বলাইবাবু
‘বাঃ, আপনার কুকুরটি কিন্তু ভারি সুন্দর বলাইবাবু।’
‘কুকুর, কোথায় কুকুর!’
‘ওই তো, আপনার পিছনে দাঁড়িয়ে লেজ নাড়ছে।’
‘অ! না মশাই, ওটা আমার কুকুর নয়।’
‘অ! ইস দেখুন তো, আপনার কুকুর মনে করে গতকালও যে ওকে আমি লেড়ো বিস্কুট কিনে খাইয়েছি! বিস্কুটের আজকাল যা দাম হয়েছে, কহতব্য নয়। পয়সাটা কি তবে জলে গেল?’
‘কিন্তু মশাই, আমার কুকুর মনে করে ওকে লেড়ো বিস্কুট খাওয়াতে গেলেন কেন? আমার কুকুরকে লেড়ো বিস্কুট খাওয়ানোয় আপনার লাভ কী?’
‘আছে, ও আপনি বুঝবেন না। সামান্য একটা লেড়ো বিস্কুটই তো! তবে ও কিন্তু গতকালও আপনার পিছু পিছু বাজার অবধি গিয়েছিল। পরশুদিনও। এমনকী তার আগের দিনও।’
‘অবাক কাণ্ড! কুকুরটা রোজ আমার পিছু নেয়, আমি তো তা জানতাম না।’
‘আমার যতদূর মনে হয়, কুকুরটা লোক চেনে। আপনি যে একজন মহান লোক তা কুকুরটা বুঝতে পেরেছে।’
‘আমি মহান লোক! তা মশাই, মহান কথাটার মানে কী দাঁড়াচ্ছে তা বুঝিয়ে বলতে পারেন? জীবনে কখনো কেউ আমাকে মহান বলেনি। শুনে বড়ো অবাক লাগছে।’
‘কী যে বলেন বলাইবাবু। মহান কথাটার জন্মই তো হল আপনার জন্য। ও কথাটা আর কারও গায়ে তেমন ফিট করে না, কিন্তু আপনার গায়ে একদম মাপে মাপে বসে যায়।’
‘বটে!’
‘তা নয়! সবাই জানে আপনার মানুষের জন্য প্রাণ কাঁদে, আপনি দু—হাতে গরিব—দুঃখীকে বিলিয়ে দেন, আপনি মানুষের বিপদ দেখলে ঝাঁপিয়ে পড়েন, নিতান্ত সামান্য মানুষকেও সম্মান দিয়ে কথা বলেন, জীবজন্তুর প্রতি আপনার প্রেম তো সর্বজনবিদিত।’
‘চিন্তায় ফেলে দিলেন মশাই। আমি মানুষকে নিয়ে মোটেই মাথা ঘামাই না। বাড়িতে ভিক্ষুক এলে তাড়িয়ে দেওয়া হয়, কারণ অধিকাংশ ভিক্ষুকই প্রফেশনাল নিষ্কর্মা। মানুষ নিজের দোষে বিপদে পড়ে বলে আমি কারও বিপদ—আপদে বোকার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ি না আর অধিকাংশ মানুষই সম্মান পাওয়ার যোগ্য নয় বলে তাদের আমি পোকামাকড়ের বেশি মনে করি না। আরও একটা কথা, কুকুর বেড়াল ইত্যাদি নানা রোগজীবাণু বহন করে বলে আমি তাদের সযত্নে এড়িয়ে চলি।’
‘আহা বলাইবাবু, এসবও তো বিবেচকের মতোই কাজ। আর তাতে আপনার মহান হতে আটকাচ্ছে কীসে?’
‘তাতেও আটকাচ্ছে না! তাজ্জব করলেন মশাই!’
‘আজ্ঞে, দু—চারটে গুণ বাদ গেলেও ক্ষতি নেই। গান্ধীজি কি ফুটবল খেলতে পারতেন?’
‘বোধ হয় না। কিন্তু হঠাৎ একথা কেন?’
‘আচ্ছা, বিদ্যাসাগরমশাই কি গান জানতেন?’
‘জানি না তো!’
‘রবিঠাকুর কি ক্যালকুলাস জানতেন?’
‘না জানাই সম্ভব।’
‘তা বলে কি তাঁরা মহান নন?’
‘তা বটে। তাহলে আপনি আমাকে মহান বানিয়েই ছাড়বেন।’
‘আজ্ঞে না! আমি বলতে চাইছিলাম যে, আপনি মহান হয়েই জন্মেছেন। তা আপনি যতই নিজেকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করুন। আর এটাও আপনার নিশ্চয়ই জানা আছে যে, নিজেকে তুচ্ছ জ্ঞান করা মহানদেরই লক্ষণ।’
‘আমি মশাই, নিজেকে মোটেই তুচ্ছ জ্ঞান করি না। আমি বিলক্ষণ জানি যে, আমি একটি বড়ো কোম্পানির ম্যানেজিং ডাইরেক্টর, সেজন্য আমার যথেষ্ট অহংকারও আছে।’
‘বলাইবাবু, ওই অহংকারও আপনাকে মানায়।’
‘আচ্ছা মশাই, আপনি তো গায়ে পড়ে অনেক কথা বলছেন। কিন্তু আপনাকে তো আমি চিনি না! আপনি কে বলুন তো!’
‘কী যে বলেন, আমাকে চিনতে যাবেন কোন দুঃখে? উঁচু সার্কেলের লোকদের কাছে দেওয়ার মতো পরিচয় তো নয়।’
‘সে তো আপনার হাড়হাভাতে চেহারা আর পোশাক দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তবু নামধাম জেনে রাখা ভালো।’
‘নাম হল ধর্মদাস ঘোষ।’
‘কী করা হয়—টয়?’
‘ওই সামান্য একটু ডাক্তারি করে থাকি। হোমিয়োপ্যাথি।’
‘তা মন্দ কী? হোমিয়োপ্যাথদের তো আজকাল বেশ পসার শুনেছি।’
‘তা আজ্ঞে কিছু কিছু মানুষ ভাগ্য নিয়ে জন্মায়। তারা যাতে হাত দেয় তাতেই সোনা ফলে। তবে কিনা হোমিয়োপ্যাথিতে আমি তেমন সুবিধে করে উঠতে পারিনি। তাই ওর সঙ্গে একটু জ্যোতিষচর্চাও করে থাকি।’
‘ওরে বাবা, আপনি জ্যোতিষীও?’
‘ওই যে বললাম, কপাল ভালো থাকলে সবকিছুতেই হাতযশ হয়। কিন্তু আমার জ্যোতিষবিদ্যারও তেমন কদর হয়নি।’
‘এবার বলুন তো ধর্মদাসবাবু, আজ গায়ে পড়ে এই খেজুর করার উদ্দেশ্যটা কী?’
‘আজ্ঞে, গত কয়েকদিন ধরেই আপনাকে আমি ফলো করছি।’
‘ফলো করছেন! আশ্চর্য ব্যাপার! ফলো করছেন কেন?’
‘আজ্ঞে পদাঙ্ক অনুসরণও বলতে পারেন। ভাবলাম কৃতবিদ্য লোক আপনি, বিশাল ডিগ্রি, বিশাল চাকরি, বিশাল নামডাক, তা আপনার হাওয়া—বাতাস গায়ে লাগলেও উপকার আছে। তাই রোজই, আপনি যখন আর পাঁচজনের মতো বাজার করতে বেরোন, তখন আমি আপনার পিছু নিই।’
‘কারও পিছু নেওয়া যে অভদ্রতা সেটা নিশ্চয়ই জানেন!’
‘যে আজ্ঞে।’
‘এরজন্য আপনাকে আমি পুলিশে দিতে পারি তা জানেন?’
‘পারেন বই কী। মানগণ্য লোক আপনি, পুলিশকে ডাকলে তারা ধেয়ে আসবে। উটকো লোক আমি, কী উদ্দেশ্যে ফলো করছি এটাও তো ভাববার কথা।’
‘যাকগে, আমি পুলিশ ডাকছি না। আপনিও আর ফলো করবেন না।’
‘আজ্ঞে। তবে কিনা ওই কুকুরটাও কিন্তু রোজই আপনাকে ফলো করে।’
‘কুকুরটা কেন ফলো করে তা আমি জানি না, তবে তার উদ্দেশ্য ততটা সন্দেহজনক না—ও হতে পারে।’
‘যে আজ্ঞে। আপনি বিবেচক মানুষ।’
‘আপনার কি আর কিছু বলার আছে?’
‘তেমন কিছু নয়। না বললেও চলে। আপনার হাতে হয়তো এত সময়ও নেই। ব্যস্ত মানুষ আপনি, বাজার করে এসে চাট্টি খেয়েই হয়তো অফিসে রওনা হবেন। আজ অবশ্য শনিবার, আপনার ছুটি। তা হলেও হয়তো বিকেলের ফ্লাইটে সিঙ্গাপুর বা লন্ডন যাওয়ার আছে, কিংবা নিদেন দিল্লি—টিল্লি।’
‘সিঙ্গাপুর। খবর—টবর রাখেন দেখছি।’
‘কী যে বলেন! হোমরাচোমরা মানুষরা যা করেন তাই খবর। এমনকী হেমন্ত আগরওয়ালের সঙ্গে পার্টিতে একটু আবডাল হয়ে কথা বললেও খবর, কিংবা দুবাইয়ের নটবরলালের সঙ্গে চোখাচোখি হলেও খবর।’
‘অ্যাঁ! কী কী বললেন?’
‘আজ্ঞে, ও কিছু নয়। বড্ড বেশি কথা বলে ফেলি বলে আমার গিন্নিও আমাকে প্রায়ই বকাঝকা করেন। আমাদের কথার দামই বা কী বলুন।’
‘দাঁড়ান, দাঁড়ান, বেশি কথা বলেন বটে, কিন্তু হেমন্ত আগরওয়াল বা নটবরলালের নাম তো আপনার জানার কথা নয়!’
‘বলেন কী বলাইবাবু! এ নামে কি সত্যিকারের কেউ আছে নাকি? আমি তো জিভের ডগায় যা এল বলে ফেললাম।’
‘না মশাই না! ব্যাপারটা এখন আমার কাছে অতটা সোজা মনে হচ্ছে না! ধর্মদাসবাবু একটু ঝেড়ে কাশুন তো!’
‘এই দ্যাখো ফ্যাসাদ। কী বলতে কী বলে ফেলেছি, আপনি হয়তো আমার ওপর অসন্তুষ্ট হলেন। বড়ো মানুষরা রেগে গেলে যে আমাদের মতো চুনোপুঁটিদের ঘোর বিপদ!’
‘ধর্মদাসবাবু, ব্যাপারটা একটু সিরিয়াস কিন্তু।’
‘না না বলাইবাবু, আমি আসলে আপনার ভালোর জন্যই বলতে এসেছিলাম যে, আপনি একজন গণ্যমান্য লোক, আপনার কোনো আসোয়াস্তির কারণ ঘটুক এটা আমি চাই না।’
‘অসোয়াস্তিটা কীসের?’
‘এই যে ওই কুকুরটা আর আমি আপনাকে রোজ ফলো করি, কিন্তু আপনি তা টের পান না এটা যেমন অসোয়াস্তি তেমনি এই আমাদের মতো আরও জনা দুই আপনার পিছু নেয় রোজ। একজন ওই যে পানের দোকানে দাঁড়িয়ে পান খাচ্ছে, মোটা মতো, ধুতি আর শার্ট পরা। আর একজন ওই যে, দেওয়ালে পোস্টার পড়ছে, লম্বা রোগামতো!’
‘আশ্চর্য! ওরা আমাকে রোজ ফলো করে, ঠিক জানেন?’
‘আজ্ঞে। তবে হয়তো ওরা চাকরির উমেদার, কিংবা টেন্ডার দিতে চায়, কিংবা হয়তো কোনো ধান্দা আছে। কিংবা এও হতে পারে ওদের কোনো উদ্দেশ্যই নেই।’
‘না মশাই, ভাবিয়ে তুললেন।’
‘আপনাদের তো এমনিতেই ভাবনাচিন্তার অবধি নেই। সর্বদাই নানারকম সমস্যার মোকাবিলা করছেন। বড়ো কোম্পানি হলে যা হয় আর কী। তাই আমি ভাবলাম, বলাইবাবুর মতো একজন মহান মানুষকে সবদিক দিয়ে রক্ষা করাই আমাদের কর্তব্য। বিশেষ করে এখন হয়তো আপনি ত্রিশ—বত্রিশ কোটি টাকার একটা ডিল নিয়ে ভারি ভাবনায় আছেন, হয়তো বড়ো বড়ো নানা ইনভেস্টমেন্ট নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন, হয়তো দু—তিনটে শত্রু কোম্পানি আপনাকে নানাভাবে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করছে। সবসময়ে যাকে এতসব সমস্যা নিয়ে ভাবতে হয় তার কী এইসব ছোটোখাটো ব্যাপারে নজর থাকে!’
‘দাঁড়ান মশাই, দাঁড়ান। ত্রিশ—বত্রিশ কোটি টাকার ডিলের কথা আপনি জানলেন কী করে, এবং আর যা যা বললেন সেগুলোও তো খুব একটা আন্দাজে ঢিল ছোড়া নয়। ধর্মদাসবাবু, আপনি আসলে কে বলুন তো?’
‘আজ্ঞে আমি একজন হোমিয়োপ্যাথ এবং জ্যোতিষী, বলিনি আপনাকে?’
‘বলেছেন, কিন্তু সেটা বিশ্বাসযোগ্য নয়।’
‘আমাকে বিশ্বাস করা উচিতও নয়। আমি প্রয়োজনে এবং অপ্রয়োজনেও মিথ্যে কথা বলে থাকি। তবে কিনা মিথ্যে কথার ফাঁকে ফাঁকে দু—চারটে সত্যি কথাও ঢুকে যায়। চালে কাঁকরের মতোই আর কী! যেগুলো বেছে বের করা মুশকিল।’
‘আপনি কী চান স্পষ্ট করে বলবেন?’
‘ওরে বাপ রে! আপনার কাছে চাইবার মতো মুখ বা যোগ্যতা কোনোটাই কি আমার আছে? জানি, আপনি এক মহান মানুষ। চাইলেই দিয়ে ফেলবেন। কিন্তু দেখুন, চাওয়ার জন্যও বুকের পাটা লাগে। আমাদের মতো নগণ্য মানুষের তো ওটারই অভাব কিনা।’
‘নগণ্য কিনা জানি না, তবে আপনি অতি বিপজ্জনক লোক।’