“বন্ধ ঘরে আর্তনাদ…”
টুনি তার ব্যাকপেক খুলে বইমেলা থেকে কিনে আনা বই দুটো বের করে সেগুলোর ওপর হাত বুলাল। নূতন বইয়ের মজাই অন্য রকম। পড়ার আগে মলাটে হাত বুলানো যায়, ঘ্রাণ নেওয়া যায়, উল্টেপাল্টে একটা-দুইটা শব্দ পড়ে কী নিয়ে লেখা অনুমান করার চেষ্টা করা যায়। বইয়ের শেষ পৃষ্ঠায় লেখকের ছবি দেখা যায়, জীবনী পড়া যায়। বইটা কাকে উৎসর্গ করেছে সেটা দেখা যায়। টুনি মাত্র সেই কাজগুলি শুরু করেছে ঠিক তখন শুনতে পেল তার পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা একটি মেয়ে বলছে, “তোমার বইগুলি একটু দেখি?”
টুনি পিছনে তাকাল, তার পিছনে ফিরোজা দাঁড়িয়ে আছে। ফিরোজা তাদের সাথে পড়ে কিন্তু খুব বেশি মিশুক না, প্রায় সবসময় একা একা থাকে। বাইরে সবাই যখন দৌড়াদৌড়ি করে খেলে তখন ফিরোজা স্কুলের লাইব্রেরিতে মাথা গুঁজে বই পড়ে। মেয়েটার বই পড়ার খুব শখ।
টুনি বই দুটি ফিরোজার হাতে দিলো, ফিরোজা বই দুটি নিয়ে ওপরে হাত বুলাল, বইগুলোর পৃষ্ঠা খুলে দেখল তারপর একটা নিশ্বাস ফেলে টুনির হাতে ফেরত দিলো।
টুনি জিজ্ঞেস করল, “এই বইগুলি পড়েছো?”
ফিরোজা মাথা নাড়ল, বলল, “না।”
দুটো বই-ই একজনের লেখা। নূতন লেখক কিন্তু এর মাঝেই সে অনেকগুলো বই লিখেছে, ছেলেমেয়েরা খুব আগ্রহ নিয়ে বই পড়ে। বুড়ো লেখকদের মতো জ্ঞানের বই লিখে না, বইয়ের ভিতরে একটু পরে পরে নানা রকম উপদেশ দেয় না। একটা বই ভূতের অন্যটা সায়েন্স ফিকশন। ফিরোজা কেমন জানি লোভী লোভী চোখে বইগুলো দেখছিল, টুনি জিজ্ঞেস করল, “তুমি এই লেখকের অন্য বই পড়েছো?”
ফিরোজা বলল, “না পড়ি নাই।”
টুনি বলল, “পড়ে দেখো। অনেক মজার বই লিখে।”
ফিরোজা একটু হাসার চেষ্টা করে কেমন জানি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। টুনি ঠিক বুঝতে পারল না দীর্ঘশ্বাসটি কেন। আজকাল বইয়ের অনেক দাম, সে জন্য সবাই সবসময় বই কিনতে পারে না। সেটা একটা কারণ হতে পারে। টুনি তাই বলল, “আমার পড়া শেষ হলে তুমি বইগুলি নিয়ে পড়তে পারো।”
ফিরোজা বলল, “স্কুলে বই পড়ার সময় পাওয়া যায় না।”
টুনি বলল, “স্কুলে পড়তে হবে না। বাসায় নিয়ে পড়বে।”
ফিরোজা এক সেকেন্ড চুপ করে থাকল, তারপর বলল, “আমার বাসায় বই পড়া নিষেধ।”
টুনি চমকে উঠল, বলল, “কী বললে? বই পড়া নিষেধ?”
ফিরোজা মাথা নাড়ল, টুনি তখন জিজ্ঞেস করল, “কেন? বই পড়া নিষেধ কেন?”
“আমার আম্মু-আব্বু মনে করে বই পড়লে ছেলেমেয়েরা নষ্ট হয়ে যায়।”
“নষ্ট হয়ে যায়? নষ্ট হয়ে যায় মানে কী? ছেলেমেয়েরা ইলিশ মাছ নাকি যে ফ্রিজে না রাখলে নষ্ট হয়ে যাবে?”
ফিরোজা উত্তর দিলো না। একটু পর বলল, “আমাদের বাসায় পাঠ্যবই ছাড়া অন্য সব বই পড়া নিষেধ।”
টুনি চোখ বড় বড় করে ফিরোজার দিকে তাকিয়ে রইল। ফিরোজা বলল, “আমাদের বাসায় পাঠ্যবই ছাড়া অন্য বই মাত্র দুইটা।”
“দুইটা?”
“হ্যাঁ। একটা হচ্ছে ‘নারীর পর্দা পুশিদা’ আরেকটা ‘বারো আওলিয়ার কাহিনী’।”
টুনি কী বলবে বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল, “পড়েছো ওই বই দুইটা?”
ফিরোজা মাথা নাড়ল, “পড়েছি।”
টুনি কিছুক্ষণ ফিরোজার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, “কিন্তু সবাই তো বই পড়ে—তোমার বই পড়লে সমস্যা কী?”
ফিরোজা বলল, “আমার আব্বু বলে, লেখকেরা বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যা কথা লিখে—মিথ্যা কথা বলা আর লিখা দুইটা গুনাহ। পড়লেও গুনাহ।”
টুনি বলল, “তুমি যদি লুকিয়ে লুকিয়ে পড়ো তাহলে কী হবে?”
“যদি ধরা পড়ি তাহলে মারবে।”
টুনি চোখ কপালে তুলে বলল, “মারবে?”
“হ্যাঁ। লেখাপড়াও বন্ধ করে দিতে পারে।”
“সর্বনাশ!” টুনি মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, “কিন্তু তোমার আম্মু- আব্বু বুঝবে কেমন করে? সবসময় কি তোমাকে চোখে চোখে রাখে?”
“হ্যাঁ। আমার ব্যাগ ঘেঁটে দেখে। প্রত্যেক দিন আমার বইপত্র-খাতা সবকিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে।”
টুনি অবাক হয়ে ফিরোজার দিকে তাকিয়ে রইল। ফিরোজা বলল, “আমি কয়েকটা কবিতা মুখস্থ করতে চেয়েছিলাম কিন্তু সেগুলো বাসায় নিতে পারি না। মাঝে মাঝে কিছু একটা লিখতে ইচ্ছা করে সেইটাও করতে পারি না।”
ফিরোজা কথা শেষ করে টুনির দিকে তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করল, টুনির মনে হলো এই হাসির চেষ্টা না করে কেঁদে ফেললে বরং ব্যাপারটা সহজ হতো।
* * *
রাত্রে ঘুমানোর আগে টুনি তার আম্মুর সাথে ফিরোজার ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলল। আম্মু পুরো ব্যাপারটা মন দিয়ে শুনলেন, তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “আহা বেচারা!”
টুনি বলল, “কিছু একটা করা যায় না?”
“যায় নিশ্চয়ই। কিন্তু কী করবি?”
“গোপনে যদি পড়ার জন্য বই সাপ্লাই দিই?
“কীভাবে দিবি?”
“সেটা চিন্তা করে বের করতে হবে।”
“যদি ধরা পড়ে, তাহলে আরো বিপদে পড়ে যাবে। লেখাপড়া বন্ধ করে দিলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।”
টুনি খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলল, “কিন্তু বই পড়া তো খুব দরকার, তাই না আম্মু?”
“হ্যাঁ, বই পড়া হচ্ছে মানুষের ব্রেনের উপযুক্ত একটা কাজ। মানুষ ছাড়া আর কেউ পড়তে পারে না। পৃথিবীর মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়, যারা বই পড়ে আর যারা পড়ে না। যারা বই পড়ে তারা দুনিয়াটা চালায়।”
টুনি মাথা নাড়ল, তারপর বলল, “আমি যদি খুবই কায়দা করে গোপনে বই পাঠাই, যেন কেউ ধরতে না পারে, তাহলে কি ভুল হবে?”
আম্মু কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন, তারপর বললেন, “ধরা না পড়লে ঠিক আছে। কারণ যদি তুই খবর পাস মেয়েটাকে খেতে দিচ্ছে না—আর তুই যদি গোপনে খাবার পাঠাস, সেটা তো আর অন্যায় হবে না। হবে?”
“না আম্মু। হবে না।”
“আর বই পড়া তো খাওয়ার মতোই। ব্রেনের খাবার।”
টুনি গভীরভাবে কিছু একটা চিন্তা করতে করতে মাথা নাড়ল। আম্মু বললেন, “একটা কাজ তো খুব সহজেই করতে পারিস।”
“কী কাজ?”
“মেয়েটা লিখতে চায়। তাকে সুন্দর একটা খাতা কিনে দে। সে স্কুলে বসে লিখবে, তুই সেটা তার জন্য বাঁচিয়ে রাখবি। তোর কাছে সবসময় রাখবি। বাসায় জানবে না।”
টুনি দাঁত বের করে হাসল, বলল, “হ্যাঁ, সেইটা তো খুবই সহজ। টুনি বিছানায় শুয়ে শুয়ে চিন্তা করতে থাকে। চিন্তা করলে নিশ্চয়ই কিছু একটা বের হয়ে যাবে।
ঠিক যখন চোখে ঘুম এসে যাচ্ছে তখন হঠাৎ করে তার মাথায় একটা বুদ্ধি চিড়িক করে উঠল। ব্যাপারটা নিয়ে একটু এক্সপেরিমেন্ট করতে হবে। কিন্তু কাজ না করার কোনো কারণ নাই।
* * *
ভোরবেলা টুনি ছোটাচ্চুকে ঘুম থেকে তুলল। ছোটাচ্চু বিরক্ত হয়ে বলল, “এত সকালে তোর কী হয়েছে?”
“তুমি অফিসে যাবে না?”
“আমার অফিসে যাওয়া নিয়ে তোর মাথাব্যথা কিসের?”
“আমারও তো স্কুলে যেতে হবে। স্কুলে যাওয়ার আগে তোমাকে একটা জিনিস জিজ্ঞেস করব।”
“কী জিনিস?”
“মনে আছে তুমি অনেক দিন আগে একটা ম্যাজিক দেখিয়েছিলে?”
“আমি? ম্যাজিক?”
“হ্যাঁ।”
ছোটাচ্চু মাঝে মাঝেই বাচ্চাদের নিয়ে নানা রকম আজব কাজকর্ম করে। টুনি ঠিক কোনটা নিয়ে কথা বলছে বুঝতে পারল না। জিজ্ঞেস করল, “কোন ম্যাজিক?”
ওই যে নোট বইয়ের ম্যাজিক। নোট বইয়ে কিছু লেখা নাই, সাদা পৃষ্ঠা। তার পরে জাদুমন্ত্র পড়ে নোট বইয়ের মলাটে আঙুল দিয়ে লিখতেই প্রত্যেক পৃষ্ঠায় লেখা হয়ে গেল!”
“ওহ! কী হয়েছে সেই ম্যাজিকের?”
“তুমি কীভাবে করেছিল দেখাবে?”
ছোটাচ্চু বলল, “শেলফে নোট বইটা আছে, সেটা খুঁজে বের করে নিয়ে বিদায় হ। আমাকে ঘুমাতে দে।” বলে ছোটাচ্চু মাথা ঘুরিয়ে আবার ঘুমানোর চেষ্টা করতে লাগল। ছোটাচ্চুর ঘুমানোর অসাধারণ ক্ষমতা আছে, কয়েক সেকেন্ডের ভিতর আবার তার নাক ডাকতে লাগল।
টুনি শেলফে গিয়ে একটু খোঁজাখুঁজি করতেই নোট বইটা পেয়ে গেল। এই নোট বইটার ম্যাজিক দেখানোর কায়দাটা এখন ভালো করে বুঝতে হবে।
টুনি নাস্তা খেতে খেতে নোট বইটা ভালো করে পরীক্ষা করতেই ম্যাজিকের কায়দাটা বুঝে গেল—খুবই সহজ এবং খুবই চমকপ্রদ! নোট বইয়ের একটি পৃষ্ঠা সাদা পরের পৃষ্ঠাতে মার্কার দিয়ে একটা মানুষের মাথা আঁকা—এভাবে পুরো নোট বইটা রেডি করানো আছে। ম্যাজিক দেখানোর সময় একটা বিশেষ কায়দায় নোট বইয়ের পাতাগুলো ওল্টালে শুধু সাদা পৃষ্ঠা দেখা যায়। তারপর একটা জাদুমন্ত্র বলে নোট বইয়ের মলাটে আঙুল দিয়ে একটা মানুষের মাথা আঁকার ভান করতে হয়। আঁকা শেষ হওয়ার পর পৃষ্ঠাগুলো অন্যভাবে ওল্টাতে হয় তখন সাদা পৃষ্ঠা না বের হয়ে শুধু ছবি আঁকা মাথাগুলো বের হয়। মনে হয় এই মাত্র জাদুমন্ত্র দিয়ে ছবিগুলো আঁকা হয়েছে।
কীভাবে কখনো কখনো শুধু সাদা পৃষ্ঠা বের হয় কখনো কখনো শুধু ছবি আঁকা পৃষ্ঠা বের হয় টুনি তখন সেটা খুঁজে বের করল। সাদা পৃষ্ঠার নিচে ডান দিকে খুব যত্ন করে একটুখানি কাঁচি দিয়ে কাটা হয়েছে। কাজেই সেখানে বুড়ো আঙুল দিয়ে চাপ দিয়ে পৃষ্ঠা উল্টে গেলে সাদা পৃষ্ঠাগুলো একটার পর একটা বের হতে থাকে। ছবি আঁকা পৃষ্ঠাগুলোর ওপরে ডান দিকে কাঁচি দিয়ে কাটা হয়েছে। কাজেই সেটা দেখানোর জন্য পৃষ্ঠাগুলো ওল্টাতে হয় বুড়ো আঙুল ওপরে ডান দিকে চাপ দিয়ে! কী সহজ — দেখে টুনি অবাক হয়ে গেল।
টুনি ফিরোজার জন্য যেটা করতে চাইছে সেটা সে আরো সহজে করতে পারবে! ইচ্ছে করলে প্রত্যেক দিন সে ফিরোজাকে একটা করে নূতন বই পড়াতে পারবে—তার বাসার কেউ ফিরোজার ব্যাগ ঘাঁটাঘাঁটি করে তার লুকিয়ে রাখা বাই বের করতে পারবে না।
ব্যাপারটা পরীক্ষা করার জন্য তখন তখনই সে একটা বই নিয়ে তার দুইটা পৃষ্ঠায় পরপর খুব সাবধানে কাঁচি দিয়ে তার ডান দিকে কয়েক মিলিমিটার কেটে ফেলে দিলো। তারপর ডান দিকে কেটে ছোট করা পৃষ্ঠা দুটির মাঝখানে এক টুকরা কাগজ রেখে পরীক্ষা করে দেখল। যতই চেষ্টা করা যাক বইয়ের মাঝখানে লুকিয়ে রাখা কাগজের টুকরাটি আর খুঁজে বের করা যায় না। কী মজা!
* * *
স্কুলে গিয়ে টুনি রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে ফিরোজার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। টুনির উত্তেজনা নিশ্চয়ই বোঝা যাচ্ছিল, কারণ সালমা তাকে জিজ্ঞেস করল, “তুই এ রকম ছটফট করছিস কী জন্য?”
টুনি বলল, “ফিরোজার জন্য অপেক্ষা করছি।”
“কী হয়েছে ফিরোজার?”
টুনি বলল, “তুই জানিস, ফিরোজাকে তার বাসায় কোনো বই পড়তে দেয় না? তার সারা বাসায় মাত্র দুইটা বই, একটা হচ্ছে ‘নারীর পর্দা পুশিদা’ আরেকটা হচ্ছে ‘বারো আওলিয়ার কাহিনী’।”
সালমা বলল, “তুই এত অবাক হচ্ছিস কেন? অনেক ফ্যামিলিই তো এ রকম—পাঠ্যবই ছাড়া অন্য বই পড়া নিষেধ।”
“আমি সে জন্য একটা সিস্টেম রেডি করছি—দেখি কাজ করে কি না।”
“কী সিস্টেম?”
টুনি বলল, “ঠিক আছে তোকে দিয়ে পরীক্ষা করি।”
“কী পরীক্ষা করবি?”
টুনি উত্তর না দিয়ে ব্যাগ থেকে তার স্পেশাল বইটা বের করে সালমার
হাতে দিলো। বলল, “নে, দেখ।”
সালমা বলল, “কী দেখব?”
“বইটার মাঝে আজব কিছু আছে কি না দেখ।“
সালমা টুনির হাত থেকে বইটা নিয়ে উল্টেপাল্টে ফেলল। রাজনীতির খুবই কাঠখোট্টা বই। এ রকম বই কে পড়ে আর কে লিখে সেটা একটা রহস্য। সালমা বলল, “খুবই অখাদ্য টাইপের বই।”
টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “আমি সেটা দেখতে বলি নাই। ভিতরে খুলে দেখ।”
সালমা বইটা খুলেও দেখল, অস্বাভাবিক কিছু পেল না। টুনি হাসি হাসি মুখ করে বলল, “এই বইয়ের মাঝে আমি রবীন্দ্রনাথের কবিতা লেখা একটা পৃষ্ঠা লুকিয়ে রেখেছি। দেখি তুই খুঁজে বের করতে পারিস কি না।
সালমা এবারে সামনে থেকে পিছনে, পিছন থেকে সামনে পৃষ্ঠাগুলি উল্টেপাল্টে দেখেও সেই পৃষ্ঠাটি খুঁজে পেল না। টুনি তখন রাজ্য জয়ের ভঙ্গি করে বইয়ের ভেতর এক জায়গা থেকে একটা কাগজ বের করে দিলো, বলল, “দেখেছিস? এই কাগজটা এখানে লুকানো আছে—কেউ খুঁজে পাচ্ছে না। তার মানে বুঝেছিস?”
“কী?”
“আমি ফিরোজার পাঠ্যবইয়ের ভিতর এই কায়দায় গল্পের বই ঢুকিয়ে দেবো। তার বাসার কেউ খুঁজলেও কিছু পাবে না—কিন্তু ফিরোজা বের করে পড়তে পারবে।“
সালমা একটু ইতস্তত করে বলল, “একটা পৃষ্ঠা লুকানো সম্ভব কিন্তু আস্ত বই?”
টুনি বলল, “সেটা সত্যি। হয়তো একবারে পুরো বই দেওয়া যাবে না, অল্প অল্প করে দিতে হবে। কিংবা বেশ কয়েকটা বই মিলে একটা বই।”
সালমার সন্দেহ তবু যায় না। বলল, “কিন্তু যদি কখনো ধরা পড়ে তাহলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।”
টুনি মাথা নাড়ল, “তা ঠিক। কিন্তু দেখি ফিরোজা সাহস করে কি না। সে যদি সাহস না করে তাহলে আমার এই প্রজেক্ট বাতিল।”
কিন্তু প্রজেক্ট বাতিল করতে হলো না। বই পড়ায় ফিরোজার এতই আগ্রহ যে সে এই ঝুঁকি নিতে রাজি। টুনি তখন কাজ শুরু করে দিলো। ফিরোজা কী কী বই পড়তে চায় তার একটা লিস্ট করে নিল। সব বই-ই নেটে পাওয়া যায়, সেগুলো সে একটু ছোট করে কাগজের এপিঠ-ওপিঠ প্রিন্ট করে নিল। তারপর ফিরোজার পাঠ্যবইগুলোর বেশ কিছু পৃষ্ঠার পাশ থেকে কয়েক মিলিমিটার কাগজ কেটে সেখানে সাবধানে পৃষ্ঠাগুলো ঢুকিয়ে রাখল। একটা বই মাঝে মাঝেই কয়েকটা বইয়ের মাঝে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দিতে হতো—তাতে ফিরোজার কোনো সমস্যা নাই।
প্রথম প্রথম ফিরোজা খুবই নার্ভাস ছিল, কিন্তু কয়েক দিনের ভেতরেই তার সাহস বেড়ে গেল। তার আব্বু-আম্মুর চোখের সামনেই সেই বই পড়তে শুরু করে দেয়। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে, তার কোনো বই লুকিয়ে রাখতে হচ্ছে না—তার পড়ার টেবিলে পাঠ্যবইগুলো সবার সামনে—সেগুলোর ভেতর লুকিয়ে আছে অসাধারণ মজার মজার বই।
শুধু যে বই পড়তে পারছে তা-ই নয়—সে আজকাল লিখতেও পারছে। টুনি তাকে খুব সুন্দর একটা নোট বই দিয়েছে। সকালে ক্লাসে যাওয়ার পর টুনি সেটা তাকে দিয়ে দেয়। সারা দিন ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে সেখানে সে তার ইচ্ছে মতন লিখে। বিকেলে বাসায় যাওয়ার সময় নোট বইটা টুনিকে দিয়ে দেয়। টুনি কথা দিয়েছে সে পড়বে না—মাঝে মাঝে ফিরোজা এক- দুই পৃষ্ঠা পড়তে দেয়। টুনি পড়ে অবাক হয়ে যায়। সাদাসিধে এই মেয়েটার হাতে নিশ্চয়ই জাদু আছে—এত সুন্দর করে সে কেমন করে লিখে?
এইভাবে বেশ কিছুদিন কেটে যায়, তখন একটা মজার ঘটনা ঘটল।
* * *
নার্গিস ম্যাডাম ক্লাসে ঢুকে বললেন, “আমার কিছুক্ষণের জন্য বাইরে যেতে হবে, খুব জরুরি কাজ। যতক্ষণ আমি নাই ততক্ষণ তোমরা শান্ত হয়ে বসে থাকতে পারবে?”
নার্গিস ম্যাডাম তাদের বাংলা পড়ান। একসময় এই নার্গিস ম্যাডাম ছিলেন সবচেয়ে ভয়ংকর ম্যাডাম। কারো দিকে তাকলেই তার বুকে ধুকধুকানি শুরু হয়ে যেত। তারপর টুনির সাথে একটা ঘটনার পর সম্পর্ক সহজ হয়েছে। একসময় ক্লাসের ছেলেমেয়েরা কল্পনাও করতে পারত না যে তারা সহজভাবে নার্গিস ম্যাডামের সাথে কথা বলছে। আজকাল একটু ভয়- ভয় করলেও তারা মোটামুটি কথা বলতে পারে।
নার্গিস ম্যাডাম আবার জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা শান্তভাবে বসে থাকতে পারবে?”
টুনি সাহস করে বলল, “মনে হয় না।”
ম্যাডাম চোখ বড় বড় করে বলল, “কেন মনে হয় না?”
টুনি বলল, “শান্ত হয়ে বসে থাকা খুব কঠিন। সবাই একটু একটু কথা বলবে।”
নার্গিস ম্যাডাম বলল, “তাহলে একটা কাজ দিয়ে যাই?”
“কী কাজ ম্যাডাম?”
“সবাই বসে বসে কিছু একটা লিখো।”
“কী লিখব ম্যাডাম?”
“তোমরা বলো কী নিয়ে লিখতে চাও।”
মৌটুসী হাত তুলে বলল, “চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে আমাদের দায়িত্ব এবং কর্তব্য।”
টুনির নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না যে কেউ এ রকম একটা বিষয়ের ওপর কিছু একটা লিখতে চাইতে পারে। শুধু টুনি না, ক্লাসের অন্য ছেলেমেয়েরাও একসাথে যন্ত্রণার মতো শব্দ করল।
টুনি বলল, “মজার কিছু লিখতে দেন ম্যাডাম। “ নার্গিস ম্যাডাম বললেন, “মজার কিছু?”
ছেলেমেয়েরা এটা পছন্দ করল, অনেকেই বলল “জি ম্যাডাম।“
নার্গিস ম্যাডাম জিজ্ঞেস করলেন, “কোনটা মজার জিনিস?”
নাদুসনুদুস একজন ছেলে বলল, “ফ্রায়েড চিকেন।”
সারা ক্লাসের সবাই হি হি করে হেসে উঠল, নার্গিস ম্যাডামও হেসে ফেললেন। হাসি থামিয়ে বললেন, “না। বাংলা ক্লাসে আমি তোমাদের ফ্রায়েড চিকেন নিয়ে লিখতে দিবো না।” তারপর খানিকক্ষণ চিন্তা করে বললেন, “মজার একটা জিনিস হচ্ছে বই। কাজেই বই নিয়ে লিখো।”
একজন জিজ্ঞেস করল, “কোন বই নিয়ে লিখব?”
“তোমার প্রিয় বই নিয়ে লিখো।”
“প্রিয় বই?”
“হ্যাঁ। শিরোনাম হচ্ছে, আমার প্রিয় বই। ঠিক আছে?”
সবাই মাথা নাড়ল, কেউ জোরে জোরে, কেউ আস্তে আস্তে।
নার্গিস ম্যাডাম চলে যাবার পর প্রথমে সবাই একজন আরেকজনের সাথে একটু কথা বলল, তারপর খাতা-কলম বের করে লিখতে শুরু করল। টুনি ফিরোজার দিকে তাকিয়ে দেখল অনেকক্ষণ, সে কিছু না লিখে গালে হাত দিয়ে চুপচাপ বসে রইল। তারপর লিখতে শুরু করল। আজকে না জানি কোন বই নিয়ে লিখবে!
নার্গিস ম্যাডাম যখন তার কাজ সেরে ফিরে এসেছেন ততক্ষণে প্রায় সবারই লেখা শেষ হয়ে গেছে। যাদের তখনও শেষ হয় নাই তাদের লেখা কোনোদিন শেষ হবে সে রকম কোনো লক্ষণ নেই।
নার্গিস ম্যাডাম জিজ্ঞেস করলেন, “সবাই লিখেছো?”
সবাই বলল, “জি ম্যাডাম।” কেউ জোরে, কেউ আস্তে, কেউ নিঃশব্দে।
নার্গিস ম্যাডাম বললেন, “কে তার লেখাটা পড়ে শোনাবে?”
শুধু মৌটুসি উঁচু করে হাত তুলল। অন্যেরা বেশিরভাগই যন্ত্রণার মতো শব্দ করল। তাদের কিছু একটা লেখার কথা ছিল। সেই লেখাটা পড়ে শোনাতে হবে এ রকম কথা ছিল না।
নার্গিস ম্যাডাম মৌটুসিকে পড়তে বললেন, মৌটুসি পড়ে শোনাল। তার প্রিয় বই হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের ‘সঞ্চয়িতা’। রবীন্দ্রনাথের কবিতা যে কী অসাধারণ এবং মৌটুসি যে সেই কবিতাগুলোর ছন্দ এবং বিষয়বস্তু তার মস্তিষ্ক এবং হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে পারে, সেটা পড়ে শোনাল। ক্লাসের প্রায় সবাই সেই বর্ণনা শুনে ঠোঁট ওল্টাল—তাদের সবারই ধারণ ছিল প্রিয় বই হওয়ার কথা কোনো অ্যাডভেঞ্চার না-হয় ডিটেকটিভ কাহিনি। তা ছাড়া টুনির কেমন জানি সন্দেহ হতে থাকে এই বর্ণনাগুলো সে আগে কোথাও শুনেছে—কোনো গাইড বইয়ে।
পড়া শেষ হলে নার্গিস ম্যাডাম বললেন, “চমৎকার লিখেছো মৌটুসি।” তারপর অন্যদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “এখন কে পড়বে?”
কেউ নিজের থেকে পড়ার আগ্রহ দেখাল না। তখন রাজু সাহস করে হাত তুলল। তার প্রিয় বই হুমায়ূন আহমেদের ‘বোতল ভূত’। কেন এটা প্রিয় রাজু বেশ সুন্দর করে লিখেছে। এরপর আরো কয়েকজন পড়ার জন্য হাত তুলল। কেউ অ্যাডভেঞ্চার নিয়ে লিখেছে, কেউ ডিটেকটিভ। একজন ভূতের একটা বইয়ের কথা লিখেছে। তখন টুনি হাত তুলল। নার্গিস ম্যাডাম বললেন, “ঠিক আছে, টুনি তুমি পড়ো তোমার লেখা।”
টুনি জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, “না না ম্যাডাম, আমি পড়তে চাই না।”
“তাহলে?”
“আমি ফিরোজা কী লিখেছে সেটা শুনতে চাই।”
টুনির কথা শুনে নার্গিস ম্যাডাম একটু অবাক হয়ে টুনির দিকে তাকালেন। ফিরোজা তখন ফ্যাকাসে হয়ে মাথা নাড়তে থাকে, সে মোটেও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজের লেখা পড়তে চায় না। টুনি বলল, “ফিরোজা খুব সুন্দর লিখতে পারে ম্যাডাম কিন্তু মোটেও কিছু পড়ে শোনায় না।”
নার্গিস ম্যাডাম ফিরোজার দিকে তাকালেন, বললেন, “ফিরোজা, শুনি তুমি কী লিখেছো।”
ফিরোজা দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে বলল, “ম্যাডাম! আমি পারব না ম্যাডাম, প্লিজ ম্যাডাম। আমাকে পড়তে বলবেন না ম্যাডাম।“
নার্গিস ম্যাডাম একটু অবাক হলেন, বললেন, “কেন?”
“আমার লজ্জা করে ম্যাডাম।”
“লজ্জার কী আছে?”
ফিরোজা তার মাথা আরো নিচু করল, বলল, “অনেক বেশি লজ্জা করে ম্যাডাম।”
টুনি তখন ফিরোজার খাতটা টেনে নিয়ে বলল, “ঠিক আছে, আমি পড়ে শোনাচ্ছি।”
ফিরোজা কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, “না, টুনি। প্লিজ না।”
টুনি পড়তে শুরু করে থেমে গেল। তারপর নার্গিস ম্যাডামের দিকে তাকিয়ে বলল, “ম্যাডাম।”
নার্গিস ম্যাডাম বললেন, “কী হলো?”
“আমি পড়লে ফিরোজা আমাকে খুন করে ফেলবে। আপনি পড়বেন? আমি চাই ফিরোজার লেখা কত সুন্দর আপনি সেটা দেখেন। প্লিজ ম্যাডাম।“
নার্গিস ম্যাডাম হাসলেন, তারপর বললেন, “দাও। খাতাটা আমাকে দাও।”
ফিরোজার চোখ দিয়ে রীতিমতো আগুন বের হতে থাকে, টুনি সেই আগুন সহ্য করে নার্গিস ম্যাডামকে তার খাতা দিয়ে এলো। নার্গিস ম্যাডাম লেখাটাতে চোখ বুলালেন, হঠাৎ করে তার মুখে প্রথমে বিস্ময় তার পরে আনন্দের একটা ছায়া পড়ল। ফিরোজার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বললেন, “তুমি এটা এখন বসে বসে লিখেছো?”
ফিরোজা মাথা নাড়ল।
“তুমি এটা পড়ে শোনাতে চাও না?”
ফিরোজা মাথা নাড়ল। সে পড়ে শোনাতে চায় না।
নার্গিস ম্যাডাম বললেন, “কিন্তু আমি এটা সবাইকে পড়ে শোনাতে চাই। আমি যেহেতু তোমাদের শিক্ষক, আমি চাইলে এটা সবাইকে পড়িয়ে শোনাতে পারব। ঠিক আছে?”
ফিরোজা কিছু বলল না। নিঃশব্দে মাথা নিচু করে বসে পড়ল। ম্যাডাম তখন পড়ে শোনাতে লাগলেন।
“সব মানুষেরই প্রিয় অনেক কিছু থাকে—প্রিয় রং, প্রিয় গান, প্রিয় মানুষ—আমার প্রিয় শুধু একটি জিনিস, সেটি হচ্ছে বই। আমি যখন বইয়ের কথা চিন্তা করি তখন আমার কী অবাক লাগে। একজন লেখকের চিন্তা-ভাবনা, কল্পনা, আনন্দ-দুঃখ সবকিছু কেমন আশ্চর্যভাবে কয়েকটা পৃষ্ঠার মাঝে স্ফটিকের মতো জমা হয় আর আমরা সেটা আমাদের হৃদয় দিয়ে অনুভব করি…”
নার্গিস ম্যাডাম পড়তে থাকলেন আর সবাই হাঁ করে শুনতে থাকে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার, ফিরোজা নির্দিষ্ট কোনো বইয়ের কথা লিখেনি—সে লিখেছে কীভাবে পুরো জীবন তার সবচেয়ে প্রিয় বইটি খুঁজে বেড়াবে তার কথা। তার প্রিয় বইটি কেমন হবে সেটি নিয়ে তার কল্পনা।
পড়া শেষ হবার পর সবাই চুপ করে রইল। টুনি সাহস করে বলল, “ম্যাডাম, আমরা হাততালি দিতে পারি?”
নার্গিস ম্যাডাম বললেন, “হ্যাঁ, দিতে পারো।”
সবাই হাততালি দিলো, অতি-উৎসাহী কয়েজন হাততালি দিয়েই থেমে গেল না “হুই হুই” করে চিৎকারও করল।
হইচই থেমে যাবার পর নার্গিস ম্যাডাম বললেন, “তোমরা কি ফিরোজার লেখার আসল বৈশিষ্ট্যটি দেখেছো?”
সবাই জিজ্ঞেস করল, “কী বৈশিষ্ট্য?”
“তার ভাষা, শব্দ চয়ন, বাক্য গঠন—সবকিছু খুব চমৎকার, যত বড় হবে তত ভালো হবে। কিন্তু যেটি সে এখনই শিখে ফেলেছে সেটি হচ্ছে বিষয়টাকে সম্পূর্ণ অন্য একটা দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা—যেটাকে আমরা সৃষ্টিশীল বলি। এত ছোট একটি মেয়ের মাঝে সেটি দেখা আসলেই বিস্ময়কর—”
নার্গিস ম্যাডাম কথা বলতে থাকলেন আর ফিরোজা তার মাথা নিচু করতে থাকল। খুব সাবধানে সে চোখের কোনা থেকে পানি মুছে ফেলল।
* * *
ফিরোজা যেদিন টুনির কায়দা করে দেওয়া সাতচল্লিশ নম্বর বইটা পড়ছিল সেদিন সে তার বাবা-মায়ের কাছে ধরা পড়ে গেল।
লুকানো বই পড়তে পড়তে ফিরোজার সাহস দিনে দিনে বেড়ে গিয়েছিল। সেদিন স্কুলের বই পড়া শেষ করে তার গণিত বইটা খুলেছে। সে যে বইটা প্রায় শেষ করে ফেলেছে তার শেষ কয়েকটা পৃষ্ঠা এই বইয়ের ভেতর লুকানো। সে যখন তার বইটা পড়ছে তখন তার বাবা-মা সামনে সোফায় বসে কথা বলছিলেন। বাবা ফিরোজার মুখের দিকে তাকিয়ে ভুরু কুঁচকালেন। ফিরোজার মায়ের দিকে তাকিয়ে নিচু গলায় বললেন, “এই মেয়ে অঙ্ক বই পড়ে আর মিটিমিটি হাসে কেন? অঙ্কের মাঝে হাসির কী আছে?”
ফিরোজার মা বললেন, “এই মেয়েটা তো এই রকমই—”
“উঁহু।” ফিরোজার বাবা মুখ শক্ত করে বললেন, উঁহু। অন্য ব্যাপার আছে।”
“অন্য ব্যাপার? অন্য কী ব্যাপার?”
“অঙ্ক বইয়ের পিছনে অন্য বই আছে। উপন্যাস বই।”
ফিরোজার মা মাথা নেড়ে বললেন, “না না। অন্য বই নাই। আমি প্রত্যেকটি ব্যাগ খুলে দেখি না? আর কিছু নাই।”
“আছে।” ফিরোজার বাবা গর্জন করে উঠলেন। তারপর ফিরোজার দিকে তাকিয়ে গলা উঁচিয়ে বললেন, “এই ফিরোজা, তোর হাতে এইটা কোন বই?”
ফিরোজা ভয়ানক চমকে উঠল। ফ্যাকাসে মুখে বলল, “অঙ্ক বই।”
“অঙ্ক বই পড়ে বান্দরের বাচ্চার মতো হাসিস কেন?”
ফিরোজা আমতা আমতা করে বলল, “কই? হাসি নাই তো।”
“আমার সাথে রংবাজি?” ফিরোজার বাবা হুংকার দিলেন, “আমি কিছু বুঝি না? আমারে বেকুব পাইছস? আন তোর অঙ্ক বই আমার কাছে।”
ফিরোজা ফ্যাকাসে মুখে অঙ্ক বইটা নিয়ে গেল। ফিরোজার বাবা বইটি তার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখলেন—কিছু খুঁজে পেলেন না। তখন খপ করে ফিরোজার চুলের মুঠি ধরে একটা ঝাঁকুনি দিলেন, চিৎকার করে বললেন, “বল কোনখানে তোর উপন্যাস বই লুকাইছস। বল আমারে —“
ফিরোজা কিছু বলল না, তখন তার বাবা চুলের মুঠি ধরে কাছে টেনে এনে তার গালে প্রচণ্ড জোরে একটা চড় দিলেন—তারপর ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দিয়ে তাকে পা দিয়ে চেপে ধরলেন। চিৎকার করে বললেন, “বল, বইটা কোনখানে লুকাইছিস। না হলে তোরে খুন করে ফেলব আজকে।”
ভয়াবহ আতঙ্কে ফিরোজা তার বাবার দিকে তাকাল, প্রচণ্ড ক্রোধে বাবার মুখটা বিকৃত হয়ে আছে, মনে হচ্ছে সত্যিই তার বাবা তাকে খুন করে ফেলবে। সেই হিংস্র মুখটির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ করে ফিরোজার বুকের মাঝে তীব্র একটা অভিমান এসে ভর করে। ফিরোজা হঠাৎ করে বুঝতে পারে তার ভেতরে আর আতঙ্ক নেই—তার বদলে সেখানে শুধু অভিমান—সারা পৃথিবীর ওপর অভিমান। তার চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে যায়—সেই ঝাপসা চোখে সে তার বাবার হিংস্র মুখটাও দেখতে পায় না—তাকে লাথি মেরে ঘরের এক কোনায় ফেলে দেয়ার প্রচণ্ড ব্যথাটাও সে অনুভব করে না।
ফিরোজা কষ্ট করে দুই হাতে ভর দিয়ে উঠে বসার চেষ্টা করল, তারপর ফিসফিস করে বলল, “হ্যাঁ বাবা, আমি বই পড়েছি। লুকিয়ে লুকিয়ে আমি অনেক বই পড়েছি। আমাকে খুন করলেও এখন আমার মাথা থেকে সেই বই কেউ আর সরাতে পারবে না।”
ফিরোজা তীব্র চোখে তার বাবার দিকে তাকিয়ে থাকে। তার বাবা তাকে এখন খুন করে ফেলবে কিন্তু ফিরোজার ভেতরে আর ভয় নেই। ফিরোজার মনে হতে থাকে সে যেন তার পড়া একটি উপন্যাসের একটা চরিত্রের মতো রাইফেলের নলের সামনে দাঁড়িয়ে মাথা উঁচু করে অপেক্ষা করছে।
* * *
পর পর চার দিন ফিরোজা ক্লাসে এলো না। পঞ্চম দিনে নিচু ক্লাসের একটা ছেলে টুনিকে একটা কাগজ দিয়ে গেল। বলল, ফিরোজা তাকে এই কাগজটা দিয়েছে টুনিকে দেওয়ার জন্য—ফিরোজা তাদের বাসার কাছে থাকে।
টুনি কাগজটা খুলল, খুবই ছোট একটি চিঠি, ভিতরে লেখা—
টুনি
আমি আর স্কুলে আসব না—বাসা থেকে বলেছে আমার লেখাপড়া শেষ। আমার জন্য চিন্তা করিস না, তুই আমাকে অনেকগুলো বই পড়িয়েছিস। সেগুলো আমার মাথার মাঝে আছে। থাকবে।
তোরা ভালো থাকিস।
ফিরোজা
টুনি কমপক্ষে পঞ্চাশ বার চিঠিটা পড়ল, কেন লেখাপড়া শেষ সেই কথাটি লেখা নেই কিন্তু বুঝতে কোনো সমস্যা হয় না যে তার লুকিয়ে বই পড়াটা বাবা-মা ধরে ফেলে এই শাস্তি দিয়েছে। টুনির হাত কাঁপতে থাকে, ফিরোজার এই অবস্থার জন্য আসলে সে দায়ী। সে ফিরোজার জীবনটা ধ্বংস করে দিয়েছে। এখন কী হবে? এখন সে কী করবে?
টুনি স্কুলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চিন্তা করতে থাকে। যেহেতু তার জন্য এই সর্বনাশ, তার কিছু একটা করতেই হবে। কিন্তু সে কী করবে? সে নিজে মনে হয় কিছুই করতে পারবে না। বড় একজন মানুষকে সাথে নিতে হবে। কাকে সে নিতে পারে? নার্গিস ম্যাডাম?
টুনি আর দেরি করল না, তখন তখনই নার্গিস ম্যাডামকে খুঁজতে শুরু করল। স্কুলের টিচারদের কমন রুমে বড় টেবিলের এক পাশে বসে নার্গিস ম্যাডাম কিছু কাগজ টেবিলে বিছিয়ে কাজ করছেন। টুনি সাহস করে পা টিপে টিপে নার্গিস ম্যাডামের কাছে গেল। পাশে দাঁড়িয়ে ভয়ে ভয়ে বলল, “ম্যাডাম।”
নার্গিস ম্যাডাম মাথা ঘুরিয়ে তাকালেন। টুনিকে দেখে একটু অবাক হয়ে বললেন, “টুনি? কী ব্যাপার?”
“আপনার সাথে একটু কথা বলতে পারি?”
“আমার সাথে? কী কথা?”
টুনি এদিক-সেদিক তাকিয়ে গলা নামিয়ে বলল, “ম্যাডাম, আপনার ফিরোজার কথা মনে আছে? ওই যে খুব সুন্দর লিখে—”
ম্যাডাম মাথা নাড়লেন, বললেন, “হ্যাঁ। মনে আছে? কী হয়েছে ফিরোজার?”
“ফিরোজা চার দিন থেকে ক্লাসে আসে না। আজকে আমাকে এই চিঠিটা পাঠিয়েছে”, বলে টুনি নার্গিস ম্যাডামের হাতে ফিরোজার হাতে লেখা কাগজের টুকরাটা দিলো।
নার্গিস ম্যাডাম ফিরোজার চিঠিটা পড়লেন, কিন্তু কিছু বুঝতে পারলেন না। তখন চিঠিটা আবার পড়ে টুনির দিকে তাকিয়ে বললেন, “কী লিখেছে, কিছু বুঝতে পারছি না।“
টুনি মাথা নিচু করল, বলল, “সব দোষ আমার।”
“তুমি কী করেছো?”
“ফিরোজার বাসায় বই পড়া নিষেধ। কিন্তু ফিরোজার অনেক বই পড়ার শখ, সেই জন্য আমি লুকিয়ে ফিরোজাকে বই পড়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম।”
“তারপর?”
“ফিরোজা প্রায় পঞ্চাশটা বই এর মাঝে পড়ে ফেলেছে।”
নার্গিস ম্যাডাম টুনির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। টুনি বলল, “শেষ পর্যন্ত মনে হয় ফিরোজা ধরা পড়ে গেছে। এখন তার আব্বু-আম্মু ফিরোজার লেখাপড়া বন্ধ করে দিয়েছে।”
নার্গিস ম্যাডাম অবাক হয়ে বললেন, “বই পড়ার জন্য লেখাপড়া বন্ধ করে দিয়েছে?”
টুনি মাথা নাড়ল। নার্গিস ম্যাডাম বললেন, “তুমি সিওর?”
“জি ম্যাডাম।” টুনি মাথা নিচু করে বলল, “সব আমার দোষ। ফিরোজা বলেছিল ধরা পড়লে তাকে মারবে, লেখাপড়া বন্ধ করে দেবে, তারপরও আমি তাকে বই পড়তে দিয়েছি।”
নার্গিস ম্যাডাম কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, “তুমি আমার কাছে কেন এসেছো?”
টুনি কাতর গলায় বলল, “কিছু একটা করা যায় না ম্যাডাম?”
নার্গিস ম্যাডাম অন্যমনস্কভাবে টেবিলে আঙুল দিয়ে টোকা দিতে লাগলেন, তারপর বললেন, “দেখি।”
টুনি বলল, “যদি ফিরোজার বাসায় তার আব্বু-আম্মুর সাথে কথা বলতে যান, তাহলে আমাকে সাথে নিয়ে যাবেন, প্লিজ!”
“তুমি? তুমি কেন?”
টুনি মাথা নিচু করল, বলল, “গিয়ে বলব ফিরোজার কোনো দোষ নাই। সব দোষ আমার।”
নার্গিস ম্যাডাম একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, “দেখি আগে টেলিফোনে কথা বলে। যদি তাতে কাজ হয়ে যায় তাহলে হয়তো বাসা পর্যন্ত যেতে হবে না।”
টুনি অনুমান করল টেলিফোনে কথা বলে কাজ হবে না, তাদের বাসাতেই যেতে হবে, কিন্তু সে কিছু বলল না। তা ছাড়া নার্গিস ম্যাডাম ব্যাপারটা হাতে নিলে একটা সমাধান কি বের হবে না?
***
টুনির ধারণার সত্যি বের হলো, তাই নার্গিস ম্যাডামকে ফিরোজার বাসায় যেতে হলো। ম্যাডাম তার কথা রেখে টুনিকেও সাথে এনেছেন এবং যখন ফিরোজাদের বাইরের ঘরের সোফায় নার্গিস ম্যাডাম ফিরোজার বাবা-মায়ের সাথে বসেছেন তখন টুনি একটু দূরে আরেকটা চেয়ারে মাথা নিচু করে বসে আছে।
নার্গিস ম্যাডাম খুব সুন্দর করে কথা বলেন এবং বেশ কিছুক্ষণ থেকে ফিরোজার বিষয় নিয়ে কিছু না বলে অন্য নানা বিষয়ে কথা বলছেন। ফিরোজার বাবা-মা পাথরের মতো মুখ করে বসে আছেন। কথায় কোনো লাভ হচ্ছে কি না বোঝা যাচ্ছে না। নার্গিস ম্যাডাম শেষ পর্যন্ত ফিরোজার কথাটা ওঠালেন, বললেন, “আমি ফিরোজার বিষয়টা নিয়ে টেলিফোনে আপনাদের সাথে কয়েকবার কথা বলেছি—আপনারা বলেছেন যে আপনারা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছেন। আমি ভাবলাম তার পরেও সামনাসামনি একটু কথা বলি—”
ফিরোজার বাবা পাথরের মতো মুখ করে বললেন, “আপনাকে আমি টেলিফোনে বলে দিয়েছি যে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি। এই মেয়েকে স্কুল পাঠিয়ে লাভ থেকে ক্ষতি হয়েছে বেশি। লুকিয়ে লুকিয়ে পঞ্চাশটা উপন্যাস পড়েছে—”
নার্গিস ম্যাডাম বললেন, “কিন্তু —“
ফিরোজার বাবা কথা বলতে দিলেন না, “কীভাবে উপন্যাস পড়েছে শুনলে আপনি বেকুব হয়ে যাবেন। পাঠ্যবইয়ের মাঝে উপন্যাসের পৃষ্ঠা লুকানো, এমনভাবে লাকুনো যে বই ওল্টালেও সেগুলি দেখা যায় না। কত বড় বদমাইশ—“
নার্গিস ম্যাডাম আবার চেষ্টা করলেন, “কিন্তু বই পড়া—”
ফিরোজার বাবা মাথা নাড়লেন, বললেন, “না, না, না—এই মেয়ের আর লেখাপড়ার দরকার নাই। ঘরে থাকবে, সময় হলে বিয়ে দিয়ে দেবো।”
টুনি তখন হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। সবাই টুনির দিকে তাকাল, টুনি এক পা সামনে এসে বলল, “ম্যাডাম, আমি যাই।“
নার্গিস ম্যাডাম অবাক হয়ে বললেন, “তুমি কোথায় যাবে?”
“স্কুলে। সেখানে আমাদের ক্লাসের সবাই অপেক্ষা করছে। ফিরোজার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেলে মানববন্ধন করবে সবাই মিলে।”
ফিরোজার বাবা এবারে প্রথমবার টুনির দিকে তাকালেন, “মানববন্ধন?”
“জি। ফিরোজা লেখাপড়া শুরু না করা পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলবে।”
ফিরোজার বাবা চোখ বড় বড় করে বললেন, “আন্দোলন?”
“জি।”
“এই পাজি মেয়ের জন্য আন্দোলন?”
“জি। ফিরোজা মোটেও পাজি মেয়ে না চাচা – “
ফিরোজার বাবা দাঁত কিড়মিড় করে বললেন, “পাজি না? তুমি জানো সে কত বড় ধুরন্ধর? কীভাবে পাঠ্যবইয়ের মাঝে আউট বই লুকায় তুমি জানো?”
টুনি বলল, “জানি চাচা। ওইটা ফিরোজা করে নাই। আমি ফিরোজাকে করে দিয়েছিলাম। ওইটা যদি দোষ হয়, তাহলে ফিরোজার কোনো দোষ নাই। দোষ আমার।“
ফিরোজার বাবা চোখ কপালে তুলে বললেন, “তুমি? তুমি করে দিয়েছিলে?”
টুনি মাথা নাড়াল, বলল, “জি চাচা।” তারপর নার্গিস ম্যাডামের দিকে তাকিয়ে বলল, “ম্যাডাম আমি যাই। সাংবাদিকদের বলতে হবে।”
ফিরোজার বাবা শুকনো মুখে বললেন, “সাংবাদিক? সাংবাদিক কোথা থেকে এসেছে?”
টুনি বলল, “এখনও আসে নাই। আসবে। তাদের সাথে যোগাযোগ করা হয়েছে। আমি নিজে করি নাই, আমার ছোট চাচা করে দিয়েছেন।”
“তোমার ছোট চাচা কে?”
“ডিটেকটিভ শাহরিয়ার। তার ডিটেকটিভ এজেন্সি আছে, দি আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সি।” তারপর আবার নার্গিস ম্যাডামের দিকে তাকিয়ে বলল, “ম্যাডাম, আমি যাই। ফিরোজার লেখাগুলি ফটোকপি করে সাংবাদিকদের দিতে হবে।”
“ফিরোজার লেখা? ফিরোজার কোন লেখা?”
নার্গিস ম্যাডাম বললেন, “আমি ঠিক জানি না কোন লেখা। সে এমনিতে খুব ভালো লেখে আমি জানি—”
টুনি বলল, “আমরা ফিরোজাকে একটা খুব সুন্দর নোটবই দিয়েছি। সেখানে ফিরোজা প্রত্যেক দিন কিছু-না-কিছু লিখে। বাসায় আনে না, আমার কাছে থাকে—”
ফিরোজার বাবা ফিরোজার মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “দেখেছো? যেটা ভয় পেয়েছিলাম, ঠিক সেইটা হয়েছে।”
টুনি বলল, “আমার ছোট চাচা ফিরোজার লেখাগুলো দেখেছেন। বলেছেন অসাধারণ লেখা। পাবলিশারের সাথে কথা বলেছেন, তারা বলেছে বই ছাপিয়ে দেবে—”
ফিরোজার বাবা বললেন, “বই?”
“জি। বইয়ের নামও ঠিক করেছি, বন্ধ ঘরে আর্তনাদ—”
“বন্ধ ঘরে আর্তনাদ?”
“জি। আমি তাহলে যাই। হাতে সময় নাই।”
টুনি বের হয়ে যাওয়ার পর ঘরের ভেতর কিছুক্ষণ কেউ কোনো কথা বলল না, তারপর ফিরোজার মা এই প্রথম কথা বললেন, জিজ্ঞেস করলেন, “এই মেয়ে কে?”
নার্গিস ম্যাডাম একটু হাসলেন, বললেন, “এর নাম টুনি। আমার প্রিয় ছাত্রী। খুবই ডেঞ্জারাস মেয়ে। সে একবার একজন দুর্ধর্ষ ক্রিমিনালকে ধরেছিল, তখন পত্রিকায় তার ওপর লেখা বের হয়েছিল। সেটা পড়লে বুঝবেন।“
ফিরোজার বাবা এবং মা তখন একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকলেন। ফিরোজার বাবা বললেন, “এই মেয়ে যে সাংবাদিকদের কথা বলল, মানববন্ধনের কথা বলল, সেইগুলো সত্যি?”
“নিশ্চয়ই সত্যি। টুনি মেয়েটা বাজে কথার মানুষ না। বিষয়টা তো সাংবাদিকদের খুবই প্রিয় একটা বিষয় হওয়ার কথা! যোগাযোগ করলে তারা লুফে নেবে।”
ফিরোজার বাবা তখন আরেকবার ফিরোজার মায়ের মুখের দিকে তাকালেন। নার্গিস ম্যাডাম বললেন, “আমি আপনাদের আরো একবার অনুরোধ করব, ফিরোজাকে স্কুলে পাঠান। আপনার মেয়ে কী অসাধারণ একটি মেয়ে আপনারা বুঝতে পারছেন না। এই মেয়ে যখন বড় হবে তখন আপনারা তাকে নিয়ে গর্ব করবেন।”
ফিরোজার বাবা-মা চুপ করে রইলেন। নার্গিস ম্যাডাম বললেন, “প্রতি বছর আমাদের স্কুল থেকে একটা বার্ষিক ম্যাগাজিন বের হয়। স্কুলের ছেলেমেয়েরা, শিক্ষকেরা সেখানে লিখে। আমি যেহেতু বাংলার শিক্ষক, তাই আমার ওপর সম্পাদনার দায়িত্ব থাকে। আমি ঠিক করেছি এই বছর ফিরোজাকে আমি সহকারী সম্পাদক হিসেবে নেব। আমাকে সাহায্য করবে।“
ফিরোজার মা একটা নিশ্বাস ফেলে মাথা নিচু করে বসে রইলেন। নার্গিস ম্যাডাম বললেন, “আপনাদের বুঝতে হবে এই দেশের মেয়েরা একটা বিপ্লব করছে, রেনেসাঁ করছে—সব জায়গায় মেয়েরা ভালো করছে, সেটা ফুটবল খেলা হোক আর গবেষণা হোক—আপনার মেয়ে সেই বিপ্লবের অংশ—তাকে তার অংশটা করতে দিন। বই পড়া মোটেও অপরাধ নয়—আমরা সবসময় আমাদের ছাত্রছাত্রীদের বলি, বই পড়ো বই পড়ো বই পড়ো। সরকার থেকে আদেশ এসেছে সব প্রতিযোগিতার পুরস্কার হিসেবে বই দিতে হবে। কোটি কোটি টাকার বই কিনে স্কুলে স্কুলে দেওয়া 2602…”
নার্গিস ম্যাডাম কথা বলতেই থাকলেন এবং ফিরোজার বাবা-মা শুনতে লাগলেন। তাদের কঠিন মুখ ধীরে ধীরে কোমল হলো এবং একসময় ফিরোজার বাবা চোখ মুছে বললেন, “সেদিন এত রাগ উঠে গিয়েছিল আর মেয়েটাকে এমনভাবে মেরেছি…”
নার্গিস ম্যাডাম চলে আসার সময় ফিরোজার সাথে দেখা করে এলেন। সে পুরো সময়টাতেই দরজার পাশে দাঁড়িয়ে সব কথাবার্তা শুনেছে। নার্গিস ম্যাডাম যখন আদর করে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন তখন সে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল।
* * *
পরদিন ফিরোজাকে স্কুলে দেখে সব ছেলেমেয়ে হইহই করে উঠল। তার বাম চোখের নিচে কালো দাগটি কেউ দেখেনি এ রকম ভান করল। তাকে দেখে সবাই যত খুশি হলো তার থেকে বিরক্ত হলো অনেক বেশি।
বিরক্ত হবে না কেন? সবাই মিলে অসাধারণ একটা আন্দোলন করার যে বিশাল পরিকল্পনা করে রেখেছিল সেটা মাটি হয়ে গেল।
আবার কবে এ রকম একটা সুযোগ আসবে কে জানে?