বনের খবর – ৪

১৯০১-১৯০২৷ ব্রহ্মদেশ ও শান স্টেট৷ সাদিন হুসেনের যে কাজ আগের বছর শেষ হয়নি, সেই কাজের ভার পড়ল আমার মাথায়৷ শেষ হলে অন্য কাজে যেতে হবে৷ এ-বছর বুড়ো রামশবদ নেই, আমি একলাই চলেছি৷ বুড়ো পেনশান নিয়েছে৷ একমাস পরে অন্য সব লোক আসবে৷

বনের ভিতর মাঝে-মাঝে গ্রাম আছে৷ আমি নকশার কাজ করি এবার, সুতরাং সুবিধা পেলেই তাঁবু ফেলি৷ গ্রামে থাকি, আর কাজ করতে যাই চারপাশের পাহাড়ে, জঙ্গলে৷ আশেপাশের পাহাড়-জঙ্গলের ম্যাপ আঁকা হলে, তাঁবু তুলে অন্য গ্রামে চলে যাই, গ্রাম না-থাকলে জঙ্গলেই আড্ডা করি৷

এইরকম একটা গ্রামে আমি কিছুদিন ছিলাম৷ আমার জরিপের কাজ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে অনেক দূর অবধি দেখতে পাওয়া চাই, নতুবা কাজের সুবিধা হয় না, বিশেষত পাহাড়ের কাজের৷ পাহাড়ের চুড়োয় চড়েই কাজ আরম্ভ করতে হয়, যদি সেখানে বন থাকে, তাহলে প্রথম কাজ হয় ওই বন কেটে পরিষ্কার করে কাজের সুবিধা করে নেওয়া৷ একদিন একটা পাহাড়ে উঠে, সঙ্গের লোকজনদের জঙ্গল কাটতে বলেছি, তারা দা-কুড়ুল নিয়ে তাদের কাজে লেগে গেছে৷ দু-চার ঘা ভালো করে দিতে-না-দিতেই এমন ভীষণ গর্জন করে একটা ভল্লুক বের হয়ে এল যে কী বলব! সে তার গর্তের ভিতর ঘুমুচ্ছিল, সেই কাঁচা ঘুম কেন ভেঙে দিল সেইজন্য তার রাগ৷

যারা তার ঘুম ভাঙিয়েছিল, তারা অবশ্য তাকে দেখেই বাপ-মা’র নাম নিয়ে, প্রাণপণে ছুট দিয়েছিল! ভাল্লুক এসে আর তাদের কারো সাক্ষাৎ পায়নি, কাজেই রাগে গরগর করতে-করতে আবার বনে ঢুকে পড়ল৷ মজার কথা এই যে, শেষে আর কেউ স্বীকার করতে চায় না যে ভাল্লুকের ভয়ে তারা পালিয়েছিল৷ শঙ্কর বলল, ‘আমি কি পালিয়েছিলাম, আমি গিয়েছিলাম আমার দাখানা আনতে৷’ এই শঙ্করই আগের বছর বলেছিল যে সে হাতি ছাড়া অন্য কোনো জানোয়ারকে ভয় পায় না!

ভাল্লুক বড়ো বেখাপ্পা জানোয়ার৷ ও-দেশের লোকেরা বাঘের চেয়েও ভাল্লুককে ভয় করে বেশি৷ বাঘে ধরলে হয়তো মেরেই ফেলল— আপদ চুকে গেল৷ ভাল্লুক বড্ড কষ্ট দিয়ে মারে, প্রাণে না মারলেও জন্মের মতো খোঁড়া করে দেয়, হয়তো চোখই কামড়িয়ে নিয়ে গেল৷

একটা গ্রামে তাঁবু ফেলে ছ-সাত দিন ছিলাম৷ গ্রামের প্রধানটি বড়ো ভালোমানুষ, আমার উপর তার বড়ো স্নেহ জন্মেছিল৷ তার গ্রাম থেকে ছয়-সাত মাইল দূরে হয়তো তাঁবু ফেলেছি, তার এলাকায়ও নয়, তবু সেখানে অবধি আমাকে দেখবার জন্য উপস্থিত হত৷ হাতে করে আমার জন্য তরি-তরকারি, নানা গ্রাম থেকে জোগাড় করে নিয়ে আসত৷ যখন তার গ্রামে গিয়ে উপস্থিত হলাম, তখন তো তার আর আনন্দের সীমাই রইল না৷ রোজ বিকেলে সে আমার কাছে এসে বসত, আর শিকারের জানোয়ারের আরও কত কিছু গল্প করত৷ তার ডান হাতখানি কী করে ভাল্লুক ছিঁড়ে নিয়ে গিয়েছিল, সেই গল্প আমি তখন তার কাছে শুনেছিলাম৷

প্রধান, তার গ্রামের আরও কয়েকজন লোকের সঙ্গে জুটে পাহাড়ে বাঁশ কাটতে গিয়েছিল৷ তাদের দেশে একরকম মোটা বাঁশ হয়, তাতে তাদের কলসির কাজ চলে৷ তার এক-একটা চোঙায় পাঁচ-ছয় সের জল ধরে— তারা সেই বাঁশ আনতে গিয়েছিল৷ পাহাড়ে উঠে সকলে যে যার কাজে ছড়িয়ে পড়েছে— প্রধানও এক জায়গায় খুব মোটা-মোটা বাঁশ দেখতে পেয়ে কাটতে গেছে৷ বাঁশের পিছনে যে প্রকাণ্ড একটা ভাল্লুক শুয়ে রয়েছে সে তা দেখতে পায়নি৷ যেমন সে খটাং করে বাঁশের গায়ে কোপ বসিয়েছে, অমনি আর যাবে কোথায়? হ্যাঁও-হ্যাঁও করে বন-জঙ্গল কাঁপিয়ে, ভাল্লুক এসে তার ঘাড়ে পড়ল৷ প্রধান বেচারা অতশত কল্পনাও করেনি, তার কেমন ভ্যাবাচ্যাকা লেগে গেল, আর হাতের দাখানা কোথায় পড়ে গেল, কী যে করবে কিছুই বুঝতে পারল না৷ ভাগ্যিস তার সঙ্গের লোকরা ভাল্লুকের গর্জন শুনে তখনি ছুটে এসেছিল, তা না হলে সেদিন তাকে মেরেই ফেলত৷ হঠাৎ অনেকগুলো লোক উপস্থিত হওয়াতে ভাল্লুকটা পালিয়ে গেল, কিন্তু যাবার সময় প্রধানের ডান হাতখানা কবজির উপর অবধি ছিঁড়ে নিয়ে গেল৷

এমন জানোয়ারকে লোকে ভয় করবে না তো আর ভয় করবে কাকে? বাঘই হোক, ভাল্লুকই হোক, বনের ভিতর তাদের হল এলাকা— কাজেই সেখানে তাদের বিশেষ হিসেব করে চলতে হয়৷ সকল সময় আবার হিসেব করবারও সময় থাকে না, তার আগেই ছুট দিতে হয়, বা ‘আর কিছু’ করতে হয়৷

‘আর কিছু’ কী রকম বলছি শোনো৷

ওই গ্রাম ছেড়ে, আমরা অন্য গ্রামে উঠে গিয়েছি৷ সেখানে একদিন কাজ বন্ধ করতে সন্ধ্যা হয়ে গেল, আমরা তাড়াতাড়ি তাঁবুতে ফিরতে আরম্ভ করলাম৷ সকলের আগে দুজন শান, তাদের পিছনে আমি, আমার পিছনে দোভাষী, আর তার পিছনে আমার সহিস ঘোড়া নিয়ে৷ খালাসিরা জরিপের যন্ত্রপাতি ঘাড়ে করে প্রায় পঞ্চাশ-ষাট হাত পিছনে পড়েছে৷

শুকনো নালার ধারে-ধারে, আঁকাবাঁকা পথ, তার একটা মোড় ঘুরেই তো সামনের শানটি ক্যাঁও-ম্যাঁও করে চিৎকার করে পিছনের দিকে এক লাফ দিয়েছে— পথের মাঝখানে চার-পাঁচ হাত দূরেই এক প্রকাণ্ড বাঘ! বাঘটা তখুনি লাফ দিয়ে নালায় পড়ল৷ পড়ল, কিন্তু পালাল না, সেইখানেই পায়চারি করতে লাগল৷

এদিকে শানরা দুজন পালাবার জোগাড় করছে দেখেই আমি তাদের হাত ধরে ফেললাম, বললাম, ‘পালাচ্ছ কোথায়?’

তারা উত্তর দিল, ‘বাবু, ওটা দুষ্টু বাঘ, দেখো-না, আমরা অত কাছেই রয়েছি, চেঁচামেচি করছি (পিছনের লোকদের ডাকা হচ্ছিল) তবু যাচ্ছে না, ফিরে-ফিরে আমাদের কাছেই আসছে৷’

আমি বললাম, ‘তা হচ্ছে না বাপু, পিছনে আমার লোক রয়েছে, তারা না-এলে যাওয়া হচ্ছে না৷’

এদিকে দোভাষী বনে আগুন ধরাবার চেষ্টা করছিল, কিন্তু হিমে লতা-পাতা ডাল-পালা সব ভিজে রয়েছে, কিছুতেই আর আগুন জ্বলে না৷ পিছনের লোকগুলোকে যতই ডাকি, ‘জলদি আও, জলদি আও,’ লোকগুলো ততই খালি বলে, ‘আতা হুঁ৷’

আবার জিগগেস করে, ‘কেয়া হুয়া?’

আমি বললাম, ‘তুমহারা নানা হিঁয়া বয়ঠা হ্যায়!’

লোকগুলো একটু ঢালু, প্রায় খাড়া জায়গা দিয়ে আসছিল৷ আমার কথা শুনে ওই জায়গাটুকু হেঁটে নামবার অবসর হল না তাদের৷ তাদের কাপড় আর পিছনের চামড়ার যে কী দশা হয়েছিল সেটা বুঝতে পার৷ একেই বলেছিলাম ‘আর কিছু’ করা৷

তখন আমরা সকলে মিলে, দশ-বারোজন একসঙ্গে কতই চিৎকার করলাম, কিন্তু সে হতভাগা বাঘ কিছুতেই সে জায়গা থেকে নড়ল না৷ পাতার উপর মড়মড় করে পায়চারি করতে লাগল৷ তখন আর সেখানে থাকা নিরাপদ না মনে করে, সকলে হাত ধরাধরি করে চলে এলাম৷ হাত ধরাধরি করবার মানে, যাতে কেউ পিছনে পড়ে না থাকে— একলাটি পিছনে পড়লেই বাঘ এসে তাকে ধরবে৷

বাঘ কিন্তু আমাদের ধমক-চমক হজম করতে পারল না৷ সে রাত্রে এসে, আমাদের তাঁবুর পিছনে দাঁড়িয়ে, অনেকক্ষণ ধরে আমাদের শাসিয়ে গেল৷

প্রথমে যে গ্রামের কথা বলেছি, সেই গ্রামে বাঘের বড়ো উৎপাত ছিল৷ একটা চিতাবাঘ প্রায়ই রাত্রে এসে কুকুর, মোরগ ইত্যাদি যা পেত ধরে খেত৷ গ্রামের লোকরা সেটাকে মারবার জন্য কত রকম ফন্দি করল, কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না৷ বন্দুক নিয়ে তার অপেক্ষায় বসে থাকলে সেটা কেমন করে বুঝতে পারে, আর অন্য কোথায় চলে যায়— গ্রামের লোকদের রাত জাগাই সার হয়৷ তীর পেতে রাখলে সে অন্য পথে যাতায়াত করে, তীরের আশেপাশেও মাড়ায় না৷ খোঁয়াড় তৈরি করে, তাতে কুকুরছানা পুরে রাখলে সে বেচারা সারারাত খালি ক্যাঁও-ক্যাঁও করে সারা হয়, বাঘ তার খবর নেয় না৷

শেষটা তাদের মধ্যে একজন বুদ্ধিমান লোক, অনেক চিন্তা করে এক ফন্দি বার করল৷ বড়ো-বড়ো বাঁশের ডগায় খুব মজবুত পাকা বেতের বাঁশ বেঁধে সে কতকগুলো বঁড়শির মতো তৈরি করল৷ গ্রামের চারদিকে বেড়া দেওয়া, সেই বেড়ার মাঝে-মাঝে ফুটো রয়েছে, আর সেই ফুটো দিয়ে বাঘ গ্রামে প্রবেশ করে৷ বুদ্ধিমান লোকটি ওই সব ফুটোর সামনে এক-একটা করে ওই বঁড়শি পুঁতল, আর বাঁশ বেঁকিয়ে, ফুটোর মুখে ফাঁদ পেতে, তার সামনে একাট করে মুরগি বেঁধে রাখল৷

তারপর দু-তিন দিন গেল৷ বাঘ আসে, কিন্তু ফাঁদ দেখে যেন সন্দেহ করে আর তাতে পা দেয় না৷ গ্রামের লোকেরা বলতে লাগল, ‘আর কেন? এখন ফাঁদগুলো তুলে ফেলি, ওতে কি আর বাঘ পড়বে?’ সেদিন রাত্রেই বাঘের চ্যাঁচানিতে তাদের ঘুম ভেঙে গেল৷ তাড়াতাড়ি লাঠি সোঁটা, বন্দুক ইত্যাদি নিয়ে, মশাল জ্বালিয়ে ঘরের বাইরে দেখে, বাঘমশাই বাঁশের ডগায় ঝুলতে-ঝুলতে গর্জন করছেন৷ তাঁর পিছনের পায়ে ফাঁস লেগেছে, সেখানে তার দাঁত পৌঁছচ্ছে না, আর ফাঁস কেটে পালাতেও পারছেন না— খালি ছটফটানি আর তর্জন-গর্জন সার হচ্ছে৷ আর তা তিনি খুব ভালো করেই করছেন৷

এমন তামাশা তো আর হামেশাই জোটে না, কাজেই সারাটা রাত জেগে শানেরা তা দেখল৷ তামাশায় একটু ঢিল পড়লেই বল্লমের খোঁচা মেরে বাঘমশায়কে আবার চাগিয়ে দেওয়া ছাড়া আর কিছু করল না৷ তারপর সকালে তারা গুলি করে বাঘটাকে মেরে ফেলল৷

এর পর আর কোনো বাঘ তাদের মুরগি নিতে আসেনি৷

.

ভিখারি নামে একজন লোক অনেকদিন আমার সঙ্গে ছিল৷ দু-পয়সা রোজগার করার সুযোগ পেলে সে ছাড়ত না৷ বদ্যি বল, রোজা বল, ভিখারি একাধারে সব৷ বদ বুদ্ধিও যথেষ্ট ছিল তার পেটে৷

একটি শান ছেলে প্রায়ই আমাদের ক্যাম্পে আসত৷ শানদের গোঁফ নেই, আর আমাদের খালাসিদের প্রায় সকলেরই গোঁফ আছে৷ তা দেখে শান ছেলেটির ভারি শখ হয়েছে তার গোঁফ হোক৷ সে কত অনুনয় বিনয় করে খালাসিদের জিগগেস করে, কী করলে তার গোঁফ গজাবে৷ ভিখারি তাকে বলল, ‘গোঁফ চেষ্টা করলেই হতে পারে, কিন্তু তাতে খরচ আছে৷’ ছোকরা তো তা শুনে বড়োই খুশি, খরচ যতই লাগুক সে দেবে৷ তার গোঁফ হওয়া চাই-ই৷ তখন ভিখারি খুব গম্ভীর হয়ে বলল, ‘পুজো করতে হবে৷ তাতে ফুল চাই, ধূপ-ধুনো চাই, আর দুটো সাদা ধবধবে মোরগ আর চার সের চাল৷’

সেই ছোকরার গোঁফের বড়োই দরকার, বলা মাত্রই সে সমস্ত জিনিস এনে হাজির করল৷ ভিখারিও নতুন উনুন তৈরি করে, ভাত আর মোরগ চড়াতে একটুও দেরি করল না৷ যতক্ষণ রান্না হচ্ছিল, ততক্ষণ সে ধূপ-ধুনো নিয়ে বেশ জমকালো রকমের পুজো করল, বিড়-বিড় করে অনেক মন্ত্রও আওড়াল৷ তারপর সব খালাসি মিলে মোরগের ঝোল আর ভাত পেট ভরে খেয়ে, পরে সেই উনুনের কয়লা, রেড়ির তেল আর একটু চিনা কালি দিয়ে খাসা মলম তৈরি করে সেই শান ছোকরাকে বলল, ‘এই মলম দিয়ে বেশ করে গোঁফ এঁকে, নাকে-মাথায় কাপড় জড়িয়ে রাত্রে শুয়ে থাকবে, সকালে উঠে দেখবে, এয়া বড়ো গোঁফ হয়ে আছে৷ লেকিন, খবরদার, একটুও যেন মুছে না যায়, তাহলে আর গোঁফ হবে না৷’

শান ছোকরাও তাই করেছে, কিন্তু, হায়! তার গোঁফ আর গজাল না৷ তখন সে এসে ভিখারিকে পাকড়াও করল৷ ভিখারি বলল, ‘এপাশের আঁকা গোঁফটা একটু মুছল কী করে?’

শান ছোকরা বলল, ‘রাত্রে কাপড় লেগে মুছে গেছে৷’

ভিখারি বলল, ‘আমি তো আগেই বলেছি, মুছলে আর হবে না৷’

আরেকবার ভিখারি গিয়েছিল এক বুড়ির মাথাধরা সারাতে৷ বুড়ি ভালো হলে তাকে একটা কুমড়ো দেবে৷ শানদেশের লোকেরা মাচার উপর ঘর বাঁধে৷ ভিখারি যেমনি সেই মাচার উপর ওঠবার জন্য সিঁড়িতে পা দিয়েছে, অমনি বুড়ির কুকুর এসে তার পায়ের গোড়ায় কামড়ে ধরেছে৷

সেদিন আর ভিখারি বেচারার ডাক্তারি করা হল না, তাকেই কাঁধে করে তাঁবুতে আনতে হল!

আগেই বলেছি জঙ্গলের কাজে সকল সময়ে গ্রাম পাওয়া যায় না৷ অনেক সময় জঙ্গলের মধ্যে একটু জায়গা পরিষ্কার করে নিয়ে তাঁবু খাটাতে হয়৷ শুকনো, খটখটে জায়গা আর জল দেখে তাঁবু ফেলতে হয়৷ এই রকম একটা জায়গায় তাঁবু ফেলা হয়েছে৷ সঙ্গে আমার ছজন খালাসি, দোভাষী, আর তিনজন শান কুলি৷ জায়গাটা ভালো নয়, কেননা ওই বনে পাঁচ-ছ মাইলের মধ্যে আর জল নেই, ওইটুকু মাত্র জল৷ সকল জানোয়ার ওইখানটায় জল খেতে আসে, চারদিকে তাদের পাঞ্জার দাগ রয়েছে৷ আমার সঙ্গে ঘোড়া রয়েছে৷ ঘোড়া, খচচরের উপর নাকি বাঘের বড়ো লোভ৷ সকলে বলে যে ঘোড়া বা খচচর পেলে, বাঘ আর অন্য জানোয়ার ধরে না৷

কাজ করে সন্ধ্যার সময় তাঁবুতে ফিরে দেখি, তাঁবুগুলো একটু বেকায়দায় খাটানো হয়েছে৷ পাতা-লতা দিয়ে, ঘোড়ার জন্য একটা চালা করেছে, তার একটা দিক খোলা, খোলা দিকটা আবার জলের দিকে৷ ধুনি জ্বালিয়েছে মাঝখানটায়৷ আমি বিশেষ করে বলে দিয়েছিলাম ঘোড়ার জন্য চালাটা যেন মাঝখানে করা হয়, আর দুপাশে দুটো ধুনি করা হয়৷ দোভাষীকে ডেকে জিগগেস করলাম, ‘এ কী করেছ? গ্রামের লোক যে বলে দিয়েছিল এখানে বাঘের বড্ড ভয়৷’

সে উত্তর দিল, ‘হুজুর, শানরা বন্দুক এনেছে, ভালো করে পাহারা দেবে, প্রকাণ্ড ধুনি জ্বালবে, তিন-চার রাত কেটে যাবে৷ কোনো ভয় নেই, জানোয়ার এদিকে আসবে না৷’

আমার মনটা কেমন খুঁতখুঁত করতে লাগল, দোভাষীর কথায় আশ্বস্ত হল না৷

রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর, দোভাষী, খালাসি আর শান কুলিরা ধুনির পাশে বসে রাত সাড়ে-নটা-দশটা পর্যন্ত তামাক খেয়েছে, গল্পগুজব করেছে, তারপর শুতে গেছে৷ আমি আগেই শুয়ে পড়েছিলাম, কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলাম বলতে পারি না, হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল৷ কেমন অস্বোয়াস্তির ভাব মনে৷ ঘোড়াটার গলার দু-পাশে মোটা বাঁশের কঞ্চি মজবুত দড়ি দিয়ে গলার সঙ্গে বাঁধা৷ ওই বাঁশ দুটো একটু পর-পর খটাং-খটাং করে ঠোকাঠুকি হচ্ছে৷ ঘোড়াটা অমন করছে কেন? আমার মন বলছে যে, কোনো একটা জানোয়ার তাঁবুর কাছেই দাঁড়িয়ে আছে৷ এই রকম অস্বোয়াস্তির ভাবটা আরও অনেকবার, অনেক ঘটনায় আমার হয়েছে৷

আমার তাঁবুর পিছনেই নালা, নালার ওপারে পাহাড়৷ হঠাৎ মট করে একটা আওয়াজ হল, যেন কোনো জানোয়ারের পায়ের চাপে একটা শুকনো ডাল বা অন্য কিছু ভেঙে গেল৷ সঙ্গেসঙ্গে একটা ভারি জানোয়ারের পা পিছলাবার একটু আওয়াজ কানে এল, সঙ্গেসঙ্গেই ঘোড়ার গলার খটাং-খটাং শব্দটাও খুব ঘন-ঘন হতে লাগল৷ আমি সবে মনে করছি উঠে দেখি ব্যাপার কী, আর অমনি ঘোড়াটা এক বিকট চিঁ-হি-হি করে চিৎকার করে উঠল, সঙ্গে সঙ্গে আমিও জোরে চিৎকার করে তাঁবু থেকে বেরিয়ে এলাম, শশী আর খালাসিরাও চিৎকার করতে-করতে তাদের তাঁবু থেকে বের হল৷

কোথাও কিছু নেই! খালি ঘোড়াটা ঠকঠক করে কাঁপছে, গলায় রসি-বাঁধা খোঁটা একটা একেবারে উপড়িয়ে ফেলেছে, আর শান স্টেটের ওই দারুণ শীতের মধ্যেও তার সর্বাঙ্গ ঘামে ভিজে গেছে৷

পাহারাওয়ালা ঘুমিয়ে পড়েছে, ধুনি নিভে গেছে৷ ধমক দিয়ে আবার ধুনি জ্বালানো হল, কড়া পাহারার বন্দোবস্ত করা হল আর ঘোড়াটাকে খুলে এনে খালাসিদের তাঁবুর সামনে ধুনির পাশে বেঁধে রাখা হল৷

রাত কেটে গেল৷ ভোরে উঠে শানরা দেখতে পেল কেমন জানোয়ার এসেছিল৷ ঘোড়ার ঘরের পাশেই তার প্রমাণ মজুদ— বড়ো বড়ো থাবার দাগ— বাঘ! শানরা বলাবলি করতে লাগল, ‘ঘোড়াটা এখানে রাখা আর নিরাপদ নয়৷ আমাদের গ্রামে পাঠিয়ে দাও৷’

চার মাইল দূরে তাদের গ্রামেই পাঠিয়ে দিলাম৷ হতভাগা কিন্তু সেখানেও গিয়েছিল ঘোড়াটার খোঁজে৷ তবে কিনা ঘোড়াটা গ্রামের প্রধানের ঘরে ছিল, সেইজন্য বিশেষ কোনো সুবিধা করতে পারেনি, বন্দুকের দু-চারটা আওয়াজ করার পর পালিয়ে গেল৷

বর্মার লোকেদের সঙ্গে আমার বেশ ভাব হয়ে গিয়েছিল, বিশেষত শানদের সঙ্গে৷ মোটের উপর এদের আমার বেশ লাগত, যদিও মাঝে-মাঝে এদের তরকারির গন্ধে একটু মুশকিলে পড়েছি৷ তবে এ কথাটা দু-দিক দিয়েই খাটে— যেমন তাদের মশলার গন্ধ আমার সয় না, তেমনি আমাদের ঘিয়ের গন্ধও তারা সইতে পারে না৷

মাছকে টুকরো-টুকরো করে কেটে হাঁড়ির ভিতর পুরে, হাঁড়ির মুখ ভালো করে বন্ধ করে মাটিতে তিন-চারমাস পুঁতে রাখে, তারপর সেটা পচে একেবারে গলে গেলে, সেটাকে বার করে খায়৷ এই জিনিসটিকে ওরা বলে ‘ঙাপি’ আর এমন সরেস জিনিস নাকি এ দুনিয়ায় নেই! আমাদের যেমন ঘি, গরম মশলা, তাদের ওই জিনিসটাও তেমনি, সব তরকারিতেই তার একটু-একটু দেওয়া চাই, নইলে সে তরকারির ‘লজ্জত’-ও হয় না, ইজ্জতও হয় না৷ এদিকে ঘিয়ের গন্ধে তাদের পেটের ভাত উলটিয়ে আসে!

শুনেছি বর্মার কোন শহরে নাকি এক হিন্দুস্থানি ময়রা খাবারের দোকান করেছিল৷ কিন্তু তার ঘিয়ে ভাজার গন্ধে বর্মীরা গিয়ে ডেপুটি কমিশনারের কাছে নালিশ করেছিল যে সে এমন দুর্গন্ধময় জিনিস রান্না করে যে তারা সহ্য করতে পারছে না, তাদের ও-পাড়ায় বাস করা অসম্ভব হয়ে উঠেছে৷ গল্পটা প্রথমে শুনে অতিরঞ্জিত মনে করেছিলাম, কিন্তু এমন ব্যাপার আমার নিজেরই ঘটেছিল৷

খেটেখুটে সন্ধ্যার সময় তাঁবুতে ফিরেছি— এইবার একটু আরাম করব৷ হঠাৎ গোলমাল৷ ফুংগির আশ্রমে তাঁবু ফেলেছিলাম, ফুংগি মহা খাপ্পা হয়ে উঠেছেন, ‘এখান থেকে তাঁবু তুলে নাও বা রান্না বন্ধ করো৷’

অপরাধ?

আমার লোক লুচি ভাজছিল, তার দুর্গন্ধে নাকি তার প্রাণ আইঢাই!

শশী একদিন খিচুড়ি রেঁধেছে৷ সেই রাঁধা খিচুড়ির গন্ধ পেয়েই তো সঙ্গের শানরা ভারি চঞ্চল হয়ে উঠেছে৷ শশী জিগগেস করল, ‘খাবে?’ তারা প্রথমে বলল, ‘না৷’ তারপর একটু হাতে নিয়ে, নাক-মুখ সিঁটকিয়ে মুখে দিল৷ পরে দু-চারবার মুখ নেড়েই তাদের আর হাসি ধরে না, তখন খালি বলে, ‘আরও দাও, আরও দাও৷’ শেষে যখন পেট ভরে এসেছে, তখন শশীকে জিগগেস করল, ‘কী দিয়ে রেঁধেছ?’ শশী বলল, ‘চাল, ডাল, পেঁয়াজ, আদা, হলুদ, লঙ্কা আর ঘি৷’ সেকথা তারা তো কিছুতেই বিশ্বাস করবে না, বলে, ‘ঘিয়ের গন্ধে তো বমি আসে, এতে তা থাকলে কি আর খাওয়া যেত?’ যাই হোক, এর পরে তারা প্রায়ই শশীকে খিচুড়ি রাঁধতে বলত৷

এই বছর, আমার কাজ খানিকটা জায়গায় ছিল যেখানে গ্রাম নেই৷ বহুকাল আগে নাকি এখানে বড়ো-বড়ো গ্রাম ছিল, এখন ঘোর বন৷ এই জায়গাগুলো জরিপ করবার সময় দশ-বারোদিন জঙ্গলে ক্যাম্প করে থাকতে হয়েছিল৷ যে জায়গাগুলোয় ক্যাম্প করেছিলাম, সেখানে পুরোনো গ্রামের সব চিহ্ন বর্তমান— আম, কাঁঠাল, পেয়ারা, সুপারি ইত্যাদি ফলের গাছ; পাকা ‘ফয়া’ অর্থাৎ প্যাগোডা— বৌদ্ধস্তূপ বা মন্দির আর জলের কুয়ো৷ আমরা চার-পাঁচদিন আগে লোক পাঠিয়ে দুটো কুয়োর জল সেঁচে ফেলে দিয়েছিলাম, তাতে আবার অতি পরিষ্কার জল বেরিয়েছিল, সেই জলই আমরা ব্যবহার করেছিলাম৷

একটু দূরে অনেকটা জায়গা জুড়ে শরবন, তার মধ্যে খেতের আল আর জলের নালার চিহ্ন বর্তমান৷ সমস্ত দেখে-শুনে মনে হয়েছিল যে ওইখানে নিশ্চয়ই আগে খুব বড়ো গ্রাম ছিল৷ এক বুড়ো শানের কাছে তার ইতিহাস শুনেছিলাম৷

বহু বছর আগে, আমাদের ক্যাম্পের জায়গায় প্রকাণ্ড এক গ্রাম ছিল, ছোটোখাটো শহর বললেই চলে— প্রায় দুশো-আড়াইশো ঘর লোকের বসতি ছিল সে গ্রামে৷ এটা মং-নাই স্টেটের এলাকা৷ বর্মার রাজা মং-নাই আক্রমণ করেছিলেন, কেননা মং-নাই-এর রাজা তাঁর বশ্যতা স্বীকার করেননি, মং-নাই-এর রাজা কেন বর্মার রাজার সঙ্গে লড়াইয়ে এঁটে উঠতে পারবেন? হাজার-হাজার বর্মী সৈন্য মং-নাই ছেয়ে ফেলল৷ মং-নাই-রাজ যুদ্ধে হেরে এই গ্রাম থেকে ন-দশ মাইল দূরে এক দুর্গম পর্বত কন্দরে আশ্রয় নিয়েছিলেন৷ বর্মী সৈন্য এসে এই গ্রাম আক্রমণ করল৷ গ্রামবাসী যথাশক্তি দিয়ে লড়েছিল, কিন্তু শেষটা হেরে গেল৷ বর্মীরা গ্রামের বয়স্ক স্ত্রী-পুরুষ সকলকে হত্যা করল, অন্যদের ধরে নিয়ে গেল আর গ্রাম পুড়িয়ে ছারখার করে দিল৷ সেই অবধি এই গ্রাম উজাড়; এর কাছেও আর কোনো গ্রামের পত্তন হয়নি৷

ওই গ্রামের ন-দশ মাইল দূরে, যে জায়গায় মং-নাই-রাজ আশ্রয় নিয়েছিলেন, সেটাও আমি জরিপ করেছিলাম৷ সে এক অদ্ভুত জায়গা, পনেরো-কুড়ি বর্গমাইল হবে, আর দুটি মাত্র প্রবেশপথ৷ চারদিকে কাঁটা ও পাথরের পাহাড়, দেয়ালের মতো খাড়া আর ক্ষুরের মতো ধারালো, চার হাত-পায়ে চড়াও মুশকিল৷ দুদিকে দুটি মাত্র প্রবেশ-পথ যা আছে তাতেও একসঙ্গে একজনের বেশি চড়তে পারে না৷ তাও আবার এমন খাড়া যে উপরে দশজন মাত্র লোক বসে থাকলে, হাজার লোক শত চেষ্টাতেও উঠতে পারবে না৷ আজও সেখানে সব প্রকাণ্ড-প্রকাণ্ড পাথর সাজানো রয়েছে, এইসব পাথর শত্রুর উপর গড়িয়ে দেওয়া হত৷ বার দুই-তিন চেষ্টা করে, বহু লোক বলি দিয়ে বর্মী সৈন্য সেখান থেকে পশ্চাৎপদ হতে বাধ্য হয়েছিল৷

এই জায়গাটুকুর মধ্যে কোনো নালা নেই, কিন্তু অনেকগুলো বড়ো-বড়ো ‘ডেভিলস কলড্রন’ আছে তাতে বেশ সুস্বাদু জল৷ মং-নাই-রাজ আর তাঁর লোকজনের জলের অভাব হয়নি৷

.

আমার কাজ শেষ হলে, দু-তিনজন সার্ভেয়ারের কাজ পরিদর্শন করতে গিয়েছিলাম৷ একদিন একজন সার্ভেয়ারের কাজ দেখে ফিরছি৷ হঠাৎ ঝোপের ভিতর কী একটা নড়ল৷৷ ক্যাঁও-ক্যাঁও করে একটা ময়ূর উড়ে গেল, আর তার ডানার আড়াল থেকে তিনটে বাচচা বার হয়ে চিঁ-চিঁ করে ছুটোছুটি করতে লাগল৷ তাড়া করে একটাকে ধরলাম৷ বাচচাটা পায়রার মতো বড়ো৷ আমি তাকে ধরে বুকে করে নিয়ে চলেছি আর বেচারার কী কান্না— ঠিক যেন তার মাকে ডাকছে৷ আমার বড়ো দুঃখ হল, বাচচাটাকে ছেড়ে দিলাম৷ সে বেচারা অমনি যেদিকে তার মা গিয়েছিল, সেদিকে দৌড়ে গেল আর তার মাকে ডাকতে লাগল৷ উড়বার শক্তি তখনও হয়নি৷ মাকে পেল কি না তা ভগবানই জানেন৷

এবারকার মতো কাজ শেষ হল৷ আমরা আবার আমাদের হেড আপিস, ব্যাঙ্গালোরে ফিরে গেলাম৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *