বরলাভ

বরলাভ

প্রৌঢ় সদরালা সারদাবাবু গভীর রাত্রে দেবীর বরলাভ করিলেন।

দেবীর চেহারাটি ঠিক ঠাকুর-দেবতার মতো নয়; তন্বী তরুণী কুহকিনীর মতো। ফিক্‌ করিয়া হাসিয়া দেবী বলিলেন, বৎস, চব্বিশ ঘণ্টার জন্য তোমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিলাম; কাল রাত্রেও যদি তোমার মনোভাব পূর্ববৎ থাকে, বর পাকা করিয়া দিব। বলিয়া চটুল হাস্যময়ী দেবী অন্তৰ্হিতা হইলেন।

ব্যাপারটা এই—শৈশবকাল হইতে সারদাবাবু ধর্মভীরু লোক। তাই ওকালতি হইতে মুন্সেবি এবং মুন্সেবি হইতে সদরালা পদবীতে উত্তীর্ণ হইয়াও তাঁহার ধর্মভীরুতা দূর হয় নাই। সুবিচার করিবার দুরন্ত বাসনা সর্বদাই তাঁহার অন্তরে জাগিয়া থাকিত। অথচ আদালতের সকল সাক্ষী এবং উকিলই যে ঘোর মিথ্যাবাদী এ-বিষয়েও তাঁহার মনে সংশয় ছিল না। তিনি ব্যথিতচিত্তে ভাবিতেন—আহা, মানুষের মুখ দেখিয়া যদি তাহার মনের কথা বুঝিতে পারিতাম!

বুঝিবার চেষ্টাও তিনি বিলক্ষণ করিতেন। ফলে তাঁহার অধিকাংশ রায় আপীলে উল্টাইয়া যাইত। কিন্তু দীর্ঘকালের একান্ত বাসনা কখনও নিস্ফল হয় না। নিদ্ৰাযোগে সারদাবাবু হঠাৎ দেবীর বরলাভ করিলেন।

সেদিন শয্যাত্যাগ করিয়া উঠিতে তাঁহার বিলম্ব হইল; ঘুম ভাঙিতে দেখিলেন, বাড়ির ঝি তাঁহার শয্যাপার্শ্বে টিপয়ের উপর চায়ের পেয়ালা রাখিতেছে। ঝিটি অনুত্তীর্ণযৌবনা বিধবা; সারদাবাবু চোখ মেলিয়া তাহার পানে চাহিতেই শুনিতে পাইলেন, সে বলিতেছে, বুড়ো মড়ার লজ্জাও নেই, তিন পহর বেলা অবধি খাটে গড়াগড়ি দিচ্ছেন। মরণ আর কি!

সারদাবাবু এই ঝিটিকে অত্যন্ত স্নিগ্ধভাষিণী ও নম্রপ্রকৃতির বলিয়া জানিতেন, তিনি একেবারে স্তম্ভিত হইয়া গেলেন। তারপর ধড়মড় করিয়া উঠিয়া বলিলেন, অ্যা! কি বললে?

ঝি বলিল, কিছু তো বলিনি বাবু, চা এনেছি। মিষ্ট হাসিয়া ঝি প্রস্থান করিল। সারদাবাবু ব্যাদিত মুখে সেই দিকে তাকাইয়া রহিলেন।

সংশয়াকুলচিত্তে চা পান করিতে করিতে তাঁহার স্মরণ হইল, রাত্রে স্বপ্ন দেখিয়াছেন। সারদাবাবুর বুক দুরু দুরু করিয়া উঠিল।

.

সারদাবাবুর সংসারে প্রথম পক্ষের একটি কন্যা ও দ্বিতীয় পক্ষের একটি পত্নী থাকা সত্ত্বেও পরিপূর্ণ শান্তি বিরাজমান ছিল। তিনি জানিতেন, ইহারা দুজনে সর্বদা তাঁহার আদেশ, এমন কী ক্ষীণতম বাসনাটি পর্যন্ত মানিয়া চলে। স্বাধীন ইচ্ছা তাহাদের নাই, স্বাধীন ইচ্ছা প্রকাশ করিতে গেলেই তিনি তৎক্ষণাৎ তাহা দমন করিতেন, ফলে, একটিমাত্র কর্তার দ্বারা শাসিত হইয়া সংসার-তন্ত্র হিটলারের জার্মানি বা মুসোলিনীর ইটালীর মতো নিরঙ্কুশ হইয়া পড়িয়াছিল।

যা হোক, সারদাবাবু নিজের আপিস-ঘরে গিয়া কাজ করিতে আরম্ভ করিয়া দিলেন। মনটা আশা-আশঙ্কার মাঝখানে দোল খাইতে লাগিল।

একটি তরুণবয়স্ক মুন্সেব তাঁহার সহিত দেখা করিতে আসিল, সে প্রায়ই আসে; প্রবীণ হাকিমের নিকট শিক্ষালাভ করিবার জন্য তাহার প্রবল আগ্রহ; বড় ভাল ছেলে। সারদাবাবু হৃষ্টচিত্তে তাহাকে হাকিমের কর্তব্য সম্বন্ধে নানাবিধ উপদেশ দিয়া থাকেন।

মুন্সেব আসিতেই তিনি সহাস্যে কলম রাখিয়া বলিলেন, এসো হে সুবোধ। একটা রায় লিখেছি, তোমার দেখা উচিত। অনেক শিখতে পারবে।

সুবোধ বিনীতভাবে বলিল, আজ্ঞে, সেই জন্যেই তো সকালবেলা এসেছি। দিন।

সারদাবাবু রায় দিতে দিতে শুনিতে পাইলেন, সুবোধ বলিতেছে, কচু রায় লিখেছ! পেটে বোমা মারলে তো এক লাইন নির্ভুল ইংরেজি বেরোয় না!

অভিভূত সারদাবাবু শুনিতে লাগিলেন, গভীর মনঃসংযোগে তাঁহার রায় পড়িতে পড়িতে সুবোধ বলিতেছে, বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ, রায়ের মধ্যে আবার রসিকতা হয়েছে! দ্বিতীয় পক্ষ কি না, রস একেবারে উথলে পড়ছে! বেশী দূর যেতে হবে না, জজ-সাহেবই রায়ের পিণ্ডি চটকে ছেড়ে দেবে।…চমৎকার। এখানটা কী পাওয়ারফুল আরগুমেন্ট!…মেয়েটা তো আজ এখনও আসছে না! রোজই ছল-ছুতো করে ঘরে ঢুকে পড়ে, আর আমাকে দেখেই জিব কেটে পালায়–যেন কতই লজ্জা! হুঁ হুঁ শিকারী মেয়ে!…বুড়ো কিন্তু আচ্ছা বেরসিক; নিজে দ্বিতীয় পক্ষ নিয়ে ফুর্তিতে আছে, এদিকে মেয়ের যে বুক ফাটছে সেদিকে নজর নেই। আমার সঙ্গে ইনট্রোডিউস্ করে দিলেও তো পারে…

সারদাবাবু শিহরিয়া কানে আঙুল দিলেন; কিন্তু তাহাতে কোনও ফল হইল না, সুবোধের স্বগতোক্তি তাঁহার কানে পৌঁছিতে লাগিল। তিনি তখন ঘাড় গুঁজিয়া প্রবল বেগে রায় লিখিতে আরম্ভ করিলেন।

যথাসময়ে মেয়ে চুলের বিনুনি খুলিতে খুলিতে ঘরে প্রবেশপূর্বক সুবোধকে দেখিয়া জিব কাটিয়া দ্রুত পলায়ন করিল। সারদাবাবু চক্ষে অন্ধকার দেখিতে লাগিলেন।

সেদিন আহারে বসিয়া সারদাবাবু করুণনয়নে স্ত্রীর মুখের পানে চাহিলেন। স্ত্রী বলিলেন, হ্যাঁ গা, আজ কি শরীর ভাল নেই? মুখখানা শুকনো শুকনো দেখাচ্ছে। আজ না হয় কোর্টে গিয়ে কাজ নেই। বলিয়া উদ্বিগ্নমুখে তাঁহার পানে তাকাইয়া রহিলেন। সারদাবাবু স্ত্রীর কণ্ঠস্বর শুনিতে লাগিলেন—জজ-সাহেব নিশ্চয় হুড়ো দিয়েছে, তাই মন খারাপ। ভালই হয়েছে বাইরে গুঁতো না খেলে পুরুষমানুষ ঘরের লোকের কথায় কান দেয় না। আজই সন্ধ্যেবেলা মাইসোর জর্জেট শাড়ির কথাটা তুলব। সোজাসুজি তুললে হবে না, তা হলেই উল্টো রাস্তা ধরবে। ছেঁড়া কাপড়খানা পরে সামনে ঘোরাঘুরি করব, চোখে পড়লেই জিগ্যেস করবে। তখন বেশ গুছিয়ে কথাটা পাড়তে হবে। সত্যি বাপু, তুমিই না হয় বুড়ো, তাই বলে আমার কি সাধ আহ্লাদ নেই। পঁচিশ বছর বয়সে কি কেবল মালা-জপই করব? দোজপক্ষে না পড়ে যদি…।

নীরবে আহার সমাপ্ত করিয়া সারদাবাবু কোর্টে গেলেন।

.

এজলাসে বসিয়া সারদাবাবু উৎসুকভাবে চারিদিকে চাহিলেন। গৃহে যদিচ কয়েকটা প্রবল ধাক্কা খাইয়াছেন, তবু তিনি একেবারে দমিয়া যান নাই।

এজলাসে তাঁহার পেশকার ও কয়েকজন উকিল উপস্থিত ছিলেন। তাঁহাদের মুখের দিকে তাকাইয়া সারদাবাবু এক অপূর্ব কলরব শুনিতে পাইলেন। সকলেই একসঙ্গে কথা কহিতেছে, অন্যের কথা শুনিবার ধৈর্য কাহারও নাই। এই সম্মিলিত অনৈক্যতানের ভিতর হইতে একটি শব্দ কেবল অনাহত-ধ্বনির মতো উত্থিত হইতেছে টাকা! টাকা! টাকা।

সারদাবাবু কড়া হাকিম, এজলাসে কোলাহল সহ্য করিতে পারেন না; তিনি পরুষকণ্ঠে বলিয়া উঠিলেন, সাইলেন্স!

সকলে অবাক হইয়া তাঁহার মুখের পানে চাহিয়া রহিল। কেহই তো কোনও কথা বলে নাই।

নিজের ভুল বুঝিতে পারিয়া সারদাবাবু সংকুচিতভাবে অধোবদন হইলেন; অমনি কোলাহল থামিয়া গেল। তিনি তখন পেশকারের দিকে না চাহিয়াই বলিলেন, কি কাজ আছে দেখি!

.

একজন উকিল একটি দরখাস্ত দাখিল করিয়া বলিলেন, হুজুর, আমার মক্কেল পীড়িত, এক হপ্তার মুলতুবি প্রার্থনা করি।

সারদাবাবু বলিলেন, ডাক্তারের সার্টিফিকেট আছে?

আছে হুজুর, সিবিল-সার্জেনের সার্টিফিকেট।

উকিলের মুখের দিকে চাহিয়া সারদাবাবু সমস্তই বুঝিতে পারিলেন। দরখাস্ত মিথ্যা, সার্টিফিকেট মিথ্যা,–পীড়িত মক্কেল সেই মুহূর্তে আদালতের নিকটবর্তী এক বটবৃক্ষতলে বসিয়া জিলিপি ভক্ষণ করিতেছে।

তিনি কড়া সুরে বলিলেন, দরখাস্ত নামঞ্জুর।

বিস্মিত উকিল বলিলেন, হুজুর, সিবিল-সার্জেনের সার্টি—–

সারদাবাবু ততোধিক চড়া সুরে বলিলেন, সার্টিফিকেট মিথ্যে, দরখাস্ত মিথ্যে!

তিনি রোষরক্তিম চক্ষে চারিদিকে চাহিয়া দেখিলেন, একটা হুলস্থুল পড়িয়া গিয়াছে। কাহারও মুখে কথা নাই, কিন্তু সকলেই বলিতেছে, বুড়ো বোম্বেটে বলে কি!…কুকুরে কামড়েছে, খ্যাপা কুকুর!…মরেছে ব্যাটা লাল-মুখো-সিবিল-সার্জেন এবার ধরে চাবকাবে।

দরখাস্তকারী উকিল বলিতেছেন, দাঁড়াও যাদু, তোমার শ্রাদ্ধের ব্যবস্থা করছি…হুজুর, স্পষ্ট করে আর একবার নিজের মন্তব্য প্রকাশ করবেন কি? আমি হয়তো শুনতে ভুল করেছি, কিন্তু সিবিল-সার্জেনের সার্টিফিকেট মিথ্যে—এই কথাই কি আপনি বলতে চান? …বল্ শালা, আর একবার ব। তারপর তোর বাপের নাম না ভুলিয়ে দিতে পারি তো আমি…বলুন হুজুর!

সারদাবাবু ক্ষিপ্ত হইয়া গেলেন, বেরোও—বেরোও—পাজি নচ্ছার চোর! এই চাপরাশি, কান পাকাড়কে সবকো নিকাল দেও!…

.

সায়ংকাল। সারদাবাবু অত্যন্ত বিমর্ষভাবে নিজের গৃহের বারান্দায় একটি ইজি-চেয়ারে শয়ন করিয়া আছেন। তাঁহার চোখের দীপ্তি নিষ্প্রভ। শহরের সর্বত্র উকিল-মহলে ও হাকিম-মহলে যে বিরাট হইচই বাধিয়া গিয়াছে তাহা কানে না শুনিলেও তাঁহার বুঝিতে বাকি নাই। হয়তো এতক্ষণে মহামান্য হাইকোর্টেও খবর গিয়াছে। উকিল-সম্প্রদায় চুপ করিয়া বসিয়া থাকিবার বান্দা নয়।

গৃহিণী আসিলেন। কয়েক বার তাঁহার সম্মুখে পায়চারি করিলেন, তারপর তাঁহার মুখ যেন হঠাৎ দেখিতে পাইয়াছেন এমনই ভাবে বলিয়া উঠিলেন, ওগো, তোমার শরীর সত্যিই খারাপ হয়েছে। না বললে শুনব কেন! খেটে খেটে যে কালী হয়ে গেলে; এ বয়সে অত পরিশ্রম সহ্য হবে কেন। আমি বলি, ছুটি তো পাওনা হয়েছে, ছুটির দরখাস্ত দাও—কিছু দিন পুরীতে নাহয়…কাপড়খানা কি এখনও চোখে পড়ছে না।…শরীর আগে, তারপর চাকরি

সারদাবাবু গুম হইয়া বসিয়া রহিলেন, কোনও কথাই বলিলেন না।

মনে মনে অসন্তুষ্ট হইয়া গৃহিণী প্রস্থান করিবার পর কন্যা আসিল। হাসি-হাসি মুখ, চোখে চপল দৃষ্টি।

কন্যা বলিল, বাবা, তোমার মাথায় বড় পাকা চুল হয়েছে–তুলে দেব?

কন্যাটিকে সারদাবাবু বড় ভালবাসিতেন, তাই চোখ তুলিয়া তাহার মুখের পানে চাহিতে পারিলেন না। সেখানে কোন্ কালসর্প লুকাইয়া আছে কে জানে! সপ্তদশবর্ষীয়া অনুঢ়া কন্যা সারদাবাবু চক্ষু মুদিত করিয়া রহিলেন।

বাহিরে পদশব্দ শুনা গেল। মুন্সেব সুবোধ আসিতেছে। কন্যা বোধ হয় পিতার পাকা চুল তুলিতে এত তন্ময় যে তাহার পদধ্বনি শুনিতে পাইল না।

সুবোধ আসিয়া বারান্দার সম্মুখে দাঁড়াইল। সুবেশ সৌখীন যুবক, হাতে ছড়ি। সারদাবাবু দেখিলেন, সে সসম্ভ্রমে চক্ষে তাঁহার মেয়ের পানে তাকাইয়া আছে।

কিন্তু সারদাবাবু তাহার মনটাও পরিষ্কার দেখিতে পাইলেন। তাঁহার মাথার মধ্যে একটা শিরা যেন হঠাৎ ছিঁড়িয়া গেল। তিনি উঠিয়া সুবোধের উপর লাফাইয়া পড়িলেন, তাহাকে এলোপাথাড়ি লাথি কিল চড় মারিতে মারিতে ফেনায়িত মুখে বলিতে লাগিলেন, শুয়োর! কুকুর! পাঁঠা!

গুরুতর স্বাস্থ্যভঙ্গের ওজুহাতে ছয় মাসের ছুটির দরখাস্ত করিয়া দিয়া সেই রাত্রে সারদাবাবু কাতরকণ্ঠে বরদাত্রী দেবীকে জানাইলেন, মা, তোমার বর ফিরিয়ে নাও। যথেষ্ট হয়েছে—আর চাই। না—

১৮ অগ্রহায়ণ ১৩৪৩

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *