বনের খবর – ১৫

১৫

(১৯১৩-১৯১৫৷ আসাম) আসামের নওগাঁ জেলার দক্ষিণ দিকে অনেক শরবন, তার মাঝে-মাঝে বিল, আর টুকরো-টুকরো জঙ্গল, ছোটোখাটো দু-চারটে পাহাড়ও আছে৷ এসব জায়গায় আগে গ্রাম ছিল, লোকের বসতি ছিল, কালাজ্বর আর নাগাদের ভয়ে এখন উজাড় হয়ে গেছে, আর যত জানোয়ারের বাসভূমি হয়েছে৷ হরিণ, মহিষ, মিথন, শুয়োর, বাঘ, ভাল্লুক আর কোনো-কোনো জায়গায় হাতিও দেখতে পাওয়া যায়৷ এ সমস্ত শিকারের প্রশস্ত জায়গা, অনেক সাহেবসুবো এখানে শিকারের জন্য এসে থাকেন৷

জরিপওয়ালার শিকার খেলবার সময় নেই৷ কিন্তু পাহাড়ে, জঙ্গলে নালায়-নালায় ঘুরে জরিপ করতে হয়, কাজেই তাদের চোখে শিকার পড়ে ঢের৷ হয়তো বা মাথা ঘুলিয়ে যায়, নয়তো মারবার অবসর পায় না, কখনো বা সাহসে কুলোয় না, আবার কখনো বা নিরস্ত্র অবস্থা, একেবারে খালি হাত৷ সব রকম অবস্থাতেই পড়েছি৷ ঘটনার পর ভেবে দেখেছি যে ওই অবস্থাটাই ওই বিশেষ ঘটনার উপযুক্ত ছিল৷ অন্য অবস্থা বা ব্যবস্থা হলে হয়তো বিশেষ বিপদ ঘটবার সম্ভাবনা ছিল৷

দু-একটা ঘটনা শুনলে বুঝতে পারবে ব্যাপারটা কেমন হয়৷

আমার সঙ্গে একজন পাঞ্জাবি ভদ্রলোক ছিলেন৷ নতুন কাজ শিখছেন, আমি তাঁর কাজ দেখতে গিয়েছি৷ খালাসিরা ছুটি নিয়েছে, কাল হোলি, কাজে যাবে না৷

ভদ্রলোক বললেন, ‘চলুন শিকারে৷’

‘বহুৎ আচ্ছা৷’

ভোরে দুজনে হাতি চড়ে বেরোলাম৷ তিনটে হাতি, একটাতে আমি, একটাতে তিনি আর একজন গ্রামের শিকারি, আরেকটা হাতি দরকারমতো জঙ্গল ভাঙবে, জানোয়ারের পথ আগলাবে৷ তিনদিকে পাহাড়, একদিকে ধানখেত, তার মাঝখানে ঘাস, খাগড়া, বিল ইত্যাদি৷ একটা নোনা মাটির জায়গাও তার মধ্যে আছে৷

আমরা ধীরে-ধীরে জঙ্গলের কিনারা ধরে চলেছি৷ একটা প্রকাণ্ড শুয়োর সামনে পড়েছিল কিন্তু তার উপর গুলি চালানো হয়নি, হরিণের লোভ আমাদের৷ কিন্তু আর কোনো জানোয়ারই চোখে পড়ছিল না৷ সকলেই আশ্চর্য হয়েছি, বিশেষ করে শিকারি, কারণ এটা শিকারের পক্ষে আদর্শ জায়গা৷ জানোয়ারের পায়ের দাগও আছে ঢের, শুয়োর, হরিণ, মিথন৷ আজ কিন্তু ওই শুয়োরটা ছাড়া আর কোনো জানোয়ারই দেখতে পেলাম না৷

ক্রমে সূর্য দেখা দিল৷ আর কেন? এবার ফিরি৷ হঠাৎ শিকারি হাত দিয়ে সামনে ইশারা করল৷ দু-চারটে ঘাস একটু-একটু নড়ছে, যেন কোনো জানোয়ার পাশ কাটিয়ে সরে পড়ছে৷ পাছে ওটা জঙ্গলে ঢুকে পড়ে সেই ভয়ে আমরা প্রথমেই তাড়াতাড়ি জঙ্গলের দিকটা ঘিরে ফেললাম৷ এক পাশে সেই ভদ্রলোক, এক পাশে আমি, আর মাঝখানে অন্য হাতিটা, তিনটে হাতির মাঝে-মাঝে আট-দশ ফুট ব্যবধানও নেই৷

ঘাস নড়াটা তখন অন্যমুখী হয়ে, এক টুকরো আট-দশ ফুট লম্বা-লম্বা ঘাসের জঙ্গল ছিল, তার মধ্যে ঢুকে থেমে গেল৷ এর পিছনেই ছোটো-ছোটো ঘাস৷ আমরাও মনে-মনে ভাবলাম, ভালোই হল, এদিকে আমরা, ওদিকে ছোটো ঘাস, বেরোলেই চোখে পড়বে আর মারব৷

আমাদের হাতি লম্বা ঘাসের জায়গাটার মধ্যে প্রায় ঢুকে পড়েছে হঠাৎ মাঝের হাতিটা ফ্যাঁশ করে নাকে শব্দ করে একেবারে ঘুরে দাঁড়াল— এই ভাগে আর কি! তার ঘাড়ে পাকা মাহুত, কানে অঙ্কুশ লাগিয়ে জবরদস্তি তাকে আটকিয়ে ধরেছে৷ আমাদের হাতি দুটোও চঞ্চল হয়ে উঠেছে৷

মাঝের হাতির মাহুত হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল— ‘বাঘুয়া! এত্তা বড়া দুম!’ সঙ্গে-সঙ্গে তার হাতি চিৎকার করে, মলমূত্র ত্যাগ করে, একাকার! চোখের পলক ফেলতে-না-ফেলতে, বন্দুক ঘুরোতে-না-ঘুরোতে, বাঘটা হামা দিয়ে ওই হাতির পেটের তলা দিয়ে গলে বেরিয়ে গিয়ে মুহূর্তের মধ্যে একেবারে অদৃশ্য!

হাতি বেচারারা লাটিমের মতো তিন-চারবার ঘুরপাক খেল, সামলাতে-না-সামলাতে শিকার ধোঁয়ার মতো কোথায় মিলিয়ে গেল!

একবার মাত্র একটা হলদেপানা জীব আমাদের চোখে পড়ল কি না-পড়ল৷ ওই হাতিটার মাহুত আর শিকারি ছাড়া কেউ ভালো করে দেখতেও পেল না৷

একেই বলেছিলাম— হয়তো মারবার অবসর মিলল না৷ ওই বাঘটা বেরোবার পর বুঝলাম এতক্ষণ কেন অন্য কোনো জানোয়ারের গন্ধ পাইনি৷ শুয়োরটাকে যে দেখেছিলাম, তার কথা আলাদা, সে বাঘ-টাঘ গ্রাহ্য করে না৷ সকলেই তার সঙ্গে হিসেব করে চলে৷ কথায় বলে সঙ্গী ছাড়া যে শুয়োর চলে, সে মত্ত হাতির চেয়েও ভীষণ৷

আরেকদিন ওই ভদ্রলোকেরই কাজ দেখতে গিয়েছি৷ মাস শেষ হয়েছে, সারা মাসের রিপোর্ট তৈরি করতে হবে, সেজন্য দু-দিন সেখানে থাকতে হবে৷ ভদ্রলোক বললেন, ‘কাল রবিবার, এক-আধটা হরিণ মারতে পারলে খালাসি বেচারারা খেতে পেত৷’

বললাম, ‘আচ্ছা, চলো, যাব৷’

ভদ্রলোক একজন শিকারি জোগাড় করলেন৷ ভোরে উঠে আমরা শিকারে চলেছি, সঙ্গে তিনটে হাতি৷ এক হাতিতে আমি, একটাতে শিকারির সঙ্গে উনি৷ ভদ্রলোক একটু বেখাপ্পাভাবে বসেছেন, দুপা-ই তাঁর একদিকে, হাতির মাথা পড়েছে তাঁর এক পাশে৷ ডেকে বললাম, ‘অমন করে বোসো না, শিকারের সুবিধা হবে না৷ খালি একদিক দেখতে পাবে, অন্যদিক দিয়ে জানোয়ার বেরোলে তোমার পিছনে পড়বে, ঘুরে মারতে-মারতে সে চলে যাবে৷ আর যদি কোনো কারণে হাতি ভড়কে গিয়ে হঠাৎ দৌড় দেয়, তাহলে উল্টে পড়ে যাবে৷’

তিনি তো হেসে খুন— ‘নহি জী, কভি নহি গিরেঙ্গে৷’

হাওদা-টাওদা নেই৷ আমি মাহুতের ঠিক পিছনে, দু-দিকে দুই পা দিয়ে ঘোড়ায় চড়ার মতো বসেছি৷ তিনি বললেন অমন করে বসা বড়ো কষ্টকর৷

শিকারি আমাদের সামনে একটা গাছ দেখিয়ে মাহুতকে বলল, ‘এখানটাতে রাস্তা ছেড়ে জঙ্গলের মধ্যে ঢোকো৷’ আর সঙ্গে-সঙ্গে ধপ করে একটা ভারি জিনিস পড়ার শব্দ! আমার পিছনের হাতিটাও খুব ছটফট করতে লাগল৷

মুখ ফিরিয়ে দেখি ভদ্রলোক ঘাসের মধ্যে চিতপাত! হাতির মুখ তাঁবুর দিকে, মাহুত তার কানে অঙ্কুশ লাগিয়ে ধরে রেখেছে, হাতি তো পালাতে পারলে বাঁচে!

‘কেয়া হুয়া রে?’

মাহুত বলল, ‘হুজুর, শিকারি বোলা ডাইনে যাও, আউর ছোটা এক সোই (গোসাপ) নিকল কর হাথিকা সামনেসে ভাগা! হাথিভি মোড় কর খাড়া হুয়া, সাহাব ভি উলট কর গির গয়ে! বড়ি মুশকিলসে রোকা হুঁ হাথিকো৷’

ভালো! যা সাবধান করে দিয়েছিলাম, তাই হল!

শিকারের জায়গায় তো ঢুকলাম৷ বড়ো-বড়ো ঘাস, মাঝে-মাঝে আমলকী গাছ তার চারদিকে জঙ্গল৷ শিকারির নির্দেশমতো ভদ্রলোক শিকারির সঙ্গে একদিকে গেলেন, আমি অন্যদিকে গেলাম৷ পঞ্চাশ গজও যাইনি আর পিছনে গুড়ুম-গুড়ুম বন্দুকের আওয়াজ৷ মাহুত তৎক্ষণাৎ হাতি ফিরিয়ে ওইদিকে ছুটল৷ সামনেই ভদ্রলোক একটা আমলকী গাছের পাশে, হাতির পিঠে হাঁ করে বসে আছেন!

‘আরে, কী মারলে? শিকার কই?’

মাহুত বলল, ‘হুজুর, বড়ি জবর সামর (সম্বর) থা, মাথে পর ইয়া বড়া ঝাড়! গোলি নহি লাগা হোগা, ভাগ গিয়া৷’

রক্তের দাগ খুঁজবার জন্য আমিও নামলাম, শিকারিও নামল৷ বলল, ‘ওইখানে দাঁড়িয়ে আমলকী খাচ্ছিল আর সাহেব ওইখান থেকে গুলি করেছেন৷’

মাত্র পঁচিশ-ত্রিশ ফুট দূরে, গুলি লাগেনি হতে পারে কি? দেখতে গেলাম কী ব্যাপার! গিয়ে দেখি আমলকীগাছের নীচে গোটা দু-চার ছোটো-ছোটো গাছ, সেগুলির বড়ো-বড়ো পাতায় অসংখ্য ফুটো, ছিটার দাগ!

‘ওকি, এ কী করেছ? ছররা মেরেছ নাকি?’

তিনি তো বন্দুক খুলে একেবারে হাঁ! নতুন শিকারি, তাড়াহুড়োতে পাঁচ নম্বর ছররা মেরে বসেছেন৷

বলা বাহুল্য সেদিন আর শিকার মিলল না৷

একেই বলেছিলাম— কখনো বা মাথা ঘুলিয়ে যায়৷

যেখানে এই সব কাণ্ড হচ্ছিল, তার একটু পুবেই শিবসাগর জেলার সীমানা৷ এর দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের প্রায় ত্রিশ-চল্লিশ বর্গ মাইল জায়গা বাঘের ভয়ে উজাড় হয়ে গিয়েছিল৷ মানুষখেকো বাঘ৷ দশ-বারোটা গ্রামের লোক ঘরদোর ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল৷ আমাদের লোক যখন সে জায়গা জরিপ করতে গিয়েছিল তখনও ওই এলাকা উজাড়! মানুষখেকো বাঘের ভয়ে মিকিররা কেউ ওর ভিতরে যেতে চায় না৷ একটা বাঘ কয়েক মাস আগে মারা পড়েছে বটে, কিন্তু মিকিররা বলে যে বাঘ দুটো ছিল, একটা মারা পড়েছে বটে কিন্তু একটা তো এখনও আছে, গেলেই ধরে খাবে৷

আমার একজন গুর্খা সার্ভেয়ারকে ওই জায়গাগুলো জরিপ করতে পাঠিয়েছিলাম, তার সঙ্গে বন্দুক৷ পাহারা দেবার জন্য আরেকজন গুর্খাকেও সঙ্গে দেওয়া হয়েছিল৷

জায়গাটুকু জরিপ হওয়া মাত্র আমি সার্ভেয়ারের কাজ দেখতে গেলাম৷ অনেক বুঝিয়ে, বাইরের অন্য গ্রাম থেকে দশ-বারোজন কুলি সঙ্গে নিয়ে গেলাম৷

দু-দিন ওই জঙ্গলে ছিলাম, কিন্তু পরিত্যক্ত গ্রাম আর খেত আর জঙ্গল ছাড়া কিছু দেখিনি৷ দ্বিতীয় দিন সন্ধ্যার পর মশাল জ্বেলে, এক গ্রামে পৌঁছলাম৷ ওই গ্রামের লোকেরাও জঙ্গল থেকে পালিয়ে গেছে, এই এলাকার বাইরে নওগাঁ জেলায় নতুন গ্রামের পত্তন করেছে৷ গ্রামের প্রধানের একমাত্র ছেলেকে ওই মানুষখেকো বাঘ খেয়েছিল৷ প্রধান পুত্রশোকে মরিয়া হয়ে, ছেলের মৃতদেহের উপর একটা বাঘকে মেরে ফেলেছিল৷ এই সব কাহিনী যখন শুনছিলাম তখন প্রাণের ভিতর যে কেমন করছিল, বলতে পারি না৷

শুনলাম বাঘের ভয়ে তো লোকজন সকলেই নিজের-নিজের ঘরদোর, খেত, ফসল, সমস্ত ফেলে পালিয়ে গিয়েছিল৷ কিন্তু তৈরি ফসল ফেলে এসেছে বলে অনেকেই বড়ো কাতর হয়েছিল৷ প্রধানের তুলোর খেত ছিল ওই পাহাড়ে৷ একেবারে তৈরি ফসল, তুলে আনলেই হল৷

ফেলে এসে তাদের মন বড়ো ব্যস্ত ছিল, বিশেষত প্রধানের ছেলের৷ একদিন সকালে সে বলল, ‘দেখে আসি খেত সব কেমন আছে৷’

প্রধান বারণ করল, গ্রামের লোকরাও মানা করল কিন্তু সে কারো কথা শুনল না৷ বন্দুক ঘাড়ে করে চলে গেল৷ বলে গেল, ‘এক নজর দেখেই ফিরে আসব৷’

গেল বটে, কিন্তু আর ফিরে এল না৷ তিন-চার ঘণ্টা অপেক্ষা করে প্রধান তো একেবারে পাগলের মতো হয়ে উঠল৷ অনেক মিনতি করে দু-চারজন লোক সংগ্রহ করে দেখতে গেল কী ব্যাপার৷ খেতের পাশে গিয়েই দেখতে পেল বন্দুকটা পড়ে আছে৷ একটু এগিয়ে দেখল তার মাথার পাগড়ি আর রক্ত৷ আরেকটু সামনেই কী যেন একটা পড়ে আছে, লতাপাতা দিয়ে ঢাকা, আর মাছি ভনভন করছে৷

দেখেই তো সঙ্গীরা পালিয়ে গেল৷ প্রধান কত কাকুতি-মিনতি করল, কেউ তার কথায় কান দিল না৷ তখন সে একাই দু-পা এগিয়ে দেখল সত্যিসত্যিই তার ছেলের দেহটা পড়ে আছে, ঘাড়ে কামড়ের দাগ, খানিকটা খেয়ে ফেলেছে৷

সে গ্রামে ফিরে এল৷ বাড়ি-বাড়ি ঘুরে প্রত্যেকটি লোককে কত সাধ্যসাধনা করল, ‘চলো আমার সঙ্গে, বাঘটাকে মারব৷’ কিন্তু কেউ রাজি হল না৷ তখন সে চার-পাঁচটা বন্দুক চেয়ে নিয়ে একাই আবার ওই তুলোর খেতে চলে গেল৷ সকলে কত বারণ করল, ভয় দেখাল, কিছুই শুনল না৷ একমাত্র ছেলেকে বাঘে নিয়েছে, তার আর বেঁচে লাভ কী? এ বাঘ সে মারবেই৷

তুলোর খেতে পৌঁছে, মৃতদেহের উপর সরু-সরু দড়ি দিয়ে বেঁধে, চারপাশে চারটে গুলিভরা বন্দুক পেতে রাখল৷ বাঘ এসে দেহটা ধরে টানবামাত্র ওই চারটে বন্দুক একসঙ্গে ছুটে যাবে৷ তাতেও যদি কোনো কারণে বাঘ না-মরে, সেইজন্য নিজে একটা বন্দুক ভরে নিয়ে, কাছে একটা ছোটো গাছে উঠে বসে রইল৷

বেলা চারটে বাজতে-না-বাজতে বাঘ এসে হাজির৷ তার ভয়ে দেশসুদ্ধ লোক পালিয়েছে, সুতরাং তার আর ভয়-ভাবনা কিছুই নেই৷ সোজা একেবারে মৃতদেহের কাছে৷ বোধহয় সে জায়গায় কিছু দেখে তার কোনোরকম সন্দেহ হয়েছিল, সেইজন্য দু-চারবার জোরে হাঁক দিল, তারপর দেহটা ধরে টান দিল৷ চারটে বন্দুক একসঙ্গে গর্জে উঠল, সঙ্গে-সঙ্গে প্রধানের বন্দুকটাও ছুটল৷ বাঘটা একবার মাত্র লাফিয়ে উঠে, মাটিতে পড়ে, দু-চারবার ঘড়ঘড় শব্দ করে একেবারে চুপচাপ৷

প্রধান আবার বন্দুক ভরে নিয়ে গাছ থেকে নেমে দেখল সব শেষ হয়েছে৷ তখন সে দৌড়ে গিয়ে সকলকে খবর দিল৷ লোকজন গিয়ে বাঘটাকে বয়ে আনল৷ পাহাড়ের উপর দেবতার পুজো দিল৷ ওই পাহাড়ে কিন্তু আর তারা ফিরে যায়নি, তাদের বিশ্বাস একটা বাঘ মরেছে, কিন্তু আরেকটা তো আছে, গেলেই ধরে খাবে৷

.

ওই এলাকায় কাজ করবার সময় আমি একটা বড়ো বোড়া সাপ মেরেছিলাম৷ যমুনা নদীর ধার দিয়ে রাস্তা, আমি বেরিয়েছি কাজে৷ সঙ্গে ঘোড়ার সহিস ও আরেকজন খালাসি৷ পথে শিকার পাওয়া যায়— হরিণ, বনমোরগ, হরিয়াল, বুনো পায়রা ইত্যাদি৷ পথের ধারে একটা বটগাছে ফল পেকেছে, আর তাতে ঢের পাখি৷ বন্দুক হাতে ধীরে-ধীরে আমি গাছের তলায় গিয়ে দাঁড়ালাম৷ গাছে অনেক হরিয়াল৷ লক্ষ্য করে বন্দুক ছুঁড়লাম, দুটো হরিয়াল পড়ল৷ একটা আমার পায়ের কাছেই পড়ল, আরেকটা ওই বটগাছের একটা প্রকাণ্ড ডাল পড়েছিল, তার পিছনে পড়ল৷

সঙ্গের খালাসিটাকে বললাম, ‘ওটাকে খুঁজে আন৷’ ডালটা প্রায় তিন-সাড়ে-তিন ফুট উঁচু৷ খালাসি সেটাকে ডিঙিয়ে গেল, কিন্তু পরক্ষণেই ‘বাপরে বাপ’ বলে আবার লাফিয়ে ডালটা পার হয়ে এসে দে দৌড়! আমি তাকে ধরে জিগগেস করলাম, ‘কেয়া হ্যায় রে?’

‘বড়া জবর সরপ হ্যায় হুজুর৷’

আমার তো বিশ্বাসই হয় না৷ বললাম, ‘কেয়া সরপ! তোমকো খা ডালেগা?’

‘হুজুর, এতনা মোটা হ্যায়,’ বলে নিজের ঊরু দেখাল৷ আমি খুব সাবধানে ডালটার উপর চড়লাম, আর তার চেয়েও বেশি সন্তর্পণে ওধারে নামলাম৷ খালাসি বলতে লাগল, ‘গাছের গোড়ায় দেখুন হুজুর৷’

চেয়ে দেখি প্রকাণ্ড একটা বোড়া সাপ কুণ্ডলী পাকিয়ে রোদ পোয়াচ্ছে৷ তার মাথা আর লেজ দেখা যায় না, কুণ্ডলীপাকানো ঢিবিটা প্রায় আমার কোমর সমান উঁচু৷ বন্দুকে পাঁচনম্বর আর আটনম্বর ছিটা ভরা ছিল৷ পাঁচ-ছয় ফুট দূর থেকে সাপের শরীরের সব চেয়ে মোটা অংশটা লক্ষ্য করে বন্দুক ছুঁড়লাম৷ আর অমনি, বাপ! কুণ্ডলীর সব উলট-পালট হতে লাগল, আর তার মাঝখান থেকে প্রকাণ্ড মাথা বিকট হাঁ করে বেরোল৷

আমি এর জন্য প্রস্তুত ছিলাম৷ গুড়ুম করে অন্য নাল ছেড়ে দিলাম, আর সাপটার মাথার উপরের অংশটা উড়ে গেল৷ আটনম্বর ছিটা, পাঁচ-ছয় ফুট থেকে মেরেছিলাম, কয়েক মিনিটের মধ্যে সব ঠান্ডা৷

ততক্ষণে অন্য খালাসিরাও এসে জুটেছে৷ বললাম, ‘ওটাকে টেনে বাইরে আন৷’

কেউ ছোঁবে না, সাপ, বাবা! অগত্যা আমিই লেজ ধরে টেনে সাপটাকে রাস্তার উপর আনলাম৷ কাছে গ্রাম ছিল, গ্রামের লোকরাও ছুটোছুটি করে এসে হাজির হল৷ তারা তো মহা খুশি! বলাবলি করতে লাগল: ‘এইটে আমার একটা বাছুর খেয়েছে!’ ‘আমার দুটো ছাগল খেয়েছে!’

গাঁওবুড়ো (প্রধান) বললে, ‘হুজুর, আরও একটা আছে৷ সেটাকেও যদি মেরে দিতে পারতে, বড়ো ভালো হত৷’

আমি বললাম, ‘দেখিয়ে দাও, মেরে দিচ্ছি৷’

তখন তো আর সেটা সেখানে উপস্থিত নেই, আমিও আর অপেক্ষা করতে পারি না, কাজেই তাকে আর মারা হল না৷

যেটা মেরেছিলাম সেটা সাড়ে-এগারো ফুটের উপর লম্বা ছিল৷

.

আরেকবার মিকির হিলস-এ আরেকজন সার্ভেয়ারের কাজ দেখতে গিয়ে বেশ তামাশা হয়েছিল৷ সার্ভেয়ারের তাঁবু প্রায় আট মাইল দূরে৷ তাকে খবর দিয়েছি যে সকালে সাতটা-সাড়ে-সাতটার মধ্যে, মাঝ-রাস্তায় একটা উঁচু পাহাড় ছিল, তার চুড়োয় যেন আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে, আমি তার কাজ দেখব৷ ভোরে উঠে বেরিয়েছি, সাতটা-সাড়ে-সাতটার মধ্যে চার মাইল পাহাড় চড়তে হবে৷ দেড় মাইল আন্দাজ গিয়েছি আর সামনেই রাস্তার পাশে বাঁশঝাড়ের নীচে বেজায় হুটোপুটি! লোকজন থমকে দাঁড়াল, কোথায় পালাই, ওটা না জানি কী! আমি ঘোড়া থেকে নেমে বন্দুক হাতে ধীরে-ধীরে অগ্রসর হলাম৷ পাঁচ-সাত কদম গিয়েছি আর সমস্ত বাঁশঝাড় নাড়া দিয়ে, জঙ্গল তোলপাড় করে লাফিয়ে উঠল সাত-আটটা প্রকাণ্ড হনুমান, এক-একটা প্রায় একজন দশ-বারো বছরের ছেলের সমান উঁচু৷ কী রকম চটে গিয়েছিলাম তা বুঝতেই পারছ৷ মনে করেছিলাম বুঝি বা হাতি! গ্রামের লোক সাবধান করে দিয়েছিল ওই রাস্তায় একটা পাগলা মকনা (দন্তহীন পুরুষ) হাতি আছে, আমরা যেন বিশেষ হুঁশিয়ার হয়ে যাতায়াত করি৷

সমস্তদিন পাহাড়-জঙ্গলে ঘুরে সার্ভেয়ারের কাজ দেখে, বেলা চারটের সময় তার তাঁবুতে পৌঁছলাম৷ এবার ফিরবার পালা৷

আট মাইল রাস্তা৷ পাহাড়ের চড়াই-উতরাই আছে, রাস্তাও খারাপ, তার উপর আবার পাগলা হাতিও আছে৷ লম্বা-লম্বা পা ফেলে চললাম, সন্ধ্যার আগে তাঁবুতে পৌঁছতে হবে৷ কী জানি অন্ধকার হলে আবার না কোনো বিপদ ঘটে৷

বড়ো পাহাড়টা পার হয়ে নীচে নেমেছি, সেই জায়গায় যেখানে ভোরে হনুমান দেখেছিলাম৷ আগে-আগে একজন খালাসি শ্যামলাল— বন্দুক ঘাড়ে৷ তার পিছনে আমি ঘোড়ার উপর৷ আমার পিছনে ঘোড়ার সহিস অলক, তার পিছনে আরও তিন-চারজন খালাসি৷ সূর্য ডোবে-ডোবে, সকলে মাটির দিকে মুখ করে তাড়াতাড়ি চলেছি৷ হঠাৎ শ্যামলাল ‘বাপরে!’ বলে পিছন ফিরে দে দৌড়!

অলকের পাশ কাটিয়ে যাবার সময় সে তাকে ধরে ফেলল৷ আমিও ঘোড়া থেকে নেমে, তার হাত থেকে বন্দুক কেড়ে নিলাম৷ সে বেচারা থরথর করে কাঁপছে৷

‘ছাড়ো, হুজুর! ভাগো, জবর হাঁথি!’

‘কোথায় রে হাতি?’

‘ওই বাঁশঝাড়ের নীচে!’

বন্দুকে ছিটে ভরে পা টিপে-টিপে এগোলাম, মাত্র তিন-চার পা, আর কিছুই দেখা যায় না৷ আমার পনেরো-কুড়ি ফুট সামনে একটা ঝোপ ছিল, সেটা যেন একটু নড়ল, অমনি আমি ওই ঝোপটার পাশের মাটি লক্ষ্য করে, বন্দুকের আওয়াজ করলাম৷ বন্দুকের আওয়াজ হওয়া মাত্র, বিকট চিৎকার করে, প্রকাণ্ড এক মকনা হাতি একেবারে রাস্তার উপর এসে হাজির হল৷ রাস্তার উপর এসেই আমাদের দিকে মুখ ফেরাল, আর সঙ্গে-সঙ্গে আমিও পরপর দুবার বন্দুকের আওয়াজ করলাম— ছররা, মাটি লক্ষ্য করে৷ হাতিটাও অমনি লাটিমের মতো ঘুরে, রাস্তায়-রাস্তায় দে দৌড়! আমিও যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বন্দুক ভরে নিয়ে, হাতির পিছনের পায়ের কাছে, মাটি লক্ষ্য করে আবার দুবার বন্দুকের আওয়াজ করলাম৷ আর যাবে কোথায়? কী কু-কাজই হাতিটা তখন করে ফেলল! আমাদের রাস্তা দিয়ে চলাই তখন মুশকিল হল, এই হোঁচট খাই কিংবা পা পিছলে পড়ে হাত-পা ভাঙি আর কি!

ওই মিকির হিলস-এর পাহাড়ে মিকিরদের ছোটো-ছোটো গ্রাম আছে, দু-চারটে নাগা বস্তিও আছে, দু-একটা পাকডাণ্ডি রাস্তা আর ঘোর জঙ্গল, আর নানারকম জানোয়ার৷ ওই জঙ্গলে দু-তিন জায়গায় আমি ‘পুং’ অর্থাৎ গন্ধকের উৎস দেখেছি৷ ওই সব জায়গায় বেলা দুটোর সময়ও জানোয়ার দেখতে পাওয়া যায়৷

এখানকার একটা ‘পুং’-এর কাছেই আমার এক সার্ভেয়ারের ডেরা ছিল৷ তাকে বড়ো সন্তর্পণে যাতায়াত করতে হত, ভয়ে-ভয়ে রাত কাটাতে হত, সারারাত প্রকাণ্ড ধুনি জ্বেলে রাখতে হত৷ জানোয়াররা কিন্তু তবুও ওই ‘পুং’-এ আসত৷ একদিন রাত্রে বৃষ্টিতে ধুনি নিভে গিয়েছিল৷ হঠাৎ একজন খালাসির ঘুম ভেঙে গেল, তাঁবুর বাইরে ধুনির আলো নেই দেখে সে ধুনিটা উস্কিয়ে দেবার জন্য বাইরে এল৷

ওরে বাবারে! বড়ো-বড়ো দুটো হাতি ধুনির পাশে দাঁড়িয়ে তাঁবুগুলোকে দেখছে! ধুনি নিভে গেছে৷ খালাসির চিৎকারে আর সকলে জেগে চেঁচাতে আরম্ভ করল, তখন হাতি দুটো চলে গেল৷

পরদিন আমি সার্ভেয়ারের তাঁবুতে গিয়ে হাতির পায়ের দাগ দেখেছিলাম৷ কেন যে তাঁবু মাড়িয়ে চ্যাপটা করেনি, সেটাই আশ্চর্যের বিষয়!

ওইখানে তাঁবু রেখে সার্ভেয়ারকে একবার তিন-চারদিনের জন্য অন্য জায়গায় কাজ করতে যেতে হয়েছিল৷ সে একটা তিরপল সঙ্গে নিয়ে গেল, আর জিনিসপত্র পাহারা দেবার জন্য দু-জন খালাসিকে রেখে গেল৷ সঙ্গের মিকির কুলিরা বলল, ওই জঙ্গলে মাত্র দু-জন লোককে রেখে যাওয়া নিরাপদ নয়৷ তারা কুড়ি-বাইশ ফুট উঁচুতে একটা মাচা বেঁধে দিল, রাত্রে খালাসিরা ওই মাচায় শোবে৷

একদিন বেশ কেটে গেল৷ দ্বিতীয় দিন একজন খালাসি নালায় জল আনতে গিয়ে দেখল যেন একটা বার্কিংডিয়ার তাঁবুর দিকে আসছে৷ দ্বিতীয় খালাসি রান্নার জোগাড়ে ছিল, সে একবার তাকিয়েই দে দৌড়!

‘ভাগ! ভাগ! শের আতা হ্যায়!’

দু-জনে দৌড়ে গিয়ে মাচায় উঠল৷ এদের হড়বড়িতে বাঘেরও চোখ পড়েছে ওদের উপর, সেও লাফিয়ে দেখতে এল ব্যাপার কী! খাওয়া-দাওয়া চুলোয় গেল৷ তারা কত চিৎকার করল, বাঘ কি তা শোনে? ওই তাঁবুর সামনে বসে রইল৷ সমস্ত দিনটাই পাহারা দিল৷ রাত্রেও ছিল কিনা সেটা তারা বলতে পারল না, অন্ধকার রাত ছিল, দেখতে পায়নি৷

পরদিন সকালে দেখে— শর্মা তো হাজির আছেনই, আবার একটি সঙ্গীও এনে জুটিয়েছেন! সেদিনও বেচারাদের উপবাস! মাচার উপর বাঁশের চোঙায় জল ছিল, তাই রক্ষা৷ তৃতীয় দিন বিকেলবেলা সার্ভেয়ার ও তার লোকরা ফিরে এল, তাদের গলার আওয়াজ পেয়েই বাঘ দুটো চলে গেল৷

.

মিকির হিলস-এ কাজ করবার সময় আমার প্রধান আড্ডা ছিল কল্যাণীতে৷ একবার এক সাহেব কল্যাণীর ফরেস্ট বাংলোতে চার সপ্তাহ ছিলেন৷ তিনি শিকার করতে এসেছিলেন, বাঘ মারাই ছিল তাঁর মুখ্য উদ্দেশ্য৷ গাছে উপর মাচায় বসে তিনি অনেক রাত কাটিয়েছেন, কিন্তু দুঃখের বিষয় একটা বাঘও মারতে পারেননি৷ অথচ সে এলাকায় বাঘ আছে, কতবার আমাদের সামনেই পড়েছে৷

একদিন রবিবার, কাজে যাব না৷ ভোরে উঠেই বন্দুক হাতে বেরিয়েছি, বনমোরগ মারব৷ গ্রামের পাশেই ধানখেত, তার দু পাশে পাহাড় আর জঙ্গল, আর এক পাশে কল্যাণী নদী৷ জায়গায়-জায়গায় পাকা ধান সবে কাটতে আরম্ভ করেছে৷ আমি আর একজন খালাসি ধীরে-ধীরে জঙ্গলের কিনারায়-কিনারায়, আলের উপর দিয়ে চলেছি৷ একজন লোক রাত্রে খেত পাহারা দিয়ে গ্রামে ফিরছিল, সে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল ওইখানে মোরগ নেমেছে৷ আমরাও সেইদিকে চললাম৷ দু-একটা ধানের গোছা নড়ছে আর মাঝে-মাঝে দু-একটা মোরগের লালঝুঁটিও দেখা যাচ্ছে৷

চলতে হচ্ছে অতি সাবধানে, মাটিতে চোখ রেখে৷ সরু আল, দেড়-ফুট দু-ফুট উঁচু, পড়ে যাবার ভয় আছে৷ এক জায়গায় আলের উপর আট-দশটা লম্বা-লম্বা খাগড়া৷ আমরা সেই খাগড়ার ঝোপটাকে আট-দশ ফুট তফাতে রেখে পাশ কাটিয়ে পার হয়েছি, আর খপ করে কাদায় বড়ো মাটির ঢেলা পড়বার মতো একটা আওয়াজ হল৷ মুখ ফিরিয়ে দেখলাম বাঘ! চিতা বাঘ৷ সেও মোরগ খাবার জন্য খাগড়ার আড়ালে ওৎ পেতে বসেছিল৷ হঠাৎ আমরাও এসে পড়েছি আর সেও লাফ দিয়ে নীচে নামল৷ তারপর ভারিক্কি চালে জঙ্গলে চলে গেল, দৌড়ল না বা একটু ব্যস্ততাও দেখাল না৷ কিন্তু আমাদের যে সে দেখেছে ও অপছন্দ করেছে তার প্রমাণস্বরূপ তার ঘাড়ের সমস্ত লোম খাড়া হয়ে উঠেছিল৷ হাতে বন্দুক ছিল, কিন্তু চালাবার ভরসা হল না, বন্দুকে মোরগ মারবার জন্য দু নম্বর ও পাঁচ নম্বর ছিটা ভরা ছিল৷

পরে ওই সাহেবের সঙ্গে গল্পচ্ছলে যখন আমি ওই ঘটনাটা বললাম, সাহেব বললেন, ‘মারলে না কেন? ছয়-সাত ফুট দূর থেকে দু নম্বর ছিটাই তো ছোটো বাঘের পক্ষে যথেষ্ট৷’ দুঃখ করতে লাগলেন, ‘আমার যা কপাল! তিন-চার সপ্তাহ চেষ্টা করেও একটা বাঘ দেখতে পেলাম না৷’

কল্যাণীতে থাকতে একদিন বাঁদরের এক অদ্ভুত কাণ্ড দেখেছিলাম৷ নদীর কিনারায় আমার তাঁবু ছিল৷ নদীর ওপারে বন, সেখানে একপাল বাঁদর থাকত, চল্লিশ-পঞ্চাশটা কি আরও বেশি হবে৷ রাতদিন তাদের কিচির-মিচির শুনতাম, অনেক সময় বসে-বসে তাদের তামাশা দেখতাম৷ একদিন বিকেল বেলায় একেবারে হুলস্থূল ব্যাপার, যেন আবার রাম-রাবণের যুদ্ধ লেগেছে! আমার চাপরাশী এসে বললে, ‘হুজুর তামাশা দেখুন এসে৷’

তাঁবু থেকে বেরিয়ে, নদীর ধারে এসে দেখলাম, ওপারে একটা বড়ো গাছের উপর সমস্ত বাঁদরগুলো জড়ো হয়েছে আর মহা হল্লা করছে৷ দূরবিন লাগিয়ে দেখলাম সব চেয়ে উপরে একটা ডালে প্রকাণ্ড একটা বাঁদর বসে আছে, তার আশেপাশে আরও তিন-চারটে বড়ো-বড়ো বাঁদর, প্রকাণ্ডটা পালের গোদা৷ তাদের একটু নীচেই, একটা ডালের উপর চার-পাঁচটা বাঁদর অন্য একটা বাঁদরকে জড়িয়ে ধরে আছে৷ আর সব বাঁদরগুলো দু-তিন ভাগ হয়ে এদিকে-ওদিক বসেছে৷ আর কী কিচির-মিচির কী হল্লা! ভালো করে দেখে আমার মনে হল ওদের নালিশ ফরিয়াদ চলেছে, বিচারক হল পালের গোদা৷

একবার একদল কিচির-মিচির করে, তারপর অন্য এক দল, তারপর পালের গোদা৷ কিছুক্ষণ ওইরকম চলল, তারপর গোদামশাই খুব ধমক-চমক করলেন, আর চার-পাঁচটা বাঁদর মিলে ওই বাঁদরটাকে শূন্যে তুলে ছুড়ে নদীতে ফেলে দিল৷ কী চিৎকার আর কী আর্তনাদ তার! জলে ফেলে দেওয়া মাত্র অন্য সবগুলো বাঁদর লাফালাফি করে গাছ থেকে নামল আর নদীর কিনারায় জলের ধারে এসে দাঁড়াল৷

ওই বেচারা যেমন ডাঙায় উঠতে যায়, অমনি তিন-চারটে বাঁদর মিলে ওকে ঠেলে দেয়, তবুও উঠতে চেষ্টা করলে, ধরে চুবিয়ে দেয়৷ বার কয়েক এমন করে বেচারা যেন শ্রান্ত হয়ে পড়ল৷ পাহাড়ী নদী, বেশ স্রোত, কতক্ষণ আর লড়বে? শেষটা অবসন্ন হয়ে স্রোতের সঙ্গে ভেসে চলল, সাঁতরাবার আর শক্তি নেই৷ আর কী কাতরানি তার! আমাদেরও দুঃখ হচ্ছিল কিন্তু বাঁদরগুলোর একটুও দয়া হল না৷ তার সঙ্গে-সঙ্গে নদীর কিনারায়-কিনারায় দৌড়ে যেতে লাগল, আর ও বেচারা কিনারার কাছে এলেই ধমক দিতে আর শাসাতে লাগল৷

.

এক জায়গায় শিকার করতে গিয়ে বড্ড জব্দ হয়েছিলাম৷ সার্ভেয়ারের কাজ দেখতে গেছি৷ সামনে জমি, তাতে দু-চারটে ছোটো নদী, আর ছোটো-বড়ো বিল অসংখ্য৷ সব জুড়ে নলখাগড়ার বন, দশ-বারো ফুট উঁচু৷ বিলের ধারে ‘খুঁটি’ আছে, তাতে পঞ্চাশ-ষাটটা করে পোষা মহিষ আর সঙ্গে রাখাল৷ দু-চারটে গ্রামও আছে৷ বিলের ধারেই আমাদের তাঁবু পড়েছে৷

বিকেলে যখন তাঁবুতে পৌঁছলাম তখনও বেশ আলো আছে৷ কাজ করবার সময় বিলে অনেক হাঁস দেখেছি, একটা হাঁস মেরেছি৷ তাঁবুতে পৌঁছে সার্ভেয়ারকে বললাম— নৌকো পেলে হাঁস মারতে পারি৷ সার্ভেয়ার ‘খুঁটি’ থেকে নৌকা জোগাড় করে আনল৷ আমরা হাঁস মারতে চললাম৷ সার্ভেয়ারটি মুসলমান, হালাল না করলে খাবে না৷ তাঁবু থেকে একটু দূরে গিয়ে দেখলাম ‘ভেলা’ অর্থাৎ গগনবেড় বা পেলিক্যান৷ ছেলেবেলায় দেশে দল বেঁধে ভেলা উড়ে যেতে দেখেছি, শুনেছিলাম খেতে বড়ো উপাদেয়৷ বড়ো লোভ হল৷ প্রকাণ্ড জীব, একটা মারলেই পাঁচ-সাত সের মাংস পাওয়া যাবে৷

image21.jpg

মাঝিকে বললাম, ‘ওই দিকে চলো৷ ভেলা মারব৷’ ওদের কাছে যেতে বলা যত সহজ, কাছে যাওয়া তত সহজ নয়৷ আমরা যতই এগোই, পাখিরাও আমাদের দিকে পিঠ করে ততই সরে-সরে যায়৷ অতি কষ্টে, অনেক কারসাজি করে, চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ গজের মধ্যে পৌঁছোলাম৷ আর কাছে যাওয়া যায় না, কোনো অবলম্বন নেই যার আড়ালে লুকিয়ে এগোব৷ বন্দুকের দু নম্বর ছিটা ভরে, লক্ষ্য স্থির করে, ঘোড়া টিপলাম৷ বন্দুকের আওয়াজ হবামাত্র সব পাখি আকাশে উড়ে গেল, একটাও পড়ল না৷ প্রায় সিকি মাইল উড়ে, ওরা আবার জলে বসল৷ এবার একটু সুবিধা হল, টুকরো-টুকরো নলখাগড়ার ঝোপ ছিল৷ তার আড়ালে নৌকো চালিয়ে, যখন আবার খোলা জায়গায় বেরোলাম, তখন পাখিগুলো মাত্র পঁচিশ-ত্রিশ গজ দূরে৷ বন্দুক তুলে আবার ছুড়লাম, আবার কোনো ফল হল না৷ পাখিও উড়ল, আমিও অন্য নাল ছাড়লাম৷ তিন-চারটে পালক পড়ল, পাখিগুলো দিব্যি উড়ে গেল৷ দু নম্বর ছিটা ওদের পালক ভেদ করে শরীরে লাগতে পারল না৷ সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, দেড় ঘণ্টা ভেলার পিছনে নষ্ট করেছি, এখন কি আর খালি হাতে ফিরব নাকি? পথে দুটি ছোটো হাঁস মেরে নিলাম৷

তাঁবুতে ফিরে এলাম, কিন্তু মেজাজটা বড়ো খাপ্পা৷ এমন জব্দ আর কখনো হইনি, এর একটা ব্যবস্থা করতে হবে৷ ভোরে যখন ঘুম ভাঙল, তখন চারদিক কুয়াশায় ঢাকা৷ বিছানায় শুয়ে একটা ফরফর শোঁ-শোঁ শব্দ কানে আসছিল৷ জিগগেস করলাম, ‘কিয়া হ্যায় রে?’

‘ভেলা হ্যায়, হুজুর৷’

মাথার উপর দিয়ে শোঁ-শোঁ শব্দে শত-শত পাখি, হাঁস ভেলা ইত্যাদি, উড়ে যাচ্ছে৷ মারা অসম্ভব, কুয়াশায় ভালো দেখা যায় না কত উঁচুতে৷

হাত-মুখ ধুয়ে চা খেতে বসেছি৷ একজন খালাসি এসে খবর দিল, ‘হুজুর, ভেলা৷’

বাইরে এসে দেখি সিকি মাইল দূরে, শত-শত ভেলা সার বেঁধে চলেছে৷ ক্রমাগত জলে মাথা ডোবাচ্ছে আর তুলছে, শিকারে ব্যস্ত!

আমি আর সার্ভেয়ার আর একজন খালাসি নৌকোতে উঠলাম৷ আগের দিনের দুরবস্থার কথা মনে ছিল, আজ হুঁশিয়ার হয়ে বন্দুকের এক নলিতে গুলি অন্য নলিতে বাকশট ভরেছি৷ দেখব আজও উড়ে যায় কিনা৷

ভেলাগুলো বড়োই ব্যস্ত, আমাদের লক্ষ্যই করছে না৷ আমরা খুব কাছে পৌঁছে গেছি৷ ত্রিশ-বত্রিশ গজ হবে, তখন তাদের খেয়াল হয়েছে, অমনি আট-দশটা একসঙ্গে ডানা মেলেছে, উড়ে যাবার ইচ্ছা৷ আমিও এর জন্যই অপেক্ষা করছিলাম, দু-একটা হয়তো জল থেকে দু-চার ফুট উঠেছে, বেশির ভাগই তখনও জলের উপর, ডানা খোলা অবস্থায়৷ তাদের মাঝখানটা লক্ষ্য করে গুলিভরা কার্তুজ ছেড়ে দিলাম৷ কয়েকটা পাখি এলিয়ে পড়ল, আর বাকিগুলো শোঁ-শোঁ করে উড়ে গেল৷ দশ-পনেরো ফুট না উঠতে বাকশট ছাড়লাম, আরও কটা ঝুপঝাপ করে জলে পড়ল৷ যে-কটা জ্যান্ত ছিল, সার্ভেয়ার তাদের হালাল করল৷

ভেলা তো শিকার করলাম৷ তাঁবুতে ফিরে সবাইকে ভাগ করেও দিলাম৷ দু-তিনটে আপিশের বাবুদের জন্য পাঠিয়ে দিলাম৷ সকলেরই মহা আনন্দ, আজ খুব ভোজ হবে৷

সন্ধ্যার সময় কাজ থেকে ফিরে, স্নান করে, খেতে বসলাম৷ আমার লোকও মাংস রান্না করেছে৷ কিন্তু মাংস খেতে গিয়ে একেবারে অবাক৷ এ তো মাংস নয়, ঠিক যেন জুতোর চামড়া! আর গন্ধ কী, বাপ! খায় কার সাধ্য!

খালাসিরাও কেউ খেতে পারেনি৷

‘কেন রে?’

‘বহুৎ বদবো, হুজুর, আউর সিজা নহি৷’

সকলের মুখেই এক কথা, মাংস একেবারে অখাদ্য৷

হাজারিবাগের ভুঁইয়া সাঁওতাল, তারাও খেতে পারল না, সে যে কেমন মাংস বোঝাই যাচ্ছে৷

.

কাল রবিবার, কাজে যাব না৷ সকলেই শ্রান্ত-ক্লান্ত, বিশ্রাম করবে আর কাপড়-চোপড় ধোবে, জঙ্গলে তো আর ধোপা নেই৷ সন্ধ্যার সময় মাহুত এসে বলল, ‘হুজুর, গাঁয়ের এই লোক বলছে ওই পাহাড়ে অনেক ভাল্লুক আছে৷’

গ্রামের লোকটিও বলল, ‘খুব ভোরে গেলে ভাল্লুক আর বুনো মোষ দেখিয়ে দিতে পারি৷’

পাহাড়টা তাঁবু থেকে মাইল দুই দূরে৷ দু-দিন আগে সন্ধ্যাবেলা ওই পথে ফেরবার সময় আমিও একটা ভাল্লুক দেখেছিলাম৷ মাহুতকে বললাম, ‘আচ্ছা, ভোরে সাড়ে-চারটের সময় বেরোব৷’

অন্ধকার থাকতেই বেরোলাম৷ সঙ্গে দুটো হাতি, গ্রামের লোকটি আর দু-জন খালাসি৷

প্রথমেই ওই ভাল্লুকের পাহাড়ে চললাম, সূর্য ওঠার আগে পাহাড়ের নীচে পৌঁছলাম৷ পাহাড়ের নীচে-নীচে হাতি চলতে লাগল, কারো মুখে টুঁ শব্দটি নেই৷ হঠাৎ গ্রামের লোকটি আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল একটা উইয়ের ঢিপির গোড়ায় একটা কালো কিছু দেখা যাচ্ছে৷ হাতি আরেকটু কাছে গেলে দেখলাম একটা ভাল্লুক উইয়ের ঢিপি খুঁড়ছে৷ উইয়ের ডিম ভালুকের অতি প্রিয় খাদ্য৷ দশ-পনেরো গজ দূরে হাতি, ভাল্লুকটার কিন্তু খেয়ালই নেই, এমনি আহারে মত্ত সে৷ হাতিটা আরও দু-চার কদম কাছে গেল, আর কাছে যাবার চেষ্টা করলে ভাল্লুকটা পালাবে৷ বন্দুক তুলে লক্ষ্য স্থির করবার চেষ্টা করতে লাগলাম, কিন্তু বৃথা চেষ্টা! নতুন-নতুন হাতি, সম্ভবত ভাল্লুকের গন্ধ পেয়েছে, বড়ো ছটফট করছে, এক সেকেন্ড স্থির হয়ে দাঁড়ায় না৷ অনেক কষ্টে মাহুত তাকে একটু শান্ত করল, আমি তাড়াতাড়ি যথাসম্ভব লক্ষ্য স্থির করে ঘোড়া টিপলাম৷ কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য! সঙ্গে সঙ্গে হাতিটাও মাথা নাড়ল, তার ফলে গুলি ভাল্লুকের মাথায় না লেগে, পাঁচ-ছয় ইঞ্চি সামনে উইয়ের ঢিপিতে লাগল৷ কিছু বালি ছিটকে ভাল্লুকের মুখে পড়ল৷ ‘এত আস্পর্ধা কার’— দেখবার জন্য সে মুখ তুলল, আর হাতি দেখেই ‘ঘোঁৎ’ শব্দ করে পালাবার ব্যবস্থা করল৷

ভাল্লুকের পাঁজর লক্ষ্য করে অন্য নলি ছেড়ে দিলাম৷ ‘হুস’ শব্দ করে ভাল্লুকটা ছিটকে লম্বা-লম্বা ঘাসের মধ্যে পড়ল, আর সমস্ত ঘাস তোলপাড় করতে লাগল৷

image22.jpg

মাহুত বলতে লাগল, ‘হুজুর, ফের মারো৷’

‘না, দরকার নেই, পড়েছে৷’

ঘাস নড়া থেমে গেল, মরে গেছে৷ এতক্ষণে হাতি সেই জায়গায় পৌঁছুল, ভাল্লুকের নামগন্ধও নেই৷ ঘাসের উপর গড়াবার, ছটফট করবার চিহ্ন আছে বটে কিন্তু জানোয়ার নেই৷ সে হামাগুড়ি দিয়ে ভীষণ কাঁটার ঝোপের ভিতর দিয়ে পাহাড়ের এক গর্তের মধ্যে ঢুকেছে, মনে হল এইটেই তার আস্তানা— ‘লেয়ার’৷

হামাগুড়ি দেওয়া ছাড়া ওর ভিতরে ঢোকা অসম্ভব৷ ভাল্লুকের পিছনে ওই কাঁটা আর গর্তের ভিতর হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকতে প্রবৃত্তিও হল না, আমার সাহসেও কুলোল না৷ ভাল্লুকের চামড়াও আর আমার জুটল না৷

আমার হেডকোয়ার্টার কয়েকদিন যমুনামুখে ছিল৷ ভাল্লুকের ভীষণ কাণ্ড সেখানে দেখেছিলাম৷ যমুনামুখের একজন ফরেস্ট গার্ড সন্ধ্যার সময় হরিণের সন্ধানে নদীর অপর পারে সরষে খেতে গিয়েছিল৷ সকালে সন্ধ্যায় হরিণ সরষের কচি পাতা খেতে আসে৷ ধীরে-ধীরে জঙ্গলের ধারে-ধারে চলেছে, চোখ চারদিকে ঘুরছে, কোথাও হরিণ বের হয়েছে কিনা৷ খেতের পাশেই জঙ্গলের ধারে একটা পুরোনো উইয়ের ঢিপি, ওই ঢিপিটার পাশ দিয়ে যাবার সময় ভাল্লুকের পায়ের দাগ চোখে পড়ল, আর ছোটো জানোয়ারের কুঁই-কুঁই ডাকও তার কানে গেল৷ চারদিক দেখে বুঝতে পারল যে ওই ঢিপিটার মধ্যে ভাল্লুকের ছানা আছে৷ সে চুপচাপ চলে এল৷

তাদের আপিসে এসে অন্য একজন ফরেস্ট গার্ডকে ভাল্লুকের ছানার কথা বলল, আর দু-জনে পরামর্শ করল যে ভোরে তারা কোদাল খোন্তা নিয়ে, হাতিয়ারবদ্ধ হয়ে যাবে আর উইঢিপি খুঁড়ে ভাল্লুকের ছানা বের করে আনবে৷ আপিসের উপরওয়ালাদের আর সে সব কথা জানাল না৷

ভোরে উঠে তারা চলে গেল৷ সেই জায়গায় পৌঁছে একজন হাতের বন্দুক পাশে রেখে, গর্তের মুখ একটু খুঁড়ে নিয়ে, উপুড় হয়ে গর্তের মুখে কান রেখে, ভাল্লুকের ছানা গর্তের ভিতর আছে কিনা শুনতে লাগল৷ অন্য গার্ডটি একটু দূরে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক দেখছিল৷ সে একটা কিছু দেখবার জন্য একটু দূরে সরে গেল, এমন সময় ভীষণ গর্জন করে পিছন থেকে এসে ভাল্লুকী প্রথম গার্ডের পিছন কামড়ে ধরল৷ লোকটি উল্টে পড়ে গেল আর হাত দিয়ে নিজের মুখটা রক্ষা করবার চেষ্টা করতে লাগল৷ ভাল্লুকী চিবিয়ে তার হাতখানা একেবারে গুড়ো করে দিল৷ ইতিমধ্যে অন্য গার্ডটি ছুটে এসে হাজির হয়েছে৷ সে বন্দুক তুলে নিয়ে এক গুলিতেই ভাল্লুকীটাকে মেরে ফেলল৷ প্রথম গার্ড অজ্ঞান, এ বেচারা দৌড়ে গিয়ে আপিসে খবর দিল আর সকলে মিলে খাটিয়ায় তুলে তাকে নিয়ে এল৷ তখুনি তাকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হল৷

বহু যত্ন ও চেষ্টা সত্ত্বেও তার প্রাণরক্ষা হল না৷

গোলাঘাট আর বড়োপখারের মাঝামাঝি গরমপানিতে গন্ধক-জলের একটা উষ্ণ প্রস্রবণ আছে৷ অনেক লোক এই গরম জলে স্নান করতে আসে৷ এর জলে নাকি রোগ নিবারণী শক্তি আছে, বিশেষত চর্মরোগ৷ সরকারি জঙ্গল বিভাগের একটা বাংলোও সেখানে আছে৷ ওই বাংলোয় আমি কয়েকদিন ক্যাম্প করেছিলাম৷

একজন সার্ভেয়ারের কাজ দেখতে যাব, আট মাইল দূরে তার ক্যাম্প৷ ভোরেই ঘোড়ায় চড়ে বের হয়েছি, সঙ্গে আমার সহিস আর একজন লোক৷ বড়োপখারের রাস্তায় চলেছি, ওই রাস্তায় এক জায়গায় বাঘের ভয়, বাংলোর চৌকিদার দু-একবার আমাকে সে কথা বলেছে আর সাবধান করে দিয়েছে যেন অন্ধকারে হুঁশিয়ার হয়ে চলাফেরা করি৷ বেশ তাড়াতাড়ি চলেছি৷ ডাকবাংলো থেকে চার-পাঁচ মাইল পথ গিয়েছি৷ খুব কুয়াশা৷ ঘোড়ার পিঠে বসে মনে হতে লাগল— এই জায়গায়-না বলেছিল বাঘের ভয়? পরমুহূর্তেই রাস্তার একটা মোড় ঘুরেছি আর কথা নেই বার্তা নেই জঙ্গল থেকে লাফিয়ে খপ করে রাস্তায় পড়ল— বাঘ! একেবারে মুখোমুখি৷ আমরা তো থমকে দাঁড়ালাম, ভয়ে ঘোড়াটা একেবারে আড়ষ্ট হয়ে গেল; বাঘটাও ‘হুপ’ বলে এক লাফ দিয়ে ঝপাং করে জঙ্গলের মধ্যে গিয়ে পড়ল৷ কে যে বেশি ভয় পেল তা বুঝতে পারলাম না!

এই গরমপানিতে একটা মজার ঘটনা হয়েছিল৷ কাজকর্ম শেষ হয়েছে, সকল সার্ভেয়ারদের উপর হুকুম হয়েছে : ‘গরমপানিতে এসে জড়ো হও, কাল ভোরে আমরা গোলাঘাট যাব৷’ গোলাঘাটে আমাদের আপিস ছিল৷

সন্ধ্যার সময় ইন্দ্রসিং সার্ভেয়ার এসে নালিশ করল, ‘হুজুর, বক্তাওয়ার সিং-এর সর্বনাশ হয়েছে৷ কাল রাত্রে তার ৮৭ টাকা চুরি গেছে৷’

‘কী করে চুরি গেল?’

‘হুজুর, টাকা তার তাঁবুর ভিতরে বাক্সে ছিল৷ ভুলে বালিশের নীচে চাবি ফেলে এসেছিল৷ কাজ শেষ করে তাঁবুতে ফেরেনি, আমার তাঁবুতে শুয়েছিল৷ বেলা আড়াইটে-তিনটে নাগাদ তার টিন্ডেল আর একজন লোক ‘পেট ব্যথা করছে’ বলে তাঁবুতে চলে যায়৷ আজ সকালে যখন আমরা বক্তাওয়াসিং-এর তাঁবুতে এলাম, সে আগে চাবি খুঁজেছে, তারপর বালিশের নীচে থেকে চাবি নিয়ে বাক্স খুলে দেখে একটিও টাকা নেই৷’

‘লোকজন যারা তাঁবুতে ছিল তাদের জিগগেস করনি?’

‘হ্যাঁ হুজুর, আমার সামনেই টিন্ডেলকে জিগগেস করা হয়েছিল৷ সে তো চটে গেল— সে কিছু জানে না, তাকে কেন জিগগেস করা হচ্ছে৷ বাবুর রোটিওয়ালাও (রাঁধুনি) তো তাঁবুতে ছিল৷’

বাবুর রোটিওয়ালা বলল যে সে ‘লকড়ি’ খুঁজতে গিয়েছিল, তখন ওই টিন্ডেল আর অন্য খালাসিটা তাঁবুতে ছিল— প্রায় আধঘণ্টা৷ সব খালাসিদের ডেকে পাঠালাম৷ অনেক জেরা করলাম৷ তাদের কথাবার্তার ভাব-ভঙ্গি দেখে, রকম-সকম দেখে আমার দৃঢ় বিশ্বাস হল যে ওই টিন্ডেল বেটাই চোর৷ কিন্তু কিছুতেই স্বীকার করে না৷

একটুক্ষণ চিন্তা করে আমার চাপরাশি রামাবতারকে ডেকে পাঠালাম, বললাম, ‘তোমাকে ভোরে গোলাঘাট যেতে হবে৷ ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের নামে চিঠি দিচ্ছি, পুলিশ নিয়ে আসবে৷ আর ইন্দ্রসিং আর বক্তাওয়ারসিং বাবুদের যত খালাসি আছে সকলকে আটক করতে হবে৷ যে পর্যন্ত না এই চুরির টাকার একটা কিনারা হয় ততদিন এদের আটক রাখতে হবে৷ রাস্তায় বাঘের ভয় আছে, মশালের বন্দোবস্ত করো আর তোমার সঙ্গে যাবার জন্য দু-জন লোক ঠিক করো৷’

তারপর তাড়াতাড়ি দুটো চিঠি লিখে আমার টেবিলের উপর রেখে দিয়ে বললাম, ‘এই চিঠি নিয়ে যাবে, একখানা ম্যাজস্ট্রেট সাহেবের আর একখানা আমাদের বড়োসাহেবের৷ তুমি যাবার সময় এই চিঠি নিয়ে যাবে৷’

রাত্রে শুতে যাব এমন সময় চার-পাঁচজন টিন্ডেল এসে অনেক মিনতি করল, ‘হুজুর চুরি যেই করুক, একজন করেছে৷ সকল খালাসিকে আটক করলে বড়ো জুলুম হবে৷ ওদের বড়ো ক্ষতি হবে৷’

আমি বললাম, ‘আমি সেটা জানি না৷ এ হতেই পারে না যে অতগুলো টাকা চুরি গেল আর কেউ কিছু জানে না৷ নিশ্চয়ই জানে৷ সকলে একজোট হয়ে কিছু বলছে না, এখান থেকে বেরিয়ে গেলে ভাগাভাগি করে নেবে৷ কাজেই পুলিশ এসে একটা ব্যবস্থা করুক৷’

‘হুজুর, পুলিশের হাতে দিলে এদের নিজের কামানো পয়সাও সব চলে যাবে৷’

‘যাক, সব বেটাই চোর এরা, চোরের উপর আমার কোনো সহানুভূতি নেই৷ তোমাদের যদি অত দরদ হয়ে থাকে তাহলে তোমরা চাঁদা তুলে, বা পঞ্চায়েত করে চোরের কাছ থেকে বাবুর টাকা আদায় করে দাও৷’ এই বলে আমি তাদের হাঁকিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়লাম৷

গরমপানি থেকে গোলাঘাট চোদ্দো মাইল রাস্তা, তাতে আবার গরমের দিন, কাজেই ভোরে চারটে নাগাদ সকলকে উঠতে হবে৷ চারটের আগেই গোলমাল আর চেঁচামেচিতে আমার ঘুম ভেঙে গেল৷ উঠে দেখি এক জায়গায় চার-পাঁচজন সার্ভেয়ার, হাতির মাহুত, আর অনেক খালাসি জড়ো হয়ে গোলমাল করছে৷ ডেকে জিগগেস করলাম, ‘কী হয়েছে?’

ইন্দ্রসিং আর এক বুড়ো সার্ভেয়ার ছুটে এসে বলল, ‘হুজুর, বক্তাওয়ারসিং-এর টাকা পাওয়া গিয়েছে৷’

‘কী করে পাওয়া গেল?’

image23.jpg

‘দেওয়ানজির (ওই বুড়ো সার্ভেয়ারকে সকলে দেওয়ানজি বলে ডাকত) চাকর তাঁর বিছানা বাঁধবার জন্য খাটিয়া ধরে ঠেলেছিল, পাশে হাতিভীম গদি ছিল, তাতে খাটিয়ার ধাক্কা লেগেছিল আর অমনি ঝনাৎ করে গদির উপর থেকে কয়েকটা টাকা নীচে পড়ে গিয়েছে৷ আওয়াজ শুনে দেওয়ানজি দেখতে গেলেন কী ব্যাপার৷ গিয়ে দেখলেন কয়েকটা টাকা মাটিতে পড়ে আছে, আর গদির উপর সারে-সারে অনেক টাকা সাজানো আছে৷ গুণে ৮৭ টাকা সব পাওয়া গেল৷’

আমি চাপরাশিকে ডেকে বললাম, ‘তোমাকে আর গোলাঘাট যেতে হবে না৷ চিঠিটা ছিঁড়ে ফেলো৷’

চিঠিটা ছিঁড়তে গিয়ে দেখি তাতে কিছুই লেখা নেই শুধু হিজিবিজি আঁকা৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *