উপন্যাস
বড় গল্প
সংকলন
রচনা

বর্গি এল দেশে

বর্গি এল দেশে

এক

‘খোকা ঘুমুলো, পাড়া জুড়ুলো
বর্গী এল দেশে’—

আমাদের ছেলেভুলানো ছড়ার একটি পঙক্তি।

মনে করুন, বাংলাদেশের শান্ত স্নিগ্ধ পল্লিগ্রাম। দুপুরবেলা, চারিদিক নিরালা। শ্যামসুন্দর পল্লিপ্রকৃতি রৌদ্রপীত আলো মেখে করছে ঝলমল ঝলমল। বাতাসে কোথা থেকে ভেসে আসছে বনকপোতের অলস কণ্ঠস্বর।

চুকে গিয়েছে গৃহস্থালির কাজকর্ম। মাটিতে শীতলপাটি বিছিয়ে খোকাকে নিয়ে বিশ্রাম করতে এসেছেন ঘুম ঘুম চোখে খোকার মা। কিন্তু ঘুমোবার ইচ্ছা নেই খোকাবাবুর। বিদ্রোহী হয়ে তারস্বরে তিনি জুড়ে দিলেন এমন জোর কান্না যে, ঘুম ছুটে যায় পল্লির এ-বাড়ির ও-বাড়ির সকলের চোখে, ছিঁড়ে যায় বনকপোতের শান্তিগান, তরুলতার কলতান, সচকিত হয়ে উঠে নির্জন পথের তন্দ্রাস্তব্ধতা।

ঘুমপাড়ানি সঙ্গীতের তালে তালে খোকার মাথা আর গা চাপড়ে চলেন খোকার মা। সেই আদর-মাখা নরম হাতের ছোঁয়ায় খানিক পরে খোকাবাবুর চোখের পাতা জড়িয়ে এল ঘুমের ঘোরে, ধীরে ধীরে। অবশেষে মৌন হল ক্রন্দনভরা কণ্ঠস্বর।

পাড়া গেল জুড়িয়ে।

আচম্বিতে অগাধ স্তব্ধতার নিদ্রাভঙ্গ করে দিকে দিকে জেগে উঠল অত্যন্ত আতঙ্কিত জনতার গগনভেদী আর্ত চিৎকার!

পথে পথে পাড়ায় পাড়ায় ভীত উচ্চরব শোনা গেল—’পালাও, পালাও! এল রে ওই বর্গি এল! সবাই পালাও, বর্গি এল!’

ধূলিপটলে দিগবিদিক অন্ধকার। উল্কাবেগে ঘোড়া ছুটিয়ে ধেয়ে আসে হাজার অশ্বারোহী—ঊর্ধ্বোত্থিত হস্তে তাদের শাণিত কৃপাণ, বিস্ফারিত চক্ষে নিষ্ঠুর হিংসা, কর্কশ কণ্ঠে ভৈরব হুংকার!

বর্গি এল দেশে—ঘরে ঘরে হানা দিতে, গৃহস্থের সর্বস্ব লুঠতে, গ্রামে গ্রামে আগুন জ্বালাতে, পথে পথে রক্তস্রোত ছোটাতে, আবালবৃদ্ধবনিতার প্রাণ হরণ করতে!

পাড়ায় পাড়ায় ঘরে ঘরে ধড়মড় করে উঠে বসল আবার ঘুমভাঙা খোকাখুকিরা। কিন্তু আর শোনা গেল না তাদের কান্না, বনকপোতের ঘুমপাড়ানি সুর এবং তরুলতার মর্মররাগিণী।

এমনি ব্যাপার হয়েছে বারংবার। তখন অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি কাল। বাংলার মাটিতে ইংরেজরা শিকড় গাড়বার চেষ্টা করছে ছলে বলে কৌশলে।

‘বর্গি’ বলতে কী বোঝায়?

আভিধানিক অর্থানুসারে যার ‘বর্গ’ আছে সে-ই হল ‘বর্গি’। ‘বর্গে’র একটি অর্থ ‘দল’। যারা দল বেঁধে আক্রমণ করত তাদেরই বর্গি বলে ডাকা হত।

ইতিহাসেও ‘বর্গি’ বলতে ঠিক ওই কথাই বুঝায় না। ‘বর্গি’ নাকি ‘বারগীর’ শব্দের অপভ্রংশ। মহারাষ্ট্রীয় ফৌজে যে-সব উচ্চ শ্রেণির সওয়ার ছিল নিজেদের ঘোড়ার ও সাজপোশাকের অধিকারী, তাদের নাম ‘সিলাদার’। কিন্তু ‘বারগীর’ বলতে বোঝায় সবচেয়ে নিম্নশ্রেণির সওয়ারদের। তারা অস্ত্রশস্ত্র ও অশ্ব লাভ করত রাজ-সরকার থেকেই।

প্রাচীনকালে অনার্য হুনজাতীয় ঘোড়সওয়াররা দলে দলে পূর্ব-ইউরোপে এবং উত্তর-ভারতে প্রবেশ করে দিকে দিকে লুণ্ঠন ও হত্যাকাণ্ড চালিয়ে ইতিহাসে ভয়াল নাম অর্জন করেছিল। বর্গিরাও সেই জাতীয় হানাদার; তবে তাদের অত্যাচার অতটা ব্যাপক হয়নি, ‘বর্গির হাঙ্গামা’ হচ্ছে বিশেষভাবে বাংলাদেশেরই ব্যাপার।

সত্য কথা বললে বলতে হয়, পরবর্তীকালের বর্গির হাঙ্গামার জন্যে এক হিসাবে দায়ী হচ্ছেন ভারতগৌরব ছত্রপতি শিবাজীই। প্রধানত লুণ্ঠনের দ্বারাই তিনি নিজের সৈন্যদল পোষণ করতেন। তিনি স্বয়ং উপস্থিত থেকে সদলবলে লুণ্ঠনকার্য চালিয়েছেন দক্ষিণ-ভারতের নানা স্থানেই; তার ফলে কেবল মুসলমান নয়, কত সাধারণ নিরীহ হিন্দুও যে নির্যাতিত হয়েছিল, ইতিহাসে তার সাক্ষ্য আছে। তখনকার মারাঠিরাও জানত, লুণ্ঠনই হচ্ছে সৈনিকের অন্যতম কর্তব্য।

আরম্ভেই যেখানে নৈতিক আদর্শ এমনভাবে ক্ষুণ্ণ হয়, পরবর্তীকালে তা উন্নত না হয়ে অধিকতর অবনমিত হয়ে পড়বারই কথা। এক্ষেত্রেও হয়েছিল ঠিক তাই। শিবাজীর কালের মারাঠি সৈনিকদের চেয়ে বর্গিরা হয়ে উঠেছিল আরও বেশি নিষ্ঠুর, হিংস্র ও দুরাচার।

কম-বেশি এক শতাব্দীর মধ্যে মোগলদের শাসনকালে হতভাগ্য বাংলাদেশকে দু-দুবার ভোগ করতে হয়েছিল ভয়াবহ নির্যাতন।

সপ্তদশ শতাব্দীতে ফিরিঙ্গি ও মগ বোম্বেটেদের ধারাবাহিক অত্যাচারের ফলে নদীবহুল দক্ষিণ ও পূর্ব-বাংলার কতক অংশ জনশূন্য শ্মশানে পরিণত হয়েছিল বললেও অত্যুক্তি হবে না। সুন্দরবন অঞ্চলে আগে ছিল সমৃদ্ধিশালী জনপদ, পরে তা পরিণত হয়েছিল হিংস্র জন্তুর জঙ্গলাকীর্ণ বিচরণ ভূমিতে এবং পূর্ববঙ্গের কোনও কোনও অঞ্চলে নাকি আকাশ দিয়ে পাখি পর্যন্ত উড়তে ভরসা করত না।

এমনি সব অরাজকতার জন্যে দায়ী কোনও কোনও লোককে ইতিহাস মনে করে রেখেছে। যেমন পোর্তুগিজদের গঞ্জেলেস ও কার্ভালহো এবং মারাঠিদের ভাস্কর পণ্ডিত। শক্তির অপব্যবহার না করলে এঁদেরও স্মৃতি আজ গরীয়ান হয়ে থাকত।

পোর্তুগিজ বোম্বেটেরা বিজাতীয় বিদেশি। তারা মানবতার ধর্ম ক্ষুণ্ণ করেছিল বটে, কিন্তু স্বজাতির উপরে অত্যাচার করেনি। আর মারাঠি হানাদার বা বর্গিরা ভারতের বাসিন্দা হয়েও ভারতবাসীকে অব্যাহতি দেয়নি, তাই তাদের অপরাধ হয়ে উঠেছে অধিকতর নিন্দনীয়।

দুই

তখন মারাঠিদের সর্বময় কর্তা ছিলেন ছত্রপতি শিবাজীর পৌত্র ও উত্তরাধিকারী মহারাজা সাহু। কেবল নিজ-মহারাষ্ট্রে নয়, মধ্যভারতেও ছিল তাঁর রাজ্যের এক অংশ। তাঁর অধীনে ছিলেন দুইজন নায়ক—পেশোয়া (বা প্রধান মন্ত্রী) বালাজি বাজীরাও এবং নাগপুরের রাজা বা সামন্ত রঘুজি ভোঁসলে। তাঁরা পরস্পরকে দেখতেন চোখের বালির মতো। দুজনেই দুজনকে বাধা দেবার জন্যে সর্বদাই প্রস্তুত থাকতেন।

শিবাজীর সময়ে এমন ব্যাপার সম্ভবপর হত না; কারণ সর্বময় কর্তা বলতে ঠিক যা বোঝায়, শিবাজী ছিলেন তাই। অধীনস্থ নায়কদের চলতে-ফিরতে হত একমাত্র তাঁরই অঙ্গুলিনির্দেশে। সে-রকম ব্যক্তিত্ব বা শক্তি ছিল না মহারাজা সাহুর। অধীনস্থ নায়কদের স্বেচ্ছাচারিতা তিনি ইচ্ছা করলেও সব সময়ে দমন করতে পারতেন না। এই কথা মনে রাখলে পরবর্তী ঘটনাগুলির কারণ বোঝা কঠিন হবে না।

কবিবর ভারতচন্দ্র তাঁর ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যে লিখেছেন—’স্বপ্ন দেখি বর্গীরাজ হইল ক্রোধিত।’

তাঁর আর একটি উক্তি শুনলে সন্দেহ থাকে না যে, কাকে তিনি ‘বর্গীরাজ’ বলে বর্ণনা করেছেন। ভারতচন্দ্র বর্গির হাঙ্গামার সমসাময়িক ব্যক্তি। তিনি বলেছেন।

‘আছিল বর্গীর রাজা গড় সেতারায়।

আমার ভকত বড় স্বপ্ন কহ তায়।।’

‘সেতারা’ বা সাতারার রাজা বলতে সাহুকেই বোঝায়। যদিও বর্গিরা ‘চৌথ’ আদায়ের নামে যে টাকা আদায় করত তার মধ্যে তাঁরও অংশ থাকত, তবু বর্গির হাঙ্গামার সঙ্গে সাহুর যোগ ছিল প্রত্যক্ষ ভাবে নয়, পরোক্ষ ভাবে।

‘চৌথ’ হচ্ছে সাধারণত রাজস্বের চারভাগের এক ভাগ। মারাঠিদের দ্বারা ভয় দেখিয়ে বা হানা দিয়ে চৌথ বলে টাকা আদায়ের প্রথা শিবাজীর আগেও প্রচলিত ছিল। তবে শিবাজীর সময়েই এর প্রচলন হয় বেশি। কিন্তু তখনও তার মধ্যে যে যুক্তি ছিল, সাহুর সময়ে তা আর খাটত না, তখন তা হয়ে দাঁড়িয়েছিল যথেচ্ছাচারিতার নামান্তর মাত্র বা নিছক দস্যুতার সামিল।

চৌথের নিয়মানুসারে টাকা আদায় করবার কথা বৎসরে একবার মাত্র। কিন্তু বর্গিরা টাকা আদায় করতে আসত যখন-তখন। হয়তো একদল বর্গিকে টাকা দিয়ে খুশি করে প্রজাদের মান ও প্রাণ বাঁচানো হল। কিন্তু অনতিবিলম্বে এসে হাজির নতুন আর একদল বর্গি। তারা আবার টাকা দাবি করে। সে দাবি মেটাতে না পারলেই সর্বনাশ। অমনি শুরু হয়ে যায় লুঠতরাজ ও খুনখারাপি—সে এক বিষম ডামাডোলের ব্যাপার।

সময়ে এবং অসময়ে অর্থাৎ প্রায় সব সময়েই বর্গিদের এই যুক্তিহীন ও অসম্ভব দাবি মেটাতে মেটাতে অবশেষে বাংলাদেশের নাভিশ্বাস ওঠবার উপক্রম। কি রাজার এবং কি প্রজার হাল ছাড়বার অবস্থা আর কি!

এই সব নচ্ছার ও পাষণ্ড হানাদারের কবল থেকে বাঙালিরা মুক্তি পেলে কী উপায়ে, এইবারে আমরা সেই কাহিনিই বর্ণনা করব।

কিন্তু তার আগে আর একটা কথা বলে রাখা দরকার। আগেই বলা হয়েছে বর্গির হাঙ্গামা বিশেষ করে বাংলাদেশেরই ব্যাপার। বাদশাহি আমলে এক-একটি ‘সুবা’র অন্তর্গত ছিল এক-একজন সুবাদার বা শাসনকর্তার অধীনস্থ এক-একটি প্রদেশ। বাংলার সঙ্গে তখন যুক্ত ছিল বিহার ও উড়িষ্যা দেশও এবং বর্গির হাঙ্গামার সময়ে এদের সুবাদার ছিলেন নবাব আলিবর্দী খাঁ। ইংরেজদের আমলেও প্রায় শেষপর্যন্ত বাংলা বিহার ও উড়িষ্যার শাসনকর্তা ছিলেন একজন রাজপুরুষই!

প্রাচীনকালে—অর্থাৎ ভারতবর্ষে মুসলমানদের আগমনের আগেও দেখি, বাংলার সঙ্গে বিহার ও উড়িষ্যার কতকাংশ একই রাজ্য বলে গণ্য হয়েছে। বাঙালি মহারাজাধিরাজ শশাঙ্ক প্রভৃতি এমনি রাজ্যই শাসন করতেন। বাঙালির সঙ্গে বিহারি ও ওড়িয়ারা তখন নিজেদের একই রাজ্যের বাসিন্দা বলে আত্মপরিচয় দিত,—’বিহার কেবল বিহারীদের জন্যে’ বা ‘উড়িষ্যা কেবল ওড়িয়াদের জন্যে’,—এ-সব জিগির আওড়াবার চেষ্টা করত না। ইংরেজদের ষড়যন্ত্রেই এ-দেশে এই শ্রেণির সঙ্কীর্ণ জাতি-বিদ্বেষের জন্ম হয়েছে।

বর্গি হানাদাররা পদার্পণ করেছিল বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার যুক্ত রঙ্গমঞ্চেই! তবে এ-কথা বলা চলে বটে, প্রধানত নীচু বাংলার উপরেই তাদের আক্রমণ হয়ে উঠেছিল অধিকতর জোরালো!

তিন

শিবাজীর আমল থেকেই মারাঠি সৈনিকরা লুণ্ঠনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল, আগেই বলা হয়েছে ও কথা।

তখনকার কালে ভারতীয় হিন্দুদের পক্ষে এ-সব হামলা ছিল তবু কতকটা সহনীয়। কারণ ধর্মদ্বেষী মুসলমানদের বহুযুগব্যাপী অত্যাচারের ফলে স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত সমগ্র হিন্দুজাতি অত্যন্ত অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। শিবাজীর অতুলনীয় প্রতিভাই সর্বপ্রথমে প্রতিষ্ঠিত করলে এমন এক বৃহৎ ও পরাক্রান্ত সাম্রাজ্য, যার বিরুদ্ধে মহামোগল ও হিন্দুবিদ্বেষী সম্রাট ঔরংজেবেরও প্রাণপণ প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গিয়েছিল। প্রধানত মুসলমানদের কাহিল করার জন্যেই শিবাজী লুঠতরাজ চালিয়ে যেতেন মোগল সাম্রাজ্যের দিকে দিকে; সেই সূত্রে মোগল সম্রাটের হিন্দু প্রজারাও হানাদারদের কবলে পড়ে অল্পবিস্তর ক্ষতিগ্রস্ত হত বটে, তবে সে ব্যাপারটা সবাই খুব বড় করে দেখত বলে মনে হয় না।

কিন্তু যখন ভারতে মুসলমানরা ক্রমেই হীনবল হয়ে পড়েছে এবং প্রায় সর্বত্রই বিস্তৃত হয়ে পড়েছে মারাঠিদের প্রভুত্ব, তখনও বর্গি হানাদাররা তাদের স্বধর্মাবলম্বী নাগরিক ও গ্রামীণদের উপরে চালিয়ে যেতে লাগল অসহনীয় ও অবর্ণনীয় অত্যাচার এবং তার মধ্যে কিছুমাত্র উচ্চাদর্শের পরিবর্তে ছিল কেবল নির্বিচারে যেন তেন প্রকারে নিছক দস্যুতার দ্বারা লাভবান হবার দুশ্চেষ্টা। যেখান দিয়ে বর্গি হানাদাররা ঘোড়া ছুটিয়ে চলে যায়, সেখানেই পিছনে পড়ে থাকে কেবল সর্ববিষয়ে রিক্ত, ধূ ধূ-করা হাহাকার-ভরা মহাশ্মশান। এতটা বাড়াবাড়ি বরদাস্ত করা ক্রমেই অসম্ভব হয়ে উঠল এবং বাংলার সঙ্গে বিহার ও উড়িষ্যাও পরিত্রাহি ডাক ছাড়তে লাগল।

এক হিসেবে হুন আটিলা ও গ্রিক আলেকজান্ডার উভয়কেই দস্যু বলে মনে করা চলে। কারণ তাঁরা দুজনেই স্বদেশ ছেড়ে বেরিয়ে পরের দেশে গিয়ে হানা দিয়েছিলেন। কিন্তু ইতিহাসে আলেকজান্ডার বরেণ্য ও আটিলা ঘৃণ্য হয়ে আছেন। তার কারণ একজনের সামনে ছিল মহান আদর্শ, আর একজন করতে চেয়েছিলেন শুধু নরহত্যা ও পরস্বাপহরণ। বর্গিদের দলপতিরা ছিল শেষোক্ত নিকৃষ্ট শ্রেণির জীব।

সেটা হচ্ছে ১৭৪১ খ্রিস্টাব্দের কথা। পাঠানদের দমন করবার জন্যে নবাব আলিবর্দী খাঁ গিয়েছিলেন উড়িষ্যায়। জয়ী হয়ে ফেরবার মুখে মেদিনীপুরের কাছে এসে তিনি খবর পেলেন, মারাঠি সৈন্যেরা অসৎ উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে বাংলার দিকে।

তার কিছুদিন পরে শোনা গেল, মারাঠিরা দেখা দিয়েছে বাংলার ভিতরে, বর্ধমান জেলায়, চারিদিকে তারা লুঠপাট, অত্যাচার ও রক্তপাত করে বেড়াচ্ছে।

দুঃসংবাদ শোনার সঙ্গে সঙ্গেই আলিবর্দী বর্ধমানের দিকে রওনা হতে বিলম্ব করলেন না। কিন্তু তিনি বোধহয় মারাঠিদের সংখ্যা আন্দাজ করতে কিংবা তাড়াতাড়ির জন্যে উচিতমতো সৈন্য সঙ্গে আনতে পারেননি—কারণ তাঁর ফৌজে ছিল মাত্র তিন হাজার অশ্বারোহী ও এক হাজার পদাতিক।

তাঁকে রীতিমতো বিপদে পড়তে হল। সংখ্যায় মারাঠিরা ছিল অগণ্য। তারা পিল পিল করে চারদিক থেকে এসে তাঁকে একেবারে ঘিরে ফেললে। সম্মুখ যুদ্ধে তাদের পরাস্ত করা অসম্ভব দেখে আলিবর্দী বর্ধমানেই ছাউনি ফেলতে বাধ্য হলেন।

মারাঠিদের নায়কের নাম ছিল ভাস্কর পণ্ডিত। নাগপুরের রাজা রঘুজি ভোঁসলের সেনাপতি। নিজের ফৌজকে তিনি দুই অংশে বিভক্ত করলেন। এক অংশ আলিবর্দীকে বেষ্টন করে পাহারা দিতে লাগল। আর একদল ছড়িয়ে পড়ল দিকে দিকে এবং চল্লিশ মাইলব্যাপী জায়গা জুড়ে আরম্ভ করলে লুঠতরাজ, হত্যাকাণ্ড ও অকথ্য অত্যাচার।

ভাস্কর পণ্ডিতের দলবল এমনভাবে আটঘাট বেঁধে বসে রইল যে, কোনওদিক থেকেই নবাবি ফৌজের ছাউনির ভিতরে আর রসদ আমদানি করবার উপায় রইল না। শিবিরের মধ্যে কেবল সেপাইরা নয়, সেই সঙ্গে হাজার হাজার অনুচর এবং নবাবের পরিবারবর্গও বন্দি হয়েছিল, আহার্যের অভাবে সকলের অবস্থাই হয়ে উঠল দুর্ভিক্ষপীড়িতের মতো।

অবশেষে আলিবর্দী মরিয়া হয়ে মারাঠিদের সেই চক্রব্যূহ ভেদ করে সদলবলে কাটোয়ার দিকে অগ্রসর হবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু তাঁকে বেশিদূর যেতে হল না, আশপাশ থেকে আচম্বিতে মারাঠিরা হুড়মুড় করে এসে পড়ে চিলের মতো ছোঁ মেরে নবাবি ফৌজের মোটঘাট ও তাঁবুগুলো কেড়ে নিয়ে কোথায় সরে পড়ল। আলিবর্দী তাঁর পক্ষের সকলকে নিয়ে খোলা আকাশের তলায় অনাহারে কর্দমাক্ত ধানক্ষেতের মধ্যে অবরুদ্ধ হয়ে রইলেন; সে এক বিষম ন যযৌ ন তস্থৌ অবস্থা—তিনি না পারেন এগুতে না পারেন পেছুতে।

কেটে গেল এক দিন ও দুই রাত্রি দুঃস্বপ্নের ভিতর দিয়ে।

উদরে নেই অন্ন, মাথার উপরে নেই আচ্ছাদন। হয় মৃত্যু, নয় মুক্তি! দৃঢ়প্রতিজ্ঞা করে আলিবর্দীর সাহসী আফগান অশ্বারোহীর দল সবেগে ও সতেজে ঝাঁপিয়ে পড়ল মারাঠিদের উপরে এবং সে প্রবল আক্রমণ সহ্য করতে না পেরে শত্রুরা পিছু হঠে যেতে বাধ্য হল।

নবাবি ফৌজ অগ্রসর হল কিছুদূর পর্যন্ত। তারপর শত্রুরা ফিরে-ফিরতি প্রতি-আক্রমণ শুরু করলে কাটোয়ার অনতিদূরে। সেখানে একটা লড়াই হল, কিন্তু শত্রুরা নবাবের গতিরোধ করতে পারলে না, নিজের অনশনক্লিষ্ট সৈন্যদল নিয়ে তিনি কাটোয়ার মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করলেন।

নবাবি শিকার হাতছাড়া হল বটে, কিন্তু মারাঠিরা বাংলার মাটি ছাড়বার নাম মুখে আনলে না। রক্তের স্বাদ পেলে বাঘের হিংসা যেমন বেড়ে ওঠে, অতি সহজে অতিরিক্ত ঐশ্বর্যলাভের আশায় ভাস্কর পণ্ডিতের লোভও আরও মাত্রা ছাড়িয়ে উঠল, অবাধে লুঠপাট করার জন্যে লেলিয়ে দিলেন নিজের পাপসঙ্গীদের।

চার

আলিবর্দী তখনও পর্যন্ত রাজধানী মুর্শিদাবাদে প্রত্যাগমন করতে পারেননি!

সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করলেন সুচতুর ভাস্কর পণ্ডিত। সাতশত বাছা বাছা অশ্বারোহী নিয়ে চল্লিশ মাইল পথ পার হয়ে তিনি অরক্ষিত মুর্শিদাবাদের উপকণ্ঠে এসে পড়লেন।

চারিদিকে হুলুস্থূল! বাড়িতে নয়, গ্রামে নয়, নিজ রাজধানীর উপরে ডাকাতের হানা! কে কবে শুনেছে এমন আজব কথা? যারা পারলে, জোরে পা চালিয়ে গেল পালিয়ে। যারা পারলে না, ভয়ে মুখ শুকিয়ে জপতে লাগল ইষ্টনাম।

শহরতলি থেকে শহরের ভিতরে—এ আর আসতে কতক্ষণ! বর্গিরা হই-হই করে মুর্শিদাবাদের মধ্যে এসে পড়ল—ঘরে ঘরে চলল লুঠতরাজের ধুম, বিশেষত ধনীদের প্রাসাদে হিন্দু এবং মুসলমান কেউ পেলে না নিস্তার।

এক জগৎশেঠকেই গুণে গুণে দিতে হল তিন লক্ষ টাকা! সে যুগের তিন লাখ টাকার দাম ছিল এ-যুগের চেয়ে অনেকগুণ বেশি।

বর্গিদের বাধা দেয় শহরে ছিল না এমন রক্ষী। তারা মনের সাধে অবাধে গোটা দিন ধরে নিজেদের ট্যাঁক ভারী করতে লাগল—সকলে ভেবে নিলে, আর রক্ষা নেই, এইবার বুঝি সর্বনাশ হয়।

এমন সময়ে কাটোয়ার পথ থেকে দলবল নিয়ে স্বয়ং আলিবর্দী এসে পড়লেন হন্তদন্তের মতো।

বর্গিরাও যথাসময়ে সরে পড়তে দেরি করলে না, সোজা গিয়ে হাজির হল কাটোয়ায় এবং আশ মিটিয়ে নিঃশেষে মুর্শিদাবাদ লুণ্ঠন করতে পারলে না বলে আক্রোশে যাবার পথে দুই পাশের গ্রামের পর গ্রামে আগুন লাগিয়ে যেতে লাগল। চিহ্নিত হয়ে রইল তাদের সমগ্র যাত্রাপথ উত্তপ্ত ভস্মস্তূপে।

কাটোয়া হল বর্গিদের প্রধান আস্তানা। সেখান থেকে হুগলি এবং তারপর তারা দখল করলে আরও গ্রাম ও নগর। রাজমহল থেকে মেদিনীপুর ও জলেশ্বর পর্যন্ত বিস্তৃত ভূমি তারা অধিকার করে বসল। গঙ্গার পশ্চিম দিক থেকে বিলুপ্ত হল নবাবের প্রভুত্ব—এমনকী জমিদাররা পর্যন্ত বাধ্য হয়ে তাদের রাজস্ব দিতে লাগল এবং তাদের বশ্যতা স্বীকার করলে ফিরিঙ্গি বণিকরাও।

গঙ্গার পূর্বদিকের ভূভাগ আলিবর্দীর হস্তচ্যুত হল না বটে, কিন্তু মাঝে মাঝে সে অঞ্চলেও বর্গিরা হানা দিতে ছাড়লে না। তাদের উৎপাতের ভয়ে ধনী ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা গঙ্গার পশ্চিম দিক ছেড়ে পালিয়ে এল।

বাংলাদেশ লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল বললেই চলে। ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হবার উপক্রম; বাজারে শস্যের অভাব, জিনিসপত্র অগ্নিমূল্য; শ্রমিকদের মজুরি বেড়ে উঠল; যারা তুঁতের আবাদ করে তারা পালিয়ে গেল—কারণ বর্গিরা তুঁতগাছের পাতা ঘোড়াদের খোরাকে পরিণত করলে, যা ছিল গুটিপোকাদের প্রধান খাদ্য। ফলে আর রেশম প্রস্তুত হত না—এমনকী যারা রেশমি কাপড় বুনত তারাও হল দেশছাড়া এবং রেশমের কারবারও হল স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা থেকে কিছু কিছু তুলে দিলে আসল অবস্থা উপলব্ধি করা সহজ হবে।

একজন বলছেন, ‘আপন আপন সম্পত্তি নিয়ে সকলেই পলায়ন করতে লাগল। আচম্বিতে বর্গিরা এসে তাদের চারিধার থেকে ঘিরে ফেললে। আর সব কিছু ছেড়ে তারা কেড়ে নিতে লাগল কেবল সোনা আর রুপা। আর অনেকের হাত, অনেকের নাক ও কান কেটে নিলে এবং অনেককে মেরে ফেললে একেবারেই। স্ত্রীলোকদেরও উপরে অত্যাচার করতে বাকি রাখলে না। আগে বাইরের লুঠপাট সেরে তারা গ্রামের ভিতরে ঢুকে পড়ত এবং আগুন লাগিয়ে দিত ঘরে ঘরে। দিকে দিকে হানা দিয়ে তারা অশ্রান্ত স্বরে চিৎকার করত—আমাদের টাকা দাও, আমাদের টাকা দাও, আমাদের টাকা দাও! যারা টাকা দিতে পারত না, তাদের নাকের ভিতর তারা সুড়সুড় করে জল ঢেলে দিত কিংবা পুকুরে ডুবিয়ে মেরে ফেলত। লোকে নিরাপদ হতে পারত কেবল ভাগীরথীর পরপারে গিয়ে।

প্রাচীন কবি গঙ্গারাম তাঁর রচিত ‘মহারাষ্ট্রপুরাণ’ কাব্যে বর্গির হাঙ্গামার চিত্র দিয়েছেন :

এই মতে সব লোক পলাইয়া যাইতে।

আচম্বিতে বরগী ঘেরিলা আইসে সাথে।।

মাঠে ঘেরিয়া বরগী দেয় তবে সাড়া।

সোনা, রূপা লুঠে নেয় আর সব ছাড়া।।

কারু হাত কাটে কারু কাটে কান।

একই চোটে কারু বধয়ে পরান।।’

বর্ধমানের মহাসভার সভাপণ্ডিত বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কার বলেছেন : সাহু রাজার সেপাইরা নৃশংস; গর্ভবতী নারী, শিশু, ব্রাহ্মণ ও দরিদ্রের হত্যাকারী, বন্যপ্রকৃতি। তাবৎ লোকের উপরে দস্যুতা করিতে দক্ষ এবং যে-কোনও পাপ কাজ করতে সক্ষম। তাদের প্রধান শক্তির কারণ, আশ্চর্যরূপে দ্রুতগতি অশ্ব। যুদ্ধের সম্ভাবনা দেখলেই তারা ঘোড়ায় চড়ে অন্য কোথাও চম্পট দেয়।

বর্গিদের চারিত্রিক বিশেষত্ব বোঝা গেল। তারা দস্যু, তারা নির্মম, তারা কাপুরুষ। মহারাষ্ট্রের বিশেষ গৌরবের যুগেও একাধিকবার মারাঠি চরিত্রের এইসব লক্ষণ প্রকাশ পেয়েছে। দিল্লির মুসলমানরাও এইজন্যে তাদের দারুণ ঘৃণা করত।

বর্ষা এল বাংলায়, ঘাট-মাঠ-বাট জলে জলে জলময়, অচল পথ-চলাচল। বর্গিদেরও দায়ে পড়ে অলস হয়ে থাকতে হল।

আলিবর্দী রাজধানীর বাইরে এসে প্রচুর সৈন্যবল সংগ্রহ করে প্রস্তুত হয়ে রইলেন।

ভাস্কর পণ্ডিতও তলে তলে তৈরি হবার চেষ্টা করলেন। আরও বেশি ফৌজ পাঠাবার জন্যে আবেদন জানালেন নাগপুরের রাজা রঘুজির কাছে। কিন্তু তাঁর আবেদন মঞ্জুর হল না। কারণ হয়তো সৈন্যাভাব।

আলিবর্দী ছিলেন অভিজ্ঞ সেনাপতি। তিনি বেশ বুঝলেন, নদী নালার জল শুকিয়ে গেলে বর্গিদের বেগবান ঘোড়াগুলো আবার কর্মক্ষম হয়ে উঠবে। এই হচ্ছে তাদের কাবু করবার মাহেন্দ্রক্ষণ!

দুর্জন হলে কী হয়, ভাস্করের ভক্তির অভাব নেই। জমিদারদের কাছ থেকে জোর করে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা আদায় করে তিনি মহাসমারোহে দুর্গাপুজার আয়োজন করলেন কাটোয়া শহরে।

নবমীর রাত্রি। পূজা ও আমোদ-প্রমোদের পরে খাওয়াদাওয়া সেরে আনন্দশ্রান্ত মারাঠিরা অচেতন হয়ে পড়ল গভীর নিদ্রায়।

কিন্তু আলিবর্দী ও তাঁর বাছা বাছা সৈনিকের চোখে নেই নিদ্রা। গোপনে গঙ্গা ও অজয় নদী পার হয়ে আলিবর্দী সদলবলে ঝাঁপিয়ে পড়লেন ঘুমন্ত দস্যুদের উপরে।

বেশি কিছু করতে হল না এবং লোকক্ষয়ও হল না বেশি। সবদিক দিয়েই সফল হল এই অভাবিত আক্রমণ।

প্রায় বিনা যুদ্ধেই বিষম আতঙ্কে পাগলের মতো বর্গিরা বেগে পলায়ন করলে দিগবিদিক জ্ঞান হারিয়ে। তাদের সমস্ত রসদ, তাঁবু ও মোটঘাট হল আক্রমণকারীদের হস্তগত।

ফৌজ নিয়ে বাংলা ছেড়ে পালাতে পালাতে ও লুঠপাট করতে করতে ভাস্কর পণ্ডিত কটক শহরে গিয়ে আবার এক আড্ডা গাড়বার চেষ্টা করলেন।

কিন্তু আলিবর্দী তাঁর পিছনে লেগে রইলেন ছিনে জোঁকের মতে—তাঁকে আর হাঁপ ছাড়বার বা নতুন শক্তিসঞ্চয় করবার অবসর দিলেন না! ভাস্করকে কটক থেকেও তাড়িয়ে একেবারে চিল্কা পার করে দিয়ে অবশেষে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন নবাব আলিবর্দী খাঁ। তারপর বিজয়ী বীরের মতো ফিরে এলেন নিজের রাজধানীতে। এ হল ১৭৪৩ খ্রিস্টাব্দের ঘটনা।

পাঁচ

ভাস্কর পণ্ডিত তখনকার মতো বিতাড়িত হলেও বাংলাদেশ থেকে বর্গিদের আড্ডা উঠে যায়নি।

কারণ কিছু দিন যেতে-না-যেতেই দেখি, তাঁর মুরুব্বি রঘুজি ভোঁসলেকে নিয়ে ভাস্কর পণ্ডিত আবার হাজির হয়েছেন কাটোয়া শহরে, তাঁরা নাকি সাহু রাজার হুকুমে বাংলার চৌথ আদায় করতে এসেছেন।

রাজা রঘুজির মস্ত শত্রু মারাঠিদের প্রথম পেশোয়া বালাজি রাও। তিনিও দলে দলে সৈন্য নিয়ে বিহারে এসে উপস্থিত হলেন। দিল্লির বাদশাহ মহম্মদ শাহের অনুরোধে রঘুজিকে তিনি বাংলা থেকে তাড়িয়ে দিতে এসেছেন।

কিন্তু সব শিয়ালের এক রা! বালাজিও লক্ষ্মীছেলে নন, কারণ তিনিও এলেন দিকে দিকে হাকাকার তুলে লুঠপাট করতে করতে। সাঁওতাল পরগনার বনজঙ্গল ভেদ করে তিনি এসে পড়লেন বীরভূমে, তারপর ধরলেন মুর্শিদাবাদের পথ।

বহরমপুরের কাছে গিয়ে আলিবর্দী দেখা করলেন তাঁর সঙ্গে। পরামর্শের পরে স্থির হল, নবাবের কাছ থেকে বালাজি বাইশ লক্ষ টাকা চৌথ পাবেন এবং তার বিনিময়ে তিনি করবেন বাংলা থেকে রঘুজিকে তাড়াবার ব্যবস্থা।

সেই খবর পেয়েই রঘুজি কাটোয়া থেকে চম্পট দিলেন চটপট। বালাজিও তাঁর পিছনে পিছনে ছুটতে কসুর করলেন না। এক জায়গায় দুই দলে বেধে গেল মারামারি। সেই ঘরোয়া লড়াইয়ে হেরে এবং অনেক লোক ও মালপত্র খুইয়ে রঘুজি ও ভাস্কর পণ্ডিত লম্বা দিলেন উড়িষ্যার দিকে। কর্তব্যপালনের জন্যে যথেষ্ট ছুটোছুটি করা হয়েছে ভেবে বালাজিও ফিরে গেলেন পুণার দিকে।

ইতিমধ্যে বাংলাদেশ করলে প্রায় নয়মাসব্যাপী শান্তিভোগ। কিন্তু বাংলা ও বিহারের বাসিন্দারা নিশ্চিন্ত হয়ে ছিল না,—বর্গিদের বিশ্বাস কী? কলকাতাবাসী ব্যবসায়ীরা পঁচিশ হাজার টাকা তুলে শহরের অরক্ষিত অংশে এক খাল খুঁড়ে ফেললে, সেই খালই ‘মার্হাট্টা ডিচ’ নামে বিখ্যাত হয়ে আছে। বিহারিরাও পাঁচিল তুলে দিলে পাটনা শহরের চারিদিকে।

ইতিপূর্বে বর্গিরা দুই-দুইবার বাংলা আক্রমণ ও লুণ্ঠন করেও শেষপর্যন্ত লুঠের মাল নিয়ে সরে পড়তে পারেনি। সেইজন্যে ভাস্কর পণ্ডিতের আপশোশের অন্ত ছিল না। এখন বালাজির অন্তর্ধানের পর পথ সাফ দেখে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে সংহার-মূর্তি ধারণ করে উড়িষ্যা থেকে আবার ধেয়ে এলেন বাংলার দিকে। চতুর্দিকে আবার উঠল সর্বহারাদের গগনভেদী হাহাকার, গ্রামে গ্রামে দেখা গেল দাউ দাউদাউ লেলিহান অগ্নিশিখা, পথে পথে ছড়িয়ে রইল অসহায়দের খণ্ড-বিখণ্ড মৃতদেহ। বর্গি এল—আবার বর্গি এল দেশে!

আলিবর্দী দস্তুরমতো কিংকর্তব্যবিমূঢ়! বালাজিকে রঘুজির পিছনে লাগিয়ে তিনি অবলম্বন করেছিলেন সেই বহু পরীক্ষিত পুরাতন কৌশল—অর্থাৎ যাকে বলে, কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা। কিন্তু ব্যর্থ হল সে কৌশল—আবার বর্গি এল দেশে!

এখন উপায়? হতভম্ব রাবণ নাকি বলেছিলেন, ‘মরিয়া না মরে রাম, এ কেমন বৈরী!’ আজ আলিবর্দীরও সেই অবস্থা—বর্গিরা যেন রক্তবীজের ঝাড়! এই অমঙ্গুলে ঝাড়কে উৎপাটন করতে হলে ন্যায়-অন্যায় জ্ঞান ভুলে অন্য উপায় আবিষ্কার না করলে চলবে না। রাজকোষ অর্থশূন্য; বারংবার যুদ্ধযাত্রায় সৈন্যরা পরিশ্রান্ত; বৃদ্ধ আলিবর্দীরও শরীর অপটু। এই সব বুঝে বর্গিদের জন্যে মোক্ষম দাওয়াইয়ের ব্যবস্থা করবার জন্যে তিনি এক গুপ্ত পরামর্শ-সভার আয়োজন করলেন।

ভাস্কর পণ্ডিতের কাছে গেল আলিবর্দীর সাদর আমন্ত্রণ; নবাব আর যুদ্ধ করতে নারাজ এবং অক্ষম। তিনি এখন আপসে মিটমাট করে শান্তি স্থাপন করতে ইচ্ছুক। ভাস্কর পণ্ডিত যদি অনুগ্রহ করে নবাব শিবিরে পদার্পণ করেন, তাহলে সমস্ত গোলযোগ খুব সহজেই বন্ধুভাবে চুকে যেতে পারে।

ভাস্কর নিশ্চয়ই মনে করেছিলেন, বালাজির মতো তিনিও আলিবর্দীর কাছে নির্বিবাদে বহু লক্ষ টাকা হাতিয়ে বাজিমাৎ করতে পারবেন। কাজেই কিছুমাত্র সন্দেহ না করেই মাত্র একুশজন সঙ্গী সেনানী নিয়ে হাসতে হাসতে তিনি পদার্পণ করলেন নবাবের শিবিরে। সেদিনের তারিখ হচ্ছে ১৭৪৪ খ্রিস্টাব্দের ৩১ মার্চ।

ভাস্কর পণ্ডিত এবং বিশজন সেনানী আর বর্গিরা আস্তানায় প্রত্যাগমন করতে পারেননি। শিবিরের আনাচেকানাচে গা ঢাকা দিয়ে অপেক্ষা করছিল দলে দলে হত্যাকারী। সহসা আবির্ভূত হয়ে তারা বর্গিদের টুকরো টুকরো করে কেটে ফেললে। মাত্র একজন সেনানী সেই মারাত্মক খবর নিয়ে নিজেদের আস্তানায় ফিরে এল ভগ্নদূতের মতো।

ব্যস, এক কিস্তিতেই বাজিমাৎ! সেনাপতি ও অন্যান্য দলপতিদের নিধনসংবাদ শুনেই বর্গি পঙ্গপালরা মহাভয়ে সমগ্র বঙ্গ ও উড়িষ্যা দেশ ত্যাগ করে পলায়ন করলে।

ছয়

কিন্তু বর্গি এল, আবার বর্গি এল দেশে। এই নিয়ে চারবার এবং শেষবার।

সেনাধ্যক্ষ ভাস্করের হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের জন্যে এবার সসৈন্যে আসছেন স্বয়ং নাগপুরের রাজা রঘুজি ভোঁসলে। গত পনেরো মাস ধরে তোড়জোড় ও সাজসজ্জা করে সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত হয়ে তিনি কার্যক্ষেত্রে অবতীর্ণ হলেন।

বর্গিদের কাছে বাংলা দেশ হয়ে উঠেছিল যেন কামধেনুর মতো। দোহন করলেই দুগ্ধ!

রঘুজি আগে উড়িষ্যা হস্তগত করে বাংলার নানা জেলায় নিজের প্রভুত্ব বিস্তার করতে করতে এগিয়ে আসতে লাগলেন।

আলিবর্দী বুঝলেন, এবার আর মুখের কথায় চিড়ে ভিজবে না। অতঃপর লড়াই ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু পনেরো মাস সময় পেয়ে তিনিও যুদ্ধের জন্যে রীতিমতো প্রস্তুত হয়ে উঠেছিলেন।

প্রথমে দুই পক্ষে হল একটা ছোটখাটো ঠোকাঠুকি। রঘুজি পিছিয়ে গেলেন বটে, কিন্তু তাঁর বিষদাঁত ভাঙল না। তারপর তিনি দশহাজার বর্গি ঘোড়সওয়ার ও চার হাজার আফগান সৈনিক নিয়ে মুর্শিদাবাদের কাছে এসে পড়লেন। সেখানে নবাবি সৈন্যদের প্রস্তুত দেখে পশ্চাদপদ হয়ে ছাউনি ফেললেন কাটোয়া নগরে গিয়ে।

কাটোয়ার পশ্চিমে রানীদীঘির কাছে আলিবর্দীর সঙ্গে রঘুজির চরম শক্তিপরীক্ষা হয়। এক তুমুল যুদ্ধের পর বর্গিরা যুদ্ধক্ষেত্রে বহু হতাহতকে ফেলে ছত্রভঙ্গ হয়ে পলায়ন করে। ইহা ১৭৪৫ খ্রিস্টাব্দের কথা।

শেষপর্যন্ত আলিবর্দী বর্গিদের বাংলা দেশের সীমান্তের বাইরে তাড়িয়ে না দিয়ে নিশ্চিন্ত হননি।

বর্গিরা শিকড় গেড়ে বসে উড়িষ্যায়। তারপরেও কয়েক বৎসর ধরে নবাবী ফৌজের সঙ্গে তাদের ঘাত-প্রতিঘাত হয়ে বটে, কিন্তু খাস বাংলার উপরে আর তারা চড়াও হয়ে অশান্তি সৃষ্টি করতে আসেনি।

না আসবার কারণও ছিল। ১৭৫৩ খ্রিস্টাব্দে বর্গিদের সঙ্গে আলিবর্দীর যে শেষ সন্ধি হয় তার একটা শর্ত এই :

‘বাংলার নবাব রাজা রঘুজিকে বাৎসরিক বারো লক্ষ টাকা চৌথ প্রদান করবেন’।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *