ছোটোগল্প
উপন্যাস
অন্যান্য

বন্ধু রবিনহুড

বন্ধু রবিনহুড (ছোট গল্প)

নটিংহ্যাম প্রদেশের নিকটস্থ আলসফোর্ড শহরের একটি সরাইখানায় বসে একজন অ্যাংলো-স্যাক্সন তরুণ ভোজন করছিল। আগন্তুকের মলিন পরিচ্ছদ দেখলেই বোঝা যায় সে অতি দরিদ্র। তার আহার্যও ছিল অত্যন্ত নিকৃষ্ট ধরনের। স্পষ্টই বোঝা যায় বেশি দাম দিয়ে ভালো খাবার খাওয়ার সামর্থ্য তার নেই।

একটু দূরে আর একটি টেবিলে তিন জন নর্মান সৈনিক পানভোজন করতে করতে নিজেদের মধ্যে কথা কইছিল এবং মাঝে মাঝে স্যাক্সন তরুণটির দিকে বক্র কটাক্ষে দৃষ্টিনিক্ষেপ করছিল। অনুমান করা যায় তাদের আলোচনার বিষয়বস্তু হচ্ছে পূর্বোক্ত স্যাক্সন তরুণ।

নর্মান সেনাদের পানভোজনের পালা প্রায় শেষ। সুরার পাত্রে শেষ চুমুক দিয়ে শুন্য পাত্র সশব্দে টেবিলের উপর নামিয়ে একজন সৈনিক কাষ্ঠাসন ত্যাগ করে উঠে দাঁড়াল, তারপর সঙ্গীদের দিকে চোখের ভঙ্গিতে ইশারা জানিয়ে তরুণের পাশে এসে দাঁড়াল। অপর দুটি সৈনিকও . উঠে এসে তরুণটিকে ঘিরে দণ্ডায়মান হল।

যে সৈন্যটি প্রথমে উঠে গিয়েছিল, সে তরুণকে উদ্দেশ করে বলল, ওরে হতভাগা, তোর চেহারা দেখেই বুঝেছি তোর কাছে পয়সাকড়ি কিছু নেই। বিনা পয়সায় খাওয়ার জায়গা এটা নয়, বুঝেছিস?

তরুণ মুখ তুলে তাকাল, কথা কইল না। উত্তর না পেয়ে বক্তা খেপে গেল। সে ক্রুদ্ধস্বরে বলল, কিরে, কথার উত্তর দিচ্ছিস না যে? ভদ্রলোকের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করতে হয় তাও জানিসনা? এখনই উঠে দাঁড়া। বর্বর স্যাক্সন! আমরা দাঁড়িয়ে আছি আর তুই বসে আছিস?

পার্শ্বে দণ্ডায়মান দুই সৈনিকের মধ্যে একজন হেসে বলল, ওহে রবার্ট! এই স্যাক্সনগুলো ভালো কথার মানুষ নয়। ওকে ভদ্রতা শিখিয়ে দাও। এই রোগের জন্য কড়া ওষুধ দরকার।

সঙ্গেসঙ্গে প্রথম সৈনিক তরুণের চোয়ালে সজোরে ঘুসি বসিয়ে দিল। তরুণ ছিটকে পড়ল মাটিতে। আহত চোয়ালে একবার হাত বুলিয়ে সে উঠে বসল, তারপর উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল।

কিন্তু সে উঠে দাঁড়ানোর আগেই দ্বিতীয় সৈনিক তার মুখের উপর প্রচণ্ড বেগে পদাঘাত করল। স্যাক্সন তরুণ রক্তাক্ত মুখে আবার লুটিয়ে পড়ল মাটির উপর।

কয়েক মুহূর্ত অবসন্ন ভাবে পড়ে থেকে তরুণটি উঠে বসল। কিন্তু এবার সে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করল না। ভূমিতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে স্থির হয়ে বসে রইল।

নর্মানরা চমকে গেল। তাদের পায়ে ছিল লোহার জুতো। সেই জুতো-পরা পায়ের লাথি সজোরে মুখের উপর পড়লে যে কোনো মানুষের পক্ষে অজ্ঞান হয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক, কিন্তু এই স্যাক্সন ছোকরা অজ্ঞান হওয়া তো দুরের কথা, মুখ দিয়ে একটা আর্তনাদ পর্যন্ত করছে না। এমন কি তার চোখে মুখে যন্ত্রণার কোনো চিহ্নও ফুটে ওঠেনি।

যে সৈন্যটি পদাঘাত করেছিল, সে আবার লাথি মারার উদ্যোগ করল, কিন্তু তার চেষ্টা সফল হল না। আচম্বিতে তার কাঁধের উপর এসে পড়ল একটি হাত, পরক্ষণেই প্রবল আকর্ষণে তার দেহটা ছিটকে এল কয়েক হাত দূরে।

তিনটি সৈনিক সচমকে দেখল, সরাইখানার মধ্যে উপস্থিত হয়েছে এক বলিষ্ঠ পুরুষ। বলা বাহুল্য, সেই নবাগত পুরুষই টান মেরে প্রহারে উদ্যত সৈনিকটিকে স্যাক্সন তরুণের সামনে থেকে সরিয়ে দিয়েছে।

এই অভাবিত স্পর্ধায় তিন সৈনিক স্তম্ভিত হয়ে গেল। আগন্তুকের পরনে স্যাক্সনদের মতো পোশাক। মাথায় সুন্দর টুপি। টুপি আর পোশাকের রং ঘন সবুজ। টুপির উপর সযত্নে বসানো হয়েছে একটি পাখির পালক। নাকের তলায় সরু গোঁফের দুই প্রান্ত ঔদ্ধত্যে উন্নত, চোয়াল পরিষ্কার ভাবে কামানো, শুধু চিবুকের উপর অবস্থান করছে একটুখানি ছাগল-শাড়ি! এক নজরে দেখলেই বোঝা যায়, লোকটি দস্তুরমতো শৌখিন।

তবে চেহারা ও পোশাকে বাহার থাকলেও মানুষটি যে নিতান্ত নিরীহ ফুলবাবুটি নয়, সে কথা বুঝতে কষ্ট হয় না। কারণ, তার কোমরের বাঁ দিকে ঝুলছে একটি দীর্ঘ তরবারি! কটিবন্ধের ডান দিকে একটি সুবৃহৎ শিঙাও দৃশ্যমান। শিঙাটি কোন কাজে লাগবে কে জানে, কিন্তু আপস্তুকের চোখের দৃষ্টি দেখলেই বোঝা যায়, তলোয়ারটা কেবল অঙ্গশোভার জন্য কটিদেশে স্থান গ্রহণ করেনি, তলোয়ারের মালিক ওই বস্তুটিকে ভালোভাবেই ব্যবহার করতে জানে।

নর্মান সেনারাও সশস্ত্র। তাদের কটিদেশেও অবস্থান করছে শাণিত তরবারি। উপরন্তু তাদের দেহ লোহবর্মে সুরক্ষিত এবং তারা দলে ভারি, একের বিরুদ্ধে তিন! তবু আগন্তুকের অতর্কিত আবির্ভাব ও উদ্ধত আচরণে তারা চমকে গিয়েছিল। বর্মধারী তিনজন সৈনিকের বিরুদ্ধে একটি সাধারণ নাগরিকের এমন উদ্ধত আচরণ কল্পনা করা যায়না।

বিস্ময়ের চমক কেটে যেতেই নর্মান সৈন্যরা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। যে সৈনিকের কাঁধে হাত দিয়ে আগন্তুক সরিয়ে দিয়েছিল, সে ঘুসি বাগিয়ে এগিয়ে এল, কে তুই? এখানে তোর কী দরকার? স্যাক্সন হয়ে তুই নর্মান সেনার গায়ে হাত দিস? তোর এত স্পর্ধা?

আগন্তুক হাসল, স্পর্ধা আমার একটু বেশি সন্দেহ নেই। আর দরকার? হ্যাঁ, দরকার একটু আছে। এইমাত্র কড়া ওষুধ দেওয়ার কথা হচ্ছিল না? আমি চিকিৎসক, রোগ বুঝে ওষুধ দিতে এসেছি।

মুখের কথা শেষ হওয়ার আগেই আগন্তুক হাত চালাল। স্যাক্সন তরুণকে যে সৈন্যটি লাথি মেরেছিল, মুখের উপর ঘুসি খেয়ে সে সশব্দে ধরাশয্যা গ্রহণ করল। তার দুই সঙ্গী সবিস্ময়ে দেখল লোকটি একটুও নড়াচড়া করছে না, সে অজ্ঞান হয়ে গেছে!

আগন্তুক নর্ম্যান সেনাদের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্যে অপেক্ষা করল না। তার মুষ্টিবদ্ধ হস্ত আবার আঘাত হানল দ্বিতীয় সৈনিকের উদরে। দুই হাতে পেট চেপে দ্বিতীয় সৈনিক অসহ্য যাতনায় সামনের দিকে ঝুঁকে পড়তেই আগন্তুক বলল, তোমার পেট ব্যথা করছে নাকি? নিশ্চয়ই খাবার হজম হয়নি। এখন তাহলে একটু শুয়ে বিশ্রাম করা উচিত।

সঙ্গেসঙ্গে চোয়ালের উপর পড়ল আর একটি মুষ্ট্যাঘাত এবং দ্বিতীয় সৈনিকও জ্ঞান হারিয়ে লম্ববান হল ভুমিপৃষ্ঠে।

তৃতীয় ব্যক্তি ছিল সৈন্যদলের সেনাপতি, সে এতক্ষণ কাঠের পুতুলের মত দাঁড়িয়েছিল, সমস্ত ব্যাপারটা এত তাড়াতাড়ি ঘটে গেল যে, সে মারামারিতে অংশগ্রহণ করার সময়ই পায়নি।

এবার খ্যাপা ষাঁড়ের মতো গর্জন করে সে আগন্তুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। পরক্ষণেই দুই প্রতিদ্বন্দ্বী আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়ে মাটির উপর গড়াগড়ি খেতে লাগাল। আচম্বিতে দলপতির বিশাল দেহ শূন্যে ছিটকে উঠে ঘরের দেয়ালে আছড়ে পড়ল এবং সেখান থেকে মেঝের উপর পড়ে স্থির হয়ে গেল।

আগন্তুক ধরাশয্যা ত্যাগ করে উঠে দাঁড়াল, তারপর ডান হাতে ঘুসি বাগিয়ে এগিয়ে এসে দলপতির মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে শত্রুর অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। পর্যবেক্ষণের ফলাফল বোধহয় সন্তোষজনক হল। কারণ, আগন্তুকের ঘুসি পাকানো মুঠি শিথিল হয়ে এল এবং গোঁফের তলায় দেখা দিল ব্যঙ্গের হাসি। সরাইখানার মালিকের দিকে তাকিয়ে সে স্মিতমুখে বলল, খোকা ঘুমিয়ে পড়েছে। এখন ও কিছুক্ষণ ঘুমাবে। বড়ো দুষ্টুমি করছিল, তাই ওদের ঘুম পাড়িয়ে দিলাম।

সরাইখানার মালিক নর্ম্যান। সৈন্যদের উপর সহানুভূতি থাকলেও তাদের হয়ে কিছু বলার সাহস তার ছিল না। সমস্ত ব্যাপারটা স্বচক্ষে দর্শন করে সে বুঝেছিল, আগন্তুক মুষ্টিযুদ্ধ ও মল্লযুদ্ধে অতিশয় দক্ষ। এমন মানুষকে ঘাঁটানো বিপজ্জনক, অতএব সে বুদ্ধিমানের মতো মৌনব্রত অবলম্বন করল।

আহত স্যাক্সন তরুণকে আগন্তুক হাত ধরে তুলল। তরুণের আচরণে উত্তেজনার চিহ্ন নেই। এইমাত্র তাকে কেন্দ্র করে চারপাশে যে ঘটনা ঘটে গেল সে-বিষয়ে সে আদৌ সচেতন নয়।

আহত তরুণকে ধরে সরাইখানার বাইরে যেতে যেতে আগন্তুক বলল, আমি ঠিক সময়েই এসে পড়েছিলাম।

নিষ্প্রাণ, নিরুৎসুক স্বরে তরুণ বলল, ধন্যবাদ মহাশয়, কিন্তু আপনি না এলেও বোধহয় বিশেষ ক্ষতি ছিল না।

আরও কিছুদূর এগিয়ে এসে গাছতলায় বাঁধা একটি ঘোড়ার কাছে দাঁড়াল আগন্তুক। তারপর তরুণকে উদ্দেশ্য করে বলল, উঠে পড়ো। ঘোড়ায় চড়ার অভ্যাস আছে নিশ্চয়ই? না থাকলেও অসুবিধা হবে না, আমি তোমার পিছনে উঠে তোমাকে ধরে রাখব।

আগন্তুক সাহায্যের জন্যে এগিয়ে এল, কিন্তু তার প্রসারিত হস্তকে উপেক্ষা করে তরুণটি মুহূর্তের মধ্যে অশ্বপৃষ্ঠে স্থান গ্রহণ করল। কিছুক্ষণ অশ্বারোহণে চলার পর আগন্তুক বলল, আমরা এখন শেরউড বনের দিকে চলেছি।

তরুণ নির্বাক। মনে হয়, কোথায় যাওয়া হচ্ছে অথবা চারপাশে কি ঘটছে সে-বিষয়ে তার কিছুমাত্র কৌতূহল নেই।

 স্তব্ধতা ভঙ্গ করল আগন্তুক, আমার নাম রবিনহুড। আমি মাঝে মাঝে এই অঞ্চলে টহল দিয়ে থাকি, কারণ চারপাশে কি ঘটছে সেটা জানা আমার কর্তব্য। ভাগ্যক্রমে এদিকে এসে পড়েছিলাম বলেই নর্মান সেনাদের অত্যাচার থেকে তোমাকে রক্ষা করতে পারলাম। ভালো কথা, তোমার নাম কি?

নির্জীব নিস্মাণ কণ্ঠে উত্তর এল, রোডেরিক।

তৎকালীন ইংল্যান্ডে রবিনহুডের নাম শুনেও নির্বিকার থাকতে পারে এমন মানুষের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। রবিন সবিস্ময়ে প্রশ্ন করল, তুমি কি কখনও আমার নাম শোননি?

না। আমি ইংল্যান্ডে ছিলাম না।

 কোথায় ছিলে?

উত্তর নেই। তরুণ নির্বাক।

রবিনহুড আর কথা বলার চেষ্টা করল না। অশ্বকে সবেগে চালনা করল শেরউড বনে তার আস্তানার দিকে।

শেরউড বনে রবিনহুডের আস্তানায় কয়েকটা দিন অতিবাহিত হল। রোডেরিকের ক্ষতস্থান ধুয়ে দলের চিকিৎসক ফ্রায়ার টাক ঔষুধ প্রয়োগ করে তাকে সুস্থ করে তুলল। কিন্তু রোডেরিকের আচরণ পূর্ববৎ। সে কারও সঙ্গেই কথা বলে না। শূন্যে দৃষ্টি মেলে গাছের তলায় বসে থাকে। প্রশ্ন করলে কখনও উত্তর দেয়, কখনও দেয় না, খাওয়ার ডাক পড়লে নিঃশব্দে এসে আহার গ্রহণ করে উঠে যায়।

রোডেরিকের সম্পর্কে সব কথাই দলের লোকেদের জানিয়েছিল রবিনহুড। প্রায় এক সপ্তাহ পরে দলের সবাই মিলে গল্পগুজব করছে, এমন সময় হঠাৎ লিটল জন বলে উঠল, ওহে রবিন, এই রোডেরিক ছোকরার ব্যাপারটা কি বলো তো? ছোকরার কোনো ব্যাপারেই গা নেই। মনে হয় আদর-ভালোবাসা, অবহেলা-অপমান সব কিছুই তার কাছে সমান, কোনো কিছুতেই তার স্পৃহা নেই।

উইল স্কারলেট বলল, রবিন। তোমার কাছে যা শুনেছি, তাতে মনে হয় ছেলেটা অতিশয় ভীরু। নর্ম্যান সৈন্যরা যখন তাকে প্রহার করছিল, সে বাধা দিতেও সাহস করেনি। একেবারেই মেরুদণ্ডহীন কাপুরুষ!

ফ্রায়ার টাক এতক্ষণ চুপচাপ ছিল, এইবার সে মুখ খুলল, ছেলেটার মনে কষ্ট আছে। পৃথিবীতে বেঁচে থাকার প্রয়োজন ওর কাছে ফুরিয়ে গেছে। ওকে শান্তিতে দিন যাপন করতে দাও, এক সময়ে হয়তো সে জীবনধারণের সার্থকতা খুঁজে পাবে।

একটু দুরেই একটা গাছের তলায় চুপ করে বসেছিল রোডেরিক। তার দিকে তাকিয়ে রবিনহুড হাঁক দিল, রোডেরিক, শুনে যাও।

যন্ত্রচালিতের মতো ধীর পদক্ষেপে রোডেরিক এসে দাঁড়াল রবিনহুডের সামনে।

রবিনহুড বলল, রোডেরিক, কয়েকদিন পরেই নটিংহ্যামের বাজারে তাতি উইলফ্রেড কাপড় বিক্রি করতে আসবে। যে-সব মাল বিক্রি হবে না, সেগুলোকে ঘোড়ার গাড়িতে চাপিয়ে উইলফ্রেড যাবে ইয়র্ক শহরে। তুমিও যাবে তার সঙ্গে। ঘোড়ার গাড়ির ভিতর থাকলে নর্মানরা তোমাকে দেখতে পাবেনা। এই অঞ্চল ছেড়ে ইয়র্ক শহরে গেলে তুমি নিরাপদ। এখানেও তোমার বিপদের সম্ভাবনা নেই। কিন্তু এটা হচ্ছে যোদ্ধাদের আস্তানা, এখানে তুমি বেশিদিন থাকতে পারবেনা।

নির্দিষ্ট দিনে নটিংহ্যামের বাজারে এসে অপেক্ষা করতে লাগল রবিনহুড ও রোডেরিক। ঠিক দুপুর বেলায় আসবে উইলফ্রেড। রবিন ও রোডেরিক একটু আগেই এসে পড়েছিল, অতএব অপেক্ষা করতেই হবে দুপুর পর্যন্ত।

তাদের বরাত খারাপ। একদল নর্ম্যান সৈন্য বাজরের মধ্যে টহল দিচ্ছিল। তাদের মধ্যে ছিল সরাইখানার নর্মান দলপতি, এতদিনেও তার গায়ে ব্যথা যায়নি। হঠাৎ তার দৃষ্টি আকৃষ্ট হল রবিনহুডের দিকে।

রবিনহুড ও রোডেরিক কাপড় দিয়ে মাথা ঢেকে এসেছিল। কিন্তু রবিনের মাথায় কালো কাপড়ের আবারণ থাকা সত্ত্বেও শত্রুকে চিনে ফেলল দলপতি। তৎক্ষণাৎ সে চিৎকার করে। সৈন্যদের বলল, ওই যে স্যাক্সন কুকুরটা দাঁড়িয়ে আছে। মনে করেছে কালো কাপড়ে মাথা ঢাকলে ওকে কেউ চিনতে পারবেনা। সৈন্যগণ! ওকে ধর। শয়তানটা যেন পালাতে না পারে।

একপাল হিংস্র নেকড়ের মতো ছুটে এল নর্মান সৈন্যদল। সঙ্গেসঙ্গে রবিনহুডের হাতে সূর্যালোকে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে ঝক ঝক করে উঠল কোষমুক্ত তরবারি। কিন্তু রোডেরিক পিছন ফিরে ছুটল তিরবেগে এবং কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই অদৃশ্য হয়ে গেল।

নর্ম্যানরা রোডেরিকের দিকে একবারও তাকাল না, তাদের দৃষ্টি তখন রবিনহুডের দিকে।

সংঘর্ষ শুরু হল। দুজন নর্ম্যান সেনা আহত হয়ে আর্তনাদ করতে করতে হাতের অস্ত্র ফেলে দিল। রবিনের হাতের ঘূর্ণিত অসি বারংবার ব্যর্থ করে দিল শত্রুর দলবদ্ধ আক্রমণ। কিন্তু এতগুলো লোকের বিরুদ্ধে একটিমাত্র মানুষ কতক্ষণ যুদ্ধ করতে পারে? একটা কাটা বসানো লৌহমুষল সজোরে এসে পড়ল রবিনের মাথায়, সঙ্গেসঙ্গে অচৈতন্য হয়ে সে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।

নর্ম্যান দলপতি রূঢ়স্বরে বলল, ওকে বেঁধে ফেল। আদেশ পালিত হল তৎক্ষণাৎ। হঠাৎ একজন নর্মান সৈন্য সংজ্ঞাহীন বন্দির মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে বলে উঠল, আরে! আরে! এ যে দেখছি স্যাক্সন দস্য রবিনহুড! রাজদরবার থেকে রবিনহুডের ছিন্নমণ্ডের জন্য এক সহস্র স্বর্ণমুদ্রা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে।

অট্টহাস্য করে নর্মান দলপতি বলল, বাজারের মাঝখানে মঞ্চের উপর যে থামটা রয়েছে, সেই থামের সঙ্গে ওকে বেঁধে ফেলে শেরিফকে খবর দাও। মৃত্যুদণ্ড তার সামনেই অনুষ্ঠিত হবে। ওই সঙ্গে তিনি যেন পুরস্কারের সহস্র স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে আসেন।

রবিনহুডের যখন জ্ঞান ফিরে এল, সে দেখল তাকে থামের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে। নর্ম্যান দলপতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বন্দির দিকে তাকিয়েছিল, রবিনহুডকে চোখ মেলে চাইতে দেখে সে বলে উঠল, ওরে স্যাক্সন কুকুর! তোকে এখনই হত্যা করা হবে। কিন্তু তার আগে আমি একটু হাতের সুখ করে নিতে চাই।

বলার সঙ্গেসঙ্গে হাত চলল, বন্দির মুখের উপর প্রচণ্ড বেগে এসে পড়ল দলপতির বদ্ধমুষ্টি। রবিনের মুখ থেকে একটিও শব্দ শোনা গেল না, কেবল তার চোখ দুটো দারুণ ক্রোধে জ্বলে উঠল। চারপাশে দণ্ডায়মান জনতা নর্মান দলপতির নিষ্ঠুর আচরণে ক্রুদ্ধ হয়ে প্রতিবাদ জানাতে লাগল উচ্চৈঃস্বরে। হয়তো তারা রবিনহুডকে উদ্ধার করার জন্য এগিয়ে আসত, কিন্তু সশস্ত্র নর্মান সৈন্যদের বেষ্টনী ভেদ করে মঞ্চের সামনে যাওয়ার ক্ষমতা জনতার ছিল না।

ভীষনদর্শন এক রণকুঠার হাতে দাঁড়িয়েছিল জনৈক নর্ম্যান সৈন্য। সে কুঠার আস্ফালন করে প্রতিবাদে মুখর জনতার উদ্দেশে চেঁচিয়ে উঠল, চুপ কর শয়তানের দল। বেশি চিৎকার করলে এই কুঠারের ধার তোদের উপর পরখ করব।

আচম্বিতে তার মুখের উপর পড়ল এক প্রচণ্ড মুষ্ট্যাঘাত, সঙ্গেসঙ্গে প্রবল আকর্ষণে তার কুঠার হল হস্তচ্যুত! যে ব্যক্তি কুঠার ছিনিয়ে নিয়েছিল, সে বিদ্যুৎবেগে কুঠার চালাল, এদিক-ওদিক ছিটকে পড়ল কয়েকজন নর্মান সৈন্য। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই সৈন্যদের বেষ্টনী ভেঙে কুঠারধারী মঞ্চের কাছে ছুটে গেল এবং কেউ বাধা দেবার আগেই এক লাফে উঠে পড়ল মঞ্চের উপর।

মঞ্চে দণ্ডায়মান দলপতি সভয়ে পিছিয়ে গেল বন্দির সম্মুখ থেকেতার পার্শ্বরক্ষী তিনজন নর্ম্যান সেনা উদ্যত তরবারি হাতে কুঠারধারীকে আক্রমণ করল।

বন্যার মুখে বালির বাঁধ যেমন ভেসে যায়, তেমনি ভাবেই ব্যর্থ হয়ে গেল নর্ম্যানদের প্রতিরোধের প্রয়াস, রক্তাক্ত দেহে তিন সৈনিক লুটিয়ে পড়ল মঞ্চের উপর। দলপতি একলাফে মঞ্চ ত্যাগ করে সরে গেল কুঠারের নাগালের বাইরে। একটি ভূপতিত সৈনিকের তরবারি নিয়ে কুঠারধারী ব্যক্তি রবিনের বন্ধনরঙ্কু ছিন্ন করল, তারপর তলোয়ার এগিয়ে দিয়ে বলে উঠল, রবিন! অস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত হও। ওরা আসছে।

রবিনহুড সবিস্ময়ে প্রশ্ন করল, রোডেরিক, তুমি!

হ্যাঁ আমি। কিন্তু কথা বলার সময় নেই। ওই দেখ, ওরা আসছে। সত্যই তাই। ঘটনার আকস্মিকতায় ক্ষণেকের জন্য বিহ্বল হয়ে পড়েছিল চতুর্দিকে অবস্থিত নর্মান সেনাদল। এখন সম্বিত ফিরে পেয়ে তারা অস্ত্র তুলে ছুটে আসছে মঞ্চের দিকে।

রক্তাক্ত কুঠার শূন্যে উত্তোলন করে রোডেরিক বলল, রবিন, ওরা আসছে।

ঊর্ধ্বে তরবারি নাচিয়ে রবিনহুড বলল, রোডেরিক, যারা আসছে তারা অনেকেই আর ফিরে যাবে না।

লড়াই শুরু হল। রবিনহুডের ভবিষ্যদ্বাণী বৃথা হল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই হতাহত সঙ্গীদের ফেলে নর্মান সৈন্যরা চম্পট দিল। তারা বুঝেছিল বেশিক্ষণ এখানে থাকলে তাদের মধ্যে একটি মানুষও জীবিত থাকবে না।

সমবেত জনতার ভিতর থেকে জাগল প্রবল উল্লাসধ্বনি, রবিনহুডের জয় হোক! শেরউড বনের রবিনহুড দীর্ঘজীবী হোক!

ধরাশায়ী নর্মান সেনাদের দিকে একবার দৃষ্টিপাত করে রবিনহুড বলল, এবার আমাদের এখান থেকে সরে পড়াই ভালো। একটু পরেই দলে ভারি হয়ে নর্ম্যানরা এখানে ছুটে আসবে। সম্ভবত শেরিফ মহাশয়ও তার তিরন্দাজদের নিয়ে এখানে উপস্থিত হবেন।

সায় দিয়ে রোডেরিক বলল, হ্যাঁ রবিন। ঠিক বলেছ। এই জায়গাটা আমাদের স্বাস্থ্যের পক্ষে বিশেষ ভালো হবে বলে মনে হয়না। এইবেলা সরে পড়াই বুদ্ধিমানের কাজ।

দুজন চটপট স্থানত্যাগ করল।

বনের পথে চলতে চলতে রবিনহুড বলল, রোডেরিক, আমি ভেবেছিলাম তুমি নিতান্ত নিরীহ শান্তিপ্রিয় মানুষ। কিন্তু তোমার কাণ্ড দেখে আমি দস্তুর মতো চমকে গিয়েছি।

রোডেরিক বলল, অশান্তি যখন আঘাত হানে, শান্তিরক্ষার চেষ্টা তখন বিড়ম্বনা মাত্র। তাই নিরীহ মানষের ভমিকা ত্যাগ করে আমি যোদ্ধার ভূমিকায় অবতীর্ণ হলাম।

রোডেরিক, তোমার মুখে শুনেছিলাম তুমি নাকি ইংল্যান্ডে ছিলে না। কোথায় ছিলে জানতে চাইলেও তুমি উত্তর দাওনি। এখন যদি সেই প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করি বোধ হয় সদুত্তর পাব।

আমি দীর্ঘকাল ইটালিতে ছিলাম, একটু ইতস্তত করে রোডেরিক বলল, রবিন তোমাকে আমার ভালো লেগেছে। অত্যাচারী নর্মানদের বিরুদ্ধে তুমি ও তোমার সঙ্গীরা যেভাবে জেহাদ ঘোষণা করেছ সেটা সত্যই প্রশংসনীয়। আমিও তোমাদের দলে যোগ দিতে চাই। আশা করি শেরউড বনের আস্তানায় আমাকে স্থান দিতে এবার তুমি আপত্তি করবে না।

রবিনহুড হেসে বলল, তোমার মতো মানুষকেই তো আমরা চাই। কিন্তু দলে আসতে হলে তোমার যথার্থ পরিচয় আমাদের জানা দরকার।

ভ্রূ কুঞ্চিত করে কিছুক্ষণ নীরবে পদচালনা করল রোডেরিক, তারপর হঠাৎ মুখ তুলে বলল, সব কথাই বলব। আমার মনের মধ্যে একটা দারুণ ঝড় ছুটোছুটি করছে। কোনো একজনকে সব কথা খুলে বলতে না পারলে আমি শান্তি পাবনা। রবিন, তোমার চেয়ে উপযুক্ত শ্রোতা আর কোথায় পাব?

একটু থেমে রোডেরিক তার আত্মকথা শুরু করল, আমি পেশাদার সৈনিক, অর্থের বিনিময়ে যুদ্ধ করাই ছিল আমার জীবিকা।* ইটালিতে অবস্থিত মন্টফেরাট রাজ্যের অধিপতি প্রিন্স ফেসিনোর হাত থেকে অর্থ নিয়ে আমি তাঁর বাহিনীতে ভাড়াটে সৈনিক হিসাবে লড়াই করতে সম্মত হই। [*দ্বাদশ শতাব্দীর ইউরোপের চেহারার সঙ্গে আজকের ইউরোপের কোনোই সাদৃশ্য নেই। সেই সময় ইউরোপের বহু রাজ্যই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে বিভক্ত ছিল। ওইসব রাষ্ট্রের অধিপতিগণ প্রায় সর্বদাই পরস্পরের সঙ্গে বিবাদে লিপ্ত থাকতেন। বর্তমান কাহিনিতে উল্লিখিত মন্টফেরাট ও লোগি নামক রাজ্য দুটি তৎকালীন ইটালির উত্তর অংশে অবস্থান করত।] অনেকগুলি লড়াইতে আমি অসামান্য কৃতিত্ব প্রদর্শন করি। আমার বীরত্বে খুশি হয়ে প্রিন্স ফেসিনো আমাকে প্রচুর স্বর্ণ দিয়ে পুরস্কৃত করেন। প্রতিবেশী রাজ্য লোগির বিরুদ্ধে যুদ্ধ। ঘোষণা করলেন প্রিন্স ফেসিনো। লোগির রাজা নিকোলো সাহসী রণনিপুণ পুরুষ, তাঁর অধীনে ছিল বহুসংখ্যক বীর্যবান যোদ্ধা। বিনা প্রতিবাদে প্রিন্স ফেসিনোর হাতে রাজ্য সমর্পণ করতে রাজি হলেন না রাজা নিকোলো। যুদ্ধ ক্রমশ ভীষণ থেকে ভীষণতর হয়ে উঠল। অবশেষে একদিন প্রিন্স ফেসিনোর সৈন্যদল রাজা নিকোলোর রাজধানীর দ্বারে উপস্থিত হয়ে নগর অবরোধ করল।

সেদিন প্রভাতে প্রিন্স ফেসিনো নগর আক্রমণের পরিকল্পনা নিয়ে প্রধান সেনানায়কদের সঙ্গে পরামর্শ করছেন, এমন সময়ে হঠাৎ নগরীর সিংহদ্বার খুলে লোগি রাজ্যের রাজদূত অশ্বারোহণে সর্বসমক্ষে আত্মপ্রকাশ করল, হাতে তার শান্তির প্রতীক শ্বেত পতাকা!

যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই সন্ধির প্রস্তাব করার পাত্র তো রাজা নিকোলো নন। প্রিন্স ফেসিনো ক্রুদ্ধস্বরে বললনে, নিকোলো নিশ্চয়ই কোনো শয়তানি মতলব করেছে।

সেনানায়করাও প্রিন্সের কথায় সায় দিয়ে কয়েকটি মন্তব্য প্রকাশ করলেন। কিন্তু বেশিক্ষণ কারও মাথা ঘামাতে হল না, অশ্বারোহী রাজদূত বজ্রগম্ভীর স্বরে ঘোষণা করল, লোগি রাজ্যের অধিপতি রাজা নিকোলোর আদেশ অনুসারে ঘোষণা করছি, আমাদের নির্বাচিত যোদ্ধা প্রিন্স ফেসিনোর নির্বাচিত যোদ্ধাকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান জানাচ্ছে। দ্বৈরথ রণের ফলাফলের উপর দুই রাষ্ট্রের জয় পরাজয় নির্ধারিত হবে। আশা করি মন্টফেরাট রাজ্যের অধিপতি প্রিন্স ফেসিনো দ্বন্দ্বযুদ্ধের আহ্বান উপেক্ষা করবেন না। এই রইল লৌহ দস্তানা

একটি লৌহ-দস্তানা মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে রাজদূত বলল, যার সাহস আছে, সে এগিয়ে এসে এই দস্তানা গ্রহণ করুক।

(তখনকার দিনে ওই ভাবেই দ্বন্দ্বযুদ্ধের আহ্বান জানানো হত। যে ব্যক্তি দ্বৈরথ রণে অংশগ্রহণ করত, সে স্বয়ং গ্রহণ করত ওই লৌহ দস্তানা।)

প্রিন্স ফেসিনো তাঁর যোদ্ধা নির্বাচন করার সময় পেলেন না, তার আগেই আমি এগিয়ে এসে দস্তানা তুলে নিয়ে উচ্চৈঃস্বরে বললাম, মন্টফেরাট রাজ্যের পক্ষ থেকে আমি দ্বন্দ্বযুদ্ধের আহ্বান গ্রহণ করলাম। লোগি রাজ্যের নির্বাচিত যোদ্ধার সঙ্গে আমি একঘণ্টা পরে এখানেই মিলিত হব। রাজদূত, তোমাদের যোদ্ধাকে প্রস্তুত হতে বলো।

নগর-প্রাকারের উপরে এবং নগরীর বহির্ভাগে দণ্ডায়মান পরস্পরবিরোধী দুই দল সৈন্যের কণ্ঠে জাগল তীব্র উল্লাসধ্বনি।

একঘণ্টার মধ্যেই মস্তক, মুখ ও সর্বাঙ্গ লৌহবর্মে আবৃত করে ভল্ল, ঢাল ও রণকুঠার নিয়ে অশ্বপৃষ্ঠে আরোহণ করলাম, তারপর নগরকারের সম্মুখে মুক্ত প্রান্তরের উপর অপেক্ষা করতে লাগলাম প্রতিদ্বন্দ্বীর জন্য।

কিছুক্ষণের মধ্যেই নগরীর সিংহদ্বার দিয়ে আবির্ভূত হল আপাদমস্তক বর্মাবৃত ঢাল ও ভল্লধারী এক ব্যক্তি- রাজা নিকোলোর নির্বাচিত যোদ্ধা অর্থাৎ আমার প্রতিদ্বন্দ্বী। অশ্বপৃষ্ঠ থেকে স্থানচ্যুত হলে অথবা ভল্ল ভগ্ন হলে লড়াই করার জন্য আমি নিয়েছিলাম কুঠার আর আমার প্রতিদ্বন্দ্বী ধারণ করেছিল সুদীর্ঘ তরবারি।

মধ্যস্থ যুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্কেত দিল। সঙ্গেসঙ্গে আমরা দুই প্রতিদ্বন্দী উদ্যত ভল্ল হাতে পরস্পরকে লক্ষ্য করে ঘোড়া ছুটিয়ে দিলাম। আমরা পরস্পরের ভল্পের আঘাত ঢালের উপর গ্রহণ করলাম এবং সংঘাতের বেগে ভারসাম্য হারিয়ে ঘোড়ার পিঠ থেকে ছিটকে পড়লাম মাটির উপর। এবার আর ঘোড়ার পিঠে নয়, মাটির উপর দাঁড়িয়ে শুরু হল মৃত্যুপণ যুদ্ধ। আমি তুলে নিলাম রণকুঠার, প্রতিদ্বন্দ্বীর হাতে ঝক ঝক করে উঠল শাণিত তরবারি।

ঊর্ধ্বে তরবারি তুলে আমার প্রতিদ্বন্দ্বী কঠোর স্বরে বলল, তোর শরীর মানুষের কিন্তু মাথাটা কুকুরের। কুকুরের মাথা মানুষের দেহে শোভা পায়না। অতএব মাথাটা আমি এখনই কেটে ফেলব।

দারুণ ক্রোধে আমার রক্ত উষ্ণ হয়ে উঠল, কুঠার আস্ফালন করে বললাম, আমার কুঠার তৃষ্ণার্ত হয়েছে। ওরে লোগির শূকর, তোর রক্তে কুঠারের তৃষ্ণা শান্ত করব।

প্রতিদ্বন্দী সবেগে ছুটে এসে আঘাত হানল। কুঠারে প্রতিহত হল তরবারি। আবার, আবার, আবার। বারংবার হত্যার আগ্রহে ঝাঁপ দিল তরবারি এবং প্রতিবারই কুঠার ফলকে ব্যর্থ হল আক্রমণ। তারপর আমি এক নতুন কৌশল অবলম্বন করলাম। কুঠার নামিয়ে এগিয়ে গেলাম প্রতিদ্বন্দ্বীর দিকে। সে তৎক্ষণাৎ আঘাত হানল আমার অরক্ষিত মস্তক লক্ষ্য করে। আমি কুঠার তুললাম, কিন্তু কুঠার ফলকের পরিবর্তে আড়াআড়িভাবে হাতলের উপর অসির আঘাত গ্রহণ করলাম। প্রচণ্ড সংঘাতে অসিধারীর হাতের মাংসপেশী ক্ষণিকের জন্য অসাড় হয়ে গেল; মুহূর্তের দুর্বলতার সুযোগ নিলাম আমি, দুই হাতে কুঠার ধরে প্রচণ্ড আঘাত হানলাম প্রতিদ্বন্দ্বীর স্কন্ধে। সেই দারুণ আঘাত সহ্য করতে পারল না লোগির যোদ্ধা, সে লুটিয়ে পড়ল মাটির উপর। প্রিন্স ফেসিনোর সৈন্যদল উল্লাসে গর্জন করে উঠল। নগরকারের শত্রু সেনা স্তব্ধ নির্বাক।

আমি এগিয়ে গেলাম। লৌহ-মুখোশ উন্মোচন করে শত্রুর মুখ দেখব এবং চরম আঘাতে শেষ করে দেব তার ইহলীলা। একহাতে মুখোশ খুলে অন্য হাতে কুঠার তুলে ধরলাম।

সঙ্গেসঙ্গে হিম হয়ে গেল আমার দেহের রক্ত, এ কি! আমার ছোটো ভাই ফিলিপ! একেই আমি আঘাত করেছি। হয়তো এই আঘাতের ফলে তার মৃত্য হবে, শেষকালে ভ্রাহ্য করলাম।

কে জানত আমার ভাই ফিলিপও সৈনিকের পেশা গ্রহণ করেছে এবং নিয়তির নিষ্ঠর পরিহাসে ইটালিতে এসে আমার বিরোধীপক্ষে যোগ দিয়েছে।

দেখলাম তখনও তার দেহে প্রাণ রয়েছে। তাকে দুই হাতে তুলে নিলাম আমার বুকের উপর।

প্রিন্স ফেসিনোর সেনাদল তখন আমার নামে জয়ধ্বনি তুলে আকাশ ফাটাচ্ছে। কিন্তু আমি কোনোদিকে দৃকপাত না করে ভাইকে নিয়ে প্রবেশ করলাম আমার নিজস্ব শিবিরে এবং শুইয়ে দিলাম আমারই শয্যার উপর।

সেই শয্যাই হল তার মৃত্যুশয্যা। প্রিন্স ফেসিনোর প্রধান চিকিৎসক যথাসাধ্য চেষ্টা করেও আমার ভাইকে বাঁচাতে পারলেন না। ফিলিপের মৃত্যুর সঙ্গেসঙ্গে আমি ইটালি ছেড়ে মাতৃভূমি ইংল্যান্ডে ফিরে আসার জন্য প্রস্তুত হলাম।

প্রিন্স ফেসিনো প্রচুর ধনদৌলত নিয়ে আমায় সাধাসাধি করলেন, বললেন, রোডেরিক, যদি তুমি আমার জন্য লড়াই করো তাহলে এই ধনদৌলত তোমার হবে। ভবিষ্যতে আমি তোমাকে আরও অর্থ দেব প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি।

অভিবাদন জানিয়ে বললাম প্রিন্স ফিলিপ! আমি আর কোনোদিন লড়াই করব না। ভাই-এর মৃতদেহ স্পর্শ করে আমি অস্ত্রত্যাগ করার শপথ গ্রহণ করেছি। বিদায়!

সেখান থেকে এসে পৌঁছোলাম ইংল্যান্ডে। ইংল্যান্ডের বিভিন্ন স্থানে ঘুরতে ঘুরতে একদিন উপস্থিত হলাম আলসফোর্ড শহরের সরাইখানায়, তারপর যা ঘটেছে তা তুমি জানো।

রবিনহুড হেসে বলল, কিন্তু রোডেরিক, তোমার শপথ ভঙ্গ হল যে!

 রোডেরিক বলল, সেজন্যে আমি কিছুমাত্র দুঃখিত নই। মহৎ কারণেই আমি শপথ ভঙ্গ করেছি। অর্থোপার্জনের জন্যে যুদ্ধের নামে নরহত্যা করা অনুচিত, কিন্তু অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করাই প্রকৃত যোদ্ধার কর্তব্য।

রবিনহুড সঙ্গীর কাঁধে হাত রেখে বলল, আমাদের দলে এসে সেই কর্তব্য করার সুযোগ তুমি নিশ্চয়ই পাবে, রোডেরিক।

অস্তায়মান সূর্য যখন পৃথিবীর কাছে বিদায় গ্রহণ করছে, সেই সময় রবিনহুড ও বোডরিক প্রবেশ করল শেরউড বনের অভ্যন্তরে।

রবিনহুডের কাছে সমস্ত ঘটনা শুনে আর রোডেরিকের প্রকৃত পরিচয় পেয়ে উচ্ছ্বসিত আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠল শেরউড বনের মুক্তিবাহিনী। উচ্ছ্বাসের কারণ ছিল; রোডেরিকের মতো দুর্ধর্ষ যোদ্ধাকে দলে পাওয়া তো ভাগ্যের কথা। কেবলমাত্র ফ্রায়ার টকের আচরণে উত্তেজনার চিহ্নমাত্র দেখা গেল না, দাড়িতে হাত বুলিয়ে শান্তস্বরে সে বলল, আমি তো আগেই বলেছিলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *