বন্দুক

বন্দুক

অধৈর্যভাবে ঘরের ভেতরে পায়চারি করছে লোকনাথ সাহা। ক্ষুব্ধ আক্রোশে অনেকক্ষণ ধরে দাঁতের ওপর দাঁত চেপে রাখবার ফলে মাড়িটা টনটন করছে এখন। ডান হাতটা অতিরিক্ত জোরে মুঠো করে রাখবার জন্যে হাতের নরম মাংসের ভেতরে দু-তিনটে নখ একেবারে বসে গেছে; জ্বালা করছে চিনচিন করে, রক্ত পড়ছে বোধ হয়। কিন্তু লোকনাথ সাহা টের পাচ্ছে না কিছু, তেমনি অধৈর্যভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘরের মধ্যে পায়চারি করে যাচ্ছে।

তারপর আস্তে আস্তে সন্ধ্যা ঘনাল। ঘরের ভেতরে নামতে লাগল কালো অন্ধকার। যেগুলো স্পষ্ট আর আকারগত ছিল, ধীরে ধীরে তারা অবয়বহীন হয়ে যেতে লাগল। তারও পরে ঘরের ভেতরে লোকনাথ সাহার নিজের অস্তিত্ব ছাড়া কিছু জেগে রইল না।

নিজের অস্তিত্বটাই শুধু জেগে রইল। কিন্তু অতি তীব্র, অতি ভয়ংকর এই জাগরণ। ইচ্ছে করতে লাগল এই অন্ধকারের মধ্যেই সে ছুটে বেরিয়ে পড়ে; জ্বালিয়ে দেয় এই পৃথিবীটাকে, ভেঙে চুরমার করে দেয় যা-কিছু সম্ভব। একটা অসহ্য অথচ অবাস্তব ধ্বংসকল্পনায় প্রচন্ড বিস্ফোরণের মতো নিজের মধ্যে ধূমায়িত হতে লাগল লোকনাথ সাহা। যুগ পালটাচ্ছে, দেশ স্বাধীন হচ্ছে, সব মানি; এও জানি যে গরিবের দুঃখ দূর করতে হবে, চাষাভুসোদের পেটের অন্নের সংস্থান করে দিতে হবে। কিন্তু এ কী ব্যাপার! স্বাধীনতার আন্দোলন করতে হয়, লড়াই করতে হয় করো ইংরেজের সঙ্গে। পেটের ভাত চাইতে হয় মহকুমা হাকিমের বাংলোর সামনে গিয়ে ধর্না দাও, শহরের রাস্তায় ভুখামিছিল বার করো। এদের কোনোটাতেই লোকনাথ সাহার আপত্তি নেই। দরকার হলে দেশের জন্যে সেও আত্মবিসর্জন করতে পারে, অর্থাৎ একটা সভাসমিতিতে সভাপতি হয়ে মাস তিন-চার এ ক্লাস জেল খেটে আসতে পারে—যা সে এর আগেও করেছে। আর বলো তো খবরের কাগজে জ্বালাময়ী একখানা পল্লিগ্রামের পুত্রও সে লিখে দিতে পারে, অগ্নিময় কণ্ঠে প্রশ্ন করতে পারে আমরা জানিতে চাই, জনপ্রিয় মন্ত্রীমন্ডলী এই অনাচার-অবিচারের প্রতিবিধান করিবেন কি না এবং কবে করিবেন?

কিন্তু এ তো তা নয়। কেঁচো খুঁড়তে খুঁড়তে শেষপর্যন্ত ফণা তুলে উঠেছে কেউটে সাপ। এ কি কখনো কল্পনাও করা যায় যে শেষপর্যন্ত এ আপদ তারই ঘাড়ে চড়ে বসতে চাইবে? তিন ভাগের দু-ভাগ ধান! তার মানে দু-মাস পরে বলবে তিন ভাগের তিন ভাগই চাই! আর শুধু ওইখানেই থামলে হয়! শেষপর্যন্ত দাবি করে বসবে ঘর দাও, বাড়ি দাও, গোরু দাও, বউ দাও…

নাঃ, অসহ্য এবং অসম্ভব। কচু গাছ কাটতে কাটতে ডাকাত হওয়ার যে অদূর সম্ভাবনা সুনিশ্চিত হয়ে আসছে, এই মুহূর্তে তার কণ্ঠরোধ করতে হবে যাতে ভবিষ্যতে টু শব্দটি করবার পর্যন্ত সাহস না পায়।

সত্যিই অসহ্য। লোকনাথ সাহা কান পেতে শুনতে লাগল গ্রামের দিক থেকে কোলাহল উঠেছে। জয়ের কোলাহল, আনন্দের কলধ্বনি। ফসল কেটে নিজেদের ঘরে তুলেছে ওরা। মহাজন আর জোতদারকে বলে পাঠিয়েছে, দরকার হলে তারা যেন নিজেদের ভাগ নিজেরা এসে নিয়ে যায়। ওরা জমিতে লাঙল দিয়েছে, সার দিয়েছে, রোদে পুড়ে জলে ভিজে ফসল ফলিয়েছে এবং ফসল কেটেছে। আসলে সব ধানটাতেই ওদের দাবি। তবু জমিদার জোতদারকে একেবারে বঞ্চিত করতে চায় না, তাই ধর্মের নামে তাদের এক ভাগ ধান দিতে ওদের আপত্তি নেই। তবে বাড়ি বয়ে সে এক ভাগ ওরা দিয়ে আসতে রাজি নয়। বাবুমশায় এবং মিয়াসাহেবেরা ইচ্ছে করলে নিজেরা এসে অথবা নোক পাঠিয়ে তাঁদের পাওনা ভাগ নিয়ে যেতে পারেন।

লোকনাথ সাহা, ফজল আলি, নুর মামুদ আর বৃন্দাবন পাল চাষাদের বোঝাবার চেষ্টা করেছিল। বলেছিল, আল্লার নামে ভগবানের নামে ভেবে দ্যাখ তোরা কী করতে যাচ্ছিস!

চাষাদের পক্ষ থেকে রহমান জবাব দিয়েছিল, যা করেছি আল্লার নামে ভেবেই করেছি। গায়েগতরে একটু আঁচড় লাগায়ে না বাবু, জমির ভালো-মন্দের দিকে একবার তাকাবে না, অথচ থাবা দিয়ে অর্ধেক ধান গোলায় তুলে নেবে। নিজেরাই একবার ইমানের দিকে তাকিয়ে দ্যাখো কোনটা হক আর কোনটা বেইমানি।

ফজল আলির আর সহ্য হয়নি। গর্জে বলেছিল, খুব তো হক আর বেইমানি বোঝাচ্ছিস। ওরে, মোছলমানের বাচ্ছা হয়ে হিঁদুর ফাঁদে পা দিলি? লজ্জা হয় না?

রহমান শুধু হেসেছিল। বাধা দিয়ে বলেছিল, মোছলমান গরিব হিঁদু গরিবের সঙ্গে দাঁড়িয়ে পেটের ভাতের জন্যে লড়াই করলে গুনাহ হয়, আর হিন্দু জোতদারের সঙ্গে দোস্তি করে মোছলমানের ভাত মারলে সেটাই বুঝি বড়ো ভালো কাজ হল? বোকা বুঝিয়ে না সাহেব, যাও যাও, নিজের কাজে যাও।

পিপড়ের পাখনা গজিয়েছে মরবার জন্যে, অ্যাঁ? ধৈর্যচ্যুত হয়েছিল ফজল আলি, আচ্ছা, টের পাবি! সেদিন পায়ে ধরে কাঁদলেও নাফা হবে না, এই বলে রাখলাম।

কলিজার রক্ত দিয়ে ধান রাখব, জান দিতে হয় দেব, তবু তোমাদের দোরে হাত পেতে সিন্নি চাইতে যাব না—এও জানিয়ে রাখছি।

বটে? বেশ বেশ!

আর কথা জোগায়নি ফজল আলির। কয়েক মুহূর্ত নির্নিমেষ চোখে তাকিয়ে ছিল রহমানের দিকে, যেন রক্তখেকো একটা বাঘের মতো ওর ঘাড়ের ওপর ঝাঁপ দিয়ে পড়বে। তারপর দাঁতের ফাঁকে একটা ভয়ংকর কটু শপথ উচ্চারণ করে ধীর পদক্ষেপে স্থানত্যাগ করেছিল। সঙ্গে সঙ্গে চলে এসেছিল লোকনাথ সাহা, বৃন্দাবন পাল আর নুর মামুদ।

তারপর?

তারপর থেকে এই চলছে। মানুষগুলো খেপে উঠেছে, মেতে উঠেছে জয়ের আনন্দে। এ যেন সাপের পাঁচখানা পা দেখবার আনন্দ। কিন্তু সাপের যে সত্যি সত্যিই পাঁচটা বেরোয় না, এটা ওদের বোঝানো দরকার। বুদ্ধিটা শেষপর্যন্ত বাতলে দিয়েছে ফজল আলিই। বলেছে, রঘুরামকে ডাকো।

রঘুরাম?

হ্যাঁ, রঘুরাম। সে ছাড়া আর কারও কর্ম নয়।

তারপর গলার স্বর নামিয়ে এনেছে ফজল আলি। চাপা গলায় বলেছে কতগুলো ভয়ংকর কথা। শুনে লোকনাথের অবধি শরীরটা ঝিমঝিম করে উঠেছে, হিম হয়ে গেছে হাত পাগুলো। জিভটা শুকিয়ে হঠাৎ যেন আঠার সঙ্গে আটকে গেছে তালুতে।

ক্ষীণকণ্ঠে লোকনাথ বলেছে, অতটা?

হ্যাঁ, অতটাই।

বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে না?

কিচ্ছু না। শত্রুর শেষ রাখতে নেই।

কিন্তু থানা-পুলিশ?

ফজল আলি হেসেছে। বলেছে, সাধে কি তোমাদের সঙ্গে আমাদের বনিবনাও হয় না, না পাকিস্তান চাইতে হয়? আরে, অত ঘাবড়ালে চলে? তা ছাড়া থানা-পুলিশ? গূঢ়ার্থব্যঞ্জক হাসিতে মুখোনাকে উদ্ভাসিত করে তুলেছে ফজল আলি। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে পারলে ওরাও আপত্তি করবে না দেখে নিয়ো। আর একটু থেমে দু-আঙুলে টাকা বাজাবার ভঙ্গি করে বলে, ঠিক হয়ে যাবে।

তাহলে রঘুরামকে খবর দিই?

নিশ্চয়।

শুকনো ঠোঁট দুটোকে বার কয়েক লেহন করে দুর্বল অনিশ্চিত স্বরে লোকনাথ বললে, দ্যাখো ভাই, শেষতক পেছনে পেছনে থেকো। শেষে আবার সামনে ঠেলে দিয়ে সরে পোড়ো না।

খেপেছ? পিচ করে অবজ্ঞাভরে দাঁতের ফাঁক দিয়ে থুথু ছড়িয়েছে ফজল আলি, দু-বার হজ করেছি, পাঁচ অক্ত নামাজ পড়ি আমি। জীবনে একটা রোজা আমার ভাঙেনি। খাঁটি মোছলমানের বাচ্চা আমি, ইমান নষ্ট করব! কী যে বলছ, তোব তোবা!

সুতরাং ডাক পড়েছে রঘুরামের। রঘুরাম বলেছে সন্ধের পরে আসবে, দিনের আলোয় এ ব্যাপার সম্ভব নয়। গাঁয়ের লোক এমনিতেই খ্যাপা কুকুরের মতো ঘুরছে, দেখলেই সন্দেহ করবে। আর সন্দেহ করা মানেই চকচকে হাঁসুয়ার কোপে টুকরো টুকরো করে কেটে বস্তায় ভরে ভাসিয়ে দেবে করতোয়া নদীতে।

তাই সন্ধ্যার অন্ধকারে আসবে রঘুরাম। আসবে কালো রাত্রির আড়ালে আড়ালে লুকিয়ে নিঃশব্দচর সরীসৃপের মতো। তারই জন্যে প্রতীক্ষা করছে লোকনাথ, পায়চারি করে বেড়াচ্ছে বন্য জন্তুর মতো। চাষিদের কোলাহলের এক-একটা দমকায় বুকের ভেতর এক-একটা করে চিড় খেয়ে যাচ্ছে তার।

রঘুরাম আসবে, কিন্তু কখন?

রঘুরাম পাশি। তাল গাছ চাঁছে, তাড়ি তৈরি করে। ব্যাবসা চলে অবশ্য আবগারিকে ফাঁকি দিয়ে। একবার ধরা পড়ে দু-বছর জেল খেটেছে কিন্তু স্বভাব বদলায়নি।

রোগা শিড়িঙ্গে লোকটা। নারকেলের দড়ির মতো ছিবড়ে-পাকানো শরীর। অতিরিক্ত তাড়ি খায়, আবার গাঁজাও টানে ততোধিক উৎসাহে। বলে, রসটা তো শুকোনো চাই, হে-হে-হে। চোখের রং খ্যাপা বুনো মোষের মতো রক্তাভ, অত্যধিক নেশার ফলে স্বাভাবিক বর্ণ হারিয়ে ওই রংটাই পাকা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

শুধু এইটুকুই যথেষ্ট পরিচয় নয় রঘুরামের। কোন ছেলেবেলাতে একটা গাদাবন্দুক জোগাড় করেছিল রঘুরাম, হাত পাকিয়েছিল। তার পর থেকে তার হাতের তাক একটা প্রবাদবাক্যের মতো দাঁড়িয়ে গেছে। কার্তিক-অঘ্রান মাসে আশপাশের বিলে হাঁস পড়তে শুরু হয়। মিয়াসাহেবেরা, বাবুমশায়েরা তখন বিলে নামে শিকারের চেষ্টায়। দমাদ্দম গুলি ছোড়ে, দশটা ফায়ারে একটা পাখি নামাতে পারে না। আর তাই দেখে এলোমেলো দাঁতগুলোর দু-পাটি একেবারে পরিপূর্ণ করে মেলে দেয় রঘুরাম, হো-হো করে হাসে। বলে, কর্তাদের একটা গুলিও তো পাখিগুলোর গায়ে লাগবে না, তবে যেরকম শব্দ-সাড়া হচ্ছে তাতে দুটো-চারটে বাসায় গিয়ে মরে থাকবে।

তা হাসতে পারে বই কী রঘুরাম, বিদ্রূপ করবার অধিকারও তার আছে। তার হাতের তাগ ফসকায় না। বাবুদের বন্দুক চেয়ে নিয়ে এক ফায়ারে দশটা পাখিও সে নামিয়ে দিয়েছে। বলেছে, শুধু কি বত্রিশ ইঞ্চি বন্দুক আর বাক্স বাক্স টোটা থাকলেই শিকারি হওয়া যায়? হাওয়া বুঝতে হয়, জায়গা বাছতে হয়, জল-কাদা কাঁটাবন ভাঙতে হয়। সুখের শরীর আর কোঁচানো ধুতিটি নিয়ে বন্দুক বাগিয়ে কাক তাড়ানো যায়, কিন্তু শিকার করা যায় না।

সত্যিই রঘুরাম পাকা শিকারি আর শিকারি বলেই তাকে এমন সমাদর করে ডেকে পাঠানো হয়েছে। তবে এবার আর তার পাখি শিকার নয়, তার চাইতে ঢের বড়ো ঢের বিপজ্জনক শিকারের বন্দোবস্ত।

আর এদিক থেকেও বেশ নিরাপদ নির্ঝঞ্ঝাট লোক রঘুরাম। নীতি বলে বিবেক বলে কোনো কিছুর বালাই নেই তার। টাকা পেলে যা খুশি সে তাই করতে পারে, খামোখা গোটা তিনেক মানুষ খুন করে আনতে পারে। সকলের মাঝখানে থেকেও সে সকলের বাইরে। প্রয়োজনমতো নিজেকে কেন্দ্র করে সে একটা বৃত্তাকার পৃথিবী সৃষ্টি করে নিয়েছে। তাল গাছ চাঁছে, তাড়ি গেলে, গাঁজা টানে আর গ্রামের প্রান্তে যে ডোম পাড়া আছে সেখানে কোন একটা মেয়েমানুষকে নিয়ে সারারাত কাটিয়ে আসে। সুতরাং একাজে তার চাইতে উপযুক্ত লোক আর নেই।

দরজায় ঘা পড়ল। ঘরের ভেতরে হঠাৎ ঘুমের ঘোরে ভয় পেয়ে চমকে জেগে-ওঠা মানুষের মতো বিকৃত স্বরে প্রায় চেঁচিয়ে উঠল লোকনাথ, কে?

বাতাসের শব্দের সঙ্গে একাকার হয়ে স্বর ভেসে এল, রঘুরাম।

দাঁড়াও, দোর খুলছি।

একটা লণ্ঠন জ্বালিয়ে দরজাটা খুলে দিলে লোকনাথ। বিড়ালের মতো শব্দহীন পায়ে রঘুরাম ঘরে ঢুকল।

দন্ডবৎ কত্তা। কীজন্যে অধীনকে ডেকেছেন আজ্ঞে?

বসসা বলছি।

দরজাটা আবার সাবধানে বন্ধ করে দিলে লোকনাথ। তারপর তেমনিভাবেই ভয়ংকর চাপা গলায়—যে-গলায় ফজল আলি কথা বলেছিল ঠিক তেমনিভাবেই সেই কথাগুলোই সে আবৃত্তি করে গেল। চুপ করে শুনে গেল রঘুরাম, শুনে গেল পাথুরে মূর্তির মতো।

কখন?

কাল সন্ধেয়?

কাল সন্ধেয়?

হ্যাঁ। দিঘির পাড়ে সভা করবে ওরা। বড়ো বাঁশঝাড়টার আড়াল থেকে কাজ শেষ করতে হবে।

ক-টাকে মারতে হবে?

না না, বেশি নয়। এক রহমান হলেই যথেষ্ট, ওটাকে ঘায়েল করতে পারলেই শিরদাঁড়া মটকে যাবে ওদের। এবার তোমার হাতের তাক দেখব রঘুরাম।

রঘুরাম হাসল, এলোমেলো দাঁতগুলো বার করে বিশৃঙ্খলভাবে টেনে টেনে হাসল খানিকক্ষণ। বললে, আচ্ছা, বন্দুকটা দিন।

লোকনাথ বন্দুক বার করে আনলে। বললে, খুব সাবধান। আমার প্রাণ তোমার হাতে দিয়ে দিচ্ছি রঘুরাম। কাজ শেষ হলেই ফেরত চাই, নইলে মহা গন্ডগোলে পড়ে যাব।

হ্যাঁ হ্যাঁ, কাজ শেষ হলেই ফেরত দেব বই কী। তাজা কার্তুজগুলো আর খোলা বন্দুকটাকে একটি থলির ভেতরে পুরতে পুরতে রঘুরাম বললে, কিচ্ছু ভাববেন না।

তারপর উঠেই দ্রুতগতিতে সন্ধ্যার অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। লোকনাথ খোলা দরজা দিয়ে তাকিয়ে রইল নির্নিমেষ দৃষ্টিতে। গ্রামের আনন্দ-কলরোল কানের পর্দায় এসে শঙ্কর মাছের চাবুকের মতো এক-একটা করে প্রবল প্রচন্ড আঘাত বসিয়ে যাচ্ছে তাকে।

কিন্তু একটা জিনিস জানল না লোকনাথ। সেই রাত্রেই রঘুনাথ গেল ফজল আলির বাড়িতে, তারপর বৃন্দাবন পালের আড়তে, তারপর নুর মামুদের কাছারিতে। তারপর…

তার পরদিন বিকেলে জোর মিটিং বসেছে দিঘির পাড়ে। দলে দলে লোক জড়ো হয়েছে, চেঁচামেচি করছে, উচ্চারণ করছে তাদের কঠিন অপরাজেয় শপথ। উত্তেজনায় মুষ্টিবদ্ধ হাতটাকে বারে বারে আকাশের দিকে ছুড়ে দিচ্ছে রহমান, ভাই সব, জান কবুল, আমরা ধান দেব না। আমরা না খেয়ে কুত্তার মতো মরব আর মহাজনের গোলা ভরে উঠবে আমাদের খুন-মাখানো ধানে, এ আমরা হতে দেব না—কিছুতেই না।

গগনভেদী সমর্থনের রোলে হারিয়ে যাচ্ছে রহমানের কণ্ঠ। এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে, সূর্যের উজ্জ্বল আলোর মতোই স্পষ্ট হয়ে গেছে যে আজ আর রহমানের নিজের কথা কিছু বলবার নেই। তার কথা আর সমস্ত মানুষের কথার বন্যায় একাকার হয়ে গেছে, সমস্ত মানুষের প্রতিশোধ আর প্রতিরোধের উদ্ধত মুষ্টির সঙ্গে মিশে গেছে রহমানের উদ্যত মুষ্টিও। ব্যক্তিমানুষের সীমানা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে সমষ্টিময় মানুষের বিপুল বিস্তারে। আজ শুধু রহমান বক্তা নয়, সমস্ত মানুষের বক্তব্য একসুরে মুখর হয়ে উঠেছে, জান দেব, ধান দেব না।

নতুন জীবনবোধ, নতুন শপথ।

পায়ের তলায় মাটি কাঁপছে, মাথার ওপরে কাঁপছে আকাশ। আকাশে বাতাসে ঝড় ভূমিকম্পের সংকেত, বজ্র-বিদ্যুতের আগ্নেয় সূচনা। অসম্ভব, এ সহ্য করা যায় না। বিকেলের ছায়া নিবিড় হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে, অন্ধকার আসছে। আর সেই অন্ধকারের জন্যে প্রতীক্ষা করে আছে লোকনাথ সাহা, ফজল আলি, বৃন্দাবন পাল আর নুর মামুদ।

রঘুরামের হাতের তাক কখনো ভুল হয় না।

বিকেল কেটে গেল, সন্ধ্যা নামল। দিঘির পাড়ে এখনও মিটিং চলছে। মশালের আলো জ্বলছে। রহমান, কান্তলাল, যদু প্রামাণিক, মইনুদ্দিন বলে যাচ্ছে একের-পর-একজন। একই কথা, পুরোনো কথা—জান দেব, ধান দেব না।

কিন্তু কোথায় রঘুরাম? রঘুনাথের মতোই অব্যর্থসন্ধানী রঘুরাম। তার হাতের তাক কখনো ব্যর্থ হবে না। বাঁশের ঝাড়ের আড়ালে গা-ঢাকা দিয়ে মাত্র একটা গুলি ছুড়বে সে—বুকে হাত চেপে পড়ে যাবে রহমান। একটি ঘায়েই বিষদাঁত উপড়ে যাবে কালকেউটের। কিন্তু সে কখন? কোন শুভলগ্নে?

লোকনাথ সাহা, ফজল আলি, বৃন্দাবন পাল আর নুর মামুদ অধৈর্য হয়ে উঠছে। আর কত দেরি করবে রঘুরাম? সময় চলে যাচ্ছে, চলে যাচ্ছে অতি মূল্যবান অতি দুর্লভ সুযোগ। সভা ভেঙে গেলেই রহমানকে আর সহজে পাওয়া যাবে না। কোথা থেকে কোথায় যে ঘুরে বেড়ায় লোকটা তার কোনো ঠিকঠিকানাই নেই। আজ হয়তো এখানেই আছে, দেখতে দেখতে কাল সকালে একেবারে হাওয়া হয়ে যাবে, চলে যাবে দূরে—অন্যান্য গ্রামে গিয়ে বিদ্রোহের আগুন জ্বালাতে চেষ্টা করবে। লোকটা এ গাঁয়েরও নয়, কোথা থেকে যে শনির মতো আমদানি হয়েছে ভগবানই জানেন। চাল নেই, চুলো নেই, গাঁয়ে গাঁয়ে চাষা প্রজা খ্যাপানো ছাড়া আর কোনো কাজই নেই তার।

কিন্তু এত দেরি করছে কেন রঘুরাম, কেন এমনভাবে নষ্ট করে দিচ্ছে এই দুর্মূল্য মহার্ঘ সময়? একটা বন্দুকের শব্দ শোনা দরকার, শোনা দরকার সমস্ত কোলাহল ছাপিয়ে এই আন্দোলনটার মৃত্যুযন্ত্রণার মতো একটা ভয়াবহ আর্তনাদ। একটা অস্বস্তিকর অধৈর্য পাথরের মতো গুরুভার হয়ে চেপে বসছে লোকনাথ সাহা, নুর মামুদ, ফজল আলি আর বৃন্দাবন পালের বুকের ওপর। মাথার চুল ছিড়তে ইচ্ছে করছে, ইচ্ছে করছে নিজেদের হাতগুলো কামড়ে রক্তাক্ত করে দিতে। কেন দেরি করছে? কেন এমন অশুভভাবে বিলম্ব করছে রঘুরাম?

অবশেষে পরমাশ্চর্য যা, তাই ঘটল। মিটিং শেষ হয়ে গেল নিরাপদে, একান্ত নির্বিবাদে। কালকেউটের বিষদাঁত ভাঙল না, বরং আরও বেশি বিষ সঞ্চয় করে নিলে সে। আরও বেশি করে প্রত্যক্ষ হয়ে উঠল আকাশে বাতাসে ঝড়-বৃষ্টি-ভূমিকম্পের সংকেতময়তা।

কী হল রঘুরামের?

ছুটতে ছুটতে এল ফজল আলি, নুর মামুদ, বৃন্দাবন পাল।

কী হল রঘুরামের?

তাই তো, ব্যাটা করল কী শেষপর্যন্ত?

সভয়ে লোকনাথ বললে, কাল সন্ধে বেলায় ব্যাটা আমার বন্দুকটা নিয়ে গেল।

অ্যাঁ! তিন জনেই চমকে উঠল।

ফজল আলি বললে, সে কী! তোমার বন্দুক নিয়েছে? আমার কাছ থেকেও তো বন্দুক চেয়ে নিয়ে গেল, বললে তোমার বন্দুকটা নাকি খারাপ হয়ে গেছে তাই…

নুর মামুদ আর বৃন্দাবন পাল আর্তনাদ করে উঠল, কী সর্বনাশ! ওই একই কথা বলে ব্যাটা তো আমাদেরও বন্দুক চেয়ে নিয়ে এসেছে।

ঘরের ভেতরে যেন বাজ পড়ল। কারও মুখ দিয়ে আর একটাও কথা ফুটছে না। একটা নয়, দুটো নয়, চার-চারটে বন্দুক সংগ্রহ করেছে রঘুরাম। কিন্তু কেন? একটা এক গুলির শিকারের জন্যে সে চারটে বন্দুক নিয়ে কী করবে?

হন্যে হয়ে খুঁজতে খুঁজতে শেষপর্যন্ত রঘুরামকে পাওয়া গেল চাঁড়াল পাড়াতে। গাঁজা আর তাড়ির নেশায় তার তখন তুরীয় অবস্থা। একদল চাঁড়াল মেয়ে-পুরুষের একটা উন্মত্ত অশোভন বৈঠকে বসে সে প্রাণখুলে অশ্লীল গান ধরেছে।

ফজল আলি চিৎকার করে উঠল, এই হারামির বাচ্ছা, আমাদের বন্দুক কই?

নেশারক্ত চোখ দুটো মেলে তাকাল রঘুরাম। তারপর এলোমেলো বিশৃঙ্খল দাঁতগুলো বার করে পরম কৌতুকে হো-হো করে হাসতে শুরু করে দিলে।

হাসছিস যে শালা? বন্দুক কোথায়?

একমুহূর্তের জন্যে হাসি বন্ধ করে রঘুরাম বললে, রহমানকে দিয়েছি।

রহমানকে!!!

আকাশ বিদীর্ণ করে বাজ পড়ল না আকাশটাই যেন ধসে পড়ল মাটিতে। একমুহূর্তে থ্যাঁতলা হয়ে, চ্যাপটা হয়ে, গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে মিশে গেল লোকনাথ সাহা, ফজল আলি, বৃন্দাবন পাল, আর নুর মামুদ।

রহমানকে!!!

তা ছাড়া আবার কী? এবার রঘুরাম আর হাসল না। পাকা ব্যবসায়ীর মতো গম্ভীর বুদ্ধিমানের গলায় জবাব দিলে, ওরা বেশি ধান পেলে আমার তাড়িও বেশি বিক্রি হবে, এটা কেন বুঝতে পারছ না?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *