বন্দী বনহুর
অস্ফুট কণ্ঠে বললো মনিরা–কি বললে?
বনহুর পূর্বের ন্যায় গম্ভীর গলায় বলে উঠলো–আমাকে চাও, না নূরকে?
স্বামীর কথায় মনিরার মুখমন্ডল বিবর্ণ হয়ে উঠলো, ঢোক গিলে বললো মনিরা–এ তুমি কি বলছো! ওগো, এ তুমি কি বলছো?
দৃঢ় কণ্ঠে বললো বনহুর–যদি নূরকে চাও তবে আমাকে পাবেনা, আর যদি আমাকে চাও তবে’নূরকে…
মনিরা দ্রুত বনহুরের মুখে হাত চাপা দিয়ে অশ্রুভরা কণ্ঠে বললো–না না, ওকথা আর বলোনা। আমার বুক ফেটে চৌচির হয়ে যাবে। আমি সহ্য করতে পারবো না।
পাশের কক্ষ থেকে এতোক্ষণ মরিয়ম বেগম সব শুনছিলেন। তিনি আচমকা প্রবেশ করলেন কক্ষমধ্যে।
সঙ্গে সঙ্গে বনহুর ফিরে তাকালো, একটু হচকিয়ে গেলো সে। পরক্ষণেই নিজকে সামলে নিয়ে বললো বনহুর–মা!
স্থির গম্ভীর হয়ে দাঁড়ালেন মরিয়ম বেগম। পাশের কক্ষ থেকে পুত্রের এবং মনিরার কথাগুলো কান পেতে তিনি শুনেছিলেন, বনহুরের কথায় রাগে শরীর তার কাঁপছিলো, এত বড় কথা সে বলতে পারলো মনিরার মুখের উপর–আমাকে চাও না নূরকে? কথাটা তার হৃদয়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। রাগ-ক্ষোভ-ব্যথা গুমড়ে ফিরছিলো মরিয়ম বেগমের মনের মধ্যে। মুখোভাব কঠিন করে বললেন তিনি–কে তোর মা! আমি তোর মা নই…না না, আমি তোর মা নই-ওরে পাষন্ড সন্তান! তুই মা বলে আমাকে আর কোন দিন ডাকিসনে।
মায়ের কথায় বনহুর যেন হতভম্ব হয়ে পড়লো। দস্যু হলেও মায়ের কাছে সে অবোধ বালকের মত। ম্লান মুখে বললো–মা, জানি তোমরা সবাই আমাকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছো।
আমরা নই–তুই, ওরে তুই সবাইকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছিস। নিষ্ঠুর সন্তান! আজ যে কথাগুলি মনিরাকে বললি, কোনো স্বামী পারবে তার স্ত্রীকে বলতে?
বনহুর এবার বুঝতে পারলো, তার মা পাশের কক্ষ থেকে তার এবং মনিরার সব কথাই শুনেছেন, সেই কারণেই তিনি এতো রাগান্বিত হয়েছেন। বনহুর মায়ের কথায় কোন জবাব না দিয়ে মাথা নত করলো।
মরিয়ম বেগম আরও কয়েক পা এগিয়ে এলেন পুত্রের দিকে–কোন নারী পারে তার স্বামী কিংবা পুত্রকে ত্যাগ করতে? তোর কি হৃদয় বলে কোন জিনিষ নেই?
বনহুর তার মায়ের সম্মুখে অসহায়ের মত দুর্বল হয়ে পড়লো। করুণ কণ্ঠে বললো–মা, আমি অপরাধী…তুমি আমাকে ক্ষমা করো।
বল আর কোনদিন মনিরার সম্মুখে ঐ কথা বলবি না!
কোন্ কথা মা? বনহুর না বুঝার ভান করে।
মরিয়ম বেগম পুনরায় তীব্রকণ্ঠে বলে উঠলেন–যে কথা একটু পূর্বে তুই ওকে বলছিলি।
ও! কিন্তু তুমিই বলো মা, আমি এখানে আসি ক্ষণিকের জন্য আনন্দ উপভোগ করতে। অল্পক্ষণের জন্য ভুলতে চাই আমি আমার জীবনের সমস্ত সত্তাকে। তোমাদের মধ্যে আমি নিজকে ডুবিয়ে রাখতে চাই…কিন্তু আমি যদি এখানে এসেও এতোটুকু স্বস্তি না পাই, তাহলে…কি হবে। বলো এসে?
মনির!
হাঁ, যখনই আমি আসবো, তোমার মনিরা শুধু তার সন্তানের কথা নিয়েই আত্মহারা থাকবে–এ আমি চাইনা।
বনহুরের কথায় মনিরা প্রস্তর মূর্তির মত দাঁড়িয়ে রইলো। মরিয়ম বেগমের মুখ দিয়েও কোন কথা বের হলোনা, তিনিও নিশ্চুপ শুনতে লাগলেন।
বনহুর আবার বলতে শুরু করলো-নূর হারিয়ে গেছে, বিলাপ করে কি হবে বলো? যদি সে বেঁচে থাকে–একদিন ফিরে আসবে।
তাই বলে তার সন্ধান করবোনা আমরা? তুমি পিতা হয়ে এ কথা বলতে পারলে? বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বললো মনিরা।
বেশ, তাহলে তোমরা নূরের সন্ধানেই থাকো, আমি যাই। বনহুর চলে যাবার জন্য পা বাড়ালো।
মরিয়ম বেগম বলে উঠলো–যাবি বলেই যাওয়া হলো, মনিরা তোর কেউ নয়?
থমকে দাঁড়ালো বনহুর, ফিরে তাকিয়ে বললো–আমি তো ওকে অস্বীকার করিনি। ওকে খুশি করবার জন্যই চলে যাচ্ছি।
তুই চলে গেলে ও খুশি হবে?
হাঁ, আমি নূরকে খুঁজতেই যাচ্ছি। যদি ওকে পাই, ফিরে আসবো, নচেৎ নয়।
মনিরার চোখ-মুখ কেমন যেন ভাবাপন্ন হয়ে উঠলো। গভীর একটা চিন্তার ছাপ ফুটে উঠলো তার ললাটে। নূরকে কোন অজ্ঞাত চোর চুরি করে নিয়ে গেছে কে জানে, কোথায় পাবে তার। সন্ধান সে। যদি নূরকে না পায় তাহলে আর কোনদিন ফিরে আসবেনা তার স্বামী। না না, সব সে ত্যাগ করতে পারবে, নূরের স্মৃতিও ভুলতে পারবে–ভুলতে পারবেনা তবু সে স্বামীকে।
মরিয়ম বেগম রাগে ক্ষোভে অধর দংশন করছিলেন। এ কি কথা বলছে তার মনির। নূরকে খুঁজে না পেলে আর সে ফিরে আসবে না। এতো বড় পাষন্ড সে! মরিয়ম বেগম বলে উঠলেন– কি বললি, নূরকে না পেলে আর আসবিনা!
না। এসে শুধু অশ্রু আর কান্না দেখবো?
তুই বাপ না কশাই…
মা…
অবাধ্য সন্তান কোথাকার!
অবাধ্য আমি নই মা। তোমার কথা রাখতে গিয়েই আজ আমি মায়ার জালে জড়িয়ে পড়েছি। বিয়ে করেছি মনিরাকে!
শুধু তাই নয়, তুই আজ সন্তানের পিতা। পিতা হয়ে তোর সন্তানের প্রতি এতটুকু দরদ নেই?
দরদ…হাঃ হাঃ হাঃ…অদ্ভুতভাবে হেসে উঠলো বনহুর, হাঃ হাঃ হাঃ..হাঃ হাঃ হাঃ…
মরিয়ম বেগম আর মনিরা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো বনহুরের মুখের দিকে। মরিয়ম বেগম পুত্রকে কোনদিন এভাবে হাসতে দেখেন নাই–তিনি হতভম্ব হয়ে চেয়ে আছেন।
বনহুর হাসি থামিয়ে বললো-বন্ধনহীন উল্কা আমি। আমাকে তোমরা মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ করে রাখতে পারবে না। দস্যু বনহুর কোনদিন দরদ বলে কোন জিনিষ জানে না।
মরিয়ম বেগম দু’চোখ ছানাবড়া করে বললেন–মনির, তুই এতো বড় পাষন্ড! নির্দয়…হৃদয়হীন…
তার চেয়েও বেশি।
আমি মা হয়ে তোকে পুলিশে দেবো, তোকে গ্রেফতার করিয়ে দেবো।
তোমার সন্তান হাসিমুখে মায়ের দান গ্রহণ করতে প্রস্তুত আছে।
ওরে আমি তাই পারবো–তোকে পুলিশের হাতে সঁপে দিয়ে আমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারবো..বনহুরকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরেন মরিয়ম বেগম–আমাকে ছেড়ে আর তুই যাসনে বাপ…
বনহুরের চোখ দুটো অশ্রু ছল ছল হয়ে উঠলো। সেও মাকে বুকে আঁকড়ে ধরে বললো মা, তোমাকে একদিন বলেছি, তোমার সন্তান যেখানেই থাক তোমার থাকবে। যখন তুমি ডাকবে তখনই তুমি পাবে…
কিন্তু কই তোকে পাই বলতো? কত দিন তোকে না দেখে কেঁদে কেঁদে আমার চোখের দৃষ্টি নষ্ট হয়ে গেছে, তবু তোকে পাইনি।
বনহুর এবার ম্লান হাসি হাসলো, বললো–এই তো এসেছি মা।
আবার চলে যাবি; আসবি তো?
তোমার সন্তান, তোমার পাশে না এসে কি থাকতে পারবে?
দেখা যাবে।
নিশ্চয়ই আসবো মা।
মরিয়ম বেগম বেরিয়ে যান কক্ষ থেকে, যাবার সময় বলেন, কিছু খাবার আনছি, পালানে যেন।
মরিয়ম বেগম বেরিয়ে যেতেই বনহুর ফিরে তাকালো মনিরার মুখে, কয়েক পা এগুতে এগুতে বললো–নূরের কথাই ভাববে, না আমাকে কিছু বলবে?
মনিরা চোখ তুলে তাকালো স্বামীর মুখের দিকে। ঠোঁট দুটো কেঁপে উঠলো, কিন্তু কিছুই বলতে পারলো না সে।
বনহুর আরও সরে এলো, মনিরার কাঁধে হাত রেখে বললো–আমি বলছি–তোমার নূর যেখানেই থাক, ভাল থাকবে–একদিন সে ফিরে আসবে।
সত্যি বলছো?
হাঁ, সত্যি মনিরা।
কিন্তু…
আর কিন্তু নয়। মনিরা, তুমি না বলেছিলে ছবি দেখতে যাবে?
যাবো না।
কেনো?
দেখেছি।
ও!
একটা কথা তুমি আমায় সত্যি করে বলবে?
বলো?
তুমি দস্যুবৃত্তি ছেড়ে অভিনয় শুরু করেছো?
বিস্ময় ভরা চোখে তাকায় বনহুর মনিরার মুখের দিকে–অভিনয়। কে বললো আমি অভিনয় শুরু করেছি?
–আমি নিজের চোখে দেখেছি, তুমি অস্বীকার করতে পারো না। বললো মনিরা।
মনিরার কথায় বনহুর বুঝতে পারলো, কুন্তি বাঈ’ ছবিটাই সে দেখেছে এবং সেই কারণেই মনিরা ভিতরে ভিতরে রাগান্বিত হয়ে পড়ছিলো। মনিরার সঙ্গে বনহুর যত কঠিন ব্যবহার করুক না কেনো, আসলে মনিরাই বনহুরের বাস্তবের রাণী। মনিরার মুখে হাসি ফুটলে এতটুকু শান্তি পায়না বনহুর মনে।
মনিরা বনহুরকে নীরব থাকতে দেখে বললো আবার–আমার কাছে লুকাতে চেষ্ট করোনা, আর কেউ তোমাকে না চিনলেও আমার চোখে ধুলো দিতে পারবে না। বলো–ছবির নায়িকা কে? ওর সঙ্গে তোমার সম্বন্ধ কি? বলো–জবাব দাও?
আজ বনহুরের কাছে সব স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠলো। মনিরার যত রাগ অভিমান সব ঐ কারণেই, এবার বুঝতে পারলো সে। হেসে বললো–তাই বুঝি সেদিন তুমি আমায় বিমুখ করে ফিরিয়ে দিয়েছিলে?
মাথা নত করলো মনিরা।
বনহুর বুঝতে পারলো, তার অনুমান মিথ্যা নয়। মনিরাকে টেনে নিলো কাছে, দক্ষিণ হাত দিয়ে মুখটা তুলে ধরে বললো–তুমি অহেতুক অভিমান করছো মনিরা। অভিনয়, অভিনয়ই…
তাহলে ‘কুন্তি বাঈ’ ছবির হিরো তুমি?
যদিও মনিরাও নিঃসন্দেহে জানে–কুন্তি বাঈ ছবির হিরো তার স্বামী, তবু আবার স্বামীর মুখে শুনতে চায় সে।
মনিরার কথায় বললো বনহুর–তুমি যা দেখেছো সত্যি। কুন্তি বাঈ’ ছবির হিরো স্বয়ং দস্যু বনহুর।
বললো মনিরা–আর হিরোইন?
মিস্ জ্যোছনা রায়। ওর সঙ্গে আমার সম্বন্ধ শুধু সুটিংকালে, তারপর নয়…কিন্তু মিস্ জ্যোছনা রায় আজ বেঁচে নেই–সে মৃত।
আশ্চর্য দৃষ্টি মেলে তাকালো মনিরা বনহুরের চোখের দিকে। বললো সে–মিস জ্যোছনা রায় বেঁচে নেই?
না। বনহুর ক্ষণিকের জন্য আনমনা হয়ে গেলো। উদাস কণ্ঠে বললো–জ্যোছনা রায়ের মৃত্যুর কারণ আমিই মনিরা।
তুমি? হ্যাঁ আমি। বেচারী সুটিং-এর ফাঁকে কখন যে আমাকে ভালবেসে ফেলেছিলো, সে-ই জানে। তুমিই তাকে হত্যা করেছিলে?
না, আমি নই…আচ্ছা বলবো আর একদিন, সে এক মস্ত কাহিনী। একটা দীর্ঘশ্বাস গোপনে চেপে যায় বনহুর। মিস জ্যোছনা রায়ের স্মৃতি যে আজও বনহুরের মনে এতোটুকু আলোড়ন জাগায় না, তা নয়। বেচারী জ্যোছনা রায়…
মরিয়ম বেগম ইচ্ছা করেই বিলম্ব করছিলেন, ঘরে তার দুধ ছানা-ফিরনী তৈরীই ছিলো তবু তিনি এগুলো আনতে বেশ বিলম্ব করলেন।
মরিয়ম বেগম একটু কেশে কক্ষে প্রবেশ করলেন–মা মনিরা, ওকে একটু খেতে দাও।
বনহুরের পাশ থেকে সরে দাঁড়ালো মনিরা, তারপর মামীমার হাত থেকে খাবারের ট্রে নিয়ে। বনহুরের সম্মুখে টেবিলে রাখলো।
মরিয়ম বেগম বললেন–মিটকেসটা বন্ধ না করেই চলে এসেছি। যা বিড়ালের উপদ্রব…
মরিয়ম বেগম বেরিয়ে গেলেন।
বনহুর বুঝতে না পারলেও, মনিরা বুঝতে পারলো–মিটকেস বন্ধ করা–এটা একটা ছলনা মাত্র; কেমন করে মরিয়ম বেগম পালাবেন, তাই এতো কথা। মনিরা মামীমার অভিনয় দেখে হাসলো।
বনহুর বললো–হঠাৎ অমন করে হাসলে কেননা মনিরা?
মামীমার অভিনয় দেখে।
বিস্ময় ভরা চোখে তাকিয়ে বললো বনহুর–অভিনয়?
হাঁ দেখলে না, মামীমা আমাদের সুযোগ দিয়ে মিছামিছি বললেন–মিটকেস খুলে রেখে এসেছি, বিড়ালের যা উপদ্ৰব…
মনিরা হেসে উঠলো, বনহুরও তার হাসিতে যোগ দিলো।
বললো মনিরা–নাও, এবার খাও দেখি।
এতো রাতে খাবার খাওয়া ঠিক হবে?
মায়ের হাতের তৈরি জিনিসে কোন দোষ নেই।
না, তা বলছি না, বলছি পেট ভর্তি রয়েছে।
তা জানি, তোমার পেট ভর্তি রয়েছে।
তা জানি, তোমার পেট কত যে ভর্তি থাকে সে কথা আমাকে বলতে হবে না। নাও, খাও তো।
তবে দাও, কিন্তু আমাকে উঠিয়ে খাইয়ে দিতে হবে…
হা করে বনহুর।
মনিরা স্বামীর মুখে খাবার তুলে দেয়।
*
দোলনায় নয়–ঝুলনায় বসিয়ে দোল দিচ্ছিলো মনিকে নূরী। আর সুন্দর একটা গান গাইছিলো সে–
আমার মনি দোলে, দোলকুমারীর কোলে…
আমার মনি দোলে…
মনির মুখেও হাসি ফুটে উঠেছে, ছোট্ট কচি শিশু মায়ের জন্য প্রথম প্রথম কাদাকাটা করলেও এখন আর তেমন করে না। মাঝে মাঝে বলে–মাল কাছে দাবো, আমি মাল কাছে দাবো…
কিন্তু নূরীর আদরের বন্যায় ভেসে যায় সব। মনিকে কখনও কোলে, কখনও পিঠে, কখনও কাঁধে নূরী ঘুরে বেড়ায় বন হতে বনান্তরে। পাহাড়িয়া ঝরণার মত চঞ্চল নূরী মনিকে পেয়ে আরও উন্মত্ত হয়ে উঠে। তার বহু দিনের হারানো ধন যেন ফিরে পেয়েছে।
মনির সুন্দর নধর দেহ, মাথায় কোঁকড়ানো চুল। সুন্দর দুটি চোখ, ফুলের হাসি ঠোঁটের কোণে, অপূর্ব সুন্দর চেহারা। ওকে দেখলেই কোলে নিতে ইচ্ছে করে, আদর দেবার জন্য মন লালায়িত হয়। মনি সুন্দর হবে না কেনো, পিতা স্বয়ং দস্যু বনহুর, মা অপূর্ব সুন্দরী মনিরা কাজেই তাদের সন্তান সুন্দর হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
শুধু নূরীই নয়, বনহুরের আস্তানার সবাই মনিকে ভালবাসে, স্নেহ করে। কিন্তু সবচেয়ে বেশি আদর করে রহমান, ‘ছোট সর্দার’ বলে ডাকে ওকে।
মাঝে মাঝে মনিকে কোলে করে ঘুরে বেড়ায় রহমান। ঘোড়ার পিঠে তুলে দিয়ে আনন্দ দেয় ওকে।
মনিকে নিয়ে আস্তনার সবাই খুশিতে আত্মহারা।
কিন্তু সবাই জানে–শিশুটিকে তাদের সর্দার একদিন কোন গহন বন থেকে কুড়িয়ে এনে নূরীকে দিয়েছিলো, সেই থেকে নূরী তাকে নিজ সন্তানের মত লালন করছিলো, তারপর একদিন সেই শিশু মনি কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলো। নূরী সদা-সর্বদা কাদা-কাটা করতো মনির জন্য। কিন্তু হঠাৎ তাদের সর্দার আবার একদিন সেই মনিকে কোথা থেকে এনে দিলো নূরীর কোলে।
কেউ না জানলেও জানে রহমান-মনি কে? কি তার আসল পরিচয়।
সময় সময় বনহুর মনিকে নিয়ে আদর করতো। নরম তুলতুলে গালে মৃদু চাপ দিয়ে বলতো…বাপি…
কোন কোন দিন তুলে নিতো কোলে, সকলের অলক্ষ্যে ছোট্ট একটি চুমু এঁকে দিতো ওর গালে।
এমনি একদিন মনি খেলা করছিলো একটা গাছের তলায় একটা ছোট্ট হরিণ শিশু নিয়ে। বার বার তার গলায় জড়িয়ে ধরে মাটিতে ফেলে দিচ্ছিলো।
বনহুর দূর থেকে দেখতে পেলো, এগিয়ে এলো মনির পাশে।
মনি তখনও বনহুরকে দেখতে পায়নি, সে আপন মনে খেলা করছিলো।
বনহুর তস্ময় হয়ে দেখছিলো মনি আর হরিণ শিশুর অদ্ভুত খেলা।
হরিণ শিশুর পিঠে চেপে বসতে গিয়ে হঠাৎ ভূতলে পড়ে গেলো মনি।
সঙ্গে সঙ্গে বনহুর তুলে নিলো মনিকে হাতের উপর।
মনি কেঁদে উঠেই বনহুরকে দেখে চুপ হয়ে গেলো।
বনহুর আদর দিয়ে বললো–একটুও লাগেনি, তাই না বাপি…চুমু দিলো মনির ছোট্ট মুখে।
মনি খুব খুশি না হলেও বনহুরের কোলে গিয়ে চুপ হয়ে গিয়েছিলো।
বনহুর যখন মনিকে আদর দিচ্ছিলো তখন নূরী পা টিপে টিপে এসে দাঁড়ালো একটা গাছের আড়ালে। উঁকি দিয়ে দেখতে লাগলো সে। বনহুর কোন দিন স্ব-ইচ্ছায় মনিকে আদর করেনি নূরীর সম্মুখে। কতদিন এ নিয়ে বনহুরের সঙ্গে রাগারাগি করেছে, আর আজ বনহুরকে মনির সঙ্গে দেখে শুধু খুশিই হলোনা, আনন্দে আত্মহারা হলো।
বনহুর মনির ললাটে চুমু দিয়ে বললো–আমি তোমার কে বলো মনি?
মনি হঠাৎ দেখে ফেলে নূরীকে। বনহুরের কোলে গিয়ে একটু বিব্রত বোধ করছিলো, নূরীকে দেখে মুখখানা হাসিতে ভরে উঠলো।
বনহুর তখন পুনরায় বললো–আমি তোমার কে বললা–বলো….বলো আমি তোমার বাপি!
বনহুর মনিকে চেপে ধরলো বুকে।
নূরী আড়াল থেকে সব দেখলো, খুশিতে ভরে উঠলো ওর মন। চঞ্চল পদক্ষেপে এগিয়ে এলো বনহুর আর মনির পাশে। খিল খিল করে হেসে লুটোপুটি খেতে লাগলো।
বনহুর হঠাৎ নূরীর আগমনে একটু হতভম্ব হয়ে পড়েছিলো। মনিকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে বললো–যাও মনি।
নূরী বললো–তুমি যদি বাপি হও, আমি কে?
বনহুর মনির মুখের কাছে মুখ নিয়ে বললো–বলোতো মনি, ও তোমার কে?
মনি এক গাল হেসে বলে উঠলো–মাম্মি…
বনহুর হঠাৎ গম্ভীর হয়ে পড়লো।
নূরী মনিকে বুকে তুলে নিয়ে হাসিতে ফেটে পড়লো–দেখো মনি ঠিক বলেছে।
বনহুর আর নূরী যখন মনিকে নিয়ে আনন্দে আত্মহারা–এ কথা সে কথা নিয়ে খুশির ফুলঝুরি ঝরে পড়েছিলো তাদের মনে, ঠিক সেই সময় রহমান আর মহসীন এসে কুর্নিশ জানালো।
বনহুর ফিরে তাকালো রহমানের মুখে–কি খবর রহমান?
রহমান বললো–সর্দার, একবার দরবার কক্ষে আসুন, কথা আছে।
চলো। বনহুর দরবার কক্ষের দিকে এগুলো।
রহমান আর মহসীন অনুসরণ করলো তাকে।
ভূগর্ভে পাথর খোদাই করা একটা বৃহৎ কক্ষ। গভীর অন্ধকারে কক্ষটা সদা অন্ধকার। কিন্তু মশালের আলোতে আলোকিত করা হয়েছে কক্ষটাকে। কক্ষের দেয়ালে অসংখ্য অস্ত্র-সস্ত্র ঝোলানো রয়েছে।
কক্ষের দরজায় দু’জন পাহারাদার দন্ডায়মান। তাদের শরীরে জমকালো পোশাক, মাথায়। জমকালো পাগড়ি। ভয়ঙ্কর চেহারা, হাতে রাইফেল।
বনহুর কক্ষে প্রবেশ করতেই অন্যান্য দস্যুগণ কুর্ণিশ জানালো।
বনহুর এসে বসলো তার পাথরাসনে।
রহমান আর মহসীন দাঁড়ালো সম্মুখে।
বনহুর গম্ভীর কণ্ঠে বললো–কি খবর বলো?
রহমান ইংগিত করলো মহসীনকে বলতে।
মহসীন একটু কেশে গলাটা পরিস্কার করে নিলো। যত সাহসীই হোকনা কেনো সর্দারের সম্মুখে দাঁড়িয়ে কথা বলতে তাদের একটু কেমন যেন লাগতো।
বললো মহসীন–সর্দার, মতি মহল হলের মালিককে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে।
মতি মহল হলের মালিক আফগানী সাহেবকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে?
হাঁ, সর্দার।
তার অপরাধ?
অপরাধ ‘কুন্তিবাঈ’ ছবি তার হলে চালানোর দরুণ–
‘কুন্তিবাঈ’ ছবি।
হাঁ সর্দার। ‘কুন্তিবাঈ’ ছবির ফিলম সম্পূর্ণ আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলার আদেশ দেওয়া সত্বেও আফগানী সাহেব তার হলে ছবি চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কারণ এ ছবিতে দর্শকের এতো ভীড় জীবনে। তার হলে কোন ছবিতে হয়নি।
রহমান বললো এবার দর্শক মহলে ছবিটা যেমন সুখ্যাতি অর্জন করেছিলো, তেমনি পুলিশ মহলে সৃষ্টি করেছিলো আলোড়ন। শুধু আলোড়নই নয়–তাদের মনে জাগিয়েছিলো ভীষণ চাঞ্চল্য।
হুঁ, তারপর?
সর্দার, এ ছবির হিরো দস্যু বনহুর–এটাই ছিলো দর্শক মনে এক প্রচন্ড উন্মাদনা। মিঃ জাফরী এটা আবিস্কার করেছিলেন সর্বপ্রথম এবং তিনিই সমস্ত শহর অঞ্চলে ও বিভিন্ন নগরে দস্যু বনহুরের আগমন ঘোষণা করে তাকে গ্রেপ্তারের জন্য তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছিলেন। কিন্তু এতে মতিমহল হলে দর্শকের ভীড় বেড়ে গিয়েছিল চরম আকারে। দেশের জনগণ সবাই চায় অন্ততঃ দস্যু বনহুরকে একটিবার দেখতে। কাজেই মালিক আফগানী সাহেব ছবিটা চট করে বন্ধ করতে পারেননি–এটাই হলো তাঁর অপরাধ।
বনহুর বললো–ছবিটা কি বন্ধ হয়ে গেছে?
হাঁ সর্দার, কিন্তু আজও চলবে। কারণ আজ মিঃ জাফরী তার দলবল নিয়ে ছবি দেখবেন। এবং সমস্ত দর্শক মন্ডলির সম্মুখে ছবিটা বিনষ্ট করা হবে।
এতো খবর সংগ্রহ করলে কেমন করে তোমরা?
সর্দার, মহসীন কৌশলে এ সব সংবাদ সংগ্রহ করেছে।
বেশ, আজ আমিও যাবো মতি মহল হলে ছবি দেখতে।
মহসীন, তুমি অগ্রিম টিকিট ক্রয় করে রাখবে, এবং ঠিক্ মিঃ জাফরীর পাশেই যেন আমার সিট হয়।
জী সর্দার।
এবার বনহুর নিজ মনে বলে উঠলো–মিঃ জাফরীর সঙ্গে আমার মোকাবেলা হবে। শোন রহমান, তুমি আর কায়েস আমার কুইন গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করবে পুলিশ অফিসের অদূরে পথে। আজই আফগানী সাহেবকেও মুক্ত করে আনবো।
বনহুর আসন ত্যাগ করে উঠে দাঁড়ালো।
অন্যান্য অনুচরগণ কুর্ণিশ জানালো নত মস্তকে।
বনহুর দরবার কক্ষ ত্যাগ করলো।
*
পুলিশ অফিসের হাজত কক্ষে বন্দী আফগানী সাহেব। ভদ্রলোক অত্যন্ত অমায়িক এবং মহৎ লোক। দেশবাসীগণ তাঁর নিকটে যথেষ্ট উপকৃত। দস্যু বনহুরও অনেক সময় এর নিকটে অনেক ব্যাপারে সাহায্য পেয়েছে–অবশ্য দস্যু হিসাবে নয়, বন্ধু হিসাবে।
বনহুর যখন সর্বপ্রথম মনিরার সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলো তখন একদিন নাথুরামের সঙ্গে সংঘর্ষ ব্যাপারে কয়েকখানা গাড়ির প্রয়োজন হয়েছিলো; তখন আফগানী সাহেব বিনা দ্বিধায় কয়টি গাড়ি দিয়েছিলেন তাকে।
বহু দিনের কথা হলেও আজও বনহুর ভোলেনি তার উপকারের কথা।
সেদিন বনহুর এক ভদ্র নাগরিকের বেশেই আফগানী সাহেবের নিকটে গমন করেছিলো মিথ্যা এক পরিচয় দিয়ে তার কাছে কয়েকটা গাড়ি সাহায্য চেয়েছিলো। আফগানী সাহেব সেদিন বনহুরকে গাড়ি না দিলেও বলবার কিছু ছিলনা। কারণ, ইতিপূর্বে আফগানী সাহেব কোনদিন তাকে দেখেন নাই বা তার সঙ্গে কোন রকম আলাপ ছিলো না।
আফগানী সাহেবের মহৎ হৃদয়ের পরিচয় পেয়ে সেদিন দস্যু বনহুর শুধু মুগ্ধই হয়েছিলো না, কৃতজ্ঞও হয়েছিলো সেদিন সে।
আজ সেই আফগানী সাহেব বিনা অপরাধে হজত কক্ষে পচে মরছেন।
কথাটা বনহুরের মনে দারুণ আঘাত করেছিলো। একটা ব্যথার ছোঁয়া খোঁচা দিয়েছিলো তার মনের কোণে।
অগণিত দর্শক মতিমহল হলের সম্মুখে ভীড় জমিয়ে দিয়েছে। অসংখ্য গাড়ি থেমে আছে হলের পাশে। আজ শহর এবং দূর অঞ্চলের জনগণ অনেকেই এসেছে কারণ আজ কুন্তি বাঈ ছবির শেষ শো। তাছাড়া বিজ্ঞপ্তির মধ্যে একথাও প্রচার করা হয়েছে আজকের শো শেষ হবার পর এ ফিলম নষ্ট করে ফেলা হবে।
এ কারণেই দর্শক মহলে একটা বিপুল আগ্রহ জেগেছে।
থেমে থাকা অসংখ্য গাড়ির পাশে এসে দাঁড়ালো একটা নতুন ঝকঝকে কুইন গাড়ি।
একটু আগে যে গাড়িখানা এসে দাঁড়িয়েছে, সে গাড়ি থেকে নামলেন পুলিশ ইন্সপেক্টার মিঃ জাফরী ও তার সহকারী মিঃ হোসেন। মিঃ জাফরী এবং মিঃ হোসেন যখন হলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন; ঠিক সেই মুহূর্তে কুইন গাড়ি এসে থামলো। গাড়ির মধ্যে থেকে নেমে এলেন শুভ্রকেশ, মুখে শুভ্র দাড়ি, চোখে চশমা, দেহটা অর্ধ নূয়ে পড়া এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক। লোকটিকে দেখলেই শ্রদ্ধা করতে ইচ্ছা হয়। কোন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি–আভিজাত্যের ছাপ স্পষ্ট ফুটে রয়েছে তার চোখে-মুখে।
দক্ষিণ হস্তে মূল্যবান একখানা ছড়ি।
ছড়ির বাটে রূপার কারুকার্য করা। বাটের মাথাটা ব্যাঘ্ৰ মুখাকারে তৈরি। ব্যাঘের চোখ দুটিতে উজ্জ্বল পাথর বসানো।
প্রবীণ ব্যক্তি ছড়িতে ভর দিয়ে এগুলেন, দক্ষিণ হাতখানা মৃদু মৃদু কাঁপছে।
হলে প্রবেশ করে মিঃ জাফরীর আসনের পাশে এসে বসলেন। মিঃ জাফরীর অপর পাশে মিঃ হোসেন বসেছেন।
শো শুরু হবার এখনও কিছু বাকি আছে।
গোটা হলঘর নীলাভ আলোতে আলোকিত।
মিঃ জাফরীকে লক্ষ্য করে বললেন বৃদ্ধ ভদ্রলোক–আদাব ইন্সপেক্টার সাহেব।
মিঃ জাফরী একটু আশ্চর্য হলেন, স্মরণ করতে চেষ্টা করলেন–কে এই বৃদ্ধ ভদ্রলোক। কোথায় যেন দেখেছেন, কিন্তু মনে করতে পারছেন না।
হাসলেন বৃদ্ধ ভদ্রলোক আমাকে চিনতে পারছেন না ইন্সপেক্টর!
এমন সময় মিঃ হোসেন বলে উঠলেন–উনি ইন্সপেক্টার আহম্মদ সাহেবের শ্বশুর সাহেব–
মিঃ হোসেন বৃদ্ধ ভদ্রলোকের নাম বলতে ইতস্ততঃ করছেন দেখে উনি নিজেই বললেন– আমার নাম, আবুল কাসেম মোহাম্মদ চিস্তি।
ওঃ এবার মনে পড়েছে। মিঃ জাফরী উঠে তার সঙ্গে হ্যান্ডসেক করলেন।
মিঃ হোসেনও হ্যান্ডসেক করলেন চিস্তি সাহেবের সঙ্গে।
মিঃ জাফরী আসন গ্রহণ করে বললেন–বহুকাল আগের দেখা তো, কেমন যে ভুলে গিয়েছিলাম–মাফ করবেন।
না না, এটা এমন কি ব্যাপার, অমন হয়েই থাকে।
মিঃ জাফরী ঠিক হয়ে বসে বললেন–আপনি কবে এসেছেন কান্দাই শহরে?
গত পরশু সন্ধ্যার ট্রেনে।
আজও আপনার দেশের কথা ভুলতে পারিনি চিস্তি সাহেব, সত্যি বড় মনোরম দেশ–মন্দরা নামের ঠিক উল্টো। ওখান থেকে ফিরেই চলে এসেছি কান্দাই এ।
হাঁ, আমি আহম্মদের মুখে শুনেছিলাম, কান্দাই এ আপনি স্ব ইচ্ছায় আগমন করেছেন। দস্যু বনহুরকে গ্রেপ্তারের জন্যই নাকি আপনার কান্দাই আগমন হয়েছিলো।
জি হাঁ, দস্যু বনহুরই আমার কান্দাই আগমনের মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু আজও আমি সাফল্য লাভে সক্ষম হইনি। একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করেন মিঃ জাফরী।
প্রবীণ ব্যক্তি একটু হেসে বললেন–সুচতুর দস্যু তাহলে আপনাকে বেশ নাজেহাল করে ছাড়ছে?
হাঁ, বলতে লজ্জা নাই–শয়তান শুধু আমাকেই নয় সমস্ত পুলিশ মহলের চোখে ঘুলি লাগিয়ে ছেড়েছে। আজকের ছবি দেখলেই বুঝতে পারবেন দস্যু এখন লোক সমাজে মিশে চিত্রনায়ক হয়েছে।
আশ্চর্য এই দস্যু বনহুর!
শুধু আশ্চর্যই নয় চিস্তি সাহেব, আজাকের ছবি দেখুন–সব বুঝতে পারবেন। এমন নিখুঁত অভিনয় করেছে, যেন সত্যি একজন অভিজ্ঞ শিল্পী। দর্শক মনে সে আসন গড়ে নেবার এটা একটা নতুন পন্থা অবলম্বন করেছে–
শো শুরু হবার পূর্বে গোটা হল ঘরের আলো নিভে গেলো।
বৃদ্ধ চিস্তি সাহেব চোখের চশমাটা রুমালে মুছে পুনরায় চোখে পরে নিলেন।
পর্দায় টাইটেল চলছে। সঙ্গে মিউজিকের সুন্দর একটা সুর একটানা বেজে চলেছে।
শো আরম্ভ হবার পূর্ব মুহূর্তে হঠাৎ চিস্তি সাহেব বলে উঠলেন–বুকের মধ্যে কেমন ব্যথা অনুভব করছি।
মিঃ জাফরী বলে উঠেন–খুব কি অসুস্থ বোধ করছেন।
হাঁ, অত্যন্ত বেশি। বুকের মধ্যে কেমন যেন হচ্ছে, নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম– চিস্তি সাহেব ঢলে পড়ে যাচ্ছিলেন, ধরে ফেললেন মিঃ হোসেন।
চিস্তি সাহেব কোঁকিয়ে বললেন–মাঝে মাঝে আমার এই রকম হয়। কিন্তু আজ যেন অত্যন্ত বেশি–মনে করছি–
ওদিকে তখন শো শুরু হয়ে গেছে।
হঠাৎ এই দুর্ঘটনার জন্য মিঃ জাফরী ও মিঃ হোসেন চিন্তিত হলেন। কিন্তু হলের মধ্যে কোন উপায় নেই। চিস্তি সাহেবকে ধরে অতি কষ্টে হলের বাইরে নিয়ে এলেন মিঃ জাফরী এবং মিঃ হোসেন।
আহম্মদ সাহেব একজন সুদক্ষ পুলিশ ইন্সপেক্টার, তাছাড়া মিঃ জাফরীর বন্ধুলোক। এ অবস্থায় তার বৃদ্ধ শ্বশুরকে একা ছেড়ে দেওয়া সম্ভব নয়। আহম্মদ সাহেব কান্দাই এ নাই, তিনি কোন এক কাজে কান্দাই এর বাইরে গেছেন। কাজেই বাসায় ফোন করে কোন ফল হবে না।
ড্রাইভার গাড়ির হ্যান্ডেলে মাথা রেখে ঝিমোচ্ছিলো। মিঃ জাফরী এবং মিঃ হেসেন চিস্তি সাহেবকে নিয়ে গাড়ির পাশে এসে দাঁড়ালেন পাহারারত কয়েকজন পুলিশ এগিয়ে এসেছে। ইন্সপেক্টার সাহেবদ্বয়কে সহায়তা করতে।
ড্রাইভারও নেমে পড়লো গাড়ি থেকে, হঠাৎ কিছু বুঝে উঠতে পারলোনা সে।
মিঃ জাফরী এবং মিঃ হোসেন মিঃ চিস্তি সাহেবকে পুলিশদের সহায়তায় গাড়িতে উঠিয়ে নিলেন।
অতি সাবধানে পিছনের আসনে চিস্তি সাহেবকে শুইয়ে দিয়ে মিঃ জাফরী এবং মিঃ হোসেন উঠে বসলেন।
মিঃ জাফরী চিস্তি সাহেবের মাথার নিকটে বসে বললেন– এখন কি খুব অসুস্থ বোধ করছেন?
হাত নেড়ে বললেন চিস্তি সাহেব, তিনি কথা বলতে পারছেন না।
কাজেই আর কেউ চিস্তি সাহেবকে বিরক্ত না করে নীরব রইলেন।
মিঃ হোসেন বললেন–ড্রাইভার, কান্দাই হসপিটালে চলো!
গাড়িতে স্টার্ট দিলো ড্রাইভার।
গাড়ির দুই পাশে পুলিশ ফোর্স স্যালুট করে দাঁড়ালো।
মিঃ জাফরীর মনে সদা আশঙ্কা হচ্ছে–বেচারী বুড়ো মানুষ চিস্তি সাহেব হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছেন, হসপিটাল পর্যন্ত পৌঁছতে সক্ষম হবেন কিনা সন্দেহ।
হঠাৎ যদি মন্দ কিছু হয়ে পড়ে তাহলে বন্ধুবর আহম্মদ সাহেবের নিকটে কি জবাব দেবেন। তাদের সম্মুখে তার শ্বশুর এ অবস্থা হয়েছিলো, অথচ ঠিকমত চিকিৎসা হয়নি। কাজেই মিঃ জাফরী স্বয়ং চললেন তার জরুরি কাজ ফেলে।
গাড়ি অত্যন্ত স্পীডে ছুটে চলেছে।
কান্দাই শহরের হসপিটাল শহরের প্রায় শেষপ্রান্তে, একটা নির্জন সুউচ্চ স্থানে। স্থানটা অত্যন্ত মনোরম এবং নীরব-নির্জন শহরের কর্ম-কোলাহলের বাইরে। কোন যানবাহন বা কলকারখানার শব্দ কান্দাই হসপিটালের রোগীদের অসুস্থ মনকে আরও অশান্ত করে তোলেনা।
কাজেই এ পথটা অত্যন্ত নির্জন নিরিবিলি।
মিঃ জাফরী, মিঃ হোসেন ও চিস্তি সাহেবসহ গাড়ির মধ্যে বসে আছেন। ড্রাইভার তাদের অভিজ্ঞ লোক, পুলিশ হাওলাদার সে!
হসপিটাল অভিমুখে উল্কবেগে গাড়ি ছুটে চলেছে। মাঝে মাঝে পাশ কেটে চলে যাচ্ছে দু’একটা প্রাইভেট কার বা ভাড়াটে গাড়ী।
কিছুক্ষণ চলার পর হঠাৎ গাড়িখানা বাঁক ঘুরে দক্ষিণ দিকে এগিয়ে চললো। এ পথ অত্যন্ত নিরিবিলি, শহরের কোন গাড়িই সহসা এ পথে চলেনা।
এতো স্পীডে গাড়িখানাকে চলতে দেখে মিঃ জাফরীর চমক ভাঙলো। মিঃ জাফরী কোন কথা বলবার পূর্বেই গাড়িখানা থেমে পড়লো আশ্চর্যভাবে। সঙ্গে সঙ্গে জনাব চিস্তি সাহেব মিঃ জাফরীর বুকে রিভলভার চেপে ধরেন, চাপা কণ্ঠে বললেন–একটু নড়েছেন অমনি সঙ্গে সঙ্গে মরবেন।
ড্রাইভার নিজের আসনের পাশে মিঃ হোসেনের বুকে আর একটি রিভলভার চেপে ধরেছে।
আচমকা এমন একটা ঘটনা ভাবতেও পারেননি মিঃ জাফরী এবং মিঃ হোসেন।
আজীবন মিঃ জাফরী পুলিশের চাকুরি করে আসছেন–তার মত দক্ষ ইন্সপেক্টর কমই আছেন! কিন্তু আজকের মত এমন অবস্থায় তিনি কখনও পড়েননি।
মিঃ জাফরী কোন দিন কাউকে স্বাভাবিকভাবে বিশ্বাস করতেন না। অপরিচিত এবং আত্মীয়-স্বজন ছাড়া কারো সঙ্গে তিনি কোথাও কোনদিন যেতেন না বা কারো দাওয়াত গ্রহণ করতেন না।
হঠাৎ আহম্মদ সাহেবের শ্বশুর প্রবীণ ব্যক্তি অকস্মাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছেন ভেবে তাঁকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন, ভুলে গিয়েছিলেন অন্য কোন কথা।
মিঃ জাফরী কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লেন যেন। মিঃ হোসেন সাহেবের অবস্থাও অত্যন্ত শোচনীয় হয়ে পড়েছে। ড্রাইভার তার কণ্ঠদেশে রিভলভার চেপে ধরেছে ভীষণভাবে।
এদিকে মিঃ জাফরীর পাঁজরে চিস্তি সাহেব রিভলভার চেপে ধরে একটা বাঁশিতে ফুঁ দিলেন।
সঙ্গে সঙ্গে কয়েজন বলিষ্ঠ লোক বেরিয়ে এলো পথপার্শ্বের ঝোপ-ঝাড়ের মধ্য থেকে।
চিস্তি সাহেবের ইংগিতে লোকগুলি মজবুত দড়ি দিয়ে পিছমোড়া করে বেঁধে ফেললো মিঃ জাফরী এবং মিঃ হোসেনকে।
মিঃ জাফরী গম্ভীর কণ্ঠে বললেন কি–তুমি–চিস্তি সাহেবের ছদ্মবেশে আমাকে–রাগে, ক্ষোভে মিঃ জাফরীর কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেলো।
মিঃ হোসেনও ভীষণভাবে ক্রুদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন, দু’চোখ দিয়ে যেন আগুন ঝরে পড়েছিলো।
এবার চিস্তি সাহেব ড্রাইভারকে আদেশ করলেন গাড়ি ছাড়তে। ঝোপের আড়াল থেকে যেসব ভীষণ চেহারার লোক বেরিয়ে এসেছিলো তারা পুনরায় অদৃশ্য হলো ঝোপের আড়ালে।
গাড়িখানা আবার ছুটতে শুরু করলো।
*
বনহুরের দরবার কক্ষ।
সুউচ্চ আসনে উপবিষ্ট স্বয়ং দস্যু বনহুর।
সম্মুখে হস্তপদ বন্ধন অবস্থায় মিঃ জাফরী ও হোসেন সাহেব দন্ডায়মান।
সূতীক্ষ্ণ বর্শা হস্তে কয়েকজন দস্যু মিঃ জাফরী ও মিঃ হোসেনের আশে-পাশে দাঁড়িয়ে আছে।
বনহুরের আদেশে রহমান মিঃ জাফরী আর মিঃ হোসেনের কোমরের বেল্ট থেকে রিভলভার। খুলে নিলো।
ক্রুদ্ধ অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকিয়ে আছেন মিঃ জাফরী দস্যু বনহুরের মুখের দিকে।
হেসে বললো বনহুর–কি দেখছেন অমন করে?
কে তুমি?
হাঃ হাঃ হাঃ এখনও আপনার বন্ধুকে চিনতে পারেন নি?
তুমিই কি–
হাঁ, আমিই গত রাতের চিস্তি সাহেব।
তুমি! তুমিই—
শুধু চিস্তি সাহেবই নই, তোমার বন্ধু দস্যু বনহুর।
তুমি! তুমি দস্যু বনহুর?
হাঁ আমি–বন্ধু, তোমার কোন ক্ষতি করবো না। কিন্তু একটা কথা তোমাকে লিখে দিতে হবে, তাহলে মুক্তি দেবো।
মিঃ জাফরী ও মিঃ হোসেন একযোগে তাকালেন বনহুরের মুখের দিকে।
মুক্তি শব্দটা যেন তাদের কানে আজ মধু বর্ষণ করলো। জীবনে কত চোর-ডাকু-দুষ্ট লোককে মিঃ জাফরী এবং হোসেন সাহেব কারা কক্ষে বন্দী করেছেন, তার কোন হিসাব নেই। কোনদিন তাদের মনে উঁকি দেয়নি বন্দী হলে তাদের অবস্থা কি হয়। আজ পুলিশ ইন্সপেক্টারদ্বয় নিজেদের চরম অবস্থায় উপনীত হয়ে মুক্তি কথাটার আস্বাদ পেলেন।
বললেন মিঃ জাফরী–কি লেখা চাও তুমি?
একটা চিঠি।
চিঠি?
হাঁ, আফগানী সাহেবকে মুক্তি দেবার জন্য একটা চিঠি দেবেন, পুলিশ কমিশনারের কাছে। আফগানী সাহেবের মুক্তির পর মুক্তি পাবেন আপনারা।
এবার বনহুর রহমানকে বললো–একটা কাগজ-কলম এনে দাও।
অতি অল্প সময়ের মধ্যেই রহমান কাগজ আর কলম এনে মিঃ জাফরীর সম্মুখে পাথরের টেবিলের উপর রাখলো।
বনহুর আসন ত্যাগ করে উঠে এলো মিঃ জাফরী আর হোসেন সাহেবের সম্মুখে। কঠিন কণ্ঠে বললো বনহুর –লিখুন।
না। মিঃ জাফরীও কঠিন গলায় বললেন–আমি লিখবো না।
কেনো?
আইনে সে অপরাধী।
যত অপরাধই সে করে থাকুক তবু তার যতক্ষণ মুক্তি না হবে ততক্ষণ মুক্তি নাই। আপনাদের।
তাই বলে আইনের বিরুদ্ধে কাজ করবো!
করতে বাধ্য করবো মিঃ জাফরী। রহমান–
সঙ্গে সঙ্গে রহমান রিভলভার চেপে ধরলো মিঃ জাফরীর পাঁজরে।
বনহুর দাঁতে-দাঁত পিষে বললো–মৃত্যু চান না আফগানী সাহেবকে মুক্তি দিতে চান বলুন?
বনহুর কখনও মিঃ জাফরীকে তুমি কখনও ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করছিলো। অবশ্য বিশেষ কোন সময়ে বনহুর তুমি’ শব্দই উচ্চারণ করতো।
বনহুরের কথায় বললেন মিঃ জাফরী–আইনের বিরুদ্ধে কিছুই করবো না আমি।
মরতে তাহলে আপত্তি নেই?
রহমান রিভলভার সরিয়ে নিলো। বনহুর মিঃ জাফরীর কণ্ঠদেশে চেপে ধরলো সূতীক্ষ্ণধার একখানা ছোরা।
একটু চাপ পড়তেই গলাটা চিড় চিড় করে উঠলো। মিঃ জাফরীর বুকের মধ্যে ধক ধক করছে। একবার মিঃ জাফরী তাকালেন মিঃ হোসেনের মুখে।
মিঃ হোসেন চোখের ইংগিতে তাঁকে চিঠিখানা লিখে দিতে বললেন।
মিঃ জাফরী কলমটা তুলে নিলেন হতের মুঠায়। বনহুর স্বয়ং মিঃ জাফরীর হাতের বন্ধন মুক্ত করে দিলো–লিখুন।
মিঃ জাফরী কাগজটা এগিয়ে নিলেন।
বনহুর বলতে লাগলো–লিখুন, আমি এবং মিঃ হোসেন দস্যু বনহুরের হস্তে বন্দী! আমাদের মুক্তির জন্য আফগানী সাহেবের মুক্তি দিতে হবে। আপনি তাকে অচিরে মুক্তি দেবার ব্যবস্থা করুন। একটু থেমে বললো সে–কার কাছে লিখলে আপনার কথা ঠিক থাকবে তারই কাছে লিখুন। পঞ্চাশ হাজার টাকা নয়, বা এক লক্ষ নয়–শুধু আফগানী সাহেবের মুক্তি–
মিঃ জাফরী কিছুক্ষণ চিন্তা করে ঘন ঘন করে লেখলেন, তারপর কাগজটা সরিয়ে রাখলেন এক পাশে। কলমটা এক রকম ছুঁড়েই ফেলে দিলেন টেবিলে।
বনহুর কাগজখানা তুলে নিলো হাতে; চোখের সম্মুখে মেলে ধরলো। হাঁ, বনহুর যা বলেছেন, তাই লিখেছেন মিঃ জাফরী। পুলিশ ইন্সপেক্টার আহম্মদ সাহেবের কাছে লিখেছেন তিনি।
বনহুর চিঠিখানা ভাঁজ করতে করতে বললো–মনে রাখবেন এর মধ্যে কোন চাতুরী খেলবার চেষ্টা করেছেন, কি মরেছেন। যতক্ষণ না আফগানী সাহেব হাজত থেকে মুক্তি লাভ করছেন ততক্ষণ আপনারা আমার বন্দী। মিঃ জাফরী, আপনি আমাকে গ্রেপ্তারের জন্য লক্ষ টাকা ঘোষণা করতেও দ্বিধা বোধ করেননি, জীবিত কিংবা মৃত–যে কোন অবস্থায় আমাকে পেলে, আপনার পুলিশ চাকুরি জীবন আজ সার্থক হতো। কিন্তু সে আশা আপনার সফল হয়নি, গত রাতেই আপনি মতিমহল হলে বসে এ কথা চিস্তি সাহেবের নিকট দুঃখ করে বলেছেন।
একটু থেমে বললো বনহুর–মিঃ জাফরী, আপনি আমাকে যতই শত্রু মনে করেন, আসলে আমি আপনার বন্ধু। আজ ইচ্ছা করলে আপনাকে এবং আপনার সহকারীকে এই মুহূর্তে হত্যা করতে পারি কিন্তু করবো না।
এতোগুলো কথা এক সঙ্গে বলে বনহুর নীরব হলো। রহমান এবং অন্যান্য দস্যুগণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কারো মুখে কোন শব্দ নেই।
দরবার কক্ষের মধ্যে কয়েকটা মশাল দপ দপ করে জ্বলছে। গোটা কক্ষটা জমকালো পাথরে তৈরি। মশালের আলোতে কালো পাথরগুলো কেমন যেন ভয়াবহ লাগছিলো। লৌহ শিকলে বন্ধন অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছেন মিঃ জাফরী আর মিঃ হোসেন।
একটা সূচ পড়ার শব্দও হচ্ছে না দরবার কক্ষে।
বনহুর আবার বললো–অতোখানি পিশাচ আমি নই।
মিঃ জাফরী, বললেন এবার–তা আমরা জানি দস্যু হলেও তোমার মহৎ হৃদয়ের পরিচয় আরও অনেকেই জানে।
মিঃ হোসেন বলে উঠলেন–তোমাকে গ্রেপ্তারের ইচ্ছা থাকলেও তোমার প্রতি পুলিশ মহলেরও একটা আন্তরিকতা আছে!
এ কথা আপনারা প্রকাশ না করলেও আমি জানি। আর জানি বলেই আজ আমি আপনাদের প্রতি অসৎ ব্যবহার করিনি। মিঃ জাফরী আমি আপনাকে এবং আপনার সহকারী মিঃ হোসেনকে কথা দিচ্ছি–কোন ক্ষতি আপনাদের হবেনা।
এবার রহমানকে লক্ষ্য করে বললো বনহুর–এদের সসম্মানে নিয়ে যাও, বন্দী করে রাখো। কোন অসুবিধা যেন না হয় সেদিকে লক্ষ্য রেখো।
রহমান মাথা নত করে বললো–আচ্ছা সর্দার।
রহমানের ইংগিতে দুজন অনুচর মিঃ জাফরী ও মিঃ হোসেনকে নিয়ে গেলো সেখান থেকে।
মিঃ জাফরী এবং মিঃ হোসেনকে নিয়ে যাবার পর বনহুর রহমানকে বললো–এই চিঠিখানা পুলিশ অফিসে পৌঁছে দেবার চেষ্টা করো।
আচ্ছা সর্দার।
তারপর অন্যান্য খবরের জন্য কায়েসকে ছদ্মবেশে পুলিশ অফিসেই অপেক্ষা করতে বলো। আফগানী সাহেবকে মুক্তি না দেওয়া পর্যন্ত কোন কথা নয়।
বনহুর দবার কক্ষ ত্যাগ করতে যাচ্ছিলো, বললো রহমান–সর্দার, ডক্টর হংকিং ও ডক্টর মংলাও–এদের কি এখন মুক্তি দেওয়া হবে?
দাঁড়িয়ে একটু করে বললো বনহুর–হাঁ, ওদের এবার মুক্তি দেওয়া যায়, কিন্তু আর যেন ঐ ধরনের কাজে লিপ্ত না হয় তার জন্য সায়েস্তাও করে দিতে হবে।
কথা শেষ করে বেরিয়ে যায় বনহুর।
*
ডক্টর হংকিং আর মংলাওকে মুক্তি দিলো বনহুর কিন্তু তাকে সাবধান করে দিলো আর যেন সে এ ব্যবসায়ে লিপ্ত না হয়।
প্রায় পনেরো বিশ দিন পর ছাড়া পেলো ডক্টর হংকিং ও মংলাও।
হংকিং ও মংলাও ছাড়া পেয়েই চললো হোটেল গুলবাগে মোটা অঙ্কের টাকা পাওনাদার আছে এখন তারা।
হংকিং ও মংলাও হোটেল গুলবাগে প্রবেশ করতেই মহব্বৎ আলী বিষ্ময়ে স্তম্ভিত হলো, সশব্যস্তে উঠে এগিয়ে এলো–আপনারা?
হংকিং বললো–ভিতরে আসুন, বলছি সব।
হংকিং আর মংলাও এর বিবর্ণ ফ্যাকাশে মুখভাব লক্ষ্য করে আরও হতভম্ব হয়ে পড়েছে। মহব্বৎ আলী; ব্যাপার কি? সেদিন ওভাবে এলো, টাকা নিয়ে চলে গেলো। আর কোন দিন কান্দাই-এ পা রাখবেনা বলে গেলো, কিন্তু–
হংকিং আর মংলাও মহব্বৎ আলীকে ভাববার সময় না দিয়ে এগিয়ে গেলো মালখানার দিকে।
মহব্বৎ আলীও তাদের অনুসরণ করলো।
মালখানায় মালপত্র রাখছিলো দুই জন লোক।
মহব্বৎ আলী, হংকিং ও মংলাও এসে বসলো গোল টেবিলটার পাশে।
মহব্বৎ আলী আর মংলাও এর মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি জন্মেছে। চোখে মুখে বেশ একটা উকুণ্ঠার ভাব ফুটে উঠেছে।
লোক দু’টো গুদাম ঘরে ঔষধের বাক্সগুলো ঠিকভাবে সাজিয়ে রাখছিলো বাক্সের সম্মুখে সাজিয়ে রাখছিলো হোটেলের প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র, আর পিছন দিকে ভেজাল মিশানো ঔষধের বাক্স।
মহব্বৎ আলী স্বয়ং এদের দিয়ে কাজ করাচ্ছিলেন, চোরা কারবারীদের সদা আশঙ্কা–কখন কোন বিপদ এসে পড়ে। বিশেষ করে পুলিশের ভয়তো আছেই, তারপর দস্যু বনহুরের ভয়ও কম নয়। সেদিন মংলাও আর হংকিং এর মুখে যখন জানতে পেরেছিলো দস্যু বনহুরের কবলে তারা পড়েছিলো কোন রকমে প্রাণ বাঁচিয়ে ফিরে এসেছে সেই দিন হতে মহব্বৎ আলীর বুকটাও ধক ধ করছিলো। না জানি কখন হামলা দিয়ে তার সব লুটে নেবে।
আজ কদিন হলো তাই মহব্বৎ আলীর মনে স্বস্তি নেই। কোথায় কেমন ভাবে তার ভেজাল ঔষধের বাক্সগুলি লুকিয়ে রাখবে সেই চেষ্টা করছে।
এমন সময় পুনরায় হংকিং আর মংলাকে দেখে বিস্ময় জেগেছিলো মহব্বৎ আলীর কারণ টাকাপয়সা সম্পূর্ণ সেদিন নিয়েই বিদায় হয়েছিলো ওরা।
আজ আবার হংকিং আর মংলাও এসে হাজির হলো দেখে মহব্বৎ আলী স্তম্ভিত হয়ে পড়লো।
গোল টেবিলের পাশে বসে পড়লো মংলাও আর হংকিং। মহব্বৎ আলীর চোখমুখে বিস্ময় ঝরে পড়ছে। বললো মহব্বৎ আলী–কি ব্যাপার, আবার যে আপনারা ফিরে এলেন?
ডক্টর হংকিং রাগত কণ্ঠে বললেন–তার মানে? আপনি কি চান আমরা আর ফিরে না আসি?
মংলাও বলে উঠলো–আমরা না এলেই খুশি হতেন আপনি?
মহব্বৎ আলী কেমন যেন অবাক হয়ে পড়লো। ডক্টর হংকিং আর মংলাও এর কথাবার্তা যেন বুঝতে পারছেনা সে। বললো মহব্বৎ আলী–আপনারা সেদিন আমার নিকট থেকে টাকা নিয়ে যাবার সময় তো সেই কথাই বলেছিলেন, কান্দাই আর আপনারা আসবেন না।
বিস্ময়ভরা কন্ঠে বলে উঠলো হংকিং–কি বললেন মহব্বৎ আলী খাঁ! আমরা টাকা নিয়ে গেছি?
হাঁ সেদিন পঁচিশে আগষ্ট রাত্রি এগারোটায় এরই মধ্যে ভুলে গেছেন সব?।
মহব্বৎ আলীর কথা শুনে ফ্যাকাসে হয়ে উঠলো হংকিং রাও আর মংলাও এর মুখমন্ডল। বললো উভয়ে এক সঙ্গে–কি বললেন আপনি!
হংকিং ললো আবার–আমরা টাকা নিয়েছি।
হাঁ নিয়েছেন।
যে লোক দু’জন ঔষধের বাক্স গুছিয়ে রাখছিলো, তারা উভয়ে মুখ চাওয়া চাওয়ি করে নিলো।
প্রথম মজুর বললো–হুঁজুর, কাজ হয়ে গেছে।
বেশ এখন বাইরে যাও। আমি এসে তোমাদের মজুরীর দাম দেবো বেরিয়ে গেলো মজুরদ্বয়।
মহব্বৎ আলী রাগত কণ্ঠে বললো–সেদিন সম্পূর্ণ টাকা আপনারা আমার কাছ থেকে বুঝে নিয়ে গেছেন।
হংকিং দৃঢ় গলায় বললো–আমরা আসি নাই, টাকা কি করে নিলাম?
আমি স্বয়ং আপনাদের হাতে টাকা দিয়ে দিয়েছি।
এতো বড় মিথ্যা কথা বলছেন–হংকিং মহব্বৎ আলীর কলার চেপে ধরেলো।
শুরু হলো প্রচন্ড ধস্তাধস্তি।
অল্পক্ষণের মধ্যে হোটেলের লোকজন সবাই ছুটে এলো সেই কক্ষে।
*
এদিকে যখন মহব্বৎ আলীর সঙ্গে ডক্টর হংকিং ও মংলাও এর তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়েছে তখন পুলিশ অফিসের দরজায় এসে থামলো একটা গাড়ি।
অফিসে তখন অন্য আর একটা ব্যাপার নিয়ে অত্যন্ত চাঞ্চল্য দেখা দিয়েছিলো। পুলিশ ইন্সপেক্টর আহম্মদ সাহেব ও অন্যান্য পুলিশ অফিসারগণের মুখমন্ডল আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে পড়েছে। কারণ কিছু পূর্বেই একখানা চিঠি এসে পৌঁছেছে মিঃ আহম্মদের হস্তে। চিঠিখানা লিখেছেন স্বয়ং মিঃ জাফরী।
আহম্মদ সাহেব গম্ভীর উৎকুণ্ঠা ভাব নিয়ে পায়চারী করছেন। এখনও তার হাতের মুঠায় মিঃ জাফরীর হস্তের চিঠিখানা রয়েছে।
অন্যান্য পুলিশ অফিসারগণ, সকলের মুখেই আতঙ্ক ভাব। সবাই তাকিয়ে আছে মিঃ আহম্মদ সাহেবের মুখের দিকে। এটা একটা ভয়ঙ্কর খবর। মিঃ জাফরীর মত দক্ষ পুলিশ ইন্সপেক্টার বন্দী হবেন দস্যু বনহুরের হস্তে–একথা যেন কেউ বিশ্বাস করতে পারছেন না।
কিন্তু বিশ্বাস না করে উপায় কি! চিঠিখানা যে স্বয়ং মিঃ জাফরী লিখেছেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। পায়চারী বন্ধ করে দাঁড়িয়ে পড়লেন আহম্মদ সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন–এখন কি করা কর্তব্য বলুন?
মিঃ আহম্মদ সাহেবের কথায় পুলিশ অফিসারগণ সবাই একবার মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে নিলেন।
এক পাশে বসেছিলেন মিঃ শঙ্কর রাও। তিনি বললেন–ওঃ এবার দস্যু বনহুর দেখছি আচ্ছা চাল চেলেছে। মিঃ জাফরী ও তাঁর সহকারীকে আটক করে আফগানীর মুক্তি চেয়েছে, নাহলে তাদেরও মুক্তি নেই।
মিঃ শঙ্কর রাও এর কথা শেষ হতে না হতে একটা লোক ব্যস্তভাবে পুলিশ অফিসে প্রবেশ করে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো– স্যার পুলিশ ফোর্স নিয়ে তাড়াতাড়ি চলুন। গুলবাগ হোটেলের গোপন একটা কক্ষে বহু ভেজাল ঔষধ বেরিয়েছে। বিলম্ব হলে সব লুকিয়ে ফেলতে পারে।
লোকটা অপরিচিত হলেও তার কথা অবিশ্বাস করবার মত কিছু ছিলনা। কারণ, আহম্মদ সাহেব জানেন–মহব্বৎ আলী গোপনে ঔষধের কারবার করছেন। কিন্তু উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে। এতোদিন মহব্বৎ আলীকে গ্রেফতার করতে পারেননি বা তার হোটেলখানা তল্লাশী করতে পারেননি।
পুলিশ অফিসের অন্যান্য অফিসারগণ এক একজন এক এক রকম প্রশ্ন করে চললেন। লোকটিকে।
মিঃ আহম্মদ সবাইকে চুপ থাকতে বলে লোকটিকে জিজ্ঞাসা করলেন–আপনি কে এবং আপনার বাড়ি কোথায়?
লোকটা মাথা চুলকে তাকালো আহম্মদ সাহেবের মুখের দিকে তারপর সবাই এর মুখে তাকিয়ে বললো লোকটা –আমি গুলবাগ হোটেলেই কাজ করি। আপনারা কি আমাকে চেনেন না? আমিই তো বয় সাহাদৎ মিয়া? স্যার, গুলবাগে যারা যান সবাই আমাকে চেনেন।
মিঃ আহম্মদ অত্যন্ত সতর্ক লোক, তিনি একজন পুলিশকে বললেন–একে এরেষ্ট করো।
আমাকে! লোকটা কেঁদেই ফেললো যেন।
মিঃ আহসান থানার বড় দারোগা, তিনি বললেন–স্যার, একে এ্যারেষ্ট করা কি ঠিক হবে। তার চেয়ে ওকে আমাদের সঙ্গে নিয়ে চলুন ঘটনা সত্য হলে মুক্তি পাবে আর যদি মিথ্যা হয়। তাহলে এর উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া হবে।
হাঁ, তাই হোক। বললো লোকটা।
মিঃ আহম্মদ পুলিশ ফোর্স নিয়ে তখনই রওয়ানা দিলেন।
মিঃ আহম্মদ ও আরও একজন পুলিশ ইন্সপেক্টার এবং সশস্ত্র পুলিশ ফোর্স নিয়ে ছুটলেন গুলবাগের উদ্দেশ্যে।
তখনও হোটেল গুলবাগে মহব্বৎ আলী এবং ডক্টর হংকিং আর মংলাও এ তুমুল কলহ চলেছে। এমনকি শেষ পর্যন্ত লড়াই শুরু হয়ে গেছে।
মহব্বৎ আলীর লোক ডক্টর হংকিং আর মংলাওকে খুব করে উত্তম মধ্যম দেওয়া আরম্ভ করে। দিয়েছে।
ঠিক সেই সময় মিঃ আহম্মদ পুলিশ ফোর্স নিয়ে হাজির হলেন হোটেল গুলবাগে।
যে ব্যক্তি মিঃ আহম্মদকে পুলিশ অফিসে গিয়ে সংবাদ দিয়েছিলো। সে মিঃ আহম্মদ ও পুলিশ ফোর্সকে হোটেল পথ দেখিয়ে নিয়ে চললো।
মিঃ আহম্মদ পুলিশ ফোর্স নিয়ে হোটেলকক্ষে প্রবেশ করতেই মহব্বৎ আলী ও ডক্টর হংকিং আর মংলাও চুপ হয়ে পড়লো।
এবার সেই লোকটি মিঃ আহম্মদকে দেখিয়ে দিলো যেখানে থরে থরে সাজিয়ে রাখা হয়েছিলো ভেজাল ঔষধের বাক্সগুলো। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ অসংখ্য ভেজাল ঔষধের বাক্স আবিস্কার করে ফেললো।
মিঃ আহম্মদের ইংগিতে মহব্বৎ আলী আর ডক্টর হংকিং রাও ও ডক্টর মংলাওকে এরেষ্ট করে ফেললো পুলিশ বাহিনী।
শুধু মহব্বৎ আলী এবং ডক্টর হংকিং রাও আর মংলাওকেই পুলিশ বাহিনী বন্দী করলোনা, সমস্ত হোটেলের কর্মচারীগণকে এরেষ্ট করা হলো।
হংকিং রাও আর মংলাও দস্যু বনহুর হস্তে বন্দী থাকার পর সবেমাত্র মুক্তি পেয়েছিলো আবার তারা বন্দী হয়ে নিজেদের কর্মদোষ মর্মে মর্মে অনুভব করতে লাগলো।
মহব্বৎ আলীর মাথায় সহসা আকাশ ভেঙে পড়লেও সে এতোখানি আঘাত পেতোনা। চোখে অমাবস্যার অন্ধকার দেখতে লাগলো মহব্বৎ আলী। তার এতো পরিশ্রমের উপার্জিত অর্থ আর ঔষধগুলো বিনষ্ট হলো। ইতিপূর্বে অন্যান্য ব্লাকমার্কেট ব্যাপারে কয়েকবার জেল খেটেছে সে। কিন্তু এতেও ভেঙে পড়েনি মহব্বৎ আলী কোনদিন। আজ তার সব গেলো শুধু অর্থই নয়–তার সঙ্গে গুলবাগ হোটেলও বন্ধ হয়ে গেলো।
মিঃ আহম্মদ বন্দীদের নিয়ে পুলিশ ভ্যানে উঠে বসলেন।
নানা ব্যস্ততার মধ্যে এতোক্ষণ মিঃ আহম্মদ ও তাঁর অন্যান্য সহকারীগণ ঐ ব্যক্তিটির প্রতি নজর রাখতে পারেননি বা নজর রাখার প্রয়োজনও বোধ করেননি। কারণ তার কথা মিথ্যা নয়। এর পূর্বে অনেক অনুসন্ধান করেও এই ভেজাল ঔষধ কোথা হতে শহরে আমদানী হয় এর খোঁজ পায়নি পুলিশ মহল! আজ সেই ভেজাল ঔষধের পরিবেশক মহব্বৎ আলীকে এবং তার সমস্ত ঔষধ আবিস্কার করায় দেশ ও দশের একটা মহান উপকার সাধিত হলো।
মিঃ আহম্মদ গাড়িতে বসে বললেন–উনি কই, যিনি আজ আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে এলেন, সেই অজ্ঞাত ব্যক্তি কই?
কিন্তু কোথায় সেই ব্যক্তি! অনেক সন্ধান করেও আর তাকে দেখা গেলো না।
*
নির্জন বনপথ দিয়ে মন্থর গতিতে এগিয়ে চলেছে দু’জন অশ্বারোহী। উভয়েরই শরীরে একই ড্রেস। কালো পোশাক মাথায় কালো পাগড়ি, গালপাট্টা বাঁধা, পিঠে রাইফেল ঝুলছে।
অসংখ্য বৃক্ষের পাতার ফাঁকে নীল আকাশের কিছু কিছু অংশ নজরে পড়ছে।
হাল্কা মেঘের ফাঁকে দ্বাদশীর চাঁদ লুকোচুরি খেলছে। মৃদু-মন্দা বাতাস দোলা দিয়ে যাচ্ছে। শাখায় শাখায়। মাঝে মাঝে রাতজাগা পাখিগুলো পাখা ঝাপটা দিয়ে উঠছে।
রাত খুব বেশি না হলেও নির্জন বনাঞ্চলে গভীর রাত বলেই মনে হচ্ছিলো।
অশ্বরোহীদ্বয় আপন মনে কথা বলতে বলতে চলেছে।
প্রথম জন দ্বিতীয় ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে বললো–রহমান পুলিশ অফিসের কেউ চিনতে পারেনি শেষ পর্যন্ত?
বললো দ্বিতীয় জন–না সর্দার, আমাকে পুলিশ অফিসের কেউ চিনতে পারেনি, মিঃ আহম্মদও নয়।
তোমার বুদ্ধি কৌশলে আমি খুশি হয়েছি রহমান।
সর্দার, আমাকে ইতিপূর্বে মিঃ আহম্মদ কিংবা পুলিশ অফিসারগণ কেউ দেখেননি, সেই কারণেই আমি এতো সহজে কাজ উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছি। তাছাড়াও আমার মুখে ছিলো ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি আর মুখ ভরা বসন্তের দাগ। আমার শরীরের রঙও পাল্টে নিয়েছিলাম নিখুঁতভাবে।
মহব্বৎ আলী ও তার দলবলকে গ্রেপ্তারের পরেই তুমি সরে পড়েছিলে?
হাঁ সর্দার, আপনি যে ভাবে বলে দিয়েছিলেন সে ভাবেই কাজ করেছি। আচ্ছা সর্দার, আপনি কি ঐ সময়–
হাঁ, আমি ঐ সময় মহব্বৎ আলীর লৌহ সিন্দুকের পাশে ছিলাম। পুলিশ সমস্ত হোটেল হস্তগত করার পূর্বেই সম্পূর্ণ অর্থ আমার হস্তগত হয়েছিলো। আমি যখন হোটেলের বাইরে এসে পৌঁছেছিলাম ঠিক তখন মিঃ আহম্মদ ও পুলিশ ফোর্স মহব্বৎ আলী আর তার বিশ্বস্ত অনুচরদের পাকড়াও করে নিয়ে পুলিশ ভ্যানে উঠে বসেছিলো। তখন আমি তোমাকে লক্ষ্য করেছিলাম, কিন্তু দেখতে পাইনি।
তার পূর্বেই আমি সরে পড়তে সক্ষম হয়েছিলাম সর্দার।
আফগানীর মুক্তি দিয়েছে কি? প্রশ্ন করলো বনহুর।
রহমান বললো–কায়েস এখন পুলিশের হেড অফিসে, আফগানী সাহেব ছাড়া পেলে নিশ্চয়ই সে বিলম্ব না করে সংবাদ দিতো।
দস্যু বনহুর আর রহমান এবার ঘোড়া ছুটিয়ে আস্তানার পথে অগ্রসর হলো।
আস্তানায় পৌঁছতেই দু’জন মশালধারী অনুচর এসে বনহুর আর রহমান-এর দুই পাশে দাঁড়ালো।
বনহুর আর রহমান অশ্বপৃষ্ঠ থেকে নেমে দাঁড়ালো। সম্মুখে এসে দাঁড়ালো কায়েস।
বনহুর আর রহমান–তাকালো কায়েসের দিকে।
বললো রহমান–কায়েস, তুমি কখন এলে?
কায়েস বললো–সন্ধ্যার কিছু পর আস্তানায় এসে পৌঁছেছি।
কি সংবাদ কায়েস? বললো বনহুর।
সর্দার আফগানী সাহেবকে হাজত থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে।
আফগানী সাহেব মুক্তি লাভ করেছে তাহলে?
হাঁ সর্দার।
এবার তাহলে মিঃ জাফরী আর মিঃ হোসেনকে মুক্তি দিতে হয়। বললো রহমান।
বনহুর আস্তানার দিকে এগুতে এগুতে বললো–মিঃ আহম্মদ অতি বুদ্ধিমান লোক। সহজাত ভাই এর জন্য তিনি মস্ত চাল চাললেন।
দু’জন অনুচর একজন তাজকে অন্যজন দুলকীকে নিয়ে চলে গেলো ওদিকে।
রহমান আর বনহুর পাশাপাশি এগুচ্ছিলো। পিছনে চলেছিলো কায়েস।
বনহুরের কথায় রহমান বললো “সর্দার, আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারলাম না?
ও, আচ্ছা চলো, বিশ্রাম কক্ষে বসে কথাটা তোমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছি।
বনহুর রহমান আর কায়েম এসে হাজির হলো বনহুরের বিশ্রাম কক্ষে।
বনহুর পিঠে ঝোলানো রাইফেলটা খুলে দেয়ালে ঠেস দিয়ে রাখলো। মাথার পাগড়িটা খুলে রাখলো সামনের টেবিলে। তারপর শয্যায় ঠেস দিয়ে বসলো –বসে রহমান।
রহমান পিঠের রাইফেলটা খুলে দক্ষিণ হস্তে ধরে বসে পড়লো পাশের একটা পাথরখন্ডে।
বনহুরের আস্তানাটা ছিলো সম্পূর্ণ পাথরের তৈরি কাজেই পাথরের কোন অভাব ছিলোনা তার আস্তানার কোন স্থানে। কক্ষমধ্যে এবং আনাচে কানাচে বিক্ষিপ্ত ছড়ানো ছিলো অসংখ্য পাথরকালো সাদা ছোট বড় নানাধরনের।
রহমান এরই একটিতে বসলো।
কায়েস দাঁড়িয়ে রইলো তাদের সামনে।
বনহুর বললো–আহম্মদ সাহেব মিঃ জাফরী ও হোসেনের মুক্তির জন্যই আফগানীকে মুক্তি দিয়েছে, তাই না?
হাঁ সর্দার, মিঃ জাফরীর চিঠি পেলেই তিনি এই মত কাজ করেছেন।
বললো বনহুর–কিন্তু এর পিছনে রয়েছে বিরাট একটা অভিসন্ধি। মিঃ আহম্মদ মিঃ জাফরী ও তার সহকারীকে ফিরে পেলেই আবার আফগানীর উপর হামলা চালাবে।
ঐরকম আমারও মনে হয় সর্দার। বললো কায়েস।
রহমান তাকলো কায়েসের দিকে।
বনহুর বললো–শুধু আফগানী নয়, ঐ মিঃ জাফরীকে পেলে মিঃ আহম্মদ নবোদ্যমে আবার আমার পিছু লাগবে।
তাহলে–কথা শেষ না করে চুপ হয় রহমান।
কায়েস বলে উঠে–মিঃ জাফরীকে মুক্তি না দেওয়াই আমি সমীচিত মনে করি।
বনহুর মৃদু হাসলো–মিঃ জাফরীকে আটক করে রাখলে পুলিশ মহল আরও ক্ষেপে যাবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। যদিও তারা আমার আস্তানা খুঁজে বের করতে কোনদিন সক্ষম হবেনা, কিন্তু আফগানী সাহেবকে তারা কঠিন শাস্তি দেবে। আহম্মদ সাহেব জানেন আমি আফগানীকে সমীহ করি।
রহমান আর কায়েস নীরবে শুনে যাচ্ছিলো বনহুরের কথাগুলো।
বনহুর বলতে লাগলো–আজ ভোর হবার পূর্বেই মিঃ জাফরী ও তার সহকারিকে পুলিশ অফিসে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করো। হাঁ, তার পূর্বে মিঃ জাফরীর সঙ্গে আমার দেখা করার দরকার। বনহুর দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকালো। রাত দুটো বাজতে কয়েক মিনিট বাকি।
উঠে দাঁড়ালো বনহুর। রহমানকে লক্ষ্য করে বললো–চলো বন্দীখানায় যাবো।
বনহুরের সঙ্গে অগ্রসর হলো রহমান আর কায়েস।
সুদীর্ঘ সুড়ঙ্গ পথ বেয়ে এগিয়ে চললো তারা।
সুড়ঙ্গের মাঝে মাঝে মশাল জ্বলছে। একটানা কিছুদূর অগ্রসর হয়ে, মস্ত বড় একটা চাকার মত জিনিস রয়েছে। রহমান চাকার হ্যান্ডেল ধরে ঘুরাতেই একটা মুখ বেরিয়ে এলো ঠিক কুমীরের মুখের মত দরজাটা। এবার বনহুর আর রহমান সেই পথে অগ্রসর হলো।
বনহুর থমকে দাঁড়িয়ে বললো–কায়েস, তুমি তাজ আর দুলকীকে প্রস্তুত রেখো, আরও দুটো অশ্ব রাখবে।
আচ্ছা সর্দার।
কায়েস দাঁড়িয়ে রইলো, বনহুর আর রহমান প্রবেশ করলো সেই কুমীরের মুখাকৃতির মধ্যে।
ওদিকে কোন আলো ছিলোনা, রহমান এপাশ থেকে একটা মশাল তুলে নিলো হাতে।
আরও অন্ধকার এবং দুর্গম এই সুড়ঙ্গপথ। বহুদিন আগে একদিন বনহুর মনিরাকে মুরাদের হাত থেকে উদ্ধার করে এখানেই এনে রেখেছিলো, এই পথ বেয়ে আসতে গিয়েই সেদিন মনিরা দু’চোখ বন্ধ করে বনহুরকে আকড়ে ধরেছিলো ভয়ে। সুড়ঙ্গপথটা অতি সঙ্কীর্ণ এবং অন্ধকার। নিচে খরস্রোত একটি জলপ্রপাত।
বনহুর আর রহমান এই পথে অগ্রসর হলো।
সঙ্কীর্ণ পথ অতিক্রম করে ওপারে এসে পৌঁছলো। এটাই হলো বনহুরের কারাকক্ষের সীমানা।
ওদিকে একট মস্ত কপাট। ওপাশে কি আছে এপাশ থেকে বুঝবার জো নেই। কপাটের গায়ে বিরাট একটা তালা।
রহমান মশালটা কপাটের এক পাশে গেড়ে রেখে চাবির গোছা বের করলো।
কপাট খুলে ভিতরে প্রবেশ করলো বনহুর আর রহমান।
একটি গোলাকার কক্ষ, কক্ষমধ্যে একটা গোলকার টেবিল। টেবিলে নানা রকমের বাদ্যযন্ত্র এবং নানা রকম আমোদ-প্রমোদের বা খেলাধূলার সরঞ্জাম।
এ কক্ষে বনহুরের অনুচরগণ কখনও কখনও আনন্দ উপভোগ করে।
বনহুর আর রহমান পৌঁছতেই বিশ জন দস্যু বলিষ্ঠ ভয়ঙ্কর চেহারা, হাতে মারাত্মক অস্ত্র — কুর্ণিশ করে দাঁড়ালো।
এরা বনহুরের কারাকক্ষের পাহারাদার। বাইরের আলো বাতাসের সঙ্গে এদের কোন সম্বন্ধ নেই বললেই চলে। এদের সুখ-সুবিধার জন্য বনহুর ভূগর্ভেই সব কিছুর ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এরা ইচ্ছামত বাইরে যেতে পারে না বা কোন সময় যাবার জন্য আগ্রহ দেখায় না। বছরে পাঁচদিন এরা ছাড়া পায়, তখন এরা ভূপৃষ্ঠে গমন করে যা খুশি তাই করে। বনহুর এদের কাজে তখন বাধা দেয় না।
বনহুর আর রহমান গোলাকার কক্ষ পেরিয়ে এগিয়ে গেলো। ওদিকেও আর একটা কপাট। এটার চাবি ছিলো ভূগর্ভস্থ এক অনুচরের নিকটে। সেই অনুচরটি এ তালা খুলে ফেললো।
সঙ্গে সঙ্গে ওদিকে পাশাপাশি কয়েকখানা কক্ষ নজরে পড়লো। উজ্জ্বল আলোতে কক্ষগুলো। আলোকিত। প্রতি কক্ষে কয়েকজন বন্দী আটক রাখা হয়েছে।
বনহুর আর রহমান এগিয়ে গেলো ওদিকে একটা বড় কক্ষে। এ কক্ষটাও আলোতে উজ্জ্বল।
এ আলোগুলো সূর্যের আলো নয়, বৈদ্যুতিক আলো। ভূগর্ভে খরস্রোত জলপ্রপাত থেকে বৈদ্যুতিক আলো আমদানি করা হয়েছে।
কক্ষে প্রবেশ করতেই মিঃ জাফরী আর মিঃ হোসেন উঠে এগিয়ে এলেন।
বনহুর আর রহমান এসে দাঁড়ালো তাদের সম্মুখে।
বললো বনহুর–মিঃ জাফরী, আপনার চিঠি পেয়ে মিঃ আহম্মদ আফগানী সাহেবকে মুক্তি দিয়েছে এবার আপনারা মুক্তি পাবেন।
বনহুরের কথায় মিঃ জাফরী ও মিঃ হোসেনের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।
বললেন মিঃ জাফরী-তাহলে বিলম্ব না করাই শ্রেয় দস্যু সম্রাট।
বনহুর হেসে উঠলো–এক মুহূর্ত আর বিলম্ব সইছেনা ইন্সেপেক্টার, কিন্তু মনে রাখবেন, আবার যদি আফগানীর উপর কোন–
না, আমি কথা দিচ্ছি আফগানীর উপর আর কোন শাস্তি প্রদান করা হবেনা। কিন্তু একটা কথা আমি বলবো দস্যু, রাখবে বলো? বলেন মিঃ জাফরী।
রাখবার মত হলে রাখবো বৈকি। বললো বনহুর।
মিঃ জাফরী বললেন–তোমার এই ভূগর্ভ আস্তানাটা একবার স্বচক্ষে দেখতে চাই।
অট্টহাসি হেসে উঠলো বনহুর–হাঃ হাঃ হাঃ, আমার ভূগর্ভ আস্তানাটা দেখতে চান? বেশ, রহমান, উনাদের নিয়ে এসো আমার সঙ্গে।
বনহুর এগুলো।
রহমান মিঃ জাফরী ও মিঃ হোসেন সহ অনুসরণ করলো বনহুরকে।
বনহুর একটা মস্তবড় লৌহ দরজার পাশে এসে দাঁড়ালো। রহমান দেয়ালের এক পাশে চাপ দিতেই দরজা খুলে গেলো। গাঢ় জমাট অন্ধকারের মধ্যে যেন একটা মরণ বিভীষিকা প্রতীক্ষা করছে।
বনহুরের ইংগিতে একটা মশাল নিয়ে এলো রহমান।
মশাল হস্তে রহমান সর্বাগ্রে প্রবেশ করলো। পিছনে বনহুর মিঃ জাফরী আর মিঃ হোসেন।
এটাও একটা সুড়ঙ্গ পথ।
বনহুর বললো–ইন্সপেক্টার এটা আমার আস্তানায় প্রবেশ পথ।
সুড়ঙ্গ পথে কিছুটা অগ্রসর হওয়ার পর একটা শব্দ শোনা যাচ্ছিলো। কোন যন্ত্র চলার শব্দ বলে মনে হলো যেন। অল্পক্ষণের মধ্যেই নজর পড়লো বিরাট একটা চাকা ঘুরছে। চাকাটার চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে অসংখ্য আগুনের ফুলকী। চার পাশে আরও অগণিত ছোটবড় মেশিন চলছে। অবাক হয়ে দেখলেন মিঃ জাফরী ও মিঃ হোসেন–শুধু মেশিনই নয়, প্রত্যেকটা মেশিনের পাশে দাঁড়িয়ে কাজ করছে বলিষ্ঠদেহী পুরুষ।
বনহুর বললো–ইন্সপেক্টার, এটা আমার অস্ত্র তৈরির কারখানা। এখানে নানা রকম অস্ত্র তৈরি হয়ে থাকে।
মিঃ জাফরী ও মিঃ হোসেনের চোখে-মুখে বিস্ময় ফুটে উঠলো, মিঃ জাফরীর ধমনীর রক্ত উষ্ণ হয়ে উঠলো সঙ্গে সঙ্গে, কিন্তু এই মুহূর্তে নীরব থাকা ছাড়া কোন উপায় নেই। মিঃ জাফরী একবার সহকারী হোসেনের দিকে তাকিয়ে নিলেন বনহুরের অজ্ঞাতে।
বনহুর এবার দ্বিতীয় কক্ষে প্রবেশ করলো। রহমান, মিঃ জাফরী ও মিঃ হোসেন তাকে অনুসরণ করলো!
দ্বিতীয় কক্ষে প্রবেশ করে বিস্ময়ে স্তব্ধ হলেন পুলিশ ইন্সপেক্টারদ্বয়! কক্ষটায় অসংখ্য অস্ত্র স্তূপীকৃত রয়েছে।
মিঃ জাফরী ও মিঃ হোসেন আবার দৃষ্টি বিনিময় করলেন। উভয়েরই চোখ ছানাবড়া হয়ে উঠেছে।
বনহুর বললো–এটা আমার অস্ত্রাগার।
ইন্সপেক্টারদ্বয় স্তম্ভিত হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন কক্ষমধ্যে স্তূপাকৃত ছোরা তলোয়ার, বর্শা, তীর-ধনু এমন কি বন্দুক-রাইফেল অসংখ্য রয়েছে। কান্দাই এর কোন গোপন অঞ্চলে এমন একটা অস্ত্রাগার আছে কেউ আজও কল্পনা করতে পারবে না।
বনহুর রহমানকে ইংগিৎ করলো কিছু।
রহমান অস্ত্রগারের মেঝেতে পা দিয়ে এক স্থানে চাপ দিলো সঙ্গে সঙ্গে মেঝের এক পাশের কিছুটা অংশ ফাঁক হয়ে একটা সিঁড়ি মুখ বেরিয়ে এলো।
বনহুর বললো–ইন্সপেক্টার, আসুন। সর্বাগ্রে বনহুর সিঁড়ির ধাপে পা রাখলো।
সিঁড়ি বেয়ে অগ্রসর হলো সে। মিঃ জাফরী ও মিঃ হোসেন ইতস্তত করছিলেন দেখে বললো বনহুর –আসুন, কোন ভয় নেই।
মিঃ জাফরী, মিঃ হোসেন ও রহমান সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করলো।
পাতাল গহ্বরে সিঁড়ির ধাপ বেয়ে আরও নিচে নামতে লাগলো তারা।
কিছুদূর অগ্রসর হয়ে বনহুর দাঁড়িয়ে পড়লো। একটা মাঝারি ধরনের কক্ষ এ কক্ষে নানা রকম গোলা বারুদ থরে থরে সাজানো রয়েছে।
কক্ষটার মধ্যে বারুদের গন্ধ নাকে এসে লাগছিলো।
বললো বনহুর–এটা আমার গোলা-বারুদ মজুদ কক্ষ। ইন্সপেক্টার, গোটা কান্দাই শহর ধ্বংস হবে, এতো গোলা বারুদ মজুত রয়েছে আমার।
মিঃ জাফরী কোন জবাব না দিয়ে একবার মিঃ হোসেনের দিকে তাকিয়ে নিলেন। দক্ষ পুলিশ ইন্সপেক্টার তিনি, একজন দস্যুর এতোখানি আধিপত্য লক্ষ্য করে ভিতরে ভিতরে ভীষণ ক্রুদ্ধ হচ্ছিলেন। এই মুহূর্তে ইচ্ছা হচ্ছিলো বনহুরকে তিনি বন্দী করেন। কিন্তু তিনি নিজেই এখন দস্যু হস্তে বন্দী, কাজেই মনের রাগ মনেই চেপে গেলেন।
বনহুর তার সমস্ত আস্তানায় গোপন স্থানগুলি এক এক করে দেখালো পুলিশ ইন্সেপেক্টার মিঃ জাফরী ও মিঃ হোসেনকে।
এমনকি তার বিশ্রামকক্ষ ও তার দরবারকক্ষও দেখালো।
মিঃ জাফরীর চোখে-মুখে রাজ্যের বিস্ময়। দস্যু বনহুরকে যতই ঘৃণা করুক যতই তার উপর রাগ থাক তবু অন্তরে অন্তরে দস্যু বনহুরের বীরত্বের প্রশংসা না করে পারলেন না। ভূগর্ভে এতো থাকতে পারে কল্পনা করতে পারেন না তাঁরা। মিঃ জাফরীর পুলিশ জীবনে এই তিনি প্রথম দেখলেন একজন দস্যু ভূগর্ভে কতখানি নিজের আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে। কবে কখন কি উপায়ে যে এতো করতে পেরেছে, ভেবে অবাক না হয়ে পারলেন না মিঃ জাফরী।
এতোক্ষণ নীরবে সব দেখে গেলেন, মনে মনে বিস্ময়ের শেষ সীমায় পৌঁছলেও এতোক্ষণ একটি কথাও তিনি উচ্চারণ করেননি।
মিঃ হোসেনও নির্বাক নয়নে সব দেখে যাচ্ছিলেন মনে প্রশ্ন জাগলেও একটি কথা তার মুখেও সরছিলো না।
বনহুর ইন্সপেক্টারদ্বয়ের মনোভাব বুঝতে পারছিলো। মৃদু মৃদু হাসছিলো সে, বললো এবার –আমার সব কিছুই বন্ধু বলে আপনাকে দেখালাম ইন্সপেক্টার, কিন্তু মনে রাখবেন আমার সঙ্গে কোন রকম চাতুরী খেলতে যাবেন না।
মিঃ জাফরী ও মিঃ হোসেন কোন কথা বললেন না।
বনহুর বললো আবার –ইন্সপেক্টার আপনারা বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন বসুন কিছু পান– আহার করা যাক। বসুন।
অগত্যা বনহুরের কথা রাখতে হলো ইন্সপেক্টরদ্বয়কে।
একটা টেবিলের পাশে এসে বসলো বনহুর ও মিঃ জাফরী এবং মিঃ হোসেন।
নানাবিধ ফলমূল আর পানীয় সাজিয়ে রেখে গেলো একজন অনুচর।
রহমান পরিবেশন করে খাওয়াতে লাগলো।
খেয়ে তো কোন উপায় নেই, আজ কত দিন দস্যু বনহুরের আস্তানায় তারা বন্দী হয়ে। আছেন জীবন রক্ষার্থে খাদ্যগ্রহণ করতেই হয়েছে। মিঃ জাফরী, মিঃ হোসেন তাদের রুচিমত খাদ্যই বনহুর তাঁদের জন্য ব্যবস্থা করে দিয়েছিলো। বরং আরও ভাল পুষ্টিকর খাদ্য পরিবেশন করা হতো তাদের জন্য।
কাজেই আজ খেতে তাঁদের কোন আপত্তি থাকতে পারে না। বনহুর স্বয়ং মিঃ জাফরী ও মিঃ হোসেনের সঙ্গে খেতে শুরু করলো।
পরিচ্ছন্ন সুন্দর, খাবার, টাটকা ফলমূল, গরম দুধ সব ছিলো টেবিলে। একটা বড় রেকাবীতে থরে থরে সাজানো ছিলো থোকা থোকা আঙ্গুর ফল।
বনহুর রেকাবী থেকে আঙ্গুরের একটা থোকা তুলে নিয়ে মুখে ধরলো, কয়েকটা আঙ্গুর এক সঙ্গে চিবুতে চিবুতে বললো–আজ রাতেই আপনারা ফিরে যাবেন ইন্সপেক্টার। আপনাদের আদর যত্ন ঠিকভাবে করতে পারলাম না এজন্য মাফ করবেন না?
মিঃ জাফরী ও মিঃ হোসেন বনহুরের কথায় খুশি হলেন না। বরং রাগ হলো তাদের অন্তরে। কারণ তাঁদের আদরযত্নের কোন ত্রুটি হয়নি এখানে। দস্যুর হস্তে বন্দী হয়ে এতো লৌকিকতা ভাল লাগছিলো না এর চেয়ে নির্মম আচরণই তাদের মনে একটা শান্তি দিতো।
মিঃ জাফরী ও মিঃ হোসেন দুধপান শেষ করে রুমালে মুখ মুছলেন।
বনহুরও দুধের গেলাসটা হাতে তুলেছিলো, এক নিশ্বাসে দুধ পান করে খালি গেলাসটা নামিয়ে রাখলো টেবিলে।
প্যান্টের পকেট থেকে সিগারেট কেসটা বের করে বাড়িয়ে ধরলো বনহুর মিঃ জাফরী আর মিঃ হোসেনের সামনে।
মিঃ জাফরী আর মিঃ হোসেন সিগারেট না নিয়ে পারলেন না। বনহুর নিজে একটা সিগারেট ঠোঁটে চেপে ধীরে তাতে অগ্নি সংযোগ করলো। সিগারেটের ধোয়ার ফাঁকে বনহুর তাকাচ্ছিলো মাঝে মাঝে ইন্সপেক্টারদ্বয়ের মুখের দিকে।
ধীরে ধীরে মিঃ জাফরী ও মিঃ হোসেনের চোখ বন্ধ হয়ে আসছে বলে মনে হলো। কিছুতেই নিজেদের সংযত রাখতে পারছেন না তারা। একটা গভীর আবেশে মিঃ জাফরী ও মিঃ হোসেন এক সময় ঢলে পড়লেন নিজ নিজ আসনে।
বনহুরের আদেশে ইন্সপেক্টার মিঃ জাফরী আর মিঃ হোসেনের সংজ্ঞাহীন দেহ কাঁধে তুলে নিলো কয়েকজন অনুচর।
রহমান ও বনহুর অশ্বপৃষ্ঠে চেপে বসলো।
মিঃ জাফরীর সংজ্ঞাহীন দেহটা বনহুর নিজের অশ্বে তুলে নিলো। আর মিঃ হোসেনকে তুলে দেওয়া হলো রহমানের অশ্বপৃষ্ঠে।
বনপথে দ্রুত অগ্রসর হলো বনহুর আর রহমান।
উভয়ের অশ্বপৃষ্ঠে দুই জন ইন্সপেক্টার।
*
মিঃ জাফরীর ঘুম ভাঙতেই বিস্ময়ে আরষ্ট হলেন তিনি। একি! তার বিছানার চারপাশে এতো লোকজন কেননা! সবার আগে নজর পড়লো পুলিশ ইন্সপেক্টার মিঃ আহম্মদের মুখে।
মিঃ জাফরীকে চোখ মেলতে দেখেই বললেন মিঃ আহম্মদ –মিঃ জাফরী, আপনি কি সুস্থ বোধ করছেন?
হাঁ, আমি সম্পূর্ণ সুস্থ রয়েছি। কিন্তু আমি এখন কোথায় ঠিক স্মরণ করতে পারছি না।
আপনি আপনার নিজ বাসায় এবং নিজ বিছানায়।
এখানে কি করে এলাম আমি?
এখন নয়, পরে সব জানতে পারবেন।
না; আপনারা সব খোলাসা বলুন? আমি বললাম তো, কোনরূপ অসুস্থই আমি নই। মিঃ জাফরী শয্যায় উঠে বসলেন।
মিঃ আহম্মদ বললেন–আপনি এখন যে ভাবে শুয়ে ছিলেন ঠিক সেই ভাবেই আপনার স্ত্রী আপনাকে আপনার শয্যায় দেখতে পেয়েছিলেন।
আমার শয্যায়?
হাঁ।
আশ্চর্য। মিঃ জাফরী গভীরভাবে কিছু চিন্তা করতে লাগলেন। একটু পরে বললেন–মিঃ হোসেন কোথায়?
তাঁকে তো এখনও পাওয়া যায়নি– মিঃ আহাম্মদের কথা শেষ হয়না, টেবিলে ফোনটা সশব্দে বেজে উঠে ক্রিং ক্রিং করে।
অন্য একজন ভদ্রলোক রিসিভার হাতে তুলে নিয়ে কানে ধরলেন–হ্যালো! হাঁ কি বললেন, মিঃ হোসেনকে পাওয়া গেছে! কোথায় বললেন? হ্যালো–হ্যালো কি? তাঁর গ্যারেজে রাখা গাড়ির মধ্যে? আশ্চর্য–রিসিভার রেখে বললেন ভদ্রলোক।
মিঃ আহম্মদ বললেন–আশ্চর্য নয়, তাকে যে এমনভাবে পাওয়া যাবে, বোঝাই যাচ্ছিলো।
মিঃ জাফরী এতক্ষণে যেন আস্বস্ত হলেন, বললেন তিনি–দস্যু বনহুর তাহলে তার কথা এ ভাবেই রাখলো।
মিঃ আহম্মদ বললেন না রেখে কি উপায় আছে। সে জানে–মিঃ জাফরী ও তার সহকারীর কোন অমঙ্গল হলে আবার আফগানী সাহেবের উপর আমাদের আক্রমণ চলবে।
অন্য একজন অফিসার বললেন–কাজেই সে পুলিশ ইন্সপেক্টারদ্বয়কে নিরাপদে স্বস্থানে পৌঁছে দিতে বাধ্য হয়েছে।
মিঃ আহম্মদ বললেন–মিঃ জাফরী, বনহুর আপনাদের সজ্ঞানে এখানে পৌঁছে দেয়নি বুঝতে পারছি।
হাঁ, আমরা জানিনা, কি ভাবে সে আমাদের এখানে পৌঁছে দিয়েছে। মিঃ আহম্মদ অনেক কথা আছে আপনার সঙ্গে। এখন চলুন মিঃ হোসেন কেমন আছেন তাকে দেখে আসি।
ব্যস্তভাবে বললেন মিঃ আহম্মদ –এখন আপনার শয্যা ত্যাগ করা ঠিক হবে না মিঃ জাফরী।
না না, আমি সম্পূর্ণ সুস্থ রয়েছি।
মিঃ জাফরী শয্যা ত্যাগ করে উঠে দাঁড়ালেন।
মিঃ হোসেনের বাড়ি পৌঁছে তারা দেখলেন–হোসেন সাহেবের শারীরিক অবস্থার কোন পরিবর্তন ঘটেনি। মিঃ হোসেনও সম্পূর্ণ সুস্থ আছেন।
তিনি কি ভাবে গ্যারেজে গাড়ির পিছন আসনে শুয়েছিলেন জানেন না। ড্রাইভার গাড়ি বের। করতে গ্যারেজে প্রবেশ করে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিলো। ছুটে এসে সংবাদ দিয়েছিলো সে বাড়ির মধ্যে।
মিঃ আহম্মদ ড্রাইভারকে ডেকে আবার সমস্ত ব্যাপারটা শুনলেন আগাগোড়া।
*
শুধু পুলিশ মহলই নয়, সমস্ত শহরে কথাটা ছড়িয়ে পড়লো বিদ্যুৎ গতিতে। বিস্ময়ের উপরে বিস্ময় জাগালো সকলের মনে। প্রত্যেকটা অফিসার এসে মিঃ জাফরী ও মিঃ হোসেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে লাগছেন। সবাই নানা রকম সহানুভূতি দেখাতে লাগলেন ইন্সপেক্টারদ্বয়কে। দস্যু বনহুর তাদের প্রতি কি ধরণের আচরণ করেছে সেখানে তারা কেমন ছিলেন তাদের কি খেতে। দিতো–কি ভাবে কি করতো–সব জানার জন্য উদগ্রীব সবাই।
মিঃ জাফরী এবং মিঃ হোসেন সত্য কথাই বললেন।
দস্যু বনহুর তাঁদের প্রতি কোন রকম অসৎ ব্যবহার করেনি, এ কথা জানালেন তারা।
কিন্তু দস্যুর আতিথ্য সেবায় সন্তুষ্ট হয়ে খুশি হবার বান্দা নন মিঃ জাফরী, ছাড়া পেয়ে ক্রুদ্ধ সিংহের ন্যায় হয়ে উঠলেন তিনি। শপথ গ্রহণ করলেন যেমন করে হোক বনহুরকে গ্রেপ্তার না করা অবধি তিনি বিশ্রাম গ্রহণ করবেন না। মিঃ জাফরী আর মিঃ আহম্মদের মধ্যে সব সময় এ বিষয় নিয়ে আলাপ আলোচনা চলতে লাগলো।
বনহুরের আস্তানা সম্বন্ধে যা মিঃ জাফরী জানতে পেরেছিলেন এবং স্বচক্ষে দেখেছিলেন সব বললেন মিঃ আহম্মদ সাহেবের নিকটে।
মিঃ আহম্মদের দু’চোখে যেন আগুন ঝরে পড়তে লাগলো। তিনি বললেন–একটা দস্যু কান্দাই এর বুকে এতোখানি আধিপত্য বিস্তার লাভে সক্ষম হয়েছে আর আমরা পুলিশ বাহিনী তার এতোটুকু টিকি আবিস্কার করতে পারলামনা। মিঃ জাফরী,আপনি কি কিছুই অনুমান করতে পারেন না? কান্দাই এর কোথায় কোন স্থানে এই আস্তানা রয়েছে?
না, কিছুতেই আমি বুঝতে পারছি না দস্যু বনহুর আমাকে কান্দাই এর কোন পথে কোন দিকে, কোথায় নিয়ে গিয়েছিলো।
আর কোথা হতে কোন পথে রেখেই বা গেলো।
মিঃ জাফরীর কথায় মিঃ আহম্মদের মুখমন্ডল গম্ভীর হয়ে উঠলো, তিনি কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন–এর বিহিত ব্যবস্থা না করে ছাড়ছি না।
মিঃ জাফরীর সঙ্গে গোপনে কিছু আলোচনা করতে লাগলেন তিনি।
সিগারেটের পর সিগারেট নিঃশেষ হতে লাগলো, আর চললো কথোপকথন।
দেয়াল ঘড়িটা টিক টিক শব্দে এগিয়ে চলেছে।
রাত বেড়ে আসছে ক্রমেই।
মিঃ জাফরীর বাংলোয় বসে আলাপ করছেন মিঃ আহম্মদ, মিঃ হোসেন আর স্বয়ং মিঃ জাফরী।
হঠাৎ একটা শব্দ ভেসে আসে তাঁদের কানে।
খট খট খট– খট খট খট– খট–খট—
মিঃ জাফরী, মিঃ হোসেন কান পেতে শুনতে লাগলেন। মিঃ আহম্মদ সিগারেটটা মুখ থেকে সরিয়ে নিয়ে স্তব্ধভাবে শুনতে লাগলেন, বললেন তিনি–কিসের শব্দ এটা?
মিঃ জাফরীর চোখেমুখে ক্রুদ্ধ ভাব ফুটে উঠলো, তিনি বললেন– এ শব্দ আমার অতি পরিচিত মিঃ আহম্মদ।
তখনও শব্দটা একেবারে মিশে যায়নি, দূরে সরে গেছে তবু অস্পষ্ট শোনা যাচ্ছে–খট খট খট–শব্দটা।
মিঃ জাফরী বললেন–দস্যু বনহুরের অশ্বপদ শব্দ এটা।
দস্যু বনহুরের?
হাঁ, আমি ইতিপূর্বে আরও অনেক বার শুনেছি এ শব্দ।
মিঃ আহম্মদ বললেন–হুঁ।
শব্দটা কয়েক মিনিটের মধ্যে দূর হতে দূরান্তে মিশে গেলো। কিন্তু তখনও পুলিশ ইন্সপেক্টার এর কানে বনহুরের অশ্বপদ শব্দে প্রতিধ্বনির রেশ লেগে রয়েছে যেন।
মিঃ আহম্মদ হঠাৎ হেসে উঠলেন–হাঃ হাঃ হাঃ দস্যু বনহুর যাদুকর নয় মানুষ। সেই মানুষকেই আমরা পাকড়াও করতে পারিনা।
*
স্বামীর কাছে যতই পুত্রশোক ভুলে থাকতে চেষ্টা করুক, আসলে মনিরা মুহূর্তের জন্য নূরকে ভুলতে পারেনি। মনের মধ্যে সদা সর্বদা একটা ব্যথা গুমড়ে কেঁদে ফিরছিলো তার। সব সময় মলিন মুখ-মন্ডল, চোখ ছলছল–যেন বিষাদের প্রতিচ্ছবি।
একদিকে স্বামীর চিন্তা অন্যদিকে পুত্রশোক। তবু যদি সব সময় স্বামীকে পাশে পেতো তাহলেও মনিরা ভুলতে পারতো সব ব্যথা।
স্বামীর সঙ্গ কোন নারী না কামনা করে! পৃথিবীর সব কিছু ত্যাগ করা যায় কিন্তু কোন নারী পারে কি তার স্বামীকে ত্যাগ করতে। মনিরা স্বামীর কথা স্মরণ করে ভুলতে চেষ্টা করে পুত্র নুরকে।
প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে মনিরা স্বামীর চিন্তায় মগ্ন থাকে, কিন্তু সব চিন্তা ছাপিয়ে ভেসে উঠে নূরের কথা তার হৃদয়ের কোণে তখন মনিরা অস্থির হয়ে পড়ে। নূরের মাধ্যমে সে ভুলতে চেয়েছিলো স্বামীর অভাব। ভুলতে চেয়েছিলো মনিরা জীবনের সব ব্যথা। নূরের কথা মনে হলেই সে আলমারী খুলে বের করে আনে তার জামা কাপড় আর জুতো বুকে চেপে ধরে মুখে মাথায় ঠেকায়। চোখ বন্ধ করে কচি হাতের স্পর্শ অনুভব করে। মনিরার গন্ড বেয়ে গড়িয়ে পড়ে তখন অশ্রুধারা।
সেদিন দ্বিপ্রহরে নির্জন কক্ষে নূরের জামা জুতো বের করে মনিরা নির্বাক নয়নে তাকিয়ে দেখছিলো আর নীরবে অশ্রু বিসর্জন করছিলো।
মরিয়ম বেগম পাশের ঘরে একটু ঘুমিয়েছেন।
দাসদাসীগণ তাদের বিশ্রাম স্থানে বিশ্রাম করছে। সরকার সাহেব বাইরের কোন কাজে বেরিয়ে গেছেন।
নকীব বাইরের গেটটা বন্ধ করে উঠানে প্রবেশ করতে যাচ্ছিলো এমন সময় এক বৃদ্ধ ভিখারি গলায় তসবী হাতে তসবী ঢিলা পায়জামা আর পা পর্যন্ত ঝোলানো পাঞ্জাবী গায়ে এসে দাঁড়ালো গেটের সম্মুখে।
নকীবকে দেখে বললো-বেটা, গোরা পানি দেগা?
ফিরে তাকলো নকীব–বৃদ্ধ ভিখারীর দিকে তাকিয়ে কয়েক পা এগিয়ে এলো বললো– পানি খাবে?
হাঁ, পানি পিয়েগা, বহুৎ পিয়াস হুয়ে।
আচ্ছা এখানে বসো, আমি পানি আনছি। নকীব চলে গেলো ভিতরে। একটু পরে পানি নিয়ে ফিরে এলো নকীব।
বৃদ্ধ পানি পান করে তৃপ্তির নিশ্বাস ত্যাগ করলো।
নকীব অনেকক্ষণ তাকিয়ে দেখলো বৃদ্ধ ভিখারীর চেহারা অতি পবিত্র অতি সৌম্য-সুন্দর। দেখলেই শ্রদ্ধা করতে ইচ্ছা করে, ভক্তি করতে ইচ্ছা হয়।
নকীবকে লক্ষ্য করে বললো বৃদ্ধ ভিখারী–ব্যাটা, তুম মেরা পাশ কই চিজ মাংতা?
নকীব প্রথমে বুঝতে পেরে একটু আশ্চর্য হল, বলে সেতুমি কি বলছো, আমি বুঝতে পারছি না বাবাজী।
তুম্ মেরা বা সমতা নেহি?
নেহি বাবা, নেহি আমি কিছু বুঝতে পারছি না।
বৃদ্ধ হাসলো–তুম কই চিজ লেগা? তোমহারা কোই দুঃখ হ্যায়?
দুঃখ! হাঁ তা আছে বই কি? তুমি কি দেবে–টাকা না পয়সা?
নেহি হাম ভিখারী আদমি, তুমকো রূপেয়া হাম কাহাছে দেংগে বেটা। হাম্ তোমহারা দিল্কা। খায়েস মিটানে চাহতা।
দিকা খায়েস। নকীব এবার একটু বুঝতে পারলো। একবার উর্দু ছবি দেখতে গিয়ে আপামনি তাকে দিকা খায়েস শব্দের মানে বুঝিয়ে বলেছিলো। মানেটা–মনের আশা।
এবার খুশি হলো নকীব, হেসে বললো–তুমি আমার মনের আশা মেটাতে পারবে?
হাঁ বেটা তুম জো চিজ চাহোগে হাম্ দেনে সাতা।
নকীব গালে হাত দিয়ে চিন্তা করতে লাগলো কি চিজ চাইবে সে। কোন অভাবটা এখন তার সব চাইতে বেশি। টাকা পয়সা-না; চৌধুরী বাড়ীতে আজ সে পঁচিশ বছর ধরে আছে টাকা পয়সার তো কোন অভাব হয়নি কোনদিন। যখন যা প্রয়োজন তাই দিয়েছেন মনিব-গৃহিনী। কি চাইবে, কই তার মনের আশা কিছু নেই তো। এ বাড়িতে তার মনের সবসাধই পূরণ হয়েছে। বৌ-ছেলেমেয়ে–এসব তো অনেক দিন শেষ হয়ে গেছে।
বৃদ্ধ হেসে বললো– বেটা হাম্ জানতা তুম্হারা কোই খায়েস নেহি। একঠো দুঃখ হ্যায়, জো তুমলোক কো হরওয়াক্ত বহুৎ পেরেশান রাখতা।
হাঁ, এবার মনে পড়েছে, আমার মনিবের বড় দুঃখ, বড় ব্যথা হয়েছে। আমাদের নূর হারিয়ে গেছে, কাজেই বাড়ীর সবাই এর জন্য দুঃখ অনুভব করছে।
বেটা, ঠিক বাত তুম বলা। নূর হ নূর চোরী হুয়া হায়। বেটা, নূর মিল জায়েগা—
আনন্দে অস্কুট ধ্বনি করে উঠে নকীবনূর মিল জায়েগা।
হাঁ বেটা হাম তসবী তেলায়েৎ করনেসে দেখ্যা–নূর মিল জায়েগা।
নকীব এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে ছুটলো সিঁড়ি বেয়ে উপরে।
মনিরা পদশব্দে নূরের জামাজুতো তাড়াতাড়ি সরিয়ে রেখে উঠে দাঁড়ালো, চোখ মুছে তাকাতেই নকীবকে দেখতে পেলো।
নকীব হাঁপাতে হাঁপাতে বললো–আপামনি, নূরকে পাওয়া গেছে। নূরকে পাওয়া গেছে–
নূরকে পাওয়া গেছে। মনিরার চোখে মুখে খুশির উচ্ছ্বাস ঝরে পড়লো কোথায়? কোথায় সে?
নকীব বললো তখন আপামনি, একটা ভিখারি এসেছে দরবেশ বলে মনে হলো, তিনি বললেন–নূরকে পাওয়া যাবে।
কোথায় সে দরবেশ নকীব?
নিচে-গেটের বাইরে।
তাকে বৈঠকখানায় নিয়ে এসো, আমি তার সঙ্গে দেখা করবো। যাও নকীব, যাও।
নকীব খুশি মনে চলে গেলো।
মনিরা তাড়াহুড়ো করে নেমে এলো নিচে। বৈঠকখানায় এসে দাঁড়াতেই নকীব এক দরবেশসহ কক্ষে প্রবেশ করলো।
মনিরা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। বৃদ্ধের চেহারার মধ্যে এক জোতির্ময় ভাব ফুটে রয়েছে। বললো মনিরা বসুন।
বৃদ্ধা মাথা নাড়লো–নেহি বেটি হাম্ বৈঠেগা–নেহি। এক বাত বোলনে আয়া। তুম বহুতহি দুঃখী হ্যায়।
হাঁ বাবাজী, আমি বহুত দুঃখী। বাষ্পরুদ্ধ হলো মনিরার কণ্ঠ।
বৃদ্ধ বললো–হ্যাম তসবী তেলায়েৎ সে দেখ্যা তোমহারা বেটা চোরী হুয়ে।
হাঁ, আমার নুর চুরি গেছে—
রোনা মাত বেটি। রোনা মাত। হাম ঐ কামছে আয়া বেটি। তোমহারা নূর মিল জায়েগা—
নূরকে পাবো? ফিরে পাবো আমার নূরকে?
হাঁ বেটি, তুম্হারা নূর মিল জায়েগা। দরবেশ বাবাজী চোখ বন্ধ করে তস্বী তেলায়েৎ করতে শুরু করলো।
তসবীটা কয়েক পাক ঘুরিয়ে নিয়ে চোখ খুলে বললো–বেটি, তোমহারা নূর বহু দূর হ্যায়।
তাহলে কি পাবোনা আমার নূরকে?
হাঁ মিল জায়েগা, আগার তোমহারা শওহরকো লেকর তুম্ যা সেতি তব মিল জায়েগা।
কোথায় যাবো বলুন বাবাজী? আমি যাবো ওকে সঙ্গে করে।
হাঁ, তোমহারা শাওহরকো ছোড় না যানা। আওর এক বাত শুনো বেটি।
বলো বাবাজী?
ও বাত তোমহারা শাওহর কেন নেনি বেলা, তব নেহি মিলেগা তোমূহরা বেটা।
না না, আমি বলবো না বলবোনা ওকে। কিন্তু কোথায় যাবো?
বেটি হিয়াসে বহু দূর নাহার মঞ্জিল নাম সে একঠো ঘর হায়, তোহারা শাওহর কো লেকর ঐ নাহার মঞ্জিল মে জায়োগি ওয়াহাঁ তোমহারা বেটা রহেগা। আভি হাম যা সেকতা?
আচ্ছা বাবাজী। মনিরা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
দরবেশ বাবাজী ধীর মন্থর গতিতে বেরিয়ে গেলো সেখান থেকে।
কথাটা মনিরা তার মামীমাকেও বললো না। একমাত্র নকীব ছাড়া আর কেউ জানলোনা।
মনিরা সব সময় ঐ এক চিন্তা নিয়েই সারাটা দিন কাটিয়ে দিলো। দরবেশ বাবাজীর কথাগুলো এখনও যেন তার কানে মধু বর্ষণ করছে। নাহার মঞ্জিল মে তোহারা নূর মিল জায়েগা– নাহার মঞ্জিল নাহার মঞ্জিল মনিরার চোখের সম্মুখে ভাসছে অজানা অচেনা একটি বাড়ি। সেখানে নূর তার হৃদয়ের ধন রয়েছে।
মনের মধ্যে একটা অস্থিরতা নিয়ে ছটফট করতে লাগলো মনিরা কবে কখন আসবে তার স্বামী তাকে নিয়ে যাবে সে পুত্রের সন্ধানে। নাহার মঞ্জিলের কোন চোর তার সন্তানকে চুরি করে রেখেছে। দরবেশ ঠিকই বলেছে খোদার ইবাদত করা লোক সব জানতে পারে ওরা। দরবেশ যদি সত্য জানতেই না পারে তাহলে তার স্বামীকে নিয়ে যাবার ইংগিত করবে কেনো? তিনি একথাও হয়তো জানতে পেরেছেন–তার স্বামী একজন শক্তিশালী পুরুষ।
*
একদিন দু’দিন করে কয়েক দিন কেটে গেলো। মনিরার সারাটা রাত্রি কাটে অনিদ্রায় প্রতি মুহূর্ত প্রতীক্ষা করে সে স্বামীর।
সেদিন একটু তন্দ্রার মত হয়ে পড়েছে মনিরা–হঠাৎ পাশে কারো অস্তিত্ব অনুভব করে চমকে পাশ ফিরে, তাকালো, ভাগ্যিস চিৎকার করে মনিরা।
পাশ ফিরে তাকাতেই আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো মনিরার চোখ দুটো। খুশি ভরা কণ্ঠে বললো–তুমি!
বনহুর খাটে বসে পড়ে বললো–না, দস্যু বনহুর।
কি নেবে আমার?
তোমাকে!
হেসে উঠলো মনিরা খিল খিল করে।
বনহুর মনিরার চিবুক ধরে উঁচু করে বললো–আজ যে বড় খুশি খুশি লাগছে।
হাঁ, তোমাকে পাশে পেলে আমার সব দুঃখ, সব ব্যথা দূর হয়ে যায়।
সব ব্যথা ভুলে যেতে পারো? মিথ্যে কথা।
না, সত্যি করে বলছি?
ভুলতে পারো তোমার নূরকে?
হাঁ, তাই ভুলছি। তোমাকে পাশে পাবো বলে আমি নূরকে ভুলেছি।
বনহুর মনিরাকে টেনে নিলো কাছে।
স্বামীর বুকে মাথা রেখে বললো মনিরা–একটা কথা রাখবে আমার?
মনিরা, তুমি আমার সঙ্গে ‘কুন্তিবাঈ’ ছবি দেখতে চেয়েছিলে কথা দিয়েও কথা রাখতে পারনি।
এবার রাখবে বলো?
যদি রাখবার মত হয় রাখবো। বলো?
না–রাখবার মত কিছু নয়। আচ্ছা বলোতো কান্দাই শহরে নাহার মঞ্জিল কোথায়?
নাহার মঞ্জিল?
হাঁ, নাহার মঞ্জিল।
বনহুর একটু ভাবাপন্ন হয়ে পড়লো, বললো–নাহার মঞ্জিলের নাম তুমি কার কাছে শুনলে মনিরা?
শুনেছি, কিন্তু কোথায় জানিনা।
কান্দাই শহরের সবচেয়ে সেরা বাড়ি ছিলো এককালে এই নাহার মঞ্জিল। কিন্তু আজ সে বাড়ি পোড়াবাড়ী হয়ে গেছে।
নাহার মঞ্জিল পোড়াবাড়ী হয়ে গেলে এখন!
হাঁ, কিন্তু নাহার মঞ্জিলের পূর্বের সেই সৌন্দর্য এখনও যেন অক্ষত রয়েছে। বাড়িটা দেখবার মত একটা জিনিষ। যাবে এ বাড়ি দেখতে?
সত্যি নিয়ে যাবে আমাকে সেই নাহার মঞ্জিলে?
এটা আর এমনকি, যাবো একদিন।
না একদিন নয়, আজ রাতেই নিয়ে চলো সেই নাহার মঞ্জিলে।
অবাক করলে মনিরা। এই গভীর রাতে– তা হয় না।
তবে কথা দাও–কাল সন্ধ্যায় তুমি আসবে।
আসবো।
সত্যি বলছো?
হাঁ, সত্যি আসবো।
মনিরা ক্ষণিকের জন্য অন্যমনস্ক হয়ে পড়লো নূরের কথা মনে পড়লো তার। একটা কচি। মুখ ভেসে উঠলো তার হৃদয়ের কোণে।
বনহুর মনিরার গালে মৃদু আঘাত করে বললো কি ভাবছো আবার?
না, কিছু না।
বনহুর বললো–এসো মনিরা, আমার ঘুম পাচ্ছে।
একটু হাসলো মনিরা, বললো–দস্যুর আবার ঘুম!
মনিরা! বনহুর ধরতে গেলো মনিরাকে।
মনিরা সরে দাঁড়ালো –উঁহু।
বনহুর হাত বাড়ালো মনিরাকে ধরবার জন্য।
মনিরা আবার সরে দাঁড়ালো।
মনিরা যতই দূরে সরে যেতে লাগলো বনহুর ওকে ধরবার জন্য ততই আগ্রহশীল হয়ে উঠলো।
বনহুরকে নাজেহাল পেরেশান করাই যেন মনিরার উদ্দেশ্য। মনিরা কিছুতেই ধরা দিবেনা বনহুরকে।
এক সময় বনহুর মনিরাকে ধরতে গেলো। অমনি মনিরা সুইচ টিপে আলো নিভিয়ে দিলো, সঙ্গে সঙ্গে সরে গেলো সেখান থেকে। বনহুর অন্ধকারে মনিরাকে হাতড়ে চললো। মনিরা বিছানায় গিয়ে চুপ করে শুয়ে বালিশে মুখ চেপে হাসতে লাগলো। বনহুর সুইচ টিপতেই মনিরা হেসে উঠলো খিল খিল করে।
বনহুরের মুখে খেলে গেলো দুষ্টুমির হাসি। কোন কথা না বলে আবার আলো নিভিয়ে দিলো বনহুর। এবার সে সোজা খাটে গিয়ে ধরে ফেললো মনিরাকে।
অন্ধকারে মনিরার চাপা আনন্দভরা কণ্ঠস্বর জেগে উঠলো–এতো দুষ্টু তুমি!
*
ভোরের আজান ধ্বনি ভেসে এলো অদূরস্থ কোন মসজিদ থেকে। ঘুম ভেঙে গেলো মনিরার। দরবড় করে উঠে বসে পাশে হাতড়ে দেখলো কেউ নেই–কোথায় তার স্বামী।
শয্যা ত্যাগ করে উঠে পাশের জানালাটা খুলে দিতেই এক ঝলক আলো ছড়িয়ে পড়লো। কক্ষমধ্যে। মনিরা নির্বাক পুতুলের মত স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ শূন্য বিছানার দিকে তাকিয়ে রইলো। বুকের মধ্যে একটা ব্যথা হাহাকার করে উঠলো কি যেন ছিলো এই মুহূর্তে তা যেন নেই। একটা হাস্য-উজ্জ্বল বলিষ্ঠ মুখ ফুটে উঠলো তার চোখের সামনে।
স্বামীর স্মৃতি চিন্তা করে অনাবিল এক আনন্দ উপভোগ করলো মনিরা হৃদয়ে। আজ আবার আসবে, দেখা হবে মিলিত হবে তারা দুজনে। মনিরার মনঃকষ্ট দূর হয়ে গেলো নিমিষে। শুধু স্বামী সঙ্গই সে লাভ করবেনা, ফিরে পাবে সে তার একমাত্র সন্তান, তার নূরকে। দরবেশ বাবাজীর কথাগুলো কানের কাছে ভেসে বেড়াচ্ছে নাহার মঞ্জিল মে তোমহারা বেটা মিল যায়েগা। নাহার মঞ্জিল–নাহার মঞ্জিলে যাবে আজ তারা।
হঠাৎ চমক ভাঙে মনিরার–এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে আছে কেনো সে! আজ কি তার দাঁড়িয়ে থাকবার সময় আছে। এই তো দিনটা চলে যাবে কোন ফাঁকে সন্ধ্যায় আসবে ও নিয়ে যাবে তাকে।
কিন্তু রোজ এমন খালি মুখে ওকে ছেড়ে দেবে কি করে। স্ত্রী হয়ে স্বামীকে সে কোনদিন পাশে বসে খাওয়াতে পারলোনা এটা কি তার কম দুঃখ। ধীরে ধীরে আনমনা হয়ে যায় মনিরা, সকাল বেলা বিছানায় স্বামী ঘুমিয়ে থাকবে, পাশে বসে গায়ে মৃদু চাপ দিয়ে ডাকবে ওগো ওঠো
–ও বলবে–উঁহু আর একটু ঘুমাতে দাও।
— বলবে মনিরা –বেলা কত হলো দেখছো?
–হতে দাও। বলে পাশ ফিরে শোবে ও।
–বলবে মনিরা চা নাস্তা সব ঠান্ডা হয়ে গেলো যে।
–লক্ষীটি বিরক্ত করোনা–সেই ফাঁকে ও টেনে নেবে তাকে নিবিড় আলিঙ্গনে। স্বামীর বুকে মাথা রেখে বলবে সে–ছিঃ ছেড়ে দাও, কেউ দেখে ফেলবে যে–
–ফেলুক, ক্ষতি নেই–বলবে ও–চমক ভাঙে মনিরার কি ভাবছে সে আবোল তাবোল, তাড়াতাড়ি বিছানাটা ঠিক করে বাথরুমে গিয়ে ঢুকে। আজ তার হৃদয়ে অফুরন্ত আনন্দ সন্ধ্যায় আসবে সে।
এখানে যখন মনিরা স্বামীর চিন্তায় মগ্ন, ওদিকে তখন বনহুর তার আস্তানার পথে ছুটে চলেছে। বনপথ মুখর হয়ে উঠেছে তাজের খুরের শব্দে। উলকা বেগে ছুটে চলেছে তাজ।
আস্তানায় পৌঁছতেই দু’জন অনুচর এসে তাজের পাশে দাঁড়ালো।
বনহুর লাফ দিয়ে নেমে পড়তেই অনুচরদ্বয় তাজের লাগাম টেনে ধরলো।
বনহুর যখন তাজের পিঠের দূর হতে আগমন করতো তখন তাজ এক নতুন উদ্যমে পথ চলতো। বনহুর নেমে পড়লেও তাজের চলার সে উন্মাদনা মিটতোনা যেন। চুপ করে দাঁড়িয়ে পড়লেও সম্মুখের পা দিয়ে মাটিতে ক্রমাগত আঘাত করতো।
যতক্ষণ না তাজকে ধরতো ততক্ষণ তাজ অস্থিরভাবে এই রকম মাটিতে আঘাত করতো।
বনহুর তাজের পিঠ থেকে নেমে আস্তানায় প্রবেশ করলো।
অনুচরদ্বয় তাজকে নিয়ে টহল দিতে দিতে চলে গেলো তাজের বিশ্রাম কক্ষে।
বনহুর আস্তানায় প্রবেশ করতেই তার পাহারারত অনুচরগণ কুর্ণিশ জানিয়ে সরে দাঁড়াতে লাগলো।
গহন বনের মধ্যে একটা বিরাট পাথর স্কুপের আড়ালে বনহুরের আস্তানায় প্রবেশের মুখ।
বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই–ঐ পাথর স্তূপের ওপাশে কি আছে।
পাথরটার গায়ে চাপ দেবার একটা যন্ত্র আছে–সেটাতে চাপ দিলেই ধীরে ধীরে পাথরটা সরে যায় এক পাশে। বেরিয়ে পড়ে একটা সুড়ঙ্গ মুখ, এটাই বনহুরের আস্তনার প্রবেশপথ।
বনহুর এগুতেই নুরী ছুটে এলো খুশিতে উচ্ছল তার চোখমুখ। বনহুরের দক্ষিণ হাতখানা চেপে ধরে বললো–কোথায় ছিলে আজ রাতে। কত কাজ আমার, ঠিক আছে বলো?
কাল রাতে সবাই তো আস্তানায় ছিলো, শুধু ছিলেনা তুমি।
বনহুর এগিয়ে চললো।
নূরী পিছন পিছন চলতে চলতে বললো–আমার কথার জবাব দিচ্ছেনা কেনো হুর?
চলতে চলতে বললো বনহুর–বললাম তো কাজ ছিলো!
রহমানকেও তো কিছু বলে যাওনি হুর?
না, আমার বিশেষ কোন কাজ ছিলো।
কথা বলতে বলতে বনহুর আর নূরী বনহুরের বিশ্রাম কক্ষে এসে পৌঁছলো।
বনহুর ড্রেস খুলতে খুলতে বললো–এখনও কৈফিয়ৎ নূরী? একটু থেমে বললো আবার তোমার মনিকে নিয়ে এখনতো বেশ আছো? তবুও আমাকে,
হাঁ, তবুও তোমাকে আমি কোথায়ও যেতে দেবো না হুর।
এখনও তুমি পূর্বের ন্যায় ছেলেমানুষী করবে?
ছেলেমানুষী নয় হুর, আমি চাইনা তুমি আমাকে না বলে কোথাও যাও। বলো আর যাবেনা। কোথাও? নূরী বনহুরের জামার আস্তিন চেপে ধরে।
হেসে বলে বনহুর–আচ্ছা তাই হবে।
সত্যি কথা দিচ্ছো তো?
বনহুর নূরীর গালে আংগুল দিয়ে মৃদু আঘাত করে বলে– হাঁ সত্যি।
বনহুরের জামার বোতাম খুলে দিতে দিতে হাসে নূরী।
বনহুর বলে–তোমার মনি কোথায়?
নূরী বলে–ঘুমাচ্ছে।
আর তুমি এত ভোরে জেগে উঠেছে, তোমার মনিকে ছেড়েই?
এমন সময় নূরীর সহচরী জেরিনা এসে দাঁড়ায়! বনহুরকে কুর্ণিশ জানিয়ে বলে সে–সর্দার, নূরী গোটা রাত ঘুমায়নি।
বনহুর অবাক হয়ে তাকালো নূরীর মুখের দিকে, তারপর ফিরে চাইলো জেরিনার মুখে, বললো–কেনো?
জেরিনা কিছু বলতে যাচ্ছিলো, ধমক দিলো নূরী–তুই চলে যা জেরিনা, এখান থেকে।
জেরিনা একবার সর্দার ও নূরীর মুখে তাকিয়ে মুখ টিপে হেসে বেরিয়ে গেলো।
জেরিনা বেরিয়ে যেতেই বললো বনহুর–নুরী, আমি আজ জানতে চাই, তুমি কেননা ঘুমাওনি।
মাথা নত করলো নূরী।
বনহুর বাম হস্তে নূরীর চিবুক ধরে উঁচু করে তুলে বললো–সব বুঝতে পেরেছি। কিন্তু নূরী, তোমাকে তো মনিকে এনে দিয়েছি তবু কেনো তুমি–গম্ভীর হয়ে পড়লো বনহুর।
নূরী বললো–মনিকে দিয়ে তুমি কি সরে পড়তে চাও? হাঁ, আমি লক্ষ্য করেছি, যেদিন থেকে তুমি আমার কোলে মনিকে এনে দিয়েছো তারপর থেকে সব সময় আমাকে তুমি এড়িয়ে চলো।
বনহুর হঠাৎ যেন বিপদে পড়ে গেলো, যতই সে নূরী থেকে দূরে থাকতে চায়, ততই নূরী যেন তাকে অক্টোপাসের মত আকড়ে ধরতে যায়। কিন্তু শুধু কি নূরীই তাকে ভালবাসে, না এর পিছনে তার মনেরও প্রবল আকর্ষণ আছে। বনহুর শয্যায় এসে বসে পড়ে গভীরভাবে চিন্তা করে। নূরীই শুধু তাকে আকর্ষণ করে না, তারও অপরাধ আছে।
বনহুর নূরীর কাছে নিজকে দুর্বল মনে করে, বলে সে–নূরী, তোমাকে না বলে আমি কোথাও যাবোনা।
নূরী খুশি হয়, বনহুরের পাশে বসে ওর চুলে আংগুল বুলিয়ে দেয়। নূরীর কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ে বনহুর। নূরী অপলক নয়নে তাকিয়ে থাকে বনহুরের মুখের দিকে। ভোরের সূর্য তখন পূর্ব আকাশে অনেক উপরে উঠে গেছে।
*
অর্ধদগ্ধ সিগারেটটা এ্যাসট্রেতে নিক্ষেপ করে আর একটি সিগারেটে অগ্নি সংযোগ করে বললেন আহম্মদ সাহেব–নাহার মঞ্জিল। দস্যু বনহুরকে বন্দী করবার বিরাট একটা ফাঁদ এখানে পাতা হয়েছে। শত শত সশস্ত্র পুলিশ ফোর্স এই নাহার মঞ্জিলের গোপন স্থানে লুকিয়ে রয়েছে। এবার যত বুদ্ধিমানই সে হোক, কিছুতেই এ ফাঁদ থেকে উদ্ধার পাবে না।
মিঃ জাফরীর চোখমুখে ক্রুদ্ধভাব ঝরে পড়ছে, তিনি গম্ভীর কণ্ঠে বললেন–এবার বনহুর কিছুতেই পুলিশ বাহিনীর হাত থেকে পরিত্রাণ পাবে না। মিঃ আহম্মদ, সত্যি আপনার দক্ষ বুদ্ধি কৌশলের কাছে আমিও হেরে গেলাম।
মিঃ আহম্মদ সিগারেট থেকে এক মুখ ধোয়া সম্মুখের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বললেন–আজ চার দিন যাবত নাহার মঞ্জিল আমার পুলিশ বাহিনী দস্যু বনহুরকে গ্রেপ্তারের জন্য বিপুল আগ্রহ নিয়ে প্রতিক্ষা করছে। আমি চব্বিশ দিন যাবত ঐ নাহার মঞ্জিলে নানা কৌশলে পুলিশ বাহিনী লুকিয়ে রাখবার গোপন স্থান আবিস্কার করেছি।
আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ মিঃ আহম্মদ। বললেন মিঃ জাফরী।
মিঃ আহম্মদ বললেন–এবার অতি গোপনে এ কাজ আমি করেছি, এমন কি দুদিন পূর্বেও আপনিও জানতেন না, আমি কোথায় কি করেছি।
এবার নিশ্চয়ই আমাদের প্রচেষ্টা সার্থক হবে।
হাঁ মিঃ জাফরী, দস্যু বনহুরকে গ্রেফতার না করে এবার আমি বিশ্রাম গ্রহণ করবো না। চলুন, আজ নাহার মঞ্জিলটা একবার স্বচক্ষে দেখে আসবেন। দেখুন, অতি গোপনে ওখানে যেতে হবে। আপনি আর আমি ছাড়া কেউ জানেনা, আর জানে আমার কিছুসংখ্যক পুলিশ ফোর্স। দস্যু বনহুরকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হলে এদের আমি পুরস্কৃত করবো। শুধু পুরস্কৃতই নয়, উপাধিও লাভ করবে তারা।
আরও কিছুক্ষণ মিঃ আহম্মদ ও মিঃ জাফরীর মধ্যে গোপন আলোচনা চলার পর মিঃ আহম্মদ বললেন–এবার চলুন, নাহার মঞ্জিলটা দেখে আসবেন।
অতি গোপনে বেরিয়ে পড়লেন মিঃ আহম্মদ এবং মিঃ জাফরী।
*
কান্দাই শহরের শেষ প্রান্তে দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে নাহার মঞ্জিল অবস্থিত। সেকালের কোন সৌখিন নবাবজাদা সখ করে নির্জন স্থানে এই মঞ্জিলটা তৈরি করেছিলেন। লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় হয়েছিলো এই মঞ্জিল গড়ে তুলতে। প্রায় এক মাইল নিয়ে এ বাড়িটা। অসংখ্য কুঠরী আর কক্ষে ঘেরা একটি রঙমহল। রঙমহলের সে জৌলুস যদিও আজ আর নেই তবু মানবচক্ষু স্থির হয়ে যায় রঙমহলের কারুকার্য খচিত দেয়াল, দৃঢ় প্রাচীর আর গেটের দিকে তাকিয়ে।
বিরাট বিরাট অশ্বথ বৃক্ষে আর বট বৃক্ষে ছেয়ে গেছে আজ সেকালের নাহার মঞ্জিল। কোথাও বা ছাদ ধসে পড়েছে, কোথাও বা দেয়াল ভেঙে পড়েছে। কোথাও ঠিক পূর্বের ন্যায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে দেয়ালগুলো।
এ বাড়িটার মধ্যে কেউ প্রবেশ করলেই বাইরে বেরিয়ে আসা অত্যন্ত কঠিন। কোথায় পথ বা দরজা বোঝা যায় না।
নাহার মঞ্জিলের অর্ধেকটা আজ মাটির নিচে চলে গেছে। তবু যতটুকু জেগে রয়েছে মাটির বুকে, তাই মনে হয় যেন একটা পাহাড়। হার মঞ্জিল একটা দেখবার মত জিনিষ ছিলো এক কালে।
আজ সেই নাহার মঞ্জিল একটা ভূতুড়ে বাড়ি বা পোড়া-বাড়িতে পরিণত হয়েছে। ভুলেও কোন পথিক এ পথে পা বাড়ায় না। যদিও এখনও এখানে দেখবার মত অনেক কিছুই বিদ্যমান রয়েছে, তবু একটা অজানা ভয় সদা-সর্বদা বিরাজ করছে এই বাড়িতে প্রবেশ করলে আর বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে না। সেই কারণেই জনগণ এই মঞ্জিলটার নাম শুনলে আতঙ্কে শিউরে উঠে। ভুলেও কোনদিন এ বাড়ি দেখবার জন্য ওদিকে যায় না, বা সখ করে না।
নাহার মঞ্জিলের বিরাট এক কাহিনী আছে। যে কাহিনী এখন কান্দাই এর লোকের কাছে রূপকথার মতই মনে হয়। নবাব জামরুদী ছিলেন সেকালের একজন রাজা-মহারাজার মত প্রতাপশালী জমিদার। কান্দাই শহরের বুকে ছিলো তার প্রবল আধিপত্য। যেমন রাগী তেমনী খেয়ালী মানুষ ছিলেন তিনি। জীবনে কোন নারীকে জামরুদী বিয়ে করেননি। কিন্তু তার বিশ্রামাগারে নারীর কোন অভাব ছিলোনা। জামরুদী সপ্তাহে এক দিন নগর ভ্রমণে বের হতেন। সঙ্গে থাকতো দুইজন সহচর আর অসংখ্য দেহরক্ষী। শহরের যে কোন মেয়ে তার নজরে পড়তো, তাকে তার চাই।
জামরুদীর ইংগিত পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার দেহরক্ষীর দল সেই অসহায় নারীকে জোরপূর্বক ধরে নিয়ে যেতো। এমনি ছিলো জামরুদীর খেয়াল।
জামরুদীর অত্যাচারে নগরবাসী সদা আতঙ্কে কাল কাটাতো। কিন্তু রক্ষক যদি ভক্ষক হয়। তাকে কে কি বলতে পারে! কাজেই সবাই নীরবে অশ্রু ফেলতো কিন্তু মুখে কোন কথা বলতে। পারতোনা।
দেশের নারীগণের এই চরম অবস্থা লক্ষ্য করে এক সাধক কন্যা–নাম তার নাহার, শপথ গ্রহণ করলো–যেমন করে হোক জামরুদীর কবল থেকে এই নারীকুলকে রক্ষা করবে সে।
নাহার ছিলো সাধক সুলতান আলীর কন্যা। অপূর্ব রূপসী ছিলো সে। নাহারকে জীবনে কোন পুরুষ দেখে নাই বা তার সঙ্গে কথা বলেনি! নাহারের কণ্ঠস্বর ছিলো মধুর। চোখ দুটি ছিলো অদ্ভুত মায়াময়।
এই নাহারের প্রাণ কেঁদে উঠলো শত শত মা-বোনদের জন্য। গভীরভাবে চিন্তা করতে লাগলো–কেমন করে রক্ষা করা যায় এই অবলা নারীগণকে। আজ পর্যন্ত কত শত নারীর জীবন বিনষ্ট হয়েছে–আরও হবে, তার ইয়ত্তা নেই।
নাহার একদিন সাধক সুলতান আলীর কাছে মনের কথা ব্যক্ত করলো বাবা, কি করে দেশের নারীগণকে শয়তান নবাব জামরুদীর কবল থেকে রক্ষা করা যায়?
কন্যার কথায় সুলতান আলীর যেন ধ্যান ভঙ্গ হলো। তাই তো! তিনি দিবারাত্রে খোদার ইবাদত নিয়ে মশগুল থাকেন কিন্তু দেশের নবাব দিনের পর দিন কি অন্যায় অবিচার করে যাচ্ছেন সেদিকে খেয়াল করেন না। কন্যার কথায় তার চক্ষু খুলে যায়। তিনি বলেন–মা, তুমি ঠিক বলেছো। হাঁ, এ চিন্তা এখনও আমি করিনি। সত্যি আমি ভুল করেছি মা। কিন্তু কি উপায় আছে। জামরুদীর কবল থেকে দেশের নারীগণকে রক্ষা করার?
বাবা, কোন কি উপায় নেই?
না মা বড় পিশাচ্ এই নবাব। কোন বাধাই তাকে দমন করতে পারবে বলে মনে হয় না। রক্ষক হয়ে যদি সে ভক্ষক হয়, কি করা যায় বল?
বাবা, আমি ওকে দমন করবো। দীপ্ত কণ্ঠে বলে নাহার।
সঙ্গে সঙ্গে সাধক বাবাজীর মুখ বিবর্ণ ফ্যাকাসে হয়, বললেন–মা, এ তুই কি বলছিস? আজ আঠারো বছর ধরে তোকে আমি লুকিয়ে রেখেছি? শুধু তোরই জন্য আমি আজ সন্ন্যাসী হয়ে বনে বনে লুকিয়ে রয়েছি। শুধু তোরই জন্য…ঐ ঐ লম্পট জামরুদীর জন্য…
বাবা!
হাঁ মা, আজ আমি সন্ন্যাসী হয়েছি শুধু তোর কারণে। জানতাম, দেশে থাকলে তোকে আমি জামরুদীর হাত থেকে রক্ষা করতে পারবোনা।
বাবা, বাবা তুমি আমার জন্য…
হাঁ, নাহার শুধু তোর জন্য আজ আমি দেশত্যাগী সন্ন্যাসী। বন আজ আমার আশ্রয় স্থান। বনের ফল আমার খাদ্য। মাটি আমার বিছানা…সব, সব তোর জন্যই আমি বেছে নিয়েছি। নাহার, তোর মাকেও ঐ জামরুদী ধরে নিয়ে গিয়েছিলো, তুই তখন দুই বছরের শিশু।
বাবা!
মা, আমি তখন জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছিলাম, স্ত্রী গেলো তাও সহ্য করলাম কিন্তু ভবিষ্যতের একটা ভয়ঙ্কর রূপ ভেসে বেড়াতে লাগলো আমার চোখের সম্মুখে। তোর ভবিষ্যত ভেবে আমি তোকে বুকে করে পালিয়ে গেলাম রাতের অন্ধকারে। কিন্তু হাঁ তোর মাকে জামরুদী ধরে নিয়ে গিয়েছিলো সত্য, কিন্তু তাকে জামরুদী পায়নি। ঘোড়ার পিঠ থেকে নদীর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে অতলে তলিয়ে গিয়েছিলো, আর সে ভেসে উঠেনি।
বাবা, এ কথা তুমি কেমন করে জানলে? আমার মা জামরুদীর কবল থেকে রক্ষা পেয়েছিলো?
আমার এক পরম আত্নীয় পিছু নিয়েছিলো–উদ্দেশ্য ছিলো তোর মাকে রক্ষা করতে পারে কি না। সেও আর একটি ঘোড়ার পিছু নিয়েছিলো, কিন্তু তোর মা নদীবক্ষে নিমজ্জিত হবার পর সে আর এগোয় নি। গাছের আড়াল থেকে সব লক্ষ্য করছিলো–ফিরে এসে সে শপথ করে বলেছিলো তোর মায়ের এই শেষ পরিণতির কথা। বাষ্পরুদ্ধ হয়ে এলো সাধক বাবাজীর কণ্ঠ। চোখ মুছে আবার বললেন–এক সপ্তাহ পর একটা লাশ পাওয়া গিয়েছিলো নদীবক্ষে। ভীড় ঠেলে আমিও গিয়েছিলাম সেদিন ঐ লাশটা দেখতে, তোকে কোলে করে। হাঁ, আর কেউ না চিনতে পারলেও আমি চিনতে পেরেছিলাম তাকে। এক সঙ্গে বিশ বছর ধরে ঘর করেছিলাম আর তাকে চিনবোনা। যদিও তোর মার দেহ পঁচে গলে যাবার মত হয়েছিলো–তবু চিনেছিলাম।
কথা বলতে বলতে আনমনা হয়ে যায় সাধক বাবাজী। সুপক্ক কেশ গুফে ঢাকা মুখখানা অসম্ভব বিষাদময় হয়ে উঠেছিলো সেদিন তার।
কিন্তু নাহারের চোখ দুটো কেমন যেন উজ্জ্বল মনে হয়েছিলো, অস্ফুট কণ্ঠে বলেছিলো নাহার–বাবা, আমি এই জামরুদীকে সায়েস্তা করবো।
শিউরে উঠে বলেছিলো সাধক বাবাজী–সে পাপাচারের সম্মুখ থেকে তোকে সরিয়ে রেখেছি অতি কষ্টে, অতি সাবধানে আর তুই তাকে শায়েস্তা করবি-বলিস কি মা!
দীপ্ত কণ্ঠে বলেছিলো নাহার–হাঁ, আমি ওকে সায়েস্তা করবো। বাবা, তুমি আমাকে অনুমতি দাও।
সাধক বাবাজী শেষ পর্যন্ত কন্যা নাহারকে অনুমতি না দিয়ে পারেননি।
আশ্চর্য এই নাহার। নারী হয়ে নারীর অবমাননা সে কিছুতেই সহ্য করতে পারলোনা। পিতার অনুমতি নিয়ে একদিন নাহার জামরুদীর সম্মুখে গিয়ে দাঁড়ালো। সেদিন সে অপূর্ব বেশভূষায় সজ্জিত হয়েছিলো।
নাহার ছিলো অদ্ভুত সুন্দরী। তারপর এই মনোহারী পোশাক পরিচ্ছদে তাকে খুবই সুন্দর লাগছিলো। স্বর্গের অপ্সরীর চেয়ে কোন অংশে কম ছিলোনা সে।
জামরুদী নাহারের রূপে তন্ময় হয়ে গেলো। নিজের চোখ দুটিকে সে বিশ্বাস করতে পারলোনা, তার সম্মুখে দন্ডায়মান নারীমূর্তি মানবী, না দেবী বুঝতে পারলোনা সে।
জামরুদী তখন তার বাগানবাড়িতে পায়চারী করছিলো।
সেই সময় নাহার গোপনে বাগানে প্রবেশ করে জামরুদীর সম্মুখে এসে দাঁড়ালো।
বিস্ময় বিস্ফারিত নয়নে জামরুদী দেখলো নাহারকে।
নাহারের ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির রেখা। চোখে ইংগিতপূর্ণ ভাবময়ী চাহনী। জামরুদীর হৃদপিন্ড বিদ্ধ করলো সে দৃষ্টিশক্তি।
জামরুদী যেন সম্বিত হারিয়ে ফেললো, বললো–কে তুমি?
নাহার এসেছে নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে শত শত নারীর ইজ্জত রক্ষার্থে। সেও ভুলে গেলো গোটা পৃথিবীটাকে, নাহারের চোখের সম্মুখে ভাসছে অগণিত মা-বোনদের করুণ মুখচ্ছবি। তাদের হৃদয়বিদারক মর্মস্পর্শী আর্তনাদ শুনতে পাচ্ছে সে কানে। নাহার বললো–আমি তোমার প্রেয়সী নাহার।
নাহারের সুমধুর কণ্ঠস্বরে মোহগ্রস্তের মত জামরুদী অস্ফুট ধ্বনি করে উঠলো–তুমি আমার প্রেয়সী?
হাঁ…বললো নাহার!
জামরুদী জ্ঞানশূন্যের মত দুই হাত বাড়িয়ে ধরতে গেলে নাহারকে। চোখেমুখে তার কুৎসিৎ লালসাপূর্ণ ভাব!
জামরুদী ধরতে গেলে কয়েক পা পিছিয়ে গেলো নাহার। বললো সেনা না, তুমি আমাকে ধরোনা। শোন।
জামরুদী থমকে দাঁড়ালো, মুহূর্ত বিলম্ব যেন তার সইছেনা। নাহারকে কাছে পাবার জন্য উম্মাদ হয়ে উঠলো সে।
বললো নাহার–আমার তিনটি বাসনা পূর্ণ করলে তবেই তুমি আমাকে পাবে।
বলো, কি তোমার বাসনা? বললো জামরুদী।
নাহার বললো–প্রথম হলো–সাতক্ষীরা পাহাড়ের ধারে মস্ত বড় একটি বাড়ি তৈরি করতে হবে–নাম নাহার মঞ্জিল। দ্বিতীয়–তুমি কোন নারী দেহকে স্পর্শ করতে পারবেনা। তৃতীয় হলো–তুমি আমায় বিয়ে করবে।
জামরুদী তখন নাহারের রূপে এতো তন্ময় হয়ে পড়েছে যে, দুনিয়া তার কাছে সামান্য তুচ্ছ বলে মনে হচ্ছে। নাহারই এখন যেন তার কাছে সব। সব ছাড়তে সে বাধ্য হবে যদি নাহারকে পায়।
জামরুদী শেষ পর্যন্ত নাহারের বাসনা পূর্ণ করেছিলো! কান্দাই শহরের অনতিদূরে সাতক্ষীরা পাহাড়ের পাদমূলে গড়ে দিয়েছিলো সে নাহার মঞ্জিল। আর কোন দিন জামরুদী ভুল করেও কোন নারীদেহ স্পর্শ করেনি। নাহারের জন্য লস্পট জামরুদী সাধু বনে গিয়েছিলো। শেষ পর্যন্ত নাহার জামরুদীকে বিয়ে করেছিলো কিন্তু জামরুদীর বাসরকক্ষে সে প্রবেশ করেনি–আত্মহত্যা করে সে ফাঁকি দিয়ে পালিয়েছিলো।
জামরুদীকে ফাঁকি দিয়ে নাহার পরপারে চলে গেলেও জামরুদী আর কোনদিন ভুলতে পারেনি নাহারকে। নাহারও এটা বুঝতে পেরেছিলো জামরুদী তাকে এতো ভালবেসে ফেলেছে। যার জন্য সে তার সব ঐশ্বর্য নিঃশেষ করে তৈরি করেছিলো নাহার মঞ্জিল। সব সে ত্যাগ করেছে নাহারের জন্য। নাহার জানতো, যে তার জন্য সব ত্যাগ করতে পারলো, এমন কি সমস্ত ঐশ্বর্য যে নিঃশেষ করেছিলো সে কোনদিন তাকে ভুলতে পারে না। নিশ্চয়ই জামরুদী তার শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়বে, তখন সে সাধু বা সন্ন্যাসী হয়ে যাবে। লম্পট হতে আর পারবে না, পারবে
সে আর কোন কুকর্ম করতে। কারণ, নাহারকে পাবার জন্য জামরুদী তার যথাসর্বস্ব দিয়ে গিয়েছিলো নাহার মঞ্জিল।
নাহার যখন জামরুদীকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেলো তখন জামরুদী নিঃসম্বল পথের ভিখারীর চেয়েও অসহায়। বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, এমন কি দাসদাসী কেউ ছিলোনা তখন তার সম্বল একমাত্র নাহার মঞ্জিল জামরুদীর আশ্রয় স্থান।
জামরুদী নাহার মঞ্জিলে কবর দিলো নাহারকে।
তারপর বহুদিন জামরুদীকে কেউ দেখেনি। হঠাৎ একদিন ভোরে লোকজন দেখলো নাহারের কবরের পাশে পড়ে আছে এক জটাজুটধারী পাগলের মৃত দেহ।
সবাই দেখলো, এ মৃতদেহ অন্য কারো নয়–নবাব জামরুদীর।
একদিন যে জামরুদীর প্রচন্ড দাপটে নগরবাসী থরথর করে কাঁপতো, কান্দাই এর নারীগণ যে জামরুদীর কবল থেকে রক্ষা পাবার জন্য আতঙ্কগ্রস্ত থাকতো, সেই জামরুদীর শেষ পরিণতি দেখে অনেকেরই চোখে অশ্রু এসেছিলো।
জামরুদীর হৃদয়ের বিন্দু বিন্দু রক্ত দিয়ে গড়া নাহার মঞ্জিল আজ ভুতুড়ে বাড়ি। ভুলেও কোন। মানুষ সেদিকে পা বাড়ায়না। কান্দাই এর লোক নাহার মঞ্জিলের নামে শিউরে উঠে।
আজ সেই নাহার মঞ্জিল দস্যু বনহুরকে বন্দী করবার ফাঁদ হিসাবে কাজে লাগাচ্ছেন মিঃ আহম্মদ।
নাহার মঞ্জিলের প্রতিটি গোপনকক্ষে লুকিয়ে আছে শত শত পুলিশ ফোর্স। রাইফেল, পিস্তল, বন্দুক, নানা রকম অস্ত্রে সজ্জিত পুলিশ বাহিনী।
মিঃ আহম্মদ মিঃ জাফরীকে সব দেখালেন।
মিঃ জাফরী অবাক হয়ে দেখলেন–নাহার মঞ্জিলের অভ্যন্তরে কি দুর্গম, কি ভয়ঙ্করভাবে ফাঁদ পেতেছেন মিঃ আহম্মদ। মিঃ জাফরী তাঁকে আন্তরিক ধন্যবাদ না জানিয়ে পারলেন না।
মিঃ আহম্মদ বললেন–বাইরে থেকে কেউ বুঝতে পারবে না, এই নাহার মঞ্জিলে কোন প্রাণী আছে।
হাঁ, আপনার কথা ঠিক। বাইরে থেকে সম্পূর্ণ একটি পোড়া বাড়ি বলে মনে হচ্ছে। কোন জনমানব এদিকে পা দিয়েছে বলে মনে হয় না। অদ্ভুত আপনার বুদ্ধি-কৌশল মিঃ আহম্মদ। কিন্তু সুচতুর দস্যু কোন রকমে না টের পেয়ে থাকে।
না, সে কিছুতেই টের পাবে না। এবার আমি তাকে ফাঁদে ফেলবোই। মিঃ জাফরী, আজ রাতে দস্যু বনহুর এ বাড়িতে আসবেই।
তাহলে…
তাহলে আজ আমাদেরও এখানে, এই নাহার মঞ্জিলে থাকতে হবে। মিঃ জাফরী, আপনি রিভলভার নিয়ে প্রস্তুত হয়ে এসেছেন নিশ্চয়ই?
হাঁ, আমি প্রস্তুত হয়ে এসেছি।
মিঃ আহম্মদ ও মিঃ জাফরী এবার নাহার মঞ্জিলের একটি চোরা কক্ষে আশ্রয় নিলেন।
যে কক্ষে মিঃ আহম্মদ ও মিঃ জাফরী লুকিয়ে রইলেন সেই কক্ষের পাশেই মস্ত বড় হলঘর। এই হলঘরের মেঝেতেই রয়েছে নাহারের কবর।
যে নারী একদিন শত শত নারীকে উদ্ধারের জন্য নিজের জীবন বিনষ্ট করেছিলো, নিজকে উৎসর্গ করে দিয়েছিলো মৃত্যুর কোলে সেই নাহারের কবরের অদূরে লুকিয়ে রইলেন দু’জন পুলিশ। ইন্সপেক্টার। উভয়েরই হস্তে গুলীভরা রিভলভার।
মিঃ আহম্মদের বাম প্যান্টের পকেটে রয়েছে হুইসেল। এই হুইসেলের এক ফুঙ্কারে সমস্ত পুলিশ বাহিনী চারদিক থেকে বেরিয়ে আসবে, ঘেরাও করে ফেলবে নাহারের কবরস্থান।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। নাহার মঞ্জিলের চারিপাশে ঘনীভূত হয়ে আসছে রাতের অন্ধকারে।
*
বিপুল আকাঙ্খা নিয়ে মনিরা প্রতীক্ষা করছে স্বামীর। মনিরার হৃদয়ে আজ এক অদ্ভুত অনুভূতি। একটা কেমন যেন উম্মাদনা তার সমস্ত অন্তরটাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। গোটা দিনটাই আজ মনিরার কেটেছে অস্থিরতার মধ্যে।
মরিয়ম বেগম মনিরার এ চঞ্চলতা লক্ষ্য করেছিলেন, তিনি এক বার বলেও ছিলেন–মনিরা, আজ ঐ দুষ্টটা আসবে বুঝি?
মৃদু হেসে বলেছিলো মনিরা–হয়তো আসতে পারে।
মামীমাকে আর কিছু বলবার সময় না দিয়ে নিজের ঘরে চলে গিয়েছিলো মনিরা, পাছে আর কোন প্রশ্ন করে বসেন তিনি।
নাহার মঞ্জিলের কথা কাউকে বলতে মানা করেছেন সাধক বাবাজী। স্বামীকে না বললে নয়, তাই বলেছে মাত্র সে। তবু মনিরা সে কথা বলে নি, বলতে নিষেধ আছে সেকথা।
কিন্তু দিনটা হেন কাটতে চাইছে না। রোজ কোথা দিয়ে কোথায় সময় কেটে যায়, আর আজ সন্ধ্যা হবে কখন।
মনিরা আজ অনেক কিছু নিজ হস্তে রান্না করেছে।
মরিয়ম বেগম লুকিয়ে লুকিয়ে সব লক্ষ্য করলেও সামনে আসেননি। স্বামীর কথায় কে না লজ্জা পায়। সে তো এখানে থাকে না; আসে বহুদিন পর লজ্জা কাটবে কি করে।
মনিরাকে এ সব করবার সুযোগ দিয়ে সরে থাকেন মরিয়ম বেগম।
অফুরন্ত আনন্দ আর খুশিখুশি ভাব নিয়ে মনিরা এ সব তৈরি করলো আজ।
নানা রকমের খাবার নিজের ঘরে টেবিলে সাজিয়ে রেখে, নিজে খুব করে সেজে নিলো শুধু স্বামীই আসবে না, আজ ফিরে পাবে সে তার নরকে।
মনিরা অফুরন্ত উম্মাদনা নিয়ে ঘরবার করছে। কখনও রেলিং এর ধরে, কখনও মুক্ত জানালায়, কখনও বা বাগানের পাশে গিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলো সে। না জানি কখন কোন মুহূর্তে আসবে তার আকাঙ্খার জন।
আজ নিজের হাতে মনিরা ঘর সাজিয়েছে।
বনহুরের ছোটবেলার ফটোখানায় নতুন মালা পরিয়ে বার বার দেখছে। কেননা যে ঐ ছোট্ট মুখখানা আজ মনিরাকে বার বার আকর্ষণ করছে।
স্বামীর ছোট বেলার ছবির পাশেই নিজের ছোট মুখখানা বড় মিষ্টি লাগছে আজ। পাশাপাশি দুটি মুখ যে মুখ দুটি কোনদিন পৃথক হবার নয়।
নির্বাক নয়নে তাকিয়ে আছে মনিরা ছবিটার দিকে।
মরিয়ম বেগম হঠাৎ কক্ষে প্রবেশ করে থমকে দাঁড়ালেন; হেসে বললেন–মনিরা!
চমকে ফিরে তাকালো মনিরা–মামীমা আমায় ডাকছে?
হাঁ, আমি একটু খালেদাদের বাড়ি যাচ্ছি, কিছু পরেই ফিরে আসবো। সরকার সাহেব আমার সঙ্গে যাবেন।
মনিরা বুঝতে পারলো, তাকে সুযোগ দিয়ে সরে পড়তে চান মামীমা। কারণ, ও এলে অসুবিধা বোধ করতে পারে। মায়ের উপস্থিতিতে তারা অবাধে মিশতে পারবেনা ভেবেই তিনি বোন খালেদার বাড়ি বেড়াতে যাচ্ছেন।
মনিরা একটু হেসে বললেন–দেরী করোনা যেন।
না দেরী করবো না–যাবো আর আসবো। মনিরার মুখের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বেরিয়ে যান মরিয়ম বেগম।
মনিরা যা ভেবেছিলেন তাই সত্যি মরিয়ম বেগম বুঝতে পেরেছিলেন, আজ সকাল সকাল মনিরা আসবে। হয়তো কোন অন্যরূপ নিয়েই সে আসবে। কাজেই মায়ের সামনে অতোটা কিছু। পারবে না, হয়তো নিজকে প্রকাশ করতে লজ্জা বোধ করবে।
কোনদিন সন্ধ্যা রাতে সে আসেনি। কোনদিন মনিরা স্বামীকে পায়নি এসময়ে কাছে। আহা। বেচারী মনিরা ওর কি সখ হয়না স্বামীকে খাওয়াবার বা পাশে বসে দুটো ভালমন্দ কথাবার্তা বলবার।
মরিয়ম বেগম সরকার সাহেবকে বললেন–ড্রাইভারকে বলুন গাড়ি বের করতে, খালেদাদের বাড়ি যাবো।
সরকার সাহেব হঠাৎ মরিয়ম বেগমের মুখে বেড়াতে যাবার কথা শুনে আজ অবাক না হয়ে পারলেন না। কারণ তিনি কোনদিন দেখেন নাই নিজ মনে বেগম সাহেবা কোথাও বেড়াতে যেতে চেয়েছেন।
সরকার সাহেব বিস্মিত হলেও মুখে কোন কথা বললেন না। তিনি চলে গেলেন ড্রাইভারকে গাড়ি বের করার আদেশ দিতে।
মরিয়ম বেগম চলে গেলেন খালেদার বাড়ি বেড়াতে।
ঠিক তার পরমুহূর্তেই কক্ষে প্রবেশ করলো নকীব।
মনিরা বললো–কি খবর নকীব?
আপামনি, কে একজন রাজকুমার আপনার সাক্ষাৎ চায়।
রাজকুমার!
হাঁ খুব সুন্দর দেখতে, গায়ে রাজার মত চকচকে কাপড়। আমি বললাম, বাড়িতে কেউ নেই–আম্মাও নেই, সরকার সাহেবও নেই। তবু বললেন রাজকুমার–তোমার আপামনিও নেই?
আপামনি! আমার কথা জানলো সে কি করে? তুই বুঝি বলেছিস?
না, আমি কোন কথাই বলিনি, সত্যি করে বলছি।
কিন্তু আমি কি করে যাবো? যা গিয়ে বল আজ দেখা হবেনা।
নকীব চলে গেলো, কিন্তু একটু পরে ফিরে এসে বললো নকীব–আপামনি, রাজকুমার এই চিঠিটা দিলো, বললো তোমাকে দিতে।
অসময়ে এ ধরনের বিরক্তি ভালো লাগলো না মনিরার। কে এই রাজকুমার-এতো বড় সাহস, তার সঙ্গে দেখা করতে চায়। নকীবের হাত থেকে চিঠিখানা নিয়ে মেলে ধরে চোখের সামনে। সঙ্গে সঙ্গে মনিরার চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। চিঠিতে লেখা আছে–
এসেছি, চলে এসো।
‘বনহুর’।
বললো মনিরা–আচ্ছা, গিয়ে বল্ আমি আসছি!
নকীব মনে করলো, আপামনির পরিচিত কেউ হবে, তাই সে বিলম্ব না করে চলে গেলো নীচে।
বনহুর আজ নতুন ড্রেসে সজ্জিত হয়ে এসেছে। শরীরে তার রাজকীয় পোশাক। চোখে। চশমা, নকল গোফ শোভা পাচ্ছে নাকের নিচে। মাথায় একটা নতুন ধরনের ক্যাপ। ইলেকট্রিক আলোতে বনহুরের পোশাকগুলি ঝক ঝক করছে।
মনিরা এসে দাঁড়ালো বনহুরের সম্মুখে।
প্রথমে একটু হকচকিয়ে গেলেও সঙ্গে সঙ্গে চিনতে পারলো স্বামীকে। খুশিতে দীপ্ত হয়ে উঠলো মনিরার মুখমন্ডল।
উভয়ে তাকিয়ে আছে উভয়ের দিকে।
নকীব অবাক হয়ে গেলো আপামনি, আপনি ওনাকে আপনি–হাঁ, আমি ওকে চিনি। আমাদের আত্মীয়। চলুন, উপরে চলুন। নকীবকে শোনাবার জন্যই স্বামীকে আপনি বলে সম্বোধন করলো মনিরা।
বনহুর আর মনিরা উপরে এসে বসলো।
মনিরা বললো–আজ এ ভাবে না এলে কি তোমার চলতোনা?
সন্ধ্যারাতে আসা কি সহজ আমার পক্ষে? বিলম্ব করোনা মনিরা, বহুদূর যেতে হবে।
তোমার জন্য কিছু খাবার তৈরি করে রেখেছি।
হাতঘড়ির দিকে তাকালো বনহুর বললো–ফিরে এসে খাবো।
একটুও মুখে দেবেনা?
না, চলো গাড়ি নিচে অপেক্ষা করছে।
মনিরা যখন রাজকুমারকে ঘরে নিয়ে এলো, তখন নকীবের মনে কেমন যেন একটু সন্দেহ জেগেছিলো। বিশেষ করে বেগম সাহেবা বাসায় নাই, এমতঅবস্থায় একটা অজানা লোককে– একেবারে আপামনির ঘরে…না, এ ঠিক একটা অভিসন্ধি নিয়ে এসেছে। নকীব কান পেতে সব শুনতে লাগলো।
বনহুর যখন মনিরাকে বলছিলো, চলো গাড়ি অপেক্ষা করছে, তখন নকীবের রাগে মুখ। কালো হয়ে উঠলো। নিশ্চয়ই কোন দুষ্ট লোক তার আপামনিকে ফুসলিয়ে নিয়ে যাবার জন্য এসেছে। দরজার পাশে পথরোধ করে দাঁড়িয়ে রইলো নকীব। কিছুতেই আজ আপামনিকে ওর সঙ্গে বাইরে যেতে দেবেনা–কিছুতেই না। রাজকুমার আর যেই হোক, নকীব খুব শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
মনিরার হাসির শব্দ ভেসে আসছে কক্ষমধ্য হতে, বলছে মনিরা–কতদূর সেই নাহার মঞ্জিল?
অনেক দূর, সেখানে পৌঁছতে রাত অনেক হবে।
তাহলে কখন ফিরে এসে খাবে?
যখন আসি, তখন খাবো।
একটু খাও।
না মনিরা, এখন কিছু খাবোনা। ফিরে এসে ক্ষুধা পাবে, তখন দু’জন মিলে খাবো।
চলো।
বনহুর আর মনিরা দরজায় এসে অবাক! দরজা বাইরে থেকে বন্ধ।
নকীব দরজা বন্ধ করে দিয়েছে বাইরে থেকে, যেতে দেবেনা সে আপামনিকে রাজকুমারের সঙ্গে।
মনিরা যখন দরজা ধরে টানাটানি করছে তখন নকীব বললো–আমি তোমাকে যেতে দেবোনা আপামনি। কিছুতেই না।
মনিরা অবাক হলো, বললো–সে কি!
হাঁ, আম্মা ফিরে না আসা অবধি তোমাদের আমি কিছুতেই বেরুতে দেবো না।
কেনো? কক্ষমধ্য হতে বললো মনিরা।
দরজার ওপাশ থেকে জবাব দিলো নকীব–তুমি রাজকুমারের সঙ্গে কোথায় যাবে?
হাসলো মনিরা–যেখানে খুশি।
তা হবেনা। বললো নকীব।
মনিরা আর বনহুর নকীবের কথায় মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে হাসলো। বললো মনিরা–নকীব সব গোলমাল করে ফেললো।
বনহুর বললো–চলো, ওদিকের জানালা দিয়ে পালাই।
কিন্তু আমি?
তোমাকে আমি পার করে নিচ্ছি।
ওরে বাবা, ওদিকে তাকালেই অমনি অজ্ঞান হয়ে যাবো।
এলো…মনিরার হাত ধরে বনহুর পিছন শার্শী দিয়ে বেরিয়ে কার্নিশের উপর এসে দাঁড়ালো।
অতি সাবধানে, কৌশলে মনিরাকে নিয়ে বনহুর এক সময় নেমে এলো গাড়ির পাশে।
ওদিকে নকীব দরজায় শিকল আটকে বসে রইলো দরজার পাশে।
বেশ কিছু সময় পর ফিরে এলেন মরিয়ম বেগম আর সরকার সাহেব।
নকীব তখন দরজায় ঠেস দিয়ে বসে বসে ঝিমুচ্ছে।
মরিয়ম বেগম এসে নকীবকে এভাবে দরজায় ঠেস দিয়ে বসে থাকতে দেখে অবাক হলেন, ব্যাপার কি বুঝতে না পেরে বললেন–একি! নকীব তুই এখানে? আমি তোকে খুঁজে মরছি!
মরিয়ম বেগমের কথায় ধড়মড় করে উঠে দাঁড়ালো নকীব, আমতা আমতা করে বললো– আপনি এসেছেন বেগম সাহেবা?
হাঁ, মনিরা কোথায়?
ঘরে।
তা এখানে দরজায় অমন করে বসে আছিস কেনো?
ঢোক গিলে বললো নকীব–ওদের ঘরে আটকে রেখেছি।
ওদের-কাদের?
ওই যে আপামনি আর কে একজন রাজকুমার না কে…
রাজকুমার?
হাঁ, লোকটা আপামনিকে নিয়ে পালাতে যাচ্ছিলো, আমি তাই ওদের দু’জনকে আটকে রেখেছি ঘরের মধ্যে…
নকীবের কথায় মরিয়ম বেগমের দু’চোখ কপালে উঠে, মুখখানা গম্ভীর বিবর্ণ হয়ে উঠে, বলেন তিনি-দরজা আটকে বসে আছিস কি হতভাগা বাবা। দরজা খোল, দরজা খোল দেখি।
নকীব দরজা খুলে দিলো।
কিন্তু একি! ঘরের মধ্যে ফাঁকা, লোক কোথায়?
মরিয়ম বেগম কক্ষমধ্যে প্রবেশ করে অবাক হলেন।
পিছনে নকীব, তার চোখেমুখে রাজ্যের বিস্ময়। যে কারণে সে দরজা বন্ধ করে পাহারা দিচ্ছিলো, তবু রাজকুমার তার আপামনিকে নিয়ে পালিয়েছে।
মরিয়ম বেগম নকীবের দিকে তাকাতেই হাউ মাউ করে কেঁদে উঠলো–আম্মা সাহেব, আমি প্রথমেই সন্দেহ করেছিলাম, রাজকুমার না কে একটা লোক এসে বললো, বাড়িতে কেউ আছে?
তুই কি বললি? প্রশ্ন করলেন মরিয়ম বেগম।
নকীব কাঁদতে কাঁদতে জবাব দিলো–আমি বললাম–আম্মা নেই সরকার সাহেব নেই…
মরিয়ম বেগম রেগে উঠলেন–মাথা আর মুন্ড, ও সব না বললে কি চলতোনা?
আমি কি অতশত জানি যে, লোকটা কুমতলব নিয়ে এসেছে!
তারপর কি বলেছিলি তুই?
বলেছিলাম, কেউ নেই, শুধু আপামনি আছে।
ঐ তো সর্বনাশ করেছিলি।
আমার ভুল হয়ে গেছে আম্মা সাহেব! লোকটা বললো, আমি রাজকুমার, তোমার আপামনির সঙ্গেই দেখা করতে চাই।
আর তুই মনিরাকে ডেকে নিয়ে গেলি বুঝি?
না, আমি এসে আপামনিকে সব বললাম, আপামনি তো কথাটা শুনে রেগে আগুন কোথাকার কে রাজকুমার, আমি কেনো যাবো তার সংগে দেখো করতে। আমি গিয়ে আপামনির কথাটা তাকে বললাম।
মরিয়ম বেগম অবাক হয়ে শুনছিলেন নকীবের কথাগুলো আর মনে মনে ভাবছিলেন, কেননা তিনি আজ বাইরে গেলেন। বাসায় থাকলে এমন তো হতো না। নকীবের কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনেছিলেন তিনি।
নকীব বলে চলেছে–রাজকুমার আমার কথা শুনে মুচকি হাসলো। একটা চিঠি লিখে আমার হাতে দিয়ে বললো, তোমার আপামনিকে দাও গে।
তারপর? অবাক কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন মরিয়ম বেগম।
আপামনিকে চিঠিটা এনে দিলাম, ছোট্ট একটু চিঠি। আপামনি চিঠিটা পড়ে বললেন-বলগে আসছি। জানেন আম্মা, আপামনি তক্ষুণি নিচে নেমে এলো রাজকুমারের কাছে। আমিও তার পিছনে পিছনে এলাম–কেউ তো আর নেই, তাই। আপামনি রাজকুমারকে দেখেই খুশিতে ডগমগ হলো।
নকীবের কথায় মরিয়ম বেগমের মুখ অনেকটা প্রসন্ন হয়ে এসেছে, বললেন–তারপর?
তারপর আপামনি আমাকে বললেন–ইনি আমাদের আত্মীয় হন, একে উপরে নিয়ে আয়। আপামনির কথা শুনে রাজকুমার খুশি হলো, আপামনির সংগে চলে এলো উপরে।
তাই নাকি?
হাঁ। বলে মাথা নত করলো নকীব, গলার স্বর নিচু করে বললো–আপামনি রাজকুমারের সংগে খুব হাসাহাসি–চুপ করে গেলো নকীব।
মরিয়ম বেগম বুঝতে পারলেন রাজকুমারটা কে। মনির ছাড়া কেউ নয় টের পেয়ে গেলেন তিনি। হেসে বললেন–রাজকুমার মনিরাকে নিয়েই ভেগেছে।
হাঁ আম্মা, সাহেবা। নকীব মরিয়ম বেগমের মুখে হাসির আভাষ দেখে বিস্মিত হলো। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে সে মনিব গৃহিণীর দিকে।
মরিয়ম বেগম বললেন–চিন্তার কোন কারণ নেই নকীব, রাজকুমার আমাদের আত্মীয়ই হয়!
কিন্তু…
ওরা তোকে অবাক করার জন্য পিছন জানালা দিয়ে কোথাও বেড়াতে গেছে, এই এলো। বলে।
এতোক্ষণে নকীবের মন থেকে যেন পাষাণ ভার নেমে যায়। আশ্বস্ত নয় নকীব।
মরিয়ম বেগম এগিয়ে গিয়ে টেবিল থেকে খাবারের ঢাকনা তুলে দেখলেন, একি! খাবারগুলি যেমনকার তেমনি আছে তো। তবে নিকটে কোথাও গেছে ওরা–এখনই ফিরে আসবে।
মরিয়ম বেগম টেবিলের খাবারগুলি আবার সুন্দর করে চাপা দিয়ে রাখলেন।
*
জনহীন পথ বেয়ে বনহুর আর মনিরার গাড়িখানা স্পীডে ছুটে চলেছে। ড্রাইভ করছে স্বয়ং বনহুর। পাশে বসে আছে মনিরা।
এসব পথে ইলেকট্রিক আলো না থাকলেও লণ্ঠনযুক্ত লাইট পোষ্ট ছিলো। আলো তেমন তীব্র না হলেও পথ পরিস্কার দেখা যাচ্ছিলো। গাড়ি চালাতে কোন কষ্ট হচ্ছিলোনা বনহুরের।
পথের দুই ধারে ঘন শালবৃক্ষগুলি নিস্তব্ধ প্রহরীর মত দাঁড়িয়ে আছে সোজা হয়ে। আকাশে অসংখ্য তারার মালা ফুটে উঠেছে। বাতাস বইছে সা সা করে।
বনহুরের ঠোঁটের ফাঁকে সিগারেটের আগুনটা জ্বল জ্বল করে জ্বলছে। মনিরা তাকিয়ে দেখছে মাঝে মাঝে স্বামীর মুখখানা। অস্পস্ট হলেও বড় সুন্দর লাগছে ওকে। মনিরার হদয়ে একটা অভূতপূর্ব আনন্দ নাড়া দিয়ে যাচ্ছে। তার মত স্বামীভাগ্য এ পৃথিবীতে বুঝি আর কারো হয়নি। কে বলে মনিরা অসুখী–কে বলে সে দুঃখী।
মনিরার মনে কত কথা উঁকি দিয়ে যাচ্ছে, একটির পর একটি করে। আজ কেনো যেন বার বার স্বামীর মুখখানাই দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে মনিরার, কেনো যেন মনে হচ্ছে একটু স্বামীর কোলে মাথা রেখে শুতে পারতো! একটু যদি হাতখানা রাখতো তার হাতের উপরে…একি! আজ এমন লাগছে কেননা। এতো কাছে রয়েছে স্বামী, তবু কেমন যেন ফাঁকা লাগছে, কেমন যেন দুরু দুরু করছে বুকের ভিতরটা। তবে কি নূরের জন্য এমন লাগছে তার!
উদাস ভাবে মনিরা তাকিয়ে আছে গাড়ির সম্মুখের দিকে।
বনহুর মনিরার মৌনভাব লক্ষ্য করে বললো–কি ভাবছো মনিরা?
স্বামীর কথায় সম্বিৎ ফিরে পায় মনিরা, বলে–আর কতদূর সেই নাহার মঞ্জিল?
এই তো প্রায় এসে গেছি। কিন্তু মনিরা, আমি বুঝতে পারছিনে এই নাহার মঞ্জিলে আসবার তোমার এতো সখ হলো কেনো?
বলছি, ও কথা বলবোনা। তুমি শুনতে চেওনা এখন।
তবে কখন বলবে?
নাহার মঞ্জিলে পৌঁছে.ঐ দেখো চাঁদ উঠেছে। মনিরা আংগুলি দিয়ে দেখিয়ে দেয় পূর্ব। আকাশটা।
বনহুর একবার তাকিয়ে দেখে নেয়, শালবনের শাখার ফাঁকে কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ উঁকি ঝুঁকি মারছে। বললো বনহুর–ভালই হলো নাহার মঞ্জিল কৃষ্ণপক্ষের চাঁদের আলোয় ঝলমল করে উঠবে। মনিরা, নাহার মঞ্জিল দেখতে তোমার কোন কষ্ট হবেনা।
হাঁ, চাঁদটা আমাদের আলোর কাজ করবে।
মনিরা!
বলো?
তুমি খেয়ে আসতে বলেছিলে কিন্তু না খেয়ে ভুল করেছি–বড্ড ক্ষুধা পেয়েছে।
সত্যি আমার খুব খারাপ লাগছে। কত রাতে ফিরবো তবেই খাবে।
না, ফিরতে তেমন বিলম্ব হবে না মনিরা। ফিরেই আমরা দুজন একসঙ্গে খাবো তখন।
এবার গাড়িখানা বেশ উঁচুনীচু পথ বেয়ে এগুতে লাগলো। ঝোপঝাড় আর আগাছা ভরা। পথের দু’পাশ। মাঝে মাঝে শিয়াল আর ফেউ আর ডাক শোনা যাচ্ছে।
মনিরা স্বামীর গা ঘেষে বসলো।
হেসে বললো বনহুর–ভয় পাচ্ছো?
না।
মনিরা মুখে না বললেও অন্তরে অন্তরে কেমন যেন একটা ভীত ভাব মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে লাগলো। যদিও স্বামী পাশে থাকতে তার কোন ভয় নেই, তবুও নারী মন একটুতেই চমকে উঠে।
মনিরার গলার স্বর লক্ষ্য করে হেসে বললো বনহুর–ভয় তো পাচ্ছেনা কিন্তু নাহার মঞ্জিলে। গিয়ে ভয় পেলে চলবে না কিন্তু?
মনিরা শুনেছিলো–এখানে নাহারের কবর আছে, নবাব জামরুদ এই কবরের পাশে একদিন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলো। কথাগুলো মনে হওয়ায় মনিরার মনের সাহস সব উবে গেলো। কর্পূরের মত। আগে তো এমন করে ভেবে দেখেনি, ভেবেছিলো নাহার মঞ্জিলে এমন কি আছে! কিন্তু এখন এসব কথা স্বরণ হতেই দুরু দুরু করে বুকটা কেঁপে উঠলো। বিশেষ করে রাতের বেলায় এটা কি ভাল হলো। কিন্তু তখনই ভেসে উঠলো হৃদয়ের ধন নূরের মুখখানা, সঙ্গে সঙ্গে সাধক বাবাজীর ভবিষ্যৎ বাণী…নাহার মঞ্জিল মে তুমহারা বেটা মিল জায়েগা। নাহার মঞ্জিল যে…মুহূর্তে মনিরার মনের ভয়-ভাবনা দূর হয়ে যায়।
বলে মনিরা–তোমার অর্ধাঙ্গিনী হয়ে ভয় পাবো নাহার মঞ্জিলে গিয়ে, কি যে বলো!
মনিরার সাহসভরা কণ্ঠস্বর শুনে বনহুর আনন্দিত হলো।
আরও কিছুটা চলার পর বনহুর বললো–ঐ যে দেখা যাচ্ছে নাহার মঞ্জিল।
মনিরার বুকটা হঠাৎ যেন ধক করে উঠলো। বুকের মধ্যে কেমন যেন ঢিপ ঢিপ করছে। সম্মুখে তাকিয়ে অবাক হলো মনিরা, কৃষ্ণপক্ষের চাঁদের আলোতে দেখলো মস্তবড় একটা পাথরের মত কোন জিনিষ, মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। খুব স্পষ্ট না দেখা গেলেও বেশ বুঝা যাচ্ছে– ওটা পাহাড় নয়, একটা ভগ্ন বাড়ির ধ্বংসাবশেষ। সুউচ্চ বাড়িটার সিঁড়ির ধাপগুলি ক্রমান্বয়ে নেমে এসেছে নিচে।
চাঁদের আলোতে নাহার মঞ্জিল ধূসর বর্ণের মনে হচ্ছিলো।
বনহুরের গাড়ি গিয়ে থামলো নাহার মঞ্জিলের পাদমূলে সিঁড়ির ধাপগুলির নিচে।
গাড়ি রেখে নেমে দাঁড়ালো বনহুর, মনিরাকে লক্ষ্য করে বললো–এসো। হাত বাড়িয়ে দিলো বনহুর মনিরার দিকে।
মনিরা স্বামীর হাতের উপর হাত রেখে নেমে দাঁড়ালো।
উভয়ে উভয়ের মুখে তাকিয়ে একবার হাসলো।
গাড়ি রেখে বনহুর আর মনিরা সিঁড়ি বেড়ে উঠতে লাগলে উপরের দিকে।
সিঁড়ির ধাপগুলো যেমন লম্বা তেমনি প্রশস্ত। স্থানে স্থানে ভেঙে ধসে গেছে, ঝোপঝাড় আর আগাছা জন্মেছে সেই ধসে পড়া স্থানে।
বনহুর মনিরার হাত ধরে এগিয়ে চলেছে।
চাঁদের আলোতে নাহার মঞ্জিল স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, ওদের চলতে কোন কষ্ট হচ্ছেনা।
দিনের আলোতে যে স্থানে মানুষ প্রবেশ করতে ভয় পায়, সেই স্থানে বনহুর হাসিমুখে এগুতে লাগলো, এতটুকু ভয় বা দুশ্চিন্তা তার মনে রেখাপাত করলোনা বা করেনি।
দুঃসাহসী দস্যু বনহুর স্ত্রীর হাত ধরে নাহার মঞ্জিলের সিঁড়ির ধাপগুলি অতিক্রম করে চলেছে।
যতই এগুচ্ছে ওরা ততই মনিরার বুকের মধ্যে তোলপাড় শুরু হয়েছে। বড় অস্বস্তি বোধ করছে সে–এতোক্ষণ নূরের চিন্তায় মনটা তার আচ্ছন্ন ছিলো, কিন্তু এই মুহূর্তে সব যেন ভুলে গেল মনিরা। বনহুরের হাতের মধ্যে মনিরার হাতখানা ঘেমে উঠতে লাগলো।
বনহুর বললো–কি হলো তোমার মনিরা?
না কিছুনা।
বনহুর বুঝতে পারলো, মনিরার গলা কাঁপছে।
অভয় দিয়ে বললো বনহুর–ভয় পাচ্ছো?
না।
বনহুর আর মনিরা এসে সিঁড়ির উপর ধাপে দাঁড়ালো। কিছুক্ষণ নীরবে তাকিয়ে রইলো নাহার মঞ্জিলের দিকে। একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বনহুর বললো–মনিরা, এখানে এলেই আমি শুনতে পাই একটা অতৃপ্ত হৃদয়ে করুণ হাহাকার।
মনিরা অবাক হয়ে স্বামীর মুখে তাকিয়ে বললো–কার?
নবাব জামরুদীর। বেচারা জামরুদীর বাসনা পূর্ণ হয়নি।
মনিরা বললো–তুমি পুরুষ, তাই নবাব জামরুদীর হৃদয়ের হাহাকার শুনতে পাও, আর যে। শত শত নারীর ইজ্জৎ রক্ষার্থে জীবন দিলো, সেই নাহারের কথা মনে হয় না তোমার?
শত শত নারীর ইজ্জৎ সে রক্ষা করেছে সত্য কিন্তু সে নিজের স্বামীকে ধোকা দিয়ে অপরাধী হয়েছে। জানো মনিরা, নাহার বিয়ে করেছিলো জামরুদীকে, কিন্তু…
থাক আর শুনতে চাইনে। বললো মনিরা।
বললো বনহুর-চলো ভিতরে যাই।
ভিতরে যাবোনা।
কেনো?
মন আমার কেমন করছে?
ও কিছু না, চলো। মনিরার হাত ধরে নাহার মঞ্জিলে প্রবেশ করলো বনহুর।
মনিরা চারিদিকে ব্যাকুল দৃষ্টি মেলে তাকাতে লাগলো, কোথায় তার নূর। সাধক বাবাজী বলেছিলেন, নাহার মঞ্জিলে তার নূরকে পাবে, কিন্তু কোথায় নূর?
মনিরার মনের চঞ্চলতা লক্ষ্য করে বললো বনহুর–অমন করে কি দেখছো মনিরা?
না, কই কিছু না তো?
তোমাকে যেন বড়ড় অন্যমনস্ক লাগছে!
না না, কিন্তু…
থামলে কেনো, বলো, বলো মনিরা কি বলতে চাইছিলে?
বলবো, বলবো তোমাকে?
বলো মনিরা, বলো?
না না, ও কথা বলতে মানা আছে, বলতে মানা আছে।
বলতে মানা? অবাক কণ্ঠে বললো বনহুর।
মনিরা বললো–চল ফিরে যাই।
কেননা এলে, কেননাই বা ফিরে যেতে চাচ্ছো–কি হয়েছে তোমার?
চলো ফিরে যাই…
বলো কেননা এলে এখানে?
বনহুরের কথা শেষ হয়না, মুহূর্তে অসংখ্য পুলিশ বাহিনী উদ্যত রাইফেল হস্তে ঘিরে ধরে বনহুরকে।
মিঃ আহম্মদ ও মিঃ জাফরী গুলীভরা পিস্তল চেপে ধরলেন বনহুরের বুকে। নিমিষে এ কাজ করলেন মিঃ আহম্মদ, মিঃ জাফরী ও তার পুলিশ বাহিনী।
বনহুর দেখলো–আচমকা যাদুর মত অসংখ্য সশস্ত্র পুলিশ ফোর্স তার চারিপাশে ঘিরে দাঁড়িয়েছে।
মিঃ আহম্মদ দাঁতে দাঁত পিষে বললেন–দস্যু, হাত উঠাও।
বনহুর ধীরে ধীরে হাত তুলে দাঁড়ালো।
মনিরা কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মত হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যেদিকে তাকাচ্ছে অসংখ্য পুলিশ আর উদ্যত রাইফেল ছাড়া কিছুই নজরে পড়ছেনা। মনিরার কণ্ঠ শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে, নিজের চোখকে সে বিশ্বাস করতে পারছেনা। একটি কথাও তার মুখ দিয়ে বের হলোনা।
মিঃ আহম্মদ রিভলভার বনহুরের বুকে চেপে ধরে মিঃ জাফরীকে বললেন–ওর পকেট থেকে রিভলভার বের করে নিন।
মিঃ জাফরী পকেট থেকে রিভলভারটা বের করে নিলেন।
মিঃ আহম্মদ এবার বনহুরের হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিলেন।
মনিরা স্বামীর এই অবস্থা দেখে দু’হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে উঠলো। এতোক্ষণে সে বুঝতে পারলো-নূরের সন্ধানে এসে স্বামীকে সে হারালো। কোন পুলিশের গুপ্তচর তার স্বামীকে বন্দী করবার জন্যই এই ফন্দি এটেছেলো এবং সাধক সেজে গিয়েছিলো তার কাছে, বলতে মানা করেছিলো সব কথা…মনিরার মনে সব কথাগুলি যেন হুড়োহুড়ি করে ভীড় পাকাতে লাগলো।
মিঃ আহম্মদ বললেন–মিসেস মনিরা আপনি আপনার স্বামীকে আমাদের হাতে তুলে দিয়ে যে উপকার করলেন তার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
বনহুর তাকালো মনিরার দিকে।
মনিরা স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো, অপরাধীর মত মাথা নত করে নিলো। সে। কত বড় অপরাধ সে করেছে এবার মর্মে মর্মে অনুভব করলো। দুঃখ, বেদনা, ক্ষোভে মুষড়ে পড়লো মনিরা, নিজের শরীরের মাংস নিজেই চিবিয়ে খেতে ইচ্ছে করছিলো তার।
বনহুরের মুখমন্ডল কঠিন হয়ে উঠেছে, মনিরাই কি আজ তাকে পুলিশের হাতে তুলে দিলো। তাকে এ ভাবে মিথ্যা ছলনায় ভুলিয়ে নাহার মঞ্জিলে নিয়ে আসার পিছনে কি এই অভিসন্ধি ছিলো মনিরার? গতকাল রাতে মনিরার কথাগুলো স্মরণ হতে লাগলো বনহুরের। নাহার মঞ্জিলে আসা তার সেকি উন্মাদনা, সেকি আগ্রহ। বনহুরের মনে সন্দেহের ছোঁয়া গম্ভীর হয়ে এলো। একটি কথা বনহুর বললোনা–বলতে পারলোনা।
মনিরার মুখ দিয়েও কোন কথা সরলো না।
অসংখ্য পুলিশ ফোর্স বনহুরের চারিপাশে রাইফেল উদ্যত করে তাকে নিয়ে চললো।
নাহার মঞ্জিলের পিছনে একটা ঝোপের আড়ালে পুলিশ ভ্যানগুলি অপেক্ষা করছিলো। বনহুরকে এই ভ্যানে তুলে নেওয়া হলো।
মনিরার মনের অবস্থা তখন অবর্ণনীয়। বনহুরকে যখন পুলিশ ভ্যানে তুলে নেওয়া হলো, উচ্ছ্বসিতভাবে কেঁদে উঠলো মনিরা–ছুটে গেল পুলিশ ভ্যানের পাশে।
লৌহ শিকল দিয়ে বনহুরকে তখন পুলিশ ভ্যানের সঙ্গে বেঁধে ফেলা হয়েছে। হাতে হাতকড়া। বুকে পিঠে এবং দেহের চারপাশে উদ্যত পিস্তল আর রাইফেল।
বনহুর ফিরে তাকালো ক্রন্দনরত মনিরার দিকে।
মনিরা কেঁদে বললো–আমাকেও নিয়ে যাও তোমার সঙ্গে।
বনহুর কিছু বলতে যাচ্ছিলো ঠিক সেই মুহূর্তে গাড়ি ছেড়ে দিলো।
মনিরা চিৎকার করে উঠলো–আমি কি করবো, কোথায় যাবো, বলে গেলেনা। ওগো, আমি কোথায় যাবো–
মনিরার কণ্ঠস্বর আর শুনতে পেলোনা বনহুর।
পুলিশ ভ্যানগুলি এক সংগে ছুটতে লাগলো।
মাঝখানের গাড়িতে বনহুর, সামনে আর পিছনে পরপর প্রায় সাতখানা ভ্যান স্পীডে ছুটে চললো।
মিঃ আহম্মদ ও মিঃ জাফরী তখনও মনিরার পাশে দাঁড়িয়ে আরও দু’জন পুলিশ অফিসার রয়েছে সেখানে।
মিঃ আহম্মদ বললেন–মিসেস মনিরা, ক্ষমা করবেন, সেদিনের সাধক অন্য কেহ নয় আমি। আমি পুলিশ ইন্সপেক্টার মিঃ আহম্মদ। একটু থেমে বললেন তিনি–আমাদের কার্য সিদ্ধ হয়েছে, এবার আপনাকে যথোচিত সম্মানের সঙ্গে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হবে। মিঃ জাফরীকে লক্ষ্য করে বললেন মিঃ আহম্মদ মিঃ জাফরী আপনি একে এর বাড়িতে পৌঁছে দিন, আমি পুলিশ ভ্যানগুলির সংগেই চললাম।
মিঃ জাফরী বললেন–আচ্ছা, আপনি পুলিশ ভ্যানগুলির সংগেই যান। কারণ, শয়তান দস্যু–
মনিরা তীব্র কণ্ঠে বলে উঠলো “খবরদার! শয়তান বলবেন না। দস্যু হলেও সে শয়তান। নয়।
মিঃ জাফরী হেসে বললেন–ভুল হয়েছে, আসুন আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।
মনিরা দৃঢ়কণ্ঠে বললো–আমি কারো সাহায্য চাইনে ইন্সপেক্টার। আমার গাড়ি আছে–
এই–এতো রাতে একা একা যাবেন? বললেন মিঃ আহম্মদ।
মনিরা বললো–দস্যুপত্নী এতো সহজে ভয়পাবার নয়। কথা শেষ করে মনিরা নিজের গাড়িখানা যেদিকে দাঁড়িয়েছিলো। সেই দিকে অগ্রসর হলো।
মিঃ আহম্মদ বললেন–মিঃ জাফরী, ও নিজে গেলেও আপনি মিঃ হারুন ও মিঃ করিমকে নিয়ে আপনার গাড়িতে যান। মেয়ে মানুষ–একা ছেড়ে দেওয়া ঠিক হবে না।
আচ্ছা তাই যাচ্ছি। মিঃ জাফরী পুলিশ অফিসারদ্বয় সহ নিজ গাড়িতে উঠে বসলেন।
মিঃ আহম্মদ চললেন নিজ গাড়ির দিকে।
*
ক্রমে রাত বেড়ে আসছে তবু মনিরার ফিরে আসার কথা নেই। মরিয়ম বেগম ঘরবার করছেন। বার বার রেলিং এর পাশে ফিরে এসে পথের দিকে তাকাচ্ছেন, কোথায় গেলো– এতোক্ষণেও ফিরে আসছেনা কেনো। টেবিলে খাবার ঢাকা রয়েছে, নিশ্চয়ই এক্ষুণি আসবে বলেই কোথাও গিয়েছে।
কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ ঢলে পড়লো পশ্চিম আকাশে। সুপ্তির কোলে ঢলে পড়েছে সমস্ত পৃথিবীটা।
মরিয়ম বেগম অস্থির চিত্ত নিয়ে কখনও বিছানায় শুচ্ছেন, কখনও গিয়ে দাঁড়াচ্ছেন রেলিং এর পাশে। কখনও আবার ফিরে এসে চেয়ারে বসছেন। মনের দুশ্চিন্তা পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে তার সারা মুখে।
এ বাড়ির জন্য চিন্তা করবার আর কে আছে একমাত্র তিনি ছাড়া। স্বামীর জীবিত অবস্থায় যা কিছু ঘটতো বা হতো বেশির ভাগ ভাবতে হতো চৌধুরী সাহেবকে। আর আজ সবকিছু দুশ্চিন্তা দুর্ভাবনা, যতি ঝড়ঝঞ্ঝা বয়ে যাচ্ছে তারই মাথার উপর দিয়ে।
চৌধুরী সাহেবের মৃত্যুর পর থেকে আজ পর্যন্ত কত না দুর্ঘটনা ঘটে গেছে, নীরবে হজম করেছে মরিয়ম বেগম। বুকের ভিতরটা যেন তার পোড়া কয়লার মত কালো হয়ে গিয়েছিলো। কত আর সহ্য হয়, সবেরই তো একটা সীমা আছে। চৌধুরী সাহেবের অপমৃত্যু তার পাঁজরের হাড়গুলো যেন গুড়ো করে দিয়ে গিয়েছিলো। নিষ্ঠুর নিয়তির পরিহাস তাকে শুধু একবার নয় বার বার নিষ্পেষিত করে চলেছিলো।
মরিয়ম বেগম দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়লেন।
বিছানায় শুয়ে কিছুতেই শান্তি পাচ্ছিলেন না, কোথায় গেলো মেয়েটা। সত্যিই যদি মনির না হয়ে অন্য কোন লোক ওকে ছলনা বা চালাকী করে ভুলিয়ে নিয়ে গিয়ে থাকে–কি সর্বনাশ হবে তাহলে।
কি ভুলই না তিনি আজ করেছিলেন, বাসায় থাকলে অমন হতোনা মনিরাকে–
মরিয়ম বেগমের চিন্তায় বাধা পড়লো।
নীচে গাড়ি বারেন্দায় শোনা গেলো গাড়ি থামার শব্দ।
মরিয়ম বেগমের কানে শব্দটা পৌঁছতেই একটা অনাবিল শান্তির ধারা তার সমস্ত মনের আকাশে প্রলেপ দিয়ে গেলো। তিনি শয্যা ত্যাগ করে উঠে পড়লেন দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নীচে গেলেন।
নকীব সিঁড়ি ঘরের বারেন্দায় নাক ডেকে ঘুমাচ্ছিলো, মরিয়ম বেগম তাকে জাগিয়ে দিয়ে বললেন–দেখতো নকীব, কে এলো?
চোখ রগড়ে উঠে বসলো নকীব, মনিব গৃহিনীকে এতো রাতে নিচে দেখে অবাক হয়ে বললো–আম্মা সাহেবা যে?
দেখতো কে যেন এলো? গাড়ির শব্দ পেলাম।
নকীব দরজা খুলে দিতেই কক্ষে প্রবেশ করলো মনিরা সম্মুখে মরিয়ম বেগমকে দেখতে পেয়েই ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো তাঁর গলা সঙ্গে সঙ্গে আকুলভাবে কেঁদে উঠলো–মামীমা!
মরিয়ম বেগম স্তব্দ হয়ে গেলেন, হঠাৎ কিছু বুঝে উঠতে পারছিলেন না। তিনি মনিরার পিছনে দরজার দিকে লক্ষ্য করছিলেন, কে সেই রাজকুমার যার সঙ্গে মনিরা গিয়েছিলো। মরিয়ম বেগম ভেবেছেন, মনিরা যার সংগে গিয়েছে আবার তার সংগেই ফিরে এসেছে। তাই বার বার তাকাচ্ছিলেন তিনি দরজার দিকে। একটা দারুণ উকুন্ঠা জাগছিলো তার মনের মধ্যে।
মনিরা উচ্ছ্বসিতভাবে কেঁদে চলেছে। এতক্ষণ যে জমাট বেদনা তার বুকের মধ্যে চাপ ধরে উঠেছিলো, এতক্ষণে তা যেন ঝরে পড়তে লাগলো অঝোরে।
মরিয়ম বেগম কিছু বলতে যাবেন সেই মুহূর্তে কক্ষে প্রবেশ করলেন মিঃ জাফরী ও দুইজন পুলিশ অফিসার।
মরিয়ম বেগম পুলিশ অফিসারদ্বয়কে দেখে তাড়াতাড়ি মাথায় কাপড়টা টেনে ঠিক হয়ে দাঁড়ালেন।
মিঃ জাফরী ও পুলিশ অফিসারদ্বয় মরিয়ম বেগমকে আদাব জানালেন।
মিঃ জাফরী বললেন–মিসেস চৌধুরী, আমাকে হয়তো চিনতে পেরেছেন, আমি পুলিশ ইন্সপেক্টার মিঃ জাফরী, আর এরা আমার সহকারী পুলিশ অফিসার। মিসেস মনিরাকে পৌঁছে দেবার জন্যই আমরা এতো রাতে এখানে এসেছি।
মরিয়ম বেগম কৃতজ্ঞতা পূর্ণ দৃষ্টি নিয়ে একবার তাকালেন মিঃ জাফরী ও পুলিশ অফিসারদ্বয়ের মুখের দিকে। তিনি মনে করলেন মনিরাকে কোন দুষ্ট লোক ধরে নিয়ে গিয়েছিলো বা ফুসলিয়ে নিয়ে গিয়েছিলো, এরা উদ্ধার করে নিয়ে এলেন।
পুলিশ অফিসারদ্বয় মনিরার গাড়িকে অনুসরণ করেই এখানে এসেছেন। যদিও মনিরা রাগ করে নিজেই গাড়িখানা ড্রাইভ করে বাড়ীর পথে অগ্রসর হয়েছিলো, তবুও পুলিশ অফিসারগণ তাকে একা ছেড়ে দেবার ভরসা পাননি। পিছনে পিছনে তাদের গাড়িখানা মনিরার গাড়িখানাকে ফলো করেছিলো।
মিঃ জাফরী ও পুলিশ অফিসারদ্বয়কে বসার জন্য অনুরোধ জানালেন মরিয়ম বেগম। বললেন তিনি–আপনারা বসুন।
মরিয়ম বেগম এখনও জানেন না পুলিশ অফিসারগণ আজ এই মুহূর্তে তার হৃদয়ের ধনকে বন্দী করে কারাগারে নিক্ষেপ করেছে। জানলে হয়তো তিনি এমন সচ্ছমনে তাদেরকে সমাদর জানাতে পারতেন না।
হাজার হলেও মা, গর্ভধারিনী জননী, পুত্র যতই দুষ্ট অশান্ত হোক, কোন মাই তার অমঙ্গল কামনা করতে পারে না। মরিয়ম বেগম সময় সময় তার সন্তান মনিরের উপর খুব রাগ করতেন কিন্তু পারতেন না তাকে অন্তর থেকে কোন অভিশাপ করতে।
মিঃ জাফরী বুঝতে পারলেন, মিসেস চৌধুরী এখনও কিছু বুঝতে পারেন নি! কাজেই তিনি বললেন–মিসেস চৌধুরী, আমরা আপনার অনুরোধ রক্ষা করতে পারছি নে, কারণ এক্ষুণি আমাদের চলে যেতে হবে। একটু থেমে বললেন–আমাদের ক্ষমা করবেন, আজ আমরা আপনার পুত্র দস্যু বনহুরকে গ্রেফতার করেছি।
মরিয়ম বেগম মিঃ জাফরীর মুখে থেকে তড়িৎ গতিতে তাকালেন মনিরার মুখে।
মনিরা তখন নীরবে অশ্রু বিসর্জন করছিলো।
মরিয়ম বেগমের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় হতেই মাথা নত করে অধর দংশন করতে লাগলো।
মনিরার অকাতর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রথমেই তিন হকচকিয়ে গিয়েছিলেন, এবার সব স্পষ্ট হয়ে এলো তার কাছে। বুঝতে পারলেন, অমন একটা ঘটনা ঘটে গেছে যা অতি মর্মান্তিক –নিদারুণ।
মরিয়ম বেগমের মুখভাব লক্ষ্য করে বললেন মিঃ জাফরী–মিসেস চৌধুরী, বুঝতে পারছি এ সংবাদ আপনার হৃদয়ে দারুণ আঘাত করেছে। কিন্তু কি করবো, আপনার সন্তান হলেও আমরা তাকে ক্ষমা করতে পারিনে। আইনের চোখে সে অপরাধী, কাজেই কর্তব্যের–
এবার বলে উঠলো মনিরা মিথ্যা ছলনায় আমাকে ভুলিয়ে আপনার কর্তব্য পালন করেছেন। মিথ্যাই কি আপনাদের পেশা?
মিঃ জাফরী হাসলেন ন্যায় কার্য্যে মিথ্যার চেয়ে আরও কিছু করতেও আমরা রাজি আছি।
বলে উঠলেন মরিয়ম বেগম–আমার মনির আজ কি করেছিলো? কি অন্যায় সে করেছিলো আজ?
অন্যায় আজ না করলেও সে গুরুতর অপরাধী। তাকে যে কোন মুহূর্তে গ্রেফতার করা পুলিশ বাহিনীর কর্তব্য। বললেন মিঃ জাফরী।
মরিয়ম বেগমের গন্ড বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগলো। গম্ভীর স্থির হয়ে তিনি দাঁড়িয়ে রইলেন।
মিঃ জাফরী ও পুলিশ অফিসারদ্বয় মরিয়ম বেগমকে পুনরায় আদাব জানিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
মিঃ জাফরী মরিয়ম বেগমকে শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। শুধু তিনিই নন সমস্ত পুলিশ বাহিনী চৌধুরী পরিবারকে সব সময় সমীহ করে চলতেন কারণ বংশ মর্যাদার বা আভিজাত্যের দিক দিয়ে কোন অংশে তারা কম ছিলেন না। তাছাড়া দস্যু বনহুরকে পুলিশ বাহিনী ভালোচোখে না দেখলেও তার সম্বন্ধে ভিতরে ভিতরে মস্তবড় একটা মনোভাব পোষণ করতো সবাই।
মিঃ জাফরী বিদায় গ্রহণ করতেই মরিয়ম বেগম বলে উঠলেন– কি বলছিস মনিরা, ওকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে?
হাঁ মামীমা! কম্পিত গলায় বললো মনিরা।
মরিয়ম বেগম বললেন–কি হয়েছিলো? কি করে আমার মনিরা বন্দী হলো মনিরা?
চলো মামীমা, সব বলছি।
মনিরা আঁচলে চোখ মুছে মামীমাকে অনুসরণ করলো।
সিঁড়ি বেয়ে এগিয়ে চললো তারা, নকীবও চললো তাদের পিছনে পিছনে। ওর কাছে সব যেন কেমন এলো মেলো লাগছে।
মনিরার বুক ফেটে কান্না আসছিলো যখন সে সিঁড়ির ধাপ বেয়ে উঠে যাচ্ছিলো উপরে। মনে পড়েছিলো কয়েক ঘন্টা আগে তারা দু’জন এই সিঁড়ির ধাপ বেয়ে উপরে উঠে গিয়েছিলো কিন্তু এখন সে কোথায়–হুঁ হু করে কেঁদে উঠে মনিরা মন।
বার বার আঁচলে অশ্রু মোছে মনিরা। চোখের সম্মুখে ভেসে উঠছে স্বামীকে গ্রেপ্তারের সেই ভয়াবহ দৃশ্যটা।
উভয়ে মনিরার কক্ষে প্রবেশ করলো।
টেবিলে তখনও খাবার ঢাকা দেওয়া রয়েছে।
মনিরা কক্ষে প্রবেশ করেই পুনরায় দু’হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে উঠলো। টেবিলে নজর পড়তেই ছটফট করে উঠলো তার হৃদয়ে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললো–মামীমা, একি হলো মামীমা? আমি যে নিজ হাতে ওকে পুলিশের হাতে সপে দিয়ে এলাম।
কি হয়েছে সব খোলাসা বল্ মনিরা, আমি সব শুনবো।
মামীমা, আমি কেমন করে বলবো আমি কোন্ মুখে বলবো তোমাকে সেই হৃদয় বিদারক কাহিনী।
মনিরা, আমি ওর মা, আমি বুকে পাষাণ বেঁধেছি। সে অপরাধী, যে কোন মুহূর্তে ওকে গ্রেপ্তার হতে হবে। কেউ তাকে আটকে রাখতে পারবেনা। বল বল মনিরা, রাজকুমারের বেশেই। কি আমার মনির এসেছিলো।
হাঁ মামীমা, কিন্তু কে বলেছে এ কথা?
নকীব, নকীব সব আমাকে বলেছে। মনিরা, আমার মনির কি এসেছিলো?
হাঁ, সেই এসেছিলো রাজকুমারের বেশে–মামীমা, ও বলেছিলে। ফিরে এসে খাবে– বাষ্পরুদ্ধ হয়ে এলো মনিরার কণ্ঠস্বর। ধীরে ধীরে টেবিলের পাশে গিয়ে খাবারের ঢাকনা তুলে দেখতে লাগলো। চোখ দিয়ে অশ্রুবিন্দু মুক্তার মত ঝরে পড়তে লাগলো খাবারের থালার উপরে। আবার বললো মনিরা–মামীমা, ফিরে এসে খাবে বলেছিলো কিন্তু ফিরে আর এলোনা। আমি কি জানতাম, আজ ওকে আমি হারাবো–নাহার মঞ্জিল আমাকে হাতছানি দিয়ে ডেকে নিয়ে। গিয়েছিলো–
নাহার মঞ্জিল!
হাঁ, মামীমা, নাহার মঞ্জিলেই আজ আমরা গিয়েছিলাম, শোন সব তোমাকে বলছি। সেদিন দুপুরে নকীব এসে বললো–আপা মনি, এক সন্ন্যাসী তোমার নূরের সন্ধান জানে বলে বলছে
সন্ন্যাসী!
হাঁ, সেই সন্ন্যাসী অন্য কেহ নয় পুলিশ ইন্সপেক্টার আহম্মদ। তিনিই ছদ্মবেশে এসেছিলেন মনিরা সমস্ত ঘটনা মামীমার নিকট বলে গেলো।
স্তব্ধ নিশ্বাসে সব শুনলেন মরিয়ম বেগম। চিত্রার্পিতের ন্যায় নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। একটি শব্দও তার মুখ দিয়ে বের হলো না।
মনিরা সব কথাই বলল। কেমন করে নাহার মঞ্জিলে তারা প্রবেশ করলো কি বলেছিলো তার স্বামী, সব ব্যক্ত করলো মনিরা মামীমার কাছে। আরও বললো–মামীমা আমিই ওকে বন্দী করলাম।
মরিয়ম বেগম মনিরার পিঠে হাত বুলিয়ে সান্তনার স্বরে বললেন –সবই অদৃষ্ট, নাহলে এতো বড় একটা ঘটনা ঘটবার পূর্বে এতোটুকু আমিও জানতে পারিনি কেনো?
আমিই এজন্য দায়ী মামীমা, আমিই এজন্য দায়ী।
মনিরা আঁচলে চোখ চাপা দিয়ে কাঁদতে লাগলো।
মরিয়ম বেগম হতাশভাবে বসে পড়লেন খাটের উপরে। চোখের সম্মুখে গোটা পৃথিবীটা যেন অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে এলো। পুত্র শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়লেন তিনি। টেবিলে খাবার ঢাকা, পাশে দাঁড়িয়ে আছে মনিরা পাথরের মূর্তির মত স্থির হয়ে। স্বামীর কথাগুলো ভাসছে তার কানের কাছে–তুমি খেয়ে আসতে বলেছিলে, কিন্তু না খেয়ে এসে ভুল করেছি মনিরা বড্ড ক্ষুধা পেয়েছে।–মনিরা খাবারের ঢাকনা খুলে নীরবে তাকিয়ে থাকে খাবারের দিকে। ভাবে, তার অদৃষ্টে নাই স্বামীর পাশে বসে তাকে খাওয়াবে। আনমনা হয়ে যায় মনিরা, স্পষ্ট দেখতে পায় চেয়ারে বসে আছে তার স্বামী, হাসছে মনিরার মুখের দিকে তাকিয়ে। মনিরা প্লেটখানা এগিয়ে দেয় স্বামীর সম্মুখে। মনিরাও হাসে–খাবার তুলে দেয় প্লেটে–উভয়ের মুখে তাকিয়ে আছে– মনিরা খাবার তুলে স্বামীর মুখে দেয়–হাত থেকে খাবার পড়ে যায় মাটিতে। তাড়াতাড়ি চমকে উঠে, মনিরা, নিজের ভুল বুঝতে পেরে ফিরে তাকায় খাটের দিকে। মামীমা নেই–কখন তিনি উঠে চলে গেছেন। মনিরা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে, ফিরে তাকায় মুক্ত জানালার দিকে। পূর্ব আকাশ আলোকিত করে প্রভাতের সূর্য উঁকি দিয়েছে।
মনিরা দুই হাতে মুখ ঢেকে ছোট্ট বালিকার মত কেঁদে উঠে কালকের প্রভাতের কাছে। আজকের প্রভাত কত বিষময়–কত বেদনাদায়ক। কাল প্রভাতে এই মুক্ত জানালায় দাঁড়িয়ে নতুন সূর্যের দিকে তাকিয়ে ভেবেছিলো মনিরাসন্ধ্যায় আসবে সে, মিলিত হবে আবার ওরা দু’জনা! আর আজ সব আশা বাসনা মুছে গেছে নিঃশেষ হয়ে কোন্ অতলে। না জানি এখন তাকে কোথায় কোন কারাগারে বন্দী করে রাখা হয়েছে। খাবার দিয়েছে কি না দিয়েছে তারই বা ঠিক কি আছে।
স্বামীর চিন্তায় মনীরা ভুলে গেলো নিজের ক্ষুধা-তৃষ্ণা সবকিছু। ভোরের আলো নিষ্প্রভ হয়ে এলো তার চোখে।
*
একটা দুঃস্বপ্নে ঘুম ভেঙে গেলো নূরীর। ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসে তাকালো চারিদিকে, পাশে ঘুমন্ত মনি। কক্ষে আর কেউ নেই, নাসরিন আর অন্যান্য সংগিনীরা ঘুমাচ্ছে। তখনও। পাশের জানালা দিয়ে ভোরের আলো মেঝেতে ছড়িয়ে পড়েছে।
নূরী শয্যা ত্যাগ করে ছুটে গেলো বনহুরের কক্ষে। প্রবেশ করে দেখতে পেলো–শূন্য বিছানা পড়ে রয়েছে–বনহুর নেই। গত রাতের কথা মনে পড়লো নূরীর, বলেছিলো–সে আজ কোথাও যাবে না, বিশ্রাম করবে গোটা রাত।
কিন্তু কোথায় সে, তবে কি তার স্বপ্ন সত্যি!
ভোরের স্বপ্ন নাকি সত্য হয়, নূরী বসে পড়লো বনহুরের শূন্য বিছানায়। কক্ষের চারিদিকে তাকিয়ে দেখতে লাগলো, জামা কাপড়গুলি যেখানে যেমন তেমনি রয়েছে। মাথার পাগড়ীটাও টেবিলে পড়ে রয়েছে, তবে সে কোথায় গেছে। নূরী তাড়াতাড়ি বালিশ সরিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো–বালিশের তলায় রিভলভার রাখতো বনহুর, কিন্তু রিভলভারটা নেই তো সেখানে।
নূরী এলোমেলো কত কি চিন্তা করছে, চিন্তা করছে স্বপ্নের কথা। দেখছিলো নূরী অদ্ভুত স্বপ্ন–বনহুর আর সে একটা রথে চেপে আকাশপথে কোথায় যেনো উড়ে যাচ্ছিলো। শুভ্র মেঘের স্তরে স্তরে জোছনার আলো ছড়িয়ে পড়ছিলো। ফুরফুরে হাওয়া বইছিলো চুলগুলি উড়ছিলো তার পাশে বসে হাসছিলো বনহুর–সুন্দর মধুর সে হাসি।
অপলক নয়নে নূরী উপভোগ করছিলো প্রকৃতির এই মধুময় দৃশ্য।
কত সাগর নদী পেরিয়ে ওদের দুজনকে নিয়ে রথখানা হাওয়ায় ভেসে চলেছে, কোন। অজানার পথে। কত পাহাড় নদী গাছপালা। কত প্রান্তরের উপর দিয়ে তাদের রথ উড়ে চলেছে– বনহুর আর নূরী তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে।
হঠাৎ তারা দেখলো–দূরে মেঘের ফাঁকে একটি সুন্দর কক্ষ।
বললো নূরী–দেখছো হুর, কি সুন্দর ঐ কক্ষটা, কেমন মেঘের উপরে হাওয়ায় ভাসছে। কক্ষটার উপরে জোছনার আলো পড়ে অদ্ভুত এক রঙ এর সৃষ্টি হয়েছে যে ঠিক রামধনুর।
নূরীর দু’চোখে খুশির উচ্ছ্বাস এমন কক্ষ তো কোনদিন সে দেখেনি। মনের ভিতরে প্রবল বাসনা জাগলো বড় দেখতে ইচ্ছা হলো কক্ষটার মধ্যে। বললো সেহুর, ওখানে তুমি আমাকে নিয়ে যাবে?
নূরী লক্ষ্য করলো, তার কথায় বনহুরের মুখ গম্ভীর হয়ে এলো বললো না না, ওখানে যেতে নেই। অতি ভয়ঙ্কর স্থান ওটা ওখানে যেতে নেই।
নূরী ভীষণ জেদ ধরে বসলো–যাবেই সে ওখানে যত বিপদই থাক।
নূরীর জেদে বনহুর রাজি হলো।
রথের সারথীকে বললো বনহুর–ওই কক্ষটার দিকে চলো।
সারথী রথের মোড় ফিরিয়ে নিলো।
নূরীর মনে খুশি আর ধরছে না।
কক্ষের চারিপাশে সোনালী কারুকার্য খচিত দেয়াল–অপূর্ব এই কক্ষ। নূরীর মনে প্রবল বাসনা দেখবে সে ওর মধ্যে কি আছে।
কক্ষের সম্মুখে এসে তাদের রথ দাঁড়িয়ে পড়লো।
নূরীর হাত ধরে বনহুর এগুতে লাগলো কক্ষটার দিকে।
মেঘের ধাপে ধাপে পা রেখে এগুচ্ছে বনহুর আর নূরীর। মেঘের গায়ে জোছনার আলো ঝকমক করে উঠেছে। রামধনুর মত কত রঙ এর ছটা ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে।
বনহুর আর নূরী প্রবেশ করলো সেই কক্ষে, সঙ্গে সঙ্গে অদ্ভুত এক কান্ড ঘটে গেলো। কক্ষমধ্যে প্রবেশ করতেই অসংখ্য অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ছুটে এসে শরীরে লাগলো বনহুরের আগুন ধরে গেলো তার শরীরে। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলতে লাগলো নূরী চিৎকার করে উঠলো, বাঁচাও– ও– ঘুম ভেঙে গেলো নূরীর।
নূরী বনহুরের শূন্য বিছানায় বসে ভোরের স্বপ্নের কথাই চিন্তা করছে, এমন সময় রহমান। প্রবেশ করলো সেই কক্ষে, নূরীকে দেখে বললো–সর্দার আসেনি?
নূরী রহমানকে দেখে উঠে দাঁড়ালো, বললো সেনাতো, বনহুর এখনো ফিরে আসেনি। কিন্তু সে কোথায় গিয়েছিলো বলতে পারো রহমান?
রহমান জানতো বনহুর আজ শহরে যাবে, চৌধুরী বাড়িতে। কিন্তু ভোরের পূর্বেই তো তার ফিরে আসার কথা ছিলো। দিনের বেলায় শহরে সে কিছুতেই থাকবেনা। তাছাড়া আস্তানায় অনেক কাজ আছে। ফিরে না আসার কারণ কি? নূরীর প্রশ্নে বললো রহমান–সর্দার, কোথায় গেছে আমি তো ঠিক জানি না।
জানো না?
না নূরী।
আমি একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছি রহমান, ওর তো কোন বিপদ ঘটেনি? বিপদ! চমকে উঠে বললো রহমান।
হাঁ, রহমান আমার মন বলছে ওর কোন বিপদ ঘটেছে। তুমি যাও সন্ধান নিয়ে দেখো আজ এতো বেলা হলো তবু এলোনা কেনো।
রহমান চিন্তিত হলো, কিন্তু মুখে বললো–না, ভয় নেই নূরী, সর্দার নিশ্চয়ই এসে পড়বে।
রহমান নূরীর নিকট থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলো কিন্তু মনের মধ্যে একটা দুশ্চিন্তার ঝড় তোলপাড় শুরু করলো। সর্দার তাকে না বলে কোথাও রাত্রি যাপন করেনা আজ সে এমন করে কোথায় ডুব মারলো। ভয় না হলেও আশঙ্কা জাগলো।
তাজ বনহুরকে পথের বাঁকে গাড়ি অবধি পৌঁছে দিয়ে ফিরে এসেছিলো। একজন অনুচর গিয়েছিলো তাজকে ফিরিয়ে আনার জন্য রহমান তার নিকট গিয়ে জিজ্ঞাসা করলো–খালেক,
সর্দার কি তোমাকে কিছু বলে গেছেন?
খালেক ঘর্মাক্ত কলেবরে গামছায় হাওয়া খাচ্ছিলো, রহমানকে দেখেই উঠে দাঁড়ালো বললো–আমি এইমাত্র তাজকে নিয়ে ফিরে এলাম।
তুমি আবার গিয়েছিলে?
হাঁ, আমি সর্দারের আদেশ মত শেষ রাতে আবার গিয়েছিলাম। ভোর পর্যন্ত সর্দারের অপেক্ষা করে ফিরে এলাম এই মাত্র।
সর্দার আসেন নি?
না হুজুর।
তাহলে সর্দার নিজেই ড্রাইভ করে গিয়েছিলেন?
হাঁ, তিনি নিজেই গাড়ি নিয়ে গিয়েছিলেন।
রহমান সোজা চলে গেলো তার ড্রেস পরিবর্তনের কক্ষে।
*
অসংখ্য পুলিশ পরিবেষ্টিত হয়ে দস্যু বনহুরের পুলিশ ভ্যান হাঙ্গেরিয়া কারাগারের সম্মুখে এসে দাঁড়ালো। আকাশচুম্বী প্রাচীরের ঘেরা হাঙ্গেরিয়া কারাগার। প্রাচীরে উপরিভাগে সূতীক্ষ্ণ ধার লৌহফলক চার আংগুল ফাঁকে ফাঁকে গাঁথা। একটি পাখি পর্যন্ত বসতে পারেনা আজ এটি প্রাচীরের উপরে। লৌহ গেট পূর্বের চেয়ে আরও মজবুত আরও দৃঢ় করা হয়েছে।
সেইবার দস্যু বনহুর হাঙ্গেরিয়া কারাগার থেকে পালাবার পর কারাগারটি আরও নতুনভাবে নতুন কৌশলে অতি ভয়ঙ্কর ইস্পাত দ্বারা মজবুত করে নেওয়া হয়েছিলো। আর যেন কোন দস্যু বা ডাকু ঐ ভাবে পালাতে সক্ষম না হয়।
দস্যু বনহুরকে পুনরায় গ্রেপ্তার করতে পারলে হাঙ্গেরিয়ার কারাগারেই তাকে বন্দী করা হবে এবং সে যেন আর পালাতে সক্ষম না হয়, সেজন্য পূর্ব হতেই হাঙ্গেরিয়া কারাগারে এ সাবধানতা।
বনহুরের সমস্ত শরীরে লৌহ শিকল বাঁধা। হাতে হাতকড়া শুধু পায়ে কোন বন্ধন নেই। চারিদিকে উদ্যত রাইফেল।
বনহুরকে হাঙ্গেরিয়া কারাগারে নিয়ে যাওয়া হলো।
সবচেয়ে বড় এবং ভেনটিলেটার বিহীন একটা কক্ষে দস্যু বনহুরকে আটকে রাখা হলো। লৌহ দরজায় একটি নয় সাতটি মজবুত তালা লাগানো হলো। যে কক্ষে বনহুকে বন্দী করা হলো সেই কক্ষের চারিপাশে সদা সর্বদা রাইফেলধারী পুলিশ সতর্ক পাহারায় নিযুক্ত রইলো। লৌহ দরজার পাশে চারজন পুলিশ গুলীভরা রাইফেল নিয়ে দন্ডায়মান।
অদ্ভুত এ দৃশ্য। পাষাণ প্রাচীরে ঘেরা লৌহ কারাগারে বন্দী এক রাজকুমার। দস্যু বনহুরের শরীরে এখনও সেই রাজকীয় ড্রেস, পুলিশ বাহিনীর সাহস হয়নি বনহুরের শরীর থেকে ড্রেস পরিবর্তন করে নিতে। কাজেই এখনও তার দেহে পূর্বের সেই ড্রেস বিরাজ করছে। শুধু মাথায় ক্যাপটা এখন আর নেই। আর নেই তার পেকেটে পিস্তলটা।
লৌহ খাঁচায় আবদ্ধ আজ সিংহ শাবক দস্যু বনহুর।
কারাগারে বন্দী হয়ে বনহুর ভূমি শয্যায় এসে বসলো।
ভোরের আলো তখন কারাগার কক্ষে প্রবেশ করেছে।
বনহুর ভাবতে লাগলো, আজ নাহার মঞ্জিলে সে বন্দী হয়েছে। মনিরাই তাকে নিয়ে এসেছিলো সেখানে, কিন্তু কেনো? তবে কি মনিরা জানতো সব? হঠাৎ এতো জায়গা থাকতে নাহার মঞ্জিল আসার এতো সখ কেননা চেপেছিলো মনিরার? কি যেন বলতে গিয়েও সে বলছিলো না, চেপে যাচ্ছিলো তার কাছে। নিশ্চয়ই মনিরা জানতো, না জানলে সে তাকে নাহার মঞ্জিলে প্রবেশে বাধা দিচ্ছিলো কেনো? মনিরার মুখোভাবও বেশ উত্তোজনাপূর্ণ ছিলো। একটা কেমন যেন ভাব লক্ষ্য করেছিলো বনহুর মনিরার মুখে– কিন্তু তা কি করে সম্ভব হয় মনিরা তার সঙ্গে চাতুরী করবে তাকে ধরিয়ে দেবো পুলিশের হাতে! না না, বিশ্বাস হয় না ওকথা, মনিরা স্বামীকে বন্দী করতে পারে না। তাহলে কি এর পিছনে কোন অদৃশ্য ইংগিত রয়েছে।
বনহুর যতই ভাবছে ততই ঘোরালো হয়ে আসছে সমস্ত ঘটনাটা মনিরা শুধু তাকে ভালই বাসেনা সমস্ত অন্তর দিয়ে তাকে কামনা করে। কিছুতেই সে পারে না তাকে পুলিশের কবলে তুলে দিতে। নিশ্চয়ই কোন রহস্য আছে–
বনহুর অধর দংশন করে তাকায় বাইরের দিকে, মনিরাকে পুলিশ বাহিনী তার বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছে কি না কে জানে। মনিরার মুখখানা কারাগারে বন্দী হয়েও ভুলতে পারে না বনহুর। সত্যিই যদি মনিরা জেনেশুনে নাহার মঞ্জিলে এনে পুলিশের হাতে সঁপে দিয়ে থাকে, তাহলেও বনহুর তাকে ক্ষমা করবে?
বনহুর যখন গভীর চিন্তায় মগ্ন, তখন মিঃ আহম্মদ ও মিঃ জাফরী কারাগারে এলেন বনহুরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে।
বনহুর মৃত্তিকা শয্যায় হাঁটুর মধ্যে মাথা গুঁজে বসেছিলো।
মিঃ জাফরী ও মিঃ আহম্মদ এসে দাঁড়ালেন লৌহ দরজার পাশে। শিকের ফাঁকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দেখলেন–বনহুর নিশ্চুপ বসে আছে, কিছু চিন্তা করছে সে।
মিঃ আহম্মদ বললেন–কি ভাবছো দস্যু সম্রাট?
বনহুর মুখ তুলে তাকালো, গম্ভীর কণ্ঠে বললো–ভাবছি আমার প্রজাদের কথা।
প্রজা! হাসলেন মিঃ আহম্মদ–রাজ্যের কথা না ভেবে প্রজাদের কথা ভাবছো?
হাঁ ইন্সপেক্টার রাজ্যের কথা ভাববেন আপনারা, আর আমি ভাববো আমার শত শত দুঃস্থ ভাই বোনদের কথা। যাদের চোখের পানিতে সিক্ত হয়ে উঠে কান্দাই এর শুকনো মাটি।
ওঃ খুব তো সাধু বাক্যে আওড়াচ্ছো, কিন্তু মনে রেখো, এবার এই লৌহকক্ষ থেকে তোমার। মুক্তি নেই। চালাকি করে আমাকে বন্দী করেছিলে এবার তার পরাভোগ ভোগ করো। কথাগুলি বললেন মিঃ জাফরী।
বনহুর হাসলো, উঠে দাঁড়ালো এবার সে কারাগার মধ্যে। এগিয়ে এলো লৌহশিকের পাশে, বললো–ইন্সপেক্টার আমি চালাকি করে বন্দী করেছিলাম বটে আপনাকে কিন্তু তার পিছনে কোন মন্দ অভিসন্ধি ছিলোনা। দস্যু হলেও আমার উদ্দেশ্য কোনদিন উকট নয়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে। সংগ্রামই আমার কাজ।
যত ন্যায় কথাই বলো না কেনো, এবার তোমার সাধুগিরি সমাপ্ত হবে।
সে ভয়ে ভীত নয় বনহুর।
তোমাকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হবে। বললেন মিঃ আহম্মদ।
হঠাৎ অট্টহাসিতে ভেঙে পড়লো বনহুর–হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ–মৃত্যুদন্ড?
দস্যু বনহুরের হাসির শব্দ হাঙ্গেরিয়ার কারাগারের পাষাণ প্রাচীরে প্রতিধ্বনি জাগালো।
.
[পরবর্তী বই–দস্যু বনহুরের মৃত্যুদন্ড]