বন্য ও বন্যা

বন্য ও বন্যা

স্নান করিতে যাইতেছিলাম। মাথায় একটা প্রচলিত ফুলেল তেল মাখি। শিশির ছিপিটা খুলিয়া একটা ঝাঁকানি দিয়া বাঁ হাতে ঢালিতে যাইব, আন্দাজের অতিরিক্ত খানিকটা হড়হড় করিয়া হাতের তেলোয় পড়িয়া গেল। লক্ষ্য করিয়া দেখি, লাল ঘন তেলটায় ফিকে রঙের চাকা চাকা দাগ, এদিকে অন্য দিনের চেয়েও হাতে যেন বেশি ঠাণ্ডা বলিয়া বোধ হইতেছে। অত্যন্ত আশ্চর্য বলিয়া বোধ হইল। তেল বাহির করিয়া লইয়া কেহ জল ঢালিয়া রাখিয়াছে নাকি?

শিশিটা তুলিয়া ধরিয়া দেখি, যাহা ভাবিয়াছি ঠিক তাহাই। একটু-আধটু নয়, প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ। কাল কিনিয়াছি শিশিটা, একদিনের খরচে সামান্য একটু খালি হইয়াছিল, প্রায় ধর্তব্যের মধ্যেই নয়; আজ দেখিতেছি, প্রায় অর্ধেকের কাছাকাছি সাবাড়! কাহার এ কীর্তি?

আমার ঘর বাড়ির বাহিরে, অন্দর-বাড়ির কাহারও সঙ্গে সংস্রব নাই। ছেলেমেয়েরা মাঝে মাঝে দৌরাত্ম্য করে, বিশেষ করিয়া ছবি। কিন্তু মাথার তেল লইতে সাহস ও করিবে না, প্রয়োজনও নাই। তবু দলটিকে ডাকিয়া পাঠাইলাম। কেহ জামার ছেঁড়াটুকু ঢাকিবার চেষ্টা করিয়া, কেহ যুটে পেয়ারাসুদ্ধ হাতটা হাফপ্যান্টের পকেটে সাঁধ করাইয়া, কেহ চুন-হলুদ- লাগানো মচকানো পায়ে না খোঁড়াইবার প্রাণপণ চেষ্টা করিতে করিতে ঘরের সামনে আসিয়া জড়ো হইল। আমার কাছে ডাক পাড়িবার মত সবারই কিছু না কিছু একটা খুঁত আছেই বলিয়া, সবারই সবার পিছনে দাঁড়াইবার জন্য একটু ঠেলাঠেলি—অবশ্য বিচারকের দৃষ্টি এড়াইবার চেষ্টা করিয়া।

তেলের শিশিটা সামনে তুলিয়া ধরিয়া প্রশ্ন করিলাম, কার কাজ এ? সত্যি কথা বলবে।

গোপালের বুকের বাঁ দিকটা কি করিয়া ছড়িয়া গিয়াছে, বোতামহীন কামিজে সেখানটা ঢাকিবার চেষ্টা করিতে করিতে ঠেলিয়া আসিয়া বলিল, আমি করেছি মেজকা, আর এর জন্যে দুঃখিত।

ওটা ধূর্তের শিরোমণি। বালক জর্জ ওয়াশিংটনের সত্যবাদিতার গল্প শোনা পর্যন্ত সব ব্যাপারেই এই বাঁধা গৎ আওড়াইয়া গোড়াতেই হাঙ্গামা মিটাইয়া রাখিবার চেষ্টা করিতেছে। ভাষাটিও ব্যবহার করে সাজানো, যেমন গল্প শুনিয়াছে।

জিজ্ঞাসা করিলাম, কি করেছিস?

গোপাল থতমত খাইয়া শিশিটার দিকে একটু হাঁ করিয়া চাহিয়া থাকিয়া পিছু হটিতে হটিতে ভিড়ে ঢুকিয়া পড়িল।

সকলকে অপরাধটা বুঝাইয়া দিলাম। বলিলাম, এই শিশিটার মধ্যে অর্ধেক তেল, অর্ধেক জল—তোমরাই কেউ করেছ এই কাণ্ডটি!

একটু মিথ্যা রচনা করিয়া বলিলাম, ছবি, ঠিক তোমার কাজ এ, তখন খেলাঘরের মাছ ভাজবার জন্যে ‘তেল নিয়ে আয়, তেল নিয়ে আয়’ করে চেঁচাচ্ছিলে।

ছবি আলাদা দাঁড়াইয়া ছিল, ভয়-করাদের দলে ওর জায়গা নয়। বলিল, বয়ে গেছে তোমার তেল নিতে আমার!

গটগট করিয়া চলিয়া গেল এবং নেবুতলা হইতে মাটির খুরি আনিয়া আমার সামনে বসাইয়া দিয়া বলিল, বয়ে গেছে তোমার তেল নিতে! এই দেখ!

সত্যই দেখি, খুব পাতলা করিয়া একখুরি গোবর-গোলা। অমন সঙ্গতিপন্ন গৃহিণীকে চুরির অপবাদ দিয়া একটু অপ্রতিভ হইয়া পড়িলাম।

মন্টু বছর আষ্টেক যাইতে না যাইতে চশমা ধরিয়াছে, অল্পভাষী এবং গলার স্বরটাও গম্ভীর। সেইজন্য বাড়িতে তাহাকে প্রফেসার বলিয়া ডাকা হয়। ছবি ভয়ের আবহাওয়াটা কতকটা নষ্ট করিয়া দেওয়ায় সাহস পাইয়া বলিল, আর মাথায় মাখবার তেলে তো মাছ ভাজা হয়ও না।

গোপালও আগাইয়া আসিয়া কি একটা বলিতে যাইতেছিল; এই রকম অপ্রিয় সত্য কিছু একটা হইতে পারে আশঙ্কা করিয়া বলিলাম, যা বেরো সব; খবরদার, কখনও দেখেছি আমার তেলে হাত দিতে তো—

শিশির জলীয় অংশটা সন্তর্পণে ফেলিয়া দিয়া, সাবানের বাক্সটা তুলিতে হাতে যেন বেশি রকম হালকা ঠেকিল। ডালা খুলিয়া অভ্যন্তরস্থ সাবান দেখিয়া অপলক দৃষ্টিতে চাহিয়া থাকিতে হইল। বোধ হয় আধখানাও সাবান না। সোজা কাটিয়া লওয়া নয়; কে সূক্ষ্ম নিপুণতার সহিত চারিদিক হইতে ছুরি দিয়া চাঁচিয়া চাঁচিয়া সাবানটাকে নিঃশেষ করিয়া আনিয়াছে। ওজন কমিয়াছে, কিন্তু আকৃতি হুবহু সেই রকম আছে।

কে এ যাদুকর?

নাওয়া মাথায় উঠিল। ইজিচেয়ারটায় গা ঢালিয়া দিয়া চিন্তা করিতে লাগিলাম। নানা দিক দিয়া চিন্তা করিয়া দেখিলাম, জানাজানি হইলে চোর সাবধান হইয়া যাইবে। আবার ছেলেমেয়েগুলোকে ডাকিয়া পাঠাইলাম। ছবিকে পুরোবর্তিনী করিয়া সবই আসিয়া দাঁড়াইল। বলিলাম, আমি যে তেল চুরির কথা টের পেয়েছি, চাকর-বাকরদের বলবি নি, বুঝলি?

সবাই ঘাড় নাড়িয়া জানাইল, বুঝিয়াছি।

আমার চোখের আড়াল হইতে না-হইতেই উহাদের মধ্যে একটা যেন হুড়াহুড়ি পড়িয়া গেল। নিজের ভুলটা বুঝিতে পারিলাম, ওদের বারণ করাটা ঠিক হয় নাই—কে কোন্ চাকরকে আগে সংবাদটা দিবে, সেই লইয়া চঞ্চলতা রেষারেষি পড়িয়া গিয়াছে। আবার ডাকিলাম।

চাকরদের ডাকাডাকি খোঁজাখুঁজি করতে লেগেছিলি কেন?

সকলে পরস্পরের মুখ-চাওয়াচাওয়ি করিল। পাপড়ি নিজের অন্তরের ইচ্ছা এবং আমার বারণের মধ্যে গোলমাল করিয়া ফেলিয়া বলিল, বলব না বলে।

সকলের মুখের উপর একবার চোখ বুলাইয়া—উগ্ৰ চোখ বুলাইয়া বলিলাম, এই শুনে রাখ, কোনও চাকর যদি টের পায়, কার কাছে টের পেয়েছে জিজ্ঞেস করে নিয়ে তার পিঠে ওই আস্ত বেতটা ভাঙব।

বাড়ির অন্য কেহ টের পাইলেই বা লাভ কি? শুধু গঞ্জনা অথবা বিদ্রূপ। বলিলাম, শুধু চাকর নয়, অন্য কেউও টের পাবে না।

এত বড় একটা সংবাদ একেবারেই কাহাকেও না জানাইতে পারার যন্ত্রণার কথা ভাবিয়া সকলে মুহ্যমান হইয়া আর একবার পরস্পরের মুখ-চাওয়া-চাওয়ি করিল। গোপলা আর মনের ভাবটা চাপিতে পারিল না, স্খলিতকণ্ঠে প্রশ্ন করিল, তা হলেও ওই ব্যবস্থা?

বলিলাম, ঠিক ওই ব্যবস্থা।

সকলে একবার আড়চোখে আমার বেড়াইবার ছড়িটার পানে চাহিয়া ভগ্নোৎসাহ হইয়া ধীরে ধীরে চলিয়া গেল।

.

তক্কে তক্কে রহিলাম এবং সত্য কথা বলিতে বি, অবশিষ্ট তেল এবং সাবানটুকু ভোগে লাগিল।

কিন্তু একটা জিনিস লক্ষ্য করিতেছি, ঘরে যেন সময়মত ঝাঁট পড়ে না, আসবাবপত্র ঝাড়াঝোড়া হয় না, এমন কি রাত্রে শুইতে যাইবার সময় রোজই দেখি, বিছানাটা গোটানো। ঘুমের চোখে তাড়াতাড়ি টানিয়া ফেলিয়া কোন রকমে শুইয়া পড়ি। মনে করি সকালে উঠিয়া তুলিব কথাটা, আবার ভুলিয়া যাই।

প্রায় পাঁচ-ছয় দিন দুর্ভোগের পর আহারের সময়ে একদিন চাকরদের প্রসঙ্গ উঠায় কথাটা মনে পড়িয়া গেল। বলিলাম, আর আমার ঘরেরও তো দুর্দশা করে রেখেছে, বাসদেওয়াটা কটা দিনের ছুটি নিয়েছে, এরা না দেয় ঘর ঝাঁট, না পাতে বিছানা।

মা বলিলেন, তোর ঘর থেকে জিনিসপত্র চুরি যায় বলে যখন তখন ঘরে ঢুকতে ওদের বারণ করে দিয়াছিলাম, তা বলে—

আমি অতিমাত্র বিস্মিত হইয়া প্রশ্ন করিলাম, জিনিসপত্র চুরি হয়েছে তোমায় কে বললে?

মা যেন একটু থতমত খাইয়া গেলেন। আমার ভগ্নী বলিল, ওমা, তোমার ঘর থেকে তেল চুরি করে শিশিতে জল ঢেলে রেখেছিল, এ কথা পাড়ায় কার অজানা আছে? বেহুঁশ অসাবধানী বলে তো তোমার বদনাম রটে গেছে সমস্ত পাড়াটায়।

সামনে গোপাল যাইতেছিল, ডাক দিলাম, গোপলা, এদিকে আয়।

মা বলিলেন, থাক বাপু, এ নিয়ে আর মারধোর করে না। আর, মারবিই বা কাকে? ও কি একা বলেছে? যাদের বারণ করেছিলি, সবাই এক এক করে এসে চুপিচুপি আমায় বলে গেছে, আর তোকে বলতে বারণ করে গেছে। আহা, ওরা কি পেটে কথা রাখতে পারে! সে চোরের মত চারিদিকে চাইতে চাইতে এসে বলার যদি ধরন দেখতিস!

মা হাসিতে লাগিলেন।

একটু পরে বলিলেন, আর একটু চোখ চেয়ে থাকিস। এত চুরিই বা যায় কেন জিনিস? যখন বাইরে যাবি, ঘরে চাবি দিয়ে গেলেই পারিস তো।

বলিলাম, আপিসে যাওয়ার সময় তো দিয়ে যাই চাবি। অন্য সময় দিই না, তার মানে বাসদেওয়া ছোঁড়াটা থাকে—

মা একটু ঝাঁজিয়াই বলিলেন, মস্তবড় সাধুপুরুষ, ও তো চুরি করতে জানে না! ও ওই ছোঁড়াটার ওপর অতি বিশ্বাসেই তোকে একদিন ভাল করে পস্তাতে হবে; ছোটলোক ওরা, ওদের হাতে যথাসর্বস্ব কখনও ছেড়ে দেয় অমন করে মানুষে?

হাত থামাইয়া বলিলাম, মা, লোক আমিও একটু-আধটু চিনি। ও ছোঁড়াটার আর সব দোষই আছে, কিন্তু চোর নয়। আজ দু বছর থেকে বাইরের সব পাট ওই করছে, কিন্তু আমার কথা ছেড়ে দাও, কেউ বলুক যে, কারুর কিছু একটা চুরি গেছে—একটা কানা কড়ি! আর তেলের কথা বলছ, ও চুরি করেও যদি একটু-আধটু তেল কখনও গায়ে মাথায় মাখে তো সে আমার ভাগ্যি বলেই মনে করব মা।

কেন যে মনে করিব ভাগ্য বলিয়া, তাহা বলিতেছি।

অত্যন্ত নোংরা ছোঁড়াটা। বছরে মাত্র চারিটা দিন স্নান করে, নন্দমহারাজের মেলার দিন, তিলাসরক্রাৎ অর্থাৎ পৌষ-পার্বণের আগের দিন, ছট অর্থাৎ কার্তিক মাসের ষষ্ঠীর দিন, আর হোলির দিন মেলা রঙ গোবর কাদামাটি মাখার পর বাধ্য হইয়া। এর অতিরিক্ত আমি দুই-একবার অন্য চাকরদের দিয়া জবরদস্তি স্নান করাইয়াছি, কিন্তু অভ্যাসের অভাবে জ্বরে পড়িয়া আমার কাজের ক্ষতি করে বলিয়া ছাড়িয়া দিয়াছি।

পরিষ্কার কাপড়-চোপড় দিয়া দেখিয়াছি, ওর গায়ে উঠিলে, চুম্বকে যেমন লোহা টানে, ঠিক সেইভাবে চারিদিককার ময়লা টানিতে থাকে। এদিক দিয়াও হাল ছাড়িয়া দিয়াছি।

বাদশা-কুঁড়ে। আমার ঘরের সামনে বারান্দাটিতে বসিয়া থাকে এবং একটা কিছু ফরমাশ করিলেই প্রথমে আকাশ-পাতাল হাঁ করিয়া আড়মোড়া ভাঙিয়া লয়, তাহাতে সঙ্গে সঙ্গে ওর চোখে জল বাহির হইয়া আসে। খোকা ডাক্তার বলে, ওটা ঠিক ক্রন্দনের অশ্রু নয়। কি একটা গ্রন্থির ডাক্তারি নাম করিয়া বলে, সেইটাতে অত্যধিক চাপ লাগিয়া অনেকের অহেতুক ভাবেই ওই রকম হয়। সজল নয়নে বাসদেওয়া উঠিয়া আসে এবং ফরমাশটা শুনিয়া চোখ মুছিতে মুছিতে তামিল করিতে যায়। অধিকাংশ সময়েই কাজটা পণ্ড করিয়া বসে।

তবু রাখিয়াছি—চুরি কাহাকে বলে জানে না। বাসদেওয়ার পূর্বে পাঁচটি চাকরের হাতে কিছু নয় তো গোটা পঞ্চাশ টাকার জিনিস খোয়াইয়া ছোঁড়াটাকে রাখিয়াছি। আজ প্রায় দুই বৎসর আছে, নানাভাবে পরীক্ষা করিয়াছি—জামাকাপড়ের বাক্স খুলিয়া রাখিয়া, টেবিলে খোলা মানিব্যাগ ভুলিয়া গিয়া, শৌখিন জিনিসপত্রের উপর দিয়াও হইয়াছে যাচাই, আংটি, সোনার বোতাম, ওর বয়সের ছেলেকে লুব্ধ করে এই রকম ধরনের খেলনা-জাতীয় কয়েকটা জিনিসও বাড়ি হইতে আনিয়া ফেলিয়া ছড়াইয়া রাখিয়াছি, চুরি দূরের কথা, একটু ঠাঁই নাড়াও হয় না। তৃণবৎ পরিহার করিয়া গিয়াছে। চাকরের মধ্যে এরূপ অদ্ভুত বৈরাগ্য আমি দেখি নাই।

সবাই বলে, এটাও ওর আলস্যেরই একটা দিক,—ও চুরি করার হাঙ্গামাও পোহাইতে চায় না।

যাক, সেসব তর্কের কথা তুলিতে চাই না। মোট কথা, বাসদেওয়া চুরি করে নাই, করিবেও না কখনও, বৈরাগ্যই হউক বা আলস্যেই হউক।

কিন্তু কথা হইতেছে, চাকর যাহার উপর এতটা নির্ভর করিতে হয়, এত উগ্ররকম সাধু না হইয়া মাঝে মাঝে মাথার তেলটা-আসটা সরাইয়া একটু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হইবার চেষ্টা করে, বেশ একটু স্মার্ট হয়, সেটা কি বাঞ্ছনীয় নয়, একটা সৌভাগ্য নয়? সে তো চুরি করিতেছে না, আমার জিনিস লইয়া নিজেকে আরও ভাল ভাবে আমারই সেবার উপযোগী করিতেছে! সেটা সে নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করিয়া করিবে, এটা আশা করি কোন বিবেচনায়?

মাকে সে কথাই বলিবার উদ্দেশ্য আমার।

.

চুরি না করিলেও অন্য চাকরদের সঙ্গে ও ছোঁড়াটাকেও বেশ রাগ করিয়া একচোট ধমকাইয়া দিলাম। ঘরের চার্জ যখন ওরই উপর তখন জবাবদিহিটা ওরই তো?

কাঁদিতে লাগিল; হাই তোলার সজলতা নয়, খাঁটি কান্না। কষ্ট হইল ময়লা, হাঁদাগোবিন্দ-গোছের মানুষটা, ওর পশুর মত নিরীহ নির্বিকার মনের কোথায় যে চোট লাগিয়াছে! বড় কষ্ট হইল। সত্যই তো, ও ফুলেল তেল লইয়া কি করিবে? মাথার মাঝখানে একগোছা জট-পড়া টিকি, তেলের সাধ্য নাই তাহার অন্দরমহলে প্রবেশ করে। বাকিটায় তেলের প্রয়োজন নাই, মই দেওয়া মাঠের মত পরিষ্কার। বাসদেওয়ার মাথায় কখনও চুলের বালাই দেখিলাম না; একটু কালচে হইয়া আসে মাথাটা, অমনই কেহ মরিয়া বসে, আত্মীয়ই হোক কিংবা গ্রাম-সম্পর্কেরই কেহ হোক; আবার মাথাটি যে-কে সেই। কাঁধের উপর যাহার এই রকম একটা অভিশপ্ত মস্তক, সে তেল চুরি করিবে কিসের জন্য? রাখিবে কোথায়?

আরও একটা কথা। চুরি যেদিন হয়, বাসদেওয়া সেদিন ছিল না। তাহার আগের দিনই বিকাল হইতে ছুটি লইয়া কোথায় গিয়াছিল। ধমক দিবার জন্য যখন ডাকিলাম, হাই তুলিয়া সজল চোখে আসিয়া দাঁড়াইল। ধমক খাইয়া একটি কথা বলিল না, নিস্পন্দ ভাবে গালমন্দগুলা বোবার মত শুনিয়া গেল। নিরীহ বোকা মানুষ যেমন চাহিয়া থাকে, সেই রকম অপলক বিহ্বল দৃষ্টি, দরবিগলিত জল গড়াইয়া পড়িতেছে। খোকা তাহার হৃদয়হীন ডাক্তারি ভাষায় যাহাই বলুক, কষ্ট হয় অত চোখের জল দেখিলে।

কয়েক দিন গেল। তেল-সাবানের কথা ভুলিয়া গিয়াছি। বৈচিত্র্যহীন জীবন আবার নিজের বাঁধাপথে চলিতেছে। আমি ঘরে বসিয়া লিখি, বাসদেওয়া বারান্দায় ঠিক সামনেটিতে বসিয়া ঢুলিতে থাকে। অভাব কম, প্রত্যেক জিনিসই হাতের কাছে, ওকে ডাকিবার বড় একটা দরকার হয় না। কালেভদ্রে ডাক পড়িলে হাই তুলিতে তুলিতে উঠিয়া কাজটা পশু করিয়া দেয়। একটু বৈচিত্র্য আসে—একটু বিরক্তি, বকাবকি! তাহার পর আবার পূর্ববৎ।

ইহার মধ্যে হঠাৎ একদিন বৈচিত্র্য বড় ঘোরালো হইয়া উঠিল। সকালবেলা মুখ ধুইতে যাইব, দেখি মাজনের টিউবটা নাই। বাসদেওয়া তখনও তাহার বাড়ি হইতে আসে নাই, অন্যান্য চাকরদের জিজ্ঞাসা করিলাম, সকলে গঙ্গামুখো হইয়া দুইহাত উঁচাইয়া শপথ করিল, তাহারা গত দুই দিন যাবৎ আমার ঘরের মধ্যে যায় নাই, এ ব্যাপারে বিন্দুবিসর্গ কিছু জানে না। গঙ্গা লইয়া শপথ না করিলেও অবিশ্বাসের কথা বড় একটা, দাঁতের মাজন লইয়া করিবেই বা কি উহারা? আনকোরা নূতন টিউব হইলেও না হয় বুঝিতাম, বিক্রয় করিয়া দুইটা পয়সা হাতে আসিবে; প্রায় অর্ধেকের কাছাকাছি খালি তোবড়ানো একটা টিউব। মাথা যেন গুলাইয়া আসিতে লাগিল। এ যে ডাহা আরব্য উপন্যাসের কাণ্ড দেখিতেছি!

কিন্তু তখনও অনেক বাকি।

কয়েকটা প্রয়োজনে অফিস হইতে টাইপ-রাইটারটা কয়েকদিন হইল বাড়িতে আনিয়া রাখিয়াছি। মাজনের শোকটা কিছু শমিত হইলে একটা চিঠি টাইপ করিতে যাইব, চক্ষু একেবারে চড়কগাছ! স্থূলসুদ্ধ সমস্ত ফিতা একেবারে লোপাট! কালই নূতন স্থূল কিনিয়া আনিয়াছি।

কিন্তু এত দুঃখের মধ্যেও একটা উল্লাস অনুভব করিলাম। চকিত বিদ্যুতালোকে হঠাৎ পথ দেখিতে পাইলে দুর্যোগঘন অন্ধকারে যেমন একটা আনন্দ হয়, অনেকটা সেই রকম। ফিতা যাক, কিন্তু চোর ধরা পড়িয়াছে।

বাড়ির মধ্যে গিয়া বলিলাম, রেবিয়া কোথায়?

গলার স্বর এবং মুখের ভাব দেখিয়া একটা গুরুতর কিছুর প্রত্যাশায় ছেলেমেয়েগুলো আসিয়া ঘিরিয়া দাঁড়াইল। একজন গিয়া রেবিয়াকে ডাকিয়া আনিল। মা প্রভৃতি অন্যান্য দুই- একজন আসিয়া উপস্থিত হইলেন। মা জিজ্ঞাসা করিলেন, হঠাৎ রেবিয়াকে?

সংক্ষেপে বলিলাম, কিনারা হয়েছে।

রেবিয়া আসিয়া উপস্থিত হইল। ছুঁড়ীটার বয়স আন্দাজ নয় বৎসর হইবে। রোগা ডিগডিগে, মিশকালো, ঢেঙা; ছোট খোকাটাকে ধরিবার জন্য মাস দুয়েক হইল রাখা হইয়াছে। পাড়াগাঁ হইতে আসিয়াছে, কিন্তু লক্ষ্য করিতেছি, বাঙালি-বাড়ির ভাত পেটে পড়িয়া মেয়েটা তরতর করিয়া শৌখিন হইয়া উঠিতছে। তেল, সাবান ফিতা—সব ওরই কাণ্ড। সাবান আর ফিতার কথাটা আর তুলিলাম না, বলিলাম, কেউ একবার দেখ তো শুঁকে, ও বেটীর মাথার কিসের গন্ধ!

বড়দের মধ্যে কেহ রাজী হইল না। মা বলিলেন, রক্ষে কর, এইখান থেকেই টেকা যাচ্ছে না, মাথার কাছে নাক নিয়ে গেলে অন্নপ্রাশনের ভাত উঠে আসবে। কেন, কি ব্যাপার?

বলিলাম, ও-ই তেল চুরি করেছে আমার।

মা বিস্মিত দৃষ্টিতে রেবিয়ার পানে চাহিয়া প্রশ্ন করিলেন, কি রে রেবিয়া?

রেবিয়া আকাশ হইতে পড়িল একেবারে। এখানকার নিম্নশ্রেণীর মেয়েদের সম্বন্ধে মার অভিজ্ঞতা খুব নিবিড়। বলিলেন, তা হলে তুই নিশ্চয়ই নিয়েছিস; তোদের পদ্ধতিই হচ্ছে—যে যত চোর, সে তত বোকা সাজবে।

আমায় প্রশ্ন করিলেন, আরও কিছু গেছে চুরি?

অগোছালো অসাবধান বলিয়া একটা বদনাম আছে, সম্প্রতি বাড়িয়াছেও; চোরাই মাল বাহির হইবে কি না ঠিক নাই, মিছামিছি বাড়াই কেন বদনামটা? বলিলাম, রামঃ, করলেই হল চুরি? সে কি রকম ফাঁকতালে খানিকটা তেল সরিয়ে ফেলেছিল। না, তাই বলতে এসেছিলাম, ও হারামজাদী ভাববে, দিব্যি চোখে ধুলো দিয়ে সরিয়ে ফেললাম, বাবুরা জানতেও পারলে না। খবরদার, খোকাকে নিয়ে যাবার ছুতো করে যদি কখনও আবার ঢুকেছিস আমার ঘরে–

মেয়েটা ফ্যালফ্যাল করিয়া চাহিয়া ছিল, হঠাৎ ময়লা আঁচলটা তুলিয়া লইয়া ভ্যাক করিয়া কাঁদিয়া ফেলিল। মাকে বলিলাম, দেখলে তো? সমস্তঢঙটি শিখেছে। পাকা হয়ে উঠেছে হারামজাদী। তোমরা বাড়ির মধ্যে সবাই যে রকম অসাবধান, আমি না বলে দিলে টেরই পেতে না বাড়ির মধ্যে একটা চোর গজিয়ে উঠছে। সরাও বেটীকে।

সরাইতে হইল না। তাহার পরের দিন টের পাওয়া গেল, রাত থাকিতেই উঠিয়া নিজের কাপড়-চোপড় লইয়া রেবিয়া সরিয়া পড়িয়াছে। বাড়িতে খুব একচোট খোঁজ খোঁজ পড়িয়া গেল। নিত্যব্যবহার্য থালা-ঘটি জামা-কাপড় সব জড়ো করিয়া মিলাইয়া লওয়া হইল। সব মিলিয়া গেল। মা বলিলেন, বোধ হয় ছিল না চোর মেয়েটা রে, মিছিমিছি গঞ্জনা খেয়ে গেল।

হাসিয়া বলিলাম, বয়ে গেছে ওর থালা-ঘটির বোঝা বইতে। মেয়েদের তেল সাবান, মাথার ফিতে, আলতা, চিরুনি সব ঠিক আছে কি না দেখতে বল তো!

সবাই খোঁজ করিয়া আসিয়া বলিল, সব ঠিকই আছে।

একটু অপ্রতিভ হইলাম। সামলাইয়া মার দিকে চাহিয়া আবার হাসিয়া বলিলাম, তা তো থাকবেই, চুরি গেলে তোমরা সত্যি কথা বলবার পাত্র কিনা।

.

যাহা হউক, কিছু যে লইয়া যায় নাই—এ সামান্য কথাটা কেহ মনে করিয়া রাখিল না। চোর যে আমার চোখে ধুলা দিতে পারে নাই, ধরা পড়িয়াছিল এবং বেগতিক দেখিয়া পিটটান দিয়াছে—এই কথাটাই টিকিয়া গেল। বরাতে একটু গোয়েন্দাগিরি যশ লেখা ছিল আর কি।

দিন দশেক পরের কথা। কয়দিন হইতে মনটা বেশ প্রসন্ন আছে। না থাকাই আশ্চর্য। মাথায় খাঁটি তেল মাখিতেছি, যতটা সাবানের দাম দিয়াছি, নিজের গায়েই উঠিতেছে, সুগন্ধি কলিনস টুথ-পেস্টও অন্য কাহারও দন্তপংক্তিতে হাস্য ফুটাইতেছে না। আরও একটা কারণ এই যে, বাসদেওয়ার উপর হইতে নিজের এবং অন্য সকলের সন্দেহ বিদূরিত করিতে সমর্থ হইয়াছি। ছোঁড়াটা সম্বন্ধে আমার একটা দুর্বলতা আছে, একটা নিরীহ মানুষের অপবাদ হইতেছিল বলিয়া আমি মনে মনে একটু ক্লিষ্ট ছিলাম। এক সময় যে বকিয়াছিলাম, অযথাই তাহার গ্লানিটা মিটাইয়া দিবার জন্য আজকাল একটু মাঝে মাঝে কারণে অকারণে ডাকিয়া দুইটা কথা কই। চোখে জল গড়াইতে থাকে, কষ্ট হয় দোষ চাপানো দেখিলে।

তাহার পর আবার একদিন স্নানের জন্য তেল লইতে যাইব, তেল নাই। এবার আবার শিশি পর্যন্ত নাই। কাগজের ঠোঙাটা খালি পড়িয়া আছে। সাবানের ডিবাও শূন্যগর্ভ। চিরুনি নাই। বাসদেওয়াকে ডাক দিলাম। বারান্দায় বসিয়া ছিল, আড়মোড়া ভাঙিতে ভাঙিতে উঠিয়া আসিল। অত্যন্ত রাগ হইল, ইচ্ছা হইল ধরিয়া আপাদমস্তক চাবকাইয়া দিই। অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করিয়া স্থির কণ্ঠে বলিলাম, আবার আমার তেল সাবান চুরি গেছে, চিরুনি পর্যন্ত। তোর কাজ। আর তো রেবিয়া নেই যে, তার ঘাড়ে দোষ চাপানো চলবে।

চোখে জল জমিয়াই ছিল, একটা হাই তুলিতে গিয়া ঝরঝর করিয়া ঝরিয়া পড়িল। গলায় আরও একটু দমকের রুক্ষতা ফুটাইয়া বলিলাম, চুপ করে রইলি যে? উত্তর দে?

উত্তর কিছুই দিল না, বেত্রাহত অবোধ পশুর মত দীন নয়নে মুখের পানে ফ্যালফ্যাল করিয়া চাহিয়া রহিল। অতখানি উপচাইয়া পড়িবার পরও জল ছলছল করিতেছে চোখে নূতন ক্ষতির জ্বালা সত্ত্বেও মনটা কেমন যেন মোচড় দিয়া উঠে, সন্দেহ হয়, খোকা যা বলে সত্যই কি তাই? এতখানি জল একটা শিরার উপর চাপের পরিমাণ মাত্র? না, নিরীহের

একমাত্র সম্বল ব্যথার অশ্রু?

কিছু বলি না, ভাবি, দেখাই যাক না আরও দুই-একটা দিন।

অত অপেক্ষা করিতে হয় না। দরজী আসিয়া উপস্থিত হয়। ডাকিয়া পাঠাইয়াছিলাম, দুয়ারের জন্য পর্দা কিনিয়া আনিয়াছি, সেলাই করিয়া তাহাতে রিং ফিট করিয়া দিতে হইবে। রুলির আকারে পাঁচটা গিল্টি করা পিতলের রিং কিনিয়া আনিয়াছি।

কাপড় মাপিয়া বুঝাইয়া দিলাম, রিং দিতে যাইব, রিং নাই।

বাসদেওয়াকে ডাকিলাম না; কি রকম একটা অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়িয়াছি, না ডাকা পর্যন্ত রাগ থাকিবে, সামনে আসিলেই মমতা আসিবে। আরও দুই-চারি দিন পর্যবেক্ষণ করিয়া সন্দেহটা—

একটু যেন এখানে ওখানে খুঁজিবার চেষ্টা করিয়, সহসা দাঁড়াইয়া পড়িয়া দরজীটাকে বলিলাম, ও, আনাই হয়নি যে কিনে রিংগুলো! এতক্ষণে মনে পড়েছে। তুই এখন যা, বিকেলে একবার আসিস।

আহার করিবার সময় মা বলিলেন, তুই যেন কি একটা ভাবছিস, ব্যাপার কি বল্ তো?

ভাবিতেছিলাম, শৌখিন দাঁতের মাজনও নেয়, টাইপ-রাইটারের ফিতাও নেয়, আবার পর্দার রিংও নেয়, এমন অভিনব চোরের উদ্ভব হইল কোথা হইতে?

কিন্তু গোয়েন্দাগিরির জন্য একবার যশ লইয়াছি, এই নূতনতর অভিজ্ঞতার কথা আর মুখ ফুটিয়া বাহির করিতে পারিলাম না।

অফিসের প্যান্ট শার্ট পরিয়া টাই পরিতে গিয়া দেখি, বিলাতী সোনার টাইপিনটা নাই।

রাগের চোটে বোধ হয় পূর্ব সংকল্প ভুলিয়া বাসদেওয়াকে ডাক দিয়া ফেলিতাম, অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করিয়া লইয়া তাড়াতাড়ি অফিসে চলিয়া গেলাম।

সেখানে গিয়া একটু পরে মাথাটা ঠাণ্ডা হইলে ভাবিয়া দেখিলাম, কি অন্যায় কাজটাই না করিতে যাইতেছিলাম! মেজাজের যেরকম অবস্থা দাঁড়াইয়াছিল, যদি সামনে আসিয়া দাঁড়াইত বাসদেওয়া তো ওকে আর আস্ত রাখিতাম না। অথচ নেহাত সর্বদা সামনে থাকার দরুন সব চেয়ে বেশি সন্দেহভাজন হইয়া পড়িলেও ওর আসল দোষটা কি? এসব শৌখিন জিনিস লইয়া ও করিবে কি? বিক্রয় করিয়া পয়সা করিবে? তাহা হইলে রিস্টওয়াচ, কলম—এইগুলোর তো আগে যাইবার কথা!

সুস্থিরভাবে ভাবিয়া দেখিতে গিয়া আরও একটা কথা মনে পড়িল, খুব সঙ্গত একটা কথা। হাতের কাছে পাইয়া এই ছোঁড়াটার উপরই সব সন্দেহ ক্ৰমে কেন্দ্রীভূত হইয়া পড়িতেছে বলিয়াই বোধ হয় আসল অপরাধী চোখে ধূলা দেওয়ার আরও সুযোগ পাইতেছে। যতই ভাবিতে লাগিলাম, ততই কথাটার যৌক্তিকতা স্পষ্ট হইয়া উঠিতে লাগিল। আমি নূতন পদ্ধতি অবলম্বন করিলাম। কয়েক রকম কেশতৈল, দুই-তিন বাক্স সাবান, আরও কয়েকটা শৌখিন দ্রব্য কিনিয়া কোনটা টেবিলে, কোনটা আলমারির মাথায়, কোনটা কুলুঙ্গিতে, কোনটা বা ঘড়ির ব্রাকেটে রাখিয়া দিলাম একটু হেলাফেলা করিয়া –চার ছড়াইয়া রাখার মত আর কি!

কর্মস্থানে যাইবার সময় ঘরে আর চাবি দিয়া গেলাম না, বাসদেওয়াকে বলিলাম, একটু নজর রাখিস, তবে ঠিক পাহারা-দেওয়ার গোছের নয়। গোয়েন্দাগিরিতে তাহাকে ও দলে টানিলাম।

তাহার পর বাহ্যিক উদাসীনতার সঙ্গে ভিতরে ভিতরে ইস্তক বুড়ি দাসীটার গতিবিধির উপর পর্যন্ত সতর্ক নজর রাখিতে লাগিলাম। বাসদেওয়াকে বলিলাম, যে কেউ এসে ঘোরাফেরা করুক না কেন, একটু আড়ালে সরে গিয়ে নজর রাখবি।

ফল পাওয়া গেল নিতান্ত অদ্ভুত এবং অপ্রত্যাশিত ভাবে।

একদিন সকল সকাল কর্মস্থান হইতে ফিরিতেছি, দেখি ঝি মাগী আমার ঘরের বারান্দা হইতে নামিয়া হনহন করিয়া অন্দর-বাড়ির দিকে যাইতেছে। ঘরে তালা দিয়া তো যাইই নাই, আজ হঠাৎ অতর্কিতে আসিয়া পড়িব ঠিক ছিল বলিয়া শিকলও দিয়া যাই নাই, হাট আদুড় হইয়া আছে। অন্যান্য দিন বাসদেওয়া বারান্দার থামে ঠেস দিয়া ঢোলে, আজ সেও নাই।

অত্যন্ত কৌতূহল হইল। ঝিয়ের মুখটা পাশ হইতে যতটুকু লক্ষ্য করিতে পারিলাম, খুব প্রসন্ন যেন।

নিষুতি দুপুরবেলা, বাসদেওয়া পর্যন্ত নাই, ঝি আমার ঘরের দিক হইতে প্রসন্ন মনে তাড়াতাড়ি অন্দর-বাড়ির দিকে চলিয়াছে—ব্যাপারখানা কি? ঘরের দিকে না গিয়া বেশ দূর হইতে অলক্ষ্যে তাহার অনুসরণ করিলাম। পায়ে ক্রেপ-সোলের জুতাই ব্যবহার করিতেছি কয়দিন হইতে—এই কাজের জন্যই, অসুবিধা হইল না। ঝি স্ফূর্তির চোখে এত নিশ্চিন্ত যে একবার ঘুরিয়াও দেখিল না। অবশ্য আমি বেশ দূরেই ছিলাম।

বাড়ির ভিতরে যাইতে হইলে দুই দিকে দুইটা ঘর পড়ে, তাহার মাঝখান দিয়া একটা গলিগোছের, সেইটাই একটু বাঁকিয়া উঠানে গিয়া পড়িয়াছে। গলির মধ্যে পা দিতেই একটা উগ্র গন্ধ নাকে আসিয়া লাগিল যেন, নাকটা সতর্কই ছিল, দুইবার নিশ্বাস টানিতেই বুঝিলাম, আমার দাঁতের মাজন—কলিনস টুথপেস্টের ঝাঁজালো গন্ধ।

কি রকম একটা অদ্ভুত উল্লাস,—ধরিয়াছি! কেন জানি না, আপনিই পা দুইটা যেন একটু দাঁড়াইয়া পড়িল—বোধ হয় ‘অটোম্যাটিক অ্যাকশন’ অর্থাৎ স্বতঃস্ফূর্ত স্নায়বিক ক্রিয়া, যাহার বশে শিকারের ঘাড়ে ঝাঁপাইবার পূর্বে বাঘ হঠাৎ নিজেকে একটু গুটাইয়া লয়…মুহূর্ত মাত্র। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আরও জোরে পা চালাইয়া দিলাম।

তারপর গলির মোড়টা ঘুরিয়া উঠানে পড়িয়া একেবারে অপ্রস্তুত হইয়া পড়িলাম।

দেখি, মেয়েছেলেরা যে যেদিকে সুবিধা পাইতেছে ত্বরিত পদে সরিয়া পড়িতেছে। ব্যাপারটা কতকটা আন্দাজ করিলাম,—আমি মনে করিয়াছি, আমার অনুগমনটা ঝি টের পায় নাই, মেয়েছেলেদের যে পিছনেও দুইটা করিয়া চক্ষু থাকে, সেটা ভুলিয়া গিয়াছিলাম। টের পাইয়াছিল ঝি, আমি প্রবেশ করিবার পূর্বেই সকলকে চাপা গলায় বা ইশারায় জানাইয়া দিয়াছে। একটা কি জটলা হইতেছিল, হঠাৎ ভাঙিয়া গেল। কিন্তু ইহাতে আবার যে সব গুলাইয়া যায়। ঝি আমার ঘর হতে একটা কিছু চুরি করিয়া আনিতেছে—এ অনুমানটা মিথ্যা তাহা হইলে! অথচ গন্ধ স্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছে আরও, শুধু কলিনস দাঁতের মাজনের নয়, একবার কলিনসের, একবার আমার ফুলেল তেলের, একবার যেন আমার ব্যবহারের সাবানের এক-একবার সব মিশিয়া যাইতেছে—আমার ঘরে মাঝে মাঝে যেমন একটা মিশ্র গন্ধ উঠে।

কিন্তু লোক কোথায়? ঝি তো আমি প্রবেশ করিবার পূর্বেই বেমালুম সরিয়া পড়িয়াছে। খুব বেশি রকম অপ্রতিভ করিয়া দিয়াছে বলিয়া অত্যন্ত রাগ হইল, খুব কড়া গলায় ডাক দিলাম, বন্‌শীকে মায়!

আমার সামনেই, বারান্দার কোণের জোড়া থামটার ওদিকে ঠুং করিয়া একটু শব্দ হইল। অগ্রসর হইতেই একেবারে থ হইয়া দাঁড়াইয়া পড়িলাম।

একটি প্রায় বছর এগারোর মেয়ে ভয়ে জড়সড় হইয়া প্রায় থামের সঙ্গে মিশিয়া রহিয়াছে। ফুটফুটে মেয়েটি। মাথার ব্রহ্মতলে কলসীর কানার মত এদেশী খোঁপা, কপালের চুলগুলো কি একটা চটচটে মসলা মাখাইয়া উপর দিকে টানা, মাঝখানে একগাদা মেটে সিঁদুর, কপালের মাঝখানে খুব বড় একটি টিকলি, চোখে কাজল—কনে-বউ।

কনে-বউয়ের খোঁপায় আমার টাইপ-রাইটারের ফিতা, খোঁপার সামনে ঠিক মাঝখানটায় আমার চৌদ্দক্যারেট সোনার টাইপিনটা ঝিরঝির করিতেছে, গলার চুড়ির সঙ্গে এহাতে দুইটি ওহাতে দুইটি গিল্টি-করা পিতলের বালা—আমার পর্দার রিং, কোন ভুল নাই তাহাতে। সামনে আসিতে জবজবে করিয়া চোবানো মাথা হইতে আমার ফুলেল তেলের গন্ধ ভুরভুর করিয়া বাহির হইয়া আসিতেছে, আমার সাবানের গন্ধও পূর্বের চেয়ে স্পষ্ট। আমার দাঁতের মাজনের মিঠে গন্ধ, সেটা এত স্পষ্ট হয় কি করিয়া? কোন্ সেই সকালে দাঁত মাজিয়াছে।

নাকের খাঁজের কাছে একটা সাদা দাগ দেখিয়া ব্যাপারটার কিনারা হইল; আমার দাঁতের মাজনটার পদোন্নতি হইয়াছে, সেটা হইয়াছে ফেস-ক্রীম। সমস্ত মুখটা এই নবপ্রবর্তিত বদন-প্রসাধনে চর্চিত হইয়া যেন জ্বলজ্বল করিতেছে।

আমার ভগ্নী প্রথমে সাহস করিয়া উপর হইতে নামিয়া আসিল। বলিল, তোমার বাসদেওয়ার বউ, মেজদা। কি চমৎকারটি! নতুন বাপের বাড়ি থেকে এসেছে, বাসদেওয়া গওনা করে নিয়ে এসেছে।

সমস্ত শরীর পুড়িয়া অঙ্গার হইয়া যাইতেছিল। নিজেকে খুব সংযত করিয়া নীরবে দগ্ধ হইতে লাগিলাম।

অন্যান্য সকলেও ধীরে ধীরে আসিয়া উপস্থিত হইল। ছোট বোন বলিল, বাঁদরের গলায় মোতির মালা হয়েছে! পোড়াকপালীকে ওই বুনোর পাশে কেমন মানায় দেখবার জন্যে ঝিকে দিয়ে ডেকে পাঠিয়েছিলাম ছোঁড়াকে, তা কোনমতেই এল না, কোথায় যে গিয়ে লুকিয়েছে।

বড় বোন বলিল, তা হোক বুনো, কিন্তু যত্নআত্তি আছে বাপু, সুখে রাখবে। এরমধ্যেই মাথার জন্যে শৌখিন ফিতে কিনে দিয়েছে, নিজের হাতে গিল্টির বালা দিয়েছে, ব্যাভার জানুক না জানুক চমৎকার একটি সেফটিপিন দিয়েছে—একটি একটি করে পয়সা জমিয়েই তো!

নিষ্ফল আক্রোশে প্রায় চোখ দিয়া জল বাহির হইয়া আসিবার উপক্রম হইয়াছে আমার।

ছোট বোন বলিতেছে, সে যশটুকু দিতে হয় বইকি। মাথার জন্যে তেলও কিনে দিয়েছে। তোমার তেলের মত কতকটা গন্ধ, নয় মেজদা?

বলিলাম, মিছে বকিস নি, আমার তেল ও কোথা পাবে?

এই বাসদেওয়ার হইয়াই বাড়ির সকলের সঙ্গে সেদিন পর্যন্ত বচসা হইয়া গিয়াছে। গোয়েন্দাগিরি যশ লইয়া নিরীহ রেবিয়াকে তাড়াইয়াছি, তাহার অভিশাপটি মাথার উপর। অন্তরে অন্তরে যতই দগ্ধ হই না কেন, শুধু ওই তেল নয়, ও ফিতা যে আমার টাইপ-রাইটারের, ও বালাও যে আমার পর্দার, ও সেফটিফিনও যে আমারই কণ্ঠভূষণ—একথা প্রকাশ করিয়া বলিবার কি আর পথ রাখিয়াছি?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *