1 of 2

বয়ঃসন্ধি

বয়ঃসন্ধি

জগদীশ পাঁচটা না বাজতেই ঘুম থেকে উঠে পড়েন। খড়ম পায়ে বাইরে বের হয়ে সূর্যপ্রণাম, তারপর নুয়ে এই বসুন্ধরা এবং যাকে তিনি জগজ্জননী ভাবেন তাঁদের উদ্দেশে চোখ বুজে কিছুক্ষণ ধ্যান, ফের ঘরে ঢুকে পেতলের গাড়টি হাতে নিয়ে হাঁটা দেন—সামনের সুপারিবাগানে ঢুকে যান, কিছুদূর হেঁটে গেলেই ঝোপের মতো জায়গায় তিনি অদৃশ্য হন। তারপর নদীর জলে অবগাহন, স্তোত্রপাঠ এবং ফেরার পথে মঠের শিবলিঙ্গের মাথায় একটি ধুতুরা ফুল এবং নদীর জল ঢেলে শিবস্তোত্র পাঠ করেন।

এত সকালে তার পুত্র অরণির ওঠার অভ্যাস নেই। দেশের বাড়িতে মাইনর পাশ করে বসেছিল, গতকাল তাকে নিয়ে তিনি তাঁর কর্মস্থলে চলে এসেছেন। স্থানীয় স্কুলে ক্লাশ এইটে ভর্তি করে দেবার ব্যবস্থাও হয়ে গেছে। রাতে পথশ্রমে অরণির বোধ হয় ভালো ঘুম হয়নি। সারারাতই ছটফট করেছে। বাড়ি ছেড়ে থাকারও কষ্ট কম না। ভোররাতের দিকে ঘুমিয়ে পড়ায় তিনি তাকে এখনও ডেকে তোলেননি। মনে মনে স্তোত্রপাঠ করছেন, এবং খড়ম পায়ে হাঁটাহাঁটি করলে অরণির ঘুমের ব্যাঘাত ঘটতে পারে-যতক্ষণ না হরমোহন নাজিরখানার দরজা খুলে দেবে, তিনি ঘর ছেড়ে যেতেও পারেন না।

অরণিকে তাঁর কিছু কথা বলার আছে। তাকে ঘুম থেকে তোলাও দরকার। ডাকতে কষ্ট হচ্ছিল, অঘোরে ঘুমোচ্ছে, অথচ সব না বলে গেলেও চলবে না। তাকে ঘুম থেকে উঠে হাতমুখ ধুয়ে বগলে বই নিয়ে জমিদারবাবুর পুত্রদের ঘরে চলে যাওয়া দরকার। সেখানে মাস্টারমশাই তাদের পড়াতে আসেন। অরণিও তাদের সঙ্গে পড়বে।

একবার, ভাবলেন ডাকেন। বলেন, অরু উঠে পড়ো। কারণ সকাল হয়ে গেছে। হাতমুখ ধুয়ে নাও। তোমার দেরি দেখলে বিশু চলে আসতে পারে। এ-বাড়িতে কেউ এত দেরি করে ওঠে না।

বাড়ি থেকে খুব সকালে রওনা হয়ে, কিছুটা পথ হেঁটে, বাকি পথ স্টিমারে যখন এই কাছারিবাড়িতে এসে উঠেছিলেন তিনি, তখন রাত হয়ে গেছিল। স্টিমারের আলোতে সুপারিবাগান এবং জমিদারদের খানিকটা প্রাসাদ ছাড়া অরণির চোখে কিছুই দৃশ্যমান ছিল না। আমবাগানের পরিত্যক্ত কাছারিবাড়িতে অরণিকে একা থাকতে হবে ভেবে সে খুবই মনকষ্টে ছিল। কিছুটা আতঙ্কও চোখেমুখে লক্ষ করেছেন তিনি।

এখন ঘুম থেকে উঠেই দেখতে পাবে, সুপারিবাগান পার হয়ে নদীর জল কলকল ছলছল-নদীর পাড়ে গেলে ছবির মতো দেখতে জমিদারবাবুদের গ্রামটিও সে দেখতে পাবে। প্রাসাদগুলির জাঁকজমক অরণিকে অবাক না করে পারে না। নদীটি এত বিশাল আর নদীর চর, পাখির ওড়াউড়ি নিয়ে এত ব্যস্ত যে নদীটিকে দেখলেই ডুব দিতে ইচ্ছে হয়। তিনি এক আনা জমিদার দেবকুমারবাবুর আমলা। প্রাসাদ, দিঘি সহ নদীর পাড়ে তাঁর এলাহি ব্যবস্থা। ফুলের রকমারি বাহারও কম নেই বাড়িটাতে। অরণি ঘুম থেকে উঠে হাই তুললেই দেখতে পাবে সামনের সুপারিবাগান পার হয়ে পণ্যতোয়া নদীটির জল, জলে ঢেউ, পালতোলা সব নৌকা।

গ্রামের পাশে নদী থাকলে স্থানমহিমা যে কত বেড়ে যায়, অরণি ঘুম থেকে উঠলেই বুঝতে পারবে।

তখনই তিথি জানালায়-ও বাব্বা, অরুদা তুমি ঘুমোচ্ছ, তুমি কি গো। কত লোক কত দূর দেশে চলে গেল, এখনও তোমার ঘুম ভাঙল না।

জগদীশের মনঃপুত নয়, তিথি তাকে ডেকে জাগিয়ে দিক—কিন্তু, এতই চঞ্চল, আর হতভাগ্য মেয়েটি, যে তাকে তিনি কোনও কড়া কথাই বলতে পারেন না। আর এত কাজের, আসলে সে চলে এসেছে, বিছানা তুলে ঘর ঝাড় দিয়ে চলে যাবে। অরু আসায় এ-ঘরে তার যেন দায়িত্ব আরও বেড়ে গেছে। ওর বাবা গোরাচাঁদকে বাড়িঘর করার মতো কিছুটা জমি পাইয়ে দেওয়ার পর থেকে গোরাচাঁদের বউ যমুনার কৃতজ্ঞতার শেষ ছিল না। আগে যমুনা করে দিত, তিথি বড়ো হয়ে যাওয়ায় সে এখন করে দেয়। জিলিপি, তেলেভাজার দোকানের জায়গাটিও তিনি ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। বাজারের ওই একফালি জায়গা নবকুমারবাবুকে বলে ব্যবস্থা না করে দিলে গোরাচাঁদ একপাল ছেলেপিলে নিয়ে অথৈ জলে পড়ে যেত। তবে জগদীশের পছন্দ নয়, তিনি আগে মানাও করতেন, তাতে যমুনা কিংবা গোরাচাঁদের দুজনের মুখই বারী ব্যাজার হয়ে যেত। ভুইঞামশাইর মর্জিতেই জমিদারি চলে, তিনি এটুকু সেবা না নিলে, তারা কার কাছে গিয়ে দাঁড়াবে।

তিনি আর তারপর থেকে, কাজ করে দিলে মানা করেন না, কাজের কথা ভুলে গেলে ডেকে মনে করিয়ে দেন না। নিজেই করে নেন। কোনওদিন তিথি হয়তো সকালেই নদীর পাড়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ঘাটে পুণ্যস্নান থাকলে, নদীর জলে ডুব দিয়ে হয়তো পয়সা তুলছে। পয়সা সংগ্রহের উত্তেজনায় মনেই নেই, সকালে এক বালতি জল ভূঁইঞাকাকার ঘরে তুলে রাখতে সে ভুলে গেছে।

জগদীশ তখন নিজেই জল তোলেন।

জগদীশ তখন নিজেই ছাড়া জামাকাপড় ধুয়ে তারে মেলে দেন। এ-সব কাজের জন্য তিথি কিংবা যমুনার উপর নির্ভর না করে নিজে করে নিতে পারলে কিছুটা আত্মতুষ্টিতেও ভোগেন।

তারপরই হয় মুসকিল।

গোরাচাঁদ শুনে খেপে গেছে, কোথায় তিথি, কোথায় গেছে। ভুইঞামশাই তারে কাপড় মেলছে, সারাদিন চুক চুক করে বেড়ান, তোর এত লোভ! বউকেও বলবে, তুমি খেয়াল রাখতে পার না, তিথি ছেলেমানুষ, তার দোষ কি! ইস কী যে হবে!

জগদীশের কানেও কথা উঠে আসে।

ইস মেয়েটাকে গোরা গোরুখখাঁজা খুঁজছে।

কেন? ও কী করেছে! অন্দরে থাকতে পারে। গোরাকে ওখানে খোঁজ নিতে বলল।

না ওখানে নেই।

ওখানে না থাকলে, নদীর চরে শালুক তুলতে যেতে পারে।

না সেখানেও যায়নি।

তবে গেল কোথায় মেয়েটা। এক দণ্ড চুপ করে বসে থাকতে পারে না। নদীর ঘাটে পুণ্যস্নান, মেলার চরে পালতোলা নৌকার ভিড়। মানুষজনও মেলা। পায়ে হাঁটা পথে, স্টিমারে কেউ কেউ এসে নেমে থাকে। মঠের চারপাশে ভিড় থাকে, তারপর মানুষজন নদীর ঘাটে পুণ্যস্নান সেরে চলে যাবে বাজারের দিকটায়। সড়ক ধরে, একপাশে, বিশাল সব প্রাসাদ ফেলে সোজা হেঁটে গেলেই বাজার চরের উপর দিয়েও হেঁটে যাওয়া যায়, তারপর বিন্নির খই লালবাসা খেয়ে যে যার নৌকায় কিংবা হাঁটাপথে বাড়ির দিকে রওনা হবে। অষ্টমী স্নানেই বেশি ভিড়, ছোটখাটো পুণ্যস্নানও বছরে যে কিছু না থাকে—তাও নয়। তিথির তখন কেমন দিশেহারা অবস্থা। নদীর জলে ডুব দিয়ে পয়সা তুলবে। দুটো পাঁচটা যা পায়, সেই দিয়ে সেও বিন্নি খই লালবাসা কিনে কোঁচড়ে নিয়ে খাবে আর নদীর পাড়ে ঘুরে বেড়াবে। আর নদীর পালতোলা নৌকা, যেমন, কাঁঠালের কিংবা আনারসের তালের নৌকাও থাকে, এই সব নৌকার দিকে তাকিয়ে আপন মনে নদীর সঙ্গে কথা বলবে। নৌকার ব্যাপারিদের সঙ্গে কথা বলবে।

এই তিথি।

সে অবাক হয়ে তাকাবে।

তুই এখানে দাঁড়িয়ে আছিস? কী খাচ্ছিস!

কি খুশি তিথি। সে তার কোঁচড় খুলে দেখাবে।

যা বাড়িতে, তোর খাওয়া বের করবে।

তিথির চোখ মুখ শুকিয়ে যায়।

জগদীশ জানেন, গোরাচাঁদের ওই এক দোষ। বড়ো চণ্ড রাগ তার। মাথা গরম হয়ে গেলে সে ভালোমন্দ বোঝে না, মেয়েটার সজল চোখও তখন তাকে আটকাতে পারে না। বড়ো নির্মম হয়ে ওঠে।

জগদীশের এই হয়েছে মুশকিল। মেয়েটাকে ধরতে পারলেই গোরাচাঁদ টেনে হিচড়ে বাড়ি নিয়ে আসবে।

তুই মেয়ে খেয়ে খেয়ে মরবি! ভূঁইঞামশাইর ঘরে জলে তুলে রাখিসনি! ছাড়া কাপড় কেচে তারে মেলে দিসনি। তোর এত নোলা।

জগদীশ এই সব জানেন বলেই, তিথিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না শুনলেই কিছুটা হতভম্ব হয়ে গিয়ে বলেন, কোথায় গেল। তারপর নিজেই খুঁজতে বের হয়ে যান, গোরাচাঁদের ভয়, মেয়েটার জন্য তার সব না শেষে যায়। বাবুদের অনুগ্রহে জমিদারিতে তার আশ্রয়। একখানা নোটিস ঝুলিয়ে দিলেই তার সব গেল। তিথি তার সর্বনাশ না করে ছাড়বে না।

জগদীশ সুপারিবাগানের এক কোণায় গিয়ে ডাকবেন, গোরাচাঁদ, গোরা আছিস?

আজ্ঞে উনি তো তিথিকে খুঁজতে গেছেন।

যমুনা দরজার বাইরে একগলা ঘোমটা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

ওকে বলবে, তিথির গায়ে যেন হাত না তোলে। হাত তুললে খুব খারাপ হবে। আমার মনে হয় মঠের ঘাটে গেছে। পুণ্যস্নান হচ্ছে, মেলা বসেছে, তালপাতার বাঁশি বাজছে, মেয়েটার মন ঘরে টিকবে কেন!

মেলায় নেই।

তা হলে জলে আছে। আমি যাচ্ছি, দেখছি খুঁজে পাই কি না।

আর তখনই তিনি ঠিক দেখতে পান গোরাচাঁদ নদীর পাড় থেকে মেয়েটাকে হাত ধরে টেনে আনছে। নদীর জলে সারা সকাল ডুবে ডুবে পয়সা খুঁজেছে, চোখ দেখেই বোঝা যায়। তারপর পাড়ে উঠে নদীর হাওয়ায় ফ্রক শুকিয়েছে তাও বোঝা যায়, শুকনো ফ্রক দেখে, বিন্নির খই, লালবাসা কোঁচড়ে নিয়ে নদীর পাড়ে ঘুড়ে ঘুরে কিছুটা খেয়েছে, বাকিটা ভাইবোনদের জন্য লুকিয়ে নিয়ে আসার মতলবে ছিল, তাও বোঝা যায় ওর এক হাতে কোঁচড় ধরে রাখার চেষ্টায়। হাত টানাটানিতে না আবার কোঁচড়ের মুঠি ফসকে যায়, যতই গোরাচাঁদ তার মেয়েকে টেনে আনার চেষ্টা করুক না, তিথি তার কোঁচড় ছাড়ছে না।

গোরাচাঁদ জগদীশকে দেখেই থমকে গিয়েছিল। তিথির হাতও ছেড়ে দিয়েছিল।

ভূঁইঞামশায় আমার কী হবে। যমুনা খবর পাঠাল, আপনি তারে কাপড় মেলেছেন, তিথি সকালে বেপাত্তা। চরণকে বসিয়ে ছুটে এসেছি। এই দেখুন কী কাণ্ড!

দেখেছি। কি রে তিথি কটা পয়সা হল!

তিথির সব ভয়ডর নিমেষে জল।

সে মুচকি হেসে বলল, পাঁচ পয়সা।

এত জল ঘাঁটলে জ্বর হবে যে। বাবার কথা শুনিস না কেন!

তিথি বড়ো বড়ো চোখে তাকিয়ে শুধু তাঁকে দেখছিল।

কোঁচড়ে কী আছে?

খুবই আহ্লাদের গলায় বলল, খই বাতাসা। বলে, কোঁচড় মেলে দেখাল।

যা বাড়ি যা। বাড়ি থেকে গেলে বলে যাবি। তুই বড়ো হয়ে যাচ্ছিস বুঝতে পারিস না।

বড়ো হয়ে যাওয়ার কথায় তিথির কী লজ্জা। সে প্রায় পড়িমরি করে ছুটতে থাকল। কোঁচড় দু-হাতে সামলে, সেই মুলিবাঁশের বেড়া দেওয়া ঘরটার দিকে ছুটতে থাকলে তার ভাইবোনগুলো বেরে হয়ে এল প্যাক প্যাক করতে করতে।

গোরাচাঁদ আপসোশের গলায় বলল, বলেন, এই কর্মনাশা মেয়েকে নিয়ে আমি কী করি! কোথায় যাই।

তিথিকে দেখতে দেখতে জগদীশের পলকে মনে পড়ে যায় সব। চোখের সামনে বড়ো হয়ে উঠছে। ছেড়া ফ্রকে তাকে খারাপও দেখায় না। মেয়েটার দস্যিপনায় তার বাবা অস্থির। নতুন ফ্রক কিনে দিলে দু-চার মাসও যায় না। ওর বাবাও পেরে ওঠে না। বউঠান, তুলির পুরানো ফ্রক থাকলে মাঝে মাঝে ওকে ডেকে দেন। কি খুশি তখন। ফ্রকটা ছোড়দি গায়ে দিত, সেই ফ্রক সে গায়ে দিচ্ছে। আর যা হয়, তখনই তার কত আবদার সবার কাছে, গাছপালা, জীবজন্তু, পাখপাখালি সবাই তার বন্ধু হয়ে যায়। সে যেন ফ্রকটা গায়ে দিয়ে ইচ্ছে করলে উড়ে বেড়াতেও পারে।

তখন সর্বত্র তার চোখ।

কে রে। কে সুপারির বাগানে ঢুকেছিস।

সে তেড়ে যায়।

গরিবগুর্বো মানুষেরা এই সব ভুস্বামীদের উচ্ছিষ্ট খেয়ে যে বেঁচে থাকে জগদীশ ভালোই জানেন। সুপারির খোল বাগানে পড়ে আছে, কেউ টেনে নিয়ে যাচ্ছে, তিথির জ্বালায় তা নিয়ে যাওয়া কঠিন। বাবুদের বাড়ির সব কিছুর উপরই তার যেন হক আছে।

সুপারির খোল নেবে সাধ্য কি?

তার চেঁচামেচির শেষ থাকে না।

অমলদা, দ্যাখো এসে আমাদের সুপারির বাগানে কে এসে ঢুকেছে।

কারও সাড়া না পেলে সে খোল নিয়ে গরিব মানুষটির সঙ্গে টানাটানি শুরু করে দেবে।

এটা আমাদের, তুই মেঘা কোন সাহসে বাগানে ঢুকলি! ভুইঞাকাকাকে দাঁড়া খবর দিচ্ছি।

এই হয়, সুপারির বাগানে হাওয়ায় পাকা সুপারি ঝরে পড়ে। গাছের ডগা থেকে খোল খসে পড়ে। যাওয়া আসার রাস্তায় গরিব মানুষদের চোখ কান শকুনের মত সজাগ। শব্দ হলেই হল, তাল পড়তে পারে, নারকেল পড়তে পারে, সুপারির খোল পড়তে পারে এত বড়ো মহলার মধ্যে কোথায় কী পড়ে থাকে কারও খেয়াল থাকার কথা না কিন্তু তিথির সব খেয়াল থাকে–বিশাল এলাকায় আম জাম জামরুল গাছেরও অভাব নেই–তিথির মতো কেউ খবর দিতে পারে না, কোন গাছে কী ফল ধরে আছে, কোন গাছে কত আম পেকে আছে। তিথির জ্বালায় গাছের ফল পাকুড় কুড়িয়ে নিয়ে কারও হাওয়া হয়ে যাবার ক্ষমতাই নেই। সে কেড়েকুড়ে সব এনে বউঠানের কাছে জিম্মা দেবে।

আর নালিশ, জান, নিয়ে পালাচ্ছিল। বাতাবি লেবুটা গাছের নীচে কখন পড়ে আছে, আমিও জান খেয়াল করিনি। শ্রীশ ধরের ব্যাটা নিয়ে পালাচ্ছিল। আমাকে দেখে ফেলে দৌড়েছে।

তিথি ঘরে ঢুকে গেছে ততক্ষণে। সে তাঁর বিছানা মশারি গুটিয়ে কাঠের তাকে তুলে রাখছে। তিথির ডাকাডাকিতে অরু বিছানায় উঠে বসল। নতুন জায়গা—এটা একটা কাছারিবাড়ি কিছুই বোধহয় তার মনে ছিল না। চোখ কচলে হাত-পা ঝাড়া দিতেই বুঝল সে তার বাবার কর্মস্থলে তিথিকে দেখে তার সব মনে পড়ল— রাতের অন্ধকারে কেমন সবকিছু রহস্যাবৃত ছিল, এই সকালবেলায় সে বিছানা ছেড়ে নামার সময়ই দেখল, সামনে সুপারিবাগান, তার ভিতর দিয়ে নদীর পাড়, চড়া সাদা কাশফুলের ওড়াউড়ি। বাবার স্নান জপতপ সারা। কারণ বাবা একটি ফতুয়া গায়ে দিয়ে চুল আচড়াচ্ছেন আয়নায়। সে কিছুটা যে উৎফুল্ল হয়ে উঠেছে বোঝা যায়। দরজায় দাঁড়াতেই বুঝল, চারপাশে বড়ো বড়ো সব আমগাছ, তার ডালপালায় কাছারিবাড়িটা তপোবনের মত।

তিথি বলল, দাঁড়াও জল এনে দিচ্ছি।

অরুর ভীষণ হিসি পেয়েছে। সে তিথির কথার তোয়াক্কা করছে না। সিঁড়ি ধরে নীচে নেমে গেল টের পেল মেলা ঝোপজঙ্গলও আছে কাছারিবাড়ির চারপাশে। তারপর বেশ বড়ো মাঠ, বাঁশের বেড়া, সেখানে ফুলের সব গাছপালা, সাদা রঙের ছোটখাটো প্রাসাদও চোখে পড়ল। সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, যেন নদীর পাড় ধরে যতদুর চোখ যায়, সবই বড় সুন্দর করে সাজানো গোছানো।

জগদীশ বের হবার সময় বললেন, তুমি গোলঘরে চলে যাবে অরু। হাত মুখ ধুয়ে নাও। বইখাতা নিয়ে যাবে। অমল কমলের ঘরে পড়বে।

রাতে খেতে বসে সবাইকে সে দেখেছে। অমলদা তার চেয়ে বেশ বড়োই হবে। ক্লাশ নাইনে পড়ে। কমল তার বয়সি, কমলদা ঠিক বলা যায় না, সমবয়সিকে সে দাদা বলতে রাজি না। সবাই অবশ্য এখানে বাবু হয়ে গেছে। অমলবাবু, কমলবাবু, কারণ জমিদারি যতই সামান্য থাক, ঠাটবাট আছে পুরো মাত্রায়। খেতে বসেই টের পেয়েছে বাড়িটায় আশ্রিতজনেরও অভাব নেই। লম্বা রান্নাঘরে আসন পেতে সারি সারি পাত পড়েছে। ঝি চাকরেরও অভাব নেই। একটা ধিঙ্গি মেয়েকে কোলে করে তুলে এনেছে—ঘুম থেকে তুলে খাওয়ানোর ফ্যাসাদও সে টের পেয়েছিল। কোল থেকে নামিয়ে দিলে সে বুঝেছিল ইনিই সেই ছোড়দি, গায়ে সাটিনের ফ্রক, ফ্রকের ফাঁক দিয়ে হাতির দাঁতের মত দুটো লম্বা ঠ্যাং বের হয়ে আছে। মাথায় লাল রিবন বাধা, কিছুতেই চোখ খুলছে না—আসনে বসিয়ে দিলেও ঢুলছে। সবাই তাকে খাওয়াবার জন্য যে বড়োই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল, এবং সে না। খেলে বাড়িতে মহামারি শুরু হয়ে যাবে যেন, আহ্লাদ আবদারেরও শেষ ছিল না।

এই তুলি কী হচ্ছে! ইস জলের গ্লাসটা দিলি তো ফেলে। এ কি রে বাবা, কিছুতেই মুখে দিচ্ছে না।

পাশে যিনি বসে তুলিকে খাওয়াবার চেষ্টা করছেন তাকে সে চেনে না। পরে অবশ্য তিথি বলেছে, বড়োবাবুর সম্পর্কে মাসি হয়—এই বাড়িতেই থাকেন।

তারা যখন খাচ্ছিল—তিথি রোয়াকে বসেছিল, নুন জল লেবু সে পাতে পাতে দিয়েছে। কাঁচালঙ্কা দিয়েছে। পায়ে আলতা পরা বউটিকে বাবার বউঠান, ভাতের টাগারি এগিয়ে দিচ্ছেন পরিবেশনের জন্য। সারাক্ষণ বউমা বউমা করছেন। এই নাও মাছভাজা। বড়ো বড়ো কইমাছ ভাজা পাতে পাতে। ডাল পাতে পাতে। আলু পটলের ডালনা, পাখির মাংস, আর ছোট বাটিতে এক বাটি দুধ সবার। ঘোমটায় ঢাকা মুখ, আর নিষ্প্রভ হারিকেনের আলোতে বউটির মুখ সে দেখতে পায়নি, তবে আলতা পরা পা দু-খানি তার এত সুন্দর একেবারে দুধে আলতায় যার রং সে যে খুবই সুন্দরী তাতে তার কোনও সন্দেহ ছিল না। সে মাথা নিচু করে বাবার পাশে চুপচাপ খাচ্ছিল, আর তুলির আবদারে বিরক্ত হচ্ছিল।

কী দিয়ে খাবি?

খাব না।

পাখির মাংস দিয়ে খা।

খাব না।

তবে কী দিয়ে খাবি?

কিছুই খাব না।

দুধ মেখে দিচ্ছি।

দাও।

দু-গ্রাস খেয়েই কেমন ওক তুলে দিচ্ছে।

অরুর বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল, মারব থাপ্পড়।

তিথির বয়সিই হবে। সারা বাড়ির মানুষজন, একটা পুঁচকে মেয়ের খাওয়া নিয়ে যেন অস্থির হয়ে পড়েছিল। আদরে আদরে যে মাথাটি গেছে অরুর বুঝতে অসুবিধা হয়নি।

তিথি রাতে খেয়েছে কি না জানে না।

খেতেও পারে, নাও পারে।

তার বাবা জামিদারবাবুর আশ্রিত। বাড়ির কাজে কিংবা গিন্নিমার ফুটফরমাস খেটে না দিলে যে তাদের সবই যেতে পারে।

তিথি কি সেই আতঙ্কেই থাকে।

একদিন সে স্কুল থেকে ফিরে না বলে পারেনি, এই তিথি শোন।

তিথি তার ঘরে জল তুলে দিয়ে গেছে। তার পর সে ছুটছিল বাড়ির আন্দরের দিকে। কাছারিবাড়ির পরে মাঠ, ঘাসের লন এবং দুটো জবাফুলের গাছ পার হয়ে পাঁচিলের দরজায় হয়তো ঢুকে যেত। তার জলখাবার, এই যেমন কখনও তেলমাখা মুড়ি, অথবা চিড়ে ভাজা, সঙ্গে বাদাম ভাজা কিংবা নাড়, কখনও ফুলুরি অথবা ফুলকপির সিঙারা, যা তাঁকে দেয়, সে নিয়ে আসে।

তিথি জবাফুল গাছের নীচে দাঁড়িয়ে বলল, ডাকছ কেন?

শুনে যা।

আমার এখন শোনার সময় নেই।

আছে। শুনে যা বলছি।

অরুদা কোনও কারণে রেগে যেতে পারে, সে ইতস্তত করছিল, গাছের নীচ থেকে নড়ছিল না।

শুনে যা বলছি।

কি যে করো না। কী হয়েছে? কখন সেই সকালে দুটো মুখে দিয়ে গেছ, না খেলে পিত্তি পড়বে না। আমি আসছি।

না আসছি না। আগে আয়।

অরু স্কুলের জামাও ছাড়েনি। এত নজর মেয়েটার। কখন সে ফিরবে সেই আশায় হয়তো নদীর পাড়ে কিংবা সুপারি বাগানে হেঁটে বেড়ায়। না হলে, সে ফিরেই দেখতে পাবে কেন, এক বালতি জল আর কাঁসার ঘটিটি সিঁড়িতে রাখা আছে। না হলে ফিরেই দেখবে কেন, তার জামা প্যান্ট ভাজ করা, চকির এক কোণায় সাজিয়ে রাখা, চাঁপা ফুল তুলেও একটা কাচের গ্লাসে জলে ডুবিয়ে রাখে। এই ঘরের সব সৌন্দর্য তৈরি হয় তার হাতে। সে যা কিছু এখানে সেখানে ফেলে রাখে, তিথির কাজ তা গুছিয়ে রাখা।

এজন্য অরুর নিজের উপরও রাগ হয়। কিন্তু মুশকিল, কমলদা কিংবা বিশুদা ডাকলে তার ছুটে যাবার অভ্যাস শীতে ব্যাডমিন্টন, বর্ষায় স্কুলের মাঠে ফুটবল, কিংবা স্কুলের প্রতিষ্ঠা দিবসে নাটক, এ-ছাড়া কত যে আকর্ষণ, মেজদা ঢাকা থেকে এলে তার সঙ্গে শিকারে যাওয়া, অথবা নদীর চরে ডাল ফেলে রাখা হয়, জোয়ারের জলে ডুবে যায় ডালপালা, ভাটার মুখে জল নামার আগে সব ডালপালা ঘিরে ফেলা হয় বাঁশের বানা দিয়ে। জল নেমে গেলে, সেই ডালপালা সরিয়ে দিলে জলে কাদায় তাজা মাছের ছড়াছড়ি। গলদা চিংড়ি, কালিবাউশ, ভেটকি থেকে কই পুঁটি ট্যাংরা কিছুই বাদ থাকে না। দাদারা পছন্দমতো মাছ ঝুড়িতে তুলে দিতে বলে, জেলেরা মাছের ঝুড়ি বাড়ি পৌঁছে দেয়, সে আর তিথি তার পেছনে পেছনে ছোটে।

তখন তার মনেই থাকে না, সে তিথির জন্য কাজ বাড়িয়ে রেখে যাচ্ছে। বই খাতা সব চকিতে ছড়ানো ছিটানো। কলম পেনসিল, জিওমেট্রি বক্স যেখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকে। স্কুল থেকে ছুটে আসে। যেন সে তাড়াতাড়ি বের হতে না পারলে তার মজা উপভোগ করার সময় পার হয়ে যাবে। তিথি আছে, সে-ই সব করবে।

সেই সব তুলে রাখে। সাজিয়ে রাখে। জিওমেট্রি বক্স খোলা, বাক্সের সব কিছু এলোমেলো, তিথির কাজই হল, ঠিকঠাক তুলে রেখে দেওয়া। এত যে মজা উপভোগ করতে পারে তিথি আছে বলেই।

তিথি কেমন ভীরু পায়ে লন পার হয়ে এগিয়ে আসছে।

সে বুঝতে পারছে না তার কী দোষ।

অরু সিঁড়ি থেকে নড়ছে না।

তিথি অত্যন্ত ভীরু মুখেই বলল, আমি কী করেছি?

আগে কাছে আয়।

তিথি ভয়ে কাছে যাচ্ছে না।

বলোই না। আমি তো কাছেই আছি।

ঘরে আয়।

না ঘরে ঢুকব না।

ঢুকবি না?

তুমি কি আমাকে মারবে?

তোকে মারতে পারলে ভালো হত। তুই কখন রাতে বাড়ি যাস? সারাদিন বাবুদের বাড়িতে পড়ে থাকতে ভালো লাগে?

তিথি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

রাতে তুই রোয়াকে বসে থাকিস কেন? তুই কি রাতে বাবুদের বাড়িতে খাস। তোকে কি তারা দু-বেলা খেতে দেয়।

দেবে না কেন? যখন যা বেশি হয় দেয়। সবাই খেলে কিছু তো পড়ে থাকেই। আমি আলাদা থালায় তুলে রাখি। ওতেই পেট ভরে যায়।

সারাদিন ধরে বাবুদের বাড়ির সবার উচ্ছিষ্ট খাবার খেয়ে বেড়াস? তোর খারাপ লাগে না।

বারে, খারাপ লাগার কি আছে। তুমি কি এজন্য আমাকে ডেকেছ? আমার কত কাজ জান? তুমি জান, ছোড়দির আজ পুতুলের বিয়ে। আমি না গেলে সব কাজ পড়ে থাকবে। পুতুলের জামা কাপড় আমি না গেলে পরাবে কে! দেরি হলে রাগ করবে। আমাকে খামচে দেবে। আমার ফ্রকও ছিঁড়ে ফেলতে পারে। ছোড়দির বেজায় রাগ জান? আমাকে কী বলেছে জান?

কী বলেছে।

তুমি নাকি ছোড়দিকে দেখলেই পালাও।

মিছে কথা।

ছোড়দি মিছে কথা বলে না। ছোড়দি তো কাউকে ভয় পায় না। মিছে কথা বলতে যাবে কেন?

পালাই! বেশ করেছি। বলবি বেশ করেছি।

ছোড়দির সঙ্গে কথা বলো না কেন? তাই তো খেপে যাচ্ছে। তোমাকে দূর থেকে দেখলেই বলবে, দাঁড়া না অরুকে আমি মজা দেখাচ্ছি। ভূঁইঞাকাকাকে বলে এমন মার খাওয়াব না, জীবনেও ভুলতে পারবে না।

তিথি তার সঙ্গে এতদিন নিজের কথাই বলেছে—সে কারও নিন্দামন্দে থাকে। তুলির কোনও কথাই এতদিন বলেনি। আজ কি তিথি বুঝতে পেরেছে, সে উচ্ছিষ্ট খেয়ে বেড়ালে, তার অরুদাকে ছোটো করা হয়। অরুদাকে বিশ্বাস করে সে কি তাকে নিজের মানুষ ভেবে ফেলেছে।

তিথি বলল, ঠিক আছে পরে কথা হবে। বলেই ছুট। একদণ্ড আর দাঁড়াল না। বাটিতে মুড়ি আর দুটো সন্দেশ নিয়ে এসে হাজির। ঘরে আলাদা তার কাঁসার গ্লাস আছে, কুঁজো থেকে গ্লাসে জল ভরে একটা টিপয়ে রেখে বলল, আমি যাচ্ছি অরুদা। দরজা খোলা রেখে উধাও হবে না। শেকল তুলে দিয়ে যাবে। কুকুর বিড়ালের উৎপাত আছে বোঝ না।

তারপর আর তিথি একদণ্ড দাঁড়াল না। বড়ো বেশি লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটে, লাফিয়ে লাফিয়ে দৌড়ায়। তিথি দৌড়ে মাঠ পার হয়ে লনের ভিতর ঢুকে গেল। অরু বাইরে দাঁড়িয়েছিল, তিথি একসময় পাঁচিলের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল।

তার এখন তাড়াতাড়ি খেয়ে বের হয়ে যাওয়া দরকার। দেরি হয়ে বিশুদা, অমল, কমল সবাই তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। শহর থেকে মেজদা নতুন র‍্যাকেট নিয়ে এসেছে। কর্ক এনেছে এক ডজন। শীতের শেষাশেষি নদীর পাড়ে নেট টানিয়ে আজ থেকে ব্যাডমিন্টন খেলা শুরু হবে। সে সঙ্গে না থাকলে বাঁশ, খোনতা কে নিয়ে যাবে। সে একজন আমলার পুত্র, এ-কাজটা তারই করা উচিত।

গোলঘরে যাবার সময়ই ভাবল, তিথিকে বড়ো বড়ো কথা না বললেই পারত। তিথি খারাপ পেতে পারে। তিথি এ-ভাবে বাবুদের উচ্ছিষ্ট খেয়েই বড়ো হয়ে উঠেছিল। কেন যে মনে হল বাবাও তার উচ্ছিষ্টভোজী এবং সেও। তার মুখে অত বড়ো কথা শোভা পায় না। তিথি তার কথা শুনে ভাগ্যিস হেসে ফেলেনি।

তারপরই মনে হয় কাজ করলে মানুষ ছোটো হয়ে যায় না। হাতে র‍্যাকেট নিয়ে সেও খেলবে। খেলার নামে তার মধ্যে ঘোর সৃষ্টি হয়। নদীর পাড়ে যখন তারা নেট টানিয়ে খেলছিল, তখন আর নিজেকে কিছুতেই খাটো ভাবতে পারেনি। ফেরার সময় মনে হল সে রাজ্য জয় করে ফিরছে।

তবে তুলি বাবাকে মিছে অভিযোগ করে মার খাওয়াবার পরিকল্পনা করছে, ভাবতেই ভারি দমে গেল। তুলির সঙ্গে যাও ইচ্ছে হয়েছিল, দেখা হলে একদিন কথা বলবে, তাও আর বোধ হয় হবে না। কী বলতে কী ভেবে নেবে কে জানে। আর তুলিকে সে কি কথা বলবে? তুমি ভালো আছ? তুমি দেখতে খুব সুন্দর। খুব বোকা বোকা কথা। তুলির সঙ্গে কথা বলার মতো ভাষাই তার জানা নেই।

সবাই চলে গেছে, নদীর পাড়ে মানুষজন কমে আসছে দূরে স্টিমার ঘাটে গ্যাসবাতি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। ঘাটে যাত্রীদের ভিড় আছে। রাত আটটায় স্টিমার আসবে, যাত্রী নামবে, যাত্রী উঠবে। আশরাফ সারেঙ জাহাজ ভর্তি করে লোক তুলে নিয়ে যাবে। তার খুবই ইচ্ছে হয়েছিল, আশরাফ সারেঙের সঙ্গে ঘাটে গিয়ে একদিন দেখা করে। কিন্তু হয়ে ওঠে না। গোলঘরে তখন সবার সঙ্গে তাকেও পড়তে বসতে হয়। মাস্টারমশাই প্রাসাদের বড়ো বড়ো জানালা দেখিয়ে বলেন, এই হচ্ছে আয়তক্ষেত্র। ঘরের মেঝে দেখিয়ে বলেন, এই বল বর্গক্ষেত্র যার চারটি বাহুই সমান।

পড়াশোনার পীড়নও তার কম নয়। ক্লাশে পড়া না পারলে ঠিক বাবার কানে কথা উঠে যায়।

ভূঁইঞামশায় আছেন?

দ্বিজপদ সার এসে হাজির।

তোমার বাবা কোথায়।

সে বুঝতে পারে দ্বিজপদ সার নালিশ জানাতে এসেছেন। সে দরজা খুলে সামনের বারান্দায় একটা টিনের চেয়ার বের করে দেয়। তারপর বাবাকে খুঁজে বেড়ায়। ইংরাজি গ্রামার ট্রান্সলেশনে সে কাঁচা, তার নাকি মনোযোগেরও অভাব আছে— দ্বিজপদ সার সে-সব কথা বলতেই হয়তো এসেছেন। সে তার বাবাকে খুঁজতে গিয়ে নিজেই হারিয়ে যায়।

এ-ভাবে সে কতদিন কত কারণে নদীর পাড়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। কাছারিবাড়িতে ঢুকতে ইচ্ছে হয় না। বাড়ির জন্য মন কেমন করে তখন। পূজার ছুটিতে সে বাড়ি যেতে পারবে, পূজারতো এখনও অনেক দেরি। নতুন উপসর্গ তুলি। তাকে ভয় দেখিয়েছে, তুলি মিছে কথা বলে না। তুলি কাউকে ভয় পায় না। ভয় না পেলে যেন মিছে কথা বলা যায় না।

নদী থেকে হাওয়া উঠে আসছে। জোয়ারে নদীর জল বাড়ছে। দেখতে না দেখতে বর্ষা এসে যাবে। বর্ষার নদী বিশেষ করে এই কোয়ালা নদীতে কুমির পর্যন্ত ভেসে আসে। তিথিই তাকে একদিন খবর দিয়েছিল, জমিদার হেমন্ত রায়চৌধুরির বৈঠকখানার বারান্দায় শ্বেতপাথরের টেবিলে একটা কুমিরের ছাল আছে। তিথি তাকে সেখানে একদিন নিয়ে যাবে, এমনও কথা দিয়েছে।

নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকলে কত কথা মনে হয়। আর কত পাখির ওড়াউড়ি, কোথা থেকে আসে, কোথায় যায় সে কিছুই জানে না। বর্ষা এলে দু-পাড়ের চর ডুবে যায়। নদীর ঘাটগুলিতে যত সিঁড়ি আছে, সব জলে ডুবে যায়। তিথিই সব খবর দেয় তাকে। কিন্তু তুলির খবরটা না দিলেই পারত। এমন সুন্দর মেয়েটা এত কুবুদ্ধির ডিপো ভাবতেই তার কষ্ট হচ্ছিল।

তবে বাবা তাকে কখনই গায়ে হাত তোলেনি। বাবাকে বলে মার খাওয়ানো সহজ না। বাবা কি পুতুল! সে সাহস পায়। ঘাটলার সিঁড়ি থেকে উঠে দাঁড়ায়। আকাশ আর মেঘমালায় ঢেকে আছে চারপাশ। দুটো একটা নক্ষত্রের প্রতিবিম্ব জলে ভাসছে। ছলাত ছলাত জলের শব্দ। গুন টেনে নিয়ে যাচ্ছে মাঝিরা। কত দূর দেশে চলে যায় কত লোক। সেও চলে এসেছে—তিথির জন্যই হোক কিংবা এই গ্রাম, মাঠ, স্কুল, মজা খাল বিশাল সব প্রাসাদ আর বাবুদের জাঁকজমক, যেমন জমিদার হেমন্ত রায়চৌধুরীর আস্তাবলে বিশাল দুটো আরবি ঘোড়া এবং ঘোড়ায় চড়ে নদীর পাড় ধরে হরিশবাবুর ছোটা, কে না দেখেছে, সে জানেই না, এক আশ্চর্য আশ্বারোহী কদম দিতে দিতে বিন্দু থেকে বিন্দুবৎ হয়ে যেতে পারে। হরিশবাবু দেশে এলে তিথি তাকে নিয়ে নদীর পাড়ে ছুটে যাবেই। কারণ হরিশবাবু বিকেলে ঘোড়ায় চড়ে নদীর পাড়ে হাওয়া খেতে বের হন। তিথি তাকে গোপনে একটা চিরকুট ধরিয়ে দেয়। চিরকুটে কী লেখা থাকে সে জানে না। তিথি চিরকুট হোক, চিঠি হোক খুবই গোপনে হরিশবাবুর হাতে দিয়ে দেয়। ঠিক ঘাটলার পাশে কদম দিতে দিতে তিথির সামনে এসে দাঁড়াবেন। তারপর ভারি সতর্ক নজর। ঘোড়র উপরেই তিনি বসে থাকেন। নুয়ে তিথির চিঠিটা নিয়েই দিঘির পাড় ধরে অদৃশ্য হয়ে যান। আসলে অরুর মাঝে মাঝে কেন জানি মনে হয় কোনও স্বপ্নের পৃথিবীতে সে এসে উঠেছে। বাড়ির জন্য প্রথম প্রথম খুবই মন খারাপ করত, কিন্তু দিন যতো যাচ্ছে, তত তার মনে হয় মন খারাপ আর আগের মতো হয় না। সে তো দেখতে পায় তুলি সাটিনের ফ্রক গায় দিয়ে মাথায় সুন্দর লাল রিবন বেঁধে কখনও সুপারি বাগানে, কখনও নদীর চরে, ঘুরে বেড়াচ্ছে। সঙ্গে কেউ থাকে। সে কাছে থাকে না, ঝোপ জঙ্গলের আড়াল থেকেই তুলিকে সে দেখতে বেশি ভালোবাসে। তুলি কাছাকাছি এলেই সে দৌড়ে পালায়—যদি তুলি টের পেয়ে যায়, সে চুরি করে চরের উপর একটা জ্যান্ত পরির ওড়উড়ি দেখছিল—ধরা পরলে কেলেঙ্কারির একশেষ—সে না পালিয়ে থাকে কী করে।

তুলি মিছে কথা বলে না, অরু ঠিকই বলেছে।

তুলি ঠিক টের পেয়েছে সে তাকে দেখে, তাকে দেখার জন্য নদীর পাড়ে কিংবা কাছারিবাডির বড়ো বড়ো আমগাছের আড়ালে সে দাঁড়িয়ে থাকে। কখনও বাবদের সঙ্গে স্টিমারঘাটে গেলেও সে যে তুলির পিছু নেয় তাও টের পেতে পারে। কখনওই তুলির সামনে যেতে সাহস পায়নি। রান্নাবাড়িতেই কখনও রাতে সে কাছ থেকে তুলিকে দেখতে পায়। রোজদিন দেখা হয় না। তুলি আগে খেয়ে নিলে দেখা হওয়ার কথাও নয়, তার যে কি হয়, সে রান্নাবাড়িতে মাথা নীচু করেই খায়। চোখে চোখ পড়ে গেলে কত বড়ো বেয়াদপি, সেটা সে বোঝে। তুলি অপছন্দও করতে পারে। বাড়ির একজন আমলার পুত্রের এত আস্পর্ধা হয় কী করে। সাটিনের ফ্রকের নীচে তুলি আজকাল টেপ দেওয়া জামাও পরে।

তুলির এত সে জানে, তুলি কেন জানবে না, তুলিকে দেখলেই সে পালায়।

কাছারিবাড়ির দিকে সে হেঁটে যাচ্ছে। বাবার সঙ্গে তার কমই দেখা হয়। বাবার ছুটি ছাটা নেই। রবিবার শনিবার নেই। সেই আটটায় গিয়ে নাজিরখানায় বসেন, তাপোষে সাদা ধবধবে ফরাস পাতা— দু-তিনটে তাকিয়া, সামনে কাঠের একটা বড়ো ক্যাশবাক্স, দেয়ালের দিকে গোটা দুই লম্বা টুল, লোকজন সব সময় বাবার কাছে বসেই থাকে—আদায়পত্র, কিছু সুদেরও কারবার আছে, নদী থেকে বড়ো রকমের রোজগার আছে বাবুদের—নদীর ডাক হয়-ইলিশমাছের জো পড়লে আদাইয়ের পরিমাণ বাড়ে।

সকাল বেলাতেই ভিতর বাড়ি থেকে একটা লম্বা ফর্দ চলে আসে। বাবা ফর্দ মিলিয়ে সব কিছু নিয়ে আসার জন্য হরমোহনকে বাজারে পাঠিয়ে দেন। যার যা দরকার, বাবার কাছে দরকার মতো সব চিরকুট আসে। লম্বা খেরো খাতায় বাবা সব খরচখরচা এবং আদায় কী হল সব টাকার জমা খরচ তুলে রাখেন। সাঁজবেলায় দেবকুমারবাবু কিংবা নবকুমারবাবুর কাছে সারা দিনের খরচা খরচা এবং আয়ের হিসাব অর্থাৎ খেরো খাতাটি সম্বল করে বাবা তাদের কাছে চলে যান। মামলা মোকদ্দমা অথবা তালুকের প্রজাদের বাদবিসংবাদে বাবাকেই ছুটতে হয়।

যত তার কথা রাতে।

তোমার কোনও অসুবিধা হচ্ছে না তো অরু?

আজ্ঞে না।

বাড়ির জন্য মন খারাপ করছে না তো?

আজ্ঞে না।

মন দিয়ে লেখাপড়া করবে। পড়া বুঝতে না পারলে দ্বিজপদকে বলবে।

তখনই একদিন সে তার বাবাকে কেন যে বলল, আচ্ছা বাবা আমার জামা প্যান্ট আমি কেচে নিতে পারি না।

পার।

সকালে তিথির জল তুলে দিয়ে যাওয়ারও কিন্তু দরকার হয় না। আমিই তুলে রাখতে পারি।

ইচ্ছে করলে সবই করা যায় অরু। এতে স্বাবলম্বী হওয়া যায়। সব কিছু নিজে করে নিতে পারার মতো বড়ো কিছু নেই।

আমি তিথিকে ঘরে ঢুকতে বারণ করে দেব।

কেন? কে কী করেছে।

কিছু করেনি। তিথির কত কাজ ভিতর বাড়িতে। সে সব করে কখন।

অঃ এই কথা। তবে তিথি কী দমবার পাত্র। আমার তো মনে হয় না রাজি করাতে পারবে।

যাবার কথাই ঠিক।

তিথিকে নিযেধ করেছিল।

শোন তিথি, এই কাজটুকু তোর না করলেও চলবে।

তিথি বড়ো বড়ো চোখে তাকিয়েছিল তার দিকে। যেন কিছুই বুঝতে পারছে না।

জলটল আমিই তুলে রাখব। বিছানা করে নিতে আমার অসুবিধা হবে না। জামা প্যান্ট গোলা সাবানে কাচতে কতটুকু সময় লাগে বল।

ঠিক আছে করে নেব। করতে পারলে তো ভালোই। তারপরই তিথি সিঁড়ি ধরে নামার সময় ভেংচি কেটে বলল, কত মুরদ। জানা আছে। তিনি সব করে নেবেন তা হলেই হয়েছে।

কিন্তু তিথি বোধহয় শেষে অবাকই হয়ে গেছিল, সে তো ছেড়ে দেবার জন্য বসে নেই। সে যখন দেখল, কোনও কাজেই তার ত্রুটি থাকছে না, কেমন দিন। দিন বিমর্ষ হয়ে যেতে থাকল। স্কুলে যাবার সময় দেখতে পায় তিথি সিঁড়িতে গালে হাত দিয়ে বসে আছে, স্কুল থেকে ফিরেও দেখতে পায় গালে হাত দিয়ে বসে আছে। কাজের কোনও খুঁতই ধরতে পারছে না, ক্ষোভে কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। আর একদিন এসে দেখল, সারা ঘর তছনছ করে রেখেছে কে। মেঝেতে বালতির সব জল ঢেলে দিয়েছে কেউ। ঘরে ঢুকেই অরুর মন খারাপ। তিথির কাজ। তিথিই শেকল খুলে সব তার তছনছ করে দিয়ে গেছে। কাজ কেড়ে নেওয়ায় তার বোধ হয় সহ্য হচ্ছে না।

তিথি! তিথি!

সে দরজার বাইরে লাফিয়ে নেমে গেল।

তারপর তিথিদের বাড়ির দিকে ছুটল।

কোথাও তিথি নেই।

কোথায় গেল মেয়েটা?

অরু কাউকে বলতেও পারছে না, আমার ঘর তিথি তছনছ করে দিয়েছে। বইটই পেনসিল খাতা সারা চৌকিময়। জলে ভাসছে মেজে। কাঁসার ঘটি, গ্লাস গড়াগড়ি খাচ্ছে চৌকির নীচে। এটা যে তিথিরই কাজ বলে কী করে।

শেষে সে তিথিকে খুঁজে পেল সুপারি বাগানের ভিতর। গাছগুলো খুবই পাতলা, দূর থেকেও দেখা যায় ভিতরে কেউ বসে থাকলে। তখন সূর্য অস্ত যাচ্ছে নদীতে। নদীর জল তেমনি ছলাত ছলাত। পাড় ভাঙারও শব্দ পেল। হরিশবাবুর ঘোড়াও ছায়ার মতো দূরে ভেসে উঠল।

অরু ছুটে যাচ্ছে।

সুপারি বাগানের ভিতর দিয়ে সোজা ছোটা যায় না। সে এ-গাছ ও-গাছ ডাইনে বাঁয়ে ফেলে বাগানে ঢুকে যাচ্ছে।

আর ডাকছে, এই তিথি, এখানে লুকিয়ে থেকে রক্ষা পাবি ভাবছিস! তোর বাবাকে ডেকে সব না দেখাচ্ছি তো আমার নাম অরু না। তোর এত জেদ!

এই কি কাছে গিয়ে কী দেখছে।

তিথি গাছের গুঁড়িতে বসে আছে মাথা নীচু করে। ডাকলেও সাড়া দিচ্ছে না।

অরু জোর করেই মুখ দেখার জন্য তিথিকে চিৎ করে দিল। তিথি বিন্দুমাত্র জোরাজুরি করল না। কারণ তিথি বোকার মতো ভেউ ভেউ করে কাঁদছে—আমি কী করব বলে দাও। আমি কী নিয়ে থাকব বলে দাও।

অরু হতভম্ব। বুঝতে পারছে না, সে হাসবে না রাগ দেখাবে। আমি কী করব, কী নিয়ে থাকব—এত পাকা পাকা কথা মেয়েটার, এটুকুন মেয়ে কেমন সুন্দর সাজিয়ে গুছিয়ে কথা বলতে পারে। তিথির পক্ষেই সম্ভব?

নে ওঠ। ঘরে চল। যে হাতে সব তছনছ করেছিস সেই হাতে সব সাজিয়ে রাখ। স্টিমার ঘাট থেকে বাবা ফিরে এলে মুশকিলে পড়ে যাবি।

তিথি হি হি করে হাসতে হাসতে উঠে বসল, তারপর ছুটতে থাকল, যেন সে জয়লাভ করে খুবই খুশি—ছোটার মধ্যে তিথির এত সজীবতা থাকে যে বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না। এক বিনুনি বাঁধা, মার্কিন কাপড়ের ঢোলা সেমিজ গায়ে, উসখো খুসকো চুলে মেয়েটার লাবণ্য যেন আরও বেড়ে যায় তখন। আর তখনই মনে হয়েছিল, তিথি চিৎ হয়ে পড়ে থেকে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল ঠিক, আবার সঙ্গে সঙ্গে এমন চোখে ওকে দেখছিল যেন কিছু একটা হয়ে যাক। আর কিছু না হোক, অরুদা তাকে আদর করলে সে আপত্তি করবে না।

এই সব মনে হলেই তিথির জন্য তার কষ্ট হয়। সে ধীরে ধীরে হাঁটে। তার কিছু ভালো লাগে না। অমলদা যাবার সময় তাকে ডেকে গেছে, এই অরু ঘাটলায় গিয়ে আবার বসলি কেন? পড়াশোনা নেই।

সে সাড়া দেয়নি। কিন্তু গোলঘরে সবাই পড়তে চলে যাবে। তাকেও হাতমুখ ধুয়ে মাস্টারমশাইর সামনে গিয়ে পড়তে বসতে হবে, সে না গেলে, দাদারাই খুঁজতে বের হবে। কাছারিবাড়িতে এসে খুঁজবে তাকে।

সে পা চালিয়ে হাঁটছে। সুপারি বাগান পার হয়ে কাছারিবাড়ির মাঠে ঢুকতেই মনে হল কারা যেন মাঠে তার জন্য অপেক্ষা করছে। কাছে গেলে দেখল তিথি আর তুলি। তুলিকে সঙ্গে নিয়ে এসেছে। তার সঙ্গে তুলির ভাব না হলে তিথি বোধ হয় স্বস্তি পাচ্ছিল না।

তিথি বলল, কোথায় একা একা ঘুরছিলে! জান সাঁজবেলায় তেঁতুলতলা দিয়ে কেউ আসে না। জায়গাটা ভালো না। একা একা তেঁতুলতলা দিয়ে চলে এলে!

আসলে রাস্তা সংক্ষিপ্ত করার জন্যই সে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে তেঁতুলতলার নীচ দিয়ে উঠে এসেছে। জায়গাটা যে ভালো না সেও শুনেছে। ছোটোপিসিকে এখানে একবার ভূতে ধরেছিল—সাঁজ লাগলে রাস্তাটা দিয়ে কেউ বড় আসে না। তুলির আক্রোশের কথা ভাবতে গিয়ে এতই দামে গিয়েছিল, তার কোনও কিছুই প্রায় খেয়াল ছিল না। সেই তুলি অরুর পাশে দাঁড়িয়ে আছে ঠিক, তবে তাকে দেখছে না। আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রিয় কোনও ক্ষেত্র খুঁজে বেড়াচ্ছে যেন।

তিথি না পেরে বলল, এই ছোড়দি, অরুদাকে কী বলবে বলেছিলে?

কী বলব?

কেন, বললে না, চল তো, অরুর সঙ্গে আমার কথা আছে।

কখন বললাম?

জানি না বাবু, তা হলে আসার কী দরকার ছিল। অরুদা তুমি যাও। হাতমুখ ধুয়ে পড়তে বসোগে।

অরু যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। সে পা বাড়াতেই তুলি বলল, সেদিন মাঠের আড়ালে দাঁড়িয়ে কী দেখছিলে?

কবে?

মনে নেই তোমার। আমি চরের বালিতে বাণীপিসির সঙ্গে হাওয়া খাচ্ছিলাম।

অরু সোজাসুজি বলল, না। মনে নেই।

না, আচ্ছা নাই মানলাম। তারপরই বলল, আমি বাঘও না ভালুকও না। আমার সঙ্গে কথা বললে জাত যাবে না। কি মনে থাকবে?

কী কথা বলব?

কথার কি শেষ আছে। আমাকে চুরি করে দেখলে খুব রাগ হয় আমার জান?

ঠিক আছে আর দেখব না।

তিথি বলল, তুমি ছোড়দিকে তবে সত্যি চুরি করে দ্যাখো!

কী বলব, ও যখন বলছে–

ও বললেই তুমি মেনে নেবে। এ কেমন কথা। চুরি করে দেখার কী আছে!

অরু কিছুটা সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল। এই চুরি করে দেখার মধ্যে কি কোনও অন্য অনুভূতি কাজ করে। সে বড়ো হয়ে যাচ্ছে। সে নিজেকে যতই আড়াল করে রাখুক তার ভিতর একজন নারী যে স্বপ্নে বড়ো হয়ে উঠছে বুঝতে পারে। এই সব গোপন কথা যদি সত্যি ফাঁস হয়ে যায়, তবে সে মুখ দেখাবে কী করে। বাবা যে তবে খুবই জলে পড়ে যাবেন। সেদিনের ছেলে, ক্লাশ এইটে সে পড়ে, তার মধ্যে একজন নারী স্বপ্নে বড়ো হয়ে উঠলে যে রোগব্যাধির পর্যায়ে পড়ে। কলঙ্কও কম না।

তখনই তুলি বলল, আমি কাউকে কিছু বলতে যাচ্ছি না। আমার পুতুলের বিয়ে আজ। তুমি খাবে। তিথি এসে তোমাকে নিয়ে যাবে। না গেলে রাগ করব।

পুতুলের বিয়ে নিয়ে অরুর আর এক ধন্দ। সে যাবে। কী খাবে? সে যাই হোক অরু বুঝল, সে তুলিকে দেখে যা ভাবে, তুলিও তাকে দেখলে তেমনই কিছু একটা ভাবে। তুলি তার বিরুদ্ধে খুব বেশি কিছু রটাতে সাহস পাবে না। তুলি নিজেও ভিতরে ভিতরে বড়ো হয়ে যাচ্ছে। তুলিও তার শরীর নিয়ে ঠিক কিছু ভাবে।

এ-ভাবে সন্ধ্যার ম্লান অন্ধকারে অরুর মুখ রক্তাভ হয়ে গেল। ভিতরে এক অতীব স্পৃহা শরীরের কোষে কোষে ঢেউ তুলে দিচ্ছে। সে কোনওরকমে কাছারিবাড়িতে ঢুকে তক্তপোষে বসে পড়ল।

হাতমুখ ধোয়ার কথা মনে থাকল না।

কেমন ভ্যাবলু বনে গেছে যেন।

মনে হয় তার জীবনে এই প্রথম এক পালতোলা নৌকা এসে হাজির। নৌকায় উঠে গেলেই এক রহস্যময় দেশ, শরীরে সুঘ্রাণহাতে পায়ে জংঘায় পদ্মফুলের ছড়াছড়ি। নরম পাপড়ি, কোমল ত্বকের ভিতর ফুটে থাকা নরম পাপড়ির স্পর্শে তার শরীরে বিদ্যুৎ খেলে যাচ্ছে। সে হাত পা টান করে একটা বালিশ টেনে শুয়ে পড়ল। কেমন অসাড় হয়ে যাচ্ছে তার শরীর।

তখনই দ্বিজপদ সারকে অরুর নামে নালিশ।

সার দিন দিন অরু ফাঁকিবাজ হয়ে যাচ্ছে। এখনও তার আসার নামগন্ধ নেই। কখন পড়তে বসবে!

দ্বিজপদ বুঝতে পারেন, যতক্ষণ তিনি পড়ান, ততক্ষণ বাবুদের ছেলেরা হাজতখানায় বসে থাকে। অরু না আসায়, তাদের ক্ষোভ বাড়ছে। হাজতখানার আর এক কয়েদির পাত্তাই নেই। সার শুধু একবার বলেছিলেন, অরুর কি শরীর খারাপ!

কমল বলল, ডাহা ফাঁকিবাজ সার। পড়ার নামে মাথায় বাজ পড়ে। কী করছে, কাছারিবাড়িতে! দেখে আসব সার?

দ্বিজপদ হাসলেন। আসলে পড়া থেকে ফাঁকি দেবার সুযোগ খুঁজছে। ভূঁইঞামশায়ের পুত্রটি পড়াশোনায় বেশ ভালো। পড়াশোনায় অরুর যথেষ্ট আগ্রহও আছে। যথাসময়েই সে চলে আসে। দ্বিজপদ ঘরে ঢুকে আর কাউকে দেখতে না পেলেও, অরুকে দেখতে পান। দ্বিজপদ ঘরে ঢুকলে সে উঠে দাঁড়ায়। নম্র স্বভাবের ছেলেটির পড়াশোনার ভার ভুইঞামশায় তার হাতেই ছেড়ে দিয়েছেন, সে যদি না আসে, চিন্তারই কারণ। আমবাগানের এক কোণায় কাছারিবাড়িতে একাই তাকে থাকতে হয়। দ্বিজপদ কী ভেবে বললেন, ঠিক আছে। আমিই দেখে আসছি।

এতে সবাই একবাক্যে সায় দিল, সেই ভালো সার।

অর্থাৎ তিনি যতক্ষণ না থাকবেন, ততক্ষণই তাদের রেহাই।

বিশু বলল, আমি যাব সঙ্গে।

কী দরকার!

কমল বলল, টর্চ নিলেন না?

তা সাপখোপের উপদ্রব আছে। নদীর পাড়ে বাড়ি। ঝোপজঙ্গল, কোথাও কোথাও প্রাসাদের ধবংসস্তূপও আছে। বিষধর, ভূজঙ্গের উৎপাতও কম না। তিনি কী ভেবে টর্চ বাতিটা সঙ্গেই নিলেন।

ঘর থেকে বের হলেই দুটো করবীফুলের গাছ, তারপর একটা হাসনুহানার গাছ। গাছটায় দু একটাই ফুল ফোটে। ফুলের তীব্র গন্ধ ছড়ালেই বোঝেন, গাছে কোথাও ফুল ফুটেছে। মাথায় অনায়াসের ডিমের মতো লম্বা ঘন পাতায় ঝোপ সৃষ্টি করে রেখেছে? গাছটার নীচ দিয়ে যাবার সময় তিনি খুব সতর্ক থাকেন। কেন যে মনে হয় যে কোনও মুহূর্তে পাতার ঝোপ থেকে পোকামাকড় লাফিয়ে পড়বে। খুবই দুর্লভ ফুলের গাছ। দিনের বেলাতেও ফুল খুঁজে বের করা কঠিন—অথচ ফুল যে ফুটেছে, গন্ধেই টের পাওয়া যায়। বিষধর সাপেদের বড় প্রিয় এই ফুলের ঘ্রাণ। একেবারে রাস্তার উপর গাছটা জমিদারবাবুরা না লাগালেই পারতেন। তিনি কী ভেবে গাছটার নীচে ঢুকে যাবার আগে টর্চ মেরেও দেখলেন। প্রায় বিশাল ছত্রাকার হয়ে আছে গাছের মাথাটি। ঘন সবুজের সমারোহ।

গাছটা পার হলেই সবুজ লন। শীত বসন্তে নীল রঙের বেতের চেয়ার টেবিল পাতা থাকে। বাবুরা বিকালে হাওয়া খান এখানটায় বসে। নদীর জলে নৌকা ভাসে। রাতে স্টিমারের সার্চলাইটে কেমন নীলাভ দেখায় এলাকাটা। বাবুদের আত্মীয়স্বজনও কম না। এখানে বসে তাস পাশার আড়াও জমিয়ে তোলার ব্যবস্থা থাকে।

দ্বিপদ যাচ্ছিলেন, তার ছাত্রটি কাছারিবাড়িতে একা একা কী করছে, শরীর যদি খারাপ হয়, এই সব ভেবেই আমবাগানে ঢুকে গেলেন। এক ইটের দেয়াল, মাথায় টিনের চাল, আটচালার উপরে গাছের ডালপাতায় জায়গাটা খুবই অন্ধকার হয়ে আছে। মূল বাড়ি থেকে বড়োই আলগা এই কাছারিবাড়িটি। অরু ছেলেমানুষ সে এমন একটি পরিত্যক্ত জায়গায় একা বসে থাকতেও ভয় পাবে।

সে কি ঘরে নেই?

দরজা খোলা?

টর্চ মেরে দূর থেকেই সব টের পাচ্ছেন।

কেউ হারিকেন জ্বালিয়ে দিয়ে যায়নি।

দ্বিজপদ কিছুটা দ্রুতই হেঁটে যেতে থাকলেন।

ঘরে ঢোকার আগে ডাকলেন, অরু আছিস! অরু।

কোনও সাড়া নেই।

তাজ্জব। ছেলেটা গেল কোথায়?

ভিতরে টর্চ মারতেইদেখলেন, অরু শুয়ে আছে একটা লম্বা সাদা চাদরে মুখ মাথা ঢেকে। সে কি ঘুমাচ্ছে।

এই অসময়ে।

এই অরু, অরু।

অরু ধড়ফড় করে উঠে বসল।

ঘরে অন্ধকার করে শুয়ে আছিস, কী ব্যাপার। শরীর খারাপ!

টর্চের আলো চোখে পড়ায়, অরু তাকাতে পারছিল না। সে হাতে চোখ আড়াল করে বোঝার চেষ্টা করল, কে তাকে ডাকছে!

তার যে কী হয়েছিল! সে কী বলবে। লজ্জায় মাথা নীচু করে বসে থাকা ছাড়া তার যেন আর অন্য কোনও উপায় নেই। সার নিজে চলে এসেছেন। এতে সে আরও শঙ্কিত হয়ে উঠল। সে ঘরে কখন ঢুকে গেছে, কখন চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েছিল—শরীরে তার যেন কীসের ঘোর উপস্থিত। চোখ মুখ জ্বালা করছিল, এবং শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গে আশ্চর্য এক ঝড়ের আভাস। ঝড়ে তাকে বড়োই বিপর্যস্ত করে দিয়ে গেছে—সে কিছুটা যেন চৈতন্যও হারিয়েছিল—এক গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত পৃথিবীতে সে স্বপ্নের বালিহাঁস হয়ে গেছিল। কোনও শিকারের দৃশ্য, সে মজবুত হাতে হাঁসটার ডানা, কিংবা পালক ছিমড়ে ছিঁড়ে খেয়েছে।

লজ্জায় সে কথা বলতে পারছিল না।

কী হয়েছে? শরীর খারাপ অরু?

আজ্ঞে। সে কথা বলতে পারছে না।

ভয় পেয়েছিস?

আজ্ঞে … সে কথা বলতে পারছে না।

ঘরে হ্যারিকেনও জ্বালিসনি!

আজ্ঞে আমি যাচ্ছি সার।

আয়। তোর একা থাকতে ভয় করলে, কারও এ-ঘরে থাকা দরকার। সত্যি তো, তুই থাকিস কী করে। ঠিক আছে, ভুইঞামশায়কে বলছি।

আজ্ঞে না সার বলবেন না। আমার একা থাকতে ভয় করে না। আপনি বাবাকে কিছু বলবেন না।

হারিকেন ধরা।

সে চৌকি থেকে নেমে হারিকেন ধরাল।

এখন তার ধীরে ধীরে সবই মনে পড়ছে। তিথি হারিকেনের চিমনি মুছে তেল ভরে রেখে গেছে। দরকারে সে জ্বালিয়ে নেয়। নিবিয়ে দেয়। আজ ঘরে ঢুকে কিছুই মনে ছিল না। শরীরে ঘোর উপস্থিত হলে এমনই বুঝি হয়—সে তার দ্বিতীয় সত্ত্বা আবিষ্কার করে কেমন নির্বোধ হয়ে গেছে আজ।

সে খুবই ধীর পায়ে বই খাতা নিয়ে ঘর থেকে বের হবার আগে আলো কমিয়ে দিল হারিকেনের। তারপর দ্বিজপদ সারের পিছনে প্রায় চোরের মতো হেঁটে যেতে থাকল। তার মনেই থাকল না, তুলি তার পুতুলের বিয়েতে খেতে বলেছে। বড়োলোকের মেয়ে তুলি, তার পুতুলের বিয়ে—সেখানে একমাত্র নিমন্ত্রিত অতিথি বোধহয় সেই ছিল। কারণ সকালে অরুর গালিগালাজে প্রায় ভূত ভেগে যাওয়ার মতো অবস্থা। তুমি কী অরুদা! ছোড়দি কত আশা নিয়ে বসেছিল, তোমাকে সে সামনে বসিয়ে লুচি পায়েস খাওয়াবে। তুমি পাত্তাই দিলে না। ভূঁইঞাকাকার সঙ্গে রান্নাবাড়িতে খেতে ঢুকে গেলে! তোমার কপালে অনেক দুঃখ আছে।

অরু খেপে গিয়ে বলল, আমার কপালে না তোর কপালে!

বারে, আমার কী দোষ!

হরিশবাবুকে ছোটোপিসির চিরকুট গোপনে পাচার করিস, ওটা বুঝি দোষ না।

তুমি অরুদা নিষ্ঠুর। জান, ছোটোপিসি বালবিধবা?

জানব না কেন? তাই বলে তোকে দিয়ে চিঠি পাচার করাবে! জানতে পারলে তোর কী হবে জানিস?

কী হবে?

অন্দর থেকে তোকে বাবুরা তাড়াবে।

জানবেই না, জানতে দেবই না। তুমি ছাড়া আর কেউ যে জানে না।

চিঠিতে কী লেখা থাকে জানিস?

হ্যাঁ, জানি।

বড়ো অকপটে তিথি স্বীকার করে ফেলল।

কী লেখা থাকে বলত! স্ব

প্নের কথা লেখা থাকে। জান স্বপ্নের কথা পড়তে নেই, পড়লে অভিশাপে পাথর হয়ে যেতে হয়। আমি পাথর হয়ে যাই, তুমি কি চাও?

তারপর তিথি আর দাঁড়াল না। সুপারি বাগান পার হয়ে নদীর চরায় কাশবনের ভিতর অদৃশ্য হয়ে গেল। কেন যে গেল! তিথি কী চায়! সে কিছুটা দৌড়ে গিয়েও ফিরে এল।

তার সাহস নেই। তিথির সঙ্গে নদীর চরে কাশের জঙ্গলে হারিয়ে গেলে বড়ো পাপ কাজ হবে। সে ধীরে ধীরে কাছারিবাড়িতে উঠে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *