বন্ধ ঘরের রহস্য
বলসোভার স্কোয়ারের ১০৯ নম্বর বাড়ির নিচতলার প্যাসেজের শেষ মাথার ঘরটা সব সময় বন্ধ থাকে কেন? জানার খুব ইচ্ছে এমেলিয়া জেঙ্কিনসের। কিন্তু বন্ধ ঘরের রহস্য জানার সৌভাগ্য হয়তো কোনদিনই হবে না ওর। কারণ ওর মনিবনী, মিসেস বিশপ এমন বদমেজাজী মানুষ, এমেলিয়ার কৌতূহলের কথা ঘুণাক্ষরেও টের পেয়ে গেলে ওকে পিটিয়েই মেরে ফেলবেন। দিন কয়েক আগে এমেলিয়া চুরি করে এক চামচ স্ট্রবেরী জ্যাম খেতে গিয়েছিল, ধরা পড়ে যায় ও। মিসেস বিশপ শুধু ঠাণ্ডা চোখে ওর দিকে তাকিয়েছিলেন, তাতেই হার্টবিট বন্ধ হবার জোগাড় হয়েছিল এমেলিয়ার। কঠিন গলায়, চিবিয়ে চিবিয়ে তিনি তিনি সাবধান করে দিয়েছিলেন-এমেলিয়াকে ভবিষ্যতে কোনদিন আর কিছু চুরি করে খেতে দেখলে মুখ ভেঙে দেবেন।
মহিলাকে যমের মত ডরায় এমেলিয়া। ওর যাবার কোন জায়গা নেই। নইলে ঠিক কোথাও চলে যেত। বাপ-মা মরা এতিম মেয়ে। পেকহ্যাম থেকে ওকে নিয়ে এসেছেন মিসেস বিশপ। বিধবা মহিলার বাড়িতে দিনভর খাটে। কিন্তু মহিলা ওর সাথে মোটেও ভাল ব্যবহার করে না। মহিলার স্বামী মারা গেছে কবে কে জানে, এখনও ডাঁটফাট কমেনি। সোনালি চুলগুলো সব সময় পরিপাটি করে আঁচড়ে রাখেন, কৃত্রিম আই ল্যাশ পরেন চোখে, লম্বা, ম্যানিকিওর করা নখ নিয়ে তাঁর গর্বের সীমা নেই।
মিসেস বিশপকে ভয় পায় এমেলিয়া। তারপরও মহিলা বাইরে গেলে তাঁর বেডরূমে ঢুকে সাজগোজের লোভ সামলাতে পারে না কিছুতেই। সাজ বলতে মিসেস বিশপের লাল রঙের একটা ফ্যান্সি ড্রেস পরা। ওটার হাড়ের তৈরি বোতামগুলো জ্বলজ্বল করে। দেখলেই বোঝা যায় খুব দামী। স্কার্টটা পরে আয়নার সামনে নিজেকে বারবার দেখে এমেলিয়া। তারপর আবার পোশাকটা খুলে, আগের মত ভাঁজ করে রেখে দেয় ওয়ারড্রোবে।
মিসেস বিশপ সম্পর্কে বলতে গেলে কিছুই জানে না এমেলিয়া। তাই দুধঅলা বা হকারের কাছে তাঁর সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেয়ার চেষ্টা করে। একদিন দুধঅলাকে সে প্রশ্ন করল, ‘মিসেস বিশপের স্বামী কি করতেন জানো কিছু?’
তরুণ এই দুধঅলাটি মনে মনে পছন্দ করে এমেলিয়াকে। প্রায়ই সে ফুল নিয়ে আসে মেয়েটির জন্যে।
‘না তেমন কিছু জানি না,’ জবাব দিল দুধঅলা। তবে শুনেছি ব্যবসা করতেন। দেশের বাইরে, ব্যবসার কাজে গিয়ে নাকি মারা গেছেন তিনি। ফ্রান্সের কোথায় যেন। ভদ্রলোকের মাথা ভর্তি সাদা চুল ছিল। মিসেস বিশপের বাবা বলে অনেকেই ভুল করত তাকে।
‘উনি স্বামীকে ভালবাসতেন কিনা সন্দেহ আছে আমার,’ বলল এমেলিয়া। ‘ভালবাসার ব্যাপারটাই বোধহয় ভদ্রমহিলার মধ্যে নেই।’
হেসে উঠল দুধঅলা। ‘আজকালকার আধুনিক মেয়েরা তাদের স্বামীদের তেমন পাত্তা-টাত্তা দিতে চায় না। মিসেস বিশপও হয়তো তাদের একজন। কেন, এখানে ভাল লাগছে না তোমার?’
করুণ মুখ করে জবাব দিল এমেলিয়া, ‘না। তবে বাইরের জগৎ এরচে ও খারাপ। তাই কোথাও যাবার সাহস পাই না।’
‘তাহলে এখানেই থেকে যাও,’ পরামর্শের সুরে বলল দুধঅলা। ‘অন্তত ভাল কোথাও চলে যাবার সুযোগ না পাওয়া পর্যন্ত।’
এমেলিয়ার আসলেই কোথাও যাবার জায়গা নেই। টাকা থাকলেও না হয়. কেটে পড়ার ধান্ধা করত। কিন্তু মিসেস বিশপ ওকে এত কম বেতন দেন যে নিজের টুকিটাকি জিনিস কেনার পর হাতে প্রায় কিছুই থাকে না। তারপরও এমেলিয়া সুযোগের অপেক্ষায় আছে। হাতে কিছু টাকা এলেই এখান থেকে চলে যাবে। এমেলিয়ার বিশ্বাস, মিসেস বিশপ ওই বন্ধ ঘরে টাকা-পয়সা রাখেন। একদিন সে এক অদ্ভুত স্বপ্নও দেখে ফেলল ঘরটিকে নিয়ে। দেখল মিসেস বিশপ ড্রইংরুমের ফায়ার প্লেসের ডান পাশে রাখা একটি সিন্দুক থেকে একজোড়া চাবি নিয়ে সটান ঢুকে পড়লেন সেই বন্ধ ঘরে। তার পিছু নিয়েছিল এমেলিয়া। কিন্তু সে ভেতরে যাবার আগেই দরজা বন্ধ করে দিলেন মিসেস বিশপ। দরজা বন্ধ হবার আগে সে শুধু দেখতে পেল ঘরের মাঝখানে বড় একটা পালঙ্ক। বাইরে দাঁড়িয়ে এমেলিয়া শুনতে পেল ভেতরে পয়সা গোনার টুংটাং শব্দ হচ্ছে।
‘যা ভেবেছি তাই,’ বিড়বিড় করল এমেলিয়া। ‘ও ঘরে টাকা লুকিয়ে রেখেছেন মিসেস বিশপ।’
সে ভেতরের দৃশ্য দেখার জন্যে চোখ রাখল কী হোলে। সাথে সাথে কি যেন গরম একটা ঢুকে গেল চোখে, ভয়ানক জ্বলতে লাগল। ব্যথাটা এত বাস্তব, ঘুম ভেঙে গেল এমেলিয়ার। এতক্ষণ স্বপ্ন দেখেছে বিশ্বাস হতে চাইছে না ওর। বন্ধ ঘরের রহস্য ভেদ করার আগ্রহ বেড়ে গেল কয়েক গুণ। ‘ওখান থেকে কিছু টাকা যদি সরাতে পারি,’ নিজের মনে বলল এমেলিয়া, ‘তাহলে সাথে সাথে এখান থেকে চলে যাব। লন্ডন বিরাট শহর। লুকোবার অনেক জায়গা আছে। পুলিশ খুঁজেও পাবে না। আর ধরা পড়লেই বা কি, এই নরকের চেয়ে জেলখানা নিশ্চয়ই খারাপ হবে না। সারাক্ষণ ওই মহিলার ধমকের ভয়ে সিটিয়ে থাকার চেয়ে চলে যাওয়া অনেক ভাল।’
স্বপ্নের বাস্তবায়ন ঘটানোর চেষ্টা চালাল এমেলিয়া বারকয়েক। কিন্তু যতবার সাহস করে ড্রইংরূমের দিকে পা বাড়াল, ততবারই কোন না কোন বাধা পেল। একবার হলঘর থেকে সে ড্রইংরূমে ঢুকবে ভাবছে, হঠাৎ মনে হলো মিসেস বিশপ পিছু পিছু আসছেন ওর, ঘুরলেই তাঁর ঠাণ্ডা, নীল চোখ জোড়া দেখতে পাবে, কটমট করে তাকিয়ে আছেন ওর দিকে। আরেকবার মাঝরাতে সে চুপি চুপি নেমে এসেছে নিচে, পায়ের শব্দ পেল পেছনে। ঝট করে ঘুরল এমেলিয়া। নাহ্, কেউ নেই পেছনে। কিন্তু এত ভয় লেগে উঠল, দৌড়ে সে ঢুকে গেল নিজের ঘরে, নিচতলায় নামার আর সাহসই পেল না। তবে দিন কয়েক পরে এমেলিয়ার বহুল প্রত্যাশার সুযোগটি এল।
‘আমি বেরুচ্ছি, এমেলিয়া,’ মিসেস বিশপ বললেন ওকে, ‘ডিনারের আগে ফিরব না। কেউ ফোন করলে মেসেজ নিয়ে রাখবি।’
নতুন কেনা কোট আর স্কার্ট পরে গটগট করে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলেন তিনি। তাঁকে রাস্তার মোড় ঘুরতে দেখেই এক দৌড়ে তাঁর বেডরূমে ঢুকল এমেলিয়া। নতুন হ্যাট কিনেছেন মিসেস বিশপ। দামী, পার্শিয়ান হ্যাট। কালো হ্যাটটা পরার খুব লোভ এমেলিয়ার। অবশেষে সুযোগ পাওয়া গেছে। সে হ্যাটটা মাথায় চাপিয়ে দাঁড়াল আয়নার সামনে। দেখতে মন্দ নয় এমেলিয়া, কালো হ্যাটে মানিয়েও গেছে, মিসেস বিশপের চেয়ে অনেক বেশি সুন্দরী লাগল নিজেকে। হাসিমুখে এবার মিসেস বিশপের লাল কলারের নীল রঙের স্কার্টটা পরল ও। মনিবনীর চেয়ে হালকা পাতলা বলে পোশাকটা ঢিলে হলো গায়ে, তবে আয়নায় নিজের চেহারা দেখে রীতিমত মুগ্ধ এমেলিয়া। ড্রেসিং টেবিলে থরে থরে সাজানো দামী সব লিপস্টিক আর নেইল- পলিশ। ওগুলো ব্যবহার করার লোভ সামলাতে পারল না এমেলিয়া। মিসেস বিশপের ফরাসী হাইহিলও পায়ে গলাল। তারপর মুচকি হেসে আবার দাঁড়াল আয়নার সামনে। নিজেকে বারবার দেখেও আশ মেটে না এমেলিয়ার।
এখন এমেলিয়াকে দেখলে কে বলবে ও বাড়ির চাকরানী। মনিবনীর চেয়ে শতগুণ সুন্দর লাগছে ওকে। আয়নায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিজেকে দেখছে এমেলিয়া, এমন সময় বেজে উঠল ফোন। আতঙ্কিত হয়ে উঠল এমেলিয়া। একটানে হ্যাটটা ছুঁড়ে ফেলে, পাগলের মত জামা-কাপড় খুলতে লাগল। ওদিকে ফোন বেজেই চলেছে। এমেলিয়া আধা নগ্ন অবস্থায় গিয়ে ফোন ধরল। মেসেজ রাখার পর শান্ত হলো ও। তারপর আস্তে ধীরে পোশাকগুলো ভাঁজ করে আগের জায়গায় পরিপাটি অবস্থায় রেখে দিল। ওর বুক এখনও ধুকপুক করছে। এমেলিয়া ঠিক করল এখনই সে ড্রইংরূমে অভিযান চালাবে।
বাড়িতে কেউ নেই, তারপরও অভ্যাস মত চারপাশে চোখ বোলাল এমেলিয়া। এখনও মনে হচ্ছে কেউ ওকে গোপনে দেখছে। অথচ মিসেস বিশপকে দেখেছে সে চলে যেতে। মিসেস বিশপ চুপিচুপি আবার ফিরে আসেননি তো? সন্দেহমুক্ত হবার জন্যে এমেলিয়া বার দুই নক করল ড্রইংরুমের দরজায়। কোন সাড়া নেই। সাহস করে এবার সে দরজা খুলল, পা রাখল ভেতরে। খোলা জানালা দিয়ে সূর্যের আলো ঢুকছে, ঘরটা ঝকঝক করছে, এমেলিয়ার ভয় অনেকটাই কেটে গেল। দ্রুত পা চালাল সে ফায়ার প্লেসের দিকে। সিন্দুকে তালা মারা নেই। ডালা খুলতেই একটা চাবি চোখে পড়ল। স্বপ্নে দেখা সব ঘটনা বাস্তবে ঘটে যাচ্ছে। ‘ইস, ওই বন্ধ ঘরে যদি সত্যি টাকা থাকে,’ মনে মনে বলল এমেলিয়া, ‘তাহলে টাকা নিয়ে এক্ষুণি কেটে পড়ব। স্বাধীন হয়ে যাব আমি। স্বাধীন এবং ধনী।’
উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে দৌড় দিল এমেলিয়া প্যাসেজের শেষ মাথায়, বন্ধ ঘরের দিকে। দরজায় তালা মারা। চাবি ঢুকিয়ে মোচড় দিতেই খুলে গেল তালা, এমেলিয়ার চোখের সামনে উদ্ভাসিত হলো ঘরটা। ঘরের মাঝখানে, ওর স্বপ্নে দেখা পালঙ্কটা সত্যি আছে, এক কোনায় একটা আয়রন সেফ। এ ছাড়া আসবাব বলতে খান কয়েক চেয়ার এবং একটা আয়না। আয়নার দিকে মুগ্ধ চোখে তাকাল এমেলিয়া। আয়না ওকে সব সময় অভিভূত করে তোলে। আয়নার সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে কোন ক্লান্তি নেই ওর। কল্পনায় প্রায়ই ও নিজেকে ফিল্মের নায়িকা ভাবে। ভাবে অনেক টাকা থাকলে দামী দামী ড্রেস কিনে, সাজগোজ করলে ফিল্মের নায়িকাদের চেয়ে কোন অংশে খারাপ দেখাবে না ওকে। ঘরের এই আয়নাটার দিকেও তাকিয়ে রইল এমেলিয়া। পালঙ্কের পরিষ্কার প্রতিচ্ছবি পড়েছে আয়নায়। এমেলিয়া দেখল সাদা চুল, সাদা গোঁফের এক বুড়ো শুয়ে আছে বিছানায়, ঘুমুচ্ছে। হঠাৎ ফায়ার প্লেসের পাশে, দেয়ালের সাথে লাগানো আলমারির দরজা ফাঁক হয়ে গেল, ওখান থেকে বেরিয়ে এলেন এক মহিলা। মিসেস বিশপ। তবে বিছানায় শোয়া বুড়োর মত মিসেস বিশপেরও চারপাশে ধোঁয়াটে একটা পর্দা দেখা যাচ্ছে। মহিলার পরনে নীল সিল্কের ড্রেসিং গাউন, তাতে বড় বড় মুক্তোর বোতাম, পায়ে উলের জুতো। এক হাতে সোনার বালা, অন্য হাতের আঙুলে অনেকগুলো ঝলমলে আংটি। এমেলিয়া লক্ষ করেছে মহিলা সবসময় গহনা পরে থাকতে ভালবাসেন। তিনি পা টিপে টিপে এগোলেন বিছানার দিকে, তারপর একটা বালিশ তুলে নিলেন হাতে। তাঁর চোখে ফুটে উঠল নিষ্ঠুর, ক্রূর চাউনি যা দেখে ভয়ে জমে যায় এমেলিয়া। তিনি বালিশটা ঘুমন্ত বুড়োর মুখে চেপে ধরলেন সর্বশক্তি দিয়ে। ভয়ে চিৎকার করে উঠল এমেলিয়া, ঝট করে ঘুরে দাঁড়াল। বিছানা খালি, ঘরও তাই। সে সম্পূর্ণ একা।
এত ভয় পেয়েছে এমেলিয়া সামলে উঠতে সময় লাগল। বুঝতে পারল আয়নায় ভৌতিক যে দৃশ্যটা দেখেছে বাস্তবে তাই ঘটেছে। ওই বুড়ো আর কেউ নন, মি. বিশপ স্বয়ং। মিসেস বিশপ তাঁর স্বামীকে খুন করেছেন। হয়তো স্বামীর সাথে তিনি মানিয়ে চলতে পারছিলেন না বা টাকার লোভে, যে কোন কারণেই হোক স্বামীকে মেরে ফেলেছেন মিসেস বিশপ। আসল ঘটনা কেউ জানে না। তিনি রটিয়ে দিয়েছেন মি. বিশপ বিদেশে মারা গেছেন। ভয়ঙ্কর সত্যটা উপলব্ধি করতে পেরে কিছুক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে রইল এমেলিয়া। মিসেস বিশপ তাহলে খুনী! এজন্যেই ওই বড় বড় নীল চোখের ঠাণ্ডা দৃষ্টি তার বুকে কাঁপন ধরিয়ে দেয়।
এখন এখান থেকে যত তাড়াতাড়ি কেটে পড়া যায় ততই মঙ্গল। কিন্তু টাকা না নিয়ে যাওয়া যাবে না। এমেলিয়া নিশ্চিত হয়ে গেছে আয়রন সেফের মধ্যে টাকা আছে। সে সেফের হাতল ধরে টানাটানি শুরু করে দিল। কিন্তু খুলছে না সেফ। কোথাও গোপন বোতাম আছে কিনা ভেবে সেফের গায়ে হাত বোলাতে লাগল- এমেলিয়া। সত্যি আছে। বোতামটায় চাপ দিতেই খুলে গেল দরজা। ভেতরে তাকিয়ে হাঁ হয়ে গেল এমেলিয়া। সোনা! ড্রয়ারগুলো সোনার মুদ্রা, সোনার চুড়ি, আংটি, ব্রেসলেট আর নেকলেসে বোঝাই। মিসেস বিশপ কেন এ ঘরটা সবসময় বন্ধ রাখেন সে রহস্য এবার জানা গেল। তিনি শুধু খুনী নন, চোরও। স্বামীকে খুন করে তার সমস্ত সোনাদানা হাতিয়ে নিয়েছেন।
এ ঘর সবসময় বন্ধ রাখেন যাতে কেউ জানতে না পারে এখানে কি আছে। ‘আমি এখান থেকে কিছু গহনা সরিয়ে ফেলব,’ বিড়বিড় করল এমেলিয়া। ‘এগুলো পরলে নিশ্চয়ই আমাকে খুব সুন্দর দেখাবে।’
উত্তেজনার চোটে ভয় চলে গেছে এমেলিয়ার। সে দ্রুত কয়েকটা চুড়ি আর ব্রেসলেট পরে নিল হাতে, গলায় পরল নেকলেস। সোনার গহনায় নিজেকে মুড়ে নিয়ে হাসিমুখে দাঁড়াল আয়নার সামনে। সাথে সাথে মুখ থেকে হাসি মুছে গেল, দৃষ্টিতে ফুটে উঠল নির্জলা আতঙ্ক, এমেলিয়া দেখতে পেয়েছে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকছেন রক্তমাংসের মিসেস বিশপ। তাঁর হাতে লম্বা এক টুকরো তার, মুখটা কঠিন, চাউনিটা শীতল এবং ক্রূর। কিছুক্ষণ আগে অবিকল এই চেহারার ভৌতিক মিসেস বিশপকে দেখেছে সে আয়নায়।
‘বেশ,’ স্বভাবসুলভ ঠাণ্ডা, শান্ত গলায় চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন তিনি। ‘অবশেষে ধরা পড়ে গেছিস তুই। আমার গোপন ব্যাপারগুলোও দেখে ফেলেছিস। আমার গহনাও পরে আছিস দেখছি। এদিকে আয় হারামজাদী।’
নীল চোখে কি সম্মোহনী যাদু আছে কে জানে, পায়ে পায়ে তাঁর দিকে এগিয়ে গেল এমেলিয়া। যেন সাপ সম্মোহন করে টেনে আনছে তার শিকারকে। এমেলিয়ার শরীরের সমস্ত শক্তি কেউ শুষে নিয়েছে, প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ করার ভাষা এবং শক্তিও হারিয়ে ফেলেছে, নীরবে সে তার মনিবনীর আদেশ পালন করল। সামনে এসে দাঁড়াল মিসেস বিশপের।
‘হাঁটু গেড়ে বোস,’ আদেশ করলেন মিসেস বিশপ।
এমেলিয়া হাঁটু গেড়ে বসল, তার চোখ স্থির হয়ে আছে মিসেস বিশপের ধবধবে সাদা হাত আর টকটকে লাল ড্রেসের ওপর।
সাবধানে দরজা বন্ধ করলেন মিসেস বিশপ, তারপর ঘুরে দাঁড়ালেন, হাতের তারটা দেখালেন এমেলিয়াকে।
‘চিনিস এটা কি?’ জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
মাথা নাড়ল এমেলিয়া, কথা বলতে চাইল, কিন্তু গলা শুকিয়ে কাঠ, একটা শব্দও বেরুল না। ‘এটা তোর গলায় বাঁধব আমি,’ বলে চললেন মিসেস বিশপ, যত্নের সাথে এমেলিয়ার ঘাড় এবং গলায় জড়ালেন তারটা। ‘তোর বাবা-মা নেই, বন্ধু বান্ধব নেই, নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেও কেউ তোর খোঁজ নিতে আসবে না। কাজেই…’ লম্বা, সরু, সাদা আঙুল দিয়ে তিনি ফাঁসটাকে শক্ত করে টানতে লাগলেন….