বয়স বাড়ছে
গল্পটা মোটামুটিভাবে প্রচলিত আছে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নামে। তবে গল্পটির একাধিক রকম-ফের আমি শুনেছি এবং একবার একটা পুরনো বাংলা সিনেমাতেও ব্যবহৃত হয়েছিল এই গল্প।
শরৎচন্দ্র-জড়িত গল্পটি লেখাই ভাল। শরৎচন্দ্র গ্রামে নতুন বাড়ি করেছেন, কলকাতা থেকে কিছু বন্ধুবান্ধব, অনুরাগী ভক্তজন গিয়েছেন শরৎচন্দ্রের সেই গ্রামের বাড়িতে। যেমন হয়, একথা-সেকথার পরে বাড়ি-ঘর দেখেশুনে, সারা গাঁয়ে ঘুরে বেড়িয়ে অতঃপর অতিথিরা শরৎচন্দ্রের কাছে জানতে চাইলেন, ‘কলকাতা থেকে এত দূরে এই পল্লীগ্রামে এসে যে এত কষ্ট করে বাড়ি করে বসবাস আরম্ভ করলেন, তা এখানকার, আপনাদের এই গ্রামের জলবায়ু, আবহাওয়া, স্বাস্থ্য কী রকম?’
শরৎচন্দ্রের তখন প্রবীণ বয়স। প্রৌঢ়ত্ব সমাপ্ত করে বার্ধক্যের সোনার সিঁড়িতে পা দিয়েছেন, তিনি মৃদু হেসে স্বভাবোচিত ভঙ্গিতে বললেন, ‘আর বোলো না। এই যে আমার এত বয়স হল, এখনও এ গাঁয়ে এলে আমাকে লুকিয়ে হুঁকো খেতে হয়।’
কথাসাহিত্যিকের এই উক্তিটির ব্যঞ্জনাটি লক্ষণীয়। গ্রামে তাঁর চেয়েও বয়স্ক লোকের সংখ্যা এত বেশি যে গুরুজনদের আড়াল করার জন্যে হুঁকো টানার সময় লুকিয়ে টানতে হয়, যাতে প্রবীণদের সম্মানহানি না হয়। সুতরাং যে গ্রামে প্রবীণের সংখ্যা এত বেশি সেখানকার স্বাস্থ্য বা আবহাওয়া ভাল বলেই তো সেটা সম্ভব।
দীর্ঘায়ু হওয়া সব মানুষেরই স্বপ্ন। স্নেহাস্পদদের দীর্ঘজীবী হও অথবা শতায়ু হও বলে আশীর্বাদ , করা শুধু আমাদের দেশে নয়, পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই রীতি।
দীর্ঘায়ু হওয়া বা শতায়ু হওয়া নিয়ে আমি কোনও রসিকতা করব না। আমি নিজে এখন যে , বয়সে এসে পৌঁছেছি, উনপঞ্চাশী পবন আমার বয়সের নৌকোর পাল প্রায় ছুঁতে চলেছে, অথচ শুনছি এটাই নাকি মধ্যবয়স।
কেন যে এই পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়সের লোক মধ্যবয়সি হবে তা আমার হিসেবের মধ্যে পড়ছে না। তাহলে কি ধরে নিতে হবে সব মানুষকে শতায়ু ধরে নিয়ে এই হিসেবটা করা হয়েছে।
এক ইংরেজ বাচাল বলেছিলেন, মধ্যবয়েস হল সেই বয়স যে বয়সে তোমার বন্ধুদের মাথায় বিশাল টাক পড়ে যায়, তারা মোটা হয়ে যায়, তারা এমন বদলে যায় যে তারা আর তোমাকে চিনতে পারে না। যখন টেলিফোন বেজে উঠলে মনে হয়, এ ফোনটা আমার নয় অন্য কারও জন্যে বাজছে। কিংবা রং নম্বর।
কুড়ি বছর বয়সে আমরা যা ইচ্ছে করি, কোনওদিন মাথা ঘামাই না অন্যেরা আমাদের নিয়ে কী ভাবছে সে বিষয়ে। পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে পৌঁছে আমরা ভাবতে শুরু করি সত্যি সত্যি অন্যেরা কী ভাবছে আমাদের নিয়ে, খারাপ কিছু ভাবছে না তো। তারপর একদিন আমরা পঞ্চাশ বছর বয়সে এসে পৌঁছে যাই এবং তখন টের পাই, আবিষ্কার করে বিস্মিত হই, কেউ কখনও আমাদের নিয়ে ভাবেনি, মাথা ঘামায়নি; কেউ কখনও কোথাও কোনওদিন মাথা ঘামায় না।
আর অন্য কেউ যদি কখনও মাথা ঘামিয়েই থাকে, তা হলেই বা শেষ পর্যন্ত কী আসে যায়? আমার এক প্রবীণ আত্মীয়ের জন্মদিনে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম, এই মাত্র কয়েকদিন আগে। বয়স বাড়ার অনেক সুবিধে। তার একটা সেদিন জানা গেল তাঁর কাছে। বৃদ্ধদের যে ধরনের বিশিষ্ট একটা সূক্ষ্ম হাসি আছে, যার মধ্যে মেশানো থাকে কিছুটা বোধ, কিছুটা অভিজ্ঞতা আর অনেকটা পরিহাস আমার সেই প্রবীণ আত্মীয় সেই হাসি ঠোঁটে টেনে কথায় কথায় আমাকে জানালেন, ‘আমার কোনও শত্রু নেই।’ কথাটা শুনে চুপ রইলাম, কিন্তু বৃদ্ধ ছাড়লেন না, হাসি ঠোঁটেই জোর করলেন, ‘বলো তো কেন?’
কী আর বলব? বললে বলতে হয়, আপনি ভাল মানুষ, কোনওদিন কারও ক্ষতি করেননি, কারও সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি করেননি; আপনার কেন শত্রু থাকবে? কিন্তু এসব তোষামোদি কথা শুধু শুধু বলতে যাব কেন?
অবশ্য আমাকে নিজে থেকে কিছুই বলতে হল না। বৃদ্ধ নিজেই বললেন, ‘সব মরে গেছে। যত ব্যাটা শত্রু ছিল সব মরে ভূত হয়ে গেছে। বেঁচেই থাকল না, তা আর শত্রুতা করবে কী?’ তবে বহুদিন বেঁচে থাকলে শুধু শত্রুদের হাত থেকেই যে অব্যাহতি পাওয়া যাবে তা নয়, বন্ধুদের হাত থেকেও অব্যাহতি পাওয়া যাবে। এমন একদিন হয়তো এসে যাবে যখন নাম ধরে ডাকার কোনও লোক তো থাকবেই না এমনকী অমুকদা বলে ডাকারও লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে।
তা হোক তবু বলি বয়স বাড়ার একটা মাধুর্য আছে। লোলচৰ্মা, শুভ্রকেশী এক আদিবাসী বৃদ্ধার এক ফটোগ্রাফ দেখেছিলাম অনেকদিন আগে, বোধহয় সুনীল জানার তোলা। মানুষ বৃদ্ধ না হলে যে সুন্দর হয় না এই কথা ওই আলোকচিত্র দেখে অনুভব করেছিলাম।
এই প্রসঙ্গে বয়স বাড়া সম্পর্কে একটি ফরাসি প্রবাদ অন্য কারণে স্মরণীয়। এই প্রবাদটি অনুসারে মানুষেরা নাকি ব্যারেলবন্দি মদের মতো, যদি ভাল হয় তবে যত পুরনো হয় তত ভাল হয় আর যদি খারাপ হয় তবে যত দিন যায় ততই খারাপ হতে থাকে।
বয়স বেড়ে যাচ্ছে, বুড়ো হয়ে যাচ্ছি—এসব নিয়ে দুঃখ করার অবশ্য কোনও মানে হয় না। একথা সর্বদাই স্মরণীয় যে এই মরপৃথিবীতে অসংখ্য মানুষ, আমাদের চেনাজানা, আত্মীয় বন্ধু, আপন-পর হাজার হাজার লোক সুযোগ পেল না, সুযোগ পায় না, বুড়ো হয়ে যাচ্ছি এই দুঃখ করার। তার ঢের আগে তারা সুখদুঃখের ঊর্ধ্বে চলে যায়।
আর শেষ পর্যন্ত বুড়ো হওয়া ব্যাপারটা অনেকটাই মানসিক। সেই যে একটা কথা হয়েছে, তোমার বয়স ঠিক ততটা যতটা তুমি বোধ কর; যতটা তোমাকে দেখায় তা নয়। এই সূত্রে একটি মজার কথা বলেছিলেন উনিশ শতকের এক জনপ্রিয় লেখক, কলম্বাসের জীবনীকার ওয়াশিংটন আরভিং। তিনি বলেছিলেন, ‘যখনই দেখবে লোকেরা তোমাকে বলছে আপনাকে খুব কমবয়সি, খুব কাঁচা, খুব ইয়াং দেখাচ্ছে, বুঝে নেবে বয়স বাড়ছে, বুড়ো হচ্ছ।’
তা বুড়ো হতে আপত্তি কী? মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে। কিন্তু তাই বলে বুড়ো বয়সে বুড়ো হব না। তিরিশ বছর বয়সে আমার মাথার চুল নাই পাকল তাই বলে পঞ্চাশে পাকলে কলপ দিতে হবে কেন? পঁচিশ বছর বয়সে দাঁত তুলে ফেলতে হলে নিশ্চয়ই দুঃখের তাই বলে চল্লিশে, পঞ্চাশে দু’-একটা দাঁত নড়বে না, চোখে উঠবে না পজিটিভ চশমা?
ছোটদের প্রতিযোগিতামূলক ফুটবল খেলার বয়স ও উচ্চতার সীমা দেওয়া থাকে। শক্তি চট্টোপাধ্যায় সেই কবে লিখেছিলেন।
‘বয়েস দাঁড়ায়ে থাকে
কোনো মাঠে স্কেলকাঠি হাতে
মানুষ মাপিতে যায়, মানুষী মাপিতে যায়
বালকেরা হাসে।’
কাব্যের কথা আপাতত থাক। একটা সরল গল্প দিয়ে এ যাত্রা শেষ করি।
হাওড়া হাটের প্রবেশমুখে বিশাল ভিড়। এক প্রাচীন সাধু মৃতসঞ্জীবনী বটিকা বেচছেন, সাধুর দীর্ঘ চুলদাড়ি, সবল স্বাস্থ্য, তিনি মন্দ্রকণ্ঠে ঘোষণা করছেন, ‘এই বটিকা দু’বেলা দুটো করে খেয়ে আজ সোয়া তিনশো বছর আমি এইরকম স্বাস্থ্য নিয়ে বেঁচে আছি।’ আলখাল্লার আস্তিন গুটিয়ে নিজের বাহুর মাংসপেশি দেখিয়ে সন্ন্যাসী সবাইকে প্রভাবান্বিত করতে লাগলেন। একটা কৌটোর মধ্যে গোল গোল কালো বড়ি নাচাতে নাচাতে সন্ন্যাসীর সহকারী অন্য এক গাট্টাগোট্টা মধ্যবয়সি আলখাল্লাধারী সমবেত দর্শকদের সামনে ঘুরছেন। আমি তাঁকে গলা নামিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘দাদা! সন্ন্যাসী ঠাকুর যে বলছেন ওঁর সোয়া তিনশো বছর বয়স, তার কি কোনও প্রমাণ আছে?
অম্লানবদনে সহকারীটি জবাব দিলেন, ‘তা আমি বলতে পারব না, আমি তো মাত্র দুশো পনেরো বছর ওঁর কাছে কাজ করছি।’