বরফসাহেবের মেয়ে
“তাহলে একটা গল্প বলি, শোনো—” পাঁচুদা বললেন, “গল্পটা যদিও সেই বয়সের যে-বয়সে আমাদেরও তোমার মতন মরাল রেস্পনসিবিলিটির ভূত ঘাড়ে চেপেছিল রাসু, কিন্তু আসলে সব মানুষেরই সব বয়সের গল্প সেটা। ”
আমরা ছিলাম তিন বন্ধু: বীরু, তিনু আর আমি। কতোই বা বয়স হবে তখন আমাদের, বড় জোর বছর বারো-তেরো। থাকতাম ধানবাদে; ডোমপাড়ার রেল-কোয়ার্টার্সে। পড়তাম পুরনো স্টেশনের ‘অ্যাকাডেমি’তে।
ধানবাদ বাজার ছাড়িয়ে ডোমপাড়া। সে-পাড়ায় ঢুকতেই ডানহাতি যে ব্লকগুলো সারবন্দিভাবে দাঁড়িয়ে আছে তারই একটাতে থাকতাম আমি, আর-একটাতে তিনু। আমার বাবা এবং তিনুর বাবা দু’ জনাই ছিলেন রেলের চাকুরে। বীরুর বাবা কাজ করতেন ধানবাদ বাজারের সবচেয়ে চোখ-ধাঁধানো বিরাট এক সাহেবি দোকান ‘গ্রেগারী ব্রাদার্সে’। থাকতেন কাছাকাছি ভাড়াটে বাড়িতে। মোহিত কাকাবাবু কী কাজ করতেন তা জানি না, তবে বীরু প্রায়ই পকেট ভর্তি করে লজেন্স, টফি, বিস্কুট—এমনি কত কি নিয়ে আসত। আর আমরা সেই সব পকেটে করে হাজির হতাম বরফসাহেবের বাড়ি; বরফ সাহেবের মেয়ে—জিনির কাছে।
বরফসাহেব! নামটা শুনে কেমন যেন লাগছে তোমাদের, না? সেই ছেলেবেলায় আমরাও যখন বরফসাহেবের কথা প্রথম শুনেছিলুম, কেমন যেন অদ্ভুত লেগেছিল। যখন ভাব হল, যাওয়া-আসা শুরু হল, বৃদ্ধি পেল অন্তরঙ্গতা, তখন কিন্তু আর অদ্ভুত লাগত না। আর কেই বা তাঁর নাম দিয়েছিল ‘বরফসাহেব’, তাও জানতে চাইনি, ইচ্ছেই করেনি। আজও জানি না, কী তাঁর আসল নাম।
আমাদের পাড়াতেই, জোড়াফটক যাবার পথে ডানদিকে বিরাট সাদা পাঁচিল-তোলা, ফটক-লাগানো প্রকাণ্ড এক বাড়ি ছিল। বাড়িটা বরফকলের। ওই পাঁচিলের মধ্যে এক পাশে টালি আর খাপরা-ছাওয়া ছোট্ট একটা কটেজ, অনেকটা দিশি-বাঙলোর মতন। গির্জার চুড়োর মতো সে-বাড়ির মাথাতেও এক চুড়ো ছিল। লতানো গাছে শ্যাওলা-মাখা সে চুড়ো ঢাকা থাকত অনেকটা। কতোরকমের ফুল দেখেছি তার গায়ে।
এই বাড়িতেই থাকতেন বরফসাহেব। ঝকঝকে-তকতকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এক কটেজে। সামনের ছোট্ট বাগানে ঋতু-বদলের সাথে সাথে নানান ফুল ফুটত। বারান্দায় থাকত ক্রোটনের টব। একটিমাত্র টব ছিল জিনিয়া ফুলের! একেবারে সাদা—বরফের মতো ধবধবে ফুল দেখতাম সেই টবে—একটিই ফুল শুধু। বরফসাহেব নিজের হাতে কী সব করতেন যেন, আর সংবৎসর সেই টবে ফুটিয়ে রাখতেন নিঃসঙ্গ একটি জিনিয়া ফুল, একটি-দুটি কুঁড়িও। দুটি ফুল কখনো আমরা সে গাছে দেখিনি। শুনেছি, দুটি কুঁড়ি ফুটবো-ফুটবো হলেই একটি তিনি কেটে সরিয়ে ফেলতেন। কোথায় যে তা জানি না। বরফসাহেবের মেয়ে জিনিয়া—হ্যাঁ, বরফসাহেবের মেয়ের নাম ছিল জিনিয়া—আমরা অবশ্য বলতুম জিনি, লোকে বলত বরফসাহেবের মেয়ে—সেই জিনি বলত, একটি ফুল বরফসাহেব তার মাকে স্বর্গে পাঠিয়ে দেন। আমরা চোখ বড় বড় করে সে কথা শুনতাম, আর ভাবতাম, বরফসাহেব নিশ্চয়ই মন্ত্র-টন্ত্র জানেন।
বরফসাহেবের বাড়িতে কিসের যেন যাদু মাখানো ছিল। সে-বাড়ির বারান্দায় সকাল থেকেই ছায়া নামত, সবুজ রং করা বেতের চেয়ার-টেবিলগুলো সারাদিন অসাড়ে ঘুমোত, হাওয়ায় হাওয়ায় পর্দা দুলত ঘরের, খাঁচার টিয়া পাখিটা থেকে থেকে ডেকে উঠত, দূর থেকে ভেসে আসত ঘুঘুর ডাক। আর বরফকলের শব্দও নিরবচ্ছিন্ন বেজে চলত কানের কাছে।
আমরা—বীরু, তিনু আর আমি—আমরা নিত্যই যেতাম সেখানে। বরফসাহেব আমাদের খুব ভালোবাসতেন। বেঁটে-খাটো, গোলগাল, মাথায় পাকা চুল, কান জড়ানো চশমা চোখে! আমাদের সেই বরফসাহেবকে আজো স্পষ্ট মনে করতে পারি। আমরা যেন ছিলাম তাঁর বন্ধু, কি নাতির দল। আমাদের ডোমপাড়ার গ্রাউন্ডে ফুটবল খেলা থাকলে বরফসাহেব কল থেকে আধ চাঁই বরফ দিয়ে দেন, দিয়ে দেন অমন দশ-বারো বোতল লেমনেড। একটা রুপোর কাপ কিনে দিয়েছিলেন তিনি আমাদের। সেই কাপ খেলা হত ফুটবল সিজিনে। বরফসাহেব ছিলেন তার কর্মকর্তা। ক্রিকেট খেলার মরসুমে তিনি আমাদের ব্যাট, উইকেট, বল—সব কিনে দিতেন। তা ছাড়া, সর্বত্রই তো তিনি আমাদের। সরস্বতী পুজো করতাম; বরফসাহেব চাঁদা দিতেন দশ টাকা। নিজে এসে ঠাকুর সাজাতেন, বিসর্জনের সময় সঙ্গে যেতেন সবার আগে, বরফসাহেবের মেয়ে জিনি এসে অঞ্জলি দিত।
আমরা তিন বন্ধু বরফসাহেবকে আরো ঘনিষ্ঠভাবে পেয়েছি তাঁর বাড়িতে। ফাঁক পেলেই তিনি আমাদের সঙ্গে লুডো, স্নেকল্যাডার, ক্যারাম, হর্সরেস—কত কি খেলতেন। আমাদের নিয়ে বেড়াতে বেরুতেন বরফকল ছাড়িয়ে ধানক্ষেত আর মাঠের মধ্যে, কবরখানার শেষে যে চাঁদমারি আছে, সেখানে। আমরা ছুটতাম—বীরু, তিনু, আমি আর জিনি। বরফসাহেব রুমাল উড়িয়ে স্টার্ট দিতেন। খেলতাম কানামাছি। বেশির ভাগ সময় বরফসাহেব হতেন চোর। তাঁর চোখ বেঁধে দিতাম, আর তিনি ছড়ি দিয়ে দিয়ে বাতাসে আঁক কাটতেন—হ্যাই বীরু, কাঁহা গিয়া? তিনু, তোকে ধরবো এবার। জিনি—জিনি—শয়তান পাঁচুটা কোথায় রে?
বরফসাহেবের বাড়ির আড্ডায় বরফসাহেবকে সব সময় অবশ্য পেতুম না, পেতুম জিনিকে। জিনি আমাদের জন্যে পথ চেয়ে বসে থাকত। সমবয়সী সখি আমাদের। জিনিয়া ফুলের মতোই গায়ের রং, বরফসাহেব তাই বুঝি ওর নাম রেখেছিলেন জিনিয়া—জিনি। একরাশ ঝাঁকড়া-ঝাঁকড়া কাঁধ পর্যন্ত চুল জিনির। কী কোঁকড়ানো আর নরম। ঈষৎ লম্বাটে ধরনের মুখ। টানা-টানা চোখ, মণি দুটো একটু কটা। জিনির গাল-ঠোঁট লাল হয়ে থাকত। লুডো খেলায় হেরে গিয়ে গলা বেঁকিয়ে জিনি যখন আমাদের সঙ্গে ঝগড়া করত, কি অভিমান জানাত, আমরা ফ্যাল ফ্যাল করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতুম। ফ্রক পরত জিনি, কত রং-বেরঙের ফ্রক ছিল তার। আর সেই ফিকে গোলাপি সিল্কের মোজা, ওর নরম দুধ-রঙের পায়ে গা মিশিয়ে যে-মোজা আরও মধুর দুধ-আলতা রং ধরত।
জিনি ছিল আমাদের খেলার সাথী, সুখ-দুঃখের বন্ধু। আমরা গল্প করতাম, খেলতাম, খেতাম। কতদিন এমন হয়েছে, বীরু পকেট ভরতি করে চকোলেট এনেছে, তিনু এনেছে ডাঁসা পেয়ারা, আর আমি স্রেফ তেঁতুলের আচার। জিনির কাছে তিনজনে লজেন্স, পেয়ারা আর তেঁতুলের আচার নামিয়ে রেখেছি। তারপর চারজনে মিলে বারান্দার তলায়, লতা-গাছের ছায়ায় বসে এক সাথে সেইসব সুখাদ্য এবং কুখাদ্য খেয়েছি। মাঝে মাঝে জিনি জিভ বের করে মুখ-চোখ কুঁচকে বলেছে, “কী ট-ক্?” বীরু বলেছে, “খাসা”; তিনু বলেছে, “বেড়ে”; আর আমি জিনির জিভ থেকে আমার জিভে মনে মনে সব টক টেনে নিয়ে বলেছি, “গ্র্যান্ড”।
এই আমাদের জিনি। তিন বন্ধুর মনের বাগানে একটি ফোটা ফুল। তার রূপে, তার গন্ধে, তার খেলায় আমরা মুগ্ধ, আমরা খুশি, আমরা বিভোর। তার চেয়েও বড় কথা বুঝি, বরফসাহেবের মেয়ে জিনি আমাদের বন্ধু—এতে আমরা কৃতকৃতার্থ।
অথচ এই জিনি যে সত্যি সত্যি কে, তা আজও জানি না। নানান মুখে নানা কথা শুনেছি। ভাসাভাসাভাবে তার মানে বুঝলেও সে-কথা নিয়ে মাথা ঘামাতে বসিনি। জিনির জন্মরহস্য যাই হোক্, বরফসাহেবের জিনিই ছিল সব, আর জিনির বরফসাহেবই সব। তিন কুলে ওদের আর কেউ আছে বলে জানতাম না, কোনোদিন আর কাউকে দেখলাম না। জিনির জাত কী, কী তার ধর্ম, কোন্টা তার মাতৃভাষা, সে-কথা একমাত্র ঈশ্বরই জানেন। বরফসাহেব নিজে বাংলায় কথা বলতেন আমাদের সাথে, একটু তাতে উচ্চারণ-বিকৃত ছিল এই যা। আর জিনি, জিনি ইংরেজি পড়তে-লিখতে পারত যত না, তার বেশি ওর দখল ছিল বাংলায়। জিনি সরস্বতী পুজোতে অঞ্জলি দিতে আসত সেকথা তো আগেই বলেছি তোমাদের, দুর্গা পুজো, কালী পুজোতে ঠাকুর দেখে বেড়ানোর উৎসাহও আমাদের চেয়ে তার কম ছিল না। ওদিকে আবার দেখেছি, জিনির গলায় সোনার সরু হারে একটা ক্রস ঝোলানো।
বেশ ছিলাম; বীরু, তিনু, আমি আর জিনি। আর—আর বরফসাহেব।
সুখেরও ঋতুবদল আছে। একথা ছেলেবেলায় প্রথম জানলাম, বরফসাহেব যেদিন মারা গেলেন। একেবারেই হঠাৎ; মাত্র একদিনের জ্বরে। বরফকলের কাছেই ছিল গ্রেভইয়ার্ড—কয়েকটা ধানক্ষেতের ব্যবধানে। বরফসাহেবকে সেখানে কবর দেওয়া হল। সেদিন বরফসাহেবের বাড়িতে অনেক লোক দেখেছিলাম। সবই সাহেব-সুবো লোক। অবশ্য অন্ত্যজ কুলেরই বেশি। আমরা তিন বন্ধু বরফকলের গেটের কাছে ঠায় দাঁড়িয়েছিলাম চৈত্র মাসের রোদ্দুরে। অত লোক আর সাহেব-সুবো দেখে ভেতরে ঢুকতে সাহস হয় নি। বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খালি হাঁ করে তাকিয়ে থেকেছি, বিরাট সাদা উঁচু পাঁচিল ভেদ করে কিছু দেখতে পাই নি, কিছু শুনতে পাই নি, শুধু নিমগাছের ডালে সেদিনও ঘুঘুটা ডাকছিল, আর চৈত্র মাসের ঘূর্ণি হাওয়ায় উড়ে-আসা ধুলোয় আমাদের মাথা-মুখ-চোখ ভরে উঠেছিল।
বিকেল হয়-হয়—একটা কালো মতন ফুল দিয়ে সাজানো গাড়িতে বরফসাহেবের মৃতদেহ নিয়ে ওরা চলে গেল। আমরা শুধু গাড়ি দেখলুম, দেখলুম ফুল আর লোক আর কিছু না। জিনি কই? জিনি? চোখ দিয়ে তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম আমরা—দেখতে পেলুম না জিনিকে।
তিন বন্ধু ছুটে গেলাম খোলা গেট দিয়ে। সেই বরফ সাহেবের বাড়ি। বারান্দা ফাঁকা, জিনিয়া ফুলের টব ফাঁকা। সব শূন্য, স্তব্ধ, নিঝুম। বীরু ভয়ে ভয়ে ডাকলো, জিনি—জিনি। তিনু ডাকলো, জিনি—জিনি। কোনো সাড়া-শব্দ নেই। অধৈর্য হয়েই আমি চিৎকার করে ডাকলুম, জিনিয়া—জিনি।
বারান্দার নীচে লতাগাছের ঘন ছায়া থেকে কে যেন ডুকরে কেঁদে উঠল। আমরা তিনজনে ছুটে গেলাম। ওই তো জিনি, আমাদের জিনি। গুম্রে গুম্রে জিনি কাঁদছে। ফোলা-ফোলা চোখ তুলে জিনি তাকাল, আর তাকিয়ে থাকতে থাকতে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে সে কেঁদে উঠল আবার। তার কান্নায় আমাদের গলাও বুজে এল। এতক্ষণ যেন জোর করে আগলে রেখেছিলুম, আর পারলুম না, জিনির পাশে বসে আমরাও কাঁদতে লাগলুম।
কতক্ষণ কেঁদেছি, খেয়াল নেই। সন্ধ্যার অন্ধকার যখন ঘন হয়ে এসেছে, তারা উঠেছে আকাশে, তখন জিনির হাত ধরাধরি করে আমরা উঠলুম।
বীরু বললে, রাত্রে এসে সে শুতে পারে। তিনু বললে, সেও। আমিও মাথা নাড়লুম।
জিনি বললে, না, কাউকে আসতে হবে না, আয়া তো তার আছেই।
আমরা তিন বন্ধু ফিরে এলুম।
পরের দিন বিকেলে জিনিকে সঙ্গে করে গেলাম গ্রেভ্ ইয়ার্ডে, বরফসাহেবের কবর দেখতে। জবা-গাছের তলায় বরফসাহেবের কবর হয়েছে। নতুন কবর। বড্ড ঠাণ্ডা যেন। কবরের চারপাশে বসে বীরু, তিনু, আমি আর জিনি অনেক কাঁদলুম। উঠে আসার সময় আমরা বুঝি সকলেই মনে মনে বললুম, বরফ সাহেবের না-থাকার দুঃখ জিনিকে আমরা পেতে দেব না। না—না—না।
দু-দশ দিন কেটে গেল। জিনির কাছে রোজই যাই আমরা। একদিন শুনলাম, জিনিকে বরফসাহেবের ঘর ছেড়ে চলে যেতে হবে। কেন কোথায় কী ব্যাপার—? জিনি কিছুই জানে না। বরফকলের মালিকের হুকুম। অন্য সাহেব আসবে সে বাড়িতে। মুখ শুকনো জিনির। বললে—কী হবে বীরু, তিনু, পাঁচু—আমি কোথায় যাব?
তাই তো, মহা দুশ্চিন্তায় পড়লাম আমরা। জিনি যাবে কোথায়, থাকবে কার কাছে, খাবে কী? জিনিকে সাহস দিয়ে বললাম, ভয় কি, আমরা আছি।
তারপর তিন বন্ধুতে চুপিচুপি ফাঁকায় বসে গালে হাত দিয়ে কত পরামর্শ, কত চিন্তা। রাত্রে আমাদের ঘুম বন্ধ। বীরু বললে, তার বাবা লোক ভাল, কিন্তু মা? মা খেস্টান মেয়ে বাড়িতে রাখতে রাজি নয়। তিনু বীরুর কথা শুনে বললে, তার মা বড় ভাল, কিন্তু ঠাকুমা? বুড়ি এক্কেবারে হাড়-জ্বালানো ছুঁচিবাই। জিনিকে ঘরের চৌকাঠ মাড়াতে দেবে না। আমি বললুম, জিনি সরস্বতী পুজোতে অঞ্জলি দেয়, মা কালীকে প্রণাম করে ও খেস্টান নয়। তিনু বললে তা হোক, ও খেস্টানই। গলায় যীশু আছে।
গলায় যীশু-ঝোলানো মেয়েকে আমিই বা ঘরে এনে তুলি কি করে, বাবা-মা আমারও আছে; অতএব বীরু, তিনু যা পারে না, আমিও পারি না। অথচ এই না-পারাটা তখন আমাদের কাছে অত্যন্ত মর্মান্তিক দুঃখ নিয়ে দেখা দিয়েছে। কত ভেবেছি আমরা তিন বন্ধু আমবাগানের ছায়ায় বসে, রাগ করেছি গুরুজনদের ওপর, মন তিক্ত হয়েছে যীশুর ওপর—যেন ওই গলার ক্রসটাই সমস্ত বাধা। আর নিজেদের অসহায়তার কথা তুলে সান্ত্বনা দিয়েছি পরস্পরকে।
আশ্চর্য, ওই বয়সেও আমাদের লজ্জা পাবার মতো মন ছিল। জিনির জন্যে কিছুই করতে পারছি না তারই লজ্জা। পরম লজ্জাই বলা যায়। জিনির কাছে যাওয়া বন্ধ করতে হল। কাঁহাতক আর রোজ রোজ মিথ্যে কথা বলে তাকে ঠেকিয়ে রাখি। তা ছাড়া সত্যি কথা বলতেও যেমন মুখ ফুটত না, জিনির কাছে মিথ্যে কথা বলতেও তেমনি কষ্ট হত।
জিনি-বিহনে আমাদের কিশোর-বৃন্দাবন অন্ধকার। মন খারাপ, মেজাজ খারাপ—এমন কি, বোধহয় শরীরটাও সকলের একটু খারাপ হয়ে গেল।
সেদিন শনিবার। স্কুল থেকে ফিরে এসে বীরু আর আমি ঘুড়ির সুতোয় মাঞ্জা চড়াচ্ছি, এমন সময় লাফাতে লাফাতে তিনু ছুটে এল। হাঁপাতে হাঁপাতে বললে, “জিনি—জিনি ডাকছে তোদের; শীঘ্রি চ’—”
জিনি? কোথায় জিনি? মাঞ্জা মাথায় থাকল—ছুটলাম আমরা জিনি-সন্দর্শনে। পাড়ার শেষ মাঠের কাছে ল্যাঙড়া ডাক্তারের বাড়িতে দেখা পেলাম জিনির; কুলতলায় দাঁড়িয়ে ছিল আমাদের অপেক্ষায়। দেখা হতে জিনি অভিমানভরে কাঁদল, বলল তার মনোব্যথা করুণ সুরে।
বরফসাহেবের বাড়িতে জিনির যে আয়াটা ছিল, সেই আয়াবুড়িই শেষ পর্যন্ত জিনিকে এখানে এনে ঠাঁই দিয়েছে। আমরা বললাম, তোমার ঘর কই? জিনি জবাব দিলে, তার ঘর নেই। আয়া-বুড়ির সাথে এক সঙ্গে একটা কুঠুরিতে সে থাকে।
জিনি আরও কত কথা বললে, সমস্ত কথাই এ বাড়ির । এখানে তার কত যে কষ্ট, তারই কথা। আমরা চুপ করে সব শুনলাম শুধু। বলার কিছু ছিল না।
আসার সময় বীরু বললে, মন-টন খারাপ করো না, জিনি। আমাদের পাড়ার মধ্যে এসে গেছ, বেশ হয়েছে; এক পাড়াতেই কাছাকাছি থাকব। রোজ আসব আমরা।
বীরুর সান্ত্বনাটা যে নেহাতই অসার একথা বুঝতে বেশ কিছুদিন লাগল। জিনিকে আমাদের পাড়ার মধ্যে পেয়ে প্রথমটায় অবশ্য পুলকিত হয়েছিলাম, দুর্ভাবনা দূর হয়েছিল জিনি আশ্রয় পেয়েছে জেনে; কিন্তু প্রথমে যা ভাবিনি, দেখিনি, ক্রমেই তা চোখে পড়তে লাগল।
জিনি যে বাড়িতে এসে উঠেছিল সেটা এক পার্শী বুড়োর পাঁউরুটি-বিস্কুট-কেক তৈরির কারখানা। পার্শীটার নাম ছিল পেসরানজী, আমরা বলতুম পেস্তাবাদামজী। বাড়ির এক অংশে থাকত সেই পেস্তাবাদামজীর পরিবার—সাহেবী কায়দায়; আলাদা করে ঘেরা সেই অংশ। বাকি বাড়িটা ছিল পাঁউরুটির কারখানা—যেমনি নোঙরা, তেমনি গন্ধ। ওখানেই রুটি-বিস্কুট-কেক তৈরি হয়, আর এদিক-ওদিক মাথা গুঁজে পড়ে থাকে কারিগররা—যত সব খানসামা, বাবুর্চি ক্লাসের ছোটলোকের দল। ওরা বিড়ি ফোঁকে, ইতর ভাষায় কথা বলে, রগড় করে জিনিকে নিয়ে, আমরা গেলে আমাদের নিয়েও।
কাণ্ড-কারখানা যত দেখি, ততই চোখ বড় বড় হয়ে ওঠে। প্রথম-প্রথম দেখতাম, জিনির কোনো কাজ ছিল না। বাড়ির কোনো নির্জন কোণে এসে সে একা-একা বই পড়ছে, কি, তেঁতুল-বিচি নিয়ে খেলছে। বাড়িতে স্থান না জুটলে কুলতলায় ঠায় বসে থাকত জিনি একা-একা। চলে আসত আমাদের কাছে। ক্রমেই সেসব বন্ধ হল। দেখলাম, জিনি কাজকর্ম করে। কখনও দেখি, জিনি দু হাতে বড় বালতি ধরে টেনে-হিঁচড়ে জল বয়ে নিয়ে যাচ্ছে, কখন মাথায় তার পাঁউরুটির ঝুড়ি, কখন বা তোয়ালে-জড়ানো খাবার বয়ে দুপুর রােদে জিনি চলেছে পেস্তাবাদামজীর দোকানে—সেই পোস্ট অফিসের কাছে।
চোখের সামনে দেখি, জিনি দিন-দিন রোগা হয়ে যাচ্ছে। তার ঠোঁটের হাসি মুছলো, মুছলো তার গালের লাল আভা। আটা-ময়দার গুঁড়োয় অমন চুল তার রুক্ষ লালচে হয়ে উঠেছে। জিনির গায়ে ছেঁড়া ফ্রক; পায়ে রং-করা মুসলমানী মেয়েদের মতো খড়ম।
জিনিকে একদিন বললাম, “তুমি এত কাজ করো কেন?”
জিনি করুণ সুরে জবাব দিল, “কাজ না করলে মারে, খেতে দেয় না।”
জিনির কথা শুনে বীরু লাফিয়ে উঠল, “কে মারে তোমায়—নাম বলো। সে ব্যাটার আমি হাত ভাঙব।”
কি জিনি জবাব দিল, “কার নাম বলবো, সকলেই। কাজ করতে না পারলে মারবে ছাড়া আর কি করবে!”
আমাদের সেই আয়াবুড়ির কাছে গেলাম। সে বুড়ি কেঁদেকেটে বললে, “খোকাবাবুরা, আমার নসিব। আঁখ্ গেছে আমার—দেখতে পাই না এক চোখে, পার্শী সাহেবের বাড়িতে ফাই-ফরমাস খাটি। সাত টাকা তলব দেয়। জিনিমিসি কারখানায় খাটে—পাঁচ টাকা তলব। না খাটলে দানা পড়বে না পেটে। তব্ভি জিনিমিসিকে আমি এক আঁখে রাখি। না রাখলে এরা ওকে কুত্তার মতো ছিঁড়ে খেতো। জিনিমিসির উমর বাড়লো।”
সত্যিই, জিনির বয়স বেড়েছে; বয়স বেড়েছে আমাদেরও। এখন অনেক জিনিস বুঝি, অনেক জিনিস দেখি। ময়লা, রঙিন শাড়ি পরে, কোমর পর্যন্ত রুক্ষ চুলের এক বেণী ঝুলিয়ে জিনি যখন আমাদের কাছে এসে দাঁড়ায়, আমরা তখন তার বাড়ন্ত দেহটাকে আড় চোখে লক্ষ করে জিনির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে শঙ্কিত হয়ে উঠি।
আমরা কারখানায় জিনির কাছে গেলে ইদ্রিস, নুলো—সব ক’টা লোকই ইতর রসিকতা করে, সে কুৎসিতভাবে। সম্মানে আঘাত লাগে আমাদের। বীরু বলে, এ বাড়িতে জিনি থাকে থাকুক, আমাদের আসা চলবে না। তিনু মাথা নেড়ে সায় দিলে। আমিও মাথা নাড়লুম।
জিনির সঙ্গে বন্ধুত্বের বন্ধনটা আরও ক্ষীণ হল। আমরা বেশ বুঝতে পেরেছিলাম, বরফসাহেবের বাড়িতে যে-জিনি আমাদের স্বপ্ন ছিল, যাকে মনে মনে অনেক উঁচুতে স্থান দিয়েছিলাম—সেই জিনি পেসরানজীর পাঁউরুটি কারখানায় ছোটলোকদের ভিড়ে একসাথে থেকে, খেয়ে, চুল্লি ধরিয়ে, আটা মেখে অনেক নীচুতে নেমে গেছে। আমাদের সাথে ওর মেলামেশা প্রকাশ্যভাবে আর চলে না। সেটা দৃষ্টিকটু।
দিনে দিনে যাওয়া-আসা, দেখা-সাক্ষাৎ বন্ধ হল। নেহাতই যদি কোনোদিন পথে দেখা হত, কিংবা জিনি আসত গল্পের বই চাইতে তবেই কথা হত। তাও সামান্য দু-চারটে কথা।
জিনিকে আমরা এড়িয়ে চলি প্রত্যক্ষভাবে, কিন্তু পরােক্ষভাবে তার নামে কথা উঠলেই কান খাড়া করে শুনি। হ্যাঁ—তখন ক্রমাগতই জিনির নামে কুৎসা শুনছি, নানান মুখে।
একদিন তিনু এসে বললে, “এ শালা জাতের দোষ।”
“কিসের?” প্রশ্ন করলুম অবাক হয়ে।
“জাতের; বুঝলি না, হাঁদারাম। যার জন্মের ঠিক নেই, দো-আঁশলা—সে ছুঁড়ির আর হবে কি? যাই বলো, ও ঠিক ওর মনের মতো জায়গায় জমে গেছে।”
“কার কথা বলছিস রে, জিনির কথা?” বীরুর লাল ঘুঁটিটা পকেটে ফেলে ক্যারাম বোর্ডটা ঠেলে সরিয়ে দিল।
“আজ্ঞে হ্যাঁ—জিনি নয় তো কার! আমি বাজি ফেলে বলতে পারি, মাইরি—ও কিছুতেই সাহেব-টাহেব নয়, এক্কেবারে লেড়িকুত্তার জাত। ময়ূরপুচ্ছ গুঁজে বসেছিল। এখন সব পুচ্ছ খসে গেছে।”
তিনুর উত্তেজিত হবার কারণটা জানা গেল। কাল শেষ বিকেলে নাকি কোন্ ধানক্ষেতের ধারে জিনি আর ইদ্রিসকে দেখা গেছে— বিজন বলেছে তাকে।
খবরটা জানিয়ে তিনু নানারকম খারাপ মন্তব্য করতে লাগল।
“যা মুখে আসে, তাই যে বলছিস, তিনু।” বললাম আমি অসন্তুষ্ট হয়ে।
“কি খারাপ বলেছে?” বীরু তিনুর হয়ে জবাব দিল।
“জিনি ভালোই হোক আর মন্দই হোক, তোর আমার কি?” বললুম আমি।
“কেন নয়?” বীরু দপ্ করে জ্বলে উঠল যেন, “জিনি কি ইদ্রিসের?”
“তো কি তোর নাকি?” আমার মুখ দিয়ে ফঁস করে কথাটা বেরিয়ে গেল।
“আলবাৎ। আমাদের নয় তো কোন্ শালার?”
আমি চুপ এবং আমরাও।
জিনি কি আমাদের? আমি ভাবলুম। শুধুই কি আমি ভেবেছি? না, না—বীরু, তিনু, আমি—আমরা সবাই হয়ত সেদিন ভেবেছি—জিনি কি আমাদের?
মাস, বছর কেটে গেল চোখের ওপর দিয়ে। আমরা তখন ম্যাট্রিক পাস করে বেকার বসে আছি। তিনজনেই চেষ্টায় আছি রেলের চাকরির। মাঝে মাঝে ইনটারভিউ দিয়ে আসি আসানসোল গিয়ে। ওই পর্যন্ত, চাকরি আর কপালে জোটে না।
বেকার যুবকদের কাজ কি কি হতে পারে—তোমরাই ভেবে নাও। স্রেফ হোটেল-ডি-পাপার অন্ন ধ্বংস, ঘুম, আড্ডা, বিড়ি ফোঁকা। আমরাও তার জের টেনে চলেছি। তফাতটুকু শুধু এই যে, আমরা অধিকন্তু তিনটি কাজ করতাম। রেল ইনস্টিটিউট থেকে অখাদ্য উপন্যাস এনে রাতারাতি শেষ করা, খেলা থাকলে মাঠে ছোটা, আর—আর বুঝতেই তো পারছ, যেহেতু বয়সটা খারাপ এবং হাতে অনন্ত সময়, সেহেতু নিজেদের মধ্য পাড়া-বেপাড়ার মেয়ে নিয়ে একটু খোশ গল্প।
ফেরতা দিয়ে কাপড় পরে, গলার ওপর শার্টের কলার তুলে, বাঁ হাতে সাইকেল চালিয়ে, বাঁশি বাজিয়ে বেশ মসৃণ গতিতে দিন কাটাচ্ছি, হঠাৎ জিনি সব সুখ ভেস্তে দিল।
পার্শী পেসরানজীর বেকারি উঠে গেছে, জিনি কাজ নিয়েছে ধানবাদ রেল ইনস্টিটিউটের সিনেমাতে—লেডিস গেটের গেটকিপার। নীল শাড়ি পরে, বিনুনি দুলিয়ে, শ্লিপারে ধুলো উড়িয়ে জিনি আমাদের চোখের ওপর দিয়ে চাকরি করতে যায়। তখনও সে থাকে আমাদের পাড়াতেই—একটা ঘর ভাড়া করে।
সে কথা যাক, আসল কথা বলি। এই বয়সে জিনিকে আবার যেন হঠাৎ একদিন নতুন চোখে দেখলাম।
সিনেমা দেখতে গিয়েছিলুম আমরা— বীরু, তিনু আর আমি। টিকিট পেলাম না। কি একটা বাংলা বই হচ্ছিল, বেজায় ভিড়। রাত্রের শোয়ের টিকিট কিনে সামনের চায়ের স্টলে বসে বসে গল্প করছি আর চা খাচ্ছি মৌজ করে, সেই সঙ্গে এদিক-ওদিক চোখ রেখে সিগারেট ফুঁকছি। এমন সময় দেখি, কলকাতা থেকে নতুন আমদানি—চালিয়াত সিনেমা অপারেটার সুখেন্দু ট্রাউজারের পকেটে হাত ঢুকিয়ে হি-হি করে হাসতে হাসতে স্টলে ঢুকছে—পাশে জিনি। আমাদের দেখে জিনি হাসি-মুখেই কি একটা বলল যেন, তার পর ওরা দু’জনেই পরদা-ফেলা ঢাকা জায়গার মধ্যে গিয়ে বসল।
বীরু তাকাল আমার দিকে, আমি তিনুর দিকে। তিনজনে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে সবাই একসঙ্গে তাকালুম পরদার দিকে। সব লক্ষ করলাম আমরা। চপ গেল, কেক গেল, টি-পটে করে চা গেল পরদার ভেতরে। সুখেন্দুর হাসির সাথে মাঝে মাঝে জিনির হাসিও কানে এল। সিগারেটের গন্ধও ভেসে আসতে লাগল ভেতর থেকে।
সেদিন যে মাথা-মুণ্ডু কি ছবি দেখেছি, জানি না। শােয়ের শেষে তিন বন্ধুই গুম হয়ে অন্ধকারে পথ হেঁটেছি। পাড়ার কাছাকাছি এসে বীরু বলল, “জিনি তা হলে বেশ ভালোই আছে!” তিনু বললে, “বেকারিতে থাকার সময় শুঁটকি মেরে গিয়েছিল। দেখলে মনে হত টি বি রুগী । এখন চেহারাটা বেশ ফিরেছে।”
আমি বললাম, “সুখেন্দু লটকেছে।” আমার কথা শুনে বীরু উত্তেজিত হয়ে ঘোষণা করলে, “লুটোচ্ছি। ওসব কলকাতিয়াগিরি ধানবাদে চলবে না।”
মিথ্যে কথা বলব না। সেইদিন থেকে কী যেন হয়ে গেল আমাদের। সে অবস্থা বর্ণনা করা মুশকিল। এক কথায় বলতে পারি, বিশ্রী একটা ঈর্ষায় আমরা জ্বলতে লাগলুম মনে মনে। এ ঈর্ষা কেন, কার ওপর, তা কি খতিয়ে দেখেছি নাকি? উঁহু, সেসব দেখি নি। খালি ভেবেছি, এ আমাদের হার। একেবারে থ্রি টু নীলে। ক্যালকেশিয়ান সুখেন্দু আমাদের হারিয়ে দিয়েছে।
পাড়ায় ঘাঁটি ফেললাম—ঘাঁটি ফেললাম সিনেমায়। জিনির যাওয়া-আসা চাল-চলন নজর রাখি। কখন যায়, কখন ফেরে, কি করে।
একদিন তিনু এসে বললে, সুখেন্দু আর জিনি অপারেটারের ঘরে গা জড়াজড়ি করে বসে থাকে। বীরু বললে, সুখেন্দু জিনিকে ওই ফুল-তোলা শাড়িটা কিনে দিয়েছে। আমি বলি, জিনি আজকাল রোজ বেশ রাত করে ফেরে।
অসহ্য—অসহ্য! এ আমাদের অসহ্য। মনে পড়ে বীরুর কথা—আলবাৎ জিনি আমাদের। আমাদের নয় তো কার? সেই জিনি বেলেল্লাপনা শুরু করেছে; আর আমরা শুধু দেখেই যাব!
বীরু সুখেন্দুকে একটা উড়ো চিঠি দিয়ে শাসালো। কোনো কাজ হল না। আড্ডায় তিনজনেই আমরা লোভনীয় তিনটি প্রত্যক্ষ দৃশ্য দেখেছি বলে বর্ণনা দিলুম। সত্যি বলতে কি, আমি কিছুই দেখি নি। কিন্তু বীরু, তিনু যদি দেখে থাকে, আমার না দেখাটা শোভা পায় না। বানিয়েই বললুম, সুখেন্দু আর জিনি রাত প্রায় বারোটার সময় কাল পাড়ায় এসেছে। সুখেন্দু জিনির ঘরেই ছিল। সারা রাত।
শুনে বীরু আমাদের টেনে নিয়ে সটান গিয়ে হাজির হল জিনির কাছে।
“কী?” জিনি প্রশ্ন করলে।
“এটা ভদ্রলোকের পাড়া, জিনি।”
“ওমা, তা কে না জানে?” জিনি হেসে ফেললো।
“জানো তো, এমন হয় কেন?” বীরু অনেক কষ্টে বললে।
“কী?” জিনি জানতে চাইল।
বীরু আমায় বলতে বললে কী’-টা। আমি কি বলব! আমি বলতে বললাম তিনুকে। তিনু বললে বীরুকে।
কাজ শেষ পর্যন্ত কিছুই বলা হল না। আমরা বোকার মতো তিনজনে ফিরলাম। জিনি খিলখিল করে হাসতে লাগল।
জিনির হাসি যেন আমাদের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিল। জ্বলে-পুড়ে মরতে লাগলুম তিন বন্ধু। এ অপমান বরদাস্ত করা যায় না।
এমন সময় হঠাৎ একদিন হকি খেলে ফেরার পথে সুখেন্দুকে পেয়ে গেলুম ফাঁকায়। বীরু তাকে গিয়ে ধরল, সঙ্গে সঙ্গে আমরাও।
হকি-স্টিকের মার তো কম নয়। সুখেন্দু বেশ ক’দিন বিছানায় পড়ে থাকল।
তারপর আবার যে কে সেই। সুখেন্দু আর জিনি। একটা শুধু পরিবর্তন লক্ষ করলাম। জিনি আজকাল আমাদের দেখেও দেখে না। পথে দেখা হলে মুখ নীচু করে দ্রুত পায়ে পাশ কাটিয়ে যায়।
এও অসহ্য। বীরু বললে, “ওর লভারকে ঠেঙিয়েছ, ও তোমাদের দিকে তাকাবে কেন? মনে মনে খাপ্পা হয়ে গেছে।”
তিনু বললে “তাই বলে এ অপমান?”
তিন বন্ধু যুক্তি আঁটলাম নানারকম এবং সবচেয়ে সাঙ্ঘাতিক যেটা, সেটাই প্রয়োগ করলাম এবার। প্রতিশোধ নেবার এমন দুর্দমনীয় বাসনা মানুষের কেন হয়, কে জানে!
সিনেমা সেক্রেটারির মানিক অধিকারীকে এক চিঠি পাঠালাম। আমাদের রেল-পাড়ার কয়েকজন বাপের বয়সী ভদ্রলোকের নাম-সই জাল করে, ব্লক নম্বর দিয়ে। তাতে জিনির চরিত্র সম্পর্কে লোমহর্ষক কুৎসিত ইঙ্গিত নানা রকমের। ও মেয়েকে চাকরিতে রাখলে বাড়ির বউ-ঝিকে আর সিনেমা দেখতে পাঠানো যাবে না। যদি জিনির চাকরি এর পরও থাকে, তবে জেনারেল মিটিং-এ এইসব নিয়ে কেলেঙ্কারি হবে কিন্তু।
মফস্বল শহরের রেল ইন্স্টিটিউটের সিনেমা সেক্রেটারি—তাঁর অত ঝামেলায় কাজ কি! জিনির চাকরি গেল। এমন কি, কয়েকদিন বাদে সুখেন্দুরও।
আমরা খুব খুশি। যেন যুদ্ধ জয় করেছি। আনন্দের চোটে একদিন ভিজে বেড়ালের মতো জিনির বাড়িতে সহানুভূতি জানাতে গেলাম। জিনি সেদিন আমাদের পরম বিস্ময়-ভরা চোখ নিয়ে অনেকক্ষণ দেখেছিল, একটাও কথা বলেনি।
গল্পটা এখানে শেষ হতে পারত, যদি জিনি সুখেন্দুর সাথে ধানবাদ ছেড়ে চলে যেত। আমরা তাই ভেবেছিলাম। কিন্তু জিনি আমাদের অনুমান মিথ্যে করল। সুখেন্দু ধানবাদ ছেড়ে চলে গেল আর জিনি আমাদের পাড়া ছেড়ে বাজারের মধ্যে খোলার চালঅলা এক সরু নোংরা গলিতে গিয়ে ঘর বাঁধল। একা।
জিনি যেখানে ঘর বাঁধল, সে-গলিটা সম্পর্কে নানান জনে নানা কথা বলত। ওখানে বাজারের শাকসবজি, আলু-পটল-অলারা থাকে, থাকে মুটে-মজুর-ঝিয়ের দল এবং আরও এ-ও, যাদের দু’চার টাকায় মাথা গোঁজার জায়গা চাই, তারাই।
বাজরের মধ্যে দিয়ে ইন্স্টিটিউট যাবার ওইটেই শর্ট-কাট পথ। আমরা সাইকেল নিয়েও ওই পথ দিয়ে যাতায়াত করতুম। জিনি যাওয়ার পর ওই পথে যাতায়াতটাও আমাদের বেড়ে গেল।
একদিন এক দৃশ্য প্রত্যক্ষ করলুম। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। ইন্স্টিটিউট থেকে আমরা দুই বন্ধু—বীরু আর আমি ব্রিজ টুর্নামেন্ট খেলে ফিরছি ভিজতে ভিজতে, জিনিদের অন্ধকার গলির পথ দিয়ে। হঠাৎ চেপে বৃষ্টি এল। একটা ঘোড়ার গাড়ির আস্তাবলের টিনের চালার তলায় দাঁড়ালুম আমরা।
এক সময় বীরু হঠাৎ বললে, “এই দ্যাখ—দ্যাখ।”
বীরুর নির্দেশ অনুসরণ করে আমি তাকালুম। মিউনিসিপ্যালিটির মিটমিটে লাইট-পোস্টের কাছে একটা লোক ঘুরঘুর করছে। টলমল পা! দু-চার পা এদিক-ওদিকে যাওয়া-আসা করতে করতে শেষ পর্যন্ত একটা ঘরের দরজায় বসে পড়ল।
“নন্দ না?”
“হ্যাঁ, নন্দ বলেই মনে হচ্ছে।” আমি বললুম।
তাকিয়ে থাকতে থাকতে বীরু বেশ একটু কঠিন গলায় বললে, “নন্দও আজকাল জিনির কাছে আসে।”
“জিনি?” আমি অবাক, “তুই জানলি কি করে?”
“জানি। ও বাড়িটা জিনির।”
বৃষ্টি থেমে এল; আমরাও পথে নামলাম।
পরের দিন জিনির প্রসঙ্গ উঠল। উঠবেই যে, সেটা স্বাভাবিক। তিনু সব শুনে টিপ্পনী কাটল, “মাত্র এই—এ আমি আগেই জানতাম। কী না দেখেছি, আর না শুনেছি। রীতিমত একটা বেশ্যা হয়ে উঠেছে জিনি। বাজারের যত মদো-মাতাল আলুঅলা-বিড়িঅলা ওর কাছে যায়-আসে।”
তিনুর কথা শুনে বীরু দপ করে জ্বলে উঠল।
“যাওয়াচ্ছি সব শালাকে। দাঁড়া—”
“কী করবি তুই?” আমি প্রশ্ন করলুম।
“পেঁদিয়ে বাজার থেকে ওঠাবো। এ কি মুফতি মাল নাকি? যে আসবে, সেই।” বীরু উত্তেজনার মাথায় বিড়ির টুকরোটা ছুঁড়ে দিলো তিনুর গায়েই। তিনু ক্ষিপ্র হাতে জামা বাঁচিয়ে বিড়ির শেষ অংশটুকু ফুঁকতে লাগল চোখ ছোট করে।
“শেষ পর্যন্ত আলুঅলা নন্দ! শেম্।” বীরু কপালে হাত তুলল।
“কী অধঃপতন!” তিনু চোখ ছোট ছোট করেই যোগ করলে, “বরফসাহেবের মেয়ে আলুঅলা নন্দর—”
তিনুর বাকি কথাটা শেষ করতে না দিয়ে আমি বললুম, “আচ্ছা বীরু, আমাদের এত মাথাব্যথার দরকার কি? যার ছাগল, সে যেখানে খুশি কাটুক।”
বীরু কটমট করে আমার দিকে তাকাল। এবং পর মুহূর্তেই অধৈর্য হয়ে চিৎকার করে উঠল, “পাঁঠাটা কি নন্দর?”
“আমাদেরও না।” আমি বললুম।
“আলবাত আমাদের। আমাদের নয় তো কোন্ ব্যাটার। আস্ক্ তিনু, এ কথাটা মরাল রেসপন্সিবিলিটির কোশ্চেন। হাজার হােক, জিনি আমাদের ছেলেবেলার বন্ধু—বরফসাহেবের মেয়ে। একসঙ্গে, এক পাড়ায় আমরা থেকেছি। সেই মেয়েটা বাজারের বনে যাবে, দ্যাট্স্ ইম্পস্ব্ল। উই ক্যান্ট অ্যালাও দ্যাট্।”
“ঠিক বলেছে বীরু,” তিনু আমার দিকে তাকিয়ে বললে, “তুই ভাব পাঁচু, ছেলেবেলার সেই জিনি আর আজকের জিনি। এ একেবারে তোর সেই হেভেন অ্যান্ড হেল্। বরফসাহেবের কাণ্ডকারখানা দেখে স্বর্গ থেকে আমাদের মুণ্ডুপাত করছে।”
“শোনো!” বীরু আমার দিকে তর্জনী তুলে শাসালো, যেন আমিই জিনি। বললে, “আমার বাবা প্লেন কথা। তুমি আমাদের বন্ধুলোক, গরিব হও, বড়লোক হও, যায় আসে না । বাট্ ইউ মাস্ট্ বি গুড্। ওসব বেলেল্লাগিরি চলবে না। জিনিকে শেষবারের মতো এই কথাটা জানিয়ে দেব।”
বীরু আর তিনু যা বললে, তাতে আর আমার সন্দেহ রইল না, জিনিকে সৎপথে রাখাটা আমাদের নৈতিক কর্তব্য অর্থাৎ মরাল রেস্পন্সিবিলিটি।”
এরপর কয়েকদিন বীরু, তিনু আর আমি বাজারপাড়ার সেই গলির মধ্যে ঘুরঘুর করলাম একসঙ্গেই। বাড়ির বাজারটা আমরা স্বহস্তে করতাম। বেকার অবস্থায় ইনকামের ওই একটা পথ গার্জেনরা আমাদের দয়া করে দিয়ে থাকেন। আলুঅলা নন্দর কাছে আলুটা আমরা কিনতাম বরাবরই। তার প্রধান কারণ, নন্দ আমাদের কাছে ধার রাখত। আর দ্বিতীয় কারণ, ভদ্রলোকের ছেলে সে; ইউ পি স্কুলের শেষ ক্লাস পর্যন্ত আমাদের সাথে পড়েছিল, সেই সুবাদে বাল্যবন্ধু। অবশ্য বাল্যকালটা যেমন চিরন্তন নয়, তেমনি নন্দরও সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্বের সম্পর্কটাও সেই ফাইভ ক্লাসেই শেষ হয়ে গেছে। পরবর্তীকালে নন্দ তার তরফ থেকে বন্ধুত্বটুকু রাখতে চেয়েছিল, আমরা পাত্তা দিই নি। ইদানীং ধার পাই বলে হেসে-টেসে দু’চারটে কথা বলি। যাই হোক, বাজার করতে গিয়ে আমরা আভাসে নন্দকে ঠেস দিয়ে কথা বলেছি, পরখ করতে চেয়েছি তার মনোভাব। মােটা-মাথা, নাদুস-নুদুস নন্দ পানের ছোপ-ধরা দাঁত বের করে শুধু হেসেছে। কিছুই বোঝে নি, কিছুই বলে নি।
বীরু বললে, ও বেটা পয়লা নম্বরের শয়তান। তিনু বললে, তা না হলে আলুর ব্যবসা করে টু পাইস করে। আমি বললুম, ওর মাথা মোটা নয় মাইরি, বেড়ে চালাক দেখছি।
ইতিমধ্যে এক সুযোগ এলো আমাদের হাতে। একেবারেই আকস্মিকভাবে।
রাত তখন গোটা দশেক হবে বোধহয়। বর্ষার দিন। বৃষ্টি আসে হঠাৎ, থামে খানিকক্ষণ; তারপর আবার দেখো, সেই একঘেয়ে ইলশেগুঁড়ি। বীরু, তিনু আর আমি সেদিন একসঙ্গে রাত করেই ইনস্টিটিউট থেকে ফিরছি বাজারপাড়ার গলি দিয়ে। গলি ফাঁকা। মিউনিসিপ্যালিটির সেই বাতিটা টিম-টিম করে জ্বলছে। গলি প্রায় ফুরিয়ে আসে-আসে এমন সময় দেখি—নন্দ। অন্ধকারের কোনো সঙ্গোপন কোণ থেকে টলতে টলতে বেরিয়ে আমাদের প্রায় ঘাড়ের ওপর পড়ে আর-কি।
আমরা একটু সরে গেলাম। নন্দও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে টলতে লাগল পা ফাঁক করে। তারপর দু হাত জোড় করে মদের ঝোঁকে সে যেন জড়িয়ে জড়িয়ে কিছু একটা বলবার চেষ্টা করলে। বোধহয় ঘাড়ের ওপর এসে পড়ার জন্যে ক্ষমা চাইছিল।
বীরু তাকাল তিনুর দিকে, তিনু আমার দিকে। তিনু ইতর একটা উক্তি করলে নন্দকে উপলক্ষ করে। তিনজনে সেই উক্তির সূত্র ধরে আর-একবার চোখ চাওয়া-চাওয়ি করলাম। আমাদের চোখে যে কি ছিলো, জানি না। বীরু হঠাৎ দু পা এগিয়ে নন্দর মুখে দড়াম করে এক ঘুষি বসিয়ে দিলে। আচমকা ঘুঁষি খেয়ে মাতাল নন্দ টলতে টলতে রাস্তার ওপর প্রায় পড়-পড়—দেখি, তিনু ছুটে গিয়ে তার পেটে টেনে এক লাথি মারল। কেমন একটা আঁতকে ওঠার শব্দ করে নন্দ রাস্তার ওপর মুখ গুঁজে পড়ল।
“ঠিক হয়েছে। শালা, মাতাল।” দাঁতে দাঁত চেপে বললে তিনু, “চল, পালাই।”
“চল্।” বীরু জামায় হাত ঘষতে ঘষতে পিছু ফিরলে।
“বীরু।” আমি ডাকলুম।
বীরু, তিনু ফিরে দাঁড়াল।
নীচু গলায় বললাম আমি, “কেটে তো পড়ছি। কিন্তু নন্দটা কেমন করে গোঙাচ্ছে দেখ্। ব্যাটা যদি মরেই যায়।”
“মরে মরুক, চলে আয়।” তিনু জবাব দিলে।
বীরু নন্দর ভূলুণ্ঠিত দেহের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কী ভেবে তার পাশে বসে পড়ল। একটু পরে উঠে দাঁড়িয়ে নীচু গলাতেই বললে, “মারটা বড় জোর হয়ে গেছে রে, পাঁচু। শালার নাক-মুখ দিয়ে এখনও রক্ত পড়ছে। মাইরি। এভাবে সারা রাত পড়ে থাকলে ব্যাটা মরুক না মরুক, নির্ঘাৎ নিউমোনিয়া হয়ে যাবে।”
বীরুর কথায় ভীত হলাম। বললাম, “কী করবি? ফেলে পালাবি?”
বীরু দাঁতে ঠোঁট কামড়ে কী যেন ভাবছিল। হঠাৎ বললে, “অল রাইট্। ধর শালাকে, চ্যাংদোলা করে তোল্।”
আমরা তাকালুম। অর্থাৎ প্রশ্ন করলুম, চ্যাংদোলা করে না হয় তুললাম নন্দকে, কিন্তু তারপর—তারপর কী?
আমাদের মনোভাব বুঝে বীরু বললে, “ঘাবড়াস না। সবচেয়ে ভালো বুদ্ধি মাথায় এসেছে। নন্দকে জিনির জিম্মায় দিয়ে যাই। যার জিনিস সে বুঝুক। জিনিও জানুক, আমাদের চোখে ধুলো দিয়ে পীরিত করা যায় না।”
বীরুর প্রস্তাব আমাদের মনঃপূত হল। ঠিক বলেছে বীরু।
নন্দর সেই বিশাল সিক্ত বপু আমরা কোনরকমে টানতে টানতে বয়ে চললাম। উৎকট গন্ধ ভাসছে নন্দর গা থেকে। কী যেন বিড়বিড় করছে হারামজাদাটা তখনও।
অনেকক্ষণ কড়া নাড়ার পর ভেতর থেকে জবাব এলো, “কে?”
বীরু জবাব দিল । বললে, “আমরা—বীরু, তিনু, পাঁচু। বিপদ হয়েছে। শিগগির খোলো।”
দরজা খুলল জিনি, হাতে তার লণ্ঠন। কোন ভূমিকা না করেই নন্দর বেহুঁশ দেহটাকে আমরা রোয়াকে নামিয়ে রাখলুম।
লণ্ঠনের আলো নন্দর মুখে ফেলে জিনি আঁতকে আর্তনাদ করে বলে উঠল, “এ কী? একে এখানে নিয়ে এসেছো কেন?”
বীরু নন্দর কাপড়ের খুঁট দিয়ে তার নাক-মুখ মুছিয়ে দিয়ে বললে, “মাতাল লোক, পথ চলতে পারে না, নালার ওপর মুখ থুবড়ে পড়েছে। ভয় নেই, রক্ত বন্ধ হয়ে এসেছে—ঠিক হয়ে যাবে।”
“তা, তা তোমরা ওকে এখানে আনলে কেন?” জিনি ভীত, বিস্মিত গলায় আবার বললে।
“কোথায় তবে নিয়ে যাব?” বীরুর গলার স্বরে তীক্ষ্ণ বিদ্রূপ, “ছেলেবেলার বন্ধু আমাদের নন্দ, আর তুমিও হলে ছেলেবেলার বান্ধবী। নন্দ নর্দমায় মুখ গুঁজে সারা রাত পড়ে থাকবে, তাই কি চোখে দেখতে পারি! পৌঁছে দিয়ে গেলাম তাই। আয় পাঁচু, তিনু—”
বীরুর ডাকের সাথে আমরা জিনির ঘরের দরজা টপকে রাস্তায় এসে নামলুম। দরজা হাট হয়েই খোলা থাকল।
গলি পেরিয়ে আমরা যখন বড় রাস্তায় পা দিয়েছি—তিনু বললে, “আ—এ যা একটা হল না মাইরি, খাসা—সব অপমান স্রেফ জুড়িয়ে জল হয়ে গেল।”
বীরু গম্ভীর স্বরেই জবাব দিলে, “নোব্ল্ রিভেঞ্জ!”
এ ঘটনার কয়েকদিন পরের কথা। বীরুদের বাড়িতে বসে আমরা তাস খেলছি। তখন দুপুর। হঠাৎ দেখি—নন্দ। নন্দকে ক’দিনই আর আলুর দোকানে দেখি নি।
ঘরে ঢুকেই নন্দ আমাদের পাশে বসে পড়ে তিনবার তিনজনের হাত জড়িয়ে ধরল। কেমন যেন ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেলুম আমরা। নন্দটাও যে কী বলবে, ঠিক করতে পারছে না। পানের ছোপ-ধরা দাঁতগুলো বের করে হাসিতে, আহ্লাদে, মিনতিতে ঠিক একটা কুকুরছানার মতো কেঁউ কেঁউ করতে লাগল।
“কী ব্যাপার।” বীরু জানতে চাইলো যথাসম্ভব গম্ভীর হয়ে।
নন্দ আরও একবার কেঁউ কেঁউ করে বীরুর হাত চেপে ধরল। “ভাই, আজ আমি তোমাদের কাছে এসেছি, একটা কথা আমার রাখতেই হবে।”
আমরা সন্ত্রস্ত হলুম। নন্দ নিশ্চয় ধারের পাওনা টাকা চাইতে এসেছে। তিনজনে চোখাচোখি হয়ে গেল।
“কী কথা?” তিনু বললে।
যেন কেউ নন্দকে কাতুকুতু দিচ্ছে—মুখ, চোখ, গলার তেমনি একটা কিম্ভুতকিমাকার আহ্লাদে মুখ করে নন্দ বললে, “আমার বিয়ে ভাই আজ, তোমাদের যেতেই হবে। তোমরা না গেলে হবে না, কিছুতেই হবে না। তোমরা আমার বন্ধু, তোমাদের দয়াতেই তো পেয়ে গেলাম।”
নন্দর বিয়ে! আমরা বোবা, বোকা বনে গেলুম।
“কোথায় বিয়ে?” বীরু প্রশ্ন করলে।
“কোথায় আবার, এখানেই। বাজার-গলিতে। তােমাদের ভাই যাওয়া চাইই। আমার অনুরোধ ।” নন্দ একটু থেমে বিগলিত হয়ে দাঁত বের করে হেসে বলল, “আমার ভাবী বউয়েরও। সে তো বারবার করে বলে পাঠিয়েছে। তা ছাড়া, তোমরাই তো তাকে চেনো, আমার হাতে দিয়েছ, তোমরাই সাক্ষী হবে বিয়ের।”
“সাক্ষী হব আমরা?” বীরু লাফিয়ে উঠল, “কী বলছিস নন্দ—এ সমস্ত তোর ইলিবিলি কথা রাখ—; সাফসোফ জবাব দে। কার সঙ্গে বিয়ে তাের, কিসের সাক্ষী?”
“যাঃ!” নন্দ মেয়েমানুষের মতো মিনমিনে লাজুক গলায় বললে, “কিছুই যেন জানো না তোমরা। জিনিয়া ভাই—তোমাদের সেই জিনিয়ার সঙ্গে বিয়ে। সই-করা বিয়ে কিনা, বোঝোই তো, তোমরা ছাড়া কে আমাদের সাক্ষী হবে!”
নন্দ উঠল। চট করে তার কোঁচার খুঁট গলায় জড়িয়ে হাত জোড় করলে আবার। বললে, “গলায় কাপড় দিয়ে বলে যাচ্ছি ভাই, নিশ্চয় যেও। না এলে বড় দুঃখ পাব। সন্ধ্যেবেলায় একটু সকাল-সকাল আসা চাই। অনেক কাজ এখন আমার। চলি ভাই।”
নন্দ যেমন ঝড়ের মত এসেছিল, তেমনি ঝড়ের মত চলে গেল। আমরা—বীরু, তিনু আর আমি—আমরা সেই ঝড়ের ধাক্কায় যেন সমূল বৃক্ষের মতো ছিটকে পড়েছি।
অনেকক্ষণ পরে বীরু বললে, “কি রে কী বুঝছিস?”
“ভেড়া বনে গেলুম মাইরি, বুঝবো আবার কি?” দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে জবাব দিলে তিনু।
“যাবি নাকি?” প্রশ্ন করলুম আমি।
বীরু ঘরের মধ্যে খানিকটা পায়চারি করলে, বিড়ির ধোঁয়ায় আরও ধোঁয়া করে তুলল আমাদের মন। অবশেষে কম্যান্ড করল। “আলবাত যাবো। বেশ একটু আগেই যাব । জিনিকে গিয়ে বোঝাব, এখনো সময় আছে। আলুঅলা নন্দকে বিয়ে করা আর গলায় দড়ি দেওয়া সমান।”
“বুঝিয়ে লাভ?” আমি মিয়ানো গলায় বললুম।
“লাভ আবার কি! এটা আমাদের মর্যাল রেস্পন্সিবিলিটি। কর্তব্য। বরফসাহেবের মেয়ে জিনি, যার পায়ের নখের যুগ্যি নয় নন্দ, তাকে সে বিয়ে করবে? কেন? বিয়ে করার মতাে আর ছেলে নেই নাকি?” বীরু অসম্ভব উত্তেজিত হয়ে উঠল।
“কিন্তু—” তিনু আমতা আমতা করে বললে, “জিনি যদি আমাদের কথা না শোনে?”
“না শুনে যাবে কোথায়? সাক্ষী—রেজেষ্ট্রি ম্যারেজের সাক্ষী কারা? আমরা তিনজনেই তো। তবে বাছাধন—হোয়ার টু গো?” বীরু চোখ টিপে ভুরু নাচালো, “আজ সন্ধ্যেয় গ্র্যান্ড একটা থিয়েটার হবে রে, পেঁচো। চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি—নন্দবেটা হাতে-পায়ে ধরছে আমাদের, জিনি হাউমাউ করে কাঁদছে”—বীরু সিনেমা-থিয়েটারের ভিলেন নায়কের মতই মুখ বেঁকিয়ে হেসে উঠল।
মরাল রেস্পন্সিবিলিটি পালন করার মহান দায়িত্ব নিয়ে এবং মজা দেখবার অসীম আগ্রহ সাথে করে আমরা তিন বন্ধু বেশ সেজেগুজেই সন্ধের গোড়াতেই বেরিয়ে পড়লাম।”
জিনির বাড়ির কাছে পৌঁছে দেখি—দরজা বন্ধ। ভেতর থেকে জোর একটা আলোর রোশনাই উঁকি দিচ্ছে। কড়া নাড়বার জন্যে হাত বাড়াতেই দরজাটা খুলে গেল। খোলাই ছিলো দরজা, ভেজানো ছিলো আর কি। মাথা বাড়িয়ে আমরা দেখলুম—উঠোন ফাঁকা, বারান্দাটুকুও। ঘরের ভেতরে বাতি জ্বলছে।
গলা পরিষ্কার করে বীরু ডাকল, “নন্দ?”
ডাকের সাথে সাথে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো জিনি। দরজার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বললে, “তোমরা এসে গেছ? দাঁড়িয়ে রইলে কেন? এসো—ঘরে চলো।” বারান্দায় জুতো খুলে রেখে আমরা ঘরে গিয়ে বসলাম। একটা তক্তপোশের ওপর সতরঞ্জি আর নকশা-কাটা সুজনি বিছিয়ে বসবার জায়গা করেছে নন্দ। জাপানী কাচের প্লেটে একরাশ বেলফুল। পাশেই একটা পানের ডিবে, সিগারেটের প্যাকেট। ঘরের এক কোণে টুলের ওপর পেট্রোম্যাক্স বাতিটা জ্বলছে নীলচে আভা ছড়িয়ে। ঘরটা আমরা নজর করলুম চোরা চোখে চেয়ে চেয়ে। নিরাভরণ ঘর। টুকিটাকি ক’টা জিনিস। একটা শুধু ছবি দেখলাম দেওয়ালে। মনে হল— বরফসাহেবের ছবি।
ঘরে ঢুকে জিনি বললে, “তোমাদের জন্যে চায়ের জল চড়িয়ে এলুম। একটু চা খাও, কেমন? সবে সন্ধে।”
“নন্দ কই?” বীরু প্রশ্ন করলে।
“হীরাপুরে গেছে। এখুনি আসবে।” জিনি কেমনভাবে যেন হাসল। সলাজ হাসিই বোধহয়।
কথা যেন আর এগোচ্ছে না। চুপচাপ। অস্বস্তি বোধ করছি সকলেই। জিনি বোধহয় অবস্থা বুঝেই বললে, “তোমরা বসো। চা-টা নিয়ে আসি।”
জিনি ঘর ছেড়ে চলে যেতেই আমি ফিসফিস করে বললুম, “জিনিকে বড় সুন্দর দেখাচ্ছে, না?”
তিনু বললে, “খাসা দেখাচ্ছে।”
শুধু বীরু কিছু বললে না।
সত্যিই জিনিকে আশ্চর্য সুন্দর দেখাচ্ছিল। অমন ধবধবে রং যার, অমন যার মুখচোখ দেহের বাঁধুনি, তাকে টকটকে লাল শাড়ি-ব্লাউজে পেট্রোম্যাক্সের উজ্জ্বল আলোয় যে ভাল লাগবে দেখতে, এ আর নতুন কথা কি। জিনি আজ খোঁপাও বেঁধেছে দেখলুম, খোঁপায় খুঁজেছে দুটি বেলের কুঁড়ি। এই প্রথম দেখলুম, বিনুনি ছেড়ে জিনি খোঁপা বাঁধলো।
মুগ্ধ গলায় বললাম আমি, “নন্দর ভাগ্যটা ভালো।”
কথাটা বীরুর কানে গেল। বীরু তাকাল আমার দিকে উগ্র দৃষ্টিতে, ফিসফিস করেই বললে, “দেখা যাক্ ভাগ্যটা”—একটু থেমে আবার—“জিনি চা নিয়ে এলে কথাটা আমি তুলবো, তোরা যোগান দিবি। হুঁশিয়ার। বাজে কথাটি কেউ বলবে না। গ্রেভ্ হতে হবে।”
জিনি আমাদের হাতে একে একে চায়ের পেয়ালা তুলে দিয়ে সরে দাঁড়াল।
আমি, তিনু চায়ের কাপে ঠোঁট ঠেকিয়ে অপেক্ষা করছি—এইবার বীরু শুরু করবে। বীরু আর শুরু করে না। চায়ের কাপ শেষ হল। আমরা আড়চোখে বীরুকে দেখছি। শেষ পর্যন্ত বীরু কি নার্ভাস হয়ে পড়লো!
জিনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চলে যাবার উপক্রম করছে, বীরু হঠাৎ কথা বললে, “তুমি দাঁড়িয়ে রয়েছ কেন বসো না? এখানেই বসো।” বীরু সরে বসল। আমরাও সরে বসলুম।
জিনি বসল। বীরু একটা সিগারেট ধরাল। কড়িকাঠের দিকে তাকাল। চাইল আমার দিকে, জিনির দিকে। তারপর খুব আস্তে মোলায়েম সুরে বললে, “এটা কি ঠিক হল?”
“আমায় বলছ?” জিনি নরম চোখ তুলে প্রশ্ন করল।
বীরু মাথা নাড়ল।
“কিসের কথা বলছো?” জিনি জিজ্ঞাসা করলে।
“কিসের আর—এই ইয়ের, এই ব্যাপারটার—” বীরুর গলায় যেন কথা যোগাচ্ছে না। তিনু বীরুকে সাহায্য করলে।
“বীরু তোমাদের বিয়ের কথাটা বলছে।”
জিনি বীরুর মুখের দিকে তাকিয়ে হাসল।
“বিয়েটা কি হল?”
“ঠিক হল না।” বললুম আমি, “নন্দ তোমার ঠিক ম্যাচ নয়—মানে মানায় না।”
“কেন?” জিনি তখনও ঠোঁট টিপে হাসছে।
“কেন কি, মানায় না, মানানসই নয় বলে। হাজার হোক, নন্দ একটা থার্ড ক্লাস লোক, আলুঅলা। কি তার স্ট্যাটাস? ভদ্রসমাজে ওর জায়গা নেই।” বীরু উত্তেজিত হয়েছে দেখলাম।
জিনি সব শুনল। উঠল তক্তপোশ থেকে। তাকাল আমাদের দিকে একে একে। ঠোঁটের কোণে তার হাসি নেই, আর তার বদলে আশ্চর্য একটা কাঠিন্য। খুব ধীরে ধীরে স্পষ্ট উচ্চারণে জিনি জবাব দিল, “ভদ্রসমাজে জায়গা তো আমারও নেই।”
“কে বললে?” বীরু আপত্তি জানাল, “তুমি আমাদের বন্ধু—বরফসাহেবের মেয়ে, আলবত তােমার ভদ্রসমাজে জায়গা আছে।”
“নাকি? তবে, তবে তোমরা অভদ্র, বাজারের আলুঅলা একটা মাতালকে রাতদুপুরে আমার বাড়িতে তুলে দিয়ে গেলে কেন?” জিনির গলার স্বর থরথর করে কাঁপছে।
আমরা চুপ। বিহ্বলবাক্। বীরু অনেক কষ্টে দোষ কাটাবার চেষ্টা করলে, “অন্যায়টা কি করেছি? আমরা শুনেছি, নন্দ—নন্দ তোমার কাছে আসত।”
“তোমরাও তো আসতে। তা বলে তোমরা—” জিনির বাঁকা হাসি ধারালো ছুরির মতো আমাদের অতি গোপন মনোবাসনাকে মুহূর্তের মধ্যে প্রকাশ্য আলোয় উন্মুক্ত করে দিল।
তিন বন্ধু আমরা পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে চোখ নীচু করলাম।
“বড্ড বাড়াবাড়ি হচ্ছে, জিনি।” বীরু উঠতে উঠতে বলল, “আর কারুর কথা জানি না, আমি কোনদিন তোমার ঘরে ঢুকি নি। দরজার বাইরেই থেকেছি। দেখতে আসতুম, তোমার লীলাখেলা কেমন চলছে।”
“অযথাই?” জিনি এবার জোরেই হাসল শুধু।
“অযথা-ফযথা জানি না। তোমায় দেখা—মানে তুমি যাতে খারাপ হয়ে না যাও, তা দেখা আমার কর্তব্য—মরাল রেস্পন্সিবিলিটি বলে ভেবেছি।”
বীরুর কথা শেষ না হতেই তিনু দাঁড়িয়ে উঠে বললে, “আমিও তাই। তোমার ঘরে ঢোকার জন্যে আসতাম না। অত ছোটলোক ভেব না আমায়।”
এবার আমার পালা। আমিও উঠতে উঠতে বললুম, “সকলকে সমান ভেব না, জিনি । আমি মন্দ নই।”
“জানি। নন্দও তোমাদের মতন নয়। তোমরা অনেকবার এসেও দরজা খোলা পাও নি। সে একবার এসেই—।”
আমরা তিনজনে ততক্ষণে ঘরের চৌকাঠে এসে দাঁড়িয়েছি। ঠিক এই সময় দরজা দিয়ে চিৎকার করতে করতে নন্দ ঢুকল। সঙ্গে তার দুই ভদ্রলোক। একজন তার মধ্যে উকিল। চিনি তাঁকে। এ পাড়াতেই থাকেন।
“তোমরা এসেছ ভাই, কি খুশিই যে হয়েছি! কতক্ষণ এলে? বাইরে কেন? চলো, চলো, ঘরের ভেতরে চলো—।” নন্দ আমাদের দু-হাত দিয়ে ঠেলে ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল।
সমস্ত অবস্থাটা তখন এমনই হয়ে এসেছে যে, আমরা ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে রয়েছি নির্বাক, বিমূঢ় হয়ে, আর দরদর করে ঘামছি।
শুনলাম, নন্দ বলছে, “বসুন স্যার—বসুন; বসুন উকিলবাবু, তোমরাও বসো ভাই। স্যার, এরাই আমার বন্ধু, ওরও বন্ধু। এরাই সাক্ষী দেবে।”
“সবই রেডি। তবে আর শুভকাজে বিলম্ব কেন?” বললেন উকিলবাবু।
আমাদের চোখের সামনে পেট্রোম্যাক্সের নীলাভ আলোটা ধীরে ধীরে আবার স্পষ্ট হয়ে উঠছে, স্পষ্ট হয়ে উঠছে জিনির মুখ, ফুল-কাটা সুজনি, বেলফুলের প্লেট্। দেখছি সেই স্যারকে-ধানবাদ কোর্টের কোনো হাকিম বা মহকুমা অফিসারকে। কাগজপত্র বেরুল, দু-চারটি প্রশ্ন করলেন স্যার।
“নিন্, সই করুন আপনারা।” উকিলবাবু আমদের দিকে তাঁর কলম এগিয়ে দিয়ে আহ্বান জানালেন।
আমরা তিনজনে তিনজনের দিকে তাকালাম। আমার বুকটা ধকধক করছে তখন। এই বুঝি হল। এখুনি ঘরের সমস্ত আলো দপ্ করে নিবে যাবে। ছুটে এসে পা জড়িয়ে ধরবে নন্দ; ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠবে জিনি।
অপেক্ষা করছি শেষ পরিণতিটুকুর জন্যে— বীরুর দিকে তাকিয়ে।
বীরু আর একবার আমাদের দিকে তাকাল। তাকাল জিনির দিকে। তারপর হঠাৎ এক লাফে ঘরের বাইরে এসে সােজা রাস্তা ধরে ছুট।
আমরা প্রথমটায় হক্চকিয়ে গিয়েছিলাম। নন্দ, উকিলবাবু এবং স্যারও। পরমুহূর্তে ব্যাপারটা অনুধাবন করেই তিনু আর আমি বীরুর পদাঙ্ক অনুসরণ করলাম।
নন্দ যখন হেই হেই করছে, ততক্ষণে আমরা রাস্তায়—বীরু অনেকটা আগে, আমি আর তিনু একসাথে ছুটছি প্রায়।
গলি পেরিয়ে বাজারের বড় রাস্তা—সেই রাস্তার অনেকখানি ছুটতে ছুটতে এসে আমরা দাঁড়ালাম অন্ধকারে— শিবমন্দিরের পাঁচিলের গায়ে।
সকলেই চুপ। কেউ কোনো কথা বলছি না; বলতে পারছি না। হাঁপাচ্ছি আর ঘাম মুছছি।
খানিকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে বিশ্রী একটা অস্বস্তি জমে উঠতে লাগল আমাদের মধ্যে। সবাই হয়ত মনে মনে জিনির বিবাহবাসরের কথা ভাবছিলাম।
সেই নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে হঠাৎ বীরু বললে, “তোরা যা তিনু, আমি একবার স্টেশন যাব। বম্বে মেলের আর-এম-এসে একটা জরুরি চিঠি ফেলার আছে।”
কথা শেষ করেই বীরু আবার বাজারের পথ ধরে হনহন করে এগিয়ে গেল।
বীরুর যাবার পথে তাকিয়ে তাকিয়ে তিনু যেন কি ভাবলে। বললে, “এখনও নিশ্চয় ন’টা বাজে নি—কি না রে, পাঁচু। যতীনবাবুর বাড়িটা একবার ঢুঁ দিয়ে আসি—কি যে করছেন ভদ্রলোক চাকরির অ্যাপ্লিকেশনখানা নিয়ে।” কথার শেষে তিনুও অপেক্ষা না করে শিবমন্দিরের বাঁ দিকের পথ ধরল।
আমি একা। বীরু, তিনুর যাবার পথে তাকিয়ে দীর্ঘনিশ্বাস পড়ল আমার। পা-পা করে এগিয়ে চললাম। কোথায় যাব? কোথায়? সামনেই ম্যাক্ সাহেবের বাঙলোর মাঠ। তার টপকে সেই মাঠে গিয়ে বসলাম।
অন্ধকার। জলো বাতাস ভেসে আসছে হুহু করে। ভিজে ঘাসের ঠাণ্ডা লাগছে হাতে-পায়ে । আকাশে চাঁদ নেই, তারা নেই। মেঘ জমছে।
সন্ধ্যেবেলার ঘটনাটাই চোখের ওপর ভাসছে তখনও। দেখছি—সেই ঘর, সেই আলো, জিনি, জিনির খোঁপা, খোঁপার ফুল। কি হল শেষ পর্যন্ত, কে জানে! ভেস্তেযাওয়া বিয়ের বর-কনে নন্দ আর জিনি পেট্রেম্যাক্স নিবিয়ে ধুলোয় বুঝি গড়াগড়ি দিচ্ছে। কাঁদছে নন্দ, কাঁদছে জিনি—। নাকি অন্য কিছু!
অসম্ভব কৌতূহল হল আমার। জিনিদের বিয়ের বাসরের পরিণতিটুকু না দেখলে যেন সব—বৃথা হয়ে যাবে। দোষ কি? কেউ তো আমায় দেখছে না। একবার উঁকি মেরে দেখেই চলে আসব।
উঠে বসলাম। পিছনের পথ ধরে গিয়ে চললাম জিনিদের গলির উদ্দেশে।
গলিটায় পৌঁছানো গেল। অন্ধকার গলি। দু-একজন লোক যাওয়া-আসা করছে। দু-চার ফোঁটা বৃষ্টি পড়ল। গা ঢাকা দিয়ে দিয়ে এগিয়ে এলুম জিনির বাড়ির কাছে। দরজার একটা পাট ভেজানো। আর একটা দিয়ে আলো আসছে তখনও—সেই নীলাভ আভা। তা হলে? তবে কি নন্দ—? পা টিপে টিপে যেই খোলা দরজার কাছে গিয়েছি, মাথা বাড়াবো—হঠাৎ কে যেন ডাকল নাম ধরে।
চমকে উঠে পালাতেই যাচ্ছিলাম—দেখি, পাশে বীরু।
“তুই?” আমি আকাশ থেকে পড়লুম।
“তিনুও এসেছে, আস্তাবলের কাছে দাঁড়িয়ে আছে।”
তিনু এগিয়ে এল। আমরা তিনজনেই দাঁড়ালাম জিনির দরজার সামনে।
“চল্—ফিরে চল্।” বললে বীরু।
“ওদের কি হল?” প্রশ্ন করলুম আমি।
“যা হবার।” গম্ভীর হয়ে জবাব দিলে বীরু, “উকিল থাকতে আবার বিয়ের ভাবনা। ব্যাটা নন্দর ওপর যা রাগ হচ্ছে—যত সব বাজে লোক ধরে এনে বিয়ের সাক্ষী দেয়ালে শেষ পর্যন্ত। কি হয়েছিল একটু সবুর করতে। আমি তো একটু পরেই এলাম।”
“তুই বুঝি অনেকক্ষণ এসেছিস?” আমি প্রশ্ন করলুম।
“এলাম, কি করবো? তোদের ছেড়ে দিয়ে ভাবলাম, কাজটা ঠিক হয় নি। আফ্টার অল্ নন্দ, জিনি দুজনেই আমাদের বন্ধু—একটা মরাল রেস্পন্সিবিলিটি আছে তো! সইটা করেই দি!” গম্ভীর সুরে বলল বীরু।
“যা বলেছিস, ভাই। আমারও তাই মনে হল। শেষ পর্যন্ত এলুম সই করতেই,” বললে তিনু।
“আমিও ওই কথাই ভেবেছি”, বীরুর দিকে তাকিয়ে বেমালুম বলে দিলাম, “সইটা করেই কেটে পড়তাম।”
তিন বন্ধু ফিরে চললাম। আমরা এসে মরাল রেস্পন্বিলিটি পালন করার আগেই ইমম্রালের দল এসে সেটা পালন করে গেছে। জিনি আর নন্দ এতক্ষণ নীলাভ আলোর তলায় নক্শা-কাটা সুজনির ওপর বসে হয়ত হাসছে কিংবা—!
পাঁচুদা গল্প শেষ করে নীরবে হাসলেন শুধু।