বরিনেজ

বরিনেজ

ভাইস অ্যাডমিরাল জোহানস ভ্যান গক ডাচ নৌবাহিনীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ অফিসার। আমস্টার্ডামে তাঁর বিরাট কোয়ার্টার। ভাইপোকে অভ্যর্থনা করবার জন্যে আজ তিনি নৌবাহিনীর ঝকঝকে ইউনিফর্ম পরেছেন সযত্নে। দু-কাঁধের ওপর সোনার তকমা জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। মস্ত তাঁর চিবুক, ভ্যান গ্রক পরিবারের যা বিশেষত্ব—চওড়া কপাল থেকে ঝুলে-পড়া উঁচু খাড়ার মতো নাক।

তুমি আসাতে বড়ো খুশি হয়েছি ভিনসেন্ট, বুঝতেই তো পারছ, ছেলেমেয়ের বিয়ের পর থেকে আমার বাড়ি একেবারে ফাঁকা হয়ে গিয়েছে।

ভিনসেন্টকে সঙ্গে নিয়ে চওড়া সিঁড়ি বেয়ে উঠে তিনি ওপরের একটা প্রশস্ত ঘরে ঢুকলেন।

এটা তোমার ঘর ভিনসেন্ট। তুমি যে শেষপর্যন্ত ধর্মযাজকের পদের জন্যে পড়াশুনো করবে ঠিক করেছ, এ খুবই আনন্দের কথা। আমাদের পরিবারের একজন করে ঈশ্বরের কাজ সর্বদা বেছে নিয়েছে।

ভিনসেন্ট বললে—আমি ভেবেছি কাকা, আমি ধর্মপ্রচারক হব, যত শীঘ্র সম্ভব কাজে লেগে যাবার চেষ্টা করব।

বলো কী, প্রচারক? সে তো অশিক্ষিতের কাজ! বোকা লোকের কাছে তারা গেঁয়ো ভাষায় ধর্মের বুলি আওড়ায়। তোমাকে গ্র্যাজুয়েট হতে হবে, সেই না হবে আমাদের পরিবারের উপযুক্ত কাজ! তবেই না ভবিষ্যতে উন্নতি করতে পারবে! শিক্ষা, শিক্ষাই তো আসল! কিছু ভেবো না তুমি। সব ব্যবস্থা হবে।

এলেন রেভারেন্ড স্ট্রিকার। ইনি ভিনসেন্টের মেসোমশাই। আমস্টার্ডামের বিখ্যাত ধর্মযাজক। পরনে কালো রঙের দামি কাপড়ের নিখুঁত পরিচ্ছদ। প্রাথমিক সম্ভাষণের পর বললেন—তোমাকে গ্রিক আর ল্যাটিন শেখাবার জন্যে যে–শিক্ষকের ব্যবস্থা করেছি তাঁর জোড়া পণ্ডিত আর নেই। মেন্ডিস ডা কস্টা তাঁর নাম, জিউইস কোয়ার্টারে থাকেন। সোমবার বিকেলে তিনটের সময়, তুমি তাঁর কাছে যাবে। আর কাল রবিবার দুপুরে আমার বাড়িতে তোমার নেমন্তন্ন। তোমার মাসি উইলহেমিনা আর বোন কে—এরা ভারি খুশি হবে তোমাকে দেখলে। ভুলো না।

আমস্টার্ডামের সবচেয়ে অভিজাত পল্লিতে রেভারেন্ড স্ট্রিকারের বাস। বন্দরের দক্ষিণ দিক থেকে চতুর্থ খালটির ধারে ধারে এই পল্লি। খালের জল কাকচক্ষুর মতো, নেই একবিন্দু শেওলার আবিলতা। রাস্তার ধারের বাড়িগুলি ছবির মতো দেখতে, প্রত্যেকটি পাকা ফ্লেমিশ স্থাপত্যের পরিচ্ছন্ন নিদর্শন।

পরদিন সকালে ভিনসেন্ট গির্জায় রেভারেন্ড স্ট্রিকারের প্রার্থনাবাণী শুনল, তারপর দুপুরের দিকে গেল তাঁর বাড়ি। খালের ধারে ধারে বজরার মেলা। কত পরিবার এইসব বজরার বাসিন্দা। মাস্তুলে বাঁধা আড়াআড়ি দড়ি, তাতে কাপড় শুকোচ্ছে। মেয়ে পুরুষ কাজ করছে, বাচ্চারা খেলা করছে পাটাতনের ওপর। খালের মাঝখান দিয়ে কত ছোটো ছোটো নৌকো চলছে উজানস্রোত ঠেলে।

মাসি উইলহেমিনা সাদরে আহ্বান করলেন ভিনসেন্টকে, নিয়ে গেলেন সোজা খাবার ঘরে। ঘন বার্নিশ করা দেয়াল। একটি দেয়ালে ক্যালভিনের মস্ত একটি ছবি, নীচে শেফের ওপর রুপোর একটি ক্রস।

ঘরের স্বাভাবিক অন্ধকারে চোখ অভ্যস্ত হতে-না-হতেই দীর্ঘাঙ্গী একটি যুবতী এসে সাদর সম্ভাষণ জানাল ভিনসেন্টকে, বললে—আমাকে তুমি চেনো না। আমি তোমার মামাতো বোন—কে।

ভিনসেন্ট করমর্দন করল। কতদিন পরে তার হাতে নারীর কবোষ্ণ-কোমল করস্পর্শ!

মেয়েটি বললে—আমাদের আর কক্ষনো দেখা হয়নি এতদিন। ভারি আশ্চর্য, না? আমার বয়স হল ছাব্বিশ, আর ধরো তোমার হল–

হাঁ করে তাকিয়ে চমকে উঠে ভিনসেন্ট উত্তর দিলে, অ্যাঁ? হ্যাঁ, কম কী? চব্বিশ আমার।

কে বললে—তুমিও কখনও এর আগে আমস্টার্ডামে আসনি, আর আমিও ব্রাবান্টে যাইনি। কী করে এর আগে আমাদের আলাপ হবে বলো? যাহোক, দাঁড়িয়ে রইলে কেন ভিনসেন্ট? দেখো কাণ্ড, তোমাকে বসতে বলিনি বুঝি?

আড়ষ্ট হয়ে একটা কাঠের চেয়ারে সে বসল। একটু ঢোক গিলে আস্তে আস্তে বললে—মা প্রায়ই বলতেন তোমার কথা। আসনি কেন ব্রাবান্টে? এলে নিশ্চয়ই ভালো লাগত।

আমি জানি। আনা মাসি ক-বার চিঠি লিখেছেন আমাকে যাবার জন্যে। এবার একবার যাবই।

কথোপকথনে ভিনসেন্টের মন নেই। তৃষ্ণার্ত আকুলতায় সে সমস্ত চৈতন্য ভরে পান করছে কে-র রূপামৃত। ডাচ মেয়ের শক্ত সুস্পষ্ট চেহারা কে-র, কিন্তু কোন নিপুণ ভাস্কর যেন তার প্রতি অঙ্গে এনেছে পেলব কমনীয়তা। চুলে তার লালের সঙ্গে সোনালির খেলা, অগ্নিশিখার সঙ্গে স্বর্ণরেখার। দেহের শুভ্রতার সঙ্গে মুখের রক্তিমাভার সংমিশ্রণ শ্রেষ্ঠ শিল্পীর রং-তুলিকে হার মানায়। গভীর নীল চোখ, তাতে প্রতি মুহূর্তের খুশির ঝিলিক, আরক্ত স্ফুট ওষ্ঠে আমন্ত্রণের ইশারা।

বাক্যহারা ভিনসেন্টকে সে বললে—কী ভাবছ?

ভিনসেন্ট বললে—ভাবছি তোমাকে আঁকতে পারলে রেমব্রাঁ কত খুশি হতো।

হেসে উঠল কে—সুস্পষ্ট উচ্চারিত হাসি, সুপক্ব ফলের মতো। বললে—রেমব্রাঁ? ইস! সে তো কেবল কুচ্ছিত বুড়িদের আঁকত! আমি বুঝি তা-ই?

ভুল তোমার, ভিনসেন্ট বললে—রেমব্রাঁ বুড়ি আঁকত ঠিক, কিন্তু তারা সব পরমা সুন্দরী বুড়ি। তারা গরিব দুঃখী হয়তো, কিন্তু দুঃখের দাহনে পবিত্র তাদের আত্মা, শিল্পীর চোখে তাদের রূপের তুলনা ছিল না।

এই প্রথমবার কে ভালো করে ভিনসেন্টকে দেখল। প্রথমে আলগোছে চোখে পড়েছিল ঝাঁকড়া লাল চুল-ভরা তার মস্ত মাথাটা, এবার ভালো করে লক্ষ করল তার গভীর চোখের জ্বালাময়ী দৃষ্টি।

প্রায় চুপি চুপি বললে—মাপ করো, বুঝেছি তোমার কথা। দুঃখশোকে জর্জরিত এই সমস্ত বুড়িদের মুখের অসংখ্য বলিরেখার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে রেমব্রাঁ বঞ্চিত জীবনের অন্তর্নিহিত সৌন্দর্যকে খুঁজে পেত, তা-ই না?

দরজার কাছ থেকে মুখ বাড়িয়ে রেভারেন্ড স্ট্রিকার বললেন—কী ছেলেমেয়েরা, কী এত গল্প হচ্ছে তোমাদের?

হাসতে হাসতে কে বললে—খুব আলাপ জমিয়েছি আমরা। ভাইটি খুব মজার, আগে তো জানতামই না!

প্রসন্ন মুখ ছিপছিপে চেহারার সুপুরুষ এক যুবক ঘরে প্রবেশ করল। কে উঠে দাঁড়িয়ে সাগ্রহে চুম্বন করল তাকে। বললে—ভিনসেন্ট, এই আমার স্বামী, মিনহার এস।

একছুটে বাইরে গিয়ে কে কোলে করে নিয়ে এল তার ছেলেটিকে, দু-বছরের একটি ফুটফুটে বাচ্চা। মিনহার দু-হাত দিয়ে তাদের দুজনকে জড়িয়ে আদর করে দিল।

খাবার টেবিলে ভিনসেন্টের সামনাসামনি বসল কে—একধারে তার স্বামী, অপর ধারে শিশুপুত্রটি। স্বামীকে পাশে পেয়ে কৌতুকের তার অন্ত নেই। চোখ দুটি নাচছে, গাল দুটি আরক্তিম। ভিনসেন্টের কথা আর তার মনে নেই।

তাদের এই উচ্ছলিত ভালোবাসার ঢেউ ভিনসেন্টকে স্পর্শ করল। অন্তরের কোন গোপন উৎসমুখ থেকে উরসুলার জন্যে বেদনাটা আবার নতুন করে ঝরতে লাগল। সামনে এই হাসিমুখ আর খুশিপ্রাণ স্বামী স্ত্রী আর শিশু, পারিবারিক প্রেমবন্ধনের এই মধুর চিত্র, চকিতে মনে পড়ল এমনি ভালোবাসার জন্যে গত ক–মাস ধরে তার সারা প্রাণ শুষ্ক তৃষিত হয়ে রয়েছে, এ-তৃষ্ণা কিছুতে ভোলার নয়।

ভোর বেলা সূর্যোদয়ের আগে ভিনসেন্ট ঘুম থেকে উঠে বাইবেল পড়াতে বসে। আকাশে আলো যখন ফুটে ওঠে কিছুক্ষণের জন্য জানলার ধারে গিয়ে দাঁড়ায়। সামনে বন্দরের ইয়ার্ড, শ্রমিকরা ছায়ার মতো গেটের মধ্যে ঢোকে। দূরে জুইডার জি-তে ছোটো-বড়ো জাহাজে নৌকোয় পাল ওঠে। শুরু হয় দিনের কর্মব্যাকুলতা।

ভিনসেন্ট একটুকরো রুটি আর এক গ্লাস বিয়ারে প্রাতরাশ সেরে নেয়। তারপর শুরু হয় ল্যাটিন আর গ্রিক নিয়ে নিরবচ্ছিন্ন সাত ঘণ্টার সাধনা। দ্বিপ্রহর পর্যন্ত সে একনাগাড়ে পড়ে চলে। মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে। তারপর সময় আসে মেন্ডিস ডা কস্টার কাছে যাবার।

শিক্ষকটিকে দেখে ভিনসেন্টের রুই পারেজের আঁকা ‘খ্রিস্টানুসরণ’ ছবিটির কথা মনে পড়ে। গর্তে-ঢোকা গভীর চোখে উধাও দৃষ্টি, রেখাঙ্কিত শীর্ণ মুখে নিরাসক্ত নির্লিপ্তি। সাত ঘণ্টা ধরে গ্রিক আর ল্যাটিন, ইতিহাস আর ব্যাকরণ পড়ার পর শিক্ষকের সঙ্গে মাঝে মাঝে অন্য বিষয়ে কথাবার্তা বলতে ভিনসেন্টের ভালো লাগে। বিশেষ করে ছবির কথা, শিল্প আর শিল্পীর কথা। কিন্তু নষ্ট করার মতো সময় কই? শিক্ষকের মোটা বেতন যে যোগাচ্ছেন রেভারেন্ড স্ট্রিকার!

মেন্ডিস ডা কস্টাও বোঝেন, তাই তিনি প্রায়ই পড়াশুনো শেষ হবার পর ভিনসেন্টকে শহরে পৌঁছে দিতে বার হন। তখন হাঁটতে হাঁটতে নানা গল্প হয়।

একদিন তিনি ভিনসেন্টকে নিয়ে চললেন শহরতলির নতুন অঞ্চল দিয়ে। ভন্ডেল পার্ক থেকে রেলস্টেশন পর্যন্ত এ-রাস্তাটা ভিনসেন্টের অচেনা। মাঝে মাঝে বহু ছোটো ছোটো খাল, অনেক্ কলকারখানা আর অসংখ্য শ্রমিকগৃহ। ভিড়ের শেষ নেই।

ভিনসেন্ট বললে—এমন একটা এলাকার পাদরি হতে পারলে চমৎকার হয়। পাইপে তামাক ভরতে ভরতে মেন্ডিস উত্তর দিলেন—ঠিক বলেছ, আর ঈশ্বরের প্রয়োজন শহরের লোকদের চাইতে এদের অনেক বেশি।

এ-কথার মানে, মিনহার?

সামনেই একটা পুল। পুলের উপর উঠে দু-ধারে শীর্ণ হাত বাড়িয়ে মেন্ডিস বললেন—এইসব শ্রমিক, জীবন এদের সুখের নয়। হাড়ভাঙা খাটুনি, তবু আজ যদি কাজ না জোটে, তাহলে কাল আর আহার জুটবে না। রোগ হলে সামান্য চিকিৎসার সম্বলটুকুও ওদের নেই। শিয়রে দুর্ভিক্ষ নিয়ে ওদের জীবন কাটে। জীবনে ওরা ঠকেছে, ঈশ্বর ছাড়া ওরা সান্ত্বনা পাবে কোথা থেকে?

আর শহরের লোকেরা?

তারা তো এমনি গরিব নয়! তাদের স্বাচ্ছন্দ্য আছে, সঞ্চয় আছে। তাদের ভাবনা কী? তাদের কল্পনায় ঈশ্বর দিব্যি গোলগাল পাকাবুড়ো বনেদি ভদ্রলোকটি!!

সে-দিন রাত্রি বেলা টেবিলের ওপর গ্রিক বই খোলা রেখে অনেকক্ষণ সামনের দেওয়ালের দিকে চুপ করে তাকিয়ে রইল ভিনসেন্ট। মনে তার ভেসে উঠতে লাগল লন্ডনের শ্রমিকবস্তি, সেখানকার অধিবাসীদের দুরন্ত দারিদ্র্য আর হতাশা। মনে পড়ল, তার কল্পনা ছিল সে প্রচারক হবে, ওইসব ভাগ্যহতদের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করবে। এই মুহূর্তের কল্পনায় ভেসে উঠল রেভারেন্ড স্ট্রিকারের গির্জাটা। ওখানে যারা যায় উপাসনায়, তারা শিক্ষিত, সম্ভ্রান্ত, সচ্ছল; ভরপুর জীবনের অনায়াস তাদের ভাগ্য। কাকা স্ট্রিকারের বাণীতে মাধুর্য আছে, আছে অনেক সান্ত্বনার আশ্বাস, কিন্তু তাঁর শ্রোতাদের মধ্যে সান্ত্বনার প্রকৃত পিয়াসী কজন?

ছ-মাস হল সে আমস্টার্ডামে এসেছে। যে-শিক্ষায় তার স্বাভাবিক ব্যুৎপত্তি নেই তাকে সে জয় করতে চাইছে হাড়ভাঙা পরিশ্রম দিয়ে। বইপত্র খুলে বসল। মধ্যরাত্রেও আলো জ্বলছে। জ্যান কাকা দরজা ঠেলে ঢুকলেন।

এখনও জেগে আছ ভিনসেন্ট? এ-দিকে রোজ ভোর চারটের সময় তুমি দিন শুরু কর। ক-ঘণ্টা পড় তুমি?

ঠিক নেই কাকা। কোনোদিন আঠারো, কোনোদিন কুড়ি।

কী সর্বনাশ! কুড়ি? কিন্তু এত পড়ার তোমার কী দরকার?

কী করি বলুন, পড়াটা তো সারতে হবে।

তা হোক। শরীর এত সইবে না। এখুনি শুয়ে পড়ো। এতটা রাত আর কোনোদিন জেগো না।

বইপত্র সরিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিল ভিনসেন্ট। ঘুম আসে না। বিশ্রাম চাই না, সুখ চাই না শুধু এই অসম্ভব পড়াটা সারতে চাই। গ্রিক আর ল্যাটিন, অঙ্ক আর গ্রামার, এদের পরীক্ষাসাগর পার হতে চাই, যাতে করে ধর্মযাজকের যোগ্যতা অর্জিত হতে পারে, ঈশ্বরের কাজে জীবনকে লিপ্ত করার সুযোগ মিলতে পারে।

একটি বৎসর কাটল। আবার মে মাস। ভিনসেন্ট হার মানল। এ-লেখাপড়া তার হবে না, পাণ্ডিত্য অর্জন তার জন্যে নয়। বৃথা তার এতদিনের পরিশ্রম। নিজের অসামর্থ্যের উপলব্ধিই যে তাকে মুষড়ে ফেলেছে তা নয়, সঙ্গে রয়েছে জ্বালাময়ী জিজ্ঞাসা, কেন এই পরিশ্রম? সে কি চায় রেভারেন্ড স্ট্রিকারের মতো সম্ভ্রান্ত ধর্মযাজক হতে? কোথায় তার আদর্শ, কোথায় তার সেবার স্বপ্নসম্ভাবনা? পড়াশুনো শেষ করতে আরও পাঁচ বছর বাকি। এ-আদর্শ, এ-স্বপ্ন, পাঁচ বছরে কোথায় মিলিয়ে যাবে!

একদিন সন্ধে বেলা পড়াশুনো শেষ করার পর সে শিক্ষককে বললে—মিনহার ডা কস্টা, একটু বেড়াতে বার হবেন আমার সঙ্গে?

মেন্ডিস বুঝেছিলেন তাঁর ছাত্রের মনে কী একটা অন্তর্দ্বন্দ্ব চলেছে, বুঝেছিলেন একটা চূড়ান্ত নিষ্পত্তির সময় সন্নিকট। গলায় মাফলার পেঁচিয়ে বললেন—চলো। বাইরে চমৎকার হাওয়া, তোমার সঙ্গে একটু ঘুরেই আসা যাক।

দুজনে বার হলেন পথে। যেতে যেতে পাশে পড়ল সেই ইহুদি ধর্মমণ্ডলটি, যেখানে তিন শতাব্দী আগে ধর্মদ্রোহী বলে ঘোষিত হয়েছিল স্পিনোজা। আর একটু এগোতে রেমব্রাঁর পুরোনো গৃহ।

বাড়িটার পাশ দিয়ে যেতে যেতে নিতান্ত সহজ গলায় মেন্ডিস বললেন—দেখো, লোকটা কীভাবে মরল শেষ পর্যন্ত। সমস্ত দারিদ্র্য আর অসম্মান মাথায় নিয়ে।

চমকে তাঁর মুখের দিকে তাকাল ভিনসেন্ট। মেন্ডিসের কথাবার্তার ধরনই এমনি। সহজ কথার আড়ালে গভীর একটি তত্ত্ব কোথায় যেন লুকিয়ে থাকে। নিবিড় অনুভূতি আর অন্তর্দৃষ্টির স্রোতোমুখ থেকে যেন তাঁর কথাগুলি উচ্চারিত।

আস্তে আস্তে ভিনসেন্ট উত্তর দিলে—তাতে তাঁর দুঃখ ছিল না, মিনহার।

ঠিক বলেছ। রেমব্রাঁর মৃত্যু সুখের মৃত্যু। যা চেয়েছিল তা লোকটা পেয়েছিল, আত্মবিকাশের পথে কোনো বাধা মানেনি; সারাজীবনে তার যা অবদান, তার দাম যে কী তাও বুঝেছিল ঠিকই। এই তো সাফল্য, নয় কি?

কিন্তু এমনি বোঝার মূল্য কী, মিনহার? এটা ঝুটো আত্মাদরও তো হতে পারে। এও তো হতে পারত যে শেষ পর্যন্ত তাঁর ভাগ্যে পৃথিবীর অবহেলাটাই সত্যি হয়ে উঠল!

বয়ে যেত তাতে তাঁর। দেখো ভিনসেন্ট, রেমব্রাঁর কাজ ছিল ছবি আঁকা। তার আঁকা ভালোই হোক আর খারাপই হোক, কিছুই তার এসে যায়নি। আঁকতে পারার মধ্যেই ছিল তার জীবনের সার্থকতা। শিল্পের একমাত্র দাম হচ্ছে এই যে এর মধ্যে দিয়েই শিল্পী আত্মপ্রকাশ করতে পারে। রেমব্রাঁর জীবন এই আঁকার মধ্যে প্রকাশিত হয়েছিল, পরিপূর্ণ হয়েছিল। কালের হাতে তার ছবির কানাকড়ি দামও যদি না মিলত, তাতেই-বা কী এসে যেত তার? ছবি না এঁকে আমস্টার্ডামের সবচেয়ে ধনী ব্যাবসাদার যদি সে হতো, তাতেই কি তার জীবনের উত্তর সে পেত?

ঠিক মিনহার।

মেন্ডিস আগের কথার জের টেনে বলে চললেন—আজ যে রেমব্রাঁর শিল্প সারা বিশ্বের আনন্দের খোরাক, এটা নিতান্ত অতিরিক্ত। তোমার আমার সাদা চোখে যে-জীবন ভাগ্যহত, আসলে সে-জীবনের পূর্ণতায় কোনো ফাঁক ছিল না। শিল্পসৃষ্টি লোকের কদর পেল না সেটা কিছুই নয়, আসল প্রশ্ন হচ্ছে, আদর্শবিচ্যুতি ঘটল কি না, শিল্পীর জীবন শিল্প হয়ে উঠল কি না।

একটু স্তব্ধতার পর ভিনসেন্ট প্রশ্ন করলে—কিন্তু একজন যুবকের কথা ধরুন, মিনহার। সে কী করে জীবনের আদর্শকে বেছে নেবে? যদি ভুল করে? যদি সে মনে ভাবে বিশেষ একটা ব্রত সে নেবে আর পরে দেখে সে অক্ষম অপারগ, তার আদর্শ তার ক্ষমতার বাইরে?

মেন্ডিসের কালো চোখ দুটো চকচক করে উঠল, কথাটা ঘুরিয়ে নিয়ে বললেন—দেখো ভিনসেন্ট, সূর্যাস্তের আভা মেঘের মাথায় কেমন রং ছড়িয়েছে দেখছ?

বন্দরের কাছে তাঁরা পৌঁছে গেছেন। জাহাজের মাস্তুল, বাড়ির ছাদ আর গাছের মাথায় সূর্যাস্তের সোনা। জাইডার জি-র সোনালি জলে ছায়া ফেলেছে এরা সব।

– চলো বাঁধের ওপর দিয়ে জিবুর্গের দিকে এগোই। সেখানে ইহুদি গির্জের কবরের ধারে একটু বসব, কেমন? ওখানে আমার পূর্বপুরুষরা সবাই ঘুমুচ্ছেন।

হাঁটতে হাঁটতে মেন্ডিস ভিনসেন্টের প্রশ্নের জবাব এতক্ষণে দিলেন। বললেন—দেখো ভিনসেন্ট, কী যে তোমার ব্রত, কোন কাজ যে ঠিক তোমার কাজের মতো কাজ, সারাজীবনেও এ-প্রশ্নের চরম জবাব তুমি পাবে না। যা করা উচিত মনে কর, সাহস আর নিষ্ঠা নিয়ে সেই কাজে যদি নিজেকে ভরিয়ে দিতে পার, ব্যাস, তাহলেই হল। হয়তো ভুল করেছ, কিন্তু তাতে কী? করেছ তো কিছু? করলেই হল। ভুলের ভরসা ভগবান, বিশ্বাসের মালিক তুমি নিজে। ঈশ্বরের কাজের জন্যে তৈরি হচ্ছ, কীভাবে করবে, কোন পথে চলবে তোমার মনই তার উত্তর দেবে। মন যা বলছে তা-ই করো। এরই নাম আত্মবিশ্বাস। আত্মবিশ্বাসকে ভয় কোরো না কোনোদিন।

কিছুক্ষণ পরে ভিনসেন্ট বললে—আচ্ছা মিনহার, এই শিক্ষায় যদি সফল হই? মেন্ডিস বললেন—তার মানে?

আমি বলছিলাম, পাঁচ বছর এইভাবে পড়ার পর পরীক্ষা যদি পাশ করতে পারি, তার পরে আমার কী হবে? স্ট্রিকার মেসোর মতো শহুরে ধর্মযাজকের জীবন—সে কি আমি পারব?

কবরস্থান সামনেই। সারি সারি অনাড়ম্বর সমাধি, কতকগুলি ঘাসে ঢাকা কতকগুলির ওপর হিব্রুভাষায় লেখা চৌকো পাথরের ফলক। একটা কোণ ডা কস্টা পরিবারের জন্যে নির্দিষ্ট করা আছে, সেখানে একটি বেঞ্চি পাতা। দুজনে বেঞ্চিতে বসল। নিঃশব্দ নির্জন সায়াহ্ন।

কবরগুলির দিকে তাকিয়ে মেন্ডিস বললেন—পৃথিবীতে প্রত্যেক মানুষই তার একটা নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে আসে। যে-কাজই সে করুক না কেন, এই বৈশিষ্ট্য এই চরিত্রগুণ থেকে যদি সে ভ্রষ্ট না হয় তাহলে তার জীবন ব্যর্থ হতে পারে না। যদি তুমি আর্টের ব্যাবসাতেই লেগে থাকতে, তাহলে তোমার এই চরিত্রগুণ তোমাকে ভালো ব্যবসায়ী করেই গড়ে তুলতে পারত। শিক্ষক হয়েছিলে, তাতেই-বা কী? নিজের প্রকাশ যদি সত্যি করতে চাও, যা-ই করো না কেন তার মধ্যে দিয়েই পারবে।

কিন্তু যদি আমস্টার্ডামে না থাকি? পেশাদার ধর্মযাজক হবার মনোবৃত্তি যদি আমার না থাকে?

না থাকে, না থাকুক। সেবাব্রতী হতে পারো, দোকানদার হতে পারো,। ব্রাবান্টের চাষি হতে পারো। তোমার আসল হওয়াটা তাতে আটকাচ্ছে কোথায়? সৎলোক সার্থক লোক হবার গুণ তোমার মধ্যে আছে ভিনসেন্ট। এ আমি দেখেছি। জীবনে অনেকবার মনে হবে ব্যর্থ হলে, হেরে গেলে, ভুল পথে বুঝি চলেছ; কিন্তু তা নয়—যে-পথই তোমার হোক, সার্থকতার আসল পরিচয় সেই পথেই তুমি পাবে।

.

পরের দিন সন্ধ্যা বেলা।

চব্বিশ ঘণ্টা ধরে ভিনসেন্ট একটি কথাই শুধু ভেবেছে। ঈশ্বরের কাজ করবে, এই ছিল অভিলাষ। যারা দুঃখী যারা অবনত তাদের সঙ্গে মিলবে, এই ছিল ব্রত। কবে? আরও পাঁচ বছর পরে? জীবনের পাঁচটি বছর পণ্ডিতি পেশার পুষ্টিসাধনের চেষ্টার অবশেষে? না অবিলম্বে? এখন যদি সে পড়াশুনো ছেড়ে দেয়, আত্মীয়দের এত চেষ্টা আর অর্থব্যয় ব্যর্থ হবে। চুনকালি দেবে সে ভ্যান গক পরিবারের মুখে। আবার প্রমাণ হবে সে কোনো কাজের নয়।

কিন্তু যদি সে ঈশ্বরের প্রকৃত কাজের মধ্যেই ঝাঁপিয়ে পড়ে? শুধু উপাসনা সভায় বক্তৃতাই তো ঈশ্বরের কাজ নয়! দুঃখীর দুঃখ মোচন, আর্ত রোগার্তের সেবা, শোকার্ডের সান্ত্বনা, দীন দরিদ্রের সাহায্য—বিনা দ্বিধায় বিনা বিলম্বে এই কর্তব্যকে সে যদি বরণ করে নেয়—সে কি কাজের মতো কাজ হবে না? সে কাজের মধ্যে কি সার্থক হবে না তার জীবন? পৃথিবীতে কোন পথ তার পথ, কোথায় তার স্থান তা সে জানে। আর মেন্ডিস দিয়েছেন সাহস, ঈশ্বরের কাজে আত্মোৎসর্গ এই মুহূর্তেই শুরু হোক।

রাস্তায় রাস্তায় আলো জ্বলল। ভিনসেন্ট তার ব্যাগটা গুছিয়ে কারও কাছে বিদায় না নিয়ে কাকার গৃহ ত্যাগ করল।

খ্রিস্টীয় সুসমাচার প্রচারণী সংস্থার বেলজিয়াম সমিতি ব্রুসেলসে একটি নতুন স্কুল খুলেছিলেন। এখানে বিনামুল্যে শিক্ষা দেওয়া হবে। ছাত্রদের শুধু আহার ও বাসের জন্যে সামান্য কিছু দক্ষিণা দিতে হবে। এই কমিটির সদস্য ভ্যান ডেন ব্রিঙ্ক, ডি জঙ ও পিটারসেন—এই তিন ধর্মযাজক। ভিনসেন্ট এই কমিটির সঙ্গে দেখা করে এই স্কুলের ছাত্র হবার সুযোগ পেল।

রেভারেন্ড পিটারসেন বললেন—তিন মাস এখানে তুমি পড়ো, তারপর তোমাকে প্রচারকের একটা কাজ জোগাড় করে দেওয়া যাবে।

রেভারেন্ড ডি জঙ পিটারসেনের দিকে তাকিয়ে বললেন—হ্যাঁ, অবশ্য যদি পরীক্ষায় সফল হতে পারে।

রেভারেন্ড ভ্যান ডেন ব্রিঙ্ক উপদেশ দিলেন—এই কথাটি মনে রাখবেন মশিয়েঁ ভ্যান গক যে, ভালো সুসমাচার প্রচারক হতে গেলে খুব সুন্দর ও জনপ্রিয় করে বক্তৃতা দিতে পারা চাই। লোককে আকর্ষণ করতে হবে, আর তা করতে হবে মিষ্টি মধুর বাণী দিয়ে।

সাক্ষাৎকার শেষ হবার পর গির্জা থেকে ভিনসেন্টের সঙ্গে বার হয়ে এলেন রেভারেন্ড পিটারসেন। তার বাহুতে হাত রেখে বললেন—তোমার নির্বাচনে আমি ভারি খুশি হয়েছি ভিনসেন্ট। সত্যিই যদি কাজ করতে চাও, তোমার মতো ছেলের সারা বেলজিয়ামে কাজের অন্ত নেই।

ভিনসেন্ট কৃতজ্ঞতায় গলে গেল। উত্তরে কিছু বলবার মতো ভাষা জোগাল না তার মুখে। তার হাতে একটি কার্ড দিয়ে পিটারসেন বললেন—এই আমার বাড়ির ঠিকানা। সন্ধে বেলা যেদিন কোনো কাজ থাকবে না, আমার ওখানে এসো। কথা বলব তোমার সঙ্গে।

স্কুলে তিনজন মাত্র ছাত্র ভিনসেন্টকে নিয়ে। শিক্ষকটি বেঁটেখাটো জীর্ণশীর্ণ চেহারার তিরিক্ষে মেজাজের মানুষ। বাংলার পাঁচের মতো মুখ। নাম মাস্টার বকমা।

ভিনসেন্টের দুজন সহপাঠী উনিশ-কুড়ি বছরের গ্রাম্য যুবক। তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব জমে উঠল, আর ভিনসেন্টকে নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করাই হল তাদের প্রধান বন্ধুত্ববন্ধন। কিন্তু সবচেয়ে বিপদ হল মাস্টার বকমাকে নিয়ে। শিক্ষক চাইতেন তাঁর ছাত্ররা যাতে বেশ ভালো রকমের উপস্থিত-বক্তা হয়ে উঠতে পারে। তাঁর নির্দেশ ছিল ছাত্ররা প্রতি রাত্রে বাড়িতে বসে খুব ভালো একটি বক্তৃতা রচনা করে মোটামুটি মুখস্থ করে নেবে, সকালে ক্লাসে দাঁড়িয়ে কাগজ না দেখে যেন তারা ঠিকভাবে বক্তৃতাটি দিতে পারে। তাঁর অপর দুজন ছাত্র মিষ্টি মিষ্টি গালভরা বাঁধা বুলির বক্তৃতা লিখে মুখস্থ করে সেই বক্তৃতা ক্লাসে শুনিয়ে শিক্ষককে খুশি করতে লাগল। ভিনসেন্টও রাত্রি জেগে এমনি ধর্মোপদেশ লিখতে লাগল। অন্তরের সমস্ত ভাবনা আর বেদনা দিয়ে সে রচনা করতে লাগল এক-একটি বাক্য। কিন্তু যে-বাণীকে প্রাণের সমস্ত অনুভূতি দিয়ে সে গেঁথেছে, তাকে মুখস্থ করে নিয়ে সহজভাবে বক্তৃতার মধ্য দিয়ে প্রকাশ করা তার পক্ষে অসাধ্য।

বকমা বকাবকি করতে শুরু করলেন। দাঁড়িয়ে উঠে বক্তৃতা করতে যে পারে না, মুখে মুখে বানাবার এতটুকু ক্ষমতা যার নেই, সে নাকি হবে প্রচারক!

এমনি অনেক ধমক সত্ত্বেও বক্তৃতা দেওয়ার অভ্যাস ভিনসেন্টের রপ্ত হল না। গভীর রাত পর্যন্ত সে ধর্মোপদেশ রচনা করে, প্রতিটি শব্দ অর্থময়, প্রতিটি বাক্য ভাবগম্ভীর। পরের দিন অন্য ছাত্ররা যখন সুলভ বক্তৃতায় শিক্ষককে সন্তুষ্ট করে, সে তখন তার রাত্রের রচনাটি পাঠ করতে চায়। শিক্ষক শুনতেই চান না, রুষ্টস্বরে বলেন—এক বছর আমস্টার্ডামে বসে বসে এই শিক্ষাই বুঝি পেয়েছিলে? আমার হাত থেকে যেসব ছাত্র তৈরি হয়েছে তারা কথায় কথায় ধর্মের বক্তৃতা দিয়ে পাঁচ মিনিটে শ্রোতাদের কাঁদিয়ে দিতে পারে। তবে না?

ভিনসেন্ট অনেক চেষ্টা করে হাল ছাড়ল। বকমা রেগে আগুন হলেন। ধমকে অপমানে জর্জরিত হল ভিনসেন্ট। উলটে একবার প্রতিবাদও জানাল সে। শিক্ষক হলেন শত্রু।

নভেম্বরে কমিটির সামনে উপস্থিত হল ছাত্ররা। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল ভিনসেন্ট, আর মাস্টারি সইতে হবে না। এবার কাজ পেয়ে বাঁচবে। কমিটিতে বকমা উপস্থিত, চোখে ক্রূর দৃষ্টি।

তার সহপাঠী দুজনকে প্রশংসা করলেন রেভারেন্ড ডি জঙ, প্রচারকের কাজে নিযুক্ত করা হল তাদের। এবার ভিনসেন্টের পালা।

রেভারেন্ড ডি জঙ বললেন—মশিয়েঁ ভ্যান গক, কমিটি স্থিরনিশ্চয় হতে পারেননি যে তুমি ঈশ্বরের কাজের উপযুক্ত। তাই তোমাকে এবার কোনো কাজ দেওয়া সম্ভব হল না।

কিছুটা স্তব্ধতার পর ভিনসেন্ট বললে—কী দোষ আমি করেছি?

শিক্ষকের নির্দেশ তুমি মাননি। খ্রিস্টধর্মের প্রধান নীতি হল নিৰ্দেশ মানা, বিদ্রোহ করা নয়। তা ছাড়া ঠিকমতো ধর্মনির্দেশ দিতেও তুমি শেখনি। তোমার শিক্ষকই তোমার কাজে সন্তুষ্ট নন।

ভিনসেন্ট রেভারেন্ড পিটারসেনের দিকে তাকাল। তিনি মুখ ঘুরিয়ে রেখেছেন অন্য দিকে। আপনমনেই যেন সে বললে অস্ফুট গলায়—তাহলে, তাহলে আমি কী করব এখন?

রেভারেন্ড ভ্যান ডেন ব্রিঙ্ক উত্তর দিলেন—স্কুলে তুমি ফিরে যাও। আরও ছ-মাস পড়াশুনো করো। তারপর দেখা যাক।

কয়েক মুহূর্ত মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইল ভিনসেন্ট। মোটা বুটজুতোটার চামড়া প্রায় ছিঁড়ে এসেছে। আর কোনো কথা বলার নেই, নীরবে সে বার হয়ে গেল গির্জা থেকে।

.

হাঁটতে হাঁটতে কখন সে লাইকেন অঞ্চলে চলে এসেছে নিজেই জানে না। একটা কাঁচা রাস্তা ধরে সে চলেছে এবার, দোকানপাট লোকজনের ভিড় পেছনে ফেলে। খানিকক্ষণ পরে সামনে পড়ল একটা ফাঁকা মাঠ। ঘাস খুঁটছে বুড়ো একটি ঘোড়া—জীর্ণশীর্ণ, সারা জীবনের কর্মশেষের ক্লান্তিতে নড়বড়ে। মাটিতে এমনি আর-একটা ঘোড়ার সাদা, সাদা হাড়ের কঙ্কাল। মাঠের অদূরে একটা কুটির। কসাইবাড়ি।

এতক্ষণের অনড় মনটা যেন একটু নড়ে উঠল এই ক্লান্ত করুণ দৃশ্যে। একটা গুড়ির ওপর বসে পাইপটা ধরাল। ধোঁয়াটা তেতো তেতো লাগছে। একটু আদরের আবদারে বুড়ো ঘোড়াটা কাছে এসে হাতের সামনে গলাটা বাড়িয়ে দিয়েছে।

আস্তে আস্তে তার মনে নেমে এল ঈশ্বরের কথা। মনে পড়ল যিশুর কথা। কত বাধা, কত বিপর্যয়, যিশুকে টলাতে পারেনি। যিশু বলেছিলেন—ভয় কী আমার, আমি তো একলা নই। ঈশ্বর আছেন আমার সঙ্গে। সান্ত্বনা পেল মনে মনে।

বাড়ি ফিরল ভিনসেন্ট সন্ধে বেলা। দেখল পিটারসেন অপেক্ষা করছেন। তিনি বললেন—তুমি আজ রাত্রে আমার সঙ্গে খাবে। তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি।

পিটারসেনের বাড়ির সামনের ঘরটা যেন একটা স্টুডিয়ো। দেওয়ালে কয়েকটি জলরঙা ছবি, এক কোণে একটি ইজেল।

ও, ভিনসেন্ট বললে—আপনি ছবি আঁকেন? আমি জানতাম না তো? পিটারসেন একটু লজ্জিত হলেন—এ কিছু না, একেবারে শিক্ষানবিশি। হাতে সময় পেলে মাঝে মাঝে একটু তুলি ধরি।

ডিনার শুরু হল। সঙ্গে বসল পিটারসেনের বছর পনেরো বয়সের একটি মেয়ে, এত লাজুক যে টেবিল থেকে মুখই তোলে না সারাক্ষণ। পিটারসেন এটা–ওটা নানা কথা বলতে লাগলেন, খাবারে রুচি না থাকলেও ভিনসেন্ট ভদ্রতা করে এটা-ওটা মুখে তুলতে লাগল। হঠাৎ তার কান খাড়া হয়ে উঠল পিটারসেনের একটি কথায়।

পিটারসেন বলছিলেন—কয়লাখনির এলাকা এই বরিনেজ। এখানকার প্রায় প্রতিটি লোকই খনির খাদে।কাজ করে’। জীবনযাত্রার জন্যে প্রতিটি দিন প্রতি মুহূর্তে কী বিপদের মুখোমুখি তাদের কাটে অথচ জীবিকা যা জোটে তাতে বেঁচে থাকা বিড়ম্বনা। বাস করে তারা জীর্ণ কুটিরে, অন্নহীন, বস্ত্রহীন।

ভিনসেন্ট বুঝতে পারে না পিটারসেন হঠাৎ এ প্রসঙ্গ তুললেন কেন। সে জিজ্ঞাসা করে—আচ্ছা বরিনেজ জায়গাটা কোথায়?

বেলজিয়ামের দক্ষিণে, মনস-এর কাছাকাছি। সম্প্রতি আমি ক-দিন সেখানে কাটিয়ে এসেছি। আমি দেখেছি, সত্যি যদি ধর্মের বাণী আশার বাণীর কারও দরকার হয় সে এই বরিনেজের অধিবাসীদের।

গলায় খাবার আটকে এল ভিনসেন্টের, হাতের ছুরি কাঁটা খসে পড়ে আর কী। সে শুনল পিটারসেন বলছেন—ভিনসেন্ট, তুমি কেন বরিনেজে যাও না? তোমার আদর্শবোধ আছে, উদ্দীপনা আছে, সেখানে গেলে অনেক ভালো কাজ তুমি করতে পারবে।

আমি? আমি কী করে যাব? কমিটি তো আমাকে…

হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি তা জানি। আগেই জানতাম, তাই সব ব্যাপারটা জানিয়ে ক-দিন আগেই তোমার বাবাকে চিঠি লিখেছিলাম। আজই তাঁর উত্তর পেয়েছি। তিনি বলেছেন, যতদিন না পর্যন্ত তোমার একটা চাকরির পাকাপাকি ব্যবস্থা আমি করে দিতে পারি, ততদিন তোমার বরিনেজে থাকার খরচ তিনি দেবেন।

লাফিয়ে উঠল ভিনসেন্ট—তাহলে, কাজ আমাকে একটা করে দেবেন আপনি?

দাঁড়াও, অত উতলা হোয়ো না। সময় নেবে কিছুটা বই কী। কমিটি যখন দেখবে তুমি ভালো কাজ করছ, তখন তোমাকে তারা মনোনীত করবেই। তা ছাড়া ধরো ডি জঙ আর ভ্যান ডেন ব্রিঙ্ক—তাদের অনেক উপকারে তো আমি আসি, আমার কথাও সময়ে অসময়ে তাদের রাখতেই হবে। একটা কথা আমি বিশ্বাস করি ভিনসেন্ট, পৃথিবীতে দুঃখীর অভাব নেই, আর তোমার মতো লোকেরই দরকার তাদের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়াবার জন্যে।

ট্রেন প্রায় গন্তব্যস্থানে এসে পৌঁছেছে। চক্রবালে ফুটে উঠল কালো কালো কয়েকটি পাহাড়। ভারি খুশি লাগল ভিনসেন্টের। ফ্ল্যান্ডার্সের সমতলভূমি দেখে দেখে চোখের বিস্বাদ বুঝি ঘুচল এতক্ষণ। বেশ কিছুক্ষণ ওই দূরের পাহাড়গুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ক্রমে মনে হতে লাগল, ওগুলো যেন কেমন অদ্ভুত ধরনের। ওগুলো কোনো গর্বতমালার অংশ নয়, সমতল মাটির ওপরই হঠাৎ হঠাৎ মাথা খাড়া করে উঁচু হয়ে ওঠা।

মনে মনে ভিনসেন্ট বললে—আশ্চর্য! ঠিক যেন কালো কালো পিরামিড। পাশের সহযাত্রীটিকে সে শুধোল—আচ্ছা বলতে পারেন, ওখানে ওই পাহাড়গুলো এল কী করে?

তা আর বলতে পারিনে? ওগুলো হচ্ছে কয়লার খাদের পাহাড়, খনি থেকে কয়লার সঙ্গে যে-আবর্জনাটা উঠে আসে তারই স্তূপ। ওই যে ছোট্ট গাড়িটা চলেছে দেখছেন, ওটাকে লক্ষ করুন, তাহলেই বুঝতে পারবেন।

ভিনসেন্ট দেখল, একটা পাহাড়ের গা বেয়ে একটা গাড়ি উঠতে উঠতে হঠাৎ উলটে গেল আর চারিদিকে ছড়িয়ে গেল কালো ধোঁয়ার রাশি–

লোকটি বললে, ওই দেখুন, দিনে দিনে ইঞ্চি ইঞ্চি করে পাহাড় বড়ো হচ্ছে। আমরা ছেলেবেলা থেকে দেখে আসছি অমনি।

গাড়ি থামল ওয়ামস স্টেশনে। ভিনসেন্ট ট্রেন থেকে নামল। নিঃস্ব রিক্ত বিশাল একটা উপত্যকার মাঝখানে এই ওয়ামসের খনি এলাকা। আকাশের নীলিমার ঠিক নীচেই কয়লার ধুলোর ঘন কালো আস্তরণ। তার মাঝ দিয়ে সূর্যের ঝাপসা নোংরা আলো চুঁইয়ে পড়ছে। পাহাড়ের ধার বেয়ে বেয়ে দু-সার ইটের বাড়ি। এ-জায়গাটা ওয়ামসের সদর। পাকা ইটের কাঠামো একটু দূরে গিয়েই শেষ হয়েছে। সেখান থেকে পুরোনো ওয়ামস গ্রামের শুরু। কয়লাখনির মজুরদের বাস সেখানে।

স্টেশন থেকে বার হয়ে রাস্তায় নেমে হাঁটতে শুরু করল ভিনসেন্ট। পথে জনপ্রাণী নেই। কদাচিৎ কোনো বাড়ির দরজায় পাংশু নিষ্প্রাণ মুখে কোনো স্ত্রীলোক দাঁড়িয়ে।

ওয়ামস গ্রামে একটিমাত্র পাকাবাড়ি। তার মালিক এখানকার রুটিওয়ালা, নাম জিন ব্যাপ্টিস্ট ডেনিস। এই ডেনিসের বাড়িতেই ভিনসেন্ট চলেছে—পিটারসেনের ব্যবস্থা অনুসারে সেখানেই সে থাকবে।

মাদাম ডেনিস আন্তরিক সহৃদয়তার সঙ্গে ভিনসেন্টকে বাড়িতে আহ্বান করলেন। টাটকা রুটির গন্ধভরা রান্নাঘরের পাশ দিয়ে উঠে একেবারে তিনি তাকে নিয়ে গেলেন তাঁর ঘরে। ছোট্ট ঘরটি, রাস্তার ওপর জানলা। গৃহবাসিনী আগে থেকেই ঘরটিকে ঝেড়ে মুছে সাজিয়ে ঝকঝকে করে রেখেছেন। ভারি ভালো লাগল ভিনসেন্টের। শুধু ঘর নয়, ভালো লাগছে সমস্ত পরিবেশ। জিনিসপত্র খোলবার তর সইল না, মোটা মোটা সিঁড়ি বেয়ে রান্নাঘরে নেমে মাদাম ডেনিসকে বলে সে বার হল রাস্তায়। মাদাম ডেকে বললেন, ফিরতে যেন খুব দেরি না করে, খাওয়ার সময় যেন পিছিয়ে না যায়।

না, না, এই একটু চারিদিকটা ঘুরে এলাম বলে।

গতরাত্রে তুষার পড়েছিল। মাঠের ধারের বেড়াগুলোর কালিমা তুষার কিন্তু মুছে ফেলতে পারেনি। ডেনিসের বাড়ির পুবদিকে মস্ত একটা খাড়াই, তার গায়ে শ্রমিকদের কুটির, উলটো দিকে প্রান্তর। সেখানে কয়লার খাদের একটা আবর্জনা–পাহাড়, আর কয়লাখনির সার সার চিমনি। খনির নাম মার্কাস। গ্রামের অধিকাংশ লোক এই খনিতেই খাটে। প্রান্তরের মাঝখান দিয়ে একটা রাস্তা—খানাখন্দ, কাঁটাচারা আর মরা গাছের শুকনো শেকড়ে ভরা।

মালিকদের আরও অনেক আছে, তবে এই খনিটাই সবচেয়ে পুরোনো। আর সারা বরিনেজ অঞ্চলে এমনি বিপজ্জনক খনি আর দুটি নেই। হয় বিষাক্ত গ্যাসে নাহয় বিস্ফোরণে, হয় জল উঠে নাহয় ধস নেমে—এই খনি যে আজ পর্যন্ত কত শ্রমিকের বলি নিয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। দুখানি পাকা পাকা গাঁথুনির ইটের ঘর নিয়ে খনির কারখানা, সেখানে রয়েছে কয়লা তোলার ও কয়লা হেঁকে গাড়িতে ওঠাবার যন্ত্রপাতি। খাড়া খাড়া চিমনিগুলো চব্বিশ ঘণ্টা, কালো ধোঁয়া উদ্‌গরণ করছে। খনির চারদিকে শ্রমিকদের অসংখ্য খুপরি, কাঁটাঝোপ, মরা গাছের শুকনো ডাল, ছাইগাদা আর আবর্জনার স্তূপ। সবার মাথার ওপর কালো পিরামিডের ভ্রূকুটি। তারও ওপরে আকাশ—বর্ণহীন, কলঙ্কধূসর। চারদিক যেন প্রাণহীন কৃষ্ণ মরু, নির্জন পথে একলা ভিনসেন্টের মনটা বিমর্ষ হয়ে গেল।

খনির অদূরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর হঠাৎ বাঁশি বাজল, খুলে গেল কারখানার গেট। শ্রমিকেরা বার হতে লাগল। গায়ে তাদের ছিন্নভিন্ন মোটা পোশাক, মাথায় চামড়ার টুপি। পুরুষ আর মেয়ে উভয়েরই একই পোশাক। প্রত্যেকের সর্বাঙ্গ কালো, কালো মুখে সাদা চোখগুলোর কেমন যেন কোটর থেকে বার-হওয়া রূপ। শেষরাত্রি থেকে শুরু করে সারাদিন মাটির অতলে অন্ধকারে কাটানোর পর বিকেলের পড়ন্ত রোদের আলো তাদের দৃষ্টি যেন সইতে পারছে না। অন্ধের মতো জড়োসড়ো পায়ে এ-ওর কাছাকাছি ঘেঁষে ওরা এগোচ্ছে, স্থানীয় ভাষায় কথা বলছে নীচু গলায়। জীর্ণশীর্ণ দেহ সকলেরই, ঝুঁকে-পড়া কাঁধ, ঝুলে–পড়া দুই হাত।

ভিনসেন্ট বুঝতে পারল, এতক্ষণ চারদিক এত নির্জন বলে মনে হচ্ছিল কেন। ওয়ামস আসলে মাটির ওপরে নয়, মাটি থেকে সাতশো মিটার নীচে সুড়ঙ্গপথ আকীর্ণ পাতালনগরই আসল ওয়ামস; দিন-রাতের অধিকাংশ সময় এখানকার প্রতিটি লোকের কাটে সেই পাতালে।

.

সন্ধে বেলা খাবার টেবিলে মাদাম ডেনিস বললেন—মার্কাসের একজন পুরোনো ফোরম্যান এখানে আসবে। তার সঙ্গে আলাপ করে এখানকার বিষয় অনেককিছু আপনি জানতে পারবেন।

ভিনসেন্ট বললে― বেশ তো।

মাদাম ডেনিস আবার বললেন–জ্যাকেস ভার্নি সামান্য শ্রমিক ছিল। খালি নিজের চেষ্টায় এত বড়ো হয়েছে, কিন্তু তবু সে শ্রমিকদের বন্ধু।

ভিনসেন্ট প্রশ্ন করলে–এ-কথার মানে? বড়ো হলে কি আর শ্রমিকদের বন্ধু থাকে না নাকি?

না, মশিয়েঁ ভ্যান গক। যখনই কোনো লোক এই গ্রাম থেকে শহরবাজারে গিয়ে বাসা বাঁধে, তখনই তার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যায়। তখন থেকে সে পয়সার লোভে সব ব্যাপারে মনিবদের পক্ষ নেয়, ভুলে যায় যে এককালে সে এইখানেতেই গতর খাটাত। তবে জ্যাকেস সেরকম নয়। বড়ো সৎ, বড়ো বিশ্বাসী। ধর্মঘটের সময়ে কারও কথা শ্রমিকরা মানে না, কেবল ওর কথা ছাড়া। কিন্তু আহা! বেচারি আর কতদিনই-বা বাঁচৰে?

কেন? কী হয়েছে তার?

সেই পোড়া ব্যায়রাম! বুকের দোষ। তবে খনিতে যারা নামে, ও-ব্যায়রাম তাদের মধ্যে হবে না কার?

একটু পরে জ্যাকেস ভার্নি এল। বেঁটে, আধকুঁজো চেহারার লোকটি, গভীর খোঁদলে-ঢোকা চোখে কেমন একটা বঞ্চনার আর হতাশার ছাপ। মাথা-জোড়া টাক। মোটা কালো ভ্রূ, কানের ধার আর নাকের ফুটো থেকে চুলের গুচ্ছ ঝুলছে। ভিনসেন্ট একজন প্রচারক ও এখানকার অধিবাসীদের মধ্যে কাজ করতে এসেছে শুনে হতাশাব্যঞ্জক গলায় সে বললে—আঃ মশিয়েঁ, কত লোক আমাদের সাহায্য করতে চায়, কিন্তু আমাদের জীবন যেমন চলবার তেমনিই চলে।

ভিনসেন্ট শুধোলে—এখানকার জীবনযাত্রার অবস্থা খুবই খারাপ, তাই কি? একমুহূর্ত চুপ করে থেকে জ্যাকেস বললে—আমার অবশ্য তা নয়। মার কাছে ছেলেবেলায় কিছুটা লেখাপড়া শিখেছিলাম, তাই ভাঙিয়ে ফোরম্যান পর্যন্ত হয়েছি। শহরে যাবার রাস্তায় ছোটো একটা পাকাবাড়ি আমার আছে, খাবার ভাবনাও নেই। নিজের ভাগ্য নিয়ে কোনো দুঃখ আমার নেই।

হঠাৎ কথা বন্ধ করতে বাধ্য হল কাশির ধমকে। ভিনসেন্টের মনে হল লোকটার জীর্ণ বুক এবার বুঝি ফেটে যাবে। সদর দরজা দিয়ে রাস্তায় বার হয়ে থুথু ফেলে রান্নাঘরে এসে জ্যাকেস বসল।

শুরু করল সে ব্যাপারটা বলি মশিয়েঁ। ফোরম্যান যখন হলাম তখন আমার বয়েস প্রায় তিরিশে গিয়ে ঠেকেছে। বুকটা তার আগেই যা খারাপ হবার হয়ে গিয়েছিল। তবে কিনা এ ছাড়া আমার ভাগ্য ভালোই। খনির শ্রমিকদের কথা যদি জিজ্ঞাসা করেন….

মাদাম ডেনিসের দিকে ফিরে জ্যাকেস রললে—কী বলো? হেনরি ডিক্রুকের কাছে নিয়ে যাব নাকি এঁকে?

যান না নিয়ে। যা সত্যি, তা তো এঁকে জানতেই হবে।

একটু বিব্রত দৃষ্টিতে জ্যাকেস ফিরে তাকাল ভিনসেন্টের দিকে, বললে—যাই বলুন মশিয়েঁ, ওরা যখন আমাকে ফোরম্যান করেছে, তখন ওদের প্রতি কিছুটা আনুগত্য আমার আছে বই কী। তবে কিনা, হেনরি, হ্যাঁ, সেই আপনাকে সবকিছু দেখাবে।

রাত্রের কনকনে ঠান্ডায় জ্যাকেসের পেছনে পেছনে রাস্তায় বার হয়ে ভিনসেন্ট চলল কুলিবস্তির দিকে। সারা খাড়াইটা জুড়ে ছড়িয়ে আছে এই বস্তি। এক-একটি পরিবারের এক-একখানা করে কাঠের খুপরি। কোনো পরিকল্পনা নেই, যেমন–তেমন করে খুপরিগুলো গজিয়েছে, তাই তাদের ঘিরে কত যে গলিঘুঁজি তার ইয়ত্তা নেই। আর মোড়ে মোড়ে জড়ো করা জঞ্জাল। অন্ধকারে কখনও ঠোক্কর খেতে হয় গুড়িতে, কখনও-বা পা ডুবে যায় আবর্জনার স্তূপে। শেষ পর্যন্ত ডিক্রুকের ঘরের সামনে পৌঁছে দরজায় ধাক্কা দিল জ্যাকেস।

দরজার একটা পাল্লা খুলে আগন্তুকদের দেখে নিয়ে তারপর দ্বিতীয় পাল্লাটি খুলে তাদের ভেতরে ডাকল ডিক্রুকের স্ত্রী। বিয়ের আগে অনেক বছর ধরে মেয়েটি ডিক্রুকের মতো এই খনিতেই নেমেছে, ঝুড়ি ধরেছে, লাইনে পাতা কয়লাগাড়িগুলোকে ঠেলে নিয়ে চলেছে। বয়েস পঁচিশ-ছাব্বিশের বেশি নয়, কিন্তু রসকসের আভাস নেই শরীরে।

বস্তির অন্যান্য ঘরের মতনই ডিক্রুকের ঘর। মাটির মেঝে, কাঠের তক্তার ফাঁকে ফাঁকে কনকনে হাওয়াকে আটকাবার জন্যে দেয়ালে ছেঁড়া-ছেঁড়া বস্তা ঝোলানো। ঘরের পেছন দিকের দুই কোণে দুটো বিছানা, একটাতে তিনটি বাচ্চা ঘুমুচ্ছে। মোটা তক্তার একটা টেবিল, দু-ধারে দুটো বেঞ্চি, এক কোণে নড়বড়ে চেয়ার, দেয়ালে পেরেক দিয়ে আঁটা একটা খোলা বাক্সে কয়েকটা বাসনপত্র। এক কোণে একটা উনুন। বরিনেজের অনেকেই গৃহপালিত পশু পোষে। ডিক্রুকেরও আছে একটা ছাগল আর কয়েকটা খরগোশ। ছাগলটা বাচ্চাদের চৌকিতে গিয়ে ঘুমোয়, খরগোশগুলো শুয়ে থাকে উনুনের ধার ঘেঁষে।

ডিব্ৰুক চেয়ারটায় বসেছিল। লাফিয়ে উঠে বললে—আরে জ্যাকেস, এসো এসো। কতদিন পরে তোমার পায়ের ধুলো পড়ল, অ্যাঁ?—ইনি? তোমার বন্ধু নাকি? আরে আসুন আসুন স্যার!

ডিক্রুকের মস্ত বড়াই, খনি তাকে মারতে পারেনি, পারবেও না কখনও। তার মাথার ডানদিকে ঝাঁকড়া চুলের ফাঁকে মস্ত একটা চৌকো ক্ষতচিহ্ন চকচক করছে। ওইটে তার জয়টিকা। একবার ক্রেনের দড়ি ছিঁড়ে একটা খাঁচা সোজা নেমে যায় একশো মিটার নীচে খনির গহ্বরে। উনত্রিশটি লোক মরেছিল। একজন কেবল মরেনি, সেই একজন সে। একটা পা টেনে টেনে সে হাঁটে। কয়লাখাদের খুপরির কাঠের খুঁটি একবার ভেঙে পড়ে, কয়লার চাঙড় ধসে পড়ে তার পায়ের সামনের হাড়টা চার টুকরো হয়ে যায়। পাঁচ দিন সে আটক থাকে খুপরির মধ্যে। তার মোটা ময়লা শার্টটার ডানদিকটা ফুলে থাকে সর্বদা। বুকের অংশটা এবড়োখেবড়ো উঁচুনীচু। সেখানে চামড়ার তলায় গুঁড়িয়ে আছে তিনটে পাঁজরা। একবার একটা বিস্ফোরণে সে ছিটকে পড়ে একটা কয়লাগাড়ির ওপর, তারই ফল। এত মারেও সে মরেনি—লড়িয়ে সে, জঙ্গি তার মেজাজ। মালিকদের বিরুদ্ধে সবচাইতে চড়া গলায় সে কথা বলে, তাই খনিতে সবচেয়ে বিপজ্জনক গলিঘুঁজিতে তার ডিউটি পড়ে। কষ্টে সে ডরায় না, ওরা যত ভয় তাকে দেখায়, ওদের বিরুদ্ধে তার রাগ ততই তেতে তেতে ওঠে। ওরা—যারা দুটি খেতে দেয় আর রক্ত নিংড়ে নেয়, ওই অধরা আততায়ীর দল।

ডিক্রুক বললে—মশিয়েঁ ভ্যান গক, আপনি ঠিক আসল জায়গাটিতেই এসেছেন। এখানে এই বরিনেজের মেয়ে পুরুষ কুলি কামিন আমরা—আমরা ক্রীতদাসও নই। কেননা আমরা মানুষই নই, স্রেফ জানোয়ার। শেষ রাত্তিরে তিনটের সময় আমরা খনির খোঁদলে নামি, মাটির ওপর আবার উঠে আসি বিকেল চারটেয়। এগারো ঘণ্টা খাটুনির মাঝখানে দুপুরে মাত্র পনেরো মিনিট খাবার ছুটি। ভেতরটা কেমন আপনি জানেন না, রাত্তিরের মতো কালো আর চুল্লির মতো গরম। ন্যাংটো হয়ে আমরা কাজ করি, যেটুকু বাতাস মেলে তাতে কয়লাগুঁড়ো আর বিষ ভরতি, দম বন্ধ হয়ে আসে। সোজা হয়ে দাঁড়াতে ভুলে গেছি, সারাদিন সুড়ঙ্গের মধ্যে হামাগুড়ি দিয়ে কাটে, দাঁড়াবার তো জায়গা নেই সেখানে। আট বছর বয়স থেকে এখানকার ছেলেমেয়েরা খাদে নামতে শুরু করে। কুড়ি বছর পেরোতে না পেরোতেই বুকের দোষ জন্মে যায়, পরমায়ু বছর চল্লিশ পর্যন্ত। অ্যাদ্দিনে যক্ষায় বুক ঝাঁঝরা হয়ে যায়, অবিশ্যি তার মধ্যে অপঘাতে মরলে তো আপদ বিদায়। বলো, ঠিক বলছিনে ভার্নি?

ঠিক ডিক্রুক।

ডিক্রুকের স্ত্রী দূরে বিছানার কোণে আধো অন্ধকারে চুপ করে বসেছিল। স্বামীর এমনি উত্তেজিত কণ্ঠস্বর সে হাজার বার শুনেছে। তার কিছুই হয় না এতে। এমনি চুপ করে এককোণে মিশে থাকাই তার স্বভাবে দাঁড়িয়ে গেছে। যৌবনারম্ভ পর্যন্ত সে কয়লাগাড়ি ঠেলেছে, তারপর তিনটি সন্তান আর বছরের পর বছর ছেঁড়া চটের ফাঁকে ফাঁকে হাড়-কাঁপানো শীতের আক্রমণ—এতদিনে তার সব রক্ত জমে ঠান্ডা।

ভাঙা পা-টাকে একধারে সরিয়ে ডিক্রুক আবার বলতে শুরু করল—আর এর বদলে আমরা কী পাই জানেন মশিয়েঁ? এই এক-ঘরের একটা খুপরি, আর গাঁইতি মারার মতো শক্তিটুকু যাতে থাকে তার উপযুক্ত একমুঠো খাবার। পোড়া রুটি, কালো কফি, পচা পনির। একটুকরো মাংস হয়তো সারা বছরে একবার কি দু-বার মাইনে থেকে পঞ্চাশটা আধলা যদি কেটে নেয়, তাহলে শুকিয়ে মরব, কয়লা তোলা আর হবে না। সেইজন্যেই ওটুকু আর ওরা কাটে না! তাই অনাহারের ঠিক দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে সারাজীবন কাটে। যে মরে সে মরে কুকুরের মতো, তার বউ ছেলে হাত পেতে পথে ঘুরে বেড়ায় আট বছর থেকে চল্লিশ, এই বত্রিশটা বছর পরে ভবযন্ত্রণা ঘোচে, তখন ওই পাহাড়ের কোণায় গর্তের মধ্যে, দেহটার সঙ্গে সঙ্গে সব দুঃখ মাটি-চাপা পড়ে।

এ এক নতুন শিক্ষা হল ভিনসেন্টের। কয়লাখনির জাতশ্রমিক—এরা অশিক্ষিত, অনেকেই একেবারে নিরক্ষর। কিন্তু মূর্খ নয়। বুদ্ধি আছে, বোধ আছে, বিবেচনা আছে। এরা যে কাজ করে তা মূর্খে পারে না, সাফ মগজ না থাকলে অসম্ভব। এদের জীবনযাত্রা জন্তুর, কিন্তু জন্তু এরা নয়, প্রাণ আছে, মমতা আছে, আর এখনও বেশ কিছু অবশিষ্ট আছে আত্মসম্ভ্রমবোধ। ক্ষুধায়, ক্লান্তিতে, রোগে জীর্ণশীর্ণ এদের শরীর, অসহায় শ্লথ গতি। গায়ের পাণ্ডুর চামড়ার লোমকূপে হাজার হাজার কালো কালো ফোঁটা। ঘা খাওয়াই যার ভাগ্য—ঘা মারা নয়, সেই হতাশ বঞ্চিতের ব্যর্থ করুণ দৃষ্টি এদের চোখে।

ভিনসেন্টের ভালো লাগে এদের। এঁরা সরল, সৎ, জুন্ডেয়ার্ট আর ইটেনের লোকদের মতো নম্র ভদ্র এদের স্বভাব। বরিনেজের মাঠ-ঘাটের নির্জন মরুরূপ ও ভালো লাগতে শুরু করেছে, কেননা এ-রূপের সঙ্গে দিনে দিনে পরিচিত হচ্ছে সে।

কয়েক দিন পরে ভিনসেন্ট তার প্রথম প্রার্থনাসভা ডাকার স্থির করল। ডেনিসদের রুটিঘরের পেছনে একটা খালি শেড পড়েছিল। সেটা সে ভালো করে পরিষ্কার করে নিল, বেঞ্চিও জোগাড় হল কয়েকটা। দিনের শেষে শ্রমিকরা এল স্ত্রী আর সন্তানদের নিয়ে, যার যা শীতবস্ত্র সম্বল তা গায়ে চাপিয়ে। দু-বগলের নীচে ঠান্ডা হাত দুটোকে পুরে দিয়ে স্থির হয়ে শক্ত কাঠের বেঞ্চিতে তারা বসল, মনোযোগের সঙ্গে দেখতে লাগল তাদের নতুন পাদরিকে। বাইরে শীত, সারা ঘর জুড়ে ছায়া ছায়া অন্ধকার—এক কোণে ধার করে আনা একটিমাত্র কেরোসিনের পুরোনো লন্ঠন।

বাইবেলের পাতা ওলটাতে লাগল ভিনসেন্ট। কোন অনুচ্ছেদটি সে বেছে নেবে প্রথম দিনের এই সভায়? শেষ পর্যন্ত সে পড়ল ষোড়শ অ্যাক্টের নবম অনুচ্ছেদটি:

অতঃপর রাত্রিকালে পলের এক স্বপ্নদর্শন হইল। তাঁহার সম্মুখে একজন মাসিডোনিয়াবাসী দাঁড়াইয়া আছে ও বলিতেছে—আপনি মাসিডোনিয়াতে আসুন, আমাদের সাহায্য করুন।

ভিনসেন্ট বললে—বন্ধুগণ, এই যে মাসিডোনিয়ার অধিবাসী, এ কে? এ একজন শ্রমিক, মুখে তার দুঃখ দৈন্য ক্লান্তির বলিরেখা। তবু সে মুখে জ্যোতি আছে, ভাতি আছে—কেননা সে তো সামান্য নয়, মৃত্যুঞ্জয় আত্মার সে ও অধিকারী। পরম পিতা তাঁর সন্তান খ্রিস্টকে পাঠিয়েছিলেন কেন? মানুষ যাতে এই সন্তানকে অনুসরণ করে সেইজন্যে। নির্লোভ, নিষ্কাম, সহজ জীবন, দীনতমের সঙ্গে সহযোগ—এই তো খ্রিস্টানুসরণ। খ্রিস্টের এই বাণী, আমাদের ধর্মপুস্তকের এই শিক্ষা: বিনত হও, প্রণত হও, তবেই সেই নির্দিষ্ট দিনে স্বর্গরাজ্যে প্রবেশাধিকার পাবে, আত্মা অক্ষয় শান্তি লাভ করবে।

.

শুরু হল নব জীবন।

সারা গ্রামে রোগীর অভাব নেই। প্রতিদিন সকালে ভিনসেন্ট বাড়ি থেকে বার হয়, রোগীদের বাড়ি বাড়ি ঘোরে। যাকে যখন যা পারে, তাই বিলোয়। কাউকে রুটি, কাউকে একটু দুধ, কাউকে একটি চাদর বা একজোড়া মোজা। ডাক্তার সে নয়, চিকিৎসা বিলোতে সে জানে না, বিলিয়ে বেড়ায় সেবা। গ্রামে আসে টাইফয়েড, ঘরে ঘরে বিকারগ্রস্ত রোগী, বেকার শ্রমিক পরিবারে অধিকতর দারিদ্র্য, ভিনসেন্টেরও কাজ বাড়ে। সারা গ্রামে এমন একটি বাড়ি নেই যেখানে সে যায়নি। হয় খাবার নিয়ে, নাহয় সেবা নিয়ে, নাহয় প্রার্থনা নিয়ে। গ্রামবাসীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে তার পরিচয়।

বড়োদিন এসে গেছে। মার্কাস খনির কাছে সে আবিষ্কার করল পরিত্যক্ত একটা আস্তাবল। বেশ বড়ো ঘরটা, একশোজনের বেশি লোক আঁটবে। ঘরটা পাথরের মতো ঠান্ডা, আসবাব নেই একটিও। তবু প্রার্থনার দিন সন্ধে বেলা সারা ঘরে তিলধারণের ঠাঁই রইল না। স্তব্ধ হয়ে শ্রমিকরা শুনতে লাগল যিশুখ্রিস্টের জন্মকাহিনি, বেথেলহেমের আকাশে নতুন তারার উদয়বার্তা। মাত্ৰ ছ-সপ্তাহ ভনসেন্ট বরিনেজে এসেছে। এরই মধ্যে লক্ষ করেছে সে, দিনে দিনে শ্রমিকদের অবস্থা চূড়ান্ত খারাপের পথে এগিয়ে চলেছে। তার কাজ তবু সে করুক। খ্রিস্টের এই পুণ্য জন্মদিনে এই আশাহারা ব্যর্থকাম মানুষদের শূন্য প্রাণে চরম আশার বাণী বনিত হোক, পরম শান্তির স্বপ্ন জাগরিত হোক।

একটা দুঃখ এখনও তার রয়েছে। এখনও সে বেকার, বাবার মুখাপেক্ষী। এটা চখচ করে সর্বদা। রোজ রাত্রে সে প্রার্থনা করে—সেদিনটা শীঘ্র আসুক যেদিন থেকে তার এই অনাড়ম্বর জীবনযাত্রার সামান্য চাহিদাগুলির দাম নিজেই সে মেটাতে পারবে।

নববর্ষের দিনে পিটারসেনের চিঠি এল:

প্রিয় ভিনসেন্ট,

সুসমাচার প্রচারণী কমিটি তোমার চমৎকার কাজের সংবাদে খুশি হয়েছেন। এ-বছরের প্রথম থেকে অস্থায়ীভাবে ছ-মাসের জন্যে তোমাকে বহাল করা হল। জুন মাসের শেষ পর্যন্ত তোমার কাজে যদি কোনো খুঁত পাওয়া না যায়, তাহলে এই নিয়োগ পাকা হবে। বর্তমানে মাসে পঞ্চাশ ফ্র্যাঙ্ক করে তুমি পাবে।

যখনই সুবিধে পাবে আমাকে চিঠি লিখবে। আশীর্বাদ করি তোমার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হোক।

পিটারসেন

আনন্দে দু-হাত মুঠো করে লাফিয়ে উঠল ভিনসেন্ট। ক-বার গড়াগড়ি দিয়ে, নিল বিছানায়। এতদিনে তার মনস্কামনা পূর্ণ হয়েছে, সে সফল হয়েছে, হয়েছে স্বাধীন! পঞ্চাশ ফ্র্যাঙ্ক! কম নাকি? দরকারের চেয়ে অনেক বেশি! আদর্শ তার সামনে, জীবনের পথ তার সামনে আর তাকে কে রোখে?

তাড়াতাড়ি টেবিলে গিয়ে সে বাবাকে চিঠি লিখতে বসল। লম্বা চিঠি—আর ভাবনা নেই, আর সে পয়সার জন্যে হাত পাতবে না। আর তার লজ্জা নেই, আর তার জন্যে কাউকে লজ্জা পেতে হবে না। এতদিন সে ছিল পরিবারের মধ্যে অপাঙ্ক্তেয়, এখন থেকে তার হয়ে ভালো কথা দুটো কাউকে না কাউকে বলতে হবে বই কী!

উৎসাহভরা অভিমানভরা চিঠি। লেখা যখন শেষ হল তখন দিনান্ত পড়ে এসেছে। আকাশ জুড়ে বজ্র-বিদ্যুৎ, মেঘ আর বৃষ্টি। সিঁড়ি দিয়ে তরতর করে ছুটে বেরিয়ে গেল ভিনসেন্ট, দুর্যোগের বাধা না মেনে।

ভিনসেন্ট এখন রীতিমতোভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রচারক। তার কাজের জন্যে স্থায়ী একটা গৃহ এখন দরকার। অনেক খোঁজাখুঁজির পর সে গ্রামের প্রান্তে পাইন বনের ধারে একটা ছোটো খালি বাড়ি আবিষ্কার করল। এখানে একসময়ে ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের নাচ গান শেখানো হতো। সেসব অনেক দিন বন্ধ, পোড়োবাড়িটা খাঁ-খাঁ করে। এবার এটি হল তার নতুন উপাসনাগৃহ। তার সমস্ত ছবির প্রিন্টগুলো দেয়ালে এঁটে এঁটে সে ঘরটাকে সুদৃশ্য করে তুলল। ঠিক করল এখানে একটা শিশু বিদ্যালয়ও সে বসাবে। চার থেকে আট বছরের ছেলেমেয়েরা তার অবৈতনিক ছাত্র। লিখতে পড়তে শিখবে, বাইবেলের গল্প শুনবে। শ্রমিকের সন্তানের পক্ষে এটুকু শিক্ষাই তো সব, আট বছর পার হলেই তো খাদে নামতে হবে।

বাড়িটা জোগাড়ের ব্যাপারে জ্যাকেস ভার্নি তাকে অনেক সাহায্য করেছিল। ভিনসেন্ট তাকে বললে—আগুন জ্বালবার কয়লা পাই কোথায়? সন্ধে বেলা বাচ্চারা সে-শীতে ঠকঠক করে কাঁপবে!

জ্যাকেস একটু ভেবে বললে—আচ্ছা, কাল দুপুরে এখানে আসবেন, দেখা যাবে। পরদিন ভিনসেন্ট যখন এই স্কুলবাড়িতে পৌঁছোল, দেখে, শ্রমিকদের একগাদা মেয়ে-বউয়ের জটলা। সবাইয়ের পরনে কালো পোশাক, মাথার চুল ঢাকা, নীল, কালো, রঙিন কাপড় জড়ানো। প্রত্যেকের সঙ্গে একটা করে বস্তা।

ভার্নির মেয়ে এদের লিডার। বললে—দেখছেন কী মশিয়েঁ ভিনসেন্ট, এই নিন, আপনার জন্যেও একটা বস্তা এনেছি। আপনাকেও কয়লা বয়ে আনতে হবে আমাদের সঙ্গে।

আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে এগোতে এগোতে গ্রাম পার হয়ে মার্কাস খনি পেছনে ফেলে তারা পৌঁছোল সেই কালো পিরামিডটার গায়ে। তারপর সার সার পিঁপড়ের মতো উঠতে লাগল পিরামিডের গা বেয়ে।

ভার্নির মেয়ে বললে—এখানে কিন্তু কয়লা নেই মশিয়েঁ ভিনসেন্ট। কবে লোকে ঝাঁটিয়ে নিয়ে গেছে। কয়লা চান তো উঠতে হবে একেবারে মাথায়। আসুন আমার সঙ্গে।

কিশোরীটির পেছনে পেছনে প্রায় হাতে পায়ে হামাগুড়ি দিতে দিতে ঢালু বেয়ে উঠতে লাগল ভিনসেন্ট। পায়ের চাপে গুঁড়ো গুঁড়ো কয়লার ধুলো ঝরে পড়তে লাগল, পদে পদে ভয় করে, পিছলে পড়ে আর কী! অনেকটা এগিয়ে যায় মেয়েটি। উবু হয়ে বসে পেছন ফিরে ভিনসেন্টের গায়ে ধুলোর চাবড়া ছুঁড়ে মারে, ঠাট্টা করে বলে—আসুন না, নইলে একেবারে সকলের পেছনে পড়ে যাবেন যে!

এই কয়লাধুলোর পাহাড় খুঁড়ে কয়লা খুঁজে বার করা সোজা কাজ নয়। মেয়েটি ভিনসেন্টকে দেখিয়ে দিতে লাগল কেমন করে স্যাঁতসেঁতে চাবড়া খুঁড়ে খুঁড়ে আঙুলের ফাঁকে শুঁড়িয়ে ঝরিয়ে ফেলতে হয়, তার মধ্যে থেকে কয়লার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশ কেমন করে হাতের মুঠোয় ধরা পড়ে। তুষার জমে জমে মাটিটা শক্ত হয়ে আছে, সেগুলো খড়ে তুলে আঙুল দিয়ে গুঁড়োতে গুঁড়োতে ভিনসেন্টের হাত কেটেকুটে গেল, লাল হয়ে ফুলে উঠল আঙুল। মেয়েরা যতক্ষণে বস্তা প্রায় ভরে ফেলল, ততক্ষণে তার বস্তার সিকিটুকুও ভরতি হল না।

প্রত্যেকটি মেয়ে নিজের নিজের বস্তা স্কুলবাড়ির দরজায় নামিয়ে দিয়ে বাড়ি দৌড়োল। বিকেলের রান্নাবান্না এবার গিয়ে করতে হবে। সবাই প্রতিশ্রুতি দিল সন্ধে বেলা স্বামীদের নিয়ে আসবে প্রার্থনায় যোগ দিতে। ভার্নির মেয়ে ভিনসেন্টকে তাদের বাড়িতে খাবার জন্যে নিমন্ত্রণ করল। খুশি মনে ভিনসেন্ট সে-নিমন্ত্রণ নিল।

ভার্নির বাড়িতে দুটি ঘর। একটি ঘর রান্নার, খাবার, বসার, অপরটি শোবার রাস্তার ধারে একগামলা জল নিয়ে সে হাত মুখ ধুল। ভার্নির অবস্থা স্বচ্ছল হলেও তার বাড়িতেও সাবান পাওয়া অকল্পনীয়। যেদিন থেকে খনির কাজে বরেন-রা লাগে সেদিন থেকেই মুখে তাদের কালির দাগ। সারা জীবনে এ-দাগ একেবারে মোছে না, মোছবার কথা কেউ চিন্তাও করে না।

জ্যাকেস বললে—যাই বলুন মশিয়েঁ ভিনসেন্ট, ছ-মাস হয়ে গেল আপনি এখানে আছেন, কিন্তু আসল বরিনেজের সঙ্গে আপনার পরিচয়ই এখনও হয়নি। ভিনসেন্ট বললে—তা সত্যি। তবে আস্তে আস্তে হয়তো পরিচয় জমছে।

তা বলিনি। আমি কী বলছিলাম জানেন! আপনি শুধু আমাদের মাটির ওপরকার জীবনটাকেই দেখেছেন। মাটির ওপরে আমরা উঠি শুধু তো ঘুমোবার জন্যে। আমাদের আসল জীবনের পরিচয় পেতে চান তো আমাদের সঙ্গে একদিন খনির মধ্যে নামুন, যেখানে আমাদের সারাদিনের কাজ!

আমি তো উৎসুক, ভিনসেন্ট বললে—কোম্পানির কাছ থেকে অনুমতি পাব কি?

ঠোঁটের ফাঁকে একটু চিনি নিয়ে কেটলিটা তুলে হাঁ-এর মধ্যে খানিকটা কফি ঢেলে নিয়ে জ্যাকেস উত্তর দিল—সেজন্যে আপনার ভাবনা নেই। কালকে আমি পরিদর্শনের জন্যে মার্কাসে নামব। আপনি ভোর পৌনে তিনটে নাগাদ ডেনিসদের বাড়ির দোরগোড়ায় অপেক্ষা করবেন, আমি আপনাকে ডেকে নিয়ে যাব।

জ্যাকেসের সমস্ত পরিবার ভিনসেন্টের সঙ্গে উপাসনায় যাবার জন্যে পথে বার হল। বাড়ির গরম আবহাওয়ায় জ্যাকেস বেশ ছিল, এখন ক-পা যেতে-না-যেতেই এমন একটা সাংঘাতিক কাশির দমক এল যে আবার বাড়ি ফিরে গিয়ে কিছুটা বিশ্রাম না নিয়ে তার উপায় রইল না।

হেনরি ডিক্রুক তাদের অনেক আগেই পৌঁছে গেছে। মনোযোগ সহকারে অগ্নিকুণ্ডটা সে খোঁচাচ্ছে। খোঁড়া পা-টা টেনে টেনে দরজার কাছে এসে একগাল হেসে সে বললে—এই যে রাম উনুনটা দেখছেন, এটি আমি ছাড়া আর কেউ জ্বালাতে পারে না। অনেক কায়দা লাগে এটাকে জ্বালাতে।

গনগনে হয়ে আগুন জ্বলল, সারাঘরে জমল মধুর উত্তাপ। গ্রামের প্রত্যেকটি পরিবার দলে দলে এসে জুটল এই নতুন গির্জায় ভিনসেন্টের প্রথম ধর্মভাষণ শোনবার জন্যে। বেঞ্চি, চেয়ার, কাঠের বাক্স—সব এল। প্রায় তিনশো লোক, সারা হলঘরটা ভরতি। ভিনসেন্টের বুক ভরে উঠল আশ্বাসে, কৃতজ্ঞতায়। এই পুরোনো ভাঙা নিরাভরণ গৃহ, এই তার গির্জা। এইসব কালিমাখা পাণ্ডুর মুখ, এরাই তার আপনজন।

ভিনসেন্ট বললে—প্রবাদ আছে, উত্তম প্রবাদ, এই পৃথিবীতে আমরা পরবাসী। প্রবাসী পথিক, তবু একাকী নই—কেননা আমাদের পিতা সুদীর্ঘ কাল রয়েছেন আমাদের সঙ্গে। আমরা তীর্থযাত্রী—মর্ত থেকে স্বর্গ, জীবনের তীর্থপথ।

আনন্দের চেয়ে দুঃখ মহৎ—এমনকী কৌতুকের মধ্যেও বেদনা লুকিয়ে থাকে। তীর্থপথিক বিশ্রামের জন্যে যাবে কোন ঘরে—যে-ঘরে হাসি, না যে-ঘরে কান্না? দ্বিতীয় ঘরেই সে যেন যায়—কেননা অশ্রুজলেই মলিন হৃদয় পবিত্ৰ হয়।

দুঃখ কিন্তু অবিমিশ্র নয়। যিশুতে যে-ব্যক্তি বিশ্বাসী, তার দুঃখ আশার আভাতে উজ্জ্বল। দুঃখের পর সুখ যেন নব নব জন্ম—অন্ধকার থেকে আলোর অভিমুখে নব নব পথে যাত্রা।

হে পিতা, তোমার কাছে প্রার্থনা করি, অমঙ্গল থেকে আমাদের দূরে রাখো। দারিদ্র্য দিয়ো না, বিত্ত হতেও বঞ্চিত রাখো; যা প্রয়োজন সেই ক্ষুধার খাদ্য দিয়ে আমাদের আশীর্বাদ করো।

আমেন।

প্রার্থনার পর সবার আগে তার পাশে এসে দাঁড়াল ডিক্রুকের স্ত্রী। চোখের কোণে অশ্রু, কম্পিত ওষ্ঠপুট। বললে—মশিয়েঁ, জীবনে এত কষ্ট পেয়েছি যে ঈশ্বরকে ভুলে গিয়েছিলাম। আবার তাঁকে বুকের মধ্যে ফিরে পেলাম। আপনারই দয়ায়।

একে একে সবাই চলে গেল। উপাসনাগৃহের দরজায় তালা বন্ধ করে ভিনসেন্ট ভাবতে ভাবতে চলল ডেনিসদের বাড়ির দিকে। গ্রামবাসীদের কাছ থেকে আজ রাতে যত সাধুবাদ সে শুনেছে তাতে তার কোনো সন্দেহ নেই যে এদের সকলের আস্থা সে পেয়ে গিয়েছে। এইসব কালিমুখ দরিদ্র মানুষ সত্যিই তাকে ঈশ্বরের প্রতিভূ বলে–গ্রহণ করেছে। কী করে এতটা সম্ভব হল! উপাসনার জন্যে নতুন বাড়ি হয়েছে বলে? নতুন বাড়ি আর পুরোনো বাড়িতে শ্রমিকদের কী এসে যায়? সে প্রচারকের পাকাপাকি নিয়োগপত্র পেয়েছে বলে? না, এ-কথা সে তো কাউকে জানায়নি! নিয়োগপত্র যে তার এতদিন ছিল না তাও তো কেউ জানত না। আজকের ধর্মবাণী খুব হৃদয়গ্রাহী হয়েছে বলে? তাই-বা কী করে হয়? এর চাইতে অনেক ভালো কথা আরও অনেক ভালো করে আগেও তো সে এদের বলেছে আগেকার আস্তাবলের উপাসনাসভায়।

ডেনিসরা ঘুমিয়ে পড়েছে। রান্নাঘরের পাশের ইঁদারা থেকে বালতি করে জল তুলে একটা গামলাভরতি জল নিয়ে সে তার ঘরে গেল। দেয়ালের ধারে আরশিটা দাঁড় করিয়ে সাবান নিয়ে সে হাত মুখ ধুতে বসল। আরশিতে দেখে, তার মুখভরতি কালি। ভার্নির বাড়িতে মুখ ধুলেও মুখের কালি সম্পূর্ণ ওঠেনি। পুরু হয়ে জমে আছে চোখের পাতায়, নাকের পাশে, চিবুকের তলায়। কী কাণ্ড! এমনি মুখ নিয়ে সে ধর্মবক্তৃতা দিচ্ছিল? এ-মুখ যদি তার বাবা দেখত বা রেভারেন্ড স্ট্রিকার!

দু-হাতে সাবানের ফেনা ঘষে নিয়ে মুখে লাগাতে গিয়ে হঠাৎ সে থমকে দাঁড়াল। আবার তাকাল আরশিটার দিকে। হঠাৎ সে বুঝতে পারল।

কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে অস্ফুট গলায় সে বললে—বুঝেছি, কেন ওরা আজ আমাকে ওদের আপন করে নিয়েছে। আমি যে আজ ওদেরই সমান হয়েছি, ওদেরই মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছি!

রাত আড়াইটে নাগাদ ভিনসেন্ট ঘুম থেকে উঠল। ডেনিসদের রান্নাঘর থেকে একটুকরো রুটি চিবিয়ে নিয়ে ঠিক পৌনে তিনটের সময় দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। জ্যাকেসও এসে পৌঁছোল ঠিক সময়েই। রাত্রে ভয়ানক তুষারপাত হয়ে গেছে, মার্কাস যাবার রাস্তাটা একেবারে ঢেকে গেছে বরফে। বরফের ওপর দিয়ে এ-ধার ও-ধার থেকে তাদেরই মতো আরও অনেক লোক ছুটে ছুটে আসছে, চলেছে খনির দিকে। ঠান্ডায় তাদের শরীর বেঁকে গেছে, পাতলা কোটের ফাঁকে মুখের থুতনি পর্যন্ত ঢেকে কুঁজো হয়ে চলেছে কালো কালো মানুষগুলো।

খনির কারখানায় প্রথম যে-ঘরটায় তারা ঢুকল তার দেয়ালে দেয়ালে কেরাসিনের আলো ঝোলানো। প্রত্যেকটি আলোর নীচে দেয়ালে এক-একটি সংখ্যা লেখা। শ্রমিকরা ঘরে ঢুকেই এক-একটি করে আলো হাতে নিচ্ছে। জ্যাকেস বললে—যখন কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, তখন কোন কোন নম্বরের আলো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না দেখেই আমরা ধরতে পারি, কোন কোন লোক খনির মধ্যে আটকা পড়ে আছে।

শ্রমিকদের পেছনে পেছনে তুষার-ছাওয়া উঠোন পার হয়ে দুজনে ঢুকল একটা চৌকো পাকাবাড়ির মধ্যে। সেখানে ক্রেন ঘুরছে, খাঁচায় করে লোক নামছে খনির মধ্যে। খাঁচাটার ছ-টা ভাগ, একের নীচে আরেকটা করে। প্রত্যেকটার মধ্যে একটা করে কয়লাগাড়ি বসানো যায়। প্রত্যেকটায় দুজন করে মানুষ ভালোভাবে বসতে পারে, কিন্তু আসলে পাঁচ জন করে গাদাগাদি। যেন তারা কয়লারই বস্তা।

ফোরম্যান বলে জ্যাকেসের কামরাটায় ভিড় বেশি হল না। সে, তার একজন সহকারী আর ভিনসেন্ট। উঁচু হয়ে তারা বসল, মাথা ঠেকতে লাগল লোহার জালের ছাদে।

জ্যাকেস সাবধান করে দিল—হাত দুটো সামনের দিকে রাখুন মশিয়েঁ ভিনসেন্ট। যদি একবার পাশের দেয়ালে লাগে তাহলে হাত আর খুঁজে পাবেন না। সংকেতের সঙ্গে সঙ্গে খাঁচা নামতে লাগল অন্ধকার গহ্বরে। অনভ্যস্ত ভিনসেন্টের বুক শুকিয়ে এল ভয়ে। একটু দুর্ঘটনা যদি ঘটে তাহলে নির্ঘাত পাতালসমাধি। চারদিকে মিশকালো অন্ধকার, তার মধ্যে শুধু মিটমিট করে জ্বলছে হাতের লন্ঠনগুলো।

জ্যাকেস বললে—ভয় করছে? এতে লজ্জার কিছু নেই। কয়লাখনির প্রত্যেকটি লোকেরই এমনি ভয় করে।

ভিনসেন্ট বললে—আপনাদের. তবু অভ্যেস আছে তো।

অভ্যেস? জ্যাকেস উত্তর দিলে—অভ্যেসে কী করে? খাঁচা ভেঙে পড়ে মরবার ভয় অভ্যেসে ঘোচে না। এ-ভয় মৃত্যুদিন পর্যন্ত আমাদের প্রতিদিনের নিত্যসাথি। গত তেত্রিশ বছর ধরে আমি এমন খনিতে নামছি। আমারও বুক কাঁপছে ঠিক আপনারই মতো।

খনিকূপের ঠিক আধাআধি পৌঁছোনো যায় তিনশো পঞ্চাশ মিটার নামলে। ততদূর নেমে খাঁচাটা একটু থামল, তারপর আবার নামতে শুরু করল। ভিনসেন্ট দেখল, চারপাশের ঝাপসা দেয়াল দিয়ে জল চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে। ওপর দিকে তাকিয়ে দেখল ছোট্ট গোল একটা তারার মতো দেখাচ্ছে আকাশটা। আবার তার বুক কেঁপে উঠল। ছশো পঞ্চাশ মিটার নামবার পর খাঁচাটা আবার থামল। তারা তিনজন কামরা থেকে বার হবার পর অন্য শ্রমিকদের নিয়ে খাঁচাটা আরও গভীরে নেমে গেল। ভিনসেন্ট দেখল তার চারপাশে অনেকগুলো চওড়া চওড়া সুড়ঙ্গ। জায়গাটা বেশ শীতল।

সে বললে—মশিয়েঁ ভার্নি, খুব কষ্টকর বলে তো জায়গাটা মনে হচ্ছে না।

ভার্নি হেসে উত্তর দিলে—ঠিক বলেছেন। এখানে কিন্তু কেউ কাজ করছে না।

এই স্তরের সব কয়লা উঠে গেছে। এখানে হাওয়াও পাচ্ছেন মন্দ নয়, কিন্তু যেখানে আসল কাজ হচ্ছে সেখানে চলুন, তখন বুঝবেন।

সুড়ঙ্গ বেয়ে প্রায় সিকি মাইলটাক হাঁটবার পর ভার্নি বললে—আসুন মশিয়েঁ ভিনসেন্ট। কিন্তু খুব সাবধান, পা যদি ফসকান, দুজনেই মরব কিন্তু একসঙ্গে।

সামনে একটা অন্ধ গহ্বর, যার মধ্যে কোনো রকমে একটা রোগা মানুষ খাড়া দাঁড়িয়ে ডুবতে পারে। গহ্বরটার গায়ে লাগানো দড়ির একটা সিঁড়ি। দেয়াল বেয়ে বেয়ে সমানে ঝিরঝির করে জল গায়ে ঝরে পড়ছে। দড়ির পাদানগুলো চটচটে শ্যাওলায় পিচ্ছিল। গহ্বর যেখানে শেষ হল সেখান থেকে আবার সুড়ঙ্গ। এ-সুড়ঙ্গের মধ্যে মাথা উঁচু করে যাওয়া যায় না। মাটির কাছে নাক নামিয়ে ঘাড় গুঁজে হামাগুড়ি দিয়ে এগোতে হল। এ-পাশে ও-পাশে ছোটো ছোটো খুপরি। খুপরির ছাদগুলো কাঠের গোঁজ দিয়ে তুলে ধরা। প্রত্যেকটি খুপরিতে পাঁচজন করে শ্রমিক। দুজন কয়লা খুঁড়ছে গাঁইতি দিয়ে, একজন সেগুলো পেছন দিকে সরাচ্ছে, একজন কোদাল দিয়ে সেগুলো তুলছে ছোটো ছোটো গাড়ির মধ্যে আর বাকি একজন গাড়ি ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে খুপরির বাইরে। দলে তিনজন ছেঁড়া মোটা কালো প্যান্ট পরা সমর্থ পুরুষ, একটি নেংটি-মাত্র পরা নগ্ন বালক, আর একজন মেয়ে।

গাড়ি ঠেলার কাজ মেয়েটার, পুরুষদের পোশাকের সঙ্গে কোনো প্রভেদ নেই, তবে কিনা ঊর্ধ্বাঙ্গ-ঢাকা কালো মোটা একটা জামা।

খুপরির কাছ থেকে সর্বদা জল ঝরছে। নীরন্ধ্র কালো, আলো শুধু বাতি–কমানো নিবুনিবু লন্ঠনগুলির। বাতাস আসার কোনো পথ নেই কোথাও, যেটুকু বাতাস খোপরে খোপরে জমা আছে, তার সঙ্গে জমাট বেঁধে আছে কয়লার কালো গুঁড়ো। অসঃ গরম, শ্রমিকদের সারাশরীর ঘামে স্নান করা। ভিনসেন্ট দেখল, প্রথম কটি খুপরিতে শ্রমিকরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাজ করছে, কিন্তু সুড়ঙ্গ দিয়ে যত এগোয় খুপরিগুলোও ততই নীচু হয়ে আসে। শেষ পর্যন্ত মাটি আর ছাদের পার্থক্য ঘুচে যায়, শ্রমিকরা কাজ করে উপুড় হয়ে শুয়ে। গায়ে ফোসকা পড়ার মতো গরম, ঘাম ঝরছে ঝরঝর করে, প্রতিটি দমের সঙ্গে নাক মুখ থেকে বার হচ্ছে কালো ধুলো, প্রতিবারের কাশির সঙ্গে গলা থেকে নির্গত হচ্ছে তরল কালো ঝুল।

জ্যাকেস বললে—এরা দিনে কত করে পায় জানেন? আড়াই ফ্র্যাঙ্ক, তাও যদি ইনস্পেকটর এদের তোলা কয়লা পরীক্ষা করে ভালো বলে তবে। আগে আরও আধ ফ্র্যাঙ্ক বেশি পেত, সম্প্রতি মজুরি কমেছে।

একটা খুপরির মধ্যে ঢুকে জ্যাকেস ছাদের সঙ্গে ঠেকানো কাঠের খুঁটিগুলো পরীক্ষা করে দেখল। শ্রমিকদের দিকে ফিরে সে বললে—এ-কাঠগুলো তো সব একেবারে পচে গেছে দেখছি। একটা যদি ভাঙে তো সারা ছাদটাই মাথার ওপর ভেঙে পড়বে। জ্যান্ত কবরে ঢোকার শখ হয়েছে নাকি তোমাদের?

গাঁইতি হাতে একটা শ্রমিক, এদের দলপতি, কুৎসিত ভাষায় সে গালাগাল দিয়ে উঠল। তারপর বললে—কাঠগুলো বদলাবার পয়সা দেয় কোম্পানি? আর কাঠ বদলাতেই যদি সময় যায়, কয়লা তুলব কখন? এক গাড়ি কম উঠলে মজুরি কাটবে না? এ-দিকে ছাদ চাপা পড়ে মরা আর ও-দিকে না খেয়ে মরা—এ আমাদের দুই-ই সমান।

শেষ খুপরিটার পরে মাটিতে অপর একটা গহ্বর। এর গায়ে একটা দড়ির সিঁড়ি পর্যন্ত নেই। গহ্বরের দেয়ালের মাঝে মাঝে কেবল কয়েকটা কাঠের গোঁজ পোতা আছে। ভিনসেন্টের হাতের লন্ঠনটা নিয়ে জ্যাকেস সেটা তার কোমরের সঙ্গে বেঁধে নিলে। হাত বাড়িয়ে বললে—আসুন এটার মধ্যে নামি। আমার পেছনে পেছনে নামুন। কিন্তু খবরদার, আমার মাথায় যেন পা ফেলবেন না। তাহলে আর রক্ষা থাকবে না।

এক-একটা গোঁজের ওপর পা ফেলে ফেলে দু-হাতে দেয়ালের পাথর চেপে ধরে ধরে ভিনসেন্ট নামল খনির নিম্নতর স্তরে। এখানে কোনো খুপরির সাক্ষাৎও নেই। শুধুমাত্র অন্ধ সুড়ঙ্গ। সুড়ঙ্গের মধ্যে কোনো রকমে শরীরটা ঢুকিয়ে দেয়ালে ঘা মেরে মেরে কয়লা কেটে চলেছে শ্রমিকের দল। বাতাস এখানে পথ ভুলেছে, গরম এখানে শানিত অস্ত্রের মতো। কালো কালো উলঙ্গ প্রেতমূর্তিরা অবিশ্রাম কাজ করে চলেছে, চোখ তাদের ঠিকরে বার হয়ে আসছে, শুকনো জিভ হাঁ থেকে বার হয়ে রয়েছে, ঠোটের কোণে কোণে পাংশু রঙের গাঁজলা। বিশ্রাম নেই মুহূর্তের, কয়লা যদি একগাড়ি কম ওঠে তাহলে বরবাদ হবে মজুরি।

সুড়ঙ্গের মধ্যে হামাগুড়ি দিয়ে এগোতে লাগল দুজনে। এরই মধ্যে কয়লাগাড়ি চলেছে, এক-একটা গাড়ি যখন যায়, তখন তাকে রাস্তা’ দেবার জন্যে দেয়ালের ধারে পাশ ফিরে শুয়ে পড়তে হয়। গাড়িগুলো ঠেলছে অর্ধউলঙ্গ মেয়েরা, তাদের কারও বয়েস দশ বছরের বেশি নয়। শীর্ণ কালো কালো টিকটিকির মতো তারা ঘাড় মাথা গুঁজড়ে লেপটে আছে গাড়িগুলোর পেছনে, ঠেলছে আপ্রাণ শক্তি দিয়ে।

এই সুড়ঙ্গটি যেখানে শেষ হল সেখান থেকে শুরু হল একটা ধাতব গহ্বর। গোল একটা চোঙা যেন ঢালু হয়ে নেমে গেছে, নীচে, আরও নীচে। ছোটো ছোটো কয়লাগাড়ি লোহার দড়ি বাঁধা অবস্থায় এই চোঙার মধ্যে নামছে, চোঙা থেকে উঠছে।

জ্যাকেস বললে—চলুন মশিয়েঁ ভিনসেন্ট, এবার আমরা নামব সবচাইতে গভীর স্তরে, সবসুদ্ধ সাতশো পঞ্চাশ মিটার মাটির নীচে। এমন জিনিস সারা পৃথিবীতে আর কোথাও দেখতে পাবেন না।

ধাতব চোঙার ওপর বসে বসে প্রায় ত্রিশ মিটার নামবার পর তারা পৌঁছোল বেশ চওড়া একটা সুড়ঙ্গের মুখে। সুড়ঙ্গটা দু-দিকে চলে গেছে। একটা পথ ধরে .. প্রায় আধমাইল হাঁটার পর হঠাৎ সুড়ঙ্গটা শেষ হয়ে গেল একটা দেয়ালের সামনে। দেয়ালের মাঝখানে বড়ো একটা ফুটো। সেই ফুটোর মধ্যে দিয়ে দেয়ালের ও-পারে পৌঁছোতেই পাওয়া গেল একটা গহ্বর। সেই গহ্বর গিয়ে পড়েছে এই খনির নিম্নতম স্তরের ঠিক গায়ের ওপর। সেখানে আবার সদ্য-তৈরি-করা কয়েকটা সরু সরু সুড়ঙ্গ। সুড়ঙ্গগুলির মধ্যে একটা মানুষের কাঁধ কোনো রকমে গলতে পারে। উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে সাপের মতো বুকে ভর দিয়ে জ্যাকেস ঢুকল একটা গর্তের মধ্যে। ভিনসেন্ট ঢুকল তার পেছনে। সুড়ঙ্গটা চওড়ায় আড়াই ফুট, ফুট দেড়েক খাড়াই। ঠিক যেন কোনো সরীসৃপের গর্ত। অন্ধকারে সরীসৃপেরই মতো তারা এগোতে লাগল। কাঁধ দুটো ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেল ভিনসেন্টের। সে-যন্ত্রণা টের পাবার অবস্থাও তখন তার নেই।

এই ভয়াল সুড়ঙ্গের শেষে ছোট্ট একটি গহ্বর। কোনো রকমে মানুষ এখানে দাঁড়াতে পারে। দেয়ালে দেয়ালে কয়েকটা নীলাভ আলোকবিন্দু। ভিনসেন্ট তখন প্রায় অন্ধ হয়ে গেছে। কালো ঝুলে আর ঘামে তার চোখের পাতা ঢেকে গেছে, জিভ বেরিয়ে এসেছে, দাঁড়াবার শক্তি নেই, মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে হাঁপাচ্ছে

মার-খাওয়া জন্তুর মতো। একবিন্দু বাতাস, একটু স্বাভাবিক নিশ্বাসের জন্যে খাবি খাচ্ছে প্রাণ। জ্যাকেস তাকে উঁচু করে তুলে বসিয়ে দিল। সে নিশ্বাস নিল, সঙ্গে সঙ্গে যেন তরল আগুন বুকের মধ্যে ঢুকে হাড়-পাঁজর পর্যন্ত জ্বালিয়ে দিল, শুকনো জিভ বার করে খকখক করে কাশতে লাগল সে, কোটর থেকে ঠিকরে বার হতে চায় শুকনো সাদা সাদা চোখ দুটো।

একটা চেনা গলা এল কানে—আরে আরে মশিয়েঁ ভিনসেন্ট, আপনাকে এখানে এনেছে! দেখতে এসেছেন আমাদের পঞ্চাশ সেন্টের রোজ-মজুরি কেমন করে আমরা রোজগার করি?

জ্যাকেস তাড়াতাড়ি গিয়ে আলোগুলো পরীক্ষা করল। সাদা আলোকে খেয়ে ফেলেছে নীলাভ আভায়।

ডিক্রুক ভিনসেন্টের কানে কানে বললে—এখানে ওর আসা মোটেই উচিত হয়নি। টানেলের মধ্যে একবার যদি কাশতে কাশতে রক্তবমি করতে শুরু করে, তখন আর ওকে দড়ি বেঁধে টেনে তোলা ছাড়া উপায় থাকবে না।

জ্যাসেক হাঁক দিলে—ডিক্রুক, আলোগুলো সকাল থেকে এমনিভাবে জ্বলছে? ডিব্ৰুক বললে—হ্যাঁ তা জ্বলছে বই কী। গ্যাসের কথা বলছ তো? ঠিক, তাও জমছে প্রচুর। ফাটবে একদিন, আমাদের ভবযন্ত্রণাও সেদিন ঘুচবে।

গত রবিবার পাম্প হয়নি?

হয়েছে বই কী। দাঁত বার করে ডিক্রুক উত্তর দিলে—তাতেই-বা কী? জমছে আবার, মিনিটে মিনিটে জমছে।

কাজ বন্ধ রাখো কাল। আবার পাম্প করতে হবে।

হইহই করে প্রতিবাদ করে উঠল শ্রমিকরা। বললে—ইয়ার্কি? ঘরে একটুকরো রুটি নেই, একদিন কাজ বন্ধ? মরব নাকি শুকিয়ে? চালাকি পায়া হ্যায়?

হো-হো করে হেসে উঠল ডিক্রুক—আরে ভায়া ঘাবড়িয়ো না। তোমার খনি আমাকে মারতে পারবে না। কত চেষ্টা করেছে আজ পর্যন্ত, পেরেছে? আমি ঠিক বুড়ো হয়ে বিছানায় শুয়ে মরব, দেখো। ভালো, খাবার কথা মনে পড়িয়ে দিলে। কটা বাজল হে ভার্নি?

নীল শিখার কাছে ঘড়িটা ধরে ভার্নি বললে—ন-টা।

ঠিক আছে। কাজ বন্ধ করো, খানা শুরু করো ভাইসব!

বীভৎসদর্শন কৃষ্ণ প্রেতের দল কাজ বন্ধ করে দেয়ালের ধারে ধারে ঠেসান দিয়ে উঁচু হয়ে বসল। দূরে যাবার উপায় নেই। হাতে পনেরো মিনিট মাত্র সময়। ঝুলি থেকে প্রত্যেকে বার করল দু-টুকরো করে কালো শুকনো রুটি আর খানিকটা করে পচা পনির। খিদের জ্বালায় হাউহাউ করে তা-ই তারা খেতে লাগল সাগ্রহে, হাতের কালি ঝুলে খাবারে মাখামাখি হয়ে যেতে লাগল। রুটি চিবোবার পর গলা ভিজোবার জন্যে এক বোতল করে কালো কফি। এই কফি আর রুটি আর দুর্গন্ধ পনির, এরই জন্যে এরা দিনে তেরো ঘণ্টা করে এই পাতালদুর্গে খেটে মরে।

ভিনসেন্টের প্রায় ছ-ঘণ্টা কেটেছে। গরমে, পরিশ্রমে রুদ্ধশ্বাস আবহাওয়ায় তার গা-বমি-বমি করছে, ঝিমঝিম করছে মাথা। ভয় করছে কখন বুঝি মূর্ছিত হয়ে পড়ে। এ-যন্ত্রণা আর বেশিক্ষণ সে সইতে পারবে না। জ্যাকেস যখন ফেরবার কথা বললে, তখন যেন সে বাঁচল।

যাবার আগে জ্যাকেস বললে—সাবধান ডিক্রুক, যেমন গ্যাস জমছে, কখন ফাটবে বলা যায় না। তুমি বরং কাজ বন্ধ রাখো একদিন।

কঠোর হাসি হাসল ডিক্রুক, বললে—দেবে একদিনের মজুরি? কোনো শৰ্মা দেবে?

আরও প্রায় আধঘণ্টা হাঁটার পর তারা একটা ক্রেনের নীচে পৌঁছোল। এখান থেকে সোজা কয়লা উঠে যায়। মানুষও ওঠে।

কুয়ার মধ্যে থেকে বালতি যেমন ওঠে, তেমনিভাবে ওপরে উঠতে উঠতে ভিনসেন্ট বললে—বন্ধু, একটা কথা জিজ্ঞাসা করব? এরা কেন এ কাজ করে? এমনি খনির কাজ ছাড়া কি আর কাজ নেই? এরা পালাতে পারে না অন্য কোথাও অন্য কোনো কাজে?

না মশিয়েঁ ভিনসেন্ট, কোনো কাজ নেই এখানে এ ছাড়া। এখান থেকে অন্যত্র পালাবেই-বা কী করে, পয়সা কোথায়? সারা বরিনেজে এমন একটা শ্রমিক পরিবার নেই, মাত্র দশটা ফ্র্যাঙ্ক যার জমা আছে। আর যদি-বা কেউ পালাতে পারে, তবু সত্যি-সত্যি এখান থেকে নড়তে সে পারে না। খনি, আমাদের অস্থিমজ্জায় মিশে আছে। একে আমরা ভালোবাসি নেশার মতো, মাটির তলার অন্ধকারের নেশা। বিনিময়ে কী পাই বলুন? শুধু বাঁচবার মতো মজুরি, আর বিপদ থেকে রক্ষার মোটামুটি ব্যবস্থা। তার বেশি নয়।

ক্রেন গিয়ে পৌঁছোল মাটির ওপরে। হাত ধোয়ার ঘরে আরশিতে ভিনসেন্ট দেখল তার সারামুখ, সর্বশরীর কুচকুচে কালো। হাত মুখ ধোয়ার ধৈর্য আর সইল না। কোনো রকমে টলতে টলতে ফাঁকা মাঠে পৌঁছে মাটিতে বসে পড়ে সে হাঁপাতে লাগল। ঈশ্বরের পৃথিবীতে এমনিভাবেও মানুষকে দিন-গুজরান করতে হয়? নাকি, তার এতক্ষণের অভিজ্ঞতা শুধু দুঃসহ দুঃস্বপ্ন?

ডেনিসদের বাড়ি যে-রাস্তায় সেখানে মোটামুটি মধ্যবিত্ত লোকদের বাস। সে-রাস্তা ছেড়ে সে চলল চড়াইয়ের অলিগলির মধ্যে দিয়ে ডিক্রুকের কুটিরের অভিমুখে। দরজায় ধাক্কা দিতে বার হয়ে এল ডিক্রুকের ছেলে। ছ-বছরের বাচ্চা, অস্থিসার দেহ, তবু বাপেরই মতো জ্বালা-ধরা চোখ। আর দু-বছর যাবে না, তার মধ্যেই এও আবার খনিতে নামবে।

রিনরিনে গলায় ছেলেটি বললে—মা কয়লা কুড়োতে গেছে মশিয়েঁ, আর আমি বাচ্চাদের দেখছি। আপনি একটু বসুন।

মেঝের ওপর উলঙ্গ দুটি শিশু কাঠকুটো নিয়ে খেলছে। ঠান্ডায় নীল হয়ে গেছে তাদের দেহ। বড়ো ছেলেটি উনুনে কয়লার ধুলো ফেলছে, যৎসামান্য। ভিনসেন্ট তাড়াতাড়ি ছেলে দুটোকে বিছানায় শুইয়ে দিল। ছেঁড়া কাঁথা দিয়ে তাদের ঢেকে দিল। এই দুরন্ত দুর্গতির পরিবেশে কেন সে পায়ে পায়ে হেঁটে এল তা সে জানে না। সে শুধু কোনো রকমে তাদের বোঝাতে চায় যে, তাদের সে সমব্যথী।

হাতে মুখে কালিঝুলি মেখে ডিক্রুকের স্ত্রী ঘরে ফিরল। ভিনসেন্টের কালিমাখা মূর্তি দেখে প্রথমে সে তাকে চিনতেই পারল না। তারপর দৌড়ে দেয়ালের কাঠের বাক্স থেকে একটু কফি নিয়ে আধোগরম জলে তা গুলে নিয়ে তাকে পরিবেশন করল। কালিমাখা ভিনসেন্ট দু-হাত বাড়িয়ে নোংরা ঠান্ডা কফির পাত্রটা নিল।

মেয়েটি বললে—ধুলো ঘেঁটে ঘেঁটে কয়লা আজকাল একদানাও মেলে না, জানেন মশিয়েঁ ভিনসেন্ট? কোম্পানি যা কেপ্পন হয়েছে বলবার নয়। বাচ্চাগুলোকে কেমন করে গরম রাখি বলুন তো? সম্বল তো এই চট, চট গায়ে দিয়ে দিয়ে বাচ্চাগুলোর বুকে পিঠে ফোসকা পড়ে গেল। সারাদিন যদি বিছানাতেই শুইয়ে রাখি, তাহলে ওরা বাড়বেই-বা কী করে?

উদ্‌গত অশ্রুকে প্রাণপণে গোপন করে রাখল ভিনসেন্ট, নির্বাক হয়ে রইল সে। এমনি দুর্দশার দৃশ্য কখনও সে চোখে দেখেনি আগে। আজ এই প্রথম তার মনে সংশয় জাগল, এই নারী তার সন্তানকে বুকে নিয়ে যদি শীতে জমে মারা যায়, ধর্মবাণী প্রচারের তাহলে আর কী মূল্য? ঈশ্বরের দৃষ্টি কি এদের ওপর পড়ে না?

পকেটে যে কটা টাকা ছিল, সব সে তুলে দিল ডিক্রুকের স্ত্রীর হাতে। বললে—ওদের কয়েকটা পশমের ড্রয়ার কিনে দিয়ো।

অর্থহীন—এমনি হৃদয়াবেগের কোনো মানে হয় না। সে জানে সারা বরিনেজে শত শত শিশু এমনি শীতে কুঁকড়ে যাচ্ছে, তার প্রতিবিধান নেই। ড্রয়ার কটা ছিঁড়লে ডিক্রুকের বাচ্চারা আবার শীতে কাঁপবে।

.

ফিরে গেল সে ডেনিসদের বাড়ি। রান্নাঘরটি জুড়ে মধুর আরামদায়ক উষ্ণতা। মাদাম ডেনিস তাড়াতাড়ি জল গরম করে দিলেন হাত-মুখ ধুয়ে নেবার জন্যে, টেবিল সাজিয়ে খেতে দিলেন খরগোশের মাংসের গরম ঝোল। দেখলেন লোকটা বড়ো ক্লান্ত হয়ে ফিরেছে, তাই রুটিতে মাখন মাখিয়ে দিলেন অনেকটা বেশি করে।

দোতলায় নিজের ঘরে গেল ভিনসেন্ট। উৎকৃষ্ট খাদ্যে উদরপূর্তির আরাম, আরাম খাটজোড়া নরম বিছানায়। দেয়ালে দেয়ালে নামকরা শিল্পীদের আঁকা ছবির প্রিন্ট। দেয়ালের সঙ্গে লাগানো ঝকঝকে আলমারিটা ভিনসেন্ট খুলল, প্যান্ট কোট শার্ট আন্ডারঅয়্যার সব সারে সারে সাজানো রয়েছে। আলনাতেও পোশাক ঝুলছে, এমনকী একটা গরম-ওভারকোট পর্যন্ত। নীচের তাকে পাশাপাশি সাজানো রয়েছে অতিরিক্ত দু-জোড়া জুতো। মিথ্যা কথা সে বলে এসেছে এতদিন, যে-মিথ্যা নিতান্ত কাপুরুষের শোভা পায়। খনির এই শ্রমিকদের কাছে সে প্রচার করেছে দারিদ্র্যের ধর্ম, বলেছে—দারিদ্র্যকে ভূষণ করো, আর নিজে থেকেছে তোফা আরামের আতিশয্যে। নিষ্প্রাণ অর্থহীন ফাঁকা বুলি আওড়ানো, এই বুঝি তার পেশা? ক্লীব পলায়নী প্রবৃত্তি, এই বুঝি তার ধর্ম?

শ্রমিকরা এতদিন তাকে সহ্য করেছে কী করে! দুরদুর করে তাড়িয়ে দেয়নি কেন বরিনেজ থেকে? সে বসে নেই, বেকার নয়, এই মিথ্যা আত্মপ্রসাদে সে ফুলে আছে, আসলে কাজ তার ফাঁকি, শুধু ভালো ভালো জামাকাপড় পরা, শ্রমিকরা সাত দিনে যা খেতে পায় না এক বেলায় তা উদরস্থ করা, নরম বিছানায় আয়েশ করে ঘুমোনো, আর মাঝে মাঝে ভালোমানুষের মুখোশ পরে লোকের মধ্যে দাঁড়িয়ে ধর্মের ফুটো ঢাক বাজানো! এই তার সাফল্য? এই কি তার জীবনের সার্থকতা? এই নাকি তার ব্রত উদযাপন? ছি ছি ছি!

আলমারি থেকে সমস্ত জামাকাপড় নিয়ে সে ব্যাগের মধ্যে পুরল। আলনার জামা জুতো, টেবিলের বইপত্র, দেয়ালের ছবি, সব সে জড়ো করে বান্ডিল বাঁধল। তারপর দৌড়ে বার হয়ে গেল বাড়ির বাইরে।

উতরাইয়ের ধারে ছোট্ট একটা পচা নালা। তার পরে আবার একটা খাড়াই, মাঝখানে পাইন বন। বনের মধ্যে মধ্যে কয়েকটা শ্রমিক-কুটির। খানিকটা খোঁজ করে ভিনসেন্ট একটা খালি কুটির পেল। জরাজীর্ণ কাঠের বাড়ি, ঝরঝরে কড়িগুলোর ওপর কোনোরকমে ছাদটা ঝুলে আছে, দেয়ালের তক্তাগুলো এখানে ওখানে হাঁ হয়ে আছে। মেঝে বলতে কাঁচা মাটি, ভাঙা দরজা, জানলার কোনো বালাই নেই।

যে-স্ত্রীলোকটি ঘরটার খোঁজ দিয়ে তাকে দেখাতে নিয়ে এসেছিল সঙ্গে করে, ভিনসেন্ট তাকে শুধোলে—মালিক কে এটার?

ওয়ামসের একজন ব্যাবসাদার।

ভাড়া কত জান?

মাসে পাঁচ ফ্র্যাঙ্ক।

ঠিক আছে। এ-ঘরটা আমি নেব।

কিন্তু মশিয়েঁ ভিনসেন্ট, এখানে তো আপনি থাকতে পারবেন না!

কেন পারব না?

মানে, মানে—এ যে একেবারে যাচ্ছেতাই ঘর! সারা তল্লাটে এমনি ভাঙা ঘর আর দুটি নেই। এ-ঘর কি কেউ নেয়?

ঠিক বলেছ। এমনি ঘরই আমার পছন্দ। এ-ঘর আমার।

ভিনসেন্ট ফিরে গেল ডেনিসদের বাড়ি মনে অনেকটা শান্তি নিয়ে। মাদাম ডেনিস শুধোলেন—এ কী মশিয়েঁ ভিনসেন্ট, জিনিসপত্র বাঁধা! ফিরে যাচ্ছেন নাকি হল্যান্ডে? হঠাৎ কোনো দুঃসংবাদ এল নাকি?

না মাদাম, আমি চলে যাচ্ছিনে। বরিনেজেই আমি থাকব।

সব কথা শুনে মাদাম ডেনিস মৃদু গলায় বললেন—আমার কথা বিশ্বাস করুন মশিয়েঁ ভিনসেন্ট, ওভাবে আপনি থাকতে পারবেন না। যা অভ্যেস নেই তা করতে যাবেন না। যিশুখ্রিস্টের যুগ তো এখন সত্যি-সত্যি আর নয়, এখন যে যতটা ভালোভাবে থাকতে পারে, তা-ই থাকাই উচিত। বরিনেজের লোক সবাই আপনাকে বিশ্বাস করে, এমনিতেই তারা জানে আপনার মধ্যে কোনো মিথ্যে নেই।

ভিনসেন্ট মত বদলাল না। ওয়ামসের ব্যাবসাদারটির সঙ্গে দেখা করে ওই জীর্ণ গৃহই সে ভাড়া নিল, ডেনিসদের বাড়ি ছেড়ে উঠে গেল সেখানে। ক-দিন পরে প্রথম মাসের মাহিনা পঞ্চাশ ফ্র্যাঙ্ক যখন এল, সে একটা চৌকি আর একটা পুরোনো স্টোভ কিনল। হাতে রাখল খালি সারা মাসের শুকনো রুটি পচা পনির আর কফি কেনবার মতো কিছু টাকা। কাদামাটি গুলে তা-ই দিয়ে সে বাইরের দেয়ালের ফুটোগুলো পুরোনো চট দিয়ে ঢাকল। এইবার সে ওদের সমান হয়েছে, সমান দুঃখ সুখ, সমান জীবনযাত্রা। ওদের কানে ঈশ্বরের বাণী শোনাবার অধিকার এবার সে অর্জন করেছে।

সে-বছরের মতো দুরন্ত শীত আর কখনও পড়েনি। অস্ত্রের মতো তীক্ষ্ণ বাতাস পাহাড়ের মাথায় মাথায় আর সারা প্রান্তর জুড়ে হু-হু করে বয়ে যায়, পথে বার হওয়া দুষ্কর। কয়লাগুঁড়োর পাহাড় খুঁড়ে খুঁড়ে কয়লাদানা সংগ্রহ করাই সবচেয়ে প্রয়োজন এখন, কিন্তু বাইরে বার হলে মেয়েগুলোর হাড়সুদ্ধ জমে যায়। তাদের পিঠে একটুকরো গরম পোশাক কোথায়?

দিনের’-পর দিন বস্তা-চাপা হয়ে শিশুরা বিছানার মধ্যে কুঁকড়ে পড়ে থাকে, সিটিয়ে যায় তাদের ছোটো ছোটো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। সারাদিন অগ্নিগর্ভে কাটাবার পর দিনান্তে শ্রমিকরা উঠে আসে তুহিনশীতল মাটির বুকে, শীত ঝটিকার ঝাপট খেতে খেতে অবসন্ন পশুর মতো ঘরে যায়। সারাদিন তারা কয়লা তোলে, ঘরে কিন্তু কয়লা নেই, আগুন নেই, নেই একফোঁটা গরম জল বা একমুঠো গরম খাবার। প্রতি সপ্তাহে কোনো-না-কোনো লোক হয় যক্ষ্মায় নয়তো মিউমোনিয়াতে মরে, ভিনসেন্টের কাজ বাড়ে, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার কাজ।

ছেলেদের পড়াশুনো করানো ভিনসেন্ট বন্ধ করেছে। এখন সে সারাদিন হাড়ে পাহাড়ে কয়লা কুড়িয়ে বেড়ায়, যেটুকু কয়লা পায় সন্ধ্যা বেলা বিলিয়ে দেয় এ-বাড়ি ও-বাড়ি। মুখে হাতে সারাশরীরে কয়লার কালি এখন তার নিত্য ভূষণ। অপরিচিতের চোখে তার আর খনিমজুরের মধ্যে কোনো প্রভেদ নেই।

একদিন এমনি কয়লা কুড়োবার পর অপরাহ্ণে সে ফিরে আসছে পিঠে বস্তা নিয়ে, এমন সময় মার্কাসে ছুটির বাঁশি বাজল। শ্রমিকের দল গেট থেকে বার হয়ে বাড়ি ফিরতে লাগল তার সামনে দিয়ে। ঘাড় তাদের হেঁট, দৃষ্টি নীচের দিকে, ক্লান্তিভারে আচ্ছন্ন চলৎশক্তি। কয়েক জন তাকে চিনতে পেরে মাথা হেলিয়ে অভিবাদন করে গেল।

মার্কাসের গেট থেকে সবশেষে বেরিয়ে এল একজন জীর্ণশীর্ণ অতি বৃদ্ধ মজুর। কাশছে লোকটা সমানে, কাশির দমকে কেঁপে কেঁপে উঠছে সারাশরীর, পা দুটো থরথর করে কাঁপছে, ঠান্ডা বাতাসের ঝাপটা যেন মুগুর মারছে তার যক্ষ্মাজীর্ণ বুকের পাঁজরে। একবার সে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল তুষারের ওপর, তারপর কোনো রকমে খাড়া হয়ে উঠে ধুঁকতে ধুঁকতে আবার হাঁটতে লাগল পায়ে পায়ে। ওয়ামসের একটা মুদিখানার দোকান থেকে বোধ হয় সে বহুকষ্টে জোগাড় করেছে একটা বস্তা, সেইটে দিয়ে সে পিঠ ঢেকেছে। ওই বস্তায় মুড়ে কোনো কাচের জিনিসপত্র হয়তো চালান হয়েছিল, লোকটার পিঠে বস্তাটার গায়ে বড়ো বড়ো করে লেখা আছে—‘ভঙ্গুর’।

পিঠের কয়লাগুলো ঘরে ঘরে বিলিয়ে দেবার পর ভিনসেন্ট ঘরে ফিরল। নিজের সব জামাকাপড়গুলো সে বার করে ছড়িয়ে ছড়িয়ে রাখল বিছানায়। কম নাকি তার ঐশ্বর্য? পাঁচটা শার্ট, তিনটে গরম আন্ডারঅয়্যার, চার জোড়া মোজা, দু-জোড়া জুতো, দুটো পুরো সুট, আর তার ওপর গায়ে রয়েছে গরম ওভারকোট! তাড়াতাড়ি একটা শার্ট, একজোড়া মোজা আর একটা আন্ডারঅয়্যার এক ধারে সরিয়ে রেখে বাকি সব সে পুরে নিল সুটকেসের মধ্যে। সুটকেসটা কাঁধে ফেলে আবার সে বার হল পথে।

প্রথমেই গেল সেই ‘ভঙ্গুর’ বৃদ্ধটির বাড়ি। তাকে দিল সুট। আন্ডারঅয়্যার আর শার্টগুলোকে বিলিয়ে দিল শিশুদের মধ্যে, সেগুলো কেটে কেটে বাচ্চাদের জামা করা চলবে। কয়েক জন যক্ষ্মারোগী শ্রমিকের হাতে তুলে দিল মোজাগুলো। মনে পড়ল অন্তঃসত্ত্বা সেই নারীটির কথা, স্বামী যার দু-দিন আগে খনির মধ্যে ধসের চাপে মরেছে, আর যে এখন থেকে নিজে নামছে খনিতে দুটি সন্তানের মুখ চেয়ে। গেল তার ঘরে। গা থেকে কোটটি খুলে তাকে দিল।

উপাসনাগৃহ বন্ধ, কেমন করে সে শ্রমিকদের স্ত্রীদের হাত থেকে সভা গরম করার জন্যে কয়লা ছিনিয়ে নেবে! কেমন করে বলবে সে শ্রমিক পরিবারকে ঘর ছেড়ে পথে বার হতে, হোক না সে উপাসনায় আসার জন্যে! ভিনসেন্টই এখন দিনশেষে ঘরে ঘরে যায়—ধর্মের কথা, যিশুর কথা শোনায়। নতুন কাজ জুটেছে। কোথাও সে রোগীর সেবা করে, কোথাও করে শিশুর পরিচর্যা, কারও জন্যে ওষুধ আনে, কারও ঘরে সে উনুন ধরায়, পথ্য রান্না করে দেয়। বাইবেলটা সঙ্গে আনতেও আর মনে থাকে না। ঈশ্বরের গুণগান এখন বিলাসিতা, আতিশয্য।

মার্চ মাসে শীত কমল, সঙ্গে সঙ্গে শুরু হল জ্বরের মড়ক। গত মাসের জন্যে যা মাইনে পেল, তার থেকে মাত্র দশটি ফ্র্যাঙ্ক ভিনসেন্ট নিজের জন্যে রাখল, বাকি সব টাকা দিয়ে সে কিনল রোগীর ওষুধ আর পথ্য। নিজের জন্যে আহার তার জোটে না, সর্বদা পেটের মধ্যে জ্বলতে থাকে, কণ্ঠা আর গালের হাড় উঁচু হয়ে ওঠে, গর্তে বসা চোখ দুটো দপদপ করে জ্বলন্ত কয়লার মতো, শুকিয়ে সামনের দিকে আরও ঝুঁকে পড়ে ভ্যান গক মার্কা হাতুড়ির মতো চোয়াল। উত্তপ্ত শরীর, সর্বদা জ্বালা করে হাত পা, চলাফেরার নার্ভাস মুদ্রাদোষগুলো আরও স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠে।

ডিক্রুকের বড়ো ছেলেটার টাইফয়েড হয়েছে। ঘরে দুটিমাত্র চৌকি। একটিতে –শোয় মা বাপ, আর-একটিতে তিনটি ছেলেমেয়ে। ছোটো দুটি বাচ্চা যদি দাদার সঙ্গে এক বিছানায় শোয় তাহলে তাদেরও টাইফয়েড অনিবার্য। মাটিতে তারা যদি শোয় তাহলে নির্ঘাত নিউমোনিয়া। আর বাপ মা যদি রাত্রে মাটিতে শোয়, মরবে না বটে তারা, কিন্তু ভোরে উঠে খনিতে যাবার আর ক্ষমতা থাকবে না বাপের, মায়েরও থাকবে না দৈনন্দিন সংসারশ্রমের শক্তি।

সন্ধে বেলা খনি থেকে ডিক্রুক ফিরে দেখে, দোরগোড়ায় পাদরি দাঁড়িয়ে। ভিনসেন্ট বললে—ডিক্রুক, একবার আমার ঘরে চলো, তো, একটু কাজ আছে।

ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে পড়ছে ডিক্রুকের, মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা, তবু সে দ্বিধা করলে না, অশক্ত পা টেনে টেনে চলল ভিনসেন্টের পিছু পিছু। বাড়ি পৌঁছে ভিনসেন্ট তার বিছানার তোশকের একটা দিক তুলে বললে—নাও, ও-দিকটা ধরো। এটা তোমার বাড়িতে নিয়ে যাই। ছেলেটার একটা শোবার ব্যবস্থা হওয়া চাই তো!

দাঁতে দাঁত নিষ্পেষণ করে ডিক্রুক রুদ্ধকণ্ঠে বললে—তিনটে বাচ্চা আছে আমাদের আলবত, ভগবান যদি চান তো তাদের একটা নাহয় যাবে। কিন্তু সারা গ্রামে মশিয়েঁ ভিনসেন্ট আর দুটি নেই, আমার জন্যে সে আত্মহত্যা করবে আর আমি তা সইব?

এই বলে মুখ ফিরিয়ে খোঁড়া ক্লান্ত পা টেনে টেনে সে ফিরে গেল নিজের খুপরিতে।

চৌকিসমেত, সমস্ত বিছানা একসঙ্গে কাঁধের ওপর তুলে নিল ভিনসেন্ট। ডিক্রুকের বাড়ি পৌঁছে নিঃশব্দে সে বিছানাটা পাতল। ডিক্রুকের রুগ্ণ শিশুটিকে সে এই আলাদা বিছানায় শুইয়ে তার সেবা করতে লাগল। নির্বাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল ডিক্রুক আর তার স্ত্রী।

রাত্রি বেলা ডেনিসদের বাড়ি গেল কিছুটা খড়ের সন্ধানে। মাদাম ডেনিস তার কাহিনি শুনে তাজ্জব হয়ে গেলেন। বললেন—মশিয়েঁ ভিনসেন্ট, আপনি এখানে যে-ঘরে ছিলেন, সে-ঘর এখনও খালি পড়ে আছে আপনারই জন্যে। এখুনি আপনি চলে আসুন।

ভিনসেন্ট উত্তর দিলে—আপনি ভারি ভালো মাদাম, কিন্তু সে হয় না।

কেন হয় না মশিয়েঁ ভিনসেন্ট? টাকার কথা ভাবছেন? জিন ব্যাপ্টিস্ট আর আমি অনেক উপায় করি। দুঃখ আমাদের নেই। টাকা আপনাকে দিতে হবে না। আপনি তো বলেন ভগবানের চোখে সব ভাই ভাই, সবাই তাঁর সন্তান। আপনি ভাই হয়ে আমাদের কাছে এসে থাকুন।

ভিনসেন্ট তখন ঠান্ডায় ঠকঠক করে কাঁপছে। সপ্তাহ দুই ধরে তার গায়ে জ্বর, মাথা যেন টলছে। পেটভরতি খাওয়া নেই; চোখজোড়া ঘুম নেই, এমনি অবস্থায় দিনের পর দিন চলেছে। গ্রামের ঘরে ঘরে পুঞ্জিত দুঃখের আশাহারা দুর্ভাবনায় সহ্যের প্রায় শেষ সীমায় এসে সে পৌঁছেছে। এই তো তার মাদাম ডেনিসের আতিথ্য গ্রহণের নিতান্ত উপযুক্ত ক্ষণ! পরিচ্ছন্ন গরম শয্যা, পথ্যের আহার্যের সমারোহ। সবার ওপরে ভগ্নীসমা মাদাম ডেনিসের নিঃস্বার্থ সেবার অঞ্জলি। এ-দিকে পা দুটো তার ভেঙে আসছে; রুটিঘরের লাল মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল বুঝি তার শরীর। আর কি দেরি করার, দ্বিধা করার সময় আছে?

কিন্তু ঈশ্বর, এ কী পরীক্ষা! এই মুহূর্তের এই বিষম পরীক্ষায় সে যদি হারে, তাহলে ব্যর্থ হবে তার এতদিনের ব্রত। আজ যেখানে চারিদিকে চরম হাহাকার, সে কি পলায়নের প্রথম সুযোগটি হাতে আসতেই পিছু হটবে? পালাবে নিরাপত্তার পক্ষপুটে?

ঢোক গিলে আস্তে আস্তে বললে সে—ভগবান আপনার এই মহত্ত্ব চোখ মেলে দেখছেন, মাদাম ডেনিস। এর সুফল তিনিই আপনাকে দেবেন। আপনি কিন্তু আমাকে প্রলোভন দেখাবেন না, আমায় কর্তব্য থেকে ভ্রষ্ট হতে বলবেন না। খড় যদি কয়েক আঁটি থাকে তো দয়া করে দিন, নইলে মাটিতে শুয়েই আমাকে রাত কাটাতে হবে। কিন্তু দোহাই, এর বেশি আমাকে কিছু দিতে চাইবেন না।

ঘরের এক কোণে খড় বিছিয়ে গায়ে পাতলা একটা চাদর জড়িয়ে সে পড়ে রইল। শীতে সর্বাঙ্গ বেঁকে গেল, একফোঁটা ঘুম এল না সারারাতে। সকালে যখন উঠল তখন বুকে ব্যথা আর কাশি, লাল চোখ দুটো কোটরের মধ্যে আরও অনেকটা ঢোকানো। জ্বর আরও বেড়েছে, অসংযত চলৎশক্তি। একটুকরো কয়লা নেই উনুনের ধারে, শ্রমিকশিশুদের বঞ্চিত করে নিজের ঘরে কয়লার গুঁড়ো সে একমুঠোও আনে না। কোনো রকমে খানিকটা শুকনো রুটি চিবিয়ে নিয়ে ভিনসেন্ট বার হল দিনের কাজে।

১০

ক্লান্ত পদক্ষেপে বিদায় নিল মার্চ, এল এপ্রিল। অবস্থার কিছুটা উন্নতি হল। হাড়–কাঁপানো হাওয়া বিরাম নিল, সূর্যের তাপ বাড়ল, গলতে শুরু করল তুষার। বরফ–গলা মাঠের কালো চেহারা ফুটে উঠতে লাগল, ডাকতে লাগল পাখি, বনে বনে এলডার গাছে গাছে ধরল পুষ্পমঞ্জরী। ঘরে ঘরে জ্বরের প্রতাপ প্রশমিত হল, মেয়েরা আবার জমায়েত হতে লাগল মার্কাসের কয়লাপাহাড়ের কিনারে। উনুনে উনুনে গনগনে আগুন, আবার শিশুদের স্বভাবসুলভ চাপল্য, জীবনে নব স্পন্দন।

ভিনসেন্ট আবার তার উপাসনাগৃহের দ্বার খুলল। প্রথম উপাসনার দিন সারা গ্রাম ভেঙে পড়ল। ক্লিষ্ট মুখে হাসির ছাপ ফুটেছে, আবার কিছুটা মাথা তুলেছে লোকগুলো। উপাসনাগৃহের স্বয়ংনিযুক্ত কর্মকর্তা ডিব্ৰুক আগুনে কয়লাকুচো ঠেলছে আর হাসিঠাট্টা জুড়েছে এর-ওর সঙ্গে।

বেদিতে দাঁড়িয়ে ভিনসেন্ট প্রাণখোলা গলায় ঘোষণা করলে—আবার সুদিন এসেছে। এতদিন ঈশ্বর আমাদের পরীক্ষা করছিলেন, সেই দুঃখের পরীক্ষায় আমরা উত্তীর্ণ হয়েছি, দুঃখ এখন অবগত হয়েছে, আবার মাঠে-ঘাটে শস্য পাকবে, সারা দিনের শ্রমের পর কৃষাণ প্রসন্ন মনে ঘরে ফিরবে। গলেছে তুষার, এল প্রকৃতির উষ্ণ পরশ। শিশুরা খেলবে ফুলের বনে, নাচবে পাখির গানে। এসো ভাই; মাথা উঁচু করো, চোখ তুলে তাকাও ঈশ্বরের দিকে, তাঁর আশীর্বাদ তোমাদের জন্যেই আছে। দুঃখরাত্রের পরে নব প্রভাত তাঁরই প্রসাদ, বঞ্চিতকে কৃতার্থ তিনিই করেন। তাঁকে নমস্কার করো, তাঁকে ধন্যবাদ জানাও।

.

কয়েক দিন পরের কথা। মার্কাস খনির পেছন দিকের পাহাড়ে ভিনসেন্ট কয়েকটি ছেলেমেয়ের সঙ্গে কয়লাগুঁড়ো কুড়োচ্ছিল, হঠাৎ চোখে পড়ল দূরে ক্রেনঘর থেকে লোকজন ব্যস্তসমস্ত হয়ে বার হয়ে আসছে, দৌড়োদৌড়ি করছে ইতস্তত। ভিনসেন্ট চেঁচিয়ে উঠল—কী হল! এখন তো তিনটে বাজেনি। ছুটির আগে ওরা অমনি করে উঠে আসছে কেন?

একজন বড়ো গোছের ছেলে বললে—নিশ্চয়ই কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছে। খাদের মধ্যে নিশ্চয়ই কিছু ভেঙেছে!

হোঁচট খেতে খেতে গড়াতে গড়াতে প্রাণপণে তারা নামতে লাগল, পাহাড় থেকে। সমতল মাটিতে পৌঁছোতে-না-পৌঁছোতেই দেখে, গ্রাম থেকে স্ত্রীলোক আর শিশুরা দৌড়ে আসছে খনির দিকে।

গেটের কাছে পৌঁছোতেই ভিনসেন্ট শুনল উত্তেজিত কলরব—সর্বনাশ, সর্বনাশ হয়েছে! ওই নতুন খাদটা! সব গেছে! সবাই আটকা পড়েছে ওটার মধ্যে! হাঁফাতে হাঁফাতে সকলের মাঝখানে এসে দাঁড়াল জ্যাকেস ভার্নি। ভিনসেন্ট তার হাত চেপে ধরে বললে—কী হয়েছে, কী হয়েছে ভার্নি?

ডিক্রুক! ডিক্রুকের সেই খাদটা! মনে আছে সেই নীল ঝাপসা আলো? ঠিক জানতাম এমনি একদিন হবে!

ক-জন, ক-জন ওখানে আছে?

ছ-টা খাটাল, প্রত্যেকটাতে পাঁচ জন করে অন্তত।

কিছুতেই ওদের বাঁচানো যায় না ভাঁর্নি!

বলতে পারি না। তবে হ্যাঁ, আমি নামছি। এখুনি আর ক-জন ভলান্টিয়ার আমি জোগাড় করে নিচ্ছি।

আমি যাব তোমাদের সঙ্গে, ভার্নি!

না। অভিজ্ঞ লোক আমার চাই। আপনাকে নিয়ে কোনো কাজ হবে না। লিফটের দিকে ভার্নি ছুটল।

গেটের সামনে এসে দাঁড়াল ছোট্ট গাড়িটা, সামনে একটা সাদা ঘোড়া। ওই সাদা ঘোড়ার গাড়ি কতবার মৃত মানুষ আর মুমূর্ষু শ্রমিকদের এখান থেকে বহন করে নিয়ে গেছে শোকার্তদের ঘরে ঘরে। গাড়িটা ঘিরে দাঁড়িয়েছে মেয়ে-পুরুষের ভিড়। হতাশ বিষণ্ণ তাদের চোখে ফ্যালফেলে দৃষ্টি, কোনো মেয়ে হঠাৎ হঠাৎ ককিয়ে উঠছে বুকচাপা আর্তনাদে। শিশুরা ফুঁপিয়ে কাঁদছে মায়েদের পোশাক চেপে ধরে, ফোরম্যানরা ছুটোছুটি করছে, চিৎকার করে হুকুম দিচ্ছে নানারকম

হঠাৎ গোলমাল থামল। ছোট্ট একটি দল ক্রেনঘর থেকে বার হয়ে নিঃশব্দে সামনে এগিয়ে আসতে লাগল। কম্বলে মুড়ে কী যেন তারা বহন করে আনছে। কয়েকটি মুহূর্তের মুখর স্তব্ধতা। তার পরেই সবাই ভেঙে পড়ল সমস্বরে।

কারা ওরা, কারা গো? বেঁচে আছে? বলো না গো, কী নাম? দেখাও, দেখাও ওদের মুখ! আমার স্বামী, আমার স্বামী নাকি? ওগো, আমার দুটি বাচ্চা যে ছিল ওই খাটালটাতেই! তাদের কি কিছু হল?

বাহকদের একজন বললে—খাটালের বাইরে যারা কয়লা সরাচ্ছিল, তাদের তিনজনকে তুলতে পেরেছি। ঝাঁঝরা হয়ে গেছে আগুনে, কেমন আছে জানি না।

দেখাও, দেখাও ওদের মুখ! আমার ছেলে, সে নাকি? আমার মেয়ে, সে তো গাড়ি ঠেলত ওখানে, তাকে তুলেছ নাকি? দেরি করো না, শুধু মুখগুলো দেখাও!

দুটি মুখ কিশোরীর, একটি বছর দশেকের একটি ছেলের। কালি-মাখা, ফোসকা-পড়া। যাদের ছেলেমেয়ে তারা ওদের ওপর লুটিয়ে পড়ে দুঃখ আর আনন্দের অবিমিশ্র আঘাতে হাউহাউ করে কেঁদে উঠল। দেহগুলো গাড়িটার মধ্যে তুলে দিয়ে সেটা চালাতে শুরু করল গাড়োয়ান। পিছনে ছুটল তাদের আত্মীয়স্বজন। সঙ্গে সঙ্গে ভিনসেন্টও।

হঠাৎ একবার সে থমকে দাঁড়িয়ে পিছন ফিরে তাকাল। জ্বলন্ত আকাশ, মাইনের ওপারে চক্রবাল ঘিরে কালো কালো কয়লাপাহাড়ের ভ্রুকুটি।

এতদিনের পুঞ্জীভূত বেদনার চরম প্রকাশ এই সর্বনাশা দুর্ঘটনা। ভিনসেন্টের শুষ্ক কণ্ঠ থেকে বার হয়ে এল কটি কথা—কালো পিরামিডের রাজ্য, কালো মিশর! ঈশ্বর, তোমার প্রিয়, তোমার মনোনীত মানুষের দল, আবার তারা এই মিশরে বন্দি! এ তুমি কী করেছ ভগবান!

শিশু তিনটির মৃতপ্রায় অবস্থা। শরীরের কাপড়-ঢাকা অংশটুকু বাদে সমস্ত চামড়া আর চুল ঝলসে পুড়ে গেছে। পাশে দাঁড়িয়ে মাথা চাপড়াচ্ছে মায়েরা। প্রথম শিশুটির গা থেকে পোড়া ন্যাকড়ার টুকরোগুলো ছাড়াতে ছাড়াতে ভিনসেন্ট বললে—তেল, তেল আনো শিগগির খানিকটা!

ঘরে তেল ছিল। পোড়ার ওপর তেল লাগাতে লাগাতে ভিনসেন্ট আবার চেঁচিয়ে ডাকল—ব্যান্ডেজ চাই এখন!

বিস্ফারিত আর্ত চোখে তাকিয়ে রইল মা। ধমক দিয়ে উঠল ভিনসেন্ট—হাঁ করে তাকিয়ে দেখছ কী? মরবে নাকি তোমার ছেলে? ব্যান্ডেজ কই?

ব্যান্ডেজ? সাদা কাপড়ের টুকরো? কোথায় পাব? সারা শীতকাল ধরে একটু বাড়তি কাপড় কারও নেই।

গোঙাতে লাগল শিশু। ভিনসেন্ট গা থেকে কোট শার্ট আর গেঞ্জি খুলে ফেলল। কোটটা আবার গায়ে জড়িয়ে নিয়ে অন্য জামাগুলো টুকরো টুকরো করে তার ফালি দিয়ে মাথা থেকে পা পর্যন্ত বাচ্চাটিকে জড়াল। তারপর তেলের পাত্র নিয়ে ছুটে গেল দ্বিতীয় শিশুটির দিকে। তৃতীয় শিশুটিকে তেল মাখানোর পর ব্যান্ডেজ আর নেই। ভিনসেন্ট প্যান্টটা আর তার ভিতরের গরম আন্ডারঅয়্যারটা খুলল। প্যান্টটা পরে নিয়ে আন্ডারঅয়্যারটা ছিঁড়ে তা দিয়ে শিশুটির অঙ্গপ্রত্যঙ্গ জড়িয়ে জড়িয়ে বাঁধল।

খালি গায়ের ওপর কোটটা চেপে ধরে আবার ভিনসেন্ট দৌড়োল খনির দিকে। দূর থেকেই কানে আসতে লাগল স্বামীহারা সন্তানহারার বিলাপধ্বনি।

গেটের কাছে মাইনাররা দাঁড়িয়ে আছে। একদল রক্ষাকারী পিটে নেমেছে। তারা উঠলে তবে আর-একদল নামতে পারবে। বেশি লোক একসঙ্গে নামবার উপায় নেই। ভিনসেন্ট একজন’ সহকারী ফোরম্যানকে জিজ্ঞাসা করল—কী মনে হয়? বাঁচানো যাবে?

এতক্ষণে একজনও আর বেঁচে নেই, পৌঁছোতেই পারবে না ওদের কাছে। যারা মরেছে তাদের তো কবরই হয়ে গেছে। সব তো পাথর চাপা—

তবে?

সপ্তাহ যাবে, মাস যাবে, দেহগুলো যদি খুঁড়ে খুঁড়ে তুলে আনতে পারে! আগেও তো দেখেছি, তখনও এমনিই হয়েছে।

তাহলে ভাই, আর কোনো আশা নেই?

না। গুনে দেখেছি আমরা। মেয়ে-পুরুষ মিলে সাতান্নজন।

সবাই মরেছে?

হ্যাঁ, সাতান্নটা প্রাণ, একলহমায় বরবাদ

তবু চেষ্টার শেষ নেই। সারারাত আর সারাদিন ধরে শ্রমিকেরা–নামছে, চেষ্টা করছে, উঠছে, আবার নামছে নতুন দল। ক্রেনঘর ঘিরে আশাহীন অপেক্ষায় বসে আছে স্ত্রীলোক আর শিশুর দল। পুরুষেরা প্রবোধ দিচ্ছে, শোক যাদের প্রত্যক্ষভাবে স্পর্শ করেনি সেসব মেয়েরা ঘর থেকে কফি বানিয়ে এনে পরিবেশন করছে কিন্তু ওরা বুক বাঁধবে কোন ভরসায়, জলটুকু মুখে ছোঁয়াবে কোন প্রাণে? চোখের জল শুকিয়ে যায়, প্রতীক্ষার শেষ হয় না।

শ্রমিকরা একটা কম্বলে জড়িয়ে তুলে আনল ভার্নিকে। সেই যে প্রথম সে নেমেছিল, আর ওঠেনি। এবার উঠল অচৈতন্য অবস্থায়। কেশে ছিল, ঝলকে ঝলকে মুখ থেকে লাল রক্ত ঠিকরে পড়েছিল খনির অন্ধ গুহায়। পরের দিন মারা গেল ভার্নি।

আটচল্লিশ ঘণ্টা পরে ভিনসেন্ট ডিক্রুকের স্ত্রী আর বাচ্চাদের জোর করে সরিয়ে আনল খনির কাছ থেকে, নিয়ে গেল তাদের ঘরে। বারো দিন ধরে অবিশ্রান্তভাবে শ্রমিক স্বেচ্ছাসেবকরা খনির অন্ধকারে খুঁজে বেড়াল সহকর্মীদের মৃতদেহ। কয়লা তোলা বন্ধ, বন্ধ রুজিরোজগার। সারাগ্রাম জুড়ে অনশনের ছায়া। মাদাম ডেনিস তাঁর সব সঞ্চয় দিয়ে রুটি বানিয়ে শ্রমিকদের মধ্যে বিলিয়ে দিতে লাগলেন। সে সঞ্চয়ও ফুরোল। চুপ করে হাত গুটিয়ে বসে রইল মালিকরা। তেরো দিনের দিন হুকুম হল—মড়া তোলবার খেলা বন্ধ করো, কাজে লাগো এবার, অনেক হয়েছে।

যেতেই হবে। সারাগ্রাম দুর্ভিক্ষের করাল হাঁয়ের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। আর-কিছু করার নেই, নেই কোনো উপায়

ধর্মঘট করল শ্রমিকেরা।

.

ভিনসেন্টের এপ্রিল মাসের বেতন এল পঞ্চাশটি ফ্র্যাঙ্ক। সদরে গিয়ে পুরো পঞ্চাশ ফ্র্যাঙ্কের খাবার কিনে পিঠে বেঁধে গ্রামে এনে সে তা বিলিয়ে দিল ঘরে ঘরে। দিন ছয়েক চলল তাতে। তারপর গ্রামবাসীরা বার হল বনে জঙ্গলে। মেয়েরা কুড়োয় বুনো ফল, ঘাস, পাতা। পুরুষরা ওত পেতে বসে শিকার করে নেউল, বেজি, ব্যাঙ, কুকুর, বেড়াল। ক্ষুধা—পেটের মধ্যেকার তীব্র যন্ত্রণাকে বন্ধ করার জন্যে মুখে যা-কিছু পোরা যায় তা-ই। অশক্ত কম্পিত দেহে জ্বালাভরা চোখে দিনের পর দিন সমর্থ শ্রমিক পুরুষগুলো মাটিতে উঁচু হয়ে বসে দেখতে লাগল, তাদের চোখের সামনে তাদের নারী আর সন্তানরা অনাহারে কুঁকড়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে। ভিনসেন্ট সাহায্যের জন্য আবেদন পাঠাল ব্রুসেলসে। কোনো উত্তর এল না।

সবাই যাবে একে একে, ওরা বলল ভিনসেন্টকে—ওই যে সাতান্নজন আগে গেছে, ওদের আত্মার জন্যে একদিন প্রার্থনা করো। নির্দিষ্ট দিনে সূর্য ডোবার পরে শ খানেক লোক জমায়েত হল ভিনসেন্টের কুঠরিতে। দুর্ঘটনার পর থেকে শক্ত খাবার এ-পর্যন্ত ভিনসেন্টের পেটে কতটুকু গেছে কেউ জানে না। গত ক-দিন ধরে কয়েক চুমুক কফি ছাড়া আর কিছুই সে খায়নি। জ্বরে পুড়ছে সারা গা, কাঁপছে হাত পা। কোটরে ঢোকা অগ্নিবর্ষী চোখ, তুবড়ে যাওয়া গাল, নোংরা মুখভরতি খোঁচা খোঁচা লাল দাড়ি। পোশাক নেই, সারাগায়ে তার চট জড়ানো। মেঝের ওপর ছেঁড়া খড়ের গাদায় তার আশ্রয়।

তার চারদিক ঘিরে নিঃশব্দে দাঁড়াল একশোটি নিরন্ন বুভুক্ষু প্রেতমূর্তি, ভুষি–মাখানো লন্ঠন বস্তা-ঝোলানো…. ফাটা তক্তার দেয়ালে দেয়ালে দেয়ালে ছড়াল কৃষ্ণগম্ভীর কত প্রেতচ্ছায়া।

কনুইয়ের ওপর ভর দিয়ে কোনোরকমে মাথা উঁচু করে বসে ভিনসেন্ট অন্ত্যেষ্টিপ্রার্থনা শুরু করল শুকনো ভাঙা গলায়। শীর্ণ শ্রমিকরা রুক্ষ ক্লান্ত চোখ মেলে তার দিকে তাকিয়ে রইল, তাদের চোখ খুঁজতে লাগল ঈশ্বরকে। কোথায়, কোথায় ঈশ্বর?

হঠাৎ বাইরে শোনা গেল অচেনা কণ্ঠস্বর, বিরক্তিভরা চড়া মেজাজের গলা। দরজা খুলে একটি শিশু বললে—আপনারা আসুন, মশিয়েঁ ভিনসেন্ট এখানে।

চুপ করল ভিনসেন্ট। শ্রোতারা সবাই তাকাল দরজার দিকে। ভেতরে ঢুকলেন দুজন সুবেশধারী ভদ্রলোক। তাঁদের চোখে আতঙ্ক আর বিভ্রান্তি।

ভিনসেন্ট উঠতে পারল না। ওইভাবে বসে বসেই সে বললে—আসুন রেভারেন্ড ডি জঙ, আসুন রেভারেন্ড ভ্যান ডেন ব্রিঙ্ক। মার্কাস খনিতে সাতান্নজন লোক মরেছে, তাদের নামে আজকের এই প্রার্থনাসভা। সকলের মনে বড়ো শোকতাপ। আপনারা এদের কাছে দুটো সান্ত্বনার কথা বলে যান।

খানিকক্ষণ অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকার পর ধর্মযাজকেরা মুখ খুললেন। ভুঁড়ির ওপর সজোরে একবার হাত চাপড়ে ডি জঙ চিৎকার করে উঠলেন—কী জঘন্য! কী বীভৎস!

খ্যাকখ্যাক করে উঠলেন ভ্যান ডেন ব্রিঙ্ক—মনে হচ্ছে যেন আফ্রিকার জঙ্গলে এসেছি আমরা!

ধর্মের নামে কী সর্বনাশ উন্মাদটা করছে দেখছেন?

যিশুর পথে ওদের ফিরিয়ে আনতে কত বছর যে লাগবে কে জানে? দু-হাত ভাঁজ করে ভুঁড়ির ওপর চেপে ডি জঙ হেঁকে উঠলেন—আমি তখনই বারণ করেছিলাম এ-লোকটাকে চাকরি দেবেন না!

আমিই কী চেয়েছিলাম নাকি! পিটারসেনের জন্যেই তো! এখন দেখছি লোকটা বদ্ধ পাগল!

পাগল? চিরকালের পাগল! প্রথম থেকেই আমি ধরতে পেরেছিলাম! ধর্মযাজকেরা বিশুদ্ধ ফরাসি ভাষায় কথা বলছিলেন, একটি কথাও শ্রমিকরা বুঝছিল না। ভিনসেন্ট শুনছিল, কিন্তু তার অসুস্থ মস্তিষ্ক যেন ঠিকমতো ধরতে পারছিল না এদের কথোপকথনের মানে।

ডি জঙ ভিড় ঠেলে ভিনসেন্টের কাছে এগিয়ে এলেন, ক্রুদ্ধ হিংস্র গলায় তাকে বললেন—হটিয়ে দাও এসব নোংরা কুকুরগুলোকে এখান থেকে!

কিন্তু….কিন্তু প্রার্থনা তো এখনও শেষ হয়নি!

চুলোয় যাক তোমার প্রার্থনা! ভাগাও এদের!

শ্রমিকরা আস্তে আস্তে চলে গেল। দুজন ধর্মযাজক দাঁড়ালেন ভিনসেন্টের সামনাসামনি।

এর মানে কী? এই গর্তের মধ্যে এ তোমার কীরকম প্রার্থনাসভা? কোন ভূতুড়ে ধর্ম তুমি প্রচার করছ এখানে বসে? তুমি না খ্রিস্টান ধর্মযাজক, এই তোমার রুচি? এই তোমার ব্যবহার? সামান্য লজ্জাও কি তোমার নেই, কিছুমাত্র সম্ভ্রমবোধও নেই? লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে আমাদের! ধর্মকে তুমি রসাতলে পাঠাতে চাও এখানে বসে বসে?

ছেঁড়া চটের বসন পরে খড়ের গাদায় স্তব্ধ হয়ে বসে রইল ভিনসেন্ট। তার জ্বরাক্রান্ত রক্তমূর্তির দিকে তাকিয়ে ধর্মযাজকেরা তাঁদের শেষ কথা এবার বললেন—আমাদের ভাগ্য ভালো যে তোমাকে পাকা চাকরি আমরা দিইনি। তোমার সমস্ত ব্যবহার জঘন্য, ঘৃণ্য! তোমার চাকরি এখানে এই মুহূর্তে খতম হল। নতুন লোক আমরা তোমার বদলে পাঠাচ্ছি। তুমি পাগল কি না জানি না, তবে এটুকু জানি যে খ্রিস্টধর্মের তুমি চরম শত্রু।

বেশ কিছুটা স্তব্ধতার পরে আবার প্রশ্ন হল—তোমার স্বপক্ষে কোনো কথা তুমি বলতে চাও?

একটি শব্দও জোগাল না ভিনসেন্টের মুখে। শুধু একবার তার মনে এল তার চাকরি পাওয়ার প্রথম দিনটির কথা।

শেষ পর্যন্ত ভ্যান ডেন ব্রিঙ্ক বললেন—লোকটার আর কোনো আশা নেই। চলুন, আর থেকে কী হবে এখানে? ওয়ামস শহরে যদি একটা ভালো হোটেল না মেলে তো সেই আবার মনসেই পৌঁছোতে হবে আজ রাত্রে।

১১

পরের দিন সকালে কয়েক জন প্রবীণ শ্রমিক ভিনসেন্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করল।

তারা বললে—মশিয়েঁ, জ্যাকেস ভার্নি মারা যাবার পর বুদ্ধি পরামর্শ দেবার মতো আপনি ছাড়া আর কেউ আমাদের নেই। আপনিই বলুন আমরা কী করব। না খেতে পেয়ে এমনি তিলে তিলে শুকিয়ে মরতে আমরা কেউই চাই না। আপনি একবার ওঁদের সঙ্গে দেখা করুন, ওঁদের বুঝিয়ে বলুন, আমাদের সাথিদের দেহগুলো অন্তত আমাদের যেন তুলতে দেয়। তারপর আপনি যা বলেন তা-ই আমরা করব। মরতে বলেন মরব, কাজে যোগ দিতে বলেন দেব।

ভিনসেন্ট স্বীকার করল, দেখা করতে গেল ‘ওঁদের’ সঙ্গে, খনিমালিকদের দফতরে। শোককাতর ম্যানেজারের মুখচ্ছবি, দরদভরা কণ্ঠ। তাঁর কথা হল—আমি মানি মশিয়েঁ ভিনসেন্ট, আমরা খুঁড়ে খুঁড়ে মৃতদেহ শেষ পর্যন্ত তুলতে দিইনি বলে শ্রমিকদের সেটা খুবই লেগেছে। কিন্তু তাতে লাভটা কী হতো বলুন? কোম্পানি ঠিক করেছে ওইসব নীচের খাটালগুলো বন্ধই করে দেবে, ওগুলোয় কাজ করা লোকসান। তবু হয়তো ওগুলোকে আবার মাস খানেক ধরে খুঁড়ে খুঁড়ে মড়াগুলোকে উদ্ধার করা যেত। তারপর এক কবর থেকে আর-এক কবরে তাদের ঠাঁই হতো, তার বেশি তো কিছু নয়?

ভিনসেন্ট বললে—যারা মরেছে তাদের কথা ছেড়ে দিন। কিন্তু যারা বেঁচে আছে তাদের জন্যে কিছু করুন! খনির মধ্যে তাদের নিরাপত্তার জন্যে এখন থেকে অন্তত উপযুক্ত ব্যবস্থা করা উচিত নয় কি?

নিশ্চয়ই উচিত, ম্যানেজার বললেন—তবে কিনা, যদি সাধ্যে কুলোয়। কিন্তু তা’-যদি না কুলোয়, তাহলে দিনের পর দিন মৃত্যুকে সামনে রেখেই তাদের খনির মধ্যে কাজ করে যেতে হবে। আপনি তো ব্যাবসার দিকটা নিশ্চয়ই বিশেষ কিছু জানেন না। কোম্পানির এমনি অবস্থা যে, নিরাপত্তার ব্যবস্থার জন্যে একটি পয়সা খরচ করবার উপায় নেই। আসল ব্যাপারটা কী জানেন, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি চারদিক জুড়ে এমনি মজে এসেছে যে শ্রমিকদের জন্যে দু-পয়সা বেশি খরচ করার ক্ষমতা কোথাও কারও নেই। এমনি পরিস্থিতি যে, আমরা প্রায় ডুবতে বসেছি। আপনি বরং ওদের এই কথাটা বুঝিয়ে বলবেন যে, আর দু-এক সপ্তাহ কয়লা তোলা ওরা যদি বন্ধ রাখে, তাহলে এমনিতেই খনিটা একেবারে বন্ধ করে দিতে হবে। তখন যে বেচারাদের কী হবে ভগবানই জানেন!

পরাজিত ভিনসেন্ট ফিরে এল গ্রামে। ভগবানই জানেন? সত্যি? না, তিনিও হয়তো জানেন না।

পরাস্ত সে। শ্রমিকদের কোনো কাজে আর সে আসবে না। এই নির্দেশ তাকে দিতে হবে—ফিরে যাও তোমাদের কাজে, দিনের পর দিন পাতালের কারাগারে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে হাড়ভাঙা খাটুনি খাটো, অর্ধাহারে অর্ধমৃত জীবন—দিন গোনো কবে মুখ দিয়ে রক্ত উঠবে, প্রতীক্ষা করো কবে আসবে অপঘাত-মৃত্যুর মুক্তি! কোনো সাহায্যই সে করতে পারল না. ভগবান পর্যন্ত তাদের ওপর বিরূপ। এদের মধ্যে ঈশ্বরের বাণী প্রচার করতে সে এসেছিল, কিন্তু কথা তার ফুরিয়েছে। মালিকরা এদের শত্রু, এ-কথা বললে সব কথা বলা হবে না। এদের শত্রু এদের ভাগ্যবিধাতা।

ফিরে যাও কাজে, ফিরে যাও অভিশপ্ত জীবনমৃত্যুর করাল ছায়ায়। কোনো উপায় নেই। কোনো পথ নেই। এতদিনে যা-কিছু করতে চেয়েছি—সব প্ৰমাণ হয়েছে অর্থহীন। হৃদয় নিংড়ে নিংড়ে যত প্রার্থনা করেছি, বোবা আকাশে তা মিলিয়ে গেছে, বধির ভগবানের কানে তা পৌঁছোয়নি। ধর্মপ্রচারণী সমিতি যে তাকে বরখাস্ত করেছে এতে দুঃখ করবার কিছু নেই। কোন সুখে আর সে প্রার্থনা করত এই বঞ্চিত সর্বহারাদের হয়ে?

ব্যর্থতার এই চরম মুহূর্তে হঠাৎ ভিনসেন্ট উপলব্ধি করল একটি সত্য, যা অনেক দিন থেকেই তার মনে ভেসে ভেসে উঠছিল। মিথ্যে কথা—ভগবান আর তাঁর প্রাসাদ, তাঁর প্রতি বিশ্বাস আর আত্মনিবেদন—এ শুধু স্তোকবাক্য, হতাশার নীরন্ধ্র রাত্রি-অন্ধকারে নিরুপায় একলা মানুষের সুলভ আত্মপ্রবঞ্চনা। তার বেশি কিছু নয়। কেননা ভগবান নেই, শুধু ভাগ্য আছে। ভাগ্য থেকে নিস্তার নেই মানুষের।

১২

ধর্মঘট বন্ধ করে শ্রমিকরা ফিরে গেল খনিতে। কাজ ফুরোল ভিনসেন্টের। থিয়োডোরাস ভ্যান গক ধর্মপ্রচারণী সমিতির কাছ থেকে ছেলের কীর্তির খবর পেলেন। লিখলেন—খুব হয়েছে, ইটেনে ফিরে এসো। গির্জার দরজা বন্ধ করে শ্রমিকবস্তির ঘর ছেড়ে ভিনসেন্ট আশ্রয় নিল ডেনিসদের বাড়িতে।

আবার দেউলিয়া জীবন, হিসেবে লাভের ঘরে শূন্য। অর্থ নেই, কৰ্ম নেই, নেই স্বাস্থ্য, নেই আদর্শ-উদ্দীপনা। কোনো পথ, কোনো আশা, কোনো লক্ষ্য নেই সামনে। যতদূরে তাকাও, শুধু শূন্যতা। ছাব্বিশ বছর বয়স, ভাগ্য শুধু ব্যর্থতার বোঝা। পাতলা হয়ে এল মাথার চুল, মুখভরতি জট-পাকানো লাল দাড়ি, সুপুষ্ট ঠোঁট দুটির বদলে খালি তীক্ষ্ণ শীর্ণ একটি রেখা, চোখ দুটি যেন কালো উনুনের দুটি গর্তে জ্বলন্ত দু-টুকরো অঙ্গার।

মাদাম ডেনিস দিলেন একটুকরো সাবান আর এক গামলা জল। শীর্ণ জিরজিরে অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো সে পরিষ্কার করল। দাড়ি কামাল সযত্নে, ফুটে উঠল হাড়-বার-করা বুভুক্ষু মুখমণ্ডলটা। অনেক দিন পরে সে চুল আঁচড়াল। মাদামের কাছ থেকে তাঁর স্বামীর পোশাক ধার করে পরে নিল। তাঁর রান্নাঘরে বসে পেট ভরে খেল অনেক দিন পরে। ভোজ্য বস্তুর পরিচয় সে ভুলে গিয়েছিল যে-দিন খনিতে দুর্ঘটনা ঘটে প্রায় সে-দিন থেকেই।

দিন কাটে। শ্রমিকদের সঙ্গে সে কথা বলে না আর, যায় না তাদের ঘরে। তারাও তাকে এড়িয়েই চলে। তারাও মনে মনে বুঝেছে যে কাজ তার ফুরিয়েছে। এই নির্বাক বোঝাবুঝির মধ্যে দিয়ে সে দূরে সরে যায়। বরিনেজের দৈনন্দিন জীবন আবর্তিত হয় আপন অন্ধ বৃত্তে।

বাড়ি থেকে মাঝে মাঝে চিঠিপত্র আসে। কিছুটা পড়ে, কিছুটা পড়ে না। একটি চিঠিতে খবর এল, কে ভস-এর স্বামীটি মারা গেছে। খবরটি এমন কিছু সাড়া জাগাল না মনে।

দিন কাটে। ভিনসেন্ট শুধু খায়, ঘুমোয় আর একা একা ঘুরে ঘুরে বেড়ায় আচ্ছন্নের মতো। শরীরটা একটু সারে, জোর বাড়ে। সঙ্গে সঙ্গে তাপ বাড়ে গ্রীষ্মের। কয়লাখনির মাঠ আর পাহাড় আর চুল্লি সারাদিন রোদ পোহায়। ভিনসেন্ট নিঃসঙ্গ হেঁটে হেঁটে বেড়ায় উদ্দেশ্যবিহীন—ক্লান্তি যখন আসে, হয় কোথাও বসে বিশ্রাম করে, নাহয় ঘরে ফিরে গিয়ে গা এলিয়ে দেয়।

হাতের টাকা ফুরিয়ে এল। সাহায্য করল ছোটো ভাই থিয়ো। সঙ্গে চিঠিতে লিখল—বরিনেজে বসে বসে সে যেন জীবনটাকে নষ্ট না করে, এই টাকা দিয়ে আবার নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করে। টাকাগুলো সে তুলে দিল মাদাম ডেনিসের হাতে।

কেন সে পড়ে আছে বরিনেজে? আর কোথাও যাবার নেই বলে। কেন সে নিষ্ক্রিয়? করবার কিছু নেই বলে। ঈশ্বরকে সে হারিয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে হারিয়েছে নিজেকে। থিয়ো পর্যন্ত চিঠি লেখা বন্ধ করল। দাদার ওপর আর তার আস্থা নেই। দুঃখ করে কী হবে? নিজেরই ওপর যে তার আস্থা নেই। পৃথিবীর পথে পথে সে ঘুরছে ব্যর্থ প্রেতের মতো। কোথায় জীবনের মন্ত্র? কোথায় পন্থাসন্ধান?

.

আরও কয়েক সপ্তাহ কাটল। আস্তে আস্তে ভিনসেন্ট ফিরে যাচ্ছে পুরোনো একটি নেশায়, বই পড়ার নেশা। একদা বই পড়া তার সর্বশ্রেষ্ঠ আনন্দ ছিল। নিজের জীবনের দিকে এখনও সে তাকাতে পারছে না, তবে বুঝি কৌতূহল জেগেছে অপরের জীবন সম্বন্ধে—অপরের আনন্দ বেদনা, সাফল্য অসাফল্যের কাহিনির প্রতি, পুস্তকের মাধ্যমে।

আজকাল সারাদিন সে মাঠেই কাটায় গাছের ছায়ায় বসে শুয়ে বই পড়ে। বাড়িতে থাকলে হয় রান্নাঘরের এক কোণে একটা ঝোলা চেয়ারে বসে, নাহয় নিজের বিছানায় শুয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তার যায় সাহিত্যপাঠে। তারই মতো শত শত সাধারণ লোক, যারা জীবনযুদ্ধে কিছুটা-বা জিতেছে আর অনেকটাই হেরেছে, তাদেরই কাহিনি সে পড়ে। এই পড়ার মধ্যে দিয়েই নিজের সম্বন্ধেও তার ধারণাটা ক্রমে ক্রমে স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে। আমি ব্যর্থ, আমি নিরুপায়, জীবন আমার বৃথা, হতাশার এই ঘন অন্ধকারটা কাটতে থাকে, মনে প্রশ্ন জাগে, এবার আমি কী করব, কী নিয়ে জীবন কাটাব, চলব আবার কোন পথে? অধ্যয়নের মধ্যে দিয়ে মন জীবনজিজ্ঞাসার উত্তরের সন্ধান করে।

বাড়ি থেকে কটা চিঠি আসে বাবার। অর্থহীন আলস্যে সে দিনের পর দিন কাটাচ্ছে, এই দায়িত্বজ্ঞানহীন অসামাজিক জীবনযাত্রা কবে সে শেষ করবে, কবে সে একটা কিছু করবার চেষ্টাটুকু অন্তত আবার শুরু করবে?

কবে—তা সে কি নিজেই জানে?

অবশেষে একদিন ভিনসেন্টের পড়ার নেশা একেবারে ছুটে গেল, হাত দিয়ে একটা বই স্পর্শ করার প্রবৃত্তি পর্যন্ত আর রইল না। ঈশ্বরে বিশ্বাসটুকু পর্যন্ত যেদিন সে হারিয়েছিল, সেদিন চৈতন্য থেকে লুপ্ত হয়েছিল সমস্ত অনুভূতি। দেহটা ছিল কায়ক্লেশে চলমান, জড় অন্তর। তারপর এই ক-সপ্তাহ ধরে একটানা সাহিত্যপাঠে আবার ফিরে পেয়েছে অনুভূতির জোয়ার, ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে মনের দু-কূল। কিন্তু কোথায় এ-স্রোতের শেষ? এ-বন্যা তো শুধু হতাশার আর যন্ত্রণার! মনে হচ্ছে হয়তো এখনও তার মধ্যে কিছুটা ভালো আছে, কিছুটা সম্ভাবনা আছে, সত্যিই সে মূঢ় মূর্খ হতভাগা নয়, হয়তো পৃথিবীতে কিছু সে করবে, কিছু রইবে তার অবদান। কিন্তু এই অনুভূতি তো নিষ্ফলা। এ শুধু হতাশের আত্মস্তুতি–প্রকৃত সান্ত্বনা এতে কোথায়? কেননা, কী যে করবে তা সে জানে না, এটুকু শুধু জানে, এ পর্যন্ত যা-কিছু করেছে তা সব মিশেছে ধুলোয়, যে-পথে চলেছে—পৌঁছেছে ব্যর্থতায়। তৃষ্ণার্ত সে, এসে দাঁড়িয়েছে শুষ্ক তীরে, কোথায় জীবনস্রোত-সন্ধান?

প্রশ্নের পর প্রশ্ন, উত্তর নেই। ভাবনার পর ভাবনা, নিরসন নেই। এমনি উদ্দেশ্যহীনতায় দিন কাটে, কাটে মাস। আবার পাতাঝরা শীত ঋতু আসে। কখনও বাবা টাকা পাঠান কয়েকটা, কখনও-বা গোপনে সাহায্য করে ছোটো ভাই থিয়ো। যখন যা পায়, গৃহকর্ত্রীর হাতে তুলে দেয়। আশ্রয়টা আছে, আহারও কিছু জোটে।

নভেম্বর মাসে একদিন সকাল বেলা ভিনসেন্ট বাড়ি থেকে বার হয়ে উদ্দেশ্যবিহীন হাঁটতে হাঁটতে মার্কাস খনির দেয়ালের ধারে মরচে-ধরা বরবাদ একটা লোহার চাকার ওপরে বসল। বসে রইল চুপ করে। শূন্য মন, শূন্য হাত। গেট থেকে বার হয়ে এল বুড়ো একজন শ্রমিক। হেঁট মাথাটার ওপর চোখ-ঢাকা টুপি, দু-হাত ছেঁড়া পকেটে, জরা ক্লান্তি আর জীবনভর দারিদ্র্যে ঝুঁকে-পড়া দুই কাঁধ, দুর্বল পায়ে স্খলিত গতি। ভিনসেন্টের মনে হল কী একটা নাম-না-জানা আকর্ষণে ওই পথচারী মূর্তিটি যেন তাকে টানছে। খেয়ালবশে পকেটে হাত পুরে সে বার করল ছোট্ট একটা পেনসিল আর একটা খাম। খামের ও-পিঠের সাদা কাগজের ওপর পেনসিলের সিস বুলিয়ে তাড়াতাড়ি সে এঁকে ফেলল শূন্য মাঠের ওপর দিয়ে অপস্রিয়মাণ ওই লোকটার ছবি।

খাম থেকে বার হল বাবার চিঠি। চিঠির কাগজটারও একটা পিঠ সাদা। আর–একটি লোক বার হল খনির দরজা দিয়ে। লোকটি তরুণ, সে দাঁড়াল কিছুক্ষণ দরজার কাছে। ভিনসেন্ট আঁকল তাকেও, তার তরুণ বলিষ্ঠ দেহের ভিন্ন রকমের ভঙ্গিটা কাগজে পেনসিলে আয়ত্ত করে নেবার সময়টুকু সে অপব্যয় করল না।

১৩

ডেনিসদের বাড়িতে ফিরেই ভিনসেন্ট জোগাড় করল কয়েকটা সাদা কাগজ আর মোটা একটা পেনসিল। সাদামাটা স্কেচ দুটোকে টেবিলে রেখে সেগুলোর অনুসরণে সে বড়ো করে আঁকতে শুরু করল। আড়ষ্ট তার হাত, মাথার মধ্যে যে-রেখাটি আসে অপটু অবাধ্য আঙুল কাগজের বুকে তাকে ফুটিয়ে তুলতে পারে না। বারে বারে মোছে আর আঁকে।

অন্ধকার যে কখন ঘনিয়ে এসেছে টেরই পায়নি। মাদাম ডেনিস দরজায় টোকা দিলেন—মশিয়েঁ ভিনসেন্ট, খাবার দেওয়া হয়েছে। আসুন।

খাবার! এখুনি? এত দেরি হয়ে গেছে নাকি?

কোনো রকমে সন্ধ্যা বেলাকার খাবারটা গলাধঃকরণ করে ভিনসেন্ট আবার ঘরে ফিরে এসে দরজায় খিল দিল। দেয়ালে পিন ফুটিয়ে স্কেচ দুটোকে এঁটে দূর থেকে সেগুলো নিরীক্ষণ করতে লাগল। মনে কেমন একটা উৎসাহ, চোখে কীসের যেন দীপ্তি। মনে মনে বললে—জঘন্য! যাচ্ছেতাই এঁকেছি! আচ্ছা দেখা যাক, কাল বোধ হয় আর-একটু ভালো হবে ছবি দুটো।

বিছানায় শুয়ে শুয়ে ছবি দুটোর দিকে সে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ। কেরোসিনের আলোটা জ্বলছে ঠিক ছবি দুটোর তলায়। দেয়ালে আরও অনেকগুলো ছবির প্রিন্ট টাঙানো। গির্জেবাড়ি থেকে সেগুলো খুলে এনে আবার এ-ঘরের দেয়ালে টাঙিয়েছিল, কিন্তু চোখ মেলে এগুলোকে দেখেনি একদিনের জন্যেও। কতদিন পরে আবার ছবির দিকে চোখ পড়েছে। ছবি! এতদিন সে ছবি ভুলে ছিল কী করে? আজ হঠাৎ মন-কেমন করছে রেখার জন্যে, রঙের জন্যে। রেমব্রাঁ, মিলেট, দেলাক্রোয়া, মারিস—এদের জীবনের নাড়িনক্ষত্র সে একদা জানত, কত নেশা ছিল ছবি দেখার, বুঝতে চেষ্টা করার, ছবির প্রিন্ট সংগ্রহ করার! সে-শখ তার ঘুচল কী করে? আবার কি সে রেখাপাগল হবে না, হবে না রংমাতাল?

পরদিন শেষরাত্রের অন্ধকারে উঠে সে ঘর ছেড়ে বার হয়ে বসে রইল মার্কাসের গেটের ধারে সেই ভাঙা চাকাটার ওপর। সঙ্গে পেনসিল ও কয়েকটা কাগজ। প্রত্যুষের আধো-অন্ধকারে কয়লাকুলিরা খনির মধ্যে ঢুকতে লাগল। ভিনসেন্ট ত্বরিত হাতে কাগজের ওপর বুলোতে লাগল পেনসিলের রেখা। চলমান যাত্রীদল, তারা দাঁড়িয়ে নেই, তারা নির্বিশেষ। সব যখন চলে গেল, ততক্ষণে ভিনসেন্ট তার কাগজে সংগ্রহ করেছে পাঁচটি মনুষ্যমূর্তির আভাস। তাদের মুখ নেই, তারা শুধু সারা বরিনেজের শ্রমিকজীবনের ছায়ানিদর্শন। তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে এল ভিনসেন্ট। এই ছবি তো তার আয়ত্তের মধ্যেই! এই পঞ্চমূর্তি, এদের তো সে চেনে, এদের ভাবভঙ্গি, চিন্তাভাবনা, আশা-নিরাশা—সবকিছু তো সে জানে! তবু রেখায় কেন এরা ধরা দেয় না তার কাছে? এড়িয়ে থাকবে আর কতদিন?

দেহ-গঠন সম্বন্ধে ভিনসেন্টের বিন্দুমাত্র জ্ঞান নেই, সামঞ্জস্যহীন কিম্ভুত অবয়ব, অপটু হাতের রেখাগুলি এমনি বীভৎস যে তা দেখে হাসি আসাও শক্ত। তবু এইটুকুই সে বোঝে যে শুধু মানুষ সে আঁকছে না, আঁকছে বরিনেজের কয়লাখনির মানুষ। আঁকে, আবার মুছে ফেলে, আবার আঁকে। নিতান্ত সহজ একটা ছবিকে কপি করে অনেকক্ষণ ধরে বসে বসে। মেঘলা আকাশের গায়ে একলা একটি গাছ—এই হল ছবিটির বিষয়বস্তু। কিছুতেই ঠিকমতো কপি করতে পারে না। বুঝতে শেখেনি যে এত সহজ বলেই শক্ত, স্রষ্টা যত কৃপণ, তার অনুকারীর বিপদও ততটা। কপি করা ছেড়ে আবার শুরু করে নিজে থেকে আঁকতে।

সারা সকাল কাটল। ফুরিয়ে গেল কাগজ। পকেট হাতড়িয়ে দেখল দুটি ফ্র্যাঙ্ক আছে। পথে বার হল ভিনসেন্ট। ওয়ামসে না হোক নমসে অন্তত কিছু ভালো কাগজ আর শুকনো ভুসো কালি পাওয়া যাবে। অন্তত দশ মাইলের হাঁটা পথ। ভাবনা কী তাতে? গ্রামের রাস্তায় শ্রমিকবস্তির কয়েকটি মেয়ের সঙ্গে দেখা হয়। অনেক দিনের চেনা মুখ মনে পড়ে। খুশি মনে সম্ভাষণ জানায়। মাইল পাঁচেক হাঁটার পর ছোটো একটা শহর। সেখানে একটি রুটির দোকানের জানলায় মিষ্টি একটি মুখ চোখে পড়ে। মেয়েটিকে ভালো করে দেখবার জন্যে দোকানটিতে ঢোকে, সস্তা একটা বনরুটি কেনে।

মনসে এক ছবিওয়ালার দোকান থেকে সে একটা হলদে কাগজের মোটা প্যাড, মোটা একটা পেনসিল আর কিছুটা ভুসো কালি কিনল। দোকানটির এক কোণে একতাড়া ছবির প্রিন্ট। ছবিগুলো সে দেখতে লাগল এক-একটি করে। দোকানদারকে বললে–শুধু দেখব কিন্তু। কেনবার পয়সা নেই।

দোকানিও তার পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছবিগুলো দেখতে লাগল। উত্তরে বললে—বাঃ, দেখুন যত খুশি। আর শুধু আজই কেন, যেদিন খুশি আসবেন, যত খুশি ছবি দেখে যাবেন।

দশ মাইল ফিরতি পথ। নিজের গ্রামে পৌঁছোতে পৌঁছোতে বেলা গেল। কালো কালো পিরামিড-ঘেরা চক্রবালে সূর্য অস্ত যাচ্ছে, আকাশের মেঘে রক্তরাঙা পাড় বসানো। টিলার মাথায় মাথায় পড়ন্ত রশ্মির আলো, ছায়া-ঘেরা শান্ত সবুজ মাঠ কোথাও। ক্লান্তি সর্বশরীরে, কিন্তু কেমন যেন আমন্দ জেগেছে মনে, কীসের জন্যে তা সে জানে না।

.

পরদিন সকালে উঠেই ভিনসেন্ট কাগজ পেনসিল নিয়ে গেল মার্কাস খনি ছাড়িয়ে কয়লাপাহাড়ের ধারে। কোমর বেঁকিয়ে ঘাড় কুঁজো করে মেয়েরা কয়লাকুচি কুড়োচ্ছে, সারাদিন ভিনসেন্ট তাদের আঁকল।

রাত্রে খাওয়াদাওয়ার পর মাদাম ডেনিসকে সে বললে, বসুন আর একটু, চেয়ার ছেড়ে উঠবেন না। দেখুন না, কেমন একটা মজা দেখাই।

তাড়াতাড়ি ঘর থেকে কাগজ পেনসিল এনে সে মাদাম ডেনিসের ছবি আঁকতে শুরু করল। হল একটা কিম্ভূত মূর্তি। মাদাম বললেন—বাঃ, ঠিক আমারই ছবি হয়েছে তো!

মাথা নেড়ে ভিনসেন্ট বললে—না, ঠিক হয়নি। তবে হবে, ক-দিন সবুর করলেই দেখতে পাবেন।

এখন থেকে আবার সে শ্রমিকদের ঘরে ঘরে যেতে আরম্ভ করল, তবে আর বাইবেল হাতে নয়, কাগজ-ক্রেয়ন হাতে। শ্রমিকরা তাকে পুরোনো বন্ধুর সমাদর দিতে লাগল আবার। ঘরের মেঝেতে বাচ্চারা খেলা করে, বউ-ঝিরা কাজ করে উনুনের ধারে, দিনশেষে সারা পরিবার রান্নাঘরে খেতে বসে—ভিনসেন্ট ওদের ছবি আঁকে। কালো চিমনি, কালো মাঠ আর কালো লাট্টু পাহাড়, দূরের ধান খেতে লাঙল-চষা চাষি এদেরও ছবি আঁকে সে। যেদিন আবহাওয়া পথে বার হওয়ায় বাধ সাধে, সেদিন ঘরে বসে হয়তো প্রিন্ট থেকে কপি করে, নাহয় নিজেরই এলোমেলো স্কেচগুলোকে ভালো করে রূপ দিতে বসে। রাত্রে ঘুমের আগে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবে—একটা-দুটো ছবি সে বেশ ভালোই এঁকেছে। পরদিন সকাল বেলা সেই ছবি আবার যখন দেখে, তখন উৎসাহে ভাটা পড়েছে। নিজের কাজ দেখে নিজেরই লজ্জা করে। টুকরো টুকরো করে ছেঁড়ে ছবিগুলো, আবার আঁকতে বার হয়।

ব্যর্থতার যন্ত্রণা বন্য একটা জন্তুর মতো, তাকে সে বুকের খাঁচায় বন্দি করে রাখে। দুঃখের কথা সে ভাবে না, ভুলে থাকতে চায়, তাইতেই সে সুখী। বাপের ভাইয়ের মুখাপেক্ষী হয়ে জীবন কাটছে, এর লজ্জাটাকেও ভুলে গিয়ে শুধু ডুবে থাকতে চায় ছবি আঁকার মধ্যে।

কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তার দেয়ালের সবকটা ছবি বারে বারে কপি করে কেবল। থিয়ো তাকে এক বছরের ওপর চিঠি দেয়নি, তবু অভিমান জলাঞ্জলি দিয়ে সে ভাইকে লিখল মিলেটের ছবির একটা অ্যালবাম তাকে পাঠাবার জন্যে।

ক্রমে ভিনসেন্টের মনে বাসনা জাগল অপর একজন শিল্পীর সঙ্গে আলাপ করবার জন্যে। সে মনে মনে বোঝে যে তার ছবিগুলো কিম্ভূত, কিন্তু কোথায় তার ভুল আর কোথায় তার ঠিক, তার যাচাই হওয়া তো চাই। নিরপেক্ষ সমালোচক ছাড়া বলবে কী করে? হঠাৎ একদিন মনে পড়ল রেভারেন্ড পিটারসেনের কথা। তখন বর্ষণক্ষান্ত অপরাহু। তাড়াতাড়ি স্কেচের তাড়া থেকে খুঁজে খুঁজে বার করল নিজের আঁকা তিনটি ছবি। একটি একজন শ্রমিকের, দ্বিতীয়টিতে একটি কুলিবউ ঝুঁকে পড়ে উনুন ধরাচ্ছে রান্নাঘরে, আর তৃতীয়টিতে কালো পিরামিডের গায়ে দাঁড়িয়ে একটি বৃদ্ধা কয়লাদানা কুড়োচ্ছে। ছবি তিনটে গুছিয়ে নিয়ে সে ব্রুসেলস যাত্রা করল।

পকেটে মাত্র তিনটি ফ্র্যাঙ্ক সম্বল, ট্রেন ভাড়ার কথা ওঠেই না। হাঁটা-পথ প্ৰায় পঞ্চাশ মাইল। তৃতীয় দিন বিকেলে সে পৌঁছোল। এ দু-দিন সে প্রায় দিন-রাত হেঁটেছে, মাঝে মাঝে বিশ্রাম করেছে রাস্তার ধারে গা এলিয়ে দিয়ে। পায়ের পুরোনো জুতোটা হাঁ হয়ে যাবার ফলে ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত আঙুলগুলো, গায়ের কোটে চাবড়া কাদা, মাথায় ঝাঁকড়া চুলভরতি ধুলো আর ঝুল। পাংশু মুখ, কোটরাগত চোখ। তবু প্রাণে খুশির জোয়ার। শিল্পী সে, চলেছে আর-এক শিল্পীর সঙ্গে আলাপ করতে।

পিটারসেনের মেয়েটি দরজা খুলেই আগন্তুকের চেহারা দেখে আঁতকে উঠল। অস্ফুট আর্তনাদ করে দৌড় দিল বাড়ির ভিতরে।

রেভারেন্ড পিটারসেন দরজার সামনে এসে কয়েক মুহূর্ত ভালো করে দেখে ভিনসেন্টকে চিনতে পারলেন। হাসিমুখে দু-হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন—আরে, ভিনসেন্ট নাকি? এসো, এসো বাবা। কতদিন পরে! বড়ো খুশি হলাম তোমাকে দেখে।

তাড়াতাড়ি ভিনসেন্টকে পড়ার ঘরে নিয়ে গিয়ে নীচু একটা চেয়ারে বসালেন পিটারসেন। সঙ্গে সঙ্গে ভিনসেন্টের সহ্যের বাঁধ বুঝি ভেঙে গেল। সারা দেহমন ভেঙে নামল দু-দিনের শুকনো রুটি চিবিয়ে অবিরাম পায়ে হাঁটার প্রতিক্রিয়া।

পিটারসেন দেরি না করে প্রস্তাব করলেন—একটু পরিষ্কার হয়ে নিয়ে তারপর শুয়ে পড়ো এখন, পরে সব হবে। কী বলো?

নরম চেয়ারে বসে পড়ে পিঠের শিরদাঁড়াটা আর যেন সোজা হতে চায় না। নিশ্বাসও যেন আটকে আটকে আসছে। ভিনসেন্ট বললে—যা বলেন তা-ই। এতটা যে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি, এতক্ষণ কিন্তু বুঝতেই পারিনি!

পরদিন ঘুম থেকে উঠে পেটভরতি খাওয়ার পর ভিনসেন্ট মুখ খুলল। দেয়ালের স্কেচগুলোকে লক্ষ করে বললে—অনেক কাজ করে ফেলেছেন, না? এসব তো নতুন!

একমুখ হেসে পিটারসেন বললেন—হ্যাঁ, ধর্মপ্রচারের কাজের চেয়ে ছবি আঁকার কাজটাই আজকাল ভালো লাগছে বেশি।

ভিনসেন্ট পালটা প্রশ্ন করলে—কিন্তু বিবেকের দংশন? এতটা সময় যে নষ্ট করেন–

হো-হো করে হেসে উঠলেন পিটারসেন—রুবেনসের সেই গল্পটা, তোমার জানা আছে? রুবেনস তখন স্পেনে হল্যান্ডের রাজদূত। প্রত্যেক দিন বিকেলে তাঁর প্রাসাদের বাগানে তিনি ছবি আঁকেন। স্পেনের রাজসভার একজন হোমরাচোমরা একদিন ঠাট্টা করে বললেন—কূটনীতিবিশারদের আবার ছবি আঁকার খেয়াল দেখছি যে! রুবেনস উত্তর দিলেন—আজ্ঞে না, আপনি যা দেখেন তা হচ্ছে ছবি-আঁকিয়ের মাঝে মাঝে কূটনীতিজ্ঞ হবার খেয়াল।

ভিনসেন্ট সলজ্জভাবে প্যাকেটটা খুলল। বললে—আজকাল আমিও কিছু কিছু স্কেচ করছি। তিনটি স্কেচ আমি সঙ্গে এনেছি। আপনি একটু দেখে দেবেন?

নতুন শিল্পীর উন্মাদনায় খুঁত ধরা বড়ো বিড়ম্বনার কাজ। ছবি তিনটি পিটারসেন, সযত্নে ইজেলের ওপর রাখলেন। তারপর দূর থেকে দেখতে লাগলেন নিবিষ্ট দৃষ্টিতে। গলা শুকিয়ে এল ভিনসেন্টের।

বেশ কিছুক্ষণ পরে পিটারসেন বললেন—প্রথমেই আমার মনে হচ্ছে যে তুমি তোমার মডেলের খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ছবি আঁক। কেমন, তা-ই না?

আজ্ঞে হ্যাঁ। অধিকাংশ ছবিই আমাকে আঁকতে হয় শ্রমিকদের ছোটো ছোটো খুপরির মধ্যে।

ঠিক, সেইজন্যেই দেখছি তোমার আঁকায় পার্সপেক্টিভের অভাব। এমন একটা জায়গা ঠিক করতে পার না যেখানে তোমার মডেলের কাছ থেকে বেশ কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে ছবি আঁকতে পারবে?

হয়তো পারব। কয়েকটা ফাঁকা কেবিন আছে বেশ বড়ো বড়ো। সস্তায় ভাড়া পেতে পারি। সেই হবে আমার স্টুডিয়ো।

বাঃ, চমৎকার হবে তাহলে।

চুপ করে আরও কিছুক্ষণ ছবিগুলি নিরীক্ষণ করতে লাগলেন। তারপর আবার প্রশ্ন করলেন—তুমি কি কখনও ড্রয়িং শিখেছ? আঁকবার আগে কি কাগজের সঙ্গে বিষয়বস্তুকে মিলিয়ে নেবার জন্যে কাগজে মাপজোখ করে নাও?

লজ্জায় পাণ্ডুর হয়ে ভিনসেন্ট উত্তর দিল—দেখুন এসব আমি কিছুই জানিনে। আমার ধারণা, কাগজ পেনসিল নিয়ে শুরু করলেই আঁকতে পারা যায়।

তা কী করে সম্ভব ভিনসেন্ট? ড্রয়িংয়ের প্রাথমিক নীতি আর পদ্ধতিগুলো তো আগে আয়ত্ত করা চাই! তবেই না আস্তে আস্তে আঁকাটা সঠিক হবে! এই দেখো, ড্রয়িংয়ে তুমি ভুল করেছ কোথায়—

পেনসিল আর রুলকাট নিয়ে পিটারসেন স্ত্রীলোকের ছবিটার মুখ ও দেহ ঘিরে চতুর্ভুজ আঁকলেন। শরীর ও মুখের মধ্যে যে কোনো আয়তনিক সামঞ্জস্য নেই তা তিনি ভিনসেন্টকে বুঝিয়ে দিলেন। তারপর শরীরের অনুপাতে নতুন করে মাটিতে আঁকতে লাগলেন। বোঝাতে বোঝাতে আর আঁকতে আঁকতে একঘণ্টা কাটল। তারপর কয়েক পা পিছিয়ে ছবিটা ভালো করে দেখে বললেন—দেখো দিকিনি? এবার মনে হচ্ছে দেহের ওপর মাথাটা ঠিক বসেছে।

ঘরের অপর দিকে গিয়ে পিটারসেনের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ভিনসেন্ট ছবিটা দেখতে লাগল। সত্যিই ছবিটা দাঁড়িয়েছে ভালো, মাথার সঙ্গে অন্যান্য অবয়বের চমৎকার সামঞ্জস্য, কোনো ব্যতিক্রম নেই। কিন্তু ভিনসেন্টের মনে হল–বরিনেজের সেই কয়লাকুড়ুনি মেয়েটি কোথায় যেন হারিয়ে গেছে, এ যেন যেকোনো একটি সুষ্ঠুভাবে আঁকা হেঁট হয়ে দাঁড়ানো সারা পৃথিবীর যেখানকার হোক যেকোনো একটি মেয়ে, আর-কিছু নয়।

ভিনসেন্ট কোনো কথা বলল না, ইজেলের সামনে গিয়ে এ-ছবিটির পাশে তার দ্বিতীয় ছবিটি রাখল, যেটিতে শ্রমিকবধূ উনুন ধরাচ্ছে। তারপর ফিরে এসে দাঁড়াল পিটারসেনের পাশে।

পিটারসেন অনেকক্ষণ ধরে পাশাপাশি দুটো ছবি দেখলেন। পরে বললেন–এবার বুঝতে পেরেছি গোলমালটা হয়েছে কোথায়। তুমি ভাবছ যে আগেকার ছবিটা আমি সংস্কার করে দিয়েছি, সুন্দর করে দিয়েছি বটে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ছবির যা চরিত্র তাকে নষ্ট করেছি, তা-ই না? হ্যাঁ, হয়তো মিথ্যে নয়। আমি ঠিক বুঝতে পারছিনে, তোমার এই দ্বিতীয় ছবিটা কেন আমাকে টানছে। সত্যি বলতে, জঘন্য তোমার ড্রয়িং, মুখটা যে এঁকেছ তা তো মুখ বলেই মনে হয় না। কিন্তু তবু তোমার স্কেচটার মধ্যে কী যেন একটা আছে যাকে অনুকরণ করা আর কারও পক্ষে সম্ভব নয়। কী সেটা বলো তো?

কী করে বলব বলুন? আমি তো যা দেখেছি তা-ই আঁকবার চেষ্টা করেছি। পিটারসেন তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেলেন। ইজেল থেকে প্রথম ছবিটি সরিয়ে নিয়ে সেটাকে ছিঁড়ে ফেললেন। দ্বিতীয় ছবিটাই শুধু রইল চোখের সামনে। বললেন—ছিঁড়লাম বলে কিছু মনে কোরো না। ছবিটা তো আমি নষ্টই করে ফেলেছি।

আবার অনেকক্ষণ ছবিটার দিকে তাকিয়ে আপনমনে বিড়বিড় করার পর পিটারসেন বললেন—ভিনসেন্ট, সত্যি বলব এমন কুৎসিত ড্রয়িং আমি কখনও দেখিনি। আর্ট স্কুলের নতুন-ভরতি ছেলেও এ-ড্রয়িং দেখে হাসবে, মাস্টার এটাকে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়বে। কিন্তু তবু কেন জানিনে মেয়েটা আমাকে টানছে। চোখ ফেরাতে পারছিনে, ও যেন আমার অনেক দিনের চেনা।

আস্তে আস্তে ভিনসেন্ট বললে—ওকে আপনি দেখেছেন রেভারেন্ড; বিস্মৃতির পার থেকে ও আপনার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।

কোথায় দেখেছি বলো তো?

হয়তো বরিনেজে।

চমকে ভিনসেন্টের দিকে তাকালেন পিটারসেন। তারপর বললেন–ঠিক বলেছ, দেখেছি ওকে। ওর মুখ নেই, কিন্তু মূর্তি আছে। ও বিশেষ কোনো মেয়ে নয়। তোমার বরিনেজের সবকটি শ্রমিকবধূর ও প্রতিভূ। ওকে তুমি খুঁজে পেয়েছ, প্রকাশ করেছ, এর দাম হাজারটা নির্ভুল ড্রয়িংয়ের চেয়ে বেশি। ও বিশেষ কোনো মেয়ে নয়, নামহীনা চিরন্তনী। ওর গুরুত্ব এতক্ষণে আমার প্রাণে সোজাসুজি এসে বাজছে।

ভিনসেন্টের বুক দুরুদুরু করতে লাগল। পিটারসেনের প্রশংসা, পিটারসেন অভিজ্ঞ শিল্পী, সত্যিই তার ছবিটার কোনো দাম আছে তাহলে!

পিটারসেন আবার বললেন—ছবিটা আমাকে দেবে নাকি ভিনসেন্ট? আমি বাঁধিয়ে দেয়ালে টাঙিয়ে রাখব। মেয়েটার সঙ্গে ভাব করতে ইচ্ছে করছে যে!

১৪

ছবির বই এল থিয়োর কাছ থেকে, কিন্তু এক লাইনও চিঠি নয়। প্রবল উৎসাহে ভিনসেন্ট ছবিগুলো কপি করা শুরু করল। এ ছাড়া পিটারসেনের নির্দেশমতো সে একটা ফাঁকা কুটির ভাড়া নিয়ে ডেনিসদের বাড়ি ছেড়ে সেখানে উঠে গেল। এই তার স্টুডিয়ো আর আস্তানা একসঙ্গে। দেয়ালের এক ধারে মডেলকে দাঁড় করিয়ে অন্যদিকের দেয়ালের কাছে দাঁড়ালে মাঝে যথেষ্ট জায়গা থাকে। এই দূরত্বটুকুর জন্যে দৃশ্যমান বস্তুকে সঠিক আকারে দেখা যায়। শ্রমিকদের বউ-ঝিরা ঘণ্টার পর এক পা পাড়ুয়ে তাকে ছবি আঁকায় সাহায্য করে। রবিবার দিন শ্রমিকরা ভিড় করে আসে, ভিনসেন্ট দ্রুতগতিতে একের পর এক স্কেচ করতে থাকে। আঁকার সময় জোড়া জোড়া কৌতূহলী চোখ পেছনে ভিড় জমায়।

দিনের পর দিন শেষরাত্রে আড়াইটের সময় সে মার্কাসের গেটের সামনে গিয়ে অপেক্ষা করে। আধো অন্ধকারে কাঁটাবেড়ার পাশ দিয়ে সরু পথ ধরে মেয়ে-পুরুষ শ্রমিক খনির হাঁয়ের মধ্যে ঢোকে। সে বড়ো বড়ো ড্রয়িং করে এইসব আগন্তুক শ্রমিকদের। খনির বাড়ি, ক্রেন, কালো পাহাড় প্রভৃতি সে ফুটিয়ে তোলে ছবির পেছনদিকে আকাশের গায়ে। একটা বড়ো ড্রয়িং খুব যত্ন করে এঁকে সে থিয়োর কাছে পাঠিয়ে দিল।

জীবনের পুরোনো ব্যর্থতার বেদনা সে আস্তে আস্তে ভোলে। নতুন নেশা আবার প্রাণে খুশির জোয়ার তোলে। শিল্পের নেশা, সৃষ্টির নেশা। পরমুখাপেক্ষী জীবনে কতদিন পকেটে পয়সা থাকে না, মাদাম ডেনিসের কাছ থেকে ধার করা শুকনো রুটি চিবিয়ে কাটাতে হয়, কিন্তু দুঃখ নেই তাতে। পেটে ক্ষুধা থাকলেই-বা কী? মন যে দিনে দিনে সুধায় ভরে উঠছে।

দু-মাস কাটল আরও। প্রত্যুষ থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সে আঁকে নিজের মতো করে, আর রাত্রি বেলা আলো জ্বেলে বসে কপি করে। এরপর আবার তার প্রাণে জেগে উঠল অন্য একজন শিল্পীর সঙ্গে দেখা করার আর তার সঙ্গে আলোচনার বাসনা। কেননা এঁকে তো সে চলেইছে, কিন্তু এগোচ্ছে কি না এও ঠিক যে বুঝতে পারছে না। যদি শিক্ষকের মতো শিক্ষক একজন পেত তাঁর সে জুতো পালিস করত, ঘর ঝাঁট দিয়ে দিত দিনে দশ বার এই শিক্ষার বিনিময়ে।

ছেলেবেলা থেকে ভিনসেন্ট শিল্পী হিসেবে জুলি ব্রিটনকে শ্রদ্ধা করে এসেছে। তিনি থাকেন যে-শহরে তা বরিনেজ থেকে একশো মাইলের বেশি দূরে। ভিনসেন্ট যাত্রা করল তাঁর কাছে। কিছুটা পথ ট্রেনে যাবার মতো ভাড়া ছিল, তারপর পাঁচ দিন সে দিনে হাঁটল, রাত্রে আশ্রয় নিল কোনো-না-কোনো চাষির খামারে খড়ের গাদায়। শেষ পর্যন্ত যখন এল কুরিয়ার্স শহরে বৃক্ষছায়ায় ঘেরা জুলি ব্রিটনের লাল টুকটুকে বিরাট বাড়ির সামনে, হঠাৎ যেন তার সর্বশক্তি লোপ পেল, আতঙ্কে কেঁপে উঠল বুক। অপরিচিত সে, অত বড়ো শিল্পীর স্টুডিয়োর দরজায় করাঘাত করার ভরসা সে পেল না। রেভারেন্ড পিটারসেনের দেওয়া বুটজুতোটা ছিঁড়ে এসেছে, কপর্দকশূন্য পকেট, সে আবার শুরু করল প্রত্যাবর্তন। বরিনেজে নিজের কুটিরে শেষপর্যন্ত যখন সে আবার পৌঁছোল, তখন জ্বরে তার সর্বাঙ্গ পুড়ে যাচ্ছে, থরথর করে কাঁপছে হাত পা। কোনো চিঠি আসেনি, কোনো টাকা আসেনি বাড়ি থেকে। মলিন বিছানায় সে লুটিয়ে পড়ল। শ্রমিকদের স্ত্রীরা পালা করে তার সেবা করতে লাগল, নিজেদের স্বামী-সন্তানের মুখের খাবার থেকে যা পারে বাঁচিয়ে এনে তাকে খাওয়াতে লাগল।

শরীর যত ভেঙেই পড়ুক মাথাটা খারাপ হয়নি। বুঝতে পারছে, এমনি করে আর দিন চলবে না। ফিরে যেতেই হবে। কোথায় যাবে! ইটেনে যাবে বাবা-মার কাছে? প্যারিসে, থিয়োর সান্নিধ্যে? আমস্টার্ডামে, কাকার আশ্রয়ে? করবে কী? চাকরি, দোকানদারি, কেরানিগিরি, স্কুলমাস্টারি—এদের মধ্যে কোনটা আবার বেছে নেবে?

দুর্বল মস্তিষ্কে ভাবনাস্রোত ভেসে চলে। কূল মেলে না কোনো। এমনি দিনে হঠাৎ একদা তার জীর্ণ ঘরের দরজা ঠেলে কে একজন ঢুকল।

তার ভাই থিয়ো।

১৫

ক-বছরে থিয়ো বদলেছে অনেক। মুখে চোখে ফুটে উঠেছে সাফল্যের ছাপ। বয়স তার মাত্র তেইশ, এরই মধ্যে প্যারিসে ভালো ছবিবিক্রেতা হিসেবে সে নাম কিনেছে, আত্মীয়স্বজন সকলের কাছে তার খাতির খুব। পোশাকে, আচরণে, কথাবার্তায় সে পুরোদস্তুর কেতাদুরস্ত। গায়ে তার হালফ্যাশনের কালো কোট, চকচকে কালো সাটিনের ল্যাপেলওয়ালা, তার নীচে উঁচু কলারের শার্ট, মস্ত ফাঁস বাঁধা সাদা রঙের টাই। ভ্যান গক পরিবারের আর সকলের মতো চওড়া কপাল তারও। এ-দিকে ব্রাউন রঙে পাতলা ঢেউ খেলানো চুল, নরম নরম চোখ, ছিপছিপে মেয়েলি চেহারা।

দরজা ঠেলে ঢুকেই থিয়ো থমকে দাঁড়াল, বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত। মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে সে প্যারিস ছেড়েছে, সেখানে তার বাড়িতে আসবাবে সাজসজ্জায় সৌখিন স্বাচ্ছন্দ্যের সমারোহ। এখানে এই ভাঙা ঘরের মেঝেতে মলিন নোংরা একটা তোশকের ওপর ছেঁড়া একটা কম্বলে বুক পর্যন্ত ঢেকে বিশীর্ণ প্রেতদেহ নিয়ে শুয়ে আছে তারই ভাই ভিনসেন্ট। ফাটা তক্তার দেয়াল, ঘরের কোণে আসবাব বলতে মাত্র এবড়োখেবড়ো একটা টেবিল আর ভাঙা একটা চেয়ার।

শীর্ণকণ্ঠে ভিনসেন্ট বললে—এসো থিয়ো, কী খবর?

থিয়ো তাড়াতাড়ি এগিয়ে বিছানার ধারে ঝুঁকে পড়ে বললে—ব্যাপার কী ভিনসেন্ট? তোমার চেহারা এ ‘কী হয়েছে?

কিছু না। মাঝে একটু অসুখে পড়েছিলাম, এখন ভালো আছি।

কিন্তু এই—এই গর্ত? এরই মধ্যে তুমি থাক নাকি?

কেন, খারাপ নাকি? এই তো আমার ঘর, এই তো আমার স্টুডিয়ো।

ও ভিনসেন্ট! ভাইয়ের কপালে থিয়ো ডান হাতটা রাখল। উদ্‌গত অশ্রুবাষ্পে তার মুখ দিয়ে আর-কোনো কথা বার হল না।

আস্তে আস্তে ভিনসেন্ট বললে একটু পরে—ঠিক তুমি এসে পড়লে থিয়ো, তা-ই না! ভারি ভালো লাগছে আমার!

আচ্ছা এবার বলো তো ভিনসেন্ট তোমার কী হয়েছে? শরীরটা এতটা ভাঙল কেমন করে?

ভিনসেন্ট তার কুরিয়ার্স যাত্রার কাহিনি শোনালে।

থিয়ো বললে—বুঝেছি এবার। আসলে তোমার অসুখ দুর্বলতা। ওখান থেকে ফিরে এসে অবধি পেট ভরে খেয়েছ একদিনও? দেখাশুনো কে করছে তোমার?

লোকের অভাব নেই। শ্রমিকবউরা খুব যত্ন করে আমার সেবা শুশ্রূষা করছে বই কী!

তা তো বুঝলাম, কিন্তু পথ্য? খাবারদাবার কিছু তো দেখছিনে ঘরে। ওরাই রোজ এনে দেয় কিছু কিছু। যেটুকু পারে—একটু রুটি, কফি, কখনও একটু পনির। তাতেই চলে যায়।

কিন্তু ভিনসেন্ট, রুটি আর কফি খেয়ে তোমার শরীর সারবে কী করে? মাংস, ডিম, মাখন—এসব কিনতে পার না?

কেন পারব না ভাই? তবে কিনা দাম দিতে হয় যে! এসব ভালো ভালো খাবার, দাম তো কম নয়! ঠিক কিনা বলো?

আবার যেন গলা বুজে এল থিয়োর। বিছানার ধারে বসে ভাইয়ের হাতটা চেপে সে বললে—মাপ করো আমাকে ভাই, মাপ করো আমাকে। তোমার এমনি অবস্থা আমি ধারণাই করতে পারিনি!

ছিঃ, ভিনসেন্ট বললে কী আবার অবস্থা আমার, দু-দিন পরেই তো আবার চাঙ্গা হয়ে উঠব। নাও এবার তোমার খবর সব বলো। প্যারিস কেমন লাগছে? ইটেনে গিয়েছিলে নাকি সম্প্রতি?

চকিতে চোখ মুছে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল থিয়ো, বললে—চুপ করে শুয়ে থাকো আমি যতক্ষণ না আসি। নোড়ো না একদম।

আধঘণ্টাটাক পরে থিয়ো ফিরে এল। সঙ্গে দুটো ছেলে, তাদের হাতে নানান জিনিসপত্র। শহরে গিয়েছিল, সেখান থেকে কিনে এনেছে বিছানাপত্র, পোশাক, বাটি. গেলাস, ডিশ আর খাবারদাবার।

গা থেকে কোটটা খুলে সে জিজ্ঞাসা করল—তোমার উনুনটা কী করে ধরাও বলো তো?

ভিনসেন্ট বললে—→ গোড়ার খানিকটা কাঠকুটোয় আগুন ধরিয়ে তারপর ওই যে কয়লা রয়েছে, চাপিয়ে দাও।

কয়লা? গুঁড়োগুলোর দিকে তাকিয়ে থিয়ো বললে–একে তোমরা কয়লা বল নাকি?

হ্যাঁ, ওই আমাদের কয়লা। থাক থাক, তুমি পারবে না। দাঁড়াও আমি উঠছি।

খবরদার! চুপটি করে শুয়ে থাকো বিছানায়। নড়বে তো মার দেব।

ভাইয়ের ধমক শুনে হাসি এল ভিনসেন্টের, অনেক দিন পরে প্রাণে খুশির আমেজ। চুপ করে শুয়ে শুয়ে সে দেখতে লাগল। উনুনটা ধরাল থিয়ো। নতুন কেনা একটা বাটিতে সে সেদ্ধ করল একজোড়া ডিম, একটা বাটিতে রাঁধল কিছুটা সবজি, আর-একটা বাটিতে ফোটাল দুধ। তারপর উনুনের ওপর টোস্টার চাপিয়ে কয়েক খণ্ড রুটি কেটে নিয়ে তাদের পিঠে লাগাল মাখনের পালিস।

পথ্য রান্না শেষ করে থিয়ো টেবিলের ওপর সাদা তোয়ালে পেতে তার ওপর খাবারদাবার সাজাল। টেবিলটা বিছানার কাছে টেনে এনে বললে—মাও, মাথা তোলো, খাইয়ে দিই।

কী ছেলেমানুষি করছ? আমি নিজে খেতে পারিনে?

আবার অবাধ্য হচ্ছ? ভয় নেই বুঝি? যা বলছি লক্ষ্মীছেলের মতো করো। কথাটি নয়।

থিয়ো আস্তে আস্তে খাইয়ে দিতে লাগল ভিনসেন্টকে। কতদিন পরে সত্যিকারের খাদ্যের স্বাদ সে মুখে পাচ্ছে! কতদিন পরে পাচ্ছে স্নেহ-মমতার করুণ স্পর্শ! খাওয়া শেষ হতে আরামের দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে আবার এলিয়ে পড়ল বালিশে, বললে—আঃ, সত্যি, খাবার খেতে চমৎকার! ভুলেই গিয়েছিলাম কেমন লাগে।

কপট বিরক্তিতে গলা চড়িয়ে উত্তরে বললে থিয়ো—থাক থাক, খুব হয়েছে, ভোলাচ্ছি তোমাকে এবার থেকে!

এবার বলো থিয়ো সব খবর। কেমন আছ তোমরা সবাই? গুপিল কেমন চলছে? কতদিন যে আমি দুনিয়াছাড়া হয়ে আছি!

কথা পরে হবে ভিনসেন্ট। এখন তুমি ঘুমোও। নাও, এই ওষুধটা খাও, তাহলেই ঘুম আসবে। তারপর সব কথা শুনো।

সূর্যাস্ত পর্যন্ত ভিনসেন্ট ঘুমোল অকাতরে। চোখ খুলে দেখে, জানলার ধারে চেয়ারটার ওপর বসে থিয়ো তার আঁকা স্কেচগুলো দেখছে। নিঃশব্দে শুয়ে রইল সে কতক্ষণ, সুস্থ লাগছে শরীর, ভারি তৃপ্তি, শান্তি লাগছে প্রাণে।

তার দিকে চোখ পড়তে মুচকি হেসে থিয়ো বললে—ঘুম ভাঙল তাহলে! কেমন লাগছে এখন?

ভিনসেন্ট বললে—ছবিগুলো দেখছিলে? কেমন লাগল? হচ্ছে কিছু?

ও-কথা পরে হবে। ঘুম যখন তোমার ভাঙল তখন আমারও মাংস চড়াবার সময় হল। আলুগুলো আগেই ছাড়িয়ে রেখেছি—ও হ্যাঁ, তোমারও কাজ আছে, দাঁড়াও বলছি–

উনুনের ওপর থেকে একগামলা গরম জল নামিয়ে সে বিছানার ধারে আনল, বললে—তোমার দাড়ি কামানোর ক্ষুর কোথায়?

ভিনসেন্টের কোনো আপত্তি থিয়ো শুনল না, নিজের হাতে তার দাড়ি কামিয়ে, মাথা মুখ ঘাড় ধুয়ে দিল। ফরসা শার্ট চড়াল তার গায়ে, মাথার চুলগুলো আঁচড়ে দিল সুন্দর করে। বললে—হ্যাঁ, এইবার ঠিক ভ্যান গকের মতোই দেখাচ্ছে।

তা তো দেখাচ্ছে। কিন্তু ও-দিকে মাংস তোমার পুড়ে গেল কি না দেখো!

খাওয়াদাওয়া শেষ করে দুই ভাই বিছানার ধারে বসল। প্যারিস থেকে আনা টাটকা সুগন্ধ তামাক থিয়ো ভরে দিল ভিনসেন্টের পাইপে

সায়াহ্নের অন্ধকারে সেই ভাঙা ঘরের শয্যায় বসে বসে থিয়ো দেখতে লাগল তার ভাইকে। মনে পড়তে লাগল ব্রাবান্টে তাদের ছেলেবেলাকার দিনগুলি। সেদিনকার শৈশবজীবনে তার চোখে সবচেয়ে বড়ো সবচেয়ে প্রিয় ছিল তার এই . বড়োভাই ভিনসেন্ট—বাবার চেয়েও বড়ো, মার চেয়েও প্রিয়। ছেলেবেলাকার তার সমস্ত সুখস্মৃতি এই দাদাকে ঘিরেই। এই দাদাকে সে প্যারিসে বসে গত ক-বছর ধরে ভুলে বসেছিল, এ-ভুল জীবনে কখনও আর তার হবে না। ভিনসেন্টকেই যদি ভোলে, তবে তো জীবন তার অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। দাদা আর ভাই, এই যুগলজীবনের সম্পূর্ণতাতে ছেদ কখনও যেন না আসে। আজ সে বুঝতে পারছে, তাকে না পেলে তার দাদার যেমন চলে না, দাদার বিহনে সেও তেমনি রিক্ত, বঞ্চিত। যতদিন দুজনে পাশাপাশি ছিল, জীবন ছিল সুসংবদ্ধ। বাল্য থেকে প্রথম যৌবন পর্যন্ত একই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েছিল দুজনে, একই মূল্যবোধের সন্ধানে ও আবিষ্কারে চলেছিল পাশাপাশি। আজ সে একলা, একলা খাটছে, একলা সফল হচ্ছে, পয়সা করছে একলা। কিন্তু জীবনের ফাঁক তাতে ভরে না।

আবার সে ভিনসেন্টকে ফিরিয়ে আনবে নিজের কাছে, একান্ত আপনার করে। দাদা তার ঠিক যেন শিশু, কিছু বোঝে না, কিছু পারে না নিজের জন্যে করতে, তাইতে এমনি হাল হয়েছে। দাদাকে আবার সে খাড়া করবেই, দু-হাত দিয়ে তাকে তুলে ধরবে।

বললে—ভিনসেন্ট, ঠিক দুটো দিন তোমাকে আমি সময় দেব সুস্থ হবার জন্যে। তারপর তোমাকে আমার সঙ্গে নিয়ে যাব ইটেনে।

ভিনসেন্ট নিঃশব্দে পাইপ টানতে লাগল কিছুক্ষণ ধরে। সময় এসে গেছে, আর এড়ানো চলবে না, মীমাংসা করতেই হবে। কিন্তু কেমন করে, সে বোঝাবে ভাইকে? শুধু কথা দিয়ে? ভাই কি হৃদয় দিয়ে বুঝবে তার হৃদয়ের কথা?

একটু পরে শান্ত গলায় সে বললে—থিয়ো, আবার বাড়িতে আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাও কেন? সারা পরিবারের কাছে আমি একটা অসহ্য আর সন্দেহজনক মানুষ, আমার ওপর ওদের কারও আস্থা নেই। তাই ওদের কাছ থেকে আমি দূরে সরে আছি। দূরে সরে থাকাই আমার ভালো, যতটা দূরে হয়, একেবারে না-থাকার প্রান্তে।

আবার সে বললে—আছি কী নিয়ে জান? আত্মবিশ্বাস নিয়ে, সেটা কিন্তু ঘোচেনি। স্বীকার করি, মন আমার বড়ো চঞ্চল। ধৈর্য নেই, স্থৈর্য নেই, যেখানে চুপ করে অপেক্ষা করাটাই বুদ্ধির কাজ, সেখানে আমি অস্থির হয়ে উঠি, দৌড়ঝাঁপ করে যা খুশি একটা-কিছু করে বসি। তা সত্ত্বেও, আর যে যাই আমাকে ভাবুক, আমি কিন্তু মনে করিনে যে জীবন আমার বরবাদ হয়ে গেছে, আমার আর-কিছুই করবার নেই। জীবনের সার্থকতার পথ-আমিও খুঁজি বই কী, অপরের চোখে সে সার্থকতার দাম নগণ্য হোক না কেন। জিজ্ঞাসা করবে, আমি কী করি আজকাল? বই পড়ি আর ছবি দেখি, কত শেখবার আছে, শেখবার চেষ্টা করি। এরও দাম আছে। নেই কি?

আছে বই কী ভিনসেন্ট। কিন্তু তোমার এ-বয়সে বই পড়া আর ছবি দেখা, কাজ নয়, অবসর বিনোদন। জীবনযুদ্ধের আওতায় এ-কাজ পড়ে না। ধরো পাঁচ বছর ধরে তুমি বেকার হয়ে এ-দিক ও-দিক ঘুরে বেড়াচ্ছ। কোথায় উঠবে, না ভেবেই চলেছ দিনের পর দিন। এটা কি ভালো?

হাতে খানিকটা তামাক নিয়ে তালুতে পাকিয়ে পাইপে ভরল ভিনসেন্ট। তারপর পাইপটা জ্বালাতে ভুলে গিয়ে বললে—কখনও দু-পয়সা রোজগার করেছি, আর কখনও পরের কাছে হাত পেতে মুষ্টিভিক্ষা নিয়েছি। দরিদ্রকে কে বিশ্বাস করে, দারিদ্র্য যার নিত্যসঙ্গী? কিন্তু তুমি অন্তত বিশ্বাস করো ভাই, নেমে আমি একেবারে যাইনি। হয়তো আমার কাজের পথ ভাগ্য এতদিনে আমাকে চিনিয়েছে, সেই পথেই এবার আমি যাব।

বিশ্বাস করতে আমার আপত্তি নেই ভিনসেন্ট, যদি তোমার মনের কথাটা ঠিক করে আমাকে বোঝাতে পার।

পাইপটা ধরাল ভিনসেন্ট। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রুদ্ধকণ্ঠে বললে—মনে পড়ে রাইসউইকের জাঁতাকলের পেছনদিককার রাস্তায় যখন আমরা বেড়াতাম? তখন কত মনের কথা আমাদের হতো! বোঝবার কোনো অসুবিধে হতো না তখন!

কিন্তু ভিনসেন্ট, তারপর থেকে তুমি অনেক বদলে গেছ যে!

ঠিক তা নয়। তখন আমার জীবন অনেক সহজ ছিল এখনকার চেয়ে, এইটুকু মাত্র পরিবর্তন। আমার দৃষ্টিভঙ্গি আর মনোভাব তখন যেমন ছিল, এখনও তেমনি আছে, একটুও বদলায়নি। বিশ্বাস করো থিয়ো, আমি অবিশ্বাসী নই, আমি ছন্নছাড়া নই। আপাতদৃষ্টিতে এই যে আমার ব্যর্থ জীবন, এ চরিতার্থ হবেই। কী করে হবে, তা-ই আমার একান্ত চিন্তা।

থিয়ো উঠে গিয়ে কেরোসিনের আলোটা জ্বালল। গ্লাসে খানিকটা গরম দুধ ঢেলে ভিনসেন্টের সামনে ধরল। বললে—নাও, খেয়ে ফেলো এটুকু। হাঁপিয়ে পড়েছ কথা বলতে বলতে!

একচুমুকে দুধটা শেষ করল ভিনসেন্ট। মুখটা মোছবার অবসর না নিয়ে আবার সে বলে চলল—ভেবে দেখো থিয়ো, অন্তরের গভীরে পথ খোঁজার এই যে চিন্তা, বাইরে তার কতটুকু আভাস ফুটে ওঠে? অন্তর্যাতনা যেখানে অগ্নিশিখার মতো জ্বলছে, সেখানে অন্য লোকের চোখে হয়তো পড়ছে কিছুটা ধোঁয়া আর কিছুটা কালি। কিন্তু তা-ই বলে অন্তরের সেই শিখাকে নিবিয়ে দেব, না নিঃস্ব একাকিত্বের মধ্যেও চেষ্টা করব তাকে অনির্বাণ রাখতে?

থিয়ো বিছানার ধারে এসে আবার বসল। বললে–হঠাৎ আমার চোখের সামনে কী একটা দৃশ্য ফুটে উঠল জান?

কী দৃশ্য ভাই?

রাইসউইকের সেই জাঁতাকলটা…

ভারি চমৎকার কলটা ছিল, তাই না?

হ্যাঁ।

আর আমাদের ছেলেবেলা? সেটাও খুব চমৎকার ছিল না?

হ্যাঁ, আমার ছেলেবেলার দিনগুলো তুমিই ভরে রেখেছিলে ভিনসেন্ট। তখনকার স্মৃতি সবই তো তোমাকে জড়িয়ে–

কেরাসিন লন্ঠনের মৃদু আলো। কাঠের ঘরের কোণে কোণে আবছায়া অন্ধকার। ভিনসেন্টের চোখে ব্যাকুল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থিয়ো বললে—তোমার সম্বন্ধে যত কথা উঠেছে ভিনসেন্ট, তা আর-সব আত্মীয়স্বজনদের কথা, আমার কথা নয়। আমি এখানে এসেছিলাম এই ভেবে যে, দেখি তোমাকে ধরে নিয়ে গিয়ে কোনো চাকরিতে লাগিয়ে দিতে পারি কি না।

আমার সম্বন্ধে যারা যা ভাববে তারা তা ভাববেই। কিন্তু তুমি যে আমার মতো হওনি, কর্মী হয়েছ কৃতী হয়েছ, সকলে তোমার সুখ্যাতি করছে, এতেই ।আমার আনন্দ। তবু শেষ পর্যন্ত বলব, আমার ওপর তুমি অন্তত একটু আস্থা রেখো থিয়ো।

থিয়ো বললে—ছেলেবেলা থেকে তুমি আমার আদর্শ ছিলে, তোমার হাত ধরে আমি বেড়িয়েছি, সে যেমন জীবনে কখনও ভুলব না, তেমনি তোমার ওপর আস্থাও কখনও আমার যাবে না।

অকপট আনন্দে উদ্ভাসিত মুখে ভিনসেন্ট উত্তর দিলে—অনেক দাম তুমি দিলে থিয়ো। ধন্যবাদ তোমাকে, ধন্যবাদ।

হঠাৎ যেন সব ভাবোন্মত্ততা ঝেড়ে ফেলল থিয়ো।

শোনো ভিনসেন্ট। এবার কাজের কথায় আসা যাক। তোমার এত কথার ফাঁকে ফাঁকে আসল ব্যাপার আমার যা মনে হয়েছে তা হচ্ছে এই যে, তুমি নির্দিষ্ট কোনো একটা কাজ করতে চাও, যে-কাজে তুমি তৃপ্তি পাবে। কী সে-সাধনা? তুমি জান, আমার মাইনে গত দেড় বছরে দু-বার বেড়েছে। টাকা নিয়ে আমি কী করব জানিনে। তুমি যা চাও আমি তোমাকে দেব। অস্বচ্ছলতার কথা তুমি ভাবতে পাবে না, অভাবে তুমি হাত গুটিয়ে বসে থাকবে না। কী তুমি চাও বলো। আমি তোমাকে সাহায্য করছি। আমি দেব মূলধন, তুমি দেবে কাজ। তোমার কাজের দামটা আমি এখন দেব, সময় যখন আসবে আমার লাভ আমি ঠিক পুষিয়ে নেব। মতি স্থির করে বলো—সারাজীবনের মতো এ-ব্যাবসায় আমার সঙ্গে তুমি লাগতে চাও?

জানলার ধারে ভিনসেন্টের গোছা গোছা স্কেচগুলো। বিকেল বেলা থিয়ো ওগুলো দেখছিল। ওগুলোর দিকে তাকাল ভিনসেন্ট। মন দুলছে কেমন একটা অবিশ্বাস্য সম্ভাবনার আশা-নিরাশার দোলায়, বিস্ময়ে বড়ো বড়ো হয়ে উঠেছে চোখ। সত্যি? এ কি সত্যি হবে? ঘুচবে দুর্ভাবনা, সাধনার পথ হবে নিত্য-নিষ্কণ্টক?

অস্ফুট গলায় সে বললে—এই কথাই আমি তোমাকে এতক্ষণ বলতে চাইছিলাম, কিন্তু পেরে উঠছিলাম না থিয়ো।

ভিনসেন্টের দৃষ্টি অনুসরণ করে ছবিগুলোর দিকে থিয়োও তাকাল। বললে–আমি কিন্তু অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিলাম।

উত্তেজনায় আনন্দ-আবেগে থরথর করে কাঁপতে লাগল ভিনসেন্ট। অন্ধ নিদ্রার তমসা থেকে সে যেন হঠাৎ জেগে উঠেছে, চোখ মেলেছে নবজীবনের সূর্যোদয়ে।

বুঝতে পেরেছিলে? আমি কিছুতেই মুখ ফুটে বলতে পারছিলাম না, তবু তুমি বুঝতে পেরেছিলে থিয়ো? শোনো থিয়ো, এতদিন পরে সত্যিই আমি আমার কাজ খুঁজে পেয়েছি, আমার সারাজীবনের সাধনা। ছবি আমাকে চিরকাল ভয়ংকর আকর্ষণ করেছে, কিন্তু নিজের হাতে কাগজ পেনসিল ধরবার সাহসটুকু হয়নি। ভয় করত, ছবি আঁকার খেয়াল হয়তো আমার আসল কাজে ক্ষতি করবে। অন্ধ ছিলাম এতদিন, ভুলেও বুঝিনি কী আমার আসল কাজ। এটা করেছি ওটা করেছি, আসল কাজের প্রকৃত প্রেরণাটাকে নিজের হাতে চেপে রেখে দিয়েছি। তাই আজ এই সাতাশ বছর বয়সেও আমার কিছু হল না।

কী এসে যায় ভিনসেন্ট? স্বাস্থ্য যদি আবার ফিরে পাও, মনের দৃঢ়তা নিয়ে যদি এগোতে পার তাহলে অন্য নতুন শিক্ষার্থীর চাইতে হাজার গুণ ফল তুমি পাবে। সাতাশ বছর! হুঁ! সারাজীবন তো তোমার সামনে!

হ্যাঁ, অন্তত আরও দশটা বছর হাতে আমার আছে। দশ বছরে কি কিছুই করে উঠতে পারব না?

আলবত পারবে। প্রাণপণে লেগে যাও। আর যেখানে খুশি সেখানে গিয়ে থাকো। প্যারিস বল, ব্রুসেলস বল, আমস্টার্ডাম, হেগ বল—যেখানে তুমি যাবে আমাকে জানিয়ো, মাসে মাসে আমি তোমাকে টাকা পাঠিয়ে দেব। যত বছরই তোমার লাগুক, আমি বলছি ভিনসেন্ট, তুমি পারবেই।

ও থিয়ো, মাসের পর মাস কী জঘন্য তিক্ততার মধ্যে আমার কেটেছে! বুকের মধ্যে খুঁড়ে খুঁড়ে চলেছি, খুঁজে চলেছি আত্মার অন্ধকারে কী আমার পথ, কী নিয়ে আমার সারাজীবন কাটবে! তারপর কী ভয়ংকর যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে আত্মোপলব্ধি! আর আমি ভয় পাব না, আর আমি পিছু হঠব না। জীবনের এতগুলো নিষ্ফলা বছরের বিনিময়ে এই চরম সত্যটাকে আজ আমি আঁকড়ে ধরেছি। আমি শিল্পী হবই, শিল্পসাধনাই আমার ললাটলিখন। এইজন্যেই অন্য যেকোনো কাজ আমি করতে গিয়েছি, হার হয়েছে আমার। থিয়ো, থিয়ো, এতদিনের বন্দিত্ব আমার ঘুচেছে, বন্ধ দ্বার তুমিই খুলে দিলে!

থিয়ো বললে—আর কোনোকিছুতেই কখনও আমাদের দূরে রাখতে পারবে না দাদা! আবার আমরা এক হয়েছি, তাই না?

হ্যাঁ, থিয়ো, সারাজীবনের জন্যে!

নাও, তুমি এখন ক-দিন বিশ্রাম করে একটু সুস্থ হয়ে ওঠো। তারপর যেখানে গিয়ে তুমি থাকতে চাও আমি তোমাকে রেখে আসব।

বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠল ভিনসেন্ট—ক-দিনের বিশ্রাম! কীসের জন্যে? কী হয়েছে আমার? আজই রাত ন-টায় ব্রুসেলসের ট্রেন আছে একটা!

উদ্দাম আগ্রহে সে জামাকাপড় পরতে শুরু করল। থিয়ো বললে—কী সর্বনাশ, তুমি পাগল হলে নাকি? আজ রাত্রে তুমি ট্রেনে যাবে কী করে? তোমার যে অসুখ! অসুখ? সে হল ‘পুরোনো ইতিহাস। এই মুহূর্তে আমার যতটা সুস্থ লাগছে, এত সুস্থ জীবনে কখনও লাগেনি। চটপট সব গুছিয়ে নাও থিয়ো! হ্যাঁ, ব্যাস, শুধু সাদা নতুন চাদরগুলো ব্যাগে ভরে নাও। দশ মিনিটের মধ্যে স্টেশনে যেতে হবে, মনে থাকে যেন। দেরি নেই!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *