বর্ষায়

বর্ষায় 

সন্ধ্যার পূর্ব হইতেই বৃষ্টি নামিয়াছে, আড্ডা জমিল না। তিন জনে ছাড়া-ছাড়া ভাবে সময় কাটাইতেছিল—তারাপদ তাস ঘাঁটিতেছে, রাধানাথ সিনেমার বিজ্ঞাপন দেখিতেছে, শৈলেন হাত দুইটাকে বালিশ করিয়া চিত হইয়া শুইয়া গুনগুন করিতেছে। 

তারাপদ বলিল, তোমার মাথার কাছের জানালা দিয়ে বৃষ্টির ছাঁট আসছে, শৈলেন।

শৈলেন বলিল, আসুক, বেশ লাগছে; সুবিধে আমার যখন সম্পূর্ণভাবে নিজের আয়ত্তে, তখন ইচ্ছে করেই একটু একটু অসুবিধে ভোগ করার বেশ একটা তৃপ্তি আছে,—রাজারাজড়ার শখ করে হেঁটে চলার মতো। 

রাধানাথ একটি সংক্ষিপ্ত টিপ্পনী করিল, কবি। 

তারাপদ বলিল, তা হলে আর একটু অসুবিধের তৃপ্তি ভোগ করতে করতে তুমি না হয় শুভেনকে ডেকে নিয়ে এস, চার জন হলে দিব্যি আরাম করে তাসটা খেলা যায়! 

রাধানাথ বলিল, আমি গিয়েছিলাম তার কাছে; সে আসবে না। 

কেন? 

তার দাদার শালা বেড়াতে আসবে। 

আসুক না! 

বললে—এ অবস্থায় আমার বাড়ি ছেড়ে যাওয়াটা নেহাত অভদ্রতা হবে না?

তারাপদ ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া বলিল, ও! অভদ্রতা! 

আবার চুপচাপ; শৈলেন গুনগুনানিটুকুও থামাইয়া দিয়াছে। একটু পরে তারাপদই আবার মৌনতা ভঙ্গ করিল। প্রশ্ন করিল, তোমরা ভালোবাসা জিনিসটায় বিশ্বাস করো? 

রাধানাথ বলিল, যখন ভূতে করি, তখন ভালোবাসা আর কী দোষ করেছে,— দুটোই যখন ঘাড়ে চাপবার জিনিস। তবে সব সময় করি না বিশ্বাস। ঘোর অন্ধকার রাত্রি, পোড়ো বাড়ি কিংবা একটানা মাঠের মাঝখানে একটা পুরোনো গাছ, একলা পড়ে গেছি—এ অবস্থায় ভূতে বিশ্বাস করি। আর ভালোবাসার কথা,—কবির ভাষায় এ-রকম ‘অঝোর-ঝরা শাওন-রাতি’–তোমার চা-টি দিব্যি হয়েছিল, আর ওদিকে বাড়িতে খিচুড়ি আর মাংসের খবর পেয়ে এসেছি, ভবিষ্যতের একটা আশ্বাস রয়েছে, এ-রকম অবস্থায় মনে হচ্ছে যেন প্রেম বলে একটা জিনিস থাকা বিচিত্র নয় … এমনকি দাদার নেই-শালির জন্যে একটা বিরহের ভাবও মনে জেগে উঠছে যেন। 

তারাপদ প্রশ্ন করিল, কবি, কী বলো? 

শৈলেন বলিল, আমি যে রয়েছি, আরও প্রমাণ দিয়ে স্পষ্ট করে বলতে গেলে— এখন এ ঘরে হাতে মাথা দিয়ে শুয়ে আছি—এটা বিশ্বাস করো? 

করি বইকি…না করে উপায় কী? বিশেষ করে বৃষ্টির ছাঁটের সঙ্গে সঙ্গে তোমার শৈলেনত্বের প্রমাণ যখন… 

তা হলে ভালোবাসাকেও বিশ্বাস করতে হবে তোমাদের, কেন না আমি আর ভালোবাসা সম-স্থিত, ইংরেজিতে তোমরা যাকে বলবে—co-existent! 

তারাপদ তাস ঠুকিতে ঠুকিতে বলিল, বটে! তো তোমার জীবনে যে একটা রহস্য আছে, সে সন্দেহ বরাবরই হয় বটে, তবে অ্যান্টি-শুকদেবের মতো আমি অ্যান্টি-ক্রাইস্টের নজিরে কথাটা ব্যবহার করলাম—অ্যান্টি-শুকদেবের মতো তুমি যে রমণী-প্রেম নিয়েই পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছ, এতটা জানা ছিল না! ব্যাপারটা ভেঙে বলো একটু। 

শৈলেন আরম্ভ করিল, বয়স যখন সাত-আটের মাঝামাঝি, সেই সময় আমার ভালোবাসার সূত্রপাত ঠিক কোন লগ্নটিতে আরম্ভ হয়েছিল বলতে পারি না। অনভিজ্ঞেরা কাব্য-কাহিনিতে যা বলেন তা থেকে মনে হয়, ভালোবাসা জীবনের একটা নির্দিষ্ট রেখা থেকে আরম্ভ হয়, যেমন মাঠের ওপর একটা চুনের রেখা কিংবা কোদালের দাগ থেকে আরম্ভ হয় বাজির দৌড়। ওই যে শোনো—প্রথম দর্শন থেকেই প্ৰেম, কিংবা হাতের লেখা দেখেই ভালোবেসে ফেলা ওসব কথা নিতান্তই বাজে। প্রেমকে একটি ফুল বলা চলে—ওর আরম্ভটা পাঁজির এলাকাভুক্ত নয়। কবে যে কেন্দ্রগত মধুকণাটুকু জমে উঠেছে, আর কবে যে তাকে ঘিরে কচি দলগুলি কুঞ্চিত হয়ে উঠবে, তার হিসেব হয় না; আমরা যখন টের পাই, তখন যাত্রাপথে অনেক দূর এগিয়েছে— সেটা বিকশিত দলের ব্যাকুল গন্ধের যুগ— 

একদিন ঠাকুরমার কাছে গল্প শুনতে শুনতে আমি ব্যাপারটুকুর সন্ধান পেলাম। সেদিনও বড় দুর্যোগ ছিল, ঝড়ঝাপটার ভাগটা আজকের চেয়েও বরং বেশি। রাজপুত্র অরূপকুমার কত দীর্ঘ পথ পেছনে রেখে, কত দীর্ঘতর পথ সামনে করে চলেছেন। আহার নেই, নিদ্রা নেই, ভয় নেই, শঙ্কা নেই, শুধু বুকের মধ্যে একটি রূপের স্বপ্ন। যাত্রাপথের শেষে সাগরের অতল তলে মানিকের তোরণ পেরিয়ে তাঁর পক্ষিরাজ ঘোড়া পৌঁছল রাজকুমারী কঙ্কাবতীর প্রবাল-পুরীর দ্বারে। 

—এতটা হল সাধারণ কথা, যাত্রাপথের দৈনন্দিন ইতিহাস। 

—সেই বিশেষ রাত্রে অরূপকুমার-আমি যখন সোনার কাঠি ছুঁইয়ে তারাপদ প্রশ্ন করিল, তুমি আবার কেমন করে বয়স আর অবস্থা ডিঙিয়ে অরূপকুমার হয়ে পড়লে? 

শৈলেন বলিল, সাত-আট বছর বয়সের একটা মস্ত বড় সুবিধে এই যে, সে সময় বয়স আর অবস্থা সম্বন্ধে কোনও চৈতন্য থাকে না, সুতরাং যাকে মনে ধরে, নির্বিবাদে তার মধ্যে রূপান্তরিত হয়ে পড়া চলে। এখন তুমি যে অমুক আর তোমার বয়স যে সাঁইত্রিশ—এই চেতনা তোমার চারপাশে গণ্ডি সৃষ্টি করে তোমাকে একান্তপক্ষে ‘তুমি’ করে রেখেছে,—একটু কাটিয়ে রাজপুত্র-কোটাল-পুত্র হয়ে নেওয়া তো দূরের কথা, মুহূর্ত কয়েকের জন্যে যে নিজের ছেলেবেলা থেকেই ঘুরে আসবে, সেটাও দুষ্কর হয়ে ওঠে। এই তরলতার জন্যে জীবনের সাত-আট বছরের বয়সটা হল রূপকথারই যুগ, যেমন সাঁইত্রিশ-আটত্রিশ বছরের সময়টা তার নির্বিকারত্বের জন্যে সাহেব, বড়বাবু প্রভৃতির মধ্যে মুখ বুজে চাকরি করবার যুগ।…যাক, গল্পটাই শোনো; বর্ষা কেটে গেল। বায়ুমণ্ডলের এই ভিজে ভিজে আমেজের ভাবটি যখন কেটে যাবে, তখন আমি গল্পটা যে চালাতে পারব—এতে সন্দেহ আছে, কেন না তখন নিজে যা বলছি তা নিজেই বিশ্বাস করতে পারব কি না নিঃসংশয়ে বলতে পারি না। 

–কী বলছিলাম? হ্যাঁ, সে রাত্রে অতিমাত্রায় বিস্মিত হয় দেখলাম, সোনার কাঠি ছোঁয়াতে রুপোর পালঙ্কে যে জেগে উঠল, সে রাজকুমারী কঙ্কাবতী নয়—সে হচ্ছে আমার সেজ বউদিদির সই নয়নতারা। 

–কঙ্কাবতী নয়—হাসিতে যার মুক্তো ঝরে, অশ্রুতে যার হিরে গলে পড়ে, যে চাঁদের বরন কন্যের মেঘের বরন চুল, জেগে উঠতেই যার চোখের দীপ্তিতে সাত মহলে আলো ঠিকরে পড়ে, সাত সখীতে যাকে চামর দোলায়, যার জন্যে সপ্তবীণায় ওঠে সপ্তসুরের মূর্ছনা—

সোনার কাঠির স্পর্শে তার জায়গায় আমার মুখের দিকে চোখ মেলে চাইলে নয়নতারা, যাকে বিনা উগ্র সাধনাতেই আমি প্রত্যহের কাজে অকাজে রোজই দেখছি। আমাদের: বাড়ির কাছেই বোস-পাড়ায় রেলের ধারে তাদের বাড়ি। সামনে পানায়—ঢাকা ছোট একটা পুকুর, তাতে একটা বকুলগাছের ছায়ায় রানাভাঙা সিঁড়ি নেমে গেছে। ঘাটের সামনেই খানিকটা দূর্বাঘাসে ঢাকা জমি। সেখানে শীতের শেষে বকুলে আর সজনে ফুলে কায়ায়-গন্ধে মাখামাখি হয়ে পড়ে থাকত। তার পরেই একটা রকের পেছনে নুয়নতারাদের বাড়ি—খানিকটা কোঠা, খানিকটা গোলপাতার। মোট কথা, সাগরতলের প্রবাল-মহলের সঙ্গে তার কোনওই মিল ছিল না। 

—না ছিল স্বয়ং কঙ্কাবতীর সঙ্গে নয়নতারার কোনও মিল। প্রথমত, নয়নতারা —ছিল কালো—যা কোনও রাজকন্যারই কখনও হবার কথা নয়। তবুও যে সে সে-রাত্রে আমার গল্পরাজ্যে বিপর্যয় ঘটালে কী করে, তা ভাবতে গেলে আমার মনে পড়ে যায় তার দুটি চোখ। অমন চোখ আমি আজ পর্যন্ত দেখিনি। তোমরা বোধ হয় স্বীকার করবে ফরসা মেয়ের চেয়ে কালো মেয়ের চোখই বেশি বাহারে হয়—সবুজ আবেষ্টনীর মধ্যে কালো জলের মতো। পরে আমি ভালো চোখের লোভে অনেক কালো মেয়ের দিকে চেয়েছি, কিন্তু অমন দুটি চোখ আর দেখিনি। তার বিশেষত্ব ছিল তার অদ্ভুত দীপ্তি; উগ্র দীপ্তি নয়, তার সঙ্গে সর্বদাই একটা হাসি-হাসি ভাব মিশে থেকে সেটাকে প্রসন্ন করে রাখত। নয়নতারা বেজায় হাসত—বেহায়ার মতো। যখন হাসত তখন তার কালো শরীর থেকে যেন আলো ছড়িয়ে পড়তে থাকত; যখন হাসত না, আমার মনে হ’ত, তখনও যেন খানিকটা আলো আর খানিকটা হাসির অবশেষ ওর চোখে লেগে রয়েছে। আমি সে দুটি চোখ বর্ণনা করতে পারলাম না, তা ভিন্ন শুধু চোখ নিয়ে পড়ে থাকলে আমার গল্প শেষ করাও হয়ে উঠবে না। আমি একবার শুধু সে চোখের তুলনা পেয়েছিলাম কতকটা; মানুষের মধ্যে নয়, পৃথিবীর কোনও জিনিসেও নয়—যদি কখনও শীতের প্রত্যূষে উঠে চক্রবালরেখার উপরে শুকতারা দ্যাখো, তো নয়নতারার চোখের কথা মনে কোরো; অর্থাৎ সে অপার্থিব চোখের তুলনা পৃথিবী থেকে অনেক দূরে—স্বর্গের কাছাকাছি। 

—রেলের দিকে দেয়াল-দিয়ে-আড়াল-করা পানাপুকুরের ধারের জায়গাটিতে নয়নতারার সমবয়সি মেয়েদের আড্ডা জমত। পুরুষের মধ্যে প্রবেশাধিকার ছিল শুধু আমার, কারণ কয়েকটি কারণে আমি ঠিক সেই ধরনের ছেলে ছিলাম নব-পরিণীতাদের যারা খুব কাজে লাগে। প্রথমত, বয়সটা খুব কম; দ্বিতীয়ত, আমি ছিলাম খুব অল্পভাষী, যার জন্যে বাইরে বাইরে আমায় খুব হাঁদা বলে বোধ হত; আর তৃতীয়ত, আমার পুরুষ-অভিভাবক না থাকায় বাড়িতে আমার অবসর ছিল সুপ্রচুর এবং ইচ্ছেমতো পাঠশালার বরাদ্দ থেকেও সময় কেটে অবসর বৃদ্ধি করবার মধ্যেও কোনও বাধা ছিল না। ফলে, ওরা যে আমায় শুধু দয়া করে কাজে লাগাত এমন নয়, আমি না হলে ওদের কাজ অচল হয়ে যেত। সবচেয়ে বেশি এবং গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল চিঠি নিয়ে; এক কথায় আমি এই সংসদটির ডাক-বিভাগের পূর্ণ চার্জে ছিলাম বলা চলে। খাম-টিকিট নিয়ে আসা, চিঠি ফেলে আসা, এমন কি প্রয়োজন বিশেষে পোস্ট-আপিসে গিয়ে পিয়নের কাছ থেকে আগেভাগে চিঠি চেয়ে নিয়ে আসাও আমার কাজের সামিল ছিল; আর পাঁচ-সাত জন নবোঢ়ার খাম, টিকিট, চিঠির সংখ্যার আন্দাজ করে নিতে তোমাদের কোনও কষ্ট হবে না নিশ্চয়ই। এ ছাড়া বাজার থেকে এটা-ওটা-সেটা এনে দেওয়াও ছিল—চিঠির কাগজ, কালির বাড়ি, মাথার কাঁটা, ফিতে, চিরুনি…আড়ালে ডেকে বলত, ‘পতি পরমগুরু’ লেখা দেখে চিরুনিটা নিবি শৈল, লক্ষ্মী ভাই…আর এদের সামনে যখন বকব—ও চিরুনি কেন মরতে নিয়ে এলি?’ বলে তখন চুপ করে থাকবি—থাকবি তো?…দুটো পয়সা নিয়ে ডালপুরী আলুর দম কিনে খেও, যাও ভাগ্যিস শৈল ছিল আমাদের! 

—এছাড়া সময়ের কাঁচা ফল, এবং সেগুলিকে তরুণীদের কাঁচা রসনার উপযোগী করবার নানারকম মশলা আহরণ করাও আমার একটা বড় কাজ ছিল।…রাধানাথ, ও রকম নিশ্বাস ফেললে যে? হিংসে হচ্ছে। 

রাধানাথ বলিল, নাঃ, হিংসে কীসের? এই আমিও তো আজ তিন ঘণ্টা ধরে গিন্নির ফর্দ মিলিয়ে মিলিয়ে মাসকাবারি কিনে নিয়ে এলাম—মশলা, তেল, ওষুধ, বার্লি…নাও, গল্প চালাও। 

—সেদিন ঠাকুরমার গল্পে নয়নতারা কঙ্কাবতীর জায়গা দখল করে মিলন-বিরহ, হাসি-কান্না, মান-অভিমানে সমস্ত গল্পটির মধ্যে একটা অপরূপ অভিনবত্ব ফুটিয়ে তুললে। রূপকথা আর সত্যের সে অদ্ভুত মিশ্রণ আমার আজ পর্যন্ত বেশ মনে আছে। সেদিন অরূপকুমারকে বিদায় দিতে কঙ্কাবতীর চোখে যখন মুক্তো ঝরল, তখন আমার সমস্ত অন্তরাত্মা রেলের ধারে সেই বকুলতলাটিতে এসে অসহ্য বেদনাব্যাকুলতা নিয়ে ভোরের জন্য প্রতীক্ষা করতে লাগল। 

—কিন্তু আশ্চর্যের কথা—অবশ্য, এখন আর সেটাকে মোটেই আশ্চর্য বলে ধরি না—তার পরদিন সকাল গেল, দুপুর গেল, বিকেল গেল, সন্ধে গেল, নয়নতারাদের বাড়ির দিকে কোনওমতেই পা তুলতে পারলাম না। কেমন যেন মনে হতে লাগল, কালকের রাত্রের রূপকথাটা আমার চারি দিকে ছড়ানো রয়েছে—ওদের সামনে গেলেই সব জানাজানি হয়ে যাবে! এখন লক্ষণ মিলিয়ে বুঝতে পারছি সেটা আর কিছু নয়, নতুন ভালোবাসার প্রথম সংকোচ। 

—সেজ বউদি বললেন, হ্যাঁ শৈলঠাকুরপো, আজ সমস্ত দিন তুমি ও-মুখো হওনি যে? নয়ন তোমায় খুঁজছিল। 

—রাত্রি ছিল। আমি লজ্জাটা ঢাকলাম, কিন্তু কথাটা চাপতে পারলাম না, বললাম, যাও, খুঁজছিল না আরও কিছু! 

—সেজ বউদি বললেন, ওমা! খুঁজছিল না? আমি মিছে বললাম? তিন-চার বার খোঁজ করেছিল, কাল সকালে যেও একবার। 

বললাম, আমার বয়ে গেছে। 

–বয়ে গেছে তো যেও না, আমায় বলতে বলেছিল বললাম।—বলে বউদি চলে গেলেন। 

সেদিন ঠাকুরমার ছিল একাদশী, গল্প হল না—অর্থাৎ তার আগে রাতে যে আগুনটুকু জ্বলেছিল, তাতে আর ইন্ধন জোগাল না। পরের দিন অনেকটা সহজভাবে নয়নতারাদের বাড়ি গিয়ে উপস্থিত হলাম। 

—ডেকেছিলে নাকি কাল? 

—নয়নতারা মুখ তুলে বাঁ গালটা কুঞ্চিত করে বললে, যা যাঃ, দায় পড়ে গেছে ডাকতে, উনি না হলে যেন দিন যাবে না। দুটো চিঠির কাগজ এনে উপকার করবেন, তা—

—ওদের চড়টা-আসটাও মাঝে মাঝে হজম করতে হয়েছে, কিন্তু সেদিন এই কথা দুটোতেই এমন রূঢ় আঘাত দিলে যে, মনের দারুণ অভিমানে বই স্লেট নিয়ে সেদিন পাঠশালায় চলে গেলাম,—মনে বৈরাগ্য উদয় হল আর কি—জানোই তো পাঠশালাটা হচ্ছে ছেলেবেলার শ্বাপদ-সংকুল বানপ্রস্থভূমি।… গুরুমশাই বাঘ, শির-পোড়ো ভাল্লুক ইত্যাদি। সেখানে আগের দিন-চারেক অনুপস্থিত থাকবার জন্যে এবং সেদিনও দেরি হবার জন্যে বেশ একচোট উত্তমমধ্যম হল। 

—এর ফলে বাল্য-মোহের কচি শিখাটি প্রায় নির্বাপিত হয়েই এসেছিল, কিন্তু পাঠশালা থেকে ফেরবার পথে যখন রেল লাইন পেরিয়েছি, পুকুরের এপারে রাঙচিতের বেড়ার কাছে দাঁড়িয়ে নয়নতারা ডাকছে আমি প্রথমটা গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম, তার পর নয়নতারা আর একবার ডাকতেই আগেকার দু দিনের কথা, সকালের কথা এবং পাঠশালার কথা একসঙ্গে সব মনে হুড়োহুড়ি করে এসে, কী করে জানি না, আমার চোখ দুটো জলে ভরিয়ে দিলে। নয়নতারা বেরিয়ে এসে আমার হাত দুটো ধরে আশ্চর্য হয়ে বললে, ওমা, তুই কাঁদছিস শৈল? কেন রে, আয়, চল। 

—বাড়ি নিয়ে গিয়ে খুব আদর-যত্ন করলে সেদিন। দুটো নারকেলনাড়ু আঁচলের মধ্যে লুকিয়ে নিয়ে এসে বলল, তোর জন্যে চুরি করে রেখেছিলাম শৈল, খা। তোকে সত্যি বড় ভালোবাসি শৈল, তুই বিশ্বাস করবিনি। তোকে রাগের মাথায় তাড়িয়ে দিয়ে মনটা এমন হুহু করছিল….মুখে আগুন নন্তের, অত খোশামোদ করিয়ে, একটা নাটাইয়ের দাম আদায় করে যদিবা কালকে চিঠির কাগজ দিলে এনে, আজ কোনও মতেই চিঠিটা ফেলে দিলে না রে! গলে যাক অমন দুশমন গতর—বেইমানের। 

—এদিক-ওদিক একটু চেয়ে শেমিজের মধ্যে থেকে একটা গোলাপি খাম বের করে মিনতির সুরে বললে, সত্যি তোকে বড্ড ভালোবাসি শৈল—বললে না পেত্যয় যাবি।…এই চিঠিটা ভাই, বইয়ের মধ্যে নুকিয়ে নে। আর একটু ঘুরে পোস্ট-আপিসে ফেলে দিয়ে বাড়ি যেও; রোদটা একটু কড়া, কষ্ট হবে? হ্যাঁ, শৈলর আবার এ কষ্ট কষ্ট! নন্তে কিনা! এগারোটা বেজে গেছে; বারোটার সময় ডাক বেরিয়ে যাবে শৈল, লক্ষ্মীটি… 

—আমি এখনও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি—পুকুরধারে, শানের বেঞ্চের পেছনে। বকুলগাছের আড়ালে আমার কাঁধে বাঁ হাতটা দিয়ে নয়নতারা দাঁড়িয়ে আছে। আমার মুখের ওপর ডাগর ভাসা-ভাসা চোখ দুটি নিচু করে তাতে চিঠির গোপনতার একটু লজ্জা, খোশামোদের ধূর্তামি, বোধ হয়, একটু অনুতপ্ত স্নেহ, আর একটা কী জিনিস— একটা অনির্বচনীয় কী জিনিস, যা শুধু নবপরিণীতাদের চোখেই দেখেছি, আর যা এই রকম চিঠি লেখা, চিঠি-পাওয়ার সময় যেন আরও বেশি করে ফুটে ওঠে। 

এইখানে আমার ভালোবাসার ইতিহাসের প্রথম অধ্যায় শেষ হল এই ফিরে যেতে যেতে আবার ঘুরে আসায়। তোমাদের ওই বয়সের মেয়েদের মজলিশের কোনও অভিজ্ঞতা আছে? 

তারাপদ বলিল, না। 

রাধানাথ বলিল, কী করে থাকবে বলো? গার্জেনের কণ্টকারণ্যে মানুষ হয়েছি। চক্ষু সর্বদা বাইরে অক্ষয়-লগ্ন কথা থাকত, অক্ষরের রূপে যে মুগ্ধ ছিলাম তা নয়, —বই থেকে চোখ তুললেই বাবা কিংবা পাঁচ কাকার কেউ-না-কেউ চোখে পড়তেন। ছুটিছাটায় যদি দু-এক জন বাইরে গেলেন তো সেই ছুটির সুযোগে মামা-পিসেমশাইদের দল এসে আমার ভবিষ্যতের জন্যে সতর্ক হয়ে উঠতেন। তাঁরা ছিলেন উভয় পক্ষ মিলিয়ে সাত জন। শেষে এই তেরো জনে মাথা একত্র করে বিয়ে দিলেন এমন একটি নিষ্কণ্টক মেয়ের সঙ্গে, যার বাপের সম্পত্তিতে ভাগ বসাবার জন্যে না-ছিল বোন, না-ছিল একটা ভাই যে, একটি শালাজেরও সম্ভাবনা থাকবে।…নাও, বলে যাও। আবার মজলিশ! এত কড়াক্কড়ির মধ্যে যে একটি মেয়ে কোনও রকমে ঢুকে পড়েছে এই ঢের। 

তারাপদ বলিল, রাধানাথ চটেছে। তা চটবার কথা বইকি। 

শৈলেন বলিল, নয়নতারাদের মজলিশের কথা বলতে যাচ্ছিলাম। আগে বোধ হয় এক জায়গায় বলেছি যে, এ মজলিশে আমি মুক্তগতি ছিলাম। ছাড়পত্র ছিল বটে, কিন্তু এর পূর্বে আমি তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতাম না। তার কারণ ওদের কথা সব সময় ঠিকমতো বুঝতামও না, আর বুঝলেও সব সময় রস পেতাম না। আমার নিজেরও বয়স-সুলভ নেশা ছিল—মাছ ধরা, স্টেশনের পাখার দিকে চেয়ে ট্রেনের প্রতীক্ষা করা, এবং ট্রেনের ধোঁয়া দেখা দিলে লাইনে পাথর সাজিয়ে রাখা, ঘুড়ি ওড়ানো—এই সব। কিন্তু এবার থেকে আমার মস্ত একটা পরিবর্তন দেখা দিল, মাছ, ঘুড়ি, ট্রেনের প্রতি পক্ষপাতিত্ব গিয়ে সমস্ত মনটি নয়নতারাদের মজলিশে, নয়নতারার—বিশেষ করে নয়নতারার আশ্চর্য চোখ দুটিতে কেন্দ্রীভূত হয়ে উঠল। সে যখন তাস খেলত, আমি তার সামনে কারুর পাশে একটু জায়গা করে নিয়ে বসে থাকতাম। নয়নতারা তাস দিচ্ছে, পিঠ ওঠাচ্ছে; তার চুড়িগুলি গড়িয়ে একবার মণিবন্ধের নিচে, একবার কনুইয়ের কাছে জড়াজড়ি করে পড়ছে; কখনও সে তার আনত চোখের ওপর ভ্রু দুটি চেপে চিন্তিতভাবে মাথা দোলাচ্ছে, তার কপালের কাচপোকার ময়ূরকণ্ঠী রঙের টিপটি ঝিকঠিক করে উঠছে—আমি ঠায় বসে বসে দেখতাম। তখন ছিল কাচপোকার টিপের যুগ, এখন বেচারি আর সুন্দর কপালে ঠাঁই পায় না, তার নিজেরই কপাল ভেঙেছে। আমি প্রতীক্ষা করতাম—জিতলে কখন নয়নতারার পান-খাওয়া ঠোঁটে হাসি ফুটবে! হারলে সে যে আমার কাছের মেয়েটিকে চোখ রাঙিয়ে কুটমন্দ বলবে, সে দৃশ্যও আমার কাছে কম লোভনীয় ছিল না। একটা কথা আমি স্বীকার করছি,—আজ যে ভাবে বয়সের দূরত্ব থেকে নয়নতারাকে দেখছি, সেসব দিন যে ঠিক সেই ভাবেই দেখতাম তা নয়। তখন তার সমস্ত কথাবার্তা চালচলন হাসি-রাগ আমার কাছে এক মস্তবড় বিস্ময়কর ব্যাপার বলে বোধ হত, —যে বিস্ময়ে মনের ওপর এক সম্মোহন বিস্তার করে মনকে টানে। এ দিক দিয়ে দেখতে গেলে মনোবিজ্ঞানের নিক্তির ভৌলমতো আমার মনোভাবটাকে ‘ভালোবাসা’ না বলে ‘ভালো-লাগা’ বলাই উচিত ছিল। আমি ভালোবাসা বলে যে শুরু করেছি, তার কারণ এর মধ্যে আমার ওই মনস্তত্ত্বেরই পরখ-মতো কিছু কিছু জটিলতা ছিল, সে কথা পরে যথাস্থানে বলব। 

—সেদিন তাসের মজলিশ ছিল না, একটা বই পড়া হচ্ছিল। বইটা যে ‘ভাগবত কিংবা ‘মনুসংহিতা’ নয়—এ কথা বোধ হয় তোমাদের বলে দিতে হবে না। আমি যে বসেছিলাম, এটা ওরা গ্রাহ্যের মধ্যে আনেনি; তার প্রধান কারণ, ওরা নিজেদের খেয়ালে সেদিন খুব বেশি-রকম মশগুল ছিল; আর দ্বিতীয় কারণ—আগে বোধ হয় বলেছিল—ওরা সাধারণত আমায় এসব বিষয়ে জড় পদার্থের সামিল বলেই ধরে নিত। সেদিন আবার আমি একেবারেই জড়পদার্থ হয়ে গিয়েছিলাম, কেননা, নয়নতারাকে সেদিন যেন আরও অপরূপ দেখাচ্ছিল। আমি বোধ হয় বইটাও শুনছিলাম না সেই জন্যে, তার বটতলামার্কা চেহারা মিলিয়ে মোটামুটি তোমাদের কাছে তার কুলশীলতা জানাতে পারলাম, তার নামধামটা দিতে পারলাম না। 

—এর মধ্যে একটি মেয়ে—নামটা বোধ হয় তার সুধা, কী এই রকম কিছু ঠিক মনে পড়ছে না—আমার দিকে চেয়ে বললে, শৈল, ভাই, যা না, আমার সেই কাজটা —দেরি হয়ে যাচ্ছে— 

—অপর একজন জিজ্ঞেস করলে, কী কাজ রে? 

—সুধা বললে, কিচ্ছু না। 

—সেই মেয়েটা ঠোঁট উলটে ভ্রু নাচিয়ে বললে, ওরে বাবা! শুধু আমি জানি আর আমার মন জানে! জিজ্ঞেস করে অপরাধ হয়েছে, মাফ চাইছি। 

—তার রাগটা পড়ল আমার ওপর। নাকটা কুঞ্চিত করে বললে, তা তুই এখানে কচ্ছিস কী রে? আরে গেল! তুই কী বুঝিস এসব 

—অন্য একজন বললে, তোর পাঠশালা নেই? 

—কে উত্তর দিলে, পাঠশালে তো গুরুমশাই এসব কথা বলবে না! বলে তো দু বেলা ছেড়ে তিন বেলা গিয়ে সেখানে ধন্না দেয়। ও মিনমিনেকে চিনিস না তোরা।

–কথাটার জন্যেও এবং আমার মুখের ভ্যাবাচ্যাকা ভাবটার জন্যেও ওদের মধ্যে একটা হাসি পড়ে গেল। 

—একজন বললে, ওর আর দোষ কি? ওদের জাতটাই হ্যাংলা, কী রকম করে চেয়ে রয়েছে দেখ না। যেন পায় তো সবগুলোকে এক গেরাসে গিলে খায়। 

—আবার একচোট হাসি। তারই মধ্যে একজন বললে, কাকে আগে ধরবি রে?

—আবার হাসি, আরও জোরে; সব দুলে দুলে গড়িয়ে পড়তে লাগল, ঝড়ে ঘনসন্নিবিষ্ট গাছগুলো যেমন এলোমেলোভাবে পরস্পরের গায়ে লুটোপুটি খায়। 

—হাসিতে যোগ দিলে না শুধু খনু। সে গম্ভীরভাবে বললে, আগে ধরবে নয়নকে; সেই থেকে ঠায় ওর মুখের দিকে কী ভাবে যে চেয়ে আছে! কী বয়াটে ছেলে গো মা! নয়ন আবার দেখেও দেখে না! 

—এখন বুঝতে পারছি, তাকে ফেলে নয়নতারাকে দেখবার জন্যেই তার এত আক্রোশ। খনুর আসল নাম ছিল ক্ষণপ্রভা। সে ছিল খুব ফরসা, সুতরাং সুন্দরী। এই রঙে-নামে তার চরিত্রের মধ্যে ঈর্ষার ভাবটা প্রবল করে তুলেছিল। 

—নয়নতারা যেন একটু অপ্রতিভ হয়ে গেল; কিন্তু তখনই সে-ভাবটা সামলে নিয়ে বললে, দেখতে হয়তো তোকেই দেখবে, আমার মতো কালো কুচ্ছিৎকে দেখতে যাবে কেন? 

—খনু বললে, আমায় দেখলে ঠাস ঠাস করে ছোঁড়ার, দু গালে চার চড় কষিয়ে দিতাম—নগদ দক্ষিণে। 

—নয়নতারা ততক্ষণে সপ্রতিভ ভাবটা বেশ ফিরিয়ে এনেছে। চকিতে ভ্রু নাচিয়ে বললে, পেট ভরে খাওয়ার পরেই দক্ষিণে হয়, আমায় দেখলে পেটও ভরবে না, দক্ষিণেও নেই। 

—এটা প্রশংসা ছিল না, ঠাট্টা; কেন না, রঙেই সুন্দরী হয় না। হাজার গুমর থাকা সত্ত্বেও খনুর যে এটা না-জানা ছিল এমন নয়। সে মুখটা ভার করেই রইল। 

—তুলনায় নয়নতারাই সবচেয়ে সুন্দরী বলে—বিশেষ করে কালো হয়েও সুন্দরী বলে—খনুর দলেও কয়েকজন মেয়ে ছিল। তার মধ্যে সুধা একজন। সে অবজ্ঞাভরে ঘাড়টা একটু বেঁকিয়ে বললে, ঠাট্টা কর্ নয়ন। কিন্তু খনুর মতো হতে পারলে বর্তে যেতিস—আমি হক্ কথা বলব। 

নয়নতারা গাম্ভীর্য, মুখভার একেবারেই সহ্য করতে পারত না। গুমটটা কাটিয়ে মজলিশটায় হাসি ফোটাবার জন্যে মুখটা কপট-গম্ভীর করে বললে, ওমা, সে আর যেতাম না! সঙ্গে সঙ্গে খনুর দিকে হেলে পড়ে বললে, আয় তো খনু, একটু গায়ে গা ঘষেনি। 

ফল কিন্তু উলটো হল। ‘হয়েছে’ বলে খনু হঠাৎ দাঁড়িয়ে উঠে মজলিশ ছেড়ে চলে গেল। খানিকটা চুপচাপ গেল, তার পর নয়নতারা হঠাৎ রেগে উঠে আমার দিকে চেয়ে বললে, ফের যদি তুই কাল থেকে এখানে এসেছিস তো তোর আর কিছু বাকি রাখব না। তুই মেয়েদের মুখের দিকে হাঁ করে কী দেখিস রে?…গলা টিপলে দুধ বেরোয় … 

—সবার হাসিঠাট্টা ধমকানির মধ্যে আমার অবস্থা সঙ্গীণ হয়ে উঠেছিল, কাঁদ-কাঁদ হয়ে বললাম, আমি কক্ষনোও দেখি না। 

—নয়নতারা বললে, দেখিস, নিশ্চয় দেখিস; তোর কোনও গুণে ঘাট নেই। না যদি দেখিস তো এই যে খনু এক ডাঁই মিথ্যে বলে গেল, বোবার মতো চুপ করে রইলি কেন? 

—সুধা শরীর দুলিয়ে দুলিয়ে উঠে পড়ে বললে, খনু মিথ্যে বলেনি; দেখে ও ড্যাব্‌ডেবে চোখ বার করে। পাঁচ বছরেরই হোক আর পঞ্চাশ বছরেরই হোক— বেটাছেলেই তো! আমাদের চোখে কেমন লাগে তাই বলি; থাকলেই বলতে হয়, তার চেয়ে না থাকাই ভালো বাবা! 

—সেদিন আড্ডা আর জমল না। কয়েকজন খনুর সঙ্গে মতৈক্যের জন্যে গেল; বাকি কয়েকজন কথাটা নিয়ে খানিকটা নাড়াচাড়া করলে, তারপর আকাশে মেঘের অবস্থা দেখে একে একে উঠে যেতে লাগল। আমার অবস্থা হয়ে পড়েছিল ন যযৌ ন তস্থৌ; আমাদের পাড়ার ননী উঠতে আমি কোনও রকমে দাঁড়িয়ে উঠলাম। 

—ননী মেয়েটি ছিল অত্যন্ত চাপা। সে যে কোন দিন কোন দলে, টপ করে বোঝবার উপায় ছিল না। বোঝা যেত একেবারে শেষের দিকে, যখন সে নিজের নির্বিকারত্ব পরিহার করে তার অভীপ্সিত দলের একেবারে শেষ এবং মোক্ষম কথাটি বলে উঠে যেত। আমি উঠতেই বিস্মিতভাবে জিজ্ঞাসা করলে, তুইও যাচ্ছিস নাকি? 

—বললাম, হুঁ। 

—তা হলে দয়া করে এগিয়ে যাও; ভাব করে সঙ্গে গিয়ে কাজ নেই—আমি তোমার ভাবের লোক নই।…না হয়, তুই পরেই আসিসখন, দিব্যি দু চোখ ভরে দ্যাখো না বসে, আর তো কেউ বলবার রইল না। বলে চাবির থোলো-বাঁধা আঁচলটা ঝনাৎ করে পিটে ফেলে হনহন করে চলে গেল। 

—আমি খানিকটা জড়ভরতের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। ননী বেশ খানিকটা চ’লে গেলে শচী বললে, মুখে আগুন, গোমড়ামুখী! 

—শচীও চলে গেল। বৃষ্টি তখন এল বলে। আমি পা বাড়াচ্ছি, নয়নতারা বললে, ভিজে যাবি শৈল, একটু বসে যা; চল, বাড়ির ভেতর। 

–সে দিনটি আমার স্পষ্ট মনে আছে, আশা করি কখনও অস্পষ্ট হবে না। তখনও ভালো করে বিকেল হয়নি, কিন্তু আকাশে গাঢ় মেঘের জন্যে মনে হচ্ছিল যেন সন্ধের আর দেরি নেই। মজলিশ যখন ভাঙল, সে সময় রেলের ওপারে বনের আড়াল থেকে একটা আরও কালো মেঘের ঢেউ যেন মেঘলা আকাশটায় ভেঙে পড়ল, মনে হল দিনটাকে অতি শীঘ্র রাত করে তোলবার জন্যে কোথায় যেন মস্ত বড় তাড়াহুড়ো পড়ে গেছে! একটু পরেই ঠান্ডা হাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টি নামল। 

—রেলের দিকে নয়নতারাদের দুটো ঘর—একটা বড়, একটা অপেক্ষাকৃত ছোট। নয়নতারা একটু এদিক-ওদিক করে এসে ছোট ঘরে রেলের দিকের জানালাটির চৌকাঠের পাশে বসল। আমায় বললে, তুই এইখানটায় বস শৈল, ভাগ্যিস যাসনি, না? 

—বললাম, হ্যাঁ, ভিজে যেতাম। 

—জানালাটা দিয়ে অল্প অল্প বৃষ্টির ছাঁট আসছিল, নয়নতারা হঠাৎ গুটিসুটি মেরে একটু হেসে বললে, একটু একটু বৃষ্টি এসে গায়ে লাগলে কিন্তু বেশ লাগে, তোর ভালো লাগে না শৈল? 

—বললাম, না, ভিজে যেতে হয়। 

রাধানাথ বলিল, তখন তা হলে তোমার মাথায় একটু সুবুদ্ধি ছিল বলতে হবে, এখন দেখছি— 

শৈলেন বলিল, ভুল বলছ, তখন বৃষ্টিতে ভেজা বরং একটা রীতিমতো উৎসব ছিল আমার পক্ষে, কিন্তু সে সময় যা বললাম তা শুধু নয়নতারার কথা ভেবে, তার ভেজা দেখে আমার কষ্ট হচ্ছিল। 

তারাপদ বলিল, এত দূর! 

শৈলেন বলিয়া চলিল, নয়নতারা বসে বসে অনেকক্ষণ ধরে বৃষ্টি দেখতে লাগল।…তার মুখের আধখানা দেখতে পাচ্ছি,—কী রকম অন্যমনস্ক হয়ে মুখটা একটু উঁচু করে বসে আছে, মুখটাতে একটা ছায়া পড়েছে বৃষ্টির ছাটের ছোট ছোট গুঁড়ি মুখের এখানে-সেখানে, চোখের কোঁকড়ানো পাতার ডগায় কপালের চুলে চিকচিক করছে। হঠাৎ কী ভেবে বললে, চারদিক মেঘে ঢেকে গেলে মনে হয় সব্বাই—যে যেখানে আছে—সব যেন এক জায়গায় রয়েছি, না রে শৈল? 

—এখন মানে বুঝি, তখন একেবারেই বুঝিনি; তবুও এত তন্ময় আর অন্যমনস্ক ছিলাম যে, কিছু না ভেবেই বলে দিলাম, হ্যাঁ। 

—নয়নতারা বোধহয় নিজের ঘোরে বলেছিল কথাটা, কোনও উত্তরের অপেক্ষায় বা আশায় নয়। আমার দিকে একটু চেয়ে রইল। আরও খানিকক্ষণ চুপচাপের পর হঠাৎ জিজ্ঞাসা করলে, মেঘ তোর কেমন লাগে শৈল? 

—সামান্য যেন একটু কুণ্ঠা, তার পরেই বললে, মেঘ কালো কিনা, তাই জিজ্ঞেস করছি, বিদ্যুৎ বরং ঢের সুন্দর… 

—আমি উত্তর দিলাম, বেশ লাগে মেঘ 

—ঠিক মনে পড়ছে না, তবুও যেন বোধ হল নয়নতারার চোখের তারা একটুখানির জন্যে কী রকম হয়ে গেল। হতে পারে এটা আমার আজকের সজাগ মনের ভুল বা অপসৃষ্টি, কিন্তু এই রকম বর্ষা পড়লেই সেদিনকার সেই ছবিটি যখন ফুটে ওঠে, দেখি নয়নতারার চোখ দুটি যেন একটু নরম হয়ে উঠল। 

—একটু পরে আবার বললে, ক্ষণপ্রভা মানে বিদ্যুৎ—ওই যে খেলে গেল— খুনির নাম—

আমি সরস্বতী দেবীর অতটা বিরাগভাজন হলেও কী করে জানি না এই অসাধারণ কথাটার মানে অবগত ছিলাম। সেইটিই পরম উৎসাহে বলতে যাব, এমন সময় নয়নতারা হঠাৎ জানলা থেকে নেমে এসে আমার সামনে বসে পড়ল এবং আমার মুখের পানে কী এক রকম ভাবে চেয়ে বলে উঠল, তুই আমায় অত করে দেখিস কেন রে শৈল? আমি কালো… 

—এখন আমিও বুঝেছি, তোমরাও বুঝছ আসল ব্যাপারটা কী—অর্থাৎ নয়নতারাকে সেদিন বর্ষায় পেয়েছিল, নবোঢ়ার মন পাড়ি দিয়েছিল তার দয়িতের কাছে;–আকাশে ওদিকে বর্ষা, সে এদিকে মনে মনে শৃঙ্গার করেছে, তার পরে আমার চোখের মুকুরে নিজের রূপটি দেখে নিয়ে সে যাবে…সে কালো, তাই তার অপূর্ণতার ব্যথা, খনুর সঙ্গে তুলনা। 

সেদিন আমি এ কথাটা বুঝিনি, বোঝবার সম্ভাবনাও ছিল না। সেদিন এই বুঝলাম যে, আমার জন্যেই নয়নতারা এ প্রশ্নটা করছে, সে বলছে—তোমার যদি ভালো লাগে তা হলেই আমার রূপের আর জীবনে সার্থকতা, আমার সমস্ত জীবন—মরণ নির্ভর করছে তোমার একটি ছোট উত্তরের উপরে— 

—আমি তখন যা ভেবেছিলাম তা গুছিয়ে বলতে গেলে এই দাঁড়ায় যে, সেদিন নয়নতারা আমায় আমার বয়সের গণ্ডি থেকে তুলে নিয়ে আমায় পৌরুষের জয়টীকা পরিয়ে দিলে, আমার হল প্রেমের অভিষেক! 

–প্রবল কুণ্ঠায় এবং কেমন একটা সশঙ্ক আনন্দে আমি মুখটা নামিয়ে নিলাম, উত্তর দিতে পারলাম না। উত্তর দিলে কথাটা তখনই পরিষ্কার হয়ে যেত, কেন না, নয়নতারা সেদিনকার নিভৃতে যেমন নিঃসংকোচে আরম্ভ করেছিল ভাতে সে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তার বরের কথা এনে ফেলতই। যদি বলতাম, তবুও—অর্থাৎ কালো হলেও তুমি খুব সুন্দর, সে হয়তো বলত, তোর কথার সঙ্গে ‘ওর’ কথা মিলে গেছে শৈল,–মেলে কি না তাই দেখবার জন্যে জিজ্ঞেস করছিলাম। কিংবা এই রকম কিছু, কেন না, এই ধরনেরই একটা কথা তার মনে ঠেলে উঠেছিল। 

—ফলে, সত্যের আলোয় যে ধারণাটা তখনই নিরর্থক হয়ে যেতে পারত, মিথ্যার অর্থাৎ ভ্রান্তির অন্ধকারে সেটা আমার জীবনে একটা অপূর্ব সার্থকতা লাভ করলে। আমার ভালোবাসার তন্তু এতদিন শূন্যে দুলছিল, আশ্রয়-শাখা এগিয়ে এসে তাকে স্পর্শ করলে। বোধহয়, এত দিন আমার শুধু ভালো লাগছিল মাত্র, সেদিন থেকে আমি নিঃসন্দেহে ভালোবাসলাম, আমার ভালোবাসার ইতিহাসে দ্বিতীয় স্তর আরম্ভ হল। 

তারাপদ বলিল, তোমার গল্পটা মন লাগছে না, তবে জিনিসটাকে ভালোবাসা বলায় স্পর্ধার গন্ধ আছে, যদিও এ ভ্রান্তির জন্য আমরা তোমায় ক্ষমা করতে রাজি আছি, কেন না, ভ্রান্তিই কবির ধর্ম। 

রাধানাথ বলিল, কেন না, কবি বিধাতার ভ্রান্তিই। 

শৈলেন বলিল, না, সেটা ভালোবাসাই, কেন না, এবার থেকে যা লক্ষণ সব প্রকাশ পেতে লাগল, তা ভালোবাসার একেবারে নিজস্ব জিনিস ট্রেডমার্কা দেওয়া।… একটি গুরুতর লক্ষণ দাঁড়াল—ঈর্ষা। 

—হ্যাঁ, তার আগে সেদিনকার কথাটা শেষ করে দিই। উত্তর না পেয়ে নয়নতারা আমার মুখটা দুটো আঙুল দিয়ে তুলে ধ’রে বললে, তোর বুঝি আবার লজ্জা হল! 

—বোধহয় তার প্রশ্নের জটিলতাটা উপলব্ধি করলে এতক্ষণে। একটু কী ভাবলে, তারপর আমার হাতটা ধরে একটু গলা নামিয়ে বললে, আমি তোকে ও-কথাটা জিজ্ঞেস করেছি, কাউকে বলিসনি যেন শৈল, বলবি না তো? বস, আমি আসছি।— বলে চলে গেল; অবশ্য আর এল না সেদিন। 

শৈলেন একটু চুপ করিল। রাধানাথ বলিল, বৃষ্টি তোমার কবিত্বের গোড়ায় জল জোগাচ্ছে বটে শৈলেন, কিন্তু ওদিকে তারাপদ কার্পেটটা ভিজিয়ে তার সমূহ অপকার করছে, আতিথেয়তার ত্রুটি হয় বলে বোধহয় ও বেচারা— 

তারাপদ তাড়াতাড়ি প্রতিবাদ করিতে যাইতেছিল, শৈলেন বলিল, দাও বন্ধ করে। 

বন্ধ জানালার উপর ধারাপাতের জন্য মনে হইল, বৃষ্টিটা যেন হঠাৎ বাড়িয়া গেল। শৈলেন চোখ বুজিল, যেন কোথায় তলাইয়া গিয়াছে। তারাপদ আর রাধানাথ বুঝিল, সেদিন নয়নতারাকে যেমন বর্ষায় পাইয়াছিল আজ ঠিক সেইভাবে পাইয়াছে শৈলেনকে। শৈলেনের গল্প আর বাহিরের বর্ষা বোধহয় তাহাদের ভিতরের গদ্যাংশও কিছু কিছু তরল করিয়া আনিয়াছিল, তাহারা শৈলেনের মৌনতায় আর বাধা দিল না। 

একটু পরে যেন একটা অতল তরলতা হইতে ভাসিয়া উঠিয়া শৈলেন বলিল, হ্যাঁ, কী বলছিলাম? ঠিক ঈর্ষার কথা। যখন আমার ভালোলাগার খাদ মরে গিয়ে সেটা ভালোবাসায় দাঁড়াল, সেই বরাবর থেকে একটি নির্দোষ নিরীহ লোক আমার শত্রু হয়ে দাঁড়াল,—সাক্ষাৎ ভাবে আমার কাছে কোনও অপরাধ না করেও। এই লোকটি নয়নতারার স্বামী অক্ষয়। 

—অক্ষয়ের পরোক্ষ অপরাধ এই যে, সে নয়নতারাকে বিবাহ করেছে। ঘটনাটি প্রায় এক বৎসরের পুরোনো, কিন্তু এতদিন এতে ক্ষতিবৃদ্ধি ছিল না। কেন না অক্ষয় এতদিন একটি নির্বিঘ্ন নেপথ্যে অবস্থান করছিল। বর্ষায় সেদিন নয়নতারার যে নূতনতর আলো ফুটে উঠল, সেই আলোতে হঠাৎ অক্ষয় দুর্নিরীক্ষ্য ভাবে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। অনেক কথা, যা কখনও ভাবিওনি, তা শুধু ভাবনার নয়—একেবারে দুর্ভাবনার বিষয় হয়ে উঠল। নয়নতারা আমায় খুবই ভালোবাসে—আমার জন্যে নারকেল নাড়ু চুরি করে রাখে, ছেঁড়া কাপড়ের রুমাল তৈরি করে তাতে রেশমের ফুল তুলে দেয়, ঘুড়ির ডালপুরির পয়সা জোগায়, গুরুমশাইয়ের বেতের দাগ পড়লে আমার পিঠে হাত বুলিয়ে রুচিকর ভাষায় গুরুমশাইয়ের আদ্যশ্রাদ্ধের ব্যবস্থা করে, জীবনের অমূল্য সম্পদ এসব; কিন্তু তার সামান্য একটি চিঠি পাবার কী পাঠাবার আগ্রহ আজ হঠাৎ এসবকে যেন নিষ্প্রভ অকিঞ্চিৎকর করে দিলে। সে আগ্রহটা আমাদের প্রতি তার সাক্ষাৎ আচরণের কাছে সামান্যই একটা ব্যাপার—কে পৃথিবীর কোন এক কোণে পড়ে আছে, তার সঙ্গে দুটো অক্ষরের সম্বন্ধ, কিন্তু এটাও আমার অসহ্য হয়ে উঠতে লাগল! ষোলো আনার মধ্যে সাড়ে পনেরো আনা আমিই পাচ্ছি, কিন্তু ওদিকে যে ওই দুটো পয়সা যাচ্ছে, ওটুকু বরদাস্ত করা—যতই দিন যেতে লাগল, ততই আমার পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠতে লাগল। 

—ঠিক এই সময় একটা ব্যাপার ঘটল, যা অবস্থাটিকে ঘনীভূত করে তুললে। 

—একদিন সুধার একটা খুব জরুরি চিঠি ডাকে দিতে যাচ্ছি। স্টেশনটা ছাড়িয়েছি, এমন সময় স্টেশনের গেট দিয়ে অক্ষয় বেরিয়ে এল। সেই ট্রেন থেকে নেমেছে। চুল উস্কখুস্ক, মুখ শুকনো। আমায় দেখেই থমকে দাঁড়িয়ে বললে, এই যে শৈলেনভায়া? মানে—ইয়ে—এরা সব কেমন আছে বলতে পার? 

—তখন ‘এরা’-র মানে আমি বুঝি, না বোঝাই অস্বাভাবিক, বুঝলাম, ভালো আছে। 

—অক্ষয়ের মুখটা যেন অনেকটা পরিষ্কার হল। আমার হাতটা ধরে জিজ্ঞেস করলে, পথ্যি পেয়েছে? কবে পেলে, অ্যাঁ? 

—আমি বিস্মিত হয়ে চুপ করে রইলাম, তারপর বললাম, কই, তার তো অসুখই করেনি। 

—অসুখ করেনি! তবে?—বলে অক্ষয়ও খানিকটা আশ্চর্য হয়ে আমার মুখের দিকে চাইলে, আস্তে আস্তে চোখ ঘুরিয়ে কী ভাবলে, তার পর মুখটা হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বললে, দ্যাখো, কাণ্ড! আচ্ছা তো!…তুমি বুঝি চিঠি ফেলতে যাচ্ছ?— কোন দময়ন্তীর? 

—নয়নতারাকে লেখা পত্রে অক্ষয় আমার সম্বন্ধে প্রায়ই উল্লেখ করত ‘হংসদূত’ বলে, তা নিয়ে চিঠি পড়বার সময় চর্চা হত। সুতরাং দময়ন্তী কথাটার অর্থ বুঝতে আমার অসুবিধে হল না। বললাম, সুধাদিদির। 

—ওই তো লেটার-বক্স—যাও, ফেলে দিয়ে এস। এক সঙ্গে যাওয়া যাবেখন।

—ভালোবাসা যখন জমে আসছে, তার মধ্যে অক্ষয়ের এসে পড়াটা আমার মোটেই প্রীতিকর হয়নি, কিন্তু ফিরে আসতে আসতে যখন শুনলাম নয়নতারার এই মিথ্যাচারণের জন্যে তাকে কি নাকালটা ভোগ করেই চলে আসতে হয়েছে, তখন আমার মনটা খুবই খুশি হয়ে উঠল। বেচারা আফিস থেকে বাড়িও যেতে পারেনি; যখন স্টেশনে, তখন ফার্স্ট বেল হয়ে গেছে, ছুটতে ছুটতে শানবাঁধানো প্ল্যাটফর্মে পিছলে পড়ে গিয়ে হাঁটুটা গেছে কেটে, হাতটা গেছে ছড়ে; কাপড়ে রক্তের দাগ দেখিয়ে বললে, এই দ্যাখো কাণ্ডটা! 

—এটার আকস্মিকতাটা আমি আর ধরলাম না; আমার মনে হল, দারুণ দুর্ভাবনায় ফেলা থেকে নিয়ে প্ল্যাটফর্মে আছাড়-খাওয়ানো পর্যন্ত সমস্তই নয়নতারার কীর্তি, সৎকীর্তি। আমার মনটা নয়নতারার ওপর প্রসন্নতায় ভরে উঠল এবং অক্ষয়কে চিঠি লেখার জন্যে, আর তার চিঠির প্রতীক্ষা করবার জন্যে যে মনে মনে একটা অভিমান ও আক্রোশের ভাব ঠেলে উঠেছিল সেটা একেবারে কেটে গেল। বুঝলাম, এত যে চিঠি তার মধ্যে এই নিতান্ত অবাঞ্ছনীয় জীবটিকে প্ল্যাটফর্মে আছাড় খাওয়াবার একটা গূঢ় অভিসন্ধি জমে উঠেছিল। অক্ষয়ের প্রতি আমার মনের ভাবের সঙ্গে বেশ একটা নিবিড়তর ঘনিষ্ঠতা উপলব্ধি করলাম। 

তার পরদিন দুপুরের মজলিশ বেশ জমাট রকম হল—প্রায় ফুল হাউস। কিন্তু কথাবার্তা প্রশ্নোত্তর বেশির ভাগই চাপা গলায় হওয়ায় এবং বিতর্কের ভাগটা কম থাকায় গোলমাল বেশি হল না। আমাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আমি পুকুরের ওপারে কামিনীতলায় বসে মাঝে মাঝে হাসির হর্রা শুনছিলাম আর অক্ষয়কে আমার এই নির্বাসনের জন্যে দায়ী করে মনে নির্বাণপ্রায় রাগের শিখাটিকে আবার পুষ্ট করে তুলছিলাম। 

প্রথম পর্ব শেষ হলে তাস পড়ল। নয়নতারা আমায় বাড়ি থেকে কী একটা আনতে বললে। এনে দিয়ে আমি দলের পাশে আমার জায়গাটিতে বসলাম। সুধা একবার আমার দিকে চেয়ে হেসে বললে, ছেলেটা কি গো? তাড়ালে যায় না। 

কে বললে, জাত-ই ওই রকম। এর পরে একবার ‘তু’ করলে হাঁটু ছেঁচে, রক্ত মাখামাখি হয়ে ছুটে যাবে। আহা— 

তাদের দান দেওয়ার মধ্যে হাসির হর্রা ছুটল। খানিকক্ষণ কাটল। 

নয়নতারার চোখের আর একটা বিশেষত্ব এই ছিল যে, নিচের দিকে চাইলে চোখের সুস্পষ্ট মসৃণ পাতা দুটি এমন নিরবশেষভাবে চোখ দুটিকে ঢেকে ফেলত যে, মনে হ’ত, যেন সে চোখ বুজে আছে। পরে পদ্যলেখা উপলক্ষে আমি এই জিনিসটিকে কিশলয়ে-ঢাকা কুঁড়ির সঙ্গে তুলনা করেছি। বেশিক্ষণ এইভাবে চিন্তা করলে মনে হ’ত যেন সে ঘুমুচ্ছে; কিন্তু তার চোখের গড়নই অপরের চোখে এই দৃষ্টিবিভ্রম ঘটাত বলে কেউ বড়-একটা টুকত না। সেদিন কিন্তু হাতে তাসের দিকে নজর রেখে প্রায় মিনিট দু-তিন ওরকম ভাবে থাকবার পর নয়নতারার মাথাটা হঠাৎ সামনে ঢুলে পড়ল। খনু বললে, ওমা, নয়ন, তুই যে সত্যিই ঘুমুচ্ছিস লা! আমরা ভাবছি— 

—নয়নতারা একেবারে হকচকিয়ে উঠল, প্রথমটা অপ্রতিভ ভাবে বললে, ধ্যাৎ, কই, যাঃ সঙ্গে সঙ্গে মুখটা বিরক্তিতে কুঞ্চিত করে বললে, না ভাই, সারারাত জাগিয়ে রাখা ভালো লাগে না। কবে যে যাবে—আপদ! 

এইটুকুই যথেষ্ট ছিল; আমার মধ্যেকার নাই—যে বীরকে তোমরা কঙ্কাবতীর সন্ধানে পাতালপুরীতে দেখে থাকবে প্রতিহিংসায় ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। আমি আপদ বিদায়ে একেবারে বদ্ধপরিকর হয়ে উঠলাম 

—সেদিন সন্ধের সময় জামার মধ্যে হাত গলাতে গিয়ে দুটি লুকোনো বিছুটি— ডগার সংস্পর্শে যন্ত্রণা, আর শ্বশুর-বাড়িতে সে যন্ত্রণা রাখবার ভদ্রতার মাঝে পড়ে অক্ষয় অস্থির হয়ে পায়চারি করলে খানিকটা। তারপরে বোধহয় ডাক ছেড়ে কাঁদবার সুবিধের জন্যে বেড়াতে যাওয়ার উদ্দেশ্য যেই জুতোয় পা ঢোকাবে—’উ’ করে একরকম চিৎকার করেই পা-টা বের করে নিলে—এক মুঠো শেয়াল-কাঁটায় পা-টা সজারুর মতো হয়ে উঠেছে। 

বাড়িতে একটা হই-হই পড়ে গিয়ে সকলে সাবধান হয়ে পড়ায় আর তখন কিছু নতুন উপদ্রব হল না, কিন্তু অক্ষয় সন্ধের পর বেরিয়ে যেই বাড়িতে ঢুকবে, অন্ধকারে একটা ঢিল বোঁ করে তার কানের কাছ দিয়ে বেরিয়ে গেল এবং চিৎকার করে রাঙচিতের বেড়া টপকাবার আগেই আর একটা সজোরে এসে তার মাথায় লাগল। 

সে সময় হাজার তল্লাশ করেও আততায়ীর সন্ধান পাওয়া গেল না বটে, কিন্তু তোমাদের বোধহয় বুঝতে বাকি নেই যে, সে মহাপুরুষটি কে! 

—তোমাদের যদি নিজের নিজের গায়ে হাত দিয়ে বলতে বলা হয় তো নিশ্চয় স্বীকার করবে যে, আজন্ম-কলিকাতাবাসীরা পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে দুটি জিনিসকে বেশি ভয় করে,—সাপ আর ভূত; আর তাদের বিশ্বাস, ওদিকে লিলুয়া আর এদিকে দমদমের পরে সমস্ত ভূভাগ এই দুই উপদ্রবে ঠাসা। অক্ষয় যখন নিঃসন্দেহ হল যে, এটা বাড়ির কারুর ঠাট্টা নয়, তখন তার এ সন্দেহ রইল না যে, সমস্ত ব্যাপারটা একেবারে ভৌতিক। সে রাতটা নিরুপায়ভাবে কোনও রকমে কাটালে এবং তার পরদিন দুপুরে—অর্থাৎ রাত্রি হবার এবং তার সঙ্গে সেই উৎকট রকম ঠাট্টাপ্রিয় অশরীরীর আবির্ভাব হওয়ার ঝাড়া পাঁচ-ছ ঘণ্টা পূর্বে সে বেচারি হাওড়া-মুখো গাড়িতে গিয়ে বসল। 

—সেদিন আমি ওদিকে যেতে পারিনি—শেতলাতলায় যাত্রার আসরের জন্যে কাগজের শেকল তৈরি করতে ধরে নিয়ে গেল। 

—তার পরের দিন কিছু সকালেই আমি বিজয়ী বীরের মতো গিয়ে নয়নতারাদের বাড়িতে উপস্থিত হলাম। সে নিশ্চয়ই সমস্ত রাত নিরুপদ্রবে ঘুমিয়ে এতক্ষণ উঠেছে। এইবার গিয়ে তার ত্রাণকর্তা যে কে, সেটা জানিয়ে বিস্ময়ে আহ্লাদে কৃতজ্ঞতায় তাকে অভিভূত করে ফেলতে হবে। 

—গিয়ে যা দেখলাম, তাতে আমার নিজেরই বিস্ময়ের সীমা রইল না। পুকুরঘাটের শেষ রানাটিতে মুখ ধোওয়ার জন্যে বাঁ হাতে খানিকটা ছাই নিয়ে নয়নতারা নিঝুম হয়ে বসে আছে। চুল উস্কখুস্ক, মুখটা খুব শুকনো, চোখ-দুটো ফুলোফুলো আর রাঙা। –আমি গিয়ে বসতে একবার ফিরে দেখলে, তারপর চিবুকটা হাঁটুর ওপরে রেখে চোখ নিচু করে বসে রইল। 

—প্রথমটা মনে হল, অক্ষয় সব আক্রোশ নয়নতারার ওপর মিটিয়ে গেছে। কী ভাবে যে একটা কথা জিজ্ঞেস করব ঠিক করে উঠতে পারছিলাম না। চেয়ে আছি, হঠাৎ? দেখি তার দু চোখ বেয়ে ঝরঝর করে জল নামল। আশ্চর্যের ভাবটা চাপতে না পেরে বলে উঠলাম, কাঁদছ যে তুমি? কাঁদছ কেন? 

যাঃ, কাঁদছি কোথায়?—বলে নয়নতারা আঁচল তুলে চোখ দুটো মুছে ফেললে। একবার, দুবার, তারপর বাঁধ-ভাঙা বন্যার মতো এত জোরে অশ্রু নামল যে, আর আঁচল সরাতে পারলে না, চোখ দুটো চেপে ধরে বসে রইল। একটু পরেই ফোঁপানির আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত শরীরটা দুলে দুলে উঠতে লাগল! 

—খানিকক্ষণ এইভাবে গেলে বেগটা যখন কমে এল, আঁচলের মধ্যে থেকেই কান্নার ভাঙা ভাঙা স্বরে বললে, অত কাকুতিমিনতি করে মিথ্যে অসুখের কথা লিখে নিয়ে এলাম শৈল, মার খেয়ে গেল! কে মারলে বল দিকিনি? কার কী করেছিল সে? নিরীহ, নির্দোষ মানুষ —

—আর বলতে পারলে না, ভেঙে পড়ল। 

—ঠিক সেই সময়টিতে নয়নতারার কান্নার মধ্যে বিনিয়ে-বিনিয়ে কথাগুলো শুনে এবং কতকটা নিজের অপরাধের জ্ঞানের জন্যেও আমিও কান্নাটা থামাতে পারলাম না বটে, কিন্তু সেই দিনই কোনও একটা সময় থেকে নয়নতারার এই রকম পক্ষপাতিত্বের জন্যে অক্ষয়ের উপর বিদ্বেষ আর হিংসার ভাবটা একেবারে উৎকট হয়ে উঠল। 

—ছেলেবেলার চিন্তাগুলো ঠিক গুছিয়ে মনে আসে না, অন্তত যা মনে আসত, তা এত দিনের ব্যবধান থেকে গুছিয়ে বলা যায় না। শুধু মনে পড়ছে এই পক্ষপাতিত্বের জন্যে—যেটা নিছক নয়নতারারই দোষ—আমি নয়নতারার ওপর না চটে চটলাম অক্ষয়ের ওপর। লোকটাকে যে নয়নতারা আসার জন্যে সত্যিই কাকুতিমিনতি করে লিখেছিল—প্ল্যাটফর্মে আছাড় খাওয়াবার অভিপ্রায়ে যে ডাকেনি, তাকে যে নয়নতারা নির্দোষ বলে—এই সব হল অক্ষয়ের অমার্জনীয় অপরাধ; আর সবচেয়ে বড় অপরাধ হল তার বিবাহ করাটা, যার জন্যে নয়ন তাকে কাকুতিমিনতি করে ডেকেছে, আর আমি অত কষ্ট করে তার মাথা ফাটালে তাকে নির্দোষ বলেছে, তার জন্যে চোখের জল ফেলেছে। 

শৈলেন চুপ করিল। তারাপদ প্রশ্ন করিল, তোমার গল্প শেষ হল নাকি? উপসংহার কোথায়? 

শৈলেন বলিল, ভালোবাসা তো গল্প নয় যে, উপসংহার থাকবে, বইয়ের দুটি মলাটের মধ্যে তার আদি-অন্ত মুড়ে রাখা যাবে! তবুও যদি ভালোবাসাকে গল্প—উপন্যাসের সঙ্গেই তুলনা করো তো বলা যায় তার উপসংহার নেই, মাত্র অধ্যায় আছে; সে কোনও একটি অনির্দিষ্ট সময়ে একবার আরম্ভ হয়, তারপর অধ্যায়ের পর অধ্যায় সৃষ্টি করে তার অফুরন্ত গতি— 

—সে সময়ের অধ্যায়টিই না হয় শেষ করো। 

সেটার শেষ ছিল একটা সামান্য চিঠি। একদিন নয়নতারা আমায় অক্ষয়ের নামে একটা চিঠি ডাকে ফেলে আসতে দিয়ে হঠাৎ থমকে মুখের দিকে চেয়ে বললে, হ্যাঁ রে, তুই চিঠি খুলে পড়িস নে তো? খবরদার! আর এই ৭৪।। দেওয়া রইল, পড়লে বুকে ব্যথা হবে। 

—আমার যে বুকে একটা ব্যথা ছিলই, নয়নতারা সে খবর রাখত না। 

—এর আগে কখনও কারুর চিঠি খুলিনি, কিন্তু সেদিন আমি পোস্ট-আপিসের রাস্তাটা একটু ঘুরে বাড়ি এলাম এবং একটা নির্জন জায়গা বেছে নিয়ে চিঠিটা খুললাম। 

৭৪।।-এর দিব্যিটা আমার হাতে হাতে ফলল। সে যে কী বিনিয়ে-বিনিয়ে লেখা চিঠি—কত ব্যাকুলতা, কত আদর, কত আশ্বাস, ফিরে আসবার জন্যে কত মাথার দিব্যি! এবার নয়নতারা তাকে বুকে করে রাখবে, যে শত্রুতা করেছে তার সমস্ত অত্যাচার নিজের সর্বাঙ্গে মেখে নেবে; অক্ষয় ফিরে আসুক, নয়নতারার চোখে ঘুম নেই—কেঁদে কেঁদে অন্ধ হয়েছে, এসে একবার দেখুক অক্ষয়, একবার দেখুক এসে তার অত আদরের নয়ন কী হয়ে গেছে—

—এত চায় সে অক্ষয়কে? ক্ষোভে, ঈর্ষায়, অসহায়তায় আমার বুকের মধ্যে একটা অসহ্য যন্ত্রণা ঠেলে উঠতে লাগল। সেদিন ঢিল কুড়োবার সময় কী করে একটা পুরোনো ভাঙা শাবল হাতে উঠেছিল। কী ভেবে সেইটেরই সদ্ব্যবহার করিনি। সেই আপশোশে ছটফট করতে লাগলাম। 

— বোধহয় সেদিন ঢিল ছোঁড়বার কথা মনে হওয়ার জন্যেই মনে পড়ে গেল, যে, অক্ষয় সমস্ত কাণ্ডটা ভৌতিক ভেবেই তাড়াতাড়ি পালিয়েছিল। আমার মাথায় একটা সুবুদ্ধি এসে জুটল। 

—আমি আস্তে আস্তে উঠে গিয়ে কালি-কলম নিয়ে এলাম এবং আমার লেখার খাতা থেকে খানিকটা কাগজ ছিঁড়ে খুব জোরে ঢিল ছুঁড়তে পারে এই রকম জবরদস্ত ভূতের হাতের উপযোগী মোটা মোটা অক্ষরে, চন্দ্রবিন্দু সংযুক্ত ভূতোচিত শুদ্ধ ভাষায় লিখলাম, খবরদার, এঁবার এঁলে এঁকেবারে ঘাঁড় মটকে তোর রক্ত খাব— এবং আমি যে ভূত, এটা প্রমাণ দিয়ে ভালো করে বিশ্বাস করাবার জন্যে জুড়ে দিলাম, আঁমি খামের মধ্যে ঢুকে সব পঁড়েছি। আঁমার সঁঙ্গে চালাকি? 

—তোমরা হাসছ? কিন্তু এর পরেই আমার অবস্থা অতিশয় করুণ হয়ে উঠল, কেন-না, এ ভূতের নামধাম পরিচয় বের করতে খুব বেশি রকম বিচক্ষণ রোজার দরকার হল না। তার ভূতপূর্ব কীর্তিও সব ধরা পড়ে গেল—ভূত-পূর্বই বলো কিংবা অদ্ভুতপূর্বই বলো…বৃষ্টিটা কি থেমে আসছে? 

শৈলেন আবার খানিকটা চুপ করিল। তারপর বলিল, এর কয়েক দিন পরে এসে বাবা আমায় বিদেশে তাঁর কর্মস্থানে নিয়ে গেলেন। তারপর আর নয়নতারার সঙ্গে দেখা নেই। 

তারাপদ বলিল, কিন্তু কী যেন অফুরন্ত অধ্যায়ের কথা বলছিলে? 

শৈলেন বাহিরের ম্রিয়মান বর্ষার বিলম্বিত মৃদঙ্গ কান পাতিয়া শুনিতেছিল আত্মসমাহিত ভাবে বলিল, হ্যাঁ, তবে একটু ভুল হয়েছিল,—অধ্যায় নয়, সর্গ, জীবনের পাতা একটির পর একটি পূর্ণ করে ভালোবাসার করুণ গাথা সর্গের পর সর্গ সৃষ্টি করে চলেছে… 

রাধানাথ বলিল, তুমি কবি, হিসেবের গদ্যকে নিশ্চয় এড়িয়ে চলো; তাই মনে করিয়ে দিচ্ছি, তোমার আট বৎসরের সময় নয়নতারার বয়স যদি পনেরো বৎসর ছিল তো তোমার এখন পঁয়ত্রিশ বৎসরে সে বিয়াল্লিশ বৎসর অতিক্রম করে… 

শৈলেন উঠিয়া বসিল, বলিল, ভুল বলছ তুমি,—নয়নতারার বয়স হয় না! আমার প্রেম তার স্ফুটনোন্মুখ যৌবনকে অমরত্ব দিয়েছে। তার পরের নয়নতারা— সে তো আমার জীবনে নেই। আমার নয়নতারা—এখনও সেই পুকুরঘাটটিতে সখীপরিবৃতা হয়ে বসে; রূপে রসে পূর্ণতায় উজ্জ্বল। তার কত দিনের কত কথা, ভঙ্গি, তার আশ্চর্য চোখের পরমাশ্চর্য চাউনির খণ্ড খণ্ড স্মৃতি আমার জীবনে এক—একটি অখণ্ড কাব্যের মধ্যে রূপ ধরে উঠেছে। যখন আমি থাকি প্ৰফুল্ল—ত্রিশ বৎসরের দীর্ঘ ব্যবধানের ওপারে দেখি নয়নতারা হাসিতে, কপট গাম্ভীর্যে কিংবা অকপট কৌতুকপ্রিয়তায় ঝলমল করছে; তার চিক্কণ চুলের নিচে, ঘোরালো গালের প্রান্তে পারসি মাকড়িটা চঞ্চল হয়ে উঠছে; আমি যখন থাকি মৌন বিমর্ষ, তখন বিকেলে নয়নতারার আকাশ ঘিরে বর্ষা নামে—রেলের ধারের ঘরটিতে মেঘের ওপর চোখ তুলে নয়নতারা নির্বাক হয়ে চেয়ে থাকে, মেঘবিলুপ্ত সান্ধ্য সূর্যের মতো কানের পারসি মাকড়ি কেশের মধ্যে ঢাকা, আমার দিকে ফেরানো গালটিতে একটা অশ্রুবিন্দু টলমল করছে… 

—আমি জীবনে আর কাউকেই চাইনি, আমার জীবনের চিত্রপটে নয়নতারাকে অবলুপ্ত করে আর কারুর ছবিই ফুটতে পায়নি। পনেরো বৎসরের অটুট যৌবনশ্রীতে প্রতিষ্ঠিত করে তারই ওপর নিবদ্ধ-দৃষ্টি আমি তাকে অতিক্রম করে আমার পঁয়ত্রিশ বৎসরে এসে পড়েছি—সূর্য যেমন যৌবনশ্যামলা পৃথিবীকে অতিক্রম করে অপরাহ্ণে হেলে পড়ে। আজকের এই বর্ষায় কি তোমরা কথাটা অবিশ্বাস করতে পারবে? 

তারাপদ বলিল, আমরা স্বয়ং তোমার বিশ্বাসের জন্যে ভাবিত হয়ে উঠছি— কেন-না, বর্ষাটা গেছে থেমে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *