বরানগর মঠ
কয়মাস হইল, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তদের অকূল পাথারে ভাসাইয়া স্বধামে চলিয়া গিয়াছেন। (২।পঃ) ঠাকুরের শরীর যায় ১৬ আগস্ট, ১৮৮৬ খ্রীষ্টাব্দ। আর শ্ৰীম এই কথাগুলি লিখছেন ১৮৮৭ খ্রীষ্টাব্দের ৭ মে। অর্থাৎ প্রায় ন-মাস হল ঠাকুর শরীর ত্যাগ করেছেন। অবিবাহিত ও বিবাহিত ভক্তেরা ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের সেবাকালে যে স্নেহসূত্রে বাঁধা হইয়াছেন তাহা আর ছিন্ন হইবার নহে। হঠাৎ কর্ণধারের অদর্শনে আরোহিগণ ভয় পাইয়াছেন বটে, কিন্তু সকলেই যে একপ্রাণ, পরস্পরের মুখ চাহিয়া রহিয়াছেন। … ছোকরা ভক্তেরা কাশীপুরের বাগানে থাকিয়া রাত্রি দিন (ঠাকুরের) সেবা করিয়াছিলেন। তাঁহার অদর্শনের পর অনিচ্ছাসত্ত্বেও কলের পুত্তলিকার ন্যায় নিজের নিজের বাড়ি ফিরিয়া গেলেন।… কিন্তু ঠাকুর তাঁহাদের অন্তরে ত্যাগী করিয়া গিয়াছিলেন। (ঐ) বস্তুত, রামকৃষ্ণ-সঙ্ঘ শ্রীরামকৃষ্ণই প্রতিষ্ঠা করে গেছিলেন। একবার লেডি মিন্টো বেলুড় মঠ দেখতে এসে স্বামী শিবানন্দজীকে জিজ্ঞেস করেছিলেন : আচ্ছা, এই সব তো স্বামী বিবেকানন্দই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন? শিবানন্দজী উত্তর দেন : না, এ সঙ্ঘ আমরা করিনি, ঠাকুরের অসুখের সময় তিনিই এই সঙ্ঘ সৃষ্টি করে গেছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ যখন অসুস্থ হয়ে কাশীপুরে এলেন, তখন এই যুবক ভক্তেরা সব একত্রিত হলেন। এর আগেও তাঁদের মধ্যে পরিচয় ছিল, পরস্পরের বাড়িতে যাতায়াত ছিল—কিন্তু খুব বেশী ঘনিষ্ঠতা হয়নি তখনও। শ্রীশ্রীমা বলেছেন:এতদিন এরা একজন আর একজনকে বলত, ‘নবেনবাবু’ কেমন আছেন, ‘রাখালবাবু’ কেমন আছেন—এইরকম। অর্থাৎ দূরত্ব আছে। তাই ‘বাবু’ বলছেন আর ‘আপনি’ করে বলছেন। কিন্তু ঠাকুরের অসুখের সময় তাঁরা দিনরাত ঠাকুরের কাছে থেকে তাঁর সেবা করতে আরম্ভ করলেন। ক্রমশ তাঁরা পরস্পরের খুব কাছাকাছি চলে এলেন। আর ‘আপনি’ করে ডাকেন না তখন—‘তুই-তোকারি’ করেন, নাম ধরে ডাকেন। আর শ্রীরামকৃষ্ণকে দেখছি, অসুস্থ শরীর নিয়েও এঁদের মধ্যে ত্যাগের বীজ বপন করে দিচ্ছেন। তীক্ষ্ণ নজর রাখছেন তাঁদের উপর। এঁদেরকে ডেকে কখনও আলাদাভাবে, কখনও বা একত্রে নানারকম উপদেশ দিচ্ছেন। আর এঁরা যে শুধু প্রাণ দিয়ে ঠাকুরের সেবা করছেন তা-ই নয়, সাধনভজনও করছেন। বস্তুত, কোন্টার উপর বেশী জোর বোঝা যায় না। ঠাকুরের সেবা এবং সাধনভজন দুটোকেই তাঁরা সাধনা হিসেবে নিয়েছিলেন। এই যুবকমণ্ডলীর মধ্যমণি হলেন নরেন্দ্রনাথ। দেখা যেত ঠাকুর মাঝে মাঝেই তাঁকে নিভৃতে ডেকে অনেক উপদেশ দিচ্ছেন। কি বলতেন জানা যায় না, তবে অনুমান করা হয়, তাঁর অবর্তমানে কিভাবে এই যুবক ভক্তদের চালাতে হবে সেই সম্বন্ধেই ঠাকুর তাঁকে নির্দেশ দিতেন। স্বামী সারদানন্দ বলছেন, এই সময় ঠাকুরের ভালবাসার আকর্ষণ এবং নরেন্দ্রনাথের আকর্ষণ এই দুয়ে মিলে আমাদের মধ্যে এমন একটা বন্ধন সৃষ্টি করেছিল, যা এক পরিবারের লোকের মধ্যেও দেখা যায় না। এইভাবে শ্রীরামকৃষ্ণের রোগশয্যাতেই রামকৃষ্ণ-সঙ্ঘ গড়ে উঠেছিল, শ্রীরামকৃষ্ণই গড়ে তুলেছিলেন। এই কাশীপুরেই বুড়োগোপাল মহারাজ (পরে যাঁর নাম হয়েছিল স্বামী অদ্বৈতানন্দ) ঠাকুরকে একদিন বললেন: আমার ইচ্ছা, গঙ্গাসাগর মেলায় যেসব সাধু আসবেন তাঁদেরকে কিছু দিয়ে সেবা করি। ঠাকুর বললেন: নরেন, রাখাল, এদের মতো সাধু তুমি কোথায় পাবে? এদের সেবা করলেই ঠিক ঠিক সাধুসেবা হবে। বুড়োগোপালদা তখন ঠাকুরের কথা-অনুযায়ী নরেন, রাখাল, বাবুরাম, নিরঞ্জন, যোগীন্দ্র, শরৎ, লাটু, তারক, কালী ও শশী—এই দশজনকে দশটি গেরুয়া কাপড় ও রুদ্রাক্ষের মালা দিলেন, নিজেও নিলেন। এইভাবে এই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়েই ঠাকুর সুস্পষ্টভাবে ভবিষ্যৎ সঙেঘর সূচনা করে গেলেন।
ঠাকুরের মহাসমাধির দিন-পনেরো পরে কাশীপুরের বাগানবাড়ি ছেড়ে দেওয়া হল। যুবক ভক্তদের অবশ্য ইচ্ছে ছিল বাড়িটা ধরে রাখা হয়—কেন না, এখানে শ্রীরামকৃষ্ণের অন্ত্যলীলার স্মৃতি জড়িয়ে আছে। কিন্তু ভাড়াবাড়ি, ভাড়া এবং অন্যান্য খরচপত্র দেন রাম দত্ত প্রভৃতি গৃহিভক্তেরা। তাঁরা যুবকভক্তদের বললেন যে, আগস্ট মাসের পরে আর এই বাড়ি রাখা হবে না। তোমরা যে যার বাড়ি ফিরে যাও। —সমস্যা হল, ঠাকুরের অস্থিভস্ম নিয়ে। রাম দত্ত বললেন: কাঁকুড়গাছিতে আমার যোগোদ্যান আছে, সেখানেই অস্থিভস্ম সমাহিত করা হবে। কিন্তু যুবকভক্তদের একান্ত ইচ্ছা, ঠাকুরের অস্থিভস্ম গঙ্গাতীরে কোন জায়গায় সমাহিত করা হয়, কারণ ঠাকুর গঙ্গা খুব ভালবাসতেন। তাঁরা গৃহিভক্তদের সেকথা বললেনও। কিন্তু তাঁদের কথা কেউ শুনল না—ঠিক হল জন্মাষ্টমীর দিন (২৩ আগস্ট ১৮৮৬ খ্রীষ্টাব্দ) অস্থিভস্ম কাঁকুড়গাছিতে নিয়ে যাওয়া হবে। যুবকভক্তদের খুব মন খারাপ হয়ে গেল। নরেন্দ্রনাথ তখন তাঁদের বোঝালেন; দেখ, অস্থিভস্ম কাছে রাখলেই কি শ্রীরামকৃষ্ণকে বেশী শ্রদ্ধা ভক্তি করা হল? তাঁর আদর্শ-অনুযায়ী যদি আমরা জীবন গঠন করতে পারি, তাহলেই তাঁর প্রতি ঠিক ঠিক শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হবে। কিন্তু শশী আর নিরঞ্জন করেছেন কি, চুপি চুপি ঠাকুরের অস্থিভস্ম থেকে বেশ কিছুটা অংশ সরিয়ে নিয়ে বলরামবাবুর বাড়িতে রেখে এলেন—যদি কোনদিন ঠাকুর সুযোগ দেন, এই অস্থিভস্ম আমরা গঙ্গাতীরে কোন জায়গায় রাখব। নরেন্দ্রনাথকে প্রথমে তাঁরা জানাননি। পরে যখন নরেন্দ্রনাথ জানতে পারলেন, তখন তিনি মনে মনে খুব খুশিই হলেন। জন্মাষ্টমীর দিন যখন শোভাযাত্রা করে অস্থিভস্মের অবশিষ্ট-অংশ কাঁকুড়গাছি যোগোদ্যানে নিয়ে যাওয়া হল, তখন নরেন্দ্রনাথ প্রমুখ যুবকভক্তরাও তাতে যোগ দিলেন। শশী মহারাজ নিজে মাথায় করে অস্থিভস্মের কলস নিয়ে গেলেন। এই নিয়ে যে গৃহিভক্তদের সঙ্গে তাঁদের কোন মনান্তর ছিল বা আছে, বুঝতে দিলেন না। নরেন্দ্রনাথ তাঁদের বলেছিলেন: দেখিস, কেউ যেন বলবার সুযোগ না পায় যে, রামকৃষ্ণের চেলারা তাঁর অস্থিভস্ম নিয়ে ঝগড়া শুরু করেছিল।
কাশীপুরের বাড়ি ছেড়ে দেওয়ার পর যুবকভক্তদের অধিকাংশই যে যার বাড়ি ফিরে গেলেন। কিন্তু দেখা গেল যে, চারজনের যাবার কোন জায়গা নেই। কিংবা তাঁরা একেবারে দৃঢ় সংকল্প করেছিলেন যে, বাড়ি ফিরবেন না। এঁরা হলেন: লাটু, তারক, কালী আর ।বুড়োগোপালদা। ঠাকুরের মহাসমাধির কয়েকদিন পরেই তারক বৃন্দাবনে চলে গেছিলেন। কিছুদিন পরে কালী মহারাজ, লাটু মহারাজ এবং যোগীন মহারাজও শ্রীমায়ের সঙ্গে বৃন্দাবনে চলে গেলেন। এদিকে নরেন্দ্রনাথের তখন খুব অশান্তির মধ্যে দিন কাটছে। বাড়িতে তাঁর নানা ঝামেলা, বাবার মৃত্যুর পর থেকেই খুব আর্থিক কষ্ট চলছে। বাড়িতে মা আছেন, ছোট ভাইবোনেরা আছে—অত্যন্ত মাতৃভক্ত ছিলেন তিনি—তাঁদের কষ্ট চোখের সামনে দেখছেন। আত্মীয়স্বজনরা মামলা শুরু করেছে। তার উপর শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর মাথায় দায় চাপিয়ে দিয়ে গেছেন যে, এই সব যুবকভক্তদের দেখাশোনা করতে হবে। অভেদানন্দ বলছেন: আমাদের বেশ মনে আছে, মহাসমাধির কয়েকদিন আগে ঠাকুর নরেন্দ্রনাথকে আমাদের সামনেই বলেছিলেন, তুই ছেলেদের একত্রে রেখে দেখাশুনো করিস। সেইদিন থেকেই আমরা বুঝে নিলাম, নরেন্দ্রনাথই আমাদের নেতা; তখন থেকে তাঁর নির্দেশ-অনুসারেই আমরা সবকিছু করতাম। স্বামী বিবেকানন্দ পরবর্তীকালে একটা চিঠিতে নিজেই বলছেন: আমাকে তিনি আদেশ করে গেছেন এই সন্ন্যাসিসঙ্ঘ প্রতিষ্ঠা করতে। আমি তাঁর কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ যে, এই ত্যাগিমণ্ডলীর দাসত্ব করব, এঁদের সব একত্রে রেখে দেখাশোনা করব। কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণের দেহত্যাগের পর সাময়িকভাবে সব অন্য রকম হয়ে গেল। অধিকাংশ যুবকভক্তেরাই যে যাঁর বাড়ি ফিরে গেলেন। নরেন্দ্রনাথের মাথায় দুশ্চিন্তা, কি করে এঁদের একত্র করবেন? তাঁর আর্থিক সামর্থ্য তো কিছুই নেই! একা তিনি কি করবেন? কোথায় এঁদের তুলবেন?
এইসময় একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। ঠাকুরের ভক্ত সুরেন্দ্রনাথ মিত্র একদিন অফিস থেকে ফিরে ধ্যান করছেন, এমন সময় হঠাৎ দেখলেন, ঠাকুর তাঁর সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন, বলছেন: তুই করছিস কি? আমার ছেলেরা সব পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছে—আগে তার একটা ব্যবস্থা কর। সঙ্গে সঙ্গে সুরেন্দ্রনাথ ছুটলেন নরেন্দ্রনাথের বাড়িতে। একই পাড়ায় দুজনের বাড়ি। নরেন্দ্রনাথকে গিয়ে বললেন: ভাই, একটা আস্তানা কর। সেখানে ঠাকুরকে নিয়ে তোমরা সব থাকবে। আর আমরা গৃহিভক্তরা মাঝে মাঝে সেখানে জুড়োতে যাব। আমি কাশীপুরে মাসে মাসে যে-টাকা দিতাম, এখন থেকে সেই টাকাই তোমাদের দেব। নরেন্দ্রনাথ তখন বাড়ি খুঁজতে শুরু করলেন আর বৃন্দাবনে তারককে চিঠি লিখে জানালেন: বাড়ি পাওয়া গেলেই আপনাকে জানানো হবে, আপনি এসে মঠের ভার নেবেন। বাড়ি পাওয়া গেল বরানগরে। একটা ভাঙা বাড়ি—টাকীর জমিদার মুন্সীরা তৈরী করেছিলেন। পরে তাঁরা অন্য জায়গায় চলে যান। সবাই বলত ‘পোড়ো বাড়ি’। সেটাই তাঁরা ভাড়া নিলেন সস্তায়। ছ’টা ঘর সেই বাড়িতে। মাসে এগারো টাকা ভাড়া। বাড়ি ঠিক হলে নরেন্দ্রনাথ টেলিগ্রাম করলেন তারককে—তিনি কাশীতে এসে অপেক্ষা করছিলেন। টেলিগ্রাম পেয়ে কলকাতায় এসে সোজা বলরাম মন্দিরে এলেন। তিনি যে ঘোড়ার গাড়িতে এসেছিলেন সেই গাড়িতেই নরেন্দ্রনাথ আর রাখাল উঠলেন—তাঁরা তিন জনে গিয়ে উপস্থিত হলেন বরানগর মঠে। সময়টা হচ্ছে ১৮৮৬ খ্রীষ্টাব্দেরই সেপ্টেম্বরের শেষ কিংবা অক্টোবরের শুরু। এইভাবে বরানগর মঠের সূচনা হল। তার প্রথম স্থায়ী বাসিন্দা হলেন তারকনাথ। কিছুদিন পরে বুড়োগোপালদা আর কালী মহারাজ এসে তাঁর সাথে যোগ দিলেন। ঠাকুরের জিনিসপত্র, ভস্মাস্থি ইত্যাদি আগেই মঠে নিয়ে আসা হয়েছিল।
এখন নরেন্দ্রনাথের কাজ হল যেসব যুবকভক্ত বাড়ি গিয়ে পড়াশুনো শুরু করেছিলেন তাঁদের মঠে টেনে আনা। বাড়ি বাড়ি গিয়ে তিনি তাঁদেরকে মনে করিয়ে দিতেন: ঠাকুর আমাদের এই এই বলে গেছেন, আমাদের সংসার ত্যাগ করতে হবে, তাঁর আদর্শকে জীবনে রূপায়িত করতে হবে, ইত্যাদি। তিনি যে কখন কার বাড়িতে গিয়ে হাজির হবেন ঠিক ছিল না। অভিভাবকরা সব গালমন্দ করত। বলত, এই নরেন ছোঁড়াটাই যত নষ্টের গোড়া। কিন্তু নরেন্দ্রনাথ তাতে দমবার পাত্র নন। তিনি হঠাৎ হঠাৎ গিয়ে তাঁদের বাড়িতে হাজির হতেন আর রাস্তায় টেনে এনে বাড়ির লোকের অসাক্ষাতে তাঁদের ত্যাগবৈরাগ্যের কথা সব শোনাতেন: কি করছিস তোরা? সারা জীবনটা কি পরীক্ষা দিয়েই কাটাবি ঠিক করেছিস? এই কি তিনি চেয়েছিলেন? এইজন্যই কি তিনি এত কষ্ট সহ্য করে গেলেন? তোরা না সন্ন্যাসী? এক্ষুনি সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে মঠে চল।—এইভাবে তিনি চেষ্টা করতেন তাঁদের মধ্যে ত্যাগবৈরাগ্যের ভাবটা জাগিয়ে রাখতে। নরেন্দ্রনাথ নিজেও অবশ্য তখন পুরোপুরি মঠে চলে আসেননি—বাড়ি থেকেই যাতায়াত করতেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই সবাই-ই ধীরে ধীরে মঠে চলে এলেন, স্থায়ীভাবে সেখানে বাস করতে শুরু করলেন। এইভাবে মঠ বেশ জমে উঠল—নরেন্দ্রের নেতৃত্বে আর সুরেন্দ্রের অর্থসাহায্যে। সুরেন্দ্রনাথ প্রথম দু-এক মাস ত্রিশ টাকা করে দিতেন। পরের দিকে মাসে একশ টাকা করে দিতেন। স্বামীজী পরে বলতেন; সুরেশবাবুই মঠের একরকম প্রতিষ্ঠাতা। বরানগর মঠের সব খরচপত্র তিনিই বহন করতেন। তিনিই তখন আমাদের জন্য সবচেয়ে বেশী ভাবতেন। ‘শ্রীম’ বলছেন: ধন্য সুরেন্দ্র! এই প্রথম মঠ তোমারি হাতে গড়া! তোমার সাধু ইচ্ছায় এই আশ্রম হইল! তোমাকে যন্ত্রস্বরূপ করিয়া ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ … কৌমার-বৈরাগ্যবান শুদ্ধাত্মা নরেন্দ্রাদি ভক্তের দ্বারা আবার সনাতন হিন্দু ধর্মকে জীবের সম্মুখে প্রকাশ করিলেন। ভাই, তোমার ঋণ কে ভুলিবে?… তোমার অকৃত্রিম স্নেহ স্মরণ করিলে কে না অশ্রুবারি বিসর্জন করিবে। (ঐ)
বরানগরের মঠ সবে কয়েক মাস হল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এমন সময় এঁরা সব চললেন আঁটপুরে— বড়দিনের ছুটি কাটাতে। আঁটপুরে বাবুরাম মহারাজের বাড়ি। নরেন্দ্র, বাবুরাম, শরৎ, শশী, তারক, কালী, নিরঞ্জন, গঙ্গাধর ও সারদা—এই ন-জন গেলেন। রাখাল মহারাজ, হরি মহারাজ আর যোগীন মহারাজ এই দলে ছিলেন না। সেখানে সাধনভজন, গান, শাস্ত্ৰচচা, ধর্মপ্রসঙ্গ এসব করে তাঁদের কাটছে। এর মধ্যে এমন একটি ঘটনা ঘটল যেটি রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে। একদিন রাত্রে একটা খোলা জায়গায় বসে তাঁরা ধুনি জ্বেলেছেন। শীতের রাত, আকাশ পরিষ্কার, তারা দেখা যাচ্ছে—আর ধুনির চারপাশে বসে এই কয়েকজন যুবক ধ্যানে ডুবে গেছেন। ধ্যান ভাঙলে নরেন্দ্রনাথ সেদিন যীশুখ্রীষ্টের সম্বন্ধে বলতে আরম্ভ করলেন। অনর্গল বলে যাচ্ছেন যীশুখ্রীষ্টের কথা, তাঁর ত্যাগী শিষ্যদের কথা। কিভাবে তাঁরা তপস্যা করেছিলেন, কিভাবে তাঁদের চেষ্টায় সারা পৃথিবীতে খ্রীষ্টধর্ম ছড়িয়ে পড়তে লাগল, ইত্যাদি। এমন আবেগময়ী ভাষায় নরেন্দ্রনাথ এসব বলে যাচ্ছেন যে, অন্যদের মনে হতে লাগল তাঁরা যেন অন্য এক জগতে চলে গেছেন। সব শেষে নরেন্দ্রনাথ বললেন: এস, এই ধুনির আগুনকে সাক্ষী রেখে এক্ষুনি আমরা প্রতিজ্ঞা করি যে, আমরাও যীশুখ্রীষ্টের শিষ্যদের মতো সংসার ত্যাগ করব, তাঁদের মতো আমরাও জগতের কল্যাণের জন্য জীবন উৎসর্গ করব। সবাই মিলে তাঁরা সেই প্রতিজ্ঞা করলেন। এরপর তাঁদের খেয়াল হল যে, সেদিন ২৪ ডিসেম্বর—খ্রীস্টমাস ইভ। যীশুখ্রীষ্টের আবির্ভাবের ঠিক আগের সন্ধ্যা। খুব অবাক হয়ে গেলেন তাঁরা। তখন পর্যন্ত তাঁরা আনুষ্ঠানিকভাবে সন্ন্যাস নেননি। কিন্তু আর দেরি করলেন না। আঁটপুর থেকে ফিরেই কিছুদিন পরে বিরজাহোম করে সন্ন্যাস নিলেন। তাঁদের প্রত্যেকের নতুন নাম হল—যে নামগুলো আমরা এখন জানি, সেই নাম। কেবল নরেন্দ্রনাথের তখন নাম হয়েছিল বিবিদিষানন্দ। পরিব্রাজক অবস্থায় কখনও কখনও তিনি সচ্চিদানন্দ নামটাও ব্যবহার করতেন। বিবেকানন্দ নামটা আমেরিকা যাবার আগে ব্যবহার করতে শুরু করেছিলেন আর সেই নামেই তিনি বিশ্ববিখ্যাত হন।
বরানগর মঠে এঁরা সব কিভাবে থাকতেন, এখন সেটা একটু আলোচনা করছি। সেই সময়কার ইতিহাস পুরো জানা যায় না। কতগুলি ঘটনা আছে যেগুলি থেকে বোঝা যায় যে, এই বরানগর মঠেরই ঘটনা সেগুলি। কিন্তু ঐ ঘটনাগুলির সঠিক কাল নির্দেশ করা যায় না। যাই হোক, স্বামী অভেদানন্দের ‘আমার জীবনকথা’, মহেন্দ্রনাথ দত্তের ‘শ্রীমৎ বিবেকানন্দ স্বামিজীর জীবনের ঘটনাবলী’, প্রমথনাথ বসুর ‘স্বামী বিবেকানন্দ’, ‘কথামৃত’, স্বামী গম্ভীরানন্দের ‘যুগনায়ক বিবেকানন্দ’, স্বামী শ্ৰদ্ধানন্দ সংকলিত ‘অতীতের স্মৃতি’—প্রধানত এই বইগুলির উপর ভিত্তি করেই বরানগর মঠের মোটামুটি একটা চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করব।
ববানগর মঠে যাঁরা ছিলেন—নরেন্দ্র, রাখাল প্রভৃতি—তাঁরা অধিকাংশই ভাল ভাল ঘর থেকে এসেছেন। কেউ কেউ খুব ধনী ঘরের সন্তান, কেউ কেউ ধনী না হলেও সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। অনেকেই ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত। সেই সময় একটু-আধটু ইংরেজিও যাঁরা শিখতেন, তাঁদের সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। ‘লেখাপড়া শেখে যেই গাড়ি ঘোড়া চড়ে সেই’—এই একটা কথা খুব শোনা যেত তখন। কিন্তু এঁদেরকে দেখছি যে, এঁরা এক নতুন ধরনের মানুষ। শ্রীরামকৃষ্ণ নতুন মানুষ, এঁরা তাঁর লীলাসঙ্গী—এঁরাও নতুন মানুষ। অচিন গাছ। চেনা যায় না হঠাৎ। এঁরা যে-নিয়মে চলেন, আমাদের নিয়মের সঙ্গে তা মেলে না। ত্যাগের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ এই দশ-বারোটি যুবক। ব্যক্তিগত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য এঁরা চান না, পার্থিব কোন সুখ চান না। ঘরবাড়ি ছেড়েছুড়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন। তাঁরা যে সংসার ত্যাগ করে পাহাড়ে-পর্বতে চলে গেলেন তা নয়। কলকাতারই উপকণ্ঠে রয়ে গেলেন। বনের বেদান্তকে তাঁরা লোকালয়ে বসে আচরণ করতে চেষ্টা করলেন। সাধারণ লোকে তাঁদের ঠিক বুঝতে পারত না। একটা অবিশ্বাস, সন্দেহের মনোভাব তাঁদের সম্বন্ধে। নানাভাবে তাঁদের বিরুদ্ধাচরণ করত। যখন স্নান করতে যেতেন, পাড়ার দুষ্ট ছেলেরা বলত, ঐ দ্যাখ রাজহাঁস যাচ্ছে। পরমহংসের শিষ্য, তাই রাজহাঁস। আর মুখে ‘প্যাঁক প্যাঁক’ শব্দ করত। সেই জন্য প্রথম প্রথম এঁরা গেরুয়া কাপড় পরে বাইরে বেরোতেন না। মঠের ভিতরে গেরুয়া পরতেন কিন্তু বাইরে বেরোনোর সময় সাদা কাপড় পরে বেরোতেন। আর সন্ন্যাস-নামও সম্ভবত প্রথম প্রথম ব্যবহার করতেন না। কারণ, এই সময়কার একটা চিঠিতে অখণ্ডানন্দজীকে শিবানন্দজী লিখছেন: আমাদের যে চিঠিপত্র দেবে তাতে ঠিকানায় যেন আমাদের সন্ন্যাস-নাম লিখো না, আমাদের আগের নামই লিখবে। এর কারণ, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ তখন গেরুয়া দেখতে অভ্যস্ত ছিল না। তারা নাগা সন্ন্যাসী বা গঙ্গাসাগর যাত্রী কিছু কিছু সাধুকে দেখেছে গেরুয়া পরতে। কিন্তু তারা বেশী দেখে বৈষ্ণব সাধুদের—তাঁরা গেরুয়া পরেন না, সাদা কাপড় পরে থাকেন। কাজেই একদল বাঙালী যুবক গেরুয়া কাপড় পরে একটা পোড়ো বাড়িতে আছে—এটা অনেকের চোখেই বিসদৃশ ঠেকত। তারা নানারকম উদ্ভট সন্দেহ করত এঁদের সম্বন্ধে। এঁরা যখন ভিক্ষেয় বেরোতেন মেয়েরা বলত: জোয়ান জোয়ান ছেলে, ভিক্ষে করতে বেরিয়েছ? ট্রামের কণ্ডাক্টরি করতে পার না? স্বামী বিরজানন্দ পরের দিকে (১৮৯১ খ্রীঃ) এসে মঠে থাকতেন, মঠের অনেক ক জকর্ম তিনি করে দিতেন। একদিন তিনি ফুল তুলতে গঙ্গাতীরে গেছেন, একটি মালী ওঁকে দেখে ভেবেছে, উনিও বোধহয় মালী বা ওরকম কিছু হবেন। জিজ্ঞেস করেছে: কত টাকা মাইনে পাও? উনি বলেছেন: মাইনে-টাইনে কিছু পাই না। সে খুব আশ্চর্য হয়ে গেল। —মাইনে দেয় না? এমনিই খাটিয়ে নেয়? এরকম একটা অপরিচিত মনোভাব তাঁদের সম্বন্ধে ছিল। একদিন যোগানন্দ স্বামী গেছেন ভিক্ষে চাইতে। তিনি তো জমিদার ঘরের ছেলে। যাঁর কাছে ভিক্ষে চেয়েছেন তিনি একজন সাধারণ অশিক্ষিতা মহিলা—গরিব। একটা খড়ের ঘর শুধু তাঁর আছে। মহিলা তাঁর গেরুয়া দেখে এমন চটে গেছেন যে, নানারকম গালিগালাজ দিতে শুরু করেছেন: অ্যাঁ, ভিক্ষে চাইতে এসেছ? খেটে খেতে পার না? দিনের বেলা ভিক্ষে করতে এসে সব দেখেশুনে যাবে আর রাত্রে এসে বাড়িতে সিঁধ কাটবে। আমরা কি আর ওসব বুঝি না?—এই বলে, হাতে তাঁর একটা ঝাঁটা ছিল, সেই ঝাঁটাটা নিয়ে তিনি একটা নারকেল গাছের গোড়াতে শপ্ শপ্ করে মারছেন। রাগটা তাঁরই উপর, কিন্তু তাঁকে মারতে একটু বাধছে—তাই নারকেল গাছের গোড়াতে মারছেন। আর যোগীন মহারাজ কি করবেন? চুপ করে সহ্য করলেন। মঠে এসে বললেন সব। সবাই মিলে খুব হাসাহাসি হল তখন। আর একদিন আরও একটা মজা হয়েছে। পাড়ার লোকেরা যে তাঁদের কিরকম সন্দেহ করত, সেটা একটু বোঝা যায় তা থেকে। এঁরা তো সব সাধনভজন নিয়ে থাকতেন—মাঝে মাঝেই এরা একসাথে বসে ভজন গাইতেন। একদিন রাতে তাঁরা ভজন শুরু করেছেন। গান গাইছেন শরৎ মহারাজ—স্বামী সারদানন্দ। আর এঁরা সব চারপাশে বসে শুনছেন। খুব ভাল গাইতেন—কিন্তু গলাটা একটু মেয়েলি ছিল। পাড়াপড়শীরা শুনে ভেবেছে, মহিলা কেউ গাইছে। তারা বলছে: এঁরা নাকি সাধু? মেয়েদের নিয়ে রাত্রিতে এরকম গান গাইছে? দাঁড়াও না, ভণ্ডামি বের করছি। একেবারে হাতে-নাতে ধরব সবকটাকে। এই বলে, দেয়াল টপ্কে তারা একেবারে গানের আসরে গিয়ে হাজির। দেখে যে, মেয়ে তো নয়, পুরুষমানুষ। তারা তখন খুব হকচকিয়ে গেছে—ক্ষমা চাইল তাঁদের কাছে। ওঁরা অবশ্য কিছুই বললেন না, হাসিমুখেই তাদের বিদায় দিলেন। —তাঁদের সম্বন্ধে এরকম একটা অবিশ্বাসের মনোভাব তখন সাধারণ লোকের ছিল।
কিন্তু এঁরা সেসব ভ্রূক্ষেপ করতেন না। সাধনভজন করে যাচ্ছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ কতগুলি তত্ত্ব তাঁদের দিয়ে গেছেন—সেগুলিকে বাস্তবায়িত করতে হবে, নিজেদের জীবনে ফুটিয়ে তুলতে হবে। তারই সাধনা, তারই তপস্যা তাঁরা করছেন। স্বামীজী নিজের ভাষায় বর্ণনা করছেন: ‘ঠাকুরের দেহ যাবার পর আমরা বরানগর মঠে কত জপধ্যান করতুম। তিনটের সময় সব সজাগ হতুম। শৌচান্তে কেউ চান করে, কেউ না করে—ঠাকুরঘরে গিয়ে বসে জপধ্যানে ডুবে যেতুম। তখন আমাদের ভেতর কী বৈরাগ্যের ভাব! দুনিয়াটা আছে কি নেই, তার হুঁশই ছিল না।’—এঁদের তখন একমাত্র চিন্তা কি করে ঈশ্বরলাভ করব। কথামৃতে দেখা যায়, মাস্টারমশাইকে নরেন্দ্রনাথ প্রশ্ন করছেন: কি করব বলুন তো? প্রায়োপবেশন করব? নাকি আর কিছু করব? কত কি দেখলাম, কত দর্শন হল কিন্তু শান্তি পাচ্ছি না মনে।—একটা হাহাকার তাঁদের মধ্যে। দিন চলে যাচ্ছে, কিছু হচ্ছে না কেন? বেদান্তসারে বৈরাগ্যের বর্ণনা দেওয়া আছে: দীপ্তশিরা জলরাশিম্ ইব। মাথায় যদি কারও সত্যি সত্যি আগুন ধরে যায়, সে যেমন সেই আগুন নেবানোর জন্য জলের দিকে ছুটে যায়, বৈরাগ্যের আগুন যার মধ্যে জ্বলছে সেও সেইরকম পাগলের মতো ছুটে বেড়ায়। এঁদের সেই সময়কার অবস্থা দেখে তাই মনে হয়। মাস্টারমশাই মঠে গেছেন। যাঁরই সাথে দেখা, তিনি শুধুই ঈশ্বরীয় প্রসঙ্গ করছেন। রাখাল মহারাজ বলছেন: আসুন মাস্টারমশাই, আমরা সবাই মিলে সাধন করি। সাধন করুন, তা না হ’লে কিছু জুটত লে কিছু হচ্ছে না। (২।পঃ) বলছেন: কখনও মনে হয় নর্মদার তীরে পালিয়ে যাই, সেখানে গিয়ে সাধনভজন করি, কখনও মনে হয় পঞ্চতপা করি। —একটাঅশান্তি যেন তাঁদের তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। এঁরা সেইসময় জীবন পণ করে সাধনভজন করেছিলেন। জগৎ আছে কি নেই, শরীর আছে কি নেই— এই বোধই তখন ছিল না। মহেন্দ্রনাথ দত্ত বর্ণনা করছেন: একদিন তাঁদের বাড়িতে স্বামীজী আর মহাপুরুষ মহারাজ গেছেন, সঙ্গে গুপ্ত মহারাজ (স্বামী সদানন্দ)। এটা ১৮৮৮ সালের কথা অর্থাৎ মঠ প্রতিষ্ঠার প্রায় দু-বছর পরের ঘটনা। দুজনেই তো খুব সুপুরুষ। কিন্তু বিকট চেহারা হয়েছে তাঁদের। চান নেই—দাঁত পর্যন্ত মাজেননি কতদিন, খেয়ালই ছিল না সেসব। দাঁত মেজে কলতলায় চান করতে বসলেন। মহেন্দ্রনাথ দত্ত মহাপুরুষ মহারাজের গা ঘষে দিচ্ছেন আর গুপ্ত মহারাজ স্বামীজীর গা ঘষে দিচ্ছেন। গায়ে এত ময়লা জমেছে যে, ঘষা মাত্র যেন কাদাজলের স্রোত বেরিয়ে আসছে গা থেকে।
খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা কিরকম? অত্যন্ত দারিদ্র্য। কিচ্ছু জুটত না। স্বামীজী বলছেন: এমন কতদিন গেছে যে খাবার কিছুই নেই, ভাত জোটে তো নুন জোটে না। দিন-কতক হয়ত শুধু নুন-ভাত চলল, কিন্তু কারও সেদিকে গ্রহ্যি নেই। ‘জপধ্যানের প্রবল তোড়ে আমরা তখন সব ভাসছি। তেলাকুচো পাতা সেদ্ধ, নুন-ভাত—এই মাসাবধি চলেছে! আহা, সে-সব কি দিনই গেছে! সে কঠরতা দেখলে ভূত পালিয়ে যেত—মানুষের কথা কি!’—এত কষ্ট করেছেন, কিন্তু তবুও বলছেন: আহা কি দিনই গেছে! কি আনন্দময় দিন সেসব! শরীরটা কষ্ট করছে, মন রয়েছে অন্য জায়গায়—ভগবৎ-আনন্দে ডুবে রয়েছে। স্বামী প্রেমানন্দ বর্ণনা করছেন; একবেলা ভাত—তাও কোনদিন জুটত, কোনদিন জুটত না। এমনকি, থালাবাসন পর্যন্ত ছিল না। মঠের সঙ্গেই একটা বাগান ছিল। সেখান থেকে লাউপাতা কিংবা কলাপাতা আনতেন। কিন্তু উড়ে-মালী খুব গালিগালাজ করত। তখন আর কি করবেন? মানকচুর পাতায় খেতে আরম্ভ করলেন। কচুর পাতায় খেয়ে গলা কুটকুট করত। ‘এত যে কষ্ট, ভ্রূক্ষেপ ছিল না—পূজা, ধ্যান, জপ, কীর্তন সর্বক্ষণ চলেছে।’ এরই মধ্যে আবার ঠাকুরকে পরীক্ষাও করছেন। শ্রীশ্রীমা বলছেন একটা ঘটনার কথা। বলছেন: এরা সব ঠাকুরকে ‘বীড়ে’ নিয়ে তবে ছেড়েছে। বীড়ে করা মানে পরীক্ষা করা। একদিন তাঁরা ঠিক করলেন; আজ আর ভিক্ষেয় যাব না, সুরেশবাবু এলে তাঁকেও কিছু বলব না। ঠাকুরের নাম নিয়ে সব ছেড়েছুড়ে এলাম, দেখি তিনি খেতে দেন কি না।—এই বলে তাঁর ধ্যান শুরু করে দিলেন। সারাদিন ধ্যান চলছে—কেউ এল না। এঁরাও ধ্যান করে যাচ্ছেন। বেশ রাত হয়েছে, এমন সময় কে যেন এসে দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে। নরেন্দ্রনাথ বলছেন: ‘দেখ্ তো দরজা খুলে, কে? আগে দেখ্ তার হাতে কিছু আছে কি-না।’ দরজা খুলে দেখেন যে, লালাবাবুর মন্দির থেকে একজন এসেছে—তার সঙ্গে নানারকম সব খাবার! বুঝলেন যে, ঠাকুর সব সময় তাঁদের দেখছেন! তখন সেই রাতেই ঠাকুরকে ভোগ দিয়ে প্রসাদ পেলেন সবাই। এরকম আরও কয়েকদিন হয়েছিল। সিঁথির বেণী পালের বাড়ি থেকেও ঐভাবে একদিন লুচি এসেছিল মঠে।
মাঝে মাঝে এঁরা আক্ষেপ করতেন; আহা! ঠাকুরের কিরকম বৈরাগ্য, কিরকম ব্যাকুলতা ছিল! তিনি যা করে দেখিয়েছেন, তার সামান্যও আমরা করতে পারলাম না। এরকম একটা অতৃপ্তি তাঁদের ছিল—divine discontent. কিন্তু যে তপস্যা তখন তাঁরা করেছেন, সাধারণ মানুষ তা কল্পনাও করতে পারবে না। কতরকমভাবে যে এঁরা সাধনা করেছেন তখন। কেউ হয়তো ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধ্যান করে যাচ্ছেন। কেউ হয়তো বিভোর হয়ে ভজন গাইছেন—বাহ্যজ্ঞানশূন্য। কেউ হয়তো শ্মশানে গিয়ে বসে আছেন। সেখানে শবদাহ হচ্ছে। চোখের সামনে দেখছেন; শরীর অনিত্য, সংসার অনিত্য। মৃত্যুচিন্তা করছেন। মৃত্যুচিন্তা থেকে মন ক্রমশ মৃত্যুঞ্জয়ের চিন্তায় মগ্ন হয়ে যাচ্ছে। কেউ হয়তো প্রতিজ্ঞা করলেন: জগন্মাতার দর্শন না পেয়ে ছাড়ব না। কেউ হয়তো দিনরাত মালা জপ করে চললেন, কেউ আবার প্রতি রাতে ধুনি জ্বালিয়ে তার পাশে বসে ধ্যান করছেন। আর স্বামীজী সবসময় এঁদের প্রেরণা দিতেন: মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন। অভেদানন্দ মহারাজ এত কঠোর তপস্যা করতেন যে, তাঁকে সবাই বলতেন কালী তপস্বী। সারাক্ষণ একটা ঘরে দরজা বন্ধ করে ধ্যানজপ, শাস্ত্ৰচর্চা নিয়ে থাকতেন। খুব বেদান্ত চর্চা করতেন—সেইজন্য তাঁকে অন্যান্যরা ‘কালী-বেদান্তী’ও বলতেন। রাজা মহারাজ সবসময় জপ করতেন। সবসময় তাঁর ঠোঁট দুটো একটু একটু নড়ছে—ভেতরে ভেতরে জপ করে যাচ্ছেন। একদিন সারদা মহারাজ বলে বসলেন: যতক্ষণ পর্যন্ত না ঈশ্বরের দর্শন পাই, ততক্ষণ জপ বন্ধ করব না। খাওয়ার সময় হয়ে গেছে, অথচ তিনি আর আসেন না। ঘর বন্ধ করে তিনি জপ করে যাচ্ছেন। এঁরা সবাই মিলে তাঁকে অনেক বোঝালেন : দরজা খোল, একটু খেয়ে নিয়ে আবার জপ করবে। কিন্তু তিনি কিছুতেই দরজা খোলেন না। জপ করে যাচ্ছেন। অনেক অনুনয়-বিনয়ের পর তিনি বললেন: ঠিক আছে, আমি খেতে যাব। কিন্তু এই জপের আসন থেকে উঠে খাওয়া-দাওয়া করে ফিরে আসতে যে সময়টা লাগবে তারকদা যেন সেই সময়টা আমাকে স্পর্শ করে থাকেন। আমি তো আর তখন জপ করতে পাব না, তারকদা মহাপুরুষ (স্বামী শিবানন্দ), উনি যদি আমাকে স্পর্শ করে থাকেন তাহলেই জপের কাজ হবে। শিবানন্দ মহারাজ রাজী হলেন, ধরে ধরে তাঁকে নিয়ে গিয়ে খাওয়ার আসনে বসালেন, স্পর্শ করে রইলেন তাঁকে—আর সারদা মহারাজ কোনরকমে পাঁচ-ছ গ্রাস ভাত মুখে দিয়ে ছুটে গিয়ে আবার জপে বসলেন। লাটু মহারাজ কি করতেন, প্রথম রাতটা তিনি সকলের সাথে শুয়ে নাক ডাকাতেন—যেন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। জপের মালাটা কাছে নিয়ে শোন। যখন বুঝতে পারেন যে, সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে, তখন মালাটা নিয়ে উনি জপ করতে শুরু করেন। জপের মালায় কুটুর কুটুর শব্দ হয়। অনেক সময় অন্যের ঘুম ভেঙে যায়। ওঁরা ভাবেন, ইঁদুর। হাতে শব্দ করেন ইঁদুর তাড়াবার জন্য আর উনিও সঙ্গে সঙ্গে জপ বন্ধ করে দেন। আবার যেই সবাই ঘুমিয়ে পড়েন, আবার উনি জপ করতে শুরু করেন। এইভাবেই চলছে। একদিন ধরা পড়ে গেলেন— শরৎ মহারাজ ধরে ফেললেন তাঁকে। বলছেন: দেখেছ, লেটো শালা সবচেয়ে উঁচিয়ে যাচ্ছে, আমাদের পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা সারা রাত্রি ঘুমিয়ে কাটাই, আর ও মজা করে জপ করবে? এ চলবে না। আমরাও রাত্রে ওর মতো জপ করব।—ওঁরাও শুরু করে দিলেন। কী অদ্ভুত! জপ করাটাকে বলছেন মজা। সাধনভজনটা কোন কষ্ট নয় তাঁদের কাছে। সেটাই তাঁদের বড় একটা বিনোদন।
সেইসময় এত অর্থাভাব তাঁদের যে, কোন কাজের লোক রাখা সম্ভব হত না। রান্না ও অন্যান্য সব কাজ তাঁদের নিজেদেরই করতে হত। পরের দিকে বোধহয় একজন রান্নার লোক রাখা হয়েছিল। বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সবাই চেষ্টা করছেন অন্যের ভাগের কাজটা নিজেই করে দিতে। এই নিয়ে তাঁদের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলত। মেথরের পয়সা নেই—পায়খানা কিভাবে পরিষ্কার হবে? স্বামীজী একদিন বললেন; ঠাকুর অপরের পায়খানা ধুয়ে দিয়ে এসেছিলেন, আমরা কি তাঁর নাম করে কিছুই করতে পারব না? এমনভাবে তিনি কথাটি বললেন যে, সকলের অন্তরে গিয়ে স্পর্শ করল। পরদিন সকালে দেখা গেল, কে যেন চুপি চুপি পায়খানা পরিষ্কার করে দিয়েছে। তাঁদেরই একজন করেছেন—কিন্তু বলছেন না। ক্রমশ পাল্লা দেওয়া শুরু হল, কে আগে পায়খানা পরিষ্কার করবে। একজন হয়তো ভোররাত্রে পরিষ্কার করলেন, তার পরদিন অন্য আর একজন একেবারে মাঝরাত্রে গিয়ে পরিষ্কার করে এলেন। আর এসব করছেন অন্যের অলক্ষ্যে। কেউ কাউকে জানতে দিচ্ছেন না। আবার মজা হচ্ছে—পায়খানা তো একটি, আর এঁরা এতগুলি লোক। একজন হয়তো পায়খানায় আছেন, অন্যেরা তখন কি করছেন? পায়খানার সামনে বসে শাস্ত্রালোচনা করছেন। আর সকলেই দিগম্বর! তাঁদের কাপড়চোপড়েরও তখন খুব অভাব ছিল। প্রত্যেকেরই একটুকরো কৌপীন আর একখণ্ড গেরুয়া কাপড় সম্বল। দেয়ালের গায়ে একটা মাত্র সাদা কাপড় ও সাদা চাদর টাঙানো থাকত। যে-কেউ বাইরে যেতেন, ঐ কাপড়টা পরে গায়ে ঐ চাদরটা জড়িয়ে বেরোতেন। শীতকালে কি করতেন? গায়ে দেওয়ার তো কিছু নেই। রাত্রে সবাই পাশাপাশি ঘেঁসাঘেঁসি করে শুতেন। শীত খুব বেশী মনে হলে মাঝে মাঝে উঠে একটু কুস্তি করে গা গরম করে নিতেন। ঘরে আসবাবপত্র কিছুই ছিল না। থাকবার মধ্যে ছিল—একটা চাদরটকা মাদুর, রাত্রে সেটার উপরে তাঁরা শুতেন; কয়েকটা জপের মালা, কয়েকটা ঠাকুর-দেবতার ছবি, একটা তানপুরা আর প্রায় শ-খানেক সংস্কৃত বাংলা ও ইংরেজি বই। বইগুলো বন্ধুবান্ধবেরা তাঁদের উপহার দিয়েছিলেন। এত কষ্ট, কিন্তু সবসময় ঠাকুরের চিন্তা করছেন। গৃহিভক্তেরা যাঁরা এইসময়ে মঠে যাতায়াত করতেন, তাঁরা এঁদের দেখে অবাক হয়ে যেতেন: কারা এঁরা? চোখ দিয়ে যেন আগুন ঠিক্রে পড়ছে—দেখে মনে হচ্ছে যেন উন্মাদ হয়ে গেছেন কিসের জন্য!—সত্যিই এঁরা সেইসময় ঈশ্বরের জন্য পাগল হয়ে গেছিলেন। স্বামীজী নিজেও খুব কঠোরতা করতেন। তাঁকে দেখে মনে হত, তিনি যেন তপস্যার আগুনে আত্মাহুতি দেবেন বলে ঠিক করেছেন। সন্ধ্যার সময় ধ্যানে বসতেন, সারা রাত তিনি ধ্যান করতেন—যখন আকাশ পরিষ্কার হয়ে আসত তখন তিনি ধ্যান থেকে উঠতেন।
নিজে এত কৃচ্ছ্রসাধন করতেন, কিন্তু যখন দেখতেন, অন্য গুরুভাইরা অত্যধিক জপধ্যান করে শরীর খারাপ করতে বসেছেন, তখন নানাভাবে তাঁদের বোঝাতেন। বলতেন: তোরা কি মনে করেছিস সকলেই এক একটা রামকৃষ্ণ পরমহংস হয়ে যাবি? তা কি হয় কখনও? রামকৃষ্ণ পরমহংস পৃথিবীতে একটাই জন্মায়—একবারই আসে। আবার কখনও কখনও বলতেন; তাঁর মুখে (অর্থাৎ শ্রীরামকৃষ্ণের মুখে) পিঁপড়ে আর চিনির পাহাড়ের কথা শুনেছিস ত? তোরা হচ্ছিস সেই পিঁপড়ে, আর ভগবান চিনির পাহাড়। তোদের এক একটা দানা পেলেই পেট ভরে যায়, কিন্তু মনে করছিস পাহাড়টা সুদ্ধ টেনে নিয়ে যাবি।—এইভাবে স্বামীজী এঁদের আগলে রাখতেন। তিনি এঁদের নেতা। ঠাকুর যে-সঙ্ঘের জন্ম দিয়ে গেছেন, সেই সঙ্ঘকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব তাঁর। ঠাকুরের কাছে তিনি এই জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। শ্রীরামকৃষ্ণের আদর্শ এই সঙেঘর মাধ্যমে যুগ যুগ ধরে প্রবাহিত হয়ে চলবে। সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে সেই আদর্শ পৌঁছে দেবে এই সঙ্ঘ। রাখাল, বাবুরাম, শরৎ, শশী—এই যে দশ -বারোটি যুবক, আপাতদৃষ্টিতে এঁরা নগণ্য, কিন্তু এঁরাই এই সঙ্ঘের প্রাণ। কত কাজ ঠাকুর এঁদের মধ্য দিয়ে করবেন ভবিষ্যতে। এঁদের জীবন তো শুধু এঁদের নিজের জন্য নয়, জগতের কল্যাণের জন্য এদের জীবন। স্বামীজী নিশ্চয়ই তখনই তা বুঝতে পেরেছিলেন। তাই সবসময় সজাগ দৃষ্টি রাখছেন এঁদের উপর। নানাভাবে প্রেরণা দিচ্ছেন তপস্যা করতে, আবার শরীরের যে একটা স্বাভাবিক সহন-ক্ষমতা আছে, সেই মাত্রাটা যাতে ছাড়িয়ে না যায় সেদিকেও খেয়াল রাখছেন।
আর কী ভালবাসা এঁদের পরস্পরের মধ্যে! গৃহিভক্ত যাঁরা মঠে যেতেন, মুগ্ধ হয়ে যেতেন। মাস্টারমশাই মঠে এসেছেন, তাঁর মনে হচ্ছে: স্থানটি যেন সাক্ষাৎ বৈকুণ্ঠ। মঠের ভাইগুলি যেন সাক্ষাৎ নারায়ণ!(2। পঃ) সত্যিই তো তাই। এঁদের মতো মানুষ কোথায় পাওয়া যাবে? এক মন, এক প্রাণ। একজন আর একজনকে ছেড়ে থাকতে পারেন না। এঁদের বিশেষ ভালবাসা আবার নরেন্দ্রের প্রতি। মাস্টারমশাই বলছেন: মঠের ভাইরা নরেন্দ্রের অদর্শন সহ্য করিতে পারেন না।(ঐ) নরেন্দ্র একটা কাজে কলকাতায় গেছেন। ফিরতে রাত হবে। বাকী যাঁরা আছেন, তাঁদের খারাপ লাগছে নরেন্দ্র না থাকায়। তাঁরা ভাবছেন, কতক্ষণে নরেন্দ্র ফিরে আসবে। আর নরেন্দ্রেরও সেইরকম ভালবাসা এঁদের জন্য। মহেন্দ্রনাথ দত্ত বলছেন: শরীরটাও যেন তখন তাঁদের এক হয়ে গেছিল—একজনের গায়ে চিমটি কাটলে আর একজন যেন ‘উঃ’ করে উঠতেন। সে যে কী ভালবাসা, যাঁরা তাঁদের দেখেছেন, তাঁরাই শুধু অনুভব করতে পারবেন, অন্যদের পক্ষে তা বোঝা সম্ভব নয়। আর নরেন্দ্রনাথ তাঁদের মাথার মণি, তাঁদের বন্ধু, অভিভাবক, নেতা—সব। একদিন কলকাতা থেকে এসে নরেন্দ্রনাথ দেখেন, সারদাপ্রসন্ন মঠ ছেড়ে চলে গেছেন। একটা চিঠি লিখে গেছেন; আমি হেঁটে বৃন্দাবন চললাম। এখানে থাকা আমার পক্ষে মুস্কিল। বাড়ির লোকের স্বপ্ন দেখছি। নরেন্দ্র সব শুনলেন—তাঁরই তো চিন্তা, ঠাকুর এঁদের ভার তাঁর উপর দিয়ে গেছেন। বলছেন: রাজা আসুক, একবার বক্বো!(ঐ) রাজা অর্থাৎ স্বামী ব্রহ্মানন্দ। কেন তারে যেতে দিলে? (ঐ) হরিশকে বলছেন: ,তুমি ত পা ফাঁক করে লেকচার দিচ্ছিলে; তাকে বারণ করতে পার নাই। (ঐ) মাস্টারমশাইকে বলছেন: দেখুন আমার বিষম মুস্কিল। এখানেও এক মায়ার সংসারে পড়েছি। আবার ছোঁড়াটা কোথায় গেল। (ঐ) সারদাপ্রসন্ন অবশ্য কয়েকদিন পরেই ফিরে এলেন। বৃন্দাবন যেতে পারেননি—কোন্নগর পর্যন্ত গিয়েই ফিরে এসেছেন। তখন রাখাল মহারাজ তাঁকে বোঝাচ্ছেন: কোথায় ছুটে ছুটে বেরিয়ে যাস? এখানে সাধুসঙ্গ। এ ছেড়ে যেতে আছে? আর নরেনের মত লোকের সঙ্গ। এ ছেড়ে কোথায় যাবি? (ঐ) কী অদ্ভুত সম্পর্ক এঁদের মধ্যে—ভালবাসা তো আছেই, আবার কত শ্রদ্ধা করেন পরস্পরকে।
এঁরা সবাই-ই অবশ্য পরে মঠ ছেড়ে বেরিয়েছিলেন, স্বামীজী নিজেও। তবে স্বামীজী সম্ভবত চাইতেন, প্রথম প্রথম সবাই মঠে থাকুক, যাতে সঙ্ঘটা একটা দৃঢ় ভিত্তির উপর গড়ে ওঠে। পরের দিকে সবাই-ই মাঝে মাঝে পরিব্রাজক হয়ে বেরিয়ে পড়তেন। কেউ অল্প সময়ের জন্য, কেউ হয়তো অনেকদিনের জন্য। প্রায় সারা ভারতবর্ষ তাঁরা ঘুরে বেড়িয়েছেন। অখণ্ডানন্দজী তিব্বত পর্যন্ত চলে গেছিলেন। মাঝে মাঝে এমন হয়েছে: এঁরা কে কোথায় আছেন জানেন না, হঠাৎ এক জায়গায় কয়েকজনের দেখা হয়ে গেছে। তখন তাঁদের কী আনন্দ! ভারতের সাধুসমাজের প্রাচীন ঐতিহ্য এই পর্যটন করে বেড়ানো। রম্তা সাধু বহতা পানি—জল যেমন বয়ে যায়, সাধু তেমনই এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় ঘুরে বেড়াবে। বেশীদিন এক জায়গায় থাকলে সে মায়ায় বদ্ধ হয়ে পড়তে পারে।
বরানগর মঠের সবাই-ই কোন-না-কোন সময় পরিব্রাজক হয়ে বেরিয়ে পড়েছেন, যাননি শুধু শশী মহারাজ—স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ। স্বামীজী বলতেন: আমি সবার মনে আগুন জ্বালিয়েছিলাম, সবাইকে মঠ ছাড়িয়ে ভিক্ষাবলম্বী সন্ন্যাসী করেছিলাম, পারিনি শুধু শশীকে। প্রথম থেকে শশী মহারাজ মঠ আগলে বসেছিলেন। কোনদিন মঠ ছেড়ে যাননি। অন্যেরা তো সব তপস্যা করছেন—দিনরাত কোথা দিয়ে কেটে যায় সেই বোধই তাঁদের থাকে না। কিন্তু শশী মহারাজের তপস্যা অন্যরকম। তিনি ঠাকুরসেবা নিয়ে মেতে আছেন। তাঁর ঠাকুরসেবা একটা দেখবার মতো জিনিস ছিল। তিনি তো মনে করতেন না যে, ঠাকুরের ছবি, ঠাকুর যেন সাক্ষাৎ আছেন, এইভাবে সেবা করতেন তিনি। ঠাকুরঘরে মেঝের উপর ঠাকুরের বিছানা করা ছিল— তার উপরে ঠাকুরের ছবি, আর পায়ের দিকে ঠাকুরের অস্থিভস্মের কৌটো আর পাদুকা। শশী মহারাজ কিভাবে সন্ধ্যারতি করতেন স্বামী বিরজানন্দ তার বর্ণনা করেছেন। (স্বামী বিরজানন্দ অবশ্য পরে মঠে এসেছিলেন—১৮৯১ সালে।) ‘একটা অপূর্ব ব্যাপার ও দেখবার জিনিস ছিল‘সেই আরতি। ধূপধুনায় ঠাকুরঘর ভরে গেছে, খোল-করতাল বাজছে, শশী মহারাজ চামর দিয়ে ঠাকুরকে ব্যজন করতে করতে নৃত্য করছেন আর হুঙ্কার দিচ্ছেন: ‘জয় গুরুদেব, শ্রীগুরুদেব’। একেবারে উদ্দাম নৃত্য। মনে হত সমস্ত বাড়িটা যেন কাঁপছে। আর তাঁর সেই সময়কার চেহারা দেখে সবাই অবাক হয়ে যেত। খুব ফর্সা ছিলেন তিনি, আরতির সময় তাঁর মুখ দিয়ে যেন রক্ত ফুটে বেরুত। চেহারা দেখে মনে হত যেন সাক্ষাৎ অগ্নিস্বরূপ। যে সেই দৃশ্য দেখত, মুগ্ধ না হয়ে পারত না। অন্যান্য গুরুভাইদের অতটা খেয়াল থাকত না ঠাকুরের সেবা হচ্ছে কি হচ্ছে না, কিন্তু শশী মহারাজের মাথায় সবসময় চিন্তা, ঠাকুরের সেবার যেন কোন ত্রুটি না হয়। স্বামীজী তাঁর সম্বন্ধে বলছেন: ‘ভিক্ষা-শিক্ষা ক’রে ঠাকুরের ভোগরাগের ও আমাদের খাওয়ানো-দাওয়ানোর যোগাড় ওই সব করত। এমন দিনও গেছে, যখন সকাল থেকে বেলা চারটা-পাঁচটা পর্যন্ত জপধ্যান চলেছে। শশী খাবার নিয়ে অনেকক্ষণ বসে থেকে শেষে কোনরূপে টেনে-হিঁচড়ে আমাদের জপধ্যান থেকে তুলে দিত। আহা! শশীর কি নিষ্ঠাই দেখেছি!’
একদিন হয়েছে কি, ভিক্ষে পাওয়া গেল না। যাঁরা ভিক্ষে করতে গেছিলেন, খালি হাতে ফিরে এসেছেন। তখন ঠিক হল, সারাদিন ধ্যান ভজন করে কাটিয়ে দেবেন। কিন্তু শশী মহারাজের শান্তি নেই। নিজেরা না হয় উপোস করে থাকলেন কিন্তু ঠাকুরের সেবা তো আর বন্ধ থাকতে পারে না। তিনি কি করেন? কাউকে কিছু না বলে একজন পরিচিত লোকের কাছে গেলেন। সেই বাড়ির সবাই আবার মঠের উপর খাপ্পা। সেই ভদ্রলোক বাড়ির কেউ যাতে দেখতে না পায়, এইভাবে জানালা দিয়ে গলিয়ে পোয়াটাক চাল, কয়েকটা আলু আর একটু ঘি দিলেন। ঐ এক পোয়া চাল রান্না হল, ঠাকুরকে ভোগ দেওয়া হল। এদিকে অন্য সাধুরা এক ঘরে বসে ধ্যান করছেন, তাঁদের কোন দিকে খেয়াল নেই। শশী মহারাজ গিয়ে সেই প্রসাদের কয়েকটা দলা করে এক একটা দলা এক একজনের মুখে গুঁজে দিলেন। তাঁরা বলছেন: ভাই শশী, এই অমৃত কোথায় পেলে?—ক্ষুধার্ত তো, ঐ এক দলা ভাতই তখন অমৃত মনে হচ্ছে। স্বামীজী সেইজন্য বলতেন: বাড়ির গিন্নীর মতো শশী সবকিছু দেখাশুনো করত। ও-ই ছিল মঠের মেরুদণ্ড।
প্রমথনাথ বসুর বইতে আছে যে, স্বামীজীকে সেইসময় দেখে মনে হত, তাঁর যেন অফুরন্ত কর্মশক্তি। চব্বিশঘণ্টা তিনি হয় সাধনভজন করছেন, নয় ধর্মপ্রসঙ্গ করছেন, নয়তো অন্য কোন কাজ করছেন। ভোরবেলা ব্রাহ্মমুহূর্তে উঠে তিনি গান ধরতেন: জাগো জাগো সবে অমৃতের অধিকারী। গান গেয়ে সবাইকে ঘুম থেকে তুলতেন। তারপর সকলে মিলে ধ্যানে বসতেন, দুপুরবেলা পর্যন্ত ধ্যান চলত। ধ্যানের পর শুরু হত স্তবপাঠ, ভজন ও অন্যান্য সৎপ্রসঙ্গ। তারপর হয়তো ইতিহাসের প্রসঙ্গ উঠল। স্বামীজীর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে; যে কোন একটা প্রসঙ্গ দিয়ে শুরু হলেই হল। এক প্রসঙ্গ থেকে আর এক প্রসঙ্গে তিনি স্বচ্ছন্দে বিচরণ করছেন। সমস্ত জ্ঞানবারিধি যেন তিনি মন্থন করে রেখেছেন। ইতিহাসের প্রসঙ্গ হতে হতে হয়তো জোয়ান অব আর্ক-এর কথা উঠল। সেখান থেকে হয়তো ঝাঁসির রানীর প্রসঙ্গ উঠল। তারপর হয়তো ফরাসী বিপ্লবের কথা এসে গেল। স্বামীজী শুধু ফরাসী বিপ্লব নিয়ে আলোচনাই করছেন না—কার্লাইলের ‘ফরাসী রাষ্ট্রবিপ্লব’ গ্রন্থ থেকে মুখস্থ বলে যাচ্ছেন। আর সকলে একসঙ্গে মিলে দুলে দুলে বলছেন: সাধারণতন্ত্রের জয় হোক, সাধারণতন্ত্রের জয় হোক। ভাবতে অবাক লাগে, কোথায় ফরাসী দেশ আর কোথায় বরানগর মঠ—কয়েকটি যুবক-সন্ন্যাসী সেখানে বসে সাধারণতন্ত্রের জয় দিচ্ছেন! এদিকে ঈশ্বরের জন্য সর্বস্বত্যাগ করে এসেছেন—কিন্তু একটা মুক্ত মন তাঁদের সবসময় ছিল। জগতের যে সমস্ত সর্বাধুনিক চিন্তা, তার সঙ্গেও তাঁদের পরিচয় আছে, যেখানে যা ভাল দেখছেন—তারিফ করছেন।
এইসব আলোচনা করতে করতে প্রায়ই বেলা প্রায় তিন প্রহর হয়ে যেত। এঁদের কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। স্নান-খাওয়ার কথা কারও মনে পড়ছে না। তখন ঐ শশী মহারাজ এসে জোর করে ভয় দেখিয়ে তাঁদের উঠিয়ে দিতেন স্নানাহারের জন্য। খাওয়ার পর আবার তাঁরা একত্র হতেন। আবার ভজন শুরু হত, সৎপ্রসঙ্গ হত। এসব চলতে চলতে সন্ধ্যা হয়ে যেত। তখন ঠাকুরের আরতি শুরু হত। অনেকক্ষণ ধরে আরতি চলত। আরতির পর একসঙ্গে ছাদে বসে নামগান করতেন—‘সীতারাম সীতারাম’।
আর একটা জিনিস লক্ষণীয় যে, স্বামীজী যেন সেইসময়ই বুঝতে পেরেছিলেন, ভবিষ্যৎ রামকৃষ্ণ সঙ্ঘ কি রূপ নেবে, কি তার আদর্শ হবে। রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের একটা মূল মন্ত্র—শিবজ্ঞানে জীবসেবা। স্বামীজী সেই তখনই গুরুভাইদের সেবাধর্মে উদ্বুদ্ধ করছেন। নিজেদের খাবার নেই, কিন্তু শুনেছেন কোথাও কেউ অনাহারে আছে—স্বামীজীর নির্দেশে তাঁরা গিয়ে তাকে খাইয়ে আসছেন। কেউ অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে—তাঁরা গিয়ে তার সেবা করছেন। এমনকি কুষ্ঠরোগীর সেবা পর্যন্ত এইসময় তাঁরা করেছিলেন।
আর একটা জিনিস, প্রত্যেকেই তাঁরা খুব পড়াশুনা করতেন আর নিজেদের মধ্যে সেসব নিয়ে আলোচনা করতেন। স্বামী অখণ্ডানন্দকে দেখতাম, বৌদ্ধদর্শন সম্বন্ধে কত আলোচনা করতেন তিনি। পড়াশুনা কতদূর আর করেছেন—এইট-নাইন পর্যন্ত। আমরাও বৌদ্ধ-দর্শন কিছু-কিছু পড়েছি। কিন্তু এতটা কি করে জানলেন ভেবে অবাক হয়ে যাই। স্বামী অভেদানন্দের কথা জানি। তিনি তো ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেননি। অথচ তাঁর বক্তৃতাগুলো কী পাণ্ডিত্যপূর্ণ! কোথা থেকে এল এতটা পাণ্ডিত্য? কারণ, এঁরা চর্চা করতেন, পড়াশুনো করতেন। আর স্বামীজী এর মূলে। তিনি উৎসাহ দিতেন এঁদের। পরবর্তীকালে মঠে যেসব নতুন ব্রহ্মচারী আসত, প্রেমানন্দ স্বামী খোঁজখবর করতেন, তারা শাস্ত্রচর্চা করছে কিনা। যদি দেখতেন যে, করছে না, তাহলে বলতেন: এটা বাবাজীদের আখড়া পাওনি। এই সময় দিলাম, এর মধ্যে এই বইটা শেষ করে ফেলবে। না হলে অফিস থেকে চারটি পয়সা নিয়ে খেয়া পার হয়ে যাবে, অর্থাৎ মঠ থেকে বিদেয় হয়ে যাবে। এই শাস্ত্রচর্চা বা পড়াশুনার প্রতি জোর আমরাও দেখেছি। স্বামীজী বলে গেছেন: অধ্যয়নের উপরে জোর না দিলে সঙ্ঘের অবনতি হয়। ত্যাগ-তপস্যা যেমন থাকবে, পাঠ-অধ্যয়ন-স্বাধ্যায়ও থাকবে। দুই-এর উপরেই জোর দিতে হবে। এই ধারা চলে আসছে রামকৃষ্ণ সঙ্ঘে। কিন্তু তার শুরু আমরা দেখি এই বরানগর মঠে।
কিরকম পড়াশুনার চর্চা রাখতেন তাঁরা, তার একটু আভাস দিতে চেষ্টা করছি। মঠে একটা বড় হলঘর ছিল—সেটাকে বলা হত ‘দানাদের ঘর’। সেখানেই তাঁরা সবাই মিলিত হতেন। ধর্ম, সঙ্গীত, দর্শন, ইতিহাস, জড়বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, শিল্পকলা প্রভৃতি নানা বিষয়ে বাদানুবাদ চলত, গীতা, উপনিষদ্ প্রভৃতি শাস্ত্র পাঠ হত, আবার কান্ট, মিল, হেগেল, স্পেন্সর—‘এমন কি নাস্তিক ও জড়বাদীদিগের মতামতও পঠিত এবং সমালোচিত হইত।’ স্বামীজীর বিশেষত্ব হচ্ছে, এক একদিন এক একটা দৃষ্টিকোণ থেকে তর্ক করতেন। হয়তো তিনি অদ্বৈতবাদের হয়ে তর্ক করছেন, তখন অন্য সব পথ বাতিল। আবার তার পরদিনই হয়তো তিনি দ্বৈতবাদের পক্ষ নিয়ে বলছেন—অদ্বৈতবাদ তখন একেবারে নস্যাৎ করে দিচ্ছেন। এই ছিল স্বামীজীর বৈশিষ্ট্য। ‘সে সভার সভাপতি ও প্রধান বক্তা ছিলেন স্বয়ং নরেন্দ্রনাথ, সন্ন্যাসীরা প্রায়ই একযোগে তাঁহার প্রতিপক্ষ অবলম্বন করিতেন। তিনিও প্রতিকূল যুক্তির অবতারণা করিয়া সকলের যুক্তি খণ্ডন করিতে প্রবৃত্ত হইতেন এবং তাঁহারা তর্কে অসমর্থ হইলে আবার তাঁহাদেরই পক্ষ অবলম্বন পূর্বক স্বীয় যুক্তিসমূহ খণ্ডন করিতেন।’ প্রশ্ন উঠল হয়তো, ঈশ্বর আছেন কিনা। নরেন্দ্রনাথ সভাপতি, তিনি তর্ক করে প্রমাণ করে দিলেন যে, ঈশ্বরের অস্তিত্ব নেই, ওটা মনের কল্পনা মাত্র। —এদিকে কিন্তু ঈশ্বরের জন্যই ঘরবাড়ি সব ছেড়ে এসেছেন। ‘আবার তিনিই কিয়ৎক্ষণ পরে প্রমাণ করিতেন ঈশ্বরই একমাত্র সত্যবস্তু।’ শঙ্করদর্শনের কথা উঠল। নরেন্দ্রনাথ শঙ্করের যুক্তিকে খণ্ড খণ্ড করে ফেললেন, দেখিয়ে দিলেন: শঙ্করের যুক্তিতে অনেক গলদ আছে। আবার কিছুক্ষণ পরে তিনিই প্রমাণ করে দিলেন যে, শঙ্করের দর্শনই একমাত্র সত্য দর্শন, তাঁর যুক্তি সব অকাট্য। এইভাবে সাংখ্য, বেদান্ত, ন্যায়, পাতঞ্জল, পূর্বমীমাংসা, বৈশেষিক—সমস্ত ষডদর্শন নিয়েই আলোচনা হত। আবার বৌদ্ধ, শৈব ও বৈষ্ণব দর্শন, তন্ত্র, পুরাণ, দেবদেবীর পূজা—এসবও বাদ যেত না। ‘সকল প্রসঙ্গ সকল আলোচনা পরিশেষে শ্রীরামকৃষ্ণদেবে পরিসমাপ্ত হইত। নরেন্দ্রনাথ কথায় কথায় সম্পূর্ণ নূতন পথে গিয়া পড়িতেন এবং সেখান হইতে দেখাইতেন, পাশ্চাত্যশিক্ষায় শিক্ষিত বর্তমান হিন্দুজাতির উপর শ্রীরামকৃষ্ণের জীবন ও উগদেশের প্রভাব কতটা এবং সে প্রভাবের মূল্য কত। দেখাইতেন যে, ছিন্নমূল হিন্দুধর্ম বাত্যাতাড়িত সমুদ্র বক্ষে কাণ্ডারীবিহীন জীর্ণতরীর ন্যায় ক্রমাগত ভাসিয়া চলিতেছিল, পরমহংসদেবের চরণস্পর্শে সেই তরী এ যাত্রা রক্ষা পাইয়াছে ও গন্তব্যদিক নির্ণয়ে সমর্থ হইয়াছে।’ নরেন্দ্রনাথ তাঁদের বলতেন: ‘এমন দিন শীঘ্রই আসিবে যেদিন তোরা বুঝতে পারবি যে, লুপ্তপ্রায় হিন্দুধর্মকে বাঁচাইবার জন্য পরমহংসদেব কি করিয়াছেন।’ ঐতিহাসিকেরা বলেন যে, ভারতবর্ষে বাইরের থেকে সভ্যতা এর আগেও এসেছে। কিন্তু পাশ্চাত্য সভ্যতার মতো এত বড় আঘাত ভারতের সভ্যতার উপর আর কেউ করেনি। ইংরেজরা যেন আমাদের সম্মোহিত করে ফেলেছিল, আমরাই আমাদের ধর্ম, সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে ঘৃণা করতে শুরু করেছিলাম। শ্রীরামকৃষ্ণ এসে লুপ্তপ্রায় হিন্দুধর্ম ও সংস্কৃতিতে প্রাণসঞ্চার করলেন।— বরানগর মঠে এইসব গুরুগম্ভীর বিষয় নিয়ে আলোচনা হত, এর ফাঁকে ফাঁকেই আবার গুরুগীতা, মোহমুদ্গর বা ঐ জাতীয় কোন সংস্কৃত স্তোত্র আবৃত্তি করা হত। মাঝে মাঝে রামপ্রসাদী গান বা শ্রীকৃষ্ণ সম্বন্ধীয় গানও হত। মঠে কয়েকদিন ধরে তাঁরা হয়তো ‘ললিতবিস্তর’ খুব মনোযোগ দিয়ে পড়লেন। বুদ্ধদেবের জীবনী ও বৌদ্ধধর্ম নিয়ে আলোচনা করতে করতে তাঁরা হয়তো এত তন্ময় হয়ে গেলেন যে, কয়েকদিন তাঁরা বুদ্ধদেবের ভাবেই বিভোর রইলেন। নরেন্দ্রনাথ তখন ভাবতেন: এদের তো এখন বৌদ্ধপ্রভাব থেকে মুক্ত করা দরকার। তখন তিনি হিন্দু অবতার, ভক্ত ও আচার্যদের সম্বন্ধে আলোচনা করতে শুরু করতেন। তখন কয়েকদিন ধরে হয়তো রামকৃষ্ণ, শঙ্কর, রামানুজ, কবীর, তুলসীদাস, চৈতন্য, রামপ্রসাদ—এঁদের নিয়ে আলোচনা চলল। এঁরা কিভাবে বিভিন্ন সময়ে এসে ভারতবাসীকে ঠিক পথে চালিয়ে নিয়ে গেছেন, সেই নিয়ে আলোচনা। তারপরে কয়েকদিন হয়তো যীশুখ্রীষ্টের সম্বন্ধে আলোচনা হল। সবশেষে আবার তাঁরা শ্রীরামকৃষ্ণের প্রসঙ্গে ফিরে আসতেন। শ্রীরামকৃষ্ণের সম্বন্ধে বলতে বলতে নরেন্দ্রনাথ ভাবপ্রবণ হয়ে পড়তেন, তাঁর গলার স্বর বন্ধ হয়ে আসত; চোখ দিয়ে দরদর করে জল পড়তে থাকত।
মঠে সব ধর্মের প্রধান প্রধান পর্বগুলি তাঁরা উদ্যাপন করতেন। এখনও হয়। কারণ সব ধর্মের প্রতি রামকৃষ্ণ সঙ্ঘ সমান শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে। সেই বরানগর মঠ থেকেই এই ধারা চলে আসছে। যেমন, শিবরাত্রি পালন করা হচ্ছে বরানগর মঠে। একবারের চিত্র—১৮৮৭ খ্রষ্টাব্দের ২১ ফেব্রুয়ারি। সকলে উপোস করে আছেন। সারাদিন ভজন-কীর্তন করছেন। মহাপুরুষ মহারাজ আর রাজা মহারাজ দুজনে মিলে নেচে নেচে গাইছেন:
তাথৈয়া তাথৈয়া নাচে ভোলা, বববম্, বাজে গাল।
ডিমি ডিমি ডিমি ডমরু বাজে দুলিছে কপাল মাল।
গরজে গঙ্গা জটা মাঝে, উগরে অনল-ত্রিশূল রাজে।
ধক্ ধক্ ধক্ মৌলি বন্ধ, জ্বলে শশাঙ্ক ভাল॥ (৪/ বঃ মঃ)
স্বামীজীর রচনা এই গান। শিবরাত্রির কয়েকদিন আগে তিনি এই গান রচনা করেছেন। এর পরে শরৎ মহারাজ গান করছেন:
শিব শঙ্কর বম্ বম্ (ভোলা), কৈলাসপতি মহারাজরাজ!
উড়ে শৃঙ্গ কি খেয়াল, গলে ব্যাল মাল, লোচন বিশাল,
লালে লাল;
ভালে চন্দ্র শোভে, সুন্দর বিরাজে। (ঐ)
সারাদিন কেটে গেল। পফুজো শুরু হল রাত নটায়। চার প্রহরে চার বার পুজো হবে। মঠের বেলতলায় পুজোর আয়োজন করা হয়েছে। সবাই সেখানে উপস্থিত হয়েছেন। তাঁদেরই একজন পুজো করছেন আর কালী মহারাজ গীতা পাঠ করছেন। গীতা পাঠ করতে করতে মাঝে মাঝে তিনি স্বামীজীর সঙ্গে বিচার করছেন। গীতা পাঠের পর বেলগাছের চারপাশ প্রদক্ষিণ করে সকলে নৃত্য-গীত শুরু করেছেন। গভীর রাত—চারদিক নিস্তব্ধ, জনমানবশূন্য। এঁরা গান করছেন আর মাঝে মাঝে একসাথে হুঙ্কার দিচ্ছেন: ‘শিবগুরু!’ ‘শিবগুরু!’ পুজো শেষ হতে হতে ভোর হয়ে গেল। তখন এঁরা সব গঙ্গাস্নান করে ঠাকুরকে প্রণাম করে একটু কিছু মুখে দিলেন।
আবার বড়দিন উদ্যাপন করতেন ধুনি জ্বেলে। গুডফ্রাইডেও পালন করতেন। একবার এরকম গুডফ্রাইডে পালন করছেন। সারাদিন এঁরা ধ্যানজপ করে কাটিয়েছেন। আর প্রায় উপোস করেই আছেন। কয়েকটা আঙুর যোগাড় করে তার রস করেছেন, তাতে জল মিশিয়ে সকলে এক চুমুক করে শুধু খেয়েছেন। রাত্রিবেলা সকলে বসে যীশুখ্রীষ্টের কথা ভাবছেন, এমন সময় কে এসে দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে: কে আছ, খ্রীষ্টের দোহাই, দরজা খোল। এঁরা ভাবলেন: বাঃ, এ তো অদ্ভুত যোগাযোগ। আমরা এখানে গুডফ্রাইডে পালন করছি, এইসময় একজন এসে বলছে, ‘খ্রীষ্টের দোহাই’। ভালই হল, আজকে এমন একটা দিন, একজন খ্রীষ্টানের মুখে খ্রীষ্টের কথা শোনা যাবে। দরজা খুলে দিয়ে সবাই তাঁকে ঘিরে বসলেন: আপনি গুডফ্রাইডের কথা কিছু বলুন। কিন্তু সেই ভদ্রলোক, পাদ্রী একজন, তিনি বললেন: আমি স্যালভেশন আর্মির লোক, গুডফ্রাইডের কথা কিছু জানি না। আমরা দুটো পর্ব শুধু পালন করি—খ্রীষ্টের জন্মদিন আর জেনারেল বুথের জন্মদিন (জেনারেল বুথ স্যালভেশন আর্মির প্রতিষ্ঠাতা)। তখন সন্ন্যাসীরা খুব অবাক হয়ে গেলেন: সে কী! তুমি গুডফ্রাইডের কথা কিছু জান না? তোমাদের প্রভু যেদিন ক্রুশবিদ্ধ হলেন, সেদিনের কথা কিছু জান না। কেমন খ্রীষ্টান তুমি?—খুব চটে গেছেন তাঁরা। তাঁর হাতে একটা বাইবেল ছিল, সেই বাইবেলটা তাঁরা কেড়ে নিয়েছেন: তোমার হাতে এই বাইবেল শোভা পায় না, যাও তুমি এখান থেকে। তিনি চলে যাচ্ছেন, তখন আবার একজন সন্ন্যাসী গিয়ে তাঁর হাতে বাইবেলটা দিয়ে এলেন। আর সেই লোকটি এসব দেখে খুব অবাক হয়ে গেছে, প্রায় দৌড়ে সে মঠ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে, যেতে যেতে ভাবছে: এঁরা কারা? এত ভালবাসেন যীশুখ্রীষ্টকে? দেখে তো মনে হচ্ছে এঁরা খ্রীষ্টেরই অন্তরঙ্গ শিষ্যমণ্ডলী!
মঠের সাধুরা এইসময় প্রচারের বিরোধী ছিলেন। নরেন্দ্রনাথ তাঁদের বলতেন যে, নিজেকে আগে তৈরী করতে হবে, তারপর প্রচার। যে নিজে কিছু লাভ করেনি, সে কি করে প্রচার করবে? জ্ঞানলাভ করার পর প্রচার। নরেন্দ্রনাথ বলতেন: ত্রৈলঙ্গস্বামী তো কথা বলেন না কোন—বিশ্বেশ্বরের চরণে পড়ে আছেন। তার মানে কি তিনি প্রচার করছেন না? মৌনই তাঁর প্রচার। মৌনভাষায় তিনি জগৎকে শিক্ষা দিচ্ছেন। এইসব বলে তিনি একটা গল্প বলতেন: এক রাজা এক সাধুকে জিজ্ঞেস করেছেন, ঈশ্বরের লক্ষণ কি? সাধু কোন উত্তর দিচ্ছেন না, চুপ করে বসে আছেন। বারবার জিজ্ঞেস করছেন রাজা, তবুও সাধু চুপ। যখন রাজা একেবারে অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছেন, তখন সেই সাধু বলছেন: মহারাজ, আমি তো উত্তর অনেকক্ষণ ধরেই দিচ্ছি, আপনি বুঝতে পারছেন না। নীরবতাই আমার উত্তর—ঈশ্বরের লক্ষণ নীরবতা। নরেন্দ্রনাথ বলছেন: নিজেকে তুমি আগে তৈরী কর। তোমার জীবন যদি তৈরী হয়, তাহলে সেটাই হবে সবচেয়ে বড় প্রচার। তুমি নীরব থাকতে পার, কিন্তু তোমার জীবন দেখেই লোকে তখন শিখবে।
স্বামীজী তখন এই কথা বললেও প্রচার কিন্তু তখনও তাঁরা এড়াতে পারেননি। তাঁরা বরানগর মঠে থাকাকালীনই অনেকে তাঁদের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল, তারা সব আসত তাঁদের কাছে, নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করত। একসময় মঠে বাইরের লোকের এত ভিড় হত যে, এক মুহূর্তও স্বামীজী হাঁফ ছাড়তে পারতেন না। অবিশ্রাম কথা বলতে হত লোকের সঙ্গে। কি আধ্যাত্মিক বিদ্যা, কি সাধারণ বিদ্যা, সব বিষয় নিয়ে তিনি কথা বলছেন। অনেক সময় বড় বড় পণ্ডিতরা আসতেন। সন্ন্যাসীদের সঙ্গে ধর্ম-দর্শন নিয়ে তাঁরা তর্ক করছেন, গোঁড়া পণ্ডিত তাঁরা।—নানা শাস্ত্র থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে সন্ন্যাসীদের আক্রমণ করছেন। তখন স্বামীজী এমন সব যুক্তির অবতারণা করতেন যে, পণ্ডিতদের সব যুক্তি ছিন্নভিন্ন হয়ে যেত। পরাস্ত হয়ে তাঁরা ফিরে যেতেন। আবার পাদ্রীরা আসতেন তাঁদের কাছে। তাঁরা এসে হিন্দুধর্মের নিন্দা শুরু করতেন। তখন স্বামীজী এমন তর্ক জুড়তেন যে, পারতেন না তাঁরা—তাঁর ক্ষুরধার বুদ্ধির কাছে তাঁরা একেবারে ভেসে যেতেন। যখন তাঁরা আর পারছেন না, রণে ভঙ্গ দেওয়ার উপক্রম, তখন স্বামীজী তাঁদের কাছে যীশুখ্রীষ্টের প্রেমের কথা বলতে শুরু করতেন। তাঁরা থমকে দাঁড়াতেন, অবাক হয়ে ভাবতেন: এই লোকটি তো ভারী অদ্ভুত! এত ভালবাসে যীশুখ্রীষ্টকে!
আর একটি ছোট ঘটনা উল্লেখ করে শেষ করছি। এইসময় শুধু যে দারিদ্র্য বা পাড়াপড়শীর উপদ্রব ছিল তা-ই নয়, একসময় পুলিশ পর্যন্ত এঁদের পিছনে লেগেছিল। স্বামীজীরই পরিচিত একজন পুলিশ কর্মচারীর সন্দেহ হয়েছিল যে এঁরা রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠে’র মতো বরানগর মঠও একটা রাজনৈতিক আড্ডা, আর এদের পাণ্ডা হলেন নরেন্দ্রনাথ। একদিন তিনি নরেন্দ্রনাথকে তাঁর বাড়িতে নিমন্ত্রণ করলেন। আসল উদ্দেশ্য হল নরেন্দ্রনাথকে কোন ছলে তাঁর বাড়িতে নিয়ে যাওয়া। নরেন্দ্রনাথ তাঁর বাড়িতে গেলে তিনি বললেন: আমার কাছে অকাট্য প্রমাণ আছে যে তোমরা রাজনীতির সাথে যুক্ত। তবে তুমি যদি আমাদের কাছে সব খুলে বল, তাহলে আর তোমাকে কোন শাস্তি দেব না, রাজসাক্ষী করব তোমাকে। শুনেই নরেন্দ্রনাথ রেগে উঠে দাঁড়িয়েছেন, দৃপ্তকণ্ঠে বলছেন: মিথ্যে অছিলায় ডেকে এনে আপনি আমার আর আমার সাথীদের বিরুদ্ধে ভুয়ো অভিযোগ করছেন, এটাই আপনার পেশা। তবুও অপমান সহ্য করাই আমার শিক্ষা। আমি যদি অপরাধী ও ষড়যন্ত্রী হতাম তো কোন সাহায্য আসবার আগেই আপনার ঘাড় মটকে দিতাম—কেউ কিছু করতে পারত না। সেসব কথা থাক—আমি আপনাকে ছেড়েই দিচ্ছি। —এই বলে তিনি গট্গট্ করে বেরিয়ে এলেন সেখান থেকে। তাঁর সেই বীরমূর্তি দেখে পুলিশ কর্মচারীটি আর কোন কথা বলতে সাহস পেলেন না।
বাস্তবিক, অর্থাভাব লোকনিন্দা রাজরোষ—সব রকম দুঃখকষ্টের ভিতর দিয়ে তাঁদের যেতে হয়েছে। পরর্তীকালে স্বামীজী একটা বক্তৃতায় বলেছিলেন: শ্রীরামকৃষ্ণের দেহত্যাগের পর আমরা কয়েকজন অসহায় বালক ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। সবাই আমাদের উপহাস করত, রীতিমতো অত্যাচার করত আমাদের উপরে। কেউ আমাদের একটু সহানুভূতি দেখায়নি—একজন ছাড়া। কে সেই একজন? তিনি হলেন শ্রীশ্রীমা। তিনি নিজেও তখন অসহায়। চরম দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে তাঁর কাটছে—কাউকে সেকথা জানতে দেননি। কিন্তু তাঁর ভালবাসা, তাঁর সহানুভূতি, তাঁর প্রার্থনা, সবসময় ছিল এই যুবকভক্তদের জন্য। সেইদিন থেকেই কিংবা তারও অনেক আগে থেকেই তিনি সঙ্ঘজননী। তিনি নিজেই পরে বলেছেন: কত প্রার্থনা করেছি এই মঠের জন্য। ঠাকুরের কাছে কেঁদে কেঁদে বলেছি, তুমি এলে আর চলে গেলে—তাতেই সব শেষ হয়ে গেল? তাহলে এত কষ্ট করে আসবার তোমার কি দরকার ছিল? আমার ইচ্ছা, এরা সব তোমার ভাব নিয়ে একত্রে থাকবে আর সংসারতাপদগ্ধ মানুষ এদের ছায়ায় এসে প্রাণ জুড়োবে। আশ্চর্যের ব্যাপার, ঠাকুরের দেহ যাবার পর প্রবীণ ভক্তদেরও অনেকেই কিন্তু বুঝতে পারেননি যে, শ্রীরামকৃষ্ণের ইচ্ছা ছিল একটা সন্ন্যাসিসঙ্ঘ গড়ে উঠুক। বরং এই নিয়ে তাঁদের রীতিমতো মতানৈক্য ছিল ত্যাগী-ভক্তদের সঙ্গে। কিন্তু সেইসময়ও শ্রীশ্রীমা বুঝতে পেরেছিলেন: শ্রীরামকৃষ্ণের আবির্ভাবের একটা যুগান্তকারী তাৎপর্য আছে। একটা সঙ্ঘ গড়ে উঠবে—যার মাধ্যমে ঠাকুরের চিন্তা, ঠাকুরের শক্তি যুগ যুগ ধরে মানুষের কল্যাণ করে যাবে। আমরা বরানগর মঠে সেই সঙেঘর শৈশব দেখলাম। দেখলাম কী তাঁদের ত্যাগ, কী তাঁদের তপস্যা, কী তাঁদের প্রেম পরস্পরের প্রতি! যেন নতুন ভারতবর্ষ রূপ নিচ্ছে সেখানে। যে ভারত শাশ্বত,—চিরনূতন অথচ চির-প্রাচীন। ভারতের বাণী—ত্যাগের বাণী। ‘ত্যাগেনৈকে অমৃতত্বমানশুঃ’১—একমাত্র ত্যাগের দ্বারাই অমৃতত্ব লাভ হয়। ভারতের মন্ত্র—তপস্যার মন্ত্র। ‘তপো ব্রহ্মেতি’২ —তপস্যাই ব্ৰহ্ম। সত্যের জন্য ভারত তপস্যা করে। ভারতের ধর্ম প্রেমের ধর্ম। সকলের প্রতি আমাদের প্রেম। আমরা কাউকে বর্জন করি না। কত ধর্ম, কত জাতি আমাদের দেশে এসেছে, অনেকেই এসেছে তরবারি ।হাতে করে। ভারতবর্ষ তাদেরও কোলে স্থান দিয়েছে, আপনার করে নিয়েছে। ভারতবর্ষ শত ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যেও যে টিকে আছে সে শুধু এই ত্যাগ, প্রেম ও তপস্যার শক্তিতে। বরানগর মঠে সেই ভারত যেন আবার রূপ নিচ্ছে। নরেন, রাখাল—এঁরা প্রত্যেকেই স্বতন্ত্র। এঁদের মধ্যে অনেক দিক দিয়ে যেমন মিল আছে, তেমনি অনেক আলাদা বৈশিষ্ট্যও আছে। স্বাভাবিক সেটা। কিন্তু তা সত্ত্বেও সবাই একসূত্রে গাঁথা—প্রেমের সূত্রে। শ্রীরামকৃষ্ণকে তাঁরা ভালবাসেন, যে-আদর্শ শ্রীরামকৃষ্ণের মধ্যে মূর্ত দেখেছেন সেই আদর্শকে ভালবাসেন, তাই তাঁরা পরস্পরকে ভালবাসেন। ত্যাগ, তপস্যা ও প্রেম—এই হচ্ছে বরানগর মঠের শিক্ষা।
আকর-তালিকা
১। কৈবল্যোপনিষদ্, ২
২। তৈত্তিরীয়োপনিষদ, ৩/৩