বন্ধু হও, শত্রু হও
ফোনটা বেজে যাচ্ছিল কিন্তু সতীর্থ ধরছিল না। কী বলবে ধরে? কিন্তু না ধরলেও ওর ভীষণ ভাবতে ইচ্ছে করছিল পিয়াল ওকে কী বলবে? গালাগাল দেবে, কাঁদবে, সম্পর্ক না রাখার হুমকিতে গরম করে তুলবে মোবাইল, নাকি স্রেফ মেনে নেবে? আশমানি যেরকম মেনে নিল!
তুমি বিশ্বাস করো, তুমি আমাকে এতটা আঁকড়ে ধরবে বুঝলে আমি সম্পর্কটায় জড়াবার আগে দশবার ভাবতাম। সতীর্থ একটা উঠি উঠি ভাব করে বলেছিল আশমানিকে।
আশমানি চেয়ারের হাতলে মাথা রেখে কাঁদছিল। লাল হয়ে যাওয়া চোখ দুটোর ওপরে সতীর্থর একটা হাত প্রায় জোর করে বুলিয়ে নিয়ে বলল, জড়াবার আগে দশবার যখন ভাবোনি, ছেড়ে যাওয়ার আগে একবার অন্তত ভাবো।
সতীর্থ বলল, আমি তোমাকে ছেড়ে যেতে চাইছি না মানি। আমি চাইছি, আমাদের মধ্যে একটা সম্পর্ক থাক। কিন্তু সেই সম্পর্কের মধ্যে যেন কোনও বাঁধন না থাকে।
তুমি প্রিয়মের কথা ভেবে বলছ? প্রিয়ম দুষ্টুমি করলে, আমরা না হয় ওকে হস্টেলে ভরতি করে দেব। ছুটিছাটায় বাড়িতে আসবে প্রিয়ম। তা হলে তো আর কোনও অসুবিধে নেই? আশমানি মরিয়া গলায় বলল।
সতীর্থ হাত দিয়ে ওর মুখটা তুলে ধরল, কিন্তু চুমু খেল না। বলল, মা আর ছেলেকে আলাদা করে দেব এতটা নিষ্ঠুর আমি নই মানি। কিন্তু তোমাদের এই সেট-আপে আমি নিজেকে মানিয়ে নিতে পারব না। আমি আসব, অতিথি হিসেবে আসব…
আশমানি সতীর্থর হাতের আশ্রয় থেকে নিজের মাথাটা সরিয়ে নিয়ে বলল, অতিথি বলছ কেন, বলো বাঁধাবাবু হিসেবে আসবে!
সতীর্থ চমকে উঠে বলল, সে তুমি যা খুশি ভাবতে পারো। কিন্তু আমি আমার মনের দিক থেকে পরিষ্কার। আমি মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে আরও বহুদিন তোমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে পারতাম, কিন্তু আমি তা দিচ্ছি না। আমি শুধু বলছি তুমি চাইলে আমায় পুরোটাই পাবে।
শুধু বিছানায়, তাই তো? লোকসমক্ষে তো পাব না?
না, পাবে না। কিন্তু বিছানাতে পাওয়াকেই বা এত খাটো করে ধরছ কেন?
ধরছি না তো। শুধু ভাবছি, পাঁঠার মাথা যখন এককোপে ধড় থেকে ছিটকে যায় না তখন তাকে নিয়ে কী করা হয়?
সে তো বেড়ে পড়া। সাংঘাতিক ব্যাপার। খুঁটি পালটে, দা পালটে আবার নতুন করে বলিদান শুরু করতে হয়।
আর ওই পাঁঠাটাকে মাটির নীচে চাপা দিয়ে দেওয়া হয়। দু’কোপে হোক, তিন কোপে হোক, কেটে ফেলে চাপা দিয়ে দেওয়া হয়। তারপর রক্তের গন্ধ শুঁকে শুঁকে কুকুরগুলো ওকে মাটি থেকে হিঁচড়ে টেনে তোলে পরদিন। ছিন্নভিন্ন করে।
এসব কথার মানে কী আশমানি? সতীর্থ জিজ্ঞেস করল।
আশমানি যেন শুনতে পায়নি এভাবে বলল, নিজেকে উৎসর্গ করা মানুষও অনেক সময় পুজোয় লাগে না, জানো? কীভাবে কে জানে, বেড়ে পড়ে যায়। কিন্তু আশমানি নিজেকে মাটির অনেক অনেক নীচে লুকিয়ে ফেলবে। দেখো, কোনও কুকুর আর আমার খোঁজ পাবে না। আমাকে আর ছিঁড়তে খুঁড়তে পারবে না কেউ।
সতীর্থ আস্তে আস্তে উঠে চলে এসেছিল আশমানির ঘর থেকে। বেরিয়ে আসার আগে লুকিয়ে একটা বড় চকোলেট রেখে এসেছিল প্রিয়মের পড়ার টেবিলে।
কিন্তু পিয়ালকে কী দেবে ও? কী করলে পিয়াল বিশ্বাস করবে যে, সতীর্থ ওর পিঠে ছোরা বসাতে চায়নি, স্রেফ নেপথ্য শিল্পীর তকমা ঝেড়ে ফেলে হিরো হতে চেয়েছিল একবার?
পিয়ালের মনে হচ্ছিল ও একটা কীট, যখন তুহিন বারবার করে ওকে শোনাচ্ছিল, সতীর্থ কীভাবে চুমু খেয়েছে টুয়াকে, কীভাবে ওকে জড়িয়ে ধরে গঙ্গার ধারে বসেছিল অনেকক্ষণ। তুহিনের পরিচিত দু’জন দেখেছে। পিয়াল চাইলে তুহিন তাদের এনে হাজির করাতে পারে ওর সামনে, কিন্তু সেসবের কী দরকার? পিয়াল সতীর্থকে একটা ফোন করে দেখুক না! তা হলেই চক্ষু-কর্ণের বিবাদভঞ্জন হয়ে যাবে। কী হল? সতীর্থ ফোন ধরছে না? ধরবে না, তুহিন জানত। কিন্তু পিয়াল যেন এবার জানে। দু’পয়সার মালসা গেছে যাক, সেই মালসায় মুখ দেওয়া কুকুর যেন চিহ্নিত হয়ে থাকে। তুহিনের ঠাকুমার কথা। পিয়াল যেন মনে রাখে।
কিন্তু রাতের পর রাত ওর মেসে বসে থেকে ওর মাথায় জলপট্টি দিয়েছে সতীর্থ, ওর সেই ছ’-সাত দিন ধরে না নামা জ্বরের সময়। পরীক্ষার সময় নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে রেখেছে, সেসব কীভাবে ভুলবে পিয়াল?
তোমার মতো ভাল লোক আমাকে ঠিক হ্যান্ডেল করতে পারত না জানো? আমার জন্য ওর মতো শয়তানই একদম ঠিকঠাক। টুয়া ফোন করে বলল।
কবে বুঝলে টুয়া? পিয়াল দম চেপে জিজ্ঞেস করল।
ঠিক কবে বুঝলাম, বলতে পারব না। তবে আমার অনেক দিনই মনে হচ্ছিল তোমার গানের সঙ্গে যতটা কমিউনিকেট করতে পারি, তোমার সঙ্গে ঠিক ততটা পারি না, টুয়া খুব সহজ গলায় বলল।
কিন্তু আমার গানই তো আমি, টুয়া।
সেজন্যই সরে এলাম। আমি তো একটা সিডি কিংবা এমপিথ্রি-র সঙ্গে প্রেম করতে পারি না।
কিন্তু, আমি কি গানের বাইরে কিচ্ছু নই? তুমি সেই আমাকে বলেছিলে, মনে আছে, ভালবাসলে তুমি কী রঙের জামা পরে আছ আমি বলে দিতে পারব? আমি বলে দিয়েছিলাম, লাল। আমি আজও বলে দিচ্ছি, সবুজ!
অ্যাই আমার একটা ফোন আসছে, আমি তোমায় পরে ফোন করছি।
কিন্তু জামাটার রং কী টুয়া? সবুজ তো?
সরি, মিলল না। আমি খয়েরি পড়েছি আজ, টুয়া ফোনটা কেটে দিল।
সত্যিই খয়েরি পড়েছে টুয়া? সত্যিই পিয়াল শুধুই একটা চলমান সিডি? তা হলে সতীর্থ যা করেছে, ঠিকই করেছে। আর ও-ই বা কী ভুল করবে যদি তুহিনের সঙ্গে নিষিদ্ধ পাড়ায় গান শুনতে যায় আজ?
এই যে স্কুলটা দেখছ, এখানে রবীন্দ্রনাথ পড়তেন, তুহিন বলল।
পিয়াল স্কুলটার উদ্দেশে মনে মনে প্রণাম জানিয়ে বলল, আর আমরা কোথায় যাব?
এই তো কাছেই, এই রাস্তাটা ধরে একটু এগোলেই। তুহিন আত্মবিশ্বাসী গলায় বলল।
বাপ রে! রবীন্দ্রনাথের স্কুলের এত কাছে? ওই যে এ-পাশ থেকে, ও-পাশ থেকে চড়া লিপস্টিক দেওয়া, গালভরতি মেচেতার দাগ মেয়েগুলো এগিয়ে আসছে পথযাত্রীদের কাছে, পিয়ালের কাছে, হাত ধরে টানছে প্রায়, ‘চলো না, অ্যাই বাবু চলো না’ ওরা কি রবিঠাকুরের কথা জানে? ওঁর একটা গানও শুনেছে কোনওদিন? ওরা কি জানে এই আদিমতম নরকের সামান্য দূরেই ঈশ্বরের পাঠশালা?
পিয়াল, এই পিয়াল, তুই এ পাড়ায়? পিয়াল চমকে দেখল ওর সামনে একটা পুলিশের গাড়ির ভিতর একজন পুলিশের পাশে শান্ত হয়ে বসে আছে স্নিগ্ধদেব।
তুহিন ব্যাপারটা সামাল দেওয়ার জন্য বলল, আমরা মানে এদিক দিয়ে শর্টকাটে মেট্রো স্টেশনে যাচ্ছিলাম।
স্নিগ্ধদেব হেসে বলল, হ্যাঁ পাতালে যাওয়ার তো এটাই শর্টকাট রাস্তা।
পিয়াল চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। টুয়ার অ্যাকোয়ারিয়ামের সেই মাছটার মতো তখন ওর মাথার মধ্যে দৌড়োতে শুরু করেছে বোকারোর সেই প্রোগ্রাম, অনিরুদ্ধদা যেখানে বিনা পয়সায় দুদিন মদ খেতে পাবে বলে স্নিগ্ধদেবকে ওদের সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল। হ্যাঁ সেখানেই তো, নিজেকে পিয়াল পরিচয় দিয়ে স্নিগ্ধদেব এক ভদ্রমহিলাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খায়। ভদ্রমহিলা মস্ত চাকরি করতেন, কিন্তু নিজেকে পরিচয় দিতেন পিয়ালের বড় ফ্যান হিসেবে। স্নিগ্ধদেব ওকে বলেছিল, সিডি কিংবা ক্যাসেট কভারে পিয়ালের যে-ছবিটা যায়, সেটা ইচ্ছে করেই অন্য রকম রাখা হয়েছে যাতে রাস্তাঘাটে লোকজন বিরক্ত না করে। বিশ্বাস করেছিলেন ভদ্রমহিলা, আর আসল পিয়ালকে চেনার পর জুতো হাতে তাড়া করেছিলেন স্নিগ্ধদেবকে। ছুটতে ছুটতে স্নিগ্ধদেব বলেছিল, আমায় মারলে কিন্তু পিয়াল আর গান করবে না।
কী যেন নাম ছিল সেই বোকারোর ভদ্রমহিলার? পিয়াল অকারণে জিজ্ঞেস করল।
সুরমিতা। সুরমিতা এখন আমার বান্ধবী জানিস তো? স্নিগ্ধদেব একগাল হেসে বলল। তারপর গলা নামিয়ে বলল, কলকাতায় এসেছিল। সব কিছুই হয়েছে।
পিয়াল যন্ত্রচালিতের মতো বলল, জুতো খাওয়া?
স্নিগ্ধদেব উত্তর দেওয়ার আগেই দু’জন পুলিশ আরও চারটে লোককে তাড়িয়ে নিয়ে এল ভ্যানের সামনে। গুঁতুনি খেয়ে ওরা ভ্যানে উঠছে, স্নিগ্ধদেব নিজের পাশের একটু জায়গা হাতে চেপে বলল, এখানে কেউ বসবে না, এটা আমার বন্ধুর জায়গা।
বন্ধুর জায়গা? পিয়াল আর তুহিন একসঙ্গে জিজ্ঞেস করল।
স্নিগ্ধদেব বলল, হ্যাঁ রে আমরা দু’জনই একটা আনরেজিস্টার্ড জায়গায় গিয়ে ফেঁসে গিয়েছি আজ। সে ঠিক আছে, তাই বলে ভ্যানে পাশাপাশি বসতে পারব না? বলেই পুলিশের একটা লোককে বলল, আমার বন্ধুকে অন্য ভ্যানে তোলা চলবে না, শিগগির এখানে নিয়ে আসুন।
ফুটপাথের উলটোদিকে তখন একজন অন্ধ ভিখিরি প্রতিদিনকার মতো ট্যাপকলের নীচে একটা জলের পাত্র ভরে তুলছে তার রাতসঙ্গী কুকুরটার জন্য। আর প্রতিদিনকার মতোই অন্য একটা কুকুর এসে সেই বাটিতে মুখ ডুবিয়ে খেয়ে যাচ্ছে। জল।