বনের খবর – ১

যারা জরিপের কাজ করে, তাদের মধ্যে অনেককে ভারি ভয়ংকর সব জায়গায় ঘুরে বেড়াতে হয়৷ সেই সব জায়গায় হাতি, মহিষ, বাঘ, ভাল্লুক আর গণ্ডার চলা-ফেরা করে, আবার যেখানে সেই-সব নেই, সেখানে তাদের চেয়েও হিংস্র আর ভয়ানক মানুষ থাকে৷ প্রায় কুড়ি-বাইশ বছর এই সব জায়গায় ঘুরে কত ভয়ই পেয়েছি, কত তামাশাই দেখেছি৷

সরকারি জরিপের কাজে অনেক লোককে দলে-দলে নানা জায়গায় যেতে হয়৷ এক-একজন কর্মচারীর উপর এক-একটা দলের ভার পড়ে৷ তাঁর সঙ্গে জিনিসপত্র বইবার জন্য, হাতি, গোরু, ঘোড়া, খচচর ও উট, আর জরিপ করবার জন্য সার্ভেয়ার, আমিন, খালাসি ও চাকর-বাকর বিস্তর থাকে৷ বনের মধ্যে থাকতে হয় তাঁবুতে৷ লোকজনের বাড়ির কাছে থাকা প্রায়ই ঘটে ওঠে না, এক-এক সময় এমনও হয় যে চারদিকে কুড়ি-পঁচিশ মাইলের মধ্যে আর লোকালয় নেই৷ বন এমনই ঘন আর অন্ধকার যে তার ভিতর অনেক সময় সূর্যের আলো প্রবেশ করে না; চলবার পথ, জঙ্গল কেটে তৈরি করে নিতে হয়, তবে অগ্রসর হওয়া যায়৷ যদি জানোয়ারের রাস্তা, বিশেষত হাতির রাস্তা, পাওয়া গেল তো বিশেষ সুবিধার কথা বলতে হবে৷

এমনি বিশ্রী জায়গা! প্রথম-প্রথম এই সব জায়গায় সহজেই ভয় হত৷ আমার মনে আছে প্রথম বছর যখন শান স্টেটে যাই, আমার তাঁবুর সামনে বসে একটা বাঘ ফোঁস-ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলছিল, আমি তা শুনে বড়োই ব্যস্ত হয়েছিলাম৷ তারপর, এর চেয়েও কত বড়ো-বড়ো ঘটনায় পড়েছি কিন্তু তেমন ব্যস্ত কখনো হইনি৷

কলেজ ছেড়ে চাকরিতে ঢুকে কাজ শিখবার জন্য দেরাদুন গিয়েছিলাম৷ আমার মাথায় তখনো চাকরির চাপ পড়েনি

কাজ শিখছি, তখনো যেন স্কুলের ছাত্র৷ স্কুলের ছাত্রের স্বভাব সুলভ বাঁদুরে বুদ্ধি পেটের মধ্যে তখনো পুরোমাত্রায় রয়েছে৷ তার ফলে লোকের উপর মধ্যে-মধ্যে একটু-আধটু অত্যাচার হত— লেগ পুলিং চলত৷

সেই বছর দেরাদুনে দুজন হিন্দুস্থানি ও তিনজন বাঙালি অফিসার ছিলেন, সকলেই আমার চেয়ে সিনিয়ার৷ তাঁরাও পাহাড়-জঙ্গলে কাজ শিখতে গিয়েছিলেন৷ বাঙালি অফিসারদের মধ্যে একজন— শ্রীযুক্ত অ আমার পূর্ব-পরিচিত, শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে আমার তিন ক্লাশ উপরে পড়তেন৷ অন্য দু-জন, শ্রীযুক্ত নি- আর শ্রীযুক্ত হি-ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের পুরাতন ছাত্র৷ শ্রীযুক্ত নি- আর শ্রীযুক্ত অ- আমাকে বড়ো স্নেহ করতেন৷ কত নিমন্ত্রণ যে তাঁদের বাড়িতে খেয়েছি৷ হিন্দুস্থানি ভদ্রলোকদের মধ্যে সর্দার অ-পাঞ্জাবি শিখ আর শ্রীযুক্ত দু-অযোধ্যার লোক৷ সর্দার সাহেব ধীর গম্ভীর লোক, কারো সঙ্গে বড়ো একটা মিশতেন না, বেশি কথাবার্তাও বলতেন না৷

আমরা চারজন বাঙালি একসঙ্গে মেস করে ছিলাম, আমাদের তাঁবু ছিল দেরাদুন থেকে মাইল দুই দূরে— নালাপানিতে৷ শনিবার কাজ শেষ করে আমরা অনেকেই দেরাদুনে আসতাম, আবার রবিবার সন্ধ্যায় তাঁবুতে ফিরে যেতাম৷ কেউ বা রবিবার রাতটাও দেরাদুনেই কাটিয়ে সোমবার ভোরে ক্যাম্পে হাজির হতেন৷ শ্রীযুক্ত হি- অনেক সময়ই রবিবার রাত্রে দেরাদুনে খাওয়া-দাওয়া করে গভীর রাত্রে তাঁবুতে হাজির হতেন, শ্রীযুক্ত নি- সন্ধ্যার পূর্বেই ফিরতেন৷ আমাদের ফিরবার রাস্তা ছিল একটি গোরস্থানের পাশ দিয়ে আর শ্মশানের ভিতর দিয়ে৷ দু-চারদিন শ্রীযুক্ত হি-কে অত রাত্রে একলাটি আসতে দেখে, শ্রীযুক্ত নি- একদিন তাঁকে তাড়া দিলেন, ‘অত রাত্রে অমন করে একলাটি আস, তোমার ভয় করে না?’

‘কীসের ভয়?’

‘কেন ভূতের ভয়, শ্মশানের উপর দিয়ে আসতে হয়, আবার পাশে গোরস্থান৷’

শুনে তো শ্রীযুক্ত হি- হো-হো করে হেসেই আকুল, ‘জ্যান্ত মানুষকে তো ভয় করলাম না, বাকি এখন মরা মানুষকে ভয়৷’

শ্রীযুক্ত নি- তো চটে লাল৷ বলাবাহুল্য তিনি একটু নার্ভাস প্রকৃতির লোক ছিলেন৷

.

নালাপানির কাজ শেষ হলে আমরা আরও মাইল দুই দূরে সোং নদীর ধারে রায়পুরে, এক আমবাগানে ক্যাম্প করেছিলাম৷ প্রকাণ্ড আমবাগান, তার এক ধারে ছয়জন সাহেবের তাঁবু, এক ধারে আমরা চার-পাঁচজন ভারতবাসী, আর এক পাশে দুজন ইনস্ট্রাক্টার— মুন্সী জ্যাকেরিয়া আর জ্যাকেরুদ্দিন৷

এক রবিবার সমস্ত সকালটা আমরা নিজের-নিজের তাঁবুতে বসে আপিসের কাজ করেছি৷ বেলা বারোটা-সাড়ে বারোটায় খাওয়া-দাওয়া সেরে আমি শ্রীযুক্ত দু-এর তাঁবুর দিকে যাচ্ছিলাম, পথে মুনশি জ্যাকেরিয়ার তাঁবু৷ দেখলাম, তাঁর সামনে একটা টেবিলের উপর একখানা খাপসুদ্ধ তলোয়ার আর এক সেট উর্দি৷ সেখানে শ্রীযুক্ত অ-, শ্রীযুক্ত গি- আর শ্রীযুক্ত দু- দাঁড়িয়ে মুনশিজির সঙ্গে গল্প করছেন৷

আমি জিগগেস করলাম, ‘এগুলো কী?’

মুনশিজি বললেন, ‘একজন সওয়ার জরিপের কাজ শিখতে এসেছে৷ এ তার হাতিয়ার আর উর্দি৷’

আমি পাগড়ি, কোমরবন্ধ ইত্যাদি উলটিয়ে-পালটিয়ে দেখলাম৷ তারপর তলোয়ারখানা তুলে নিয়ে, টেনে খাপ থেকে বার করলাম৷ তার ব্যালেনসটা পরীক্ষা করবার জন্য হাতলটা ধরে, জোরে সামনের দিকে একটা খোঁচা মারলাম— অবশ্য শূন্যে৷

টেবিলের অন্য পাশে, বেশ চার-পাঁচ ফুট দূরে ছিলেন শ্রীযুক্ত নি-৷ ‘বাপরে!’ বলে এক লাফে তিনি আরও চার-পাঁচ ফুট পিছনে সরে গেলেন৷

আমার মাথায় শনি চাপল৷ আমি এক পা অগ্রসর হয়ে আবার তলোয়ার চালালাম হাওয়াতে৷ ‘আরে বাপ!’ বলে শ্রীযুক্ত নি- লাফিয়ে আরও তিন-চার ফুট পিছনে সরে গেলেন৷

আর যায় কোথায়! তিনি যতই পিছনে হটে যান, আমি ততই দু-এক পা করে এগোই আর তলোয়ার চালাই শূন্যে— তিনি আবার চিৎকার করে পিছনে হটে যান, একবার চেয়েও দেখেন না যে তলোয়ারের ডগা তাঁর চার-পাঁচ ফুটের মধ্যেও পৌঁছয় না৷

সকলে তো হেসেই আকুল! আর সকলে যতই হাসে, তিনিও তত চিৎকার করেন আর আমাকে গালি দেন— ‘রাখ ওটা হাত থেকে, শিগগির রাখ৷’

আমি তলোয়ারখানা খাপে পুরে টেবিলের উপর রেখে দিলাম, মুনশিজি হাসতে-হাসতে সেখানা তাঁর তাঁবুর ভিতরে রেখে এলেন, আর শ্রীযুক্ত নি-কে বললেন, ‘গোসসা মৎ করো বাবু সাহেব, উয়ো তো স্কুল কা ছোকরা হ্যায়!’

সোং নদীর অপর পারে দোয়ারা পাহাড়ে কাজ করতে গিয়েছিলাম আমরা চারজনে— শ্রীযুক্ত নি-, শ্রীযুক্ত অ-, শ্রীযুক্ত জ- আর আমি৷

কাজ করতে-করতে যখন পাহাড়ের চুড়োয় পৌঁছলাম তখন ঝড় আর মুষলধারে বৃষ্টি আরম্ভ হল৷ সকলে মিলে একটা ঝোপের আড়ালে আশ্রয় নিলাম আর জরিপের বড়ো-বড়ো ছাতার আড়ালে অতি কষ্টে ম্যাপগুলোকে রক্ষা করলাম৷ দেড়-দু ঘণ্টা পর, ঝড়-বৃষ্টি থামলে আমরা উঠে বাকি কাজটুকু শেষ করবার জন্য ব্যস্ত হলাম৷ একটুকু মাত্র বাকি আছে, তখন শ্রীযুক্ত নি- বললেন, ‘এক্ষুনি চল, না হলে তাঁবুতে পৌঁছতে রাত হয়ে যাবে৷’

আমরা বললাম, ‘এইটুকু কাজের জন্য আবার কাল এত দূর আসা হতে পারে না৷ এইটুকু শেষ করেই যাব, একটু সবুর করুন৷’

না, তিনি কিছুতেই রাজি হলেন না, বললেন, ‘একে তো বিশ্রী রাস্তা, তার উপর আবার বৃষ্টিতে ভিজেছে৷ নিশ্চয়ই বেজায় পিছল হয়েছে, অন্ধকার হয়ে গেলে যেতেই পারব না, এক্ষুনি চল৷’

‘তাহলে আপনি এগোন আমরা কাজটুকু শেষ করে আসছি, আপনাকে রাস্তায় ধরে নেব৷’

তিনি চলে গেলেন, আর যাবার সময় তাঁর নিজের বল্লম লাগানো লাঠিটা তো নিলেনই, আমারটাও নিলেন৷

কুড়ি-পঁচিশ মিনিটে বাকি কাজটুকু আমরা করলাম৷ ততক্ষণে পশ্চিমদিক লাল করে সূর্য অস্ত যায়-যায়৷ শ্রীযুক্ত অ- বললেন, ‘চল, যেদিক দিয়ে এসেছি, সেইদিক দিয়ে ফিরে যাই৷’

আমরা বললাম, ‘না৷ ওটা বড্ড খাড়া৷ চড়বার সময়ই তিন-চার জায়গায় ধরে-ধরে উঠতে হয়েছে৷ এখন বৃষ্টিতে ভিজে ওইসব জায়গা আরও বিশ্রী হয়েছে৷ অনর্থক রিসক নেবার দরকার নেই৷’

শ্রীযুক্ত অ- গ্রাহ্যই করলেন না, একজন পাহাড়ি খালাসি সঙ্গে নিয়ে ওইদিক দিয়েই চলে গেলেন৷ শ্রীযুক্ত জ- আর আমি রাস্তা ধরে চললাম৷ রাস্তা আড়াই ফুট থেকে তিন ফুট চওড়া, দেয়ালের মতন প্রায় খাড়া পাহাড়ের গা বেয়ে এঁকে-বেঁকে নেমেছে৷ সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে দেখে আমরা দৌড়ে চললাম, খালাসিরাও আমাদের পিছন-পিছন দৌড়ে নামতে লাগল৷ বোধহয় তৃতীয়াংশ বা অর্ধেক রাস্তা নেমেছি, শ্রীযুক্ত জ- বললেন, ‘সামনে যেন শ্রীযুক্ত নি-?’

‘সে কী রকম? তিনি তো আধঘণ্টা আগে বেরিয়েছেন, এতক্ষণে বোধহয় নীচে নালায় পৌঁছে গেছেন৷’

শ্রীযুক্ত জ- বললেন, ‘ওই দেখ৷’

তাকিয়ে দেখলাম সত্যি-সত্যিই শ্রীযুক্ত নি- নামছেন৷ আর সে পাহাড় নামা এক অদ্ভুত কাণ্ড! তিনি খাদের দিকে পিছন ফিরে, পাহাড়ের চুড়োর দিকে মুখ করে, একেবারে পাহাড়ের দেয়াল ঘেঁষে, দুই হাত দুই বল্লমে ভর দিয়ে ‘হাঁটি-হাঁটি পা-পা’ করে এক-এক পা ফেলছেন, দু-জন পাহাড়ি খালাসি তাঁর দুই পাশে, দুই হাত দিয়ে আগলিয়ে রয়েছে৷ ঠিক যেন ছোটো ছেলে, মা-বাবার দুই হাত ধরে ধীরে-ধীরে পা ফেলছে পাশের দিকে— যেমন করে ডাঙায় কাঁকড়া চলে৷

আমরা দু-জন দৌড়ে নামছিলাম, পায়ে ভারি-ভারি বুট, তার দুমদুম আওয়াজ হচ্ছিল৷ ওই শব্দ কানে পৌঁছানো মাত্র শ্রীযুক্ত নি- একেবারে বসে পড়লেন৷ আমার মাথায় ভূত চাপল, রাস্তার পাশে বেশ বড়ো গোটা দু-চার পাথর ছিল, তার একটাকে ঠেলে খাদে ফেলে দিলাম৷ হুড়-হুড় শব্দে সব ভেঙে চুরমার করে, সেটা যেন একেবারে পাতালে চলে গেল৷ বেচারা নি-! তাঁর কী দুরবস্থা!’ চোখ বুজে বসে-বসে খালি আমাকে তাড়না করছেন, ‘হতভাগা, তোর না হয় সাতকুলে কেউ নেই, মরতে হয় তুই খাদে পড়ে মর-না৷ শুধু-শুধু আমাদের কেন আবার টানছিস?’ একটু অপ্রস্তুত হয়ে আমি বললাম, ‘আচ্ছা দাদা, আর না৷ আপনি চলুন, আমরা আপনার পিছন-পিছন আস্তে-আস্তে চলছি৷’

‘না, না, কিছুতেই নয়৷ তোকে দিয়ে বিশ্বাস নেই, তুই এগিয়ে না গেলে, আমি উঠছি না এখান থেকে৷’

অগত্যা কী করি৷ অতি কষ্টে শ্রীযুক্ত জ- আর আমি পাশ কাটিয়ে তাঁকে পার হয়ে গেলাম, তিনি পাহাড়ের দেয়াল ঘেঁষে, চোখ বুজে বসে রইলেন৷ আমরা দৌড়ে নেমে গেলাম৷

নীচে সোং নদীতে পৌঁছে দেখি শ্রীযুক্ত অ- আমাদের অপেক্ষায় বসে রয়েছেন৷ জিগগেস করলেন, ‘এত দেরি কেন?’ সব কথা তাঁকে বললাম৷ তিনি বললেন, ‘সবুর কর, তিনি আসুন৷’

অনেকক্ষণ পর শ্রীযুক্ত নি- এলেন আর আমার চোদ্দো পুরুষ উদ্ধার করলেন৷ বললেন আমি একটা রেকলেস ফুল!

.

আগেই বলেছি সর্দারসাহেব ধীর, গম্ভীর লোক, কারও সঙ্গে বড়ো একটা মিশতেন না, নিজে একলাটি কাজ করতে যেতেন৷ আমরা যেতাম তিন-চারজন এক সঙ্গে৷ আমরা কাজ করে তাঁবুতে ফিরে এলে কিন্তু সর্দারসাহেব রোজ রাত্রে শ্রীযুক্ত জ-এর নকশাখানা নিয়ে তাঁর নিজের নকশার সঙ্গে মিলিয়ে দেখতেন, কোনদিকে কতটুকু কাজ আমরা করেছি, কোন পাহাড়ের কতটুকু আমরা চড়েছি ইত্যাদি৷ যদি দেখতেন যে কোনোদিকে তাঁর চেয়েও বেশি দূরে আমরা মেপেছি, বা কোনো পাহাড়ে বেশি উঁচু পর্যন্ত উঠেছি, অমনি তার পরদিনই, ওই পাহাড়ে গিয়ে আমাদের চেয়েও একটু বেশি কাজ করে আসতেন৷ একদিন ঠিক করলাম সর্দারসাহেবকে একটু ভোগাতে হবে৷

আমরা সত্যি-সত্যি যতটুকু জরিপ করেছি, টিমলি পাহাড় তার বাইরে৷ শ্রীযুক্ত জ-এর ও আমার নকশার উপর ওই পাহাড়ের চেহারা একটু-একটু এঁকেছিলাম জানি মাত্র৷ একদিন শ্রীযুক্ত জ-এর ম্যাপের উপর ওই আঁকাটার চারদিকে পেনসিল দিয়ে এ-পাশে ও-পাশে আরও পাঁচ-সাতটা নালা আর পাহাড়, কতকটা আভাসে আর কিছুটা কল্পনার সাহায্যে এঁকে একটা নকশা তৈরি করলাম, ঠিক যেন আমরা ওই সব জরিপ করে এসেছি৷ সর্দারসাহেব রোজই শ্রীযুক্ত জ-এর নকশাই দেখে থাকেন, তাই তাঁর নকশার উপরই করলাম৷ আমারটা তিনি দেখবেন না, সুতরাং আমার নকশার উপর করলে পণ্ডশ্রম হবে৷

আমার কাণ্ড দেখে শ্রীযুক্ত জ- বলতে লাগলেন, ‘তুমি এই গরিবকে কাল টিমলি পাঠাবে দেখছি৷ আই হোপ সো, ইট উইল সারভ হিম রাইট!’

যেমন রোজ হয়, তেমনি সে রাত্রেও সর্দারসাহেব শ্রীযুক্ত জ-এর নকশার সঙ্গে তাঁর নিজের নকশা মিলিয়ে দেখলেন৷

সকালে উঠে, কাজে বার হবার সময় শ্রীযুক্ত জ- সর্দারসাহেবকে ডাকলেন, তাঁর চাকর এসে বলল, ‘উয়ো তো রাত সাড়ে-চার বাজে কাম পর চলে গঁয়ে৷’

আমরা কাজকর্ম শেষ করে সন্ধ্যার সময় তাঁবুতে ফিরলাম, সর্দারসাহেব তখনও ফেরেননি৷ একটু দুঃখ হল, তাড়াতাড়ি লন্ঠন দিয়ে, তিন-চারজন লোক পাঠালাম তাঁর খোঁজ করার জন্য৷ অনেক রাত্রে তিনি ফিরলেন৷

ভোরে উঠেই সর্দারসাহেব শ্রীযুক্ত জ-এর নকশার জন্য লোক পাঠালেন৷ ইচ্ছা, তাঁর নিজের নকশার সঙ্গে মিলিয়ে দেখবেন৷ নকশা দেখেই তো তাঁর চক্ষুস্থির, শ্রীযুক্ত জ-এর নকশা পরিষ্কার! টিমলির আশেপাশে কোনো কাজই নেই, পরিষ্কার সাদা কাগজ মাত্র!

বলা বাহুল্য আগের দিনই আমি সব রবার দিয়ে ঘষে পরিষ্কার করে রেখেছিলাম৷ সর্দারসাহেব তাড়াতাড়ি শ্রীযুক্ত জ-কে ডেকে জিগগেস করলেন, ‘ওই কাজটুকু কাল দেখেছিলাম, সেটা কী হল?’

শ্রীযুক্ত জ- বললেন, ‘ওখানে তো কাজ করিনি আমরা৷ ওটুকু প্র-এর স্কেচিং আর ইম্যাজিনেশন-এর দৌড়৷ কাল কাজে যাবার সময় ও নিজেই সেটা মুছে ফেলেছে৷’

সর্দারসাহেবের মনের ভাবটা যে কেমন হয়েছিল তা ভগবানই জানেন৷ আমি নাকি ‘এ ভেরি মিসচিভাস ফেলো!’

.

দেরাদুনে আমার উপর হুকুম হল ঘোড়ায় চড়তে শিখতে হবে৷ একটা ঘোড়ার বন্দোবস্ত করলাম৷ আগে কখনো চড়িনি, কাজেই ‘শিক্ষাটা’ সোজা হল না, বিশেষ বেগ পেতে হল৷ জিনের সঙ্গে যেন আড়ি, একটু নড়াচড়াতেই সে আমাকে ঠেলে ফেলে দেবার উপক্রম করে৷

সে সময়ে দেরাদুনে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের ডেপুটি কনজারভেটার রায়বাহাদুর ক- থাকতেন৷ তিনি একদিন আমার অবস্থা দেখে জিগগেস করলেন, ‘বাবাজির বুঝি এই প্রথম চেষ্টা?’

‘হ্যাঁ৷’

‘আচ্ছা, চলো৷ আমি তোমাকে কী করে চড়তে হয় দেখিয়ে দিচ্ছি৷’

তিনি আমার শিক্ষকতা গ্রহণ করলেন, বলা বাহুল্য তাঁর শিক্ষকতার গুণে অল্পদিনের মধ্যেই একটু-একটু চড়তে শিখেছিলাম৷

রায়বাহাদুর ছিলেন পাকা শিকারি৷ বাঘ, ভাল্লুক অনেক শিকার করেছেন তিনি৷ তাঁর কাছে অনেক শিকারের গল্প শুনেছিলাম, তার মধ্যে একটি বড়োই হাস্যকর৷

তিনি তখন চক্রাতায় ডেপুটি কনজারভেটার, সেখানে সঙ্গে তাঁর এক ভাইপো ছিলেন৷ অবসরমতো খুড়োর বন্দুক দিয়ে কখনো-কখনো পাখি শিকার করতেন৷ রায়বাহাদুরের বাঘ শিকারের বড়ো শখ, তাই তাঁর অধীনস্থ সব ফরেস্ট গার্ডদের উপর হুকুম দিয়েছিলেন যে বাঘের সন্ধান পেলেই তাঁকে খবর দেবে৷

একদিন কার্যোপলক্ষে তাঁকে দেরাদুন চলে আসতে হয়েছিল৷ তার পরদিনই দুজন ফরেস্ট গার্ড এসে হাজির৷

‘সাহেব কোথায়?’

‘কেন? সাহেব কাল দেরাদুন গিয়েছেন৷’

‘শিগগির তাঁকে খবর দিন৷ বাঘ৷’

‘কোথায়?’

‘এই মাইল দুই দূরে, মোষ মেরেছে৷’

ভাইপো বললেন, ‘সাহেব তো তিন-চারদিন পর আসবেন৷ তোমরা গিয়ে মাচা বাঁধো, আমি মারব বাঘ৷’

‘বাবু, তুমি পারবে না৷ মস্ত বড়ো বাঘ, প্রকাণ্ড মহিষটাকে টেনে কত দূরে নিয়ে গেছে৷’

‘পারবে না’ শুনে বাবু তো মহা খাপ্পা! সাহেবের বন্দুক, রাইফেল সব মজুত রয়েছে, ‘পারব না’ আবার কী?

ধমক খেয়ে বেচারারা একটু ভয় পেল৷ হাজার হোক সাহেবেরই তো ভাইপো! একটু চিন্তা করে বলল, ‘আচ্ছা বাবু, তিনটের সময় তৈরি থাকবেন, আমরা আসব৷’

অমনি মাহুতের উপর হুকুম হল, ‘তিনটের সময় হাতি চাই, বাঘ মারতে যাব৷’

যথাসময়ে হাতিয়ার নিয়ে তাঁরা বের হলেন৷ রাস্তায়, ওই গার্ডরা শিখিয়ে রাখল যেন বাঘ আসা মাত্রই বন্দুক না ছোঁড়া হয়, তাক করে বসে থাকতে হবে; ওরা বাবুর গা টিপলে তবে যেন ফায়ার করেন৷

ভাইপো বললেন, ‘আচ্ছা৷’

সেখানে পৌঁছেই তো বাবু চটে লাল, ‘অত নীচু কেন মাচা?’

গার্ডরা বলল, ‘বাবু, সাহেবের জন্য আরও ঢের নীচু মাচা বাঁধা হয়৷ আপনি নতুন লোক বলে উঁচু করে বেঁধেছি৷ বেশি উঁচু হলে মারবার সুবিধা হয় না৷’

শিকারিরা মাচায় উঠে বসলেন৷ মাহুতকে হুকুম দিলেন যে উপরি-উপরি দুবার বন্দুকের আওয়াজ করলেই যেন হাতি নিয়ে আসে৷ রাইফেল হাতে ভাইপো মাঝখানে বসলেন, গার্ড দুজন তাঁর দু-পাশে৷ আবার তাঁকে তারা বলে রাখল যেন তাক করে প্রস্তুত হয়ে থাকেন, কিন্তু তারা আঙুল দিয়ে তাঁর গা টিপলে তবে যেন বন্দুক ছোঁড়া হয়৷

সব ঠিক, এবার বাঘ এলেই হয়৷

সন্ধ্যার আগেই, কিছু দূরে একটা শব্দ ‘হিঁয়াও’— যেন একটা কুকুর হাই তুলল৷ গার্ডরা বলল, ‘ওই আসছে৷’ আবার সব নিস্তব্ধ৷ দশ-পনেরো মিনিট পর, অল্প দূরে ‘ক্যাঁও ক্যাঁও’ শব্দ করে একটা ময়ূর উড়ল, গার্ডরা ভাইপোকে ইশারায় সাবধান করে দিল— আসছে৷ কয়েক মিনিট পরেই এসে হাজির— এক প্রকাণ্ড বাঘ, যেন একটা লাল ঘোড়া৷ মহিষটাকে গার্ডরা টেনে পাঁচ-সাত ফুট সরিয়ে রেখেছিল, বাঘটা তা লক্ষ্য করে সোজা মহিষটার কাছে না এসে, একটু দূরে বসে রইল, আর চারদিকে দেখতে লাগল৷ কয়েক মিনিট দেখে, উঠে সটান গিয়ে মোষটার ওপর হামা দিয়ে বসল— পিছনের দু-পা মাটিতে, সামনের দু-পা আর বুক মোষটার উপর৷ আবার চারদিক দেখে নিয়ে, খেতে আরম্ভ করল৷

বাঘটা যখন খাওয়ায় মত্ত, তখন একজন গার্ড আঙুল দিয়ে শিকারির পায়ে চাপ দিল৷ দু-এক মিনিট অপেক্ষা করেও বন্দুকের আওয়াজ হল না দেখে, আবার আঙুলের চাপ দিল, এবারেও কোনো ফল হল না৷ ভাইপো বন্দুক ছুঁড়লেন না৷

ব্যাপার কী? ব্যাপার গুরুতর! ভাইপোর চোখ কপালে উঠেছে, দাঁত-কপাটি লেগেছে, হাত-পা আড়ষ্ট হয়ে গেছে! ব্যাপার দেখেই গার্ডরা বুঝতে পারল যে তাঁকে দিয়ে এই বাঘ শিকার হবে না৷ আবার ভাবল— এমন সুযোগ চলে যাবে৷ তাদের মধ্যে একজন শিকারে বেশ অভ্যস্ত ছিল, সে ধীরে-ধীরে ভাইপোর হাত থেকে রাইফেলটি তুলে নিতে গেল৷ আর যায় কোথায়? গোঁ-গোঁ-গোঁ করে, ঘুমের মধ্যে বোবায় ধরলে লোকের যেমন অবস্থা হয়, ভাইপো তাকে একেবারে জড়িয়ে ধরলেন৷

গোলমালে বাঘের খাওয়া বন্ধ হল আর উপরের দিকে মুখ তুলেই শিকারিদের দেখতে পেয়ে বিকট গর্জন করে, এক লাফ দিয়ে দশ-বারো ফুট দূরে পড়ল৷

ফরেস্ট গার্ডরা বলল, ‘বাবু, দুবার বন্দুকের আওয়াজ করুন, হাতি আসুক, বাড়ি ফিরে যাই৷ আজ আর বাঘ আসবে না৷’

বাবুর মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হয় না, খালি ওই মুখ চাপা গোঁ-গোঁ শব্দ৷ বন্দুক বা ওদেরও ছাড়ে না, পাছে বন্দুকের আওয়াজ করে৷ বন্দুক ছোঁড়াও হল না, হাতিও এল না৷ সমস্ত রাত ওই মাচায় কাটাতে হল৷

এদিকে বাংলোর সকলেই বড়ো ব্যস্ত হয়ে উঠলেন৷ ব্যাপার কী? ভোর হতে চলেছে, অথচ এখনও বন্দুকের আওয়াজ হল না৷ নানা চিন্তা করে নিজেরাই হাতিতে চড়ে খোঁজ করতে গেলেন৷ হাতি যখন গাছতলায় পৌঁছল, তখনও বাবু মাচা থেকে নামতে চান না, ‘কী জানি, হতভাগা বাঘ হয়তো আবার কোনো ঝোপের মধ্যে বসে রয়েছে৷’

সকলে ধরাধরি করে তাকে মাচা থেকে একেবারে হাতির পিঠে নামিয়ে নিল৷ বাংলোয় পৌঁছে তাঁর যা দুরবস্থা দেখা গেল, তা বলা যায় না৷ দুর্গন্ধে কাছে যাওয়া মুশকিল! বাঘের গর্জনের সঙ্গে-সঙ্গে এই বীভৎস কাণ্ড হয়েছে!

রায়বাহাদুরের কাছে এই গল্প শুনে মনে হয়েছিল লোকটি কী ভীতু! কিন্তু পরে অনেকবার বাঘের বিকট গর্জন শুনে মনে হয়েছে যে, ওরকম হওয়াটা নেহাত আশ্চর্যের বিষয় নয়৷

দেরাদুনে প্রায় এক বছর ছিলাম, তারপর আমার উপর ব্রহ্মদেশে শান স্টেটে যাবার হুকুম হল৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *