃশ্বাসের মতো প্রয়োজনীয় নয়।
এই খোঁটা বৌদি পুরুষদের সম্বন্ধে যখন-তখন দেন। আমিও হেসে তাতে সায় দিই। কিন্তু আজ পারলাম না।
বললাম, সুকোমলের সম্বন্ধে ওকথা আপনি বলবেন না বৌদি। টুলুর জন্যে ও যে বাড়ী-ঘর সর্বস্ব ছেড়েছিল, সে কথা ভুলতে চাইবেন না। টুলুকে আনন্দে রাখবার জন্যে ও কী না করেছে!
বৌদি এবারে জোরে জোরেই হেসে ফেললেন। বললেন, তাই তো বলছি গো, নেশা। যেই ছুটেছে অমনি নেশার বস্তুকে দু’পায়ে ঠেলে ফেলে দিয়েছে।
বৌদি আমাকে ভাববার অবকাশ দিয়ে চলে গেলেন।
.
একদিনের কথা মনে পড়ল :
আমাদের পড়া তখন শেষ হয়ে গেছে। সুকোমলের ভাগ্য ভালো, পাশ করার সঙ্গে সঙ্গেই একটা ভালো চাকরী জুটে যায়। একদিন সন্ধ্যার সময় সুকোমল এসে উপস্থিত।
তার ভাবভঙ্গি দেখে বিস্মিতভাবে বললাম, সুকোমল যে! ব্যাপার কি?
—ব্যাপার আছে। টুলুকে এখানে নিয়ে এসেছি।
—সে কি! কবে আনলে?
—ঘণ্টাকয়েক হল। হোটেলে উঠেছি, এখন একটা বাসা দরকার।
এত তাড়াতাড়ি টুলুকে কলকাতা আনার সংবাদে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলাম। বললাম, কি ব্যাপার বলতো? অসুখ-বিসুখ নয় তো কিছু? বোসো, বোসো, দাঁড়িয়ে রইলে কেন?
সুকোমল একখানা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলে। বললে, টুলুকে বাড়ীতে রাখা চলল না। তোমার কাছে গোপন করে লাভ নেই। শনিবারে-শনিবারে বাড়ী যাই। কিন্তু সপ্তাহের বাকী পাঁচটা দিনও ওকে ছেড়ে থাকা আমার পক্ষে অসম্ভব। বাসা আমাকে করতেই হত। তবে এমন করে নয়।
চেয়ারটা আমার আরও কাছে সরিয়ে এনে সুকোমল বললে, কিন্তু মায়ের অত্যাচার ক্রমেই বেড়ে উঠেছে। টুলুকে ওখানে আর একটি দিনও রাখা চলল না।
আমি জানতাম, সুকোমলের মা অত্যন্ত কোপন স্বভাবের। স্নেহ, মায়া, মমতা তাঁর কারও চেয়ে কম তা নয়। দীর্ঘকাল বহু দুঃখ সয়ে কেমন একরোখা হয়ে পড়েছিলেন। রাগলে আর জ্ঞান থাকত না। কেঁদে-কেটে, চীৎকার করে অভিসম্পাত দিয়ে পাড়া মাথায় করতেন। সুকোমল তাঁর একমাত্র সন্তান। তারও নিস্তার ছিল না। টুলু বাড়ীতে থাকলে সে যে ঘন ঘন বাড়ি যায় এ তিনি পছন্দ করতেন না। এর মধ্যে পুত্রবধূর প্রতি ঈর্ষা ছিল কিনা কে জানে? থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মুখে বলতেন অন্য কথা। বলতেন, বেটাছেলে দিন-রাত্রি বউ-এর আঁচলে-আঁচলে ঘুরবে নাকি? তাঁর নিজের স্বামী যে তাঁর কথায় উঠতেন বসতেন, সেজন্য কোনোদিন কেউ তাঁকে প্রতিবাদ করতে শোনে নি। এইটুকুই আশ্চর্য!
সুকোমল বাড়ী গেলেই তিনি মুখ অন্ধকার করতেন। সুকোমল তা জানত। কিন্তু নিজেকে সংযত করা তার পক্ষে সাধ্যাতীত ছিল। অবশ্য যে ক’দিন সে থাকত, তার মা মুখ বুজেই চলতেন! সে চলে এলেই বাক্যবাণ বর্ষণ আরম্ভ হত। তার আর বিরাম ছিল না।
একথা আমি জানতাম। এবং সুকোমল ও টুলু দু’জনকে বহুবার সাবধানও করেছি যে, মায়ের ঈর্ষায় ইন্ধন যোগান দু’জনের পক্ষে কখনই সুখকর হবে না। তারা নিঃশব্দে আমার উপদেশ গ্রহণ করেছিল। ভেবেছিলাম, গোলযোগের শেষ হল। সুকোমল বাসা করছে শুনে বুঝলাম আমার উপদেশ বৃথা গেছে।
দোষ যারই হোক, টুলু নিজেও যে আর শাশুড়ীর বাক্যজ্বালা সইতে পারছিল না, এ বিষয়ে ভুল নেই। শুধু তাই নয়, শাশুড়ীর প্রত্যেকটি কথা কখনও মুখে, কখনও পত্রযোগে স্বামীর কানে পৌঁছেও দিয়েছে। মানুষ রাগের মাথায় কি না বলে! বিশেষ সুকোমলের মায়ের মতো লোক। সুতরাং সকল কথা যখন সুকোমলের কাছে পৌঁছয়, অনেকখানি বিষ ছড়িয়ে দেয়।
ভাবছিলাম, সেই সুকোমল টুলুকে ত্যাগ করেছে। সপ্তাহে পাঁচটা দিনও যার পক্ষে ছেড়ে থাকা অসম্ভব ছিল, সে যদি টুলুকে ত্যাগ করে থাকে, তাহলে পৃথিবীতে অসম্ভব বলে আর রইল কি!
বৌদি এসে আমার ধ্যান ভাঙিয়ে দিলেন। জিজ্ঞেস করলেন, কি ভাবছ?
ম্লানভাবে একটু হাসলাম। বললাম, ভাবছি অনেক পুরোনো একটা কথা।
আমার কেমন মনে হচ্ছিল, টুলু এখনই আসবে। আমার সঙ্গে অজয়ের এবং সুকোমলের কত নিবিড় সম্বন্ধ তা সে জানে। তার নিজের প্রতিও আমার স্নেহ কম নয়। এই দুঃখের দিনে যদি কাউকে সমস্ত কথা জানাতে পারে, সে আমি। হয়তো কবে আমি আসব এই ভেবেই সে দিন গুনেছে। তারই প্রতীক্ষায় বসে রইলাম। কিন্তু সমস্ত সকালের মধ্যে সে এল না। বৌদিকে জিগ্যেস করলাম, আমি কবে আসব একথা টুলু কোনোদিন জিগ্যেস করেনি?
বৌদি ঘাড় নেড়ে বললেন, এ-বাড়ীতে সে বহুদিন আসেনি! সে কোথাও বের হয় না।
ভাবলাম, এমনও হতে পারে যে টুলু আমার আসার সংবাদই জানে না। কিন্তু কিছুক্ষণ আগেই তো তার ছোট ভাইটি একটি রবারের বল না কি খুঁজতে এ-বাড়ীর মধ্যে এসেছিল। আমাকে দেখে একটা প্রণামও করে গেল। সে কি বাড়ীতে এ সংবাদ দেয় নি? কি জানি!
দুপুরও গেল। বিকেলের দিকে মনটা বড় চঞ্চল হয়ে উঠলো। ভাবলাম, এবার টুলুর না হোক, তার বাড়ীর খবরটাও নিয়ে আসা যাক।
.
টুলু ঘরের ভিতর কি একটা করছিল। আমার ডাক শুনে বাইরে এসে অবাক হয়ে চেয়ে রইল। অবাকও নয়, কেমন স্তব্ধ হয়ে গেছে।
জিগ্যেস করলাম, মা কোথায়?
—ঘাটে গেছেন। এখনি আসবেন।
বসব কি না ভাবছিলাম। টুলু হয়তো সেকথা বুঝতে পারলে। বললে, বসবেন? টুলু দাওয়ায় একটা আসন পেতে দিলে। জিগ্যেস করলে, কাল রাত্রে এসেছেন?
—হ্যাঁ, কাল রাত্রে।
—ভালো ছিলেন?
—আছি একরকম। তুমি কেমন আছ?
টুলু একটু হাসলে। শীতের সকালবেলায় মেঘ-ভাঙা এক টুকরা রোদের মতো। বললে, আজকালকার দিনে ভালো থাকা কত কঠিন জানেন তো?
টুলু যেন আমার কথা বলার পথ পরিষ্কার করে দিলে। তবু কথাটা উত্থাপন করতে বাধছিল। একটা ঢোক গিলে জিগ্যেস করলাম, সুকোমলের খবর কি? ভালো তো?
টুলু হঠাৎ মুখে কাপড় দিয়ে হাসতে লাগলো। বললে, জানি না।
টুলুর হাসি আর বন্ধ হয় না। আশ্চর্য মেয়ে! আমার সন্দেহ হল বৌদির কথা বুঝি তবে সত্যি নয়। তবু জিগ্যেস করলাম, এর মধ্যে আসে নি? চিঠি পেয়েছ?
এবারে টুলু এমন জোরে হেসে উঠল যে, আমি অবাক হয়ে গেলাম!
টুলু বললে, কেন মিথ্যে না-জানার ভান করছেন? আমার ভাগ্যের কথা কে না শুনেছে?
ওর কথায় আমি অপ্রতিভ হলাম। বললাম, আমি সবই শুনেছি টুলু। আমি আশ্চর্য হচ্ছি-
টুলু চুপ করে রইল।
বললাম, আমার কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না, সুকোমলের দ্বারা এ কাজ সম্ভব।
টুলু এক মুহূর্ত চোখ মেলে আমার দিকে চাইলে। বললে, বিশ্বাস আমারও হয়নি মৃণালবাবু। আমিও রাগের মাথায় চলে এসেছিলাম। মনে মনে জানতাম, একদিন সাধ্যসাধনা করে আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার পথ পাবে না।
টুলু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললে। দেখতে দেখতে কোথায় গেল মুখের হাসি। চোখ বাষ্পসমাকুল হয়ে উঠল। আমার দিকে চোখ তুলে আর চাইতে পারে না। বললাম, হঠাৎ তার মতিগতি এমন হয়ে গেল? কী হয়েছিল?
—সে তাঁকেই জিগ্যেস করবেন। আমি কিছু জানি না।
টুলু উঠে পড়ল। তার ভঙ্গিমার দৃঢ়তায় বোঝা গেল, এ-প্রসঙ্গে আর বেশী কথা সে কইতে চায় না।
কিন্তু আমিও ছাড়লাম না। বললাম, বোসো। উঠলে হবে না। সুকোমলের ওপর অভিমান করবার তোমার অধিকার আছে সত্যি, কিন্তু এখন অভিমান করে বসে থাকবার সময় নয়। আমাকে সব কথা খুলে বলতেই হবে। তার সঙ্গে আমাকেও বোঝাপড়া করতে হবে। তোমাদের দু’জনের সম্বন্ধেই আমার একটা দায়িত্ব আছে।
টুলু এক মিনিট চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। বোধ করি আমার কথাটা মন দিয়ে বোঝবার চেষ্টা করলে। তারপর সেইখানে মেঝের উপর ধুপ করে বসে উত্তেজিতভাবে বললে, কি ছাই বলব? এ কি বলবার মত কথা মৃণালবাবু? আপনার বন্ধু আমাকে সন্দেহ করেন। আর শুনবেন?
টুলুর চোখ দিয়ে যেন এক ঝলক আগুন বের হয়ে এল।
বৌদিও আমাকে এমনি আভাসই দিয়েছিলেন। তথাপি একথা এত স্পষ্ট করে শুনে আমার আর বিস্ময়ের অবধি রইল না। যে কেউ টুলুকে বিন্দুমাত্রও জানে সে-ই একথা শুনে বিস্মিত হবে। আমি তার মুখের দিকে নির্বাক বিস্ময়ে চেয়ে রইলাম। বলবার মতো কোনো কথা খুঁজে পেলাম না।
মিনিট দুই এমনি কাটল।
ধীরে ধীরে বললাম, এতদিন একত্রবাসের পরেও তোমাকে সন্দেহ করলে? সুকোমল?
এত দুঃখেও ফিক করে হেসে টুলু মুখে আঁচল চাপা দিলে। বললে, দেখুন তো মৃণালবাবু! বুড়ো বয়সে এ আবার কি রোগে ধরলে!
রোগই বটে। এতদিন একসঙ্গে কাটিয়েও যদি দু’টি নরনারী পরস্পরের মন জানতে না পারে, আর কবে পারবে! স্বামীর প্রতি টুলুর শ্রদ্ধা যে কত বেশী একথা কিছু না- হলেও একশোবার আমি সুকোমলের কাছেই শুনেছি। তারপরেও সেই সুকোমল যদি স্ত্রীর চরিত্রে সন্দিহান হয়, তাকে রোগ বলব না তো কি বলব।
জিগ্যেস করলাম, এদানি কি তোমাদের বনিবনাও হত না? খুব কি ঝগড়া ঝাঁটি হত?
টুলু তাড়াতাড়ি বাধা দিয়ে বললে, একদিনও না। আপনি তো ওঁকে জানেন, উনি কি ঝগড়া করার লোক? দোষ আমারই। আমি যদি একটু সাবধান হতাম, এ অনর্থ ঘটত না। আপনাকে সব কথাই বলি :
একটু সলজ্জভাবে হেসে টুলু বলতে লাগল :
অজয়দার দেখাদেখি একটু কবিতা লেখার সখ আমার হয়েছিল। লুকিয়ে লুকিয়ে কবিতা লিখতাম। একদিন সেই খাতা ওঁর চোখে পড়ল। আমি জানি, সে সব কবিতা হয়তো কিছুই নয়। তবু তাই পড়েই ওঁর কি আনন্দ।
টুলুর চোখে সেদিনের সুখ-স্মৃতি বোধ হয় একবার ভেসে উঠল। একটুখানির জন্যে সে উন্মনা হয়ে পড়ল।
তারপর বলতে লাগল, আমার অদৃষ্টে সেই হল কাল। কাজকর্ম সব গেল চুলোয়, শুধু কবিতার পর কবিতা লিখি। আগে বিকেলের জল খাবার আমি নিজের হাতে তৈরী করতাম। ক্রমে সে ভার পড়ল ঠাকুরের হাতে। আমি কেবল কবিতা লিখি। হঠাৎ একদিন মনে হল, মাসিকপত্রে পাঠালে হয় না? তাই পাঠালাম! কিন্তু কাউকে বললাম না। ভাবলাম যদি ফেরত আসে, জানিয়ে আর লজ্জা বাড়াই কেন? বরং যদি ছাপা হয় সবাইকে তাক লাগিয়ে দোব। কিন্তু তাক লাগান আর হল না। লেখা ফেরত এল। আর পড়বি তো পড় ওঁরই হাতে। লজ্জায় আমার মাথা কাটা গেল। কিন্তু উনিও কিছু বললেন না, আমিও না। আপনি পান খাবেন মৃণালবাবু? আপনার আবার বেশী পান খাওয়ার অভ্যাস।
টুলু উঠতে যাচ্ছিল। আমি তাড়াতাড়ি বললাম, না থাক। পান আমার পকেটেই আছে। তুমি তারপর বলো।
টুলু হঠাৎ অনুনয়ের সুরে বললে, আর শুনতে হবে না মৃণালবাবু। এ শুনে কারও কোনো লাভ নেই।
আরম্ভেই কথা বন্ধ করায় আমি চটে গেলাম। বললাম, আছে লাভ। তুমি বলো।
টুলু আর আপত্তি করলে না। বললে, আমি কিন্তু দমলাম না। নানা কাগজে নানা লেখা পাঠাতে লাগলাম। সব কবিতাই সব জায়গা থেকে যথা সময়ে ফেরত এল। কেবল একখানি বড় কাগজ একটি লেখা ছাপলে এবং তার সম্পাদক মশাই কবিতাটির প্রশংসা করে একখানা চিঠিও দিলেন। সে চিঠি উনি দেখেছেন কি না জানি না। কিন্তু আমি আর দেখালাম না। ভাবলাম, লেখাটা নিজের চোখে ছাপার অক্ষরে না দেখলে আর কারও কাছে ভাঙচি না। অবশেষে লেখাটা বের হল।
সে কবিতা আমিও দেখেছি। বললাম, ওহো, সেটা তোমারই লেখা? ‘বন্দীর ব্যথা’? সে তো আমিও দেখেছি। স্বামীর গৃহে মেয়েদের দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে লেখা।
আনন্দে ও গর্বে টুলু মুখ নত করলে।
বললে, সেই হল কাল। লেখাটা নিজে থেকে ওঁকে দেখাতে লজ্জা করছিল। ওঁর টেবিলে কাগজখানা রেখে দিই, যেন ভুলে রেখেছি। উনি দু’তিনবার কাগজখানার দিকে চাইলেন টের পেলাম। কিন্তু সে আর বাঁ হাত দিয়েও ছুঁলেন না। সে রাত্রে কেবলই গল্প করতে লাগলেন, ক’জন সম্পাদকের সঙ্গে কজন লেখিকার বিবাহ হয়েছে। আর যে-ক্ষেত্রে লেখিকা বিবাহিতা সে-ক্ষেত্রে কি অঘটন ঘটেছে। বেশ বুঝতে পারছিলাম এসবই তাঁর বানানো গল্প। কোন সম্পাদকের সঙ্গেই তাঁর পরিচয় নেই! কোনো লেখিকার কথাও জানেন না। আপিসে বসে হিসেবের খাতা নিয়ে পরের লক্ষ লক্ষ টাকার হিসাব রাখা ছাড়া কিছুই তিনি করেনও না, জানেনও না। ওর কথা শুনে একটা অজানা আশঙ্কায় মনটা কেঁপে উঠল। সেই সঙ্গে রাগও হল। মনে হল পুরুষ মানুষ শুধু মেয়েদের দেহ পর্দানশীন করেই তৃপ্ত নয়, তাদের মনকেও পর্দানশীন করতে চায়।
আমি হেসে ফেললাম।
—সর্বনাশ! তোমারও দেখছি স্ত্রী-স্বাধীনতার হাওয়া লাগল। আমার পানে বড় বড় চোখ মেলে টুলু গম্ভীরভাবে বললে, হাসবেন না মৃণালবাবু। অধিকাংশ পুরুষের পক্ষেই যে একথা সত্যি এ আমি আমার সর্বস্ব দিয়ে জেনে গেলাম।
টুলুর চোখ ছল ছল করে উঠল।
ঈশানকোণে একটুকরো মেঘ ধীরে ধীরে কালো হয়ে উঠেছিল। নির্নিমেষে সেইদিকে চেয়ে রইল।
তারপর বললে, তখন যদি বুঝতে পারি ওঁর মনে পাপ ঢুকেছে তাহলে কি আর এ দুর্ভোগ ঘটে! অতটা আমি ভাবতেই পারিনি। যেমন কবিতা পাঠাচ্ছিলাম, তেমনি পাঠাতে লাগলাম। সম্পাদকের সঙ্গে পত্র-বিনিময়ও বন্ধ করলাম না। বরং ধীরে ধীরে পত্রালাপের মধ্য দিয়ে আমাদের মধ্যে কেমন যেন একটা বন্ধুত্ব গড়ে উঠল,—একটুখানি আত্মীয়তাও। সে সব চিঠি উনি পড়েছেন কিনা জানি না। হয়তো পড়েননি, মাঝে মাঝে খামটুকুই দেখেছেন। কিংবা যদি পড়ে থাকেন তো লুকিয়ে। তখন আমাদের সম্বন্ধ কেমন দাঁড়ালো জানেন? কলহ নয়, কথা বন্ধও নয়। কারণ ঘটলে পরস্পরের কথায় পরস্পরে হেসেও ফেলি। কিন্তু তবুও যেন কেমন একটা ফাঁক থেকে যায়। আমার কাছে একলা বসলে উনি যেন অস্বস্তি বোধ করেন এবং আমিও কেমন কুণ্ঠিত হই। হয় দু’জনে দু’খানা বই নিয়ে বসি, নয় উনি চাকরটাকে তামাক দিতে বলেন আর আমি চাকরটা তামাক দিচ্ছে কিনা দেখবার জন্যে সেই যে বাইরে আসি আর ভিতরে যেতে পারি না। এমনি করে ওঁর দিন হয়তো কেটে যাচ্ছিল, কিন্তু আমি আর পারছিলাম না। একটা কথা বিশ্বাস করুন মৃণালবাবু, উনি যদি আমাকে ত্যাগ না করতেন আমাকে আত্মহত্যা করতে হত। ঐ গুমোট আমি আর সইতে পারছিলাম না।
টুলুর বুকের ওপর কে যেন একটা ভারী পাথর চাপিয়ে দিয়েছে। সহজভাবে নিশ্বাস নিতে পারছিল না!
দেখতে দেখতে ঈশান কোণের মেঘ বেশ কালো হয়ে উঠলো। ঝড় ওঠেনি, কিন্তু গাছপালাগুলি যেন রুদ্ধ নিঃশ্বাসে ঝড়েরই প্রতীক্ষা করছিল। সেদিকে একবার দৃষ্টি দিয়ে আমি টুলুর পানে চাইলাম।
টুলু বলতে লাগলো, একটা ঝগড়া হওয়া দরকার,—তুমুল ঝগড়া। যেদিক দিয়ে হোক একটা শেষ না হলে আমি বাঁচব না, এমনি আমার মনের অবস্থা। একদিন উনি অফিস থেকে ফিরতেই বললাম, এত দেরী হল যে!
একে তো ওঁর দেরী হয়নি, তার ওপর এমন প্রশ্ন অনেকদিন করিনি। জামা ছাড়তে ছাড়তেই উনি বিস্মিতভাবে আমার দিকে ফিরে জিগ্যেস করলেন, কেন বলো তো? কিছু দরকার ছিল?
প্রাণপণ চেষ্টায় মুখে হাসি ফুটিয়ে বললাম, ছিলই তো! আমাকে যে এক জায়গায় নিয়ে যেতে হবে।
—কোথায় বলতো?—উনি ক্রমেই বিস্মিত হচ্ছিলেন।
—একটা সাহিত্য-সভায়। নিমন্ত্রণ এসেছে।
আমি দুরু দুরু বুকে অপেক্ষা করতে লাগলাম, এইবার ওঁর মুখ থেকে একটা কড়া কথা নিশ্চয় বেরুবে। তখন আমিও….
ও হরি, একটা কড়া কথাও তিনি বললেন না! জামাটা খুলে আলনায় রেখে বললেন, তবেই তো মুশকিলে ফেললে। আমাকে যে এক্ষুনি বেরুতে হবে। না বেরুলেই নয়। আমি আরও একটু চাপ দিলাম। বললাম, তাহলে আমি একাই ঘুরে আসি। কি বল?
—বেশতো!—বলেই চলে গেলেন।
উনি তো চলে গেলেন, কিন্তু আমি যাই কোথায়! সত্যিই তো আর কোথাও নিমন্ত্রণ ছিল না। তবু বেরুতে হল। একখানা গাড়ী করে অনাবশ্যক খানিকটা ঘুরে যখন বাড়ী ফিরলাম তখন রাত ন’টার কম নয়। ওঁকে দেখলাম না। শোবার ঘরে কাপড় ছাড়তে গিয়ে নজরে পড়লো টেবিলের উপর আমার নামে একখানা চিঠি, ওঁরই হাতের লেখা। তাড়াতাড়ি চেয়ারে বসে চিঠিখানা খুলতেই পড়লাম :
টুলু,
তোমার বাড়ীতে টেলিগ্রাম করে দিলাম। কাল সকালের গাড়ীতেই কেউ আসবেন আশা করা যায়। তাঁর সঙ্গেই তুমি চলে যেও। তুমি গেছ খবর পেলেই আমি বাড়ী ফিরবো। ইতি-
সুকোমল
আমার কি হয়েছিল জানি না, যখন জ্ঞান হল তখন সকাল হয়েছে। আমি সেই চেয়ারেই বসে। সেই পোশাকে।
আকুল করে মেঘ এলো। এখুনি ঝড় উঠবে। এইবার উঠতে হয়।
টুলুর কথায় আমার মন ভারী হয়ে উঠল। তথাপি তরলকণ্ঠে বললাম, এখন উঠলাম টুলু। কাল কলকাতা যাচ্ছি। সেই রাসকেলটাকে ধরে এনে পরশু তোমার কাছে হাজির করব নিশ্চয়।
আমার সঙ্গে সঙ্গে টুলুও উঠে দাঁড়িয়েছিল। আমার কথা শোনামাত্র সে খপ্ করে আমার একটা হাত চেপে ধরে বললে, ঐ কাজটি করতে পারবেন না মৃণালবাবু। লোককে ভূতে পায়, ওঁকে পেয়েছে সন্দেহে। মানুষের সাধ্য নেই তার হাত থেকে ওঁকে নিষ্কৃতি দেয়!
—তুমি দেখোতো!
—না, না, না। আমি দেখতে চাই না। ওঁকে আপনি আমার চেয়ে বেশী চেনেন? আমি এখানে যে কষ্ট পাচ্ছি, তার চেয়ে ঢের বেশী উনি সেখানে বসে ভোগ করছেন। সন্দেহের বিষ কীটের মত সমস্ত মন কুরে কুরে খাচ্ছে। উনি আমার চেয়েও অসহায়। কি হবে গিয়ে?
কোথা হতে ধুলো-বালি শুকনো পাতা উড়ে এসে উঠান অন্ধকার করে দিলে। ঝড় এসে পড়েছে। কাল বৈশাখীর ঝড়? সেই মুহূর্তেই টুলুর মা ভিজা কাপড়ে একটা পিতলের ঘড়া কাঁখে করে খিড়কীর দরজা দিয়ে বাড়ী ঢুকলেন। টুলু তখনও আমার হাতখানা ধরে ছিল।
টুলুর মা দরজার গোড়াতেই আমাদের দেখে থমকে দাঁড়ালেন। আর টুলু একটা ঝাঁকুনি দিয়ে আমার হাত ছেড়ে দিলে।
আমি তাড়াতাড়ি গিয়ে মার পায়ের ধুলো নিলাম। কিন্তু আমাকে চেনবার পরেও তাঁর মুখ খুব প্রসন্ন হল বলে মনে হল না।
—খুড়িমা, ভালো আছেন?
প্রত্যুত্তরে কি বললেন বোঝা গেল না। সোজা ঘরের মধ্যে চলে গেলেন।
ওদিকে চেয়ে দেখি টুলুও অকস্মাৎ কখন সরে পড়েছে।
অর্থ বুঝলাম না। তবু একটা লজ্জাকর আশঙ্কায় সঙ্কুচিত হয়ে পড়লাম। স্তব্ধভাবে অল্পক্ষণ দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে ফিরে এলাম।
.
কলকাতা ফিরে সেই রাসকেলটার সঙ্গে আর দেখা করি নি। করার ইচ্ছাও হয় নি। শুধু সুকোমলই তো নয়, আজ পৃথিবী সুদ্ধ লোকের সন্দেহ পড়েছে ওর উপর। কেউ কিছু জানে না। সত্য-মিথ্যা যাচাই করেও দেখবে না। অকারণে কেবল ওকে সন্দেহই করবে।
এসে অজয়কে সমস্ত বললাম। তখনও সে এমন শয্যাগত হয় নি। তার চোখ কালো চশমায় ঢাকা ছিল;– দেখা যাচ্ছিল না। শুধু কুঞ্চিত রোগগ্রস্ত গালের উপর দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। ‘টুলুকে ও নিজের হাতে মানুষ করেছে। টুলু ওর শিষ্যা। কিন্তু তাও নয়। অজয় চিররুগণ; এবং বোধ হয় সেই জন্যেই মেয়েদের সম্বন্ধে চিরকাল chivalrous, ওর দুঃখ শুধু টুলুর জন্যে নয়, কোনো একটি মেয়ের জন্য নয়। সকল কালের, সকল দেশের লাঞ্ছিত এবং অপমানিত মেয়ের জন্যে। অজয় ওকে আদর করে নিয়ে এসে সসম্মানে নিজের গৃহে প্রতিষ্ঠিত করলে।
ওর সম্বন্ধে আমার সঙ্কোচ কাটতে দেরী লেগেছিল। কিছুই নয়, কিন্তু ওর মায়ের বিরক্ত সন্দিগ্ধ চাহনি, টুলুর ত্রস্তভাবে পলায়ন, সে আমি কিছুতেই ভুলতে পারিনি। সন্দেহ শুধু সন্দেহপরায়ণকেই নীচু করে না, সন্দিগ্ধ ব্যক্তির মনেও গ্লানি জমায়। সেই গ্লানি পরিষ্কার হতে সময় নিয়েছিল। তারপর এসব কথা একরকম ভুলেই গিয়েছিলাম। তখন ভাবি নি যে, ভুলে ছিলাম অজয়ের ব্যক্তিত্বের মধ্যবর্তিতায়। আজকে সে নেই। সমস্ত গ্লানি, সমস্ত লজ্জা আজ আবার নতুন করে ফিরে এলো।
.
ভাবনা হল, এইবারে এদের নিয়ে করি কি! এত বড় বাড়ীতে দুটি মেয়ের পক্ষে আজ রাত্রে একলা থাকা অসম্ভব। অবশ্য আজ রাত্রের সমস্যার মীমাংসা কঠিন হবে না। তারপর রাধা না হয় বৃন্দাবনেই ফিরে গেল। সেইখানেই তো মানুষ। কিন্তু টুলু? টুলু যে অজয়ের ভরসায় সব আশ্রয় ত্যাগ করে এসেছে! শ্বশুরালয়ে স্থান নেই, পিত্রালয়েও না। তবে ও যায় কোথায়? সদ্য বিয়োগ ব্যথায় এসব সমস্যা এখনও হয়তো ওর মনে ওঠে নি। কিন্তু কাল?
একটি মেয়ের ভরণ-পোষণের ভার নেওয়ার শক্তি যে আমার নেই তা নয়। সে ভয় করি না। কিন্তু ওকে রাখি কোথায়? এই বাড়িতে একলা ও থাকবে সে সম্ভব নয়। আমার বাড়ীতেও একটি স্ত্রীলোক নেই যে ওকে নিঃসঙ্কোচে নিয়ে গিয়ে রাখি। শঙ্কা করার কারণ কিছু নেই। সমাজের সঙ্গে কোথাও আমার বাঁধন শক্ত নয়। প্রতিবেশীর মিথ্যে চোখ রাঙানোর ভয় আমি করব কেন?
কিন্তু শুধু আমার কথাই তো নয়, আরও একটা পক্ষ রয়েছে যে! আমি পুরুষ মানুষ। কলঙ্ক আমার হাঁটুর উপর উঠতে পারে না। কিন্তু সত্য হোক, মিথ্যা হোক, এতটুকু অসম্মানের মধ্যে ওকে আমি ফেলি কি করে? আমার পক্ষে যা কিছুই নয়, ওর পক্ষে তা যে বিষ! এক মুহূর্তে ওর সমস্ত অস্তিত্বকে দেবে কুৎসিত করে। পৃথিবীতে মুখ দেখাবার কোনো উপায়ই রাখবে না। তবে টুলুর আজ আশ্রয় কোথায়?
আমি ওকে ছেলেবেলা থেকে জানি, চিনি, বুঝি! সবাই তো সে সুযোগ পায় নি। একজন মানুষ আর একজনের বিচার করার সময় যথেষ্ট চেনার অপেক্ষা রাখে না। বিচারের ফল যত গুরুই হোক-বাইরে দেখেই সবাই বিচার করে। বিশেষ, টুলুকে সন্দেহ করা—আমি ভেবে দেখেছি—অত্যন্ত সহজ। তার সম্বন্ধে অবিচার করা প্রায় স্বাভাবিক।
বাঙালীর মেয়ে সাধারণত কাঁকন এবং কণ্ঠহারের বেড়ির বাঁধনে ধীরে ধীরে বাড়ে। টুলু বাঁধন পায় নি ছেলেবেলায়। সে বেড়েছে তারই বয়সী ছেলের সঙ্গে সঙ্গে সতেজে। ফলে, সে হয়েছে চপল, চটুল, বাচাল। জন্মের সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিক নিয়মে যে প্রচুর প্রাণশক্তি টুলু পেয়েছিল, অজয় তাকে খর্ব করার, সংযত করার কোনো ব্যবস্থাই করে নি। ওর মাথা খেয়েছে অজয়।
অবশ্য অজয়ের দুঃখও আমি বুঝি। জন্মের সঙ্গে সে পেয়েছিল কুৎসিৎ, দুরারোগ্য ব্যাধি। এ তার পিতৃপুরুষের দান। তার চাপে বিধাতার দেওয়া প্রাণশক্তি শুকিয়ে কুঁকড়ে যায়। তাই প্রাণশক্তির ওপর তার শ্রদ্ধাও ছিল যেমন, লোভও ছিল তেমনি। কোনো সামাজিক বিধি-ব্যবস্থার খাতিরেই সে কারও প্রাণশক্তি ক্ষুণ্ণ করতে চাইত না। মনে করত পাপ। বলত, এ যারা করে তারা বিধাতার অভিশাপকে আহ্বান করে।
হয়তো করে। কিন্তু আজকে তার টুলু তো দাঁড়ালো পথে! তাকে সম্মানের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করে এমন বলিষ্ঠ বাহু আমি তো দেখি না। অজয়ের কথা স্বতন্ত্র। দুরারোগ্য ব্যাধি রাখার মতো কোনো সম্পদই তার রাখে নি। কিন্তু তার বদলে দিয়েছিল একটা নিস্পৃহ বলিষ্ঠতা। একটা কিছুর লোভে অন্য কিছুকে মেনে চলার প্রয়োজন গিয়েছিল ফুরিয়ে। ভরসা করার কিছুই যার নেই তার আর ভয় কিসের? কিন্তু আর সকলের তো তা নয়। প্রচলিত বিধি বিধান তাদের মেনে চলতে হবে। বিশেষ করে মেয়েদের! সুনাম ছাড়া তাদের জীবনে আর আছে কী? কলঙ্কিনী হওয়া কি মুখের কথা?
সর্বশেষ এবং একমাত্র আশ্রয় থেকে চ্যুত হয়ে টুলু একেবারে ভেঙে পড়েছে। ওকে সান্ত্বনা দিতে যাওয়াই বর্বরতা! তার চেয়ে ও একলা বসে বসে কাঁদুক। কেঁদে কেঁদে নিজেকে হালকা করে ফেলুক। তারপরে শক্ত তো ওকে হতেই হবে। কিম্বা পালকের মতো হালকা যাতে আঘাত ওর গায়ে লাগবে না।
রাধাকে ডেকে বললাম, আজ রাত্তিরটা বোধ হয় আমাকে এইখানেই থাকতে হবে!
রাধা তাড়াতাড়ি বললে, হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমিও তাই আপনাকে বলব ভাবছিলাম।
বললাম, না, সে আমি আগেই স্থির করেছি। নইলে তোমাদের…বলতে যাচ্ছিলাম, অসুবিধা হবে। কিন্তু রাধা অসঙ্কোচে বললে, ভয় তো হবেই। দু’টি মেয়েতে, এত বড় বাড়ীতে, তাতে…
তার নিঃসঙ্কোচ উক্তিতে আমি বিস্মিত হলাম। মনে হল টুলু ঠিকই বলেছে। রাধা নিতান্ত সাধারণ মেয়ে।
এমন একটি পুস্তক পড়ার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাচ্ছি।