বনের খবর – ৯

(১৯০৬-১৯০৭ ব্রহ্মদেশ৷ পকোফু, চিন হিলস) শান দেশে আর আমার যাওয়া হয়নি৷ এবছর অন্য আপিসের সঙ্গে পকোফু আর চিন হিলস-এ কাজ করতে গিয়েছিলাম৷ লোকজন, দেশ, ভাষা সবই আমার কাছে নতুন৷ পাঁচ-ছয় বছর শান স্টেটে কাজ করে শান ভাষা একটু-একটু শিখেছিলাম৷ এখানে এসে সেসব আমার কোনো কাজে লাগল না৷ নতুন করে সব জিনিসের পত্তন করতে হল৷

এখানেও জঙ্গলের কাজ, স্থানে-স্থানে পথের কষ্ট, অর্থাৎ পথ না থাকার কষ্ট৷ রাস্তা নেই বললেই চলে, বিশেষত পাহাড়ে৷ পাহাড়ে নদী, তাই আশ্রয় করে লোকজন চলে৷ আর একটা পথ আছে কিন্তু তাতে বড্ড ঘোরফের৷

নদীতে হাতি চলা অসম্ভব— এদেশে খচচর নেই, মাল বইবার জন্য সরকারি হাতি একটা সঙ্গে আছে৷ পথ বলতে যা বোঝায় তার কিছুই নেই, আছে শুধু জল আর বড়ো-বড়ো চ্যাটালো পাথর৷ নদীর কিনারাগুলো এক-এক জায়গায় নিরেট পাথর আর দেয়ালের মতো খাড়া, তার গায়ে পা রাখবার মতো একটু-একটু জায়গা আছে বটে, কিন্তু সে অতি সামান্য৷ তার উপর দিয়ে বাঁদরের মতো চার হাত-পায়ে না হলে চলবার জো নেই৷ মানুষেরই এই দশা, হাতি চলে কী করে?

ভোরবেলায় উঠে, তাড়াতাড়ি চা খেয়ে কাজ দেখতে বেরিয়েছি, সঙ্গে একজন বর্মী সার্ভেয়ার, মাং-ফো-হান, বড়ো ভালোমানুষ৷ আমাদের তাঁবু ছিল আটশো ফুট উঁচুতে, আর যেতে হবে পাঁচ হাজার ফুট উঁচু পাহাড়ের উপর দিয়ে৷ মালপত্র নিয়ে হাতি গেছে অন্য পথে, তার সঙ্গের লোকজনদের পাঁচ-ছয় মাইল দূরে একটা হাতিওয়ালাদের আড্ডায় পৌঁছে তাঁবু ফেলতে বলে দিয়েছি৷ দু-আড়াই মাইল দূরেই আরও একটা হাতির আড্ডা আছে, বিশেষ করে বলে দিয়েছি যেন সেখানে না যায়৷

আমরা কাজ করতে-করতে চলেছি৷ একে তো ওই রাস্তা, তায় আবার পাহাড় বেজায় চড়াই, তার দশ আনা উঠতে-না-উঠতে সন্ধ্যা হয়ে গেল৷ কাজেই সার্ভেয়ারকে বললাম, ‘চলো, এখন ফিরি, বাকি কাজ কাল এসে শেষ করব৷’

আমরা সোজাসুজি নদীতে নামতে আরম্ভ করলাম৷ নামতে-নামতে হাঁটুতে ব্যথা ধরে গেল, তবু পথ আর ফুরোয় না৷ ক্রমে অন্ধকার হয়ে এল, তখনও নদী প্রায় সিকি মাইল নীচে রয়েছে৷ বাকি পথটুকু আরও খাড়া, আলো না হলে তাতে চলা অসম্ভব৷ কাজেই আমরা সেখানে বসে-বসে শুকনো বাঁশ দিয়ে চার-পাঁচটা বড়ো-বড়ো মশাল তৈরি করে নিলাম৷ মশাল জ্বেলেও কি সহজে নামা যায়? কাঁটাগাছ ধরে-ধরে নামতে গিয়ে অনেকেরই হাত ছড়ে গেল৷

নদীতে পৌঁছে সার্ভেয়ারকে জিগগেস করলাম, ‘আড্ডা কত দূরে?’

সে বললে, ‘একটা আধ মাইল নীচে, আরেকটা দেড়-দু মাইল উপরে হবে, অন্ধকারে ভালো করে বুঝতে পারছি না৷’

উপরের আড্ডাটাতেই আমাদের যেতে হবে৷ সে যে কী বিদঘুটে রাস্তা তা আর কখনো ভুলব না৷ কখনো বালির উপর দিয়ে, কখনো বা পাথর ডিঙিয়ে, আবার কখনো বাঁদরের মতো কাঁটা, বাঁশ, লতাপাতা আঁকড়িয়ে ধরে পাহাড়ের গা বেয়ে চলেছি৷ দুটো মশালের আলোতে সে অন্ধকারে বিশেষ সুবিধা হচ্ছিল না৷ দেড় মাইল পথকে মনে হচ্ছিল যেন আট-দশ মাইল৷ হাঁটতে-হাঁটতে যখন আর পা চলতে চায় না, তখন সার্ভেয়ারকে জিগগেস করলাম, ‘আর কদ্দূর?’

সে বললে, ‘অধেক এসেছি৷’ শুনে তো আমার চক্ষুস্থির!

খালাসিরা বললে, ‘হুজুর, একটু না জিরোলে আর চলতে পারছি না৷’

কী করি? তাদের সেখানে রেখে, সার্ভেয়ার আর একজন খালাসিকে— যার কাছে আমার খাবারটুকু ছিল— সঙ্গে নিয়ে চললাম৷ খালাসির হাতে একটা মশাল বেশি দিয়েছি, দরকার হলে জ্বালাব৷ এমনি করে আরও কিছু দূর গেলাম৷ মনে হচ্ছিল কত ঘণ্টাই না জানি চলেছি৷ জিগগেস করলাম, ‘আর কদ্দূর?’

সার্ভেয়ার বললে, ‘পঞ্চাশ-ষাট জরিপ হবে৷’

শুনে মনে একটু উৎসাহ হল, আবার খানিকটা চলে একটা নদী পার হলাম৷ ততক্ষণে সার্ভেয়ারের হাতের মশালটা নিবু-নিবু হয়ে এসেছে৷ সে খালাসিকে বললে, ‘সেই যে আরেকটা মশাল এনেছিলি—সেটা দে৷’

সে বললে, ‘সেটা তো ফেলে দিয়েছি৷’

ব্যস, আমাদের তো চক্ষু চড়কগাছ!

‘ফেলে দিয়েছিস কী রে ব্যাটা? কার হুকুমে ফেললি?’

‘কেন বাবু যে বলল আর বেশি দূর নেই৷’

তখন আরেকটা মশাল তৈরি করা ছাড়া উপায় নেই৷ খালাসিকে বললাম, ‘তোর সঙ্গে দা আছে, সেটা দে৷’

কিন্তু দাখানাও বেটা পিছনের লোকদের কাছে রেখে এসেছে৷ এখন উপায়? সার্ভেয়ারকে বললাম, ‘শুকনো লতাপাতা জড়ো করে এই নিবু-নিবু মশালটার বাকি বাঁশটুকু দিয়ে একটু আগুন জ্বালো৷ তারপর শুকনো বাঁশ পাথর দিয়ে থেঁতলে মশাল বানাও৷’

ততক্ষণে মশালটা নিবে গিয়েছিল৷ সার্ভেয়ার আর খালাসি শুকনো পাতা জড়ো করে, তার ভিতর ওই মশালের বাকি বাঁশ কখানা চাপা দিয়ে, উপুড় হয়ে তাতে ফুঁ দিতে লাগল৷ আমি পাশে দাঁড়িয়ে দেখছি৷ আমার পিছনে ছোটো নদী, সামনে হাত ছয়-সাত দূরে একটা মস্ত বড়ো চওড়া পাথর প্রায় আমার সমান উঁচু৷ ওরা ক্রমাগত খালি ফুঁ-ই দিচ্ছে, হিমে ভেজা পাতা সহজে জ্বলতে চায় না৷

image14.jpg

এমন সময় ওই বড়ো পাথরটার দিকে আমার চোখ পড়ল৷ দেখলাম তার উপর কীসের দুটো চোখ জ্বলজ্বল করছে৷ চোখ দুটো আমারই দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে৷ চোখ পাথরটা থেকে প্রায় দেড় হাত উঁচুতে, ভাবলাম নেকড়ে বা হায়েনা হবে৷ আবার ভাবলাম যদি তাই হয় তো অত দূরে-দূরে কেন?

ততক্ষণে পাতায় সবে একটু আগুন ধরেছে৷ এখন যদি আমি কিছু বলি বা গোলমাল করি, ওরা আর আগুন জ্বালাতেই পারবে না, আর তা হলেই বিপদ৷ কাজেই আমি চুপ করে রইলাম৷ ওরা তখনও খালি ফুঁয়ের উপর ফুঁ দিচ্ছে, দিতে-দিতে হঠাৎ যেমনি দপ করে আগুন জ্বলে উঠল, অমনি সেই জানোয়ারটাও ব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়াল৷ বাবা! এই বড়ো বাঘ! এতক্ষণ গুড়ি মেরে ছিল, তাই বেশি উঁচু দেখাচ্ছিল না৷

বাঘটা উঠেই লাফ দিয়ে মাটিতে নামল, আর অমনি সার্ভেয়ারও বুঝতে পেরেছে৷ সে সেই দেশের লোক, বনে-বনে ঘুরে বেড়ায়, তার কাছে লুকোবার জো নেই৷ সে লাফিয়ে উঠে বলল, ‘ওটা কী রে?’

আমি বললাম, ‘যাই হোক, এখন তো চলে গেছে, শিগগির মশাল জ্বালো৷’

ততক্ষণে আগুন খুব জ্বলে উঠেছে আর চারদিক আলো হয়ে গেছে৷ বাঘটা তাই দেখে আস্তে-আস্তে পাহাড়ে উঠে গেল৷ শুকনো পাতার উপর তার পায়ের শব্দ শুনে সার্ভেয়ার বলল, ‘বড়া জবর শের৷’

খালাসিটা কিছু বলল না, সে খালি ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল৷

যাই হোক, আমরা তাড়াতাড়ি মশাল তৈরি করে জ্বেলে নিয়ে সেখান থেকে রওয়ানা দিলাম৷ সার্ভেয়ার ঠিকই বলেছিল, একটু চিৎকার করে ডাকবামাত্র আড্ডা থেকে জবাব এল, আর আমরাও একটু পরেই আড্ডায় পৌঁছলাম৷

আড্ডায় পৌঁছে দেখি সেখানে খালি সার্ভেয়ারের দু-জন খালাসি আর তার বিছানাটি আর খালাসিদের খান কয়েক কম্বল আছে৷ হাতি বা অন্য লোকজন বা জিনিসপত্র কিছুই আসেনি৷ সে সব যে কোথায় গেছে এরা তার কিছুই জানে না৷ জিগগেস করলে খালি বলে, ‘তারা আসেনি৷’

সে রাত্রে আর খাওয়া-দাওয়া হল না, একটা কম্বল জড়িয়ে কোনো রকমে রাত কাটানো গেল৷ সকালে উঠে দু-জন খালাসিকে হাতির খোঁজে পাঠালাম, আর বাকি লোকদের নিয়ে আমরা কাজে বেরিয়ে গেলাম৷ একজন খালাসির কাছে সের খানেক চাল ছিল, খালাসিরা তাই রেঁধে নুন দিয়ে খেল, আমাদের দু-জনের উপোস! সন্ধ্যার পর কাজ থেকে ফিরে দেখি গুণধররা হাতি নিয়ে এসেছেন৷ দাঁত বের করে বললেন, ‘ভুলে অন্য আড্ডায় গিয়েছিলাম৷’

যে আড্ডার সম্বন্ধে বিশেষ করে বারণ করে দেওয়া হয়েছিল, সব জায়গা ছেড়ে হতভাগারা সেইখানেই গিয়েছিল৷ এখন যে এসেছে তাও আমাদের পাঠানো দূত গিয়ে ডেকে এনেছে বলে!

যাই হোক, তখন আর আলোচনায় কোনো লাভ নেই৷ ত্রিশ ঘণ্টা পেটে কিছু পড়েনি, খিধেয় প্রাণ ওষ্ঠাগত! কাজেই তাড়াতাড়ি চারটি খেয়ে শুয়ে পড়লাম৷ সে রাত্রে আমার যে কী চমৎকার ঘুম হয়েছিল সে আর কী বলব! তখন কেউ আমার দুটো আঙুল কেটে নিলেও টের পেতাম কি না সন্দেহ৷

.

এপ্রিল মাস, বেজায় গরম পড়েছে৷ সার্ভেয়ার, খালাসি সকলেই ব্যস্ত, তাড়াহুড়ো করে ভোরে কাজে বেরোয়, সমস্ত সকালটা খেটেখুটে ক্লান্ত হয়ে বেলা দুটো-তিনটের সময়ে যদি কোনো নালায় জল পায়, খেয়ে প্রাণটা ঠান্ডা করে৷ যতক্ষণ ঠান্ডা থাকে পাহাড়ের উপরে-উপরে কাজ করে৷ দুপুর পার হলে জলের খোঁজে নালায় নামে৷ কখনো-কখনো আবার জল পাওয়াই যায় না, নালা শুকনো, তাতে আছে খালি বালি আর পাথর৷

সার্ভেয়ার রণজিৎ সিং জলের আশায় এমনি একটা নালায় নেমেছে, আর নালার ভিতরে জরিপ টেনে চলেছে৷ সার্ভেয়ার একটা মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে আছে, টিন্ডেল আর মেট জরিপ টেনে আনছে৷ একজন খালাসি আগে-আগে গিয়েছে, সে সামনের মোড় থেকে সিগনাল দেবে৷ হঠাৎ লোকটি দাঁড়াল, কী যেন নিবিষ্ট মনে দেখল, তারপর ফিরে ঊর্ধ্বশ্বাসে দে-দৌড়! একেবারে সার্ভেয়ারের কাছে হাজির৷

‘কেয়া হ্যায় রে?’

‘বাবুজী, বড়া জবর সরপ হ্যায়, হামারা জং কা মাফিক মোটা হোগা!’

ততক্ষণে পিছনের লোকরা এসে পড়েছে৷ তাদের সঙ্গে দুজন বর্মীকুলি ছিল, তারা বললে, ‘চলো, মারব৷ ও সাপ আমরা খাই, বড়ো চমৎকার খেতে৷’

রণজিৎ সিং-এর হাতে একটা বল্লম ছিল, কুলিদের কোমরে খুব ধারাল দা ছিল, আর সকলে বাঁশ কেটে চোখা-চোখা বল্লম তৈরি করে নিল৷ সেই জায়গায় এসে কিনারার ঘাসের দিকে আঙুল দেখিয়ে খালাসি বলল— ‘উও হ্যায়৷’

সকলে তাকিয়ে দেখল প্রকাণ্ড গোসাপের মাথার মতো একটা মাথা দেখা যাচ্ছে! আর মুখ দিয়ে যেন জিভ বের হয়ে রয়েছে৷ বর্মীরা পাথর ছুড়ে মারল, আর সমস্ত ঘাস নড়ে উঠল, কিন্তু মাথাটা খুব সামান্য নড়ল৷ তখন সকলে মিলে বাঁশের বল্লম নিয়ে জায়গাটুকু ঘিরে ফেলল আর ঢিল ছুড়তে লাগল৷ একজন কাছে গিয়ে তার হাতের বল্লমটা ছুড়ে মারল আর সাপটাকে একেবারে মাটির সঙ্গে গেঁথে ফেলল৷ তখন সব ওলটপালট হতে লাগল৷ বর্মীরা তাড়াতাড়ি আরও দু-তিনটে বল্লম দিয়ে সাপটাকে জায়গায়-জায়গায় মাটির সঙ্গে চেপে ধরল৷ বেচারা আগেও বিশেষ নড়তে পারছিল না, এখন একেবারে অচল হয়ে গেল৷

সার্ভেয়ার কাছে গিয়ে দেখল ওটা জিভ নয়, সাপটার মুখ দিয়ে কোনো জানোয়ারের লেজ বেরিয়ে আছে, জানোয়ারটা সাপের পেটে৷ দু-জন বর্মী দা দিয়ে চাপ দিয়ে সাপটাকে হাঁ করাল আর দুজন ওই ল্যাজটা ধরে টানতে লাগল৷ টানতে-টানতে বের হয়ে এল প্রকাণ্ড একটা হনুমান৷ কী করে যে হনুমানের মতো হুঁশিয়ার জানোয়ারকে সাপটা ধরেছিল কে জানে!

বর্মীরা বলল তারা সাপটার চামড়া ছাড়িয়ে মাংস নেবে৷ সার্ভেয়ার রাজি হল না, তাঁবু অনেক দূরে, শিগগির না ফিরলে রাত হয়ে যাবে৷ কাল তো বাকি কাজটুকুর জন্য আসতেই হবে, তখন মাংস নিতে পারবে৷

অগত্যা সাপটাকে ওই রকম মাটির সঙ্গে গাঁথা অবস্তায় রেখেই তারা চলে এল৷ পরদিন সকালে গিয়ে দেখে সাপটার কোনো চিহ্নই নেই, যেন উড়ে গেছে৷ সকলে আন্দাজ করল যে আগের দিন পেট ভরা ছিল বলে সাপটা বেশি নড়াচড়া করতে পারেনি, পালাতেও পারেনি, আর সেইজন্যই তাকে অত সহজে কাবু করতে পেরেছিল৷ তারপর এরা চলে এলে রাত্রে যখন সে একটু প্রকৃতিস্থ হল, তখন দু-চারবার গায়ে মোচড় দিয়ে ওই সব বল্লম উপড়িয়ে ফেলে চলে গেছে৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *