বর ও নফর

বর ও নফর

গণশা বলিল, “আমার ক-ক-কপালে পরের শ্বশুরবাড়ি গিয়ে সুখ লেখা নেই। সেবাবে কালসিটেয় তিলুর বরযাত্রী হয়ে গিয়ে ওই হল; পরশু মাসির বাড়ি গেছলাম। মা-মাসি ডেকে ডেকে তেইশজনকে পেরনাম করালে, তিনজন ফাউ, সেখানে অত গুরুজন আছে জানলে ওদিক মাড়াতাম না। কো-ক্কোমরের ফিক-ব্যথাটা এয়সা আউড়ে উঠেছে—”

ত্রিলোচন প্রশ্ন করিল, “ফাউ মানে?”

“তি-ত্তিনটে তাদের মধ্যে দাসী ছিল, মানে, ঘাড় তুলে দেখবার তো আর ফুরসুত ছিল না।”

কে. গুপ্ত বলিল, “ভিড় জিনিসটা ফুটবলের মাঠেই ভালো মশাই। গাড়িতে বলুন, শ্বশুরবাড়ি কুটুমবাড়িতে বলুন—”

গোরাচাঁদ বলিল, “নেমন্তন্নয় বল, বড্ড অসুবিধেয় পড়তে হয়।”

রাজেন জিজ্ঞাসা করিল, “তোর নিজের বিয়ের কি হল র‍্যা গণশা? মামা বলে কি?”

গণশার মুখটা অদ্ভুত ভাবে বিকৃত হইয়া পড়িল। একটু পরে সংক্ষেপে বলিল, “কুষ্টির মিল হয় তো গু-গু-গুষ্টির মিল হয় না, ওরা বলে এক, মামারা বলে আর। বিয়ের কথা হচ্ছে, কিন্তু ব-উয়ের কথা চাপা পড়ে গেছে।”

ঘোঁৎনা বলিল, “আসলে ওর মামারা ঠাউরেছে, এর মধ্যে একটা চাকরি-বাকরি হয়ে গেলে দাঁও মারবে। গ্যাঞ্জেস মিলে তো সেদিন গিছলি, কি বললে?”

গোরাচাঁদ বলিল, “ভিড়ের কথা যদি বললি তো আমার শ্বশুরবাড়ি ভালো। বউ, শাশুড়ি, খুড়শাশুড়ি, একটি শালী, শালা আর শালাজ; পিসেমশাই বলে ডাকবে, তার জন্যে শালাজের একটি ছেলেও দিয়েছেন ভগবান, মানে যে কটি দরকার, ঠিক সাজানো, ফালতু ভিড় পাবে না। বাজে মার্কার মধ্যে এক শ্বশুর, তা সে বেচারী সন্ধ্যের পর আফিম খেয়ে পড়ে থাকে, নিশ্চিন্দি।”

কিছুক্ষণ চুপচাপ গেল, বোধ হয় সবাই মনে মনে গোরাচাঁদের কথাগুলি রোমন্থন করিতে লাগিল। একটু পরে গোরাচাঁদ আবার বলিল, “শিগগির একবার যেতে লিখেছে শাশুড়ি, অনেকদিন দেখে নি কিনা!”

রাজেন প্রশ্ন করিল, “কবে যাচ্ছিস?”

“বাবা বলছে, এটা মলমাস; কটা দিন যাক, তারপর।”

গণশা বলিল, “বে-বেটাছেলের আবার মলমাস! তুই তো আর স্বামীর ঘর করতে যাচ্ছিস না।”

রাজেন শিস দেওয়া আরম্ভ করিয়াছিল, থামাইয়া বলিল, “আমি তো বুঝি শ্বশুরবাড়ি যাব, ঠিক যখন কেউ ভাববে না যে জামাই আসছে। তা হলেই তো যার জন্যে যাওয়া, তাকে ঠিক স্বাভাবিক অবস্থায় দেখতে পাব। বলা নেই, কওয়া নেই, হুট করে গিয়ে পড়লাম, বউ বোধ হয় তখন গা ধুয়ে উঠে কালো চুলে রাঙা গামছা জড়িয়ে জল নিংড়োচ্ছে—”

গণশা বলিল, “ঘুম থেকে উঠে কক্কড়াইমুড়ি চিবোতেও তো পারে, নয়ত মুখ ভেংচে ঝগড়া করছে কারও সঙ্গে—”

গোরাচাঁদ রাজেনের মতো কবি না হইলেও রাজেনের কথাটা তাহার মনে লাগিল। নূতন বিবাহ তো! একটু চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, “কিন্তু তাতে খাওয়াদাওয়ার একটু অসুবিধে হয়, যোগাড়যন্তর কিছু থাকে না কিনা, আর আমার শ্বশুরবাড়ি একটু আবার পাড়াগাঁ-গোছেরও।”

ত্রিলোচনের নববিবাহের রসচেতনায় একটু আঘাত লাগিল। বিরক্তভাবে বলিল, “তোর শুধু খ্যাটের চিন্তা গোরা। বিয়ে না দিয়ে কাকা যদি তোর একটা হোটেলে ওয়েটারের চাকুরি করে দিত তো—”

গোরাচাঁদ বলিল,–”গণশা, কি বলিস, যাব একবার কাউকে কিচ্ছু না জানিয়ে?”

গণশা অন্যমনস্ক হইয়া কি যেন ভাবিতেছিল, বলিল, “চ-চ্চল্ না।”

সকলেই একজোটে বলিয়া উঠিল, “চল্ না মানে?”

গণশা উত্তর করিল, “আম্মো তা হলে একবার দেখে আসি গোরার শ্বশুরবাড়ি।”

গোরাচাঁদ একেবারে উৎফুল্ল হইয়া উঠিল, গণশার হাতটা চাপিয়া ধরিয়া বলিল, “চল মাইরি; আমার বন্ধু জানলে তারা—”

গণশা বলিল, “হ্যাঁ, তোর বন্ধু হয়ে গিয়ে বাইরের চালের বাতা গুনি আর তোর আফিমখোর শ্বশুরের বক্তার শুনি!”

রাজেন প্রশ্ন করিল, “তবে?”

“ভাবছি, চা-চ্চাকর সেজে গেলে কেমন হয়!

ত্রিলোচন একটু অন্যমনস্ক ছিল; বোধ হয় বিনা খবরে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার কথাটা লইয়া মনে মনে আলোচনা করিতেছিল। আর সবাই উল্লসিত ভাবে বলিয়া উঠিল, “গ্র্যান্ড হয়, উঃ!”

ঘোঁৎনা বলিল, “যাবি যে, গোরার বাড়িতে কি বলবে? দুদিন থাকবে তো? তুই বা কি বলবি?”

রাজেন বলিল, “গোরা বলবে, আমাদের কারুর জন্যে মেয়ে দেখতে গেছল কোথাও। তোর শালীর বয়েস কত র‍্যা গোরা?”

কে. গুপ্ত বলিল, “আরে গণেশবাবুর বললেই হবে, চাকরি খুঁজছিলেন।”

গণশা বিরক্ত হইয়া বলিল, “চা-চ্চাকরি কি হারানো গাই-গরু মশাই যে, তিন দিন ধরে, দিন নেই রাত নেই, খুঁজতে থাকব? বলে দিলেই হবে একটা কিছু, মা-ম্মাদের তো ঘুম হচ্ছে না গণশার ভাবনায়!”

.

সঙ্গে চাকর যাইতেছে, গোরাচাঁদের মনে একটা মস্ত লোভের উদ্রেক হইয়াছিল, সন্ধ্যা-বাজারের নিকট পৌঁছিয়া সেটাকে আর চাপিয়া রাখিতে পারিল না; বলিল, “যখন দুজনেই যাচ্ছি গণশা, কিছু গলদাচিংড়ি, দার্জিলিঙের কপি, কড়াইশুঁটি আর নৈনিতাল আলু নিয়ে গেলে হত না? আর কিছু মিষ্টি? মানে তোর খাবার কষ্ট না হয়, একটু পাড়াগাঁ- গোছের জায়গা কিনা! আমরা পৌঁছবও সেই যার নাম আটটা, রাত হয়ে যাবে।”

গণশা বলিল, “কিন্তু গাড়ির আর মোটে আধ ঘণ্টাটাক দেরি।”

যাহা হউক, বাজারটা একেবারে হাতের কাছে, কেনাই ঠিক হইল। আন্দাজের একটু বেশি সময়ই লাগিল। গোরাচাঁদ তরকারির ঝুড়িটা লইল, গণশা খাবারের হাঁড়িটা। তারপর ক্ষিপ্রতার জন্য গণশা যে বাসটায় উঠিয়া বসিল, কতকটা ক্ষিপ্রতার অভাবে ও কতকটা ঝুড়িটার জন্যও গোরাচাঁদ সেটা ধরিতে পারিল না। দুইটি স্টপ পার হইয়া যাওয়ার পর গণশা সেটা টের পাইল। ফিরিয়া আসিতে, গোরাচাদকে খুঁজিয়া বাহির করিতে এবং গায়ের ঝাল মিটাইতে আরও খানিকটা সময় গেল। স্টেশনে আসিয়া প্রায় হাঁপাইতে হাঁপাইতে প্ল্যাটফর্মে ঢুকিয়া গণশা জিজ্ঞাসা করিল, “ডা-ড্ডানদিগেরটা, না, বাঁদিগেরটা র‍্যা গোরে?”

পাশাপাশি দুইটা গাড়ি দাঁড়াইয়া। ঢুকিবার সময় প্ল্যাটফর্মের নম্বর দেখিতে ভুলিয়া গিয়াছে; সন্দেহ আছে বুঝিলে গণশা আবার পাছে ক্ষিপ্ত হইয়া উঠে, সেই ভয়ে গোরাচাঁদ পরিণাম চিন্তা না করিয়াই বলিল, “বাঁদিগেরটা।”

গাড়িতে ভিড় ছিল একটু। একেবারে ভিতরের দিকে এক কোণে গিয়া দুইজনে একটু জায়গা পাইল। গোরাচাঁদ চুপড়িটা উঠাইয়া বাঙ্কের এক কোণে রাখিল; গণশার হাত হইতে হাঁড়িটা লইয়া চুপড়ির মধ্যে বসাইয়া দিল।

কয়দিন বৃষ্টি হয় নাই, বেশ গরম পড়িয়াছে; দৌড়াদৌড়ি, তাহার উপর ভিড়। গণশা ঠেলিয়া-ঠুলিয়া আসিয়া প্ল্যাটফর্মের উপর পায়চারি করিতে লাগিল। একটি বৃদ্ধযাত্রী বলিল, “ফাষ্টো বেল হয়ে গিয়েছে হে বাপু!”

গণশা দোরটার কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। বৃদ্ধ প্রশ্ন করিল, “যাওয়া হবে কনে?”

“সিঙ্গুর।”

“সিঙ্গুর! সে তো বাবা তারকেশ্বরের লাইনে। এ গাড়ি তো নয়, ওই সামনেরটা। এ গাড়িতো পশ্চিম যাবে।”

গণশা কতকটা অবিশ্বাসে, কতকটা উদ্বেগে বলিল, “কে বললে?”

দ্বিতীয় ঘণ্টা পড়িল।

বৃদ্ধ বোধ হয় একটু রগ-চটা। বলিল, “কেউ বলে নি; তুমি উঠে এস। ওতে যাবে না, শেষে এটাও হাতছাড়া করবে! গাঁটের পয়সা দিয়ে যখন টিকিট কিনেছ, উঠে পড়।”

হুইসল্ দিয়া গাড়ি স্টার্ট দিল। গণশা চিৎকার করিয়া বলিল, “গোরা শি-শি-শিগগির নেমে পড়, বলছে—”

গোরাচাঁদের খটকা লাগিয়াছিল একটু “কে বলছে? কে বলছে র‍্যা?—বলিতে বলিতে হন্তদন্ত হইয়া লোকদের পা মাড়াইয়া মোট ডিঙাইয়া আসিয়া কোনোমতে নামিয়া পড়িল। গণশা চোখ রাঙাইয়া বলিল, “ত-ত্তবে যে তুই বললি বাঁদিগেরটা?”

গোরাচাঁদ চলন্ত গাড়িটার দিকে চাহিয়া বলিল, – “যাঃ, চুপড়িটা গেল ছেড়ে— হাঁড়িসুদ্ধু! হায় হায়!”

একটু অগ্রসর হইতে হইতে বলিল, “মশাই, চুপড়িটা ফেলে দিন না এদিকে, ওই বাঙ্কে রয়েছে—উত্তর দিকে, মানে পূর্ব দিকের উত্তুর, মানে উত্তুর কোণটায় আর কি—–”

গণশা দাঁতমুখ খিঁচাইয়া বলিল, “ছো-ছোট্, দৌড়ো দিল্লি পর্যন্ত ওই বলতে বলতে!”

পাশের গাড়ির প্রথম বেলটা পড়িল। একজন রেল-কর্মচারি একটু দূরে দাঁড়াইয়া ছিল; গণশা জিজ্ঞাসা করিল, “এটা তারকেশ্বর লাইনের গাড়ি তো স্যার?”

“হ্যাঁ, শিগগির উঠে পড় গিয়ে।”

ভুলের সমস্ত সম্ভাবনা এড়াইবার জন্য গোরাচাঁদ প্রশ্ন করিল—”যে তারকেশ্বরের লাইনে সিঙ্গুর আছে?”

গণশাও উত্তরটা শুনিবার জন্য ঘাড় বাঁকাইয়া দাঁড়াইয়া ছিল, একটা ধমক খাইয়া দুইজনে তাড়াতাড়ি গিয়া গাড়িতে উঠিল। গণশা প্ল্যাটফর্মের দিকের বেঞ্চটায় বসিয়াছিল; গোরাচাঁদ পকেট হইতে মানিব্যাগ বাহির করিতে করিতে বলিল, “গলা বাড়িয়ে দেখ তো গণশা, খাবারের ভেন্ডারটা আছে কাছে-পিঠে? বেশ খানিকটা ছুটোছুটি হয়রানি হল কিনা!”

দ্বিতায় ঘণ্টা পড়িল, হুইসল্ দিয়া গাড়ি ছাড়িয়া দিল।

গোরাচাঁদ ব্যাগটা যথাস্থানে রাখিয়া দিল। একটি দীর্ঘশ্বাস মোচন করিয়া বলিল, “সে চুপড়িটা এতক্ষণ বোধ হয় লিলুয়া পেরিয়ে গেল হাঁড়িসুদ্ধু! কেনা পর্যন্ত খালি দৌড়োদৌড়ি, একটাও যে মুখে ফেলে দোব, এমন ফুরসৎ হল না।”

যাহা হউক, গাড়িটার গতিবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দুইজনেরই মনমরা ভাবটা কাটিয়া গেল। গণশা চাকরের মুখে মানায় এইরকম ভাব ও ভাষার একটা গান ধরিল, “পরাণ যদি লিলেই রে প্রাণ–” সেটা জমিয়া উঠিতে দুই-একজন উঠিয়া যাওয়ায় কোলের কাছে যখন একটু জায়গা খালি হইল, গোরাচাঁদ গিয়া সেইখানটিতে বসিল। প্রথমে গুনগুন করিয়া গানে একটু যোগ দিল, কিন্তু গণশার তোলামির জন্য কোরাসে অসুবিধা হওয়ায় গাড়ির বাহিরে হাত বাড়াইয়া শুধু তবলা বাজাইতে লাগিল।

গাড়ি রিষড়ায় আসিয়া দাঁড়াইলে একদল বরযাত্রী নামিল। খানিকটা উল্লসিত চেঁচামেচি; এসেন্সের, জুইয়ের গোড়ের গন্ধ; চেলি-পরা, কপালে চন্দনের ফুটকি দেওয়া বর। গণশার গানটা মৃদু হইতে হইতে থামিয়া গেল। গাড়ি ছাড়িয়া খানিকটা গেলে বলিল, “হ্যাঁ, হঠাৎ মনে পড়ে গেল, তোর শা-শা-শালীর বয়েস কত র‍্যা গোরা? মানে যদি বিয়ের যুগ্যি হয় তো শিবপুরে পাত্তোর-টাত্তোর দেখি; একটা ভদ্দলোকের উদ্‌গার করতে পারা মস্ত ভাগ্যি কিনা!”

গোরাচাঁদ বলিল, “বউয়ের ষোল যাচ্ছে, এ কার্তিকে সতেরোতে পড়বে; শালী হল দু বছর তিন মাসের ছোট, তা হলে—”

গণশা হিসাবের গোলমালের দিকে না গিয়া বলিল, “বিটুইন তেরো অ্যান্ড চোদ্দো! হেল্থ কেমন?”

“বউয়ের চেয়ে ভালোই বলতে হবে। বউটা ম্যালেরিয়ার বড় ভুগলো কিনা, একেবারেই হাড্ডিসার হয়ে গিয়েছিল; ধন্যি বলতে হবে পান্নালাল ডাক্তারকে, যাকে বলে মরা মানুষ চাঙ্গা করে—”

গণশা প্রশ্ন করিল, “দে-দ্দেখতে কেমন?”

গোরাচাঁদ একটু লজ্জিতভাবে ধমক দিয়া বলিল, “যাঃ! আহা, উনি যেন দেখেন নি! তবে যে বললি সেদিন, গোরা, তিলুর বউয়ের চেয়ে তোর বউয়ের রঙটা—”

গণশা আর বিরক্তি চাপিতে পারিল না, “তোর শালীর কথা জিজ্ঞেস করছি, না স্রেফ বউ বউ করে সেই থেকে—”

গোরাচাঁদ অপ্রতিভ হইয়া বলিল, “তাই বল্! আমি এদিকে ভেবে সারা হচ্ছি, গণেশ জেনে-শুনেও ও-কথা জিজ্ঞেস করছে কেন! শালী হচ্ছে যাকে বলে—হ্যাঁ, সুন্দরী!”

“লেখাপড়া কেমন? ক-কথা হচ্ছে, কেউ জিজ্ঞেস করলে আবার খুঁটিয়ে বলতে হবে কিনা। নইলে বলবে, খুব খোঁজ রাখেন তো মশাই! আবার সম্বন্ধ করতে এসেছেন!”

“ছাই লেখাপড়া, ওর চেয়ে বউ অনেক পড়েছে; কিন্তু মুখের কাছে দাঁড়াও দিকিন শালীর!”

গণশা হাসিয়া বলিল, “সত্যি নাকি?” মৃদু হাস্যের সঙ্গে মাথা দুলাইয়া কি চিন্তা করিল খানিকটা, তাহার পরে ধীরে ধীরে ত্রিলোচনের বিয়ের সেই হিন্দি গানটা ধরিল, “মুহা পঙ্কজ সোঙরি সোঙরি—”

শেওড়াফুলিতে পৌঁছিতে গোরাচাঁদ বলিল, “তোর ক্ষিদে পায় নি গণশা? সে চুপড়িটা বোধ হয় এতক্ষণ চন্দননগরে—তোর কি আন্দাজ হয়?”

গণশা বলিল, “ক্ষিদের চেয়ে তেষ্টা পেয়েছে বেশি; একটা লেমনেড হলে হত।”

গোরাচাঁদ বলিল, “তুই তবে তাই খা, ওই ভেন্ডারটা আসছে, আমি দেখি নেমে, যদি খাবার-টাবার পাওয়া যায় কিছু।”

গণশা ধমক দিয়া উঠিল, “গ-গ-গর্দভ কোত্থাকার! আর একটুখানি সহ্যি করে থাকবে, তা নয়, পথে যা-তা খেয়ে পেট ভরাচ্ছে!”

কথাটা গোরাচাঁদের খুব সমীচীন বলিয়া বোধ হইল। প্রকাশ করিয়া বলিলও, “ঠিক বলেছিস গণশা, পাড়াগাঁয়ের রাত হলেও জামাই মানুষ পৌঁছেছে, যতদূর সাধ্য করবেই তারা, একটা মস্ত আহ্লাদের কথা তো! কিছু নাহলেও পুকুরের মাছ আর গরুর দুধটা তো আছেই। আমিও তাহলে একটা লেমনেড খাই এখন; ক্ষিদেটা জলে চাপা রইল। তাতে কোনো ক্ষতি হবে না, কি বলিস?”

লেমনেড ছিল না, দুইজনে দুইটা সোডাই পান করিল। গণশা একটা ঢেকুর তুলিয়া বলিল, “চা-চ্চাপা কি! ক্ষিদেয় একেবারে শান দেওয়া রইল। মাছ যদি তেমন ওঠে তো একবার কালিয়া রেঁধে দেখাই গোরে। পাড়াগাঁয়ে কিন্তু আবার চাকরের রান্না খাবে না যে!”

গোরাচাঁদ উল্লসিত হইয়া বলিল, “রান্নাঘরের দোরগোড়ায় বসে তুই বাতলে দে না কেন শালাজকে, সে-ই রাঁধে কিনা। এক ঢিলে দু-পাখি মারা হবে, গল্পও করতে থাকবি, আবার শালী, বউ সবাই থাকবে। তারা ভাববে, জামাইবাবুর চাকর, ওটার কাছে আবার লজ্জা! চাকরবাবু যে এদিকে শিবপুরের ডাকসাইটে গণেশরাম—”

দুইজনেই সজোরে হাসিয়া উঠিল।

সিঙ্গুরের আর দেরি নাই। গাড়ির এদিকটায় তাহারা মাত্র দুইজনে বসিয়া। গণশা উঠিয়া জামাকাপড় ছাড়িয়া একটা ময়লা ধুতি ও একটা ঘুণ্টিদেওয়া ফরসা পিরান পরিল; মাথার তেরিটা মুছিয়া ফেলিয়া কানে একটা বিড়ি গুঁজিয়া দিল। জামাকাপড় এবং ক্যাম্বিসের জুতা-জোড়াটা গোরাচাঁদের ছোট সুটকেসটায় গুছাইয়া ফেলিল; তাহার পর হঠাৎ চোখ দুইটা ট্যারা করিয়া লইয়া গোরাচাঁদের দিকে চাহিয়া ডাকিয়া উঠিল, “দাঠাউর!”

দুইজনে আবার একচোট হাসিয়া উঠিল।

.

রাত প্রায় সাড়ে আটটার সময় গাড়ি সিঙ্গুরে পৌঁছিল।

গল্প করিতে করিতে স্টেশনের বাহির হইয়া দুইজনে চলিতে আরম্ভ করিল। বউয়ের কথা, শালী-শালাজের কথা, খাওয়ার কথা যখন বেশ জমিয়া উঠিয়াছে, গোরাচাঁদ বলিল, “হ্যাঁ, আসল কথাটাই ভুলে যাচ্ছি যে! এদিকে এসেও পড়েছি অনেকটা; তোকে কি বলে ডাকব র‍্যা শ্বশুরবাড়িতে? মানে, বউটা আবার তোর নাম জানে কিনা।”

হঠাৎ থমকিয়া সভয়ে চারিদিক চাহিয়া বলিল, “এ কোথায় এলাম র‍্যা গণশা, এ যে অনেক ভদ্দরলোকের বাড়ি!”

গণশা বিস্মিতভাবে দাঁড়াইয়া রহিল, তারপর ব্যঙ্গের স্বরে প্রশ্ন করিল, “তুই কি বা- ব্বাগ্দী-পাড়া কেওরাপাড়ায় শ্বশুর-বাড়ি খুঁজছিলি?”

বেশ অন্ধকার। গোরাচাঁদ দৃষ্টি প্রসারিত করিয়া চারিদিকে দেখিতে দেখিতে বলিল, “সে কথা নয়, মানে শ্বশুর-বাড়িটা এক টেরেয় কিনা, নিজ সিঙ্গুর ছাড়িয়ে খানিকটা ভেতরের দিকে। বাড়িঘর, কি দোকানপাট তো নেই সেদিকে, চল্ আবার ইস্টিশানে, গল্প করতে করতে এক্কেবারে উল্টো রাস্তায় এসে পড়েছি; এদিকটা তো আমার জ্ঞাতি পিসশ্বশুরের বাড়ি।”

“না হয় পিসশ্বশুরের বাড়িই রাতটা কাটাবি চল না, সকালে তখন—”

গোরাচাঁদ শিহরিয়া উঠিল; বলিল, “ওরে বাব্বা! তারা তো চায়ই তাই। টের পেলে রাস্তা থেকে টেনে নিয়ে গিয়ে রাতারাতি কাজ সাফাই করে লাস গুম করে ফেলবে। জমি নিয়ে শ্বশুরের সঙ্গে ভয়ঙ্কর খুনে মকদ্দমা চলছে কিনা! ওরা তো চায়ই, কেউ একবার আসুক এদিক বাগে, জামাই পেলে তো লুফে নেবে!”

গণশা তাড়াতাড়ি তাহাকে টানিয়া লইয়া ফিরিল। খুবই চটিয়া গিয়াছিল, কিন্তু স্টেশনে না পৌঁছানো পর্যন্ত কিছু বলিল না। স্টেশনের কাছে আসিয়া খুব একচোট গালিগালাজ করিল গোরাচাঁদকে। আবার ঠিক রাস্তা ধরিয়া দুইজনে যাইতে আরম্ভ করিল। চলিতে চলিতে দুই-তিন জায়গায় খবর লইয়া যখন বুঝিল যে, ঠিক রাস্তাতেই যাইতেছে, তখন মনের রাগটা এবং পিসশ্বশুরের আতঙ্কটা অল্পে অল্পে কাটিয়া গেল। বুঝিল, কাছে আসিয়া পড়িয়াছে, গণশার মনটা প্রফুল্ল হইয়া উঠিল, কথাবার্তাও সরস হইয়া আসিল। সাহস পাইয়া গোরাচাঁদ বলিল, “তুই তো ওই সব বলে ঠাট্টা করছিস শুধু, আমার এদিকে নাড়ী জ্বলে গেল ক্ষিদেয়, ভুল রাস্তার পাল্লায় পড়ে রাতও হয়ে গেল বড্ড।”

“না-ন্নাড়ী কি আমারই জ্বলছে না? দেখছি, কালিয়াটা আর হবে না রাত্তিরে। যদি বড় মিরগেল ওঠে তো ভেজেই দিক আপাতত; লুচি তো করবেই—স্রেফ মিরগেল মাছের পেটি ভাজা আর লুচি।”

গোরাচাঁদ মুখে রস জমিয়া উঠায় একটা ঝোলটানা-গোছের শব্দ করিয়া বলিল, “দুটোই বড় শুকনো হয়ে গেল; তা রাতটা কাটুক ওই ভাবেই, সকালে তখন দেখা যাবে। বউকে বরং বলব, দুধটাকে নটক্ষিরে করে—; হাতে একটা আধলা ইট তুলে নে তো গণশা, এসে গেছি, আমি এই বাঁশের আগালেটা বাগিয়ে ধরছি।”

গণশা দাঁড়াইয়া পড়িয়া বিস্মিতভাবে প্রশ্ন করিল, “কেন র‍্যা, আবার কি?”

“কুকুরটা বড় রোখা। রাত্তিরে কেউ এলে ধরে নেয়, চোর কিংবা পিসশ্বশুরের বাড়ির কেউ; দাঙ্গার পর থেকে ওদের ওপর বড় চটা কিনা! ওই, ডাকতে আরম্ভ করেছে! তুই যে থান-ইট তুলে নিয়েছিস, একেবারে থেঁতো হয়ে যাবে যে! আয়, বাঘা বাঘা, চ্যু চ্যু—আমি রে তোদের জামাইবাবু। আচ্ছা, বাড়ি একেবারে নিষুতি কেন বল তো গণশা?”

“ঘুমিয়েছে নিশ্চয়, রাত দশটা হয়ে গেল।”

গোরাচাঁদ বলিল, “ঘুমুলে কুকুরটার এরকম ডাকেও ঘুম ভাঙবে না?”

দুইজনে কুকুরটাকে আটকাইতে বাহিরের উঠানে গিয়া উপস্থিত হইল। তখন একজন ভিতর-বারান্দা হইতে জড়িত কণ্ঠে প্রশ্ন করিল, “কে? কে র‍্যা বাঘা?”

গোরাচাঁদ বলিল, “আমি শিবপুর থেকে আসছি।”

সেই রকম নিদ্রালু স্বরে প্রশ্ন হইল, “কি দরকার রাতদুপুরে?”

এরূপ অপ্রত্যাশিত প্রশ্নের উত্তর গোরাচাঁদের মুখে টপ করিয়া যোগাইল না। গণশা বলিল, “না দ-দরকার তেমন কিছু নেই, তবে ইনি—তোমায় গিয়ে দা-দ্দাদাঠাউর এ-বাড়ির জামাই।”

গোরাচাঁদ ফিসফিস করিয়া বলিল, “বাড়িটা ঠিক তো? ‘জামাই’ আবার গালাগাল কিনা?”

ওদিকে আর কোনো সাড়া নাই। লোকটা ঘুমাইয়া পড়িয়াছে নিশ্চয়, ঘুমের মধ্য হইতেই প্রশ্ন করিয়াছিল। দুইজনে কুকুরটাকে কখনও তাড়না, কখনও খোশামোদ করিতে করিতে বারান্দার খেলা রকে উঠিয়া গেল। গোরাচাঁদ লোকটাকে লক্ষ্য করিয়া একটু চড়া গলায় বলিল, “জামাই মানে, শিবপুরের জামাই গোরাচাঁদ আমি; সঙ্গে এ গণ—, আমার চাকর।”

গণশা কানের কাছে মুখ লইয়া বলিল, “দু-দ্দুখীরাম।”

“আমার চাকর দুখীরাম। তুমি কে কথা কইলে?”

সেই নিদ্রালু স্বর একটু ধমকের সুরে প্রশ্ন করিল, “বলি, তুমি কে?”

গোরাচাঁদ হতাশ হইয়া গণশার দিকে চাহিয়া বলিল, “বললাম তো একচোট সব খুলে! কি গেরো বল তো!”

একটু থামিয়া গলা আর একটু চড়াইয়া বলিল, “বাঘা, এখনও চিনতে পারছিস না জামাইবাবুকে—সেই লুচি খেতিস হাত থেকে?”

গণশা বলিল, “পিসশ্বশুরের বাড়ির লোক নয় রে বাঘু।”

এবার ঘরের ভিতর হইতে ভারি গলায় প্রশ্ন হইল, “বাইরে কে ব্যাড়র ব্যাড়র করছে? কাঁচা ঘুমটা ভাঙিয়ে দিলে!”

গোরাচাঁদ গণশাকে বলিল, “শ্বশুরের আওয়াজ। আফিমের ঘুম কিনা, ঠিক ধরতে পারছে না।”

চেঁচাইয়া বলিল, “বাবা আমি আপনাদের গোরাচাঁদ, শিবপুর থেকে আসছি।”

“কে বাবাজী? এস বাবা, এস এস। নিধে! এই ব্যাটা হারামজাদা, পড়লে আর হুঁশ থাকে না! রকে জামাই দাঁড়িয়ে যে!”

তাড়া খাইয়া নিধিরাম ধীরে ধীরে উঠিয়া পড়িল। বাঁ হাতে কালি-পড়া লণ্ঠনটা লইয়া দুয়ার খুলিল, তাহার পর আলোটা তুলিয়া ধরিয়া চোখ পিটপিট করিতে করিতে টানা জড়িত স্বরে কহিল, “তাই তো, জামাইবাবু যে! এস এস, আস্তেজ্ঞে হোক, পেন্নাম হই। তা বলা নেই, কওয়া নেই—যেন গিয়ে বিনি মেঘে বজ্রাঘাত, বাঃ, কি সৌভাগ্য! ওটি কে?”

গণশা বলিল, “আমি দাঠাউরের নফর নিধুদা; গড় করি।”

.

তিনজনে ঘরে আসিল। গোরাচাঁদ শ্বশুরকে প্রণাম করিয়া সামনের একটা পায়া মচকানো চেয়ারে, প্রতি মুহূর্তেই পড়িয়া যাইবার আশঙ্কায় সতর্ক হইয়া বসিয়া রহিল। গণশাও খুব ভক্তিভরে পায়ের ধূলা লইয়া নীচে উবু হইয়া বসিল। নিধু ঘরের এক কোণে গিয়া তামাক সাজিতে লাগিল।

শ্বশুর খানিকটা নিঝুম হইয়া বসিয়া রহিলেন। অস্বস্তি বোধ হওয়ায় গোরাচাঁদ প্রশ্ন করিল, “আপনি-আপনারা কেমন আছেন?”

কোনো উত্তর হইল না।

গণশা ইশারায় তাগাদা করিল, হাতের কাছে অন্য কোনো প্রশ্ন না পাওয়ায় গোরাচাঁদ জিজ্ঞাসা করিল, “এবার এদিকে—এবারে এদিকে বৃষ্টি কেমন হল?”

নড়নচড়ন পর্যন্ত নাই। গণশা আবার প্রশ্ন করিতে তাগাদা করিল গোরাচাঁদ ভীতভাবে হাত নাড়িয়া ফিসফিস করিয়া বলিল, “চটে যায়।”

আবার খানিকক্ষণ নিঝুম। একটা ঝোঁক কাটিয়া গেলে শ্বশুর হঠাৎ মাথা তুলিয়া বলিলেন, “হুঁ, গোরাচাঁদ এসেছ, না?”

গোরাচাঁদ ব্যাকুলভাবে একবার গণশার দিকে চাহিয়া উত্তর করিল, “আজ্ঞে হ্যাঁ।”

“তাই তো!”

আবার খানিকটা চুপচাপ, শুধু গোরাচাঁদের চেয়ার সামলানোর ক্যাচ কোঁচ শব্দ হইল দুই-তিনবার।

নিধিরাম তামাক সাজিয়া দিয়া এক পাশে বসিল।

হুঁকায় কয়েকটা টান দিয়া গোরাচাঁদের শ্বশুর একটু চাঙ্গা হইলেন। বলিলেন, “তখন থেকে চুপ করে তাই ভাবছি। হ্যাঁরে, নিধে, বাড়ির সবাই বিয়েবাড়ি নেমন্তন্ন গিয়ে বসে রইল, জামাই খাবেন কি?”

নিধিরাম কলিকাটির দিকে অর্ধমুদ্রিত সতৃষ্ণ নয়নে চাহিয়া ছিল, নিশ্চিন্ত কণ্ঠে বলিল, “সেই কথাই তো ভাবছি।”

গোরাচাঁদের মুখ ফ্যাকাশে হইয়া গেল। গণশা একটু চাপা, তবু তাহার দিকে চাহিয়া দেখিল, সেও হতভম্ব হইয়া গিয়াছে। দুইজনে পরস্পরের মুখের দিকে চাহিয়া শ্বশুর কি স্থির করেন, সেই প্রত্যাশায় একটু চুপ করিয়া রহিল। আরও খানিকক্ষণ তামাক টানিয়া নিধিরামের দিকে হুঁকাটা বাড়াইয়া শ্বশুর বলিলেন, “ভাবিয়ে তুললে যে! উপোস করে থাকবেন?”

নিধিরাম কলিকাটা পাক দিয়া হুঁকা হইতে খুলিতে খুলিতে বলিল, “রামঃ, সে কি হয়?”

“উপায়?”

“উপায়!”—পরম ভক্তিভরে কলিকাটা মাথায় ঠেকাইয়া বলিল, “বাবা আছেন।”

বাবা—এ প্রান্তে তারকেশ্বরের সাধারণ নাম।

গণশা গোরাচাঁদের পানে ঠোঁটটা কুঞ্চিত করিয়া মাথা নাড়িল, অর্থাৎ আর কোনো আশা নাই।

“আমি বলি।”—বলিয়া গোরাচাঁদ কি বলিতে যাইতেছিল, নিধিরাম হাসিয়া বলিল, “তুমি যা বলবে বুঝতেই পারছি দাদাঠাকুর, খবর দিয়ে আসতে পার নি বলে, আর খুব রাত হয়ে গেছে বলে পথে শেওড়াফুলিতে খেয়ে এসেছ, এই তো? শুনছেন জামাইবাবুর কথা কৰ্তা?”

নেশাটা চটিয়া যাইতেছে, জামাইয়ের হাঙ্গামা না মিটাইলে অব্যাহতি নাই; বৃদ্ধ মিটিমিটি করিয়া হাসিয়া বলিল, “দ্যুৎ! সেই তুই আমি করতাম বলে কি ও ছেলেমানুষরাও করবে? না, সেটা উচিত হত?”

অর্থাৎ সেইটাই উচিত হইত, এবং যদি না হইয়া থাকে তো কাণ্ডজ্ঞানহীন ছেলেমানুষ বলিয়াই হয় নাই।

গণশা গোরাচাঁদ বিমূঢ়ভাবে পরস্পরের মুখ-চাওয়াচাওয়ি করিল। গোরাচাঁদ কি উত্তর দিতে যাইতেছিল; পেটুক মানুষ পাছে বেমানান কিছু বলিয়া বসে–সেই ভয়ে গণশা তাড়াতাড়ি বলিয়া দিল, “আজ্ঞে, বললে বিশ্বাস যাবেন না, দাঠাউর সত্যি খেয়ে এয়েছেন।” গোরাচাঁদ গণশার দিকে কটমট করিয়া চাহিয়া মরীয়া হইয়া আবার কি একটা বলিতে যাইতেছিল, কপালদোষে হঠাৎ একটা ঢেকুর বাহির হইল। তবু যথাসম্ভব সামলাইয়া লইয়া বলিল, “আজ্ঞে হ্যাঁ, একটা সোডা–”

গণশা তাহার দিকে একটা ভ্রুকুটি করিয়া মুখ ঘুরাইয়া লইয়া বলিল, “খাবেন না সোডা? তি-ত্তিন গণ্ডা রসগোল্লা, পোয়াটাক কচুরি-সিঙাড়া মিলিয়ে পো-খানেক মিহিদানা খেলেন, শেষে আমি বললাম—”

গোরাচাঁদ হতাশভাবে চাহিয়া ছিল, তাহার মুখের উপর সতর্ক দৃষ্টি রাখিয়া গণশা বলিল, “শেষে আমি বললাম, দাঠাউর, একটা সোডা খেয়ে নাও; তাঁরা তো সেখানে খাবার জন্যে জেদাজেদি করবেনই—”

নিধিরাম বলিল, “করব না জেদাজেদি? ঘরের জামাই এলেন, বাঃ!”

গণশা ক্রমাগত চোখ টেপানি দিতেছে। আর কোন আশা নাই দেখিয়া গোরাচাঁদ নিরুৎসাহ কণ্ঠে যতটা সম্ভব জোর দিয়া বলিল, “দুখীরামের কথা শুনে আমি বললাম, হাজার জিদ করলেও আমি আর খেতে পারব না। শেষকালে কি মারা যাব?”—বলিয়া চেষ্টা করিয়া আর একটু ঢেকুর তুলিল।

শ্বশুর নিধিরামের নিকট হইতে কলিকাটা লইয়া বলিলেন, “আমার কিন্তু বাপু বিশ্বাস হচ্ছে না যে, জামাই পথেই খেয়ে এসেছেন। নিধে কি বলিস?”

হাঙ্গামা-পোহানোর ভয়ে নিধিরাম অনেকটা সামলাইয়া আনিয়াছে, আবার কাঁচিয়া যায় দেখিয়া তাড়াতাড়ি বলিল, “অবিশ্বাসের তো হেতু দেখছি না, কর্তামশাই; নোতুন জামাই মিছে কথা বলবেন কি? তায় আপনার মতো দেবতুল্যি শ্বশুর।

“তাই তো!”—বলিয়া বৃদ্ধ আরও খানিকটা চিন্তা করিলেন, তাহার পর উৎসাহভরে বলিয়া উঠিলেন, “আমি বলি কি নিধে, জামাইকে না হয় নেমন্তন্নবাড়ি নিয়ে যা না কেন, ততক্ষণ আমাতে আরএটির নাম কি?”

গোরাচাঁদ উৎসাহভরে বলিল, “ক্ষুদিরাম।”

“আমাতে আর ক্ষুদিরামে বসে বসে গল্প করি না হয়। বেয়াই বেহান-ঠাকরুন আছেন কেমন ক্ষুদিরাম?”

“বেশ আছেন।”—বলিয়া গণশা তাড়াতাড়ি বলিল, “আজ্ঞে আমি তো জা-জ্জান থাকতে দাঠাউরকে একলা ছেড়ে দিতে পারব না। এই সাপ-খোপের দেশ! কর্তাবাবু বললেন, দুখীরাম, ম-ম্মলমাস, ছেলেটা একলা যাচ্ছে, সর্বদা সঙ্গে সঙ্গে থাকবি, খ-খ- খবরদার!”

গোরাচাঁদ হাসিবার চেষ্টা করিয়া বলিল, “নিধু, খুব বিচক্ষণ লোক গণ—দুখীরাম, ও আবার ঝাড়ফুঁকও জানে। তোর কোনো ভাবনা নেই; নিশ্চিন্দি হয়ে বাবার সঙ্গে গল্প কর, আমি একটু হয়ে আসি। কথা হচ্ছে, ক্ষিদে তো এক্কেবারেই নেই, কিন্তু শাশুড়ি-ঠাকরুনকে দেখবার জন্যে প্রাণটা কেমন আইঢাই করছে; অনেকদিন পায়ের ধুলো নিই নি কিনা!”

গণশা ভিতরে ভিতরে জ্বলিয়া খাক হইতেছিল, গোরাচাঁদের দিকে একটা উগ্র কটাক্ষ হানিয়া সংযতভাবে কহিল, “বি-ব্বিনি পায়ের ধুলোয় যখন চারটে মাস কাটালে চোখকান বুজে, ত্যাখন আর একটা কি দুটো ঘণ্টা কোনোরকমে কাটাও না দাঠাউর, মা-ঠাকরুনও এক্ষুনি নেমন্তন্ন খেয়ে ফিরবেন ছিচরণ সঙ্গে নিয়ে।”

শ্বশুর মাথা নাড়িয়া বলিলেন, “সে আজ সমস্ত রাত আসবে না, তারা কেউ না; সম্পর্কে আমার নাতনীর বিয়ে কিনা, গিন্নি বাসর জাগবে, ও কি! ধর ধর।”

শেষ আশা একটু ছিল, শাশুড়ির,–সেটুকুও যাওয়ায়, গভীর নিরাশায় শরীরটা হঠাৎ শিথিল হইয়া পড়ায় গোরাচাঁদের ভাঙা চেয়ার হইতে আছাড় খাওয়ার দাখিল হইয়াছিল; গণশা আর নিধিরাম ধরিয়া ফেলিল।

শ্বশুর বলিলেন, “আহা ঘুম ধরেছে।’

নিধিরাম বলিল, “চাপ খাওয়া হয়েছে কিনা!”

শ্বশুর উঠিয়া বলিলেন, “তবে বাবাজী, চল দুর্গা শ্রীহরি বলে শুয়েই পড়বে চল। ক্ষিদে যখন নেই-ই বলছ, শুধু প্রণাম করবার জন্যে কোশটাক পথ ভাঙার মাঝরাত্রে কি দরকার? ওঠ তা হলে। দুখীরামকে না হয় গোটাকয়েক খইচুর এনে দোব!”

গণশা উত্তর দেওয়ার আগে গোরাচাঁদ প্রতিহিংসাবশে বলিল, “না না, খাওয়ার ওপর খেয়ে একটা কাণ্ড করে বসবে শেষে; ওর ভরসায়ই বাবা আমায় পাঠিয়েছেন মলমাস অগ্রাহ্যি করে।”

গণশার পানে না চাহিয়া শ্বশুরের পিছনে পিছনে ভিতরে চলিয়া গেল।

প্রায় ঘণ্টা দেড়েক আরও কাটিল। গোরাচাঁদ ভিতর-বাড়িতে ক্ষুধার জ্বালায় এবং খাদ্য সম্বন্ধে হতাশায়, বিছানাতে পড়িয়া এপাশ-ওপাশ করিতেছিল, এমন সময় ঘরের দুয়ারের কাছে গণশা ডাকিল, “দাঠাউর!”

গোরাচাঁদ উত্তর দিতে যাইতেছিল, নিধিরামের গলার আওয়াজ শুনিল, “ঘুমে এলিয়ে পড়েছেন আর তুলে কাজ নেই। তুমি তাহলে এই দোরগোড়াটায় শুয়ে থাক দুখীরাম ভাই, আমি যাই কর্তার কাছে; এই শতরঞ্জি রইল।”

নিধিরাম চলিয়া গেলে গণশা ভিতর বাড়ির কপাট বন্ধ করিয়া যখন ফিরিয়া আসিল, গোরাচাঁদ ধীরে ধীরে ডাকিল, “গণশা!”

“জেগে আছিস?”—বলিয়া গণশা দুয়ার ঠেলিয়া ভিতরে ঢুকিল।

গোরাচাঁদ চিঁ চিঁ করিয়া বলিল, “ঘুমুতে পারছি না ভাই, আর সাহসও হচ্ছে না— এইসা ক্ষিদে গণশা! মনে হচ্ছে, ঘুমুলে আর ওঠা হবে না, জামাইকে ওদের সকালে টেনে বের করতে হবে।”

গণশা মশার কামড়ে চুলকাইতে চুলকাইতে বলিল, “চাকর সেজে এলে আবার মশারি দেবে না, মনে ছিল না রে—উঃ! তার ওপর দু ব্যাটা আপিমখোরের বক্তার! নেশা চটে গেছে কিনা।”

গোরাচাঁদ বলিল, “তাও যেমন ভগবান দয়া করে ভুল গাড়ি চড়িয়ে দিয়েছিলেন, যদি রেখে দিতেন—। পেটটা খালি থাকলে পুড়ে যাওয়ার মতো জ্বালা করে রে! জানতাম না। নিধেটা কি ধড়িবাজ দেখেছিস?”

“দুটোই। খিদেয় মরছি, অথচ কেমন বলিয়ে নিলে, খেয়ে এসেছি! এইসা কোণঠাসা করে এনেছিল যে, না-না বললে, আর মান থাকত না।”

খানিকটা চুপচাপ গেল। তাহার পর গণশা মাথাটা মশারির মধ্যে গলাইয়া দিয়া পূর্বের চেয়েও চাপা গলায় বলিল, “গোরে, এক মতলব বের করেছি। ভাবছি, রাজী হবি কি না, তোর আবার শ্বশুরবাড়ি কিনা।”

গণশার মতলব বাহির করায় কত বড় বড় সমস্যার সমাধান হয়। গোরাচাঁদ পরম আগ্রহে বলিয়া উঠিল, “কি মতলব রে গণশা?”

“বুড়ো সেই খইচুরের কথা বলছিল—”

“দিয়েছে নাকি? বলিয়া গোরাচাঁদ মশারি জড়াইয়া এক রকম পড়-পড় হইয়া নামিয়া গণশার সামনে দাঁড়াইল।

গণশা বলিল, “দেয় নি, ত-ত্তবে বাড়িতেই তো আছে।”

গোরাচাঁদ গণশার দিকে একটু বিমূঢ়ভাবে চাহিয়া থাকিয়া একেবারে গলা নামাইয়া বলিল, “চুরি?”

গণশা উপরে নীচে মাথা নাড়িল।

গোরাচাঁদ ঝোল-টানার শব্দ করিয়া বলিল—”জামাই হয়ে—তাই বলছিলাম; কিন্তু কেই বা দেখছে! আর এসা চমৎকার খইচুর এখানকার গণশা, সন্দেশ, রসগোল্লা ফেলে—”

“ভাঁড়ার ঘর কোনটে জানিস?”

গোরাচাঁদ আবার ভাঁড়ার-ঘর চিনিবে না—তাও শ্বশুরবাড়ির! বলিল, “উঠোনের ওদিকে রান্নাঘরের পাশে—হ্যাঁ রে গণশা, আমার একটা-আধটায় হবে না; কমে গেলে ওরা সব টের পেয়ে যাবে না তো, যে জামাই রাত্তিরে উঠে এই কাণ্ডটি—”

“গা-গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল? আগে চল নিয়ে, যদি তালা দেওয়া থাকে তো আবার—”

গোরাচাঁদের বুকটা যেন ধসিয়া গেল; ভীত নিরাশ দৃষ্টিতে বলিল—”তা হলে?”

“চল না, ইডিয়ট!”—বলিয়া গণশা তাহাকে একটা ঠেলা দিল। বালিশের তলা হইতে দেশলাইটা লইল।

প্রদীপ লইয়া সন্তর্পণে অগ্রসর হইতে হইতে গোরাচাঁদ বলিয়া উঠিল, “তোরই মতলবের ওপর আমার এক মতলব এসে গেল গণশা, রান্নাঘরটাও অমনই আগে একবার দেখে নিলে হয় না? কপাল যেমন, তাতে যে কিছু পাব—তবু ধর, যদি ও-বেলায় ভাজা মাছটা-আসটা—”

গণশা বলিল—”হ্যাঁ, চল। কখনও কখনও জল দিয়ে পান্তা করেও রাখে মেয়েরা, খুব তোয়াজ বোঝে কিনা, নেমন্তন্ন খেয়ে শরীরটা গরম হবে।”

উঠান পার হইয়া রকে উঠিয়া গোরাচাঁদ উৎফুল্লভাবে বলিল, “তালা দেওয়া নেই রে গণশা, ভগবান বোধ হয় এবার মুখ তুলে চাইলেন।”

ভগবান সত্যিই মুখ তুলিয়া চাহিয়াছেন। রান্নাঘরে প্রবেশ করিতেই দুইজনে দেখিল, সামনে একটা শিকায় টাঙানো একটা বড় সাইজের হাঁড়ি, তার উপর একটা জামবাটি, তাহার উপর একটা কড়া; পাশে আর একটা শিকায় একটা পিতলের কড়া।

একটা বিড়াল উনানের পাশে বসিয়া ছিল, ইহাদের দেখিয়া লাফাইয়া জানালায় উঠিয়া বসিল।

গোরাচাঁদ তাড়াতাড়ি গিয়া পিতলের কড়াটায় আঙুল ডুবাইয়া উল্লাসে চোখ দুইটা বড় করিয়া বলিল, “দুধ রে গণশা—মিল্ক!”

গণশা বলিল, “নামা।”

চঞ্চল হাতে নামাইতে গিয়া একটু সরসুদ্ধ দুধ চলকাইয়া গোরাচাঁদের কপালের উপরটায় পড়িয়া গেল। বাঁ হাতে সরটি মুছিয়া মুখে দিয়া গোরাচাঁদ বলিল, “বেশ মোটা সর রে! দুটা বাটি যদি পাওয়া যেত!”

গণশা বলিল, “আগে হাঁড়ির শিকেটা দেখে নে। এই রে, তোর কপালে কড়ার কালি লেগে গেল যে!”

সৌন্দর্যের দিকে গোরাচাঁদের খেয়াল ছিল না। “ঠিক বলেছিস, দুধটা শেষ পাতের জিনিস কিনা!”—বলিয়া কপালটা ডানহাতে মুছিয়া অন্য শিকাটার দিক অগ্রসর হইল।

গণশা বলিল, “আমি ধরছি শিকেটা, তুই একটা একটা করে পাড়। আবার জামায় হাতটা মুছলি বুঝি? এঃ ভূত হয়ে গেলি যে!”

গণশা শিকার একটা দড়ি ধরিল; গোরাচাঁদ উপরের কড়াটায় আঙুল ডুবাইয়া বলিল, “ঝোল, গণশা!” আঙুলগুলা চালাইয়া উত্তেজিত ভাবে বলিল, “মাছের ঝোল।”

আর তর সহিতেছিল না, গোটাকতক মাছ বাহির করিয়া মুখে ফেলিয়া আনন্দের চোটে গণশার হাতটা ধরিয়া ফেলিল, “পুঁটিমাছের টক মাইরি!”

গণশার উঁচু-করা মুখে জল আসিয়াছিল, একটা ঢোক গিলিয়া বলিল, “তা হলে হাঁড়িতে নির্ঘাত পান্তা আছে; জামবাটিটা দেখ তো! আমার হাত ধরতে গেলি কেন? দেখ তো, আমায়ও বাঁদর বানিয়ে ছাড়লি!”

জানালার উপর বিড়ালটা ডাকিল, মিউ।

গোরাচাঁদ বলিল, “তাড়া তো বেটীকে। ভাগীদার জুটেছেন!”

গণশা বলিল, “না না, আমি মতলব ঠাউরেছি, যাবার সময় সব ফেলে-ছড়িয়ে বেড়ালটাকে ঘরে বন্ধ করে যাব!”

“তোর এত মাথায় খেলে মাইরি!”—বলিয়া গোরাচাঁদ সপ্রশংস দৃষ্টিতে বন্ধুর পানে চাহিল, তাহার পর বলিল, “ঠিক করে ধরিস, আমার হাতটা কাঁপছে।”

কড়াটা বাঁ হাতে একটু তুলিয়া জামবাটির মধ্যে হাত দিতে যাইবে, এমন সময় বাহিরের রকের এ কোণটায় বাঘা উৎকট স্বরে ঝাউঝাঁউ করিয়া ডাকিয়া উঠিল। একে আচমকা, তায় চোরের মন, দুইজনেই একসঙ্গে চমকিয়া উঠিল এবং তাহাদের হস্তধৃত দড়ি ও কড়াটা কাঁপিয়া গিয়া কড়াটা বাঁকিয়া প্রায় অর্ধেকটা অম্বলের মাছ আর ঝোল হড়হড় করিয়া গোরাচাঁদের মাথার উপর পড়িল। গণশা একটা লাফ দিয়া পেছনে সরিয়া গেল, কিন্তু তবু যে নিতান্ত বাদ গেল, এমন নয়!

সঙ্গে সঙ্গে বাহিরের দরজার নিকট হইতে আওয়াজ আসিল, “বাঘা আমরা সব; থাম।”

ঝোলে-বোজা চোখে কোনোরকমে পিটপিট করিয়া চাহিয়া গোরাচাঁদ দেখিল, গণশা চোখ দুইটা বড় করিয়া তাহার দিকে চাহিয়া আছে; অতিমাত্র ভীত চাপা স্বরে বলিল, “আমার সম্বন্ধী—শিবুদা।”

গণশা জিজ্ঞাসা করিল, “উপায়?”

আওয়াজ অগ্রসর হইতে লাগিল—বিয়েবাড়ির চর্চা। সবাই রকে উঠিল। শিবু বাহিরের দুয়ারের কড়া নাড়িয়া ডাকিল, “বাবা, ও বাবা! নিধে! দুজনেই নিঃসাড়! এই নিধে!”

কর্তার গলারই উত্তর হইল, “এলি তোরা? জামাই এসেছেন।”

দুয়ার খোলার শব্দ হইল। প্রবেশ করিতে করিতে শিবু প্রশ্ন করিল, “আমাদের গোরাচাদ! কখন এল?”

গণশা ফিসফিস করিয়া ডাকিল, “গোরে!”

গোরাচাঁদ কাঠ হইয়া গিয়াছে; একবার নিজের অম্লসিক্ত শরীরটা দেখিয়া বিহুলভাবে গণশার পানে চাহিয়া রহিল।

ভিতর-বাড়ির দুয়ারে করাঘাত হইল। গোরাচাঁদ জিজ্ঞাসা করিল, “কি করবি বল তো গণশা? কাপড়-জামাটা ছেড়ে—”

গণশা বলিল, “পাগল! সময়ই বা কোথায়? আর সুটকেসটাও বাইরে।”

ঘন ঘন করাঘাতের সঙ্গে তাগাদা হইল, “গোরাচাঁদ, দোর খোল হে। জামাইবাবু!” গণশা অতিমাত্র চঞ্চল হইয়া বলিল, “পালাতে হবে গোরে, খিড়কিটা কোন্ দিকে বল তো!”

এত বিপদেও গোরাচাঁদের এ সম্ভাবনাটা মনে হয় নাই; চরম বিস্ময়ের সহিত বলিল, “পা-লা-তে হবে? শ্বশুরবাড়ি যে! আর সত্যিই তো, তা না হলে—”  

বাইরে শোনা গেল, “নিধে, তুই ওদিক থেকে একটু হাঁক দে তো! শালা যেন কুম্ভকর্ণ! আর চাকরটাই বা কি রকম! দোর খোল হে।”

জোর কড়া-নাড়ার শব্দ হইল, কপাটে দুই-একটা লাথির ঘা পড়িল।

এমনসময় যেখানটা কুকুর ডাকিয়া উঠিয়াছিল, সেখানটায় নিধিরামের শঙ্কিত কণ্ঠ শোনা গেল, “দাদাবাবু, রান্নাঘরে আলো দেখছি যে! মা-ঠাকরুণ জ্বেলে রেখে গিয়েছিলেন নাকি?”

“কই না! হে বাবা তারকেশ্বর!”–মেয়ে গলায় কাঁপা আওয়াজ হইল।

খানিকক্ষণ একেবারে চুপচাপ। শিবু নিধিরামের কাছে আসিয়া বলিল, “সত্যিই তো! আর দু—”

গোরাচাঁদ এক ফুৎকারে আলোটা নিবাইয়া দিল। গণশা খুব চাপা গলায় বলিল, “কি করলি গাধা?”

“নিবিয়ে দিলে! চোর! চোর! বাবা, জেনেশুনে চোর ঢোকালে বাড়িতে! নিধে!”

“দেখলাম, জামাই—সেই রকম মুখ-চোখ কথাবার্তা, দিব্যি প্রণাম করলে—”

“তবে আর কি! প্রণাম করলে: শিগগির খিড়কি আগলাগে নিধে; নিশে বাগদীকে হাঁক দে। ও রতনের মা! ও সামন্ত, সামন্ত!”

একটু দূরে বনের মধ্যে হইতে আওয়াজ আসিল, “এজ্ঞে!”

“শিগগির এস সড়কিটা হাতে করে, দু শালা ঢুকেছে।”

“এলাম। সটকায় না যেন, একসঙ্গে গাঁথব। রতনের মা, তোর সেই কাটারিটা নিয়ে বেরো!”

গণশা আর গোরাচাঁদ ঘর ছাড়িয়া উঠানের মাঝামাঝি জড়সড় হইয়া দাঁড়াইয়া ছিল, গোরাচাঁদ একসঙ্গে গাঁথার কথায় একটু সরিয়া দাঁড়াইল।

আওয়াজ হইল, “নিধে!”

“আমি এই খিড়কিতে, বাঘাকে নিয়ে!”

গণশা চারিদিকে চাহিয়া নিরাশভাবে বলিল, “কি করা যায়?”

তাহার পর হঠাৎ গোরাচাঁদের পায়ের নিকট হইতে একটা আধলা ইট কুড়াইয়া লইয়া বলিল, “হয়েছে, চল খিড়কির দিকে; তুইও পিঁড়েটা তুলে নে।”

গোরাচাঁদ শঙ্কিত ভাবে বলিল, “খুন করে পালাবি নাকি নিধেকে?”

গণশা বলিল, “আর বাঘাকে। নয়তো কি খু-খু-খুন হব সামন্তর সড়কিতে? কোনটে খিড়কি? এগো।”

কি হইত বলা যায় না, কিন্তু এই সময় কুকুরটা হঠাৎ নিধিরামের নিকট হইতে ঊর্ধ্বশ্বাসে কি একটা তাড়া করিয়া রান্নাঘরের পিছনে গেল এবং সেখান থাবা গাড়িয়া বসিয়া উঁচু মুখে প্রবল শোরগোল লাগাইয়া দিল।

শিবু একটু লক্ষ্য করিয়া বলিল, “আবার রান্নাঘরে ঢুকেছে; সবাই এই দিকটা চলে এস, এখনও আছে শালারা। নিধে, আয় দিকিন, সামন্ততে আর তোতে পাঁচিল ডিঙিয়ে ওদিকে পড়। বাঘা, ঠিক চোখে চোখে রাখবি ওই ভাবে।”

বাঘা রাখিতেও ছিল, কালো বিড়ালের মতো শত্রু আর তাহার নাই। বাঘাহীন খিড়কিতে নিধিরামের পা থরথর করিয়া কাঁপিতেছিল, সে তাড়াতাড়ি সরিয়া আসিয়া সবিক্রমে বলিল, “হ্যাঁ, ওঠ তো সামন্ত খুড়ো; দাও, সড়কিটা ধরে থাকি ততক্ষণ। ‘

গণশা ও গোরাচাঁদ গিয়া খিড়কি ঘেঁষিয়া দাঁড়াইয়া ছিল। যেই বুঝিল নিধিরাম সরিয়া গিয়াছে, দোর খুলিয়া আস্তে আস্তে বাহির হইল। গণশা খুব সন্তর্পণে শিকটা তুলিয়া দিল। খুব অন্ধকার, ঝোপঝাপ। গোরাচাঁদ অগ্রসর হইল। হাতটা পিছনে করিয়া গণশার জামা ধরিয়া খুব চাপা গলায় বলিল, “আয়, একটু ঘুরে গিয়ে সদর রাস্তা। বাঘা সরে নি, ওরা বাড়ি নিয়েই থাকবে একটু।”

এত বিপদেও বাড়িটার দিকে চাহিয়া তাহার একটা দীর্ঘশ্বাস পড়িল। বলিল, “একটা রাতও কাটল না; বউ ওদিকে নেমন্তন্ন খেয়ে এসেছে—”

গণশা কালসিটের ব্যাপারটা স্মরণ করিয়ে শুধু একবার প্রশ্ন করিল, “সামনে পানাপুকুরটুকুর নেই তো?”

.

শিবপুরে স্টীমার-জেটির রেলিঙে হেলান দিয়া মুখোমুখি হইয়া দাঁড়াইয়া রাজেন, ত্রিলোচন, কে. গুপ্ত, গণশা আর গোরাচাঁদ। রাজেন প্রশ্ন করিল, “তারপর গোরের শ্বশুরবাড়ি কেমন লাগল গণশা?”

ত্রিলোচন প্রশ্ন করিল, “এক রাত্তির থেকেই চলে এলি যে বড়?’

গোরাচাঁদের মনটা অবসন্নই ছিল, একটু ব্যঙ্গের সুরে উত্তর করিল, “শ্বশুরবাড়ি এক রাত্তিরের বেশি থাকলে মান থাকে নাকি?”

ত্রিলোচন বলিল, “সে কথা নয়, মানে—দিলে যে বড় আসতে?”

গণশা কুটা না কি একটা দাঁতে কাটিতেছিল; গঙ্গার দিকে চাহিয়া বলিল, “আসতে কি দি-দ্দিতে চায়? অনেক ক-কষ্টে–”

আর শেষ করিতে পারিল না। কথাটা বাড়ি ঘেরাও করিয়া আটকানো, খিড়কি দিয়া পলায়নের সঙ্গে এমন মিলিয়া গেল যে, আপনিই যেন তাহার গলার স্বর মাঝপথে বাধিয়া গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *