বর্তমান ভারতে ধর্মের প্রাসঙ্গিকতা
বর্তমান ভারতে ধর্মের প্রাসঙ্গিকতা সম্বন্ধে আলোচনা করবার আগে সাধারণ ভাবে ধর্ম সম্বন্ধে দু’-চার কথা বলে নেওয়ার প্রয়োজন আছে মনে হয়। পণ্ডিতেরা বলেন, ধর্মের উদ্ভব দু’টি উৎস থেকে: ভয় ও বিশ্বাস। মানুষের ইতিহাসের আদি পর্বে প্রকৃতির নানা দুর্যোগ— বন্যা খরা, ভূমিকম্প, দাবানল, সাপ, বাঘ ইত্যাদি হিংস্র জীব, মহামারী, খাদ্যাভাব, গোষ্ঠী ও কৌম-যুদ্ধ ইত্যাদি নানা বিরুদ্ধ পরিবেশের মধ্যে তদানীন্তন মানুষ যথার্থ কারণেই অসহায় বোধ করত; সত্যিই সে দিন সে অসহায় ছিল। প্রকৃতির ওপরে তার কোনও আধিপত্য ছিল না, অথচ প্রকৃতির সব খেয়ালখুশিতে সে নিয়তই বিপর্যস্ত হত। প্রথম বৃত্তি ছিল ফলমূল পেড়ে খাওয়া, তার পরে শিকার, তার পরে পশুপালন এবং ব্রোঞ্জ যুগে কৃষি— এই ছিল তার খাদ্য সংস্থানের ইতিহাস; এ দিক থেকেও অনাহারের আতঙ্ক তার কাছে অত্যন্ত বাস্তব ছিল। গাছের থেকে গুহায়, জঙ্গলে, তার পরে কুঁড়েঘর এই ছিল তার আশ্রয়; নিরাপদও নয়, আরামজনক তো নয়ই। কাজেই সব মিলে পরিবেশ ছিল প্রতিকূল এবং আগুন আবিষ্কারের পরেও পরিবেশ সম্পর্কে তার আতঙ্কের যথেষ্ট বাস্তব কারণ ছিল। পৃথিবীতে মানবশিশু হল সবচেয়ে অসহায় জীব, জীবজগতে মানুষ যেন অনাহূত, অবাঞ্ছিত, অতিথি। অথচ চারদিকে তাকিয়ে তার বিস্ময়ের অবধি ছিল না, মাথার ওপরে দিনে প্রজ্বলন্ত সূর্য, রাত্রে অগণ্য তারা, চাঁদের কলাক্ষয় ও কলাবৃদ্ধি, প্রতিদিনের সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আকাশের প্রকাণ্ড জ্যোতিলীলা, কত হাজার রকমের গাছ, লতা, ফুল, ফল, কত অগণ্য শ্রেণির জীবজন্তু, সরীসৃপ, পাখি নানা রকম ডাক জন্তুদের, পাখির গানে চিত্তের বিহ্বলতা। দিনের পরে রাত, শীতের পরে বসন্ত, গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্তের ঋতুবৈচিত্র্যে প্রকৃতিতে কত রং, কত গন্ধ কত রবের সমারোহ। দেশেশুনে বিস্ময় আর ফুরোয় না। কেউ কি কোথাও থেকে এ সব নির্মাণ করে পাঠাচ্ছে? কে সে? ভগবান? তা হলে চারপাশের বিপদসঙ্কুল পরিবেশে যে আতঙ্ক, তার থেকে রক্ষা পাবার জন্যে কি সেই অদৃশ্য শক্তির শরণাপন্ন হওয়া যায়?
ভয় আর বিস্ময় জন্ম দিল অত্যন্ত আদিম পর্যায়ের একটি ধর্মবোধ, যার কেন্দ্র এক অপ্রত্যক্ষ শক্তি। মানুষ তাকেই কল্পনা করল নিজের চেয়ে বহুগুণ শক্তিশালী এক মহান ঈশ্বররূপে এবং আনন্দে বিস্ময়ে তাঁর স্তব গাইল, বিপদে আতঙ্কে তাঁর শরণাগত হল। পৃথিবীর সর্বত্রই প্রাথমিক এক আরাধনা পদ্ধতি রচিত হল; স্তোত্র, গান, অর্ঘ্য, হব্য দিয়ে নিজের প্রয়োজনীয় ঐহিক সুখশান্তি ও নিরাপত্তার জন্যে তাঁর কাছে প্রার্থনা জানানো। আদিম জগতের নানা চেহারায় যজ্ঞের এই ছিল মূল উপাদান।
ওই কল্পিত উচ্চতর শক্তিতে মানুষ তার চরিত্রের যা কিছু শ্রেষ্ঠ, বিভিন্ন মানুষে যে-সব সদগুণাবলি সে প্রত্যক্ষ করেছে তার সব কিছুই সর্বোত্তম মাত্রায় আরোপ করল ঈশ্বরে গড়ে উঠল এক শ্রদ্ধেয় মহান পুরুষ। গানের প্রেরণা আসে তাঁকে ঘিরে, চিত্রশিল্পে দৈনন্দিনের সঙ্গে তাঁকে জড়িয়ে স্ফুরিত হয় শিল্পীর প্রতিভা। তাঁর বাসস্থান নির্মাণের চেষ্টায় শুরু হয় মন্দির, মসজিদ-গির্জা-জিগুরাটের স্থাপত্য, তাঁর লীলা কল্পনা করে তাঁকে রূপ দেওয়া হয় পাথরে কাঠে মাটিতে ধাতুতে— সূত্রপাত হয় ভাস্কর্যের এবং এ সব প্রেরণা দীর্ঘস্থায়ী হল, নিত্যনব উদ্ভাবনে ঋদ্ধ হল। মানুষের সৃষ্টি প্রতিভার অনেকটাই বিকশিত হল তার আপন সৃষ্টি ঈশ্বরকে ঘিরে।
প্রকৃতি সম্বন্ধে ভয় এবং বিস্ময় দুয়েরই ভিত্তিতে আছে প্রকৃতির সম্বন্ধে বিশেষ জ্ঞানের অর্থাৎ, বিজ্ঞানের অভাব, অসহায়তার বোধও ওইখান থেকেই আসে। যে-জ্ঞান থাকলে প্রকৃতিকে নিজের অনুকূলে জয় করা যায়, খুব ধীরে ধীরে মানুষ সে জ্ঞান অর্জন করেছে এবং যতটা করেছে সেই অনুপাতে প্রকৃতিকে আয়ত্ত করে স্বনির্ভর হয়েছে, ঈশ্বরে একান্ত নির্ভরতা ততটাই কমেছে। ঈশ্বরের কল্পনা প্রথম থেকেই অতিপ্রাকৃতের সঙ্গে সম্পৃক্ত; মেঘ, বিদ্যুৎ, ঝড়-বৃষ্টি, খরা, বন্যা ইত্যাদি প্রাকৃতিক ঘটনাগুলির পশ্চাতে অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন এবং ঈশ্বরকে মানুষ কল্পনা করেছে। কিন্তু যেহেতু ঈশ্বর অদৃশ্য তাই ঈশ্বর বিশ্বাসের প্রথম প্রতিপাদ্যই হল ঈশ্বর বিশ্বাসগ্রাহ্য; ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বা বুদ্ধিগ্রাহ্য নয়; অতএব প্রথম পর্যায় থেকেই অলৌকিকতা জুড়ে রইল ঈশ্বরবোধের সঙ্গে।
অধিকাংশ ধর্মেই ঈশ্বরের ভূমিকা কেন্দ্রস্থানীয়, কিন্তু আরও কিছু আনুষঙ্গিক বিশ্বাসও ধর্মে অপরিহার্য, যেমন পরলোক, আত্মা, পাপ, পুণ্য এবং তৎ-সহ দণ্ড ও পুরস্কার, অর্থাৎ নরক ও স্বর্গ। ভারতবর্ষে এর সঙ্গে জুড়েছিল জন্মান্তর এবং কর্মবাদ। এর মধ্যে জন্মান্তরে বিশ্বাস, গ্রিস, মিশর, মানেকীয়, মাণ্ডেয় ও আরও কোথাও কোথাও অঙ্কুর রূপে মাঝে মাঝে দেখা দিয়েছে। ভারতবর্ষেও বৌদ্ধ, জৈন, আজীবিক ইত্যাদি সম্প্রদায়ে জন্মান্তরে বিশ্বাস ছিল। কিন্তু ব্রাহ্মণ্য ধর্মে যেটি বৈশিষ্ট্য, অর্থাৎ কর্ম অনুসারে জন্মান্তর, তা কোথাও ছিল না। ভারতবর্ষে ধর্মচিন্তা ও অনুষ্ঠান প্রাথমিক সিন্ধু সভ্যতার পর্বে কী ছিল তা আজ জানবার উপায় নেই। কারণ, সিন্ধুসভ্যতার লিপি পাঠ করা যায়নি এখনও। তবে অনুমান করবার বেশ কিছু অবকাশ আছে। অত বিস্তৃত ভূখণ্ডে, কোয়েটা থেকে গুজরাতে যে একটি সুশৃঙ্খল রাজ্য অন্তত দেড় হাজার বছর ধরে চলেছিল, তার মধ্যে একটি বিশেষ লক্ষণীয় অভাব হল, প্রত্নখননে কোনও অস্ত্রশস্ত্র বিশেষ পাওয়া যায়নি। তা হলে অত বড় রাষ্ট্র চালনা হত কোন শক্তিতে? পণ্ডিতেরা অনুমান করেন, রাষ্ট্রশক্তির সঙ্গে একাত্ম হয়েছিল পুরোহিত-শক্তি; অর্থাৎ, রাষ্ট্রের চালিকাশক্তি ছিল ধর্ম। প্রত্নখননে বিরাট স্নানাগার, তৎসংলগ্ন ছোট ছোট কুঠরি, সম্ভবত বেশ-পরিবর্তন বা আরাধনার প্রস্তুতির জন্যে। কাজেই সামুহিক উপাসনা যে অনুষ্ঠিত হত তার একটা আভাস মেলে। এ ধর্মের বোধ-বিশ্বাস, আচার-অনুষ্ঠান, কী ছিল তা আজ আর বোঝবার উপায় নেই। কারণ, লিপি যা পাওয়া গেছে, নিঃসন্দিগ্ধ প্রামাণ্য ভাবে তার পাঠোদ্ধার হয়নি। হলেও তাদের অন্তর্বাণিজ্য ও বহির্বাণিজ্য সম্বন্ধে কিছু তথ্য ছাড়া আর বিশেষ কিছু পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। এ সভ্যতা অবলুপ্ত হবার হাজারখানেক বছর পরে এল পশুচারী যাযাবর আর্যরা, সঙ্গে আনল— অন্তত এর শেষতম অভিযাত্রীরা আনল ঋগ্বেদ। পশুচারী-দিনে সম্ভবত দলের একজন জ্ঞানপ্রবীণ ও বয়োবৃদ্ধ একটি বা একাধিক পশু হনন করে, একক বা সমবেত কণ্ঠে কিছু স্তোত্র, আবৃত্তি ও গান করে তাদের আর্জি পেশ করত তাদের বহু দেবতাযুক্ত দেবমণ্ডলীকে। এ দেশে এসে দীর্ঘকাল বসবাস করবার সময়ে, বিশেষত স্থানীয় লোকদের কাছে কৃষি ও পোড়া-ইটের বাড়ি তৈরি শেখার সঙ্গে সঙ্গে দেবতারা সংখ্যায় বাড়তে লাগলেন, স্তোত্রও বহুগণিত হল, যজ্ঞ অনুষ্ঠানেও বহু অনুষঙ্গ, বৈচিত্র্য, জটিলতা ও ব্যাপ্তি দেখা দিল। যজমান শব্দটির ব্যাকরণগত অর্থ হল, যে যজ্ঞফল ভোগ করে। যাযাবর-দিনে গোষ্ঠী-প্রতিভূ ছিলেন পুরোহিত এবং যজ্ঞফল ভোগ করত পুরো গোষ্ঠী, তাদেরই মঙ্গলের জন্যে ছিল প্রার্থনা— আয়ু, স্বাস্থ্য, পশু, সন্তান, বিজয় ও নিরাপত্তা তখন জীবন ছিল আনন্দের, উপভোগ্য, তাই প্রার্থনা ছিল দীর্ঘদিন এ পৃথিবীতে বেঁচে থাকবার।
ক্রমে লোহার লাঙলের ফলা দিয়ে চাষ শুরু হল খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের কাছাকাছি; দ্বিতীয় নগরায়নে নতুন সব নগরের পত্তন হল, ষোড়শ মহাজনপদের সৃষ্টি হল, গোষ্ঠী কৌম ভেঙে সমাজের নিম্নতম একক হল ‘কুল’ বা বৃহৎ যৌথ পরিবার। প্রায় দু’-শতক ধরে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে ইউরোপ পর্যন্ত যে নৌবাণিজ্য বন্ধ ছিল আর্য অভিযানের পরে, সিন্ধুসভ্যতা আমলের সেই বহির্বাণিজ্য আবার শুরু হল। কৃষি শিল্পের উদ্বৃত্ত অন্তর্বাণিজ্য ও বহির্বাণিজ্যে ব্যবহৃত হয়ে সম্পদ সৃষ্টি করল। এ সম্পদের অধিকার ছিল মুষ্টিমেয় সুবিধাভোগী ওপরতলার মানুষের।
যজ্ঞনিষ্ঠ ধর্ম চলাকালীনই অরণ্যে নানা সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের উদ্ভব হল। কে জানে, প্রথম নগরায়নের, অর্থাৎ সিন্ধুসভ্যতার উত্তরাধিকার কি না এরা। এরা যজ্ঞ করত না, জ্ঞানচর্চার দ্বারা জীবনকে বোঝাবার চেষ্টা করত। আরণ্যক, উপনিষদ, বৌদ্ধ, জৈন, আজীবিক ও আরও নানা মুনি-সম্প্রদায়ের প্রাদুর্ভাব এত বাড়ল যে, ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ‘বানপ্রস্থ’ ও ‘যতি’ বলে দু’টি আশ্রমকে চতুরাশ্রমের অন্তর্ভুক্ত করল, যাতে সমাজে থেকেই লোকে আনুষ্ঠানিক ধর্মচর্যা থেকে অব্যাহতি পেয়ে বনে বাস করে জ্ঞানচর্চা করতে পারে। ধর্ম-সংগঠন নিজেকে সম্প্রসারিত করে বিরোধী মতকে স্থান দিল সমাজের পরিসরে।
কিন্তু ওই মুষ্টিমেয় সুবিধাবাদী ধর্মকে নানা কঠোর আচার-আচরণের রীতিতে বাঁধল। যজ্ঞ ক্রমেই সাধারণ মানুষের আর্থিক ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছিল, তাই সম্ভবত প্রাগার্য কালের পূজাপদ্ধতি নতুন রূপে দেখা দিচ্ছিল সমাজে। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে পূজা সমাজে এসে গেছে। যজ্ঞে মানুষ যেমন ঐহিক সুখের জন্যে দেবতাদের কাছে প্রার্থনা করত, তেমনি উপনিষদ, বৌদ্ধ ও জৈনধর্মে মোক্ষ বা নির্বাণের জন্যে সে জ্ঞানমার্গে সাধনা করত। শুধু যে সাধনার প্রণালী পালটে গেছে তা নয়, উদ্দেশ্যও পালটে গেছে; ঐহিক সুখের বদলে লক্ষ্য এখন মোক্ষ বা নির্বাণ। কারণ, উপনিষদ থেকেই জন্মান্তরবাদ সমাজে দৃঢ়মূল, এখন সমাজে শ্রেণিভিত্তিক দু’টি ভাগ হবার পরে, ভারতবর্ষে দ্বিতীয় নগরায়নের পরে, গ্রামবাসী সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রাথমিক উৎপাদকরা দারিদ্র্যসীমার নীচে বাস করত। তাদের কায়িক শ্রমে উৎপন্ন শস্য ও শিল্পের উদ্বৃত্ত জমত সংখ্যালঘু উচ্চবর্ণের শক্তিমানের হাতে। এই সময়ে জন্মান্তরবাদের সঙ্গে ব্রাহ্মণ্য ধর্মে যুক্ত হল কর্মবাদ, চিন্তাজগতে পৃথিবীর দুষ্টতম আবিষ্কার। এ দুইয়ে মিলে ধর্ম এমন একটা খাঁচায় পরিণত হল যার মধ্যে সাধারণ মানুষ মাথাই খুঁড়তে পারত, বেরোবার পথ তার সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল। অতি দরিদ্র, ঋণভারগ্রস্ত, অন্নবস্ত্র-স্বাস্থ্য-শিক্ষাহীন সাধারণ মানুষের কাছে জীবনের অর্থ হয়ে দাঁড়াল নিরন্তর শ্রম, ক্ষুধা, নিরাশ্রয়তা; এবং জন্মান্তরবাদ তাকে জানাল যে, এই রকম পরিবেশেই তাকে ফিরে ফিরে জন্মাতে হবে। কেন? তার বাসনার অবশেষ থাকবে। তা তো থাকবেই, জীবনে সে কিছুই তো পেল না, চেয়ে চেয়ে দেখলই শুধু। দেখল নিষ্ঠুর, অত্যাচারী, হৃদয়হীন একটি শ্রেণি জীবনের সব সুখসুবিধা ভোগ করছে, আর তারা নিজেরা ঋণে দারিদ্র্যে নানা দুঃখকষ্টে জর্জরিত, নিপীড়িত। কেন এমন হয়? ধর্ম এখন তাকে বলল, পূর্বজন্মের পাপের ফলে তার এই দুর্গতি; এ জন্মে নত নম্র হয়ে উচ্চ ত্রিবর্ণের এবং ক্ষমতায় আসীন রাজা ও রাজন্যদের যথোচিত সেবা করতে পারলে পরজন্মে তার অবস্থার উন্নতি হতে পারে। এখন, পূর্বজন্মও যেমন তার জ্ঞানের পরিধির বাইরে, কাজেই সে-জন্মে সত্যিই কোনও পাপ করেছে কি না তা জানবার কোনও উপায়ই তার নেই, পরজন্মও তেমনি তার অনভিজ্ঞতার ওপারে, সেখানে এ জন্মের কষ্টের ক্ষতিপূরণ হবে কি না জানবার কোনও উপায় নেই। দু’টি অজ্ঞাতের মধ্যে কারণ ও কার্যকে ঠেলে দিয়ে উচ্চ ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা সহজেই সংখ্যাগরিষ্ঠ নিম্নবর্গের মানুষের একান্ত নিষ্প্রতিবাদ আনুগত্য পেয়ে গেল। কাজেই নিম্নবর্ণের সাধারণ মানুষের কাছে জীবন এত দুঃখপূর্ণ হয়ে উঠেছিল যে, স্বভাবতই মানুষ পুনর্জন্ম থেকে অব্যাহতির চেষ্টা করবে। মোক্ষ বা নির্বাণ সেই দিকে পথ দেখায়।
কর্মবাদ ছাড়াও এখন সমাজে পূজা-নির্ভর উপাসনা পদ্ধতিতে কয়েকটি নতুন দিক দেখা দিয়েছিল। প্রথমত দেবমণ্ডলী প্রায় সম্পূর্ণ পরিবর্তিত, পূজা প্রণালীও সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। বেদের কালে যজ্ঞবেদির ওপরে, অমূর্ত দেবতাকে আহ্বান করে বৃষমাংস, পুরোডাশ, মধু, সুরা, দুগ্ধজাত খাদ্য ও সোমরস দেওয়া হত। পূজায় মন্দিরে বিগ্রহবান দেবতাকে প্রধানত নিরামিষ নৈবেদ্য ও ফলমূল দেওয়া হয়। বেদে প্রার্থনা ছিল ঐহিক সুখসাচ্ছন্দ্য ও (দু’-একটি যজ্ঞে) স্বর্গ; পূজায় ঐহিক সুখ, স্বর্গ বা ইষ্টদেবতার সান্নিধ্য এবং অন্তিমে মুক্তি। বেদে উপাসকের মনোভাব ছিল বিশ্বাস, পূজায় ভক্তি। পুরোহিত, পুরাণ ও নতুন রচিত কিছু শাস্ত্র পূজায় ব্যবহার করেন, বেদ কদাচিৎ এবং প্রায়ই অপ্রযুক্ত ভাবে।
পূজার-কালে অর্থাৎ, মহাকাব্য-পুরাণের কালে ধর্ম মানুষকে কী দিয়েছিল? ঐহিক সুখের প্রত্যাশা, শরণাগতির যোগ্য এক ইষ্টদেবতা, সম্পূর্ণ আত্মনিবেদন, বোধবুদ্ধি, আবেগ, ইচ্ছা, প্রযত্ন, ব্যক্তিত্ব সব কিছুই ঐকান্তিক ভাবে দেবতার কাছে নিবেদন করার ‘সুখ’ বা ‘স্বস্তি’। ক্রমশ, পরবর্তী পুরাণগুলিতে ধর্মাচরণ সহজ হয়ে এল। তীর্থ, ব্রত, দান-দক্ষিণা, ধ্যান-জপ এ সবের দ্বারা ঊর্ধ্বতন পুরুষের এবং অধস্তন বহু পুরুষের পাপক্ষালন হয়, স্বর্গবাস হয় বহু কল্প ধরে।
বৈদিক যজ্ঞের যুগে নানা অতিকথা স্পষ্ট হয়, সাহিত্যিক সৃষ্টি হিসেবে নয়, ধর্মীয় উদ্দেশ্য প্রোথিত করবার জন্য এর মধ্যে অল্প কয়েকটির সাহিত্যিক মূল্য আছে। কিন্তু মহাকাব্যের যুগ থেকে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের এবং তার কিছু আগে থেকে বৌদ্ধ ধর্মের পরে জৈন ধর্মের সাহিত্যেও বেশ কিছু রসোত্তীর্ণ কাব্য উপাখ্যান আছে। তা ছাড়া ধর্মকে কেন্দ্র করে মন্দির, মঠ, সঙ্ঘারাম ইত্যাদিতে স্থাপত্যবিদ্যার বিকাশ দেখা যায়। মন্দিরে, মন্দিরগাত্রে দেবদেবী ও অন্য উপকথার কাহিনি ভাস্কর্যে রূপ পেয়েছে। দেবতার উদ্দেশে রচিত গান-স্তোত্র, দেবতাকে কেন্দ্র করে রচিত কাব্য, নাটক, কাহিনি, মন্দিরে দেবদাসী নৃত্য ও অন্যান্য ধর্মীয়, ভজন-কীর্তন ও নৃত্যগীত অনুষ্ঠানের মধ্যে এ সব শিল্পের চর্চা। চিত্রশিল্পেও এর প্রকাশ ঘটে। অর্থাৎ, ধর্মকে কেন্দ্র করে সাহিত্যশিল্পের বিচিত্র বিকাশ দেখা যায়। এ কথা সত্য যে, এ ধরনের চর্চা ধর্ম-নিরপেক্ষ ভাবেও হতে পারত, কিছু কিছু হয়েওছিল। যেমন ভারতে সাঁচির ভাস্কর্যে লোকজীবনের আলেখ্যও বিধৃত হয়েছে। তবু এ সব শিল্পের প্রথম প্রকাশ ঘটে ধর্মকে কেন্দ্র করেই; শুধু ভারতবর্ষে নয়, পৃথিবীর সর্বত্রই। ধর্মকে কেন্দ্র করে নানা লৌকিক জ্ঞানচর্চাও শুরু হয়, যেমন জ্যোতিষ, জ্যামিতি, ব্যাকরণ, ছন্দ, ব্যুৎপত্তিশাস্ত্র, ভেষজ ইত্যাদি। অল্পকালের মধ্যেই অবশ্য এগুলি ধর্মনিরপেক্ষ জ্ঞানচর্চার পথে এগিয়ে যায় এবং স্বতন্ত্র শাস্ত্ররূপে প্রতিষ্ঠা অর্জন করে।
কিন্তু মুখ্য প্রশ্ন ধর্ম, ধর্ম মানুষকে কী দিয়েছে? আগেই বলেছি, ধর্মের যে মূল ভয়ের মধ্যে প্রোথিত সেখানে ধর্ম অতি-লৌকিক শক্তি বা ভগবানকে উদ্ভাবন করে মানুষকে আধ্যাত্মিক ভরসা ও আশ্রয় দিয়েছে, বর্তমানে সুরক্ষা ও মৃত্যুর পরে সদগতির প্রতিশ্রুতি দিয়ে। আর ধর্মের যে মূলটি বিস্ময়ে প্রোথিত তার থেকে আনন্দ, গান, কাব্য, নৃত্য, স্থাপত্য, ভাস্কর্য ইত্যাদিতে বিকশিত হয়েছে। এ ছাড়াও সমাজের অধিপতিরা যখন সাধারণ প্রজার ওপরে অকারণে নিষ্ঠুর ও অত্যাচারপরায়ণ হয়ে ওঠে, তখন ধর্ম কখনও প্রতিবাদী রূপ নিয়ে বিদ্রোহকে সমর্থন করেছে, অথবা অন্য ভাবে বললে, বিদ্রোহীরা ধর্ম থেকে সমর্থন বের করেছে। কখনও বা ধর্ম সরাসরি বিপ্লবের পুরোভাগে এসে দাঁড়িয়েছে, যেমন ইংল্যাণ্ডে লোলার্ডরা, এখনকার কার্গোকাল্ট ও লিবারেশন থিওলজি। সন্তান বিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদ্রোহ, শিখ বিদ্রোহ, নকশাল বিদ্রোহ এগুলিও বিশেষ বিশেষ পর্যায়ে কোনও দেবদেবী বা ধর্মকথা ব্যবহার করেছে। ওয়াহাবি, খোদা-ই খিদমতগার ও খিলাফত আন্দোলনেও ধর্ম ব্যবহৃত হয়েছে। যুক্তবঙ্গে ব্রিটিশ আমলে সন্ত্রাসবাদীরা গীতার বাণী ব্যবহার করেছে। কাজেই ধর্মের মধ্যে এমন উপাদান ছিল যার রচনার উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ পৃথক হলেও, মানুষ রাষ্ট্রনৈতিক দুর্যোগের দিনের বিপ্লবে তাকে ব্যবহার করতে পেরেছে।
সমাজে দুর্নীতি, অত্যাচার বেড়ে উঠলে কোনও কোনও সময়ে নতুন একটি ধর্মের জোয়ার এসে কলুষকে মুছে দিতে চেষ্টা করে। বৈদিক যজ্ঞ যখন একটি শ্রেণির কায়েমি স্বার্থে পর্যবসিত হল, তখন বেদবিরোধী নানা সংস্থা, যেমন যজ্ঞবিরোধী উপনিষদ, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম এসেছিল প্রতিবাদী চেহারায়। জাতিভেদ যখন প্রবল অত্যাচারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ, তখন মধ্যযুগে বহু প্রতিবাদী ধর্ম-সংস্থার অভ্যুত্থান ঘটল। চৈতন্য, কবীর, নানক, দাদু, শংকরদেব, জ্ঞানদেব, রুইদাস, রামদাস— এঁরা প্রত্যেকেই সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধিকে নস্যাৎ করে দিলেন। পাণ্ডা, গুরু, পুরোহিত, মোল্লা, মৌলবীর ভূমিকার প্রতি তীব্র শ্লেষ নিয়ে রচনা করলেন এঁদের গান ও কবিতা। কিছুকালের জন্যে, অন্তত কিছুকালের মধ্যে সংবিৎ ও শুভবুদ্ধির উদয় হল, ধর্মের আবর্জনাকে এঁরা ঝাঁট দিয়ে সরিয়ে দিলেন। কিন্তু এর কোনওটিই উদ্দিষ্ট লক্ষ্যে বেশি দিন স্থির থাকেনি– ফের ফিরে এসেছে গৌড়ীয় বৈষ্ণবের, জাত বোষ্টমের ও বৃন্দাবনের বৈষ্ণবের মতবিরোধ, জঞ্জাল জমেছে ধীরে ধীরে, যে জঞ্জাল সাফ করতে এসেছিলেন ওই মহাপ্রাণ সাধকরা। কিছুকালের জন্যে তৈরি হয়েছে কিছু কিছু প্রতিবাদী সম্প্রদায় কিন্তু অধিকাংশই অচিরে মিশে গেছে মূল সনাতন ধারার মধ্যে। কিন্তু কিছুকালের জন্যে হলেও ধর্মের নামে মধ্যযুগের সন্তরা প্রতিবাদী ধর্মের কাঠামোর মধ্যেই ভরে দিতে চেয়েছিলেন বিশুদ্ধ মানবিকতা। পেরেওছিলেন কিছুকালের জন্যে। প্রাথমিক প্রতিবাদের ঐতিহাসিক প্রয়োজন ফুরোলে প্রতিবাদ আবার নিষ্প্রতিবাদে আশ্রয় খুঁজে নিল সনাতন মূল ধর্মধারার মধ্যে। মুসলমান ধর্ম ভারতবর্ষে আসবার পর বিনা সংঘাতে হিন্দু ধর্মের সঙ্গে সহাবস্থান করেছিল তিনশো বছর। পরে যখন রাষ্ট্রশক্তি তাদের হাতে গেল, তখনও অনিচ্ছায় ধর্মান্তরীকরণ হয়নি বহুদিন, পরে চতুর্দশ শতক থেকে সেটি শুরু হয় এবং এ-ও সত্যি যে, জাতিভেদের অত্যাচারে নিপীড়িত নিম্নবর্গের বেশ কিছু মানুষ স্বেচ্ছায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে, কারণ ইসলামে জাতিভেদ নেই বলে এই প্রান্তস্থ মানুষরা কিছু পরিমাণ নিরাপত্তা, মানবিক মর্যাদা পেয়েছিল। ধর্মীয় গোঁড়ামি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কিছু মন্দির ভেঙে মসজিদ নির্মাণ করা হয়, প্রধানত লুণ্ঠনের জন্যে, কারণ মন্দিরে দীর্ঘসঞ্চিত ধনভাণ্ডার ছিল; এর পূর্বেও বহু বৌদ্ধমঠও এই কারণে ভাঙেন হিন্দু সম্রাটরা। আবার হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্রাটই মন্দির মসজিদ দুইয়েতেই অর্থ সাহায্য করতেন, এর বিস্তর নিদর্শন আছে। মোগল সম্রাটের অন্তঃপুরে রাজপুত মহিষীরা থাকতেন নিরাপদ সম্মানে; আত্মহত্যা করেননি, কাজেই পীড়ন ছিল না।
মুসলমান ধর্ম এ দেশে আসবার পর সম্রাটরা একটি পাই-পয়সাও এ দেশ থেকে আরবে, পারস্যে পাঠাননি, বরং দেশ থেকে শিল্পী আনিয়েছিলেন, ফলে স্থাপত্যে, ভাস্কর্যে, চিত্রশিল্পে, সাহিত্যে, কণ্ঠ ও যন্ত্রসঙ্গীতে একটি অতি সমৃদ্ধ মিশ্র সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল যা আজও ভারতবর্ষের গর্বস্থল। ধর্ম সরাসরি কিছু বিশ্বাস আচার-অনুষ্ঠান দেয় আর প্রকারান্তরে দেয় একটি জীবনবোধ, কিছু সাংস্কৃতিক সৃষ্টির প্রেরণা। হিন্দু-মুসলমান যুগ্ম প্রতিভার বহু সৃষ্টি এখনও ভারতবর্ষে নানা ভাবে ফল ধারণ করছে, রাগরাগিণী তার একটি নিদর্শন। সাহিত্যেও সহযোগিতামূলক অনেক সৃষ্টি হয়েছে; মুসলমান কবি দরাফ খাঁ গঙ্গাস্তোত্র ও অন্যান্য সংস্কৃত কবিতা লিখেছেন, রামমোহন রায় এবং আরও অন্যান্যরাও ফারসি ভাষায় গ্রন্থ রচনা করেছেন।
মূল ধারার হিন্দুধর্ম মানুষকে ধর্মের সঙ্গে ধর্মের নামে এমন অনেক কিছু দিয়েছে যাতে তার মনুষ্যত্ব খর্ব হয়েছে। মুসলমান প্রতিবেশীর সঙ্গে আত্মীয়বন্ধুর মতো বহু শতক বাস করবার পর ইংরেজ রাজশক্তি বিভেদ-নীতি প্রবর্তিত করে অতি কৌশলে, হিন্দুকে প্রাধান্য দিয়ে মুসলমানকে আধুনিকতার আলো থেকে কৌশলগত ভাবে সরিয়ে রেখে তাকে সামাজিক ভাবে শিক্ষাগত ভাবে বঞ্চিত করে সত্যকার একটা পার্থক্যের প্রাচীর নির্মাণ করে কূটনীতির আশ্রয়ে। এতে দু’-পক্ষেরই বহু ক্ষতি হয়, আত্মীয়কল্প প্রতিবেশীকে হারাল দু’-জনেই। হিন্দুধর্মে রন্ধ্রে-রন্ধ্রে অনুপ্রবিষ্ট দু’-হাজার বছরের জাতিভেদবোধের বিষের সঙ্গে মিশল সাম্প্রদায়িকতার বিষ এবং সেটার জন্যে প্রথমে প্রচ্ছন্ন, পরে প্রকাশ্য-প্রশ্রয় ছিল রাষ্ট্রশক্তির। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে ১৯২০ সালে সৃষ্টি হল ‘হিন্দুমহাসভা’, তার পরে মুসলিম লিগ এবং এ দু’টিরই বিস্তর শাখাপ্রশাখা আজ সারা দেশে পরিব্যাপ্ত। প্রশ্ন হচ্ছে, ধর্মের ভূমিকা এতে কোথায়? উত্তরে বলা চলে, ধর্মের দু’টি দিক— ব্যক্তিগত ও সমাজগত। ব্যক্তিগত দিকের কথা পরে আলোচনা করছি। সামাজিক দিকে দু’-সম্প্রদায়ের মধ্যেই ধর্ম বিষ ছড়িয়ে দিল। যারা ছিল আত্মীয়তুল্য বন্ধু-প্রতিবেশী তাদেরকে দুই সম্প্রদায়ই দেখল শত্রু হিসেবে। এই রেষারেষি প্রায় দেড় শতক ধরে শুধু চলছে না, বাড়ছে। হিংসাত্মক ক্রিয়াকলাপে নির্বিবাদে ধর্মের নামে তুচ্ছতম কারণেও হিংসা ও ধ্বংস আচরিত হচ্ছে। অন্য সম্প্রদায়ের ক্ষতি করা এখন ধর্মের অনুকূল আচরণ বলে বিবেচিত হচ্ছে।
এই গত দেড়-শতক ধরেই সমাজের প্রত্যন্ত দেশে নানা নিম্নবর্গীয় সমাজে ভিন্ন ভিন্ন ধর্মপ্রস্থানের উদ্ভব ঘটেছে, এদের মধ্যে লালন ফকির, সাহেবধনী, কর্তাভজা, বলাহাড়ি, খুশি বিশ্বাসী ইত্যাদি নানা ছোটখাটো প্ৰস্থান আছে। এদের মধ্যে পারস্পরিক পার্থক্য যা-ই থাক না কেন, এঁরা সবাই সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী, সর্বমানবের মর্যাদায় বিশ্বাসী এবং ধর্মগুরু ও পুরোহিতদের সম্পর্কে বিদ্রূপ ও শ্লেষের বাণী উচ্চারণ করেছেন এঁদের গানে ও কবিতায়। প্রচলিত হিন্দুধর্মকে এঁরা অস্বীকার করেন, সেটি কায়েমি স্বার্থের প্রতীক বলে। স্বচ্ছ দৃষ্টি দিয়ে এই নিম্নবর্গীয় অতি দুঃখী মানুষরা যে ভাবে দেখতে পেয়েছেন কেমন করে সাম্প্রদায়িকতা ও জাতিভেদের কূটকৌশলে সমাজপতিরা শুধু নিজেদের ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে ও সংরক্ষণ করতে প্রয়াসী হয়েছে তাতে এঁদের কাছে প্রতিষ্ঠিত ধর্ম-প্রস্থানগুলি প্রতিভাত হয়েছে সামাজিক ভণ্ডামি, নীচতার ও অত্যাচারের অস্ত্র রূপে। তাই এঁরা তাকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করে জাতিধর্মনির্বিশেষে মানুষমাত্রের প্রতি সৌভ্রাত্রের বাণী প্রচার করেছেন।
এই প্রান্তিক ধর্ম-প্রস্থানগুলি সনাতন সমাজ ও ধর্মের বিরুদ্ধে মূর্ত প্রতিবাদ। এই ধর্ম, অন্তত হিন্দুধর্ম, জাতিভেদ, সম্প্রদায়ভেদকে ধর্মের নামে প্রতিষ্ঠা করে এবং জন্মান্তরবাদ, কর্মবাদ ও নিয়তিবাদের দ্বারা ধর্মের যে ব্যক্তিগত দিকটি আছে সে দিকে মনুষ্যত্বের অপমান করে, ব্যক্তিকে দুর্বল ও অসহায় করে তোলে। যে দেশে বিপুলসংখ্যক মানুষ স্বাধীনতার প্রায় অর্ধশতাব্দী পরেও দারিদ্র্যসীমার নীচে বাস করে, অন্ন-বস্ত্র, শিক্ষা-স্বাস্থ্যের অভাবে এবং ঋণভারে জর্জরিত, সেই দেশে ধর্ম যখন এই মানুষদের বোঝায় যে, এই কষ্ট তাদের পূর্বজন্মকৃত পাপের ফল এবং অত্যাচারী, বর্বর, লুব্ধ শোষকশ্রেণি যে আরাম ভোগ করছে তা তাদের পুণ্যের ফল, তখন স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, ওই ধনী বিলাসীরা, পূর্বজন্মে যারা নাকি পুণ্যবান ছিল, এ জন্মে তাদের সে জন্মের পুণ্যাচারী করে মনটাকে কোথায় ফেলে এল, যে কালোবাজারি, ফাটকাবাজি, ভেজাল, চুরি, ‘স্ক্যামে’ লিপ্ত হতে একটুও বাধল না? এ ঘৃণ্য প্রকৃতিগত লোভ ওই জন্মের পুণ্যবানদের মনে এল কোথা থেকে? উপরন্তু ধর্ম তাদের বোঝায় যে, এ জন্মে মুখ বুজে যদি তারা উচ্চ ত্রিবর্ণ ও রাষ্ট্রশক্তিতে ক্ষমতাসীন ব্যক্তিবর্গের একান্ত ভাবে সেবা করে যায় তো পরজন্মে তাদের অবস্থার উন্নতি হতে পারে। মুশকিল হল, গত জন্ম (বা জন্মগুলি) তো কাল্পনিক। তার কোনও প্রমাণ নেই। এবং পরজন্ম বা জন্মগুলি তার দৃষ্টিগোচর নয় এবং তারও কোনও প্রমাণ নেই। ওই সম্পূর্ণ অনুমাননির্ভর, শুধুমাত্র শাস্ত্র ও পুরোহিতের ফতোয়াতে সিদ্ধ, এই কর্মবাদ ও তার ফলে পুনর্জন্মের সুখদুঃখ এটা সম্পূর্ণ ধোঁকা হলেও সমাজে মানুষে মানুষে যে গুরুতর অবস্থাবৈষম্য তার একটা আপাত ব্যাখ্যা মেলে ধর্মের এই ব্যাখ্যানে। এ প্রশ্ন আদিমকাল থেকেই পৃথিবীর সর্বত্র সব মানুষকেই ভাবিয়েছে— যে দুরাচার সে কেন সব ঐহিক ভোগসুখ পাবে, নীতিনিষ্ঠ মানুষ কেন অভাবে, ব্যাধিতে, দুঃখ-অত্যাচারে নিরন্তর ক্লিষ্ট হবে? জন্মান্তর ও কর্মবাদের অশুভ সংযোগের পূর্বে মানুষ নানা রকমে এর ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছে। অন্যান্য দেশে যেখানে এই দুষ্ট সন্ধিটি ঘটেনি, সে দেশের মানুষ ঈশ্বরের প্রাক-নির্বাচন বলে এর ব্যাখ্যা করেছে। এ কথা ভারতবর্ষেও বলা হয়েছে। অন্যত্র বলেছে, দৈব, নিয়তি এবং ভারতবর্ষ ও এ-সব কথা দৃঢ় ভাবে শাস্ত্রের পর শাস্ত্রে অসংখ্যবার উচ্চারণ করেছে।
অথচ ভারতবর্ষে ধর্মশাস্ত্রকাররা কখনও ভেবে দেখেনি যে, তারা যা যা বলছে, সেগুলি সবই পরস্পরবিরুদ্ধ। কর্মফলের দ্বারা যদি মানুষের সুখ-দুঃখ নিরূপিত হত, তা হলে করুণা, ঈশ্বর বা দেবদেবী— যারা ভারতবর্ষে দীর্ঘজীবী এবং সংখ্যায় অগণ্য, তারা নিরর্থক হয়ে যায়। নিয়তি দ্বারাই যদি মানুষের ভাগ্য নির্ধারিত হয়, তা হলে কর্মফল নস্যাৎ হয়ে যায়। কর্মফল বা নিয়তি যদি নিয়ন্তা হয়, তা হলে মানুষের পুরুষকার সম্পূর্ণ নিষ্ফল হয়ে যায়। ঈশ্বরেচ্ছা যদি সুখ-দুঃখের নিয়ামক হয়, তা হলে পুরুষকার, নিয়তি, কর্মফল সবই অর্থহীন হয়ে যায়। কর্ম অনুসারে ফল যে বলা হয়, চোখের ওপরে তার বহু ব্যতিক্রম দেখা যায়, আর ফলকে বা কর্মকে যদি আগের বা পরের জন্মে ঠেলে সরিয়ে দেওয়া হয়, তা হলে এমন কোনও নীতিপরায়ণ বিধাতা ঈশ্বর বা দেবতাকে স্বীকার করতে হয় যিনি কর্ম ও ফলের অনুপাত ঠিক রাখবেন। শাস্ত্র শুধু যে তেমন কোনও দেবতাকে উপস্থাপিত করতে পারেনি তা নয়, পরস্পরবিরুদ্ধ অসংখ্য শাস্ত্রবচনে বারবার প্রমাণিত হয়েছে যে, ন্যায়বিচারের কর্ম ও ফলের মধ্যে তেমন কোনও অনুপাত তো নেই-ই, বরং একই কর্মে ভিন্ন ভিন্ন ফলের এবং ভিন্ন ভিন্ন কর্মের একই ফলের অজস্র উদাহরণ আছে। কাজেই কর্মের সঙ্গে ফলের কোনও ‘নিয়ত’ সম্বন্ধ নেই। তা হলে সমস্ত ব্যাপারটা যদৃচ্ছ অর্থাৎ, নিয়তি নির্দিষ্ট হয়ে যায়।
এই নিয়তিকে প্রভাবিত বা প্রতিহত করবার বহুবিধ উপায় পুরাণ ও ধর্মশাস্ত্রগুলিতে নির্দিষ্ট করা আছে। দৈববাণী, স্বপ্ন, নানা জাদুক্রিয়ার মাধ্যমে যেমন এর পূর্বাভাস পাওয়ার চেষ্টা সারা পৃথিবীতে চিরদিনই চলে এসেছে তেমনই নিয়তির অভীষ্টকে প্রতিহত করতে বা মানুষের অনুকূলে প্রবৃত্ত করবার জন্যেও নানা রকম নির্দেশ দেওয়া আছে: যেমন ব্রাহ্মণের পরিচর্যা, ব্রত, তীর্থ, দান-দক্ষিণা, পূজা, মানত, ধ্যান, জপ, সাধনা ইত্যাদি। এর প্রত্যেকটি সম্বন্ধে একাধিক শাস্ত্র বারেবারে বলেছে যে, মানুষের প্রতিকূল নিয়তির প্রয়াসকে ব্যাহত করতে প্রত্যেকেই স্বতন্ত্র ভাবে সমর্থ। তাই যদি হয়, তা হলে মানুষের সৎকর্ম অসৎকর্মও নিরর্থক হয়ে যায়। শেষ দিকের পুরাণগুলিতে বারবার বলা হয়েছে যে, গঙ্গায় বা যমুনায় স্নান, ব্রাহ্মণকে খাদ্যবস্ত্র ছত্র পাদুকা দান, তীর্থে স্নান ও পূজা এ সব করলে (এবং আরও নেহাত নগণ্য নানা ধর্মাচরণ করলে) ঊর্ধ্বতন এবং অধস্তন অসংখ্য প্রজন্মের লোকের বহু কল্পকাল ধরে স্বর্গগাস হয়। এবং বহু শিলালেখে অভিসম্পাত দেওয়া আছে, পুরাণেও, যে ব্রাহ্মণকে দেওয়া ভূমি বা সম্পত্তির সুরক্ষা না করলে ঊর্ধ্বতন অধস্তন বহু পুরুষের ঘৃণ্য জন্ম বা নরকবাস ঘটে প্রায় অক্ষয়কালের জন্যে।
এ সমস্ত কিছুর আর এক শাস্ত্রীয় বিকল্প হল ভক্তি— বিকল্প যজ্ঞের পূজার, জ্ঞানচর্চার দানধ্যান, ব্রততীর্থ, মানত এ সবেরই। অর্থাৎ মনে ইষ্টদেবতার প্রতি ভক্তি থাকলে তার সব পাপ মার্জনা হয়ে যায়— ঊর্ধ্বতন ও অধস্তন বহু পুরুষের সব পাপ এবং সে বহু পুণ্যের ভাগী হয়ে জ্ঞান ও কর্মমার্গের সাধনে যা লাভ করত, তা সবই পায় বিনা আয়াসে। ভক্তি, বিশেষ হরিভক্তিকে ‘ভুক্তিমুক্তিপ্রদ’ বলা হয়েছে, ভক্তিমানের স্থান নিরূপিত হয়েছে কর্মযোগী জ্ঞানযোগীর অনেক ওপরে। ভক্তির জন্যে কোনও যোগ্যতার প্রয়োজন নেই; বিদ্যা, বংশ, জ্ঞান, কর্ম কিছুই ভক্তির মানদণ্ড নয়; শুধুমাত্র মানসিক আত্মসমর্পণেই সমস্ত ইষ্টসিদ্ধি হয়। গীতা থেকে ভাগবত পর্যন্ত সকল শাস্ত্রই ভক্তির মহিমা ব্যাখ্যানে মুখর। পূর্বের ধর্মসাধনার যত নির্দেশ ছিল, সব ভেসে গেল ভক্তির প্লাবনে এবং এই ভক্তিসাধনে যে সব সমীকরণ আছে, যেমন হরিকে স্মরণ করলে অশ্বমেধ যজ্ঞ করার ফল পাওয়া যায়, বা শততীর্থ ভ্রমণের তুল্য পুণ্য লাভ করা যায়, এ থেকে বোঝা যায়, ভক্তিমার্গকে শ্রেষ্ঠ বলার অভিপ্রায়েই এ সব সমীকরণ। মুশকিল হল, এগুলি স্বীকৃত শাস্ত্র, কাজেই উড়িয়ে দেবার জো নেই; এদের প্রামাণ্যতা বহু যুগ ধরে ব্রাহ্মণ্যসমাজে মেনে নেওয়া হয়েছে। এ সব শাস্ত্রে নির্দিষ্ট শাপ ও আশীর্বাদে বিশ্বাস করলে পাপ-পুণ্যের সংজ্ঞাই পালটে যায়, ধর্ম-কর্ম ফলে ধারণা ধসে পড়ে। তা হলে কোন শাস্ত্রটি প্রামাণ্য, কোনটি নয় তা নির্ণয় করার কোনও মানদণ্ড যেহেতু কোথাও দেওয়া হয়নি, সেহেতু শাস্ত্রনির্দিষ্ট ধর্ম একটি প্রহেলিকায় পর্যবসিত হয়, এবং শাস্ত্রকার ও পুরোহিতরা সচেতন ভাবে এ প্রহেলিকাটিকে সংরক্ষণ করেছেন। সাধারণ মানুষ কী পেয়েছে এ প্রহেলিকা থেকে? প্রথমত, তাকে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে যে, পাপ-পুণ্য, জন্মান্তর, কর্মবাদ, স্বর্গ-নরক, দেব-দেবী, নিয়তি মিলে তার জন্যে একটা ব্যবস্থা করেছে, এ জন্মে না হোক, পরের কোনও এক জন্মে সে সুখশান্তি পাবে, যদি সে শাস্ত্র-পুরোহিতের নির্দেশ মেনে চলে। দ্বিতীয়ত, সে অনুভব করে যে, জীবন একটি জটিল সমস্যা, বহু জন্মে এর বিস্তার, একে বুঝতে চেষ্টা করাই ধৃষ্টতা, এ বোধেও সে আবছা ভাবে জীবনের গরিমা সম্বন্ধে অবহিত হয়, এবং অভিভূত হয়।
কিন্তু এটাও সে বোঝে যে, শাস্ত্র পুরোহিতরা মিলে তাকে যা করতে বলে তা করতে হলে তাকে তার মানবিক মর্যাদা, আত্মবিশ্বাস, পুরুষকার, স্বাধীন চিন্তা, যুক্তি-তর্ক করার ক্ষমতা এ সমস্ত বিসর্জন দিতে হয়। পরিবর্তে এ জন্মে একটা নেশায় আচ্ছন্নভাব ছাড়া আর পরজন্ম সম্বন্ধে একটা ভিত্তিহীন আশ্বাস ছাড়া কিছুই সে পায় না। অথচ সমাজের ও শাস্ত্রের চাপে এ ভাবে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া তার বিকল্প কিছু থাকে না।
এই যদি মানুষকে দেবার থাকে ধর্মের, তবে আজ বিজ্ঞানের এবং ইতিহাসচর্চার দ্বারা মানুষ যখন বুঝতে পেরেছে যে, কী কী সামাজিক অবস্থায় পুরোহিত শাস্ত্রকার সম্প্রদায় কোন কোন উদ্দেশ্য সিদ্ধির অভিলাষে কোন কোন শাস্ত্র প্রণয়ন করেছে, তখন ধর্মের অভিপ্রায় এবং কায়েমি স্বার্থের রূপটি পরিষ্কার হয়ে যায়। পূর্বে মানুষ যা ধর্মের কাছে পেত, আজ তার অনেকটাই পাচ্ছে বিজ্ঞানের কাছে, শিল্প সাহিত্যের কাছে। এখন ধর্ম প্রায় সব সম্প্রদায়কে বলছে যে, তার নিজের বোধ বিশ্বাসটিই খাঁটি, অন্যদের সব কিছুই ভ্রান্ত। এবং তার চেয়েও পরিতাপের কথা, ধর্মব্যবসায়ীরা আজ কুমন্ত্রণা দিচ্ছে মানুষকে, বলছে, ভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ যেহেতু ভুল মতে ও পথে চলছে, অতএব তারা অন্যদের শত্রু; এ শত্রুকে সমূলে নিঃশেষ করাই আজ সবচেয়ে বড় ধর্মকৃত্য হয়ে উঠেছে।
স্পষ্টতই এ কুমন্ত্রণা দানবিক, মানবিক নয়। ‘সঙ্ঘ পরিবার’ আজ যাকে ধর্মযুদ্ধ বলছে, তার চেয়ে অধর্মযুদ্ধ আর কিছুই হতে পারে না। এবং লজ্জা ও ঘৃণার বিষয় এই যে, এই নারকীয় অভিযানটা ধর্মের আবরণে রাষ্ট্রনৈতিক ক্ষমতা দখলের জন্যেই হচ্ছে। এরা কেউ কিছুই বিশ্বাস করে না। ঈশ্বরে বিশ্বাস করলে এরা মানতে বাধ্য হত যে, মুসলমান, শিখ, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, আমার ভিন্নধর্মাবলম্বী ভাই, কারণ ঈশ্বর বিশ্বপিতা। যে ‘ধর্ম’ বা বিশ্বাস মানুষকে শত্রু বলে চিহ্নিত করে, কেবলমাত্র তার ধর্মবিশ্বাস ভিন্ন বলে, সে-বিশ্বাস সম্পূর্ণতই মানবতাবিরোধী।
ভারতবর্ষে ধর্মের বিষয়ে বারবার অন্য কথাও শুনেছি। ভীষ্ম শরশয্যায় শুয়ে ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরকে বলছেন, ‘তোমাকে একটি গোপন কথা বলছি যুধিষ্ঠির, মানুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ আর কিছুই নেই।’ চণ্ডীদাস বলেন, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’, অর্থাৎ এঁরা দু’-জনই ঈশ্বর দেব-দেবী কাল নিয়তি সব কিছুকে অস্বীকার করলেন। আমরা শুনেছি, ‘জীবে দয়া করে যেই জন সেই জন সেবিছে ঈশ্বর’— এখানে তো জীবই ঈশ্বর হয়ে গেল, কিংবা শুনেছি, ‘জীব মাত্রই শিব’। এ সব কথা বলেছেন ধর্ম-শাস্ত্রকাররা নয়, গুরু-পুরোহিতরা নয়, বলেছেন মহাপ্রাণ মানুষরাই এবং এঁদের এ-সব কথা শাস্ত্রবচনের চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান। কিন্তু মানুষ ধর্ম বলতে এ-সব কথা বোঝে না, বোঝে আচার-বিচার, ভেদবুদ্ধি, সাম্প্রদায়িকতা। মানবিকতা নয়।
এই যখন ঘটেছে তখন মানবিকতার দৃষ্টিতে ধর্ম আজ দেউলে হয়ে গেছে। মানুষকে দেবার মতো জীবনরস তার শুকিয়ে গেছে, বাকি আছে শুধু নেশাটুকু। যা তাকে ভোলায়, অন্যকে সহ্য করতে শেখায় না, সত্য দেখতে দেয় না। আজকের সত্য হল, দিকে দিকে মানুষের দুঃসহ দুর্গতি; খাদ্য-বস্ত্র, শিক্ষা-স্বাস্থ্য, বাসস্থান, নিরাপত্তার একান্ত অভাব; রাষ্ট্রপতিরা এবং ধর্মধ্বজীরা একযোগে এই দুর্গতিতে ইন্ধন জোগাচ্ছে, মানুষের শোষণপীড়ন বাড়াবার জন্য। মুখে বলছে, ছুঁচো, প্যাঁচা, বানর, ইঁদুরে ব্রহ্ম আছে কিন্তু ডোম-চণ্ডাল-মুসলমানে গিয়ে আর ব্রহ্ম দেখতে পাচ্ছে না। সর্বতোভাবে ধর্মের আড়ালে একটা প্রকাণ্ড স্বার্থপর পুঁজিবাদী আয়োজন চলছে, সাধারণ মানুষকে পিষ্ট করে নিঃশেষ করে দেবার। দেশের মানুষ কি আজও এই প্রকাণ্ড স্বার্থসন্ধ ফাঁকিটা দেখতে পাবে না, বুঝতে পারবে না যে, এ লড়াইটা আসলে ক্ষমতার লড়াই, ওই নকল মোটর রথটার গন্তব্যস্থল হল দিল্লির মসনদ? একদা আমরা পরকে আপন করতে জানতাম, তাই যবন, পারদ, পহ্লব, মূতীব, শক, হুন সকলকে নিঃশেষ মিলিয়ে নিতে পেরেছি সমাজদেহে। কাজটা সহজ ছিল না, প্রতি শতাব্দীতে ঢেউয়ের মতো এসেছে বিদেশি আক্রমণকারী; তবু আর্যাবর্ত সবাইকে স্থান দিতে পেরেছে, পরকে আপন করতে পেরেছে।
আজ এ কী দুর্দশা আমাদের? এত শতাব্দী যারা পরম আপন ছিল আজ সমস্ত উদ্যম নিয়ে তাদের পর করতে উঠে পড়ে লেগেছি। এ কখনও ধর্ম হতে পারে না। যে ধর্ম ধারণ করে তাড়িয়ে দেয় না, হানাহানি করে না, আগুন ধরায় না ভাইয়ের ঘরে। বাবর তাঁর পুত্র হুমায়ুন বাদশাকে শেষ চিঠি লিখে যাচ্ছেন: ‘হিন্দু মুসলমান দুই-ই তোমার প্রজা, উভয়ের প্রতি সমদর্শী হয়ো’, সেই বাবরের নামের মসজিদ পূর্বকল্পিত ভাবে সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা ধরে ভাঙা হল কেন্দ্রীয় সরকারের প্রত্যক্ষ সমর্থনে। কেউ কিছু বলল না। এক মিনিটে দিল্লিতে খবর গেছে, দশ মিনিটে হেলিকপ্টার কাঁদানে গ্যাসের বোমা ফেলে ওই তাণ্ডবলীলার অবসান ঘটাতে পারত। করেনি যখন, তখন কেন্দ্রীয় সরকারের প্রশ্রয়ে শুধু নয়, পরিকল্পনায়, পূর্বনির্দেশে ওই দানবীয় পর্ব সমাধা হয়েছে। এতে কোনও সন্দেহ থাকে না। আজ বাতাস অন্য দিকে বইছে বলে এরা হঠাৎ শান্তির ললিতবাণী উচ্চারণ করছে, কিন্তু আজ তা নিছক পরিহাসে পর্যবসিত হয়েছে।
অতএব ধর্ম আজ দেউলে শুধু নয়, পাপ ব্যবসায়ে লিপ্ত। এখন মানুষ কোন নিরিখে জীবনের পথ নির্ণয় করবে? ‘বহুজনহিতায় বহুজনসুখায় লোকানুকম্পায়ৈ, মহতো জনকায়স্যার্থায়।’ বুদ্ধ বলেছেন, বহু মানুষের হিতের জন্যে, বহু মানুষের সুখের জন্যে, মানুষের প্রতি করুণাবশত, বৃহৎ জনকায়ের স্বার্থে। এর চেয়ে বড় কোনও আদর্শ আজ আর হতে পারে না। এক মহানুভব প্রাণ এই অনুজ্ঞা দিয়ে গেলেন মানবজীবন নিয়ন্ত্রণের নিরিখ হিসেবে। ব্রাহ্মণ্য ধর্ম, ইসলাম, শিখ, ইয়োরোপে খ্রিস্টান ধর্ম যখন রক্তাক্ত নখদন্ত প্ৰকাশ করেছে, তখন একমাত্র অহিংস বৌদ্ধধর্মই এমন মত প্রচার করল যা ধর্ম নয়, বেদনাদীর্ণ মানবচিত্তের মর্মকথা, যাতে বিভেদ লুপ্ত হয়, মানুষমাত্রেই বৃহৎ জনকায়ের অংশ ও পরস্পরের ভাইয়ে পরিণত হয়। আড়াই হাজার বছরের ব্রাহ্মণ্যধর্ম যা দিতে পারেনি তা আজ বুদ্ধের এ বাণীতে ধ্বনিত, যা আজকের দিনের প্রয়োজনে আজকের দিনের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ তার অন্তরের নির্দেশে হয়তো নিজে থেকেই লাভ করত। সরকারি ধর্মগুলো আজ দেউলে, রসের খাত বইছে মানুষের মনুষ্যত্বে, মানুষের সৌভ্রাত্রে। এই সংগ্রাম ক্ষমতায় আসীন ধর্মধ্বজীদের বিরুদ্ধে। এ সংগ্রাম মৃত্যুর বিরুদ্ধে জীবনের সংগ্রাম। মানুষকে মানুষ হিসেবে বাঁচতে হলে এ ছাড়া অন্য পথ নেই, এবং দেয়ালে পিঠ রেখেও এ সংগ্রামে আমাদের আজ জিততেই হবে।