কংগ্রেস ভুল করেছে—এমনি একটা চীৎকার কিছুদিন ধরে শুনছি। এই কোলাহলের মধ্যে সত্য বস্তু আছে কতটুকু, তার বিচার কিন্তু হয়নি।
নিজে আমি কোনদিনই হঠাৎ কোন বিষয়ে ধারণা গড়ে নিতে পারিনে। যারা জোর গলায় প্রচার করে যে, তাদের দাবীই প্রবল, সহজে তাদের কথাও আমি স্বীকার করে নিইনে। তাই কংগ্রেসের বিরুদ্ধে এই যুক্তিহীন নিন্দাপ্রচার আমার পক্ষে মেনে নেওয়া কঠিন।
যিনি এই নব-আন্দোলনের পুরোভাগে রয়েছেন, তাঁকে আমি একনিষ্ঠ প্রবীণ কর্মী হিসেবে শ্রদ্ধা করি; দেশের রাজনৈতিক সাধনার ইতিহাসে দান তাঁর কম বলেও মনে করিনে। কিন্তু দেশের প্রতি দুঃখবোধ তাঁর কংগ্রেসের চেয়েও বেশী, এ কথা প্রমাণের জন্য নূতন কোন দল গঠনের প্রয়োজন বোধ করি ছিল না। কংগ্রেস দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, কংগ্রেস চিরকাল লড়াই করে এসেছে সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির বিরুদ্ধে। আজ তাকে ছোট প্রমাণ করবার চেষ্টায় ব্যক্তিগত গৌরব কারও কিছুমাত্র বেড়েছে কিনা জানিনে, কিন্তু দেশের গৌরব বুঝি এতটুকুও বাড়েনি।
দেশসেবা জিনিসটা যতদিন ধর্ম হয়ে না দাঁড়ায়, ততদিন তার মধ্যে খানিকটা ফাঁকি থেকে যায়। এ কথা আমি প্রতিদিন মর্মে মর্মে অনুভব করি। আবার ধর্ম যখন দেশের মাথা ছাড়িয়ে ওঠে, তখনও ঘটে বিপদ। মহাত্মা জানেন এবং ওয়ার্কিং কমিটিও জানেন যে, ভুল তাঁরা করেন নি। মালব্যজী এবং অ্যানের বিরুদ্ধাচরণও মহাত্মাকে বিচলিত করেনি।
সুতরাং তিনি যদি কংগ্রেসের সম্পর্ক ত্যাগই করেন, তার সঙ্গে এ গোলযোগের কোন সম্বন্ধ থাকবে না। তাঁর আসল ভয় সোশিয়েলিজম্কে। তাঁকে ঘিরে রয়েছেন ধনিকরা, ব্যবসায়ীরা। সমাজতান্ত্রিকদের তিনি গ্রহণ করবেন কি করে? এইখানে মহাত্মার দুর্বলতা অস্বীকার করা চলে না।
একটা কথা আমি জানি যে, বাঙলাদেশের মুসলমানরাও ‘জয়েন্ট ইলেক্টোরেট’ চাইতে শুরু করেছেন। তা না হলে গলদ কোথায়, তা তাঁরা ভাল করেই জানেন। এ কথা ভুললে চলবে না যে, অধিকাংশ ধনী মুসলমানই নায়েব, গোমস্তা, উকিল, ডাক্তার হিসেবে স্বজাতির চেয়ে হিন্দুদের বিশ্বাস করেন বেশী। সঙ্গে সঙ্গে এও আমি বলি যে, প্রত্যেক হিন্দুই মনেপ্রাণে ন্যাশন্যালিস্ট। ধর্মবিশ্বাসেও তারা কারও হতে ছোট নয়। তাদের বেদ, তাদের উপনিষৎ, বহু মানুষের বহু তপস্যার ফল। তপস্যার মানেই হলো চিন্তা। বহুজনের বহুতর চিন্তার ফলে যে ধর্ম গড়ে উঠেছে, আইন-সভায় গুটিকতক আসন কম হবার আশঙ্কায়, তাকে সর্বনাশের ভয় দেখাবার প্রয়োজন বোধ করি ছিল না। (‘ নাগরিক,’ শারদীয় সংখ্যা, ১৩৪১).