বনের বাঘ বনাম মনের বাঘ
বনের বাঘ বনেই থাকে। কদাচিৎ কালে-ভদ্রে লোকালয়ে আবির্ভাব ঘটে তার। কয়টা লোকই বা বাঘের হাতে প্রাণ হারায়? মানুষের হাতে বাঘেরও তো মৃত্যু কম ঘটে না? বনের বাঘ দেখা যায়, তাই তার থেকে আত্মরক্ষা সহজ। প্রয়োজন হলে তার সাথে করা যায় সংগ্রাম। কিন্তু মনের বাঘ অদৃশ্য–অদৃশ্য বলেই মারাত্মক। কারণ, অদৃশ্য শক্রর। সঙ্গে মোকাবিলা করা কঠিন।
সব বনে বাঘ থাকে না। কিন্তু সব মনেই এক একটা বাঘ লুকিয়ে আছে। এ বাঘের ভয়েই আমরা শঙ্কিত, সন্ত্রস্ত। অধিকাংশ মানুষকে বনের বাঘে খায় না; কিন্তু তারা হয়ে পড়ে মনের বাঘের খোরাক। তাই ইংরেজিতে কথা আছে : Cowards die many a time before their death–অর্থাৎ আজরাইল আসার আগেই তাদের মৃত্যু ঘটে বহুবার।
দুঃখের বিষয় এই মৃত্যুর হাত আমাদের সাহিত্যেও সম্প্রসারিত ফলে সাহিত্য। আজ নিরক্ত, বর্ণহীন ও ফ্যাকাশে। রাষ্ট্রনীতি যখন আজ রাষ্ট্রের দ্বারাই নিন্দিত, সে পথে আমরা না হয় নাই গেলাম; কিন্তু তার বাইরে চিন্তা ও ভাবের যে অসীম ক্ষেত্র পড়ে রয়েছে, সেখানেও আমরা অবাধে বিচরণ করতে পারছি কই? প্রচলিত সামাজিক ধ্যান ধারণা ও ধর্মনীতির বাইরে পা বাড়াতে আজ আমরা শঙ্কিত, দ্বিধান্বিত। সরকার বা সরকারি নীতির বিরুদ্ধে না হলেও অন্যান্য প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির ভয়ে আমাদের অনেক লেখকের হাতের কলম আজ জড়োসড়ো। যদি কেউ কিছু বলে বসে বা আপত্তি করে? এই যদি’র ভয় থেকে লেখক ও সম্পাদক কেউ আজ মুক্ত নন। এমন কি তরুণ লেখকরাও আজ এই যদি’র ঝুঁকি নিতে নারাজ। অবাধে চিন্তা করা আর সেই চিন্তার অবাধ প্রকাশ ছাড়া কোন সাহিত্যই বড় হতে পারে না। ভাব নিয়ে খেলা করার অধিকারটুকুও যেন আমরা হারিয়ে বসেছি। আমাদের যৌবনকালে যে সুযোগটুকু ছিল, আজ তাও নিশ্চিহ্ন। সামাজিক সমৃদ্ধির সাথে সাথে সমাজের মন আরো উদার ও সহিষ্ণু হয়, হয় অধিকতর গ্রহণশীল। কিন্তু আমাদের বেলায় ফল হয়েছে তার বিপরীত। প্রথম বয়সে বেপরোয়া লেখার, বেপরোয়া ভাবার ও চিন্তার একটি বিশেষ মূল্য আছে। কারণ চিন্তা ও ভাব নিয়ে খেলা করতে করতেই একটা ভাব স্থিরতা লাভ করে। যা হয় পরে সাহিত্যের বিষয়বস্তু। মনের কথা মন খুলে বলতে বলতে, লিখতে লিখতেই প্রকাশের শক্তি, লেখার শক্তি বাড়ে ও খুঁজে পাওয়া যায় নিজের স্বাভাবিক মাধ্যম আর নিজস্ব রচনাশৈলী। এসব কথা সর্বজন স্বীকৃত।
সব শিল্পেরই মূল কথা প্রকাশ। এ প্রকাশ যত অবাধ ও বিচিত্রমুখী শিল্পও তত সম্পদশালী। সংগীত ও চিত্রের তুলনায় সাহিত্য আরো পুরোপুরি প্রকাশ-শিল্প। তাই প্রকাশের অবাধ স্বাধীনতা সাহিত্যের জন্য অপরিহার্য। এবং এর ফলেই সাহিত্য এত বিচিত্র ও এত বিভিন্ন। ইংরেজি সাহিত্যের পরিধি ও ব্যাপকতা দেখলে আমাদের অবাক হতে হয়। ইংরেজ জাতির বড় হওয়ার মূলেও ইংরেজি সাহিত্যই যে প্রেরণা যুগিয়েছে, তাতে বোধ করি কোনো সন্দেহ নেই। মানুষ মননধর্মী জীব–বিচিত্র ভাব, কল্পনা ও চিন্তা থেকেই মন খোরাক সংগ্রহ করে। গাছ যেমন চারদিকের মাটি থেকে শেকড় দিয়ে রস আহরণ করে বেঁচে থাকে, পরিপুষ্ট হয়ে ওঠে–মানুষের মনও তেমনি বিচিত্র ভাব রস সংগ্রহ করেই সজীব ও সবল হয়ে ওঠে। চিন্তার চেয়ে, ভাবের চেয়ে বড় শক্তি নেই। চিন্তা ও ভাবের স্বাধীনতা হরণ করে তাকে রুদ্ধ করা, নিয়ন্ত্রিত করা মানে মানুষের মনকে খাটো করা, দুর্বল করী। এমন মন কখনো mature বা প্রবীণ হওয়ার সুযোগ পায় না। এমন নাবালক মন নিয়ে আর যাই হোক বড় কিছু করা যায় না, গড়া যায় না। মহৎ কোনো ইমারত।
তাই লেখক ও শিল্পীকে হতে হয় বেপরোয়া, কিছুটা বোহেমিয়ান। সামাজিক বা ধর্মীয় লোকাঁচার বা প্রথাগত সংস্কার ও তার ভয় শিল্প ও শিল্পীর পথে এক মহা। অন্তরায়। আমাদের এই অন্তরায় যে কত আর তার দাপট যে কী রকম প্রচণ্ড তা কারো অজানা নয়।
একটি ব্যক্তিগত তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা এখানে উল্লেখ করলে আশা করি কেউ অপরাধ নেবেন না। আমরা যখন প্রথম জীবনে লিখতে শুরু করি তখন নিশ্চয়ই আমাদের লেখা কাঁচা ও অপরিণত ছিল। তবুও যতদূর মনে পড়ে তখন আমার কোন লেখাই সম্পাদকের দফতর থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে ফিরে আসে নি। আমাদের লেখার ওপর সম্পাদকরা কোনো সেন্সরই বসান নি সেদিন। মনের কথা মন খুলে বলার আমরা তখন এক অবাধ সুযোগ পেয়েছিলাম। একথা স্মরণ করেই আমি সওগাত সম্পাদক নাসির উদ্দিন সাহেব সম্বন্ধে লিখেছিলাম : ‘তরুণ বয়সের রচনায় সাধারণত কোন সংযম-শাসন থাকে না–আমরা তখন যা খুশি আর যা ইচ্ছে লিখেছি আর সওগাত–সম্পাদক আশ্চর্য উদারতার সঙ্গে তা প্রকাশ করে আমাদের অবাধে লেখার প্রশ্রয় দিয়েছেন সানন্দে। লেখার প্রস্তুতি তথা অভ্যাসের জন্য নবীন লেখকদের কাছে এই প্রশ্রয়টুকুর মূল্য অপরিসীম।’
এখনকার তরুণ লেখকরা সম্পাদকদের কাছে এ প্রশ্রয়টুকু পাচ্ছে কি না জানি না। আমি আর তরুণ নই–রীতিমতো স্বীকৃত প্রবীণ। আমার লেখক জীবনের সীমা অন্তত ত্রিশ বছর। তবুও আমার লেখা এখন প্রত্যাখ্যাত হতে শুরু হয়েছে। আমার একটি লেখা একে একে পঁচটা পত্রিকা থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে! আমার সম-সাময়িকদের মধ্যে এমন ভাগ্য আর কারো হয়েছে কিনা জানি না। আমি জীবনে কোনো বিষয়ে কোনো রেকর্ড প্রতিষ্ঠা করতে পারি নি। আমার বিশ্বাস, এ ক্ষেত্রে অর্থাৎ প্রত্যাখ্যাত লেখক হিসেবে, অন্তত পূর্ব পাকিস্তানে আমারই রেকর্ড। আমি চ্যালঞ্জ করে বলতে পারি ঊনষাট বছর বয়সে কারো কোনো লেখা পাঁচ পাঁচবার প্রত্যাখ্যাত হয় নি। হলে নিশ্চয়ই তিনি এতদিনে হার্টফেল করে মারা যেতেন!
যে পাঁচটি কাগজের পাঁচজন সম্পাদক আমার লেখাটি ছাপাতে অস্বীকার করেছেন, তারা কেউই গোঁড়া বা দক্ষিণ-পন্থী নন এবং তাঁরা সাহিত্য-শিল্পে প্রগতি ও চিন্তার স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। অন্তত তাঁদের কাগজ পড়লে তাই মনে হয়। পাঁচটি কাগজের চারটি জীবিত বলে তাই নাম উল্লেখ থেকে বিরত রইলাম। আমার সেই ‘প্রত্যাখ্যাত’ কমবক্ত লেখাটির নাম হচ্ছে : ‘ঈশ্বর : শয়তান ও মানব সভ্যতার রূপান্তর’। লেখাটিতে যে রাজনীতির কোনো রকম গন্ধ নেই, তা নামেই প্রকাশ। প্রবন্ধটিতে পাকিস্তান বা ইসলাম সম্বন্ধেও কোন উল্লেখ নেই। শুনেছিলাম রাজনীতি, পাকিস্তান আর ইসলাম–এই তিনটি এড়িয়ে যেতে পারলেই যাই লেখা হোক আর যাই বলা হোক ইবলিশেরও সাধ্য নেই গায়ে হাত দেয়। আমি আমার উক্ত রচনায় ঐ তিনটি বিষয়ে কোনো উল্লেখই করি নি। তবে হ্যাঁ, ইবলিশ বা শয়তান আমার ঐ রচনার অনেক অংশ যে জুড়ে আছে তা সত্য। রচনাটার সূচনাও শয়তানকে নিয়ে। লেবাননের আরবি লেখক খলিল জিব্রানের ‘শয়তান’ নামে একটি লেখা আছে। ঐ লেখাটির সংক্ষিপ্তসার নিয়েই আমি আমার লেখাটি শুরু করেছিলাম। লেখাতে মোটামুটি আমি বলতে চেয়েছিলাম, শয়তান না থাকলে ঈশ্বরও থাকবে না; ঈশ্বর না থাকলে শয়তানের থাকারও কোন মানে হয় না। এরা একে অপরের পরিপূরক। এই দুই না থাকলে মানব সভ্যতার বদল অনিবার্য। আমার সমস্ত রচনাটির এ হচ্ছে প্রদিপাদ্য ও মূল কথা। পাঠক নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন এ শুধু একটুখানি চিন্তার খেলা। খানিকটা free thinking-এর চর্চা, তার বেশি কিছু নয়। কারো পাকা ধানে মই দেওয়ার কোনো ইঙ্গিত লেখাটিতে নেই। ঈশ্বর আছেন, শয়তান আছে অতি উত্তম, অতি ভালো কথা। এরা নেই, এরা না থাকলে পৃথিবীর বা। সমাজের চেহারাটা কেমন হতে পারে এ সম্বন্ধে আমি শিল্পী, আমি সাহিত্যিক, আমি কবি, একটু কল্পনা করতে পারব না কেন? দেখি না আমার কল্পনা আমাকে কোথায় নিয়ে যায়! এ দুঃসাহসটুকুও কি নিষিদ্ধ? আমার কল্পনা ভুল হতে পারে, হতে পারে ভ্রান্ত। কিন্তু তাই বলে আমি কি কল্পনা করতেও সাহস করব না? চিন্তা করতেও ভুলে যাব? শিল্পী-সাহিত্যিকের চিন্তা তো শুধু বাধা সড়ক ধরে চলে না? চললে খাঁটি শিল্পও কি নীরস ধর্ম কাহিনী হয়ে উঠবে না?
চোখের সামনে সূর্যটাকে দেখতে পাচ্ছি–এ এক অনিবার্য সত্য, কিন্তু সূর্য নেই, না থাকলে পৃথিবীর চেহারাটা কেমন হতে পারে এই দুঃসাহসিক কল্পনাটুকু আমি করতে পারব না কেন? অনভ্যস্ত পথে, নিষিদ্ধ সড়কে কল্পনা রথের সারথি হওয়ার যে আনন্দ শিল্পী তার লোভ তো ছাড়তে পারে না। শয়তান বা ঈশ্বর সম্বন্ধে রাষ্ট্র তো কখনো এ কথা বলে নি–Thus far, no further। তবুও পাঁচ পাঁচটা বিজ্ঞ সম্পাদক আমার আলোচ্য রচনাটা ছাপাতে অস্বীকার করেছেন! এ কি বনের বাঘের ভয়ে না মনের বাঘের ভয়ে? রচনাটা কোনো রাষ্ট্রীয় বিধির আওতায় পড়ে বলে তো মনে হয় না।
আমি তো শুধু আমার ঐ রচনায় আমার মনের ভেতর একটুখানি free হতে চেয়েছি মাত্র এবং প্রচলিত সংস্কারের বন্ধন ছিঁড়ে তাকে ভাষায় রূপ দিতে চেয়েছি শুধু।
আমি স্বাধীন চিন্তায় বিশ্বাসী। চিন্তা ভুল হতে পারে; কিন্তু আন্তরিক চিন্তা কখনো মূল্যহীন হতে পারে না। সব রকম স্বাধীন চিন্তাই লেখক ও পাঠক উভয়ের মনের দিগন্ত খুলে দেয়। মনের বন্ধনের চেয়ে বড় বন্ধন আর নেই। সে বন্ধন কাটার প্রধান হাতিয়ার। চিন্তা। এ বিষয়ে রোমা রোলার বিখ্যাত মন্তব্য স্মরণীয়—’Every honest idea, even when it is mistaken, is sacred and divine.’
সব রকম চিন্তা চর্চারই তো ফসল ভাব, আইডিয়া, আদর্শ। আইডিয়া তথা ভাব সম্বন্ধে জর্জ ক্লিমেন্সের মন্তব্য—’The thing that gives people courage is idea.’
লেখকরা যদি স্বাধীন চিন্তায় বাধা পান, যে সব রচনায় স্বাধীন চিন্তার কিছু গন্ধ। রয়েছে, সম্পাদকেরা যদি বনের বাঘের কি মনের বাঘের ভয়ে তা ছাপতে অস্বীকার করেন, তা হলে অচিরে লেখকরা স্বাধীনভাবে চিন্তা করতেই ভুলে যাবেন। লেখকরা ভুলে যাওয়া মানে জাতি ভুলে যাওয়া। যে জাতির মনে আইডিয়ার অর্থাৎ নব নব ভাবের অগ্নিস্পর্শ ঘটে না, তার ভীরু ও নিবীর্য হয়ে পড়তে বেশি সময় লাগে না।
[‘বনের বাঘ বনাম মনের বাঘ’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৬৫-র সালে দৈনিক সংবাদে। প্রথম গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় সাহিত্য, সংস্কৃতি ও জীবন গ্রন্থে।]