পঞ্চনদীর তীরে বেণী পাকাইয়া শিরে দেখিতে দেখিতে গুরুর মন্ত্রে জাগিয়া উঠেছে শিখ নির্মম নির্ভীক । হাজার কণ্ঠে গুরুজির জয় ধ্বনিয়া তুলেছে দিক্ । নূতন জাগিয়া শিখ নূতন উষার সূর্যের পানে চাহিল নির্নিমিখ । ‘ অলখ নিরঞ্জন ' মহারব উঠে বন্ধন টুটে করে ভয়ভঞ্জন । বক্ষের পাশে ঘন উল্লাসে অসি বাজে ঝন্ঝন্ । পঞ্জাব আজি গরজি উঠিল , ‘ অলখ নিরঞ্জন ! ' এসেছে সে এক দিন লক্ষ পরানে শঙ্কা না জানে না রাখে কাহারো ঋণ । জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য , চিত্ত ভাবনাহীন । পঞ্চনদীর ঘিরি দশ তীর এসেছে সে এক দিন । দিল্লিপ্রাসাদকূটে হোথা বারবার বাদশাজাদার তন্দ্রা যেতেছে ছুটে । কাদের কণ্ঠে গগন মন্থ , নিবিড় নিশীথ টুটে — কাদের মশালে আকাশের ভালে আগুন উঠেছে ফুটে ! পঞ্চনদীর তীরে ভক্তদেহের রক্তলহরী মুক্ত হইল কি রে ! লক্ষ বক্ষ চিরে ঝাঁকে ঝাঁকে প্রাণ পক্ষীসমান ছুটে যেন নিজনীড়ে । বীরগণ জননীরে রক্ততিলক ললাটে পরালো পঞ্চনদীর তীরে । মোগল - শিখর রণে মরণ - আলিঙ্গনে কণ্ঠ পাকড়ি ধরিল আঁকড়ি দুইজনা দুইজনে । দংশনক্ষত শ্যেনবিহঙ্গ যুঝে ভুজঙ্গ - সনে । সেদিন কঠিন রণে ‘ জয় গুরুজির' হাঁকে শিখ বীর সুগভীর নি : স্বনে । মত্ত মোগল রক্তপাগল ‘ দীন্ দীন্' গরজনে । গুরুদাসপুর গড়ে বন্দা যখন বন্দী হইল তুরানি সেনার করে , সিংহের মতো শৃঙ্খল গত বাঁধি লয়ে গেল ধরে দিল্লিনগর - ' পরে । বন্দা সমরে বন্দী হইল গুরুদাসপুর গড়ে । সম্মুখে চলে মোগল - সৈন্য উড়ায়ে পথের ধূলি , ছিন্ন শিখের মুণ্ড লইয়া বর্শাফলকে তুলি । শিখ সাত শত চলে পশ্চাতে , বাজে শৃঙ্খলগুলি । রাজপথ - ' পরে লোক নাহি ধরে , বাতায়ন যায় খুলি । শিখ গরজয় , ‘ গুরুজির জয় ' পরানের ভয় ভুলি । মোগলে ও শিখে উড়ালো আজিকে দিল্লিপথের ধূলি । পড়ি গেল কাড়াকাড়ি , আগে কেবা প্রাণ করিবেক দান তারি লাগি তাড়াতাড়ি । দিন গেলে প্রাতে ঘাতকের হাতে বন্দীরা সারি সারি ‘ জয় গুরুজির' কহি শত বীর শত শির দেয় ডারি । সপ্তাহকালে সাত শত প্রাণ নিঃশেষ হয়ে গেলে বন্দার কোলে কাজি দিল তুলি বন্দার এক ছেলে । কহিল , ‘ ইহারে বধিতে হইবে নিজহাতে অবহেলে ।' দিল তার কোলে ফেলে কিশোর কুমার , বাঁধা বাহু তার , বন্দার এক ছেলে । কিছু না কহিল বাণী , বন্দা সুধীরে ছোটো ছেলেটিরে লইল বক্ষে টানি । ক্ষণকালতরে মাথার উপরে রাখে দক্ষিণ পাণি , শুধু একবার চুম্বিল তার রাঙা উষ্ণীষখানি । তার পরে ধীরে কটিবাস হতে ছুরিকা খসায়ে আনি বালকের মুখ চাহি ‘ গুরুজির জয়' কানে কানে কয় , ‘ রে পুত্র , ভয় নাহি ।' নবীন বদনে অভয় কিরণ জ্বলি উঠি উৎসাহি - কিশোর কণ্ঠে কাঁপে সভাতল বালক উঠিল গাহি ‘ গুরুজির জয় ! কিছু নাহি ভয় ' বন্দার মুখ চাহি । বন্দা তখন বামবাহুপাশ জড়াইল তার গলে , দক্ষিণ করে ছেলের বক্ষে ছুরি বসাইল বলে - ‘ গুরুজির জয়' কহিয়া বালক লুটালো ধরণীতলে । সভা হল নিস্তব্ধ বন্দার দেহ ছিঁড়িল ঘাতক সাঁড়াশি করিয়া দগ্ধ । স্থির হয়ে বীর মরিল , না করি ' একটি কাতর শব্দ । দর্শনজন মুদিল নয়ন , সভা হল নিস্তব্ধ ।