বর্ণপরিচয়ের প্রথম সংস্করণ – রতনতনু ঘাটী
সকাল থেকে বাড়ির মাচায় রাখা যত পুরোনো খাতা, কাগজ ও বইপত্র নামিয়ে কী খুঁজছিল অয়ন। মা কাজের ফাঁকে-ফাঁকে এক-একবার এসে বলে গেছেন, কী করছিস তুই পুরোনো কাগজপত্র ঘেঁটে? গোটা ঘরময় ধুলো-ময়লা করছিস। কতদিন তোর বাবাকে বলেছি, ওগুলো কাগজওয়ালার কাছে বিক্রি করে দাও। তো কে শোনে কার কথা! মা চলে গেলেই আবার কাগজ ঘাঁটতে শুরু করে অয়ন।
অয়ন কী খুঁজছে, তা শুধু জানে দেবল। অয়নের প্রাণের বন্ধু দেবল। দু-জনে একই স্কুলে ক্লাস নাইনে পড়ে।
দেবল গরমের ছুটিতে বেড়াতে গিয়েছিল কলকাতায়। সেখানেই অরুণাংশুদার কাছে প্রথম শুনেছে কথাটা। কলকাতায় কারা নাকি একটা বই খুঁজছে। বইটা পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয়-এর প্রথম সংস্করণ। অরুণাংশুদা এও বলেছেন, যারা বইটি খুঁজছে, তারা বইটির জন্য একলক্ষ টাকাও খরচ করবে। তারা যে কেন বইটি খুঁজছে, কী কাজে তাদের লাগবে বইটি, অত কথা দেবল জানতে চায়নি। কলকাতা থেকে ফেরার পথে দেবল শুধু বলে এসেছে, আমি যদি খুঁজে পাই অরুণদা, আপনাকে চিঠি দিয়ে জানাব।
দেবল গ্রামে ফিরে এসে অয়নকে কথাটা না বলে পারেনি। আর অয়ন শোনার পর থেকেই অনেক পরিকল্পনা এঁটে ফেলেছে। বইটা পাওয়া যাক বা না যাক, পরিকল্পনা করতে দোষ কী? বইটা পেয়েই গেছে এভাবেই দুই বন্ধুতে কত পরিকল্পনার খসড়া করে ফেলেছে। টাকাটা তো কম নয়! একলক্ষ টাকা। আর মাত্র বছর দেড়েক পরেই তো মাধ্যমিক পরীক্ষা হয়ে যাচ্ছে। ব্যস, পরীক্ষাটা হয়ে গেলেই অয়ন-দেবলকে আর পায় কে? গোটা ভারতবর্ষটা ঘুরে দেখবে প্রথমে। আমার দেশটা আগে আমাদের ঘুরে দেখা দরকার। বিবেকানন্দ পায়ে হেঁটে গোটা ভারত পরিক্রমা করেছিলেন। পায়ে হেঁটে না হোক, অন্তত ট্রেনে চড়েও তো অয়ন-দেবল ঘুরে আসতে পারবে ভারতটা। তারপর টাকা বাঁচলে…। দেবলই বলেছে, একবার যদি আমেরিকাটা ঘুরে আসা যেত, বেশ হত। দেবল এও বলেছে, বুঝলি অয়ন, চল বরং আমেরিকাটা দেখে আসি। ভারত তো নিজের দেশ, পরে বড়ো হয়ে রোজগার করলে ঘুরে আসা যাবে।
অয়ন পুরোনো বই-খাতা ঘাঁটতে-ঘাঁটতে ভাবল, যদি একবার পেয়ে যেত বইটা! অয়ন বাবার কাছেই গল্প শুনেছে, অয়নের দাদুর বাবার খুব শখ ছিল বই সংগ্রহের। তিনি বই পড়তেনও অনেক। আর সময় পেলে ছড়া লিখতেন। উনি নিশ্চয়ই বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় বইটা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে কিনেছিলেন। আর উনি তো কোনও বই ফেলে দেওয়ার মতো মানুষ ছিলেন না।
অয়ন বাবার কাছ থেকে জেনে নিয়ে একটা বংশতালিকা তৈরিও করেছে। ওর দাদুর নাম ছিল অভয়পদ, আর দাদুর বাবার নাম ছিল বিভূতিবিনোদ। পুরোনো বই ঘাঁটতে-ঘাঁটতে অয়ন দেখল, বিভূতিবিনোদ অনেক ছড়া লিখেছিলেন। সেগুলো কোনওটাই ছাপা হয়নি। দু’-একটা খাতা ঝেড়েমুছে বের করল অয়ন। না:, কোত্থাও বর্ণপরিচয় পাওয়া গেল না। যাবেই বা কী করে! অযত্নে সব বই পোকায় কেটেছে, নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ভাবল, বাবাকে বলে একটা আলমারি বা বুক সেলফ বানাবে। বইগুলো যাতে গুছিয়ে রাখা যায়।
পুরোনো বই-খাতাগুলো গুছিয়ে রাখল অয়ন। তারপর সোজা চলে গেল চিলেকোঠার ছাদে। সঙ্গে বিভূতিবিনোদের স্বরচিত ছড়া লেখার খাতা দুটো। বেশির ভাগ ছড়াই কারও-না-কারও উদ্দেশে লেখা। ছড়াগুলো পড়তে-পড়তে একটা পাতায় এসে থেমে গেল অয়ন। উত্তরসূরিদের উদ্দেশে ছড়াটা লেখা। কিন্তু ছড়াটার মধ্যে একটা লুকোনো ধনরত্নের ব্যাপার আছে। কেমন ইঙ্গিতবহ ছড়াটা।
দুপুরে খেয়েই মাকে বলে অয়ন বেরিয়ে পড়ল দেবলদের বাড়ি। দেবল বসে-বসে অঙ্ক করছিল। অয়নকে পেয়ে আনন্দে লাফিয়ে উঠল। আয়, তোর কথাই ভাবছিলাম। কিছু পেলি?
অয়ন হতাশ গলায় বলল, পেয়েছি, তবে বর্ণপরিচয় নয়, দুটো ছড়ার খাতা।
দেবল তো অবাক, ছড়া? কার লেখা?
অয়ন রহস্য-মেশানো গলায় বলল, আমার দাদু অভয়পদর বাবা বিভূতিবিনোদবাবুর।
তিনি কি কবি ছিলেন? দেবলের গলায় বিস্ময়।
অয়ন বলল, হ্যাঁ, কবি তো বটেই। এই দ্যাখ, খাতা দুটো এনেছি।
দেবল কেমন এড়িয়ে যাওয়ার ভঙ্গি করে বলল, দ্যাখ অয়ন, ওসব ছড়া-টড়া আমার ভালো লাগে না। ও তুই পড়িস।
অয়ন বাধা দিয়ে বলল, আহা, ছড়া নয় রে বাবা, গুপ্তধন।
দেবল বিস্ময়ের গলায় বলল, কোথায়?
অয়ন ফিসফিস করে বলল, বিভূতিবিনোদ একটা ছড়ায় তাঁর উত্তরসূরিদের জন্য গুপ্তধনের ইঙ্গিত রেখে গেছেন। তুই পড়ে দ্যাখ।
দেবল মনে-মনে পড়ল বার কয়েক। একটা ছোট্ট ছড়া। মাত্র ছ-লাইন। কিন্তু মানে বোঝা কঠিন। তবে, একটা গুপ্তধনের ইঙ্গিত যে আছে সেবিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই!
অয়নই বলল, তুই জোরে-জোরে ছড়াটা পড় তো দেবল। অনেক সময় কঠিন বিষয় জোরে-জোরে পড়লে কেমন মাথায় ঢুকে যায় সহজে!
দেবল ছড়াটা পড়ল—
বর্ণের সাথে পরিচয় কর
তারপর চাবি ধন—
দেবালয়। আর ওঠানামা
তিনি নীচে দিবি মন।
বংশের ধারা পাবে তাই রাখলাম।
যা পাবি তার লক্ষ মানিক দাম।।
এই ছড়া নিয়ে গবেষণায় ওদের কেটে গেল সারা বিকেল।
সেদিন রাত্রে খাওয়ার সময় অয়ন বাবাকে ছড়াটা বলল। বাবা তো হেসে উড়িয়ে দিলেন। অয়ন কিন্তু গুপ্তধনের কথাটা মাথা থেকে উড়িয়ে দিতে পারল না। অয়ন আর দেবল মিলে অনেক গবেষণা করেছে ছড়াটা নিয়ে। এখন পর্যন্ত ওরা শুধু একটা কথাই উদ্ধার করতে পেরেছে ছড়া থেকে — তা হল মন্দির। কিন্তু মন্দির অয়নদের বাড়ির চারপাশে নেই। হ্যাঁ, তবে একটা মন্দির আছে, অনেক দিনের পুরোনো। গাছ আর আগাছায় ভরতি। বাদুড়, চামচিকের বাসা। কোনও মানুষের পক্ষে ওই পোড়ো মন্দিরের কাছে যাওয়া সহজ কাজ নয়।
অয়নদের পাড়ায় কয়েকজন কলেজে-পড়া দাদারা মিলে তৈরি করেছে ‘গোয়েন্দা সব্যসাচী’ নামে একটা সংস্থা। তাদের কাজই হল কেউ কোনও সমস্যায় পড়লে উদ্ধার করা। এক ছুটির দিন বিকেলে অয়ন আর দেবল ছড়াটা নিয়ে গেল গোয়েন্দা সব্যসাচীর দপ্তরে। অলকেশদা আর অভিরামদা — এই দু-জনে মিলে প্রথম তৈরি করেছিল সংস্থাটা। তাই সংস্থার নাম সব্যসাচী। দু-জনে মিলে যেন একজন গোয়েন্দার দুটো হাত। আর গোয়েন্দা রহস্য সমাধানে যে-দুটো হাত সমান দক্ষ। পরে আরও কয়েকজন এসে যুক্ত হয়েছে।
ওরা যখন গোয়েন্দা সব্যসাচীর দপ্তরে গেল, তখন একটা লোক চুপ করে বসে আছে একপাশে। অয়নরা একটু ইতস্তত করছে দেখে অলকেশদা বলল, তোমরা অকপটে সব কথা বলতে পারো।
অয়ন ছড়াটা দেখাল আর সব কথা খুলে বলল ওদের। সব শুনে অভিরামদা বলল, তোমাদের কথা শুনলাম, ছড়া লিখে রেখে যাও। সাতদিন পরে এসো।
দেবল একটা সাদা কাগজে ছড়াটা লিখে দিল। ওরা যখন বিভূতিবিনোদের হাতের লেখা ছড়ার পাতাটা পকেটে পুরে গোয়েন্দা সব্যসাচী থেকে বেরিয়ে আসছে—তখন ওরা দেখল, এক কোণে বসে থাকা বয়স্ক লোকটার চোখদুটো যেন আগুনের মতো চকচক করছে।
সন্দেহের চোখে তাকিয়ে ওরা চলে এল।
ওদের এই মফস্বল শহরে এই লোকটাকে ওরা কখনও দ্যাখেনি। পরে অভিরামদার কাছে শুনেছে লোকটা একটা বদ্ধ পাগল। লোকটার পূর্বপুরুষরা ছিল খুব বড়োলোক। অনেক টাকাপয়সা, ধনরত্ন ছিল। সেই সম্পদ খরচ হতে হতে এই লোকটার কাছে এসে একদম শূন্য হয়ে গেছে। তাই লোকটা সারাজীবন ধরেই গুপ্তধনের খোঁজ করে গেল শুধু। এমনকী কোন দেশের নদীর জলে নাকি সোনা পাওয়া যায়। অনেক টাকা খরচ করে সেখানেও গিয়েছিল। একবার বেশ কিছুদিন ধরে ওদের শহর থেকে দূরে একটা দিঘিতে ঝিনুকের পেট থেকে মুক্তো পাওয়া গিয়েছিল শুনে দিঘির জলে ডুবে-ডুবে লোকটা ঝিনুক তুলত আর ডাঙায় এসে ভেঙে দেখত। ঝিনুক থেকে মুক্তো আর পায়নি কোনওদিন।
ওরা বেশ কয়েকবার গেল গোয়েন্দা সব্যসাচীর দপ্তরে। কিন্তু উঠতি গোয়েন্দারা মন্দির ছাড়া আর কিছু আবিষ্কার করতে পারল না। অয়নের বাবা একদিন অয়ন আর দেবলকে বললেন, ছড়াটা কোনও গুপ্তধনটনের নয়, ছড়াটা ছড়াই।
ওরাও পরে-পরে গুপ্তধনের কথাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলেছে। বরং পুরোনো কাগজওলার কাছে বর্ণপরিচয়ের প্রথম সংস্করণটা খুঁজলে লাভ আছে। পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে ওরা সেচেষ্টাই চালিয়ে যাচ্ছে।
ওরা কলকাতার অরুণাংশুদাকেও চিঠি দিয়েছে। লিখেছে, আমরা এখনও খুঁজে যাচ্ছি। বইটা পেলেই জানাব।
দেখতে-দেখতে মাধ্যমিক পরীক্ষা এসে গেল। জোর করে মন থেকে তাড়াতে হল ওই বর্ণপরিচয়ের চিন্তাও। অয়নের বাবা বলেছেন, আসল গুপ্তধন লুকিয়ে আছে মাধ্যমিক পরীক্ষার মধ্যেই। ভালো করে পরীক্ষাটা না দিলে সব ফক্কা।
সেদিন দেবল কী একটা প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য আসছিল অয়নদের বাড়ি। পোড়ো মন্দিরের পাশে সেই গুপ্তধন-খোঁজা লোকটাকে ঘুরঘুর করতে দেখে চমকে গেল দেবল। আর লোকটাও খুব ধূর্ত। দেবলকে চিনতে পেরেছে। অমনি সাঁত করে চলে গেল অন্যদিকে।
পড়াশোনার আলোচনার ফাঁকে দেবল কথাটা বললও অয়নকে। তারপর দেবল চলে গেল বাড়ি।
মাধ্যমিক পরীক্ষাও দিয়ে দিল ওরা। দু-জনেই পরীক্ষা ভালো দিয়েছে। এবার যেন এক অন্যরকম ছুটির গন্ধ। এখন যেন বেশ ভারমুক্ত মনে হচ্ছে ওদের।
অয়ন সেদিন কোথায় যেন যাওয়ার জন্য যেই বাড়ি থেকে বেরিয়েছে, অমনিই দেখল সেই লোকটা পোড়ো মন্দিরের লতা-পাতার মধ্যে কী খুঁজছে যেন। লোকটা অয়নকে দেখেনি। তাই অয়ন একটু আড়াল খুঁজে দাঁড়িয়ে পড়ল। দেখল, লোকটা নিবিষ্টমনে কী খুঁজছে। অয়ন ভাবল, তাহলে কি লোকটা বিভূতিবিনোদের ছড়ার সূত্র ধরে এসেছে সেই গুপ্তধনের খোঁজে?
আবার গুপ্তধনের কথাটা মাথায় চড়ে বসল। বাড়ি এসে বের করে দেখতে চাইল সেই বিভূতিবিনোদের ছড়ার খাতাটা। অনেকদিন কেটে গেছে, তাই ছড়াটার পুরোটা মনেই পড়ছে না। কিন্তু অবাক কান্ড, ছড়াটা তো দূরের কথা, খাতা দুটোও নেই। বইয়ের সেলফে রেখে দিয়েছিল খাতা দুটো। তা হলে খাতা দুটো কে নিল?
মাকে জিজ্ঞেস করতে মা বললেন, একটা লোক এসেছিল পুরোনো খাতা কিনতে। সেবই কিনবে না। তার শুধু পুরোনো খাতা চাই। দামও দিতে চাইল অনেক বেশি। তাই পুরোনো খাতা সব ওকে দিয়ে দিয়েছি।
অয়ন মার কাছ থেকে লোকটার যা বর্ণনা পেল, তাতে মনে হল ওই গুপ্তধন-খোঁজা লোকটাই গুপ্তধনের লোভে খাতাগুলো নিয়ে গেছে।
অয়ন ভাবল, এখনই একবার দেবলের কাছে যাওয়া দরকার।
সব কথা শুনে দেবল বলল, চল, আমরা গোয়েন্দা সব্যসাচীতে যাই।
অয়ন বলল, না, বরং লোকটাকে চোখে-চোখে রাখি চল। লোকটা হয়তো ছড়াটা পড়ে একটা পথের সন্ধান পেয়েছে। আর সেই পথ ধরেই খুঁজতে এসেছে গুপ্তধন।
লোকটাকে ওরা আরও কয়েকদিন দেখল পোড়ো মন্দিরে। একদিন সকালে ওরা দেখল মন্দিরের সিঁড়ি পর্যন্ত ঝোপ-লতাপাতা কেটে একটা সরু রাস্তা বানানো হয়েছে। সিঁড়ির দু-একটা জায়গায় শাবলের আঘাতে গর্ত খোঁড়া হয়েছে। তাহলে আর দু-একদিনের মধ্যেই হয়তো লোকটা গুপ্তধনের জন্য জোর তল্লাশি চালাবে। দিন তিনেক লোকটাকে আর দুপুরে মন্দিরের কাছে দেখা যাচ্ছে না। তার মানে, লোকটা টের পেয়ে গেছে যে, ওকে অয়নরা নজর রাখছে। তাই এখন মনে হয় রাত্রে আসছে। তাহলে ক-দিন যদি রাত্রে অয়নদের ছাদ থেকে লক্ষ রাখা যায়, তাহলে ধরা যেতে পারে লোকটাকে।
সেই ভাবনা মতো দেবল বাড়ির অনুমতি নিয়ে রাত্রে থাকার জন্যে চলে এল অয়নদের বাড়ি। বাবা-মা তেমন বাধা দিলেন না। যাক, পরীক্ষা তো হয়ে গেছে। এখন দু-বন্ধুতে একটু আনন্দে কাটাক।
ওরা ছাদে বসে থাকল রাত বারোটা পর্যন্ত। একবার মনে হল, একটা ছায়ামূর্তি যেন ঢুকে গেল মন্দিরের দিকে। তারপর আর কিছু নেই। কোনও শব্দও নেই। ওরা ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
সকালে উঠেই ঘুমচোখে ওরা গিয়ে দেখল, সিঁড়িতে খোঁড়াখুঁড়ির চিহ্ন অনেক বেশি। তাহলে কি লোকটা ভেবেছে — সিঁড়ির নীচেই আছে লুকনো গুপ্তধন?
পরের রাত্রে বারোটা পর্যন্ত ওরা জেগে বসে রইল ছাদে। কাউকেই দেখতে পেল না। তাহলে কি লোকটা গুপ্তধনের আশা ছেড়ে দিয়েছে?
সকালে গিয়ে ওরা দেখল, গতকালের চেয়ে অনেক খোঁড়াখুঁড়ি বেশি। মন্দিরের সিঁড়ির তিনটে ধাপ। ওপরের দুটো ধাপ প্রায় খোঁড়াই হয়ে গেছে। তা হলে লোকটা কি এখন ভোর রাতে আসছে?
ওরা এবার রাত্রে তাড়াতাড়ি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। আজ আবার পূর্ণিমা। জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে চারদিক। মাঝরাত্রে লোডশেডিং হতে মাকে বলে ওরা ছাদে শুতে গেল। আর ঠিক রাত তিনটের সময় দেখল, সেই লোকটা এগিয়ে যাচ্ছে পোড়ো মন্দিরের দিকে। কিছুক্ষণ পর লোকটাকে আবছ্য জ্যোৎস্নার আলোয় ব্যস্ত হয়ে উঠতে দেখে ওরা সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল নীচে। মন্দিরের কাছাকাছি যেতেই, একটা ছোটো বাক্স হাতে লোকটাকে ছুটে পালাতে দেখে ছুটল ওরাও। শহর ছাড়িয়ে দূরে একটা ফাঁকা মাঠ। সেই মাঠের মাঝখানে পড়ে থাকা ইঁটে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল লোকটা। দেবল গিয়ে জাপটে ধরে ফেলল লোকটাকে। লোকটা পড়ে গিয়েও বাক্সটা হাত থেকে ছাড়েনি।
লোকটা চিৎকার করে উঠল, না, এ গুপ্তধন আমি কাউকে দেব না, না।
অয়ন লোকটাকে বসিয়ে দিল মাঠের ওপর। তারপর সহজ গলায় বোঝানোর মতো করে বলল, এ গুপ্তধন তো আমার। আমার দাদুর বাবা রেখে গেছেন। প্রথম সন্ধান তো আমরা পেয়েছি। তোমাকে দেব না।
লোকটা হুটোপাটি করছে দেখে দেবল বলল, শোনো, এই গুপ্তধনে তোমার এবং আমাদের দু-জনের সমান অধিকার। তুমি অর্ধেক নেবে, আর আমরা নেব অর্ধেক।
লোকটা দেবলের কথায় যেন শান্ত হল। বলল, ঠিক আছে, এখনই বাক্সটা ভেঙে ভাগ করব। তবে বেশি নেব আমিই।
অয়ন ঘাড় নেড়ে সায় দিল। লোকটা সাঁড়াশির মতো কী একটা দিয়ে জোরে চাগাড় দিল। উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছে লোকটা। কড়কড় করে একটা শব্দ হল তারপর খুলে গেল বাক্সটার পাল্লা।
লোকটা হুমড়ি খেয়ে পড়ল বাক্সটার ওপর। ওদিকে পুবের আকাশ ফরসা হয়ে উঠছে। ওরা সবাই তাকিয়ে দেখল বাক্সটার মধ্যে কী একটা বই।
লোকটা বাক্সটাকে রাগে-দুঃখে ছুঁড়ে ফেলে দিল দূরে। তারপর হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। অয়ন কী করবে বুঝে উঠতে পারল না। দেবল বাক্সটার কাছে গিয়ে দেখল, যে বইটা ওরা খুঁজছে, এ তো সেই বই, বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয়। অয়নকে হাত নেড়ে ডাকল দেবল।
বর্ণপরিচয় দেখে অয়নও বেশ উত্তেজিত। ভোরের আকাশ লাল হয়ে উঠেছে। অয়ন মুখ নীচু করে স্পষ্ট দেখতে পেল—বইটা প্রথম সংস্করণই।
আনন্দে লাফিয়ে উঠল ওরা। এবার হাঁটতে লাগল ওরা বাড়ির দিকে। ওদের কাছে এখন বিভূতিবিনোদের ছড়াটাও সহজ হয়ে গেল। আগে লেখাপড়া করা দরকার, তারপর তো টাকা পয়সা আসবে। তাই মন্দিরের ওঠা-নামা অর্থাৎ সিঁড়ির তিন ধাপ নীচে তলায় বিভূতিবিনোদ বর্ণপরিচয় বইটা যত্নে রেখে দিয়েছেন। তিনি তো আর জানতেন না যে বইটার দাম পরে এত হবে। তবু তিনি লিখেছিলেন—লক্ষ মানিক দাম। কারণ—পড়াশোনার মতো এত মূল্যবান তো আর কিছু নেই।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে দেবলই বলল, শোন অয়ন, আজই আমরা সোজা কলকাতায় অরুণাংশুদার কাছে যাব। তারপর ঠিক করব ভারত ভ্রমণের খসড়া।
অয়নও ঘাড় নেড়ে সায় দিল দেবলের কথায়।