বন্ধ-বাতায়নে
ইংরেজকে যত দোষই দিই না কেন, ইংরেজি সভ্যতার যত নিন্দাই করি না কেন, ইংরেজ যে একটা মহৎ কর্ম সুচারুরূপে সম্পন্ন করতে সমর্থ হয়েছে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। একদিক দিয়ে বহু জাত-বেজাত ইংলন্ড দখল করেছে, অন্যদিক দিয়ে ইংরেজ বিশ্বভুবনময় ছড়িয়ে পড়েছে, এবং তার ফলে ইংলন্ডে যে কত প্রকারের ভাবধারা এসে সম্মিলিত হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই।
এই নানা ঘাত-প্রতিঘাতী পরস্পরবিরোধী চিন্তাধারা, রসবোধ পদ্ধতি, আদর্শানুসন্ধান যখন পৃথকভাবে যাচাই করি তখন বিস্ময়ের আর অন্ত থাকে না যে, ইংরেজ কী করে সবকটাকে এক করে বহুর ভিতর দিয়ে ঐক্যের সন্ধান পেল।
কাব্যকলায় ইংরেজের যে খুব বেশি মৌলিক গুণ আছে তা নয়–ইয়োরোপীয় সঙ্গীত, স্থাপত্য, চিত্রকলায় ইংরেজের দান অতি অল্পই কিন্তু মনের সবকটি জানালা ইংরেজ সবসময়ই খোলা রেখেছে বলে বহু প্রমর তার ঘরে এসে নানা গুঞ্জন গান তুলেছে, নানা ফুলের সুবাস তার বৈদগ্ধ্যকে সুবাসিত করে তুলেছে। সে বৈদগ্ধের প্রকাশও তাই সুভাষিত।
অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, এই নানা বস্তু অন্তরে গ্রহণ করার ক্ষমতার পিছনে রয়েছে সহিষ্ণুতা। এ গুণটি বড় মহৎ, এবং জর্মন জাতির এ গুণটি নেই বলেই তারা বহু প্রতিভাবান কবি, গায়ক, দার্শনিক পেয়েও কখনওই ইয়োরোপে একচ্ছত্রাধিপত্য করতে পারেনি।
ইংরেজরাজত্বের সময় আমাদের প্রধান কর্ম ছিল ইংরেজকে খেদানোর কল-কৌশল বের করা। আমরা সহিষ্ণু এবং উদার কি না, দুবাইগ্রস্ত এবং কূপমণ্ডুক- এ প্রশ্ন জিগ্যেস করবার ফুরসত এবং প্রয়োজন আমাদের তখন ছিল না।
এ প্রশ্ন জিগ্যেস করবার সময় আজ এসেছে।
আমাদের বৈদেশিক রাজনীতি সম্পূর্ণ নির্ভর করবে আমাদের চরিত্রের ওপর।
আমরা যদি হাম-বড়াই প্রমত্ত হয়ে দেশ-বিদেশে সর্বত্র এরকম ধারা ভাবখানা দেখাই যে কারও কাছে আমাদের কিছু শেখবার নেই, আমাদের পুরাণাদি অনুসন্ধান করলে এটম বম্ বানানোর কৌশল খুঁজে পাওয়া যায়, আমাদের বিদ্যা-বুদ্ধির সামনে যে লোক মাথা না নেওয়ায় সে আকাট মূর্খ, আমরা যদি দেশ-বিদেশে আপন সামাজিক জীবনে পাঁচজনকে নিমন্ত্রণ করে, নিমন্ত্রণ রেখে হৃদ্যতাযোগে সকলের সঙ্গে এক না হতে পারি তবে আমরা বৈদেশিক রাজনীতিতে মার খাব–বেধড়ক মার খাব, সে বিষয়ে আমার মনে কণামাত্র সন্দেহ নেই।
যুদ্ধের সময় কত মার্কিন, ফরাসি, চেক, বেলজিয়াম আমার কাছে ফরিয়াদ করেছে, বাঙালিদের সঙ্গে মেশবার সুযোগ তারা পেল না। এক মার্কিন আমাদের একখানা বাজে ইংরেজি কাগজের রবিবাসরীয় পড়ে মুগ্ধ হয়ে বলল, তোমরা যদি এরকম ইংরেজি লিখতে পার তবে বাঙলাতে তোমাদের চিন্তাধারা কত না অদ্ভুত খোলতাই হয় তার সন্ধান পাব কী প্রকারো বাঙলা শেখবার মতো দীর্ঘকাল তো আর এদেশে থাকব না, তাই অন্তত দু-চারজন গুণীর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দাও, দু-দণ্ড রসালাপ আর তত্ত্বালোচনা করে লড়াইয়ের খুনকলের কথাটা যাতে করে ভুলে যেতে পারি।
আলাপ করিয়ে দিলুম কিন্তু জমল না।
আমার বাঙালি বন্ধুরা যে জাত মানেন তা নয়, কিংবা মার্কিন ভদ্রলোকটি যে আমাদের ঠাকুরঘরে বসে গোমাংস খেতে চেয়েছিলেন তা-ও নয়, বেদনাটা বাজল অন্য জায়গায়।
আলাপ-পরিচয়ের দুদিন বাদেই ধরা পড়ে, আমাদের মনের জানালাগুলো সব বন্ধ। আমরা করি সাহিত্যচর্চা ও কিঞ্চিৎ রাজনীতি। নিতান্তু যারা অর্থশাস্ত্র পড়েছেন, তাদের বাদ দিলে আমাদের রাজনীতিচর্চাও নিতান্ত একপেশে; আর আমাদের নিজেদের দর্শন, সঙ্গীত, চিত্রকলা, স্থাপত্য, নৃত্য সম্বন্ধেও আমাদের জ্ঞান অত্যল্প। ইংরেজি সাহিত্য সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান খানিকটে আছে বটে কিন্তু ইয়োরোপীয় বৈদগ্ধের আর পাঁচটা সম্পদ সম্বন্ধে আমরা অচেতন।
তাই গালগল্প ভালো করে জমে না। যে আমেরিকান পঁচিশপদী খানা পায় তাকে দুবেলা ডালভাত দিলে চলবে কেন? রবীন্দ্রনাথ আর গান্ধী, গান্ধী আর রবীন্দ্রনাথ করে তো আর দিনের পর দিন কাটানো যায় না।
এরচেয়ে আশ্চর্যের জিনিস আর কিছুই হতে পারে না। কারণ এখনও আমাদের যেটুকু বৈদগ্ধ্য আছে, যে সম্পদ সম্বন্ধে আমাদের বেশিরভাগ লোকই অচেতন, সেটুকু গড়ে উঠেছে এককালে আমাদের মনের সবকটি জানালা খোলা ছিল বলে।
শুধু তাজমহল নয়, সমস্ত মোগল-পাঠান স্থাপত্য– জামি মসজিদ, আগ্রা দুর্গ, হুমায়ুনের কবর, সিক্রি এবং তার পূর্বেকার হৌজবাস, কুত্ত্বমিনার সবকিছু গড়ে উঠল ভারতবাসীর মনের জানালা খোলা ছিল বলে; দিল্লি-আগ্রার বাইরে যেসব স্থাপত্যশৈলী রয়েছে, যেমন ধরুন আহমদাবাদ বাঙলা দেশ কিংবা বিজাপুরে সেগুলোও তাদের পরিপূর্ণতা পেয়েছে, এককালে আমাদের মনের দরজা খোলা ছিল বলে; খানসাহেব আব্দুল করীম খান উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের যে চরমে পৌঁছতে পেরেছিলেন তার সোপান নির্মিত হয়েছে ভারতীয় পূর্বাচার্যগণের ঔদার্যগুণে।
এই বাঙলা ভাষা আর সাহিত্যই নিন। বৌদ্ধচর্যাপদে তার জন্য, তার গায়ে বৈষ্ণব পদাবলির নামাবলি, মঙ্গল-মুকুট তার শিরে, আরবি-ফারসি শব্দের খানা খেয়েছে সে বিস্তর আর তার কথার ফাঁকে ফাঁকে যে ইংরেজি বোল ফুটে ওঠে তার জ্বালায় তো মাঝে মাঝে প্রাণ অস্থির হয়ে ওঠে।
আর কিছু না থোক আরবি-ফারসির যে দুটো জানালা আমরা বন্ধ করে দিয়েছি। যেগুলো সামান্য ফাঁক করে দিয়েই কবি নজরুল ইসলাম আমাদের গায়ে তাজা হাওয়া লাগিয়ে দিলেন সেগুলোই যদি আমরা পুনরায় খুলে ধরি তা হলে আফগানিস্তান, ইরান, ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, প্যালেস্টাইন, মিশর, লিবিয়া, মরক্কো, আলজেরিয়ার সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ সহজ হয়ে যাবে। আফগানিস্তান ও ইরানে ফারসি প্রচলিত আর বাদবাকি দেশ আরবি।
স্বার্থের সন্ধানে একদিন আমরা তাদের কাছে যাব, তারাও আমাদের অনুসন্ধান করবে। তখন যদি তারা আমাদের যতটা চেনে তারচেয়ে তাদের সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান বেশি হয় তবে আমরাই জিতব।
আর পুবের জানালাও তো খুলে ফেলা সহজ। বৌদ্ধধর্মের ত্রিপিটক তো ভারতের পিটকেই বন্ধ আছে। ত্রিশরণ ত্রিরত্নের রত্নাকর তো আমরাই।
.
০২.
পশ্চিমের জানালা খুললে দেখতে পাই, পাকিস্তান ছাড়িয়ে আফগানিস্তান, ইরান, আরব দেশের পর ভূমধ্যসাগর, অর্থাৎ ভারত এবং ভূমধ্যসাগরের মধ্যবর্তী ভূমি মুসলিম। তাই স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জাগে, এই বিশাল ভূখণ্ড যদি ধর্মের উদ্দীপনায় ঐক্যলাভ করতে পারে তবে আন্তর্জাতিক রাজনীতি-পঞ্চায়েতে এদের উচ্চকণ্ঠ কি মার্কিন, কি রুশ কেউই অবহেলা করতে পারবে না।
তার পূর্বে প্রশ্ন, বহুশত বৎসর ধরে এ ভূখণ্ডে কোনওপ্রকারের স্বাধীন ঐক্য যখন নেই তখন আজ হঠাৎ কী প্রকারে এদের ভিতর একতা গড়ে তোলা সম্ভব? উত্তরে শুধু এইটুকু বলা চলে যে, এ ভূখণ্ডে ইতোপূর্বে আর কখনও এমন কট্টর জীবনমরণ সমস্যা উপস্থিত হয়নি। তাই আজ যদি প্রাণের দায়ে এরা এক হয়ে যায়!
ঐক্যের পথে অন্তরায় কী?
প্রথম অন্তরায় ধর্মই। ভারতবর্ষের পূর্বপ্রান্তে যেমন বর্মা-চীন এবং অন্যদিকে মুসলিম ভূমি, ঠিক তেমনি শিয়া ইরানের একদিকে সুন্নি আফগানিস্তান-পাকিস্তান এবং ভারতীয় মুসলমান, অন্যদিকেও সুন্নি আরবিন্তান। শিয়া ইরানের সঙ্গে সুন্নি আফগানিস্তানের মনের মিল কখনও ছিল না, এখনও নেই। একটা উদাহরণ দিলেই আমার বক্তব্যটা খোলসা হবে; আফগান বিদগ্ধজনের শিক্ষাদীক্ষা এবং রাষ্ট্রভাষা ফারসি, আর ইরানের ভাষা তো ফারসি বটেই, তৎসত্ত্বেও কাবুলের লোক কস্মিনকালেও ইরানে লেখা-পড়া শেখবার জন্য যায়নি এবং তারচেয়েও আশ্চর্যের বিষয় যে তারা লেখা-পড়া এবং ধর্ম-চর্চার জন্য আসত ভারতবর্ষে, এখনও আসে, যদ্যপি সকলেই জানে যে, ভারতবর্ষের কোনও প্রদেশের লোকই ফারসিতে কথা বলে না। ইসলামের অভ্যুদয়ের পূর্বেও তাই ছিল– আফগানিস্তান এককালে বৌদ্ধ ছিল, তার পূর্বে সে হিন্দু ছিল, কিন্তু ইরানি জরথুস্ত্র ধর্ম সে কখনও ব্যাপকভাবে গ্রহণ করেনি।
ইরান-আফগানিস্তানে তাই অহরহ মনোমালিন্য। আফগানিস্তান ও ইরান সীমান্ত নিয়ে দুদিন বাদে বাদে ঝগড়া লাগে ও আজ পর্যন্ত সেসব ঝগড়া-কাজিয়া ফৈসালা করার জন্য কত যে কমিশন বসেছে তার ইয়ত্তা নেই। আফগানিস্তানের পশ্চিমতম হিরাত ও ইরানের পূর্বতম শহর মেশেদে প্রায়ই শিয়া-সুন্নিতে হাতাহাতি মারামারি হয়। আফগান-ইরানেতে বিয়ে-শাদি হয় না, কাবুলরাজ কখনও তেহরান যান না, ইরান-অধিপতিও কখনও কাবুলমুখো হন না। ব্যত্যয় আমানউল্লা খান এবং তার ইরান গমনের সংবাদ পেয়ে আফগানরা কিছুমাত্র উল্লসিত হয়নি।
ওদিকে যেমন ইরানের সঙ্গে আফগানিস্তানের মনের মিল নেই, এদিকে তেমনি আফগান-পাকিস্তানিতে মন-কষাকষি চলছে। সিন্ধুর পশ্চিম পার থেকে আসল পাঠানভূমি আরম্ভ হয়, এবং পূর্ব আফগানিস্তানের উপজাতি সম্প্রদায়ও পাঠান। তাই আফগান সরকারের দাবি, পাকিস্তানের পাঠান হিস্যাটা যেন তার জমিদারিতে ফেরত দেওয়া হয়। এ দাবিটা আফগানিস্তান ইংরেজ আমলে মনে মনে পোষণ করত, কিন্তু ইংরেজের ভাণ্ডার ভয়ে বিশেষ উচ্চবাচ্য করত না।
এই তো গেল পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরানের মধ্যে হার্দিক সম্পর্ক বা আঁতাত কর্দিয়ালের কেচ্ছ!
ওদিকে আবার ইরান-আরবে দোস্তি হয় না। প্রথমত ধর্মের বাধা ইরান শিয়া, আরব সুনি; দ্বিতীয়ত ইরানিরা আর্য, আরবরা সেমিতি, তৃতীয়ত ইরানের ভাষা ফারসি, আরবের ভাষা আরবি।
কিন্তু তার চেয়েও গুরুতর বাধা হয়েছে এই যে, খুদ আরব ভূখণ্ড ঐক্যসূত্রে গাঁথা নয়। খুদ আরবভূমি যদি এক হয়ে ইরানের ওপর তার বিরাট চাপ ফেলতে পারত তবে হয়তো ইরান প্রাণের দায়ে ভালো হোক মন্দ হোক, কোনপ্রকারে একটা দোস্তি করে ফেলত (তা সে-আঁতাত, হার্দিক, হার্টি অর্থাৎ কর্নিয়াল হল আর না-ই হল। কিন্তু তাবৎ আরব ভূখণ্ডকে এক করবার মতো তাগদ আজ কারও ভিতরেই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না।
আরবভূমি আজ ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, ট্রান-জর্ডান, সউদি আরব, প্যালেস্টাইন ও ইয়েমেন এই সাত রাষ্ট্রে বিভক্ত। তাছাড়া, কুয়েত, হাদ্ৰামুত, অধুনা নির্মিত আদন ইত্যাদি ক-গণ্ডা উপরাষ্ট্র আছে সে তো অমার! এদের সকলেরই ভাষা ও ধর্ম এক ও তৎসত্ত্বেও এদের ভিতর মনের মিল নেই। এবং সে ঐক্যের অভাব এই সেদিন মর্মন্তুদরূপে সপ্রমাণ হয়ে গেল– যেদিন কথা নেই বার্তা নেই আড়াই গণ্ডাই ইহুদি হঠাৎ উড়ে এসে আরবিস্তানের বুকের উপর প্যালেস্টাইনে জুড়ে বসল। যে আরব হাজারো বৎসর ধরে প্যালেস্টাইনের পাথর নিংড়ে সরস জাফা কমলালেবু বানিয়ে নিজে যেত, দুনিয়াকে খাওয়াত, সেই আরবের ভিটেমাটি উচ্ছন্ন করল আড়াই গণ্ডা রণভীরু ইহুদি! আরব রাষ্ট্রের আপন গৃহকলহ নিয়ে মশগুল– ওদিকে প্যালেস্টাইন পয়মাল হয়ে গেল।
লেবাননকে বাদ দিয়ে আরব সম্বন্ধে আলোচনা করা যাক– কারণ লেবানন রাষ্ট্রে মুসলিম-আরবের চেয়ে খ্রিস্টান-আরবের সংখ্যা একটুখানি বেশি; লেবাননের খ্রিস্টান আরবেরা ইহুদিদের সঙ্গে দোস্তি করতে চায় না একথা খাঁটি এবং তারা হয়তো বৃহত্তর আরবভূমির পঞ্চায়েতে হাজিরা দিতে রাজি না-ও হতে পারে। কিন্তু তাতে কিছুমাত্র এসে-যায় না, কারণ লেবানন অঙ্গুষ্ঠ পরিমাণ রাষ্ট্র।
আসল লড়াই দুই পালোয়ানে। তাদের একজন আমির আব্দুল্লা, ট্রান্স জর্ডনের রাজা, অন্যজন মক্কা-মদিনা, জিন্দ-নেজদের রাজা ইবনে সউদ। আব্দুল্লার বংশই ইরাকে রাজত্ব করেন, কাজেই এ দু রাষ্ট্রের মিতালি পাক্কা, কিন্তু ইবনে সউদ একাই একশো। কারণ রাজা বলতে আমরা যা বুঝি সে হিসেবে আজকের দুনিয়ায় একমাত্র তিনিই খাঁটি রাজী। আব্দুল্লার পিছনে রয়েছে ইংরেজের অর্ধবল, বাহুর দম্ভ; কিন্তু ইবনে সউদ কারও তোয়াক্কা করে আপন রাজ্য চালান না! মার্কিনকে তেল বেচে তিনি এ যাবৎ কয়েকশো মিলিয়ন ডলার পেয়েছেন বটে, তবু মার্কিন তার রাজত্বে কোনও প্রকারের নাম-প্রভুত্ব কায়েম করতে পারেনি। আর সবচেয়ে বড় কথা, তিনি মক্কার কাবা শরিফের তদারকদার বিশ্বমুসলিম, সেই খাতিরে তাকে কিছুটা মানেও বটে।
যেন ঘোঁটলাটা যথেষ্ট প্যাচালো নয় তাই মিশরকেও এই সম্পর্কে স্মরণ করতে হয়। কারণ মিশরবাসীর শতকরা নব্বই জন আরবি কথা বলে, ধর্ম তাদের ইসলাম ও তাদের বেশিরভাগের রক্তও আরব-রক্ত। এবং তারচেয়েও বড় কথা, ইসলাম এবং মুসলিম ঐতিহ্যের সবচেয়ে বড় অছি কাইরোর সহস্রাধিক বৎসরের প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় অল-অজহর আরব। আফগানিস্তান, যুগোশ্লাভিয়া, রুমানিয়া, ভারতবর্ষ, চীন, মালয়, জাভা এক কথায় তাবৎ দুনিয়ার কুল্লে ধর্মপ্রাণ মুসলিমের আন্তরিক কামনা অজহরে ধর্মশিক্ষা লাভ করবার।
তদুপরি মিশর প্রগতিশীল এবং বিত্তশালী রাষ্ট্রও বটে।
কিন্তু মিশরের উপরে রয়েছে ইংরেজের সরদার।
সেই হল আরেক বখেড়া। আরবদের ভিতর ঝগড়া-কাজিয়া তো রয়েছেই, তার ওপর আবার আরব হাঁড়ির ভিতর গর্দান ঢুকিয়ে বসে আছেন ইংরেজ এবং স্বয়ং মার্কিন চতুর্দিকে ছেক-ছোঁক করে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, হাঁড়ির কিছুটা স্নেহজাতীয় পদার্থ ইতোমধ্যেই তাঁর লাজুলকে কিঞ্চিৎ চেকনাই এনে দিয়েছে সেকথা পূর্বেই নিবেদন করেছি।
তাই সবকিছু ছয়লাপ করে দেয় তেলের বন্যা। ইরান-ইরাকের তেল ইংরেজের আর সউদি আরবের তেল মার্কিনের। পাঠক বলবেন, তা হলেই হল, ব্রাদারলি ডিভিশন, কিন্তু সুশীল পাঠক, আপনি উপনিষদ পড়েননি তাই এরকম ধারা বললেন। ভূমৈব সুখম- অল্পে সুখ নেই। মার্কিন চায় তৈলযজ্ঞের একক পুরোহিত হতে, আর ইংরেজ চায় মার্কিনকে দরিয়ার সে-পারে খেদাতে।
কী দিয়ে আরম্ভ করেছিলুম আর কোথায় এসে পড়েছি। কোথায় আফগানিস্তানের প্রস্তরময় শৈলশিখর আর কোথায় স্নেহভারে ডগমগ আরবের পাতালতল। এ সবকিছুর হিসেব-নিকেশ করে পররাষ্ট্রনীতির হদিস বানানো তো সোজা কর্ম নয়।
আমাদের একমাত্র সান্ত্বনা এদেশের বিস্তর লোক আরবি এবং ফারসি উভয় ভাষাই জানেন। ইচ্ছে করলে এদের সম্বন্ধে আমরা নিজের মুখেই ঝাল খেতে পারি।
তাই বলি খোলো খোলা জানালা খোলো ॥*[** এ প্রবন্ধটি লিখি ১৩৫৬ (১৯৪৯ খ্রি.) সালে (অর্থাৎ দেশে-বিদেশে পুস্তকাকারে প্রকাশিত হওয়ার সময়)। ইতোমধ্যে আরব ভূখণ্ডে রাজার বদলে কোনও কোনও জায়গায় ডিকটেটর হয়েছেন, মিশর থেকে ইংরেজ অনেক দূরে হটে গিয়েছে। নইলে এ প্রবন্ধের মূল দর্শন তখন যা ছিল, আজও তাই। আমি তাই প্রবন্ধের কোনও পরিবর্তন করিনি।]