বনের খবর – ৭

১৯০৪-১৯০৫ বেলুচিস্থান৷ উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ) পরের বছর আবার শান স্টেটে যাব বলে সব ঠিক৷ এক মাসের ছুটি নিয়ে কলকাতা হয়ে, কয়েকদিন সেখানে কাটিয়ে তবে যাব৷ হঠাৎ শিমলা থেকে তারে হুকুম এল: একে এক্ষুনি কোয়েটা পাঠিয়ে দাও৷ ৪৮ ঘণ্টা সময় দেওয়া হল বেলুচিস্থানের উপযোগী কাপড়-চোপড় তৈরি করে নেবার জন্য৷ তাড়াহুড়ো করে কাপড়-চোপড় করিয়ে ট্রেনে চেপে বসলাম৷ ব্যাঙ্গালোর থেকে কোয়েটা লম্বা পথ৷ পুণা, বম্বে, বরোদা, মাড়োয়ার, হায়দারাবাদ ও সিবি হয়ে তবে কোয়েটা৷ পথে সিবিতে প্লেগ ক্যাম্পে আমাকে দু-দিন আটকিয়ে রাখল, কেননা আমি ব্যাঙ্গালোর থেকে আসছি আর সেখানে প্লেগ হচ্ছিল৷

লম্বা পথ, ট্রেনে চলতে-চলতে একেবারে প্রাণ আইঢাই! রাজপুতানার মরুভূমিতে তো বালিতে নাক-চোখ বন্ধ হয়ে যাবার জোগাড়৷ আর ভীষণ গরম!

কোয়েটা পৌঁছে কাজে বেরোবার জন্য সব গুছিয়ে নিয়েছি, পরদিন ভোরে রওয়ানা হব, আবার তার এল: কোহাট যাও৷ কাজকর্ম অন্য লোকের জন্য ছেড়ে দিয়ে আবার ট্রেনে চাপলাম, গেলাম কোহাট৷ কোহাট থেকে বন্নু আর টর্চি উপত্যকা৷ কোহাট অবধি রেল, তারপর টঙ্গা৷

এত লম্বা ট্রেন যাত্রা আমি জন্মে কখনো করিনি৷ কোথায় ব্যাঙ্গালোর আর কোথায় কোহাট! কতদিন পর্যন্ত খটাং-খটাং খট-খট করে আমার কানের ভিতরেও ট্রেন চলেছিল৷

আমি বেলুচিস্থানে যে কাজ ফেলে এলাম, দু-দিন পরে আমাদের আপিসের এক সাহেব সেই কাজ করতে গেলেন৷ আফগানিস্থানের সীমানা পর্যন্ত কাজ করতে হবে৷ সে সব দেশের লোকেও আইনকানুন বড়ো একটা মানে না৷ তাই সাহেবের সঙ্গে বারো-চোদ্দোজন সিপাই গেছে৷ তারা রাত্রে তাঁবু পাহারা দেবে, দিনে তাঁর সঙ্গে কাজ করবে৷ এই সিপাইরাও ওই দেশেরই লোক— ‘বেলুচ’৷ তাদের উপর একজন হাবিলদার ছিল৷ সিপাইদের মধ্যে অবার দুই দল ছিল, দুই দলের মধ্যে একটু মনোমালিন্যও ছিল, সেইজন্য প্রায়ই খুঁটিনাটি নিয়ে কথা কাটাকাটি লেগেই থাকত৷ হাবিলদার এক দলকে একটু অনুগ্রহ করত, সেইজন্য অন্য দল বিশেষ সন্তুষ্ট ছিল না৷ সে-দলের একজন সিপাই হাবিলদারের নেকনজরে ছিল না, সম্ভবত তার উপর কিছু-কিছু জুলুমও চলত৷ সেও দু-একবার সাহেবের কাছে নালিশ করতে চেষ্টা করেছে, কিন্তু সিপাইরা তাঁর অধীন নয় মনে করে তিনি তার নালিশে কান দেননি৷

এর ফলে তাদের গোলযোগ আরও গুরুতর হয়ে উঠল, এমনকী সঙ্গিন অবস্থা হয়ে দাঁড়াল৷ এই সময়ে প্রায় একেবারে আফগান সীমার উপরে সাহেবের তাঁবু পড়ল৷ পাঁচ-ছয়শো গজ মাত্র ব্যবধান৷ সেইদিনই রাস্তায় ওই সিপাই আর হাবিলদারের মধ্যে কিছু বচসা হয়েছে৷ সিপাই তাঁবুতে এসেই সাহেবের কাছে নালিশ করল যে হাবিলদার তার উপর অন্যায় জুলুম করেছে ইত্যাদি৷ এবারও সাহেব শুনলেন না৷ হাঁড়িপানা মুখ করে সিপাই বসে রইল৷ রাত্রে হাবিলদার ওরই ঘাড়ে পাহারা চাপাল৷

খাওয়া-দাওয়া শেষ করে সকলে শুয়েছে, সিপাই পাহারায় দাঁড়াল৷ দু-ঘণ্টা বাদে অন্য সিপাই এসে তাকে বদলি করবে৷ সাহেবের তাঁবুর পাশেই সিপাইদের তাঁবু, মাঝখানে কয়েক ফুট জায়গা৷ রোজ পাহারাওয়ালা সিপাই তাঁবুর সামনে পাইচারি করে, কিন্তু সেদিন ওই সিপাই তাঁবুর চারদিকে ঘুরতে লাগল আবার মাঝে-মাঝে দুই তাঁবুর মাঝখান দিয়েও যাতায়াত করতে লাগল, আবার যেন কখনো-কখনো দুই তাঁবুর মাঝে দাঁড়িয়ে কী দেখতে বা ভাবতে লাগল৷

সাহেবের ঘুম ভেঙে গিয়েছিল, আর শুয়ে-শুয়ে ভাবছিলেন, আজ পাহারাওয়ালা অমন করছে কেন? একবার ভাবলেন বাইরে গিয়ে দেখি ব্যাপার কী, আবার তক্ষুনি তন্দ্রা এল৷ চোখ বুজতে-না-বুজতে দুড়ুম করে বন্দুকের আওয়াজ, পাকড়ো-পাকড়ো চিৎকার! সকলেই উঠেছে, সাহেবও পিস্তল হাতে তাঁবু থেকে বের হলেন৷

‘কী ব্যাপার? কে গুলি চালল?’

ওই সিপাই৷

আলো জ্বালা হল৷ হাবিলদারকে প্রাণে মেরেছে, আরও দু-তিনজন সিপাই জখম হয়েছে৷ তাদেরও অবস্থা খারাপ৷ সিপাইটা আরও একটা রাইফল আর দু-তিন ব্যান্ডোলিয়ার কার্তুজ নিয়ে অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়েছে৷ আলো জ্বালানো হল বটে, কিন্তু পরক্ষণেই নিভিয়ে দিতে হল৷ কারণ, হতভাগা সিপাই একটু দূরে একটা পাহাড়ের উপর আশ্রয় নিয়েছিল, আর একটু পর-পর লন্ঠনের আলো তার নজরে পড়তেই পিং করে গুলি ছুড়ছিল৷

সকালে লোকজন সিপাইদের ওখানে রেখে, রাইফল আর কার্তুজ নিয়ে সাহেব একলাই গেলেন চোদ্দো মাইল দূরে কেল্লায় খবর দিতে৷ তারপর সেখান থেকে ডাক্তার, সিপাই ইত্যাদি এসে সকলকে নিয়ে গেল৷ দু-তিনদিন বিশ্রাম করে, অন্য দল সিপাই নিয়ে, সাহেব আবার কাজ শুরু করলেন৷

সিপাইটার আর কোনো সন্ধান পাওয়া গেল না, সে আফগান এলাকায় চলে গিয়েছিল৷

আগেই বলেছি আমি বেলুচিস্থানের কাজ ফেলে বন্নু আর টর্চি উপত্যকায় চলে গিয়েছিলাম৷ বর্মায় যেমন বাঘ-ভাল্লুকের ভয় ছিল, এখানে তার কিছুই নেই৷ এ-দেশের ভয় হল শীতের, আর বাঘ-ভাল্লুকের চেয়েও হিংস্র মানুষের— ডাকাতের৷

উঃ, সে কী ভয়ানক শীত! পাহারাওয়ালা বাইরে দাঁড়িয়ে পাহারা দেয় আর দুঘণ্টা পর-পর বদলি হয়৷ বাইরে বলতে আবার একেবারে খোলা মাঠ নয়, মাথার উপরে চাল আছে৷ গায়ে তো তাদের এক বোঝা কাপড়-চোপড় আর ‘পোস্তিন’৷ লোমসুদ্ধ ছাগলের চামড়ার কোটকে ‘পোস্তিন’ বলে, তার মতো গরম আর কিছু হতে পারে না৷ কিন্তু তাতেও কি আর শীত যায়? কয়েকজন পাহারাওয়ালা এই সব সুদ্ধই জমে মরে গেল৷

উপরে মোটা-মোটা তিনটে কম্বল, গায়ে গরম গেঞ্জি, ফ্ল্যানেলের জামা আর সোয়েটার, পায়ে দু-জোড়া গরম মোজা, তবু মনে হয় না কিছু গায়ে দিয়েছি৷ এর উপর একটা ‘পোস্তিন’ চড়ালে তবে কিছু আরাম বোধ হয়৷ তবু কিন্তু নাক-মুখ ঢেকে শুতে হয়, আর তা সত্ত্বেও ভোরের দিকটা হাত-পা ঠান্ডা হয়ে ঘুম ভেঙে যায়৷ তাঁবুর বাইরে তো সমস্ত একেবারে সাদা ধবধব করছে৷ পাহাড় মাঠ সব সাদা, নদীর জলও জমে গেছে, উপরের দিকটা৷

তাঁবুর ভিতরে বালতির জল কম্বল চাপা দিয়ে রাখলেও জমে পাথরের মতো হয়ে যায়৷ আর তাতে মাঝে-মাঝে বড়ো তামাশা হয়৷ একজন বাঙালি ভদ্রলোক আমাদের সঙ্গে সেখানে গিয়েছিলেন, তাঁর সঙ্গে একজন পাঞ্জাবি চাকর৷ লোকটা বেশ মজবুত, খাটতেও পারে খুব, কিন্তু বুদ্ধিটা একটু কম৷ বাবুর বোধহয় সেদিন ভালো করে হজম হয়নি, তাই তিনি ভোরে উঠে, ব্যস্ত হয়ে চারককে বললেন, ‘জলদি এক লোটা পানি দেও৷’ হুকুম দিলেন বটে কিন্তু চাকর আর জল দেয় না, বাবু যতই তাড়া দেন সে ততই বলে, ‘হুঁ, হু, যাচ্ছি৷’ বাবুর আর সবুর সয় না, তিনি চ্যাঁচামেচি আরম্ভ করলেন আর আমার তাতে ঘুম ভেঙে গেল৷ আমি উঠে বাবুর ভঙ্গি দেখে বুঝলাম তাঁর অবস্থা বেগতিক৷ তখন আমার লোক তাড়াতাড়ি এক ঘটি জল এনে দিল, বাবুও হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন৷

ব্যাপার হয়েছে কী, চাকরটি রাত্রে বালতির মধ্যে লোটা রেখে দিয়েছিল৷ তাড়া দেওয়া মাত্র সে ছুটে জল আনতে গেছে, কিন্তু এদিকে বালতিসুদ্ধ জল জমে পাথর! তার ভিতর থেকে লোটা বের হবে কী করে? উনুন ধরিয়ে, বালতি সুদ্ধ বরফ চাপিয়ে লোটা বের করতে পনেরো মিনিট লেগেছিল৷

থার্মোমিটার ১৭° ফ্যারেনহাইট পর্যন্ত নেমেছিল, আবার যখন গরম পড়ল তখনও প্রাণ ওষ্ঠাগত, ডাকবাংলোর বারান্দার ছায়াতে ১১৭°!

ও-দেশে জঙ্গল নেই, অন্তত বর্মায় বন বলতে আমরা যা বুঝতাম তা নেই৷ সমস্ত পাহাড় ন্যাড়া, তাতে খালি ছোটো-ছোটো ঘাস আর পাথর, সেই ঘাস আবার শীতের ধাক্কায় একেবারে জ্বলে গেছে৷ পাঠানের দেশ, বড়ো শক্ত জায়গা৷ দিনে হাতিয়ার-বাঁধা পাহারাওয়ালা নিয়ে কাজে বেরুতে হয়, আবার রাতেও বন্দুক নিয়ে লোক পাহারা দেয়৷ এই কাজের জন্য একুশ-বাইশজন লোক সঙ্গে আছে, এরাও পাঠান, এই দেশেরই লোক হাতিয়ারও তাদের নিজের, আমরা খালি তংখা দিই৷ তারা কেল্লায় পলিটিকেল সাহেবের কাছে গিয়ে দলিল সই করে দিয়ে এসেছে যে গবর্নমেন্টের এতজন লোক, এতগুলো জানোয়ার ও আসবাব ইত্যাদি বুঝে পেল, আবার গুণে ফিরিয়ে দেবে৷ জিনিসপত্র বইবার জন্য সঙ্গে উট আছে, উটওয়ালারা পাঞ্জাবি মুসলমান, পাঠান দেশের দু-চারটি কথা বলতে পারে৷ সঙ্গের খালাসিরাও পাঞ্জাবি মুসলমান৷

সে দেশে বড়ো ডাকাতের ভয়, সুবিধা পেলেই সব লুটে নেয়৷ সেইজন্য রাত্রে সর্বদা পাহারা রাখতে হয়, আর নিজেও সশস্ত্র থাকতে হয়৷ দিনে কাজে যাই কোমরে রিভলভার বেঁধে, রাতে শুই গুলিভরা রিভলভার বালিশের তলায় রেখে৷ এই দারুণ শীত কিন্তু আগুন জ্বালাবার জো নেই৷ একে তো কাঠই মেলে না, তার উপর ধুনি জ্বালালে দূর থেকে ডাকাতরা দেখতে পেয়ে গুলি চালাবে৷

কাজ শেষ করে সন্ধ্যার আগে তাঁবুতে ফেরা চাই৷ অন্ধকারে চোর-ডাকাতের সুবিধা, যদি পথের পাশেই বসে থাকে তাহলেও দূর থেকে দেখা যাবে না৷ মেরে, কেটে, লুটে নেওয়া তাদের ব্যাবসা বললেও চলে৷

ও-দেশের প্রধানদের ‘মালিক’ বলে৷ একজন মালিক আমার কাছে বখশিস চেয়েছিল৷ আমি বললাম, ‘টাকা তো আমার কাছে নেই, কেল্লার তহশিলদারের কাছে টাকা রেখে এসেছি৷ আমি চিঠি দিচ্ছি, তাঁর কাছে যাও বখশিস মিলবে৷’

সে হেসে বললে, ‘আচ্ছা বাবুসাহেব, আমি তো ওয়াজির, লুটে খাওয়া আমার পেশা, যখন সুবিধে হবে বখশিসটা নিয়ে নেব৷’

নিজেদের মধ্যেও অনেক সময় মারামারি কাটাকাটি! অনেক সময় দেখা যায় এ গ্রামের কোনো-কোনো লোক গ্রাম বিশেষে যায় না৷ কেন? ও-গ্রামের অমুকদের সঙ্গে এদের বংশগত শত্রুতা— ব্লাড ফিউড— আছে৷ কোন প্রাচীন যুগে এদের পূর্বপুরুষদের কেউ ওদের পূর্বপুরুষদের কাকেও হত্যা করেছিল৷ তারপর আবার ওদের কেউ এদের আর কাউকে মেরে সেই রক্তের ঋণ শোধ করেছিল, আবার এরা তার প্রতিশোধ নিয়েছিল, এমনি করে বংশানুক্রমে রক্তের বিরোধ চলে আসছে৷

এখন ওদের পালা৷ এদের কাউকে পেলেই শেষ করবে৷

টর্চি উপত্যকার উত্তর পশ্চিম দুইদিকে আফগান রাজ্য৷ দক্ষিণ মাসুদদের দেশ, মাসুদরাও ওয়াজির, সকলেই লুটপাটে ওস্তাদ! আমাকে কাজের খাতিরে আফগান সীমানায় যেতে হত৷ দু-দুবার ওরা আমার ক্যাম্প লুটে নেবার বন্দোবস্ত করেছিল, আর দু-বারই ভগবানের কৃপায় বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছিলাম৷

এবার আফগান সীমানার দু-আড়াই মাইল দূরে একটা গ্রামে আমার তাঁবু ছিল৷ প্রোগ্রামমতো বরাবর কাজ করে এসেছি, কিন্তু এই প্রথম একদিন দেরি হল৷ ঠিক সময়ে কাজ শেষ হল না, কাজেই বাধ্য হয়ে আমাদের আরও একদিন সেখানে থেকে যেতে হল৷ হুকুমমতো ভোরে উঠেই একখানি চিঠি সাহেবের কাছে পাঠিয়ে দিলাম৷ একজন সওয়ার চিঠি নিয়ে চোদ্দো-পনেরো মাইল দূরে কেল্লায় চলে গেল, আমি কাজে বেরোলাম৷

বিকেলে ওই সওয়ারের ফিরবার কথা, চোদ্দো-পনেরো মাইল রাস্তা ঘোড়ায় চড়ে গেছে, কিন্তু সে ফিরল না৷ পরদিন আমি কাজে বেরিয়েছি, পথে ওই সওয়ার, তহশিলদার সাহেব, আরও বহুলোকের সঙ্গে দেখা৷ কী ব্যাপার? আমার যে আগের দিন ফিরবার কথা ছিল এ-খবরটা কী করে নাকি ডাকাতরা জানতে পেরে, লুটপাট করবার জন্য পথে এক জায়গায় আড়ি পেতে বসেছিল৷ আমার সওয়ারটি পাহাড়ের উপর থেকে, প্রায় এক মাইল দূরে, রাস্তার ধারে একটা কী চকচক করছে দেখতে পেয়ে, সন্দেহ করে দাঁড়াল৷

দু-তিনবার ওই চকচকে জিনিসটা তার চোখে পড়ল৷ ভালো করে দেখে বুঝতে পারল যে ওটা বন্দুকের নলিতে রোদ পড়ে চকচক করছে৷ তখন সে সেই রাস্তায় না গিয়ে পাহাড়ের উপরে ছাগল-ভেড়ার রাস্তা ধরে চলল৷ তিন-চতুর্থাংশ গিয়ে স্পষ্ট দেখতে পেল অনেক লোক পাথরের আড়ালে বন্দুক হাতে গুড়ি মেরে বসে আছে৷ লোকগুলোও ততক্ষণে তাকে দেখতে পেয়েছে, আর সে ভালো রাস্তা ছেড়ে জংলি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে দেখে বুঝতে পেরেছে যে ও তাদের দেখে ফেলেছে৷ তখন তারা বেরিয়ে এসে ওকে তাড়া করল, দু-চারটে বন্দুকও ছুড়ল, এও বন্দুক ছুড়ল, তারপর ঘোড়া হাঁকিয়ে পালিয়ে গেল, ওরা কুড়ি-পঁচিশজন আর ও একলা৷

অনেক ঘুরে দুটো-তিনটার সময় কেল্লায় পৌঁছেছিল৷ তহশিলদার সাহেব সব শুনে তার সঙ্গে লোকজন পাঠিয়েছেন৷ পরে তিনি আমাকে বলেছিলেন বড্ড বেঁচে গিয়েছ৷ ওই গ্রামে নিশ্চয়ই ওদের চর আছে৷

আর একবার ওই একই গ্রামে আমার তাঁবু ছিল৷ এবার যথাসময়েই কাজ শেষ হয়েছিল, কিন্তু আমাকে একটু তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে৷ কেল্লার কাছে একটু কাজ ছিল তাও শেষ করতে হবে৷ খোঁজ করলাম অন্য রাস্তা আছে কিনা যাতে ঘণ্টা দু-তিন আগে পৌঁছানো যায়৷ শুনলাম একটা ছোটো পথ আছে৷ গ্রামের লোকেরা বলল সেটা দিয়ে গেলে চার-পাঁচ মাইল বেঁচে যাবে, কিন্তু রাস্তা খারাপ, বোঝা নিয়ে উট চলতে পারবে না৷ প্রায় তিন-চার জরিপ খারাপ রাস্তা, এক জরিপ হল বাইশ গজ৷ ওইটুকুর জন্য চার-পাঁচ মাইল ঘুরব! আমি বললাম, ‘এই রাস্তাতেই চলো৷ খারাপ জায়গাটাতে বোঝা নামিয়ে উট পার করে নেব৷ আবার বোঝাই করলে হবে৷’

গ্রামের কয়েকজন লোক সঙ্গে নিয়ে ওই পথেই চললাম৷ খুব সাবধানে উটগুলো খারাপ জায়গাটা পার হল, বোঝা নামাতে হল না৷ কেল্লায় পৌঁছে যথাসময়ে কাজ শেষ করলাম৷

পরদিন তহশিলদার সাহেব খবর দিলেন যে আবার আফগান ডাকাতরা ওই জায়গায় আমাদের অপেক্ষায় বসে ছিল৷ অনেকক্ষণ বসে থেকে, যে গ্রামে তাঁবু ছিল সেখানে গিয়ে মহা তম্বি! কেন সরকারি লোকদের গ্রামে থাকতে দেওয়া হয়েছিল! আর তারা গেল কোথায়? কোন রাস্তায় গেল, ইত্যাদি৷

একদিন সন্ধ্যার সঙ্গে-সঙ্গেই কাজ শেষ করে তাঁবুতে ফিরেছি, কাপড়-চোপড় ছেড়ে, হাত-পা ধুয়ে, বিশ্রাম করে, খেয়ে শুয়ে পড়েছি৷ সমস্তদিনের পরিশ্রম, বেজায় শীত, আবার থাকি তাঁবুতে, কাজেই একটু তাড়াতাড়ি তাঁবুর দরজা বন্ধ করে লেপ মুড়ি দিতে পারলেই ভালো লাগে৷

কতক্ষণ ঘুমিয়েছি বলতে পারি না, বন্দুকের আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল৷ ওদেশের লোকেরা শত্রুর ভয়ে সব গ্রামের চারধারে উঁচু মাটির দেয়াল দেয়৷ আমরা একেবারে সেই দেয়ালের গা ঘেঁষে তাঁবু খাটিয়ে ছিলাম৷ জিগগেস করলাম, ‘কীসের আওয়াজ?’

‘ডাকাত এসেছে, তাদের বন্দুকের আওয়াজ৷’

‘কত দূরে ডাকাত?’

‘তিন-চার-শো গজ হবে, তবে রাত বলে ভালো বোঝা যাচ্ছে না৷’

জ্যোৎস্না রাত বলে রক্ষা৷ আমাদের লোকেরা ততক্ষণে সকলে জেগে গেছে, পাহারাওয়ালারা বন্দুক নিয়ে প্রস্তুত, হুকুম পেলেই চালায়৷ আমি সবেমাত্র দোভাষীকে দিয়ে হুকুম দিয়েছি, অমনি আবার সেই বন্দুকের আওয়াজ৷ তখন আমাদের লোকরাও বন্দুক চালাতে আরম্ভ করল, বার দশেক চালাবার পর আবার সমস্ত চুপচাপ হয়ে গেল৷ তারপর লোকজনদের সকলের খোঁজ নিলাম, সকলেই ভালো আছে, কারো গায়ে গুলি লাগেনি৷ তখন পাহারাওয়ালাদের সাবধান করে দিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম৷ সকালে উঠে দেখা গেল একটা উটের পায়ে গুলি লেগেছে, বিশেষ কিছু না, কয়েকদিন ওষুধ লাগাতেই সেরে গেল৷

ও-দেশের লোকরাই আমাদের সঙ্গে পাহারা দিত৷ জন দুই মালিক আর পনেরো-কুড়িজন অন্য লোক৷ বন্দোবস্ত ছিল যে মালিকরা দৈনিক মজুরি পাবে দেড়-টাকা-দু-টাকা করে আর অন্যরা আট আনা হিসাবে৷ নিজেদের এলাকায় তারা রক্ষণাবেক্ষণ করবে, অন্য এলাকায় যাবে না৷ এক সর্দারের এলাকার কাজ শেষ হলে, পথে এসে অন্য এলাকার লোক বসে থাকত আর তাদের হাত থেকে গুণে সকলের ভার নিত৷ এই পাহারাওয়ালাদের খাসাদার বলে৷

একটা গ্রামের কাছে গিয়ে তাঁবু ফেলেছি, গ্রাম থেকে প্রায় সিকি মাইল দূরে৷ এই এলাকার লোকরা কেল্লা থেকে আমাদের মালপত্র সব গুণে এনেছে, কিন্তু তবুও সন্ধ্যার সময় গোলযোগ আরম্ভ করেছে৷ শুনতে পেলাম একটা কিছু খুঁটিনাটি চলছে, তর্ক হচ্ছে৷ সর্দার দু-জন যেন এক-একবার বেশ গরম হয়ে উঠছে৷

দোভাষীকে জিগগেস করলাম, ‘কী হয়েছে?’

দোভাষী বললে, ‘খাসাদাররা গোল করছে, শয়তানি আরম্ভ করেছে, বলছে তাদের প্রত্যেককে এক টাকা করে না দিলে তারা কাজ করবে না, এক্ষুনি চলে যাবে৷’

সর্দার দু-জনকে ডেকে পাঠালাম, তাদের সঙ্গে চার-পাঁচজন খাসাদারও এল৷ জিগগেস করলাম, ‘ব্যাপার কী? কীসের গোলমাল?’

সর্দাররাও দোভাষীর কথার পুনরক্তি করল, আর বলল, ‘এরা বদমাস, তাই গোলমাল করছে৷’

খাসাদারদের জিগগেস করলাম, ‘তোমরা তো রোজ আট আনা হিসাবে রাজি হয়ে এসেছ, এখন আবার গোল করছ কেন?’

ওরা বলল, ‘আমরা রাজি হইনি, সর্দাররা রাজি হয়েছে৷ আমরা এক টাকা রোজের কম রাজি হব না৷ এক্ষুনি চলে যাব৷’

ততক্ষণে অন্ধকার হয়ে এসেছে, আর তাঁবুও গ্রাম থেকে সিকি মাইল দূরে, সেইজন্যেই বেটাদের শয়তানি৷

আমি সর্দারদের জিগগেস করলাম, ‘তোমরাও কি চলে যাবে?’

তারা উত্তর দিল, ‘তাহলে আর এতক্ষণ ধরে ওদের সঙ্গে ঝগড়া করছি কেন? আমাদের কথার নড়চড় হবে না৷’

আমি বললাম, ‘আমি আট আনার বেশি এক পয়সা দেব না৷’

তখন মহা খাপ্পা হয়ে খাসাদাররা সকলে চলে গেল আর যাবার সময় বেশ করে শাসিয়ে গেল, ‘রাত্রে ভালো করে পাহারা দিস, চাই কি আমরাই আসতে পারি৷’

সর্দাররাও পাল্টা শাসিয়ে জবাব দিল, ‘জানিস এটা সায়েদাখানের এলাকা? রাত্রে আসবার সময় খুব সাবধানে আসিস, কার গর্দানে কটা মাথা আছে দেখা যাবে!’

সায়েদাখান ওখানকার ওয়াজিরদের প্রসিদ্ধ মালিক, তার দোর্দণ্ড প্রতাপ৷ আমার সঙ্গের সর্দাররা সায়েদাখানের আপনার লোক৷ আমরা সে রাতটা খুব সাবধানে কাটালাম, খুব কড়া পাহারার বন্দোবস্ত করলাম৷ সর্দাররা খালাসিদের সাবধান করে দিল যেন রাত্রে কেউ তাঁবু থেকে বাইরে না যায় বা বাতি না জ্বালায়৷ সামান্য নড়াচড়ার উপরেই রাত্রে গুলি চলবে৷ যাই হোক, রাত কেটে গেল, কোনো গোলযোগ হল না৷

সর্দারদের সঙ্গে তাদের আপনার লোক তিনজন ছিল৷ সকালে উঠে একজনকে আমি কেল্লায় পলিটিকেল তহশিলদারের কাছে পাঠালাম, দু-জনকে তাঁবু পাহারায় রাখলাম আর সর্দার দু-জনকে সঙ্গে নিয়ে কাজে চলে গেলাম৷ কাজ শেষ করে সেদিন শিগগির ফিরেছি, এসে দেখি তাঁবুতে লোকে লোকারণ্য, তহশিলদার সাহেব, সিপাই আরও মেলা লোক৷ তাঁবুতে পৌঁছানো মাত্র তহশিলদার সাহেব বললেন, ‘বাবুসাহেব, তুমি করেছ কী! কাল তোমাকে খোদা বাঁচিয়েছেন৷ পাঁচটি মাত্র লোক সঙ্গে নিয়ে কেউ এ-জায়গায় রাত্রে থাকে? তোমার তক্ষুনি গ্রামে চলে যাওয়া উচিত ছিল৷’

‘তহশিলদার সাহেব, চটো কেন? কাল যদি ওদের অন্যায় আবদারে রাজি হতাম বা ওরা চলে গেলে পর আমিও ভয়ে গ্রামে চলে যেতাম, তাহলে ফলটা কী হত? তুমি তো পলিটিকেল লোক, একবার চিন্তা করে দেখো৷ ওরা হয়তো আবার দেড় টাকা চেয়ে বসত, বা অন্য চাল চালত৷ আর চলে গেলে এখানে আর কেউ কাজ করতে পারত না, বদনাম হত, সরকারের কাজের ক্ষতি হত৷’

একটু চিন্তা করে তহশিলদার সাহেব সেকথা মেনে নিলেন, কিন্তু তাঁবু তুলে গ্রামে নিয়ে যেতে বললেন৷

আমি বললাম ‘তা হবে না, এখানেই থাকব, আপনি অন্য খাসাদারের ব্যবস্থা করুন৷’

অনেক চেষ্টা করে তহশিলদার অন্য লোকের বন্দোবস্ত করে দিলেন৷

এর পর আরও দু-দিন ওই আড্ডায় ছিলাম৷ কাজ শেষ করে তবে কেল্লায় ফিরলাম৷

ও-দেশে আছে সব ঝানু চোর৷ বন্নু শহরে আমার তাঁবু ছিল ডাকবাংলোর কমপাউন্ডে৷ উটওয়ালারা উট নিয়ে সরাইয়ে আশ্রয় নিয়েছে৷ সরাইয়ের চারদিক ঘেরা, তার ভিতর থেকে দেয়াল কেটে কখন কে উট বের করে নিয়ে গেছে, কেউ টেরও পায়নি৷ বহু কষ্ট করে প্রায় দু-মাস পরে ওই উট পাওয়া গিয়েছিল৷

একদিন বন্নু শহর থেকে প্রায় পাঁচ-সাত মাইল দূরে একটা পাহাড়ে কাজ করতে গিয়েছি, সঙ্গে চারজন খাসাদার৷ পাহাড়ের উপর উঠে দূরবিন (থিওডোলাইট) লাগিয়ে কাজের জন্য প্রস্তুত হচ্ছি, এমন সময় একজন খালাসি বলল, ‘হুজুর, হরিণ!’ চেয়ে দেখলাম আন্দাজ ৩৫০—৪০০ গজ নীচে নালার ধারে চার-পাঁচটা হরিণ চরছে৷ একজন খাসাদার অমনি রাইফল হাতে নিয়ে শুয়ে পড়ল, আর খুব ভালো করে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ল৷ একটা হরিণ তক্ষুনি মাটিতে পড়ে ছটফট করতে লাগল, আর বাকি কটা নিমেষের মধ্যে কোথায় যেন উড়ে গেল৷

দু-জন খাসাদার আমার বড়ো পেন-নাইফখানা চেয়ে নিয়ে হরিণটাকে হালাল করতে ছুটল৷ হরিণটা মরেনি, গুলি লেগে তার কোমর ভেঙে গিয়েছিল, নড়বার শক্তি ছিল না৷ এরা ছুটে গিয়ে তাকে জবাই করল, তারপর গোটা একটা পিছনের ঠ্যাং ছাড়িয়ে নিল, দুজনে মিলে হরিণটাকে ঘাড়ে করে নিয়ে এল৷ আর দু-জন এর মধ্যেই শুকনো ঘাস, কাঁটাঝোপ ইত্যাদি জড়ো করে তাতে আগুন ধরিয়েছে, আর একটা চ্যাপটা সমান পাথর আগুনের উপর চাপিয়ে দিয়েছে৷ হরিণ নিয়ে এলে পর চারজনে মিলে ওই পাটাকে ফালি-ফালি করে কেটে, ওই গরম পাথরটার উপর রাখতে লাগল৷ মিনিট দুই ছ্যাঁকছোঁক করলে পর, উল্টে দিল, আরও মিনিট দুই ছ্যাঁকছোঁক করলে পর, তুলে খেতে আরম্ভ করল৷ তখনও রক্ত পড়ছে৷

একজন আমাকে জিগগেস করল, ‘খাবে?’

আমি বললাম, ‘না৷’

তাই শুনে একজন ঠাট্টা করে বলল, ‘বাবু ক্যায়সা খায়গা? ঘি চাহিয়ে, মাশালা চাহিয়ে, তব না বাবু খায়গা!’

দেখতে দেখতে চারজনে মিলে একটা গোটা রাং, চার-পাঁচ সের মাংস হবে, সমস্তটা খেয়ে শেষে করল৷

একবার আমাদের এক সাহেবের তাঁবু পড়েছে এক গ্রামে৷ তাঁবু থেকে প্রায় সিকি মাইল দূরে উটওয়ালারা উট চরাচ্ছে, সঙ্গে লোকজন রয়েছে৷ বেলা সাড়ে-তিনটে-চারটের সময় কোথা থেকে আট-দশজন লোক হাতিয়ার-টাতিয়ার নিয়ে এসে উপস্থিত! আর এসেই উটগুলোকে তাড়িয়ে নিয়ে চলল৷ উটওয়ালাদের চিৎকার শুনে খাসাদাররা বন্দুক হাতে ছুটল, একটু কাছে পৌঁছতেই গুলি চালাতে আরম্ভ করল৷ ‘লুটেরা’-রা যখন দেখল উটসুদ্ধ পালাতে পারবে না, তখন উট ছেড়ে দিয়ে পিট্টান দিল৷ যাবার সময় দুটো উটের পা কেটে দিয়ে গেল৷ খাসাদাররা ওই দুটো উটকে তাড়াতাড়ি জবাই করে ফেলল, আর চারদিকের লোকজন মিলে তো মহা ভোজ!

ওখানকার লোকগুলোই বেখাপ্পা৷ সর্বদা হাতিয়ার সঙ্গে থাকে আর কথায়-কথায় হাতিয়ার চালায়৷ শেষটা আমাদের সার্ভেয়ারদের উপরও গুলি চালাতে আরম্ভ করল৷ বেচারা সার্ভেয়াররা সমস্তদিন খেটে ক্লান্ত হয়ে ফিরেছে, স্নান করে, খেয়ে-দেয়ে শুয়েছে, এইবার একটু আরাম করবে, আর অমনি দুড়ুম-দুড়ুম তাঁবুর উপর গুলি! সার্ভেয়ারদের সঙ্গেও সশস্ত্র পাহারা আছে, কিন্তু অন্ধকারে তারা কী করবে? তার উপর তাঁবু নালার ধারে, গুলি চালাচ্ছে পাহাড়ের উপর থেকে৷ কোনো রকমে রাত কাটিয়ে, সকালে উঠে একেবারে কেল্লায়!

অবশেষে সেবারের মতো কাজ বন্ধ করে আমরা আবার ব্যাঙ্গালোরে ফিরে গেলাম৷

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *