বন্দিনী
লোহার গেটটা বন্ধ। তার বাইরে মহিমবাবু যেই সাইকেল রিকশা থেকে নামলেন, অমনি ভেতর থেকে একটা কুকুর হিংস্রভাবে ডাকতে ডাকতে তেড়ে এলো। সাধারণ খয়েরি রঙের নেড়িকুত্তা, কিন্তু তার গলায় খুব তেজ!
মহিমবাবু প্যান্ট—শার্ট পরা, রোদ্দুরের জন্য মাথায় দিয়েছেন একটা তালপাতার টুপি। তিনি কুকুর—টুকুর বিশেষ পছন্দ করেন না।
কুকুরটা ঘাউ ঘাউ করে ডেকেই চলেছে। মহিমবাবু বললেন, কী আপদ! এখানে আবার একটা কুকুর এলো কী করে?
পরে রিকশা থেকে নামলেন তাঁর স্ত্রী সুজাতা দেবী। রিকশার ভাড়া তিনিই চুকিয়ে দিতে দিতে বললেন, ভালোই তো। একটা কুকুর থাকলে বাড়ির পাহারা হয়, যাকে তাকে ভেতরে ঢুকতে দেবে না।
মহিম বললেন, এ যে আমাকেই ঢুকতে দিচ্ছে না! কামড়ে—টামড়ে দেবে নাকি?
সুজাতা কোনো কুকুরকেই ভয় পান না। তিনি গেট খুলে চুঃ চুঃ শব্দ করতে কুকুরটা ডাক থামিয়ে দিল।
সুজাতা ডাকলেন, সরদার! সরদার!
বাড়ির পেছন দিক থেকে এলো একজন কুচকুচে কালো মাঝবয়েসী লোক। সে একজন সাঁওতাল। সে এই বাড়ির কেয়ার—টেকার।
সুজাতা জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছো, সরদার?
সাঁওতালরা সাধারণত খুব হাসি—খুশি ধরনের মানুষ হয়। কিন্তু এই মানুষটি গম্ভীর ধরনের। সে সহজে কথা বলে না। সুজাতার প্রশ্ন শুনে সে মুখে কিছু না বলে শুধু ঘাড়টা হেলাল। এই সময় কোথায় থেকে আর একটা কুকুর লেজ নাড়তে লাগলো সরদারের পাশে এসে।
একেবারে নতুন ঝকঝকে বাড়ি। সামনের বাগানে অনেক ফুল ফুটেছে। পাশে একটা ছোট্ট পুকুর। তাতে টলটল করছে জল।
মহিম নিজেই বাড়িটা দেখে অবাক। অনবরত বাঃ বাঃ বলতে লাগলেন।
বছর খানেক আগে কেনা হয়েছিল জমি। তখন জায়গাটা ছিল এবড়ো—খেবড়ো মাঠের মতন। আর ছিল কয়েকটা তাল গাছ। বাড়ি তৈরির জন্য যখন সবেমাত্র খোঁড়াখুঁড়ি শুরু হয়েছে, তখন অফিসের একটা কাজে মহিমকে চলে যেতে হলো আফ্রিকা। সেখানেই থেকে যেতে হলো আট মাস। এর মধ্যে সুজাতা নিজেই দেখাশুনা করে শান্তিনিকেতনে এই বাড়িটা বানিয়ে ফেলেছেন।
মহিমের কাছে তাই সবকিছুই নতুন। তাঁর মনে হচ্ছে, যেন আলাদিনের দৈত্য মাঠের মধ্যে একটা বাড়ি বসিয়ে দিয়েছে। সবই বেশ পছন্দ হয়েছে মহিমের। শুধু অনবরত কুকুরের ডাক শুনলে তাঁর মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। দুটো কুকুর যখন তখন ডাকে, ঝগড়া করে, খেলা করে। কুকুর দুটো মহিমের পা চাটবার চেষ্টা করলে তিনি খানিকটা ভয় পেয়ে আর খানিকটা বিরক্ত হয়ে বলে ওঠেন, এই যাঃ যাঃ।
বারান্দার বেতের চেয়ারে বসে মহিম হয়তো আকাশের মেঘ দেখে গুনগুন করে গান গাইছেন, এমন সময় কুকুর দুটো হুটোপাটি করে তাঁর সামনে এসে তাঁর গায়ের গন্ধ শুঁকতে চায়। কুকুরদের এই উপদ্রবে তাঁর গান বন্ধ হয়ে যায়।
তিনি সুজাতাকে ডেকে বললেন, এ বাড়িতে কুকুর দরকার নেই। তুমি ওদের তাড়াও।
সুজাতা বললেন, সে কি! ও দুটো তো সরদারের পোষা কুকুর। সাঁওতালরা কুকুর ছাড়া থাকতে পারে না, তুমি জানো না?
মহিম বললেন, একটা কুকুরই তো যথেষ্ট, আবার দুটো কেন?
সুজাতা বললেন, দুটোই যে ওর আগে থেকে পোষা।
মহিম বললেন, ওর যদি একটা পোষা বাঘ থাকতো, সেটাও কি আমাদের এই বাড়িতে রাখতে হতো?
এ কথা শুনে হেসে ফেললেন সুজাতা!
এই নতুন বাড়ির সবকিছুই পছন্দ মহিমের। শুধু কুকুর দুটো ছাড়া। ওদের আবার বন্ধু আছে। এক এক সময় আরও কুকুর ঢুকে আসে বাড়ির মধ্যে।
শান্তিনিকেতনের এই বাড়িতে তো একটানা বেশিদিন থাকা যায় না। কলকাতায় কাজকর্ম আছে। তবে মহিম আর সুজাতা একটু ছুটি পেলেই চলে আসেন এখানে।
কয়েকমাস বাদে সরদার হঠাৎ চাকরি ছেড়ে দিল। কোনো কারণ নেই, ঝগড়াঝাঁটি কিছু হয়নি, এমনিই সে বললো, নিজের গ্রামে ফিরে যাবে।
নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে চলে গেল সরদার। সুজাতা বিপদে পড়ে গেলেন। এরপর বাড়ির দেখাশুনো করবে কে? খালি বাড়ি ফেলে রাখলেই চোর আসবে।
মহিম কিন্তু খুশি। কুকুর দুটো তো বিদায় হয়েছে।
চেনাশুনো লোকদের ধরাধরি করে আর একটি লোক পাওয়া গেল। তার নাম রাখাল। তেইশ—চব্বিশ বছর বয়েস, খুব চটপটে, বাগানের কাজ জানে, রান্না জানে।
কয়েকদিনের মধ্যেই, বোঝা গেল, রাখাল খুবই উপযুক্ত ছেলে। সুজাতার বেশ পছন্দ হয়ে গেল। মহিমের আরও পছন্দ, রাখালের কোনো পোষা কুকুর নেই।
একদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে মহিম পাখির ডাক শুনছেন। এত পাখি কলকাতায় দেখা যায় না। বুলবুলি, দোয়েল, মুনিয়া। মহিম ঘুমোন দোতলার ঘরে। জানলা দিয়ে পুকুরটা দেখা যায়। পুকুরের ধারে ধারে ছোট ছোট গাছ। একটা কদম গাছ এর মধ্যেই অনেকটা বড় হয়েছে। সেই গাছটায় পাখিরা এসে বসে। একদিন এসেছিল একটা ইস্টকুটুম পাখি। পায়রা আর বকেরা পুকুরের জল খেতে আসে।
পাখির ডাক শুনতে শুনতে মহিম একটা কুঁই কুঁই শব্দ শুনতে পেলেন। এটা আবার কিসের শব্দ? তিনি নেমে এলেন নিচে। বাইরের বারান্দায় এসে দেখলেন, সুজাতা বিস্কুট ভেঙে ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিচ্ছেন আর সেগুলো লাফিয়ে লাফিয়ে খাচ্ছে একটা বাচ্চা কুকুর। খুবই বাচ্চা, মোটে তিন—চার মাস বয়েস হবে, কালো—সাদা রং, একটা পশমের বলের মতন।
মহিম ভুরু তুলে বললেন, আবার কুকুর?
সুজাতা বললেন, দ্যাখো দ্যাখো, কী সুন্দর কুকুরটা। কী রকম তুলতুলে। আর কী সুন্দর চোখ দুটো।
মহিম বললেন, এটাকে আবার কোথায় পেলে?
সুজাতা বললেন, এমনিই গেটের তলা দিয়ে ঢুকে পড়েছে। এইটুকু কুকুর, কিন্তু কী বুদ্ধি দেখবে?
একখানা আস্ত বিস্কুট উঁচু করে ধরে সুজাতা বললেন, এই শুয়ে পড়, শুয়ে পড়! না হলে পাবি না।
কুকুরটা অমনি চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লো। পাগুলো গুটিয়ে রাখলো, আর মাথাটা ঘোরাতে লাগলো এদিক ওদিক।
সুজাতা ওকে টপ করে বুকে তুলে নিয়ে বললেন, কী লক্ষ্মী কুকুর। এটাকে আমি পুষবো।
মহিম বিরক্ত হয়ে বললেন, আবার কুকুরের ঝামেলা কেন?
সুজাতা ধমক দিয়ে বললেন, তুমি এইটুকু একটা কুকুরছানাকে ভয় পাও নাকি?
মহিম বললেন, না ভয়ের কী? তবে এটা নিশ্চয়ই অন্য কোনো বাড়ির পোষা কুকুর। গেটের বাইরে রেখে আসাই ভালো!
সুজাতা ঝংকার দিয়ে বললেন, তোমাকে অত ভাবতে হবে না। অন্য কেউ চাইতে এলে দিয়ে দেবো। বাড়িতে একটা কুকুর রাখা খুব দরকার।
মহিম আর কিছু বলতে সাহস পেলেন না। দু’তিন দিনের মধ্যে কেউ চাইতেও এলো না কুকুরটাকে।
বাচ্চা কুকুরটা সারাক্ষণ খেলে বেড়ায়, বেশি ডাকাডাকি করে না। শুধু দুপুরবেলা মহিম আর সুজাতা যখন খেতে বসেন, সে তখন জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে ভুক ভুক শব্দ করে। যেন সে বলতে চায়, আমাকে খেতে দিতে ভুলে যেও না যেন!
সেই যে প্রথম দিন সুজাতা ওকে কোলে তুলে নিয়ে বলেছিলেন, লক্ষ্মী কুকুর। সেই থেকে ওর নাম হয়ে গেল লক্ষ্মী।
সুজাতার খুব মায়া পড়ে গেছে লক্ষ্মীর ওপর। মহিমও মাঝে মাঝে এখন ওকে বিস্কুট খেতে দেন। হঠাৎ কোনো সময় লক্ষ্মী তাঁর পায়ের ওপর এসে লুটোপুটি খেলে রাগ করার বদলে হেসে ফেলেন তিনি।
রাখাল কিন্তু প্রথম থেকেই কুকুরটাকে অপছন্দ করেছে। সে বললো, এটা মেয়ে—কুকুর। বাড়িতে মেয়ে—কুকুর রাখা ভালো নয়, তাতে অনেক ঝামেলা হয়!
সুজাতা ধমক দিয়ে বললেন, মেয়ে—কুকুর আর ছেলে—কুকুর কী রে? মেয়ে বলে বুঝি মানুষ নয়?
তাই শুনে মহিম খুব হাসতে লাগলেন।
সুজাতা সেই হাসি অগ্রাহ্য করে বললেন, ওকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। লক্ষ্মী এ বাড়িতেই থাকবে। আমরা যখন থাকব না, তখনো ওকে ভালো করে খেতে—টেতে দেবে।
দু’দিন বাদে সুজাতা আর মহিম ফিরে গেলেন কলকাতায়। তারপর আর বেশ কিছুদিন ফেরা হলো না। শান্তিনিকেতনে। কলকাতায় অনেক কাজ।
মাস দেড়েক বাদে আবার ওঁরা এলেন শান্তিনিকেতনে। এবার বেশ বড় দল। মহিমের মা এসেছেন সঙ্গে। ওদের ছেলে বাপ্পা খড়্গপুরে হোস্টেল থেকে পড়াশুনো করে, সেও এসেছে গরমের ছুটিতে। সুজাতার দিদি—জামাইবাবু এসেছেন বেড়াতে।
ঘরের জিনিসপত্র ঠিক—ঠাক করে সাজাতে সাজাতে হঠাৎ সুজাতার খেয়াল হলো, লক্ষ্মীকে তো একবারও দেখা যায়নি!
রাখালকে সেই কথা জিজ্ঞেস করতেই সে বললো, ও মাঝে মাঝেই বাইরে চলে যায়। বাড়িটাড়ি কিছু পাহারা দেয় না। বাইরে বাইরেই থাকে!
সুজাতা বললেন, নিশ্চয়ই তুই ওকে খেতে দিস না। তাই ও বাইরে চলে যায়।
সুজাতা গেটের কাছে দাঁড়িয়ে দু’বার ডাকলেন লক্ষ্মী লক্ষ্মী!
তখন দেখা গেল দূরের মাঠ পেরিয়ে তীরের মতন ছুটে আসছে একটা বাচ্চা কুকুর। কাছাকাছি এসে এক লাফে ঝাঁপিয়ে পড়লো সুজাতার পায়ের ওপর। সুজাতা তাকে কোলে তুলে নিয়েই বললেন, ইস, দেখেছো কত ময়লা মেখেছে গায়ে।
একটুক্ষণের মধ্যেই ঘাসে কয়েকবার গড়াগড়ি দিয়ে পরিষ্কার হয়ে গেল লক্ষ্মী।
বাপ্পা কুকুর ভালোবাসে। সে একটা বল নিয়ে খেলতে লাগলো। যতবার বলটা ছুঁড়ে দেয়, লক্ষ্মী দৌড়ে গিয়ে বলটা মুখে করে আনে। বাপ্পা খেলতে খেলতে ক্লান্ত হয়ে গেলেও লক্ষ্মী তার সঙ্গে সঙ্গে ঘোরে।
কুকুরটা খুব দুরন্ত কিন্তু অসভ্য নয়। খাবার দিলেই চেটেপুটে খায়, অথচ হ্যাংলামি নেই একটুও। দেখতেও বেশ সুন্দর। সবারই পছন্দ হয়ে গেল ওকে।
শুধু মা বললেন, ওর নাম লক্ষ্মী রেখেছো কেন? ঠাকুর দেবতার নাম নিয়ে ইয়ার্কি করতে নেই। তার বদলে ওর নাম দাও রক্ষী। বাড়ি পাহারা দেবে, তাই রক্ষী নামটাই মানাবে।
সুজাতা সঙ্গে সঙ্গে নামটা পছন্দ করে ফেললেন। রক্ষী বলে ডাকলেই ও সাড়া দেয়। ও লক্ষ্মী আর রক্ষীর বিশেষ তফাৎ বুঝবে না। কয়েকবার তিনি রক্ষী রক্ষী বলে ডাকলেন, অমনি সে ছুটে এলো।
বাপ্পা শুধু বললো, ঠাম্মি, কুকুরটা তো মেয়ে। তাহলে রক্ষীর বদলে ওর নাম রক্ষিণী রাখতে হয়।
বাপ্পার ঠাকুমা বললেন, রক্ষিণী শুনতে বিচ্ছিরি। ওসব রক্ষিণী—যক্ষিণী দরকার নেই। শুধু রক্ষীই ভালো।
লক্ষ্মী সেদিন থেকে রক্ষী হয়ে গেল।
সুজাতার ধারণা অন্য সব কুকুরের চেয়ে রক্ষীর বুদ্ধি বেশি। একদিন সকালে তার কিছুটা প্রমাণও পাওয়া গেল।
আগের রাতে পাঁঠার মাংস খাওয়া হয়েছিল। তার প্রচুর হাড় রক্ষী খেয়েছে। পাঁঠার মাংসের হাড় কুকুরদের বেশি পছন্দ।
সকালবেলা সবাই যখন বারান্দায় চা খেতে বসে, তখন রক্ষী কাছে এসে লাফালাফি করে। প্রত্যেকেই খানিকটা বিস্কুটের টুকরো দেয় ওকে।
সেই সকালে রক্ষীর যেন বিস্কুট খাওয়ার তেমন উৎসাহ নেই। ছুটে ছুটে বিস্কুট কুড়োচ্ছে না। সুজাতা বললেন, কাল রাত্তিরে রক্ষী এত মাংস খেয়েছে যে এখনো ওর খিদে পায়নি।
বাপ্পা তবু আস্ত একটা বিস্কুট ছুঁড়ে দিলে একটু দূরে।
রক্ষী কয়েক পলক সেই বিস্কুটটার দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর সেটা মুখে নিয়ে ছুটে গেল ফুলবাগানে। সেখানকার নরম মাটি খুঁড়ে একটা গর্ত বানিয়ে ফেলে তার মধ্যে রাখলো বিস্কুটটা। আবার মাটি চাপা দিয়ে দিল!
বাপ্পা বললো, ও কি বিস্কুটটাকে পুঁতলো নাকি? ভাবছে, বিস্কুটের গাছ হবে?
মহিম বললেন, না রে! ও বিস্কুটটাকে জমিয়ে রেখে দিল, পরে খাবে।
বাপ্পা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, বাবা, জন্তু—জানোয়াররা এরকম খাবার জমাতে জানে? আগে তো কখনো দেখিনি!
সুজাতা বললেন, দেখলে, ওর কত বুদ্ধি?
শান্তিনিকেতন থেকে চলে আসার সময় সকলেরই একটু একটু মন খারাপ লাগে। রক্ষী প্রত্যেকের পায়ে এমন মাথা ঘষে, যেন বলতে চায়, যেও না, যেও না।
তবু তো যেতেই হয়।
এক মাস বাদে আবার ফিরে এসে সুজাতা দেখলেন রক্ষী বাড়িতে নেই। এবার গেটের কাছে গিয়ে ডাকাডাকি করতেও সে এলো না।
রাখালকে জিজ্ঞেস করতেই সে বললো, ও কুকুরটা কিছুতেই বাড়ির মধ্যে থাকতে চায় না। গেটের তলা দিয়ে যখন তখন বেরিয়ে যায়। অন্য বাড়ি গিয়ে বসে থাকে।
সুজাতা ধমক দিয়ে বললেন, নিশ্চয়ই তুমি ভালো করে ওকে খেতে দাও না। না হলে অন্য বাড়িতে যাবে কেন? ওর খাবার জন্য তোমাকে আলাদা টাকা দিই!
মহিম বুঝলেন, রাখালকে ধমকে লাভ নেই। রাখাল কুকুর ভালোবাসে না। রক্ষীকে ও প্রথম থেকেই অপছন্দ করেছে। সেই জন্যই মনে করে নিয়মিত খাবার দেয় না। কুকুরেরা ঠিক বুঝতে পারে, কে ভালোবাসে আর কে ভালোবাসে না।
পোষা কুকুর নিজে শিকার করে খেতে জানে না। মানুষ যদি খাদ্য না দেয়, তাহলে ওরা অসহায়। শান্তিনিকেতনের এই দিকটায় বেশির ভাগ বাড়ি প্রায়ই ফাঁকা পড়ে থাকে। মালিকরা না এলে কুকুররা মুশকিলে পড়ে যায়।
সুজাতা অনেকক্ষণ রাগারাগি করলেন, তারপর নিজে পাড়া খুঁজতে বেরোলেন। রক্ষীকে পাওয়া গেল না। অন্য দু’তিনটে কুকুর খাদ্যের লোভে সন্ধের দিকে বাড়ির বাইরে ঘোরাঘুরি করতে লাগলো।
পরদিন সকালবেলা দেখা গেল গেটের কাছে শুয়ে আছে রক্ষী।
তার অবস্থা দেখে মহিম আর সুজাতা আঁতকে উঠলেন। তার চোখের দৃষ্টি করুণ। সুজাতাকে দেখে সে কোনোক্রমে উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে আসার চেষ্টা করলো, কয়েক পা এসই ঢলে পড়ে গেল মাটিতে।
এই এক মাসের মধ্যেই সে অনেকটা রোগা আর লম্বাটে হয়ে গেছে। আর তার পেটের একদিকে বিরাট ঘা। সেই ঘা একেবারে দগদগ করছে, রস গড়াচ্ছে। দেখলে ঘেন্না করে।
কান্না এসে গেল সুজাতার। তিনি বললেন, এ রকম অবস্থা কী করে হলো ওর? কে ওকে মারলো?
সুজাতার ঘেন্না নেই। তিনি রক্ষীকে কোলে তুলে এনে শুইয়ে দিলেন বারান্দায়। নিশ্চয়ই রক্ষী অনেকদিন খেতে পায়নি, তিনি কয়েকখানা বিস্কুট এনে রাখলেন তার সামনে। রক্ষী খাবার চেষ্টা করেও পারলো না। যেন বিস্কুট চিবোবার শক্তিও তার নেই। তখন সুজাতা নিয়ে এলেন এক বাটি দুধ। এমন একটা কুঁ—উ—উ শব্দ করলো রক্ষী, যেন সুজাতা তার মা, আর সে সুজাতার মেয়ে।
কাছাকাছি অন্য একটা বাড়ির কেয়ারটেকার ভৈরব এসে বললো, গোয়ালপাড়ায় একটা বাড়ির লোক রক্ষীর গায়ে গরম ফ্যান ঢেলে দিয়েছে। সেইজন্য রক্ষীর ওরকম ঘা হয়েছে।
তা শুনে সুজাতার চোখে কান্না এলো আবার। ওইটুকু একটা কুকুর, অমন সুন্দর চোখ, তার গায়ে কেউ গরম ফ্যান ঢেলে দিতে পারে? মানুষ এত নিষ্ঠুর হয়?
সুজাতা নিজের হাতে ওর সেবা করতে লাগলেন। গরম জলে তুলো ভিজিয়ে ওর ক্ষতস্থানটা পরিষ্কার করে দিলেন। তারপর যেই মলম লাগিয়ে দিতে গেলেন, রক্ষী অমনি তা চেটে খেয়ে ফেললো। সুজাতা আবার মলম লাগিয়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিলেন সেখানে। বারবার রক্ষীকে খাওয়াতে লাগলেন দুধ।
এক একসময় ক্ষত স্থানটার যন্ত্রণায় রক্ষী আর্তনাদ করে, সুজাতার কাছ থেকে পালিয়ে যেতে চায়।
সুজাতা বোলপুরে গিয়ে কুকুরের ডাক্তারের খোঁজ করলেন, তা অবশ্য পাওয়া গেল না। একটি ডাক্তারখানার লোক বললো, মানুষের ওষুধে কুকুরের কাজ হয়।
এবারে বেশিদিন থাকার উপায় নেই। মহিমকে আবার বিদেশ যেতে হবে, এবার সুজাতাও সঙ্গে যাবেন। ছ’মাসের জন্য। কিন্তু সুজাতার মন খুব খারাপ। রক্ষীকে এইভাবে রেখে যাবেন কী করে? রক্ষীকে সঙ্গে করে কলকাতাতে নিয়ে যাওয়াও সম্ভব নয়।
মহিম বললেন, তিন চারদিনে রক্ষী তো অনেকটাই সুস্থ হয়ে গেছে। দেশি কুকুর, ওরা কত মার খায়, এমনিতেই ভালো হয়ে যাবে।
সুজাতা আরও বেশি টাকা বরাদ্দ করে গেলেন রক্ষীর জন্য। রাখালকে বার বার বললেন, প্রত্যেকদিন যেন দু’বেলা দুধ খাওয়ানো হয় ওকে। সপ্তাহে দু’দিন অন্তত মাংস।
ছ’মাস বাদে ফিরে এসে শোনা গেল রক্ষী মারা গেছে। ঠিক কীভাবে সে মরেছে, তা বলতে পারলো না রাখাল। সুজাতারা চলে যাবার দু’দিনের মধ্যেই রক্ষী আবার বেপাত্তা হয়ে গিয়েছিল। অনেক খুঁজেও তাকে পাওয়া যায়নি। কে যেন বলেছিল, খালের ধারে মরে পড়ে আছে একটা কুকুর। সেটা আর দেখতে যায়নি রাখাল।
এবার আর কাঁদলেন না সুজাতা। মরেই গেছে যখন, তখন আর ভেবে লাভ কী? তিনি নিজেও তো রক্ষীকে পুরো সেবা—যত্ন করতে পারেননি। রাখাল রক্ষীর যত্ন করবে না, এ তো জানা কথাই।
আস্তে আস্তে রক্ষীর কথা মন থেকে মুছে গেল।
তারপর কেটে গেল আরও এক বছর।
একদিন দুপুরবেলা সারা আকাশ ঢেকে গেছে কালো মেঘে।
মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। তারই মধ্যে মহিমের বেড়াতে যাবার শখ হলো—কলকাতা শহরে তো এতখানি বর্ষার আকাশ দেখা যায় না! মাঝপথে বৃষ্টি এলেও ক্ষতি নেই, একদিন না হয় ভেজা যাবে।
সুজাতার বাড়ির পেছনটায় ফাঁকা মাঠ ছিল। এখন দূরে দূরে দুটো একটা নতুন বাড়ি তৈরি হয়েছে। তারও পরে গাছপালা ঘেরা একটা গ্রাম।
সেইদিকেই বেড়াতে গেলেন মহিম আর সুজাতা। হাঁটছেন আস্তে আস্তে। নতুন বাড়িগুলো দেখছেন। হঠাৎ একটা বাড়ির পাশ থেকে একটা বেশ বড়সড় কুকুর জোরে জোরে ডাকতে ডাকতে ছুটে এলো, তারপর ঝাঁপিয়ে পড়লো সুজাতার ওপর!
সুজাতা ভয় পেয়ে বাবা—গো, মা—গো বলে বসে পড়লেন মাটিতে। কুকুরটা তার গায়ের ওপর লাফাতে লাগলো।
মহিমও বেশ ভয় পেয়ে গেছেন। এটা বোধহয় পাগলা কুকুর। পাগলা কুকুর কামড়ালে অনেকগুলো ইঞ্জেকশন নিতে হয়। নিজের স্ত্রীকে বাঁচাতে হবে। একলা পাললে চলবে না। কোনো রকমে বীরত্ব সঞ্চয় করে কুকুরটার সঙ্গে লড়বার জন্য তিনি একটা ইঁট খুঁজতে লাগলেন।
কুকুরটা সুজাতাকে ঘিরে লাফাচ্ছে বটে, কিন্তু কামড়াচ্ছে না তো! সুজাতা মুখ থেকে হাত সরালেন, তারপর দারুণ অবাক হয়ে বললেন, ওমা, এ তো রক্ষী!
সঙ্গে সঙ্গে কুকুরটা মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে কুঁ কুঁ করতে লাগলো।
এবার দেখা গেল, তার পেটের একদিকে অনেকখানি পোড়া দাগ, এখন আর ঘা নেই। এ কুকুরটা তা হলে সেই রক্ষী, সে মরেনি! এতদিন পরেও সে সুজাতাকে দেখামাত্র চিনতে পেরেছে।
রক্ষী অবশ্য এখন অনেকটা বড় হয়ে গেছে, তাকে কোলে তোলা যায় না। সুজাতা আদর করে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, মানুষই মানুষকে বেশিদিন মনে রাখে না। কুকুরটা আমাদের মনে রেখেছে। ওকে এবার কলকাতায় নিয়ে যাবো। আর কোনোদিন চোখের আড়াল করবো না।
ঠিক তখুনি চৌদ্দ—পনেরো বছরের একটি ছেলে একটা বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে ডাকলো, দুখিয়া! দুখিয়া!
কুকুরটা তখন সুজাতাকে ছেড়ে ছেলেটার কাছে চলে গেল। আবার সুজাতার কাছে ফিরে এসে তার পায়ে মাথা ঘষলো।
মহিম ছেলেটিকে জিজ্ঞাসা করলেন, এটা তোমার কুকুর নাকি?
ছেলেটি বললো, হুঁ।
সুজাতা বললেন, এটা আসলে ছিল আমাদের কুকুর। তুমি খুব ভালো ছেলে একে বাঁচিয়েছো—
ছেলেটি আর কোনো কথা বললো না। ও কুকুরটাকে আবার দুখিয়া বলে ডাকলো। তারপর কুকুরটাকে জড়িয়ে ধরে নিয়ে গেল বাড়ির মধ্যে। বন্ধ করে দিল লোহার গেট।
সুজাতা হাহাকার করে বললেন, ও কি, ও রক্ষীকে ফেরৎ দেবে না?
মহিম বললেন, রক্ষী তো আর নেই, ওর নাম এখন দুখিয়া। ছেলেটা ওকে বাঁচিয়েছে, আমরা ফেরৎ চাইবো কী করে বলো?
সুজাতা ডাকলেন, রক্ষী, রক্ষী।
লোহার গেটের ওপাশে কুকুরটা এমনভাবে লাফালাফি করছে, যেন কারাগারের কোনো বন্দিনী।
সুজাতার ডাক শুনে সে এমনভাবে ডেকে উঠলো, যেন ঠিক কান্নার মতন।
আবার ছেলেটা ভেতর থেকে ডাকলো, দুখিয়া, দুখিয়া! তখন কুকুরটা কান্না থামিয়ে ছেলেটার দিকে ছুটে গেল।
মহিম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, আমাদের চেয়ে ওই ছেলেটার দাবি বেশি। চলো যাই।
দু’জনে ফিরে চললেন। সুজাতা পেছন ফিরে তাকাতে লাগলেন বারবার। কুকুরটা আবার গেটের কাছে পা তুলে দাঁড়িয়েছে। আর ডাকছে ঠিক কান্নার মতন।