বসন্তের নতুন রং
বসন্ত কোথায়? শীত এল কি এল না, শহরে গাঁয়ে গঞ্জে বসন্ত এসে গেছে বলে রব উঠতে উঠতে মিলিয়ে গেল। বসন্ত আসতে না আসতে গ্রীষ্মের হুহু আগুনে বাতাস বইতে শুরু করেছে। এতদিন জেনেছিলাম বসন্তের সময় জ্ঞান তীব্র প্রখর। প্রকৃতিতে না এলেও মনের ভিতরে সে গুণগুণ করে ঘোর শীতের ভিতরেও। এবছর চলছে ঋতু সংহার। শীত তো এল এল করে চলিয়া গেল অকালে প্রায়। বসন্ত মুখ লুকিয়েছে গ্রীষ্মের তেজময় বাতাসের ভিতরে। আমরা অবাক হয়ে আছি, জীবন থেকে একটি অম্লানকুসুম ম্লান হয়ে ঝরে গেল। বসন্ত মুখ দেখাতে না দেখাতে মিলিয়ে গেল।
আসলে আমাদের এই দেশে শীতের তেমন কামড় আর কই? আমাদের পথ ও প্রান্তর কি তুষারাবৃত হয়ে ঢেকে থাকে, যেমন থাকে শীতপ্রধান দেশে? পুশকিন, তলস্তয়ের উপন্যাসে পড়েছি যে অনন্য শীতের বিবরণ, তা আমাদের দেশে বিরল। সিনেমায় ইউরোপের যে শীত দেখেছি, সেই শীতকাল এক অবরুদ্ধ জীবনের কাল। সৈয়দ মুজতবা আলির দেশে বিদেশের সেই কিশোরটির কথা মনে পড়ে সে দুমাস শীতের জন্য রসদ সংগ্রহ করে ঘরে ঢুকে পড়ে ফায়ার প্লেসে আগুন দিয়ে কাচে ঢাকা জানালার ধারে বসে অবিরাম তুষারপাত দেখে যায়। উত্তর গোলার্ধে, পশ্চিমে শীত বড় কঠিন সময়। ফলে বসন্তের প্রার্থনা থাকে অন্তরজুড়ে। শীতে তুষারাচ্ছন্ন প্রকৃতি, মানুষ প্রায় গৃহবন্দী। সূর্যের উত্তরায়ণের কাল শুরু হয় বড়দিনের সময়, আমাদের পৌষের দিন দশ গেলে। সূর্যরশ্মি ধীরে ধীরে খাড়া হয়ে নেমে আসতে থাকে। শীতে জমে থাকা তুষার গলতে শুরু করে ফেব্রুয়ারি থেকে। গলা-বরফ ফুঁড়ে সবুজ তৃণের মুখ দেখা যায়। সেই হলো বসন্তের আগমন। বরফ গলে নতুন তৃণে আচ্ছাদিত মাঠ-পাথার মুখ দেখালে ধরা যায় বসন্ত আসিল প্রাণে আর মনে। আমাদের দেশে তেমন শীত কই কাশ্মীর আর লাদাখ ব্যতীত। সে তো এই সাধারণ মানুষের মনে রাশিয়া আর হাঙ্গেরির শীত ব্যতীত কাছের কিছু নয়, ফলে বসন্ত আমাদের তেমন নেই। তলস্তয়ের রেজারেকশন উপন্যাসে সাইবেরিয়ার পথে অপরাধী মেয়েটিকে নিয়ে যখন প্রশাসনের কনভয় যাত্রা করে শীতের শেষে, বসন্তের আরম্ভে, অনুতাপে জর্জরিত কাউন্ট সেই কনভয়কে অনুসরণ করে সাইবেরিয়ায় আত্মনিবার্সনের পথে যাত্রা করে। চারিদিকে বসন্তের আগমনের চিহ্ন সব। দীর্ঘ অবরুদ্ধতা ভেঙে মানুষ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। আমাদের শীত অবরুদ্ধতার নয়। আমাদের শীতকাল রৌদ্রালোকিত, উপভোগের। ফলে বসন্ত শুধু তাপমাত্রার হেরফেরে ধরা যায়। কিন্তু সেই বসন্ত এবার উধাও। এবার শীত সেভাবে নিজের দাপট দেখাতে পারেনি তার কালে, পৌষ-মাঘে। আর বসন্তেই এসে গেল গ্রীষ্মের উত্তাপ। কেন?
নিউইয়র্কবাসী বন্ধু ফেসবুকে জানালেন, না, এবার ওদেশেও শীত আসেনি রে রে করে। এল নিনোর প্রভাবে সমগ্র বিশ্বেই এমন। এল নিনো সামুদ্রিক ঘূর্ণাবর্ত। উষ্ণ জলস্রোতের যাতায়াতে সামুদ্রিক সেই ঘূর্ণাবর্ত ক’বছর অন্তরই সক্রিয় হয়ে প্রকৃতির রূপ আর রঙে থাবা বসাচ্ছে। আমাদের নিজস্ব আয়োজনও তাই ব্যর্থ হয়ে গেল এবার বুঝি। শীতকাল পত্র ঝরণের কাল। বসন্ত নতুন পাতা নিয়ে আসে। তা এসেছে নিশ্চয় বনে বনে। কিন্তু বাতাস অগ্নিময়। ২১শে ফেব্রুয়ারি, ফাল্গুন এসেছে সবে, তাপমাত্রা ছিল ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এমন যে হয় না স্বাভাবিক ভাবে। বসন্ত উধাও। অথচ শহর ছাড়িয়ে দূরে গেলে সেই গরম বাতাসে আমের মুকুলের অদ্ভুত সুবাস, এই মুখ লুকোনো বসন্ত বলে দিচ্ছে এবার আম হবে ভালো। আবার খনার বচন বলে দেয়, আমে ধান। এবার ধানও হবে ভাল। ফাল্গুনের দশদিনের মাথায় আকাশে মেঘ। বৃষ্টি হয়ে গেল মেঘ গুড়গুড় করে। খনার বচনে বলে, যদি বর্ষে মাঘের শেষ, ধন্য রাজা পুণ্য দেশ। মানে সেই একই, ফসল হবে ভাল। এই সময়ে বৃষ্টি হলে, মাটি নরম হয়, কৃষকে একবার হল কর্ষণে নামে। তাপমাত্রা বেড়ে গিয়ে বসন্ত উধাও হয়েও আছে সে মনে, তাই এত কথা। এল নিনো তো শুধু সামুদ্রিক ঘূর্ণাবর্ত নয়, এল নিনো সামাজিক ঘূর্ণাবর্তও। এই বসন্ত এসেছে দমন পীড়ন আর ক্ষোভের উত্তাপ নিয়ে। বসন্ত তো যৌবনের কাল। নতুন জন্মের কাল। সেই কালে নেমে আসছে শাসকের প্রাচীন অন্ধকার। বুড়ো পাখির খসিয়ে দেওয়া পালক ভেসে যাচ্ছে বাতাসে। আমরা এই বসন্তে ভাল নেই। হ্যাঁ, কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, পলাশের আগুন তো আছেই। সেই আগুন আর রং ছড়িয়ে গেছে ভাবুক নতুন প্রজন্মের নিকট। তাদের স্পষ্ট কথায় তপ্ত হয়েছে প্রাচীন প্রজন্ম। কিন্তু আমি শুনছি বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ। এই বসন্ত এসেছে যে প্রেমের উত্তাপ নিয়ে তা ছড়িয়ে পড়ছে দেশবাসীর ভিতরে। এবার ইন্টারনেটের ভুবনডাঙায় তেমন চিহ্ন নেই বসন্তের। রক্তপলাশ, শিমুল, মাদার, কাঞ্চন থেকে কৃষ্ণচূড়া রাধা চূড়া, নিমফুল, আম্রমুকুলে রঙে রঙে ছেয়ে যায়নি কম্পিউটারের মনিটর। বদলে মুখর হয়েছে তা নানা কন্ঠের নানা মতে। সেও তো বসন্তেরই চিহ্ন। রঙের বদলে এসেছে বসন্তের বজ্র নির্ঘোষের ছবি। মিছিলের ছবি। “আমাকে বলতে দাও”, মুষ্ঠিবদ্ধ হাত উঠেছে আকাশে। আমাকে যদি না বলতে দাও, তবে কেন আমার জীবনে এই বসন্ত এল। এল নিনো এসেছে সত্যি আমাদের সমাজে। তাই সবদিক অশান্ত, কেউ ওদের কথা শুনতে চায় না। দমন পীড়নে বসন্তের অবসান ঘটে না। প্রকৃতিই নিয়ে আসে নতুন ঋতু। বছর ঘুরে আবার বসন্ত আসবে, বনে বনে ফুল ফুটবে। আমার সন্তান মুখর হবে নতুন কথা নিয়ে। ওরা বলবে, আমাদের শুনতেই হবে। প্রহরী আর কোটাল ওদের মুখের ভাষা বন্ধ করতে পারবে না। দেশটা আমাদের চেয়ে ওদের বেশি। ওরা অনেকদিন বাঁচবে।
বসন্তের দেরি হয় না। কোনোদিন কোনো বছর সে দেরি করে না। ৩৬ নম্বরের কুসুমের যেমন, টালা পার্ক এভিনিউ-এর ফুটপাথবাসিনী দামিনীরও জীবনে বসন্ত আসতে দেরি করেনি। কিন্তু দামিনীর ক্ষেত্রে তা হয়েছে বিড়ম্বনাময়। বসন্তের ডাকে রাতবিরেতে ধাড়ি শেয়ালে ঘুরঘুর করে ঝুপড়ির ধারে। সে তো বেওয়ারিশ এক বুনো হংসী। নখের ধার আছে বটে, কিন্তু তা দিয়ে আর কত বাঁচাবে নিজেকে। কম্পিউটারের মনিটরে খুনখারাপি রং ছিটকে পড়েছে। তখন সে বসন্ত দিনে শীতের প্রার্থনা করে।
ওই যে গগনবাবু বসে আছেন তিন-রুম ফ্ল্যাটের বড় এক ব্যালকনিতে, একা, সম্পূর্ণ একা এক সত্তুরে ফিক্সড ডিপোজিটের সুদখোর বুড়ো, ছেলে বিলেতে থাকে, মিসেস চলে গেছেন আচমকা, সন্ধের উতলা বাতাস দিয়েছে তাঁরে ঘ্রাণ, বসন্ত এসে গেছে। সেই যে পেয়েছেন তিনি বাতাসে তাহারই ঘ্রাণ, নিজেই ফেসবুকের দরজা খুলে ডেকেছেন সেই কুসুমকে, বসন্ত এসে গেছে। ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডের কুসুম আর ৩৬ নম্বরের অদিতি তো এক নয়। গগন কুণ্ডু আর জীবন মিত্রও তাই এক নয়। মোবাইল থেকে ছবি উগরে দেয় যেমন কুসুম, তেমনি তিনি উগরে দেন ওই ইন্টারনেট থেকে খুঁজে পেতে নিয়ে। কেউ বলে ফাল্গুন কেউ বলে পলাশের মাস… গুনগুন করতে করতে গগন কুণ্ডু নেট সার্চ করে কত ছবি, ফাগুনের আগুন ডাউনলোড করে কুসুমকে উপহার দেন, এই দ্যাখো বসন্ত এসে গেছে। এই গান শুনেছ তুমি কুসুম? কোন গান গো? বনে বনে পাপিয়া বোওলে… কুঞ্জে কুঞ্জে গুঞ্জরে অলি কুসুমে, নীল নলিনী দোলে…। ওয়া, এই গান যে আমাদের উপরের ফ্ল্যাটের গগন দাদাই চালিয়েছিল সেদিন। তুমি জানলে কী করে?
বসন্ত এসে গেছে, তাই জেনেছি গো। বলে গগন বললেন, তোমার একটা ছবি দেবে?
এই বসন্ত নগরের। আর সেই বসন্ত গঞ্জে গঞ্জে, নপাহাড়ি, সাতপাহাড়ি, সাতশো পাহাড়ে সাতশো ফুলের দেশে। সেই গঞ্জ, সেই পাহাড়তলি, সেই প্রান্তর এখন পলাশের আগুনে জ্বলছে দাউ দাউ। এখনো রাতে শীত শীতে ভাব, দিনে মাটি থেকে গরম নিঃশ্বাস উঠছে। সূর্যের উত্তরায়ণ শুরু হয়ে গেছে, পাতা ঝরে গেছে বনে বনে। জঙ্গল অনেক ফাঁকা। এরই ভিতরে ফাল্গুণী পূর্ণিমা এল। দু-পক্ষ বাদে চৈত্র পূর্ণিমা। তখন বসন্ত পুড়ে জ্বলে খাঁক হয়ে যাবে। দূর উজ্জয়িনীতে চৈত্র পূর্ণিমায় কামদেবের পূজা। ফুলদোল ছিল একদিন। এখন নেই। ভার্চুয়াল জগতে তা আছে। যা কিছু মুছে যাবে তা থেকে যাবে অনস্তিত্বের এই আন্তর্জালের পৃথিবীতে।