বন্দিনী

বন্দিনী – দস্যু বনহুর সিরিজ – রোমেনা আফাজ

চারদিকে সীমাহীন অথৈ জলরাশি। শুধু জল আর জল। শেষ প্রান্তে জলের সঙ্গে মিশে গেছে যেন নীল আকাশখানা। শান্ত ছেলের মতই নীরব আজ নদীবক্ষ। নেই কোনো উচ্ছলতা। মৃদু মন্দ বাতাসে দোল খেয়ে খেয়ে এগিয়ে চলেছে নূরীর নৌকা। কোলে তার অর্ধ অচেতন মনি। নূরী ব্যাকুল আঁখি মেলে তাকাচ্ছে মনির শুষ্ক মুখখানার দিকে। মাঝে মাঝে তার দৃষ্টি চলে যাচ্ছে দিক থেকে দিগন্তে। যতদূর চোখ যায় নিপুণ দৃষ্টি মেলে সন্ধান করছে তীর দেখা যায় কিনা।

আজ এক সপ্তাহের বেশি হলো তাদের এই অবস্থা হয়েছে। নৌকায় কিছু পানি আর সামান্য খাবার ছিলো তাই দিয়ে দুতিন দিন চালিয়ে নিয়েছিলো নূরী। এ খাবারটুকুর সন্ধান নূরী জানতো না। মাঝিরা পথে খাবে বলে হয়তো এটুকু নিয়েছিলো। তাই একদিন নূরীর নজরে পড়ে গিয়েছিলো। কোনোরকমে সেই সামান্য খাবারে চালিয়ে নিয়েছিলো। কিন্তু এক সপ্তাহ বা তার বেশিদিন না খেয়ে বাঁচা তো সম্ভব নয়। প্রায় চারটি দিন ওরা সম্পূর্ণ অনাহারে। নিজের জন্য নূরীর দুঃখ নেই, মরতে হয় মরবে। কিন্তু এই অসহায় শিশু যার মুখের দিকে তাকিয়ে নূরীর দুনয়ন অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে। কি করে তার এই মর্মবিদারক অবস্থা দর্শন করতে পারে সে! নূরী কায়মনে খোদাকে স্মরণ করে চলেছে।

বেলা শেষ হয়ে এলো, অস্তমিত সূর্যের শেষ রশ্মি এসে পড়লো নূরী

আর মনির মুখে।

হঠাৎ নূরীর মনটা কেঁপে উঠলো, সূর্য অস্ত হবার পর নেমে আসবে জমাট অন্ধকার। পৃথিবীর আলো মুছে যাবে চোখ থেকে। কাল আবার ভোর হবে, সূর্য উঠবে। সোনালী আলোয় বসুন্ধরা ঝলমল করে উঠবে, বাতাস বইবে, দিগ হতে দিগন্তে ফুটে উঠবে কত রঙের মেলা। কিন্তু আর জাগবে না তার মনি। এই আলোর অতলে তলিয়ে যাবে একটি ছোট্ট ফুলের মত সুন্দর জীবন। আর কোনোদিন ঐ মুদিত আঁখি দুটি মেলে তাকাবে না। আর ডাকবে না, মাম্মা বলে। নূরী উচ্ছসিতভাবে কেঁদে ওঠে মনি–মনি–ওরে তুই আর একবার চোখ মেলে দেখ। আর একবার মাম্মা বলে ডাক্, ওরে ডাক!

নূরীর কান্নার দোলা লাগে যেন নদীবক্ষে। হঠাৎ যেন নৌকাখানা একটু বেশি নড়ে উঠলো। চমকে উঠলো নূরী! আজ কদিন তার নৌকা একই–ভাবে মৃদু মন্থর গতিতে ধীরে অতি ধীরে এগিয়ে চলেছে। এতটুকু ছিলো না কোনো রকম পরিবর্তন।

এবার নৌকাখানা যেন বেশ দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে বলে মনে হলো। সূর্য তখন ডুবে গেছে। নদীবক্ষে নেমে এসেছে একটা ঘোলাটে আলোছায়া।

নূরী চমকে উঠলো। বেশ দোলা লাগলো নূরীর দেহে। বুঝতে পারলো তার নৌকাখানা স্রোতের টানে দ্রুত ছুটতে শুরু করেছে। একি, কোথাও নীচু দিকে চললো নাকি তাদের নৌকা? ভয় হলো নূরীর মনে। কিন্তু পরক্ষণেই বুকে সাহস এলো তার। মৃত্যু যখন অনিবার্য তখন ভয় পেয়ে কি লাভ–মরতে তো একদিন হবেই।

নৌকাখানা এবার বেশ দ্রুত গতিতে এগোচ্ছে। মাঝে মাঝে ঘুরপাক খাচ্ছিলো, আবার ছুটছিলো আপন গতিতে। বেলা ডুবে গেছে। নৌকার ভেতর জমাট অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে গেছে। নূরী মনির মুখখানা আর দেখতে পাচ্ছে না। মনিকে বুকে চেপে ধরে রইলো নূরী। দুচোখ বন্ধ করে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো সে।

নূরী জানে, এসব পাহাড়িয়া নদী। মাঝে মাঝে প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড পাহাড় আর পাথরখণ্ড লুকিয়ে আছে। যেভাবে তাদের নৌকা এগোচ্ছে তাতে যে কোনো পাহাড় বা উঁচু পাথরের গায়ে নৌকাখানা ধাক্কা খেয়ে ভেঙ্গে খান খান হয়ে যাবে। সঙ্গে সঙ্গে হবে তাদের সলিল সমাধি।

নূরীর মনে শেষ বারের মত বনহুরের মুখখানা ভেসে উঠলো। সেই সুন্দর দীপ্ত দুটি চোখ। নূরী অন্ধকারে তার হুরের স্মরণ করে এত বিপদেও তৃপ্তি অনুভব করলো, পেলো অনাবিল এক আনন্দ। এ জীবন যৌবন সবই যে হুরের–এই নদীবক্ষেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে তার হুর? সেও করবে। তারপর মিলিত হবে ওরা দুজন নির্মল জলের তলায়।

স্থিরভাবে বসে আছে নূরী।

নৌকা স্রোতের টানে তীরবেগে ছুটে চলেছে।

কখন যে নূরী নৌকায় ঠেস দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে তার খেয়াল নেই। আজ কদিন উপবাসী, তারপর সব সময় কেঁদে কেঁদে ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে নৌকার গায়ে ঢলে পড়েছে সে।

ঘুমিয়ে রয়েছে নূরী—

হঠাৎ নূরীর ঘুম ভেঙ্গে গেলো।

ভোরের মৃদু বাতাসে দেহটা শীতল হয়ে এসেছে। এমন সময় নূরীর কানে এসে পৌঁছলো পাখীর কলরব! তাড়াতাড়ি সোজা হয়ে দৃষ্টি মেললো সে! সঙ্গে সঙ্গে দুনয়ন তার জুড়িয়ে গেলো। নৌকার ছৈয়ের বাইরে সবুজ বৃক্ষলতা, আলোছায়াভরা প্রকৃতি। পাখীরা ডালে বসে কিচমিচ করছে। কেউ বা উড়ে বেড়াচ্ছে মুক্ত আকাশে।

নূরী প্রাণভরে নিশ্বাস নিলো! ভাল করে লক্ষ্য করতেই দেখলো তাদের নৌকাখানা একটা নালার মত জায়গায় আটকে আছে। দূপাশে দুখানা পাথরে চাপে তাদের নৌকা আর এগুতে পারেনি। একটা জলপ্রপাতের শব্দ কানে এলো নূরীর। নূরী মনিকে কোলে নিয়ে ছৈয়ের বাইরে এসে দাঁড়ালো। সঙ্গে সঙ্গে ভয়ে আঁতকে উঠলো সে। পাথরখন্ডের হাত কয়েক দুরেই প্রায় দুশ ফিট গভীর খাদ। সেই খাদে জলধারা সশব্দে গিয়ে আছড়ে পড়ছে। ভাগ্যিস তাদের নৌকাখানা দুপাশের দুটো পাথরখন্ডের সঙ্গে আটকে পড়েছিলো, তাই এতক্ষণও বেঁচে আছে তারা নইলে দিনের সূর্যের আলো দেখার ভাগ্য আর তাদের হতো না। নূরী দুহাত তুলে খোদার নিকটে শুকরিয়া আদায় করলো।

না,মনিও বেঁচে আছে, ক্ষুধায় একেবারে কাতর হয়ে পড়লেও এখনও প্রাণ আছে তার দেহে।

নূরী নৌকা থেকে ধীরে ধীরে নেমে দাঁড়ালো। অতি সাবধানে নামলো সে, হঠাৎ নৌকাখানা যদি খুলে যায় তাহলে আর তাদের রক্ষা থাকবে না। নূরী নেমে দাঁড়ালো তীরে। ধার দিয়েই নির্মল স্বচ্ছ জলধারা বয়ে যাচ্ছে। সে আর তৃষ্ণা ধরে রাখতে পারলো না। মনিকে বুকে চেপে উবু হয়ে পানি পান করলো। না, এ পানি অতি সুস্বাদু, লবণাক্ত নয়। নূরী মনির মুখে আঁজলা দিয়ে একটু একটু করে পানি দিতে লাগলো। মনির ঠোঁটে পানির ছোঁয়া। লাগতেই ঠোঁট দুখানা ধীরে নড়ে উঠলো। একটু পানি খেলো মনি। নূরীব। মনে একটা ক্ষীণ আশা দেখা দিলো, হয়তো মনি বাঁচলেও বাঁচতে পারে।

এক সময় মনি চোখ মেলে তাকালো।

আশায় আনন্দে নূরীর মনে দোলা জাগলো, মনি তাহলে এ যাত্রা বেঁচে গেলো। কিন্তু সামান্য পানি খাইয়ে কতক্ষণ বাঁচাতে পারবে নূরী এই ছোট শিশুটিকে।

কোনো আশ্রয়ের আশায় নূরী মনিকে বুকে করে এগিয়ে চললো।

নূরী যতই এগোয় ততই অবাক হয় সে। বন হলেও গভীর নয়–সুন্দর পরিষ্কার বন।আগাছা বা ঐ ধরনের গাছ-গাছড়া নেই। বেশ বড় বড় আর সুন্দর সুন্দর, ঝাউগাছ জটলা পাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাঝে মাঝে নাম না জানা অনেক রকম ফুল গাছ। এক মধুর স্নিগ্ধ সুরভি নূরীর মনকে প্রফুল্ল করে তুললো।

আরও কিছুটা এগুতেই নূরী দেখলো সুন্দর পরিস্কার একটা জায়গা, দেখে মনে হলো কোনো লোক সেখানে একটু আগে ছিলো, এই মুহূর্তে উঠে গেছে। পরিস্কার জায়গাটায় স্পষ্ট পায়ের ছাপ রয়েছে। নূরীর চোখ দুটো আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। বাঁচবার আশা দোলা দিয়ে গেলো তার মনে। নূরী মনিকে কোলে নিয়ে তাকাতে লাগলো চারদিকে।

নূরী কতক্ষণ বনের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে এসেছে। কিন্তু আশ্চর্য এখন পর্যন্ত একটি হিংস্র প্রাণী তাঁর নজরে পড়েনি। এমন কি একটি বানর বা শিয়াল পর্যন্তও দেখতে পায়নি সে।

নূরী অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলো, মনিকে কোলে করে বসে পড়লো সেই পরিস্কার জায়গাটিতে।

সঙ্গে সঙ্গে একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এলো নূরীর কানে বৎস, এদিকে এসো!

চমকে উঠলো নূরী, মনিকে কোলে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো।

সচকিতভাবে তাকালো চারদিকে কোথা থেকে ভেসে এলো এ কণ্ঠস্বর, কে তাকে ডাকলো কি তার উদ্দেশ্য! নূরীর চোখে মুখে ফুটে উঠলো ভীতি ভাব। কই, কোথাও তো জনমানব দেখা যাচ্ছে না বা কোথাও কোনো ঘর বা কুটিরও নেই।

নূরী যখন ভয়বিহ্বলভাবে তাকাচ্ছে এদিকে ওদিকে তখন পুনরায় সেই কণ্ঠ–ভয় নেই বৎস। পূর্ব দিকে সোজা চলে এসো।

নূরী ভয়চকিত হরিণীর মত কম্পিত পদক্ষেপে এগুলো, কোলে তার মনি।

ধীরে ধীরে এগুচ্ছে নূরী।

চারদিকে বন, কিন্তু অন্ধকার নয়!

সব পরিস্কার, স্বচ্ছ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে নূরী চারদিকে। ভয় ও আতঙ্কে ধকধক করছে তার বুক।

গাছের ওপরে একটা পাখী পাখা ঝাপটে উড়ে গেলো।

চমকে উঠলো নূরী। মনিকে বুকে চেপে ধরলো জোরে। হঠাৎ নূরীর দৃষ্টি চলে গেলো সোজা পূর্ব দিকের একটি বৃক্ষমূলে। একি, বিস্ময়ে আরষ্ট হলো সে। অদূরে একটি বট বৃক্ষতলে জটাজুটধারী ভস্মমাখা এক সন্ন্যাসী উপবিষ্ট। দাঁড়ি-গোফ আর মাথার জটাজুটে তাকে কিস্তুত কিমাকার দেখাচ্ছে।

নূরী ভীত চোখে তাকিয়ে আছে, আর এক পাও এগুতে পারছে না সে।

পুনরায় সন্ন্যাসী গম্ভীর গলায় বললো–ভয় নেই, এসো।

নূরী এবার পা বাড়ালো, কিন্তু মনের মধ্যে ঝড় বইছে। ভয় হচ্ছে সন্ন্যাসীটা নরখাদক নয় তো?

নূরী নিকটে আসতেই সন্ন্যাসী হাত তুলে বললো–বসো।

নূরী তখনও সন্ন্যাসীর নিকট হতে প্রায় দশ হাত দূরে রয়েছে। থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো নূরী, বসে পড়লো সেখানে। সন্ন্যাসীর চেহারা তার মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে চলেছে। নূরীর মত সাহসী মেয়েও ভয়ে ঘেমে উঠতে লাগলো। সন্ন্যাসীর দেহটা ঠিক পাথর বা ঐ ধরনের শক্ত কিছুর তৈরি বলে মনে হলো, এ যেন মানুষের দেহ নয়। মাথায় জটা মূলোর মত মোটা, আর লম্বায় প্রায় তিন হাতের মত, মাটিতে স্তুপাকার হয়ে রয়েছে। দাঁড়ি আর গোঁফেও জট ধরেছে। দাড়িগোঁফও দেড় দুহাত লম্বা। ভুরুগুলো একে বারে সাদা ধবৃধবে হয়ে গেছে। কিন্তু আশ্চর্য সন্ন্যাসীর চোখ দুটো ঠিক কাচের মত স্বচ্ছ বলে মনে হলো। বাঘের চোখের মত যেন জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। কি তীব্র সে চাহনি! নূরী বসে পড়ে মনিকে বুকে আঁকড়ে ধরলো। এবার বুঝি আর তাদের রক্ষা নেই। নরখাদক সন্ন্যাসী তার আর মনির রক্ত শুষে নেবে।

হঠাৎ সন্ন্যাসী বিকট শব্দে হেসে উঠলো–হাঃ হাঃ হাঃ—

মনি সে হাসির শব্দে নূরীর বুকে মুখ লুকালো।

শিউরে উঠলো নূরী। দুচোখে ফুটে উঠলো রাজ্যের ভয় আর ভীতি। সন্ন্যাসী বললো-বৎস, ভয়ের কোনো কারণ নেই। জানি তুমি নিঃসহায়, নইলে এতক্ষণ তোমাকে আমি ভস্ম করে দিতাম।

নূরী অসহায় দৃষ্টি নিয়ে তাকালো সন্ন্যাসীর দিকে।

সন্ন্যাসীর মুখমন্ডল যদিও দাঁড়ি গোঁফ আর জটাজুটে আচ্ছাদিত তবু সে মুখে একটা প্রসন্নতার আভাস ফুটে উঠেছে। নূরী কিছুটা আশ্বস্ত হলো।

সন্ন্যাসী পুনরায় বললো–নৌকায় তুমি যখন ভেসে চলেছিলে যোগ বলে আমি তা জানতে পেরেছিলাম। এক সপ্তাহকাল না খেয়ে মানুষ কোনোদিন বাঁচতে পারে না, আমিই তোমাকে আর তোমার ঐ পালিত সন্তানকে মৃত্যুর কবল থেকে রক্ষা করেছি। দয়াময়ের নিকট আমি তোমাদের জীবন ভিক্ষা চেয়ে নিয়েছি।

স্তম্ভিত নূরী হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে সন্ন্যাসীর মুখের দিকে। একি, তার সব কথা যে বলে দিচ্ছে সন্ন্যাসী! সত্যই যা ঘটেছে তাই বলছে। কি করে জানলো এসব কথা সে!

নূরী যখন এসব ভাবছে তখন সন্ন্যাসী হাসলো, বললো–আমি সব জানতে পারি। একশ বছর আমি জল গ্রহণ না করে তপস্যা করে সর্বশক্তি যোগবল লাভ করেছি! তোমার এবং তোমার পালিত সন্তানের নামও অবগত আছি। তোমরা ক্ষুধায় এখন অত্যন্ত কাতর। যাও দক্ষিণে, তোমাদের খাবার প্রস্তুত রয়েছে।

নূরী চিত্রাপিতের ন্যায় উঠে দাঁড়ালো।

মনিকে কোলে করে এগুলো দক্ষিণ দিকে।

কিছুদূর এগুতেই নূরী লক্ষ্য করলো, সম্মুখে সুন্দর একটা কক্ষ। বিস্ময়ে অবাক হলো নূরী, একটু পূর্বেও এখানে কোনো কক্ষ ছিলো না।

নূরী ভয়চকিতভাবে পা বাড়ালো কক্ষের দিকে।

কক্ষের সামনে উপস্থিত হতেই দরজা মুক্ত হয়ে গেলো। নূরী মনিকে নিয়ে থমকে দাঁড়ালো, কক্ষে প্রবেশ করবে কিনা ভাবছে।

এমন সময় সেই কণ্ঠস্বর-ভয় নেই বৎস, প্রবেশ করো। নূরী ক্ষুধায় এত কাতর হয়ে পড়েছিলো যে, ভয় তার বেশীক্ষণ স্থায়ী হলো না বা চিন্তা করবার সময় হলো না।

কক্ষে প্রবেশ করলো নূরী।

কক্ষে প্রবেশ করতেই নানাবিধ খাদ্য সম্ভার নজরে পড়লো তার। কক্ষের মেঝেতে থালায় সাজানো থরে থরে নানা রকম ফলমূল আর বাটিভরা দুধ।

নূরী মুহূর্ত বিলম্ব করতে পারলো না, মনিকে নিয়ে বসে পড়লো খাবারের পাশে।

বাটি থেকে খানিকটা দুধ ছোট একটা গেলাসে ঢেলে মনির মুখে ধরলো।

মনি দুধটুকু ধীরে অতি ধীরে খেয়ে ফেললো।

নূরী ফলমূল আর দুধ খেয়ে তৃপ্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো।

পেট পুরে আজ খেলো নূরী। মনি বেশী খেলো না, তবু যা খেলো তাতেই সে সুস্থ হয়ে উঠলো।

সেই কক্ষের মেঝেতেই ঘুমিয়ে পড়লো নূরী।

ঘুম যখন ভাঙলো নূরী দেখলো সে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক সবল সুস্থ হয়ে উঠেছে। মনিও যেন পূর্বের মত সুস্থ চেহারা আর হাসি খুশীতে ভরে উঠেছে, ফিক্‌ কি করে হাসছে সে।

খুনী জেগে উঠতেই মনি নূরীর গলা জড়িয়ে ধরে ভাঙ্গা ভাঙ্গা কণ্ঠে বললো–মাম্মা, আমলা কোথায় এসেছি?

নূরী হেসে বললো–দাদুর ওখানে।

একটা হাসির শব্দ হলো তার কানের কাছে—হাঁ বৎস, ঠিক বলেছো।

নূরী আর মনি চমকে তাকালো, কিন্তু কেউ কোথাও নেই। নূরী এবার মনিকে মি বেরিয়ে এলো, ঘরের বাইরে এসে সোজা চললো সন্ন্যাসীর নিকটে।

নূরী অবাক হয়ে দেখলো–সন্ন্যাসীকে সে তখন যে ভাবে যে স্থানে বসে থাকতে দেখেছে সে, ঠিক সেইভাবে সেই স্থানে বসেই আছে। আশ্চর্য, একচুল এদিক সেদিক হয়নি।

এসব নিয়ে নূরী যখন বিস্ময় বোধ করছে তখন সন্ন্যাসী হেসে বললো—আশ্চর্য হবার কিছু নেই বৎস! তুমি আজ কয়েক দন্ড পূর্বে আমাকে এভাবে এখানে দেখে অবাক হচ্ছে, কিন্তু জানো না আমি এই বটবৃক্ষ তলে আজ একশ বছর পূর্বে এক সন্ধ্যায় বসেছিলাম।

নূরী অস্ফুট ধ্বনি করে উঠলো–একশ বছর পূর্বে!

হাঁ বৎস। সরে এসো, লক্ষ্য করে দেখো আমার দেহে আর মাংসপিণ্ড নেই। বটবৃক্ষের শিকড় এবং মাটি জমে জমাট হয়ে গেছে আমার দেহটা। কিন্তু আমি এখনও জীবিত আছি।

নূরী হঠাৎ বলে উঠলো–বাবা, তুমি আহার-ন্দ্রিা করোনা?

সন্ন্যাসীর সেই ভারী কণ্ঠস্বর–না, আহার-নিদ্রার আমার কোনো প্রয়োজন হয় না। আমি যখন যা ভাবি তখন সেই অভাব পূরণ হয়ে যায়। যখন ক্ষুধা অনুভব করি তখন যা খাবার আমার খেতে ইচ্ছা করে সেই খাবার দ্বারা আমার উদর পূর্ণ হয়। নিদ্রা অনুভব করলে, জেগেই আমি নিদ্রিত হই, কোনো অসুবিধা আমার হয় না।

বাবা!

বৎস, জানি তুমি বড় ব্যথিত, বড় নিঃসঙ্গ।

হাঁ বাবা!

বৎস, আমার আশ্রয়ে তোমার কোনো অসুবিধা হবে না। শুধু তুমি পশ্চিমে ভুলেও কোনোদিন যাবে না।

আমি যাবো না বাবা।

মনিকেও তুমি সাবধানে রাখবে, সেও যেন কোনোদিন ওদিকে না যায়। একটা কথা জেনে রাখো বৎস, পশ্চিমে আমার কোনো যোগবল খাটে না।

আচ্ছা বাবা।

০২.

নূরী আর মনির এখন কোনো কষ্ট নেই।

সুন্দর একটা কুটিরে তারা বাস করে। পাশের ঝর্ণায় স্নান করে। যখন যা খাবার ইচ্ছা হয় তাই খেতে পায়।

কিন্তু তবু সর্বদা নূরী আনমনা হয়ে থাকে, বনহুরের কথা স্মরণ করে সে সর্বক্ষণ চোখের পানি ফেলে। সময় সময় ভাবে—বলবে সে সন্ন্যাসী বাবার কাছে, কোন্ অতলে হারিয়ে গেছে তার হুর। কিন্তু এ কথা সে বলতে পারে না কিছুতেই। এখনও জানে নূরী, তার হুর মরেনি, মরতে পারে না। কিন্তু সন্ন্যাসী বাবা যদি বলে তার মৃত্যু হয়েছে তখন কি উপায় হবে। সহ্য করতে পারবে কি সে ঐ কথা! তার হুর এই পৃথিবীর বুকে বেঁচে আছে, এই আশা নিয়ে নুরীও বেঁচে থাকবে। অনন্তকাল ধরে বেঁচে থাকবে প্রতীক্ষা করবে সে হুরের।

দিন যায়, মাস আসে।

দিনে দিনে গড়িয়ে যায় একটি বছর।

মনি এখন বেশ ভালভাবে হাঁটতে শিখেছে। দীপ্ত সুন্দর ফুলের কুঁড়ির মত অর্ধ ফুটন্ত চেহারা। মাথায় কোঁকড়ানো চুল, ঘাড়ের ওপর ঝুলে পড়েছে। গভীর নীল দুটি চোখে মনোমুগ্ধকর চাহনি। ভাঙ্গা ভাঙ্গা শব্দে অস্ফুট ধ্বনি করে, সারাদিন খুটখুট করে হেঁটে বেড়ায়।

নূরীর ওকে নিয়ে আশঙ্কার শেষ নেই, না জানি কখন কোন দিকে চলে যাবে, কোনো হিংস্র জানোয়ার কখন ঘাড় মটকে খেয়ে ফেলবে কে জানে।

নূরী মনিকে নিয়ে যতই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে সন্ন্যাসী বাবা সান্ত্বনা দেন–ভয় নেই বৎস, এ বনে আমার সীমানায় কোনো পাপাচারী প্রবেশে সক্ষম হবে না। কিন্তু সাবধান, পশ্চিমে যেন তোমার মনি না যায়।

০৩.

সিন্ধুর মহারাজ নারায়ণ দেবের বিধবা কন্যা হীরাবাঈকে বিয়ে দিতে বাধ্য করেছিলো দস্যু বনহুর। হীরা এ বিয়েতে প্রথমে রাজী হয়নি, সে মনপ্রাণ দিয়ে ভালবেসেছিলো বনহুরকে। ওকে ছাড়া সে বাঁচতে পারবেনা এ কথাও জানিয়ে দিলে ছিলো তাকে। কিন্তু বনহুর ধরা দেবার পাত্র নয়

হীরা বনহুরকে নিয়ে স্বপ্নসৌধ রচনা করেছিলো। সব সময় ওকে নিয়ে মেতে থাকতো, বনহুর যদিও হীরা আর তার সখীদের মধ্যে নিজকে ছেড়ে দিয়েছিলো, কিন্তু নিজকে সে সংযত রাখতো অতি সাবধানে।

পুরুষ মন মাঝে মাঝে বিচলিত হতো। হীরার সান্নিধ্য তাকে করে তুলতো চঞ্চল, একটা অনুভূতি নাড়া দিয়ে যেতো বনহুরের মনে যখন হীরাবাঈ নিভৃতে এসে বনহুরের বুকে মাথা রাখতো গভীর আবেগে জানাতো—আমি তোমাকে ভালবাসি বনহুর!

বনহুর হীরার কথায় মৃদু হাসতো, জবাব দিতো না কিছু। নিজকে সংযত রাখতো দৃঢ়চিত্তে।

হীরা তার সুকোমল বাহু দুটি বেষ্টন দিয়ে ধরতে বনহুরের গলা –আমি তোমাকে কোনোদিন ছেড়ে দেবো না!

বনহুরের চোখে তখন ভাসতো মনিরার মুখখানা। না জানি তার এই বহুদিনের অদর্শনে মনিরা ও তার মা কত চিন্তিত ও মর্মাহত হয়ে পড়েছেন। আরও মনে পড়তো নূরী আর মনির কথা। কোথায় তারা, বেঁচে আছে না মরে গেছে তাই বা কে জানে। আনমনা হয়ে যেতো বনহুর।

হীরা বনহুরের গম্ভীর ভাবাপন্ন ভাব লক্ষ্য করে বিমর্ষ হতো। ব্যথায় মনটা তার গুমরে কেঁদে উঠতো, অভিমান করে চলে যেতো সে বনহুরের কাছ থেকে!

সখীরা হীরার বিষণ্ণ ভাব লক্ষ্য করে চিন্তিত হতো, ব্যস্তও হতো তারা। হীরাকে নানা প্রশ্ন করতো।

একদিন হীরাবাঈ মুখ গম্ভীর করে বসেছিলো, সখীরা প্রমাদ গুণলো। সবাই ঘিরে ধরে সখীর মনোভাব প্রসন্ন করার চেষ্টা করতে লাগলো, কিন্তু হীরার মুখোভাব কিছুতেই সচ্ছ হলো না বরং অশ্রু গড়য়ে পড়লো তার দুগণ্ড বেয়ে।

সখীরা উদ্বিগ্ন হলো, নিশ্চয়ই ভয়ঙ্কর কিছু একটা ঘটেছে। কিন্তু কি ঘটেছে ভেবে পায় না তারা।

সখীরা গিয়ে ধরে বসলো বনহুরকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে চললো।

হেসে বললো বনহুর—তোমাদের হীরা বিয়ে করতে চায়। পা

রুল সবার হয়ে বললো–তা কি করে সম্ভব, সে যে বিধবা!

কিন্তু বিধবার বিয়ে হয়।

অসম্ভর!

তাহলে হীরাকে আমার সঙ্গে মিশতে দাও কেন?

বন্ধু হিসাবে।

হীরা কি তাতেই খুশী?

না হয়ে উপায় নেই। সে জানে হিন্দু বিধবার বিয়ে হতে পারে না।

তাহলে আজ তোমাদের সখী হীরা অমন রাগ বা অভিমান করতো না।

সত্যি তাহলে–

হাঁ, হীরা, শুধু ভালবাসাই চায় না, তার জীবনটা সার্থক করে তুলতে চায়, স্বামী সন্তান সংসার নিয়ে সুখী হতে চায়।

পারুলের দুচোখে বিস্ময় ঝরে পড়ছে, বললো সেমহারাজ যদি একথা জানতে পারেন?

বনহুর শান্ত গলায় বললো–মহারাজ রাজী হয়েছেন।

এ আপনি কি বলছেন?

হাঁ পারুল, হীরার আবার বিয়ে হবে এবং অতি শীঘ্রই হবে।

পারুলের দুচোখে আনন্দ ঝড়ে পড়ে। ছুটে গেলো সখীদের নিয়ে হীরার পাশে। বললো পারুল-সখী, এবার বুঝতে পেরেছি তোমার মনের কথা। জানি তোমার কোথায় এতো ব্যথা। হু– পারুল হীরার গালে মৃদু আঘাত করে।

হীরা সখীদের খুশীভরা ভাব দেখে কিছুটা প্রসন্ন হয়, বলে যা, তোরা বড় দুষ্ট!

পারুল জড়িয়ে ধরে হীরাকে—এবার সব দুঃখ সব ব্যথা দূর হবে সখী। বন্ধুকে পাবি এবার অতি আপন করে।

হীরা অবাক হয়ে বলে–সত্যি?

সত্যি নয় তো মিথ্যা বলছি!

কে বললো এ কথা তোকে পারুল?

তোর বন্ধু।

ও বলেছে?

সেদিন হীরা ভেবেছিলো বনহুরকেই সে স্বামীরূপে পাবে। আশায় আনন্দে নেচে উঠেছিলো তার মন। অফুরন্ত খুশী নিয়ে প্রতীক্ষা করছিলো সেই দিনটির যেদিন বন্ধুকে সে একান্ত আপনার করে পাবে।

হীরা যতই বনহুরের কথা ভেবে আনন্দ উপভোগ করছিলো বনহুর ততই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছিলো। গোপনে সে পাশের রাজ্যের অবিবাহিত রাজার সঙ্গে হীরার বিয়ের সব আয়োজন ঠিক করে ফেললো।

একদিন বিয়ের শুভ লগ্ন এগিয়ে এলো।

হীরার আনন্দ আর ধরে না।

হীরা যতই বনহুরের সঙ্গ কামনা করে, বনহুর ততই নিজকে সরিয়ে রাখে ওর কাছ থেকে। গোপনে পালিয়ে থাকে এদিকে সেদিকে।

একদিন বনহুর পুকুরের শান বাঁধানো ঘাটে বসে নিজের কাজের কথা ভাবছিলো, হীরা চুপি চুপি গিয়ে বনহুরের চোখ দুটো টিপে ধরলো।

বনহুর হেসে বললো-হীরা!

হীরার দুচোখে আনন্দের দ্যুতি খেলে গেলো। বসে পড়লো বনহুরের পাশে কি ভাবছো?

তোমার বিয়ের কথা।

লজ্জায় হীরার মুখ লাল হয়ে ওঠে, বলে–তোমার আনন্দ হচ্ছে না?

খুব!

সত্যি?

সত্যি।

এরপর একদিন সত্যিই হীরার বিয়ের দিন এগিয়ে এলো।

মহারাজ নারায়ণ দেব কন্যার বিয়ের সব আয়োজন করলেন। যদিও প্রজাগণ এ বিয়েতে সন্তুষ্ট ছিলো না তবু মহারাজের মতের বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলতে পারলে না।

একমাত্র রাজগুরু বেঁকে বসলেন, মহারাজকে জানালেন–বিধবা কন্যার বিয়ে দিলে অমঙ্গল হবে।

রাজগুরুর আদেশ অমান্য করা কারও সাধ্য নয়। মহারাজ নারায়ণ দেব। চোখে সর্ষে ফুল দেখলেন। এটা কি তারই ইচ্ছা, দস্যু বনহুর তাঁকে বাধ্য করেছেনইলে মৃত্যু তাঁর অনিবার্য। মহারাজের হৃদয়ে ঝড়ের তান্ডব শুরু হলো।

একদিকে দস্যু বনহুরের তীক্ষ্ণধার ছোরা আর একদিকে রাজগুরুর। অমঙ্গল বাণী। নারায়ণ দেব সমস্যায় পড়লেন। এদিকে বিয়ের সব আয়োজন সমাধা হয়েছে।

পাত্র কে এবং কেমন দেখতে কিছুই জানেন না মহারাজ, এসব দায়িত্ব নিয়েছে বনহুর নিজে।

মহারাজকে বলেছে সে আপনার কন্যার মঙ্গল কামনাই আমার লক্ষ্য। আপনার জামাতা কুলীন ব্রাহ্মণ এবং সে অন্য এক রাজ্যের রাজা। দেখতে শুনতে বেশ। হীরার সাথে মানাবে ভাল। বিয়ের দিন বর আসবে বিয়ে হবে। তারপর শুভ দৃষ্টির সময় বরের মুখের আবরণ উন্মোচন করা

হবে।

বিয়ের দিন।

হীরা বাঈকে ঘিরে সখীরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ে।

নানা জনে নান রকম আলাপ ঠাট্টা করছে তার সঙ্গে। হীরার মনে খুশীর উৎস বয়ে চলেছে। আজ সে বনহুরকে নিজের করে পাবে। আর কোনদিন সে চলে যাবে না তাকে ছেড়ে।

বিয়ে হয়ে গেলো।

এবার শুভ দৃষ্টি।

বরের মুখ এতক্ষণ একটা সুন্দর চাদরে ঢাকা ছিলো। কতগুলো ফুলের মালাও ছিলো ছোট চাদারের সংগে আঁটা। তবে বরকে ভালই লাগছিলো, যদিও তার মুখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো না।

শুভ দৃষ্টির সময় চমকে উঠলো হীরা, এ তো তার বনহুর নয়। কিছু বলতে পারলো না, একটা অস্ফুট শব্দ করে ঢলে পড়লো সে। কিন্তু আর কোনো উপায় নেই। অগ্নিস্বাক্ষী রেখে বিয়ে তাদের হয়ে গেছে।

হীরা যখন স্বামীর সঙ্গে বাসর কক্ষে প্রবেশ করলো তখন বনহুর একটা অশ্বপৃষ্ঠে আরোহণ করে দ্রুত বেগে ছুটে চলেছে রাজ্যের শেষ প্রান্তে।

এরপর আর কোনদিন হীরা বা তার সখীরা বনহুরকে দেখতে পেলো।

০৪.

অজানার পথে ছুটে চলেছে বনহুর। কোথায় চলেছে তা সে নিজেই জানে না। দিকহারা, দিশেহারা উদভ্রান্ত পথিকের মত যেদিকে দুচোখ যায় সেদিকে অশ্ব চালনা করছে।

দিন যায়, রাত আসে–আবার দিন হয়! আবার রাত হয়! বনহুরের চলার বিরাম নেই।

একদিন পথের শেষে সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এলো। আশে পাশে কোথাও কোনো লোকালয় নেই। বনহুর আর এগুলো সমীচীন মনে করলো না। একটা গাছের সংগে ঘোড়াটা বেঁধে গাছটার নীচে শুয়ে পড়লো। পথ চলার ক্লান্তি আর অবসাদে বনহুরের শরীর অবসন্ন হয়ে পড়েছিলো,

অল্পক্ষণেই ঘুমিয়ে পড়লো সে!

একটা ধস্তাধস্তির শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেলো বনহুরের। তাড়াতাড়ি উঠে বসলো, তাকালো সামনের দিকে! অন্ধকারে কিছুই নজরে পড়ছে না—শুধু তার ঘোড়াটা যেখানে বাধা ছিলো সেইখানে প্রচন্ড শব্দ হচ্ছে।

বনহুর কিছু বুঝতে না পেরে অগ্রসর হলো।

একটু এগিয়েছে অমনি পায়ের সংগে বিরাট গাছের গুঁড়ির মত কিছু লেগে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলো। সর্বনাশ, কি ঠান্ডা সেই জিনিসটা। বনহুর ভয় পাবার পাত্র নয়, চট করে উঠে দাঁড়ালো। অন্ধকারে সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মুহূর্তে তার মুখমন্ডল বিবর্ণ হলো, বিস্ময়ে আড়ষ্ট হলো সে।

বনহুরের মত নির্বীক দস্যুও বিচলিত হলো।

বিরাট একটা অজগর তার অশ্বটার অর্ধেক গিলে ফেলেছে আর অর্ধেকটা এখনও ঝুলছে অজগরের মুখ গহ্বরে। ঘোড়াটার সামনের ভাগ অজগরের মুখের ভেতরে প্রবেশ করেছে, আর পেছনের অংশ এখনও ছটফট করছে। বনহুর নিরস্ত্র নয়, তার সংগে একটা রাইফেল রয়েছে। এটা বনহুর মহারাজ নাবায়ণ দেবের অস্ত্রাগার থেকে নিয়ে এসেছিলো। বনহুর রাইফেল বাগিয়ে ধরলো, কিন্তু গুলী ছুঁড়বার পূর্বে মনে হলো ওকে মেরে কোনো ফল হবে না। ঘোড়াটা প্রাণ হারিয়েছে, আর তাকে ফিরে পাওয়া যাবে না। রাইফেল নীচু করে নিলো বনহুর।

কিন্তু এখানে আর বিলম্ব করা মোটেই উচিত নয়। বনহুর রাতের অন্ধকারেই দ্রুত চলতে লাগলো।

অশ্বটাকে হারিয়ে বনহুর বিপদে পড়লো। এই নির্জন নিস্তব্ধ রাত্রির অন্ধকারে কোন দিকে কোথায় যাবে। কোথায় কোন বিপদ ওত পেতে আছে কে জানে।

বেশী দূর না এগিয়ে বনহুর সামনে একটা বৃক্ষ দেখতে পেয়ে তাতেই চড়ে বসলো।

সেদিন রাতে আর ঘুম হলো না।

ভোরের আলো ফুটে উঠতেই বনহুর নেমে পড়লো। ঘোড়াটা না থাকায় বড় অসুবিদা হয়ে পড়লো তার। পায়ে হেটে কতদূর যাবে, কোথায় যাবে সে?

তবু চলতে লাগলো, দক্ষিণ হাতে গুলীভরা রাইফেল। এটাই এখন তার সম্বল।

বনবাদাড়, পথ-ঘাট মাঠ পেরিয়ে এগিয়ে চললো বনহুর। গোটা দিন চলার পর দূরে অনেক দূরে দেখা গেলো বড়বড় দালানকোঠা আর ইমারত।

বনহুর দ্রুত পা চালালো।

ক্ষুধায় পিপাসায় অত্যন্ত কাতর হয়ে পড়েছিলো সে। তবু এগুচ্ছে যেমন করে হোক তাকে শহরে পৌঁছতেই হবে।

প্রায় সন্ধ্যার কাছাকাছি, বনহুর শহরের সিংহদ্বারে এসে পৌঁছলো। একটা সরাইখানা দেখতে পেয়ে সেখানে প্রবেশ করলো।

বনহুরের দেহের পোশাক পরিচ্ছদ রাজ রাজার মতই ছিলো। হীরার ইচ্ছায় তাকে এ পোশাক পরতে হয়েছিলো। একটা মূল্যবান পাগড়ীও ছিলো তার মাথায়। পায়ে মূল্যবান নাগরা।

বনহুরকে দেখে সরাইখানার মালিক সসম্মানে অভ্যর্থনা জানালো।

বনহুর একটা চেয়ারে গিয়ে বসলো। তাকিয়ে দেখতে লাগলো সরাইখানার চারদিকে। প্রত্যেকটা টেবিলের পাশে জটলা পাকিয়ে লোকজন বসে আছে। মাঝে মাঝে দুচারজন নারীও রয়েছে।

সব টেবিলেই মদের বোতল আর নানা রকম ফলমূল সাজানো। বনহুর সরাইখানায় প্রবেশ করতেই কক্ষস্থ সবাই একবার তার দিকে তাকিয়ে দেখলো। অবশ্য বনহুরকে এ সরাইখানায় তারা এই প্রথম দেখলো। তাই আশ্চর্য হলো অনেকেই।

কয়েকটা যুবতী বসেছিলো, তারা বনহুরকে দেখে নিজেরা মুখ চাওয়া চাওয়ি করে নিলো। সবাই বিস্ময়ভরা চোখে তাকিয়ে আছে বনহুরের দিকে।

একটি অর্ধ উলঙ্গ নারী নাচতে শুরু করলো।

একপাশে বাদ্যকরগণ দাঁড়িয়ে বাজনা বাজাচ্ছে।

বনহুরের সামনে এক বোতল মদ আর কিছু মাংস ও ফলমূল এনে সাজিয়ে রাখলো।

বনহুর অত্যন্ত ক্ষুধার্ত ছিলো, খেতে শুরু করলো।

কিন্তু যখন স্মরণ হলো, তার পকেট তো শূন্য, তখন কুঞ্চিত করে ভাবতে লাগলো। খেয়েছে এখন পয়সা দিতে হবে তো?

পয়সার চিন্তায় বেশ অশ্বস্তি বোধ করলো। সে দস্যু হতে পারে, লুটতরাজ করে নিতে পারে, বিপাকে পড়লে খুন করতেও তার বাধে না। কিন্তু সে তো পয়সা ছাড়া খেতে পারে না। বনহুর অন্যমনস্কভাবে চিন্তা করছে। ঠিক সেই মুহূর্তে নাচনেওয়ালী নাচতে নাচতে তার পাশে এসে দাঁড়ালো, অদ্ভুত ভঙ্গিতে ঝুকে পড়লো বনহুরের দিকে।

বনহুর তাকালো, দেখনো নাচনেওয়ালীর গলায় ঝকঝক করছে একছড়া হার। মূল্যবান হার ছড়ার দিকে তাকিয়ে বনহুর উঠে দাঁড়ালো। হাত বাড়ালো নাচনেওয়ালীর দিকে।

নাচনেওয়ালী বনহুরের চেহারায় মুগ্ধ হলো। দুহাত বাড়িয়ে বনহুরের জামার আস্তিন চেপে ধরে নাচার ভঙ্গিতে ঝুঁকে পড়লো।

সেই ফাঁকে অদৃশ্য হলো নর্তকীর কণ্ঠের হার।

বনহুর এসে বসলো টেবিলের পাশে।

নর্তকীর নাচ তখন শেষ হয়ে গেছে। অনেকেই বেরিয়ে যাবার জন্য উঠে দাঁড়ালো। তাদের সংগে বনহুরও উঠে দাঁড়ালো।

সরাইখানার মালিক একপাশে গদি আঁটা সোফায় বসে আলবোলা টানছিলো।

বনহুর ভীড় ঠেলে বেরিয়ে যাবার সময় চট করে হারছড়া সরাইখানার মালিকের হাতে গুঁজে দিয়ে দ্রুত সরে পড়লো।

সরাইয়ের মালিক হারছড়া হাতে নিয়ে অবাক হয়ে দেখছে, আর ভাবছে, সামান্য ভুরিভোজনে একটা মূল্যবান হার–ব্যাপার কি?

সরাইখানার মালিক হারছড়া হাতে নিয়ে দেখছে, এমন সময় নর্তকীর করণ অর্তিকণ্ঠ শোনা গেলো আমার হার কি হলো! আমার হার কি হলো?

সরাইখানার মালিক নর্তকীর দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ভরা চোখে দেখলো তার গলা শুন্য, হার নেই। সব বুঝতে পারলো এটাই নর্তকীর হার। আশ্চর্য, এ হার নতুন আগন্তুক লোকটির নিকটে কি করে গেলো এবং সে না নিয়ে তার হাতে দিয়ে গেলো কেন ভাবতে লাগলো সরাইয়ের মালিক। তারপর হারটা ফিরিয়ে দিলো সে নর্তকীর হাতে।

বনহুর পথ চলেছে। রাতের মত ক্ষুধা পূরণ হয়ে গেছে তার। এখন বিশ্রামের প্রয়োজন। বহু পথ আজ সে হেঁটে এসেছে। এক রাজ্য ছেড়ে অন্য রাজ্যে।

শিথিল পা দুখানা টেনে টেনে চলছিলো বনহুর। এখনও তার সঙ্গী রাইফেলটা রয়েছে।

রাত বেড়ে আসছে।

একটা নির্জন পথ ধরে এগুচ্ছিলো বনহুর। মাঝে মাঝে দুএকটা পথিক তার পাশ কেটে চলে যাচ্ছিলো।

এখানে কেউ তাকে চেনে না, যদি কেউ জানতো এ লোক স্বাভাবিক পথিক নয়, তাহলে আঁতকে উঠতো। কিন্তু এদেশের কেউ বনহুরকে চেনেনা জানে না।

বনহুর আপন মনে এগিয়ে চলেছে।

অন্য একটা সরাইখানা পেলে উঠে পড়বে, রাতের মত একটু আশ্রয় তার চাই।

হঠাৎ বনহুরের কানে ভেসে এলো একটা নারীকন্ঠের তীব্র করুণ আর্তনাদ–আঃ, আঃ, আঃ–ক্রমে থেমে এলো শব্দটা।

বনহুরের জড়তা মুহূর্তে ছুটে গেলো, সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে তাকালো চারদিকে।

বনহুর লক্ষ্য করলো পথের ধারে একটা বাড়ীর দোতলা থেকে এই শব্দটা এসেছে। বাড়ীটা মস্তবড়। দ্বিতলের একটা কক্ষে আলো দেখা যাচ্ছে।

বনহুর স্থির হয়ে দাঁড়ালো, তাকিয়ে রইলো দোতলার বৈদ্যুতিক আলোক রশ্মির দিকে। একটা ছায়ার মত কিছু নড়ছে দেখতে পেলো সে। আর একদন্ড বিলম্ব না করে রাইফেলখানা পিঠের সঙ্গে বেঁধে বাড়ীখানার দিকে এগিয়ে গেলো সে। লক্ষ্য করে দেখলো কিভাবে ওপরে যাওয়া যায়। নিশ্চয়ই কোনো নারী বিপদে পড়েছে।

বনহুর কিছু ভাবছে ঠিক সেই মুহূর্তে একটা ট্যাক্সি থামলো বাড়ীখানার সামনে।

বনহুর মুহূর্তে সরে দাঁড়ালো দেয়ালের আড়ালে।

বনহুর আড়াল থেকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে দেখতে লাগলো।

ট্যাক্সিখানা পৌঁছতেই বাড়ার মধ্যে সিঁড়িতে দ্রুত পদশব্দ হতে লাগলো। ভারী জুতোর শব্দ, কেউ সিঁড়ি বেয়ে দোতলা থেকে নেমে আসছে মনে হলো।

বনহুর স্তব্ধ নিঃশ্বাসে প্রতীক্ষা করতে লাগলো।

দরজা খুলে গেলো, চমকে উঠলো বনহুর। দেখতে পেলো আপাদমস্তক জমাকালো আলখেল্লায় ঢাকা একটা লোক দ্রুত গাড়ীটায় উঠে বসলো।

মাত্র দুজন লোক গাড়ীতে। একজন ড্রাইভার অন্যজন সেই অদ্ভুত আলখেল্লাধারী।

বনহুর ভাবলো, এই মুহূর্তে এদের দুজনকে কাবু করা তার পক্ষে অসম্ভব কিছু নয়, কিন্তু এই যে একটা আর্তনাদ তারপর এদের দ্রুত পলায়ন, এর পেছনে কি রহস্য লুকিয়ে আছে কে জানে।

বনহুর লোক দুটিকে অনুসরণ করবে না দোতলায় গিয়ে দেখবে ভাবতে লাগলো। এমন সময় গাড়ীখানা স্টার্ট দিয়ে চলতে শুরু করলো। বনহুর সঙ্গে সঙ্গে গাড়ীর চাকা লক্ষ্য করে গুলী ছুড়লো।

চাকার হাওয়া বেরিয়ে গেলো। গাড়ী কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে থেমে পড়লো। বনহুর দ্রুত ছুটলো গাড়ীর দিকে।

লোকগুলোও সজাগ ছিলো গাড়ী থেমে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে নেমে পড়লো, তারপর একটা বাড়ীর আড়ালে অদৃশ্য হলো।

বনহুর গাড়ীর নিকটে পৌঁছে হতবাক হলো।

আলখেল্লাধারী ও গাড়ীর ড্রাইভার উভয়েই কোনো বাড়ীর অন্তঃপুরে আত্মগোপন করেছে।

ঘন বাড়ীঘর আর দালানকোঠা থাকায় শয়তানদ্বয় পালাতে সক্ষম হলো, নইলে বনহুরের হাতে তাদের রক্ষা ছিলো না।

বনহুর এবার দ্রুত ছুটে চললো সেই পূর্বের বাড়ীটার দিকে। যে বাড়ী থেকে পূর্বে একটা করুণ আর্তনাদ ভেসে এসেছিলো।

বনহুর প্রাচীর বেয়ে উপরে উঠলো, তারপর পাইপ বেয়ে উঠতে লাগলো। দোতলা হলেও বেশ উঁচু বাড়ীখানা। বনহুর অনেক চেষ্টায় উঠে পড়লো। তারপর রেলিং টপকে প্রবেশ করলো দোতলার বারান্দায়। সতর্কভাবে চারদিকে তাকিয়ে দেখলো। গোটা বাড়ীটা নিস্তব্ধ। বনহুর আর বিলম্ব না করে কক্ষের দরজায় এসে ধাক্কা দিলো, সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে গেলো।

কক্ষে প্রবেশ করতেই স্তম্ভিত হতবাক হলো সে।

কক্ষের মেঝেতে লুকিয়ে পড়ে আছে একটি রক্তাক্ত যুবতী। যুবতীর বুকের রক্তে মেঝের কার্পেট লালে লাল হয়ে গেছে।

বনহুর যুবতীর মুখের দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ে অস্ফুট ধ্বনি করে উঠলো,

একি! এ যে সেই যুবতী!

সন্ধ্যায় সরাইখানায় এই যুবতীই অর্ধ উলঙ্গ অবস্থায় নেচেছিলো এবং যার গলা থেকে বনহুর মূল্যবান হারছড়া গোপনে খুলে নিয়েছিলো। কিন্তু একে হত্যা করলো কে? কি কারণ রয়েছে এর হত্যার পেছনে? এতবড় বাড়ীতে যুবতী একাই বা থাকে কেন এর কি কেউ নেই?

বনহুরের মনে নানা প্রশ্নে উঁকি দিচ্ছে। নিহত যুবতীকে ভাল করে লক্ষ্য করতে লাগলো সে। দেখলো যুবতীর বুকে গভীর ক্ষত ছোরার আঘাতে তাকে হত্যা করা হয়েছে। এখনও ক্ষত দিয়ে তাজা লাল টকটকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে।

বনহুরের দৃষ্টি হঠাৎ চলে গেলো যুবতীর গলায়। একটা আঁচড়ের লাল দাগ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সেখানে। যুবতীর হাতখানা মুষ্টিবদ্ধ দেখে বনহুর দ্রুতহস্তে ওর হাতের মুঠি খুলে ফেললো। চমকে উঠলো বনহুর, নিহত যুবতীর মুঠার মধ্যে দেখতে পেলো চেনের খানিকটা অংশ, একটা মূল্যবান পাথরও রয়েছে চেনের সঙ্গে। বিদ্যুতের আলোতে চেনের পাথরটা ঝকমক করে উঠলো। বনহুরের স্মরণ হলো-সন্ধ্যায় যুবতীর গলায় এই হারছড়াই সে দেখেছিলো এবং এটাই সে খুলে নিয়েছিলো। হারে অন্ততঃপক্ষে এই রকম পাঁচখানার. বেশী পাথর ছিলো এও বেশ মনে আছে তার।

বনহুরের নিকটে যুবতীর হত্যা-রহস্য এবার পরিস্কার হয়ে এলো। দুঃখ, হলো তার হারছড়া তখন যদি ফিরিয়ে না দিতো তাহলে আজ এই মুহূর্তে যুবতীর মৃত্যু ঘটতো না।

বনহুর যুবতীর হাতের মুঠা থেকে মালার টুকরোখানা নিয়ে দাঁড়ালো, শপথ করলো সে—এই যুবতীর হত্যাকারীকে সে খুঁজে বের করবেই, এবং নিজ হাতে এর শাস্তি তাকে দেবে।

বনহুর উঠতে যাবে—এমন সময় সিঁড়িতে দ্রুত বুটের শব্দ শোনা গেলো।

বনহুর এবার বুঝতে পারলো, কোনো লোক এই হত্যার সন্ধান পেয়েছে। এখন তারা যদি এসে তাকে এখানে এই অবস্থায় দেখে ফেলে তাহলে আর রক্ষা নেই। তাকেই যুবতীর হত্যাকারী বলে জানবে। মুহূর্ত বিলম্ব না করে বনহুর একটা আলমারীর পেছনে লুকিয়ে পড়লো।

সঙ্গে সঙ্গে কক্ষে প্রবেশ করলো কয়েকজন পুলিশ অফিসারসহ এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক ও এক যুবক। বনহুর দেখতে পেয়েই চিনতে পারলো প্রৌঢ় লোকটি অন্য কেউ নয়, সরাইখানার মালিক যাকে তখন বনহুর মালাছড়া দিয়ে এসেছিলো আর যুবকটিকেও তখন সে দেখেছিলো সরাইখানার একটি টেবিলের পাশের চেয়ারে।

পুলিশ অফিসারাগণ ও প্রৌঢ় ভদ্রলোক যুবতীর লাশের নিকটে এসে দাঁড়ালেন। প্রৌঢ় ভদ্রলোক বারবার রুমালে চোখ মুছতে লাগলেন। পুলিশ অফিসার একজন—বোধ হয় পুলিশ ইন্সপেক্টার হবেন, তিনি ঝুঁকে পড়ে লাশ পরীক্ষা করে দেখতে লাগলেন।

প্রৌঢ় ভদ্রলোক বলে উঠলেন—না জানি কোন দুশমন আমার কন্যা মালতীকে খুন করেছে।

বনহুর এবার বুঝতে পারলো, নিহত যুবতী সরাইখানার মালিকের কন্যা, নাম মালতী। কিছুটা অবাকও হলো বনহুর প্রৌঢ় ভদ্রলোকের রুচির পরিচয় পেয়ে। নিজ কন্যার দ্বারা এভাবে অর্থ উপার্জন ছাড়া তার কি কোনো উপায় ছিলো না? কিন্তু সঙ্গের যুবকটি কে? যে এখনও একটি কথাও উচ্চারণ করেনি। লাশটার একপাশে দাঁড়িয়ে স্থিরচোখে তাকিয়ে আছে সে।

পুলিশ ইন্সপেক্টার লাশ পরীক্ষা শেষ করে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন, কুঞ্চিত করে বললেন আপনার কন্যার হত্যাকান্ড অত্যন্ত রহস্যজনক।

প্রৌঢ় ধরা গলায় বললেন-হাঁ স্যার, সেই রকমই মনে হচ্ছে।

ইন্সপেক্টর বললেন-আপনি এবার সব কথা আমার কাছে স্পষ্টভাবে বলুন। কারণ, আপনার বলার বিবরণে নির্ভর করবে আপনার কন্যার মৃত্যু-রহস্য উদঘাটন।

প্রৌঢ় বলল–বলুন কি জানতে চান।

ইন্সপেক্টার একটা সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করে একমুখ ধোঁয়া ছুড়ে বললেন–আপনার কন্যা কি এ বাড়ীতে একাই থাকতো?

না। যুবকটির দিকে তাকিয়ে বললেন প্রৌঢ় ভদ্রলোক-ও নীচের তলায় থাকে। আজ সে ছিলো না, সরাইখানার একটা জরুরী কাজে তাকে বাইরে পাঠিয়েছিলাম।

আপনি কোথায় থাকেন?

আমি–আমাকে সরাইখানার কাজে প্রায়ই সেখানে থাকতে হয়। আমি সরাইখানার একটি কামরায় থাকি।

আপনার কন্যা নিহত হওয়ার সংবাদ কি করে পেলেন?

এখানে একটি চাকর থাকে, সেই ছুটে গিয়ে আমাকে সংবাদ দেয়। ইরে রহমত, এদিকে আয়।

একটা জমকালো লোক কক্ষে প্রবেশ করে একপাশে দাঁড়ালো। লোকটা নিগ্রো বা ফ্রি বলে মনে হলো।

পুলিশ ইন্সপেক্টার লোকটার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে বললেন–তুমি এ বাড়ীতে থাকো?

হাঁ। কাফ্রি লোকটা জবাব দিলো।

ইন্সপেক্টার পুনরায় প্রশ্ন করলেন—তুমি মিস মালতীর হত্যা সম্বন্ধে কি জানো বলো?

কাফ্রি খাঁটি বাংলায় বললো—আমি আজ সকাল সকাল ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কারণ–যুবকের দিকে তাকিয়ে বললোঊনিও ছিলেন না, একা একা কি করবো। দিদিমণির খাবার সাজিয়ে রেখে শুয়ে পড়েছিলাম।

তোমার দিদিমণি কখন বাসায় ফিরে এসেছিলো জানো?

জানি। সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শুনে জেগে পড়েছিলাম। মনে করেছিলাম, দিদিমণির খাবার এবং অন্য সব কিছু তো গুছিয়ে রেখেছি, তবু যদি ডাকেন তবে উঠে পড়বো। কিন্তু তিনি আর ডাকলেন না। আমিও উঠলাম না। চুপ করে শুয়ে থেকেই শুনতে পেলাম সিঁড়িতে একসংগে দুজন লোকের পায়ের শব্দ।

দুজন লোকের পায়ের শব্দ?

হাঁ স্যার। আমার মনে হলো অরুণ বাবু আর মালতী দিদি এক সংগে ফিরে এলেন। কাফ্রি লোকটা যুবকটির দিকে আর একবার তাকালো।

বনহুর আড়ালে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারলো, যুবকটির নাম অরুণ বাবু। আলমারীর আড়ালে আত্মগোপন করতে গিয়ে মশার কামড়ে পা দুটো জ্বালা করছে। কিন্তু উপায় নেই একটু নড়বার। রুদ্ধ নিঃশ্বাসে ওদের কথাবার্তা শুনছে বনহুর।

পুলিশ ইন্সপেক্টার এবার যুবকে লক্ষ্য করে বললেন অরুণ বাবু, আপনি কি মিস মালতীর সংগে ফিরে এসেছিলেন? সত্যি কথা বলবেন।

সত্য কথাই বলবো আমি তার সংগে ফিরে আসিনি। গম্ভীর স্থির কণ্ঠস্বর অরুণ বাবুর।

তবে কে এসেছিলো মিস মালতীর সঙ্গে? প্রশ্ন করলেন ইন্সপেক্টার।

অরুণ বাবু পূর্বের ন্যায় স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো—সে কথা নিহত মালতী ছাড়া কেউ জানেনা।

হুঁ। অস্ফুট শব্দ করলেন পুলিশ ইন্সপেক্টার।

আড়ালে দাঁড়িয়ে বনহুরের ভূকুঞ্চিত হলো।

এবার ইন্সেপক্টার প্রশ্ন করলেন কাফ্রি চাকরটাকেএসড়িতে উঠাকালে মালতী এবং দ্বিতীয় ব্যক্তির কথাবার্তা শুনতে পাওনি?

না স্যার। সিঁড়িতে তাদের কোনো কথাবার্তা শুনতে পাইনি। তবে একটু পরে দিদিমণির কক্ষে অরুণ বাবুর গলার স্বরের মত আওয়াজ পেয়েছিলাম একটু।

অরুণ বাবু বলে উঠলেন–মিথ্যে কথা! আমি কিছুক্ষণ পূর্বে আমার কাজ সেরে সরাইখানায় ফিরে মালতীর হত্যাকান্ডের কথা জানতে পারি এবং উনার সঙ্গে চলে আসি। মালিককে দেখিয়ে বললো–অরুণ বাবু।

ইন্সপেক্টার এবার কাফ্রি চাকরটাকে প্রশ্ন করলেন–তুমি মালতীর হত্যা ব্যাপারে কখন জানতে পেরেছিলে?

কাফ্রি চট করে বললো–আমি একটু ঘুমিয়ে পড়েছি, হঠাৎ একটা আর্তনাদে আমার ঘুম ভেঙে গেলো। আর্তনাদের শব্দটা দিদিমণির বলেই মনে হলো–ছুটে গেলাম সিঁড়ি দিয়ে, ওপরে গিয়ে হতবাক হলাম, দেখলাম দিদিমণির রক্তাক্ত দেহ মেঝেতে পড়ে আছে।

পুলিশ ইন্সপেক্টার বললেন–তারপর?

কাফ্রি একবার সকলের অলক্ষ্যে অরুণ বাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে নিলে, অরুণ বাবুও তাকিয়েছিল তার দিকে। দিষ্টি বিনিময় হতেই চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল সে আমি কখন কি করবো ভেবে না পেয়ে ছুটলাম, সরাইখানার দিকে।

আলমারীর আড়ালে দাঁড়ালো বনহুর, দাঁতে দাঁত পিষলো, কারণ কাফ্রির কপাট। সম্পূর্ণ মিথ্যা। সে ভালোভাবে লক্ষ্য করেছে—এ বাড়ী থেকে দুজন লোকটা ট্যাক্সিতে পালিয়েছে। এ ছাড়া অন্য কেউ এ বাড়ীর বাইরে যায়নি। কাফ্রি চাকরটা একেবারে মিথ্যা কথা বানিয়ে বললো।

পুলিশ ইন্সেপেক্টর বললেন–তুমি যখন সরাইখানায় গিয়ে পৌঁছলে, তখন সেখানে কি অরুণ বাবু ছিলেন?

না, ছিলেন না। আমি দিদিমণির হত্যাকান্ডের কথা মালিককে জানিয়ে বেরিয়ে আসছি, এমন সময় অরুণ বাবু সেখানে উপস্থিত হলেন।

ইন্সপেক্টর গম্ভীরভাবে একটু ভেবে নিয়ে সরাইখানার মালিককে লক্ষ্য করে বললেন–মিঃ শর্মা, আপনি কি জানেন আপনার কন্যার সঙ্গে আর কোনো ব্যক্তির বিশেষ ঘনিষ্ঠতা বা নিবিড় যোগাযোগ ছিলো?

বাসুদেব শর্মা ব্যথাকাতর কণ্ঠে বললেন–আমার কন্যা মালতীর তেমন কোনো বন্ধু-বান্ধব ছিলো না। সে সব সময় অরুণের সঙ্গেই ওঠা–বসা করতো।

আপনি খুব ভালভাবে চিন্তা করে বলুন আর কারও সঙ্গে তার মেলামেশা ছিলো কি না?

বেশ কিছুক্ষণ মৌন থেকে বললেন বাসুদেব ছিলো, সে হচ্ছে ধনবান মিঃ লুই এর পুত্র জন। জনকে এক সময় মালতী গভীরভাবে ভালবাসতো। জনও ভালোবাসতো মালতীকে। কিন্তু জন লন্ডনে চলে যাবার পর মালতী একমাত্র অরুণ ছাড়া আর কারও সঙ্গে তেমন ঘনিষ্ঠভাবে মিশতো না।

ইন্সপেক্টর বললেন-জন কি এখন লন্ডনেই অবস্থান করছে?

না, সে কিছুদিন হলো ফিরে এসেছে।

এখনও কি সে আপনার কন্যার সংগে পূর্বের ন্যায় মেলামেশা করতো?

না, লন্ডন থেকে ফিরে আসার পর সে মালতীর সঙ্গে দেখাই করতে আসেনি। মালতীই নাকি গিয়েছিলো তার সঙ্গে দেখা করতে। শুনেছি সে মালতীর সঙ্গে খুব ভাল ব্যবহার করেনি।

পুলিশ ইন্সপেক্টর মিঃ লাহিড়ী একটা শব্দ করলেন। তারপর বললেন-মালতী ফিরে এসে কিছু বলেছিলো আপনাকে?

হাঁ। বলেছিলো, জন নাকি কোন মেয়েকে বিয়ে করবে বলে কথা দিয়েছে। একটু থেমে বললেন বাসুদেব–মালতী জনকে গভীরভাবে ভালোবেসেছিলো। সেদিন ওর ওখান থেকে ফিরে গোটা রাত কেঁদে কেঁদে কাটিয়েছিলো মা আমার। একটু থেমে বললেন পুনরায়—জনের সুন্দর চেহারাই আমার মালতীর কাল হয়েছিলো ইন্সপেক্টর।

ইন্সপেক্টার একবার সকলের অলক্ষ্যে অরুণ বাবুর মুখমন্ডল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ্য করলেন। তারপর লাশ মর্গে পাঠানোর ব্যবস্থা করে তখনকার মত বিদায় গ্রহণ করলেন।

ইন্সপেক্টার সংগীদের নিয়ে চলে যেতেই অরুণ বাবু বলে উঠলো–একি, শটে গেলো কাকাবাবু?

সরাইখানার মালিক বাসুদেব তখনও কাঁদছিলেন। একমাত্র কন্যার মৃত্যু তার অন্তরে যেন শেলবিদ্ধ করেছে। বাববার তিনি রুমালে চোখ মুছছিলেন। অরুণ বাবুর কথায় তাকালেন তার দিকে, একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বললেন-সবই জানেন সেই সর্বজ্ঞ।

কাফ্রি চাকরটা তাকালো অরুণ বাবুর দিকে, তারপর বললো-এ ঘরে বেশীক্ষণ থাকতে মন আমার চাইছে না। কেমন যেন ভয় ভয় করছে।

অরুণ বাবু বলে উঠলো–চলুন কাকাবাবু, আমারও বড় অস্বস্তি লাগছে।

প্রৌঢ় ভদ্রলোক একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বললেন—চলো।

সবাই কক্ষ ত্যাগ করে বেরিয়ে গেলো।

অরুণ বাবু চলে যাবার সময় একবার কক্ষের চারদিকে লক্ষ্য করে দেখে নিলো, তারপর নিঃশব্দে অনুসরণ করলো সরাইখানার মালিক প্রৌঢ় ভদ্রলোককে।

সবাই কক্ষ ত্যাগ করতেই আলমারীর আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো বনহুর, চোখেমুখে তার একটা উন্মাদনা।

০৫.

কক্ষে অরুণ বাবু অস্থিরভাবে পায়চারী করছে। চোখে তার ঘুম নেই। দেয়ালঘড়িটা ঠক্ ঠক্ শব্দ করে আপন মনে নিজের গন্তব্য পথে এগিয়ে চলেছে।

অরুণ বাবুর ললাটে গভীর চিন্তার ছাপ ফুটে উঠেছে। চোখ দুটোতে কেমন জ্বালাময় চাহনি। মনের অস্থিরতা পরিলক্ষিত হচ্ছে তার মুখোভাবে। কি যেন ভাবছে, কখনও মাথার চুল ধরে টানছে, কখনও বা অধর, দংশন করছে।

এক সময় অরুণ বাবু ঘরের টেবিলের ড্রয়ার খুলে ফেললো, বের করলো সুতীক্ষ্ণ ধার একখানা ছোরা-তুলে ধরলো চোখের সামনে। তারপর অতি সতর্কতার সঙ্গে জামার আড়ালে ছোরাখানা লুকিয়ে ফেলে সোজা হয়ে দাঁড়ালো।

ঠিক সেই মুহূর্তে একটা ছায়ামূর্তি সরে গেলো জানালার একপাশে।

অরুণ বাবু চারদিক তাকিয়ে দেখে নিলো। তারপর দরজা খুলে বেরিয়ে এলো বাইরে। অন্ধকারে দ্রুত এগিয়ে চললো।

ছায়ামূর্তি ধীরে ধীরে অতি সংগোপনে অরুণ বাবুকে অনুসরণ করলো।

অরুণ বাবু টানা বারান্দা ধরে কিছুদূর এগিয়ে থমকে দাঁড়ালো তাকালো চারদিকে, তারপর অতি দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামতে লাগলো।

পেছনে অনতিদূরে আত্মগোপন করে এগিয়ে চলেছে একটি ছায়ামূর্তি।

অরুণ বাবু বাড়ীর সামনে বাগানটার মধ্যে এসে দাঁড়ালো পুনরায় সচকিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকালো পেছনে। এবার বাগানস্থ পুকুরঘাটে এসে দাঁড়িয়ে পড়লো অরুণ বাবু। ছোরাখানা দ্রুত জামার আড়াল থেকে বের করে নিয়ে যেখনি সে পুকুরের পানিতে নিক্ষেপ করতে যাবে অমনি পেছন থেকে ছায়ামূর্তি স্থপ করে চেপে ধরলো অরুণ বাবুর হাতখানা।

চমকে ফিরে তাকালো অরুণ বাবু, মুখমন্ডল তার বিবর্ণ ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে। অন্ধকার হলেও অরুণ বাবু চিনতে পারলে, অস্ফুট কণ্ঠে বললো–ইন্সপেক্টার!

গম্ভীর কণ্ঠে পুলিশ ইন্সপেক্টার মিঃ লাহিড়ী বললেন—হাঁ, আমি। এবার আপনার সব চেষ্টা ব্যর্থ হলো তো?

অরুণ বাবু থমমত খেয়ে বললো–আপনি বিশ্বাস করুন, আমি মালতীকে খুন করিনি।

মিঃ লাহিড়ী হুইসেলে ফু দিলেন, সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন পুলিশ এসে অরুণ বাবু আর ইন্সপেক্টারের সম্মুখে দাঁড়ালো।

মিঃ লাহিড়ী বললেন–বন্দী করো একে।

ইতিমধ্যে অরুণ বাবুর হাত থেকে ছোরাখানা মিঃ লাহিড়ী কেড়ে নিয়েছিলেন।

অরুণ বাবু হঠাৎ এভাবে বন্দী হবে ভাবতেও পারেনি। ভেবেছিলো সে ছোরাখানা পুকুরের পানিতে নিক্ষেপ করে নিজে নির্দোষ হবে। কিন্তু পুলিশ ইন্সপেক্টার মিঃ লাহিড়ী অতি চতুর ব্যক্তি, তিনি লাশ মর্গে পাঠানোর ব্যবস্থা করে নিজেও দলবল নিয়ে বিদায় গ্রহণ করলেন বটে, কিন্তু একেবারে চলে গেলেন না। সবার অলক্ষ্যে লুকিয়ে পুনরায় ফিরে এলেন এই বাড়ীখানাতে। গোপনে অনুসরণ করলেন সন্দিগ্ধ ব্যক্তিকে।

মিঃ লাহিড়ী যা ভেবেছিলেন তাই, অরুণ বাবুকেই তার প্রথম থেকে সন্দেহ হয়েছিলো।

পুলিশ ইন্সপেক্টার যখন অরুণ বাবুকে বন্দী করে নিয়ে চললেন, তখন হঠাৎ একটা হাসির শব্দ তাদের কানে এলো। মুহূর্তে ফিরে তাকালো সবাই, কিন্তু কোথা থেকে এই হাসির শব্দ ভেসে এলো কেউ বুঝতে পারলো না।

০৬.

পুলিশ অফিসে গত রাতের মালতী হত্যা রহস্য নিয়ে আলোচনা হচ্ছিলো। মিঃ লাহিড়ী, পুলিশ অফিসার মিঃ রায় ও থানা অফিসার মিঃ আলী ছিলেন সেখানে।

অরুণ বাবুই যে মিস মালতীর হত্যাকারী এ ব্যাপারে মিঃ লাহিড়ী একেবারে নিঃসন্দেহ হয়ে পড়েছেন। কারণ, তিনি স্বচক্ষে দেখেছিলেন, অরুণ বাবু রাতের অন্ধকারে পুকুরের পানিতে একখানা ছোরা নিক্ষেপ করতে যাচ্ছিলেন।

মিঃ লাহিড়ী এবং অন্যান্য পুলিশ অফিসার যখন এই হত্যা ব্যাপার নিয়ে আলোচনায় রত ঠিক সেই মুহূর্তে কক্ষে প্রবেশ করে এক যুবক। সুন্দর সুপুরুষ। শরীরে মূল্যবান পোশাক।

মিঃ লাহিড়ী এবং অন্যান্য পুলিশ অফিসার বিস্ময়ভরা চোখে তাকালেন যুবকের দিকে।

লাহিড়ী কিছু জিজ্ঞাসা করতে যাচ্ছিলেন কিন্তু তার পূর্বেই যুবক বলে উঠলো—আমি মিঃ লুই—এর পুত্র মিঃ জন।

মিঃ লাহিড়ী উঠে দাঁড়িয়ে সহাস্যে বললেন–আপনি মিঃ জন?

হাঁ, আমি মিস মালতীর হত্যা সংবাদ জানতে পেরে এসেছি।

বসুন মিঃ জন। লাহিড়ী মিঃ জনকে সাদরে অভ্যর্থনা জানালেন।

জন আসন গ্রহণ করলো।

মিঃ লাহিড়ী পুনরায় নিজ আসনে বসে সিগারেট কেসটা বের করে মেলে ধরলেন জনের সম্মুখে–গ্রহণ করুন।

জন মিঃ লাহিড়ীর সিগারেট কেস থেকে একটি সিগারেট তুলে নিয়ে বললো-ধন্যবাদ।

সিগারেটটা ঠোঁটের ফাঁকে চেপে ধরে অগ্নিসংযোগ করে ম্যাচের কাঠিটা বাড়িয়ে ধরলো জন মিঃ লাহিড়ীর দিকে।

মিঃ লাহিড়ী কথা শুরু-করবার আগেই বললো জন মিস মালতীর হত্যাকান্ড আপনার নিকট কেমন মনে হয়?

মিঃ লাহিড়ী কিছুক্ষণ জনের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন—মিঃ জন, আপনি যদি কিছু মনে না করেন আমি আপনাকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞাসা করবো?

নিশ্চয়ই করুন। একটু থেমে বললো জন–মিস মালতীর হত্যা আমাকে বিচলিত করেছে ইন্সপেক্টার।

শুনেছি আপনি নাকি তাকে ভালোবাসতেন।

হাঁ ইন্সপেক্টার, আমি তাকে গভীরভাবে ভালোবাসতাম। একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে গেলো জন।

মিঃ লাহিড়ী তাকিয়ে দেখলেন জনের মুখ ব্যথাকরুণ হয়ে উঠেছে। এবার বললেন তিনি আমার যতদূর বিশ্বাস আপনার প্রিয়াকে যে হত্যা করেছে তাকে আমরা গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছি।

ক্রুদ্ধ, হিংস্র হয়ে উঠলো জনের মুখমন্ডল, বললো—সত্যি বলছেন?

হাঁ মিঃ জন, সত্যি বলছি।

আশ্চর্য, আপনি এত সহজেই হত্যাকারীকে গ্রেপ্তারে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু যাকে আপনারা গ্রেপ্তার করেছেন সেকি সত্যিই হত্যাকারী—এ সম্বন্ধে

আপনি নিশ্চিত?

কতকটা তাই।

কিভাবে আপনি তাকে হত্যাকারী বলে নিশ্চিত হলেন?

কোথায় মিঃ লাহিড়ী জনকে প্রশ্ন করবেন তা নয়, জনই মিঃ লাহিড়ীকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে চললেন।

মিঃ লাহিড়ী জনের বুদ্ধিদীপ্ত কণ্ঠস্বরে এবং তার মধুময় ব্যবহার ও কথাবার্তায় মুগ্ধ হলো অতি স্বাচ্ছন্দে জনের প্রশ্নের জবাব দিয়ে চললেন। বললেন মিঃ লাহিড়ী–আমরা যাকে গ্রেপ্তার করেছি তাকে আপনি নিশ্চয়ই জানেন, তার নাম অরুণ বাবু!

হাঁ তাকে আমি জানি, যদিও তাকে দেখিনি কোনোদিন কিন্তু তার নাম আমি মিস মালতীর মুখে অনেকবার শুনেছি। আচ্ছা, এবার বলুন মিঃ লাহিড়ী, তাকে সন্দেহ করার কি কারণ থাকতে পারে?

মিঃ লাহিড়ী এবার বললেন—প্রথম কারণ, অরুণ ও মিস মালতী উভয়ে একই বাড়ীতে বাস করতো। দ্বিতীয় কারণ, যেদিন মিস মালতী নিহত হয় সেদিন অরুণ বাসায় বা সরাইখানায় ছিলো না। তৃতীয় কারণ, অরুণ বাবু হত্যারাত্রে গোপনে একখানা ছোরা লুকিয়ে পুকুরের পানিতে নিক্ষেপ করতে যাচ্ছিলো এবং সেই মুহূর্তে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

আচ্ছা ইন্সপেক্টার, আপনার কি মনে হয় মিঃ অরুণ যে ছোরাখানা পুকুরের পানিতে নিক্ষেপ করতে যাচ্ছিলেন সেই ছোরা দিয়েই মিস মালতীকে হত্যা করা হয়েছে?

না, তেমন কোন প্রমাণ এখনও আমরা সংগ্রহ করতে পারিনি, তবে সেই ছোরাখানা দিয়েই যে মিস মালতীকে খুন করা হয়েছে এটা সঠিক। নাহলে অরুণ বাবু রাতের অন্ধকারে আত্মগোপন করে ছোরাখানা পুকুরের পানিতে নিক্ষেপ করতে যেতো না।

এর অন্য কোনো কারণও তো থাকতে পারে।

সে অবশ্য ঠিক কিন্তু যতদূর সম্ভব সে-ই খুনী।

ইন্সপেক্টার, আপনারা যদি সম্মত হন তবে এই মালতী হত্যা রহস্য উদ্ঘাটনে আমি আপনাদের সহায়তা করতে পারি।

আনন্দভরা কণ্ঠে মিঃ লাহিড়ী বললেন–নিশ্চয়ই। এটা তো খুশীর কথা। তাছাড়া মালতীর বাবা বাসুদে বাবু শুনলে তিনিও আনন্দিত হবেন।

সত্যি ইন্সপেক্টার, মালতীর হত্যা আমাকে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন ও উত্তেজিত করে তুলেছে। জন কথার ফাঁকে দাঁতে দাঁত পিষলো। একটু থেমে পুনরায় বললো—মালতীর পোষ্টমর্টেমের রিপোর্টখানা আমাকে অনুগ্রহ করে দেখাবেন?

নিশ্চয়ই। মিঃ জন, আপনার মত একজন মহান ব্যক্তিকে আমরা সঙ্গী হিসেবে পেলে উপকৃত হবো। আপনি আমাদের সহায়তায় এগিয়ে আসছেন, আমরা ও পুলিশ বাহিনী এ ব্যাপারে আপনাকে যথাসাধ্য সহযোগিতা করবো।

ধন্যবাদ ইন্সপেক্টার। কথাটা বলে জন উঠে দাঁড়ালো। আবার দেখা হবে। গুডবাই।

ইন্সপেক্টার এবং অন্যান্য পুলিশ অফিসার উঠে তাকে বিদায় সম্ভাষণ, জানালেন।

জন বেরিয়ে গেলো।

আসন গ্রহণ করে বললেন মিঃ লাহিড়ী-ধনবান লুই-এর পুত্র জন এতদিন লন্ডনে ছিলেন, সবে ফিরে এসেছেন। কিন্তু কি আশ্চর্য, উনারও পরিচয় ছিলো বাসুদেবের মেয়ে মালতীর সঙ্গে।

মিঃ রায় বললেন মিস মালতীর সঙ্গে শহরের প্রায় ধনবান ব্যক্তিরই পরিচয় ছিলো, অবশ্য এটা তার বাবা বাসুদেবেরই সহযোগিতায় হয়েছে।

মিঃ লাহিড়ী বললেন–এতোবড় একটা সরাইখানার মালিক হয়ে বাসুদেব শর্মা নিজ কন্যাকে অর্থের লোভে ব্যভিচারে লিপ্ত করেছিলো। সুন্দরী যুবতীর লোভে পুরুষ পতঙ্গের দল ছুটে আসতো তার সরাইখানায়।

মৃত মালতীর মৃত্যু রহস্য নিয়ে পুনরায় মিঃ লাহিড়ী তাঁর সঙ্গীদের সঙ্গে আলোচনায় লিপ্ত হলেন।

০৭.

একদিন দ্বিপ্রহরে কুটিরের মধ্যে ঘুমিয়ে আছে নূরী, মনিও ঘুমিয়ে ছিলো পাশে। হঠাৎ মনির ঘুম ভেঙ্গে গেলো। খেজুর পাতার শয্যায় উঠে বসলো মনি, তাকালো নূরীর ঘুমন্ত মুখের দিকে। দেখলো মাম্মি ঘুমাচ্ছে।

দুষ্ট মনি নিঃশব্দে বেরিয়ে এলো বাইরে। পা পা করে এগিয়ে চললো সামনের দিকে। কুটিরের মধ্যে নূরী ঘুমিয়ে আছে, কেউ তাকে বাধা দেবার নেই। ছোট্ট মনি আপন মনে চলতে লাগলো।

মনি সোজা বনের পশ্চিম দিকে এগুচ্ছে। বয়স তার বেশী নয়-মাত্র তিন বছরে পা দিয়েছে মনি, বুদ্ধি বলতে কিছুই তেমন হয়নি। কিছুদূর এগুনোর পর মনি দেখলো, তার সামনে সুন্দর একটা ফুলের বাগান, নানা রকম ফুল ফুটে রয়েছে সেখানে। মনি আলগোছে প্রবেশ করলো বাগানের মধ্যে। একটা সুন্দর ফুল দেখে মনি যেমনি ফুলটা ছিঁড়ে ফেললো, অমনি একটি ধুম্ররাশি আচ্ছন্ন করে ফেললো গোটা বাগানটাকে। মনির হাত থেকে ফুটা খসে পড়লো, কেঁদে উঠলো মনি। কে একজন নারী মূর্তি তখন মনিকে কোলে তুলে নিয়েছে।

সন্ন্যাসীর আহ্বানে ঘুম ভেঙ্গে গেলো নূরীর। সচকিতভাবে উঠে পাশে তাকাতেই অস্ফুট ধ্বনি করে উঠলো—মনি কোথায়?

সন্ন্যাসীর কণ্ঠস্বর ভেসে এলো-বৎস, মনি মায়াজালে আবদ্ধ হয়েছে।

নূরী উম্মাদিনীর ন্যায় ছুটে চললো সন্ন্যাসী বাবাজীর নিকটে। আছাড় খেয়ে পড়লো তার পায়ের কাছে—বাবাজী এখন উপায়?

 কোনো উপায় নেই আর মনিকে উদ্ধারের—কারণ, সে এখন মায়ারাণীর মায়াজালে আবদ্ধ হয়েছে।

নূরী আকুলভাবে কেঁদে উঠলো—তাকে আর ফিরে পাবো না তাহলে গুরুদেব?

বৎস, আমি পূর্বেই বলেছিলাম,এ বনের সর্বত্র আমার আধিপত্য রয়েছে শুধু পশ্চিম দিকে ছাড়া, ঐ দিকে আমার কোনো বল খাটবে না।

নূরী ব্যাকুল কণ্ঠে বললো—কিন্তু মনিকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারবো। বলুন গুরুদেব, আমি কি করে তাকে ফিরে পেতে পারি?

সন্ন্যাসী বাবাজী এবার বলে উঠলেন—পশ্চিম ছাড়া তোমার মনি যেখানেই যেতো, সে কেমন আছে কি করছে সব তোমাকে বলতে পারতাম বৎস, এখন আমি অক্ষম।

তবে আমিও ঐ পশ্চিমে যাবো, দেখবো আমার মনি কোথায়, কেমন আছে?

সর্বনাশ! ওদিকে তুমি যেও না, গেলে আর কোনোদিন ফিরে আসতে পারবে না।

০৮.

সন্ন্যাসী বাবাজী যতই নিষেধ করুন, নূরী মনির জন্য অত্যন্ত অধীর হয়ে পড়লো। সর্বক্ষণ চোখের পানিতে বুক ভাসিয়ে চললো। একদিন নির্জন . প্রভাতে নূরী বনের পশ্চিম দিক লক্ষ্য করে রওনা দিলো–মরতে হয় সেও মরবে, তবু মনির সন্ধান নেবে সে।

ঘন বনের অন্তরালে নূরী এগিয়ে চললো। সে জানে, ওখানে গেলে আর কোনোদিন ফিরে আসতে পারবে না, এই তার জীবনের শেষ অধ্যায়—তবু নূরী নির্ভীকভাবে এগুচ্ছে।

পেছন থেকে ভেসে এলো সন্ন্যাসী বাবাজীর কণ্ঠস্বর—যেও না, যেও না, বিপদ রয়েছে।

নূরী দুহাতে কান চেপে ধরলো, তারপর দ্রুত পা চালালো।

কিছুদুর এগুতেই সামনে তাকিয়ে দেখলো নূরী সুন্দর একটি বাগান, ফুলে ফুলে ভরে রয়েছে বাগানটা। নূরী মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রইলো বাগানটার দিকে, ক্ষণিকের জন্য ভুলে গেলো নূরী মনির কথা।

নিজের অজ্ঞাতেই নূরী প্রবেশ করলো বাগানে। সামনে একটি সুন্দর ফুল গাছ দেখে একটি ফুল ছিঁড়ে ফেললো হঠাৎ সে। সঙ্গে সঙ্গে একরাশ ধূয়া আচ্ছন্ন করে ফেললো নূরীর চারদিকে। নূরী চীৎকার করে উঠলো-একি হলো একি হলো! মুহূর্তে অনুভব করলো সে তার হাত দুখানা লৌহশিকলে আবদ্ধ করা হয়েছে।

প্রাণপণ চেষ্টা করেও নূরী হাত দুখানাকে মুক্ত করে নিতে সক্ষম হলো মী।

তারপর একসময় নূরী দেখলো, তার চারদিকের ধূম্ররাশি ক্রমান্বয়ে মিশে আসছে। এবার পরিষ্কার দেখতে পেলো—যেখানে সে দাঁড়িয়েছিলো সেখানে কোন বাগান নেই, একটা অন্ধকার কক্ষে সে বন্দিনী। হাত-পা শৃঙ্খলাবদ্ধ! আকুল কণ্ঠে চীৎকার করতে গেলো কিন্তু একটু শব্দও তার মুখ দিয়ে বের হলো না। নূরী এবার বুঝতে পারলো, সন্ন্যাসী বাবাজীর কথা মিথ্যে নয়, সে মায়ারাণীর মায়াজালে আবদ্ধ হয়েছে। কি করবে নূরী। একে মনির জন্য মন তার আকুল, তারপর নিজের অবস্থাও মহাসঙ্কটময়। মনিকে উদ্ধার করতে এসে সেও বন্দিনী হলো। চারদিকে তাকালো নূরী-নিঃশ্বাস যেন তার বন্ধ হয়ে আসছে-কিন্তু কোথায় মনি।

নুরী যখন মনির জন্য এবং নিজের অবস্থা ভেবে আকুল হয়ে কাঁদছে, ঠিক সেই মুহূর্তে দেখলো একটি নারীমূর্তি তার সামনে এসে দাঁড়ালো, সাদা ধবধবে পরিচ্ছদে দেহ তার আবৃত –মাথায় মুকুটহাতে একটা পণ্ডের মত কিছু রয়েছে। চোখ দুটো কাজল টানা, জ দুটি ধনুকের মত বাঁকা–অদ্ভূত দেখতে নারীমূর্তিটা।

নূরীর সামনে দাঁড়িয়ে নারীমূর্তি বললো—কেঁদে আর কোনো লাভ হবে না, আর কোনোদিন তুমি মায়ারাজ্য থেকে বাইরে যেতে পারবে না। অট্টহাসি হেসে উঠলো নারীমূর্তি-হাঃ হাঃ হাঃ–_ নুরী শিউরে উঠলো, করুণ চোখে তাকালো নারীমূর্তির দিকে, তারপর মিনতির সুরে বললো–আমার মনি কোথায়? আমার মনি?

আবার হেসে উঠলো নারীমূর্তি অদ্ভুতভাবে তোমার মনি…হাঃ হাঃ হাঃ, তোমার মনিকেও আর কোনোদিন ফিরে পাবে না।

কি বললে, মনিকে আর কোনোদিন ফিরে পাবো না?

না না। জানো এ কোন্ রাজ্যে তুমি এসেছো?

জানি মায়ারাণী, আমি এখন তোমার মায়ারাজ্যে এসেছি।

হাঁ, তুমি আমার বন্দিনী।

আমার অপরাধ?

আমার মায়ারাজ্যে যে প্রবেশ করবে তাকেই আমার বন্দী হতে হবে।

বলো আমার মনি কোথায়?

সেও বন্দী।

পিশাচী, এতটুকু শিশুকে তুমি বন্দী করেছো?

আমার কাছে শিশু বা যুবক-বৃদ্ধ বলে কিছু নেই—আমার ঐ মায়া–বাগানে যে প্রবেশ করবে, সে-ই আবদ্ধ হবে আমার মায়াজালে! শুধু তুমি নও, তোমার মত শত শত নর-নারী যুবক-বৃদ্ধ-শিশু আমার মায়াজালে আবদ্ধ হয়ে মায়ারাজ্যে বন্দী হয়ে রয়েছে। এখানে কারও সাধ্য নেই কাউকে মুক্ত করে নিয়ে যায়।

নূরী অবাক হয়ে মায়ারাণীর কথাগুলো শুনে যাচ্ছিলো। এসব কি শুনছে সে। পৃথিবীতে কি এমন জিনিস আছে যা যাদুবিদ্যা বা মায়াজালে মানুষকে এভাবে আচ্ছন্ন করতে পারে! এমন তো সে কোনোদিন শোনেনি বা দেখেনি। একি অদ্ভুত ব্যাপার সে দেখছে? শুধু দেখছে নয়, মন-প্রাণে উপলদ্ধি করছে। নূরী ভাবে, কি করে এই মায়ারাণীর মায়াজাল থেকে মুক্তি পাবে।

নূরী যখন আপন চিন্তায় বিভোর তখন হঠাৎ মায়ারাণী ধীরে ধীরে হাওয়ায় মিশে গেলো। বিস্ময়স্তব্ধ চোখে তাকিয়ে রইলো নূরী-মায়ারাণী যে স্থানটিতে অদৃশ্য হলো সেইদিকে।

হঠাৎ নূরীর কানে ভেসে এলো মনির কান্নার শব্দ। উচ্ছ্বসিতভাবে কাঁদছে মনি, কেউ যেন ওকে মারছে বা কোনো রকম কষ্ট দিচ্ছে।

নূরী ক্ষিপ্তের ন্যায় ছুটে গেলো সেইদিকে, যেদিক থেকে ভেসে এসেছিলো কান্নার শব্দটা, কিন্তু একি! শব্দটা ঠিক কোন্ দিক থেকে আসছে বোঝা যাচ্ছে না। নূরী থমকে দাঁড়ালো, সামনে সুউচ্চ একটা প্রাচীর তার পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে আছে। মনির কান্না যেন ঐ প্রাচীরটার ওপাশ থেকেই আসছে বলে মনে হচ্ছে তার। নূরী অনেক চেষ্টা করেও প্রাচীর পার হতে পারলো না। নূরী যতই দেখছে ততই আশ্চার্য হচ্ছে মায়াজাল সে কোনোদিন বিশ্বাস করতো না, আজ বিশ্বাস না করে পারলো না। পৃথিবীতে যাদু বা মায়াজালও রয়েছে। কে এই মায়ারাণী যার যাদুবলে এত সব হতে পারে। নূরীও কম মেয়ে নয়, সে দেখে নেবে মায়ারাণীর মায়াজাল ছিন্ন করতে পারে কিনা।

ততক্ষণে মনির কান্নার শব্দ থেমে গেছে। কেমন যেন একটা গম্ভীর নীল রশ্নি তার চারদিকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। কোথায় সেই কক্ষ, নূরী দেখলো এবার একটা গোলাকার প্রাচীর ঘেরা জায়গায় সে নিজে দাঁড়িয়ে আছে।

মায়ারাণীর মায়াজালে বন্দিনী নূরী।

পৃথিবীর সঙ্গে তার কোনো সম্বন্ধই নেই, কোথায় এসেছে, কোথায় আছে, সে নিজেই বুঝতে পারছে না। সব সময় নূরী অনুভব করে তার চারপাশে কোন অশরীরী আত্মার দীর্ঘশ্বাস। কেউ যেন অতি লঘু পদক্ষেপে তার চারদিকে হেঁটে বেড়ায়। কখনও কখনও নূরী তার আশেপাশে অনতিদূরে শুনতে পায় ফিস ফিস কণ্ঠস্বর। ভয়ে নূরী পালাতে চায়, কিন্তু কোথায় পালাবে। যে দিকে যায় সেইদিকেই সে দেখতে পায় সুউচ্চ প্রাচীর তার পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে আছে। এক পাও এগুতে পারে না নূরী, বসে পড়ে মাথায় হাত দিয়ে। সব যেন কেমন এলোমেলো হয়ে গেছে, সে জীবিত আছে কিনা, তাই সন্দেহ জাগে তার মনে।

০৯.

মিঃ লুই এর তিনতলা বাড়ী।

শহরের সেরা ধনবান ব্যক্তি মিঃ লুই। সংসারে তার একমাত্র সন্তান জন খাড়া আর কেউ নেই। মিঃ লুই গত কয়েক মাস হলো ব্যবসার ব্যাপারে জার্মানে অবস্থান করছেন, বাড়ীতে রয়েছে শুধু জন ও দুজন কর্মচারী।

জন একটু আলাদা ধরনের যুবক, সব সময় একা নির্জনে থাকতে ভালোবাসে। সংসারের যত কাজকর্ম বা অন্যসব তত্ত্বাবধান করে তার কর্মচারী দুজন। নির্জন কক্ষে জন সিগারেটের পর সিগারেট নিঃশেষ করে চলে, আর মোটা মোটা, বই পড়ে। লন্ডন থেকে ফিরে আসার পর সে বাইরে বের হওয়া এক রকম প্রায় ছেড়েই দিয়েছে। মনের মত কাউকে পায় না। তাই সে নিজেকে ডুবিয়ে রাখে নানা রকম বই-পুস্তকের মধ্যে। মাঝে মাঝে বাসুদেবের সরাইখানায় দেখা যেতো মিঃ জনকে, গভীর রাতে যখন সরাইখানার লোকজন বিদায় গ্রহণ করতো তখন মিঃ জনের নতুন ঝকঝকে নীল রঙের বিরাট গাড়ী এসে দাঁড়াতো বাসুদেবের সরাইখানার সামনে। পর পর দুটো হর্নের আওয়াজ হতো—অমনি ছুটে বেরিয়ে আসতো মালতী, সুমিষ্ট কণ্ঠে ধ্বনি করে উঠতো—হ্যালো জন, এসে গেছে?

জন নেমে আসতো গাড়ী থেকে, উভয়ে হাত ধরে এগিয়ে যেতে সরাইখানার একটি নির্দিষ্ট কক্ষে, তারপর চলতো নাচ-গান, হাসি-গল্প। মালতীর কাছে জন একেবারে যেন পালটে যেতো, কোথায় চলে যেতো তার গুরুগম্ভীর ভাব।

এবার জন লন্ডন থেকে ফিরে আসার পর বাসুদেবের সরাইখানায় একটি দিনের জন্যও যায়নি বা মালতীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেনি। মালতী জনের লন্ডন থেকে ফিরে আসার সংবাদ পেয়ে নিজেই গিয়ে দেখা করে এসেছিলো তার সঙ্গে!

সেই মালতীর আকস্মিক মৃত্যু জনকে বিচলিত করবে তাতে অবান্তর কি আছে?

আজও গভীর রাতে জন মালতীর মৃত্যু-রহস্য নিয়েই গভীরভাবে চিন্তা করছিলো। সিগারেটের পর সিগারেট নিঃশেষ করে চলেছে সে।

হঠাৎ একটা শব্দ শোনা গেলো তার জানালার শার্শীর পাশে। খুট করে একটা শব্দ। চমকে উঠলো জন, হাতের সিগারেটটা, এ্যাসট্রের ওপর রেখে উঠে দাঁড়ালো, নিঃশব্দে এগিয়ে চললো জানালার দিকে। স্পষ্ট দেখলো—

একটা আবছা কালো মূর্তি দ্রুত সরে গেলো জানালার পাশ থেকে।

জন কুঞ্চিত করে কিছু ভাবলো, পুনরায় ফিরে এলো নিজের আসনে, সুন্দর ললাটে ফুটে উঠলো গভীর চিন্তারেখা।

ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে চললো। জনের চোখে ঘুম নেই। প্রতিহিংসার একটা তীব্র জ্বালা তার অন্তরে দাহ সৃষ্টি করে চলেছে। মালতীর হত্যাকারী কে, তাকে খুঁজে বের করতেই হবে…।

পায়চারী করছে জন, মালতীকে সে ভালবাসতো ঠিকই। সরাইখানার নর্তকী বলে ঘৃণাও করতো সে মনে মনে–তাই বলে তার হত্যা চিন্তা করতে পারে না সে কোনো সময়! জন এবারে ড্রয়ার খুলে ফেললো–দ্রুতহস্তে কাগজপত্র বের করে কি যেন খুঁজতে লাগলো, পর পর কয়েকটা ড্রয়ার খুলে হঠাৎ একটা ডায়রী তুলে নিলো হাতে। মুহূর্তে জনের চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।

ডায়রী খানা নিয়ে ফিরে এলো জন নিজের শয্যায়। টেবিল ল্যাম্পের সলতে বাড়িয়ে দিয়ে ডায়রী খানা মেলে ধরলো চোখের সামনে।

পরদিন জন একটা টেলিগ্রাম পেলো, তার ভাবী পত্নী মিস এ্যানি আসছে, সন্ধ্যায় এরোড্রামে তাকে রিসিভ করে আনতে যেতে হবে।

টেলিগ্রাম পাবার পর জনের সুন্দর মুখমন্ডল গম্ভীর হয়ে উঠলো। দাঁতে অধর দংশন করে কি যেন ভাবতে লাগলো সে। তারপর একসময় ড্রইংরুমে প্রবেশ করে দরজা বন্ধ করে দিলো। দেয়ালে টাঙ্গানো তার নিজের ছবিখানার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো, নির্বাক নয়নে তাকিয়ে রইলো ছবিখানার দিকে।

সন্ধ্যায় এ্যানিকে আনবার জন্য গাড়ী নিয়ে এরোড্রামে হাজির হলো জন।

কতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে, হঠাৎ একটা মেয়েলী কণ্ঠস্বর-হ্যালো জন, তুমি এখানে?

জন একটু থতমত খেয়ে বললোহা, আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করছি।

ততক্ষণে যুবতীটি জনের পাশে এসে তার কণ্ঠ বেষ্টন করে ধরেছে–ভালো আছো তো?

জন একটু হেসে বললো—আছি। তুমি?

আমিও ভাল। চলো।

গাড়ীতে উঠে বসলো ওরা দুজন।

জন নিজে ড্রাইভ করে চললো। এ্যানি বসলো তার পাশে।

জনের মুখ গম্ভীর, আপন মনে ড্রাইভ করছে সে।

মিস এ্যানি জনের কাঁধে মাথা রেখে আবেগভরা কণ্ঠে বললো–জন, এ দুবছরে তুমি যেন কেমন হয়ে গেছো?

সামনে দৃষ্টি রেখে বললো জন–কেমন হয়ে গেছি এ্যানি?

ঠিক যেমন ছিলে তার উল্টো।

মানে?

এরোড্রামে আমাকে দেখেও তুমি যেন চিনতেই পারছিলে না, আমি কথা বললাম তবে তুমি জবাব দিলে।

এ্যানি, আমি আজকাল চোখে একটু কম দেখি কিনা। তা ছাড়া চোখে কালো চশমা ছিলো, সন্ধ্যার ঝাপসা অন্ধকারে তোমাকে স্পষ্ট দেখতেই পাইনি।

চোখে কম দেখো! কোনো অসুখ বিসুখ হয়েছিলো নাকি তোমার?

হাঁ, মাঝখানে অসুখে অনেক ভুগেছি।

এখন কেমন দেখো?

বললাম তো কিছুটা কম, সেই কারণেই কালো চশমা পরি।

বড় দুঃখ হচ্ছে তোমার জন্য জন।

কিন্তু কি উপায় আছে বলো!

জন, তোমার স্বরও যেন কেমন পালটে গেছে, নতুন লাগছে তোমাকে।

অনেক দিন পর কিনা!

জন, সত্যি এ দুবছর আমি তোমাকে ছেড়ে কিভাবে যে কাটিয়েছি, শুধু আমিই জানি। সেই যে তুমি আমাকে ছেড়ে চলে এলে মনে পড়ে সেদিনের কথা?

পড়ে।

সত্যে তোমার চিঠি পেয়ে আমি সেই দিনটির প্রতীক্ষায় প্রহর গুণছিলাম। এবার দেখবো তোমার কথা কতখানি সত্য হয়।

আচ্ছা।

নাঃ আজ তুমি বড় স্বল্পভাষী হয়ে গেছো জন।

মিস এ্যানি…

মিস মিসকই তুমি তো এর আগে মিস বলে ডাকোনি কোনোদিন!

হাসলো মিঃ জন—মিস বলতে আমার ভাল লাগছে তাই।

মিঃ লুইয়ের বাড়ীর গেটে গাড়ী এসে থামলো।

দারোয়ান এসে গাড়ীর দরজা খুলে ধরলো, নেমে দাঁড়ালো এ্যানি, ততক্ষণে জনও নেমে দাঁড়িয়েছে।

এ্যানি সহ জন অন্তঃপুরে প্রবেশ করলো।

ঠিক সেই মুহূর্তে একটা খামের আড়ালে সরে দাঁড়ালো একটি ছায়ামূর্তি।

 এ্যানিকে তার বিশ্রামকক্ষে পৌঁছে দিয়ে জন, নিজের কক্ষে প্রবেশ করলো। হঠাৎ তার দৃষ্টি চলে গেলো পাশের দেয়ালে, থামের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ছায়ামূর্তির ছায়া এসে পড়েছে সেই দেয়ালে। জনের মুখে ফুটে উঠলো একটা হাসির রেখা! নিজের কক্ষে প্রবেশ করে শয্যায় গা এলিয়ে দিলো সে।

অল্পক্ষণ পর বয় এসে জানালোস্যার, একজন ভদ্রলোক আপনার সাথে সাক্ষাৎ করতে চান।

মিঃ জন উঠে পড়লো–চলো।

হলঘরে প্রবেশ করতেই মিঃ লাহিড়ীকে দেখতে পেলো জন। মনে মনে বিস্মিত হলেও মুখোভাব প্রসন্ন রেখে বললো–হঠাৎ আপনি?

দেখা করতে এলাম।

বসুন ইন্সপেক্টার।

মিঃ লাহিড়ী আসন গ্রহণ করলেন।

জনও আসন গ্রহণ করে বললোমিস মালতীর হত্যা রহস্যের কিছু উদ্ঘাটন করতে পেরেছেন কি?

এখনও কোন নতুন ক্লু আবিষ্কার হয়নি। আমি ঐ কারণেই আপনার নিকটে এলাম মিঃ জন।

বলুন?

আপনি বলেছিলেন, মালতী হত্যারহস্য উদ্ঘাটনে আপনি আমাদের যথাসাধ্য সহায়তা করবেন।

হাঁ ইন্সপেক্টার, আমি করবো।

আপনি সেই যে চলে এলেন, এ কদিনের মধ্যে আর একটি বারও আমার সঙ্গে দেখা করলেন না। একটু বাঁকা হাসি হাসলেন মিঃ লাহিড়ী।

জন গম্ভীর কণ্ঠে বললো—আপনার ওখানে না গেলেও আপনার সাক্ষালাভ আমার প্রায়ই ঘটেছে ইন্সপেক্টার আমরা উভয়ে উভয়কে দেখলেও কোনো আলাপ-আলোচনা হয়নি এই যা।

তার মানে?

মানে আপনি আমাকে দেখেছেন, আমি আপনাকে দেখেছি।

আপনার হেঁয়ালি ভরা কথা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না মিঃ জন?

গভীরভাবে চিন্তা করতে পারবেন। যাক, শুনুন ইন্সপেক্টার, আমি আপনার অফিসে গিয়ে দেখা না করলেও মালতী হত্যারহস্য উদঘাটনে অত্যন্ত আগ্রহশীল রয়েছি। একদিন মালতীকে সত্যি আমি গভীরভাবে ভালোবাসতাম….এবং সেই কারণেই আমি মালতীর হত্যাকারীকে আবিষ্কার করতে চাই।

এমন সময় এ্যানি সেই কক্ষে প্রবেশ করলো। হাতমুখ ধুয়ে নতুন ড্রেসে সজ্জিত হয়েছে এ্যানি, শুভ্র মোলায়েম পোশাকে তাকে খুব সুন্দর লাগছিলো।

এ্যানি ঘরে প্রবেশ করতেই মিঃ লাহিড়ী বিস্ময়ভরা চোখে তাকালেন তার দিকে।

জন একটু হেসে বললো-ইনি আমার ভাবী পত্নী মিস এ্যানি।

মিঃ লাহিড়ী একটু হাসবার চেষ্টা করলেন।

জন এবার এ্যানির নিকটে মিঃ লাহিড়ীর পরিচয় দিলো আর ইনি আমাদের পুলিশ ইন্সপেক্টার মিঃ লাহিড়ী। মিঃ বাসুদেব শর্মার কন্যা মিস মালতীর হত্যারহস্য উদ্ঘাটন করার ব্যাপারে উনি আমার নিকটে এসেছেন।

এ্যানি অবাক হলো কথাটা শুনে, প্রশ্নভরা চোখে তাকালো জনের দিকে।

জন বললো-সব তোমাকে বলবো এ্যানি, কেমন?

আচ্ছা।

এখন তুমি ভেতরে যাও এ্যানি, ওনার সঙ্গে কথা শেষ করে আসছি।

মিঃ লাহিড়ী হেসে বললেন আপনি যেতে পারেন মিঃ জন, আজ আমার কথা শেষ হয়েছে।

ধন্যবাদ।

মিঃ লাহিড়ী উঠে দাঁড়ালেন, জন তাকে বিদায় সম্ভাষণ জানালো।

মিঃ লাহিড়ী বিদায় হতেই এ্যানি জনের পাশে ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ালো, জ্ব কুঞ্চিত করে বললো—মিস মালতীর হত্যারহস্য উদঘাটনে তোমার নিকটে তার কি দরকার জানতে পারি কি?

নিশ্চয়ই পারো এ্যানি। চলো বলছি সব।

চলো।

মিঃ জন আর এ্যানি গিয়ে বসলো পাশাপাশি দুটি সোফায়। এ্যানি প্রশ্ন করলোবলো মিস মালতী কে?

মালতী! মালতী আমার এক পরিচিত যুবতী।

বাঁকা চোখে তীব্রকণ্ঠে বললো এ্যানি—শুধু কি পরিচিত না অন্য কোনো সম্বন্ধ ছিলো তোমার সঙ্গে তার?

এ্যানি!

তুমি তাহলে কেন বললানি এতদিন তার কথা?

এমন সামান্য কথাও তোমাকে বলতে হবে এটা আমার ধারণার বাইরে।

জন, তোমার ব্যবহার তো এমন ছিলো না। তোমার কথাবার্তা আমার কাছে বড্ড নীরস বলে মনে হচ্ছে। আমি জানি, তুমি আমাকে ছাড়া এ পৃথিবীর কাউকে ভালবাসতে পারো না।

হাঁ এ্যানি। চলো রাত অনেক হলো—শোবে চলো।

এ্যানি জনের হাত ধরে উঠে দাঁড়ালো–চলো ডার্লিং।

জন এগুলো, এ্যানির হাতের মুঠোয় তার হাতখানা।

জনের হাত ধরে কক্ষে প্রবেশ করলো এ্যানি। শয্যায় নিজের দেহটা এলিয়ে দিয়ে বললেন, তুমি শোবে না?

আমার কাজ আছে এ্যানি, তুমি ঘুমোও।

ডার্লিং, তুমি কেমন যেন হয়েগেছ। শয্যায় উঠে বসলো এ্যানি।

জন তখন দরজার দিকে পা বাড়িয়েছে।

এ্যানি জনের দক্ষিণ হাত চেপে ধরলো–চলে যাচ্ছো?

হাঁ।

জন, তোমার কি হয়েছে বলো তো? এসো, অনেক কথা আছে তোমার সঙ্গে। এ্যানি জনের হাত ধরে টেনে এনে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে নিজে বসে পড়লো তার পাশে ঘনিষ্ঠ হয়ে। তারপর বঙ্কিল গ্রীবা দুলিয়ে বললোকি বলেছিলে মনে নেই তোমার?

জন চোখের কালো চশমাটা ঠিক করে নিয়ে বলে—এদিকে নানা ঝামেলায় সব ভুলে গেছি এ্যানি। তুমি আমাকে ক্ষমা করো।

অভিমানে এ্যানির মুখমন্ডল আরক্ত হয়ে আসে। রাগত কণ্ঠে বলে ওঠে—তুমি কি মানুষ। জন, আমি ভেবেছিলাম সত্যি তুমি আমাকে ভালবাসো——কিন্তু সব তোমার ছলনা—সব মিথ্যা, ভুয়ো।

এ্যানি!

না, আজই আমি চলে যাবো এখান থেকে।

এ্যানি শান্ত হও।

না না, আমি তোমার কোন কথাই শুনতে চাইনে। কি ভয়ঙ্কর লোক তুমি। দাও ফিরিয়ে দাও তুমি আমার সেই জিনিসটা।

জন নির্বাক হয়ে বসে থাকে, এ্যানি কথায় সে কোনো জবাব দেয় না।

এ্যানি ক্ষিপ্তের ন্যায় চীৎকার করে উঠলো এবার আমি সব বুঝতে পেরেছি, তুমি সেই মালতীকে ভালবেসেছিলে!

এ্যানি যদি তাই মনে করো, তবে সত্যি তাই।

কি বললে, জানো আমার সঙ্গে তোমার কি সম্বন্ধ?

জানি! বিয়ে করবো কথা দিয়েছিলাম যদি না করি?

জন! চীৎকার করে ওঠে এ্যানি–দাও, আমার জিনিসটা তবে ফিরিয়ে দাও তুমি।

দেবো।

এখনিই দাও, আমি চলে যাবো তোমার এখান থেকে।

জন ধীরে ধীরে নমনীয় হয়ে এলো, নরম গলায় বললো—এ্যানি, তুমি একি ছেলেমানুষি করছো! যেখানে আমাদের বিয়ের কথা পাকা হয়ে গেছে।

না, আমি তোমার কোনো কথা শুনবো না। তুমি আমার জিনিস ফেরত দাও। . এ্যানি, তুমি বিশ্বাস করো আমি তোমাকে ছাড়া কাউকে ভালোবাসিনি, বাসতে পারিনা। এ্যানি, তুমি আমাকে মাফ করে দাও। জন

এ্যানির হাত দুখানা চেপে ধরে বিনীতভাবে কথাগুলো বললো।

এ্যানির মুখোভাব পরিবর্তন হয়ে এলো, গলার স্বর শান্ত করে বললোজানি, জানি বলেই তো আমি ছুটে এসেছি তোমার পাশে! একটু থেমে পুনরায় বললে—কিন্তু তোমার অবহেলা ভার আমাকে…

এ্যানি, আমি একটা দুশ্চিন্তায় আছি, তাই তোমার সঙ্গে ঠিক পূর্বের মত আচরণ করতে পারছিনে। জানো এ্যানি, মিস মালতীর হত্যা ব্যাপারে পুলিশ আমাকেও সন্দেহ করছে, এবং সদা আমার ওপর তাদের সতর্ক দৃষ্টি রয়েছে।

কেন পুলিশ তোমাকে সন্দেহ করছে? তুমি যে বললে—মালতীর সঙ্গে, তোমার কোন সম্বন্ধ ছিলো না?

না এ্যানি, তুমি বিশ্বাস করো, মিস মালতীকে আমি সব সময় এড়িয়ে চলতাম। কিন্তু মালতী আমার পেছনে জোঁকের মত লেগে থাকতো। আমি তাকে ঘৃণা করতাম।

জন, সত্যি বলছো?

সম্পূর্ণ সত্যি এ্যানি।

ডার্লিং!

এ্যানি!

ডালিং, তুমি ঐ কালো চশমা খুলে ফেলল। এ্যানি জনের কণ্ঠ বেষ্টন করে ধরে।

জন ধীরে ধীরে এ্যানির কোমল বাহু দুটি সরিয়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়—এ্যানি, আমার জরুরী একটা কাজ আছে। এক্ষুণি বাইরে যাবো।

উঁ হুঁ, আমি তোমাকে ছেড়ে দেবো না, ডার্লিং!

প্রিয়ে তুমি জানো না কত জরুরী আমার কাজ। চলি-গুডবাই!

অস্ফুট কণ্ঠে বললো এ্যানি—গুডবাই!

জন বেরিয়ে গেলো।

এ্যানি বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে পড়লো বিছানায়।

১০.

নূরী আর মনি মায়ারাণীর মায়াজালে বন্দী। শত চেষ্টা করেও নূরী নিজেকে উদ্ধার করতে পারলো না কিংবা মনির সাক্ষাৎ পেলো না। চোখের পানিতে নূরীর বুক ভেসে গেলো, তবু মায়ারাণীর মনে মায়া হলো না।

অদ্ভুত এক নারী এই মায়ারাণী। আসলে সে নারী নয়, যাদুকর হরশঙ্কর নারীর রূপ নিয়ে নূরীর নিকট হাজির হতো, তাকে নানা ভাবে ভোলাতে চেষ্টা করতো। কখনও বা যাদুর দ্বারা আচ্ছন্ন করে রাখতো।

মাঝে মাঝে হরশঙ্কর মনিকে নিয়ে শহরে যেতো, নানা যাদুর খেলা দেখাতো, সুযোগ পেলে মানুষকে হত্যা করে তার যথাসর্বস্ব লুটে নিতো। অতি পিচাশ পাপাচার এই হরশঙ্কর। নারীর রূপে নূরীকে নানা ছলনায় ভোলাতে চেষ্টা করলেও হরশঙ্কর নূরীকে সংস্পর্শ করতে পারলো না।

দিনের পর দিন নূরী এই গহন বনে একটি অন্ধকারময় কুটিরের মধ্যে অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করে চললো। একদিকে মনির অদর্শন, অন্যদিকে এই বন্দিনী অবস্থা।

যাদুকর হরশঙ্কর শুধু নূরী আর মনিকেই বন্দী করেনি, তার কবলে আরও অনেক নারী ও শিশু নরক জ্বালা ভোগ করছে তীব্র কষ্ট ভোগের পর কেউ এখনও বেঁচে আছে, কেউ চিরদিনের জন্য বিদায় নিয়েছে ধরণীর বুক থেকে।

যাদুকর হরশঙ্কর শুধু যাদুকরই নয়—বনাঞ্চলে যেমন তার আধিপত্য, তেমনি শহরেও তার বিচরণ সর্বত্র।

সপ্তাহে হরশঙ্কর দুদিন তার যাদুর খেলা দেখাতে শহরে যেতো। মনি নিতান্ত শিশু, কাজেই প্রায় দিনই বিভিন্ন ছেলে নিয়ে যেতো সে দেশ হতে দেশান্তরে। কোন শহর বা নির্দিষ্ট জায়গায় হরশঙ্কর স্থায়ীভাবে থাকতো না। নানা বেশে নানা দেশে সে যাদুর খেলা দেখাতে চলে যেতো।

বিশেষ করে রাতের বেলায় সে যাদু খেলা দেখাতো। তার কয়েকজন অনুচর ছিলো যখন হরশংকর খেলা দেখাতো তখন তার নানা ছদ্মবেশে থাকতো তার আশেপাশে। হরশঙ্করের যাদু খেলায় যখন দর্শকগণ আচ্ছন্ন। হয়ে পড়তো, ঠিক সেই মুহূর্তে তার সঙ্গীরা হরণ করতো তাদের মূল্যবান সামগ্রী।

কয়েকজন যুবতীও ছিলো হরশংকরের বনের কুটিরে। তাদের নিয়ে মাঝে মাঝে সে শহরে নাচ দেখাতো ও খেলা দেখিয়ে পয়সা উপার্জন, করতো।

নূরীকেও হরশংকর সেইভাবে তৈরী করে নিতে চেষ্টা করছিলো। নিজে নারীর ছদ্মবেশে নানা কৌশলে তাকে বশীভূত করছিলো। কিন্তু নূরী সাধারণ মেয়ে নয়, তাকে আয়ত্তে আনা যাদুকর হরশংকরের কাজ নয়। যাদুকর। হরশংকর বেশীদিন নূরীর কাছে আত্মগোপন করে নারীর ছদ্মবেশে থাকতে পারলো না। একদিন ধরা পড়ে গেলো সে নূরীর কাছে।

সেদিন নূরীকে কাছে টেনে বললো মায়ারাণী বেশী হরশংকর তোমাকে আমি বোনের মত ভালবাসি। তুমি আমাকে ভালো বাসতে চেষ্টা করো। তোমার লাল টুকটুকে সুন্দর মুখখানা আমাকে উন্মত্ত করে তুলেছে কথার ফাঁকে সে নূরীকে আকর্ষণ করছিলো।

চমকে উঠছিলো নূরী—এ তো কোন নারীর কোমল হাতের স্পর্শ নয়। ভয়ে সংকুচিত হয়ে সরে গিয়েছিলো নূরী মায়ারাণীর পাশ থেকে। হেসেছিলো মায়ারাণী!

নূরী ওর চোখ দুটির দিকে তাকিয়ে শিউরে উঠেছিলো, বুঝতে পেরেছিলো মায়ারাণী নারী নয়—পুরুষ।

এরপর থেকে নূরী সব সময় মায়ারাণীকে এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করতো, ও এলেই বিব্রত বোধ করতো নূরী।

কিন্তু নূরী ভয়ে ভীত হবার মেয়ে নয়। সে দুর্দান্ত ভয়ংকর মেয়ে, নানা ছলনায় কৌশলে পালাবার পথ খুঁজতো কিন্তু মনিকে না নিয়ে যাবে না—এই তার শপথ।

একদিন গভীর রাতে নূরীর হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেলো। শুনতে পেলো পাশে কোথাও নুপুরের শব্দ হচ্ছে। শয্যা ত্যাগ করে উঠে পড়লো নূরী, কুটিরের ঝাপ সরিয়ে উঁকি দিলো বাইরে। অবাক হয়ে দেখলো—একটা খাটিয়ার ওপরে বসে আছে একটা লোক, লোকটার হাতে চাবুক! সামনে নৃত্যরত একটি যুবতী। নৃত্যরত যুবতীর অনতিদূরে কয়েকটা মশাল জ্বলছে। মশালের আলোতে নূরী দেখলো, খাটিয়ায় বসা লোকটা যেন তার পরিচিত বলে মনে হচ্ছে। কোথায় দেখেছে ভূকুঁচকে ভাবতে লাগলো সে, হঠাৎ মনে পড়লো এ তো মায়ারাণীর মুখ। নূরীর চোখের সামনে লোকটার মুখ মিশে সেখানে ভেসে উঠলো। একটি অসাধারণ নারীমুখ। আজ সব পরিস্কার হয়ে গেলো নুরীর কাছে। তার ধারণা সত্যি মায়াঁরাণী আসলে নারী নয়, সে পুরুষ বুঝতে পারলো নূরী।

আরও অবাক হলো নূরী——যুবতীকে মাঝে মাঝে লোকটা চাবুক দ্বারা। আঘাত করছে। মেয়েটি মাটিতে পড়ে যাচ্ছে, আবার উঠে নাচতে চেষ্টা করছে।

নূরীর সে রাতে আর ঘুম হলো না, কে এই মায়ারাণী বেশী শয়তান। নিশ্চয়ই লোকটা ভেলকিবাজি জানেনইলে এক এক সময় এক এক রূপ সে ধরে কি করে! আর সব কিছুর এমন পরিবর্তনই বা করে কেমন করে মনে পড়লো প্রথম দিনের কথা, সন্ন্যাসী বাবাজীর নিষেধ সত্ত্বেও মনির সন্ধানে নূরী এসেছিলো পশ্চিম দিকে। হঠাৎ তার সামনে দেখতে পেয়েছিলো সুন্দর একটি ফুলের বাগান, কত রকমের ফুলের সমারোহ সে বাগানে। বিমুগ্ধ নূরী হঠাৎ একটা ফুল ছিঁড়ে ফেলে ছিলো ভুল করে, সঙ্গে সঙ্গে একরাশ ধোঁয়া তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিলো। তারপর একটা তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাব তার সমস্ত সত্তাকে লুপ্ত করে দিয়েছিলো তখন, দেখতে পেয়েছিলো তার চারপাশে যেন প্রকান্ড প্রকান্ড দেয়াল, কোনোদিকে পালাবার পথ খুঁজে পাচ্ছিলো না। কিন্তু তারপর আবার দেখেছিলো একটা অন্ধকার কক্ষে বন্দিনী সে। আজ দেখছে সে কক্ষও কোথায় উধাও হয়েছে। একটা কুটিরের মধ্যে আটক রয়েছে। নূরীর কাছে সব যেন কেমন ঘোলাটে হয়ে এসেছে। সে বুঝতে পেরেছে নিশ্চয়ই যাদুর নাগপাশে তাকে বন্দী করা হয়েছে।

১১.

শিশু মনির অবস্থা আরও দুর্বিষহ। তাকে একটা বৃদ্ধার নিকটে রাখা হয়েছে। শুধু মনিই নয়, আরও কয়েকজন শিশু বালককেও সেই বৃদ্ধা দেখাশোনা করে। মনিহত বৃদ্ধাকে দেখলেই ভয়ে কুঁকড়ে যায়, কাঁদতে শুরু করে সে। বৃদ্ধার চেহারা অতি ভয়ংকর আর বিশ্রী। নাকটা চ্যাপ্ট—মাথাটা মস্ত বড় মাথায় আধাপাকা মোটা মোটা একগাদা চুল। শরীরটা জমাট পাথরের খোদাই করা মূর্তির মত শক্ত। মাঝে মাঝে খড়িমাটির মত সাদা দাঁত বের করে কথা বলে। মনি কিছুতেই ওকে সহ্য করতে পারে না।

ওকে দেখলেই মনি প্রাণফাটা চীৎকার করে ওঠে, তবু বৃদ্ধা জোর করে ওকে কোলে তুলে নেয়, মিছামিছি আদর করতে চেষ্টা করে—দুধ-কলা খেতে দেয়। ছোট্ট মনি কিছুই বোঝে না, বৃদ্ধাকে দেখলে ভয়ে চুপসে যায় আর সেই মুহূর্তে হরশংকর এসে ডাকলে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার কোলে। হরশংকর মনিকে নানাভাবে যাদুর দ্বারা নিজের বশীভূত করে নিয়েছে যা বলে হরশংকর শিশু হলেও মনি তাই করে। মনিকে নিয়ে যাদুর খেলা দেখাতে গেলে দর্শক হয় বেশী। তার কারণ, মনি শিশু হলেও খেলা দেখিয়ে দর্শকদেরকে অবাক ও মুগ্ধ করে। তাছাড়া মনির অপূর্ব সুন্দর চেহারাও দর্শকগণকে মুগ্ধ করে। মনি হরশংকরের যাদু খেলায় লাকি হয়ে দাঁড়ালো।

গহন বনে নূরী ছটফট করলেও শান্তভাবে গোপনে সে এখানকার রহস্যজাল ভেদ করবার চেষ্টা করতে লাগলো। হরশংকরের মনোভাব সে বুঝে নিলো কিছুদিনের মধ্যেই! নূরী একদিন হরশংকরকে বললো-আপনার মনঃতুষ্টির জন্য আমি সব করতে পারি। আপনি পুরুষ তাও আমি জানি, কেন আমার কাছে আপনি নারীর রূপ ধরে আসেন?

হরশঙ্কর নূরীর কথায় আশ্চর্য হলো, তার এই নিখুত নারীর ছদ্মবেশেও এই যুবতী তাকে চিনতে পেরেছে শুনে কিছুক্ষণ নিশ্চুপ রইলো হরশঙ্কর। তারপর কি যেন ভেবে বললো–তোমার অদ্ভুত বুদ্ধিবল দেখে আমি খুশী হয়েছি সুন্দরী। সঙ্গে সঙ্গে নিজের শরীর থেকে নারীর পোশাক খুলে ছুড়ে ফেলে দিলো দূরে, তারপর নূরীর দিকে দুহাত বাড়িয়ে বললো সুন্দরী, তোমাকে আমি প্রথম দেখেই মুগ্ধ হয়েছিলাম। কিন্তু আমি নিজকে অতি কঠিনভাবে সংযত রেখে এতদিন শুধু তোমার অপূর্ব রূপসুধা পান করেই এসেছি, তোমাকে স্পর্শ করিনি। এসো, আজ তুমি আমার বাহুবন্ধনে। এসো প্রেয়সী–

নূরী ভেতরে শিউরে উঠলেও মুখে হাসি টেনে বললো–তোমার বলিষ্ঠ দীর্ঘ চেহারা আমাকেও মুগ্ধ করেছে, কিন্তু আমার মনিকে না পেলে আমি কিছুতেই তোমাকে–কথা শেষ না করে মাথা নত করলো।

দুষ্ট যাদুকর ক্রুদ্ধ হলো, মনিকে সে মায়াজালের আবেষ্টনীতে স্মৃতিচ্যুত করে রেখেছে, কোনো রকমেই তাকে নূরীকে দেখানো সম্ভব নয়। ক্রুদ্ধকণ্ঠে বললো সে সুন্দরী, তোমার মনি নেই।

মনি নেই!

না।

কোথায় আমার মনি?

তার রূপ পালটে গেছে।

তার মানে?

মনি তোমাকে দেখলে আর চিনতে পারবে না বা তোমার নিকটে আসতে চাইবে না।

না না, তা হতে পারে না, মনিকে আমি চাই। এনে দাও, এনে দাও আমার মনিকে।

অসম্ভব! তুমি তাকে কোনোদিনই পাবে না।

আমি তোমাকে হত্যা করবো শয়তান! নূরী দুহাতে হরশঙ্করের গলা টিপে ধরলো জোরে।

অতি সচ্ছ সহজভাবে হাসতে লাগলো হরশঙ্কর নূরীর হাত দুখানা তার গলায় যেন পুষ্পহারের মত অনুভূত হলো। হরশঙ্কর ধরে ফেললো নূরীকে। নূরী ভীষণভাবে কামড়ে দিলো যাদুকরের হাতে। যাদুকর যন্ত্রণায় ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো বটে কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তার দৃষ্টি অগ্নিবাণের মত নূরীর চোখে এসে লাগলো নূরী ধীরে ধীরে সংজ্ঞা হারিয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়লো।

যাদুকর হরশঙ্কর হেসে উঠলো হাঃ হাঃ করে, তারপর কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেলো।

নূরীর যখন জ্ঞান ফিরলো তখনও সে মেঝেতেই পড়ে আছে। উঠে বসলো নূরী। বেরিয়ে এলো কুটিরের বাইরে, চারদিকে তাকিয়ে দেখলো—

কোথাও কেউ নেই। নূরী এগুলো সামনের দিকে। একি! চারপাশে বেড়াজাল কেন! বাধা পেলো নূরী। বেড়া পার হবার জন্য অনেক চেষ্টা করলো-কিন্তু কিছুতেই সক্ষম হলো না! নূরী জানে তাকে যাদুর বেড়াজালে আবদ্ধ করা হয়েছে। অনেক চেষ্টা করেও সে বাইরে যেতে পারলো না। মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো নূরী। হঠাৎ মনির কণ্ঠের শব্দ তার কানে এলো। চমকে উঠলো নূরী, সামনে  তাকাতেই দেখতে পেলো বেড়ার একপাশে দাঁড়িয়ে মনি চোখ রগড়াচ্ছে।

নূরী মনিকে দেখামাত্র ছুটে গেলো তার দিকে, উচ্ছ্বসিতভাবে ডাকলোমনি হাত বাড়ালো মনিকে কোলে নেবার জন্য। কিন্তু মনি নূরীর দিকে তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলো। বিস্মিত ব্যথিত নূরী, ডেকে উঠলো–মনি, মনি-মনি ফিরেও তাকালো না নূরীর দিকে। ঠিক সেই মুহূর্তে একটা অট্টহাসির শব্দ ভেসে এলো পেছন থেকে-হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ–

চমকে ফিরে তাকালো নুরী, সঙ্গে সঙ্গে আড়ষ্ট হলো সে। তার পেছনে দাঁড়িয়ে বিকট স্বরে হাসছে হরশঙ্কর। মনি নূরীর কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে। নিয়েছে বলেই তার এই অদ্ভুত হাসি হাসি যেন থামতে চায় না।

হরশঙ্কর বিদ্রুপের সুরে বললো–নাওনা তোমার মনিকে।

নূরী চিত্রাপিতের ন্যায় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, সামনে বিপরীত দিকে মুখ ফিরিয়ে মনি—এখনও মনি চোখ রগড়াচ্ছে আর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।

নূরী দুহাত বাড়িয়ে কোলে নিতে গেলো—মনি কিছুতেই নূরীর কোলো এলো না-কেঁদে উঠলো সে চীৎকার করে। কাঁদতে লাগলো মনি হাত-পা ছুড়ে। হরশঙ্কর এগিয়ে এসে হাত বাড়াতেই মনি তার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়লো।

দুহাতের মধ্যে মুখ ঢেকে ডুকরে কেঁদে উঠলো নূরী।

হরশঙ্কর মনিকে নিয়ে ততক্ষণে চলে গেছে সেখান থেকে।

নূরীর মাথাটা কেমন যেন বনবন করে ঘুরে উঠলো। মাটিতে বসে পড়লো সে।

১২.

নিজের কক্ষে বসে আপন মনে ডায়ারীর পাতা উল্টাছিলো জন। আজ কদিন অবিরত কক্ষের প্রতিটি কাগজপত্র আর বাক্স স্যুটকেস তন্ন তন্ন করে কিসের যেন অনুসন্ধান করছে সে। আজও তার চারপাশে স্তুপাকার কাগজপত্র। ঘরময় জিনিসপত্র ছাড়ানো মাঝখানে একটা চেয়ারে বসে ডায়রী দেখছিলো জন অতি নিপুণ দৃষ্টি মেলে ডায়রীর পাতায় দেখছিলো, এমন সময় কক্ষে প্রবেশ করে এ্যানি!

চমকে ফিরে তাকায় জন, এ্যানিকে দেখতে পেয়ে দ্রুত ডায়রীখানা লুকিয়ে ফেলে।

এ্যানি এসে বসলো জনের চেয়ারের হাতলে, দুহাতে জনের কণ্ঠ বেষ্টন করে বলে—ডার্লিং তুমি সারাক্ষণ শুধু এ ঘরেই কাটাবে? তা ছাড়া এ কি হয়েছে তোমার ঘরের অবস্থা?

আর বলো না এ্যানি, বিশেষ দরকারী একটা জিনিস হারিয়ে ফেলেছি, খুঁজে পাচ্ছিনে।

সঙ্গে সঙ্গে মিঃ জনের কণ্ঠ ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে বসলো এনি–আমার জিনিসটা হারাওনি তো?

মাথা চুলকায় মিঃ জন—আরে না না, ওটা ঠিক আছে।

এতক্ষণে স্বস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করে এ্যানি—উহ, বাঁচালে জন! আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। একটু থেমে বললো এ্যানি-আমি কাউকেই বিশ্বাস করিনি জন, তাই ওটা আমি তোমার কাছে গচ্ছিত রেখে গেছি।

হাঁ এ্যানি, আমিও সেই কারণে ওটাকে খুব যত্ন করে রেখেছি।

তুমি লন্ডন যাবার সময় ওটাকে ঠিক করে রেখেছিলে তো?

কালো চশমার ফাঁকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো জন এ্যানির মুখে। একটু চিন্তা করে বললোহাঁ, ওটা আমি নিরাপদ স্থানে রেখেই গিয়েছিলাম।

ডার্লিং,এবার তো আমরা সব কাজ শেষ করে ফিরে এসেছি। বিয়ের তারিখটা এবার ঠিক করে ফেললা, কেমন?

আমিও সেই কথাই ভাবছি এ্যানি, এবার আমাদের বিয়েটা শীঘ্র হওয়া দরকার।

ডালিং, আমার সত্যি বড় আনন্দ হচ্ছে। কিন্তু কবে সেই দিনটি আসবে প্রিয়?

এ্যানি জনের মুখের কাছে মুখখানা এগিয়ে এনে প্রশ্ন করলো। দক্ষিণ হাতে জনের চোখের কালো চশমা খুলে নিতে গেলো এ্যানি, জন তাড়াতাড়ি মুখটা সরিয়ে বললো—উহু।

না না, তোমার ঐ কালো চশমা খুলে ফেলো! তোমার চোখ দুটো আমাকে দেখতে দাও।

এ্যানি, চশমা খুললে আমি বড় অস্বস্তি বোধ করি, চশমা আমার সম্বল!

জন!

এ্যানি, আমাকে কি তোমার ভাল লাগছে না?

অতি উত্তম—অতি মধুর–ডার্লিং তুমি এবার আমাকে ধরা দিচ্ছো না কেন? কেমন যেন পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছো আমার কাছ থেকে?

এই তো আর কটা দিন, আমাদের শুভ বিবাহটা আগে হয়ে যাক, তখন আমরা দুজন এক হয়ে যাবো, মিশে যাবো, দুজন দুজনার মধ্যে।

আমার বিলম্ব সইছে না ডালিং–এ্যানি জনের বুকে মাথা রাখলো আগে কিন্তু তুমি এমন ছিলে না।

জন বিব্রত বোধ করলো, কিছু বলতে যাচ্ছিলো, ঠিক সেই মুহূর্তে জানালার শার্শীর ফাঁকে দুখানা চোখ ভেসে উঠলো।

এ্যানি লক্ষ্য না করলেও জনের চোখে ধরা পড়ে গেলো। জন এ্যানির কানে ফিস ফিস করে বললো—এ্যানি, কেউ আমাদের লক্ষ্য করছে।

বলো কি! এ্যানি সোজা হয়ে দাঁড়ালো।

জন উঠে গেলো জানালার দিকে, ইতিমধ্যে চোখ দুটি অন্তর্ধান হয়েছে।

জন ফিরে এলো এ্যানির পাশে—এ্যানি, আমার পেছনে কেউ ছায়ার মত ঘুরে বেড়াচ্ছে, সদাসর্বদা সে আমাকে অনুসরণ করছে।

ভীতকণ্ঠে বললো এ্যানি-আমার কিন্তু ভয় করছে।

ভয় পাবার যদিও তেমন কিছু নেই তবু সাবধানে থাকা নিতান্ত দরকার।

কি করবো জন?

এখন তুমি সব সময় নিজের ঘরে থাকবার চেষ্টা করবে। এমনকি আমার কক্ষেও আসবে না এ্যানি।

একি বলছো ডার্লিং!

হাঁ এ্যানি, আমিই যাবো তোমার ঘরে।

না গেলে আমি কিন্তু আনেক দুঃখ পাবো।

এ্যানি, তার চেয়ে আমিই বেশী দুঃখ পাবো তোমার পাশে না গেলে।

সত্যি!

সত্যি এ্যানি–জন এ্যানির চিবুক খানা তুলে ধরলো—তাহলে তুমি এখন যাও, এ্যানি!

যাচ্ছি। তুমিও এখন শুয়ে পড়া জনহাতঘড়িটা দেখে নেয় এ্যানি–রাত অনেক হয়ে গেছে।

এ্যানি বেরিয়ে যায়, হাই তোলে জন—তারপর দরজা বন্ধ করে এগিয়ে যায় জানালার শার্শীর পাশে খুলে বাইরে উঁকি দিয়ে দেখে নেয়। না কোথাও কেউ নেই। আবার ভাল ভাবে জানালার শার্শী বন্ধ করে ফিরে আসে চেয়ারের পাশে, অতি সন্তর্পণে প্যান্টের পকেট থেকে ডায়ারীখানা বের করে মেলে ধরলো চোখের সামনে। কিছুক্ষণ দৃষ্টি বুলিয়ে উঠে দাঁড়ালো চেয়ার ছেড়ে।

ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালো, কালো চশমাটা খুলে রাখলো আপন মনে হেসে উঠলো হাঃ হাঃ করে। এবার দ্রুত অন্য একটি ড্রেস পরে নিলো জন। তারপর কালো চশমাটা পুনরায় পরে নিলো চোখে। দরজা খুলে সোজা সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো। গাড়ী বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলোজম গাড়ীতে উঠে ষ্টার্ট দিলো।

গভীর রাতের জনহীন পথ বেয়ে জনের নতুন নীল রঙের গাড়ীখানা দ্রুত এগিয়ে চলেছে। মাঝে মাঝে দুএকজন পথচারী এদিক সেদিক চলে যাচ্ছিলো। ট্রাফিক পুলিশ পথের মোড় থেকে বিদায় নিয়েছে অনেকক্ষণ।

আঁকাবাঁকা পথ ঘুরে ফিরে একটা অন্ধকার গলির মধ্যে এসে গাড়ী থামিয়ে নেমে পড়লো জন। রাস্তার ওপাশে একটা বহুদিনের পুরোন রঙচটা বাড়ী। বাড়ীর দরজায় একটা তালা লাগানো। জন সেই দরজার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো চারদিকে তাকিয়ে দেখে নিলো, তারপর দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো।

এগিয়ে চললো সামনের দিকে। পাশাপাশি সারিবদ্ধ কয়েক খানা পুরোন ইটের গাঁথুনি করা চুনবালি খসে পড়া ঘর। টানা বারান্দা বেয়ে জন শেষ কক্ষের নিকটে এসে থামলো, পুনরায় পেছনে তাকিয়ে দেখে নিলো অতি সতর্ক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। কক্ষটা অন্যান্য কক্ষের চেয়ে একটু বিশেষ ধরনের। এ দরজাতেও মস্ত একটা তালা লাগানো। তালা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো সে। সঙ্গে সঙ্গে কতকগুলো বাদুড় ও চামচিকে পাখাি ঝাপটে এদিক থেকে সেদিকে উড়ে গেলো।

জন পকেট থেকে একটা ছোট টর্চ লাইট বের করে জ্বালালো দেখতে পেলো, মেঝেতে একটা কাঠের বাক্স পড়ে রয়েছে। জন বাক্সটি সরিয়ে ফেলতেই একটা সুড়ঙ্গ পথ বেরিয়ে এলো।

জন সেই সুড়ঙ্গপথে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেলো। ভূগর্ভেও ওপরের মত পাশাপাশি কয়েকখানা কক্ষ। একটা কক্ষের মধ্যে প্রবেশ করে জন থমকে দাঁড়ালো, অদূরে দুগ্ধফেননিভ শুভ্র বিছানায় শায়িত এক যুবক। শরীরে মূল্যবান স্যুট। চীৎ হয়ে শুয়েছিলো সেজনের পদশব্দে বিছানায় উঠে বসলো। ফিরে তাকাতেই জন বললো—গুড ইভনিং।

শয্যায় উপবিষ্ট যুবক কোনো কথা উচ্চারণ করলো না, একবার তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বসলো। যুবকের চেহারা, সুন্দর, বলিষ্ঠ, দীপ্তময়, মাথায় কোঁকড়ানো একরাশ চুল, প্রশস্ত ললাটে, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি মুখোভাব গম্ভীর উদাস।

জন যুবকের পাশে এসে বসলো—পিঠে হাত রেখে ডাকলো বন্ধু, কেমন আছো?

এবারও কোনো জবাব দিলো না যুবক, মাথা নীচু করে নীরবে বসে রইলো।

শয্যার পাশেই একটা চৌকোনা টেবিল, টেবিলে নানা রকম ফলমূল সাজানো। জন একথোকা আঙ্গুর তুলে নিয়ে একটা ছিঁড়ে মুখে ফেললো, তারপর চিবুতে চিবুতে বললো—কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো?

যুবক তবু নিরুত্তর। জন হেসে বললো আর কটা দিন–কথার ফাঁকে চোখের কালো চশমা খুলে টেবিলে রাখলো।

যুবক তাকালো জনের মুখের দিকে।

হাসলো জন, তারপর পকেট থেকে একটা চেঁক বের করে বাড়িয়ে ধরলো—এখানে সই দাও বন্ধু।

না, আমি সই দেবো না।

তোমার একটা পয়সাও বাজে নষ্ট করবো না।

কি করবে তুমি এত টাকা?

সমস্ত হিসেব পাবে।

না, আমি কিছুতেই সই দেবো না।

দেবে না?

না!

জন প্যান্টের পকেট থেকে বের করলো একটা ছোট্ট রিভলবার চেপে ধরলো যুবকের বুকে—সই না দিলে আর কোনোদিন তুমি পৃথিবীর আলো দেখতে পাবে না বন্ধু!

যুবক ফ্যাল ফ্যাল করে তাকালো জনের মুখের দিকে। তারপর চোখ। নামিয়ে তাকালো রিভলবারের দিকে, এবার ধীরে ধীরে জনের হাত থেকে পেনটা নিয়ে চেকে সই করলো সে।

চেকটা পকেটে ভাঁজ করে রেখে জন উঠে দাঁড়ালো—আবার দেখা হবে। গুডবাই!

জন রিভলবারখানা পকেটে রেখে দ্রুত বেরিয়ে গেলো।

পথের পাশে গাড়ীখানা অপেক্ষা করছিলো, জন গাড়ীতে উঠে ষ্টার্ট দিলো।

নিজ বাড়ীর গাড়ী-বারান্দায় গাড়ী পৌঁছতেই জন লক্ষ্য করলো—তার হলঘরের দরজার ওপাশে কেউ যেন আত্মগোপন করলোজন ঘরে প্রবেশ করে সুইচ টিপে আলো জ্বালালো। তারপর ওদিকের দরজা খুলে ধরলোআসুন মিঃ লাহিড়ী।

সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকার থেকে সরে এলেন পুলিশ ইন্সপেক্টার মিঃ লাহিড়ী। তাঁর মুখোভাব কিছুটা বিব্রত, হতভম্ভ।

জন হেসে বললো—নিশ্চয় আমার জন্য অপেক্ষা করছেন!

মিঃ লাহিড়ী কক্ষে প্রবেশ করে বললেন—হাঁ, মানে আপনার কাছে একটু দরকার ছিলো, তাই

আসুন, আমি একটা কাজে বাইরে গিয়েছিলাম।

মিঃ লাহিড়ী আসন গ্রহণ করে বললেন–এত রাতে বাইরে আপনার কি এমন জরুরী কাজ ছিলো, মিঃ জন?

সব কথাই তো বলা যায় না, তবে আপনাকে বলা উচিত মনে করি।

বলুন?

আমার এক অন্তরঙ্গ বন্ধু আজ পনেরোবিশদিন হলো অসুস্থ হয়ে পড়েছে, তাকে দেখতে গিয়েছিলাম।

ওঃ–মিঃ লাহিড়ী একটা শব্দ করলেন!

এবার জন নিজের সিগারেট কেসটা মিঃ লাহিড়ীর সামনে বাড়িয়ে ধরে বললো—নিন।

মিঃ লাহিড়ী একটা সিগারেট তুলে নিতে নিতে বললেন—এত রাতে আপনাকে বিরক্ত করা আমার উচিত হলো না মিঃ জন!

না, পুলিশের লোকের আবার সময় অসময় আছে নাকি! যখনই আপনি প্রয়োজন বোধ করবেন তখনই অনুগ্রহ করে আসবেন খুশী হবো।

ধন্যবাদ মিঃ জন।

জন একটা সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করে বললো-মিঃ লাহিড়ী মিস মালতী হত্যারহস্য উদঘাটনে কতদূর অগ্রসর হয়েছেন, জানতে পারি কি?

না, তেমন বেশী এগুতে পারিনি। তবে হাঁ, খুব শিগগির মালতী হত্যারহস্য উদঘাটিত হবে এটা সুনিশ্চয়!

অরুণ বাবু এখনও হাজতে আছেন?

হাঁ, অরুণ বাবু এখনও হাজতে।

কেন, কেউ কি তাকে জামিনে মুক্ত করে নেয়নি? মিঃ বাসুদেবও কি তার জামিনের আবেদন করেননি?

না, তিনি মিস মালতী হত্যার পর কেমন যেন স্তব্ধ হয়ে গেছেন। হাজার হলেও কন্যার মৃত্যুশোক কম নয়, বৃদ্ধ বয়সে এমন একটা অঘটন তাকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছে।

আচ্ছা মিঃ লাহিড়ী, আমি একবার অরুণ বাবুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাই, কয়েকটা প্রশ্ন করবো!

স্বাচ্ছন্দে মিঃ জন!

ধন্যবাদ।

মিঃ লাহিড়ী এবার মাথা চুলকান, তারপর বলেন—মিঃ জন, আপনি আমার একটা প্রশ্নের ঠিক জবাব দেবেন?

নিশ্চয়ই, বলুন?

আচ্ছা মিঃ জন, মিস মালতীর সংগে আপনার কেমন সম্বন্ধ ছিলো? অবশ্য এ প্রশ্ন আমি আগেও আপনাকে করেছি, পুনরায় করছি!

হাঁ, করবেন, একবার কেনো প্রয়োজনে দশবার করবেন। তার সঙ্গে আমার বান্ধবীর সম্বন্ধ ছিলো।

আপনি তাকে গভীরভাবে ভালবাসেননি?

হাঁ। বাসলে আমি এ্যানিকে বিয়ে করবার পাকা কথা দিতে পারতাম না।

এবার আপনি লন্ডন থেকে ফিরে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেননি কেন?

এ্যানিকে বিয়ে করবার পাকা কথা দিয়ে অন্য একজন যুবতীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আমার বিবেকে বেধেছে।

সে আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলো—একথা সত্য?

হাঁ সত্য।

সেদিন আপনি তাকে সরাইখানায় পৌঁছে দিয়ে আসেননি?

না, সে নিজেই—একটু থেমে বললো জন-আমি তাকে পৌঁছে দিয়েছিলাম, কিন্তু সরাইখানায় নয়-তার নিজ বাড়ীতে।

তখন কি অরুণ বাবু বাড়ীতে ছিলো?

না, কেউ ছিলো না! মিস মালতীকে আপনি কি বাড়ীর ভেতরে পৌঁছে দিয়েছিলেন না বাড়ীর সদর দরজা থেকেই বিদায় নিয়েছিলেন।

জন নিশ্চুপ হয়ে কি যেন ভাবলো, তারপর বললো—মালতী আমাকে ছেড়ে দেয়নি, আমি তার সংগে তার কক্ষে গিয়েছিলাম।

কতক্ষণ অপেক্ষা করেছিলেন আপনি সেখানে?

মিনিট পনেরো–কিন্তু–আপনি কি আমাকে সন্দেহ করছেন মিঃ লাহিড়ী?

আমরা পুলিশের লোক—সন্দেহ করা আমার স্বভাব। মিঃ জন, আজ আমি চললাম, কাল আপনি থানায় আসবেন?

হাঁ, আমাকে যেতে হবে একটু, কারণ অরুণ বাবুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করা আমার একান্ত প্রয়োজন।

চলি? উঠে পড়লেন মিঃ লাহিড়ী।

জন নিজের কামরায় গিয়ে দরজা বন্ধ করলো। বার দুই হাই তুলে হাতঘড়ির দিকে তাকালো তারপর একখানা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়লো। প্যান্টের পকেট থেকে ডায়রীখানা বের করে মেলে ধরলো চোখের সামনে।

হঠাৎ একসময় জনের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। ডায়রীর পাতায় এক জায়গায় বারবার পড়তে লাগলো সে। তারপর ডায়রীখানা পকেটে রেখে কিছুক্ষণ ধীর পদক্ষেপে কক্ষে পায়চারী করলো। তার মুখোব স্বচ্ছ দীপ্তময়, একটা পাষাণভার যেন তার বুক থেকে নেমে গেছে বলে মনে হলো। ঠোঁটের কোণে একট। তীক্ষ্ণ হাসির রেখা ফুটে উঠেছে।

এবার শয্যায় গিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লো জন, অল্পক্ষণেই ঘুমিয়ে পড়লো সে।

বেলা হয়ে গেছে অনেক—–এখনও জনের ঘুম ভাঙলো না! অঘোরে ঘুমাচ্ছে সে। কক্ষে প্রবেশ করলো এ্যানি। খাবার টেবিলে বসে চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে তবু জনের সাক্ষাত না পেয়ে এ্যানি চলে এলো জনের কক্ষে।

জন পাশের টেবিলে তার কালো চশমাটা খুলে রেখে উবু হয়ে শুয়ে ছিলো বালিশটা আঁকড়ে ধরে।

এ্যানি গিয়ে বসলো জনের পাশে, পিঠে হাত রেখে ডাকলো—ডার্লিং, এত ঘুমাচ্ছো! ওঠো!

জনের ঘুম ভেঙে গেলো আচম্বিতে কিন্তু সে নিশ্চুপ ঘুমের ভান করে শুয়েই রইলো। এ্যানি মাথাটা রাখলো জনের পিঠের ওপর—ওঠো, ডালিং!

উ হুঁ, শরীরটা বড় খারাপ লাগছে।

এ্যানি তাড়াতাড়ি সোজা হয়ে বসে জনকে টেনে এদিক করতে গেলো কিন্তু জন। কিছুতেই পাশ ফিরলো না, বললো এবার—এ্যানি, প্রিয়ে, আর একটু ঘুমোতে দাও।

অনেক বেলা হয়েছে, ছিঃ এত ঘুমায় না!

এ্যানি!

বলো?

লক্ষ্মীটি, আমাকে আর একটু ঘুমাতে দাও।

বেশ আমি যাচ্ছি। যাবার সময় টেবিল থেকে কালো চশমাটা কাপড়ের নীচে লুকিয়ে নিয়ে বেরিয়ে গেলো।

জন এবার পাশ ফিরে হাত বাড়ালো টেবিলে চশমাটার জন্য কিন্তু একি? চশমা কোথায়? জন বিপদে পড়লো। তাড়াতাড়ি বাথরুমে প্রবেশ করে ড্রেসিং আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালো, চোখটা তার এখনও সম্পূর্ণ সারেনি।

১৩.

বাসুদেব সরাইখানার দোতলার একটা কক্ষে থাকতেন; এটাই তাঁর বিশ্রামকক্ষ। মাঝে মাঝে কন্যা মালতীর বাড়ী বেড়াতে যেতেন কিংবা কখনও তাকে রাখতে যেতেন বাসুদেব স্বয়ং। কিন্তু মালতী নিহত হবার পর। আর বাসুদেব মালতীর শূন্য বাড়ীতে যাননি। কন্যার শেষ নিঃশ্বাস যে বাড়ীর হাওয়ায় মিশে রয়েছে, যে বাড়ীর শুষ্ক মেঝে তার কন্যার বুকের রক্তে রাঙা হয়ে উঠেছিলো, সে বাড়ী তাঁর কাছে অসহ্য।

আজকাল বাসুদেব, সব সময় তার নিজের ঘরেই থাকেন। কখনও বিশেষ প্রয়োজনে এসে বসেন তিনি সরাইখানার গদিতে।

ভাবগম্ভীর প্রবীণ ব্যক্তি বাসুদেব কন্যার মৃত্যুতে সত্যিই একেবারে মুষড়ে পড়েছেন। পুলিশ অফিসারগণ আসনে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে, যেটুকু না বললে নয় তাই তিনি বলেন।

সেদিন অনেক রাতে বাসুদেব বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছিলেন। সরাইখানা সম্পূর্ণ নীরব হয়ে যায়নি, নীচে খানাপিনা নাচ গান তখনও চলছে।

হঠাৎ বাসুদেবের জানালার শার্শী খুলে কক্ষে প্রবেশ করলো জন, দক্ষিণ হাতে তার উদ্যত রিভলবার।

বাসুদেব পদশব্দে মুখ ফেরাতেই চমকে উঠলেন, অস্ফুট কণ্ঠে বললেনজন, তুমি!

দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে এলো জনহাঁ আমি, চিনতে তাহলে ভুল হয়নি মিঃ দেব?

সাত বছর পর তোমাকে দেখলাম কিন্তু কি কারণে তুমি এখানে এসেছো?

একটা জরুরী কাজে।

তা সামনে দিয়ে না এসে পেছনের জানালা দিয়ে কেন?

বহুদিন পর কিনা সরাইখানার সবাই আমাকে দেখলে অবাক হবে–তাই আত্মগোপন করে এলাম।

কিন্তু ওটা কেন তোমার হাতে? জনের হাতের রিভলবারখানা দেখান বাসুদেব।

হাসে জন—যে প্রশ্ন করবো সঠিক জবাব না দিলে এটার দরকার হতে পারে!

বাসুদেবের মুখমন্ডল ভয়ে বিবর্ণ হয়ে উঠলো, আমতা আমতা করে বললেনকি এমন প্রশ্ন করবে জন?

আপনার কন্যা সম্বন্ধে দুচারটা কথা।

সে জন্য রিভলবার দেখাতে হবে না জন। মালতীর সম্বন্ধে তুমি যা জিজ্ঞাসা করবে তাই বলবো, মা মালতী আমাকে শোকসাগরে ভাসিয়ে রেখে গেছে। রুমালে চোখ মোছেন বাসুদেব।

সত্যই বাসুদেব কন্যাকে হারিয়ে উন্মাদের মত হয়ে পড়েছেন। একমাত্র কন্যা ছিলো তাঁর সম্বল।

জন বললোআমি যখন লন্ডন যাই তখন আপনার কন্যা মিস মালতীর নিকটে আমার একছড়া হীরার হার রেখে যাই, সেটার জন্য আজ আমি এসেছি।

বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বলে ওঠেন বাসুদেব হীরার হার!

হাঁ, পাঁচখানা হীরার খন্ড সেই হারে গাঁথা ছিলো।

একটু চিন্তা করে বললেন, বাসুদেব—হাঁ, আমি সেই রকম এক ছড়া হার তার গলায় দেখেছিলাম। আমি তাকে সেই হার সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করায় সে বলেছিলো তোমার কথা–তুমি নাকি তাকে ওটা উপহার দিয়েছে।  দিয়েছিলাম, কিন্তু আজ সে নেই—কাজেই ওটা আমি ফেরত নিতে এসেছি।

বাসুদেবের চোখ দুটোতে ক্রুদ্ধ ভাব ফুটে উঠলো, বললেন—সে হারের কথা আমি জানিনা। হারের ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন করলে আমি তার জবাব দিতেও রাজী নই।

জন রিভলবারখানা একবার ঘুরিয়ে নিলো হাতের মধ্যে। কক্ষের স্বল্পালোকে রিভলবারখানা চকচক করে উঠলো।

বাসুদেব ঢোক গিলে বললেন—সে নিহত হবার পর হারের সন্ধান আমি জানি না।

জন হাসলো-জানেন না, কিন্তু মালতী নিহত হওয়ার সময়ও সেই হার তার গলায় ছিলো মিঃ দেব।

এ কথা তুমি কি করে জানলে জন? নিশ্চয় তুমি তাকে হত্যা করেছো?

সেই কথা জানাতেই আমি এসেছি মিঃ দেব।

কি, এত সাহস তোমার। মালতীকে তুমিই তাহলে হত্যা করেছো?

হত্যা করিনি, কিন্তু মালতীকে যখন হত্যা করা হয় তখন আমি সেখানেই ছিলাম।

বাসুদেবের মুখমন্ডল কালো হয়ে উঠলো—আমার কন্যার হত্যাকান্তে, তুমি ছিলে সেখানে অথচ হত্যাকারীকে তুমি–

হাঁ, আমিই তাকে পালাবার সুযোগ দিয়েছি।

কেন? কেন?

হারছড়া পরে তার কাছে পাবো এই আশায়।

তাহলে আমার কক্ষে কেন এসেছো জন?

হারছড়া এখন আপনার কক্ষেই আছে কিনা—

না না, আমার কক্ষে কেন সেই হার থাকবে। জন, তুমি ভুল করছো। আমার কন্যাকে আমি হারিয়েছি, তার চেয়ে কোনো জিনিসই আমার কাছে মূল্যবান নয়।

এমন সময় সিঁড়িতে জুতার শব্দ শোনা গেলো। জন একবার দরজার দিকে তাকিয়ে দ্রুত যে পথে এসেছিলো সেই পথে প্রস্থান করলো।

হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন বাসুদেব শর্মা।

কক্ষে প্রবেশ করলেন মিঃ লাহিড়ী ও দুজন পুলিশ। পেছনে হোটেলের ম্যানেজার রজতবাবু।

রজতবাবু বললেন–এই কিছুক্ষণ আগেও কেউ ছিলো। মিঃ লাহিড়ী বললেন—বাসুদেব বাবু, এখানে কেউ এসে ছিলো?

হাঁ, এই মুহূর্তে মালতীর হত্যাকারী এখানে এসে আমাকে হত্যা করতে যাচ্ছিলো।

হোয়াট?

হাঁ, ইন্সপেক্টার আর একটু হলেই আমার মৃতদেহ আপনারা দেখতে পেতেন।

এসব কি বলছেন মিঃ শর্মা!

হাঁ, সব সত্য। ইন্সপেক্টার মালতীর হত্যাকারী আর কেউ নয়জন জনই তাকে হত্যা করেছে।

জন!

হাঁ, ইন্সপেক্টার! জনই আমার কন্যাকে হত্যা করেছে।

মিঃ লাহিড়ীর মুখমন্ডল কুঞ্চিত হয়ে এলো, তিনি একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়ে বললেনজন মালতীর হত্যাকারী একথা আপনাকে কে বললো? সে নিজেই কি বলেছে?

না নিজে বলেনি, নিজে কেউ বলেওনা।

তবে?

তার কথাবার্তায় প্রকাশ পেয়েছে।

কি রকম?

প্রথমতঃ জন আমার পরিচিত লোক, সে গোপনে পেছনের জানালা দিয়ে আমার কক্ষে প্রবেশ করার কোনো কারণ থাকতে পারে না। দ্বিতীয়তঃ জনের হাতে গুলীভরা রিভলবার ছিলো। তৃতীয়তঃ জন নাকি মালতীকে একছড়া হীরার হার উপহার দিয়েছিলো। সে হার ছিলো অত্যন্ত মূল্যবান। সে ঐ হার পুনরায় নিতে এখানে এসেছিলো! হার আমার নিকেট না পাওয়ায় সে আমাকে হত্যা করতে উদ্যত হয়।

তারপর?

জন বলে, মালতীকে যখন হত্যা করা হয় তখন সে নাকি সেই স্থানে উপস্থিত ছিলো।

একথা সে নিজে স্বীকার করেছে? হাঁ করেছে।

এটাই কি আপনার জনকে মালতীর হত্যাকারী বলে সন্দেহ হওয়ার কারণ?

এছাড়াও জনের সবকিছুই আমার কাছে বেশ রহস্যজনক বলে মনে হলো ইন্সপেক্টার।

রজতবাবু বললেন—জন তাহলে সরাইখানার সম্মুখভাগ দিয়ে না এসে পেছনের শার্শী খুলে এসেছিলো কেন?

হাঁ, সবতো শুনলেন। বললেন বাসুদেব।

এমন সময় কাফ্রি চাকরটা হাঁপাতে হাপাতে এসে বললো–হুজুর হুজুর,–একটা লোক সরাইখানার পেছনে দাঁড়িয়েছিলো আমি তাকে দেখে ফেলায় সে ছুটে পালিয়ে গেলো।

মিঃ লাহিড়ী বিষ্ময়ভরা কণ্ঠে বললেন পালিয়ে গেলো!

হা, স্যার,কোট-প্যান্ট পরা একটা সাহেবের মত লোক। এখনও সে বেশী দূর যেতে পারেনি হুজুর–

মিঃ লাহিড়ী প্রশ্ন করলেন কোন দিকে গেছে বলতে পারো?

নিশ্চয়ই পারি। দক্ষিণ দিকে গেছে লোকটা।

মিঃ লাহিড়ী আর বিলম্ব না করে দলবল নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।

বাসুদেব এতক্ষণে নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচলেন। একে কন্যাশোকে তিনি মুহ্যমান, তার ওপর এসব উপদ্রব তাঁর মনটাকে একেবারে যেন ছেচে দিয়েছে!

মিঃ লাহিড়ী অনেক সন্ধান করেও জন বা অন্য কাউকে সরাইখানার আশেপাশে সন্দেহজনকভাবে ঘোরাফেরা করতে দেখলেন না।

অফিসে ফিরতেই মিঃ রায় জানালেন—মিঃ লাহিড়ী, মিঃ জন আপনার সাক্ষাৎ কামনায় বহুক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছেন।

বিস্মিত হলেন মিঃ লাহিড়ী—তিনি এইমাত্র বাসুদেবের মুখে শুনে এলেন—জন নাকি একটু আগেই তার ওখানে হামলা, দিয়েছিলো। অবাক হলেও তিনি কথাটা প্রকাশ করলেন না। জনকে লক্ষ্য করে বললেন—হ্যালো মিঃ জন, আমি একটু বাইরে কাজে গিয়েছিলাম।

জন গম্ভীর মুখে বললো—যাক, এসেছেন ভালই হলো—আমি অরুণ বাবুর সঙ্গে একটু সাক্ষাৎ করতে চাই।

আসুন মিঃ জন!

জনকে নিয়ে মিঃ লাহিড়ী হাজত কক্ষে এলেন।

জন অরুণ বাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে। লম্বা ছিপছিপে গঠন, মাথায় কোঁকড়ানো চুল, গায়ের রঙ ফর্সা, মুখে খোঁচা খোঁচা দাঁড়িবেশ কদিন শেভ করা হয়নি। চোখ দুটোতে করুণ চাউনি।

মিঃ লাহিড়ী বললেন—আপনার যা বলবার তাড়াতড়ি বলে নিন মিঃ জন।

ইয়েস! আমি সামান্য কটি কথা ওকে জিজ্ঞাসা করবো। অরুণ বাবুকে লক্ষ্য করে বললো জন-অরুণ বাবু, আপনার সঙ্গে তেমন করে আমার পরিচয় নেই। আমি মিস মালতীর পুরোনো বন্ধু জন।

অরুণ বাবু অস্ফুট কণ্ঠে উচ্চারণ করলো আপনি জন!

হাঁ আমি জন। দেখুন আপনাকে আমি কয়েকটা প্রশ্ন করবো। আপনি যদি সঠিক জবাব দেন তাহলে মালতীর হত্যা রসহস্য উদ্ঘাটন হবে আপনি যদি সত্যই নির্দোষ হন তাহলে আপনার মুক্তির পথও পরিস্কার হবে।

বলুন। আগ্রহভরাদৃষ্টি নিয়ে তাকালো অরুণ বাবু মিঃ জনের মুখের দিকে।

জন একবার মিঃ লাহিড়ীর মুখের দিকে তাকিয়ে নিয়ে বললো—আচ্ছা মিঃ অরুণ বাবু, মিস মালতীর সঙ্গে আপনার কত দিনের পরিচয়?

একটু ভেবে নিয়ে বললো অরুণবাবুবছর তিন হবে।

তার সঙ্গে আপনার কেমন সম্বন্ধ ছিলো? লজ্জা বা সংকোচ করবেন না, যদিও মিস মালতী আমারও বান্ধবী ছিলো।

না না, তা করবো না।

বলুন তবে!

মালতীকে আমি ভালবাসতাম।

শুধু কি ভালবাসতেন, না তার সঙ্গে অন্য কোনো রকম সম্পর্ক–মানে আপনাকে প্রথমেই বলেছি কোনো রকম দ্বিধা করবেন না আমার কাছে।

হাঁ, মালতী বলেছিলো সে আমাকে বিয়ে করবে এবং সে কারণেই আমি তাকে ভালবাসতাম ও তার বাড়ীতে থাকতে রাজী হয়েছিলাম।

জন আর একবার মিঃ লাহিড়ীর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে নিলো।

মিঃ লাহিড়ীও অরুণবাবুর কথাগুলো অত্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে শুনে যাচ্ছিলেন।

জন বললো-শুধু কি মিস মালতীর কথাতেই আপনি তার বাসায় থাকতে রাজী হয়েছিলেন?

না, তার বাবা বাসুদেবও আমাকে ওখানে থাকবার জন্য অনুরোধ জানিয়েছিলেন।

আপনি কি একাই মালতীর বাড়ীতে থাকতেন?

না, একটা কাফ্রি চাকরও থাকতো। সে নিচের তলায় ঘুমাতো।

আর আপনি?

আমি–আমি একটু ইতস্ততঃ করে বললো অরুণ বাবু—আমি মালতীর পাশের কামরায় থাকতাম। তবে আমাকে প্রায় রাতেই বাইরে কাটাতে হতো।

কেন?

বাসুদেব নানা কাজে আমাকে বাইরে পাঠাতেন।

তখন মালতীর কাছে, মানে ঐ বাসায় কে থাকতো?

ঐ কাফ্রি চাকরটা। আমি কোনো কোনো দিন রাতে ফিরে আসতাম।

জন কি যেন ভাবলো, তারপর বললো—মিঃ লাহিড়ী আপনি মনোযোগ সহকারে এর কথাগুলো শুনে যাবেন।

হাঁ, মিঃ জন আমি আপনাদের উভয়ের কথা বার্তাই অতি মনোযোগ সহকারে শুনে যাচ্ছি।

ধন্যবাদ মিঃ লাহিড়ী! পুনরায় ফিরে তাকায় জন অরুণ বাবু মুখের দিকে——আচ্ছা অরুণ বাবু?

বলুন?

মিস মালতী সরাইখানা থেকে কত রাতে বাসায় ফিরতো?

তার কোন ঠিক সময় ছিলোনা। কারণ সে কোনো কোনো রাত দুটো-তিনটে পর্যন্ত সরাইখানায় কাটাতো।

শুধু কি নাচ গানের জন্যই সরাইখানায় তাকে অত রাত পর্যন্ত রাখতে তার বাবা বাসুদেব?

অরুণবাবু মাথা নত করলো, কোনো জবাব দিলো না?

জন ও মিঃ লাহিড়ী দৃষ্টি বিনিময় করলো। উভয়ের মুখেই মৃদু হাসির আভাস ফুটে উঠে মিলিয়ে গেলো।

মিঃ লাহিড়ী বললেন—অর্থের লোভে মানুষ কতদূর নীচ হতে পারে! আপন কন্যাকেছিঃ ছিঃ ছিঃ।

জন মিঃ লাহিড়ীর কথার কোনো জবাব না দিয়ে অরুণ বাবু বললো—এসব জেনেও আপনি মালতীকে বিয়ে করতে রাজী ছিলেন?

অরুণ বাবু কোনো জবাব না দিয়ে একবার মিঃ জনের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে নিলো। পুনরায় দৃষ্টি নত করে সে।

মিঃ লাহিড়ী গম্ভীর কণ্ঠে বললেন—উনি যা প্রশ্ন করছেন তার জবাব দিন অরুণবাবু। লজ্জার স্থান এটা নয়।

অরুণ বাবু পুনরায় চোখ তুললো।

জন বললো মালতীর চরিত্রহীনতার কথা জেনেও আপনি তাকে ভালবাসতেন?

হাঁ, ওকে আমার ভাল লাগতো।

সেটা কি ওর অর্থ, না ওকে?

ওকে।

তাই বুঝি কোনো ঘৃণা ছিলো না ওর ওপর?

হাঁ, যাকে ভালবাসা যায় তাকে ঘৃণা করা যায় না।

অদ্ভুত মানুষ আপনি অরুণবাবু। একটু হেসে বললো জনআমিও একদিন মালতীকে গভীরভাবে ভালবাসতাম, সমস্ত অন্তর দিয়ে ভালবাসতাম। আমার ভাবী স্ত্রী মিস এ্যানি আমার নিকটে একটা হীরার হার গচ্ছিত রেখে লন্ডন গিয়েছিলো ওর বাবার সঙ্গে। মিস মালতীর সঙ্গে আমার যখন ভালবাসা গভীরভাবে জমে ওঠে তখন আমি এ্যানির সেই গচ্ছিত হীরার হার তাকে উপহার দেই।

তারপর একদিন লন্ডন থেকে আমার ডাক এলো। চলে গেলাম। যবার সময় মালতী আমাকে অনেক কথাই বলেছিলো। সে বলেছিলো জন তুমি ফিরে না আসা পর্যন্ত আমি তোমার প্রতীক্ষা করবো যদিও তুমি অন্য মেয়েকে বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছো তবু আমি তোমাকে অন্তর দিয়ে। ভালবাসি ও চিরদিন বাসবো। কিন্তু আমি লন্ডন থেকে ফিরে জানতে পারলাম—সে তার পিতার সরাইখানার নাচনে ওয়ালী হয়েছে। কন্যার যৌবন বিক্রি করে বাসুদেব অর্থ উপার্জন করছে। কথাটা শোনার পর আমার মস্ত মন চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গিয়েছিলো, আমি আর মালতীর পাশে যেতে পারিনি অবশ্য সেই একদিন এসেছিলো আমার সঙ্গে দেখা করতে। হাঁ, আমি শেষ পর্যন্ত তাকে তার বাড়ীতে পৌঁছে দিয়েও এসেছিলাম কিন্তু আগের মত সচ্ছ মন নিয়ে তাকে আর ভালবাসতে পারিনি।

মিঃ লাহিড়ী হঠাৎ প্রশ্ন করে বসলেন আপনার ভাবী স্ত্রীর গচ্ছিত সেই b্যবান হীরার হার কি মিস মালতীর নিকটেই রয়ে গেলো?

হাঁ, ওটা আমি আর ফেরত নিতে পারলাম না।

মিঃ লাহিড়ী সন্দিগ্ধ দৃষ্টি নিয়ে তাকালেন জনের মুখের দিকে।

জন অরুণ বাবুকে প্রশ্ন করলেন-অরুণ বাবু, ঠিক করে বলুন দেখি, আপনি সেই হীরার হার দেখেছিলেন?

হাঁ দেখেছিলাম, এমন কি মৃত্যুর দিনও ঐ হার তার গলায় ছিলো।

মিঃ লাহিড়ী বললেন—কিন্তু কি আশ্চর্য কই মৃত্যুকালে তার কণ্ঠে তো কোনো হার ছিলো না। তবে পোষ্টমর্টেম রিপোর্টে জানা গেছে মিস মালতীর গলায় একটা আঁচড়ের চিহ্ন ছিলো।

সেই চিহ্নই হলো মিস মালতীর নিহতের কারণ।

তাহলে কি ঐ হারছড়া—

হাঁ ইন্সপেক্টার, ঐ হারছড়াই মালতীর মৃত্যু ঘটিয়েছে।

কঠিন হয়ে উঠলো মিঃ লাহিড়ীর মুখমন্ডল-এ হার আপনিই তাকে দিয়েছিলেন?

সে কথা তো বলেছি। এ সন্দেহ মিথ্যে নয় ইন্সপেক্টার। আপনাকে ধন্যবাদ না দিয়ে পারছি না যে আপনি এতদিনও আমাকে এরেষ্ট না করে নিশ্চপ আছেন। একটু থেমে বললো জন–আমি হার নিলে তাকে হত্যা করতে হতো না, আমার বাসায় যখন সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলো তখন তার কণ্ঠে হার ছিলো কিন্তু আমি অতখানি নীচ হতে পারিনি। যাক, একথা মুখে বলে বিশ্বাস করানো বাতুলতা ছাড়া আর কিছু নয়।

আচ্ছা অরুণবাবু হারটা কি মালতী সব সময় পরতো?

না, কোনো কোনো বিশেষ দিন ছাড়া ঐ হার সে পরতো না এবং হারছড়া সে অতি সাবধানে ব্যাঙ্কে রেখে আসতো, এমনকি কোনোদিন রাতে ঐ হার নিজের বাসায় রাখতো না।

কেন, তার বাবা বাসুদেবকেও সে বিশ্বাস করতো না কি?

না, সে কথা নয়। মালতী ঐ মূল্যবান হারছড়া বাসায় বা সরাইখানায় রাখা নিরাপদ মনে করতো না। যদিও অনেক সময় বাসুদেব বলেছেন-হারছড়া তাঁর কাছে রাখলে কোনো ভয় নেই চুরি যাবার।

হুঁ, মিস মালতীর এত সাবধানতা সত্ত্বেও একবার হারছড়া চুরি গিয়েছিলো না অরুণবাবু?

হাঁ গিয়েছিলো।

কিছুক্ষণ পর পুনরায় ফেরত পায় তাই না?

এ কথা আপনি কি করে জানলেন?

আরও জানি—সেইদিনই মালতী নিহত হয়।

আপনি–আপনি—

আমি সব জানি!

মুহূর্তে অরুণ বাবুর মুখমন্ডল ফ্যাকাশে হয়ে যায়। মিঃ লাহিড়ীর মুখে ভাবও বেশ ভাবাপন্না হয়ে ওঠে। ভূ-কুঞ্চিত করে তাকান জনের মুখের দিকে।

জন বলে ওঠে—চলুন মিঃ লাহিড়ী। অরুণ বাবুর কাছে আমার যা জানবার ছিলো জানা হয়ে গেছে।

পুলিশ ইন্সপেক্টার মিঃ লাহিড়ী ও জন হাজত কক্ষ থেকে বেরিয়ে এলো বাইরে।

জন বললো মিস মালতীর পোষ্টমর্টেম রিপোটখানা একটু দেখতে চাই।

মুখোভাব পূর্বের ন্যায় গম্ভীর করে বললেন মিঃ লাহিড়ী—আচ্ছা চলুন।

পুলিশ অফিস থেকে জন যখন ফিরলো তখন ভোর হয়ে গেছে। সূর্যের আলোয় ঝকমক করছে গোটা পৃথিবী।

১৪.

হরশঙ্কর আজকাল নূরীকে নাচ শিক্ষা দিচ্ছে। তার কথামত নাচতে না পারলে চাবুকের আঘাতে জর্জরিত করে তোলে তাকে। নানাভাবে যন্ত্রণা অর কষ্ট দেয়া হয়। অন্যান্য মেয়ের চেয়ে নূরী অনেক সুন্দরী, নূরীকে নাচিয়ে। হরশঙ্কর বেশী পয়সা উপার্জন করবে তাই ওকে মেরেপিটে সুন্দরভাবে নতুন নতুন নাচ শেখাচ্ছে।

নূরীর নাচ শিক্ষা চলছে—আর মনিকে নিয়ে দেখানো হচ্ছে নানা রকম যাদুখেলা। মনিকে নিয়ে শহরে শহরে যায় হরশঙ্কর বহু দূরদেশেও চলে যায়। নৌকা-ষ্টিমারে জাহাজে। কখনও ট্রেনে বা প্লেনেও যায় হরশঙ্কর। সে তো আর সাধারণ যাদু খেলোয়াড় নয়। তার খেলা অতি ভয়ঙ্কর, অতি সাংঘাতিক। পয়সাও পায় সে প্রচুর। দেশ হতে দেশান্তরে তার বিচরণ। হরশঙ্করের অসাধ্য কোনো কাজ নেই। যে যুবক বা যুবতীর সাথে একবার নিভৃতে তার দেখা হয়েছে তাকেই সে মায়াজালের আবেষ্টনীতে আবদ্ধ করে ফেলেছে। বহু বালক-যুবতী-শিশুকে সে ফুসলিয়ে নিয়ে এসে অন্য জায়গায় বিক্রি করে মোটা পয়সা পেয়েছে। যাকে সে বাধ্য করতে পেরেছে বা যাকে দিয়ে পয়সা উপার্জন করা যাবে বলে মনে করেছে তাকে রেখে দিয়েছে নিজের যাদুর প্রাচীরে ঘেরা গহন বনের মধ্যে। যেখানে সাধারণ লোক বা জীবজন্তু প্রবেশে সক্ষম নয়।  

দিন যায়। নূরী সুন্দরভাবে নাচ শিখে ফেলে, অদ্ভুত সে নাচ। সাধারণ নারীর পক্ষে সে ধরনের নাচ অসম্ভব।

হরশংকর একদিন মনিকে সঙ্গে করে প্লেনযোগে রওয়ানা দিলো দূরদেশে। আরাকান, হাবলুন হয়ে একদিন কান্দাই শহরে পৌঁছলো হরশংকর আর মনি। অবশ্য সঙ্গে তাদের আরও কয়েকজন তোক ছিলো-এরা হরশংকরের সঙ্গী বা সাথী।

কান্দাই-এ হই হই রই রই পড়ে গেলো, বিশ্ববিখ্যাত যাদুকর হরশঙ্কর যাদুর খেলা দেখাতে এসেছেন কান্দাই শহরে।

শহরের সেরা থিয়েটার হলে হরশংকর তার খেলা দেখাবেন। বেলা চারটা থেকে টিকিট বিক্রি হচ্ছে। হল লোকে লোকারণ্য।

সন্ধ্যার পর খেলা শুরু হবে।

সংবাদটা একসময় চৌধুরীবাড়ীতেও গিয়ে পৌঁছলো। নকীব একটা বিজ্ঞাপন নিয়ে হাজির হলো মরিয়ম বেগমের সামনে আম্মা, কান্দাই এ একজন খুব নামকরা যাদুকর এসেছে। সে নাকি অনেক অদ্ভুত খেলা দেখায়। একটা ছোট্ট ছেলেকে নিয়ে এসেছে যাদুকর। এই দেখো বাচ্চাটার ছবিও রয়েছে বিজ্ঞাপনে। ছেলেটা বাঘের সঙ্গে লড়াই করবে।

মরিয়ম বেগম বিজ্ঞাপনটা হাতে নিয়ে দেখলেন। সেই যে বনহুর বলে যাবার পর থেকে মনমরা হয়ে গেছেন, দুনিয়ার কোনো কিছুই তিনি মন প্রাণে গ্রহণ করতে পারেন না। মনিরার অবস্থাও মরিয়ম বেগমের চেয়ে কম। নয় কিন্তু তবু সে মনটাকে শক্ত করে নিয়েছিলো; মামীমাও ভেঙ্গে পড়েছেন, সেও যদি মুষড়ে পড়ে তাহলে চলবে কি করে। তার মন বলছে বনহুর বেঁচে আছে, একদিন ফিরে সে আসবে। কিন্তু এসে যদি সে তাদের কাউকে না দেখে সে ফিরে আসার আগেই তারা যদি মরে যায়–না না, বেঁচে থাকতে হবে, মরলে তার চলবে না। তার বনহুর আসবে কত আশা কত বাসনা নিয়ে মনিরার মনে সেই আশার স্বপ্ন তাকে বেঁচে থাকার প্রেরণা যোগায়।

মরিয়ম বেগমকে সান্ত্বনা দেয় মনিরা, মামীমা তুমি হারিয়েছো তোমার সন্তান, আর আমি হারিয়েছি স্বামী-পুত্র দুজনকেই। ভেঙ্গে পড়লে সব শেষ হয়ে যাবে-নিঃশেষ হয়ে যাবে সবকিছু। সে যদি কোনোদিন ফিরে আসে তখন কি হবে? কে তাকে সামলাবে তোমার ছেলে যে বড়ই আঘাত পাবে সেদিন।

মরিয়ম বেগম বলেছিলেন আমার মনির বেঁচে আছে?

হাঁ, মামীমা, মন বলছে সে বেঁচে আছে।

এরপর থেকে মরিয়ম বেগম ভেতরে ভেতরে গুমড়ে কেঁদে মরলেও প্রকাশ্যে আর তেমন করে কাঁদাকাটি করতেন না, পাষাণের মত হৃদয়কে শক্ত করে নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু মনকে কঠিন করলেও অন্তরে দুঃসহ জ্বালা দগ্ধীভূত করছিলো।

আজ নকীব বিজ্ঞাপনটা তার হাতে এনে দিলে তিনি একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে মনিরাকে বললেন—দেখতো কি এটা?

অদূরেই মনিরা বসে কি যেন সেলাই করছিলো। মামীমার কথায় নকীব বিজ্ঞাপনখানা তার হাত থেকে নিয়ে মনিরার হাতে দিয়ে বললো—এক যাদুকর এসেছে খুব সুন্দর খেলা দেখায়।

তাই নাকি? মনিরা বিজ্ঞাপনখানা নকীবের হাত থেকে নিয়ে দেখতে লাগলো। বিজ্ঞাপনে একটা ছোট্ট শিশু একটা বাঘের সঙ্গে লড়াই করছে, বড় ভাল লাগলো ওর কাছে। বললো সেমামীমা, সত্যি বড় অদ্ভুত এতটুকু তিন-চার বছরের একটা ছেলে বাঘের সঙ্গে লড়াই করবে এটা কম কথা নয়। যাবে মামীমা দেখতে?

ওসব আমার ভাল লাগে না মনিরা।

মামীমা, আমার বড় দেখতে ইচ্ছে করছে।

তাহলে সরকার সাহেবকে বলে দাও টিকিট করে আনতে।

মনিরা খুশী হয়ে নকীবকে বললো–সরকার সাহেবকে পাঠিয়ে দাও।

নকীব চলে গেলো।

যাদুর খেলা শুরু হবার অনেক পূর্বেই মামীমা ও সরকার সাহেব সহ মনিরা স্বপ্নরাগ থিয়েটার হলে গিয়ে হাজির হলো। আজ যেন মনিরাকে কোনো মায়ার আকর্ষণ প্রবলভাবে আকর্ষণ করে নিয়ে এসেছে এখানে। কেমন যেন একটা বিপুল আগ্রহ তার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। যাদুকরের বাচ্চা শিশুটাকে দেখবার জন্যই মনিরা ছুটে এসেছে আজ যাদুকরের যাদুখেলা দেখতে।

সামনে ভেলভেটের গভীর লাল পর্দা ঝুলছে। পর্দার ওপর আঁকা শিশু আর বাঘের লড়াইয়ের ছবি। বাঘটা নীচে পড়ে রয়েছে একটি শিশু বাঘটার গলা টিপে ধরেছে। অদ্ভুত দৃশ্য, মনিরার হৃদয়ে একটা অনুভুতি নাড়া দিয়ে যাচ্ছে। ব্যাকুল আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে মনিরা ঐ পর্দার ওপরে কালো কাপড়ে আঁকা ছবির দিকে।

একটা অদ্ভুত ধরনের বাঁশির সুর ভেসে আসছিলো পর্দার ওপাশ থেকে। গোটা হলঘরের মধ্যে সেই সুরের আবেশ মোহ সৃষ্টি করে তুলেছিলো। দর্শকগণ তন্দ্রাচ্ছন্নের মত তাকিয়েছিলো লাল পর্দাটার দিকে।

এমন সময় পর্দা নড়ে উঠলো।

আকুল আগ্রহে তাকালো সবাই সেইদিকে।

ছুরি দিয়ে চিরে দুফাঁক করার মত ধীরে ধীরে দুদিকে সরে গেলো লাল পর্দাটা। সামনে স্পষ্ট দেখা গেলো লম্বা একটা টেবিল। টেবিলে কাপড়ে ঢাকা রয়েছে কোনো একটা জিনিস। টেবিলের পাশে দাঁড়ানো বলিষ্ঠ অদ্ভুত চেহারার একটা লোক। লোকটার শরীরে গাঢ় লাল রঙের কোট-প্যান্ট। সবকিচুই লাল, এমনকি গলার টাইটাও লাল টকটকে! যাদুকরের চোখ দুটোও যেন তার পোশাকের সংগে খাপ খেয়ে গেছে, লাল গোলাকার দুটি চোখ। মাথার ক্যাপ রয়েছে ক্যাপটার দুপাশ দিয়ে যতটুকু চুল বেরিয়ে আছে তাও লাল দেখা যাচ্ছে। লোকটার শরীরের রঙ তামাটে। দক্ষিণ হাতে একটি কঙ্কালের টুকরা।

যাদুকর এবার কঙ্কালের টুকরাখানা নিয়ে উঁচু করে ধরলো। একবার টেবিলে কাপড় ঢাকা জিনিসটার ওপর বুলিয়ে নিয়ে বললো—এই কাপড়ের নিচে কি আছে আপনারা কেউ জানেন না। আমি কাপড়টা তুলে ফেলছি দেখুন–

কাপড়টা তুলে ফেললো, সবাই দেখলো একটি বালিকা মৃতের ন্যায় টেবিলে শায়িত। বালিকা নিদ্রিত না জাগরিত ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।

দর্শকগণ সবাই একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে সেইদিকে। যাদুকর নিদ্রিত বালিকাটিকে পুনরায় কাপড়চাপা দিলো। এবার যাদুকর হাড়খানা নিয়ে একবার কাপড়-ঢাকা বালিকার দেহের ওপর বুলিয়ে নিলো, তারপর কাপড়খানা তুলে ফেললো, আশ্চর্য হয়ে সবাই দেখলো-টেবিল শূন্য-একটি লম্বা বলিশ পড়ে রয়েছে টেবিলটার ওপরে। যাদুকর এবার বালিশটা ঢেকে নিয়ে হাড়খানা বুলিয়ে বললো—আপনারা বালিশটাকে কিসের আকারে দেখতে চান?

একজন দর্শক বলে উঠলো—কুকুরের আকারে।

অন্য সকলেই বললো-হাঁ, আমরা সবাই একমত।

যাদুকর হাসলো, তারপর কাপড় ঢাকা বালিশটার ওপরে হাড়-খানা বুলিয়ে বিড় বিড় করে কি যেন মন্ত্র পাঠ করলো। তারপর তুলে ফেললো কাপড়খানা!

বিস্ময়ের ওপর বিস্ময় সবাই স্তব্ধ দৃষ্টি মেলে দেখলো টেবিলে শুয়ে রয়েছে একটি কুকুর। কাপড়খানা তুলে ফেলতেই কুকুরটা ঝাপটা দিয়ে উঠে দাঁড়ালো।

দর্শকের করতালিতে ভরে উঠলো হলঘর।

আরও বিস্ময়কর অনেক খেলা দেখালো যাদুকর হরশঙ্কর।

হলঘর স্তব্ধ।

দর্শকগণ নির্বাক নয়নে খেলা দেখছিলো, এমন খেলা তারা কোনোদিন দেখেনি।

মনিরা ব্যাকুল আগ্রহে প্রতীক্ষা করছিলো—সেই শিশু বাঘের সঙ্গে লড়াইর দৃশ্যটা দেখবার জন্য।

সবশেষ খেলা সেটা।

সমস্ত দর্শক বিপুল আগ্রহ নিয়ে প্রতীক্ষা করছিলো।

মঞ্চে দাঁড়িয়ে যাদুকর তার বাঁ হাতে সেই কঙ্কালের টুকরাখানা আর দক্ষিণ হাতে একটা চাবুক।

একটা শিস দিলো যাদুকর।

অল্পক্ষণের মধ্যেই একজন বলিষ্ঠ লোক একটা তিন চার বছরের শিশুসহ মঞ্চে উপস্থিত হলো। পেছনে চাকাওয়ালা একটা কাঠের বাক্স টেনে

আনছে আর একজন বলিষ্ঠ লোক।

শিশুটিকে এনে দাঁড় করানো হলো।

দর্শকমন্ডলী একসঙ্গে তাকিয়ে আছে। মনিরা শিশুর দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলো, বিস্মিত হলো সে। হৃদয়ে একটা আলোড়ন শুরু হলো তার। এ মুখখানা যেন তার কোনো পরিচিত মুখের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। এক মাথা সুন্দর কোঁকড়ানো চুল। ছোট্ট দেহ হলেও সুন্দর নধর চেহারা। উজ্জ্বল গৌর বর্ণ। গভীর নীল দুটি চোখ। মনিরা কেমন যেন আনমনা হয়ে যাচ্ছে। নিজেই সে বুঝতে পারছে না তার এমন লাগছে কেন। অপলক নয়নে তাকিয়ে আছে মনিরা শিশুটির দিকে। অভূতপূর্ব একটা আকর্ষণ মনিরাকে হাতছানি দিচ্ছে। প্রবল বাসনা জাগছে তার মনে। একটি বার ঐ শিশুটিকে বুকে নিতে পারলে তার সমস্ত হৃদয় যেন জুড়িয়ে যেতো। কিন্তু মনিরা ভেবে পায় না কেন তার এমন হচ্ছে। ঐ ক্ষুদ্র মুখখানার সঙ্গে তার মনিরের মুখের হুবহু মিল সে যেন খুঁজে পাচ্ছে। না না তার ভুল নেই তার স্বামীর মুখখানাই যেন ঐ শিশুর মুখে লুকিয়ে রয়েছে। মনিরার মনে ভীষণ এক অশান্ত আলোড়ন শুরু হলো।

খেলা শুরু হয়ে গেছে।

যাদুকর একপাশে উদ্যত চাবুক হাতে দন্ডায়মান।

বলিষ্ঠ লোকটা চাকাওয়ালা কাঠের বাক্সটার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।

বাক্সের মধ্যে শিকের ফাঁকে বিরাট বাঘটা হুম হুম করে গর্জন করছে।

দর্শকগণ ভয়ে কম্পিত হলো হঠাৎ বাঘটা যদি তাদের আক্রমণ করে বসে তখন কি হবে! তবু সবাই বুকে সাহস নিয়ে দুচোখে রাজ্যের ব্যাকুল আগ্রহভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো, খেলাটা তাদের দেখতেই হবে।

বলিষ্ঠ লোকটা কাঠের বাক্সের দরজা খুলে দিতে গিয়ে শিশুটিকে হাতের ইশারায় ডাকলো।

শিউরে উঠলো মনিরা, এও কি সম্ভব—এইটুকু কচি শিশু একটা বিরাট বাঘের সঙ্গে লড়াই করবেনা না, এ খেলা সে দেখতে পারবে না। কেন যেন তার বড্ড অস্বস্তি লাগছে।

যাদুকর এগিয়ে এলো, সঙ্গে সঙ্গে কাঠের বাক্সটার দরজাটা মুক্ত করে দিয়ে সরে দাঁড়ালো।

মুহূর্তে বাঘটা গর্জন করে বেরিয়ে এলো।

সঙ্গে সঙ্গে শিশু মনি বাঘটার গলা জাপটে ধরে ফেললো, চড়ে বসলো বাঘের পিঠে দুহাতে বাঘটার গলা চেপে ধরে চাপ দিতে শুরু করলো। শুরু হলো বাঘের সংগে শিশুর লড়াই।

যাদুকর মাঝে মাঝে তার চাবুক উঁচু করে সপাং করে একটা শব্দ করেছিলো বাঘটা তখন মাটিতে চীৎ হয়ে পড়ে যাচ্ছিলো শিশু মনি চেপে বসছিলো তার বুকের ওপর। অনেকক্ষণ ধরে শিশু আর বাঘটার লড়াই চললো—হঠাৎ এক সময় শিশু মনি পড়ে গেলো নীচে, অমনি বাঘটা ঝাপিয়ে পড়লো ওর বুকের ওপর।

দর্শকমন্ডলী হা, হা করে উঠলো–যারা এতক্ষণ স্তব্ধ নিঃশ্বাসে শিশু আর বাঘের খেলা দেখে হতবাক–অবাক হচ্ছিলো তারা আর্তনাদ করে উঠলো এবার।

সঙ্গে সঙ্গে মনিরা দুহাতে চোখ ঢেকে ফেললো।

তারপর আর কিছু মনে নেই মনিরার।

যখন মনিরার সংজ্ঞা ফিরে এলো, তখন সে দেখলো তার নিজের কক্ষে বিছানায় সে শুয়ে আছে। শিয়রে বসে রয়েছেন মরিয়ম বেগম দুচোখে তার রাজ্যের আকুলতা আর উদ্বিগ্নতা। একপাশে দাঁড়িয়ে বৃদ্ধ সরকার সাহেব ও নকীব। পাশে একটা চেয়ারে বসে ডাক্তার।

মনিরা চোখ মেলেই বলে উঠলো—মামীমা!

বলো মা?

আমার নূর কেমন আছে?

নূর! নূর কোথায়?

মনিরা তার হারিয়ে যাওয়া শিশু নূরের সম্বন্ধে মরিয়ম বেগমের নিকটে অনেক কথাই বলেছিলো। নূর কেমন আছে বলতেই মরিয়ম বেগম বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বললেন—কোথায়, কোথায় তোমার নূর মনিরা?

মনিরা চারদিকে তাকিয়ে দেখে বললো—ঐ যে বাঘের সঙ্গে লড়াই করছিলো!

সে তো যাদুকরের ছেলে।

না, আমার নূর ছাড়া সে অন্য কেউ নয়! মামীমা, তুমি দেখোনি সেই মুখ সেই চোখ দক্ষিণ বাজুতে সেই অদ্ভুত চিহ্ন—মামীমা, আমার নূর ছাড়া সে অন্য কেউ নয়। বলো বলো মামীমা সে বেঁচে আছে-বাঘটা তাকে মেরে ফেলেনি তো?

নারে না, তুই অমন হয়ে পড়লি—তোকে নিয়েই আমরা অস্থির হয়ে পড়লাম-ওদিকে দেখবার সময় ছিলো না।

তাহলে তোমরা জানো আমার নূরের কি হলো?

ডাক্তার গম্ভীর কণ্ঠে বললেন—আপনি চুপ করে থাকুন। এখন বেশী কথা বললে খারাপ হবে।

না, আমি চুপ করে থাকতে পারবো না, আগে বলুন আমার নূর কেমন আছে?

কোথায় আপনার নূর? সে তো যাদুকরের ছেলে।

না, সে আমার নূর। কি করে বুঝলেন সে আপনার নূর?

আমি চিনবো না, আমার নূরকে চিনবো না সেই মুখ সেই চোখ, দক্ষিণ বাজুতে সেই চিহ্ন-আমার নূর ছাড়া ও আর কেউ নয়।

ডাক্তার এবারও বললেন–হুঁ, সে সুস্থ আছে।

সত্যি বলছেন?

হাঁ।

সেদিনের পর থেকে মনিরা কেমন যেন আনমনা হয়ে পড়লো, সব সময় যাদুকরের যাদুখেলা দেখতে যাবার জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠে।

কিন্তু মরিয়ম বেগম কিছুতেই তাকে যাদুখেলা দেখতে যাবার অনুমতি দিলেন না। মরিয়ম বেগমের বিশ্বাসমনিরা তার নিজের সন্তানের মত চেহারার ছেলেকে দেখে অমন আত্মহারা হয়ে পড়েছে! আসলে ওর ছেলে কোথায় হারিয়ে গেছে, এতটুকু ছেলে বেঁচে আছে না মরে গেছে তাই বা কে জানে। মনিরার এই ব্যথা করুণ ভাব মরিয়ম বেগমকেও বেশ চঞ্চল করে তুললো। মরিয়ম বেগম মনিরাকে যতই সাবধানে রাখুন না কেন একদিন সকলের অলক্ষ্যে মনিরা একটা টেক্সি ডেকে বেরিয়ে পড়লো।

খেলা শুরু হবার পূর্বে স্বপ্নরাগ হলের সামনে অসংখ্য ভীড় জমে উঠেছে। রাস্তার অগণিত গাড়ী সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে আছে। শহরের সেরা লোকজনও বাদ যায়নি হরশংকরের যাদু খেলা দেখা থেকে।

মনিরার গাড়ী এসে থামলো স্বপ্নরাগ হলের সামনে, গাড়ীর ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে নেমে পড়লো মনিরা। জনস্রোতের মধ্যে মিশে গেলো সে।

অতি সন্তর্পণে আত্মগোপন করে হরশংকরের বিশ্রামকক্ষে প্রবেশ করলো মনিরা। হরশংকর তখন মঞ্চে যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। অদূরে একটা শয্যায় শায়িত শিশু মনি একটা কিছু নিয়ে খেলা করছে সে। মনিরা লুকিয়ে পড়লো এক পাশের একটা খামের আড়ালে। হরশংকর এবার বেরিয়ে গেলো, যাবার সময় শিশু মনিকে লক্ষ্য করে বললো সেমানু, ঘুমাবে না খবরদার।

মনি ভয়ার্ত কণ্ঠে বললো—না, আমি ঘুমাবো না।

হরশংকর বেরিয়ে গেলো।

শিশু মনি শয্যায় বসে হাই তুলতে লাগলো—দ্বিপ্রহরে একটা শো হয়ে গেছে। মনি ক্লান্ত হয়েছে–এলিয়ে পড়ছে তার ছোট্ট শরীরটা। কিন্তু হরশংকরের ভয়ে সে ঘুমাতে পারছে না। ছোট মনি কতক্ষণ নিদ্রাহীন। থাকতে পারে কতক্ষণই বা হরশংকরের চাবুকের কথা তার স্মরণ থাকে একসময় হাতের খেলনাটা খসে পড়লো একপাশে, মনি এলিয়ে পড়লো বিছানায়।

ওদিকে হরশঙ্করের যাদুখেলায় মুগ্ধ দর্শকবৃন্দের করতালিতে হলঘর মুখরিত।

এদিকে বিশ্রামকক্ষ থেকে হরশঙ্করের সাথীগণ সবাই ওদিকে চলে গেছে, একা মনি শয্যায় কাৎ হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।

মনিরা এতক্ষণ ধৈর্য ধরে দাঁড়িয়ে প্রতীক্ষা করছিলো এই মুহূর্তটির। এবার সে অতি লঘু পদক্ষেপে এগিয়ে গিয়ে মনির শয্যার পাশে দাঁড়ালো ঝুঁকে পড়ে দেখতে লাগলো মুনির মুখখানা। তারপর অতি সন্তর্পণে মনির দক্ষিণ হাতখানা উঁচু করে ধরলো চোখের সামনে এই তো সেই স্মরণীয় চিহ্ন যা আজও তার মনের পাতায় গভীরভাবে আঁকা হয়ে রয়েছে। মনিরা অতি ধীরে ধীরে মনির হাতখানা নামিয়ে রাখলো। পেয়েছে সে তার বহু দিনের হারানো রত্নকে। মনিরা কিছুতেই নিজকে সংযত রাখতে পারলো নালঘু হস্তে বুকে তুলে নিলো মনিকে।

কদিন অবিরত খেলা দেখিয়ে মনির শিশু দেহ ক্লান্তিতে অবসন্ন হয়ে পড়েছিলো, মনিরার কোমল হস্তের পরশে তার ঘুম ভাঙলো না।

মনিরা শিশু মনিকে বুকে তুলে নিতেই দরজার বাইরে কারও পদশব্দ শোনা গেলো।

মনিরা এই মুহূর্তে সম্বিৎ হারালো না, সে দ্রুত এবং অতি সন্তর্পণে দরজার একপাশে আত্মগোপন করলো।

একজন বলিষ্ঠ লোক প্রবেশ করলো সেই কক্ষে।

শিউরে উঠলো মনিরা এই মুহূর্তে যদি লোকটা তার অবস্থিতি জান? পারে তাহলে আর রক্ষা নেই নূরকেও হারাবে, নিজেও বিপদে পড়বে। মনিরা খোদার নাম স্মরণ করতে লাগলো।

লোকটা যেমনি ওপাশে মনির বিছানার দিকে এগিয়ে গেছে ঠিক সেই সময় মনিরা দরজার পাশ থেকে বেরিয়ে গেলো বাইরে। তারপর অতি আলগোছে আত্মগোপন করে একটা গাড়ীর পাশে এসে দাঁড়ালো। চারদিকে নজর বুলিয়ে নিয়ে ড্রাইভারকে বললো—ভাড়া যাবে?

ড্রাইভার বললো–হাঁ মাজী। আপ যাওগী?

হাঁ চলো। মনিরা শিশু মনিকে নিয়ে গাড়ীতে উঠে বসলো।

ড্রাইভার স্টার্ট দিলো গাড়ীতে। গাড়ী এবার উল্কাবেগে ছুটতে লাগলো।

ঘুম ভেঙে গেলো মনির গাড়ীর ভেতরে অন্ধকার থাকায় সে কিছুই দেখতে না পেলেও অবাক হলো বললো—আমাকে তোমরা কোথায় নিয়ে যাচ্ছো?

মনিরা বললো–বাড়ীতে।

তুমি কে? কচি মনি স্পষ্ট কণ্ঠে প্রশ্ন করে বসলো।

আমি-আমি তোর মা!

না, আমার মা তুমি নও। তুমি কে আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো?

গিয়ে দেখো বাবা।

এদিকে যখন মনিকে নিয়ে মনিরা গাড়ীতে ছুটে চলেছে, তখন স্বপ্নরাগ থিয়েটার হলের হরশঙ্করের বিশ্রামকক্ষে হুলস্থুল পড়ে গেছে। তাদের খেলার শিরোমণি মানু নেই।

হরশঙ্কর মনির নাম রেখেছিলো মানু।

মানুর অন্তর্ধানে হইহুল্লোড় পড়ে গেলো, হরশঙ্কর রাগে বোমার মত ফেটে পড়লো। তাজ্জব ব্যাপার—এত সতর্কতার মধ্যেও কি করে মানু হারালো! কোথায় গেলো, কে তাকে নিয়ে গেলো?

সেদিন আর তেমন করে খেলা জমলো না।

ওদিকে মনিকে নিয়ে মনিরার গাড়ী চৌধুরী বাড়ীর গাড়ী বারান্দায় পৌঁছতেই শশব্যস্তে ছুটে এলেন সরকার সাহেব ও নকীব।

মনিরা ততক্ষণে মনিকে কোলে করে গাড়ী থেকে নেমে দাঁড়িয়েছে। তাড়াতাড়ি ব্যাগ খুলে দশ টাকার কয়েকটা নোট ড্রাইভারের হাতে গুঁজে দিয়ে দ্রুত অন্তপুরে প্রবেশ করলো।

সরকার সাহেব ও নকীব হতবাক হয়ে অনুসরণ করলো তাকে। সরকার সাহেব শিশুটিকে দেখেই চিনতে পেরেছিলেন, এই শিশুই কাল রাতে তাদের সকলের সামনে একটা বিরাট বাঘের সঙ্গে লড়াই করেছিলো।

আগে আগে চলেছে মনিরা কোলে তার শিশু মনি।

পেছনে বিস্ময়ভরা চোখে এগুচ্ছে সরকার সাহেব ও নকীব।

মনিরা ছুটে এলো মামীমার কক্ষে—মামীমা, দেখো দেখো কে এসেছে!

মনিরার কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়েই মরিয়ম বেগম ব্যস্তভাবে এগিয়ে এলেন। মনিরার দিকে তাকিয়ে তার কোলে গত রাতের সেই শিশুটিকে দেখতে পেয়ে স্তব্ধ হয়ে গেলেন। বিস্ময়ের ঘোর কাটতেই বললেন-—একে তুই কোথায় পেলি মনিরা?

মামীমা, এ যে আমার নূর। একে তুমি চিনতে পারছো না?

পাগলী মেয়ে, তোর নূরকে হারিয়েছিস ছোট এক বছরের শিশু আর একে তুই চিনলি কি করে?

এই দেখো–মামীমা, মনির কচি হাতখানা তুলে ধরলো। এই সেই চিহ্ন যা আজও আমি ভুলতে পারিনি।

মরিয়ম বেগমের চোখের সামনে আর একটি কচি বাহু ভেসে উঠলো। আতুর ঘরে তার নিজের সন্তান মনিরের বাহুখানা। দাইমা নবজাত শিশুটিকে কোলে তুলে নিয়ে বলেছিলো—বেগম সাহেবা, আপনার ভাগ্য অতি প্রসন্ন। রাজটিকা নিয়ে রাজকুমার এসেছে আপনার ঘরে। এ মস্ত একজন হবে —মরিয়ম বেগম আজ সেই কথা স্মরণ করেন। এ যে তার দক্ষিণ বাহুর সংকেত চিহ্ন–তবে কি, তবে কি এটাই তার বংশের প্রতীক তার মনিরের সন্তান, মরিয়ম বেগম তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে দেখতে লাগলেন ওকে। হঠাৎ মরিয়ম বেগম অস্ফুট ধ্বনি, করে উঠলেন-মনিরা তোর হারানো ধন ফিরে পেয়েছিস সেই মুখ, সেই চোখ, সেই নাক, আমার মনিরের সব চেহারাই পেয়েছে–

শিশু মনি এসব দেখে হাবা বনে গেছে। অবাক হয়ে দেখছে এসব। ছোট্ট হলেও তার মন বা হৃদয় বলে তো একটা জিনিস আছে। শিশুকাল থেকে সে বন বাদাড়েই মানুষ হয়েছে সভ্য সমাজে মিশবার তেমন সুযোগ হয়নি এখনও। চৌধুরীবাড়ীর সাজসজ্জা, বিরাট বাড়ী নানা রকমের আসবাবপত্র আলোর ঝড় কত রকমের কারুকার্যখচিত ফুলদানি এসব শিশু মনির চোখে রাজ্যের বিস্ময় জাগালো। সে অবাক হয়ে তাকিয়ে সব দেখতে লাগলো।

মনিরা মনিকে পেয়ে আকাশের চাঁদ যেন হাতে পেলো। সর্ব প্রথম মনিকে নিয়ে ছুটে গেলো মনিরা বনহুরের ছোট বেলার ফটোখানার পাশে। মনিকে দাঁড় করিয়ে বার বার তাকিয়ে দেখতে লাগলো বনহুরের ছোটবে–চেহারাখানা আর শিশু মনিকে। ডাকলো মামীমা, দেখে যাও। দেখে যা এসে, দেখে যাও এসে।

মরিয়ম বেগম এলেন, সন্তানের ছবির পাশে মনিকে দেখে অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন তারপর জড়িয়ে ধরলেন মনিকে বুকের মধ্যে–দাদু! ওরে আমার নয়নের মনি, হৃদয়ের ধন–মরিয়ম বেগমের চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগলো ফোঁটা ফোঁটা অশ্রুবিন্দু।

মনিরার চোখও শুষ্ক ছিলো না, স্বামীর কথা স্মরণ করে বুকটা তার ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছিলো।

যাদুকর হরশংকর, তার অমূল্য রত্ন মনিকে হারিয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো। যাদুর খেলা বন্ধ করে দিয়ে শহরময় চষে বেড়াতে লাগলো কোথায় তার মানু।

কখনও সাপুড়ের বেশে, কখনও বানর খেলোয়াড়ের ছদ্মবেশে, কখনও বা ভিখারীর বেশে হরশঙ্কর শহরের আনাচে কানাচে প্রতিটি বাড়ীতে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। কখনও বা নানা রকমের খেলনা নিয়ে বিক্রি করতো শহরের পথে পথে।

হরশংকরের চাতুরি মনিরার সুতীক্ষ্ণ বুদ্ধির কাছে পরাজিত হলো। কত সাধনা আর আরাধনার পর মনিরা তার নূরকে ফিরে পেয়েছে। এক মুহূর্ত মনিরা তার সন্তানকে নিজের কাছছাড়া করতো না। মনিরা জানতো, যাদুকর নূরকে হারিয়ে ভীষণ উদ্বিগ্ন ও উন্মত্ত হয়ে পড়বে কারণ তার সেরা খেলাটাই সে নূরকে দিয়ে দেখাতো। তাই নূর ওর অমূল্য সম্পদ। নিশ্চয়ই যাদুকর নূরের সন্ধানে শহরটাকে তন্ন তন্ন করে চষে ফেলবে। তাই মনিরা যতদূর সম্ভব নূরকে সাবধানে রাখতে চেষ্টা করতো।

মনিরা যখন সন্তানকে নূর বলে ডাকলো তখন সে কোনো জবাব দিলো না, মনিরা তাই ওকে জিজ্ঞাসা করেছিলো বাবা তোমাকে কি বলে ডাকতো ওরা?

কচি মুখে ভাঙ্গা ভাঙ্গা কন্ঠে জবাব দিয়েছিলো সে—মাম্মা আমাকে মনি বলে ডাকতো।

আর যাদুকর?

ঐ দাদা? যাদুকরকে নূর দাদা বলে ডাকাতো।

হাঁ, দাদা তোমায় কি বলে ডাকাতো?

দাদা ডাকতো মানু বলে।

মনিরা ওকে বুকে চেপে ধরে বললো তুমি আমার নূর। আমি তোমার নাম রেখেছিলাম নূর!

মাথা কাৎ করে বললো নূর–আচ্ছা।

অনেক সন্ধান করেও হরশংকর আর মানুকে খুঁজে পেলো না। শহরের নানা জায়গায় খুঁজে খুঁজে হয়রাণ পেরেশান হয়ে গেলো সে।

প্রায় এক সপ্তাহকাল কান্দাই শহর চষে ফিরে ক্লান্ত অবসন্ন হরশংকর, একদিন ফিরে চললো নিজের দেশে, যেখানে নূরী অহরহ চোখের পানিতে বুক ভাসাচ্ছে সেই গহন বনে।

হরশংকরকে দেখে ছুটে এলো নূরী-অনি, আমার মনিকে আমায় ফিরিয়ে দাও। আমি ওকে না দেখলে মরে যাবো যে!

হরশংকর অন্যদিন হলে অট্টহাসি হেসে উঠতো। আজ যেন সে হাসতে পারলো না, কেমন গম্ভীর মুখে বসে রইলো নিশ্চুপ হয়ে।

এরপর হরংশংকর নূরীকে নিয়ে বের হবে মনস্থ করলো। এবার যাদুর খেলা স্থগিত রেখে চলবে নাচ-গান এতেই মোটা পয়সা উপার্জন হবে তার। আর দূরদেশে নয়, নিজ দেশের মধ্যেই চালাবে সে তার ব্যবসা।

১৫.

পুলিশ অফিস।

জন গাড়ী রেখে নেমে পড়লো। পুলিশ অফিসে প্রবেশ করতেই মিঃ লাহিড়ী এবং মিঃ রায় তাকে অভ্যর্থনা জানালেন। অসময়ে জনকে পুলিশ অফিসে দেখে মিঃ লাহিড়ী কিছুমাত্র অবাক হলেন না, কারণ জন এমন আচম্বিতে আরও অনেক দিন পুলিশ অফিসে এসে হাজির হয়েছে। এটা যেন তার স্বভাব আর কি!

আজও মিঃ রায় এবং মিঃ লাহিড়ী কিছুমাত্র অবাক না হয়ে তাকে বসতে অনুরোধ জানালেন।

জন আসন গ্রহণ করেই বললো–এক্ষুণি আপনাকে আমার সঙ্গে যেতে হবে মিঃ লাহিড়ী।

কোথায়? জিজ্ঞাসা করলেন মিঃ লাহিড়ী।

পরে সব জানতে পারবেন। আপনার সঙ্গে মিঃ রায় ও কয়েক জন পুলিশ থাকবে।

মিঃ লাহিড়ী গম্ভীর কণ্ঠে বললেন—আপনার হেঁয়ালিভরা কথা অটে কিছু বুঝতে পারছি না মিঃ জন।

একটু হেসে বললো জনমালতী হত্যারহস্য আজ উদ্ঘাটন করতে চাই মিঃ লাহিড়ী। আজ আপনি খুনীকে গ্রেপ্তারে সক্ষম হবেন।

হোয়াট?

ইয়েস, ইন্সপেক্টার! আপনি বিলম্ব না করে এই মুহূর্তে তৈরী হয়ে নিন।

মিঃ লাহিড়ী মিঃ রায়ের দিকে লক্ষ্য করে বললেন—কয়েকজন পুলিশসহ তৈরী হয়ে নিন মিঃ রায়, মিঃ জনের সঙ্গে বেরুবো।

জন নিজেই ড্রাইভ করে চললো তার গাড়ীখানা। জনের গাড়ীতে মিঃ লাহিড়ী আর মিঃ রায়। পেছনে একটি পুলিশ ভ্যান—কয়েকজন পুলিশ রয়েছে তাতে!

শহরের বড় রাস্তা ধরে গাড়ীখানা উল্কাবেগে ছুটে চললো।

রাত প্রায় বারোটা হবে!

পথের জনতা অনেক কমে এসেছে।

দোকানপাট কতকগুলো বন্ধ হয়ে গেছে ইতিমধ্যে।

একটা স্বর্ণকারের দোকানের অদুরে এসে জন গাড়ী থামিয়ে ফেললো।

পূর্বেই বলা ছিলো জনের গাড়ীর প্রায় বিশ গজ দূরে পুলিশ ভ্যান থামাবে ঠিক তাই থেমে পড়লো।

জন মিঃ লাহিড়ীকে লক্ষ্য করে বললো—আপনারা বাইরে অপেক্ষা করুন আমি স্বর্ণকারের দোকানে প্রবেশ করবো। খুনী এই দোকানে অপেক্ষা করছে।

মিঃ লাহিড়ী বললেন খুনীর উপযুক্ত প্রমাণ না পেলে আপনাকে কৈফিয়ত দিতে হবে মিঃ জন।

নিশ্চয়ই দেবো মিঃ লাহিড়ী। কথা শেষ করে জন স্বর্ণকারের দোকানে। প্রবেশ করলো।

মিঃ লাহিড়ী এবং মিঃ রায় ওদিকের জানালার শার্শির পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। সেখান থেকে কক্ষের ভেতর পরিস্কার সব দেখা যাচ্ছিলো। মিঃ লাহিড়ী চমকে উঠলেন, স্বর্ণকারের দোকানে মিঃ বাসুদেব শর্মা।

এত রাতে নিহত মালতীর পিতা বাসুদেব স্বর্ণকারের দোকানে কি করছে? ভাল করে লক্ষ্য করতেই বিস্ময় জাগলো মিঃ লাহিড়ী এবং মিঃ রায়ের মনে।

বাসুদেব কোনো একটা জিনিস স্বর্ণকারের হাতে দিতে যাচ্ছিলেন ঠিক সেই মুহূর্তে জন সেখানে উপস্থিত হলো।

বাসুদেব জনকে লক্ষ্য করতেই জিনিসটা লুকিয়ে ফেললেন জামার পকেটে। কিন্তু জন সেটা দেখে ফেললো।

বাসুদেব জনকে দেখেই উঠতে যাচ্ছিলো।

জন রিভলবার উদ্যত করে ধরলো–খবরদার পালাতে চেষ্টা করবেনা।

বাসুদেব বিবর্ণ ফ্যাকাশে মুখে পুনরায় বসে পড়লেন।

জন উচ্চকণ্ঠে ডাকলো—ইন্সপেক্টার!

মিঃ লাহিড়ী এবং মিঃ রায় কক্ষে প্রবেশ করলেন।

স্বর্ণকার ফ্যালফ্যাল করে তাকাতে লাগলেন।

বাসুদেব বললেন–আমাকে এভাবে জব্দ করছো কেন জন?

জব্দ নয় মিঃ শর্মা, আপনাকে সম্মান দেখাতে এসেছি। প্রথমে জবাব দিন-এত রাতে এখানে কেন, কি কারণে এসেছেন?

বাসুদেব ঢোক গিলে জবাব দিলেন——আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার তোমাকে জানাতে রাজী নই।

ঠিক সেই মুহূর্তে ওদিক থেকে কাফ্রি লোকটা সরে পড়তে যাচ্ছিলো, জন ইংগিত করলো মিঃ রায়কে-ওকে লক্ষ রাখবেন যেন না পালায়।

মিঃ রায় মুহূর্তে সজাগ হয়ে দাঁড়ালেন, তার হাতেও পিস্তল ছিলো।

কাফ্রি চাকরটা কাঁচুমাচু মুখে বসে পড়লো বেঞ্চের ওপরে।

মিঃ লাহিড়ী অবাক হয়েছেন বাসুদেব মালতীর পিতাতাকে এরকম অপদস্ত করার কি মানে হয়ই তিনি যেন কিছু বুঝতে পারছেনা গম্ভীর মুখে তিনি দাঁড়িয়ে সব লক্ষ্য করতে লাগলেন।

মিঃ শর্মা ব্যক্তিগত ব্যাপার হলেও পুলিশের কাছে আপনাকে তা জবাব দিহি করতে হবে।

মিঃ লাহিড়ী বললেন—হাঁ, আপনাকে যখন যা জিজ্ঞাসা করা হবে সঠিক জবাব দেবেন আশা করি।

নিশ্চয়ই দেবো ইন্সপেক্টার।

জন দৃঢ়কণ্ঠে বললো—মালতীর হত্যাকারী স্বয়ং বাসুদেব।

বাসুদেব বিবর্ণ মুখে কম্পিত কণ্ঠে বললেন—মিথ্যা কথা!

জন বলে উঠলো–সম্পূর্ণ সত্য, আপনিই তাকে হত্যা করেছেন মিঃ শর্মা।

মিঃ লাহিড়ী বললেন—তার প্রমাণ?

প্রমাণ আছে মিঃ লাহিড়ী। তার পূর্বে আমি জানাতে চাই–মিস মালতী বাসুদেবের কন্যা নয়। বললো জন।

বাসুদেব ফেটে পড়লেনমালতী আমার কন্যা এ কথা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না।

মিঃ শর্মা, আপনার ঐ কাফ্রি চাকর বারো বছর আগে পাঁচ বছরের এত শিশুকন্যাকে চুরি করে এনে দেয়নি?

মিথ্যা—সব মিথ্যা! বাসুদেব যেন ফেটে পড়লেন।

জন এক টানে কাফ্রি চাকরটাকে সরিয়ে এনে তার বুকে রিভলবার চেপে ধরলো—বলো, মিস মালতী কার মেয়ে?

কাফ্রি চাকর একবার বাসুদেবের মুখে তাকিয়ে পুনরায় ফিরে তাকায় নিজের বুকে ঠেকানো রিভলবারের ডগায়।

জন বললোসঠিক জবাব না দিলে এই মুহূর্তে তোমাকে হত্যা করবো।

কাফ্রি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকালো কিছু বলতে গেলো, কিন্তু বাসুদেবের দিকে তাকিয়ে থেমে গেল সে।

মিঃ লাহিড়ী জনের এই আচরণে খুশী হতে পারছিলো না। কিন্তু নিশ্চুপ হয়ে দেখা ছাড়া উপায়ও ছিলো না কিছু বলার।

জন বললোআর দুমিনিট সময় দিলাম।

কাফ্রি এবার বলে উঠলো—হাঁ, আমি বারো বছর আগে মালতীকে চুরি করে এনেছিলাম।

কার মেয়ে সে? বললা, নচেৎ–

এক পুলিশ ইন্সপেক্টারের মেয়ে, ওর বাবার নাম যতীন্দ্র মোহন রায়।

আচম্বিতে বৃদ্ধ মিঃ রায় প্রতিধ্বনি করে উঠলো—যতীন্দ্র মোহন রায়ের কন্যা মালতী? বারো বছর আগে আমার প্রথমা কন্যা মাধুরী পাঁচ বছরের শিশু বাইরের বারান্দা থেকে হারিয়ে গিয়েছিলো সেই কামান্না শহর থেকে,

কাফ্রি বলে উঠলোহা বাবু, ওকে আমি কামান্না শহর থেকেই চুরি করে এনেছিলাম।

মিঃ রায় ছুটে এসে কাফ্রির গলাটিপে ধরলেন–ওরে শয়তান, নর পিচাশ…তুই আমার মাধুরীকে…।

জন মিঃ রায়কে ছাড়িয়ে দিয়ে বললেন—যা হবার হয়ে গেছে মিঃ রায়, এখন পূর্বের সেই শোক বিস্মৃত হয়ে নতুনভাবে এর বিচার করুন। এবার আপনারা স্পষ্ট বুঝতে পারছেন, মিস মালতী বাসুদেবের কন্যা নয়।

বাসুদেব নতমুখে বসে রইলেন।

মিঃ লাহিড়ীর চোখ দুটি তীব্র উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে, বললেন—আশ্চর্য!

জন এবার বললো—এবার বুঝতে পারছেন? আরও পারবেন একটু পরে।

মিঃ লাহিড়ী পুনরায় বললেন কিন্তু মিস মালতীকে বাসুদেব যে হত্যা করেছে তার প্রমাণ?

প্রমাণ আছে মিঃ লাহিড়ী।

হঠাৎ বাসুদেব বলে উঠেন—তুমি তাকে হত্যা করেছে জন। যে হীরার হার তুমি তাকে দিয়েছিলে সেটা ফিরিয়ে নেবার জন্যই তুমি তাকে হত্যা করেছো এবং হার নিয়ে গেছো।

মিস মালতীকে যে হত্যা করেছে, সেই হার তার নিকটেই আছে একথা সত্য।

বাসুদেব কেমন যেন শিউরে উঠলেন। একটু নড়েচড়ে বসলেন তিনি।

মিঃ রায় বিষণ্ণ মুখে দাঁড়িয়েছিলেন, বার বার ঐ কাফ্রি চাকরটার দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকাচ্ছিলেন—এই মুহূর্তে কেউ বাধা না দিলে ওকে তিনি গলা টিপে হত্যা করতেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আজ সেই বারো বছর আগে হারিয়ে যাওয়া পাঁচ বছরের একটি শিশুকন্যার মুখ বার বার ভেসে উঠছিলো তাঁর চোখের সামনে। মিঃ রায় দাঁতে অধর দংশন করছিলেন।

জন এবার বাসুদেবকে টেনে তুলে দাঁড় করিয়ে দিলো এবং পর মুহূর্তেই তার পকেটে হাত দিয়ে একছড়া হীরার হার বের করে আনলো। এতোদ্রুত হস্তে এ কাজ করলো জন অবাক হলেন মিঃ লাহিড়ী।

জনের চোখে আজও সেই কালো চশমা রয়েছে, যা সে কোনো সময়ের জন্যও চোখ থেকে খোলে না।

জন সেই হারছড়া হাতে নিয়ে উঁচু করে ধরলো—এই হার ছাড়াই মালতীর মৃত্যুর কারণ।

অস্ফুট ধ্বনি করে উঠলেন মিঃ লাহিড়ী-বাসুদেব তাহলে….

হাঁ, বাসুদেবই মালতীর হত্যাকারী।

মিথ্যা কথা। মালতী আমার কন্যা না হলেও তাকে আমি কন্যার মতই স্নেহ করতাম। কথা কয়টি বললেন বাসুদেব।

জন বললো—মালতীর মৃত্যুর পূর্বেও এ হার তার কণ্ঠে ছিলো। মিঃ লাহিড়ী, নিহত মালতীর কণ্ঠে যে আঁচড়ের দাগ পাওয়া গেছে তা এই ছিন্ন হারের।

বাসুদেব আবার বললেন, এ হার মৃত্যুকালে মালতীর কণ্ঠে ছিলো, এটা সে মৃত্যুর কদিন আগে আমাকে রাখতে দিয়েছিলো।

না, এ হার মালতীর মৃত্যুর পূর্বেও তার কণ্ঠে ছিলো এবং এই হারের জন্যই তাকে হত্যা করা হয়েছে। জন হারছড়া স্বর্ণকারের হাতে দিয়ে বললো—দেখুন তো এটা নিখুঁত আছে কিনা?

স্বর্ণকার হারছড়া পরীক্ষা করে বললোনা, এটা নিখুঁত নেই। এট, থেকে একটি হীরা নেয়া হয়েছে।

বাসুদেব ফ্যাকাশে মুখে কিছু বলতে গেলো কিন্তু পারলো না।

হারখানা যখন মালতীর কণ্ঠ থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয় তখন মালতী নিজের দক্ষিণ হাত দিয়ে হারছড়া চেপে ধরেছিলো, তবু সেটা ছিনিয়ে নেয়া হয়েছিলো এবং হারের একটি পাথরসহ খানিকটা চেন মালতীর হাতের মুঠায় আবদ্ধ হয়ে রয়েছিলো।

 মিঃ লাহিড়ী বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বললেন—কিন্তু কই, মৃত মালতীর হাতের মুঠোয় কোনো পাথর খন্ড বা কোনো চেন পাওয়া যায়নি তো?

আপনারা সেখানে পৌঁছবার পূর্বেই এক ব্যক্তি সেখানে পৌঁছেছিলো এবং মিস মালতীর হাতের মুঠা থেকে সে ঐ পাথরটা সরিয়ে নিয়েছিলো!

বাসুদেব এবার রাগতকণ্ঠে বললেন—মিথ্যা, সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। মৃত মালতীর হাতে কোনো হীরক হারের অংশ ছিলো না ইন্সপেক্টার।

মিঃ লাহিড়ী বললেন—এ কথা আপনি কি করে জানলেন মিঃ জন?

আমি সেই ব্যক্তি। এই দেখুন মিঃ লাহিড়ী…মিঃ জন পকেট থেকে একটি হীরা ও কিছুটা চেন বের করে বললো—এটাই ছিলো মিস মালতীর হাতের মুঠোয়।

মুহূর্তে বাসুদেবের মুখমন্ডল অমাবস্যার অন্ধকারের মত হয়ে উঠলো।

জন বলে চলেছে—হীরার হারখানা সম্পূর্ণ নিতে পারেনি খুনী, একখানা হীরা মালতী আঁকড়ে ধরে রেখেছিলো। আর হাঁ, মালতী শেষ পর্যন্ত খুনীকে চিনতে পেরেছিলো এবং সেই কারণেই খুনী তাকে হত্যা করেছে। সেই খুনী

অন্য কেউ নয়, মালতীর পিতার রুপধারী বাসুদেব শর্মা।

মিঃ জনের কথা শেষ হতে না হতে মিঃ লাহিড়ী পকেট থেকে বাঁশী বের করে ফুদিলেন, সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন পুলিশ কক্ষে প্রবেশ করলো। মিঃ লাহিড়ী বললেনবাসুদেবকে গ্রেপ্তার করো!

সঙ্গে সঙ্গে বাসুদেবের হাতে হাতকড়া লাগিয়ে দেওয়া হলো। কাফ্রি চাকরটা সেই সুযোগে পালাতে যাচ্ছিলো, মিঃ রায় তার ওপর বাঘের মত লাফিয়ে পড়লেন, তৎক্ষণাৎ তাকেও এরেষ্ট করা হলো।

মিঃ লাহিড়ী এবার বললেন মিঃ জন, আপনি সেদিন ওখানে যাবার কারণ কি?

আমি মালতীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলাম, কিন্তু তার একটু পূর্বেই তাকে হত্যা করা হয়েছিলো। আমি জানতাম সেই মুহূর্তে সত্যি কথা বললেও আপনারা কেউ আমাকে বিশ্বাস করতে পারতেন না বরং উল্টো আমাকে গ্রেপ্তার করে আটকে রাখতেন। তাই আমি হীরার হারটি মৃত  মালতীর হাতের মুঠো থেকে খুলে নিয়ে আত্মগোপন করেছিলাম এবং শপথ শ্ৰহণ করেছিলাম মালতীর হত্যাকারীকে খুজে বের করবো। হত্যাকারীকে আবিষ্কার করতে গিয়ে আপনাদের অনেক সময় অসন্তুষ্টির কারণ হয়ে পঁড়িয়েছি, আমাকেও আপনারা খুনী বলে সন্দেহ করেছেন তাতেও আমি কিছুমাত্র উদগ্রীব বা বিচলিত হইনি।

মিঃ লাহিড়ী লজ্জ্বিত কণ্ঠে বললেন–আপনার অনুমান সত্য মিঃ জন, আমি সন্দেহপরবশ হয়ে বহু সময় আপনাকে অনুসরণ করেছি।

জন বললো—মিঃ লাহিড়ী, অরুণ বাবু সম্পূর্ণ নির্দোষ। তাকে অযথা বন্দী করে রেখেছেন। সে মালতী হত্যা ব্যাপারে ঘাবড়ে গিয়ে ভয় পেয়ে রাতের অন্ধকারে নিজের ছোরাখানাকেই গোপনে পুকুরের পানিতে নিক্ষেপ করতে গিয়েছিলো। আসলে সে মালতীকে সত্যই গভীরভাবে ভালবাসতো।

হাঁ, এবার তাকে মুক্তি দেবো মিঃ জন।

মিঃ লাহিড়ী স্বর্ণকারকে গ্রেপ্তার করতে যাচ্ছিলেন, জন বললো-ওকে এরেষ্ট করবার কোনো প্রয়োজন নেই, কারণ স্বর্ণকার সম্পূর্ণ নির্দোষ। এবং সে আমাকে এ ব্যাপারে যথেষ্ট সাহায্য করেছে। স্বর্ণকারের সাহায্য ছাড়া আমি হয়তো এতো শীঘ্র এই খুনের সমাপ্তি বা রহস্য উদঘাটনে সক্ষম হতাম না। কাজেই স্বর্ণকার মহাশয়কে আমার অশেষ ধন্যবাদ।

স্বর্ণকার এবার হাস্যেজ্জ্বল মুখে বললেন–আপনি ঠিক সময় আমাকে ঐ একটি হীরা আর চেনখন্ড দেখিয়ে ছিলেন বলেই আমি আসল খুনীকে বাকী। চারখানা হীরা সহ আবিষ্কার করতে সক্ষম হই এবং আপনার কথা অনুযায়ী কাজ করি। ওটা আমি কিনবো বলে তাকে কথা দেই এবং আপনাকে সংবাদ দিয়ে জানাই।

মিঃ লাহিড়ী জনের পিঠ চাপড়ে বললেন আপনার সুতীক্ষ্ণ বুদ্ধির কাছে আমাদের পুলিশ বাহিনীও নতি স্বীকার করলো মিঃ জন।

জন হাসলো। . মিস মালতীর হত্যারহস্য উদঘাটিত হলো।

বাসুদেব শর্মা ও কাফ্রি চাকরটাকে বন্দী করে নিয়ে পুলিশ ভ্যান এগিয়ে চললো।

জন মিঃ লাহিড়ী ও মিঃ রায়কে নিয়ে গাড়ীতে স্টার্ট দিলো।

পুলিশ অফিসে মিঃ লাহিড়ী এবং মিঃ রায়কে পৌঁছে দিয়ে ফিরে চললো জন।

বাড়ী পৌঁছেতেই এ্যানি ছুটে এলো জনের পাশে—হ্যালো ডালিং, কোথায় ছিলে তুমি এ কদিন?

জন চোখের কালো চশমাটা ঠিক করে নিয়ে বললো–মালটে হত্যারহস্য উদঘাটন করলাম।

ডালিং, তুমি নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছে তো?

হাঁ এ্যানি।

তবে এবার আমাদের আনন্দ করতে কোনো ভয় নেই?

এ্যানি, কিন্তু…কিছু বলতে গিয়ে জন থেমে গেলো।

এ্যানি ততক্ষণে জনের মুখের কাছে ঝুঁকে এসেছে, আবেগভরা কণ্ঠে বললো—ডার্লিং, তুমি কত সুন্দর!

এ্যানি, আমি শীঘ্রই আমাদের বিয়ের দিন ধার্য করে ফেলবো।

সত্যি?

হাঁ এ্যানি।

ডার্লিং—

এ্যানি, আমাকে এক গেলাস ঠান্ডা পানি পান করাতে পারো?

নিশ্চয়ই পারি। তুমি বসো আমি আনছি।

এ্যানি বেরিয়ে যায়।

একটু পরে ফিরে আসে এ্যানি, দক্ষিণ হাতে তার ঠান্ডা পানির গেলাস। কিন্তু জন কই?

এ্যানি ব্যস্তভাবে তাকালো কক্ষের চারদিকে, উচ্চকণ্ঠে ডাকলো জন! জন! জন! তুমি কোথায়? হঠাৎ এ্যানির দৃষ্টি পড়লো সামনের টেবিলে, বিস্মিত হলো সেজনের কালো চশমাটা পড়ে আছে টেবিলের ওপরে।

এ্যানি তুলে নিলো চশমাটা হাতে, পুনরায় উচ্চস্বরে ডাকলো-জন…জন….জন….

এ্যানির কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনি জাগালোজন-জন-জন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *