বয়েস বাড়ছে
আমাদের টাঙাইলের বাড়িতে অনেকরকম বই ছিল। পাঁচ পুরুষের ভিটেবাড়ি। উকিলের বাড়ি। প্রায় সবাই এম এ বি এল, বি এ বি এল। অধিকাংশই আইনের বই, এরই ফাঁকে ফাঁকে বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ, শেক্সপিয়র-মিলটন এবং অনেকরকম আজব বই।
এসবের মধ্যে একটি বই ছিল কলম্বাসের জীবনী। পৃথিবীর যে কোনও ঘরকুনো লোকের মতোই কলম্বাস আমার চিরদিনের হিরো। সেই কলম্বাসের জীবনীকার ওয়াশিংটন আরভিং বলেছিলেন, ‘যদি দেখেন লোকেরা আপনাকে বলছে খুব ইয়াং, খুব যুবক দেখাচ্ছে, বুঝে নেবেন বুড়ো হয়ে যাচ্ছেন।’
তারাপদ রায় নামে এক ব্যক্তিকে আমি জানি, সে লোকটা নিজের চোখের সামনে বুড়ো হয়ে গেল কিন্তু একবারও টের পায়নি বুড়ো হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ একদিন আবিষ্কার করল গোলাকার থপথপ হয়ে গেছে, দাঁতের গোড়া সব নড়বড়ে হয়ে গেছে, পা ঢোলা, কোমরে বাত। হঠাৎ হঠাৎ হাঁফ ধরা, শেষরাতে শ্বাসকষ্ট।
প্রথম প্রথম বার্ধক্যের স্বাদ পাওয়ার পরে তারাপদ বয়েসের বিরুদ্ধে একটু লড়ার চেষ্টা করেছিল। একটু হাঁটাহাঁটি, একটু ডায়েটিং। কিন্তু কোনও সুবিধে হয়নি।
এই সময়ে একবার তারাপদ রায়ের বাঁ পা ফুলে গিয়েছিল, রীতিমতো ব্যথা। জুতো পায়ে দিতে, সামান্য হাঁটাহাঁটি করতে কষ্ট।
পুরনো ডাক্তারবাবুর কাছে যেতে তিনি তারাপদকে বললেন, ‘বয়েস বাড়ছে, বুড়ো হচ্ছেন, এখন এ রকম একটু-আধটু হবে। চিকিৎসা করে লাভ নেই, মানিয়ে নিতে হবে।’
তারাপদ ছাড়ার পাত্র নয়, সে জানে বুড়ো রোগী পেলে ডাক্তারেরা খুশি হয়, কারণ অসুখ বা ব্যারাম যাই হোক, ধরতে পারার দরকার নেই, বললেই হল, ‘বুড়ো বয়েসে এ রকম হয়।’
কিন্তু তারাপদ সাধারণ বুড়ো নয়, সে ডাক্তারকে বলল, ‘দেখুন বুড়ো হওয়ার জন্য যদি এই চরণশূল হয়ে থাকে তবে শুধু বাঁ পায়ে হল কেন, আমার বাঁ পা আর ডান পা দুটো তো সমান বয়েসি, ডান পা চরণশূল থেকে রেহাই পেল কী করে?’
ডাক্তারবাবু কী বলেছিলেন সে এই রম্যনিবন্ধের বিষয় হতে পারে না।
বরং বিষয়ান্তরে যাই। বয়েসের ব্যাপারটা অল্প একটু বুঝতে পেরেছিলেন কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়। সেই কবে নবযৌবনে শক্তি লিখেছিলেন,
‘বয়েস দাঁড়ায়ে থাকে
কোনও মাঠে স্কেলকাঠি হাতে,
মানুষ মাপিতে যায়,
মানুষী মাপিতে যায়,
বালকেরা হাসে।’
নিতান্ত কবিকল্পনা, কিন্তু কত স্বচ্ছ। একটু ভাবুন। উচ্চতা মাপার স্কেলকাঠির মতো বয়েসের স্কেলকাঠি। দিন যাচ্ছে, সময় যাচ্ছে—মাঠের মধ্যে সেই স্কেলকাঠি—মানুষ যাচ্ছে, মানুষী যাচ্ছে, বয়েস বাড়ছে সেটা ধরা পড়ছে স্কেলকাঠিতে, স্কেলকাঠি কিন্তু স্থির রয়েছে।
শক্তি হঠাৎ বুড়ো হয়ে গেল। অথচ সেই সে আমাদের অনেককে বুড়ো বলে সম্বোধন করত, বলত, ‘এই বুড়ো, আমি কিন্তু কোনও দিন বুড়ো হবো না। আমি অনেকদিন বাঁচবো।’
(শক্তির মৃত্যুদিন ছিল এই সপ্তাহে, তাই বোধহয় এসব কথা মনে পড়ছে। না হলে রম্যনিবন্ধে, সপ্তাহান্তে হালকা হাসির এই প্রতিবেদনে মৃত্যু আসে কী করে?)
মৃত্যু নয়, বয়েস বাড়ার কথা বলি। এ বিষয়ে জটিলতম এই কাহিনীটি অন্য প্রসঙ্গে আগে বলেছি, তবু বলি।
বছর বারো আগের কথা। তখন আমি নিকটবর্তী এক জেলা সদরে আমলা। মফস্বলে আমলাদের বিষয়-বহির্ভূত নানা কাজ করতে হয়, নানারকম তদারকি, সালিশি।
এক হাউসিং-এস্টেটের লোকেরা এসে অভিযোগ করল যে তাদের এস্টেটের যে দারোয়ান সে তার স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া করে। স্বামী-স্ত্রী দুইপক্ষই সমান, যেমন দেব তেমন দেবা। শেষরাত থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত কর্কশ চিৎকার, কুৎসিত গালিগালাজ—পাড়ায় কাক-চিল পর্যন্ত আসে না। প্রতিবেশীরা ঝালাপালা হয়ে গেছেন। আজ সেই বুড়ো-বুড়িকে সঙ্গে করে তারা এসেছেন এর প্রতিকার চাই।
বুড়ো-বুড়িকে দেখলাম। অনতিবৃদ্ধ অতি সাধারণ দম্পতি। বুড়োর সঙ্গে আলাদা করে কথা বললাম। মামুলি সরকারি প্রশ্ন, ‘আপনার বয়েস?’ উত্তর, ‘ষাট’। ‘আপনার স্ত্রীর বয়েস?’ উত্তর, ‘সত্তর’। একটু সন্দেহ হওয়ায় আমি জিজ্ঞেস করি, ‘বিয়ের সময় আপনার বয়েস?’ উত্তর, ‘পঁচিশ!’ ‘তখন আপনার স্ত্রীর বয়েস?’ উত্তর, ‘কুড়ি’। আমি জিজ্ঞেস করতে বাধ্য হলাম, ‘তা হলে এখন আপনার স্ত্রীর বয়েস পঞ্চান্ন না হয়ে আপনার থেকে দশ বছর বেশি হল কী করে?’
মামার ঘরের দরজার বাইরে বেঞ্চির ওপরে বসে থাকা স্ত্রীর দিকে কটমট করে তাকিয়ে বৃদ্ধ বললেন, ‘মেয়েমানুষের যে কী বাড়, আপনাকে আর কী বলব হুজুর!’
সেই দাম্পত্যকলহের কী মীমাংসা হয়েছিল, সে গল্প পরে হবে।