1 of 3

বন্ধুর মতো

বন্ধুর মতো

ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে রঞ্জন বলল, এই বাড়ি। দিশা মুখ তুলে তাকাল। পাঁচতলা ঝকঝকে। বাড়ি, সামনে গেট, নিচে কার-পার্কিং। বেশ সমৃদ্ধ চেহারা। আসার সময় দেখে বুঝেছে পাড়াটাও বেশ সমৃদ্ধ। অতএব ফ্ল্যাটের ভাড়া নিশ্চয়ই কম হবে না। রঞ্জন বলল, চলো।

বাড়িটা পাঁচতলা হলেও লিফট আছে। দারোয়ান জানতে চাইল তারা কার কাছে যাবে। জেনে লিফট দেখিয়ে দিল। স্বয়ংচালিত লিফট বারো তলায় উঠে বাঁ-দিকের দরজার বেল টিপল রঞ্জন, যার পাশে লেখা রয়েছে আর সামন্ত। কয়েক মিনিট পরে কি-হোলে চোখের তারা, দরজা ঈষৎ খুলে চেনে আটকে গেল, কি ব্যাপার? এক মহিলার গলা।

আমি রঞ্জন। আপনাকে ফোন করেছিলাম।

চেন খুললেন যিনি তাঁর বয়স সত্তর পেরিয়ে গিয়েছে পরনে হাউসকোট, কাঁধ-ছোঁয়া চুলে রুপোলি ছোপ। হাত নেড়ে বললেন, আসুন।

সোফায় মুখোমুখি বসার পর মহিলা জিজ্ঞাসা করলেন, অপু আপনার কথা আমাকে বলেছে। তবু, আপনার প্রফেশন কি?

আমার একটা অ্যাড এজেন্সি আছে। রঞ্জন বলল।

আপনি আর অপু একসঙ্গে পড়তেন?

হ্যাঁ। আমরা প্রেসিডেন্সিতে একসঙ্গে পড়েছি।

এখন কোথায় আছেন?

আমার পৈতৃক বাড়ি গড়পারে। বেশ অসুবিধা হচ্ছে ওখানে। রঞ্জন বলল।

আপনি?

আমি দিশা। কলেজে পড়াই।

কি সাবজেক্ট?

ইকনমিক্স।

আমি আপনাদের চা অফার করতে পারছি না, কারণ কাজের মেয়েটি এখনও আসেনি। উনি চলে যাওয়ার পর অনেকদিন ঠেকিয়ে রেখেছিলাম অপুকে, আর পারলাম না। ওর কাছে যেতেই হচ্ছে। অবশ্য বয়স বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে অক্ষমতাও চেপে ধরছে। যাক গে। অপু যখন আপনাকে রেফার করছে তখন আমার আপত্তি নেই। কিন্তু একটা ব্যাপারে সমস্যা হতে পারে। বৃদ্ধা তাকালেন।

বলুন।

প্রতি বছর যে কবছর বাঁচব, আমার স্বামীর মৃত্যুদিনে আমি এই ফ্ল্যাটে থাকব। সেজন্যে বছরে দিন দশেকের জন্যে কলকাতায় আসব। মুশকিল হল, আমি কারও সঙ্গে শেয়ার করে থাকতে। পারি না। অপু ওর লং আইল্যান্ডের বাড়ির আউট হাউস আমার জন্যে ছেড়ে দিচ্ছে। তাই আমি এলে–। বৃদ্ধা আচমকা চুপ করলেন।

কোনও সমস্যা হবে না। এই ফ্ল্যাট যেমন আছে ঠিক তেমন রেখে আমরা দিন পনেরোর জন্যে বাইরে বেড়াতে যেতে পারি।রঞ্জন হাসল।

তাহলে তো কোনও সমস্যা নেই। হ্যাঁ, দেখতেই পাচ্ছেন, পুরো ফ্ল্যাটই সাজানো। বেডরুম চারটে। আপনারা তো দুজন, এত লাগার কথা নয়। একটি ঘর, যেখানে আমার স্বামী থাকতেন, আমি লক করে যাব। চলুন, ফ্ল্যাটটা দেখে নিন। বৃদ্ধা উঠলেন। রঞ্জন বলল, আপনি আমাদের তুমি বলুন।

ওটা আমার জিভে চট করে আসে না।

বৃদ্ধার ফ্ল্যাট দেখে দিশা খুব খুশি। অন্তত আড়াই হাজার স্কোয়ার ফিট। সর্বত্র রুচির ছাপ। কিচেনটা বিশাল। তাতে সব আছে। বৃদ্ধা বললেন, এখানে থাকলে আপনাদের কিছুই আনতে হবে না। পছন্দ হয়েছে?

খুব। দিশা হাসল।

আমি একটা অনুমতিপত্র লিখে রাখব। ওটা থাকলে কোনও প্রশ্ন উঠবে না। হ্যাঁ, আমি কিন্তু আঠারো তারিখে চলে যাচ্ছি।

দশদিন বাকি। রঞ্জন হিসেব করল, কিন্তু–

বৃদ্ধা তাকালেন।

রঞ্জন ইতস্তত করল, আসলে অপুর সঙ্গে আমার টাকাপয়সা নিয়ে কথা হয়নি।

টাকা-পয়সা কেন? আমি তো আপনাকে ভাড়া দিচ্ছি না। আপনি আমার ছেলের বন্ধু, তাই আপনাকে কেয়ারটেকার হিসেবে থাকতে দিচ্ছি। এরমধ্যে টাকাপয়সার কথা উঠছে কেন? উলটে আপনি টেক কেয়ার করবেন বলে আপনাকেই আমার কিছু দেওয়া উচিত। হ্যাঁ, এমন হতে পারে, আমি মন পালটালাম, ছয় মাস পরে ঠিক করলাম কলকাতায় চলে আসব, তাহলে অন্তত এক মাস আগে আপনাকে জানাব। ভদ্রমহিলা জানিয়ে দিলেন।

রঞ্জন দিশার দিকে তাকাল। দিশা কি বলবে ভেবে পেল না। তাই দেখে বৃদ্ধা মাথা নাড়লেন, না। এক বছরের মধ্যে সেরকম কিছু ঘটবে বলে মনে হয় না। আপনি রবিবার বিকেলে আমার সঙ্গে দেখা করুন।

বিদায় নিয়ে ওরা বেরিয়ে এল বাইরে। রঞ্জন জিজ্ঞাসা করল, কীরকম লাগল?

খুব খারাপ। দিশা হাঁটতে-হাঁটতে বলল।

কেন?

উনি ভাড়া নেবেন না, মনে হবে কারও অনুকম্পায় আমরা থাকছি। দিশা জানাল।

অনুকম্পা বলছ কেন? ওঁর প্রয়োজনের সঙ্গে আমাদের প্রয়োজন মিলে যাচ্ছে বলেই থাকছি। অপু আমার বন্ধু। ওর সঙ্গে ফানে এ ব্যাপারে কথা হয়েছে আমার। ইলেকট্রিক, টেলিফোন তো ব্যবহার করব আমরা, তার বিল আমরাই দেব। রঞ্জন বোঝাল।

রঞ্জনের বয়স এখন বিয়াল্লিশ। এতদিন ইচ্ছে হয়নি বলে বিয়ে করেনি। ওর দুই ভাই বিবাহিত, একজন মুম্বাইতে থাকে, দ্বিতীয়জন একই বাড়িতে। মা মারা গিয়েছেন গত বছর। এবং তারপরেই ওর আলাপ হয় দিশার সঙ্গে। মাথার ওপর কোনও অভিভাবক নেই, আলাপ ঘনিষ্ঠ হলে বিয়ের প্রসঙ্গ আসবেই। এবং ওখানেই সমস্যার শুরু।

ইকনমিক্সে এম এসসি করার পর পরীক্ষা-টরীক্ষা দিয়ে দিশা চাকরি পেয়ে গিয়েছিল দমদমের একটা কলেজে। ওর বাবা-মা থাকতেন সিউড়িতে। ছাত্রী জীবন কেটেছে হোস্টেলে। এখনও সে থাকে ওয়ার্কিং গার্লস হোস্টেলে। এক ঘরে একা। তার এই আটত্রিশ বছরের জীবনে বার তিনেক রোমান্সের ছোঁয়া লাগতে-লাগতে লাগেনি স্রেফ নিস্পৃহতার জন্যে। শুরুর দিকে যে ভালোলাগা তৈরি হত তা খানিকবাদে ভয়ে রূপান্তরিত হত। ওর ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল কারণ ওই তিনজন পুরুষই ছিল উড়ে আসানীড়ের পাখির মতো, নীড় বাঁধবার ইচ্ছে কারও ছিল না। তারপর। নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল দিশা। ছাত্রীদের পড়ানো, লাইব্রেরিতে বই ঘাঁটায় সময়টা কাটিয়ে দিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল। হঠাই রঞ্জনের সঙ্গে আলাপ। একটি ভদ্র মানুষের সঙ্গে ক্রমশ। মানসিকভাবে জড়িয়ে গিয়েছে সে। এই এক বছরে ওরা কোথাও এক রাতের জন্যে বেড়াতে যায়নি। কোনও রেস্তোরাঁর ঘেরাটোপে সময় কাটায়নি। পথ চলতে গিয়ে হঠাৎ সামান্য ছোঁয়াছুয়ি আকস্মিকভাবে হওয়া ছাড়া কেউ কারও হাতে হাত রাখেনি। কিন্তু যেই বিয়ের কথা মনে এল অমনি সন্ত্রস্ত হল দিশা। প্রায় অচেনা একটি মানুষের সঙ্গে চব্বিশ ঘণ্টা থাকতে হবে, এই বয়সে মানুষটির প্রয়োজনে বিছানায় বিবস্ত্র হতে হবে ভাবতেই কীরকম শীতল হয়ে যাচ্ছিল শরীর। আর এই সময়, মাত্র মাস খানেক আগে বিয়ের কথা উঠল। দিশা মুখ নিচু করেছিল, এই তো ভালো, ভালো না?

তার মানে? চোখ কপালে তুলেছিল রঞ্জন! তুমি কি আমার সঙ্গে বাকি জীবন থাকতে চাও না?

মাথা নেড়েছিল সম্মতিতে, কিন্তু মুখে কিছু বলেনি দিশা।

রঞ্জন গলা নামিয়েছিল, কি ব্যাপার বলো তো?

আমায় ভয় করে।

ভয়, কেন?

যদি বিয়েটা ভেঙে যায়। এই বয়সে বিয়ে করার পর সেটা হলে মুখ দেখাতে পারব না। মাথা নাড়ল দিশা, যেন ভবিষ্যতে যেটা ঘটবে সেটা চোখের সামনে দেখতে পেল।

রঞ্জন অবাক। বলল, আমার মধ্যে কি এমন কিছু দেখেছ যে মনে হচ্ছে বিয়ে ভেঙে যাবে?

দূর! তা না। আসলে নিজেকে ভয় করে।

কথাগুলো দিশা বললেও দেখাশোনা বন্ধ হল না। সপ্তাহে অন্তত চারদিন দেখা না করলে বুকে। ভার জমে। যে দিন দেখা হওয়ার কথা সে দিন সকালে ঘুম ভাঙতেই অদ্ভুত ভালোলাগা ছড়িয়ে পড়ে মনে।

শেষপর্যন্ত সে জিজ্ঞাসা করেই ফেলল, তোমার এমন হয়?

হুঁ। হয়। রঞ্জন মাথা নেড়েছিল।

শেষপর্যন্ত ওরা সিদ্ধান্তে এল, একসঙ্গে থাকবে। দুজন পুর্ণবয়স্ক মানুষ একসঙ্গে থাকতে গেলে বিয়ে করতেই হবে তার কোনও মানে নেই। বিয়ে করার পর স্বামী-স্ত্রীরা খেয়োখেয়ি করেও একসঙ্গে থাকছে, পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস, সন্দেহ নিয়েও বিয়ের বাঁধনটাকে ছিঁড়তে পারছে না, এরকম দৃষ্টান্ত চারপাশে ছড়িয়ে। সে দিন একটা কাগজে সমীক্ষা পড়েছিল, আশি শতাংশ। দম্পতির সম্পর্ক সুখের নয়। বিয়ে না করে একসঙ্গে থেকে যদি সেই পরিস্থিতি তৈরি হয় তাহলে বন্ধুত্ব রেখেই আলাদা হওয়া যেতে পারে। এখন তো বিবাহ বহির্ভূত একসঙ্গে থাকাকে আইন। স্বীকৃত দিয়েছে। বিচ্ছেদের জন্য তো কোর্টে যেতে হচ্ছে না। সেখানে দাঁড়িয়ে দুজনের কেচ্ছা শোনাতে হবে না।

কিন্তু আত্মীয়স্বজন? দিশার মনে তখনও অস্বস্তি।

কৈফিয়ত দেওয়ার দরকার কি?

প্রশ্নের মুখ কি দিয়ে চাপা দেব?

বলবে আমরা ভালোবেসে একসঙ্গে থাকছি।

যদি না থাকতে পারি, তাহলে তো হাসাহাসির পাত্র হব।

তা হব। হয়তো ওদের সামাজিক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পাব না।

না পাই, ও নিয়ে আমি মোটেই ভাবিত নই। আচ্ছা, যদি বলি বিয়ে করেছি, রেজিস্ট্রি করেছি। তাহলে সব মুখ বন্ধ হয়ে যাবে।

মিথ্যে কথা?

যুধিষ্ঠিরও বলেছিলেন। দিশা বলল, লোকে জানুক কিন্তু ছাড়াছাড়ি যদি হয় তাহলে তো উকিলের কাছে ছুটতে হবে না। তাই না?

কিন্তু তুমি যদি প্রথম থেকেই কু গাও–।

কু গাই মানে?

ওই যে এখনও একসঙ্গে থাকলাম না, আর তুমি ছাড়াছাড়ির কথা ভাবছ! এত বেশি ভাবলে তো সত্যি হয়ে যেতে পারে। রঞ্জন বলেছিল।

না। উলটো। ভাবছি বলেই ওটা যাতে সত্যি না হয় তার জন্যে সতর্ক থাকব আমরা। বিয়ের মন্ত্রের চেয়ে বিয়ে না করে থাকার অঙ্গীকারে অনেক বেশি দায়িত্ব এসে যায়। তাই না? দিশা সহজ হয়েছিল।

সিদ্ধান্ত নেওয়ামাত্রই তো কার্যকর করা যায় না। রঞ্জনের পক্ষে ছোট ভাই এবং তার স্ত্রীকে জানাতে সময় লাগল। জানার পর স্বাভাবিকভাবেই মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেল। এত দিন পরে দাদা বিয়ে করছে, পাত্রীটি তাদের অপরিচিতা, শাস্ত্র মেনে বিয়ে হবে না, এবং বিয়ের পর দাদা বউদি এ-বাড়িতে থাকবে না। তারা যে উপেক্ষিত এতে মনে ক্ষুণ্ণভাব এলেও ওরা যে এই। বাড়িতে থাকছে না তাতে এক ধরনের স্বস্তি এল। একটু দূরের আত্মীয়রা আশা করল, একটা উৎসবের আয়োজন করা হবে এবং সেখানেই তাঁরা স্বীকৃতি দেবেন। রঞ্জন জানিয়ে দিল, কোনও উৎসব করা হচ্ছে না। সবাই ভাবল বেশি বয়সের বিয়ে বলে রঞ্জন লজ্জা পাচ্ছে।

দিশা অবশ্য তেমন কোনও প্রশ্নের সামনে পড়েনি। দীর্ঘকাল একা থাকার ফলে সিউড়ির বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক তো শিথিল হয়েই এসেছিল। ভাইরা রোজগার শুরু না করা পর্যন্ত সে টাকা পাঠিয়ে দিয়েছে প্রতি মাসে। তখন বাড়ি গেলে যে আদরযত্ন পেত, ওরা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর টাকা পাঠানো বন্ধ করলে সেটা দ্রুত কমে গেল। সে বিয়ে করবে না, বাকি জীবন একা থাকবে, এরকমটাই ধরে নিয়েছিল সবাই। অতএব ওরা যখন দিশার চিঠিতে ব্যাপারটা জানতে পারল তখন চুপচাপ মেনে নিল। ছোট ভাই জানত দিশার প্রভিডেন্ট ফান্ডের নমিনি হিসেবে তার নাম আছে। দিদি কি সেটা বদলে দেবে? কৌতূহলটা সে প্রকাশ করতে পারল না।

রবিবারে গিয়েছিল রঞ্জন। বন্ধুর মায়ের সঙ্গে দেখা করে কাগজপত্র নিয়েছিল। ওই ফ্ল্যাটের টেলিফোন এবং ইলেকট্রিকের টাকা ওঁর ব্যাঙ্ক থেকেই দিয়ে দেওয়া হয়। প্রতিমাসে রঞ্জনকে সেই অ্যাকাউন্টে বিলের টাকা জামা দিতে হবে। কেয়ারটেকারকে ডেকে তিনি রঞ্জনের পরিচয় দিলেন আত্মীয় বলে। ওঁর অনুপস্থিতিতে রঞ্জন সস্ত্রীক এখানে থাকবে, ফ্ল্যাটে ঢোকার একটি চাবি তিনি রঞ্জনকে দিয়ে বললেন, অন্যটা আমার কাছে রইল।

আপনার ফ্লাইট কবে?কখন?

কেন? তুমি আমাকে দমদমে পৌঁছাতে যাবে নাকি?

আপনি যদি আপত্তি না করেন।

না-না। ও ব্যাপারে আমার কোনও অসুবিধে হয় না। তা ছাড়া তুমি তো তোমার বন্ধুর মায়ের খবর কোনওদিন নাওনি, এখন এসব করলে মনে হবে চক্ষুলজ্জায় করছ। ভদ্রমহিলা বলেছিলেন।

দিন ঠিক হল। মাসের প্রথম তারিখেই ওরা নতুন জীবন শুরু করবে। তবে দু-জনে আলাদা ভাবে ওই বাড়িতে যাওয়া ঠিক নয়। ওরা যে বিবাহিত নয় তা প্রচার করে লাভ কি! অতএব রঞ্জন ট্যাক্সি নিয়ে দুপুরের শেষে দিশার হোস্টেলে এল।

এ ক্ষেত্রে হোস্টেলের ঘর ছেড়ে দেওয়াই স্বাভাবিক। দিশাও ভেবেছিল কর্তৃপক্ষকে নোটিস দিয়ে দেবে। যে ঘরে দীর্ঘকাল একা কাটালো সেই ঘরে নিশ্চয়ই অন্য মেয়ে আসবে। শেষ মুহূর্তে মত বদলাল সে। এখনও ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত না জানিয়ে কিছুদিন পরেও তো জানান যেতে পারে। বিশেষ কাজে কিছুদিন বাইরে থাকতে হবে বলে টাকা দিয়ে গেলে কর্তৃপক্ষ নিশ্চয়ই মেনে নেবেন। তার এতদিন এখানে থাকার কারণে কেউ প্রতিবাদ করবে না। শেষপর্যন্ত তাই করল সে।

দুটো সুটকেশ হোস্টেলের দারোয়ান তুলে দিয়ে গেল ট্যাক্সিতে। ট্যাক্সি ছাড়তে রঞ্জন বলল, তোমার যাবতীয় সম্পদ ওই দুটোয় ভরে গেল?

না বলতে গিয়ে সামলে নিশ দিশা। উত্তরে শুধুই হাসল। ঘর ছেড়ে না দিয়ে আসার কথা শুনলে রঞ্জনের কি প্রতিক্রিয়া হবে তার জানা নেই। পরে ওকে বুঝিয়ে বলা যাবে। সে জিজ্ঞাসা করল, তোমার?

সব তো আনা যায় না। যা প্রয়োজনীয় তা নিয়ে এসেছি। ওখানে তো কোনও কিছুর অভাব নেই। শুধু ব্যক্তিগত জিনিস থাকলেই দিব্যি চলে যাবে। তারপর স্বর নামিয়ে জিজ্ঞাসা করল, দিশা,। এখন এই মুহূর্তে তোমার কেমন লাগছে?

দিশা বলল, যেমন লাগা উচিত!

রঞ্জন হাসল, আর কথা বাড়াল।

একটি ঘর তালা বন্ধ কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। দুজনের জন্যে ফ্ল্যাটটা এত বড় যে প্রথমেই একটি কাজের লোকের কথা মনে এল দিশার। এতদিন সে হোস্টেলের একটি ছোট ঘরে থেকেছে। ঘরটাকে পরিষ্কার রাখতে তার মোটেই বেশি পরিশ্রম করতে হত না। কিন্তু এত বড় ফ্ল্যাট পরিষ্কার রাখা তার একার পক্ষে সম্ভব নয়। জিনিসপত্র নামিয়ে রেখে ওরা হলঘরের সোফায় বসেছিল। দিশা জিজ্ঞাসা করল, তোমার বন্ধুর মায়ের নিশ্চয়ই মেইড সার্ভেন্ট ছিল, সে কোথায়?

রঞ্জনের মনে পড়ে গেল, তোমাকে বলাই হয়নি। রবিবারে যখন ওঁর সঙ্গে দেখা করতে এখানে এসেছিলাম তখন প্রসঙ্গটা তুলেছিলাম। শুনলাম যে কাজ করত সে নাকি দীর্ঘকাল ওঁর সঙ্গে ছিল। তার বয়স হয়েছে এবং উনি আমেরিকায় চলে যাচ্ছেন বলে সে তার দেশের বাড়িতে গিয়ে। শেষ জীবন কাটাতে চায়। অতএব তাকে পাওয়া যাবে না।

বাঃ। তাহলে এখন কি হবে?

খুঁজে পেতে হবে। কেয়ারটেকারকে বললে নিশ্চয়ই ব্যবস্থা করে দেবে কাউকে।

তাহলে যাও, আজই বলে এসো। কাল সকাল থেকে চাই।

রঞ্জন উঠল। টেবিলের কাছে গিয়ে বলল, লোকটাকে এখানে ডাকি।

ইন্টারকমের বোতাম টিপে অনুরোধ জানিয়ে ফিরে এসে বলল, আজকের রাত্রে আর বাড়িতে রান্না করার দরকার নেই, বাইরে খাব!

রান্না করতে হলে কি ভাবে হত?

কেন? কিচেনে তো গ্যাস সিলিন্ডার আছে।

ব্যস? গ্যাস জ্বালালেই রান্না হয়ে যাবে? রান্নার আগে তো বাজার করতে হবে।

ওহো। তা বটে। আসলে কোনওদিন সংসারের এ-দিকটা নিয়ে মাথা ঘামাতে হয়নি।

আমিও তাই। সতেরো বছর হোস্টেলের রান্না খাচ্ছি। রান্নাঘরে ঢোকার দরকারই ছিল না।

তাহলে তো তোমার পক্ষে রান্না করা সমস্যা হয়ে যাবে। চিন্তায় পড়ল রঞ্জন। হাসল দিশা, এসব নিয়ে আমরা আগে আলোচনা করিনি, করা উচিত ছিল।

কেন?

তাহলে সিন্ধান্ত নেওয়ার আগে ভাবনা-চিন্তা করা যেত। দিশা মুখ তুলল।

দূর। সম্পর্ক ভালো হলে এটা কোনও পয়েন্টই না। আজকাল হোম ডেলিভারির মাধ্যমে দারুণ খাবার পাওয়া যায়। এ-বাড়িতে একটা ভ্যাকুয়াম ক্লিনার আছে, দেখছি। ওটা দিয়ে আমি রোজ ধুলো পরিষ্কার করে দেব। জামাকাপড় লন্ড্রিতে দেওয়া যাবে। রঞ্জনের কথা শেষ হতে-না হতেই বেল বাজল। সে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলতেই কেয়ারটেকারকে দেখতে পেল, ইয়েস স্যার।

আসুন।

মাঝবয়সি ভদ্রলোক ঘরে ঢুকে দিশাকে নমস্কার করলেন।

রঞ্জন বলল, কয়েকটা ব্যাপারে আপনার সাহায্য চাই।

বলুন।

কাজের লোক চাই। হোলটাইমার। রঞ্জন বলল।

না-না। হোলটাইমারের দরকার নেই। শুধু সকালটা হলেই চলবে। দিশা প্রতিবাদ করল। রঞ্জন বলল, কেন? বিকেলে, মানে রাত্রের ব্যাপারটাই।

কেয়ারটেকার বললেন, ম্যাডাম ঠিক বলেছেন স্যার। প্রথমত হোলটাইমার পাওয়া প্রায় অসম্ভব। কাজ না জেনেও প্রচুর টাকা চাইবে। তার ওপর বিশ্বাস করে বাড়ির দায়িত্ব দেওয়া নিশ্চয়ই ঠিক হবে না। তুলনায় পার্টটাইমার চেষ্টা করলেই পাওয়া যেতে পারে।

মেনে নিল রঞ্জন, ঠিক আছে, কাল সকাল থেকে কাউকে আসতে বলুন।

এত তাড়াতাড়ি হবে কি করে স্যার? এ-বাড়িতে যারা কাজে আসে তাদের বলতে হবে। সবাই তো প্রচুর কাজ করে, তার মধ্যে যাদের সময় আছে তাদের কাউকে খুঁজে বের করতে হবে। কেয়ারটেকার বললেন। দাঁড়ান। আমাদের এখানে যে কাজ করতে আসবে সে কি অন্য বাড়িতেও কাজ করবে?

পার্টটাইমাররা তো তাই করে। যে কাজের দায়িত্ব শুরুতে দেবেন তা আধঘণ্টার মধ্যে শেষ করে অন্য বাড়িতে চলে যাবে। কেয়ারটেকার এ ব্যাপারে ওয়াকিবহাল করলেন।

কি আশ্চর্য। আমি ভেবেছিলাম যে আসবে সে সমস্ত সকাল এখানে থাকবে। রঞ্জন বলল।

আপনাকে পাঁচ গুণ চার্জ দিতে হবে স্যার। আচ্ছা। কেয়ারটেকার চলে গেলেন।

চিন্তিত রঞ্জন বলল, কি করা যায় বলো তো?।

দিশা হাসল, আপাতত ওসব ভাবনা মাথা থেকে সরিয়ে আরাম করে বোসো।

রঞ্জন কিছু বলতে গিয়ে মন বদলাল, আমরা সংসার করব অথচ নির্ভর করতে হবে অজানা অচেনা একজনের ওপর। অদ্ভুত!

বিদেশে কিন্তু এই তৃতীয়জন থাকে না। দিশা বলল।

রাইট। ওরা যদি পারে তাহলে আমরা কেন পারব না। এই ফ্ল্যাটে সব আধুনিক ব্যবস্থা আছে।

একটা রান্নার বই কিনে নিলেই হবে।

রঞ্জনের গলায় উত্তেজনা।

হোম ডেলিভারি। নিচু গলায় বলল দিশা।

ফ্ল্যাটটা আর একবার জরিপ করে নিয়ে নিজের স্যুটকেশ যে বেডরুমে ঢোকাল দিশা সেখানে সুন্দর বিছানা পাতা রয়েছে বার্মা টিকের কাঠের খাটে। টেবিল চেয়ার, ড্রেসিং টেবিল আয়না, দেওয়াল আলমারি, যা-যা দরকার সব চার পাশে। এমনকী একটা হেয়ার ড্রায়ারও চোখে পড়ল। খুশি হয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েই দরজায় রঞ্জনকে দেখতে পেল দিশা।

এই ঘরটাকে পছন্দ হল? রঞ্জন হাসল।

হ্যাঁ, বেশ ভালো।

তাহলে আমি পাশের ঘরটা নিই? রঞ্জন দাঁড়াল না।

থমকে গেল দিশা। বিয়ে না করে বিবাহিত জীবনযাপন করতে গেলে কি আলাদা শুতে হয়? অথচ এখন ব্যাপারটা ভাবতেই এক ধরনের আড়ষ্টতা এসে যাচ্ছে। বিয়ের মন্ত্র বা সই কি সেই আড়ষ্টতা দূর করতে সাহায্য করে? আবার, একসঙ্গে এক ঘরে থাকলেই কি সে রঞ্জনকে দেওয়াল ড্রেসিং টেবিল ভাবতে পারবে? ওর সামনে পোশাক পালটাতে পারবে? অসম্ভব। তবু এই ভালো। না হয় রাত্রে দরজাটা ভেজিয়ে রাখবে কিন্তু আলাদা ঘরে একা শোওয়ার স্বস্তিটা তো থাকবে। কোথায় যেন পড়েছিল, বিদেশে স্বামী-স্ত্রীরাও আলাদা ঘরে শোয় তাদের ব্যক্তিগত। গোপনীয়তা বজায় রাখতে।

ঘরটা বড়। স্যুটকেশ খুলে পাজামা-পাঞ্জাবি বের করল রঞ্জন। একটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া হচ্ছে তার মনে। দু-জনের ঘর আলাদা হয়ে কতটা ভালো বা মন্দ হল ঠিক বুঝতে পারছিল না রঞ্জন। জীবনে প্রথমবার সে একটি নারীর সঙ্গে একত্রে থাকছে, সেটা অবশ্যই আলাদা ঘরে থাকলে শিহরিত হওয়ার কথা নয়। কয়েকদিন ধরে সে আজকের রাতটার কথা ভাবছিল। এই রাতটাকে অবশ্যই ফুলশয্যার রাত বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু এখানে আসার পর দিশার আচরণে কোনও আবেগ না দেখে সেও সৌজন্যের বাইরে যেতে পারেনি। এখন দিশা যখন তার শোওয়ার ঘর নির্বাচন করে ফেলেছে তখন জোর গলায় বলতে পারেনি, আমিও তোমার ঘরে থাকব। মনে একটু ভার জমলেও পাশাপাশি একটা তিরতিরে স্বস্তি টের পাচ্ছিল রঞ্জন। এতটা বয়স একা একা থেকে এমন একটা অভ্যেস তৈরি হয়ে গিয়েছে যে কারও সঙ্গে রাত্রিবাস করার কথা ভাবতে পারত না। অন্য কারও জন্যে নিজস্ব অভ্যেসগুলোর পরিবর্তন করা সম্ভব নয় বলে মনে হত। আজ অন্য আবেগে আক্রান্ত হয়ে সেটাকে উপেক্ষা করতে যাচ্ছিল সে, না হওয়ায় যেন স্বস্তি এসে গেল চুপিচুপি।

পাজামা-পাঞ্জাবি পরে বসার ঘরে ঢুকে প্রথম জানলাগুলো খুলে দিল রঞ্জন। সামনের অনেকটা খোলা। সূর্য ডুবছে। ছায়া-ছায়া বিকেল।

কি দেখছ?

দিশার গলার শুনে পেছন ফিরে তাকিয়ে চমকে উঠল রঞ্জন। সালোয়ার কামিজে এখন দিশাকে অপূর্ব দেখাচ্ছে। আকাশিনীল স্থির হয়ে আছে পোশাকে। এতদিন, যখনই দেখা হয়েছে ওকে। শাড়িতে দেখেছে। সে দ্রুত এগিয়ে গেল। দুটো হাত দিশার কাঁধে রেখে বলল, তোমাকে কী সুন্দর লাগছে।

দিশার গালে কি লালের ছোঁয়া লাগল, যাঃ।

আমায় দ্যাখো।

এই বয়সে কখনও সুন্দর লাগে?

কেন নয়? গায়ত্রী দেবী, ইন্দিরা গান্ধি, সুচিত্রা মিত্র সুন্দরী নন? অপর্ণা সেন, রেখা কি এখনও রূপসীনন? তা ছাড়া প্রতিমার বয়স হয় না। রঞ্জন বলল।

মানে?

দুর্গাঠাকুর দুশো বছর আগে যেমন সুন্দরী ছিলেন এখনও তাই আছেন।

এইবার বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। দিশার চোখে কপট রাগ। দু-হাত কাঁধ থেকে সরিয়ে জড়িয়ে ধরল সে দিশাকে। নরম মেয়েলি গন্ধ, অনুভূতি, যেন ক্রমশ বাগিচা রঞ্জনের করায়ত্তে, সে দিশার গালে গাল রেখে বলল, তুমি আমার। তারপরেই তার। কপালে ভাঁজ পড়ল। মুখ সরিয়ে সে দিশার মুখ দেখল। থরথর করে কাঁপছে দিশা। সমস্ত শরীর যেন শক্ত হয়ে গেছে। হাত সরিয়ে নিলেই পড়ে যাবে। চোখ বন্ধ।

সে ফিশফিশিয়ে ডাকল, দিশা!

দিশা সাড়া দিল না। যেন শুনতেই পায়নি তার ডাক। ধীরে-ধীরে ওকে একটা সোফায় বসিয়ে দিল রঞ্জন। বসার পরেই যেন চেতনা ফিরে এল, দু-হাতে মুখ ঢেকে ডুকরে কেঁদে উঠল দিশা। রঞ্জন হতভম্ব। সে এমন জোরে চেপে ধরেনি যে দিশা অসুস্থ হয়ে যেতে পারে! আর অসুস্থ হওয়ার পর এই কান্নার মানে কি!

সে বলল, দিশা, আমি সরি। আমি নিজেই বুঝিনি কি করছি!

কাঁদতে-কাঁদতে মাথা নাড়ল দিশা। যার মানে সরি বলার দরকার নেই। ঠিক তখনই বেল বাজল ঝমঝমিয়ে।

তুমি ঘরে যেতে পারবে? কেউ এসেছে?

কান্না গিলল দিশা। তারপর ওড়নায় চোখ মুছল। দ্বিতীয়বার বেল বাজলে রঞ্জন বাধ্য হল দরজা খুলতে। বেশ স্বাস্থ্যবতী এক তরুণী দাঁড়িয়ে।

কেয়ারটেকার বাবু বলল আপনারা লোক খুঁজছেন। মেয়েটি চোখ ফেরাল।

ও হ্যাঁ। তুমি একটু পরে আসতে পারবে? রঞ্জন বলল।

পরে টাইম হবে না। মেয়েটা সোজাসুজি রঞ্জনকে দেখল।

ওকে ভেতরে আসতে বলো। পেছন থেকে দিশার ধরা গলা ভেসে এল।

অগত্যা সরে দাঁড়াল রঞ্জন, মেয়েটি ভেতরে ঢুকল। দিশাকে দেখে বলল, আমার নাম মালা। মা মালা সিনহার ফ্যান ছিল তো। আপনি বউদি?

দিশা চকিতে রঞ্জনের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বলল, তুমি কাজ করবে?

কেয়ারটেকারবাবু বললেন আপনার লোক দরকার। যদি তালাচাবি মিলে যায় করব।

বুঝতে পারলাম না। দিশা বলল।

আপনাদের যা প্রয়োজন তা যদি আমার অসুবিধে না হয় করব।

তোমার কি সুবিধে তা আগে বলো। দিশা একটু-একটু করে সহজ হচ্ছিল।

দেখুন বউদি, আমি সকালে চার বাড়িতে কাজ করি। তখন টাইম নেই। বিকেলে দু-বাড়িতে কাজ করছি। একটা চারটে থেকে ছটা। আর একটা ছটা থেকে আটটা, ওই দ্বিতীয় কাজটা ছেড়ে দিতে চাই। ওই সময় আপনাদের দিতে পারি। মেয়েটা একটা চেয়ারের দিকে তাকাল, ওখানে বসব?

মাথা নাড়ল দিশা। সঙ্গে-সঙ্গে বসে পড়ে পা নাচাতে লাগল মালা।

কিন্তু আমাদের লোক দরকার সকালে। রান্নার জন্যে, ঘর পরিষ্কার করার জন্যে।

কিছু চিন্তা করবেন না। আমি রাত্রে রান্না করে ফ্রিজে ঢুকিয়ে দেব, আপনি সকালে গরম করে নেবেন। আর সকালে ঘর পরিষ্কার করলে রাত্রে যা হবে, রাত্রে করলে সকালে তাই তো হবে। মালা বলল।

দিশারঞ্জনের দিকে তাকাল।

রঞ্জন বলল, আমরা যদি রোজ ছটার মধ্যে না ফিরে আসি?

চাবি দিয়ে যাবেন। একটা চাবি। সহজ গলায় বলল মালা, ভেবে বলুন, আপনারা হয়তো সকলে নটায় বের হবেন। আমি যদি আটটায় আসি তাহলে কটা পদ খেয়ে বেরুবেন? তার চেয়ে রাত্রে কান্না করা থাকলে অনেকে সুবিধে।

বাজার হাট? দিশা জিজ্ঞাসা করল।

ওটা যদি দাদাবাবু করে দেন ভালো। আমি কাঁচা পয়সায় হাত দিতে চাই না।

দিশা জিজ্ঞাসা করল, তুমি কাজটা ছেড়ে দিচ্ছ কেন?

সত্যি কথা বলব বউদি?

আমি মিথ্যে কথা ভালোবাসি না।

দেখুন, আমি ওখান থেকে আড়াই হাজার পাই।

আড়াই হাজার! রঞ্জনের গলা শুকিয়ে গেল।

হ্যাঁ। সাড়ে বারোশো রান্নাবান্নার জন্যে। দুই বুড়ো বুড়ি। বুড়ি বাতের ব্যথায় অষ্টপ্রহর বিছানায় শুয়ে থাকে। বুড়োর খুব রস। রোজ তাকে ম্যাসাজ করে দিতে হয় আমাকে। তার জন্যে আরও সাড়ে বারোশো দেয়।

আমরা তো তোমাকে এত দিতে পারব না। দিশা বলল।

কে চাইছে? চোখ ফেরাল মালা, ওই বারোশোর জন্যে রোজ রাত্রে আশি বছরের বুড়োর শরীর চটকাতে ভালো লাগে? এখন ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া নারকেল গাছ। যে কোনওদিন ভেঙে পড়বে। তবু কোমরের ওপরে আমার হাত উঠতে দেবে না। ঘেন্না ধরে গেছে বউদি। আপনি আমাকে ওই সাড়ে বারোশো দেবেন। আপনাদের বাড়িতে তো কোনও বুড়োহাবড়া নেই।

রঞ্জন চটজলদি বলল, ঠিক আছে। তোমার কথা শুনলাম। নিজেরা কথা বলে কেয়ারটেকারকে জানিয়ে দেব!

কিন্তু তার আগে যদি কাজ পেয়ে যাই তাহলে দোষ দেবেন না। আমরা গরিব মানুষ। হাতখালি করে বসে থাকতে পারি না তো! উঠে পড়ল মালা।

ঠিক আছে। তুমি কি আজ থেকে কাজে লাগবে?

তার মানে আপনি আমাকে রাখবেন?

হ্যাঁ, দিশা মাথা নাড়ল।

মাথা নাড়ল মালা, তাহলে কেয়ারটেকারকে ফোন করুন।

কেন? দিশা বুঝতে পারল না।

আমি কে, সত্যি-সত্যি উনি আমাকে পাঠিয়েছেন কিনা জেনে নিন। আজকাল তো আমাদের ছবি থানায় পাঠাতে হয়। নিশ্চিত হয়ে নিয়ে কাজে লাগতে বলুন। পরে আমাকে দোষ দিতে পারবেন না। শেষ কথাগুলো মালা বলল রঞ্জনের দিকে তাকিয়ে।

অগত্যা রঞ্জন রিসিভার তুলে যাচাই করে নিয়ে দিশার দিকে তাকিয়ে ঘাড় নাড়ল।

এবার খুশি হল মালা, আপনাদের রান্নাঘরটা বোধহয় ও দিকে। যাই আগে দেখে আসি।

সে চোখের আড়ালে যেতেই রঞ্জন চাপা গলায় বলল, খুব টকেটিভ।

দিশা হাসল, মনে হচ্ছে ভালো কাজ জানে।

একটু এক্সপেন্সিভও আমাদের বাড়িতে যে রান্না করে সে বারশো পায়।

এ ব্যাপারে আমার কোনও অভিজ্ঞতা নেই। দিশা বলল।

বউদি, বলতে-বলতে ফিরে এল মালা। সবই আছে দেখলাম। কিন্তু সবজি, মাছ, মাংস নেই। আজ রাত্রের খাবারটাও কালকের সঙ্গে করে দিচ্ছি। কী খাবেন?

যা হোক কিছু করে দাও। দিশা বলল।

ভাত বা রুটি?

আমি রুটি। দিশা বলল।

আমি ভাত খাই। রঞ্জন বলল।

দু-রকমের ঝামেলা করবেন না বাবু।

ঠিক আছে, রুটি খাচ্ছি রাত্রে। সকালের জন্যে ভাত করো।

এবার আপনি যান। এক কেজি আলু, পাঁচশো পেঁয়াজ, আদা, লংকা, সবজি যা পাবেন আনবেন আর কাটাপোনা পাঁচশো। তাড়াতাড়ি ফিরবেন। বলেই ভেতরে চলে গেল মালা।

সর্বনাশ। আজই বাজারে যেতে হবে। দিশার দিকে তাকাল রঞ্জন।

খেতে হলে যেতে হবে।

আজকে আমরা কোনও রেস্টুরেন্টে খেতে পারতাম।

কাল সকালে কী করতে? আমার তো দশটায় ক্লাস।

বেস্ট ছিল কোনও হোমও ডেলিভারি সংস্থাকে বলে দেওয়া।

তাই দাও।

কিন্তু একে তো কাজ করতে বলে দিয়েছ। রঞ্জন বিরক্ত হয়েছে বোঝাল। তারপর নিজের ঘরে ঢুকে গেল। সঙ্গে-সঙ্গে ফিরে এল মালা, বউদি, দাদা তো এখানকার কিছু চেনে না, না? তাহলে  তো এখন মুশকিলে পড়বে। ঠিক আছে, আমাকে টাকা দিন, প্রথম দিনটা আমিই বাজার করে দিচ্ছি। দাদা সঙ্গে যাক, আমি চিনিয়ে দিচ্ছি।

তাই ভালো।

টাকা নিয়ে রঞ্জন প্রস্তাবটা শুনে বলল, কোনও অসুবিধে হবে না। খোঁজ করলেই লোকে বলে দেবে। আমি একাই যাচ্ছি। রঞ্জন বেরিয়ে গেল।

ওই যাঃ। দাদা বাজারের ব্যাগ নিয়ে গেল না।

কিনে নেবে।

কিনবে কেন? রান্না ঘরে চারটে ব্যাগ রয়েছে।

থাক।

আগে যেখানে থাকতে সেখানে দাদা বাজার করত না?

না।

তাই মুখ অমন হয়েছে! হাসল মালা, তোমরা রান্নায় ঝাল খাও না মিষ্টি?

মাঝামাঝি।

তোমাদের অনেকদিন বিয়ে হয়েছে?

কেন?

না, দাদা ও-ঘর থেকে বের হল, তোমার জিনিস দেখলাম ওপাশের ঘরে। বেশিদিন বিয়ে হয়ে গেলে শিক্ষিত স্বামী-স্ত্রীরা দেখেছি আলাদা শোয়। মালা বলল।

দিশা হাসার চেষ্টা করল।

অবশ্যি একসঙ্গে শোওয়া পার্টি দেয় হয়তো দেখেছি। দিনভর ঝগড়া, সন্দেহ, গালমন্দ অথচ রাত্রে এক বিছানায় শোয়, কিন্তু কেউ কারও সঙ্গে কথা বলে না। খেয়োখেয়ি করেও একসঙ্গে থাকবে, ছাড়বে না। আমার সঙ্গে যার বিয়ে হয়েছিল, সে খেয়োখেয়ি শুরু করতে, এক বছর মানিয়ে নিতে চেয়েছিলাম। যখন দেখলাম শুধরাল না তখন লাথি মেরে বেরিয়ে এলাম। সবাই বলে, মালা আবার বিয়ে কর। পুরুষগুলো দিনরাত ছোঁকছোঁক করে। অথচ বলি ন্যাড়া আর বেলতলায় যায়? মালা কথা বলে চলেছিল।

তাহলে এত রোজগার করছ কেন?

ভবিষ্যতের জন্যে বউদি। যখন শরীর ভাঙবে, পরিশ্রম করতে পারব না, কেউ ফিরেও তাকাবে তখন বাঁচতে হবে না? বলে হাসল, তোমাদের দেখে ভালো লাগল।

কেন?

এই এত বড় বাড়িতে যত ফ্ল্যাট আছে, তার দশটার মধ্যে নটায় স্বামী-স্ত্রী সুখে নেই গো। তিনটে বউদি যে দুপুরে ফুরতি করতে যায় তা আমি জানি। স্বামী সব জেনেও চুপ করে থাকে। একে কি বিয়ে বলে, বলো বউদি! মালা বলল, যাই চা নিয়ে আসি।

রাতের খাবার সাড়ে নটায় খেয়ে নিল ওরা। ঠিক সওয়া আটটায় মালা চলে গেছে। খেতে-খেতে রঞ্জন বলেছিল, না, মেয়েটা ভালো রাঁধে।

শুধু বেশি বকা ওর দোষ। দিশা বলেছিল।

তা করুক। জানো, জীবনে আজ প্রথমবার বাজার করলাম। বাজারে ঢোকার পর বুঝলাম ব্যাপারটায় বেশ থ্রিল আছে।

কোনও কিছু করার আগে বোঝা যায় না সেটা ভালো না খারাপ।

তারপর বাইরের আলো নিভিয়ে নিজের ঘরে বসে ম্যাগাজিনের পাতা ওলটাচ্ছিল রঞ্জন। দরজায় শব্দ হতে ফিরে তাকাল। দিশা দাঁড়িয়ে আছে।

এসো!

না, একটা কথা বলতে এলাম। দিশার গলার স্বর প্রায় খাদে।

হ্যাঁ, বসে বলোনা। রঞ্জন চেয়ার ছেড়ে খাটে গিয়ে বসল।

দিশা চেয়ারে বসল। বসে বলল, আমার খুব খারাপ লাগছে।

কেন? আমি কি কোনও অন্যায় করেছি?

না-না। দ্যাখো আজ আমাদের প্রথম দিন, প্রথম রাত। আমাদের আলাদা থাকা উচিত নয়। কিন্তু, ভেতরে-ভেতরে কীরকম একটা আড়ষ্টতা, তোমাকে বোঝাতে পারব না! এটা ভাঙা দরকার। তুমি আমাকে সাহায্য করবে? কাঙালের দৃষ্টি দিশার চোখে।

নিশ্চয়ই।

তাহলে চলল, তোমার বা আমার ঘরে নয়, ও-পাশের খালি ঘরটায় আমরা একসঙ্গে থাকি। আমাকে একটু সময় দাও–।

নীল আলো জ্বলল। পাশাপাশি শুয়ে ওরা গল্প করছিল। রঞ্জন দিশার শরীরের ঘ্রাণ পাচ্ছিল। একটা জোক শুনে দিশা ছেলেমানুষের মতো হাসল। তারপর রঞ্জন বলল, এই, আমার ঘুম পাচ্ছে।

দিশা বলল, ঘুমিয়ে পড়ো।

দুজনের মধ্যে তখন মাত্র এক ইঞ্চির ব্যবধান।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *