বলাবাহুল্য
বনফুল জন্মশতবর্ষে বনফুলকে স্মরণ করে এই রম্য কথিকা রচনা করছি।
অবশ্য বলাবাহুল্য নয়, বনফুল লিখেছিলেন ‘বলাই বাহুল্য’। প্রসঙ্গত মনে রাখতে হবে যে বনফুলের নাম ছিল বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়। নিজেকে নিয়ে রসিকতা করার জন্যে যে মানসিক প্রসারতা এবং সরস বোধের প্রয়োজন পড়ে, সেটা বনফুল তথা বলাইচাঁদের ছিল।
‘বলাই বাহুল্য’ গল্পটা বিখ্যাত। সেই জন্যে একদা আমি এই গল্প নিজের মতো করে ঘুরিয়ে এবং ছোট করে লিখেছিলাম। প্রসঙ্গের প্রয়োজনে এবার-ও তাই করছি।
বলাই আর কানাই দুই বন্ধু দুই রকম। বলাই রোগা, বেঁটে, গায়ের রং কালো, তার ওপরে সে গরিব, কাজকর্ম বিশেষ কিছু করে না।
কানাই ঠিক বিপরীত। সুদর্শন, গৌরবর্ণ, লম্বা। সে ধনীর ছেলে। নিজেও ভাল উপার্জন করে।
বলাইয়ের শুধু এক জায়গায় জিত, সে প্রেমে সফল। তার প্রেমিকা শ্রীমতী মানসী রূপবতী, বিদ্যাবতী, গুণবতী।
একদা বলাই তার বন্ধু কানাইয়ের সঙ্গে প্রেমিকা মানসীর পরিচয় করিয়ে দিল।
তারপর?
তারপর আর কী? বলাই বাহুল্য।
শ্রীমান পাঠক, শ্রীমতী পাঠিকা আপনাদের হাতের লেখা, ওই যাকে বলে হস্তাক্ষর খুবই খারাপ, প্রায় আমার মতো? একটা উদাহরণ দিই। একদা এক কাগজে আমার নাম তারাপদ না হয়ে, ‘তাড়াপদ’ হয়েছিল। আমি কিছু বলিনি, কারণ আমি জানি আমার হস্ত লিপিতে ‘র’ এবং ‘ড়’ এই দুই অক্ষরে খুব পার্থক্য হয় না, যেমন হয় না আমার বাঙাল উচ্চারণে।
সে যা হোক, আপনাদের কারও হাতের লেখা যদি আমার মতোই খারাপ হয়, কিংবা তার কাছাকাছি, আমি আপনাকে একটি গূঢ় উপদেশ দিতে পারি।
উপদেশটি হল এই যে নিজের গুরুত্ব বোঝানোর যদি কোথাও কখনও প্রয়োজন বোধ করেন, দম্ভভরে বলবেন, ‘এমন একটা কাজ আছে, যা এই পৃথিবীতে আমি একা করতে পারি আর কেউ পারে না।’
স্বভাবতই শ্রোতারা জিজ্ঞাসা করবেন, ‘কী সেই মহৎ কাজ।’
আপনি বলবেন, ‘আমার নিজের হাতের লেখা পাঠ করা।’
প্রসঙ্গান্তরে যাই।
সেদিন একটা বহুতল বাড়িতে শ্রীযুক্ত নরেশ চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম।
নরেশবাবুকে আমি চিনি না। আমাকে যেতে হয়েছিল সামাজিক প্রয়োজনে, তাঁর পিতৃহীন ভ্রাতুষ্পুত্রের তিনি অভিভাবক। সেই যুবকটি আমার ভাগিনেয়ীর প্রণয়ী এবং পাণিপ্রার্থী।
সামাজিকতার খাতিরে আমি নরেশবাবর সঙ্গে আলাপ-পরিচয় করতে গিয়েছিলাম।
বোধহয় তখন লোডশেডিং বা পাওয়ার কাট ছিল, বহুতল বাড়ির লিফটটি বন্ধ। সিঁড়ির মুখে একটি বালক খেলা করছিল, তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘খোকা, এ বাড়িতে নরেশ চৌধুরীর ফ্ল্যাটটা কোথায়?’
খোকা বলল, ‘আমার সঙ্গে আসুন।’ এই বলে সে তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল। আমার এই বয়েসে দ্রুত সিঁড়ি ভাঙা খুব কষ্টের, হঠাৎ কখনও মারাত্মক হতে পারে, এমনকী মৃত্যু পর্যন্ত। কিন্তু মেয়ের বিয়ে, কী করা যাবে।
হাঁফাতে-হাঁফাতে, ঘামতে-ঘামতে সিঁড়ি বাইতে লাগলাম। ওঠা আর শেষ হয় না। তিনতলা-চারতলা-পাঁচতলা অবশেষে ছয়তলা উঠে খোকা থামল, সিঁড়ির বাঁদিকে এগিয়ে একটা ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়িয়ে আঙুল দেখিয়ে বলল, ‘এই ফ্ল্যাটটা হল চৌধুরী জেঠুর।’
কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে, পকেট থেকে রুমাল বার করে ঘাম মুছে নরেশ চৌধুরীর ফ্ল্যাটের সামনে গিয়ে ডানদিকের দেওয়ালের কলিংবেল টিপলাম।
খোকা পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। সে এসে আমাকে বলল, ‘বেল টিপছেন কেন?’
আমি বললাম, ‘তবে?’
খোকা বলল, ‘দেখছেন না, দরজায় তালা। তার ওপরে লোডশেডিং।’
সত্যিই দরজায় তালা। আমি বললাম, ‘তা হলে?’
খোকা বলল, ‘তা হলে?’
আমি বললাম, ‘আমি যে নরেশ চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম।’
খোকা বলল, ‘আমরা যখন ওপরে উঠলাম, তিনি তো নীচে নামছিলেন, সাদা সাফারি স্যুট দোতালার সিঁড়িতে তাঁকে দেখেননি?’
পুনশ্চঃ
আরম্ভেই আমার রচনায় পাঠক-পাঠিকাদের বাংলা জ্ঞান একটু যাচাই করে নিচ্ছি।
বলুন তো, গলাধাক্কা দেওয়া এবং গলায় গামছা দেওয়ার মধ্যে পার্থক্য কী?
অর্থনৈতিক বিচারে পার্থক্য যথেষ্টই। গলা ধাক্কা দিতে হাতের কবজির জোর লাগে কিন্তু কোনও পয়সা খরচ নেই। গলায় গামছা দিতে গেলে হাতের জোর তো লাগেই, তদুপরি একটা গামছা ক্রয় করতে হয়, যার দাম কম নয়।
তবে আসল পার্থক্য হল এইখানে যে, লোককে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া হয়, আর গলায় গামছা দিয়ে ধরে আনা হয়। এবং তখনই সোনায় সোহাগা হয়, যখন গলায় গামছা দিয়ে টেনে এনে গলাধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দেওয়া হয়।