বয়েস
রোজ সকালে বিষ্ণুবাবু কী করেন? ঘুম থেকে ওঠেন। না, বিষ্ণুবাবু রাতে ঘুমোতে পারেন না। অতএব ঘুম থেকে ওঠার কোনো প্রশ্নই নেই। তবে, হ্যাঁ, বিছানা ছাড়েন। বিছানা ছাড়েন সংসারের গুঁতোয়। তাঁর শোবার ঘরের বাইরের জগৎ হৈ-হৈ করে জেগে ওঠে গোটাকতক নাতি-নাতনি। গোটা দুয়েক পুত্রবধূ। গোটাতিনেক ডাকসাইটে ছেলে। একটি মুখরা ঠিকে-ঝি। সঙ্গে ততোধিক মুখরা তারা মেয়ে অ্যাসিস্ট্যান্ট। সব মিলিয়ে এক বিচিত্র কনসার্ট। ঐক্যতান নয়, অনৈক্যতান।
বিষ্ণুবাবু বারকতক চা চা করে দরজা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বাইরেটা দেখে নেন। দরজার বাইরে করিডর প্রশস্ত দু-দিকে। একদিকে ছড়ানো জুতো, ঝ্যাঁটা, হাত মোচড়ানো আলুর পুতুল। অন্যদিকে খানকতক বই, খাতা পেনসিল আর একটি চেয়ারে বসে থাকা অসহায় একটি চরিত্র। এ বাড়ির গৃহশিক্ষক। বিষ্ণুবাবু শুধু চায়ের প্রত্যাশী। গৃহশিক্ষক ভদ্রলোককে দেখলে দুঃখ হয়। তিনি ছাত্র-ছাত্রী দুটোরই প্রত্যাশা নিয়ে ঠায় বসে থাকবেন। কোনো কোনোদিন দুটোই পেয়ে যান। কোনো কোনোদিন একটা। কোনো কোনোদিন একটাও না।
চায়ের কী হল রে! দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে একবার হাঁক মেরেই বিষ্ণুবাবু ঘরে ঢুকে গেলেন। নিজের আধোআলোকিত ঘর অনেক ভালো। বাইরেটা বড়ো বেশি পরিষ্কার স্পষ্ট। ‘হোওচ্ছে’ রান্নাঘর থেকে একটা কর্কস কন্ঠ উড়ে গেল। বড়ো বউয়ের গলা। বিষ্ণুবাবু তিনবার হাঁকবেন। এর মধ্যে চা এলো এল, না এল তো ভাঁজকরা একটা বাজারের ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়বেন। অবশ্য ক্যালেন্ডারে একটা দাগ মেরে রাখবেন। হিসেবটা থাকা চাই মাসে কদিন চা পেলেন আর কদিন পেলেন না।
‘কোই কি হল,’ গৃহশিক্ষকের তৃতীয় হাঁক। ‘ওরে মেথা কোথায় গেলি, মাস্টার বসে আছে।’ ইস, সেই মাস্টার! বিষ্ণুবাবু সিটকে গেলেন। কতদিন বলেছি মাস্টার নয়, মাস্টারমশাই। বাড়ির দুটো বউই জানোয়ার। ছোটোটার বউ আনার সময় বেশ বাজিয়ে আনতে হবে। ও একদিনের দেখায় ঠিক চেনা যায় না। ছদ্মবেশে বাড়ির আনাচে-কানাচে দিবারাত্র ঘুরতে হয়। তবেই মা লক্ষ্মীদের আসল রূপ ধরা যায়। মাছের কানকো তুলে দেখার মতো এক ঝলকে দেখার জিনিস ঠিক বোঝা যায় না। ঠকে মরতে হয়। আজকাল আবার কানকোতে আলতা মাখানো থাকে।
‘কি হল চায়ের?’ জামার গলার বোতাম লাগাতে লাগাতে বিষ্ণুবাবু দ্বিতীয়বার তাগাদা লাগালেন। এক কাপ চা করতে হাতে সব পক্ষাঘাত হয়। সবকটার গলা শোনা যাচ্ছে কিন্তু চা হাতে এদিকে আসার গরজ কারুর নেই। মানুষ বৃদ্ধ না হইলে সুন্দর হয় না। একটু পালটে নিই, মানুষ বৃদ্ধ না হইলে উপেক্ষিত হয় না। দরজা দিয়ে আর একবার গলাটা বাড়ালেন। একি! মাস্টারমশায়ের পাশে একটা খালি কাপ রয়েছে মনে হচ্ছে! তার মানে! আমারটা ভুলেই মেরে দিয়েছে। বিষ্ণুবাবু গুটিগুটি শিক্ষকমশায়ের কাছে এগিয়ে এলেন। কী মশাই কী পেয়েছেন? করুণ মুখে ভদ্রলোক বললেন, ‘আজ্ঞে না। চা, ছাত্রী কোনটাই আসেনি!’ বিষ্ণুবাবুকে খালি কাপের দিকে তাকাতে দেখে বললেন, ‘ওটা বোধ হয় কালকের। কাল সকালের কাপটা।’
‘কেন আসেন আপনি? কী জন্য আসেন?’ অসহায় ভদ্রলোককে বিষ্ণুবাবুর সোজা প্রশ্ন। কড়া প্রশ্ন।
‘পড়াতে আসি।’
‘কে পড়ে? দায়টা কার, আপনার, না যে পড়ে তার?’
‘আজ্ঞে যুগটাই তো পালটে গেছে। পড়াশোনায় সব তেমন মন নেই। মায়েদেরও শাসন কমে গেছে।’
‘বাপেরা কী করছে? বগল বাজিয়ে বংশবৃদ্ধি করছে? কাল থেকে আর আসবেন না আপনি।’
‘খাব কি? ছেলে ঠেঙিয়েই তো সংসার চলে। ভাত ভিক্ষে।’
‘তবে মরুন। হাঁ করে বসে থাকুন।’ বিষ্ণুবাবু গজগজ করতে করতে নিজের ঘরে এসে ঢুকলেন।
বেলা আটটার মধ্যে বাজার ফেলতে না পারলে ছেলেরা খেয়ে বেরোতে পারবে না। চায়ের জন্য বাজারের দেরি এ যুক্তি সংসার মানবে না। বিষ্ণুবাবুর পিন্ডি চটকে দেবে। চাকুরে ছেলে বলে কথা। সংসার মাথায় করে রেখেছে। তার আদর আগে না অবসরভোগী বুড়ো বিষ্ণুর আদর আগে।
সেই বিষ্ণুবাবু চায়ের অপেক্ষা না করেই ব্যাগ হাতে বেরিয়ে পড়লেন বাজারের জন্যে। টাকাটা রাতের বেলাতেই বিষ্ণুবাবু নিয়ে রাখেন। চশমার খাপে ভরে রাখেন, হিসেবটা এখনও মা লক্ষ্মীরা চায় না। তবে মাঝে মাঝে কানে আসে, একী বাজার! একটামাত্র কপি! ওমা, এই ক-টা আলু, সে কীরে ছোটো! দেখ বড়ো, মাছের টুকরোটা! তারপর থেকেই বিষ্ণুবাবু বাজারের থলেতে প্রতিটি জিনিসের ‘কেজি প্রতি দাম’ গ্রাম এবং দাম মন্তব্যসহ একটি চিরকুটে লিখে ভরে রাখেন। যেমন মাছ (কাটা পোনা) ১৮ টাকা কেজি করে দুশো গ্রাম (আঁসসহ) ৩ টাকা ৬০ পয়সা। গতকল্য ষোলো টাকা ছিল। ফুলকপি প্রতিটি ৫৫ পয়সা হিসাবে দুটো ১ টাকা ১০ পয়সা। গতকল্য প্রতিটি ৫০ পয়সা ছিল। একবার ভেবেছিলেন বাজারের দায়িত্বটা ছেড়েই দেবেন। তারপর ভাবলেন, না, শ্রমের বিনিময়েই পাত পাতবেন। বলতে যেন না পারে বুড়ো বসে বসে ভাত মারছে।
পাড়ার চায়ের দোকানের সামনে দিয়ে যাবার সময় একবার ভাবলেন, শীতের সকাল এক কাপ চা খেলে মন্দ হয় না। তারপরই মনে হল জীবনে যা কখনো করেননি তা এই বয়েসে কী করে করবেন। চ্যাংড়া ছেলে-ছোকরার সঙ্গে চায়ের দোকানে বসে চা খাবার বয়স চলে গেছে।
ধোঁয়া ওঠা কেটলির দিকে তাকাতে তাকাতে বিষ্ণুবাবু বাজারের পথে পা বাড়ালেন।
সাদা ধবধবে সোয়েটারের ওপর ঘি রঙের গরম চাদর। মাথার সব চুলই প্রায় ধবধবে সাদা। পায়ে চকচকে জুতো। সবাই ভাবেন বৃদ্ধের কী সুখ! তিন চাকুরে ছেলে, দু বউ। আহা কী সুখের সংসার।
বিষ্ণুবাবুর বাড়ি থেকে গৃহশিক্ষক বেরিয়ে এলেন, শুকনো মুখে বিরক্তি নিয়ে। মনে তার গজগজানি, সামান্য ক-টা টাকার জন্য ভদ্রলোকের কী হেনস্তা। পান বিড়ির দোকানে টাবু সবে সিগারেট ধরিয়েছিল। তাড়াতাড়ি লুকিয়ে রেখে দোকানের মালিককে বলল, ‘উরে বাপরে, কত বড়ো মানি লোক, ওঁর মতো শিক্ষক ও তল্লাটে ছিল না। আমার বাবাকে উনি পড়িয়েছেন এখন অবশ্য বয়েস হয়েছে। তাহলেও।’