1 of 2

বন্দী আত্মার কাহিনী – হেমেন্দ্রকুমার রায়

বন্দী আত্মার কাহিনী – হেমেন্দ্রকুমার রায়

বিখ্যাত ‘ম্পিরিচুয়ালিস্ট’ অনন্তবাবুর বাড়িতে বসে এক সন্ধ্যায় আলাপ করছিলুম। কথা হচ্ছিল প্রেততত্ত্ব নিয়ে।

আমি ডাক্তার। কিঞ্চিৎ পসারও যে আছে, নিজের মুখে এ-কথা বললে গর্ব করা হবে না।

‘আত্মা’ বলে কোন কিছুর অস্তিত্ব যে আদৌ আছে, আমি আজ পর্যন্ত হাতে-নাতে এমন প্রমাণ কখনো পাইনি। জন্ম, মৃত্যু ও দেহগত সমস্ত রহস্য একেবারে আমার নখদর্পণে, এমন অভিমান আমার পুরোমাত্রায় আছে।

কিন্তু অনন্তবাবু আমার সেই অভিমানে আঘাত দিতে চান। তিনি বলেন, জন্ম ও মৃত্যু কথার কথা মাত্র, দেহটা সাময়িক খোলস ছাড়া আর কিছু না, জন্মের আগেও এবং মৃত্যুর পরেও আত্মা বেঁচে থাকে ইত্যাদি।

খুব জোরে তর্ক চালিয়েছি। আমিও বুঝব না, অনন্তবাবুও না বুঝিয়ে ছাড়বেন না। তর্কটা যখন রীতিমত জমে উঠেছে, হঠাৎ রাস্তায় উঠল ভীষণ গোলমাল। সচমকে মুখ ফিরিয়ে আমরা জানলা দিয়ে বাইরে চেয়ে দেখি, পথের ওপাশের ফুটপাথের ওপরে সুরেনবাবুর বাড়ির সামনে মস্ত ভিড়ের সৃষ্টি হয়েছে। আমরা সকলে ঘর থেকে বেরিয়ে দ্রুতপায়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে হাজির হলুম।

ফুটপাথের ওপরে হাত-পা ছড়িয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে রয়েছেন সুরেনবাবু নিজেই। তিনি কেবল আমাদের প্রতিবেশীই নন, আমাদের দুজনেরও বিশেষ বন্ধু বটে।

ভিড়ের একজন তোক জিজ্ঞাসার উত্তরে বলল, ‘বারন্দার ওপর থেকে উনি পড়ে গিয়েছেন।’

আমরা ধরাধরি করে সুরেনবাবুকে নিয়ে তাঁর বাড়ির ভেতরে ঢুকলাম। তারপর বৈঠকখানার তক্তপোশের ওপরে শুইয়ে রেখে তাঁকে পরীক্ষা করতে লাগলুম।

পরীক্ষার পর বুঝলুম, গতিক সুবিধের নয়। সুরেনবাবুর দেহের ওপরটায় গুরুতর আঘাতের চিহ্ন নেই বটে, কিন্তু তাঁর দেহের ভেতরের অবস্থা ভয়াবহ, এটা বেশ সহজেই আমি অনুমান করতে পারলুম।

অনন্তবাবুকে বললুম, ‘এঁর মৃত্যুর আর দেরি নেই।’

অনন্তবাবু বললেন, ‘কি সর্বনাশ, তাহলে উপায়? সুরেনের স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে সবাই যে হরিদ্বারে তীর্থ করতে গিয়েছে! বাড়িতে আর দ্বিতীয় ব্যক্তি নেই। এখন তাহলে আমরা কি করব? তাঁদেরও তো প্রয়োজন।’

বললুম, ‘আমার পরীক্ষা ভুল হতে পারে। দাঁড়ান, ডাক্তার পি. ঘোষকে ডাকি।’

ডাক্তার পি. ঘোষ হচ্ছেন কলকাতার শ্রেষ্ঠ ডাক্তারদের অন্যতম। ফোনে খবর পেয়েই এসে হাজির হলেন। সুরেনবাবুকে পরীক্ষা করে বললেন, ‘কোন আশা নেই। মিনিট কয়েকের মধ্যেই ইনি মারা যাবেন।’

আমি বললুম, ‘অনন্তবাবু, আপনার যদি ঠিকানা জানা থাকে, তবে সুরেনবাবুর স্ত্রী আর ছেলে-মেয়েদেরকে এক্ষুনি টেলিগ্রামে খবর দিন।’

‘ঠিকানাও জানি, টেলিগ্রামও যেন করে দিচ্ছি। কিন্তু আপনারা বলছেন সুরেন এখনি মারা যাবে। হরিদ্বার এখান থেকে একদিনের পথ নয়, সুরেনের আর কোন আত্মীয়ও নেই। সমস্ত ঝুঁকি আমাদেরই সামলাতে হবে তো? মৃতদেহ নিয়ে আমরা কি করব? মিস্টার ঘোষ, দেখুন —আপনাদের চিকিৎসা বিজ্ঞান যদি একে কোনরকমে আর দিন-তিনেক বাঁচিয়ে রাখতে পারে, ভাল হত তাহলে?’

ডাঃ ঘোষ মাথা নেড়ে বললেন, ‘অসম্ভব। এতক্ষণে মৃত্যু ওঁর দেহের ভেতরে প্রবেশ করেছে। এ অসাধ্য সাধন অসম্ভব! উনি মারা পড়লেন বলে।’

অনন্ত অত্যন্ত উত্তেজিতের মত একবার ঘরের এদিক থেকে ওদিক পর্যন্ত ঘুরে এলেন। তারপর হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে বললেন, ‘মৃত্যুর পরেও কি দেহের ভেতরে আত্মার সাড়া পাওয়া অসম্ভব, ডাক্তার ঘোষ?’

ডাঃ ঘোষ সবিস্ময়ে বললেন, ‘আপনি কী বলছেন?’

আমিও তখন হতভম্বের মত অনন্তবাবুর মুখের পানে তাকিয়ে রইলাম।

আমার দিকে চেয়ে তিনি বললেন, ‘আপনারা ‘হিপ্‌নটিজম্‌’ এর কথা নিশ্চয়ই জানেন? বাংলায় যাকে বলে সম্মোহন বিদ্যা বা যোগনিদ্রা?’

আমি বললুম, ‘জানি। আর এও জানি যে, ‘হিপ্‌নটিজম্‌’এ আপনার দেশজোড়া খ্যাতি আছে, অনন্তবাবু। কিন্তু তার কথা এখন কেন?

‘আমি এখনি একবার সুরেনকে সম্মোহন-বিদ্যায় অভিভূত করতে চাই।’

‘তাতে ফল কি হবে? সুরেনবাবু কি মৃত্যুর কবল থেকে রক্ষা পাবেন?’

‘মৃত্যুর’ কবল থেকে কোনদিন কোন মানুষই কোন মানুষকে রক্ষা করতে পারে না। তবে যোগনিদ্রার একটা আশ্চর্য মহিমা আছে। তার দ্বারা নিশ্চয়ই একটা কিছু ফল পাওয়া যাবে, তাতে কোনই সন্দেহ নেই। সেটা যে কি, তা অবশ্য আমি বলতে পারছি না, তবে—না, থাক! আর কথা বাড়াবার সময় নেই। সুরেনের দিকে তাকিয়ে দেখুন, ওর শেষ মুহূর্ত উপস্থিত!’

সুরেনবাবুর মুখ তখন মৃত্যু-যন্ত্রণায় ভীষণ হয়ে উঠেছে তাঁর দুই বিস্ফারিত চোখের তারা চারিদিকে ঘুরছিল। অনন্তবাবু তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে সুরেনবাবুর দেহে ওপরে বিশেষ কৌশলে হস্তচালনা করতে লাগলেন।

ডাঃ ঘোষ গম্ভীর মুখে বসে রইলেন। তাঁর চোখে নিদারুণ অবিশ্বাসের ছায়া।

কি আর করি, আমি অবাক হয়ে অনন্তবাবুর কাণ্ড-কারখানা দেখতে লাগলুম।

কয়েক মুহূর্ত পরে তেমনিভাবে হস্তচালনা করতে করতেই অনন্তবাবু দৃঢ়স্বরে বারংবার ডাকতে লাগলেন, ‘সুরেন ! ও সুরেন! সুরেন!’

প্রথমটা সুরেনবাবুর কোনরকম ভাবান্তরই হতে দেখা গেল না। তারপর ধীরে ধীরে তাঁর চোখের তারা স্থির ও স্বাভাবিক হয়ে এল।

অনন্তবাবু বললেন, ‘সুরেন, আমার চোখের দিকে এবার তাকিয়ে দেখ।’

সুরেনবাবুর চোখ অনশুবাবুর চোখের দিকে ফিরল—সঙ্গে সঙ্গে তাঁর সারা দেহ একবার শিউরে উঠল।

‘সুরেন!’

স্বাভাবিক কণ্ঠে জবাব হল, ‘কি?’

‘তোমার কি কোন কষ্ট হচ্ছে?’

‘না।’

‘তবে?’

জবাব নেই। আবার তিন-চারবার ডাকাডাকির পর সুরেনবাবু চমকে উঠে বললেন, ‘অ্যাঁ?’

‘তুমি কি ঘুমোচ্ছ?’

‘হ্যাঁ। আর আমায় ডেকো না তোমরা, আমাকে ঘুমোতে ঘুমোতে মরতে দাও।’

‘তবে তুমি ঘুমোও। কাল সকালে আমি তোমাকে ডাকব। তোমাকে সাড়া দিতেই হবে।’

‘সাড়া দেব। এখন আমি মরছি। আমাকে ঘুমোত দাও।’ সুরেনবাবুর দুই চোখ মুদে গেল।

অনন্তবাবু আমাদের কাছে এসে বললেন, ‘আপনাদের মত কি, কিরকম বুঝলেন?’

ডাঃ ঘোষ বললেন, ‘আপনি কি ভাবছেন, কাল সকালে ওর সাড়া পাওয়া যাবে?’

‘হ্যাঁ।’

‘অসম্ভব! তাহলে তো চিকিৎসা-বিজ্ঞান ব্যর্থ হয়ে যাবে।’

‘বেশ, কাল সকালে এসে দেখবেন।’

‘আসব। যদিও জানি অসম্ভব সম্ভব হবে না, তবু আপনি আমার কৌতূহল জাগিয়ে তুলেছেন। কাল সকালে আমি আবার আসছি।

পরদিনের সকাল। বহুকাল ধরে প্রেততত্ত্ব নিয়ে ক্রমাগত নাড়াচাড়া করে করে গোঁড়ামির দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে অনন্তবাবু বিচারশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন, এই কথা বলাবলি করতে করতে ডাঃ ঘোষের সঙ্গে আমি সুরেনবাবুর বাড়িতে গিয়ে হাজির হলুম। দেখলুম, বৈঠকখানার সমস্ত জানলা বন্ধ করে আধা অন্ধকার ঘরে সুরেনবাবুর দেহের পাশে অনন্তবাবু চুপ করে বসে আছেন। সমস্ত নিথর, নিঝুম!

ডাঃ ঘোষ সুরেনবাবুর দেহ পরীক্ষা করে বললেন, ‘দেহ শীতল আর আড়ষ্ট। হৃৎপিণ্ডের ক্রিয়া স্তব্ধ। শ্বাস-প্রশ্বাস নেই। কাল রাত্রেই এঁর মৃত্যু হয়েছে।’ ডাক্তার জিগ্যেস করলেন, ‘অনন্তবাবু, এখনো কি আপনার সন্দেহ দূর হয়নি?’

অনন্তবাবু উত্তর দিলেন না।

সুরেনবাবুর গায়ের রং রীতিমত হলদেটে হয়ে গেছে। তাঁর দুই চোখ বোজা। মুখ হাঁ করা।

আমি বললুম, ‘আর কেন অনন্তবাবু, এবার এঁর সৎকারের ব্যবস্থা করুন।’

‘হরিদ্বারে তার করে দিয়েছি! আগে সুরেনের স্ত্রী আর ছেলে-মেয়েরা আসুক।’

‘সে কি! ততক্ষণে ওঁর দেহটার কি অবস্থা হবে, বুঝতে পারছেন, আপনি?’

‘দেহের কি অবস্থা হবে বুঝতে পারছি না। তবে সুরেনকে আর একবার ডেকে দেখা দরকার।’

ডাঃ ঘোষ বললেন, ‘আপনার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? আর কাকে ডাকবেন?’

‘সুরেনকে। …সুরেন, সুরেন!’

কোন সাড়া নেই।

ডাঃ ঘোষ বললেন, ‘কি আশ্চর্য! মড়া কখনো কথা কয় নাকি আবার?’

‘সুরেন, সুরেন! আমি অনন্ত, তোমাকে ডাকছি। সুরেন একবার সাড়া দাও।’

স্তম্ভিত নেত্রে দেখলুম সুরেনবাবুর ফাঁক করা ওষ্ঠাধরের ওপাশে জিভখানা ছটফট করছে যেন!’

‘সুরেন, সুরেন!’

সুরেনবাবুর চোয়াল ও ওষ্ঠাধর একটুও নড়ল না, কিন্তু তাঁর হাঁ-করা মুখবিবর থেকে অদ্ভুত বিকৃত স্বরে এই কথাগুলো বেরুল, ‘আঃ, আবার কেন? আমার মৃত্যু হয়েছে। আমি এখন ঘুমোচ্ছি।’

সে কী স্বর! মনে হল, সুরেনবাবুর মুখ যেন কথা কইছে না, সে-সুর আসছে যেন বহুদূর থেকে—যেন গভীর কোন গিরিগুহার অতলতার ভেতর থেকে।

একটা অজানা ভয়ে আমার গা কাঁপতে লাগল। ডাঃ ঘোষ যেন ধাক্কা খেয়ে পিছিয়ে গিয়ে দাঁড়ালেন দেয়ালে পিঠ রেখে। তাঁর মুখ-চোখ উদ্‌ভ্রান্তের মত।

‘সুরেন, তুমি কি এখনো ঘুমিয়ে আছ?’

‘না না, আমি ঘুমোচ্ছিলুম বটে! কিন্তু এখন আমার মৃত্যু হয়েছে।’

‘সুরেন, আবার তুমি ঘুমিয়ে পড়। …ডাক্তার ঘোষ, আপনার কোন বক্তব্য আছে?’

ডাঃ ঘোষ ক্ষীণ স্বরে বললেন, ‘না।’

সুরেনবাবুর কণ্ঠস্বর কি রকম মনে হল?’

‘ভয়ানক। মানুষের গলার ভেতর থেকে যে ওরকম বীভত্স আওয়াজ বেরুতে পারে, এটা ধারণারও অতীত। ও তো কণ্ঠস্বর নয়—যেন একটা অমানুষিক ধ্বনি মাত্র!’

‘কিন্তু ও ধ্বনি তো অপর কারো নয়, ও ধ্বনি তো আসছে সুরেনেরই গলার ভেতর থেকে। সুরেনকে আজ আর ব্যস্ত করব না, ও এখন নিশ্চিন্ত আরামে ঘুমিয়েই থাক। বোধহয় পরশুদিনই সুরেনের স্ত্রী এসে পড়বেন, তখন আর একবার আপনাকে ডাকব, আসবেন তো?’

‘নিশ্চয়ই আসব! ডাঃ ঘোষ তাঁর বিস্ময়াবিষ্ট কৌতূহল দমন করে শশব্যস্ত হয়ে বললেন, ‘এ যে অজানা নতুন বিজ্ঞানের রহস্য! না এসে থাকতে পারব না।’

আজ অনন্তবাবুর আহ্বানে আবার সুরেনবাবুর বাড়িতে চলেছি আমরা দুজনে। সন্তানদের নিয়ে সুরেনবাবুর স্ত্রী কলকাতায় এসে পৌঁছেছেন। তাঁর নাম হৈমবতী।

ক্রন্দনধ্বনি শুনতে শুনতে সুরেনবাবুর বৈঠকখানার ভেতরে গিয়ে ঢুকলুম। সুরেনবাবুর আড়ষ্ট দেহ ঘিরে বসে আছেন হৈমবতী। তাঁর দুই ছেলে আর এক মেয়ে। সকলের চোখে জল, কন্ঠে আর্তনাদ।

অনন্তবাবু বসে আছেন মৃতদেহের ডান পাশে। মুদিত নেত্রে তিনি মূর্তির মত স্থির—যেন ধ্যানমগ্ন।

সুরেনবাবুর দেহ যেমনভাবে দেখে গিয়েছিলুম তেমনিভাবেই আছে। হৈমবতী গতকাল এসেছেন। হিসেব করে দেখলুম সুরেনবাবুর মৃত্যুর পর পাঁচদিন কেটে গিয়েছে। একে গ্রীষ্মকাল, তায় এ বছর আবার অতিরিক্ত গরম। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার এই যে, সুরেনবাবুর গায়ের রং হলদে এবং দেহ মৃত্যু-শীতল ও কাঠ আড়ষ্ট হয়ে গেলেও একটুও পচেনি বা ফুলে ওঠেনি।

অনন্তবাবু চোখ খুলে বললেন, ‘এই যে, আপনার এসেছেন। হৈমবতী বড়ই ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। তাহলে সুরেনকে আর একবার জাগাবার চেষ্টা করি?’

আমরা নীরবে ঘাড় নেড়ে সায় দিলুম। যদিও আমার বুকের ভেতরে জাগল কাঁপন।

মৃতদেহের ওপরে খানিকক্ষণ হস্তচালনা করে অনন্তবাবু ডাকলেন, ‘সুরেন! সুরেন! সুরেন!…’

প্রায় দশ-বারোবার নাম ধরে ডাকার পর মৃতদেহের আড়ষ্ট হাঁ-করা মুখের ভিতরে জিভখানা হয়ে উঠল আবার সেই রকম ভয়াবহরূপে চঞ্চল।

হৈমবতী স্বামীর বুকের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে ক্রন্দনস্বরে বলে উঠলেন, ‘ওগো, তাহলে তুমি সত্যিই বেঁচে আছ?’

ছেলে-মেয়েরাও বাবা, বাবা বলে চেচিয়ে কেঁদে উঠল।

অনন্তবাবু বললেন, ‘কথা কও সুরেন, কথা কও!’

আবার শোনা গেল সেই বর্ণনাতীত ভয়ঙ্কর কণ্ঠস্বর—যা আসছে যেন বাড়ির বাইরে পৃথিবীর অতল পাতালের ভেতর থেকে, ‘আঃ, আবার কেন ডাকাডাকি? বলেছি তো, আমি বেঁচে নেই!’

হৈমবতী বললেন, ‘ওগো, এই তো তুমি বেঁচে আছ—এই তো তুমি কথা কইছ! একবার চোখ মেলে তাকিয়ে দেখ। আমরা সবাই এসেছি।’

অনন্তবাবু বললেন, ‘হৈম স্থির হও—শান্ত হও। সুরেন এখন আমি ছাড়া আর কারোর কথার জবাব দেবে না। সুরেন, হৈম তোমাকে ডাকছে।’

মৃতদেহ বলল, ‘ডেকে লাভ নেই। আমার মৃত্যু হয়েছে।’

‘তোমার যদি মৃত্যু হয়ে থাকে, তবে তুমি কথা কইছ কেমন করে?’

‘আমি এখন আমার মৃতদেহের ভেতর বন্দী হয়ে আছি।’

‘বন্দী! কেন?’

‘তুমি যেতে দিচ্ছ না বলে।’

অনন্তবাবু এতক্ষণ সমানে হস্তচালনা করছিলেন। এই ব্যাপারে তিনি যে তাঁর সমস্ত ইচ্ছাশক্তিকে প্রবলভাবে নিযুক্ত করেছেন, সেটা বোঝা যায় তাঁর চেহারা দেখে। তাঁর কপালের ওপরে শিরাগুলো এবং কণ্ঠের ওপরে মাংসপেশীগুলো দ্বিগুণ ফুলে এবং মুখের রং রাঙা টক্‌টকে হয়ে উঠেছে।

হঠাৎ তিনি হস্তচালনা বন্ধ করে খানিকক্ষণ নীরবে অত্যন্ত হাঁপাতে লাগলেন। তারপর ফিরে বললেন, ‘হৈম, আর কেন?’ তোমার জন্যেই সুরেনকে যোগনিদ্রায় আচ্ছন্ন করে রেখেছিলুম। এইবার ওর ঘুম ভাঙাই, ওর আত্মাকে মুক্তি দিই, তোমরা মৃতদেহের সৎকারের ব্যবস্থা কর।’

হৈমবতী এমন তীব্রম্বরে চেঁচিয়ে কেঁদে উঠলেন যে আমাদের কান যেন ফেটে গেল। তারপর তিনি মাটির ওপরে আছড়ে পড়ে বললেন, ‘অনন্তবাবু—অনন্তবাবু, আমাকে দয়া করুন! উনি এ অবস্থাতে থাকলেও আমার সুখ। মনে করব আমি বিধবা হইনি।’

অনন্তবাবুর মুখে ফুটে উঠল এক সঙ্গে ব্যথা, দয়া ও মমতার ভাব। অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে তিনি বললেন, ‘বেশ, বৌমা—তাই হোক। আরো কিছুদিন এইভাবে যাক। তুমি শান্ত হও—সংযত হও। তারপর আমার যা করবার করব—মনে রেখ মা, আমি হচ্ছি তুচ্ছ মানুষ। মৃত্যু হচ্ছে ভগবানের ইচ্ছা, তাকে বাধা দেবার চেষ্টা করলে আমারও সর্বনাশ হবে, আমিও বাঁচব না।’

অনন্তবাবু উঠে দাঁড়ালেন। এতক্ষণ আমরা ছিলুম দুঃস্বপ্নে অভিভূতের মত, অসাড় হয়ে। অনন্তবাবু উঠে দাঁড়াতেই সাড় হল আমাদের।

ডাঃ ঘোষ বললেন, ‘আমি আর সহ্য করতে পারছি না—আমার প্রাণ-মন হাঁপিয়ে উঠেছে!’

আমি বললুম, ‘আমারও। বাইরে বেরুতে পারলেই বাঁচি!’

অনন্তবাবুও হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, ‘আমারও ওই ইচ্ছা। চলুন, আমরা বাড়ি যাই।’

তারপর কেটে গেছে দু’মাস। সুরেনবাবুর দেহ পড়ে আছে বৈঠকখানার তক্তপোশে। তাতে এখনো পচ ধরেনি।

ইতিমধ্যে এই অদ্ভুত খবর শুনে দলে দলে বাইরের লোক এবং খবরের কাগজের সংবাদদাতারা সুরেনবাবুর বাড়িতে আনাগোনা শুরু করে দিয়েছিল। অনন্তবাবু খাপ্পা হয়ে উঠেছিলেন, বাইরের লোকেরা আর ভেতরে ঢুকতে পায় না। খবরটা রটে গিয়েছিল দিকে দিকে। চারিদিকে বিষম উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে। কেবল বাঙালী নয়, ইংরেজ এবং আরো নানাজাতীয় লোকেও কৌতূহলী হয়ে আবেদন জানাচ্ছেন, সুরেনবাবুর দেহ পরিদর্শনের জন্যে। আবেদনকারীদের মধ্যে ছিল বহু বিখ্যাত নাম।

একদিন অনন্তবাবুর জরুরী আত্মন এল। তাঁর বাড়ির কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই শুনলুম সুরেনবাবুর বাড়ির ভেতর থেকে কান্নার আওয়াজ। অনন্তবাবুর বৈঠকখানায় ঢুকে দেখি, একখানা চেয়ারের ওপরে বসে আছেন ডাঃ ঘোষ। অনন্তবাবু ঘরময় ঘুরে বেড়াচ্ছেন, তাঁর ভাবভঙ্গী কুদ্ধ, বিরক্ত।

আমাকে দেখেই তিনি বললেন, ‘কান্না শুনতে পাচ্ছেন?’

‘হ্যাঁ, ব্যাপার কি?’

‘আজ সুরেনের যোগনিদ্রা ভাঙব, তাই ওই কান্না। হৈমবতীর ইচ্ছা, সুরেনের দেহ ওইভাবেই থাকুক। কিন্তু তাও কি সম্ভব? আমি বেশ বুঝতে পারছি, আমার নিজের স্বাস্থ্য দিনে দিনে ভেঙে পড়ছে—এই অস্বাভাবিক উত্তেজনা আর কতদিন সহ হয়? প্রবল ইচ্ছা-শক্তিরও সীমা আছে।’

‘এই জনেই আমাকে ডেকেছেন?’

‘আপনাকেও, ডাক্তার ঘোষকেও। আর একটা কি কথা জানেন? নিজেকে অপরাধী বলে মনে হচ্ছে।’

‘কেন?’

‘বোধহয় প্রকৃতির আইন ভঙ্গ করছি। ভগবান সুরেনের আত্মাকে যে অদৃশ্য পথে নিয়ে যেতে চান, আমি হয়েছি তার বাধার মত। এ এক মস্ত অপরাধ, এজন্যে হয়তো আমাকে শাস্তি ভোগ করতে হবে। হয়তো একটা প্রাণহীন কুৎসিত দেহের কারাগারে বন্দী হয়ে সুরেনের আত্মাও অত্যন্ত কষ্ট ভোগ করছে। না, আর নয়। আমি দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করেছি, এ ব্যাপারের ওপরে আজকেই যবনিকা ফেলে দেব। কারোর মিনতি, কারোর অশ্রু আর আমাকে বাধা দিতে পারবে না। আসুন আপনারা। গোড়া থেকেই যখন সঙ্গে আছেন, তখন শেষ দৃশ্যটাও দেখুন।

শেষ পর্যন্ত হৈমবতীকেও সম্মতি দিতে হল।

অনন্তবাবু অনেক চেষ্টার পর তাঁকে বুঝিয়ে দিয়েছেন, এই মৃতদেহ্বে মধ্যে সুরেনবাবুর আত্মা বন্দী হয়ে আছে অভিশপ্তের মত, দেহ থেকে বেরুতে না পারলে আত্মার গতি হবে না।

অনন্তবাবু দেহের পাশে বসে হতচালনা করতে করতে ডাকলেন, ‘সুরেন, সুরেন, সুরেন!’

আমরা রোমাঞ্চিত দেহে, বিস্ফারিত নেত্রে রুদ্ধশ্বাসে মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে রইলাম। সাত-আট মিনিট কেটে গেল, দেহ নিঃসাড়, নিস্পন্দ। অনন্তবাবুর কপাল থেকে দরদর ধারে ঘাম ঝরতে লাগল।

‘সুরেন, সুরেন! জাগো, সাড়া দাও। আমি অনন্ত, তোমাকে ডাকছি, সুরেন।’

আরও সাত-আট মিনিট কাটল।

অনন্তবাবু উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললেন, ‘তবে কি ব্যর্থ হব? সুরেনের আত্মা কি নেই? না না, তা তো হতে পারে না। যোগনিদ্রার প্রভাব না থাকলে দেহের অবস্থান হত যে অন্যরকম !….সুরেন, সুরেন, জাগো—তোমার যোগনিদ্রা ভঙ্গ হোক।’

এইবার উন্মুক্ত, দস্তকণ্টকিত মুখবিবরের মধ্যে জ্যাস্ত হয়ে ছটফট করতে লাগলো জিভখানা।

‘সুরেন!’

উত্তরে শোনা গেল এক ভীষণ ও তীক্ষ্ণ আর্তধ্বনি! সে আর্তনাদ ভাষায় বর্ণনা করা যায় না, মানুষের কান কোনদিন শোনেনি তেমন আর্তনাদ! ছেলে-মেয়েরা ঘর ছেড়ে পালিয়ে গেল। হৈমবতী মুর্ছিত হয়ে পড়লেন। আমাদের অবস্থা হয়ে দাঁড়াল শোচনীয়!

‘সুরেন, শান্ত হও ভাই শান্ত হও!’

‘শান্ত হব? তোমরা জানো না, এই দেহের নরকে কি দুঃসহ যন্ত্রণা! নিশিদিন কাঁদছি আর ছটফট করছি—মৃত্যুর পরেও একি শাস্তি? আর কেন? আমাকে এবার মুক্তি দাও—মুক্তি দাও!’ আজকের স্বর আরো বিকট ও ভয়াল এবং আসছে যেন আরো—আরো—আরো বেশি দূর থেকে।

অনন্তবাবু বললেন, ‘তোমাকে মুক্তি দিলুম, সুরেন। ভেঙে যাক তোমার যোগনিদ্রা!’

পরমুহূর্তে অদ্ভুত একটা শব্দ হল। সঙ্গে সঙ্গে আমের মত দেখলুম, তক্তপোশের ওপর পড়ে রয়েছে সুরেনবাবরু দেহের বদলে একটা নর-কঙ্কাল এবং তার চারিদিক ঘিরে গড়াচ্ছে বিগলিত মাংস-মেদ-মজ্জার তরল, বিবর্ণ ধারা। বিষম পূর্তিগন্ধে ঘরের বাতাস দুর্গন্ধ, বিষাক্ত!

…সভয়ে প্রাণপণে দৌড়ে বাইরে পালিয়ে এলুম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *