বনের খবর – ৮

(১৯০৫-১৯০৬ ব্রহ্মদেশ৷ শান স্টেট) আবার আমরা শান স্টেটে গেলাম৷ দু-বছর আগে আমি আর এক সাহেব এই সমস্ত জায়গাতে দূরবিনের কাজ করেছিলাম, এবার আমার ঘাড়ে জরিপ করবার ভার পড়ল৷

পাহাড়ের উপর জঙ্গলের লোকরাও চাষবাস করে কিন্তু তাদের প্রক্রিয়াটা অন্য ধরনের৷ হাল সেখানে চলে না, কেননা একে তো পাহাড়ে সমান জমি নেই; দ্বিতীয়ত, জমি পাথরের মতো শক্ত৷ সুতরাং বাধ্য হয়ে তাদের চাষের অন্য ধারা বের করতে হয়েছে৷

পাহাড়ে-পাহাড়ে ঘুরে, মাটি পরীক্ষা করে, উপযুক্ত জমি ঠিক করে নেয়৷ ধান, তুলো, আফিঙ— প্রত্যেকটার জন্য বিশেষ রকমের জমি চাই৷ জমি ঠিক হলে, তারা সমস্ত জঙ্গল কেটে ফেলে৷ জঙ্গল কেটে দু-আড়াই মাস ফেলে রাখে, গাছপালা সমস্ত রোদে শুকিয়ে প্যাঁকাটির মতো হয়ে যায়৷ তারপর ভালো দিন দেখে, পুজো দিয়ে, তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়৷ সমস্ত পুড়ে ছাই হয়ে গেলে, জায়গাটা পরিষ্কার করে নেয়৷ তারপর তাতে ছোটো ছোটো গর্ত খুঁড়ে, গর্তে দু-চারটি করে বীজ রেখে, পোড়া মাটি চাপা দেয়৷ ধান, কচু, কুমড়ো লঙ্কা— সমস্ত ওই একই জমিতে৷ তারপর চারা বেরোলে, মাচা বেঁধে রাত জেগে পাহারা দেয়, নইলে বুনো শুয়োর বা হরিণ এসে সব শেষ করবে৷

মার্চ-এপ্রিল মাসে যখন এই সব জমিতে আগুন ধরিয়ে দেয় তখন চারদিক ধোঁয়ায় অন্ধকার হয়ে যায়৷ এক-এক সময় এমন ধোঁয়া হয় যে দিনের বেলাও তিন-চার মাইল দূরের পাহাড় দেখা যায় না৷ অনেক সময় এই খেতের— বর্মীরা বলে ‘টাউনিয়া,’ আসামে বলে ‘জুম’— আগুন সমস্ত পাহাড়ে ছড়িয়ে পড়ে, আবার কখনো গরমের দিনে শুকনো গাছে আপনা থেকেই আগুন লেগে যায়, এক ডালের সঙ্গে অন্য ডালের ঘষা লেগেই বোধ করি৷ রাত্রে দূর থেকে দেখতে বেশ, কিন্তু যারা জঙ্গলে থাকে তাদের মাঝে মাঝে বিপদে পড়তে হয়৷

একবার একজন সার্ভেয়ারের তাঁবু এই জঙ্গলের আগুনে পুড়ে গিয়েছিল, তার সঙ্গে দু-তিনজন খালাসিও পুড়ে মরেছিল৷ তাঁবুর চারদিকে লম্বা-লম্বা ঘাস ছিল৷ ভোরে যখন খালাসিরা রান্না করতে উঠেছে, তখন তারা দূরে পাহাড়ের উপরে আগুন দেখতে পেয়ে বলেছিল, ‘বাবু, আজ কাজে যেয়ো না৷ ওই দেখো আগুন, মনে হচ্ছে যেন এইদিকেই আসছে৷ আজ আমরা তাঁবুর চারদিকের ঘাস পরিষ্কার করে ফেলবার জন্য পাল্টা আগুন ধরাতে চাই৷’

সার্ভেয়ার বললে, ‘আগুন ঢের দূরে৷ এখানে পৌঁছতে এখনও দু-তিন-দিন লাগবে৷ একদিনের তো কাজ বাকি৷ আজ সেইটুকু শেষ করে, কাল ভোরে চলে যাব৷’

সার্ভেয়ার কাজে চলে গেল৷ সন্ধ্যার পর ফিরে এসে, খাওয়া-দাওয়া সেরে শুয়ে পড়ল৷ ভোরে উঠে চলে যাবে৷ রাত্রে ঝড়ের মতো হাওয়া চলতে লাগল, আর ঘুম ভাঙবার আগেই আগুন এসে তাদের ঘিরে ফেলল৷ সার্ভেয়ার আর জন তিনেক লোক অতি কষ্টে প্রাণ নিয়ে পালাতে পেরেছিল, বাকিরা পুড়ে মরেছিল৷

একদিন আমিও এই আগুনের হাতে পড়েছিলাম৷ পাহাড়ের উপর দিয়ে ঘোড়ায় চড়ে চলেছি, সামনে আগুন, তখনও পথ থেকে একটূ দূরে৷ লোকজনদের এগিয়ে দিয়ে, পিছন থেকে তাড়া দিয়ে, লম্বা-লম্বা পা ফেলে চললাম, আগুন পথের উপর পৌঁছবার আগেই পার হয়ে যাব৷ লোকজন সকলেই পার হয়ে গেছে, আমিও প্রায় পেরিয়ে গিয়েছি, এমন সময় হাওয়াতে আগুন উড়িয়ে এনে ফেলল প্রায় পথের পাশে৷ আমি ঘোড়া ছুটিয়ে দিলাম, ইচ্ছেটা যে আগুন ঘিরে ফেলবার আগেই পার হয়ে যাব, আর তখুনি একটা জলন্ত ডাল এসে পড়ল একেবারে সামনে ঘাসের উপর৷ দাউ-দাউ করে জ্বলে উঠল, সঙ্গে-সঙ্গে পিছনে দুমদাম বাঁশ ফাটতে আরম্ভ করল, আর ঘোড়াটা ভড়কিয়ে গিয়ে একেবারে দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে দে ছুট! খালাসিদের পার হয়ে একটা নীচু গাছের ডালের তলা দিয়ে ছুটল৷ ডালটা আমার বুকে লেগে আমি তো পাঁচ-সাত ফুট দূরে ছিটকিয়ে পড়লাম, ঘোড়াটা দিব্যি গলে বের হয়ে গেল৷ আমার শুধু পায়ে একটু চোট লেগেছিল, তিন-চারদিন খুঁড়িয়ে হেঁটেছিলাম৷ পকেট থেকে ঘড়িটা দশ-বারো ফুট দূরে ছিটকিয়ে পড়েছিল কিন্তু থামেনি, সমানে টিকটিক করছিল৷ আর ঘোড়াটা পঞ্চাশ কদম গিয়েই থেমেছিল৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *