বন্ধু
দুটো দিন কাটতে-না-কাটতেই দীপের বেজায় একঘেয়ে লাগতে থাকে। মা আর মাসির সঙ্গে দীপ দাদু-দিদার কাছে বেড়াতে এসেছে। সঙ্গে এসেছে দীপের দিদি টিংকু আর মাসতুতো দিদি পিংকু। দীপের বয়স বারো। পিংকু-টিংকুর বয়স পনেরো-ষোলো।
দীপের দাদু-দিদা থাকেন মেদিনীপুরে এক গ্রামে। একসময় ওই অঞ্চলের জমিদার ছিলেন এই চৌধুরীরা। এখন জমিদারি নেই বটে তবে পুরনো দাপট আর ঐশ্বর্যের রেশ বেশ খানিকটা রয়ে গেছে।
বিশাল তিন-মহলা চৌধুরীবাড়ি এখন খাঁ খাঁ করে। মহলগুলি দোতলা। একতলা দোতলায় সার সার ঘরের পর ঘর বন্ধ। সামনে টানা রেলিং দেওয়া বারান্দা। ছোটোখাটো ফুটবল মাঠের মতো গোটা তিনেক ছাদ। সব নিঝুম, বিশেষত দোতলার অংশগুলি। এখন এ বাড়িতে চৌধুরী বংশের স্থায়ী বাসিন্দা বলতে কেবল দীপের দাদু ভবানন্দ চৌধুরী, দিদিমা, আর দাদুর এক ছোটো ভাই। এছাড়া আছে একপাল কাজের লোক। দীপের মা মাসি মামা অনেকবার চেয়েছেন, দীপের দাদু-দিদাকে নিজেদের কাছে শহরে নিয়ে রাখতে। কিন্তু দাদু-দিদা রাজি হননি। শহরে নাকি তাঁদের দমবন্ধ হয়ে আসে। এতকাল খোলা হাওয়ায় বাস।
দীপের মা-মাসি-মামা আর তাদের জ্যাঠতুতো খুড়তুতো ভাইবোনরা একটু বড়ো হতেই এ গ্রাম ছেড়ে শহরে হস্টেলে থেকে পড়াশুনা করেছে। বাড়ি অবশ্য আসত তখন ছুটিতে ছুটিতে। এখন আবার অনেক দিন ধরে শহরে বাস করার ফলে পুরোপুরি শহুরে হয়ে গেছে। গ্রামে আসতে তাদের আর ভালো লাগে না। নেহাতই বাবা-মায়ের টানে যেটুকু আসা।
এসব কথা দীপ তার মায়ের কাছে শুনেছে।
দীপ আগে বার তিনেক এ বাড়িতে এসেছে, কিন্তু রাতে থাকেনি। দিনে কয়েক ঘণ্টা মাত্র কাটিয়ে ফিরে গেছে।
এ গ্রামে তো আগে ইলেকট্রিসিটি ছিল না। লন্ঠন আর হ্যাজাকই ভরসা ছিল অন্ধকারে। ফাঁকা বিরাট বাড়িটা তখন সন্ধের পর বড্ড ভুতুড়ে ঠেকত। শহরবাসী মা মাসি মামারা তাই এলেও রাত কাটাত না। দিনে দিনে মা-বাবার সঙ্গে দেখা করে ফিরে যেত। ছোটো ছেলেমেয়েদেরও আনত না সবসময়। একদিনে এতখানি আসা-যাওয়ার ধকল তো কম নয়।
বছর খানেক আগে এ গ্রামে বিদ্যুৎ এসেছে। চৌধুরীবাড়িতে ইলেকট্রিসিটি নিয়েছে! ফলে অন্ধকারে ছমছমানি অনেকটা কমেছে। গরমে পাখা ঘোরার ব্যবস্থা হয়েছে। তাই এবার ছেলেমেয়েদের স্কুলে গরমের ছুটি পড়তে মা মাসি এসেছেন— বাবা-মায়ের কাছে কটা দিন কাটিয়ে যেতে। সঙ্গে ছেলেমেয়েদেরও এনেছেন।
সকালসন্ধে দীপ খানিক সময় ক্লাসের হোমটাস্ক করে। বাকি সকাল আর বিকেল যেন তার কাটতে চায় না। বিশেষত বিকেল বেলাটা।
মা বলেন, ‘দিদিদের সঙ্গে ব্যাডমিন্টন খেল।’
—‘দূর দূর, ওদের সাথে খেলা মোটে জমে না।’
বাড়ির ভিতরে পাঁচিল ঘেরা বাঁধানো উঠোনে কায়দা করে ব্যাডমিন্টনের নেট টাঙানো হয়েছে। দিদিরা র্যাকেট হাতে কেডস মোজা স্কার্ট পরে খেলতে চায় বটে, কিন্তু খেলে কতটুকু? দীপের সঙ্গে দু গেম খেললেই তারা বেদম হয়ে পড়ে। তখন রেস্ট চাই। বসে বসে জিরোয়। অমনি শুরু হয় তাদের নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব। মাঝে মাঝে হি হি হু হু হাসি। উঠে যে ফের খেলবে, তার কোনো চাড়ই নেই। একে তো দুই দিদিই অতি বাজে খেলে, তার ওপর দু-এক গেম খেলেই রেস্ট। সকালে যদি বা কিছুক্ষণ খেলে, বিকেলে দিদিরা খেলেই না প্রায়। কেবল ছাদে বেড়ায় আর আড্ডা দেয়। বেজার হয়ে দীপ আর খেলতে চায় না দিদিদের সঙ্গে। তার চেয়ে একা একা ঘোরা ভালো।
গ্রামের ছেলেরা ফুটবল খেলে মাঠে। মাঠটা গ্রামের সীমানায়। চৌধুরী বাড়ি থেকে দূরে। দীপের ইচ্ছে ছিল যে ওদের সঙ্গে গিয়ে ফুটবল খেলে। সে ক্লাবে আর ক্লাস টিমে চান্স পায় ফুটবলে। কিছু কায়দা দেখাতে পারত গাঁয়ের ছেলেদের। কিন্তু মা বারণ করলে, ‘না না, ওদের সাথে খেলা ঠিক নয়। কী সব আজেবাজে ছেলেরা খেলে। মাঠটাও দেখেছি আমি। একদম চষা ক্ষেত। খেলতে গিয়ে পা মচকাবে। ওসব এখানকার ছেলেদের পোষায়।’
মাঠটা ভালো নয় ঠিকই। কিন্তু অতগুলো ছেলে যদি সেখানে রোজ রোজ দিব্যি খেলে, দীপ পারবে না কেন? অমন এবড়োখেবড়ো মাঠে দীপ কত টুর্নামেন্ট খেলেছে কলকাতায়।
মায়ের আসল ইচ্ছেটা বোঝে দীপ। ওই ছেলেগুলোর সঙ্গে খেলা তাঁর পছন্দ নয়। এই গ্রাম একদা চৌধুরীদের প্রজা ছিল। আজও সেটা মুছে যায়নি মা-মাসি-দাদু-দিদাদের মন থেকে। তাই চৌধুরীবংশের লোকেরা আজও পারতপক্ষে মেশেন না এই গ্রামের লোকেদের সঙ্গে। শুকনো ভদ্রতা করেন বড়োজোর, কিন্তু ঘনিষ্ঠ হন না।
ওই মাঠে যারা ফুটবল খেলে তাদের কয়েকজনের বাবা মা চৌধুরীবাড়িতে কাজ করেন। চাষবাসের কাজ। ধোপা নাপিত মিস্ত্রির কাজ। তাদের ছেলেদের সঙ্গে দীপকে খেলতে দিতে মায়ের আপত্তি।
মায়ের এই মনের ভাবটা দীপের ভালো লাগেনি। কলকাতায় তাদের ক্লাস টিমে, তাদের ক্লাব টিমে যারা খেলে, তাদের বাবা মা-রা কী কাজ করে, কেউ কি তাই নিয়ে মাথা ঘামায়? যে বাড়ির ছেলেই হোক, ভালো খেললেই তার খাতির। তা এখানে তাই নিয়ে মা-মাসির এত মাথাব্যথা কেন?
বাধ্য হয়ে দীপ একদিন গ্রামে বেড়াতে বেরুলো। একা একাই। দাদু রঘুদা বলে একজনকে সঙ্গে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দীপ রাজি হয়নি। ধুততেরি, আধবুড়ো রঘুদাকে নিয়ে কি বেড়িয়ে সুখ? খুটখুট করে চলে। গম্ভীর মুখ। আর দীপ কি ছেলেমানুষ যে এই ছোট্ট গ্রামে পথ হারাবে? না তাকে কেউ ধরে নিয়ে যাবে? কলকাতায় যে কত ভিড়ের বাসে চাপে। একাই চলে যায় কত দূর দূর।
একদিনেই কিন্তু দীপের গ্রামে ঘোরার শখ মিটে গেল।
ঘণ্টাখানেকের মধ্যে গোটা গ্রাম দেখা শেষ। গাছে চড়তে ইচ্ছে হচ্ছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয়, সে গাছে চড়ায় তেমন পোক্ত নয়। মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ গ্রামের ছেলেদের ফুটবল খেলা দেখল। পা নিসপিস করছিল, দূর দূর, এরা ঠিকমতো শটই মারতে পারে না। এলোপাথাড়ি পিটছে বল। ওদের কয়েকটা পাসিংয়ের কায়দা আর কিকিং দেখিয়ে তাক লাগিয়ে দেওয়া যেত। মনমরা হয়ে দীপ বাড়ি ফেরে।
নাঃ, একা একা গ্রামে ঘোরায় সুখ নেই। দীপ পরদিন থেকে চৌধুরীবাড়ির আনাচে-কানাচে ঘুরতে লাগল।
এটা বেশ রোমাঞ্চকর ঠেকল তার কাছে।
পাক খাওয়া সরু সরু সিঁড়ি দিয়ে কখনো ওঠে। কখনো নামে। নির্জন বারান্দা দিয়ে হাঁটে। এক উঠোন পেরিয়ে আর-এক উঠোনে যায়। কোনো অচেনা দরজা খোলা পেলেই সেখান দিয়ে এক নতুন জগতে যেন হাজির হয়। দোতলা তো বেবাক ফাঁকা। একতলায় কেউ কেউ সামনে পড়ে। তারা হেসে বলে— ‘কীগো খোকাবাবু, বাড়ি দেখছ বুঝি?’
তবে সব রহস্য আবিষ্কারে ভরসা হয় না। এমন সব অন্ধকার সিঁড়ি রয়েছে যে তাতে উঠতে নামতে ভয় হয়। যদি পথ হারায়! অনেক ঘুপচি আধো অন্ধকার উঠোনে উঁকি মেরে পেছিয়ে আসা।
দ্বিতীয় দিন বিকেলে এমনি ঘুরতে ঘুরতে দীপ কানুর দেখা পেল।
একতলার ভেজানো একটা দরজা ফাঁক করে বাইরে তাকিয়ে দীপ দেখল যে ঠিক সামনে চারদিক ঘেরা ছোট্ট এক টুকরো জমি। তার ভিতর দীপেরই বয়সি একটি ছেলে এক পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে কী জানি খেলছে। আর ছেলেটার কাছে থাবা গেড়ে বসে ইয়া তাগড়াই একটা মেটে রঙের দেশি কুকুর।
অচেনা ছেলেটি প্রথমে দীপকে দেখতে পায়নি। কিন্তু কুকুরটা টের পেল। সে দীপের দিকে ঘাড় ফিরিয়ে গরগর করে উঠল। অমনি ছেলেটিও খেলা থামিয়ে তাকায় দীপের দিকে। দীপ বেরিয়ে এল দরজার বাইরে। ছেলেটি মৃদু স্বরে কী জানি বলতে কুকুরটা গরগরানি থামাল বটে, কিন্তু সন্দিগ্ধ চোখে নজর রাখল দীপের ওপর।
এ জায়গাটা বাড়ির একটা সীমানা। সামনে আর দুপাশে উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা হাত তিরিশেক লম্বা আর প্রায় পনেরো হাত চওড়া একটা জায়গা। দাদুর বাড়ির গা দিয়ে সরু এক চিলতে টানা রোয়াক চলে গেছে। সামনে পাঁচিলের মাথা ছাড়িয়ে দেখা যাচ্ছে একটা দোতলা বাড়ি। দীপ চিনল যে ওটা তার দাদুর ছোটো ভাইয়ের মহল। ছোটোদাদু বাতের জন্য দোতলায় ওঠেন না। তাই ও-বাড়িতে দোতলাটা বন্ধই থাকে। টানা রোয়াকটুকু ছাড় দিয়ে দুপাশের পাঁচিল জায়গাটাকে আড়াল করে রেখেছে। জায়গাটার এক কোণে একটা কুয়ো। কুয়োর মুখ দুটো বড়ো বড়ো তক্তা দিয়ে চাপা। বোধহয় এই কুয়োতে লোকে চান-টান করে বা করত কখনো। তাই জায়গাটা এভাবে আড়াল করা হয়েছে। ঘেরা জায়গাটার জমি বেশ সমান। তাতে ঘাস নেই, আগাছা নেই।
এক নজরে চারিপাশটা দেখে নেয় দীপ।
ছেলেটির রং কালো। মুখখানা মিষ্টি। ভাসা ভাসা বড়ো বড়ো চোখ। এক-মাথা রুক্ষ চুল। পাতলা গড়ন। পরনে ময়লা হাতকাটা গেঞ্জি আর হাফ প্যান্ট। খালি পা। সে দীপের দিকে চেয়ে লাজুক হাসল। দীপের ভারি ভালো লাগল ওর হাসিটি। সে জিজ্ঞেস করল, ‘কী খেলছিলে?’
—‘এক্কাদোক্কা।’ একটু থতমত খেয়ে মৃদু কোমল গলায় জবাব দেয় ছেলেটি।
—’ধুস। ও তো মেয়েদের খেলা। ক্রিকেট জানিস?’ বলল দীপ।
—‘না।’ ছেলেটা মাথা নাড়ে।
—‘ফুটবল?’
—‘হুঁ।’
—‘ফুটবল আছে?’
—‘না।’
দীপ ভাবল, এখন ফুটবল জোগাড় করি কোত্থেকে? তাছাড়া এইটুকু জায়গায় ফুটবল কি জমবে? আর মাত্র দুজনে?
ছেলেটা টপ করে বুঝে ফেলে দীপ খেলতে চাইছে। সে বলে ওঠে, ‘গুলি খেলবে?’
—‘গুলি? আগে তো খেলতাম। ঠিক আছে তাই খেলব। কই গুলি?’
—‘আনছি’ বলে ছেলেটা খোলা দরজা দিয়ে সুড়ুৎ করে দাদুদের মহলের ভিতরে ঢুকে যায়। কুকুরটাও লাফ দিয়ে ছেলেটার পিছু নেয়।
দাদুর বাড়ির এইদিকে নিচুতলায় একসার ছোটো ছোটো ঘর। তাদের দরজা ভিতরের উঠোনের দিকে, জানলাগুলো এপাশে বাইরের দিকে। বোঝা মুশকিল ঘরগুলোয় লোক থাকে কিনা।
দীপরা আগে যে পাড়ায় ভাড়া থাকত সেখানে ছেলেরা ফুটপাতে আর একটা ছোটো মাঠে গুলি লাট্টু খেলত। ফুটবল ক্রিকেটও চলত। বছর দুই হল দীপরা অন্য পাড়ায় নিজেদের কেনা ফ্ল্যাটে উঠে এসেছে। এখানে গুলি লাট্রু খেলার চল নেই। দীপ এখন কাছেই একটা ক্লাবে ভর্তি হয়েছে। সেখানে শুধু ফুটবল ক্রিকেট খেলা হয়। গুলির টিপ তার এখন কেমন আছে কে জানে?
একটু বাদেই পোষা কুকুর সমেত ফিরে আসে ছেলেটা। তার হাতে চারটে কাচের গুলি। গুলিগুলোর অবস্থা শোচনীয়। বেশ পুরনো। খেলে খেলে গা চটে গেছে। এর চাইতে ভালো গুলি বোধহয় নেই ছেলেটার। যাহোক এতেই খেলা যাক।
দীপ জিজ্ঞেস করে, ‘তোর নাম কী রে?’
ছেলেটি বলল— ‘কানু।’
—‘আমার নাম দীপ। ভালো নাম দীপংকর।’
—‘তুমি বুঝি বেড়াতে এসেছ?’ জিজ্ঞাসা করে কানু।
—‘হ্যাঁ, কলকাতা থেকে। এটা আমার দাদুর বাড়ি। মায়ের সঙ্গে এসেছি। কয়েকদিন থাকব। মাসি আর দিদিরাও এসেছে। বুঝলি, না খেলে সময় কাটছে না। বড্ড বোর লাগছে। তুই আমার সাথে খেলবি তো?’
—‘হুঁ।’ কানু খুশি হয়ে ঘাড় দোলায়।
দীপ সমবয়সি কানুকে দিব্যি তুইতোকারি চালালেও সে লক্ষ্য করে যে কানু ‘তুমি’র নীচে নামে না। ও বোধহয় এ বাড়ির কোনো কর্মচারীর ছেলে। বাবুদের ছেলেকে তুই বলতে তাই সংকোচ।
যাহোক খেলা শুরু হয়ে যায়।
বাপরে, কানুর হাতের টিপ দেখে দীপ থ। একে তো তার অভ্যাস নেই অনেক দিন, তার ওপর ভাঙা গুলিগুলো আঁটে বসে না ঠিকমতো। সে স্রেফ গো-হারা হারে। তবে সহজে হার মানবার পাত্র সে নয়। খানিকক্ষণ খেলার পর দীপ কানুকে বলে, ‘এখানে গুলি কিনতে পাওয়া যায়?
কানু বলল, ‘হ্যাঁ যায়। এগরা বাজারে।’
দীপ বলে, ‘এখন চলি। কাল ফেরত খেলতে আসব। এখানে খেলবি তো?’ —হ্যাঁ।’ সায় দেয় কানু।
—‘কখন খেলবি?’
‘মা কাজে চলে গেলে। বিকেলে চারটের পর।’
—‘তোর মা কী করে?’ জিজ্ঞেস করে দীপ।
কানু মুখ নামিয়ে সংকোচের সাথে বলে, ‘এই ঘরের কাজ। ঘর পৌঁছা। বাসন মাজা এইসব।’
—‘তোর বাবা কী করে?’
—‘বাবা নেই।’ বিষণ্ণ ভাবে জানায় কানু
—‘তোর ভাইবোন আছে?’
—‘আছে। ছোটো বোন।’
—‘তুই কোথায় থাকিস?’
—‘ওইখানে।’ দাদুর বাড়ির এই পাশে নীচুতলার ছোটো ছোটো যে ঘরের সারি সেইদিকে আঙুল দেখায় কানু।
দীপু ভাবল, ‘যাকগে, ওর মা কী করে তাতে আমার বয়ে গেছে। ছেলেটা কিন্তু ভারি ভদ্র। শহুরে অনেক চালিয়াত ছেলের চেয়ে ঢের ভালো। তবে মা-মাসিরা না জানতে পারে। তাহলে ঠিক বারণ করবে ওর সঙ্গে খেলতে। বরং এখানে লুকিয়ে খেলব।’
পরদিন সকালে দীপ দাদুর বাড়ির একজন কাজের লোককে পাঠাল মাইল পাঁচেক দূরে বাজারে গুলি কিনতে।
বিকেলে সেই পাঁচিল ঘেরা গোপন জায়গাটিতে দীপের চারটে ঝকঝকে লাল নীল নতুন কাচের গুলি দেখে কানুর চোখ চকচক করতে থাকে। হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে গুলিগুলো। বিড়বিড় করে, ‘ইস কী সুন্দর!’
দীপ নতুন দুটো গুলি কানুকে দিয়ে, নিজে অন্য দুটো নিল। তারপর খেলা শুরু হল।
কিন্তু নতুন গুলিতেও দীপ কানুর সঙ্গে মোটেই এঁটে উঠতে পারল না। উঃ, ছেলেটার মারাত্মক টিপ।
শেষে হতাশ হয়ে দীপ খেলা থামিয়ে বলে ফেলল, ‘নাঃ গুলিতে জুত হচ্ছে না। অনেকদিন প্র্যাকটিস নেই কিনা। আর তোর যা টিপ। জমছে না খেলা।’
একটু লজ্জিত ভাবে কানু বলল, ‘আমি কেবল এক্কাদোক্কা আর গুলি খেলি। তাই খেলে খেলে টিপ বেড়ে গেছে। কদিন খেললে তোমারও হয়ে যাবে।’
দীপ ভাবে, নাঃ সে গুড়ে বালি। অমন টিপ বানানো এটা কটা দিনেই অসম্ভব। গুলি চলবে না, অন্য খেলা ভাবতে হবে।
পরদিন বিকেলে দীপ তাদের খেলার জায়গায় একটা টেনিস বল নিয়ে হাজির হল। এখানে খেলার মতলবে একটা ক্রিকেট ব্যাট আর একটা টেনিস বল সঙ্গে এনেছিল। আসল ফুটবলে না হোক, টেনিস বলেই ফুটবল খেলা যাক।
কিন্তু মাত্র দুজনে কি ফুটবল জমে?
দীপ ভেবে বের করল— পেনাল্টি কম্পিটিশন হোক।
পাশে একদিকে দেয়ালের নীচে ইটের টুকরো রেখে দুই গোলপোস্টের মার্কা হল। উল্টোদিকের দেয়াল ঘেঁষে বল বসিয়ে শট মারা হবে। প্রত্যেকে এক-একবার পর পর পাঁচটা শট মারবে। তারপর অন্যজন পাঁচটা। দেখা যাক কে কেমন পেনাল্টি বাঁচায়।
এবার যে কানু পারবে না দীপ নিশ্চিত। ক্লাবে ফুটবল ক্রিকেট ব্যাডমিন্টনে দীপের কত নাম। এখানে এক পাড়াগেঁয়ে ছেলের কাছে গুলিতে বারবার হেরে দীপের বেশ মনে লেগেছে।
পেনাল্টি কম্পিটিশনের ব্যাপারটা কানুকে বুঝিয়ে দিল দীপ।
কানুকে গোলে দাঁড় করিয়ে শট মারার জন্য বল হাতে যাচ্ছে দীপ, এমন সময় পায়ের শব্দ শোনা গেল। কেউ দাদুর বাড়ির গা ঘেঁষে রোয়াক দিয়ে এদিকে আসছে।
কে আসে? একবার কান পেতে তারপর পেছনে তাকিয়ে দীপ দেখে কানু নেই। শুধু তার কুকুরটা রয়েছে।
যে মাঝবয়সি লোকটি ঘেরা জায়গাটার মধ্যে হাজির হয় তাকে আগে দেখেছে দীপ। সে দাদুর যে চাষের জমি আছে তাতে কাজ করে। নাম- গোবিন্দ।
গোবিন্দ এই নিরালায় দীপককে দেখে অবাক হয়ে থমকে গিয়ে বলল, ‘খোকাবাবু এখানে কী কোচ্চো?’
—‘বল খেলছি।’ গম্ভীরভাবে হাতের বলটা দেখিয়ে দীপ বলে, ‘জায়গাটা বেশ ঘেরা। বল বাইরে যায় না।’
—‘তা বটে। আরে বাঘাও দেখছি জুটেছে।’ কানুর কুকুরটাকে দেখায় গোবিন্দ। তারপর বলে, ‘কুয়োয় ঝুঁকো না যেন।’
—‘না না।’ দীপ ভরসা দেয়।
আর কথা না বাড়িয়ে গোবিন্দ হনহন করে সরু রোয়াকটা দিয়ে হেঁটে অপর প্রান্তের পাঁচিলের ধার দিয়ে অদৃশ্য হচ্ছিল।
হাঁফ ছেড়ে বাঁচল দীপ। কিন্তু কানু কোথায় গেল? ভাবতে ভাবতেই দেখে যে কুয়োপাড়ের আড়াল থেকে কানুর মাথা জাগছে। একগাল হেসে উঠে দাঁড়ায় কানু।
যাক, ছেলেটার বুদ্ধি আছে। ঠিক সময়ে লুকিয়েছে। এখানে বাসনমাজা ঝিয়ের ছেলের সঙ্গে দীপ খেলছে খবরটা যদি গোবিন্দ মারফত মা-মাসির কানে যায় তাহলে কানুর সঙ্গে দীপের খেলার বারোটা বেজে যাবে। অমনি নিষেধ আসবে। হয়তো বা কানুকেও বকুনি খেতে হবে। ব্যাপারটা আঁচ করে ছেলেটা গা ঢাকা দিয়ে খুব ভালো কাজ করেছে। এধার দিয়ে লোক চলাচল করে কদাচিৎ। তবু সাবধান থাকতে হবে।
পেনাল্টি প্রতিযোগিতায় সত্যি কানু দীপের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে না। বেচারি জানে না কেমন করে ঠিকমতো বল কিক করতে হয়। কেমন করেই বা গোল আটকাতে হয়, প্রথমদিকে সে গোলকিপার হয়ে দীপের একটাও শট রুখতে পারছিল না। আর তার বেশির ভাগ শটই দীপ গোলকিপার হয়ে অনায়াসে আটকে দিচ্ছিল। কানুর অনেক শট আবার স্রেফ গোলপোস্টের বাইরে চলে যাচ্ছিল।
বারবার হেরে কানুর কিন্তু বিকার নেই। সে মহা উৎসাহে নতুন খেলায় মাতে। বরং গুলিতে হেরে মনমরা দীপ এখন বল খেলায় জিতে খুশিতে চনমনে দেখে কানুও ভারি খুশি।
এ খেলাটায় সবচাইতে খুশি হয় বাঘা।
বলটা দেয়ালে লেগে ছিটকে গেলেই সে দৌড়ে গিয়ে সেটা মুখে ধরে। খুব চালাক কুকুর। বারকয়েক বোঝাবার পরই সে আর বলটা মুখে নিয়ে চক্কর খায় না। বরং বল আলতো করে দাঁতে চেপে এনে যে শট মেরেছে তার পায়ের কাছে নামিয়ে রেখে চকচকে চোখে ঘনঘন ল্যাজ নাড়ে।
বাঘার ফিল্ডিংয়ে দীপদের খাটুনি কমে যায়।
ঘণ্টাখানেক খেলার পর দীপকে দেখে দেখে কানু বল কিক করা আর গোলকিপিংয়ের কায়দা অনেকটা রপ্ত করে ফেলে। শেষের দিকে সে দীপের কাছে হারছিল বটে, তবে আগের মতন গোহারা নয়। ভালোই হল, তাতে খেলাটা জমছিল। নইলে একতরফা হয়ে যায়। তেমন খেলে সুখ নেই।
পরদিন কিন্তু খেলতে এসে দীপ খানিকক্ষণের মধ্যেই রীতিমতো হকচকিয়ে গেল। পেনাল্টি কম্পিটিশনে কানু সেদিন হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চালিয়ে দেয় দীপের সঙ্গে। কখনো কানু জেতে, কখনো বা দীপ। দীপ বোঝে যে ছেলেটা জাত খেলোয়াড়, খেলা দারুণ জমে।
বাঘার ফুর্তি দেখে কে! সে পাঁই পাঁই করে দৌড়য় বলের পেছনে পেছনে।
একবার গোল করার আনন্দে দীপ চেঁচিয়ে উঠতেই কানু ঠোঁটে আঙুল রেখে ইশারা করে— চুপ!
ঠিক তো। খেয়াল হয় দীপের। তার উত্তেজিত গলা পেয়ে কেউ যদি হাজির হয় এখানে? ফলে খেলার উত্তেজনা গলায় প্রকাশ করা চলে না।
ক্রমে হাঁপিয়ে পড়ে দুজনে। খেলা থামায়। দীপ অল্পের জন্যে জিতে যায়। কুয়োপাড়ে বসে জিরোতে জিরোতে দীপ বলে কানুকে, ‘তুই বড়ো মাঠে ফুটবল খেলতে যাস না কেন? প্র্যাকটিস করলে তুই দারুণ খেলবি।’
কানু চুপ করে থাকে।
—‘কেন যাস না?’ ফের জিজ্ঞেস করে দীপ।
—‘ওরা নেয় না।’ করুণ স্বরে জানায় কানু।
—‘কেন?’
একটুক্ষণ চুপ করে থেকে ইতস্তত করে কানু বলল, ‘ওখানে খেললে চাঁদা চায়।’
দীপ বোঝে। গরিব কানুর চাঁদা দেবার ক্ষমতা নেই। মনে মনে সে ঠিক করে ফেলে, যাবার সময় কানুকে কয়েকটা টাকা দিয়ে যাবে, তার নিজের জমানো টাকা থেকে।
হঠাৎ একটা কথা মনে হতে সে প্রশ্ন করে কানুকে, ‘হ্যারে, তুই ইস্কুলে যাস?’
—‘না।’ মাথা নাড়ে কানু।
—‘কেন?’
কানু কাঁচুমাচু ভাবে শুধু বলে, ‘আগে যেতাম।
—‘তা এখন যাস না কেন?’
কানু নতমুখে চুপ করে থাকে। জবাব দেয় না।
দীপ ভাবে, এর কারণও হয়তো পয়সার অভাব। বইখাতা কিনতে পারে না, তাই ও পড়া ছেড়েছে। কিংবা স্কুলের সময় অন্য কোনো কাজ ক’রে টাকা রোজগারের জন্যে। কৌতূহল হলেও এ নিয়ে সে আর কানুকে খোঁচায় না। বলে, ‘কানু, তোকে আমি ক্রিকেট শিখিয়ে দেব। ব্যাট এনেছি, দেখবি কেমন ইন্টারেস্টিং খেলা।’
শুনে খুশিতে কানুর মুখ চকচকে করে ওঠে।
ঘরে ফিরে যেতে যেতে দীপ ভাবল, শুধু বিকেলে কেন? সকালেও তো খেলা যায়। দশটার পর। বলে দেখব কানুকে। ও কি সকালে কোনো কাজ-টাজ করে? কানুর মতো চমৎকার খেলার সাথী জুটে যাওয়ায় এখন আর দীপের মন দাদুর বাড়ি থেকে পালাই পালাই করছে না।
কিন্তু কানুকে ক্রিকেট শেখাবার সুযোগ আর মেলে না।
কারণ সেই রাতেই দীপ জ্বরে পড়ল।
দীপের মা রাগ করেন, ‘দুপুরে অতক্ষণ ঝাঁপাই জুড়লি, পুকুরে, ঠা ঠা রোদে। বারণ করলাম, শুনলি না। এখন বোঝ ঠ্যালা। ওইজন্যেই জ্বর এসেছে।’
যাহোক, পরদিন ডাক্তার আসেন। ওষুধ পড়ে। সুখের বিষয় জ্বর তেমন বাড়ে না। দুদিনেই ছেড়ে যায়। তবু আরও একটা দিন দীপ দোতলায় তার শোবার ঘর থেকে বেরুতে পায় না।
জ্বর হবার পরদিন সকালে দীপ দেখে বারান্দার দিকে জানলার কোণে কানুর মুখ। উদ্বিগ্ন চোখে সে দেখছে দীপকে। কেন খেলতে আসেনি? তাই বুঝি খোঁজ নিতে এসেছে লুকিয়ে।
ঘরে তখন আর কেউ ছিল না। বিছানায় বসেই দীপ কানুকে বলল, ‘একটু জ্বর হয়েছিল ভাই। ভয় নেই, কমে গেছে।’
কানু একটু হেসে সরে যায়।
জ্বর হবার চারদিন বাদে দীপ নীচে নামে দুপুরে খেতে। মায়ের ইচ্ছে ছিল ঘরেই খাবার দেওয়া হোক। দীপ জেদ ধরল যে নীচে যাবে। একখানা ঘরে বন্দী হয়ে তিনদিন কাটিয়ে তার অসহ্য লাগছে।
একতলার মস্ত খাবারঘর। কলকাতার বাড়ির মতো টেবিল চেয়ারে খাওয়ার ব্যবস্থা নয়। তকতকে মেঝেতে আসন পেতে বসে পাশাপাশি খায় সবাই।
দীপ পৌঁছে গেছে খাবার ঘরে। দিদিরা আর মা-মাসিমা আসছেন খেতে। ঘরের এককোণে ম্যানেজার মশাই বসেছিলেন তক্তপোশে। খাবার তদারকি করতে। দীপও ওই তক্তপোশে বসেছিল। একটি মাঝবয়সি বিধবা মেঝে মুছে আসন দিল।
একে দীপ আগেও দেখেছে কাজকম্ম করতে। তবে নামটা খেয়াল করেনি। আজ ম্যানেজারবাবু তাকে ডেকে বললেন, ‘কানুর মা, ঠাকুরকে বলে দিয়ো খোকাবাবুকে কোনো ঝালমশলার রান্না না দিতে। দিদিমণি বলে দিয়েছেন।’
দীপের হঠাৎ খেয়াল হল নামটা।
সে ম্যানেজার মশাইকে জিজ্ঞেস করল, ‘কাকাবাবু, ওর ছেলে বুঝি কানু?’
—হ্যাঁ।’ ম্যানেজার মশাই জবাব দেন।
দীপ ফট করে বলে বসল, ‘আচ্ছা কানু কী করে?’
ম্যানেজার অবাক হয়ে বললেন, ‘কী করে মানে?’
—‘মানে কাজ-টাজ করে কিছু?’
ম্যানেজার হাঁ করে খানিক দীপের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘কী
বলছ? কানু কাজ করবে কী? কানু যে মারা গেছে বছর দুই হল।’
শুনে দীপ হতভম্ব।
ইতিমধ্যে কানুর মা কী যেন কাজে ঘরে ঢুকেছিল।
ম্যানেজার মশায়ের কথাগুলো কানে যেতেই সে চোখে আঁচল দিল।
—‘সত্যি?’ কোনোমতে উচ্চারণ করে দীপ।
ম্যানেজার মশাই বেশ জোর দিয়ে বললেন, ‘সত্যি নয়তো কী?’
কানুর মা ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।
মানেজার একটু ধমকে বললেন, ‘কানুর মা, তুমি এখন যাও। সবাই খেতে আসছেন। আর কেঁদে কী করবে বলো? সবই নিয়তি।’
কানুর মা বেরিয়ে যায়।
খানিকক্ষণ কাঠ হয়ে বসে থেকে দীপ জিজ্ঞেস করে ম্যানেজার মশাইকে, ‘আচ্ছা কানুর একটা কুকুর ছিল? বাঘা?’
ম্যানেজার বললেন, ‘হ্যাঁ, আছে তো বাঘা। ভারি ন্যাওটা ছিল কানুর। কানু মারা যেতে কেমন জানি হয়ে গেছে। দুবেলা শুধু খেতে আসে এখানে। আর কোথায় কোথায় যে ঘোরে? দেখতেই পাই না।’
দিদি মা-মাসিরা এসে পড়লেন।
কোনোরকমে দীপ দুটি মুখে দিয়ে উঠে পড়ে আনমনা ভাবে। মা-মাসিদের কথায় সে বুঝেছে যে তারা আসছে কালই কলকাতায় ফিরছে। পাছে দীপ ফের জ্বরে পড়ে সেই ভয়ে এখানে থাকতে আর ভরসা পাচ্ছে না তার মা।
মা দীপকে বারণ করলেন, ‘বিকেলে আজ বাড়ির বাইরে যাবিনে। ছাদে থাকবি। সন্ধের আগে ঠিক ঘরে ঢুকবি। এ কদিন বড্ড বেশি টো টো করেছিস।’
দুপুরে মা আর মাসি দিদার ঘরে গল্প করতে গেছে। দিদিরা অন্য ঘরে ঘুম দিচ্ছে। এই সুযোগে দীপ পা টিপে টিপে বেরুলো বন্ধু কানুর দেখা পাবার আশায়। বিকেলে তো আজ নীচে যাবার উপায় নেই।
নিঝুম বাড়ি। শুধু পায়রার বকবকম আর পাখার ঝটপটানি কানে আসে।
নীচতলার সেই পাঁচিল ঘেরা জায়গাটাতে যাবার দরজার কাছে পৌঁছে দীপ দেখল যে ওখানে একটা ঘরের দরজা খোলা। ওই ঘরের ভিতর থেকে কানুর মায়ের গলা পাওয়া গেল। আর একটা কচি মেয়ের গলা। ও হয়তো কানুর বোন।
দরজা খুলে ঘেরা চত্বরে উঁকি দিয়ে দীপ দেখল যে কানু সেখানে নেই। এদিক-ওদিক তাকিয়েও সে কানুর দেখা পেল না।
কানু বোধহয় এখানে আসে না যতক্ষণ না কানুর মা কাজে যায়। যতক্ষণ না জায়গাটা একেবারে নিরালা হয়ে যায়। সেই বিকেলে আসবে।
দীপ তাহলে খেলার জায়গাটিতে এগিয়ে যায় নিঃশব্দে। পকেট থেকে বের করে চারটে নতুন কেনা কাচের গুলি। সেগুলো রাখে মাটিতে, গুলি খেলার গাব্বুর ভিতর। তারপর একই জায়গায় গুলিগুলোর ওপরে রাখে টেনিস বলটা।
কানু বিকেলে এসে ঠিক পাবে বলটা আর গুলিগুলো। তখন ওর খুশিভরা অবাক মুখখানা সে মনে মনে কল্পনা করে। এগুলো সে যাবার আগে কানুকে দান করে যাবে ঠিকই করেছিল। তবে উপহারগুলো হাতে হাতে দিতে পারলে ভারি ভালো লাগত। বলটা শুধু কানুর খেলার জন্যে নয়। কানু-বাঘা দুজনেরই। ইস বাঘার দেখাও যদি একবার মিলত। ও এখন কানুর সঙ্গে কোথায় ঘুরছে কে জানে?
পরদিন সকালে দীপ, মা-মাসি-দিদিদের সঙ্গে মোটরে উঠেছিল। এখান থেকে যাবে স্টেশন। সেখান থেকে ট্রেনে কলকাতা।
গাড়ি স্টার্ট দিতেই মা-মাসি-দিদিরা গাড়ি থেকে হাত নাড়তে লাগল দাদু-দিদা আর যারা বিদায় জানাতে এসে দাঁড়িয়েছে তাদের উদ্দেশে।
দীপও হাত নাড়ছে। কিন্তু সে বিদায় জানাচ্ছে শুধু একজনকে লক্ষ্য করে কানু।
দূরে সবার পেছনে সদর বাড়ির বারান্দায় মোটা একটা থামের আড়াল থেকে উঁকি দেওয়া কানুর ম্লান মুখখানি সে দেখতে পেয়েছে ঠিক গাড়ি ছাড়ার আগে।
অন্যদের লুকিয়ে কানুও একবার হাত নেড়ে বিদায় জানাল দীপকে।