বন্ধুর মতন নেই আর!
বান্ধবীরা নিতুই নব। নিত্য নবীন। দর্শনে অদর্শনে নব নবরূপে দেখা দিয়ে থাকেন, আমি জানি।
কিন্তু বন্ধুরা চিরকালীন। তাদের রূপ গুণের বিশেষ হেরফের হয় না বোধহয় কোনো দিনই। এইতো জানতাম।
তাদের সেই চিরকেলে একঘেয়ে চেহারা আর ব্যবহারের কোন দিন ভোল পালটে কখনো যে তারা অভিনব রূপ ধরতে পারে এ ধারণা আমার ছিল না। সেই বদ্ধমূল ধারণা আমার বদলে গেল অকস্মাৎ। চিরঞ্জিতের কাছে চিরদিনের মতই হার হলো সেদিন আমার…আর আমার ধারণার।
বন্ধুর মতন হয় না সত্যিই!
প্রেসিডেন্সি হাসপাতালে পীড়িত এক আত্মীয়াকে দেখে রেসকোর্সের ধার ঘেঁষে পাশ কাটাচ্ছিলাম, ময়দানের সড়কে উঠে এসপ্ল্যানেডের ট্রাম বাস বার মতলবে। ইতিমধ্যে ঘোড়-দৌড়ের খেল খতম হয়ে মাঠের ভিড় ভেঙে রাস্তায় নেমে এসেছে।
ভিড়ের ভেতর চিরঞ্জিত। দেখতে পেয়ে আমার উপর এসে যেন হুমড়ি খেয়ে পড়ল। এধারে যে? এমন অসময়ে? শুধায় সে।
সুখ লি কার্নানি থেকে ফিরছিলাম। আমি জানালাম।
সুখলাল থেকে? কেন হে? খাসা তো আছে। খাসীর মতই প্রায়। দেখে তো মনে হয় না তোমার কোনো অসুখ বিসুখ আছে। মনে হয় যে তোমার সুখের অবধি নেই…
অবধি নেই? আমি প্রতিবাদ করি—উচ্চরক্ত চাপে চাপিত। সর্বপ্রকার চাপল্য নিষেধ আমার—তা জানো?
আরে ব্লাডপ্রেসার কি আবার একটা অসুখ নাকি? চালু থাকলে কোনো ভয় নেই—বিলকুল নিরাপদ। চলতে ফিরতে পারলেই নিশ্চিন্তি। কিন্তু পড়লে কি মরলে।
তার মানে?
সেই যাত্রাপালার নায়কের মতই প্রায়। পতন আর মৃত্যু সঙ্গে সঙ্গে। বলে চিরঞ্জিত : তবে স্ট্রোক হলেই পড়ে, না, পড়লেই স্ট্রোকটা হয় তা আমি সঠিক বলতে পারব না।
ওর কথায়, নৈয়ায়িকদের সেই তাল পড়িয়া টিপ করে, না টিপ করিয়া তাল পড়ে–কথাটা মনে পড়ল আমার।
হার্টফেল করলেই মরণ হয়, না, মরণদশা হলেই হার্টফেল করে অনেকটা সেই রকম আরকি। ওর কথায় আমার সায়।
ঠিক তাই। আর পড়লেই তোমার হার্ট ফেল হবে। নাও যদি হয় তা, পক্ষাঘাত তো নির্ঘাত। কেউ আটকাতে পারবে না। সে জানায়। তোমার পক্ষে হাঁটা চলাই নিরাপদ। তাহলেও খুব সাবধানে চলাফেরা করবে, ভিড়ের ভেতরে কদাপি যেয়ো না, কারো গায়ে ধাক্কা লেগে পড়ে যাও যদি তো সেটাই হবে তোমার নিরানব্বইয়ের ধাক্কা।
ভিড়ের মধ্যেই তো এসে পড়েছি এখন। একটা ট্যাসি ডাকো তাহলে… আমি বাতলাই।
এই বাজারে ট্যাকসি মেলে নাকি? সে অবাক হয়ে যায় আমার কথায়। আর, অ্যাতো খদ্দেরের ভিড়ে?
তাহলে ট্রাম বাস ধরা যাক, এসো। কিরকম বাদুড় ঝোলা হয়ে যাচ্ছে মানুষ দেখছ? ঐভাবে যেতে যেতে যদি পদস্খলন হয় তো আর রক্ষে আছে তোমার? নিজের দুশ্চরিত্রও খোয়াবে…নিজেও খোয়া যাবে সেই সঙ্গে। নিজেই হারিয়ে যাবে এই দুনিয়ার থেকে… সবার সঙ্গেই সঙ্গেই খসলে।
দরকার নেই। হাঁটাইযাক তাহলে, কিন্তু খিদে পেয়েছিল বেজায়।আমি বলি-হাঁটলে পরে আবার আমার খিদে বেড়ে যায় আরো।
চলো, কাছেই একটা রেস্তরাঁ আছে। পুলটার কাছাকাছি। সেখানে গিয়ে পেট ঠেসে খাওয়া যাবে দুজনে। সে আশ্বাস দেয়।
খিদিরপুরের ব্রিজ দিয়েই তো এসপ্ল্যানেডের ট্রাম যায়, ট্রাম তখন তুমি ফাঁকাই পাবে—খাওয়া দাওয়ার পর। যতো ভিড় এই এখানটাতেই…এখন এই রেস ভাঙবার মুখটায়। সে প্রায় আমার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়—দ্যাখো না, আপ ডাউন দুদিকের গাড়িতেই লোক উঠেছে এখন। ভিড়ে ভিড়াকার।
সত্যিই তাই। অগত্যা সেই রেসকোর্সের থেকে হাঁটতে হাঁটতে উঠলাম গিয়ে রেস্তরাঁয়। দুজনার ছোট্ট একটি টেবিল দখল করে চিরঞ্জিত খাদ্যতালিকাটা এগিয়ে দিলো আমার দিকে—নাও, ঢালাও হুকুম করো। যা খেতে চাও…যা খেতে তোমার প্রাণ চায়।
মাঠের থেকে মোটামুটি বেশ কিছু মেরেছে নিশ্চয় মনে হয়। পকেটে রেস্ত না থাকলে ওর মতন কঞ্জুষ কখনো রেস্তারাঁয় আসে না, তথাকথিত কোনো বন্ধুকে নিয়ে অন্ততঃ। প্রাণ ভরে খাওয়াতে চায় না অপরকে।
সুপ-এর থেকে কফি পর্যন্ত একগাদা ফরমাশ দিয়ে বসলাম পরম্পরায়।
রেসে আজ বেশ লাভ করেছে বোঝা যাচ্ছে। কটা বাজি মারলে শুনি? জিজ্ঞেস করি।
একটাই। একটা ঘোড়ার ওপরই যথাসর্বস্ব ধরে দিয়েছিলাম। মানে, পকেটে যা কিছু ছিল আমার। বলল সে। তবে বাজি জেতার কথা যদি বলল এমন জিত আর হয় না।
ক লেংথে জিতল তোমার ঘোড়া?
লেংথে কিহে? ফারলং বলো। দেড় ফার্লং এগিয়ে ছিল সবার থেকে…
বলো কি হে! সে কি সম্ভব? আমি অবাক হয়ে যাই। রেসের দিন ঘোড়াদের ডোপ দিয়ে থাকে জানো কি? কাকে ডোপ দেওয়া বলে তা জানো?
শুনেছি যেন কথাটা। মাছের টোপ ফেলার মতই কিছু একটা হবে বোধহয়? আরে না, ট্রেনাররা পালা করে নিজেদের স্টেবলের ঘোড়াদের জেতায় সব। এক এক দিনে কয়েকজনের জিতবার পালা। নিজেদের মধ্যে গোপনে সেটা ঠিক করে যেদিন যে ঘোড়াটাকে জেতাবে তাকে ডোপ দেয়। তার পরে সবাই মিলে সেই ঘোড়াটার ওপর মোটা টাকার বাজি ধরে। তাতে আর সব ঘোড়ার হার হলেও মাঠসুদ্ধ রেসুড়েরা সবাই মার খেলেও ট্রেনারদের, জকিদের আর জানাশোনার ভেতরের লোকদের লাভ হয় খুব। যেটার ওপর বাজি ধরেছিলাম তাকে আজ ডোপ দেবার কথা ছিল। একেই বলে ঘোড়ার মুখের খবর—খবরটা আমি পেয়েছিলাম।
ঘোড়াটা বুঝি বলেছিল তোমায়? আমি আরো অবাক হয়ে যাই: ঘোড়াটার সঙ্গে খুব ভাব ছিল বুঝি তোমার?
আরে, ঘোড়া বলবে কেন হে? ঘোড়ার মুখ দেখলেই তো বোঝা যায়। রেসের দিন সকালে যারা ঘোড়াদের স্মার্ট দেখতে ময়দানে যায় তাদের ভেতর যারা সমঝদার তারা ঘোড়াদের মুখ চোখ চাল চলন হাব ভাব দেখেই টের পায় কোনটার আজ জেতার পালা, কাকে সেদিন ডোপ দেওয়া হয়েছে।
বটে বটে?
ডোপ মানে, কী একটা উত্তেজক ইনজেকশন, ঘোড়াকে সকালে দিয়ে দেয়। তাতে দৌড়বার সময় তার খুব তাগদ হয়, খুব এনার্জি দেখা যায়। একেবারে অস্বাভাবিক রকমের। তাতে হয় কি, যে ঘোড়ার আগের দুটো বাজিতে হার হয়েছে পর পর, মানে জেতানো হয়নি যেটাকে, অবশ্যই মতলবমাফিক, সেই ঘোড়াটাই ডোপ নেবার দিন তিন লেংথে সবাইকে হারিয়ে বাজি মেরে দেয়—তার ফলে সব কিছু আপসেট হয়ে যায়। একেই বলে রেসের আপসেট। আগের হেরো ঘোড়র ওপর সেদিন তো কেউ বড়ো আর বাজি ধরে না—তাই। বহুত লোকের হার হলেও খবর পেয়ে যারা বাজি ধরেছিল মোটা টাকার টোট জেতে তারা তাদের বেলায় বাজিমাৎ!
আর ডিগবাজি-মাত বাকী সবার?
তা বলতে পারো। তবে আমারটা যে কী হলো তা আমি ঠিক বলতে পারব না, বাজিও বলা যায়। আবার ডিগবাজিও বলা যায়।
খাবার মুখে গল্প চলছিল আমাদের। বেয়ারা বিল রেখে গেল টেবিলে—খানার দাম ঊনত্রিশ টাকায় উঠেছে। উতুক গে, বিল মেটাবার দায় তো আমার নয় আর।
তার মানে? আমি শুধাই। তোমার ঘোড়াটা তিন লেংথে, না কি, তিন ফালংয়ে জিতেছে এইমাত্র বললে যে! তাহলে?
বলেছি ঠিকই। তিন ফার্সংয়ের এক ইঞ্চি কম নয়। বরং কিঞ্চিৎ বেশিই হতে পারে। কিন্তু হলে কী হবে, ওটাকে ঠিক বাজি জেতা হয়তো বলা যায় না…
মোটামুটি মেরেছ বেশ আজ। নইলে তুমি আমার মত রাক্ষসকে নিয়ে আজ এই রেস্তরাঁয় এসেছ! ওর কথায় আমি হাসি।
হয়েছে কী, বলি তোমায়। খেলাটা খতম্ হয়ে যাবার পরই খবরটা পেলাম ঐ মাঠেই একটু আগে। ঘোড়ার মুখের খবর নয় এবার, আমার মতই এক গাধার মুখ থেকে পেয়েছি খবরটা। সে-হতভাগাও বাজি ধরেছিল ঐ ঘোড়ার ওপরেই—ডোপের খবর পেয়েই বোধহয়।
কী বললো সে ভেঁপোনা-ডোলো লোকটা? বলল যে, ঘোড়ার ডাক্তার আজ সকালে ডোপ দিয়েছিল ঠিকই, কি ভুল করে…ব্যাটা নিজেই নেশা করেছিল কিনা কে জানে! ..ভুল করে করেছে কী, ঘোড়াটাকে ইনজেকসন না দিয়ে ঐ ইনজেকসনটা দিয়ে বসেছে তার জকিকে। ফলে মাঠে নেমে ঘোড়াটা তেমন দৌড়চ্ছে না দেখে জকি…ডোপের মাথায় ছিল তো সে…ঘোড়াটাকে টেনে নিয়ে না নিজেই দৌড়তে শুরু করে দিয়েছে। লাগাম ধরে ঘোড়াটাকে টেনে নিয়ে এসেছে সে…রেকর্ড টাইমে…আর সব ঘোড়ার থেকে তিন লেংথে নয়, তিরিশ লেংথ আগে। কিন্তু তাকে তো আর ঘোড়ার জিত বলা যায় না।
নিশ্চিত না। তার কথায় সায় দিতে গিয়ে আমার ভিত কাঁপিয়ে দিয়ে পেল্লায় এক বের উঠল।
নাঃ, এতটা খাওয়া ভালো হয়নি ভাই! হাইব্লাডপ্রেসারে এত বেশি খাওয়ার ধকল সইবে না হয়তো। ভেজিটেবল চপটা অবশ্যি কিছু নয়, আমার পক্ষে নিরাপদ, ফ্রি-ফ্রায়েও কিছু যায় আসে না। কিন্তু মোগলাই পরোটা, মাটন চপ, চিকেনকাটলেট, অগির দোপেঁয়াজি, ভকয়োসট এত সব খাওয়া—রক্ত চাপের ওপর এতখানি খাদ্য চাপানো আমার ঠিক হয়নি। ডাক্তার বলেছে আমায় খাওয়ার খুব ধরাকাট করতে…।
ধরাকাট করতে? ডাক্তার বলেছে? তা তুমি তো টেবিলের কাঠ ধরেই খাচ্ছ হে? তোমার ভাষায় বলতে গেলে—এই তো যথেষ্ট খাওয়ার ধরাকাঠ।
এত খেয়ে এই বর্ধমান রক্তচাপের ওপর মাথা ঘুরে যদি রাস্তায় পড়ে যাই তাহলেই আমার কাল না, আমি কাটোয়া, মানে কাটলাম। পড়লাম কি মরলাম—তুমিই বলছে। না মরলেও পক্ষাঘাত তো নির্ঘাত!
সেকথা ঠিক। বলে আমার কথায় সায় দিয়ে সে বিলের দিকে তাকায়—তিরিশ টাকার বিল উঠেছে। যাঁহা উনত্রিশ তাঁহা ত্রিশ। এক টাকা তো টিপস-ই দিতে হবে বয়টাকে।
তাতো হবেই। আমিও টেবিলের দিকে তাকাই—তুমি নিশ্চয় বলছ না যে, হজ হুজ হিজ হিজ? যার যার তার তার। আমার ভাগেরটা আমাকে দিতে বলছ না নিশ্চয়? তাই বলছ নাকি? আমার কাছে কিন্তু আমার বাড়ি ফেরার ট্রাম ভাড়াটাই আছে কেবল।
আমার আবার তাও নেইকো। সে সখেদে জানায়। তবে আমার বাড়ি তো কাছেই। এটুকু আমি হেঁটেই মেরে দিতে পারব।
তুমি তো হেঁটে মারবে! কিন্তু টাকা না পেলে কি এরা রক্ষে রাখবে? আমাকেই পাকড়াবে। আমিই যে খাবারের সব কুম দিয়েছি আবার। এরা আমায় মারতে মারতে হাঁটাবে তাহলে।
তারপর বয় এসে আমার কাছে বিলের টাকা চাইতেই আমি তাকে পকেট উটে দেখিয়ে দিলাম—আমার কাছে এই সিকিটা শুধু আছে ভাই! আমার বাড়ি ফেরার ট্রাম ভাড়াটাই। তার বেশি আর কিছু নেই আমার।।
শুনে বয়টা আমাকে কিছু না বলে সেখান থেকেই এক হাঁক ছাড়ল। এক হারে
সমস্ত ব্যাপারটা বিশদ করে জানিয়ে দিল সে কাউন্টারে বসা রেস্তরাঁর মালিককে।
মালিক সেখান থেকে হাঁকলেন, দাঁড়া। যেতে দিসনি লোকটাকে। আমি গিয়ে উচিত শিক্ষা দিচ্ছি ওকে।
আস্তিন গুটিয়ে আমার সামনে এসে হাজির হলো সে-সিকি? সি কি বলছেন মশাই? বিরাশি সিকির ওপর সাঁটিয়ে সিকি দিচ্ছেন এখন? দাঁড়ান। উচিত শিক্ষা দেব আপনাকে। এই হাতের বিরাশি সিক্কার একখানা খেলেই ঠিকমত শিক্ষা হবে আপনার। আর কোনো রেস্তরাঁয় এভাবে সিকি পকেটে নিয়ে খেতে আসবেন না। অন্ততঃ, আমার এ রেস্তরাঁতে তো নয় আর।।
বলেই সে আমার জামার কলার ধরে টেনে তুলল। তবে আমার বীরোচিত চেহারা দেখে বোধ করি পাছে প্রাণে মারা পড়ি, সেই আশংকায় বিরাশির মাপের একখানা
দিয়ে উনিশ বিশ আন্দাজের চড়-চাপড়ের চোটে ঠেলে নিয়ে গেল আমায় দরজার দিকটায়। এক চোটে ঠিক না হলেও মোটের ওপর ওর মারগুলো সব টোট্যাল করলে বিরাশিকে ছাড়িয়ে যায় নি। এইভাবে অনেকগুলো সিকি ছাড়বার গব রেস্তর্বার দোর গোড়ায় এসে সে একখানা আধুলি ঝাড়ল। তার সেই অর্ধচন্দ্রের ধাক্কায় আমি রাস্তায় গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম।
আপনার বিলের টাকা তো আপনি উশুল করে নিলেন বাবু! বেশ করে হাতের সুখ মিটিয়ে। বলল তখন বয়টা, কিন্তু আমার বসিসের কী হবে? আমার টিপস্টা?
তোমার টিপ তুমি আদায় করে নাও বাপু। ঢালাও হুকুম মালিকের।
আমি গায়ের ধুলো ঝেড়ে সোজা হয়ে না দাঁড়াতেই আমাকে টিপসই করার মতলবে সে ঘুষি পাকিয়ে আমার সামনে এসে খাড়া হলো। বসিসের বদলে তার বকসিংয়ের চোট থেকে নিজের দাঁত চোখ নাক বাঁচাতে আমি পৃষ্ঠপ্রদর্শন করলাম। বাধ্য হয়ে সে তখন পৃষ্ঠদেশেই…আমার অপর পৃষ্ঠায় তার স্বহস্তের স্বাক্ষর রাখল। তার সেই অটোগ্রাফের দাপটে আমি সাত হাত এগিয়ে গেলাম সটান।
ধরে নিয়ে আয় লোকটাকে।কুম করলেন মালিক আমি এক্ষুনি ও-সিকে ফোন করে দিই—পাহারোলারা এসে পাকড়ে নিয়ে যাক থানায়। সেখানে দস্তুরমতম বোলাই হলে তবেই ওর থড়ে হাড়ে শিক্ষা হবে।
তার কোনো দরকার হবে না, চিরঞ্জিত আমাদের মাঝখানে এসে পড়ল এতক্ষণ বাদ—আমিই নিজের হাতে শিক্ষা দেব ওকে আজ–বাছাধন আর জীবনে এমন কম্মো করবে না। ভুলবে না আর জীবনে। নেমতন্ন করে নিয়ে এসে….ছি ছি…এমন অপমানিত আমি কোনো দিন হইনি।
এবার সে স্বয়ং এসে আমায় এক গলাধাক্কা লাগাল। গলদেশে তার সেই তাড়নায় আমার তলদেশ পর্যন্ত আলোড়িত হয়ে উঠল—আমি চোহাত এগিয়ে গিয়ে রাস্তার উপর উপুড় হয়ে পড়লাম। সে এসে ধরে তুলল আমায়, তারপর বেশ করে ঘা-কতক কসিয়ে আবার আমার গলার ওপর এক চোট…আবার আমায় তুলে ধরল, ফের ঘা-কতক…আবার আরেকখানা…এমনি দ্রুত তালে তার হস্তক্ষেপ আর আমার পদক্ষেপে চালু হয়ে…উঠতে পড়তে…পড়তে উঠতে…উঠে পড়ে আমি এই পতন-অভ্যুদয়-বন্ধুর পন্থাটা (বন্ধুর পন্থাই বটে!) পার হয়ে ট্রাম রাস্তার ওপর এসে দাঁড়ালাম।
তখন সে ছাড়ান দিল আমায়।
হাঁপ ছেড়ে দম নিয়ে আমার বাক্যস্ফূর্তি হলো তখন। আমি বললামঃ চিরঞ্জিত! চিরদিনই তোমার জিৎ, আর তোমার কাছে আমার হার। কিন্তু তাই বলে তোমার হাতে এমন মার আমি খাব কোনোদিন আমার ধারণা ছিল না। তোমাকে আমি বন্ধু বলেই জানতাম এতদিন। কিন্তু বন্ধুর কাছে এই ব্যবহার… আমার কণ্ঠরোধ হয়ে আসে।
বন্ধুর কাজ করিনি আমি? বন্ধু আবার বলে কাকে? বলল রিঞ্জিত: কেন, খারাপটা কী করেছি? মারার ছলনা করে থানার ফঁড়া থেকে কাটিয়ে, কেটে বেরিয়ে এসেছি তোমায় নিয়ে…
মারার ছলনা?…ওদের মারে আমার তেমন ধারা লাগেনি। গায়ে লাগলেও প্রাণে লাগেনি আমার…কিন্তু তোমার এই ছলনার মার কোনোদিন আমি ভুলব না ভাই, হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি আমি…এখন ঠিক না পেলেও বাড়ি গিয়ে টের পাব ঠিকই, যদি বাড়ি গিয়ে পৌঁছতে পারি। গায়ের ব্যথায় কাল বিছানা ছেড়ে উঠতে পারব কিনা কে জানে!
তাহলেও তুমি আস্তই রয়েছে দাদা! হাড়গোড় কিছুই বরবাদ যায়নি—সবই তোমার অটুট রয়েছে এখনো। এই এলাকার দারোগা আননবাবুকে তো জানো না ভাই! থানায় নিয়ে গেলে আর সেখানে রামধোলাই খেলে তোমার রামত্ব লোপহয়ে শিবত্বলাভ ঘটত।… গুন্ডারা পর্যন্ত আননবাবুর ভয়ে কাঁপে। তা জানো?
আমার ভয় কিসের? আমি কি গুণ্ডা?
বড়ো বড়ো গুণ্ডাকেও থানায় নিয়ে গিয়ে কম্বলধোলাই দিয়ে হাড় গুঁড়িয়ে গুণ্ডি বানিয়ে ছাড়েন তিনি। কিন্তু সে তো পরে…এহ বাহ…তার আগে তাঁর অন্তঘোতি আছে। নিজস্ব পেটেন্ট পঞ্চগব্য খাইয়ে পেটের কথা টেনে বের করেন তিনি আসামীর। পঞ্চগব্য কাকে বলে জানো?
কেন জানবো না? দই, ঘি, দুধ, গোবর আর গোরোচনা—কে না জানে? তাই খেয়ে প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়, জানে সবাই।
পঞ্চগব্যের ঐ প্রথম তিনটে বাদ, তার বিকল্পে ঘোড়ার নাদ, কুইনিন, ছাগলনাদি যদি পাওয়া যায়, সেইসঙ্গে কেরোসিন আর ফিনাইল—পছন্দসই ফ্লেভার দেবার জন্যেই। ওই তিনি মুখ হাঁ করিয়ে গাঁট্টার চোটে ঢক্ করে গিলিয়ে দেন, তখন আপনার থেকেই পেটের কথা সব বেরিয়ে আসে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় তোলাস সামনেই ধরা থাকে তো, তাই দেখেই না!
আমার পেটের কথা টেনে বের করার কী আছে? আমি জিজ্ঞেস করি।
নেই-ইত। কাজেই কোনো কথাই বেরুবে না। বাধ্য হয়েই তোমায় পাঁচ সাত গেলাস গিলতে হবে। কথা কিছু না বেরুলেই, একটু আগে বিনেপয়সায় ভালো মন্দ যা খেয়েছো তার সবটাই তোমার বেরিয়ে আসত নির্ঘাত। সেটা কি ভালো হতো? তারপর সেই অন্তধৌতির পর, আসল সেই ধোলাইয়ের এহ বাহ্য তো রয়েই গেল; তার চোটে নির্বিকল্প সমাধি না হলেও অর্ধবাহ দশা তো হতেই তোমার আলবাৎ। গন্ধে গোটা পাড়া মাত হয়ে যেত তখন। প্রায় সবার বেলাই সেটা হয়ে থাকে শুনেছি, তেমন ধারণা-শক্তি ততা নেই সবার! তখন তোমার সেই হতজ্ঞান গন্ধমাদন ঘাড়ে করে তোমায় বাড়ি পৌঁছে দিতে হতো আমায়। তার বদলে এই একটুখানি মারামারি-কী এমনটা বাড়াবাড়ি হয়েছে শুনি?
মারামারি? মারামারিটা হলো কখন? কথাটার আমি মৃদু আপত্তি না করে পারি না: মারাই তো হয়েছে শুধু, মারি-টা হলো কোথায়? তোমরাই আমায় ঠেঙালে, আমি কি তোমাদের গায় হাত তুলেছি নাকি?
এই কথা! আচ্ছা, আমি তোমার গায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি… বলে আবার সে আমার গলায় পিঠে হস্তক্ষেপ করে…এবার মন্দাক্রান্তা ছন্দে। তাতে আমার জ্বলে যায় আরো! আমি ছিটকে ওর নাগাল থেকে সরে যাই।
রাগ হয়েছে? আচ্ছা, তাহলে মানো তুমি আমায় ঘা কতক, বেশ করে কসে মারো, খুব জোর জোর লাগাও। তাহলে হবে তো? বলে সে আমার সামনে পিঠ পেতে। দেয়।
খুব হয়েছে। আর ন্যাকামো করতে হবে না। এতক্ষণ হয়নি, কিন্তু এবার আমার সত্যিই রাগ হলো——আমার না উচ্চ রক্তের চাপ? পড়ে গেলেই পক্ষাঘাত না নির্ঘাত? তুমি নিজেই তো বলেছে।
সঙ্গে সঙ্গে তারও মনে পড়ে যায় কথাটা——তাই নাকি? তাই তো হে! মনেই ছিল না আমার। আশ্চর্য, তোমার তো খাবি খাবার-কথা এতক্ষণ! কিন্তু কই, খাবি
তো খাওনি! কতবার তো পড়লে হে! পক্ষাঘাতও হয়নি তো দেখছি।
আহা! হলে যেন খুব খুশি হতে মনে হচ্ছে।
আশ্চর্য! এখনো তুমি আস্ত আছে, সটান খাড়া রয়েছে সামনে! নো পক্ষাঘাত, নষ্ট কিছু। এই শক ট্রিটমেন্ট করে ব্যায়ামটা তোমার সারিয়ে দিলাম বোধ হচ্ছে। আমার এক ঘুষিতে…এক না হোক একাধিকই হলো…থানার পক্ষপাত আর নিশ্চিত পক্ষাঘাত দুটোর থেকেই এক চোটে বাঁচিয়ে দিয়েছি তোমায়। তাতেও তুমি খুশি নও ভাই? এটা কি বধুর কাজ করিনি আমি, বললা? নহলে তুমি কী বলতে চাও?
আমি আর কিছু বলতে চাই না তারপর। চুপ চাপ পা চালাই।
বন্ধুর মতন হয় না! সত্যি।