1 of 2

বন্দি আত্মার কাহিনি

বন্দি আত্মার কাহিনি

বিখ্যাত ‘স্পিরিচুয়ালিস্ট’ অনন্তবাবুর বাড়িতে বসে এক সন্ধ্যায় আলাপ করছিলুম।

কথা হচ্ছিল প্রেততত্ত্ব নিয়ে। আমি ডাক্তার। কিঞ্চিৎ পসারও যে আছে, নিজের মুখে এ-কথা বললে গর্ব করা হবে না।

আত্মা বলে কোনো-কিছুর অস্তিত্ব আছে, আজ পর্যন্ত হাতেনাতে এমন প্রমাণ পাইনি। জন্ম, মৃত্যু ও দেহগত সমস্ত রহস্য আমার নখদর্পণে, এমন অভিমান আমার আছে।

কিন্তু অনন্তবাবু আমার সেই অভিমানে আঘাত দিতে চান। তিনি বলেন, জন্ম ও মৃত্যু কথা মাত্র, দেহটা সাময়িক খোলস ছাড়া আর কিছু না, জন্মের আগেও এবং মৃত্যুর পরেও আত্মা বেঁচে থাকে ইত্যাদি।

খুব জোরে তর্ক চালিয়েছি। আমিও বুঝব না, অনন্তবাবুও না বুঝিয়ে ছাড়বেন না। তর্কটা যখন রীতিমতো জমে উঠেছে, হঠাৎ রাস্তায় উঠল বিষম গোলমাল। সচমকে মুখ ফিরিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে দেখি, পথের ওপাশের ‘ফুটপাথে’র ওপরে সুরেনবাবুর বাড়ির সামনে মস্ত ভিড়ের সৃষ্টি হয়েছে। আমরা ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে দ্রুতপদে ঘটনাস্থলে গিয়ে হাজির হলুম।

‘ফুটপাথে’র ওপরে হাত-পা ছড়িয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে রয়েছেন সুরেনবাবু নিজেই। তিনি কেবল আমাদের প্রতিবেশী নন, আমাদের দু-জনেরই বিশেষ বন্ধু।

ভিড়ের মধ্যে একজন লোক জিজ্ঞাসার উত্তরে বললে, ‘উনি বারান্দার ওপর থেকে পড়ে গিয়েছেন।’

আমরা ধরাধরি করে সুরেনবাবুকে নিয়ে তাঁর বাড়ির ভিতরে ঢুকলুম। তারপর বৈঠকখানার তক্তাপোশের ওপরে শুইয়ে রেখে তাঁকে পরীক্ষা করতে লাগলুম।

পরীক্ষার পর বুঝলুম, গতিক সুবিধার নয়। সুরেনবাবুর দেহের ওপরটায় গুরুতর আঘাতের চিহ্ন নেই বটে, কিন্তু তাঁর দেহের ভিতরের অবস্থা যে ভয়াবহ, এই অনুমান করতে পারলুম।

অনন্তবাবুকে বললুম, ‘এঁর মৃত্যুর আর দেরি নেই।’

অনন্তবাবু বললেন, ‘কী সর্বনাশ! তাহলে উপায়? সুরেনের স্ত্রী ছেলে মেয়ে— সবাই যে হরিদ্বারে তীর্থ করতে গিয়েছে। বাড়িতে আর দ্বিতীয় ব্যক্তি নেই। এখন আমরা কী করব?’

বললুম, ‘আমার পরীক্ষা ভুল হতে পারে। দাঁড়ান, ডাক্তার পি. ঘোষকে ডাকি।’

ডাক্তার পি. ঘোষ হচ্ছেন কলকাতার শ্রেষ্ঠ ডাক্তারদের অন্যতম। ‘ফোনে’ খবর পেয়েই এসে হাজির হলেন। সুরেনবাবুকে পরীক্ষা করে বললেন, ‘কোনো আশা নেই। মিনিট কয়েকের মধ্যেই ইনি মারা যাবেন।’

আমি বললুম, ‘অনন্তবাবু, যদি আপনার ঠিকানা জানা থাকে, তবে সুরেনবাবুর স্ত্রীকে এখনি তারে খবর দিন।’

‘ঠিকানাও জানি, তারও না হয় করে দিচ্ছি। কিন্তু আপনারা বলছেন সুরেনবাবু এখনই মারা যাবেন। হরিদ্বার এখান থেকে একদিনের পথ নয়, সুরেনের আর কোনো আত্মীয়ও নেই। সমস্ত ঝুঁকি আমাদেরই সামলাতে হবে তো? মৃতদেহ নিয়ে আমরা কী করব? মি. ঘোষ দেখুন, আপনাদের চিকিৎসাবিজ্ঞান যদি এঁকে কোনোরকমে আর দিন-তিনেক বাঁচিয়ে রাখতে পারে।’

ডাক্তার ঘোষ মাথা নেড়ে বললেন, ‘অসম্ভব! এতক্ষণে মৃত্যু ওঁর দেহের ভিতরে প্রবেশ করেছে। উনি মারা গেলেন বলে।’

অনন্তবাবু অত্যন্ত উত্তেজিতের মতো একবার ঘরের এদিক থেকে ওদিক পর্যন্ত ঘুরে এলেন। তারপর হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে বললেন, ‘মৃত্যুর পরেও কি দেহের ভিতরে আত্মার সাড়া পাওয়া একেবারেই অসম্ভব?’

ডাক্তার ঘোষ সবিস্ময়ে বললেন, ‘আপনি কী বলছেন!’

আমিও হতভম্বের মতন অনন্তবাবুর মুখের পানে তাকিয়ে রইলুম।

আমার দিকে চেয়ে তিনি বললেন, ‘আপনারা ”হিপনটিজম”-এর কথা জানেন তো? বাংলায় যাকে বলে সম্মোহন বিদ্যা বা যোগনিদ্রা?’

আমি বললুম, ‘জানি। আর এও জানি যে, ”হিপনটিজম”-এ আপনার দেশজোড়া খ্যাতি আছে। কিন্তু তার কথা এখন কেন?’

‘আমি এখনি সুরেনকে সম্মোহন-বিদ্যায় অভিভূত করতে চাই?’

‘তাতে ফল কী হবে? সুরেনবাবু কি মৃত্যুর কবল থেকে রক্ষা পাবেন?’

‘মৃত্যুর কবল থেকে কোনো মানুষই কোনো মানুষকে রক্ষা করতে পারে না। তবে যোগনিদ্রার একটা আশ্চর্য মহিমা আছে। তার দ্বারা নিশ্চয়ই একটা ফল পাওয়া যাবে। সে যে কী তা আমি বলতে পারছি না, তবে— না, থাক! আর কথার সময় নেই। সুরেনের দিকে তাকিয়ে দেখুন, ওঁর শেষমুহূর্ত উপস্থিত।’

দুই

সুরেনবাবুর মুখ তখন মৃত্যু-যন্ত্রণায় ভীষণ হয়ে উঠেছে। তাঁর দুই বিস্ফারিত চোখের তারা চারিদিকে ঘুরছিল। অনন্তবাবু তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে সুরেনবাবুর দেহের উপরে বিশেষ কৌশলে হস্ত-চালনা করতে লাগলেন। ডাক্তার ঘোষ গম্ভীরভাবে বসে রইলেন। তাঁর মুখে-চোখে দারুণ অবিশ্বাসের ভাব।

আমি অবাক হয়ে অনন্তবাবুর কাণ্ডকারখানা দেখতে লাগলুম।

কয়েক মুহূর্ত পরে তেমনি হস্ত-চালনা করতে-করতেই অনন্তবাবু দৃঢ়স্বরে বারংবার ডাকতে লাগলেন, ‘সুরেন! সুরেন! সুরেন!’

প্রথমটা সুরেনবাবুর কোনোরকম ভাবান্তর হল না। তারপর ধীরে ধীরে তাঁর চোখের তারা স্থির ও স্বাভাবিক হয়ে গেল।

অনন্তবাবু বললেন, ‘সুরেন আমার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখ।’

সুরেনবাবুর চোখ অনন্তবাবুর চোখের দিকে ফিরল— সঙ্গে সঙ্গে তাঁর সারা দেহ একেবার শিউরে উঠল।

‘সুরেন!’

স্বাভাবিক কণ্ঠে জবাব হল, ‘কি?’

‘তোমার কি কষ্ট হচ্ছে?’

‘না।’

‘তবে?’

জবাব নেই। আবার তিন-চারবার ডাকাডাকির পর সুরেনবাবু চমকে উঠে বললেন, ‘অ্যাঁ।’

‘তুমি কি ঘুমুচ্ছ?’

‘হ্যাঁ। আর আমায় ডেকো না, আমাকে ঘুমুতে -ঘুমুতে মরতে দাও।’

‘তবে তুমি ঘুমোও। কাল সকালে আবার আমি তোমাকে ডাকব। তোমাকে সাড়া দিতেই হবে।’

‘সাড়া দেব। এখন আমি মরছি। আমাকে ঘুমুতে দাও। সুরেনবাবুর দুই চোখ মুদে গেল।’

অনন্তবাবু আমাদের কাছে এসে বললেন, ‘আপনাদের মত কী?’

ডাক্তার ঘোষ বললেন, ‘আপনি কি ভাবছেন, কাল সকালে ওঁর সাড়া পাওয়া যাবে?’

‘হ্যাঁ।’

‘অসম্ভব! তাহলে আমাদের চিকিৎসা বিজ্ঞান ব্যর্থ হয়ে যাবে।’

‘বেশ, কাল সকালে এসে দেখবেন।’

‘আসব। যদিও জানি অসম্ভব সম্ভব হবে না, তবু আপনি আমার কৌতূহল জাগিয়ে তুললেন। কাল সকালে আমি আসছি।’

তিন

পরদিনের সকালে বহুকাল ধরে প্রেততত্ত্ব নিয়ে ক্রমাগত নাড়াচাড়া করে করে গোঁড়ামির দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে অনন্তবাবু বিচারশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন— এই কথা বলাবলি করতে করতে ডাক্তার ঘোষের সঙ্গে আমি সুরেনবাবুর বাড়িতে গিয়ে হাজির হলুম। দেখলুম বৈঠকখানার সমস্ত জানালা বন্ধ করে আধা-অন্ধকার ঘরে সুরেনবাবুর দেহের পাশে অনন্তবাবু চুপ করে বসে আছেন।

ডাক্তার ঘোষ সুরেনবাবুর দেহ পরীক্ষা করে বললেন, ‘দেহ শীতল আর আড়ষ্ট। হৃৎপিণ্ডের ক্রিয়া বন্ধ। শ্বাস-প্রশ্বাস নেই। কাল রাত্রেই এর মৃত্যু হয়েছে। অনন্তবাবু, এখনও কি আপনার সন্দেহ দূর হয়নি?’

অনন্তবাবু উত্তর দিলেন না।

সুরেনবাবুর গায়ের রং রীতিমতো হলদেটে হয়ে গেছে। তাঁর দুই চোখ মোদা। মুখ হাঁ করা।

আমি বললুম, ‘আর কেন অনন্তবাবু, এইবারে এঁর সৎকারের ব্যবস্থা করুন।’

‘হরিদ্বারে তার করে দিয়েছি। আগে সুরেনের স্ত্রী আর ছেলে-মেয়েরা আসুক।’

‘সে কী, ততক্ষণে দেহের কী অবস্থা হবে! বুঝতে পারছেন?’

‘দেহের কী অবস্থা হবে বুঝতে পারছি না। তবে সুরেনকে আর একবার ডেকে দেখা দরকার।’

ডাক্তার ঘোষ বললেন, ‘আপনার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? আর কাকে ডাকবেন?’

‘সুরেনকে।… সুরেন, সুরেন! কোনো সাড়া নেই।

ডাক্তার ঘোষ বললেন, ‘কী আশ্চর্য, মরা মানুষ কখনো কথা কয়?’

‘সুরেন, সুরেন! আমি ডাকছি। সুরেন সাড়া দাও।’

স্তম্ভিত নেত্রে দেখলুম, সুরেনবাবুর ফাঁক-করা ওষ্ঠাধরের ওপাশে জিভখানা যেন ছটফট করছে।

‘সুরেন, সুরেন!’

সুরেনবাবুর চোয়াল ও ওষ্ঠাধর একটুও নড়ল না, কিন্তু তাঁর হাঁ-করা মুখবিবর থেকে অদ্ভুত বিকৃত স্বরে এই কথাগুলো বেরুল— ‘আঃ! আবার কেন? আমার মৃত্যু হয়েছে! আমি এখন ঘুমুচ্ছি!’

সে কী স্বর! মনে হল সুরেনবাবুর মুখ যেন কথা কইছে না, সে স্বর আসছে যেন বহুদূর থেকে— যেন গভীর কোনো গিরিগুহার অতল গহ্বরের ভিতর থেকে।

একটা অজানা ভয়ে আমার গা কাঁপতে লাগল। ডাক্তার ঘোষ যেন ধাক্কা খেয়ে পিছিয়ে গিয়ে দেওয়ালে পিঠ রেখে দাঁড়ালেন। তাঁর মুখ-চোখ উদভ্রান্তের মতো।

‘সুরেন, তুমি কি এখনও ঘুমিয়ে আছ?’

‘না, না, আমি ঘুমুচ্ছিলুম বটে! কিন্তু এখন আমার মৃত্যু হয়েছে?’

‘সুরেন, আবার তুমি ঘুমিয়ে পড়।… ডাক্তার ঘোষ, এখন আপনার কোনো বক্তব্য আছে?’

ডাক্তার ঘোষ ক্ষীণস্বরে বললেন, ‘না’।

‘সুরেনবাবুর কণ্ঠস্বর কীরকম মনে হল?’

‘ভয়ানক! মানুষের গলার ভিতর থেকে যে ওরকম বীভৎস আওয়াজ বেরুতে পারে, এটা ধারণারও অতীত। ও তো মানুষের কণ্ঠস্বর নয়— যেন একটা অমানুষিক ধ্বনি মাত্র।

‘কিন্তু ও ধ্বনি আসছে সুরেনেরই গলার ভিতর থেকে। সুরেনকে আর ব্যস্ত করব না, ও এখন ঘুমিয়েই থাক। বোধ হয় পরশুদিনই সুরেনের স্ত্রী এসে পড়বেন। তখন আর একবার আপনাকে ডাকব, আসবেন তো?’

‘নিশ্চয়ই আসব! এ যে এক অজানা নতুন বিজ্ঞানের রহস্য। না-এসে থাকতে পারব না।’

চার

আজ অনন্তবাবুর আহ্বানে আবার সুরেনবাবুর বাড়িতে চলেছি আমরা দুজনে। সন্তানদের নিয়ে সুরেনবাবুর স্ত্রী কলকাতায় এসে পৌঁচেছেন। তাঁর নাম হৈমবতী।

ক্রন্দনধ্বনি শুনতে শুনতে সুরেনবাবুর বৈঠকখানার ভিতরে গিয়ে ঢুকলুম। সুরেনবাবুর আড়ষ্ট দেহ ঘিরে বসে আছেন হৈমবতী, তাঁর দুই ছেলে ও এক মেয়ে। সকলেরই চক্ষে অশ্রু, কণ্ঠে আর্তনাদ।

অনন্তবাবু বসে আছেন মৃতদেহের ডান পাশে। মুদিত চোখে তিনি মূর্তির মতন স্থির— যেন ধ্যানমগ্ন।

সুরেনবাবুর দেহ যেমনভাবে দেখে গিয়েছিলুম তেমনি ভাবেই আছে। হৈমবতী গতকল্য এসেছেন। হিসাব করে দেখলুম, সুরেনবাবুর মৃত্যুর পর পাঁচদিন কেটে গিয়েছে। একে গ্রীষ্মকাল তায় এ বছর পড়েছে আবার অতিরিক্ত গরম। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার এই যে, সুরেনবাবুর গায়ের রং হলদে এবং দেহ মৃত্যু-শীতল ও কাঠ-আড়ষ্ট হয়ে গেলেও তা একটুও পচেনি বা ফুলে ওঠেনি।

অনন্তবাবু চোখ খুলে বললেন, ‘এই যে, আপনারা এসেছেন। হৈম বড়ই ব্যস্ত হয়ে উঠছেন। তাহলে সুরেনকে আর একবার জাগাবার চেষ্টা করি?’

আমরা নীরবে ঘাড় নেড়ে সায় দিলুম। যদিও আমার বুকের ভিতরে জাগল কাঁপন।

মৃতদেহের উপরে খানিকক্ষণ হস্ত-চালনা করে অনন্তবাবু ডাকলেন, ‘সুরেন! সুরেন! সুরেন!’

প্রায় দশ-বারো বার নাম ধরে ডাকার পর মৃতদেহের আড়ষ্ট, হাঁ-করা মুখের ভিতরে জিভখানা হয়ে উঠল আবার সেইরকম ভয়াবহরূপে চঞ্চল।

হৈমবতী স্বামীর বুকের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে ক্রন্দন স্বরে বলে উঠলেন, ‘ওগো, তাহলে তুমি সত্যিই বেঁচে আছ?’

ছেলেমেয়েরাও ‘বাবা, বাবা’ বলে চেঁচিয়ে কেঁদে উঠল।

অনন্তবাবু বললেন, ‘কথা কও সুরেন, কথা কও।’

আবার শোনা গেল সেই বর্ণনাতীত ভয়ঙ্কর কণ্ঠস্বর, যা আসছে যেন বাড়ির বাইরে পৃথিবীর অতল পাহাড়ের ভিতর থেকে—

‘আঃ, আবার কেন ডাকাডাকি? বলেছি তো, আমি বেঁচে নেই?’

হৈমবতী বললেন, ‘ওগো, এই তো তুমি বেঁচে আছ— এই তো তুমি কথা কইছ। একবার চোখ মেলে তাকিয়ে দেখ— আমরা সবাই এসেছি।’

অনন্তবাবু বললেন, ‘হৈম স্থির হও, শান্ত হও। সুরেন এখন আমি ছাড়া আর কারুর কথার জবাব দেবে না।… সুরেন, হৈম তোমাকে ডাকছে।’

মৃতদেহ বললে, ‘ডেকে লাভ নেই। আমার মৃত্যু হয়েছে।’

‘তোমার যদি মৃত্যু হয়ে থাকে, তবে কথা কইছ কেমন করে?’

‘আমি এখন আমার মৃতদেহের ভিতরে বন্দি হয়ে আছি।’

‘বন্দি! কেন?’

‘তুমি যেতে দিচ্ছ না বলে।’

অনন্তবাবু এতক্ষণ সমানে হস্ত-চালনা করছিলেন। এই ব্যাপারে তিনি যে তাঁর সমস্ত ইচ্ছাশক্তিকে প্রবলভাবে নিযুক্ত করেছেন, সেটা বোঝা যায় তাঁর চেহারা দেখে। তাঁর কপালের উপরে শিরাগুলো এবং কণ্ঠের ওপরে মাংসপেশীগুলো দ্বিগুণ ফুলে এবং মুখের রং রাঙা টকটকে হয়ে উঠেছে।

হঠাৎ তিনি হস্ত-চালনা বন্ধ করে খানিকক্ষণ নীরবে অত্যন্ত হাঁপাতে লাগলেন। তারপর ফিরে বললেন, ‘হৈম আর কেন? তোমার জন্যেই এই ক-দিন সুরেনকে যোগনিদ্রায় আচ্ছন্ন করে রেখেছি। এইবার ওর ঘুম ভাঙাই, ওর আত্মাকে মুক্তি দিই। তোমরা মৃতদেহের সৎকারের ব্যবস্থা করো।’

হৈমবতী এমন তীব্রস্বরে চেঁচিয়ে কেঁদে উঠলেন যে, আমাদের কান যেন ফেটে গেল। তারপর তিনি মাটির ওপরে আছড়ে পড়ে বললেন, ‘অনন্তবাবু, অনন্তবাবু, আমাকে দয়া করুন! উনি এ অবস্থাতে থাকলেও আমার সুখ! মনে করব আমি বিধবা নই!’

অনন্তবাবুর মুখে ফুটে উঠল একসঙ্গে— ব্যথা, দয়া ও মমতার ভাব। অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে তিনি বললেন, ‘বেশ মা, তাই হোক। আরও কিছুদিন এইভাবে থাক। তুমি নিজের মনকে দৃঢ় করো, শান্ত হও— সংযত হও। তারপর আমার যা করবার করব। মনে রেখো মা, আমি হচ্ছি তুচ্ছ মানুষ। মৃত্যু হচ্ছে ভগবানের ইচ্ছা। তাকে বাধা দেবার চেষ্টা করলে আমারও সর্বনাশ হবে— আমিও বাঁচব না।’

অনন্তবাবু উঠে দাঁড়ালেন। এতক্ষণ আমরা ছিলুম দুঃস্বপ্নে অভিভূতের মতো অসাড় হয়ে। অনন্তবাবু উঠে দাঁড়াতেই সাড় হল আমাদের। ডাক্তার ঘোষ বললেন, ‘আমি আর সহ্য করতে পারছি না— আমার প্রাণ মন হাঁপিয়ে উঠেছে!’

আমি বললুম, ‘আমারও। এখন বাইরে বেরুতে পারলেই বাঁচি।’ অনন্তবাবু হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, ‘আমারও ওই ইচ্ছা। চলুন, আমরা বাড়ি যাই।’

পাঁচ

তারপর কেটে গেছে দুই মাস। সুরেনবাবুর দেহ এখনও পড়ে আছে বৈঠকখানার তক্তাপোশে। তাতে এখনও পচন ধরেনি।

ইতিমধ্যে অদ্ভুত খবর শুনে দলে দলে বাইরের লোক এবং খবরের কাগজের সংবাদদাতারা সুরেনবাবুর বাড়িতে আনাগোনা শুরু করে দিয়েছিল। অনন্তবাবু খাপ্পা হয়ে উঠেছিলেন। বাইরের লোকেরা আর ভিতরে ঢুকতে পায় না। কিন্তু খবরটা রটে গিয়েছিল দিকে দিকে। চারিদিকে বিষম উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে। কেবল বাঙালি নয়, ইংরেজ এবং আরও নানাজাতীয় লোক কৌতূহলী হয়ে আবেদন জানাচ্ছেন, সুরেনবাবুর দেহ পরিদর্শনের জন্যে। আবেদনকারীদের মধ্যে ছিল বহু বিখ্যাত নাম।

একদিন অনন্তবাবুর জরুরি আহ্বান এল। তাঁর বাড়ির কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই শুনলুম সুরেনবাবুর বাড়ির ভিতর থেকে কান্নার আওয়াজ। অনন্তবাবুর বৈঠকখানায় ঢুকে দেখি, একখানা চেয়ারের উপরে বসে আছেন ডাক্তার ঘোষ। অনন্তবাবু ঘরময় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তাঁর ভাবভঙ্গি ক্রুদ্ধ, বিরক্ত।

আমাকে দেখেই তিনি বললেন, ‘কান্না শুনছেন?’

‘হ্যাঁ, ব্যাপার কী?’

‘আজ সুরেনের যোগনিদ্রা ভাঙব, তাই ওই কান্না। হৈমবতীর ইচ্ছা, সুরেনের দেহ ওইভাবেই থাকুক। কিন্তু তাও কী সম্ভব! আমি বেশ বুঝতে পারছি, আমার নিজের স্বাস্থ্য দিনে দিনে ভেঙে পড়ছে— এরকম অস্বাভাবিক উত্তেজনা আর কতদিন সহ্য করব? প্রবল ইচ্ছাশক্তিরও সীমা আছে।’

‘এই জন্যেই আমাকে ডেকেছেন?’

‘আপনাকেও, ডাক্তার ঘোষকেও। তারপর আর একটা কি কথা জানেন? নিজেকে অপরাধী বলে মনে হচ্ছে।’

‘কেন?’

‘বোধ হয় প্রকৃতির আইন ভঙ্গ করেছি। ভগবান সুরেনের আত্মাকে যে অদৃশ্য পথে নিয়ে যেতে চান, আমি হয়েছি তার বাধার মতো। এ এক মস্ত অপরাধ। এজন্যে হয়তো আমাকে শাস্তি ভোগ করতে হবে। হয়তো একটা প্রাণহীন কুৎসিত দেহের কারাগারে বন্দি হয়ে সুরেনের আত্মাও অত্যন্ত কষ্টভোগ করছে। না, আর নয়। আমি দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করেছি, এ ব্যাপারের উপরে আজকেই যবনিকা ফেলে দেব! কারুর মিনতি, কারুর অশ্রু আর আমাকে বাধা দিতে পারবে না। গোড়া থেকে যখন সঙ্গে আছেন, তখন শেষ দৃশ্যটাও দেখুন।

ছয়

শেষ পর্যন্ত হৈমবতীকে সম্মতি দিতে হল।

অনন্তবাবু অনেক চেষ্টার পর তাঁকে বুঝিয়ে দিয়েছেন, এই মৃতদেহের মধ্যে সুরেনবাবুর আত্মা বন্দি হয়ে আছে অভিশপ্তের মতো। দেহ থেকে বেরুতে না পারলে আত্মার গতি হবে না।

অনন্তবাবু দেহের পাশে বসে হস্ত-চালনা করতে করতে ডাকলেন, ‘সুরেন, সুরেন, সুরেন!’

আমরা রোমাঞ্চিত দেহে বিস্ফারিত চক্ষে রুদ্ধশ্বাসে দেহের দিকে তাকিয়ে রইলুম। সাত-আট মিনিট কেটে গেল। দেহ নিঃসাড়, নিস্পন্দ। অনন্তবাবুর কপাল থেকে দরদর করে ঘাম ঝরতে লাগল।

—সুরেন, সুরেন! জাগো, সাড়া দাও! আমি ডাকছি, সুরেন!’

আরও সাত-আট মিনিট কাটল।

অনন্তবাবু উদবিগ্নকণ্ঠে বললেন, ‘তবে আমি কি ব্যর্থ হব? সুরেনের আত্মা কি এখানে নেই। না, না, তা তো হতে পারে না। যোগনিদ্রার প্রভাব না থাকলে দেহের অবস্থা হত যে অন্যরকম।… সুরেন, সুরেন, জাগো তোমার যোগনিদ্রা ভঙ্গ হোক!’

এইবারে উন্মুক্ত, দন্ত কণ্টকিত মুখ-বিবরের মধ্যে জ্যান্ত হয়ে ছটফট করতে লাগল জিহ্বাখানা।

‘সুরেন!’

উত্তরে শোনা গেল এক ভীষণ ও তীক্ষ্ন আর্তধ্বনি। সে আর্তনাদ ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। মানুষের কান কোনোদিন শোনেনি তেমন আর্তনাদ। ছেলে-মেয়েরা ঘর ছেড়ে পালিয়ে গেল, হৈমবতী মূর্চ্ছিত হয়ে পড়লেন। আমাদের অবস্থা শোচনীয়।

‘সুরেন, শান্ত হও, ভাই শান্ত হও!’

‘শান্ত হব। তোমরা জানো না এই দেহের নরকে কী দুঃসহ যন্ত্রণা! নিশিদিন কাঁদছি আর ছটফট করছি! মৃত্যুর পরেও এ কী শাস্তি! আর কেন? আমাকে মুক্তি দাও— মুক্তি দাও!’

আজকের স্বর আরও বিকট ও ভয়াল এবং আসছে যেন আরও-আরও-আরও বেশি দূরে থেকে। অনন্তবাবু বললেন, ‘তোমাকে মুক্তি দিলুম। সুরেন, ভেঙে যাক তোমার যোগনিদ্রা।’

পরমুহূর্তে অদ্ভুত একটা শব্দ হল। সঙ্গে সঙ্গে আচ্ছন্নের মতো দেখলুম, তক্তাপোশের ওপরে পড়ে রয়েছে সুরেনবাবুর দেহের বদলে একটা নরকঙ্কাল!

…সভয়ে প্রাণপণে দৌড়ে বাইরে পালিয়ে এলুম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *