বর্ধমান লোক্যাল

বর্ধমান লোক্যাল

কী আশ্চর্য! ঐ লোটা আজকেও আবার আমার কামরায় উঠেছে? লোকটার মতলব কী?

অদিতি মুহূর্তের জন্য লোকটাকে একবার দেখে নিয়েই দৃষ্টি ঘুরিয়ে নেয়। মনে মনে বলে, থাক, থাক, আর ভদ্দরলোকের ভান করতে হবে না। লোক্যাল ট্রেনে বা ট্রামেবাসে একটা পত্রপত্রিকা পড়লেই ভদ্দরলোক হওয়া যায় না। ওসব আমার খুব জানা আছে।

হাজার হোক, রাত আটটা কুড়ির লোক্যাল। অন্ধকারের মধ্যে দিয়েই ট্রেন ছুটছে। জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বিশেষ কিছুই দেখা যায় না। তবু অদিতি কয়েক মিনিট জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে।

কামরার মধ্যে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিয়েই অদিতি মনে মনে বলে, না, না, জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকা ঠিক নয়। আমাকে অন্যমনস্ক দেখে লোকটা যদি হঠাৎ আমার মুখ চেপে ধরে?

ও লুকিয়ে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলেই ঠিক করে, একটু সতর্ক থাকতে হবে। যদি লোকটা সত্যি কোনো বদ মতলবে এগিয়ে আসে, তাহলে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে লোকটাকে জুতাপেটা করতে হবে।

মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েও অদিতি যেন হোঁচট খায়।

কিন্তু,

যদি জুতাপেটা করার সুযোগ না পায়? তার আগেই ব্যাগটা ছিনিয়ে নিয়ে ট্রেন স্টেশনে ঢোকার মুখে লাফিয়ে পড়ে?

তাহলে কী করা যাবে?

তবু ভালো, অন্য কোনো ক্ষতি তো করল না।

আচ্ছা যদি লোকটা ছুরি বেব করে? যদি গলার কাছে ছুরি ধরে হাতের কঙ্কন আর ঘড়িটা খুলে দিতে বলে?

সঙ্গে সঙ্গে অদিতির কত ঘটনা মনে পড়ে যায়।

.

এই তো মাস তিনেক আগেকার কথা। বোধহয় এই আটটা কুড়ির ট্রেনেই শেফালীদি মেয়েকে নিয়ে চন্দননগর যাচ্ছিলেন। বর্ধমানের পর দুতিনটে স্টেশন পার হতেই একটা ভদ্রঘরের ছেলে হঠাৎ শেফালীর মুখের সামনে ছুরি ধরে বলল, চটপট আপনার ঘড়ি আর গলার হারটার খুলে দিন।

ছেলেটার কাণ্ড দেখে শেফালীদি ভয়ে আতঙ্কে কিছু বলতে গিয়েও মুখ দিয়ে কিছু শব্দ বের করতে পারেন না।

ছেলেটা খ্যাপা কুকুরের মতো হুঙ্কার দিয়ে শেফালীদির মেয়েকে বলল, কী রে ছুঁড়ি গায়ে হাত না দিলে কি খুলতে পারছিস না?

আঠারো বছরের মেয়েটা ভয়ে ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠতেই শেফালীদি আর একটুও মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে নিজের ঘড়ি আর হার খুলতেখুলতেই মেয়েকে বললেন, নে রে চটপট খুলে দে।

ছেলেটা সবকিছু পকেটে পুরে অন্ধকারের মধ্যেই পরের স্টেশনে নেমে গেল। কামরায় যে তিনচারজন লোক ছিল, তারা টু শব্দটি পর্যন্ত করল না।

শেফালীদি বলছিলেন, তোমরা ভাবতে পারবেনা ছেলেটাকে দেখতে কি সুন্দর। অত্যন্ত ভদ্রঘরের ছেলে না হলে অত সুন্দর দেখতে হতে পারে না।

.

আবার অদিতি মুহূর্তের জন্য লোকটাকে দেখে নিয়েই মনে মনে বলে, এই হতভাগাকে দেখতেও বেশ সুন্দর। যেমন গায়ের রঙ, সেইরকমই চোখমুখ। দেখে তো মনে হয়, উনি অত্যন্ত ভদ্রঘরের ছেলে কিন্তু দেখতে সুন্দর হলেই কী স্বভাবচরিত্রও ভালো হয়?

অত্যন্ত দুশ্চিন্তার মধ্যেও ও একটু চাপা হাসি হাসে।

ওরে বাপু, তোমার মতলব কী আমি বুঝতে পারিনি? যদি অত সাধুই হবে, তাহলে ঠিক পর পর দুসপ্তাহ আমার কামরাতেই উঠবে কেন? এত বড় টেনে আর কোথাও উঠলে না কেন?

দৃষ্টিটা কামরার চারপাশে ঘুরিয়ে নিতেই অদিতি দেখে, সেই দুটো লোক, এখনও ব্যাগ মাথায় দিয়ে ঘুমুচ্ছে। ভগবান জানেন, ওরা কোথায় যাবে। তবে দেখে মনে হয়, বোধহয় সারাদিন পরিশ্রম করে অত্যন্ত ক্লান্ত হয়েই ঘুমুচ্ছে। নির্ঘাৎ ছোটখাটো ব্যবসাদার। এই ধরনের রাত্রের ট্রেনে নিশ্চয়ই নিয়মিত যাতায়াত করে। তা না হলে অত নিশ্চিন্তে কি ঘুমানো যায়?

হঠাৎ ট্রেনটা থামতেই ও জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকায়। হা ভগবান! এতক্ষণে দেবীপুর এলো? আমি তো ভেবেছিলাম, পাঁচসাত মিনিটের মধ্যে ব্যান্ডেল আসবে। একজন বৃদ্ধবৃদ্ধা এই কামরায় উঠলেন। যাক, তাও ভালো।

একবার মনে হল, ওদের জিজ্ঞেস করি, আপনারা কোথায় যাবেন? না, না, কী দরকার ঐ হতভাগা ঠিক মনে করবে, আমি ভয় পেয়েছি। ওকে কিছুতেই বুঝতে দেব না, আমি একটু চিন্তিত, আতঙ্কিত।

কী আশ্চর্য! ঐ বুড়োবুড়ি পরের স্টেশন বৈচিতেই নেমে গেল? আহাহা! কী দরকার ছিল এই পাঁচসাত মিনিটের জন্য এই কামরায় ওঠার?

রাগে দুঃখে দুশ্চিন্তায় অদিতি যেন নিজের উপরই রাগ করে। খেয়ালই করে না, কখন কোথায় ট্রেন থামছে।

হঠাৎ অল্পবয়সী এক দম্পতি কামরায় উঠতেই অদিতির খেয়াল হল, পাণ্ডুয়া ছাড়ল।

এদের পোশাকপরিচ্ছদ হাবভাব দেখে তো মনে হচ্ছে, এরা গ্রামগঞ্জের লোক না, নিশ্চয়ই কলকাতায় থাকে। বোধহয় কোনো আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে নেমন্তন্ন খেয়ে ফিরছে। যাক, ভালোই হল। লোকটার বদ মতলব থাকলেও ওদের সামনে বোধহয় কিছু করতে সাহস হবে না।

কিন্তু…

ছুরি দেখে যদি ওরাও ভয় পায়?

তবে ওরা দুজনে তো বেশ খানিকটা দূরে বসে আছে। ওদের দুজনকে আর আমাকে একসঙ্গে ছুরি দেখাতে পারবেনা! ওদের সামনে ছুরি বের করলেই আমি অ্যালার্ম চেন… না, না, না তো হবে না। হতচ্ছাড়া রেল কোম্পানি বোধহয় লোক্যাল ট্রেনে অ্যালার্ম টেনের কারবারই তুলে দিয়েছে।

তাহলে!

যা থাকে কপালে, আমি ঠিক ট্রেন থেকে লাফ দেব। তারপর যা হয় হোক।

যে দুটো লোক এতক্ষণ অঘোরে ঘুমুচ্ছিল, তারা হঠাৎ উঠে বসেই একবার বাইরের দিক দেখে নিয়েই চুপ করে বসে থাকে। পরের স্টেশনে ট্রেন থামতেই ওরা নেমে যায়। আট-দশ মিনিট পরে মগরায় ঐ দম্পতি নেমে যেতেই অদিতির মুখ শুকিয়ে যায়। মনে মনে ভগবানের নাম স্মরণ করলেও অজানা বিপদের চিন্তায় ও শিউরে ওঠে। এখন ওকে একা পেয়ে যদি লোকটা ওর গায়ে হাত দেয়? যদি ওর সর্বনাশ করে?

ওরা দুজন ছাড়া কামরায় আর কেউ নেই। বাধা দেবারও কেউ নেই; চক্ষুলজ্জারও কোন ঝামেলা নেই।

অদিতি ভেবে কূলকিনারা পায় না।

লোকটাকে সাক্ষাৎ যমদূত মনে হয়। ওর মুখ দেখলে গা জ্বলে যাবে কিন্তু তবু একবার ওর দিকে না তাকিয়েও পারে না।

লোকটা বই পড়ছে?

ওকে দেখে অদিতির হাসি পায়। মনে মনে বলে, তোমার ভণ্ডামিতে আমি ভুলছি না। তোমার যদি কোনো বদ মতলবই না থাকে, তাহলে আমাকে দেখে এই কামরায় উঠেছিলে কেন?

এইসব আকাশপাতাল ভাবতে ভাবতেই আটটা কুড়ির লোক্যাল ব্যান্ডেল পেরিয়ে গেল। দেখতে দেখতে হুগলি-চুঁচুড়া-চন্দননগরও চলে যায়। তারপর আরো কয়েকটা স্টেশন পার হয়ে শ্রীরামপুর-রিষড়া ছাড়তেই অদিতি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।

কোন্নগরে ট্রেন থামতেই অদিতি প্রায় লাফ দিয়ে নেমে যায়।

ও প্ল্যাটফর্মে নেমে পিছন দিকে ফিরে দেখে, ঐ লোকটা ওর দিকে তাকিয়ে আছে।

.

চার ভাইবোনের মধ্যে চাইতে বড় অদিতি। ও যখন বি এ পড়ে তখনই একদিন ওর স্বামীকে বললেন, ছেলেমেয়েরা বড় হচ্ছে। বড় মেয়েকে যদি এম এ পড়াও তাহলে তিনচার বছরের মধ্যে ওর বিয়ে দিতে হবে। ততদিনে তো আবার একটা মেয়ের বিয়ের চেষ্টা করতে হবে। তাই বলছিলাম, এ বছরের মধ্যেই ঘরদোর পাকা করে নাও।

সুখেন্দুবাবু চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে একটু হেসে বললেন, পরশু দিনই অফিসে লোন এর জন্য দরখাস্ত করেছি।

পুরো বাড়িটাই শেষ করবে তো?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, একবার যখন ধরব, তখন পুরোটাই শেষ করব। সুখেন্দুবাবু একটু থেমে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, এই টিনের বাড়ি দেখলে কী কোনো ভালো পরিবারের ছেলে তোমার মেয়েদের বিয়ে করতে রাজি হবে?

যাই হোক, সত্যি সত্যি মাস খানেকের মধ্যেই বাড়ি তৈরি শুরু হল। সকালবিকাল লরি বোঝাই ইটবালিসিমেন্টপাথর আসে।দশ বারোজন মিস্ত্রি আর পাঁচছজন সাগরেদ সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত কাজ করে। মাস খানেকের মধ্যেই জানলাদরজার ফ্রেম বসানো হয়ে গেল। কয়েক দিনের মধ্যেই বাথরুম পায়খানার সব সরঞ্জাম হাজির।

ছাদ ঢালাইএর ঠিক দিন দশেক আগে সুখেন্দুবাবু স্ত্রীকে বললেন, যা ভেবেছিলাম, তার চাইতে অনেক বেশি খরচ হয়ে গেল। এখন হাতে যা আছে, তা দিয়ে ছাদ ঢালাই হবে না।

তোমার হাতে একেবারেই কিছু নেই?

আছে কিন্তু ছাদ ঢালাইএর জন্য আরো সাতআট হাজার লাগবে তার উপর দোতলার ঘর বাথরুম ছাড়াও বাড়িটার একটা পাঁচিলও তো দিতে হবে।

এখন কী হবে?

কী আর হবে? পি এফ থেকে লোন নেব। সুখেন্দুবাবু একটু হেসে বলেন, একবার যখন শুরু করেছি, তখন শেষ না করে ছাড়ছি না।

ছাদ ঢালাই হতেনাহতেই দোতলার ঘর বাথরুমের সব মালমসলা জিনিসপত্র এসে গেল।

এবার সুখেন্দুবাবু বললেন, সামনের সপ্তাহেই বাথরুমের কাজ শুরু হবে। তারপর একতলার প্লাসটার আর রংটং হতে না হতেই দোতলায় ঘরদোর তৈরি হয়ে যাবে।

এভাবে বাড়ি তৈরি হচ্ছে দেখে সবাই খুশি।

ঠিক তিন দিন পর কারখানা লকআউট হয়ে গেল। সারা পরিবারের মাথায় যেন বজ্রাঘাত পড়ল।

.

ঐ কয়েকটা বছরের কথা মনে পড়লে এখনও ওরা সবাই শিউরে ওঠে। হাজার সমস্যার মধ্যেও অদিতি বি এ পাস করেই বি এড করল। তারপর কোন্নগরেই একটা প্রাইমারি স্কুলে বছর খানেক চাকরি করার পর শেষ পর্যন্ত বর্ধমান শ্ৰী বিদ্যামন্দিরে চাকরিটা জুটে গেল। যাতায়াতে পরিশ্রম থাকলেও মাইনে ভালো।

এসব বেশ কয়েক বছর আগেকার কথা! সুখেন্দুবাবুর কারখানা এখনও খোলেনি কিন্তু অদিতি নিজে বিয়ে না করলেও ছোট দুবোনের বিয়ে দিয়েছে। কপালগুণে দুটো ভগ্নীপতি বেশ ভালো। আরতির স্বামী সাধারণ গ্র্যাজুয়েট হলেও আইসিআইতে ভালোই মাইনে পায়। আরতি স্কুলে চাকরি করে প্রত্যেক মাসে মাকে শ চারেক টাকা দেয়। ছোট ভগ্নীপতি কোল ইন্ডিয়ার এঞ্জিনিয়ার। খুবই ভালো মাইনে পায়। তাই ছোট বোন নিজে কোন কাজকর্ম না করলেও প্রত্যেক মাসে মাকে আড়াই শ টাকা পাঠায়। ছোট ভাই বি এস-সি পড়ছে। ওকে একটু দাঁড় করাতে পারলেই অদিতি একটু নিশ্চিন্ত হতে পারে।

তাছাড়া দোতলায় ঘরদোর তৈরি না হলেও আরবি বিয়ের আগেই একতলার সব কাজ হয়ে যায়। আরতির বিয়ের পর একটা ঘর ভাড়া দিয়ে মাসে মাসে তিন শ টাকা আসছে। তা দিয়ে অন্তত গ্যাস আর ইলেকট্রিসিটির খরচ মিটে যায়।

সুখেন্দুবাবু কিছু না বললেও তার স্ত্রী মাঝেমাঝেই বড় মেয়েকে বলেন, তুই যে কবে বিয়েথা করে সংসারি হবি, সেই চিন্তাতেই আমি পাগল হয়ে যাই। অদিতি হাসতে হাসতে বলে, তোমার সতেরো বছরে বিয়ে হয়েছিল বলে আজকাল আর তা হয় না।

তা ঠিক কিন্তু বাইশতেইশের মধ্যেই তো আর দুজনের বিয়ে হয়ে গেল। এদিকে সামনের অঘ্রানেই তো তুই আঠাশ পূর্ণ করে ঊনত্রিশে পড়বি।

আজকাল আঠাশঊনত্রিশেই মেয়েরা বুড়ি হয় না। তাছাড়া তিরিশবত্রিশের আগে অনেক ছেলেই বিয়ে করতে চায় না। একটু সেট না হয়ে কেউই আজকাল বিয়ে করবে না।

এইভাবেই দিন চলে।

.

আবার কদিন পর ঐ আটটা কুড়ির ট্রেনে ঠিক ওরই কামরায় ঐ লোকটাকে দেখে অদিতি চমকে ওঠে। দুচারজন যাত্রী ওঠানামা করেন কিন্তু কামরায় শুধু ওরা দুজনেই থাকে। অদিতি সতর্ক না থাকলেও সন্ত্রস্ত না হয়ে পারে না। আগের দিনের মতোই লোকটা সব সময় বইপত্তর পড়ে। না, সেদিনও কোনো ঘটনা ঘটে না।

অদিতির স্কুলের পর এক ছাত্রীর বাড়িতে কয়েকটি মেয়েকে পড়ায়। তাই সাড়ে সাতটার ট্রেন ও কিছুতেই ধরতে পারে না। এই আটটা কুড়ির ট্রেনেই ও রোজ বাড়ি যায় এবং প্রত্যেক দিন গার্ডের ঠিক পাশের কামরায় বসে।

না, অদিতি লোকটাকে রোজ দেখতে পায় না। আস্তে আস্তে খেয়াল করল, লোকটা সপ্তাহে তিন দিন যায়। তাছাড়া কয়েক মাস ধরে দেখার পর অদিতি মনে মনে স্বীকার করে, লোকটা চোরডাকাত বা ছিনতাইবাজ নয়। যদি লোকটা খারাপ হত, তাহলে অনেক কিছুই করতে পারতো। কম দিন তো সুযোগ পায়নি!

তাছাড়া লোকটা শুধু পড়ে। আশেপাশে লোকজন থাকলেও কারুর সঙ্গেই কোনো কথাবার্তা বলে না

আচ্ছা ঐ লোকটা কি বর্ধমানের কোনো কলেজে পড়ায়? না কি বর্ধমানেই কোনো অফিসে চাকরি করে?

এইভাবেই ক টা মাস কেটে গেল। গরমের ছুটিতে স্কুল বন্ধ হবার পর বাড়িতে বসে বসেই অদিতি ঐ লোকটার কথা ভাবে। না ভেবে পারে না কোনো কোনোদিন লোকটাকে দেখতেও ইচ্ছে করে।

মাঝে মাঝে অদিতি নিজেকেই ধিক্কায় দেয়। ছি! ছি! একটা নিছক ভদ্রলোককে গুণ্ডা বদমাইশ ভেবেছিলাম।

মে মাসের একেবারে শেষের দিকে আবার স্কুল খোলে। অদিতি আবার আগের মতো আটটা কুড়ির ট্রেনে ফিরতে শুরু করে, কিন্তু না, ঐ লোকটাকে আর ট্রেনের কামরায় দেখতে পায় না। ও মনে মনে অস্বস্তিবোধ করে। বোধহয় একটু অসহায়ও বোধ করে। হাজার হোক, রাত্রের ট্রেনে কামরায় একজন ভদ্রলোক থাকলে অনেক নিশ্চিন্তে থাকা যায়।

স্কুল খোলার পর পনরোকুড়ি দিনের মধ্যে লোকটার দেখা না পেয়ে অদিতি যেন মনে মনে ছটফট করে। প্রত্যেক দিন কত প্রত্যাশা নিয়ে ট্রেন ধরতে এসে হতাশ হওয়া যেন আর সহ্য করতে পারে না।

দেখতে দেখতে জুন মাসও শেষ হলো।

কদিন বৃষ্টির পর সেদিন আকাশে এক টুকরোও মেঘ নেই। রোদ্দুরে ঝলমল করছে চারদিক। অত রোদ্র দেখে অদিতি আর ছাতি নিয়ে বেরোয় না। স্কুল ছুটির পরও আকাশে বিশেষ মেঘ দেখে না কিন্তু ছাত্রীদের পড়িয়ে স্টেশনে রওনা হবার সময় দেখল সারা আকাশ কালো মেঘে ভরে গেছে। মনে করে, বেশি রাত্তিরের আগে বৃষ্টি হবে না।

প্রতিদিনের অভ্যাসমতো শেষ কামরায় উঠেই অদিতি ঐ লোকটাকে কোনোর দিকে বসে থাকতে দেখেই একটু হাসে। হঠাৎ মনে হয়, ঐ লোকটার সামনের সিটে বসে জিজ্ঞেস করে, এতদিন দেখিনি যে? কিন্তু না, ও বেশ খানিকটা দূরেই বসে।

আরো দুচারজন যাত্রী উঠলেন। ট্রেন ছাড়ল। কিন্তু দুএকটা স্টেশন পার হতেই শুরু হল তুমুল বৃষ্টি! সব জানলাগুলো ভালো ছিলনা। তাই যাত্রীরা বাধ্য হয়েই কামরার একদিকে মাঝামাঝি এসে বসেন। ট্রেন এগিয়ে চলে। যাত্রীরা ওঠানামা করেন কিন্তু বৃষ্টির বেগ আরো বাড়ে। ছাতি না আনার জন্য অদিতি মনে মনে অনুশোচনা করে।

দেখতে দেখতে ট্রেন শ্রীরামপুর এসে গেল। অদিতি শাড়ির আঁচল কোমরে খুঁজে নেয়। হাতের ব্যাগটা বগলের তলায় চেপে ধরে।

এই ছাতাটা নিন।

মুহূর্তের জন্য অদিতি বাইরের দিকে তাকিয়েছিল। দৃষ্টিটা ঘুরিয়ে আনতেই ঐ লোকটাকে সামনে দেখে অবাক হয়ে যায়।

ঐ লোকটা আবার বলে, এই ছাতাটা রাখুন। তা না হলে একেবারে ভিজে যাবেন।

কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে অদিতি বলে, না, না, ছাতির দরকার নেই। আমি দৌড়ে রিকশায় উঠে যাব।

ঐ লোকটা একটু হেসে বলে, ট্রেন থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে একেবারে ভিজে যাবেন।

আমি ছাতি নিলে আপনি কী করবেন?

আমি পুরুষ মানুষ। আমি ভিজলে ক্ষতি নেই কিন্তু কাপড়চোপড় ভিজে গেলে মেয়েদের অনেক অসুবিধে। তাছাড়া রাস্তাঘাটের লোকজন এমন বিশ্রীভাবে চেয়ে থাকে যে…

অদিতি ওর হাত থেকে ছাতিটা নিতেনিতেই রিষড়া পার হয়। ও উঠে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে এগুতে এগুতে জিজ্ঞেস করে, ছাতিটা কবে ফেরত দেব?

ঐ লোকটা একটু হেসে জবাব দেয়, ছাতিটা ফেরত না দিলেও ক্ষতি নেই। তবে পরশু দিনই আবার দেখা হবে।

সেদিন সারারাত অদিতি বোধহয় শুধু স্বপ্ন দেখে।

মাঝখানের দিনটাকে যেন অসহ্য মনে হয়। পরের দিন অদিতি অন্য দিনের তুলনায় একটু আগেই স্টেশনে এসে শেষ কামবার এক কোণায় বসে। ট্রেন ছাড়ার মিনিট খানেক আগে ওকে উঠতে দেখেই অদিতি বলে, এদিকে আসুন।

পাশে না, ঠিক সামনে উনি বসতেই অদিতি ছাতাটা ফেরত দিয়ে বলে সেদিন আপনি। ছাতা না দিলে সত্যি বিপদে পড়তাম। স্টেশনে একটা রিকশাও ছিল না।

সেই শুরু।

তারপর এই রাত আটটা কুড়ির লোক্যালে সপ্তাহে তিনদিন একসঙ্গে যেতেযেতেই আলাপ-পরিচয়-ঘনিষ্ঠতা।

.

সামনের রবিবার কি তুমি ব্যস্ত? অদিতি প্রশ্ন করে।

কেন? কোনো দরকার আছে?

বাবামা প্রায় রোজই বলেন, তোমাকে নিয়ে যেতে। অদিতি একটু থেমে বলে, রবিবার বিশেষ কোনো কাজ না থাকলে সকালের দিকে চলে এসো। সারাদিন একসঙ্গে কাটানো যাবে।

হ্যাঁ, আসব।

রবিবার কোন্নগরের নবগ্রামে অদিতিদের বাড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় বারোটা হয়ে গেল। ওকে দেখেই অদিতি জিজ্ঞেস করে, এত দেরি হল?

সকালে বাবা বললেন, পিসিমাকে নিয়ে একবার ডাক্তাবের কাছে যেতে হবে।

কেন, পিসিমার আবার কী হলো?

হাইপ্রেসারের রুগী…

কিন্তু পিসিমার মতো হাসি খুশি মানুষের তো হাই প্রেসার থাকা উচিত না। অদিতি একবাব নিঃশ্বাস নিযেই বলে, যাই হোক, তাই বলে এত দেরি?

ডাক্তারের কাছ থেকে এসেই দেখি, ছোট্ট ভগ্নীপতি এসেছে। হাজার হোক, একেবারেই নতুন জামাই। তাই…

সুখেন্দুবাবু বারান্দায় দাঁড়িয়েই মেয়েকে বলে, ওকে ঘরে এনে বসতে দে। তারপর কথা বলিস।

অদিতি ওকে নিয়ে কয়েক পা এগুতেই ওর মা সামনে এসে দাঁড়ান।

মা, এই হচ্ছে সার্থক। অদিতি খুশির হাসি লুকিয়ে বলে, থিসিস জমা দিয়ে দিয়েছে। সুতরাং ক দিন পরই ইনি ডক্টর সার্থক চৌধুরী হয়ে যাবেন।

অদিতির মা বলেন, এই ছেলে যদি ডক্টরেট না হয়, তাহলে আর কে হবে?

সুখেন্দুবাবুও বারান্দা থেকে নেমে এসে পাশে দাঁড়ান। সার্থক ওদের দুজনকে প্রণাম করে।

সুখেন্দুবাবু ওর মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করে বলেন, দীর্ঘজীবী হও বাবা।

অদিতি সাৰ্থককে নিয়ে ঘরে যাবার পরপরই অদিতির মা এসে জিজ্ঞেস করেন, বাবা, তুমি কি চা খাবে? না কি এখনই খেয়ে নেবে?

না, মাসিমা, এখনই খাবো না। পিসিমা এত লুচি খাইয়ে দিয়েছে যে

এখন চা খেতে তো আপত্তি নেই?

না, না, চা খেতে আবার আপত্তি কী?

সবাই মিলে চা খেতে খেতে গল্পগুজব হয়।

অদিতি হাসতে হাসতে বলে, জানো মা, পিসিমা এখনও ওকে ভাত মেখে দেন।

উনিও একটু হেসে বলেন, তাই নাকি?

সার্থক বলে, পিসিমার ধারণা, এখনও আমি ছোট্ট বাচ্চা আছি। ও একটু থেমে একটু থেমে একটু হেসে বলে, তাছাড়া আমারও এমন অভ্যাস হয়ে গেছে যে উনি মেখে না দিলে আমিও ঠিক খেয়ে তৃপ্তি পাই না।

তোমার পিসিমার রান্না খেয়ে তো আমার মেয়ে মুগ্ধ হয়ে গেছে।

হ্যাঁ, পিসিমা সত্যি খুব ভালো রান্না করেন। তাছাড়া কত রকমের যে খাবারদাবার বানাতে জানেন, তার ঠিকঠিকানা নেই। সার্থক একটু থেমে বলে, বাবা মাঝেমাঝেই হাসতে হাসতে পিসিমাকে বলেন, ছোড়দি, তোমার আচার তৈরির জন্য সারাজীবন যা ব্যয় হল, তা দিয়ে স্বচ্ছন্দে সল্টলেকে একটা দোতলা বাড়ি তৈরি করতে পারতাম।

ওর কথা শুনে সবাই হাসেন।

সুখেন্দুবাবু জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কলকাতায় এত টিউটোরিয়াল হোম থাকতে বর্ধমানে পড়াও কেন? আমাদের মণীন্দ্র কলেজের মর্নিং সেকশনের একজন অধ্যাপক রিটায়ার করার পর বর্ধমানে টিউটোরিয়াল হোম খুলেছেন। উনি অনুরোধ করেছিলেন বলেই…

কিন্তু সকালে কলেজে পড়িয়ে বিকেলে আবার বর্ধমানে গিয়ে পড়াতে তো যথেষ্ট পরিশ্রম হয়।

না, তেমন কিছু না। দশটার মধ্যেই কলেজের ক্লাস শেষ হয়ে যায় আর বর্ধমান যাই পৌনে তিনটের ট্রেনে।

রিসার্চ করার সময় তো তোমাকে অনেক খাটতে হত।

হ্যাঁ, তখন একটু বেশি পরিশ্রম করতে হলেও বর্ধমানে যাই তো সপ্তাহে তিন দিন। খেতে বসেও নানা কথা হয়।

সুখেন্দুবাবু বললেন, আমরা স্বামীস্ত্রী একদিন তোমার বাবার সঙ্গে দেখা করতে যাব ভাবছি।

হ্যাঁ, আসুন। বাবা আর পিসিমা তো কতদিনই অদিতিকে বলছেন, আপনাদের নিয়ে যেতে

সুখেন্দুবাবুর স্ত্রী বললেন, না, না, এবার আমরা সত্যি যাবো। ওঁদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে একটা শুভদিন ঠিক করা দরকার।

সন্ধের দিকে বিদায় নেবার আগে সার্থক অদিতিকে জিজ্ঞেস করে, শেষ পর্যন্ত একটা গুণ্ডা-বদমাইশের সঙ্গে তোমার বিয়ে হবে?

এর চাইতে আর বেটার কোয়ালিফায়েড গুণ্ডা যখন পাওয়া গেল না, তখন একেই বিয়ে করতে হবে। আমার কপালই এমন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *